ধ্যার মশয়, ও সব কৃষিবিল-টিল নিয়ে আর হ্যাজাতে পারছি না। এদিকে বলে লকডাউনের জ্বালায় প্রাণ ছটফটাচ্ছে… তালে আছি, টুক করে কীভাবে একটা 'ছোটো বাইরে' মেরে আসব...
কৃষি বিল নিয়ে বলারই বা কী আছে? আরে ভাই, বাজারকেও তো স্মার্ট হতে হবে, নাকি? চিরকালই কি সরকারী বাজারে মাল বিক্রি হবে?
হতভাগাগুলোর দাবী, আরও মন্ডি বানাও, এমএসপি বাড়াও, এমএসপি লিগালাইজ করো, কেবল সাতাশ'টা ফসল নয়, এসেনশিয়াল প্রোডাক্টসের সংখ্যা বাড়াও...বায়নার কি আর শেষ আছে? তাদের ভালোর জন্য সরকার কত ভালো ভালো আইন করলো, সেসব নাকি তাদের চাই না।
চিরকাল যেন তারা এপিএমসি'র কোলের উপর বসে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে চাইলেই পেয়ে যাবে। এমএসপি দিয়ে দাম সিকিওরড্ রাখবে। চাষীরা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস না পেলেই অমনি নালিশ জানাতে হলেই আদালতে ছুটতে পারবে। ইল্লি আর কি! একটু কর্পোরেট সেক্টরের আকচাআকচিও প্রত্যক্ষ করো, কাকা। আইটির ভাইটি'রা কেমন সুখে আছে, দেখো।
গাড়িটা নিয়ে হাইওয়ে ধরে 'এই পথ যদি না শেষ হয়'- এর সুরে শিষ দিতে দিতে এইসময়ে চারপাশটা দেখতে হেব্বি লাগে কিন্তু, বস। যেদিকে তাকাও, সবুজ ধানের ক্ষেত, হাওয়ায় দোল খেতে থাকে...আঃ! অপূর্ব!
লোকজন এমন চিল্লাচিল্লি জুড়েছে, যেন আগে চাষীরা সব রাজার হালে ছিল। আরে বাবা, এদেশে দুই হেক্টরের বেশী জমি আছে মাত্র ১৩.২% চাষীর। এক হেক্টর জমি থাকা চাষীর বছরের আয় এক লাখ টাকা। খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হাতে থাকে হাজার পঁচিশেক। সেটি তাদের সম্বচ্ছরের আয়। কমই-বা কী এমন? তার জন্য তোদের আহ্লাদ করে আত্মহত্যা করতে হবে? বেশী বাড়াবাড়ি...
আরে, তোরা বলদ নিয়ে কাদামাঠে চাষ করছিস, দেখতেও তো কত ভালো লাগে! এই সময়ে তোরা হাল-বলদ নিয়ে মাঠে নেমে পড়লে, আমার নতুন এসএলআর'টা ইনোগারেট করার একটা ফার্স্টক্লাস সাবজেক্ট পেয়ে যাব। পাবলিকে আবার এসব ভিলেজ নেচারের ছবি-টবি ভালো খায়।
আরে বাবা, মাথা খারাপ করার কী আছে? এমনিতেই 'শান্তাকুমার কমিটি'র রিপোর্টে তো বলাই আছে, এতোকাল দেশের মাত্র ছয় পার্সেন্ট চাষীরাই এমএসপি নিয়ে ফসল বেচতে পারতো। চুরানব্বই পার্সেন্ট চাষী তো আগেও বাইরের বাজারেই ফসল বেচত, খুড়ো।
হ্যাঁ, সে বাজার হয়তো খুব ভালো নয়। তোরা শেষমেশ আত্মহত্যাই যখন করে বসছিস...
তা হবেই বা কী করে? একই সঙ্গে যদি গুচ্ছের ফসল বাজারে চলে আসে, খোলা বাজারের কর্পোরেট ক্রেতারা কেমন করে বেশী দামে তা কিনবে? যথেচ্ছ মজুত করে রাখতে পারলেই তারা যথাসম্ভব কম দামে কিনতে চাইবেই। আর সরকার বাহাদুর তো মজুত করার দেদার ছাড়পত্র দিয়েই রেখেছেন।
নতুন আইনে তো ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজের ওপর থেকে 'নিত্য প্রয়োজনীয়' জিনিসের ছাপ্পা তুলে দেওয়া হয়েছে। বড় কারবারিরা এবার যত খুশী খাবার-দাবার মজুত করতে পারবে। ব্ল্যাক মার্কেটিংয়ের হদ্দমুদ্দ করে ছাড়বেই তো তারা।
তা কি আর করা যাবে? কর্পোরেটরাও তো ব্যবসা করতেই বসেছে, কর্তা। খয়রাতি করতে তো আর বসে নি।
এদেশে চাষী হয়ে জন্মে তো আর রাজার হালে থাকা আশা করতে পারে না মানুষ। রাজাতে আর চাষীতে কোনো পার্থক্যই থাকবে না, এটা হয়?
পথঘাট নেই, ফসল নিয়ে মন্ডিতে যাওয়ার টাকা নেই... হাজার একটা বাহানা করে অপোগন্ডগুলো এমএসপি'তে ফসল বেচতে পেতই না।
এদেশে নাকি পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে একটা করে মন্ডি ধরলে, মোট বিয়াল্লিশ হাজার মন্ডি চাই। আছে মাত্র সাতহাজার মন্ডি।
এতো মন্ডি তৈরি, রাস্তাঘাট বানানো,এমএসপি নিয়ে নিত্যকার বাহানা...সরকারের খরচের বহর'টা একবার চিন্তা করেছে চাষাভুষোগুলো? সমস্ত ঝামেলা একেবারে চুকিয়ে দিতে চাইছে সরকার, মন্দটা কী এমন? "বেসরকারি কোম্পানি যা ভালো বোঝে, করুগ্গে যাগ"...বলে হাত ধুয়ে ফেলে সরকার সেন্ট্রাল ভিসটা প্রোজেক্টে মন দিতে চাইছে এইবার।
আবার কতগুলো হাঁদালোক চিল্লাতে লেগেছে, "অন্য সমস্ত জিনিসের দাম বিক্রেতা ঠিক করে, ফসলের দাম কেন ক্রেতা ঠিক করবে?"
আরে বাপু, গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল, শাড়ি'র দাম তো আর প্রোডাকশনের উপর ডিপেন্ড করে না। এক মাস গাড়ির বিক্রি কমে গেলে, পরের মাসে গাড়ির প্রোডাকশন কমিয়ে ফেলা যায়। আলু একবার লাগিয়ে ফেললে, তার প্রোডাকশন কি চাষীর হাতে? কুইন্টাল কুইন্টাল আলু ফলে গেলে, প্রোডাকশন বেড়ে গেলে, দাম তো পড়বেই বাপ। চাষী তখন ক্যামনে দাম ঠিক করবে, মেজোমামা?
সেই বেঙ্গল ফেমিনের সময় থেকে শিক্ষা নিয়েই, গ্রিন রেভোলিউশনের উদ্বৃত্ত ফসল জমিয়ে রাখার জন্য সরকার ১৯৬৫ সালে মন্ডি তৈরি করেছিল। নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করলে তো ফসলের পরিমান বাড়বেই। ফলে দাম পড়তে বাধ্য। তাদের তো আর জমিয়ে রাখার উপায় নেই। তাই না সরকারের মিনিয়াম সাপোর্ট প্রাইস চালু হয়েছিল? তাবলে আজও চাষীরা সেকথা ধরে বসে থাকবে? এগুলো কি ঠিক?
এদিকে এই যে 'লেবার ল'টাও তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন তো আর 'মিনিয়াম ওয়েজ' বলেও কিছু নেই। যদি বেসরকারি কোম্পানিগুলো চাষীকে বলে বসে, "দাম পাচ্ছিস না? বেশ। আমি তোকে লোন দিচ্ছি। চাষ কর। পরের বার যা ফসল হবে, সব আমার। তোর লোন মাফ করে দেব'খন।" ভুলটা কোথায়? আমরাও তো কাকা বন্ডেড লেবারই, চাষীরও হলো...কি আর এমন এসে গেল?
না হয়, চাষী এবার থেকে বিনি মাইনের শ্রমিক হয়ে যাবে, কী হোলোটা কি তাতে?
চাষাভুষোরা কোমর বেঁকিয়ে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সারাদিন খাটবে, এ আবার নতুন কি? এই-ই তো চিরকাল হয়ে আসছে। এতো চিল্লামিল্লির কি আছে? খাটনি ওদের রক্তে। মাটির গন্ধ ছাড়া ওরা বাঁচবে? চাষ তো ওরা করবেই।
আরে বাবা, কর্পোরেটরা কি অমনিই সরকারকে বিল পাস করানোর জন্য চাপ দিয়েছে?
জিওমার্ট কি বোঝে নি, আগামী কয়েক বছর লকডাউনের আফটার এফেক্ট হিসাবে খাবার-দাবার ছাড়া অন্য জিনিস বেশী বিক্রি হবে না? ছোটোখাটো পাড়ার দোকানগুলো কম্পিটিশনে টিঁকে উঠতে পারবে না। তাই না তারা 'নিত্য প্রয়োজনীয়' জিনিসে বেশী বেশী ইনভেস্ট করছে।
শোনো বাপু, আসল কথাটা হোলো, আমরা এখন আর কোনো 'দেশে' বাস করি না, বুঝলে? কোনো সরকারও আমাদের রিপ্রেজেনটেটিভ নয় আর। আমরা এখন একটা 'কর্পোরেট বিশ্বে' বাস করি। এক একজন কর্পোরেট এক একজন দেশের রাজা। আমরা 'আম সাবস্ক্রাইবার'রা সেসব দেশের প্রজা। ফালতু সরকারের বিরুদ্ধে চিল্লিয়ে লাভ আছে? সরকার এখন নেহাতই 'দাবার বোড়ে'।
লোকজনেরও কোনো কাজ নেই, যত্ত ফালতু ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানো। মাঝখান থেকে রিয়া চক্রবর্তী...করণ জোহর... দীপিকা পাড়ুকোন...সলমন খান... কত ইন্টারেস্টিং সাবজেক্টস...ইচ্ছে করে... এসব সাংঘাতিক খবর থেকে ধ্যান হঠানোর জন্যই এসব বেকার ঝামেলা নিয়ে চিল্লাচিল্লি। মাঝখান থেকে আমার 'ছোটো বাইরে'র মুডটাই গেল চটকে।
একটা কথা ঠিক। একটা ছোট বাইরে কিভাবে মেরে আসা যায় সেই প্ল্যান আমিও কষছি। কৃষি বিল টিল নিয়ে কোন বক্তব্য নেই।