এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দেবোত্তম চক্রবর্তী | 11.39.***.*** | ০২ এপ্রিল ২০১৬ ১৯:১৩704574
  • কাক এসেছে রামায়ণে, তাও একাধিকবার। কৃত্তিবাসী রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে উল্লেখ রয়েছে ‘জয়ন্ত’ নামে এক মস্তান কাকের যে ‘দুই নখে আঁচড়ে সীতার দেহখানি’। এহেন অন্যায় কাজ করে কাক তো পালিয়ে পথ পায় না। রাম-লক্ষণও তাকে উচিত শিক্ষা না দিয়ে ছাড়বেন না। কাক প্রথমে গেল কৈলাস, তারপর সেখান থেকে পালিয়ে স্বর্গে ইন্দ্রের কাছে সে আশ্রয় নিল। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রামচন্দ্রও গেলেন ইন্দ্রের কাছে এবং সটান বললেন যে জয়ন্ত কাক “ করিয়াছে মন্দ কর্ম বধিব জীবন। / রক্ষিবে যে জন কাক তাহারি মরণ ।। ” রামের রূদ্ররূপ দেখে “ রাখিতে নারিল কাকে দেব পুরন্দর। / আনিয়া দিলেন কাকে বাণের গোচর ।। ” তাকে রামচন্দ্র অবশ্য প্রাণে মারলেন না শুধু ‘বিন্ধিয়া করিল তার একচক্ষু কাণ’। তারপর থেকেই নাকি কাক কানার মতো একদিকে ঘাড় হেলিয়ে তাকায় !

    আবার নবান্নের প্রচলিত প্রথা কাকবলির উৎসও সম্ভবত রামায়ণ। নবান্নের নির্দিষ্ট দিনটিতে গৃহস্থের পিতৃপুরুষের উদ্দেশে কলাপাতায় নতুন ধানের চাল, ফলমূল, মিষ্টি ইত্যাদি কাককে বলি বা ভোজ্য দেওয়ার প্রথাই কাকবলি। প্রসঙ্গত হিন্দুদের শ্রাদ্ধের হবিষ্যিও কাককে খাওয়ানোর প্রথা আছে। দুটি ক্ষেত্রেই মনে করা হয় যে কাক বলি গ্রহণ করার অর্থ স্বর্গত পিতৃপুরুষের অন্নজল গ্রহণ করা। এমত বিশ্বাসের কারণ হিসাবে কৃত্তিবাসী রামায়ণেরই উত্তরাকাণ্ডের অষ্টাদশ সর্গে দেখি রাবণ রথে চড়ে মরুত্তরাজার যজ্ঞস্থলে পৌঁছতেই দেবতারা ভয়ে কেঁপে উঠে যে যার মতো পাখির রূপ ধরেন : “ ইন্দ্র হন ময়ূর, কুবের কাঁকলাস। / যম কাকরূপ হন বরুণ সে হাঁস ।। ” রাবণ যজ্ঞস্থল ছেড়ে যাওয়ার পর দেবগণ পুনরায় স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন এবং প্রাণরক্ষার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ পাখিদের ঢালাও আশীর্বাদ দিলেন। মৃত্যুর দেবতা যমদেব কাককে বললেন : “ যেইজন যোগাইবে তোমার আহার। / যমলোকে তৃপ্তি তার হইবে অপার ।। ” এই কারণেই কাকের অন্য নাম বলিপুষ্ট বা বলিভুক্‌। আর বছরের বাকি ৩৬৪ দিন কাককে যতই হতছেদ্দা করা হোক, নবান্নের দিন তার আদর-যত্ন সৃষ্টি করেছে ‘নবান্নের কাক’ শব্দবন্ধটির যার খুব কাছাকাছি শব্দগুচ্ছ হল ‘ডুমুরের ফুল’। এই কাকবলি প্রসঙ্গেই কবিতাপ্রেমীদের অবধারিতভাবে মনে পড়বে জীবনানন্দ : “ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে / কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় ” (আবার আসিব ফিরে) কিংবা আরও বিস্তৃতভাবে একটি সম্পূর্ণ স্তবক জুড়ে ‘১৯৪৬-৪৭’ কবিতায় : “ এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে; / নতুন চালের রসে রৌদ্রে কত কাক / এ-পাড়ার বড়ো মেজো... ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের / ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত; / এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও; / মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়; / সময়ের হাতে অন্তহীন ”।

    রামায়ণের পাশাপাশি মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বে কৌরবপক্ষের শেষ প্রতিহিংসার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে কাক। এখানে অবশ্য তার অবদান প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। দুর্যোধনের উরুভঙ্গ হয়েছে, একে একে সব কৌরবপক্ষীয় সেনাপতি নিহত হয়েছেন। বেঁচে আছেন কেবল কৃপাচার্য, কৃতবর্মা এবং অশ্বত্থামা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অশ্বত্থামা সেনাপতি নির্বাচিত হলেন এবং রাত্রিবেলাতেই পাণ্ডবশিবিরের দিকে চললেন। কাশীরাম দাস তাঁর অমর লেখনীতে লিখছেন :
    “ হেনমতে কত দূর যায় তিন জন।
    বৃক্ষতলে বসি করে কথোপকথন।।
    হেনকালে তারা সেই বৃক্ষের উপরে।
    দারুণ পেচক পক্ষী পায় দেখিবারে।।
    বৃক্ষোপরে অবস্থিতি করে মৌনভাবে।
    ভাবে, কতক্ষণে সবে নিদ্রিত হইবে।।
    দেখিতে দেখিতে যত বায়সাদিগণ।
    ঘোর নিদ্রাবশে সবে হয় অচেতন।।
    অমনি পেচক দুষ্ট হ’য়ে অগ্রসর।
    মারিয়া ফেলিল যত বিহগনিকর ।। ”
    এ দৃশ্য দেখে অশ্বত্থামা ‘এক বুদ্ধি পাইলাম কৃপাচার্য্য মামা’ বলে উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন এবং ঘুমন্ত পাণ্ডব শিবিরে অতর্কিতে আক্রমণ চালালেন। রাতের অন্ধকারে শ্রীকৃষ্ণ এবং পঞ্চপাণ্ডব ভেবে যাদের মাথা কেটে ফেললেন, দিনের আলো ফুটতে দেখা গেল সেগুলি ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রের মাথা। অবশ্য সেসব অন্য কথা।

    আর রামায়ণের কাক হয়েও যে কাক মহাভারতকেও সংযুক্ত করে দেয় সে কাক ভুশুণ্ডীকাক। অবশ্য এ-কাক কৃত্তিবাসী নয়, যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণের ‘নির্বাণ প্রকরণ’-এর কাক। ‘বুড়ো আংলা’-য় অবনীন্দ্রনাথ চমৎকার বর্ণনা দিচ্ছেন – “ পৃথিবীর আদিকাক হল ভুষুণ্ডিকাক, তারি বংশ ভুষুণ্ডে বা ভুষো, দেখতে কালিঝুলি, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি এই কাকের বংশ চলে আসছে – এদেরই পূর্বপুরুষ রামের সঙ্গে লড়ায়ে একচোখ হারিয়েছিল, সেই থেকে এদের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছে ...” । হয়তো সে কারণেই বয়োবৃদ্ধ,বহুদর্শী ও বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি বোঝাতে ‘ভুশুণ্ডির কাক’ শব্দবন্ধের ব্যবহার। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত যোদ্ধার রক্তপায়ী এই ত্রিকালজ্ঞ কাক যেভাবে দুই মহাকাব্যকে সংযুক্ত করে দেয় তা চমৎকার দেখিয়েছেন ‘ পৌরাণিক অভিধান’-এ সুধীরচন্দ্র সরকার “ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে শ্রীকৃষ্ণ ভুশুণ্ডীকে যুদ্ধের বিবরণ জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দিয়েছিল, সত্যযুগে শুম্ভ-নিশুম্ভ যুদ্ধে বিনা আয়াসে সে দৈত্যরক্ত পান ... করেছিল। ত্রেতাযুগে লঙ্কাযুদ্ধে তাকে অল্প পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তার কষ্টের সীমা ছিল না ” ।

    চলবে...
  • Abhyu | 81.9.***.*** | ০২ এপ্রিল ২০১৬ ২৩:০৮704575
  • খুবই ভালো লাগছে পড়তে।
  • Debabrata Chakrabarty | ০২ এপ্রিল ২০১৬ ২৩:২১704576
  • কিন্তু পর্ব ২ এ কেউ মন্তব্যই করেন নি । আপনি লিখুন দেবোত্তম অনেকেই পড়েন সকলে হয়ত মন্তব্য করেন না । আমারও বেশ ভালো লাগছে ।
  • Ekak | 212.62.***.*** | ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ১০:৪৪704577
  • সবকটাই পড়ছি :) এক টা "পর্বে পর্বে কাক " খুলে লিখতে পারতেন । আলাদা আলাদা টই তে কাক্বিহার করে বেড়াতে হত না ।
  • b | 135.2.***.*** | ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ১১:০০704578
  • দাঁড়ান। আরেকটা গল্প ছিলো। সত্যযুগের কোনো স্বর্গবাসী রাজা, পুণ্যের ক্রেডিট কমে যাওয়ায় ইন্দ্রকে জিগ্গেস করে জানতে পারলেন, যতদিন মর্তে বসবাসকারী একজন প্রাণীও সেই রাজার কীর্তি মনে রাখবে, ততদিন স্বর্গে ফ্রিতে থাকা যাবে, নইলে ফুডিং লজিং অপ্সরাইং সবেতেই পার ডিয়েম চার্জ লাগবে। এর পরে সম্ভবতঃ নাড়ীজঙ্ঘ নামের বক, ভুষণ্ডী কাক আর কোন এক কচ্ছপকে একে একে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ক্রমশঃ একে অপরের থেকে প্রাচীনতর। শেষে কচ্ছপ (নাকি কাক) রাজার যজ্ঞের কথা মনে করতে পারে।
    মহাভারতের গল্প। ডিটেলটা মনে পড়ছে না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন