এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • গরমের ছুটি ১৩৪৪ ও তার আগুপিছু কয়েকটি দিনঃ ঠাকুরের সহিত কথঞ্চিৎ

    গৌতম চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ আগস্ট ২০১১ | ৬৯৬ বার পঠিত
  • গরমের ছুটি ১৩৪৪ ও তাহার আগুপিছু কয়েকটি দিন: ঠাকুরের সহিত কথঞ্চিৎ

    বাংলা ১৩৪৪ সাল। বৈশাখের শুরুতেই শান্তিনিকেতনে গরমের ছুটি পড়িয়া গিয়াছে। বিগত ৪বছর ঠাকুর কখনও বিশ্রামের জন্য ছুটি লন নাই। ৭৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এইবার ঠিক হইল শৈলশহর আলমোড়া যাত্রার। সেই উদ্দেশে ২৯ এপ্রিল ১৯৩৭ ঘনিষ্ঠজনের ছোট একটি দল লইয়া বাহির হইয়া পড়িলেন। এইযাত্রা প্রায় ২মাস হিমালয়ের কোলে কাটাইবেন - "কাজ ক'রে মন অসাড় যখন মাথা যাচ্ছে ঘুরে / হিমালয়ের খেলা দেখতে এলেম অনেক দূরে'। আপাতত গান আসিতেছে না। শেষ গানটি রচনা করিয়া আসিয়াছেন শান্তিনিকেতনে বসিয়া, নববর্ষের দিনে। সেইদিন আবার ছিল চিনাভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। নেহরুর আসিবার কথা ছিল। আসিতে পারেন নাই। ভাষণ পাঠাইয়া দিয়াছেন কন্যা ইন্দিরার হাতে। সেইদিনের সেই গানটি ছিল - "ওরে, নূতন যুগের ভোরে / দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে'। সময় অবশ্য এইখানে বৃথা কাটিতেছে না। একদিকে লিখিয়া চলিতেছেন বিশ্বপরিচয়-এর বিজ্ঞাননির্ভর নিবন্ধ, অন্যদিকে ছড়ার ছবি-র লঘুচালের রচনাগুলি। ছবি আঁকিতেছেন প্রচুর। মাঝে মাঝে ১টি/২টি করিয়া সেঁজুতি, নবজাতক, সানাই-এর কবিতা।

    বহুযুগ আগে এই আলমোড়াতেই রচিত হইয়াছিল শিশু কাব্যগ্রন্থের একগুচ্ছ শিশুপাঠ্য কবিতা। ছড়ার ছবি-তেও ঠাকুরের অবলম্বন হইল তেমন এক ছন্দ, যাহা "প্রাকৃত ভাষার ঘরাও ছন্দ। এ ছন্দ মেয়েদের মেয়েলি আলাপ, ছেলেদের ছেলেমি প্রলাপের বাহনগিরি করে এসেছে।' তবু মাঝে মাঝেই সেই সকল "ছড়া' তাহাদের লঘুভার কথকতা পরিহার করিয়া যেন কিছু গভীর অনুভবের কবিতা হইয়া উঠিতেছে। ঘটিতেছে স্বগতের বিনির্মাণ। কখনও দেখিতে পাই, বিজন প্রান্তরের বালুরাশির ভিতর দিয়া বহিয়া চলা শীর্ণ নদীর নি:সঙ্গতার ছবির ভিতর দিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে কবির নিজেরই অন্তর্বেদনা - "সমস্ত নি:ঝুম / জাগাও নেই কোনোখানে, কোত্থাও নেই ঘুম' (রিক্ত / ছড়ার ছবি, ২৭জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)। সেই আত্মজৈবনিক হাহাকার আরও অবিমূর্ত হইয়া উঠে, যখন সিন্ধুতীরের পাথরপিণ্ডটির কথা উঠে -

    আগুন ছিল পাখায় যাহার আজ মাটি-পিঞ্জরে
    কান পেতে সে আছে ঢেউএর তরল কলস্বরে।
    শোনার লাগি ব্যগ্র তাহার ব্যর্থ বধিরতা
    হেরে-যাওয়া সে যৌবনের ভুলে-যাওয়া কথা

                          পাথরপিণ্ড / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪

    দিনান্তবেলায় এলাইয়া পড়িয়াছে অস্তসূর্যের বিষণ্ন পট, তবু আজও "মর্ত্যধরার পিছু-ডাকা দোলা লাগায় বুকে'। কিন্তু মর্মলোকে এই বেদনাবোধ জাগিয়া উঠে কিসের জন্য? সভ্যতার যেসকল কীর্তি দিকে দিকে শক্তিমত্তার নিশান উড়াইয়া দেয়, এ-বেদনা সেসবের জন্য নহে - "অনেক কীর্তি, অনেক মূর্তি, অনেক দেবালয়, / শক্তিমানের অনেক পরিচয়। / তাদের হারিয়ে যাওয়ার ব্যথায় টান লাগে না মনে' (পিছু-ডাকা / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪ )। দেবালয়ও তাহা হইলে শক্তিমানের কীর্তিমাত্র, যাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া গেলে আজ আর হৃদয়ে কোনও টান অনুভূত হয় না? নতুন কথা বটে! বদলে, বেদনা জাগে, যখন চোখে পড়ে সামনের সবুজ বনের ছায়ায় গরু চরিতেছে, শুকনো বাঁশের পাতায় আচ্ছন্ন সরু পথটি দিয়া একটি মেয়ে ঘাসের আঁটি মাথায় হাটে চলিতেছে - "তখন মনে হঠাৎ এসে এই বেদনাই জাগে / ঠাঁই রবে না কোনোকালেই ওই যা-কিছুর মাঝে' (ঐ)। শক্তিমানের পরিচায়ক কীর্তি-মূর্তি-দেবালয় আকীর্ণ বিশ্বব্যবস্থার প্রতি এই নির্বেদ এবং বিপরীতে প্রতিদিনকার না-অসাধারণ জীবন-প্রবাহের প্রতি এই আকুতি প্রকাশের ভিতর অবশ্য কোনও তিক্ততা নাই। আছে এক নির্মল স্বীকারোক্তি।

    ছড়ার ছবির পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে চোখ চলিয়া যায় পিস্‌নি বুড়ির মর্মস্পর্শী বৃত্তান্তে। দিনের আলো না-ফুটিতেই আজ সংসার-পরিত্যক্ত তাহাকে সঙ্গোপনে গ্রাম ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে - "দূরে গিয়ে, বাঁশবাগানের বিজন গলি বেয়ে / পথের ধারে বসে পড়ে, শূন্যে থাকে চেয়ে'(পিস্‌নি / ছড়ার ছবি, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)। এই কবিতার আখ্যান অংশটি কবিকে নিশ্চয় তাড়িত করিয়াছিল। না হইলে দেখা যাইতেছে, কয়দিন পূর্বেই (২২ মে ১৯৩৭) তীর্থযাত্রিণী নামে ইহার অপর একটি কাব্যরূপ ঘটিয়া গিয়াছে। সেঁজুতি-র সেই কবিতার তীর্থযাত্রিণীও পিস্‌নি বুড়ির মতোই "প্রত্যাখ্যাত জীবনের প্রতিহত আশা / অজানার নিরুদ্দেশে প্রদোষে খুঁজিতে চলে বাসা'। অন্তিমে, পিস্‌নির মতো সেও পথের ধারে পড়িয়া থাকে নি:সঙ্গ। তবে পিস্‌নি শুধুই শূন্যের পানে তাকাইয়া রয়, আর এই কবিতার মানুষটি হয়তো শূন্যের কাছে এখনও কিছু প্রত্যাশা বহন করে - "পরিত্যক্ত একা বসি ভাবিতেছে, পাবে বুঝি দূরে/ সংসারের গ্লানি ফেলে স্বর্গ-ঘেঁষা দুর্মূল্য কিছুরে'। কিন্তু "স্বর্গ-ঘেঁষা' সেই দুর্মূল্য কিছুর প্রত্যাশার প্রতি ঠাকুরের মনোভাবটি কীরকম -

    হায় সেই কিছু
    যাবে ওর আগে আগে প্রেতসম, ও চলিবে পিছু
    ক্ষীণালোকে, প্রতিদিন ধরি-ধরি করি তারে
    অবশেষে মিলাবে আঁধারে।

                          তীর্থযাত্রিণী /সেঁজুতি, ২২ মে ১৯৩৭

    স্বর্গীয় শান্তির স্বপ্নকল্পনা তাহা হইলে মিথ্যা সান্ত্বনা মাত্র! তাহা শুধুই পার্থিব জীবনের সকল অপ্রাপ্তিকে ভুলাইয়া রাখিবার এক ছলনাময় আয়োজন, যাহা মানুষকে ভূতগ্রস্তের মতো ছুটাইয়া লইয়া চলিয়া শেষ পর্যন্ত বিলুপ্তির অন্ধকারে নিক্ষেপ করে? নতুন কথা বটে! তাহা হইতেও নতুন হইল অভিব্যক্তির এই অভাবিত তিক্ততা। একেবারেই অঠাকুরোচিত! অথচ মন যে তাঁহার খুব তিক্ত হইয়া উঠিয়াছে এমন নহে। "হংকঙেতে সারাবছর আপিস করেন মামা' (ভজহরি / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪) বা "যোগীনদাদার জন্ম ছিল ডেরাস্মাইলখাঁয়ে' (যোগীনদা / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪) ইত্যাদির মতো অনর্থলোভী ছড়া জন্ম নিতেছে। সিংহলে দেখা ক্যান্ডিদলের "আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা' নাচের কথা মনে পড়িয়া যাইতেছে। সেইসূত্রে, নটরাজের ভিতর দিয়া ব্যক্ত হইতেছে পুরুষশক্তির অদম্যতা - "নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন, / আপন শক্তি মুক্ত করে ছেঁড়েন আপন বাঁধন' (ক্যান্ডীয় নাচ /নবজাতক , জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)। সেই পুরুষসত্তার কথাই অপর একটি কবিতায় আসিতেছে এইভাবে - "পুরুষের অনন্ত বেদন / মর্ত্যের মদিরা-মাঝে স্বর্গের সুধারে অন্বেষণ' (নারী /সানাই, ১৮ মে ১৯৩৭)। আর মর্ত্যের সেই শ্রেষ্ঠ মদিরা হইল রমণীর ভিতর মূর্ত হইয়া থাকা আনন্দরস, "স্বাতন্ত্র্যস্পর্ধায় মত্ত পুরুষেরে করিবারে বশ / যে আনন্দরস / রূপ ধরেছিল রমণীতে'। এই উপলব্ধিতে আর যাহাই হৌক, তিক্ততা আছে বলা যায় না। ইহারই ভিতর, সমকালীন পৃথিবীও আসিয়া আছড়াইয়া পড়িতেছে বাতায়নে - "যুদ্ধ লাগল স্পেনে / চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে' (চলতি ছবি / সেঁজুতি, জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩৪৪)। তবু এখনও তিনি এই ধারণায় আস্থাশীল যে, বহমান কালের সহস্র পরিবর্তমানতার ভিতরও মানবচিত্তে জাগিয়া রয় কোনও এক পুরাতন ধ্রুবপদ - "যে হোক রাজা যে হোক মন্ত্রী কেউ রবে না তারা, / বইবে নদীর ধারা, /.../ তখনো সেই বাজবে কানে যখন যুগান্তর -/ "এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর' (নতুন কাল / সেঁজুতি, ২৫ মে ১৯৩৭)।

    দেহমনে ভাঙনের পদশব্দ, তথাপি আলমোড়া হইতে শান্তিনিকেতন ফিরিবার পর নানান কর্মকাণ্ডে জড়াইয়া পড়িতেই হয়। সহসা মন উতলা হইল, দিনকয়েকের জন্য একবার পতিসর মহাল ঘুরিয়া আসিবার জন্য। শান্তিনিকেতনের রাঢ়ভূমি হইতে বরেন্দ্রির খাল-বিল-নদী-নালা ঘেরা সেই শ্যামল জনপদে। সেই গহন জলযাত্রার পূর্বেকার স্মৃতি তো তাঁহাকে ছাড়ে নাই -

    আমারও পথ হাঁসের যে-পথ, জলের পথে যাত্রী,
    ভাসতে যাব ঘাটে ঘাটে ফুরোবে যেই রাত্রি।
    সাঁতার কাটব জোয়ার-জলে পৌঁছে উজিরপুরে,
    শুকিয়ে নেব ভিজে ধুতি বালিতে রোদ্‌দুরে।

                          জলযাত্রা / ছড়ার ছবি, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪

    নাগর নদের তীরে এই পতিসরে ইতিপূর্বে জমিদারির কাজে কতবার কত না দিনরাত্রি কাটাইয়াছেন। সেখানকার কাছারিবাড়িতে বা নদীতে বোটের বুকে বসিয়া লিখিয়াছেন কত না অবিস্মরণীয় রচনা। কিন্তু এখন তো জমিদারির কাজ কিছুই নাই। শুধু সেখানকার পরিচিত মানুষজনের সাথে, প্রকৃতির সাথে, একবার দেখা করিয়া আসা। কেহ কি জানিত, ইহাই তাঁর এতদঞ্চলে শেষ সাক্ষাৎকার। তাঁহার প্রজাবৃন্দ কি কিছু টের পাইয়াছিলেন? নহিলে, ফিরিবার পথে সাশ্রুনয়নে তাঁহারা ঠাকুরের বোটের পাশাপাশি নদীতট ধরিয়া পতিসর হইতে আত্রাইঘাট পর্যন্ত হাঁটিতে হাঁটিতে আসিবেন কেন! সে কি শুধু এই কৃতজ্ঞতাবশে যে, স্থানীয় কৃষকদের জন্য তিনি সেই দুর্গম পল্লীঅঞ্চলে কৃষিব্যাংক স্থাপন (১৯০৫) করিয়াছিলেন। আর, নোবেল পুরস্কারে প্রাপ্ত অর্থ হইতে এক বিপুল অংক এই কৃষিব্যাংকে জমা করিয়াছিলেন (১৯১৩)। মনে হয়, না। রাজশাহী জেলার তৎকালীন জেলাশাসক অন্নদাশংকর আসিয়া আত্রাইঘাটে কবির সহিত মিলিত হন। তাঁহাকে অভিভূত ঠাকুর বলেন, "ওরা কী বলে জানো? বলে, পয়গম্বরকে তো আমরা চোখে দেখিনি। আপনাকেই দেখেছি'।

    হায়, সেই "পয়গম্বর'এর দেশকালও তো বজ্রগর্ভ। স্মৃতি বা স্বপ্ন ব্যতীত শান্তির অবকাশ কোথায়। পতিসরের নাগর নদীর মতোই একদা পদ্মার বুকে কাটানো দিনগুলির স্মৃতিও আজতক চিরঅম্লান। আলমোড়াতে বসিয়া তাই লিখিয়াছিলেন -

    আমার নৌকা বাঁধা ছিল পদ্মানদীর পারে,
    হাঁসের পাতি উড়ে যেত মেঘের ধারে ধারে -
    জানি নে মন-কেমন-করা লাগত কী সুর হাওয়ার
    আকাশ বেয়ে দূর দেশেতে উদাস হয়ে যাওয়ার।
    কী জানি সেই দিনগুলি সব কোন্‌ আঁকিয়ের লেখা,
    ঝিকিমিকি সোনার রঙে হাল্‌কা তুলির রেখা।

                          পদ্মায় /ছড়ার ছবি, ৬।৬।১৯৩৭ (২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪)

    কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামের সেই সোনার রঙে আঁকা দিনগুলি আজ কই? আসিয়া পড়িয়াছে যে "নতুন কাল'! সেই নতুন কালের আকালের কালো ছায়া আসিয়া ঢাকিয়া দিয়াছে বাংলার সকরুণ মুখ। সামান্য রুজি-রুটির খোঁজে মানুষ চলিতেছে শহরের অভিমুখে, দিশাহীন -

    প্রাণ-ধারণের বোঝাখানা বাঁধা পিঠের 'পরে,
    আকাল পড়ল, দিন চলে না, চলল দেশান্তরে।
    দূর শহরে একটা কিছু যাবেই যাবে জুটে,
    এই আশাতেই লগ্ন দেখে ভোরবেলাতে উঠে
    দুর্গা ব'লে বুক বেঁধে সে চলল ভাগ্যজয়ে...

                          দেশান্তরী / ছড়ার ছবি, আষাঢ় ১৩৪৪

    আর শহর-গঞ্জের হালই বা কী? নতুন কাল কি সেইখানেও নিজেকে জানান দিতে ছাড়িতেছে? -

    এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার
    মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার
    ধর্মঘটে বাঁধল কোমর সাহেব দিল ডাক,
    বললে, মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক?।
    দলের সঙ্গে যোগ দিলে শেষ মরবি-যে মার খেয়ে।
    মাধো বললে, মরাই ভালো এ বেইমানির চেয়ে

                          মাধো / ছড়ার ছবি, শ্রাবণ ১৩৪৪

    এই "আলগোছে' না-থাকিতে পারার সংকট তো আসলে চটকলের মজুর মাধোর নহে, তাহা ঠাকুরেরই নিজের। তাই দেশের নানান সামাজিক-রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে এই বুড়া বয়সেও কেবলই জড়াইয়া পড়িতে হয়। মাধো হয়তো একটি মনগড়া নাম, কিন্তু চটকলের যে-ধর্মঘটের কথা ওই ছড়ায় আমরা পড়ি, তাহা আদৌ কবিকল্পনা নহে। আসলেই সেই বছর (১৯৩৭) ফেব্রুয়ারি মাস হইতে হাওড়ার ফোর্ট উইলিয়াম, হাওড়া মিলস, গ্যাঞ্জেস জুট মিলস-এর মতো কয়েকটি চটকলের কয়েক সহস্র শ্রমিক ন্যায্য মজুরি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনসন, স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদির দাবিতে ধর্মঘটে সামিল হইয়াছিলেন। এক পর্যায় যখন মিল-মালিকদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষধোঁয়া ছড়াইয়া সেই ধর্মঘট বাঞ্চাল করিবার প্রয়াস দেখা গেল, তখন মর্মাহত ঠাকুর আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। দেশবাসীকে ধর্মঘটী শ্রমিকদের পাশে আসিয়া দাঁড়াইবার আহ্বান জানাইয়া বলিলেন -

    ...Humanity demands that those who bear the burden of the society should be protected and looked after by the society itself. To give this strike a communal turn by stirring up ugly communal poisons should be condemned by every right-thinking man.

    I appeal to my countrymen to help the jute-workers and their helpless women and children in this period of their suffering and distress. In Defence on the Workers on Strike, 29 April 1937

    প্রিয় পাঠিকা, প্রিয় পাঠক, ধর্মঘটী শ্রমিকদের সমর্থনে দেওয়া এই বিবৃতির তারিখটি আমরা একটু খেয়াল করিতে পারি। হ্যঁ¡, ২৯ এপ্রিল ১৯৩৭, গরমের ছুটিতে "বিশ্রাম' লইবার উদ্দেশ্যে যেদিন তিনি আলমোড়া যাত্রা করিতেছেন। ফিরিয়া, কিছুদিন শান্তিনিকেতন থাকিয়া আবার পতিসর। পতিসর হইতে কলিকাতায় ফিরিতে না ফিরিতেই খবর পাইলেন, সুদূর আন্দামানের কারাগারে বাংলাদেশের ১৮৭জন বিপ্লবী বন্দি তাঁহাদের মুক্তি এবং দেশের মূল ভূখণ্ডে ফিরিবার দাবিতে অনশন শুরু করিয়াছেন। "আলগোছে' থাকা হইল না তাঁহার। অনশনরত বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ডাকা টাউন হলের জনসভার (২ অগস্ট ১৯৩৭) সভাপতির আসনে গিয়া বসিতে হইল তাঁহাকে। তাঁহার বক্তৃতায় সরকারের মনোভাবকে "ফাসিস্ট' বলিয়া নিন্দা করিলেন তিনি। আর, বন্দিদের তারবার্তা পাঠাইয়া, তাঁহাদের প্রতি সারা বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা, সমর্থনের কথা, জানাইয়া দিলেন।

    আমরা অত:পর ১৩৪৪ সালের শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি আসিয়া পড়িয়াছি। এইবার ঠাকুর বর্ষামঙ্গলের গান লইয়া মগ্ন হইয়া পড়িবেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৪ আগস্ট ২০১১ | ৬৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন