#কোনঠাসা #কুণালশেখর
ভোরবেলায় একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল সুব্রত। আজকাল রোজই দাঁড়িয়ে থাকে এসময়। ঘুম ভেঙে যায় খুব তাড়াতাড়ি। ঘুম আর ধরেই বা কোথায়? সারারাত তো এপাশ ওপাশ করেই কেটে যায়। তারপর আলো ফুটলে চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সামনে রাস্তা। সেদিকে তাকিয়ে ছিল সুব্রত। হয়তো কিছু দেখছিল। আসলে কিছুই দেখছিলনা। মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনার ধাক্কায় দোকানদানি শিকেয় উঠেছে।
ছোট্ট একটা দোকান আছে সুব্রতর। বাচ্চাদের খেলনা, অনুষ্ঠানে উপহার দেবার জিনিস এসবের দোকান। সামান্য দোকান, সামান্য পুঁজি। এর বেশি করার সামর্থ্য হয়নি তার। দোকান থেকে কিছু রোজগার হত আর বাবা একটা এম আই এস করে দিয়েছিলেন তার থেকে সুদ পায় সামান্য। এই দুয়ে মিলে সংসারটা চলে যায়। কিন্তু এখন নাভিশ্বাস। ব্যবসা মার খাচ্ছে তিনমাস ধরে। প্রথম একমাস তো দোকান পুরো বন্ধ ছিল। তারপর থেকে খুলছে কিন্তু খদ্দের কই? তার ব্যবসা তো উৎসব অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। করোনার জেরে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, পৈতে, জন্মদিন সব বন্ধ। নেমন্তন্ন পেলে তবে তো লোকে গিফট কিনবে।
ভাড়া বাকি দুই মাস। বাড়ি আর দোকান দুটোরই। অনেকদিনের ভাড়াটে তারা। জন্মের পর থেকে এবাড়িতেই বাস সুব্রতর। তাই চক্ষু লজ্জার খাতিরে ভাড়ার জন্য তাগাদা দেননি বাড়িওয়ালা।
কি করে কি হবে ভেবে পায়না সুব্রত। শেষে সপরিবারে আত্মহত্যা করতে হবে না তো? এখন মনে হচ্ছে চাকরি করলেই হয়তো ভালো হত। তাতে অন্তত এখনের মত চাপে পড়তে হতো না। মাস গেলে একটা ফিক্সড ইনকাম থাকতো। কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বছর দুই সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছিল সুব্রত। কিন্তু সবার ভাগ্য তো আর শিকে ছেঁড়েনা। একটা পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারেনি সুব্রত। তার হয়ে উমেদারী করবার লোকও নেই কোন। ঘুষ দেবার টাকা কই?
তারপর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে বছর কয়েক সেলসের কাজ করেছিল। কিন্তু পোষায়নি। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে টো টো করে সারাদিন দরজায় দরজায় ঘুরে জিনিস বিক্রি তার ধাতে সহ্য হলনা। শরীর ভেঙে গেল সুব্রতর। বাধ্য হল চাকরি ছাড়তে। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল ব্যবসা করবে। কিন্তু কি ব্যবসাই বা করবে? সুব্রতর বাবা ছা পোষা কেরানি ছিলেন। তাঁর বাবা মাষ্টার। তাদের বংশের কেও কোনদিন ব্যবসার ধারও মাড়ায়নি। সব থেকে সোজা ব্যবসা ছিল দোকানদারি। সেটাই করবে ঠিক করেছিল সুব্রত। প্রথমে ভেবেছিল হাট মশলার গোলদারী দোকান করবে। কিন্তু পাড়াতেই একটা মস্ত বড় দোকান আছে সেসবের। তাই সেদিকে না গিয়ে গিফট আর খেলনার দোকানের কথাটা মাথায় আসে। বাড়িওয়ালার একচিলতে গ্যারাজ ছিল একটা। ব্যবহার হত না। সেটাকেই ভাড়া নিয়ে দোকান করেছিল সুব্রত। সেটাতেই টুকটাক করে চলে যাচ্ছিল। খুব একটা বেশি রোজগার না থাকলেও অন্তত বেকার বসে তো ছিলনা। কিন্তু আর যে চলছেনা। মুদিখানা করলেই বোধহয় ভালো হত। এই বাজারে ওই একটাই ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে। চাকরি ছেড়ে ভুল হয়েছে। ভাবে সুব্রত। কোনরকমে ঘাড়মুখ গুঁজে দাঁতে দাঁত চেপে যদি চালিয়ে যেতে পারত তাহলে হয়তো এত চিন্তা করতে হত না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই বাজারে চাকরিটাই কি থাকত আজ? কোম্পানি তো এক কথাতেই জবাব দিয়ে দিতে পারত। বসিয়ে মাইনে তো আর দিত না।
এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে এলো মিতু। মিতু, মিতালি। সুব্রতর সাত বছরের পুরোন বউ। চা আর বিস্কুট হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল মিতু। ছেলেটা এখনো ঘুমোচ্ছে। এই বেলা যতটা পারা যায় হাতের কাজ গুলো সেরে ফেলতে হবে তাকে।
চায়ে চুমুক দিয়ে আবার ভাবনায় ডুবে যায় সুব্রত। তার জীবনটা কেমন অনিশ্চয়তায় ভরা। এই যে বিয়ে, সেটাও কেমন হুট করে হয়ে গেছিল। মাত্র চারদিনের নোটিশে। বিয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ চলছিল জাত, গোত্র, বংশ মিলিয়ে। কিন্তু গরু খোঁজা করেও মেয়ে জুটছিলনা সুব্রতর। সামান্য এক দোকানদারের হাতে কোন বাপই বা রাজি হবে মেয়েকে তুলে দিতে? ক্রমে ক্রমে বিয়ের আশা যখন ছেড়েই দিয়েছে তখনই এই সম্বন্ধটা এনেছিল ফুলকাকু। বলেছিল দেখ মেয়ের বাপ ট্রেনে হকারি করে কিন্তু মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালোই। সবে কলেজ পাশ করেছে। মেয়ের বাপের ক্ষমতা নেই বড় মানুষ জামাই করার। তুই রাজি থাকলে বল। রাজি হয়েছিল সুব্রত। এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছিল মিতুকে। পছন্দ না হয়ে কোন উপায়ও অবশ্য ছিলনা তার। কারন তাকেই তো কেও পছন্দ করছিল না। বিয়েতে কিছু নেয়নি সুব্রত। অবশ্য চাইবার মত ক্ষমতাও তার ছিলনা। যৌতুক তারাই চাইতে পারে যাদের পাত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে সেই নিয়ে সুব্রতর মনে ক্ষোভ নেই কোন। শ্বশুর মশাই যতটা সম্ভব সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। মিতুকে বিয়ে করে খুশি সুব্রত। সাত বছরের সংসার জীবন পার করে ফেললো তারা। মেয়েটা ভালো। অন্তত তার মনের মত।
ঘড় ঘড় করে শাটার তোলার শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে সুব্রত। প্রতিমা স্টোর খুলছে। এই এলাকার সব থেকে বড় ফুড এন্ড ভ্যারাইটি স্টোরস। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুব্রত। এরাই বেশ আছে। বাবার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা এখন দু ভাই চালায়। তিনজন কর্মচারী আছে। এলাহী কারবার। ওদের সাথে নিজের ব্যবসার তুলনা করে হাসি পায় সুব্রতর। সেই সাথে আবারো ফিরে আসে একরাশ চিন্তা। কি যে হবে আগামী দিনে কে জানে। পরিস্থিতি এখন যা তাতে আরো ছয়মাস বা একবছর কোন উৎসব অনুষ্ঠান হবে বলে তো মনে হয়না। ততদিনে তো না খেতে পেয়ে মরেই যাবে। তিল তিল করে সামান্য যেটুকু জমিয়েছিল তাতেই এইকদিন চলল। সেখানেও তো টান পড়বে এবার। ব্যবসা যে বদলাবে সেই সুযোগও নেই। টাকা কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা কি ব্যবসা করবে? এই বাজারে এখন দুটি ব্যবসা চলছে। মুদিখানা আর ওষুধ দোকান। শেষেরটা তো দুম করে হবেনা। তার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফার্মেসি লাইসেন্স চাই। তার থেকেও বেশি দরকার অভিজ্ঞতা। দুটোর কোনটাই নেই সুব্রতর। মুদিখানাই শুরু করবে নাকি? কিন্তু চাল ডাল আটা এসবের ভালো মন্দ কোয়ালিটির কিছুই তো বোঝেনা সুব্রত। ঠকে যাবে নির্ঘাত। ঠকতে ঠকতে হয়তো শিখবে কিন্তু প্রতিমা স্টোরসের সাথে তো পাল্লা দিতে পারবেনা কিছুতেই। সুব্রত যে দামে দেবে ওরা চাইলে আরো দু টাকা কমে দিয়ে দেবে। তাতেও ওদের পুষিয়ে যাবে। বড় ব্যাপারীর তো এটাই সুবিধে। গোটা শহরের লোক আসে ওদের দোকানে জিনিস নিতে। কারন ওদের হোলসেল আর খুচরো দুটোই আছে। এই তো গগনদা ওদের মত দোকান খুলেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। চালাতে পারল কি? টিঁকলোই না ব্যবসা। বছর দুয়েক ব্যর্থ চেষ্টা করে তুলে দিতে বাধ্য হল।
বুবুন উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। পাঁচে পড়ল ছেলেটা। সবে ভর্তি হয়েছে স্কুলে। ছেলেটাকে মানুষ করবে কি করে খুঁজে পায়না সুব্রত। মধ্যবিত্ত হবার অনেক জ্বালা। নিচে নামতেও বিবেকে আটকায় আবার ওপরে ওঠারও ক্ষমতা নেই। সবথেকে বড় জ্বালা জেনারেল কাস্ট হবার। এদেশে জাত দেখিয়ে সুবিধা পাওয়া যায়। অবস্থা দেখে নয়। সুব্রতর বাবা কেরানি ছিলেন, তাই রেশন কার্ডটাও বিপিএল হয়নি। জাতে কায়স্থ বলে কোন সরকারি প্রকল্পেও ঠাঁই হয়না ওদের।
সকাল দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার স্নান করে দোকান খুলতে হবে। দোকান খোলা মানে এখন দোকানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকা। কোনদিন দু তিনশ টাকার বেচাকেনা হয় তো কোনদিন বউনিটাও হয় না। আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুব্রত। আরো একটা দিন পেরিয়ে যাবে। আবার কাল সকাল হবে। সুব্রত বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। আকাশ পাতাল ভাববে। আবারো দিন গড়িয়ে যাবে। এভাবেই চলছে। আরো কতদিন চলবে কে জানে। ভগবান, এ তুমি কি শাস্তি দিচ্ছ ভগবান? গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ব্যাকুল হয়ে উত্তর খুঁজতে থাকে সুব্রত।।
©