আজ ৫ ই সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবস। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান তাঁর এই ৫ ই সেপ্টেম্বর জন্মদিনটিকে শিক্ষক দিবস পালনের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাই ১৯৬২ সাল থেকে আজকের দিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
আজকের দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আজ ছাত্র, অভিভাবক ও সমাজের দ্বারা শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এর দিন এবং সেই সাথে সমাজে শিক্ষকদের অবদান স্মরণের দিন। আবার আজকের দিনটি শিক্ষকদের কাছে সমাজের প্রতি তাঁদের দায়িত্ব-কর্তব্য স্মরণ ও মূল্যায়নের দিন।
বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারীর প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেছেন যে করোনার ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হলে ডাক্তার ও শিক্ষকদের বাঁচাতে তিনি সর্বপ্রথম ডাক্তার ও শিক্ষকদের উপর টিকা প্রয়োগ করবেন,কেননা একজন ডাক্তার তৈরী করতে ৩০ বছর সময় লাগে এবং তাতে দেশের জনগণের টাকা খরচ হয়। একজন ডাক্তার মারা গেলে সেই ডাক্তারের অভাবে ৩০ বছর সময় কালে অনেক মানুষ মারা যাবে। একই বক্তব্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এছাড়া একজন শিক্ষক মারা গেলে ডাক্তার তৈরি হবে কিভাবে? ডাক্তার ও শিক্ষক উভয়ই সমাজে অতুলনীয়।
বাস্তবিকই শিক্ষক হলেন সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক সমাজ দেশে শিক্ষার আলোক বর্তিকা বহন করেন। একজন মানব-শিশু তার মাতা, পিতা ও পরিবারের পর সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয় তার শিক্ষক দ্বারা। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিমন্ডলেও একটি শিশু-কুসুম উন্মেষিত হতে পারে একজন শিক্ষকের স্নেহমাখা পরশে, তাঁর কাঙ্ক্ষিত ভূমিকার দ্বারা। তাই আজকে স্মরণ করি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে রচিত একটি বিখ্যাত গান -----
শিক্ষক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর "শিক্ষা সমস্যা" প্রবন্ধে বলেছেন যে ,শিক্ষকই যদি জানেন যে তিনি গুরুর আসনে বসেছেন, যদি তাঁর জীবনের দ্বারা ছাত্রের মধ্যে জীবন সঞ্চার করতে হয়, তাঁর জ্ঞানের দ্বারা তার বাতি জ্বালাতে হয়, তাঁর স্নেহের দ্বারা তার কল্যাণ সাধন করতে হয় , তবেই তিনি গৌরবলাভ করতে পারেন। তবে তিনি এমন জিনিস দান করতে বসেন যা পণ্য দ্রব্য নয়। যা মুল্যের অতীত ------। তিনি জীবিকার অনুরোধে বেতন নিলেও তার চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে নিজ কর্তব্যকে মহিমান্বিত করেন।
যেহেতু শিক্ষকের প্রভাবে একজন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত হয় , যেহেতু শিক্ষক সমাজের কাছ থেকেই একজন ছাত্র জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সামগ্রিক ভাবে প্রাথমিক ধারণা বা জ্ঞান লাভ করে ,সেহেতু জগৎওজীবন সম্বন্ধে শিক্ষকদের নিয়মিত জ্ঞান চর্চা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে , যে প্রদীপ নিজে জ্বলন্ত থাকে না ,সে অপরকে প্রজ্বলিত করতে পারে না , একইভাবে যে শিক্ষক নিয়মিত জ্ঞান চর্চা করেন না , নতুন নতুন তথ্যরাজির খবর রাখেন না তিনি শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান পিপাসা সৃষ্টি করতে পারেন না।
শিক্ষকদের হাত দিয়েই জ্ঞানের মশাল এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মে প্রবাহিত হবার সূচনা হয়। তাই ,সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী লুনাচারস্কি বলেছেন যে, শিক্ষক হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি নতুন প্রজন্মের কাছে যুগ-যুগান্তরে সঞ্চিত যাবতীয় মূল্যবান সাফল্য হস্তান্তরিত করবেন , কিন্তু কুসংস্কার, দোষ ও অশুভকে ওদের হাতে তুলে দেবেন না। এটাই হল শিক্ষকদের গুরুত্বের মাপকাঠি।
বিশ্ব সঙ্কটময় পরিস্থিতির মধ্যে আজ শিক্ষাজগৎ-ও সঙ্কটময়। বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অন্যান্য পণ্য দ্রব্যের মতো শিক্ষাও হয়ে উঠতে যাচ্ছে এক ধরনের পণ্য। শিক্ষা দানের লক্ষ্য হতে চলেছে মুনাফালাভ এবং শিক্ষক পরিণত হতে যাচ্ছে পুঁজিপতিদের কাছে মুনাফালাভের যন্ত্র রূপে। এ বড়ই বেদনাদায়ক ! কিন্তু শিক্ষক হলেন অমিত শক্তির অধিকারী। এই সঙ্কটময় মূহুর্তে শিক্ষক এক সদর্থক ভূমিকা পালন করে সমাজকে পথ দেখাবেন, সমাজকে নতুন করে গঠনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন-- এই বিশ্বাস শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের রয়েছে। এই প্রসঙ্গে শিক্ষকদের ক্ষমতা বিষয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত স্মরণ করি------
শেষে সমাজের পক্ষ থেকে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। নমস্কার। ০৫ - ০৯- ২০২০