(এ লেখাটা বেশ কয়েক মাস আগের। সেসময় বড্ডো অকারন মনকেমনে ভুগছিলাম আমি। সেই মনকেমন কাটাতেই কলম ধরেছিলাম। তারপর সে লেখা চাপা পড়ে গিছলো উচ্ছল সব রচনাতে। আজ সেটাই ঝেড়ে মুছে তুলে আনলাম ডাইরি থেকে। এটা আদতেও "নারীদিবসের" লেখা হয়তো নয় প্রথাগত অর্থে। কিন্তু তলিয়ে যদি পড়েন....)
মনকেমন করা আমার একটা স্বভাব। কথা নেই বার্তা নেই সমস্ত কিছু দূরে ছুঁড়ে দিয়ে ফেলে, চোখ মুখ নাক, বিষাদ-আদর লটর পটর ঝুলে, আমি মন কেমন আঁকড়ে ধরে ঝুপ্পুস হয়ে বসে থাকি । পন্ডিতেরা বলেন এসব নাকি বাইপোলার ডিসঅর্ডার। হবেও বা। আমি কি আর অতশত জানি? আমি শুধু এইটুকু জানি যে, এইসব মনখারাপীয়া রাতগুলো আমার বড্ডো প্রিয়। আমি ত্যাবড়ানো বালিশ মুখ গুঁজে, ডিগডিগে ঠ্যাং দোলাতে দোলাতে এলোমেলো হাবড়ি জাবড়ি ভাবি। মনখারাপের নরম চাদর আমাকে আঁকড়ে ধরতে ধরতে একসময় মোলায়েম ঘুম পাড়িয়ে দ্যায়। গোলটা বাঁধে সকাল বেলায় উঠে। কপালের ফেরে আমি চিকিৎসক। রোজ সকালে আমার আউটডোর থাকে। সেখানে হোক না হোক ডেইলি একশো দেড়শো রুগী হয়। আমাকে, আমির মনকেমন লুকিয়ে রেখে হেসে হেসে কথা বলতে হয় এদের প্রত্যেকের সাথে। অ্যাতো না হাসলেও চলতো, কিন্তু ডাক্তার হিসাবে আমি বেজায় রকমের খাজা। ওষুধের সাথে তাই " ভুবনভোলানো" হাসি ফ্রি। মন এদিকে অযথা মনকেমনে টসটসে টইটুম্বুর হয়ে আছে টুবটুবিয়ে, পালাতে ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে হুড়মুড়িয়ে, ওদিকে, বাইরের আমিটা, গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে দাঁত বত্রিশ কেলিয়ে বলে চলেছে--" নিজে তো সোয়েটার পরে ঘুরে ব্যাড়াচ্ছো..বাচ্চাটার গায়ে গরম জামা নেই ক্যানো?" অদ্ভুত এই সময়গুলোতে,আমার বড়ো অস্থির লাগে। আর তখনই আমি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে বোলাই--" আর তো কিছুক্ষণ রে পাগলা, আর তো একটুক্ষণ...তারপরেই রাউন্ড দিতে যবি" । আউটডোর শেষ করে রাউন্ড দেওয়াটা, আজও এখনও আমার সবচাইতে প্রিয় কাজ। ইনডোরে ঢুকলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। একদল মারণব্যধি আক্রান্ত পুরুষ মহিলা, সেখানে একটু একটু করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দ্যাখে প্রতিদিন। টিবি, এমনিতে ওষুধ খেলেই সেরে যায় পুরোপুরি। কিন্তু যাদের মাল্টি ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট টি বি, তাদের ভাগ্য, এখনও অব্দি অতটাও সুপ্রসন্ন নয়। নাগাড়ে ওষুধ ইন্জেকশন চলে একবছর থেকে দু বছর। গোটা সাতেক কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক, একটা করে বেদনাদায়ক ইন্জেকশন। এত কিছু করেও, সব সময় রোগী সুস্থ্য হয়ে ওঠে না। তারউপর, এসব ওষুধের সাইড এফেক্টও মারাত্মক। ( এই সুযোগে বলে নি, টিবি হলেই নিকটবর্তী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করে সরকারি ওষুধ খান। এম ডি আর টিবি থেকে বাঁচুন)। আমার হাসপাতালে, এই এম ডি আর টিবি রোগীর সংখ্যাই বেশি। এম ডি আর মেল এম ডি আর ফিমেল। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে চলা একদল ছেলে আর মেয়ের ওয়ার্ড। এমনি অর্থাৎ সাধারন টিবি পেশেন্টও থাকে অবশ্য গোটা পাঁচেক। তারা থাকে বিচিত্র এবং বিবিধ কারণে। প্রথম কারণটা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি বোধগম্য। এরা বাড়ি ফিরলেই নেশা ভাঙ করে শরীর নষ্ট করবে। তাই, বাড়ির লোক সব্যসাচীর "কড়া শাসন" এ ফেলে রেখে চলে গ্যাছে। বেশ সোজা এন্ড সাপ্টা টু আন্ডার"ইস্ট্যান্ড"। দ্বিতীয়টি, সে তুলনায়, কল্পনা করা কঠিন। এরা থাকে স্রেফ দুবেলা ভরপেট খেতে পাবে ব'লে। ভাবতে পারেন? একটা মানুষ, নিজের আত্মীয় পরিবার পরিজন ছেড়েছুড়ে দিয়ে, নাগাড়ে ছ মাস ন মাস হাসপাতালে পড়ে থাকছে শুধু ভাতের আশায়? এরপরেও আপনি আমি বিপ্লব কপচাই, "ডি.এ "বেশী না কম দাবী করি, হাফ প্লেট চাউমিন অবহেলায় ফেলে রেখে আসি রেস্টুরেন্ট প্লেটে। এরা, বেশিরভাগই চা বাগান শ্রমিক। টেম্পুরারি। মাস গেলে উপার্জন করে সাকুল্যে হাজার টাকা। একদিন কাজ পেলে, তিন দিন পায় না। তিন কাজ পেলে...সাতদিন.... বিপ্লব..আপনার পকেটে গুঁজে রাখুন। কিছু যদি করতেই হয়, "জিন্দাবাদ" না চিল্লিয়ে, নিজের নাগরিক দায়িত্বটুকু পালন করুন। সঠিক ট্যাক্স দিন, অফিসে খাটুন, সৎ থাকুন, আরো আরো লোভ ছাড়ুন। যাক গে, থোড়া যাদা হো গ্যায়া। এভাবেও বলতে চাই নি আমি। আসলে, দারিদ্র্যকে, খুব কাছ থেকে দেখছি তো প্রতিদিন। তাই ডি এ নিয়ে বুলি কপচানোকে আমার বড়ো নগন্য মনে হয়। তাই, এদের নিয়ে বলতে গেলে, আমি কটুভাষী....রূঢ়ভাষী হয়ে উঠি নিজের অজান্তেই... থাক সেসব। বরং অন্য গল্প বলি। রাউন্ডের গল্প। গতকাল রাত্রি থেকে আমার মনখারাপ। এ মনখারাপের কোনো কারণ নেই, নেই কোনো সঠিক তত্বতালাশ। কিম্বা হয়তো আছে...সব কিছুটাই বলাটা উচিত নয় কিছু কিছু দাগ গোপন থাকুক,একলাটে পরাজয়। ওই যেরকমটা শুরুতে বলেছি আর কি! আর তাইই, আজও, আউটডোরে আমি, দাঁতে দাঁত অপেক্ষা করছিলাম-- রাউন্ডের। আমার আশা খুঁজে পাওয়ার একমাত্র মুহূর্তের। বিফল..... হই নি। দোতলা বাড়িটার একতলার ডান দিকে, এমনি টিবি রোগীদের ওয়ার্ড। এম ডি আর নয়। এমনি। রাউন্ডের সময় আমার শ্যেনদৃষ্টি থাকে খরখরে। রোগীর খোঁজখবরের সাথে সাদেই, শকুনের মতো নজর খুঁজে বের করতে থাকে--- " ভাতের থালায় ভাত পড়ে আছে কি না....বালিশের নিচ থেকে ওটা কি খৈনির প্যাকেট উঁকি মারছে?" আজ ধরা পড়লো অন্য জিনিস। একটা বই। বইটা পড়ছিলো সাহেব টোপ্পো। সাহেব এখানে আছে মাস চারেক হলো। আছে-- ভাতের আশায়। প্রথমদিকটায় সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকতো। এখন, অনেকটাই সামলে নিয়েছে নিজেকে। বাদ বাকি হা ভাতে দের সাথে মিলেমিশে "বাঘ ছাগল" খেলে সময় কাটায়। টুকটাক রেডিও শোনে। কোথ্থেকে একখান তুলসী গাছ জোগাড় করে এনেছে সবাই মিলে। সন্ধ্যেবেলায়, তাতে ধূপ দ্যায় জোড় হাত ক'রে। সকাল বেলায় গাছের চারপাশে পড়ে থাকে খয়রি রঙের ছাই। লম্বা লম্বা। সাহেব, মিশনারি দিক্ষীত। ইংরেজি লিখতে পারে কাজ চালানোর মতো। কিন্তু আজ, হাতের বইটা মনে হলো -- বাংলা। কার্ডবোর্ড বাঁধাই। মলাট উধাও। আমাকে দেখেই বন্ধ করে দিলো ফট করে। আমি একটু এগিয়ে বললাম--" কি বই..দ্যাখা দ্যাখা." ( তুইই- বলি, এরা আদিবাসী, এরাও আমাকে তুই বলে) । সাহেব দোনোমনা করে খুলে দ্যাখালো। এক ঝটকা। তারপরই বন্ধ করে দিলো আবার। আমি অবশ্য ওর মধ্যেই শিরোনাম দেখে নিয়েছি--" কোকশাস্ত্র" । খ্যাঁক করে হাসি পেয়ে গিছলো। পেছনে, সিস্টার ছিলো বলে সামলালাম কোনোমতে। "শাল্লা..কোকশাস্ত্র.. হি হি" । কিন্তু মন , শালা বড় আজব রকমের বস্তু মশাই। সাহেবের রুম ছেড়ে বেরোনোর আগেই, খ্যাঁকখ্যাঁকিয়া হাসি আচমকা পাল্টে গ্যালো ভাবালু দর্শনে। সাহেব, খেতে পায় না। সাহেব, প্রতিদিন পাছাতে একটা করে মোটা ইন্জেকশন খায়। সাহেব, প্রতিদিন গেলে, আট আটটা কড়া বড়ি। সাহেব জানে, ওর মেয়াদ আর চার মাস। তারপরেই ছুটি। এমন ছুটি, যেটা ও চায় না। এমন ছুটি, যার পরে আবার তিনবেলায় একবেলা ভরপেট খাওয়ার যন্ত্রণা। তাও, ও কোকশাস্ত্র পড়ছে। বেশ করছে। সাব্বাশ সাহেব। সাব্বাশ। এই স্বপ্নটুকু দেখতে পারিস বলেই তুই-- শ্রেষ্ঠ জীব। তুই-- মানুষ। পায়ে পায়ে উঠে এলাম দোতালায়। সাহেবদের ঠিক মাথার উপর এমনি টিবি ফিমেল। সেখানে আপাতত একটাই পেশেন্ট। মরিয়ম ওরাঁও। মরিয়মের বয়স সাতাশ। ওজন একুশ। অসম্ভব অপুষ্টিতে ভোগা একটা মানুষ। হঠাৎ দেখলে ভ্রম হয়-- বুঝি কাঠের টুকরো। কিন্তু মরিয়ম মানুষ। মরিয়মের চোখের কোণে পিঁচুটি, মরিয়মের নারীত্ব নেই কিছুটি। আছে-- একটা স্বামী। স্বামীটির বয়সও ওই সাতাশ আঠাশই হবে। রোগা লম্বা তেলচুল নীলজামা। প্রথম যেদিন হিস্টরি নিচ্ছিলাম, সেদিনই লজ্জা লজ্জা মুখে বলেছিলো-- " বিয়ের চারমাস পরেই বাচ্চা হয়েছে স্যার" । ঘরে ঢুকেই দেখলাম মরিয়ম হাত মুঠো করে কি একটা ধরে রেখেছে। সিস্টার বললো-- চিরুনী। আমার বিশ্বাস হলো না। বললাম--" হাত খোল" মরিয়ম খুললো না। পিঁচুটি চোখে চেয়ে রইলো আমার দিকে নির্ণিমেষে। অনেক জোরাজুরির পর, খুলে দ্যাখা গ্যালো-- ওটা চিরুনী নয় মোটেই। ওটা-- ছুরি। মারিয়মের বর দাঁড়িয়েছিলো পাশেই। রাউন্ডের সময় প্রতিদিনই থাকে। গত দেড়মাসে অন্যথা দেখিনি একদিনও। অন্যান্য দিন চুপচাপই থাকে। আজ মাথা নিচু করে মুখ খুললো-- " কাল নেহি আয়া থা স্যার..ভোট দেনে গ্যায়া থা..ইসি লিয়ে গুস্সা কিয়া মেরে উপর...থোড়া ডাঁট দিজিয়ে না স্যার..বোল রহি হ্যায় কে খুদখুশী করেগী" । মারিয়মকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যখন বেরোচ্ছি, আমার মনের ভেতর টলটল করছে জল--- " এত প্রেম..এরম প্রেমও হয়? " মরিয়ম হয়তো বাঁচবে না..এদের সমাজে দ্বিতীয় শয্যাসঙ্গী/নী বেজায় স্বাভাবিক...কেউ বলবে না কিচ্ছুটি...তাও.....তবুও....এরম প্রেমও হয়? মরিয়মের পাশের ওয়ার্ডটা 'এম ডি আর -ফিমেল'। ওই যাদের সুস্থ্য হওয়ার সম্ভাবনা--ষাটভাগ। এখানেই আছে বর্ষা কুজুর। বর্ষা, গত দুবচর ধরে এইখানেই আছে। ওর রোগ আমরা সারাতে পারিনি এখনো। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট থেকে খারাপ হতে হতে বর্ষা এখন এক্সট্রিমলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগী। বাড়ির লোক ফেলে দিয়ে গ্যাছে এখানে। লোক বলতে-- দাদা। আর কেউ কোথ্থাও নেই। দাদা নিজে মাসে দেড়হাজারিয়া বেতন পায়। বোনকে রাখবে, এ সাধ্য তার নেই। ভাই দুজ এর দুইদিন খালি বাড়ি নসীব হয় বর্ষার। সেরে গেলে..সুস্থ্য হলে...হয়তো শেয়াল কুকুরে খাবে। তবুও বর্ষা সাজে। নখে পরে শস্তা নেলপালিশ অন্যের থেকে ধার করে। চুলে পাকায় কায়দা। বর্ষার সাথে সাথেই আরেকখানি মেয়ে আছে পরিত্যক্ত। নিয়তি সেন। তো, আজ দেখলাম বেডে দুজনেই নেই। বাকিরা বললো--" ওরা ওই দিকে আছে স্যার।" বাকিরা বলতে বাকি ফিমেল এম ডি আর রা। আর ওই দিকটা বলতে-- রুমের বাইরের কোণাটে মার্কা বারান্দা। পা টিপে টিপে গেলাম সেই দিকেই। মাল দু'টো কি করছে, দেখে আসা দরকার। বারান্দায় আচমকা উঁকি মেরে চমকেই গেলাম। রেডিওতে গান বাজছে-- " আনা মেরে প্যায়ার কো না তুম ঝুঠা সামঝো জানা সনম তুঝে পা নে কা ইয়ে থা সারা বাহানা" গানের তালে তালে তিড়িং বিড়িং নাচছে বর্ষা নিয়তি। আমাকে দেখতে পেয়ে লজ্জায় মুখ ঢেকে মাটিতে বসেই পড়লো। আঙুলের ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো ইকিড় মিকিড়। আমি হেসে ফিরতি পথ ধরলাম। আমার মন ভালো হয়ে গ্যাছে। ( বর্ষা বর্তমানে সুস্থ। এবং তার চাইতেও আনন্দের খবর, বর্ষার দাদা ওকে বাড়ি নিয়ে গেছে)