এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিষ্ণু

    Jeet Bhattachariya লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৮০৩ বার পঠিত
  • -বাহ্ , কি সুন্দর ফুল এঁকেছিস তো। 


    বাচ্চা মেয়েটা একটা ছোট মিষ্টি হাসি হেসে বললো - এটা কি বলতো ?


    -কি?


    -গোলাপ ।  আর ওটা পারিজাত, ওটা পলাশ।  তার পাশে কাঞ্চন , আর ঐ যে, ঐ  ফুলটা দেখছো ওটা অপরাজিতা। 


    বিষ্ণু বাচ্চা মেয়েটার ফুলের জ্ঞান দেখে একটু অবাক হয়ে গেলো।  এতো ফুলের নাম সে নিজেও জানে না।  জানবেই বা কি করে , এখন যে আর ফুল ফোটেনা।  অন্তত এই কমাস তো তাই দেখছে।


    হঠাৎ করে আকাশটা  কেমন গমগম করে উঠলো।  বৃষ্টি আসার সম্ভবনা।  সে তাড়াতাড়ি একটু এগোবে ভাবছিলো।  কিন্তু বাতাসে এমন তীব্র গন্ধ যে তাড়াতাড়ি পথ চলার উপায় নেই।  একটু জোরে হাঁটলেই দম  বন্ধ হয়ে আসে। 


    -এই মেয়ে , বাড়ি যা।  এখানে দেওয়ালে আঁকলে হবে শুধু।  দেখ আবার বৃষ্টি আসছে। 


    মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে বলল - না আঁকলে যে সব শেষ হয়ে যাবে। 


    -কি শেষ হয়ে যাবে ? সব তো শেষের পথেই। 


    -না আমাকে বলেছে , আঁকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। 


    -কে বলেছে ?


    -তা জানিনা। 


    বিষ্ণু একটু হেসে বললো - কে বলেছে তা জানিস না।  তাহলে আঁকছিস কেন ? বাড়ি কোথায় তোর ?


    মেয়েটা একটু ভাবতে লাগলো। তারপর বলল - বাড়ি তো আমার ঝড়ে  উড়ে গেছে। 


    বিষ্ণুর একটু মনটা খারাপ হয়ে গেলো।  সত্যি , কি বীভৎস ঝড়টাই না ছিল।  কংক্রিট ছাড়া আর কিছুই টিকবেনা এই গোলযোগের সামনে ।  শেষ কবে যে কাউকে বাড়ি বানাতে দেখেছিল সেটাও তার খেয়াল নেই।  কি সময় এসেছে! আজ মাস কয়েক পরে সে কাউকে প্রথম দেখলো ।  হয়তো এই মেয়েটার মতো আরো কেউ আছে , কিন্তু তারাও  এখন বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনা ।  গাছপালাও  কোন কিছুই যেন নতুন করে গজায় না। 


    বিষ্ণু আর কিছু না ভেবে মেয়েটাকে বলল -চল আমার সঙ্গে।  ওই উল্টোদিকের স্কুল বাড়িটাতেই আমি আছি।  এখানে থাকলে যে মারা পড়বি। এই বৃষ্টি বড় ভয়ঙ্কর। একটু ঝরলে তোর মা বাবাকেও নিয়ে আসবো না হয়। 


    -মা বাবা তো নেই।  তারাও বাড়ির সাথে পাখির মতো উড়ে গেছে। 


    বিষ্ণু কি বলবে বুঝে উঠতে পারলোনা।  তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো হালকা হালকা।  চোখের জলেও কি এসিড থাকে ? জানেনা সেটা বিষ্ণু।  এখন সবকিছুই যেন নোনতা নোনতা লাগে।  


    -তোর নাম কি রে?


    -অহনা। 


    -যাবি  আমার সঙ্গে ঐ  বাড়িতে ?


    অহনা তার ছোট একটা ব্যাগে  রঙ পেন্সিলগুলো ভোরে নিলো। তারপর চললো বিষ্ণুর সাথে।  এইদিকে আকাশ তখন গর্জে উঠছে।  মাঝে মাঝেই এমন জোরে বাজে পড়ছে যে তাদের পায়ের তলা ক্রমশ কেঁপে উঠছে। কিন্তু  উপায় নেই , তাড়াতাড়ি হাঁটা  যে সম্ভব না। 


    বিষ্ণুর এবারে একটু ভয় ধরতে লাগলো।  সে পিছন ঘুরে দেখে যে দূরে ভাঙা পাঁচিলগুলো ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।  বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। 


    -অহনা , একটু তাড়াতাড়ি চল। 


    সামনেই সেই কংক্রিটের স্কুলবাড়ি।  আসে পাশে খালি ভাঙা পাঁচিল আর ক্ষয়ে যাওয়া পুরানো ঘর।  কোন এক সময় বিশাল বাজার ছিল এই জায়গায়।  স্কুলের সামনে কত লোকজন, কত বাজার বসত।  সারাক্ষন ঝকঝক করতো রাস্তা ঘাট। এই স্কুলেই তো সে শিক্ষক ছিল।  মাস কয়েক এরই তো আগের কথা । ইতিহাস পড়াতো সে। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে সবে চাকরিটা পেয়েছিল।  এতো জমজমাট জায়গা দেখে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল প্রথমে। তবে এখন আর কোন কিছুতেই মনে কিছু আসে না।  খালি ধোয়া ধোয়া , যেন সমগ্র পৃথিবী একটা বিশাল সিগারেট ধরিয়েছে। আর ধিক ধিক করে তার মধ্যে থাকা তামাক গুলো জ্বলে উঠছে। 


    স্কুল বাড়িতে তাদের ঢুকতে ঢুকতেই বৃষ্টিটা নেমে এলো।  নিমেষের মধ্যেই প্রবল বর্ষণ।    


    মাথা নিচু করে বসে রইলো স্কুলের খোলা দরজাটার দিকে।  কুয়াশা আর বৃষ্টিতে কেমন সবজে সবজে লাগছে।  দেখে মনে হচ্ছে যেন পৃথিবী পাল্টাচ্ছে , আবার সেই সবুজে সবুজে ভোরে উঠছে।  কিন্তু বৃষ্টি থামতেই তার ভুল ভেঙে যায় প্রতিদিন।  সবুজ রঙটা  এসিডিক। 


    --কিছু খাবি ?  


    --না।  পরে খাবো।  ঘুম পাচ্ছে। 


    বিষ্ণু অহনার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে উঠলো - তুই শুয়ে পর।  কিছুক্ষন পরে খাবার দেব , কেমন?


    অহনা চুপচাপ বিষ্ণুর পাশে মাটিতে তার ঝোলাটা রেখে শুয়ে পড়লো।  বিষ্ণুর চোখ দুটোও কেমন দুলে দুলে উঠলো।  সে খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়ে চুপ চাপ তাকিয়ে রইলো।  প্রত্যেকদিন সন্ধে বেলাতেই তার এই কাজ। দরজার সামনে বসে বৃষ্টি দেখা।  আজ এই করে করে কত দিন কেটে গেলো। এখন আয়নাতে নিজেকে দেখলে চিনতে পারেনা।  কত আগ্রহ নিয়ে  এসেছিল এই স্কুলে।  কত ছাত্র ছাত্রী তার শিক্ষায় শিক্ষিত হবে।  কত কিছু সে শিখবে এই খুদে খুদে বাচ্চাগুলোর থেকে।  কিন্তু ,কিছুদিন পরেই শুরু হলো পৃথিবীর এক ভয়ঙ্কর তান্ডব নৃত্য। 


    এক বিকেলবেলায় একটু আটকে পরে গেছিলো।  পরের দিন বৃক্ষরোপন উৎসব।  তাই সব কিছু গোছাতে গোছাতে বেশ দেরি হয়ে যায়।  স্কুলে তাকে ছাড়া আর কেউ নেই।  আর এমনি সময় হঠাৎ করে পায়ের তলার মাটি যেন কেঁপে উঠলো ।  একটু বোঝার  সঙ্গে সঙ্গেই এক ছুটে বেরিয়ে পড়েছিল ময়দানে।  হালকা কম্পন , কিন্তু ভয়াবহ।  ভূমিকম্প!!  স্কুল বিল্ডিংএর কিছু হয়নি।


     তবে  মাথাটা কেমন  ঘুরতে শুরু করছিল ।  ভূমিকম্পের সময় এরকম হয় নাকি । পড়েছিল কোথাও সে, মনে নেই এখন।


    একটু ধাতস্থ হতেই নেমে এলো এক তুমুল বৃষ্টি। অগত্যা আবার স্কুলের ভেতরে।  তারপর থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে  এই বৃষ্টি চললো। ফোন, কারেন্ট , ইন্টারনেট সেইদিন থেকেই সব বন্ধ। আর সেই বৃষ্টিও বড় অদ্ভুত ধরণের। চোখের সামনে বিষ্ণু দেখলো ময়দানের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বটগাছ যেন মোমের পুতুলের মতো গোলে গেলো।  এরকম বৃষ্টির কথা সে কোনোদিন দেখেনি , কোনোদিন শোনেনি। এমনকি স্বপ্নতেওঁ কোনোদিন ভাবেনি। 


    আর বৃষ্টি থামলেই আশেপাশে এক ঘন কুয়াশা।  সেই কুয়াশাতে কিছু দেখা যায়না।  মাঝে মাঝে একটু হালকা হলে চোখ পরে স্কুলের সামনের জমজমাট দোকানগুলোতে । সেগুলো যেন এখন বিগত সভ্যতার প্রস্তরীভূত নিদর্শন। যতবারই দেখে ততবারই মনে পরে তার সিন্ধু সভ্যতার কথা।  খানিকটা এরকমই তো ছিল।  কোন এক সময় খুব জমজমাট তারপর একেবারে ধূলিসাৎ।  সেই থেকেই  আটকা  পরে গেলো স্কুলের এই চার গন্ডির মধ্যে। 


     প্রথম প্রথম খুব চিন্তা হতো সবার জন্য। নিজেকে পাগল পাগল মনে হতো । কারুর সাথে কথা বলার নেই।  কারুর সাথে দেখা করার নেই।  বৃষ্টি আর কুয়াশাই যেন তার সঙ্গী।  বৃষ্টি বাদলা নিয়ে যত গান মনে ছিল সব গাওয়া হয়ে গেছে। যত কবিতা লেখার ছিল তাও শেষ।  এখন যেন একেবারে কর্মশূন্য।  এইদিকে খাবারও ফুরিয়ে আসছে। মিডডে মিলের জন্য মজুত খাবার গুলোতে তার মাস দুয়েক চলেছে।  এখন চাল আর ডাল  ভিন্ন কোনো কিছুই নেই।  তাই সে ওই বৃক্ষরোপন উৎসবের জন্য আমদানি করা বীজ গুলো স্কুল ঘরের ভেতরেই মাটি এনে পোতা শুরু করলো।  সেই থেকে শুরু হলো প্রকৃতির সাথে তার এক অবিরাম সংগ্রাম।  জল পরিশোধন করে সেই জল মাটিতে দিতে দিতেই কোনোরকমে শাক সবজি হতে লাগলো। 


    বৃষ্টির জল যে এতটা এসিডিক সেটা আন্দাজ করা তার পক্ষে সম্ভব না।  এমন সময় আবার এক বিশাল ঝড় হলো।  ঢকঢক করে ভেঙে বেরিয়ে গেলো জানলার রেলিং।  পবনদেব যেন আদিমকাল থেকে পোষা রাগকে একেবারে বার করছে।  হওয়ার এতো তেজ যেন সমস্ত পৃথিবীকে নিজের অক্ষচ্যুত  করে অন্য কোন গ্যালাক্সিতে ছুড়ে ফেলে দেবে। 


    বিষ্ণুর কিচ্ছু করার নেই , কোথাও যাওয়ার নেই।  তার নাম দেবতার হলেও সে নিজে দেবতা নয়।  তাই চেষ্টা করলেও এই প্রকৃতি মাকে  শান্ত করতে পারবেনা। তাই সে শুধুই বসে রইলো।  চুপ করে। 


     ধীরে ধীরে ঝড় থামল,তবে  কুয়াশা জড়িয়ে নিলো নিজের বুকের ভেতরে।  কি অসম্ভব গন্ধ এই কুয়াশাতে। পোড়া , পোড়া  রাবারের গন্ধ।  তবে সব থেকে বেশি যেটা তার নাকে লাগতো সেটা হচ্ছে আতঙ্কের। কুয়াশার মায়াসাগরে যখন একটু ভাটা পড়তো তখন সে বেরিয়ে যেত।  মনে মনে কোথাও যেন আশা ছিল যে হয়তো ট্রেন চলছে, হয়তো কোন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে তাকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য।  হয়তো সমস্ত পৃথিবী ঠিক আছে আর সে এক দুঃস্বপ্নে বাস করছে।  কিন্তু এগোতেই বুঝতে পারে, যে সামনে কিছুই নেই।  থাকলেও তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। বাতাসের গন্ধে তার শ্বাসনালী যেন আটকে যাচ্ছে।  এদিক ওদিক যেইদিকে চোখ পরে খালি ভাঙা পাঁচিল।  গাছ পালা সব নষ্ট হয়ে গেছে।  মনে পরে একদিন বাস স্ট্যান্ডের সামনে কি একটা যেন ফুলের গাছ ছিল।  বড় বড় হলুদ ফুল ফুটেছিল।  আর সেই ফুল নিয়েই একটা প্রজাপতি আর একটা মৌমাছির মধ্যে তীব্র ঝগড়া।  


    এখন সেই দৃশ্য খালির স্মৃতির ভেতরেই আটকে আছে।  এখন আর সে ফুলই দেখতে পায়না তো প্রজাপতি আর মৌমাছি। কত মাস যে হয়ে গেলো তার হিসেব নেই।  শরীর ভেঙে পড়েছে তার।  তাই এগোতে সাহস পেলোনা।  ফিরে আসার পথেই যখন দেওয়ালে চোখ পড়লো তখন দেখতে পেলো টকটকে লাল গোলাপের ছবি এঁকে  চলেছে অহনা। 


    অহনা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।  কতক্ষন ঘুমিয়েছে কেউ জানেনা। সময়ের হিসেবে আর কেউ রাখেনা।  


    -খিদে পেয়েছে। 


    বিষ্ণু এগিয়ে গিয়ে একটু ভাত আর পালন শাক নিয়ে এসে দিলো।  অহনা তা পেয়েই খুশি।  কে  জানে কি খাচ্ছিলো মেয়েটা এতদিন। মনে মনে ভাবে বিষ্ণু। 


    অহনা খাবার শেষ করে ব্যাগ থেকে আবার রং পেন্সিল গুলো বার করলো।  


    বিষ্ণু তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো -- কি অংকবি অহনা ?


    -- ফুল আর গাছ। 


    -- বাহ্।  তোর বুঝি আঁকতে খুব ভালো লাগে ?


    -- হ্যা , না আঁকলে যে সব শেষ হয়ে যাবে। 


    -- কি শেষ হয়ে যাবে ? রঙ ?


    -- না আমরা সবাই।  তাইতো আমি আঁকি।  আমাকে তো বলেছে আঁকতে। 


    -- কে বলেছে ?, একটু অবাক ভাবেই জিজ্ঞাসা করলো বিষ্ণু । 


    অহনা একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বললো --সেই লোকটা। আমাকে সব সময় বলে আঁকো আঁকো।  আর আমি একেই যাই। 


    বিষ্ণু অন্তর্যামী নয় , কিন্তু সে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।  অহনা এঁকে চললো।  আর বিষ্ণু মাটিতে শুয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো। 


    সেই রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো সে। 


    বিষ্ণু একা দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল বাগানে।  চারিদিকে ফল, ফুল আর নানা পাখি জন্তু জানোয়ারের মাঝে।  আর মাথার উপর পরিষ্কার আকাশে রামধনু ঝকঝক করছে।   অন্যদিকে আবার আগত সূর্যের প্রথম আলোতে স্নান করছে কয়েকটা প্রজাপতি।  আর তার সামনে একটা বাদামি রঙের বেঞ্চে কে যেন উল্টো দিক করে  বসে বসে সূর্যোদয় দেখছে । বেঞ্চের উপরে চকচক করছে লাল রঙের একটা পাথরের সারি। কিন্তু  সেইদিকে যেতে না যেতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। 


    সূর্যের আলো তার স্বপ্ন আলোকিত করলেও স্কুলের বারান্দার ছায়াকে ভয় পায়।  তাই আকাশটা  এখনো অন্ধকার।  তার পাশেই ছোট অহনা শুয়ে আছে। 


    অহনার দিকে তাকাতেই তার চোখে যেন একটা চমক খেলে গেলো।  দেখে সারা মেঝে জুড়ে নানারকম ফুলের ছবি এঁকে ফেলেছে এই ছোট বাচ্চাটা। এতো সেই ফুলগুলো যেটা সে তার স্বপ্নের বাগানে দেখেছিলো।  মনটা কেমন যেন ভোরে গেলো।  সে অহনার ব্যাগ থেকে পেন্সিল বার করে নিজে আঁকা শুরু করলো।  হলুদ ফুল, সবুজ ঘাস আরো কত কিছু।  কেমন যেন ভালো লাগতে লাগলো তার।  রঙের পেন্সিলগুলো যেন আশার  জাদুকাঠি হয়ে উঠেছে তার কাছে।  


    অহনা ঘুম থেকে যখন ওঠে তখন ঘরের মেঝেটা ভোরে গেছে নানারকম ফুল আর প্রজাপতিতে।  


    --কি করছো তুমি ?


    বিষ্ণু একটু হেসে বললো --দেখ অহনা , এই পুরো ঘরটা বাগান হয়ে উঠেছে।  এবার থেকে আমরা দুজনে এই বাগানে ফুল লাগাবো। 


    অহনা ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝলোনা।  বোঝার কথাও নয় , তার সাত বছর বয়সে এতো কিছু মাথায় ঢোকে না। কিন্তু ছবি আঁকা তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। আর সে ওটা নিয়েই খুশি। 


    একটা বাদামি রঙের পেন্সিল দিয়ে সে ঘরের দেওয়ালে আঁকতে শুরু করলো।  


    -কি আঁকছিস ?


    -প্রজাপতি 


    বিষ্ণুর মনটাও অহনার প্রজাপতির মতো ডানা মেলতে লাগলো।  মনের মতো সাথী পেয়েছে।  তিনদিন ধরে বিষ্ণু খাওয়া দাওয়া ভুলে খালি একেই চলেছে।  তার সেই স্বপ্নে দেখা  বাগান।  বিরতি বলতে খালি খাবার দিতে উঠেছিল অহনাকে।  মিডডে মিলের গচ্ছিত চাল ফুরিয়ে এসেছে।  দুজনে খেলে হয়তো একদিনও চলতো না।  কিন্তু বিষ্ণুর খিদে নেই,তৃষ্ণা নেই। আছে শুধু এক স্বপ্ন। 


    তিনদিনের দিন শেষ রাতে তার বাগান সম্পূর্ণ হলো।  একদম ঠিকঠিক যেটা স্বপ্নে দেখেছিল সেইরকমই হয়েছে। খালি একটা জিনিসের অভাব।  কি সেই জিনিস ? স্বপ্নটা যেরকম বেঞ্চ দেখেছিলো ঠিক সেরকমই এঁকেছে।  মাথার উপর রামধনু , চারিদিকে ফুলের সম্ভার, কোনো কিছুই বাদ নেই।  তাহলে কি সেই জিনিস ?


    অহনা ঘুমিয়ে পড়েছিল কিন্তু বিষ্ণুর ঘুম নেই।  তার মাথা ঘুরছে কিন্তু কিছুতেই সেই অনুভূতিটা আসছেনা।  


    হঠাৎ দূরে একটা বিশাল বাজ পড়লো আর আবার শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি।  অহনা কেঁপে উঠলো আওয়াজে।  বিষ্ণু ভয়ার্ত সেই ছোট বাচ্চাটার কাছে গিয়ে বলল -- কোন চিন্তা নেই।  সব ঠিক হয়ে যাবে।  


    কিছুক্ষন পর বৃষ্টি থামতেই তার খেয়াল হলো।  বেঞ্চের উপর লাল রঙের পাথরের সারি ছিল।  সেটা আঁকা হয়নি।  


    অহনা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।  তাকে একপাশে শুইয়ে সে লাল পেন্সিলটা খুঁজতে লাগলো।  কিন্তু , লাল পেন্সিল আর নেই।  ফুরিয়ে গেছে।  বিষ্ণুর মুখটা চুপসে গেলো--  তাহলে কি সম্পূর্ণ হবেনা আমার বাগান ? তাহলে কি সব শেষ ?


    এই সময় তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো । সে রান্নার জায়গা থেকে একটা চুরি নিয়ে বুড়ো আঙুলটায় আঁচড় মারলো।  গলগল করে বেরিয়ে এলো তকতকে লাল তাজা রক্ত।  


    অন্য সময় হলে হয়তো সে ছুটে যেত চিনির খোঁজে।  কিন্তু এখন তার এই রক্ত দিয়েই জীবিত হবে স্বর্গীয় বাগান।  সে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে এঁকে চললো ওই বেঞ্চের গায়ে।  আঁকা  সম্পূর্ণ হতে তখন তার মনটা ভোরে উঠলো।  এবার সে ঘুমোবে।  তার সৃষ্টি এবার সম্পূর্ণ হয়েছে। 


    সেই রাতে সে আবার ঐ  একই স্বপ্ন দেখলো ।  চারিদিকে নানা রঙের ফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে।  আর দূরে সেই বেঞ্চে বসে আছে কে একজন।  সে এগিয়ে গেলো তাকে দেখবার জন্য।  এখনো সেই সূর্যের ভেজা আলোতে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতিগুলো।  আর তাদের মাঝেই বসে আছে সেই লোকটা।  এই লোকটাই কি অহনার সাথে কথা বলে? মনে মনে ভাবলো সে। 


     বেঞ্চের  খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে বিষ্ণু।  মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। সে বুঝতে পারছে তার দিকে পিছন করে করে যে লোকটা এখন সূর্যোদয় দেখছে সে কে। আর এগিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। 


    ঘুমটা তার আবার ভেঙে গেলো অহনার ডাকাডাকি তে। 


    --দেখো দেখো , কি সুন্দর ।  


    আবছা চোখে বিষ্ণু তাকিয়ে দেখলো খোলা দরজা দিয়ে নতুন এক সূর্যের আলো লেপ্টে দিয়েছে স্কুল বারান্দাটা।  যেমন করে কোন পুজোর আয়োজনে গোবর লেপ্টানো হয় , ঠিক সেরকম ভাবেই।  আর তাতেই স্নান করছে দুটো লাল রঙের প্রজাপতি।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Guruchandali | 136.228.***.*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:২৫97502
  • যাঁরা খেরোর খাতায় নতুন লেখালিখি করছেন, গুরুচণ্ডা৯-র টেকনিকাল ফীচারগুলো তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য আগামী শনিবার ভারতীয় সময় রাত ৮-১০টা আমরা একটা ওয়েবিনার করছি গুগল মীট-এ। ইচ্ছে আছে আগামী কয়েক সপ্তাহ জুড়ে প্রতি শনিবার ঐ নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েবিনার করার। আপনাদের কী কী অসুবিধে হচ্ছে লিখতে বা একটা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গুরুচণ্ডালির পূর্ণ স্দ্ব্যবহার করতে, সেটাও আমরা নোট করব, যাতে এটাকে আরও উন্নত করা যায়, প্রযুক্তিগতভাবে। সম্ভব হলে থাকবেন। শনিবার রাত আটটায় নিচের লিংকে ক্লিক করেই মীটিং এ জয়েন করা যাবে। 


     https://meet.google.com/ydz-ekww-see

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন