গাম ট্রি
বাইরে এসে বসি । দিনের অবসন্ন কাল। মার্চের শেষ । দিন এখন প্রলম্বিত। আকাশের মৃদু নীলাভ আলো মায়াময় হয়ে ছড়িয়ে থাকে চারিদিকে সূর্য ডুবে যাবার অনেক অনেক পরেও । সারা দিনের গুমোট ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে বাইরের খোলা হাওয়ায়।
সিমেন্টের বাঁধানো চাতালে মাথা ঢাকা বারান্দায় বসে আছি। সামনে একটুকরো সবুজ ঘাসের চড়াই । তার এক পাশে একটি গাম ট্রি । শতাব্দী প্রাচীন – বলিষ্ঠ । জমি থেকে উঠে গেছে সটান । তারপরেই দুই দৃপ্ত কাণ্ড অবাধে ছড়িয়েছে আকাশের বহুদূরে - তাদের অজস্র শাখা প্রশাখা নিয়ে মুক্ত আনন্দের অকারণ লীলায়। স্পষ্টই বলছে ............দেখো দেখো আমার মুক্তি পাতায় পাতায় - আলোয় আলোয় এই আকাশে। তাদের এই অবাধ , অকারণ , আনন্দে প্রাণ ভরে যায় শান্তিতে – সকল সময়ে – সকল হতাশায় – সকল লাঞ্ছনা – সকল অপমানে।
কিন্তু এই গাম ট্রি সকলের কাছেই স্বস্তি আর শান্তির দ্যোতক নয়। প্রতি বছর বছরের গ্রীষ্ম ঋতুতে এর কদলী- কাণ্ড সম মসৃণ ত্বকটি শুকন গরম হাওয়ায় ফেটে চৌচির হয়ে যায়। -দেখে মনে হয় গায়ের চামড়া শীতের রুক্ষ হাওয়াতে যেন ফেটে গেছে। সেই শুকনো গাছের বাকল – বড় বড় আকারের – আর শুকনো ছোট ছোট ডাল সাড়া দিন সাড়া সময় ঝরে ঝরে পড়তে থাকবে পথে, বাড়ির ছাদে , সিঁড়িতে , আঙ্গিনায়, সবুজ জমির সযত্ন লালিত গালিচায়। হতকুশ্রীতে ঢেকে যায় চারিদিক। পথচারী, প্রতিবেশীদের ক্রমাগত জ্বলন্ত ভ্রূকুটিতে আমি ক্রমাগাত পুড়ি । পুড়ে যাই প্রতি বছর । কিন্তু এতো চলতে পারে না । তাই সম্মিলিত আবেদন হয়েছে। প্রশাসনে । বুক কাঁপে আমার।
বসে আছি । গাম ট্রির ছায়ায়। আজ এই ক্ষনে মনে মেঘ জমে আছে। বিষাদ বেদনায়। অতিমারী তার বিশাল ডানা বাড়িয়ে দিয়েছে ঘরের কাছেই । বন্ধুর যাবার ডাক এসেছে। শুয়ে আছে সংজ্ঞা হীন ,স্বজন বিহীন - একা- দূরে । সঙ্গী শুধু অগনিত যন্ত্রপাতি,তার , সিলিন্ডার, মুখোশ , নল। ......কখন? এখনই কি ? ---- আকাশে তাকাই – মেঘেরা ভেসে যায়- যেন বন্ধুর মুখ- কখনো চোখ চায় , কখনো নিমীলিত – আলো ঢেকে যায় এই মেঘে – মন আরও ভেঙ্গে যায় ...... যেন এই ঢাকা পড়া আলো কোন অশুভকে ডেকে আনে – যেন সংকেত – যেন যবনিকার – যেন এখনই অন্ধকার হবে রঙ্গমঞ্চ – আর কেন দেরী ? তবে কি এতক্ষণে ......?
আকাশে তাকাই । দেখি মেঘে ঠেস দিয়ে বন্ধু ভেসে যায়—রাজকীয় ভঙ্গী। গরবী ......স্কুলের পোশাকে প্রথম দিন। হাসল - মুখ খুলে – চোখে ভেজা কৌতুক—চোখ টিপল একটু - ভেসে গেল শেষ বিকেলের কমলা রঙের মেঘে ...............
তাকিয়ে দেখি টেবিলে পড়ে আছে গামট্রির মৃত্যু পরোয়ানা।