কথায় বলে 'মাছে ভাতে বাঙ্গালী।' বাংলার বাইরে বাঙালীর বদনাম 'মছলিখোর' বলে। হ্যাঁ, দিনে একবেলা মাছ-ভাত না খেলে গড়পড়তা বাঙালীর দিনটা ভালো যেতেই পারে না। নদীমাতৃক বাংলায় মাছের যোগান আজন্মকাল। তা সে মাছ ছোট বা বড় যাই হোক না কেন। ফলত রকমফের মাছের হরেক কিসিম পদ বাঙালীর খাদ্যতালিকায় বরাবর। আগে রসনাপ্রিয় বাঙালী বলত, 'লিখিব পড়িব রইব দুঃখে, মৎস মারিব খাইব সুখে।' কিন্তু আম বাঙালীর সে সুখের দিন গিয়েছে। উন্নয়নের স্রোতে বাংলায় নদী নালা খাল বিল তাদের স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে কালের নিয়মে। কালের নিয়মেই বদলেছে প্রাত্যহিক অভ্যেস। খাদ্যতালিকায় তার ছাপ পড়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। তবু বাঙালি আজও নিজের পুরোনো অভ্যেসকে জিইয়ে রেখেছে।
এই দুর্মূল্যের বাজারে বাঙালীর বাজারতালিকায় মাছ নিজের চিরকালীন জায়গা ধরে রেখেছে আজও। রোজদিনের টাটকা বাজারের অভ্যেস বদলে ফেলে সপ্তাহভরের বাজারের সঙ্গে সপ্তাহভরের মাছ এ যুগের বাঙালীর ফ্রীজে ভরা। বাড়ীর প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় বাঙালীর নতুন প্রজন্ম মৎস বিমুখ হলেও বাইরে হোটেল রেস্টুরেন্টে কিন্তু মাছের বিভিন্ন পদ তারা যথেষ্ট আয়েশ করেই আস্বাদন করে। আজও বাঙালী চায়ের কাপে তুফান তোলে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানে নিয়ে। তর্কে যেই জিতুক শেষ অবধি জিতে যায় সেই মাছ। চিংড়ি আর ইলিশের শতাব্দী প্রাচীন দ্বন্দ সত্ত্বেও মৎসকুলে ইলিশের আভিজাত্য ও কৌলীনতা সর্বজন স্বীকৃত।
সারা বছর বাঙালী শবরীর প্রতীক্ষায় থাকে কবে বর্ষা আসবে আর রূপোলি শষ্যে বাজার ভরে যাবে। জুন জুলাইতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সঙ্গে বাঙালীর মনের চঞ্চলতা আর উঁকি ঝুঁকি বাজারে। কবে ওপার বাংলার ইলিশ ঢুকবে আর কবে দাম পড়বে ইলিশের। এসময় এলাকায় ঘুরে বেড়ালেই এবাড়ী ওবাড়ীর হেঁশেল থেকে বাতাসে ভেসে আসে ইলিশের আমোদ করা গন্ধ। বারো মাসে তের পার্বণে মাতোয়ারা বাঙালী মেতে ওঠে ইলিশ পার্বণে। দেওয়ালি অবধি চলে ইলিশের মরসুম। জামাইষষ্ঠী থেকে ভাইফোঁটা, ঘরোয়া উৎসবে অনুষ্ঠানে গরিষ্ঠ সংখ্যক বাঙালী বাড়ীতেই ইলিশ প্ৰথম পছন্দ।
আজ এই অতি দুর্মূল্যের বাজারে বছরে একদিনের জন্য হলেও মহার্ঘ ইলিশ বাঙালীর পাতে শোভা পাবেই। শুধু মাত্র প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় নয়, ইলিশ স্থান করে নিয়েছে ঘরোয়া পুজোর নৈবেদ্য তালিকায়। নিজস্ব মরসুম ছাড়াও বহু বাঙালী পরিবারের সরস্বতী পুজোর ভোগে ইলিশ থাকবেই। তারা জোড়া ইলিশ অর্পণ করেন মায়ের চরণে। এপার বাংলার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রান্তিক মানুষ জনের কাছে অতি পরিচিত ঘরোয়া উৎসব 'রান্না পুজো'। এই প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষরা তাদের বাড়ীর নিমন্ত্রিতদের আপ্যায়ন করাতে ইলিশকেই বেছে নেয়। সাধ্যের মধ্যে একটা ছোট্ট ইলিশের আরো ছোট্ট ছোট্ট টুকরো তারা তুলে দেয় আমন্ত্রিতদের পাতে।
ঝালে ঝোলে অম্বলে বাঙালীর রসনাকে তৃপ্ত করতে ইলিশের জুড়ি মেলা ভার। মূলত সমুদ্রের মাছ হলেও প্রাক বর্ষায় ডিম পাড়ার জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ঢুকে পড়ে সমুদ্র মোহনা ও উপকূলবর্তী নদীগুলোতে। তারপর মৎসজীবীদের শিকার হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। বর্তমানে দেশীয় বাজার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা অন্য অনেক মাছের থেকে বেশী।
এছাড়াও এর পুষ্টিগুণ বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দূর করাতেও সক্ষম। বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে এর বিভিন্ন খনিজ উপাদান আমাদের শরীরের পক্ষে যথেষ্ট উপকারী। এই করোনা উদ্ভূত অতিমারীকালীন পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে ইলিশ করোনা প্রতিরোধেও সক্ষম। অতএব মছলিখোর বাঙালী ইলিশের ঐতিহ্যকে পরম্পরাগত ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। যতদিন বাঙালী বাঁচবে ততদিন ইলিশও থাকবে বাঙালীর পাতে। আহারে বসে বাঙালী ইলিশ দেখে উত্তেজিত হয়ে যেন চিরকাল বলতে পারে 'আহা-রে' ইলিশ।
★★★★★★★