এই যে মতামত।
Test.
যে জীবন ফড়িঙের
চিন্ময় রায়
সপ্তর্ষি প্রকাশন
মূল্য: ২৫০ টাকা
যে জীবনস্মৃতির নামকরণ ভীষণ ভাবেই জীবনানন্দ ঢঙে লিরিকাল, সেই 'ফড়িং' জীবনের শুরুই হয়েছিল জীবনানন্দের মতোই ওপার বাংলায়। দাদুর হাত ধরে কুমিল্লা থেকে ভবানীপুর আসেন শান্তি দত্তরায়। 'দত্তরায়' হয়ে যায় 'রায়' আর শান্তি? বলাই বাহুল্য, যে ফড়িং জীবনের কয়েকটা পাতা দু'মলাটের মাঝে পড়ার সুযোগ হয়ে আজকের এই আলোচনার অবতারণা, সেই আলোচনার নায়ক, শান্তি থেকে চিন্ময়। নিজের আত্মজীবনীকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন ছ'টি পর্বে।
প্রথম পর্বে তিনি লিখছেন,
|| "বরাহনগরে এসেও লোকাল ফুটবল টিমে রাইট আউট খেলতাম। তবে ভালো খেললেও বাহবার সঙ্গে মাঝেমাঝে তিরস্কারও জুটত। এই তিরস্কার 'বাঙাল' হওয়ার কারণে।
'বাঙালগুলো এয়েচে' - এই বলে পাড়ায় একটা দল আমাকে মেরেছিল যখন, খুব কান্না পেয়েছিল। এইসময় আমায় সামলালেন ঠাকুমা। তেজের সঙ্গে আমায় বলেছিলেন, "আমাগো বাড়ির পোলায় কখনও কাইন্দ্যা বাড়ি ফেরে নাই - অগো মাইরা যেদিন বাড়ি ফিরবি, আমি খুশি হইব" - তখন আমি বেশ স্বাস্থ্যবান।... তারপর সময় সুযোগ বুঝে সেই 'ঘটি'-র দলটাকে বেশ করে পিটিয়ে ঠাকুমার হাতে তৈরি নাড়ু খেয়েছিলাম।" ||
দাদু মারা যাবার পর পরিবারসহ তারা চলে আসেন বরাহনগরে। খেলাধুলা আর যাত্রাপাগল, পড়াশোনায় অমনোযোগী, বাড়ির ছোটছেলে তার ঠাকুমা ও মাকে আঁকড়ে ধরে বড় হতে থাকে। ঠাকুমা আর স্কুলজীবনের টুকরো টুকরো রঙিন স্মৃতি নিয়েই ফড়িং-জীবনীর প্রথম পর্ব।
দ্বিতীয় পর্বে আছে ফড়িং-এর কলেজের চৌকাঠে পদার্পণ এবং সেখান থেকেই নাট্যজগতের সাথে জড়িয়ে পড়া। হঠাৎ 'জিওর্ডিওসিস' রোগে আক্রান্ত হন চিন্ময় রায়, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। কিন্তু একইসময়ে পরিচয় হয় বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে, সারাজীবন যাঁকে চিন্ময় রায় দ্রোণাচার্য মেনে এসেছেন। আত্মজীবনীতে উঠেও এসেছে এই পর্বে নান্দীকার, তার ভাঙন ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর নানা উপলব্ধি।
|| ".... তো আস্তে আস্তে আমাদের দল তৈরি হতে আরম্ভ হল। কেয়া চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মায়া ঘোষ— তৈরি হল নান্দীকার। ভারতের সেরা দলগুলোর মধ্যে অন্যতম। দলের নাটক প্রথম স্টেজ করার উত্তেজনা যে কী! অজিতেশদা লিখতে শুরু করলেন নাটক। 'সেতুবন্ধ' লেখা হল। অসামান্য নাটক। আমার খুব ছোটো রোল ছিল। মাতালের চরিত্র। অজিতেশদার কথামতো রাস্তাঘাটে মাতালদের স্টাডি করতাম। দেখতাম, কথা বলার ভঙ্গি হাঁটাচলা। প্রাণবন্ত অভিনয় করতে হবে তো। প্রথম শো ছিল নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। ওপেন এয়ার তখন। নাকের তলায় স্পিরিট গামের গন্ধের পর প্রথম পেশাদারি মঞ্চাভিনয়ের অভিজ্ঞতা অনেকটা ঘোরের মতো। সব যেন গুলিয়ে গেল। শুধু মনে আছে, শো শেষে দর্শকাসনে উপস্থিত তখনকার বিখ্যাত অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, "ভায়া অসামান্য প্রতিভা তোমার। তেমনই তোমার দলের অভিনয়। দলটাকে মজবুত করে ধরে রেখো সবাই মিলে— দল পরে নাম করবে। তুমিও।"
সেদিন বাড়ি এসে ঠাকুমাকে প্রণাম করে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। আমি জানি, আমার চিরবঞ্চিতা মা-ও সেদিন চোখের জল ফেলেছিলেন। 'সেতুবন্ধ' - কে আমরা বলতাম নান্দীকার আর আমাদের সাফল্যের সিঁড়ি, মানে সেই আমাদের শুরু। পরবর্তী নাটক 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' । চেখভের 'চেরি অর্চারড' নাটকের বাংলা অনুবাদ করলেন অজিতেশদা। নাহ! অনুবাদ বলব না— সারটুকু নিলেন মাত্র। বাকিটা আপন খেয়ালে, আপন প্রতিভায় সাজালেন। 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' পড়ে মনেই হল না কোনও বিদেশি অনুপ্রেরণা আছে। বাংলার গন্ধে ভরপুর এই নাটক। বীরভূমের পটভূমিকায় লেখা হয়। জমিদারি প্রথার শেষ লগ্নের সময় সাধারণ কৃষকের যন্ত্রণা প্রত্যেক সংলাপ, দৃশ্যায়নে অদ্ভুত ভাবে ফুটে উঠেছিল। সত্যিই মনে হচ্ছিল একটা মৌলিক নাটক। প্রথম দিন শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে ভাবছিলাম, আমি এ দলের সদস্য— আমি অজিতেশদার স্নেহধন্য। যাই হোক, জোর কদমে মহলা শুরু হল। আমার মনে মহিলাপ্রীতি কমে বেশ একটা ভীতি জন্মেছে। আমার রোগা চেহারার প্রতি তো আর মহিলারা কৃপাদৃষ্টি দিতেন না। অভিনয়ে তা পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। তবে মহলার সময় মজা হত বেশ। অজিতেশদা চেহারার সঙ্গে মানানসই গম্ভীর। একদিন খেপাবার জন্য সকলে মিলে বললাম " অজিতেশদা, নাটকের নাম 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' না করে বোল, আমের বোল— করলে কেমন হয়? " অজিতেশদা মজাটা না বুঝে গম্ভীরভাবে বললেন, "না না, কোনও কাব্যরসবোধ নেই দেখছি আপনাদের।" মহিলাদের ফিগার বর্ণনা করতে গিয়ে ক্যাম্পা-কোলার বোতলের তুলনা আনায় আরও ক্ষেপে গিয়েছিলেন। তবে বড়ো আপনভোলা ছিলেন। চা আর লেড়ো বিস্কুট খেয়ে মহলা দিতাম, খিদে-তেষ্টা ভুলে। সেই সময় থেকেই পেতে সামান্য ব্যথা ও জ্বালা অনুভব করতাম। তখন অবজ্ঞা করার ফল ভোগ করেছিলাম পরে। পার্ট মুখস্থ করার জন্য বাড়িতেও ঘুরে ঘুরে জোরে জোরে পড়তাম। মুখস্থ হলে নিজের মনে অভিনয়টাকে আনতাম—মডিউলেশান দিতাম সংলাপ বলতে বলতে। 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' প্রথম শো হল মুক্তাঙ্গনে। হল হাততালিতে ফেটে পড়েছিল।
কেয়ার অসামান্য অভিনয়। অজিতেশদার ডিরেকশন আর সংলাপের যুগলবন্দি মানুষকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করেছিল। এ নাটকের একের পর এক শো চলতে লাগল - হাউসফুল শো। সত্তর নাইট শো চলে। মায়া ঘোষ, বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে এই অধমও কাজ করার সুযোগ পায়। মুক্তাঙ্গনে শো চলাকালীনই একদিন দেখতে এলেন পরিচালক তপন সিনহা, সত্যজিৎ রায় এবং হিরো নির্মল কুমার। শো শেষে তপনদা তার সহকারী পলাশকে (তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো) দিয়ে আমায় ডাকলেন। 'গল্প হলেও সত্যি' - র প্রথম অফার। যাই হোক সিনেমার কথা পরে আসুক। এ প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ, আমার জীবনে - 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' র গুরুত্ব।
এ নাটকের হাত ধরেই বাড়ির রোগা - ফেলটু ছেলেটা হিরো।" ||
‘নান্দীকার’এর প্রথম ভাঙনের সাক্ষী তিনি।
আত্মজীবনীতে লিখছেন,
|| “আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। এখন বুঝি সেটা বড় ভুল ছিল। আমরা ন’জন একদিনের একটা মিটিং ডেকে ‘নান্দীকার’ ছাড়লাম। অনেকগুলো কারণ আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ফাটল আনছিল।” ||
কী সেই কারণ? চিন্ময় জানিয়েছেন, মায়া ঘোষের সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা রিহার্সাল, ওঁর একনায়কতন্ত্র এ সব মিলিয়ে তাঁদের তখন ‘রক্ত গরম’। ফলে দল ছাড়েন তাঁরা।
|| “কারণ দেখালাম অজিতেশদার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক পার্থক্য। নাহ্! অনবদ্য সংলাপস্রষ্টা অজিতেশদা সেদিন কোনও কথা বলেননি। শুধু নীরবে বিদায় দিলেন। নান্দীকারে প্রথম ভাঙন। আমরা ১৯ জন অর্থাৎ বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অজয় গাঙ্গুলি, আমি আর বাকিরা মিলে গড়ে তুললাম থিয়েটার ওয়ার্কশপ।”
পরে কিন্তু অনুতাপ হয়েছে। চিন্ময় লিখেছেন কীভাবে সব সময় পুরনো দল আর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মিস’ করতেন। “মনে হত, নাহ্! এ ভাবে দলটা ছাড়া একদম ঠিক হয়নি। কারণ ব্যক্তিগত ঝামেলা ইগো, এই সব গণ্ডি ভেঙে যদি দলটার কথা ভেবে অজিতেশদার পাশে থাকতাম, তা হলে ‘নান্দীকার’ আজ ভারতের শ্রেষ্ঠ দল হত।” ||
|| "উত্তমদা প্রথম দিনই তুই বলে আপন করে নিলেন। বললেন, অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে মাঝে মাঝে হাতে তালি দিবি, ছোটদের মতো। বোবাদের একটা শিশুসুলভ সরলতা থাকে, জানিস তো। পাশ থেকে মানিকদা গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিকই বলেছে উত্তম।” ||
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের ভূমিকায় উত্তমকুমার। চাকর পানুর ভূমিকায় চিন্ময় রায়।
পরের পর্বগুলিতে অভিনেতা স্মৃতিরোমন্থন করেছেন তার রূপোলি পর্দার সোনালী দিনগুলির। তপন সিনহার হাত ধরে ১৯৬৬ তে 'গল্প হলেও সত্যি'র মাধ্যমে যে যাত্রা তিনি শুরু করেন, প্রায় ১৫০ টি ছবিতে অভিনয়ের পর তা শেষ হয়। 'গুগাবাবা', 'পদীপিসীর বর্মীবাক্স', 'বসন্ত বিলাপ', 'চারমূর্তি', 'সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা' তাঁর মুকুটের এক একটি উজ্জ্বল পালক। নান্দীকার ও থিয়েটার ওয়ার্কশপ ছেড়ে আসা চিন্ময় রায় সান্নিধ্যে আসতে থাকেন একের পর এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের। নজর কাড়েন এবং ভালোবাসাও পান দর্শকের এবং বিখ্যাত সহঅভিনেতা ও অভিনেত্রীদের। এই পর্বগুলিতে পাঠকের কাছে তিনি উপুড় করে দিয়েছেন তার স্মৃতির ঝুলি। তাঁর ঝাপসা হয়ে আসতে থাকা জীবনস্মৃতিতে উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, উৎপল দত্ত, তপন সিনহা, দীনেন গুপ্ত'রা যেমন এসেছেন, এসেছেন ছায়া দেবী, জয়া ভাদুড়ি থেকে শুরু করে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন'রা।
বৈজয়ন্তীমালাকে নিয়ে একটি মজার অভিজ্ঞতা, তিনি লিখছেন,
“হাটে বাজারে। বড় চরিত্র। কিন্তু সেখানেও হাফপ্যান্ট পরা হাসপাতালের বেয়ারা।...আমার জন্য একটা গান ছিল।...আগে আগে ননদি চলে পিছে ননদৈয়া...গানের সঙ্গে বৈজয়ন্তীমালার নাচের রিহার্সালও শুরু হল। ওহ্ কী আসাধারণ ফুটস্টেপিং। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম।”
রিহার্সালে বৈজয়ন্তীমালা নাকি একদিন বলেছিলেন, “হরবখত কেয়া দেখতে হো তুম?” চিন্ময়ের উত্তর ছিল, “আপনার নাচ। যে নাচে সঙ্গম-এ রাজ কপূরকে হারিয়েছিলেন।” এর পরেও সেই ‘হাঁ করা ভাবটা’ যায় না। তাই দেখে বৈজয়ন্তী বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, তুমি আরও কিছু বলবে।” চিন্ময় লিখছেন, “আমি আমতা আমতা করে বলে ফেলি, আপনার কোমরটা একটু টাচ করব? আপনাকে দেখলে মনে হয় অজন্তার মূর্তিগুলো প্রাণ পেয়েছে। হা হা করে হেসে বললেন, তোমাকে টাচ করতে হবে না, আমিই টাচ করিয়ে দেব।”
দৃশ্য গ্রহণের দিন। বৈজয়ন্তীমালা নাচতে লাগলেন। সঙ্গে চিন্ময়ের গলায় সেই গান। হঠাৎ ‘মেরি পিছে সাঁইয়া’য় এসে বৈজয়ন্তী চিন্ময়ের কোমরে বিশাল এক ধাক্কা মারলেন তাঁর কোমর দিয়ে। আবার নাচতে লাগলেন। “আমি হাঁ, কী সাংঘাতিক ব্যালান্স।...এর পরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেই লোকে জিগ্যেস করত, কী হল? আমি বলতাম, বৈজয়ন্তীমালা কোমরে ধাক্কা দিয়েছেন। সেই স্মৃতিটাকে ধরে রাখছি।” লিখেছেন চিন্ময়।
সারা জীবনের অসীম কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জ্ঞাপন করেছেন, বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের 'ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের' প্রতি।
|| 'ছবির জগতের সেরা তিন কমেডিয়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ আমার খুব কাছের হয়ে গেছিলেন। আমি আদতে ঢাকার ছেলে বলেই ভানুদা মাঝে মাঝে পিঠ চাপড়ে বলতেন, "বেকার পোলারা কখনও হারে না, মাঝে মাঝে বাসায় আইস, ইলিশ মাছ খাওয়াইমু।" ||
প্রিয় 'রবিদা' তাঁর জীবনের এক বটবৃক্ষের ন্যায় ছিলেন, ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছিলেন, সাহায্য করেছিলেন - স্মৃতিচারণের সময়ে বিভিন্ন পাতায় বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে তা উঠে এসেছে। চিন্ময় রায়ের এই আত্মজীবনী আদতেই সেই সময়ের নাট্য ও সিনেমা জগতের এক জীবন্ত ও উজ্জ্বল দলিল। স্মৃতিচারণ শুধু মজার নয়। বেদনারও। রয়েছে বিতর্কের ছোঁয়া। কোনও রাখঢাক না রেখে পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন তাঁকে ঘিরে অনেক বেসামাল সওয়ালেরও। এক সময় সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চিন্ময় রায়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কানাঘুষো উঠত সিনেমা পাড়ায়। তিনি খোলামেলা সেই প্রসঙ্গেও।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে নির্দ্বিধায় যেমন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর আসনে রেখেছেন, তেমনি তুলে ধরেছিলেন সাবিত্রী সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী কিছু ঘটনা ও মন্তব্য, সাবিত্রী যেন আদতেই রহস্যময়ী।
আত্মজীবনীতে তিনি প্রতিটি পাতায় ভীষণভাবে অকপট। কম বয়সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ায়, অর্থের জন্যে তিনি যে অভিনয় করতেন, বারবার তার উল্লেখ করেছেন। এই একই কারণে তাঁর প্রথম পছন্দ থিয়েটার যে ছাড়তে হয়েছিলো, জানিয়েছেন সেই কথা। আর জুঁইদেবীকে নিয়ে যেন তার এই স্মৃতিকথনে বরং তিনি বেশীই রক্ষণশীল, সযত্নে এড়িয়ে গেছেন তাঁর বৈবাহিক জীবন।
|| “বালিকা বধূ ছবিতে প্রথম দেখেছিলাম জুঁইকে। ননীগোপালের বিয়ে ছবিতে কাজ করার সময় প্রেম নিবেদন করি। আমার মতো চেহারার এক মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছিল। আমরা বিয়ে করলাম। সব কেমন হারিয়ে গেল সুখে চলতে চলতে। পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এর বেশি আর বলতে পারব না। জুঁই চলে যাওয়ার পর যে অবসাদ আমায় ঘিরে রেখেছে তা থেকে আমি বেরোতে চাই।” ||
সারাজীবন দাপিয়ে কাজ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই সেনসেশন - থিয়েটার, বেতার, যাত্রা, অভিনয়ের সকল মাধ্যম, সকল মঞ্চে ছিলেন সমান সাবলীল, শক্তিশালী। 'জিওর্ডিওসিস' এ আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেললেও হারিয়ে ফেলেননি সহজাত অভিনয় ক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাস। তাই হয়তো 'বসন্ত বিলাপ' এর জন্য চেয়ে নিয়েছিলেন নিজের জায়গা এবং পরিচালক বলায় নিজেই নিজের সেই আইকনিক কমেডি সিন লিখে ফেলেছিলেন, যার সেই ঐতিহাসিক ডায়লগ বাঙালী আজীবন মনে রাখবে।
"একবার বলো আমি উত্তমকুমার!"
যে ব্যক্তিত্ব স্ক্রিনের সামনে আসলেই হাসি ধরে রাখতে পারেনি বাঙালি, তিনিই ২০১৯ এর মার্চের, বসন্তের এক সকালে আপামর বাঙালিকে বিলাপে রেখেই চলে যান। চলে যান বাংলার স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাস্যকৌতূক অভিনেতা চিন্ময় রায়।
একনজরে তাঁর জীবনসফর 'চারমূর্তি ' ছবিতে একটা প্রকাণ্ড 'হাঁ' করে মাছের মাথা কামড়ানোর চেষ্টা.. কিংবা 'ধন্যিমেয়ে' ছবিতে আইনজীবী হয়েও তাঁকে উত্তম কুমার 'বেআইনী' বলে ডাকলেই এক অসামান্য অভিব্যক্তি নিয়ে সাড়া দেওয়া.. সব কিছুতেই চিন্ময় রায়ের জায়গায় আর কাউকে ভাবতে পারেনি বাঙালি। আর এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, এখানেই তিনি 'চিন্ময় রায়', এখানেই তিনি পটলডাঙ্গার এক ও একমাত্র সেলুলয়েডের সফল টেনিদা। আর এখানেই তাঁর আত্মজীবনীর সার্থকতা যা তিনি জীবিত অবস্থায় লিখে গেলেও শেষ লাইনটি ছিল,
"নাকের কাছে স্পিরিট গামের প্রিয় গন্ধটা নিয়ে আমি মরতে চাই!"
***বইয়ের শেষে অভিনেতার চলচ্চিত্রপঞ্জী ও নাট্যপঞ্জীর দীর্ঘ তালিকা জায়গা পেয়েছে, ঠিক সেরকমই বইটিতে জায়গা পেয়েছে বেশ কিছু সাদা কালো ফ্রেম।
শিল্পী দেবাশীষ দেবের অনবদ্য প্রচ্ছদ বইটির উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। প্রকাশনীকে অনুরোধ জানাবো বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদের দিকে তারা যেন বিশেষ যত্নশীল হন পরবর্তী সংস্করণে।
অলমিতি।