এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কর্পোরেটরাজ  

    Jhuma Samadder লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ অক্টোবর ২০২০ | ১০৪১ বার পঠিত
  • ধ্যার মশয়, ও সব কৃষিবিল-টিল নিয়ে আর হ্যাজাতে পারছি না। এদিকে বলে লকডাউনের জ্বালায় প্রাণ ছটফটাচ্ছে… তালে আছি, টুক করে কীভাবে একটা 'ছোটো বাইরে' মেরে আসব...


    কৃষি বিল নিয়ে বলারই বা কী আছে? আরে ভাই, বাজারকেও তো স্মার্ট হতে হবে, নাকি? চিরকালই কি সরকারী বাজারে মাল বিক্রি হবে?


    হতভাগাগুলোর দাবী, আরও মন্ডি বানাও, এমএসপি বাড়াও, এমএসপি লিগালাইজ করো, কেবল সাতাশ'টা ফসল নয়, এসেনশিয়াল প্রোডাক্টসের সংখ্যা বাড়াও...বায়নার কি আর শেষ আছে? তাদের ভালোর জন্য সরকার কত ভালো ভালো আইন করলো, সেসব নাকি তাদের চাই না।


    চিরকাল যেন তারা এপিএমসি'র কোলের উপর বসে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে চাইলেই পেয়ে যাবে। এমএসপি দিয়ে দাম সিকিওরড্ রাখবে। চাষীরা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস না পেলেই অমনি নালিশ জানাতে হলেই আদালতে ছুটতে পারবে। ইল্লি আর কি! একটু কর্পোরেট সেক্টরের আকচাআকচিও প্রত্যক্ষ করো, কাকা। আইটির ভাইটি'রা কেমন সুখে আছে, দেখো।


    গাড়িটা নিয়ে হাইওয়ে ধরে 'এই পথ যদি না শেষ হয়'- এর সুরে শিষ দিতে দিতে এইসময়ে চারপাশটা দেখতে হেব্বি লাগে কিন্তু, বস। যেদিকে তাকাও, সবুজ ধানের ক্ষেত, হাওয়ায় দোল খেতে থাকে...আঃ! অপূর্ব! 


    লোকজন এমন চিল্লাচিল্লি জুড়েছে, যেন আগে চাষীরা সব রাজার হালে ছিল। আরে বাবা, এদেশে দুই হেক্টরের বেশী জমি আছে মাত্র ১৩.২% চাষীর। এক হেক্টর জমি থাকা চাষীর বছরের আয় এক লাখ টাকা। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হাতে থাকে হাজার পঁচিশেক। সেটি তাদের সম্বচ্ছরের আয়। কমই-বা কী এমন? তার জন্য তোদের আহ্লাদ করে আত্মহত্যা করতে হবে? বেশী বাড়াবাড়ি...  


    আরে,  তোরা বলদ নিয়ে কাদামাঠে চাষ করছিস, দেখতেও তো কত ভালো লাগে! এই সময়ে তোরা হাল-বলদ নিয়ে মাঠে নেমে পড়লে, আমার নতুন এসএলআর'টা ইনোগারেট করার একটা ফার্স্টক্লাস সাবজেক্ট পেয়ে যাব। পাবলিকে আবার এসব ভিলেজ নেচারের ছবি-টবি ভালো খায়। 


    আরে বাবা, মাথা খারাপ করার কী আছে? এমনিতেই  'শান্তাকুমার কমিটি'র রিপোর্টে তো বলাই আছে, এতোকাল দেশের মাত্র ছয় পার্সেন্ট চাষীরাই এমএসপি নিয়ে ফসল বেচতে পারতো।  চুরানব্বই পার্সেন্ট চাষী তো আগেও বাইরের বাজারেই ফসল বেচত, খুড়ো। 


    হ্যাঁ, সে বাজার হয়তো খুব ভালো  নয়। তোরা শেষমেশ আত্মহত্যাই যখন করে বসছিস...


    তা হবেই বা কী করে? একই সঙ্গে যদি গুচ্ছের ফসল বাজারে চলে আসে, খোলা বাজারের কর্পোরেট ক্রেতারা কেমন করে বেশী দামে তা কিনবে? যথেচ্ছ মজুত করে রাখতে পারলেই তারা যথাসম্ভব কম দামে কিনতে চাইবেই। আর সরকার বাহাদুর তো মজুত করার দেদার ছাড়পত্র দিয়েই রেখেছেন। 


    নতুন আইনে তো ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজের ওপর থেকে 'নিত্য প্রয়োজনীয়' জিনিসের ছাপ্পা তুলে দেওয়া হয়েছে। বড় কারবারিরা এবার যত খুশী খাবার-দাবার মজুত করতে পারবে। ব্ল্যাক মার্কেটিংয়ের হদ্দমুদ্দ করে ছাড়বেই তো তারা।


    তা কি আর করা যাবে? কর্পোরেটরাও তো ব্যবসা করতেই বসেছে, কর্তা। খয়রাতি করতে তো আর বসে নি। 


    এদেশে চাষী হয়ে জন্মে তো আর রাজার হালে থাকা আশা করতে পারে না মানুষ। রাজাতে আর চাষীতে কোনো পার্থক্যই থাকবে না, এটা হয়? 


    পথঘাট নেই, ফসল নিয়ে মন্ডিতে যাওয়ার টাকা নেই... হাজার একটা বাহানা করে অপোগন্ডগুলো এমএসপি'তে ফসল বেচতে পেতই না। 


    এদেশে নাকি পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে একটা করে মন্ডি ধরলে,  মোট বিয়াল্লিশ হাজার মন্ডি চাই। আছে মাত্র সাতহাজার মন্ডি। 


    এতো মন্ডি তৈরি, রাস্তাঘাট বানানো,এমএসপি নিয়ে নিত্যকার বাহানা...সরকারের খরচের বহর'টা একবার চিন্তা করেছে চাষাভুষোগুলো? সমস্ত ঝামেলা একেবারে চুকিয়ে দিতে চাইছে সরকার, মন্দটা কী এমন? "বেসরকারি কোম্পানি যা ভালো বোঝে, করুগ্গে যাগ"...বলে হাত ধুয়ে ফেলে সরকার সেন্ট্রাল ভিসটা প্রোজেক্টে মন দিতে চাইছে এইবার।


    আবার কতগুলো হাঁদালোক চিল্লাতে লেগেছে, "অন্য সমস্ত জিনিসের দাম বিক্রেতা ঠিক করে, ফসলের দাম কেন ক্রেতা ঠিক করবে?"


    আরে বাপু, গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল, শাড়ি'র দাম তো আর প্রোডাকশনের উপর ডিপেন্ড করে না। এক মাস গাড়ির বিক্রি কমে গেলে, পরের মাসে গাড়ির প্রোডাকশন কমিয়ে ফেলা যায়। আলু একবার লাগিয়ে ফেললে, তার প্রোডাকশন কি চাষীর হাতে? কুইন্টাল কুইন্টাল আলু ফলে গেলে, প্রোডাকশন বেড়ে গেলে, দাম তো পড়বেই বাপ। চাষী তখন ক্যামনে দাম ঠিক করবে, মেজোমামা?


    সেই বেঙ্গল ফেমিনের সময় থেকে শিক্ষা নিয়েই, গ্রিন রেভোলিউশনের উদ্বৃত্ত ফসল জমিয়ে রাখার জন্য সরকার ১৯৬৫ সালে মন্ডি তৈরি করেছিল। নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করলে তো ফসলের পরিমান বাড়বেই। ফলে দাম পড়তে বাধ্য। তাদের তো আর জমিয়ে রাখার উপায় নেই। তাই না সরকারের মিনিয়াম সাপোর্ট প্রাইস চালু হয়েছিল? তাবলে আজও চাষীরা সেকথা ধরে বসে থাকবে? এগুলো কি ঠিক? 


    এদিকে এই যে 'লেবার ল'টাও তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন তো আর 'মিনিয়াম ওয়েজ'  বলেও কিছু নেই।  যদি বেসরকারি কোম্পানিগুলো চাষীকে বলে বসে, "দাম পাচ্ছিস না? বেশ। আমি তোকে লোন দিচ্ছি। চাষ কর। পরের বার যা ফসল হবে, সব আমার। তোর লোন মাফ করে দেব'খন।" ভুলটা কোথায়? আমরাও তো কাকা বন্ডেড লেবারই, চাষীরও হলো...কি আর এমন এসে গেল?


    না হয়, চাষী এবার থেকে বিনি মাইনের শ্রমিক হয়ে যাবে,  কী হোলোটা কি তাতে? 


    চাষাভুষোরা কোমর বেঁকিয়ে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সারাদিন খাটবে, এ আবার নতুন কি? এই-ই তো চিরকাল হয়ে আসছে। এতো চিল্লামিল্লির কি আছে? খাটনি ওদের রক্তে। মাটির গন্ধ ছাড়া ওরা বাঁচবে? চাষ তো ওরা করবেই। 


     আরে বাবা, কর্পোরেটরা কি অমনিই সরকারকে বিল পাস করানোর জন্য চাপ দিয়েছে?


    জিওমার্ট কি বোঝে নি, আগামী কয়েক বছর লকডাউনের আফটার এফেক্ট হিসাবে খাবার-দাবার ছাড়া অন্য জিনিস বেশী বিক্রি হবে না? ছোটোখাটো পাড়ার দোকানগুলো কম্পিটিশনে টিঁকে উঠতে পারবে না। তাই না তারা 'নিত্য প্রয়োজনীয়' জিনিসে বেশী বেশী ইনভেস্ট করছে। 


    শোনো বাপু, আসল কথাটা হোলো, আমরা এখন আর কোনো 'দেশে' বাস করি না, বুঝলে? কোনো সরকারও আমাদের রিপ্রেজেনটেটিভ নয় আর। আমরা এখন একটা 'কর্পোরেট বিশ্বে' বাস করি। এক একজন কর্পোরেট এক একজন দেশের রাজা। আমরা 'আম সাবস্ক্রাইবার'রা সেসব দেশের প্রজা। ফালতু সরকারের বিরুদ্ধে চিল্লিয়ে লাভ আছে? সরকার এখন নেহাতই 'দাবার বোড়ে'। 


    লোকজনেরও কোনো কাজ নেই, যত্ত ফালতু ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানো।  মাঝখান থেকে রিয়া চক্রবর্তী...করণ জোহর... দীপিকা পাড়ুকোন...সলমন খান... কত ইন্টারেস্টিং সাবজেক্টস...ইচ্ছে করে... এসব সাংঘাতিক খবর থেকে ধ্যান হঠানোর জন্যই এসব বেকার ঝামেলা নিয়ে চিল্লাচিল্লি। মাঝখান থেকে আমার 'ছোটো বাইরে'র মুডটাই গেল চটকে।

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 103.195.***.*** | ০৮ অক্টোবর ২০২০ ১৩:১৭98179
  • একটা কথা ঠিক। একটা ছোট বাইরে কিভাবে মেরে আসা যায় সেই প্ল্যান আমিও কষছি। কৃষি বিল টিল নিয়ে কোন বক্তব্য নেই। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন