এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • লকডাউনের এক সন্ধ্যাতে...

    Soumabha Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ৩০ জুন ২০২০ | ২৭৩১ বার পঠিত
  • রাতে বেডরুমের আলো নিভিয়ে দেবার পর রাস্তার স্ট্রিট লাইট ঘরটাকে যতটা আলোকিত করে, সেদিন সন্ধ্যের সময় রাস্তায় বেরিয়ে ঠিক ততটাই আলো চোখে পড়ছিল । লোডশেডিং এর চাঁদটা দেখে অন্ধকার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা এক চিলতে রোদ মনে হবার কোনও কারন না থাকলেও, বিদ্যুৎহীন পৃথিবীর বিশালতাকে তা উপলব্ধ করতে সাহায্য করে কিঞ্চিৎ । তখন যাবতীয় মুখোশ গুলো শুধুমাত্র যে লোকলজ্জার কারণে মুখে চাপানো - তা ঠাওর করতে বিশেষ অসুবিধা হয়না । 

    মুখ ঢেকে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে ডানদিকে ঘোরার আগে আমি পিছনে তাকাই - এটা বরাবরের অভ্যাস । বাবা ছাদে দাড়িয়ে আছে জানি, কিন্তু অন্ধকারে মুখটা দেখা গেল না । সরু গলিতে চাঁদের আলো রাস্তা হারিয়ে ফেলে, ঠিক যেরকম ভাবে ছোটবেলায় সাইকেল চালিয়ে রাস্তা হারিয়ে আমরা নিজেদের চেনা জগতকে অচেনা বানানোর আনন্দে মেতে উঠি, সেভাবেই । বয়স বাড়ার সাথে সাইকেলে জং ধরে, বিয়ারের বোতল ব্যারিকেডের মতন ঘরের চৌকাঠ পেরোতে মানা করে । 

    জং ধরা সাইকেল ছেড়ে এখন পায়ে হাঁটতেই বেশি ভাল্লাগে । মামাবাড়ির তিনমাথার মোড়ে কোনও এক অজানা কারণে বারংবার বাঁদিকের গলিটায় চোখ চলে যায় । প্রত্যহের অভ্যাস কাটিয়ে এখন শিবমন্দিরে আলো জ্বলছে না - দেবতা মানুষের মুখের উপর আশ্রয়ের দরজা বন্ধ রেখেছেন । একটু আগে আসলে বেশ দূর থেকেও মাসখানেকের অবজ্ঞার ধুলো দেখতে অসুবিধা হয় না । এখন আকাশের যাবতীয় আবর্জনা মাটিতে আসছে, থিতিয়ে যাচ্ছে । এই জং সরানোর কাজ যে সহজ হবেনা, তা নতুন করে কাওকে বলে দিতে হয়না । 

    ছোটবেলায় নীল পুজোয় বেশ আনন্দ হত । শিব মন্দিরের গলিটায় ঢুকলে মনে হত ঈশ্বরের সাথে প্রকৃতির বিবাহের আনন্দে সারা পাড়া মেতে উঠে চারদিক আলোকিত করেছে । যাদের মনে অন্ধকার তারা প্রসাদে অতিরিক্ত লুচি চাইলে মুখ ব্যাজার করতেন । আমরা ছোটরা রাখাল সাজতাম না - গুন্ডা সেজে হাতে ক্যাপ বন্দুক নিয়ে কোনও এক কাল্পনিক জমিদারবাড়ি লুঠ করতে তেড়ে যেতাম - আর সেই কৌতুক নাটকের একমাত্র দর্শক হয়ে চাঁদমামা হাততালি দিত । 

    হাঁটতে হাঁটতে সাহেব্বাগান মাঠের কাছে এসে একটু দম বন্ধ লাগলো । মুখোশটা খুলে একটু শ্বাস নিয়ে বুঝতে পারলাম এই হাওয়ায় ছোটবেলার ঘাসের গন্ধ আছে; আসলে আমাদের যাবতীয় মুখোশ তো বড় হবার জন্যই পড়তে হয় । হঠাৎ খেয়াল হল যে এখানে রোগী ধরা পড়েছে - এরকম একটা খবর হাওয়ায় ভেসে বেরাচ্ছে । চটপট মুখ বন্ধ করে এগিয়ে চললাম - যেরম সারা জীবন এগিয়ে যাই, নিঃসাড়ে নিস্তব্ধে । 

    এখানে এককালে আমি পড়তে আসতাম । হইহই করে যাওয়া আসার মাঝে কোনদিন ভাবতে হয়নি যে এই রাস্তায় একা হাঁটব । অবশ্য সব ট্রেনযাত্রীর যে গন্তব্যস্থল এক - তা ভাবা তো উচিৎ নয় । যে একা যাত্রা করে, তার কোনও গন্তব্যস্থল দরকার হয়না । বড় রাস্তায় রূপোলী চন্দ্রসুধা সার্চলাইটের মত এদিক ওদিক তাকাতে বলে । এভাবেই হেঁটে যেতে যেতে একদিন উল্কাপিণ্ড কখন যে তারামণ্ডলের আকর্ষণ ছেড়ে লাগাম ছাড়া সাদীর মত তার ফেলে আসা যাবতীয় সবকিছুকে ভালবাসতে ভুলে যায় - তা ধরতে পারা যায়না । 

    আমার ছেলেবেলার শেষ খুঁটি ছিল বড় রাস্তার ধারের সাইবার ক্যাফে । বাবার পকেট থেকে দশটাকা বের করে কাউন্টার স্ট্রাইক আর ফিফাতে উচ্চমাধ্যমিকের বারটা বাজানোয় একটা আফসোস ছিল, কিন্তু কোনদিন অপরাধ বোধ হয়নি । গালাগালমন্দ, চিৎকার চেঁচামেচি, ঝগড়া অশান্তি, আবার বেরিয়ে দু টাকার ফ্লেক - এসবের ঝাঁপ কবে যে এখনকার শাটারটার মতন বন্ধ হয়ে গেল তা বুঝে ওঠার সময় জীবন দেয়নি । শুধু এটুকু ভাল করে বুঝিয়েছে যে অপরাধবোধটা সমসাময়িক আমদানি । 

    তবুও চাঁদের আলোয় রাস্তা খুঁজে বাড়ি ফিরতে হয় । ভালবাসার ঝাঁপ গুলো বন্ধ হলেও আবার, বারবার মন চায় ঘরের দেওয়ালের মত হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকি - বাড়িতে ঘর তৈরি করি । আবার তাতে ছোট ছোট আনন্দগুলো আনাগোনা শুরু করুক, বিয়ারের বোতল গুলোর ব্যারিকেড ভাঙুক প্রেমের অপরিসীম বিদ্রোহে । 

    লোডশেডিং কাটেনি । পায়ের তলায় অবশিষ্ট চন্দ্রকনাকে পারিয়ে ঘরে ঢুকলাম । এই লকডাউন একদিন কাটবেই - তারপর আবার শিবমন্দিরে সন্ধ্যার আলো জ্বলবে ।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন