এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 204.23.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৭:৫৬681655
  • নতুন গলপো?
  • অকার | 192.66.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৭:৫৭681666
  • মেয়েটার তখন তিন বছর বয়েস, মেয়েটার দিদি পাঁচ। পরের বোনটা জন্মাতে গিয়েই মরে গেল, আর সেই সঙ্গে মেয়েটার মা-ও। এবার বোঝো ঠ্যালা, আরে দু-দুটো দুধের মেয়েকে বড় করবে কে? সে হোক না যতই তখনকার দিনের একান্নবর্তী সংসার, তলে তলে তো সেই যার যার তার তার। মেয়েটার মামাবাড়ি ছিল মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, লেখাপড়ারও চল ছিল ভালোই, তারা বলল, “আমরাই লইয়া যাই মাঐমা, হ্যারারে লইয়া আপনাগো ভাবতে অইব না”।

    মেয়েটার ঠাকুমা ছিলেন দাপুটে। অল্প বয়সে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে বিধবা হয়েছিলেন, তারপর কারো কাছে কোনো সাহায্য টাহায্য না পেয়ে তখনকার কালে যা ভাবাও যেত না সেই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে কোথাকার কোন রাজবাড়ি না জমিদারবাড়ির বউ-মেয়েদের রেসিডেণ্ট গভর্নেস হতে চলে গিয়েছিলেন। সেই রোজগারেই সংসার পালন, ছেলেপুলে বড় করা। ছোটটা যদিও অমানুষ হয়েছিল, সে যাক্ গে।
    তা তিনি রাজি হলেন না। মেয়েটা রয়ে গেল এ বাড়িতেই। তার চিররুগ্ন দিদিটাও রইল। আর রইল তাদের মরা মায়ের সিন্দুক ভর্তি ভারি ভারি সোনার গয়না, দামি দামি সিল্ক আর বেনারসি। মেয়ে দুটোর কথা কারো মনে থাকুক আর না থাকুক, পালা-পার্বণ বিয়ে থা লাগলেই সিন্দুকটার কথা সবার মনে পড়ে যায়।

    “অমুকের পোলার বিয়া না, অর বউরে সোনা দেওনের লাগে ত, বাইর কর দেখি মাইজ্যা বউয়ের সীতাহারখান। এই ল, আধখান ভাইঙ্গা দিলাম, স্যাকরারে কইস একখান পাটিহার গড়াইয়া দিবো ভালা দেইখ্যা।“
    কিংবা যার সোনা পাওয়ার যোগ্যতা নেই তার জন্য একখান রেডিও সিল্কের শাড়ি, “মাইজ্যা বউ পরেই নাই কুনদিন, এক্কের নতুন আছে ত!”

    মেয়েটা ছোট্ট হলে কী হবে, খুব কটকট করে কথা বলে, কাউকে রেয়াত করে না। ওইটুকু বয়েসেই বুঝে গেছে নিজেরটা নিজেকেই লড়াই করে জোটাতে হবে। দিদিটা শান্ত, ভীতু। চুপ করাতে চেষ্টা করে, কিন্তু মেয়েটা শোনে না। একবার তাকে জব্দ করার জন্য ট্রাংকে বন্ধ করে দিল পিসতুতো দাদারা, তারপর ভুলেই গেল। মেয়েটা কেঁদে, চেঁচিয়ে, গুমরে যখন মৃতপ্রায় তখন কে যেন টকটকে ফর্সা মেয়েটাকে বার করে এনেছিল। তখন মেয়েটার চোখ উলটে গেছে, ঠোঁটদুটো নীল। সেই থেকে আজও মেয়েটা বন্ধ ঘরে থাকতে পারে না, পর্দা সরিয়ে অন্তত একফালি আলো ঘরে আসতে দিতেই হয়। লিফট, সিনেমা-হল সব তার কাছে আজও, সত্তর বছর পরেও অন্ধকূপের সমান।

    আর একবার, সাঁতার শেখানোর নাম করে তাকে ছুঁড়ে দেওযা হল মাঝদীঘিতে। জল খেয়ে, শ্বাস আটকে যখন মেয়েটা প্রায় যায় যায় তখন তাকে দয়া করে তুলে আনা হয়েছিল অবশ্য। জলে আজও মেয়েটার আতংক কাটে নি।

    মেয়েটার বাবা রোজগার করত অনেক, কিন্তু জমানোর স্বভাব ছিল না। দেখতে খুব সুন্দর, যাকে বলে রমণীমোহন। কিন্তু সংসারী নয় এক্কেবারে। বাড়িতে খাওয়ার মুখ অনেকগুলো, অথচ রোজগারের লোক কম। মেয়েটার জ্যাঠাই মূল রোজগেরে, আর ঠাকুমা। জেঠিমার ডাঁট খুব, বিদ্যেবুদ্ধি যদিও শূন্য। আঠারবাড়িয়ার পয়সাওলা, জমিজিরেতওলা ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে আনা হয়েছিল শুধু পণের জন্য, নইলে মেয়েটার পিসির বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। এক হাতে পণের টাকা নিয়ে অন্য হাতে সেই টাকা আবার কন্যাপণ হিসেবে দিয়ে দেওযা হয়েছিল।

    তা সেই জেঠির নিজেরও চারটি, তার সঙ্গে জুটল দেওরের দুটি। পাঁচ বছর বয়েসেই মেয়েটাকে জেঠির হুকুমমত মাছ কাটতে হত, বাসন ধুতে হত। মেয়েটা ঠাকুমার পেছন পেছন ঘোরে, জেঠির আঁচলে আঁচলে ঘোরে, আর সব্বার ফাই-ফরমাশ খাটে।

    ওদিকে মেয়েটার বাবার দুঃখে সকলের চোখ থেকে ঘুমই প্রায় উড়ে গেছে। “আহা, পুরুষমাইনষের অ্যামনে কী চলে? অ্যাকখান বিয়া না করলে ক্যামনে হয়? মাইয়াডিরে দ্যাখনেরও তো কেউ লাগে না কি?” অতএব তিনি একদিন বরবেশে রওনা দ্যান।

    মেয়েটাকে ঠিকঠাক কেউ কিচ্ছু বলে না। শুধু যেদিন বরবউয়ের ফেরার কথা, সেদিন সবাই খিলখিল করে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে, আর মেয়েটার দিকে চেয়ে চেয়ে এ ওকে ঠ্যালে। মেয়েটা ঠিকঠাক সবটা বোঝে না, কিন্তু তাকে লুকিয়ে কিছু একটা বড়সড় কাণ্ড হচ্ছে সেটা ঠিকই বুঝতে পারে, আর নিষ্ফল ক্রোধে ফুলতে থাকে। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমরা অমন হাসো ক্যান? বাবা কই গ্যাছে?” তারা আরও হাসে। “অ মা, বুকা মাইয়া তাও জানস না। তর বাবায় তো তোর নতুন মায়েরে আনতো গ্যাছে”। মেয়েটা আরো রেগে যায়, কেঁদে ফ্যালে এবার, “মা না হাতি। আমার মা তো মইরা গ্যাছে সেই ক-বে। তোমরাই ত কইছ। বুঝছি, বাবায় আমাগো লাইগ্যা ঝি আনতো গ্যাছে, ঝি”।

    নতুন যে এল সে আসলে এদের মা হতে আদৌ চায় নি। নিত্য অশান্তি, নিত্য কোঁদল। জেঠিমাটি ওদিকে হাত ঝেড়ে ফেললেন। জ্যাঠার বদলির চাকরি ছিল, আজ চাটগাঁ তো কাল গোরখপুর। পরের মেয়ে ট্যাঁকে নিয়ে ঘুরতে জেঠিমার বিশেষ ইচ্ছে ছিল না। ঠাকুমাও চোখ বুজেছেন এর মধ্যে, তাই মেয়েটার হয়ে দাঁড়ানোর কেউ ছিল না। কাজেই দুটি বোন বেড়ালের মত নতুন মায়ের সংসারে চালান হল। সে সংসার তো রোজই বাড়ছে, একটি একটি করে পাঁচটি মেয়ে হল, এদিকে বাপের রোজগার তখন পড়তির দিকে। এরা দু বোন তার ওপর।

    বড়দিদিটি হাঁপানিতে ভীষণ কষ্ট পায়, কাজেই তার নিয়ম করে ইস্কুলে পড়াশোনা হল না। অথচ তার অংকে দারুণ মাথা, হাতের সেলাই দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু তাতে কী। এই মেয়েটাকে যা হোক করে ভর্তি করে দেওযা হল ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে। হস্টেলে পুরে দিয়ে নিশ্চিন্তি। কোন মাসে বাবা টাকা পাঠায়, কোন মাসে আবার ভুলেই যায়। মেয়েটা বড় হচ্ছে, লজ্জাও জন্মাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু নিরুপায়। পড়া আটকে গেলে দেখিয়ে দেওযার কেউ নেই। সাহস করে বাবার কাছে একবার অংক আর ইংরেজির জন্য টিউটর রাখার কথা বলেছিল, সে কানে গেল কিনা কে জানে। মোদ্দা কথা ফল কিছু হয় নি। ইসকুল ছুটি হলেও যাওয়ার জায়গা নেই। কখনো জেঠতুতো দিদির শ্বশুরবাড়ি, তো কখনো নিজের মামাবাড়ি, এই করে ছুটির দিনগুলো যায়।

    ওদিকে ফর্সা গোলগাল বাড়ন্ত মেয়ে, তখন আবার তার অন্য বিপদও কম না। বাপ থাকতেও নেই, মা তো নেই-ই, আত্মীয়ের বাড়ির খুদকুঁড়োয় প্রতিপালিত, তাকে খাবলাতে কি আর কারো আটকায়!
  • সে | 204.23.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৮:০৩681667
  • ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়?
    আমার ইশকুল!
  • অকার | 192.66.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৮:১৩681668
  • বহু যুগ আগের ঘটনা এগুলো, আমার জন্মেরও আগের, নইলে হয়তো চেনাশোনা বেরিয়ে পড়ত। আমিও কেলাস থিরিতে ওই ইসকুলে পড়েছিলাম। অমিয়াদি অঙ্ক করাতেন।
  • সে | 204.23.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৮:৩২681669
  • অমিয় কুমারী আসল নাম। আমরা বলতাম অমিয়াদি
  • Byaang | 233.227.***.*** | ২৩ জুন ২০১৫ ১৮:৪১681670
  • অকার, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। পরের কিস্তি পড়ার জন্য অপেক্ষা করছি অধীর আগ্রহে। আপনার লেখা পড়তে খুব ভালো লাগছে। তাই একটু তাড়া দিয়ে গেলাম। একটু হাত চালিয়ে প্লিজ।
  • সে | ২৩ জুন ২০১৫ ১৯:১৭681671
  • হ্যাঁ, আপনি লিখুন। এখন আর কমেন্ট করব না। সাগ্রহে পড়ছি।
  • | ২৪ জুন ২০১৫ ০৮:৪৪681672
  • আপনি বড় ভাল লেখেন অকার।
    লিখুন লিখুন।
  • Bratin | 122.79.***.*** | ২৪ জুন ২০১৫ ০৯:২০681673
  • পড়্লাম।খুব ভালো লাগছে।
  • Suhasini | 213.99.***.*** | ২৪ জুন ২০১৫ ০৯:৩৯681656
  • খুব ভালো লেখা। পরের পর্বের জন্য বসে আছি।
  • Bratin | 122.79.***.*** | ২৪ জুন ২০১৫ ০৯:৫২681657
  • আরে সুহাসিনী যে। ওয়েলকাম ওয়েলকাম ঃ))
  • Manish | 127.214.***.*** | ২৪ জুন ২০১৫ ১৪:২৮681658
  • আমিও নীপা
  • অকার | 192.66.***.*** | ২৫ জুন ২০১৫ ১১:১১681659
  • মেয়েটার মা যখন মরে গেল তখন মেয়েটার বয়েস ছিল তিন, আর নতুন মা যখন এল তখন বয়েস দশ এগারো। ঠাকুমা যদ্দিন ছিলেন তদ্দিন অন্তত ঠিকঠাক ইসকুলে লেখাপড়াটা হচ্ছিল। গোরখপুরে দু বোনই ভর্তি হয়েছিল মেমদিদিদের ইসকুলে। সেখানে দিদি পড়ছিল ক্লাস সিক্সে আর মেয়েটা পড়েছিল ফোর পর্যন্ত। তারপর ঠাকুমা চোখ বুজলেন। মেয়েটারও এলোমেলো জীবন আরো এলোমেলো হয়ে গেল। বাবা নির্বিকার। এক বছর মেয়েটা বাড়িতে বসা। বইপত্রের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু রান্নাঘরের ট্রেনিং চলছে। শেষটায় জ্যাঠা তেড়ে উঠলেন। ততদিনে তাঁর কলকাতায় বদলি হয়েছে। ভাইকে আচ্ছা করে আগাপাশতলা ঝাড়লেন কদিন।

    কী ভাবস কী তুই, অ্যাঁ? মাইয়া দুইডারে ঘরেই বয়াইয়া রাখবি?

    ভাই মাথা টাথা চুলকে গত্যন্তর না দেখে মেয়েকে কলকাতার কয়েকটি ইসকুলের অ্যাডমিশন টেস্ট দেওয়ালেন। সে চান্স পেল বেলতলা গার্লসে আর ব্রাহ্ম বালিকায়। কিন্তু বেলতলা গার্লসে তার পিসতুতো দিদিও সে বছর ভর্তি হচ্ছিল। অতএব বিজ্ঞ গুরুজনেরা মত দিলেন, ‘একই জায়গায় দুইডারে দেওন চলবো না। একলগে থাকলে বান্দর অইবো। পড়ায় মন দিবো না’

    একা একা মেয়েটা হস্টেলে থাকতে এল। যেমন তেমন করে মানিয়েও নিল। কী আর করবে।

    এতদিনের রান্নাঘরের ট্রেনিং এখানে এসে কাজে লেগে গেল কিন্তু। হোম সায়েন্সে মেয়েটাকে কেউ মারতে পারে না। রান্নার সব পরীক্ষা, সব কম্পিটিশনে মেয়েটার প্রাইজ বাঁধা। শেখা রান্নাগুলো মেয়েটা মনে করে করে রাখে, ছুটিতে বাড়ির লোকদের খাওয়াবে বলে। হোয়াইট সস দিয়ে স্যালাড বানিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আসে, সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে। ‘এইতা কী আনছস, সাদা সাদা কত্তডি! মাইনষে খায় এইতান। এই শিখাইলো তগো ইসকুলে। মাছের ঝুল শিখায় না?’

    মেয়েটার উৎসাহ নিমেষে চুপসে যায়। তবু ইসকুলে ওটাই তার একমাত্র ভালো লাগার জায়গা। লেখাপড়ায় মাথা ছিল, কিন্তু উঁচু ক্লাসের ইংরেজি অংক একটু দেখিয়ে না দিলে অসুবিধা হচ্ছিল। তা সে আর তাকে কে দেখিয়ে দেবে। ‘মাস্টর রাখতে পয়সা লাগে না? ক্যাডা দিবো পয়সা?’

    ওদিকে শরীর বাড়ে, মনও বাড়ে। চারিদিকে হাত নখ দাঁত তাকে চেখে চেখে খায়। তার যাওযার জায়গা নেই, বলার লোক নেই। শুধুই আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। অনেক, অনেক দিন পরে মেয়েটা তার প্রাণপ্রিয় ভাইঝিকে বলেছিল, ‘মাথার ওপর এক টুকরো ছাদের জন্য আমায় বড়ো বেশি দাম দিতে হয়েছে সারা জীবন ধরে’।

    মেয়েটার জ্যাঠার তিন ছেলে। মেজজনের তখন বাড়ির কাছেই আর এক বাড়ির মেয়ের সঙ্গে মন দেওযা-নেওয়া পর্ব চলছে। মেয়েটা দূতীর কাজ করে। করতে করতে সেই মেয়েটার একমাত্র ভাই তাকে ভালোবেসে ফেলল। মেয়েটারও আপত্তি ছিল না। ও বাড়িতে সে কিছুটা হলেও আদর পেত।

    প্রস্তাব এল এ বাড়িতে।কিন্তু ফাটা কপাল নিয়ে যে জন্মেছে তার আর কী হবে! একই বাড়িতে ভাই বোন দুজনের বিয়ে! অসম্ভব। মেজদার বিয়েটাও কেঁচে যাচ্ছিল প্রায়, তবে সে ছেলে অত্যন্ত জেদি ও দুর্মুখ হওয়ায় পরিবারের আপত্তি তাকে আটকাতে পারে নি। মেয়েটার স্বপ্নের অবশ্য ওখানেই ইতি। প্রেমিকটিও বাধ্য হয়েছিল অন্য জায়গায় বিয়ে করতে। এই বিয়েটি অত্যন্ত অসুখী হয়েছিল, যাই হোক।

    এই মেজদাকেও পরে কোনো কারণে সস্ত্রীক বাড়ি ছেড়ে প্রায় এক বস্ত্রে বেরিয়ে আসতে হয়। সে অন্য গল্প।

    তা মেয়ের তখন প্রায় আঠেরো। টুকটুকে সুন্দরী। ক্লাস ইলেভেন। হস্টেল থেকে ছুটিতে বেশির ভাগ সময়ে জ্যাঠার বাড়িতেই থাকা। নয়তো মেজদার বাড়িতে। ততদিনে মেজদার একটি মেয়ে হয়েছিল। তাকে নিয়ে দিব্যি সময় কাটত মেয়েটার।

    জেঠিমা প্রমাদ গুনলেন। মেয়ের বাবাকে বলা হল ব্যবস্থা করতে। তিনি অবশ্য ভালো ব্যবস্থাই করেছিলেন।

    বাজারে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলেন মেয়ের দাম ভালোই উঠবে। একদিন মেয়েকে ট্যাক্সি চড়িয়ে তিনি নিয়ে চললেন। সেই প্রেমিক ছেলেটির সন্দেহ হয়েছিল। সে মেয়েটির মেজদাকে খবর দেয়। দুজনে মিলে আর একটি ট্যাক্সিতে এদের পিছন পিছন চলতে থাকে।

    ভরা দুপুরে শহর কলকাতার বুকে রীতিমত সিনেমা। একটা ট্যাক্সি থেকে এক সুন্দরীকে ঠেলে অন্য ট্যাক্সিতে ওঠানোর চেষ্টা চলছে। সেই ট্যাক্সির ভেতর থেকে কিছু অচেনা হাত তাকে প্রাণপণে টানছে, আর মেয়েটা বেয়াড়া ঘোড়ার মত পা ঠুকছে, হাত ছুঁড়ছে। পেছন থেকে আর একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল, সেটা থেকে লাফিয়ে নামল দুই যুবক।

    পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ায় মেয়েটার বাবা ভীষণ রেগে হাত ধুয়ে ফেললেন। মেয়েটাকে আবার নিয়ে যাওয়া হল জ্যাঠার বাড়ি। কিন্তু জেঠি কিছুতেই রাজি নন। মেয়েটাও আর এদের সঙ্গে থাকতে চাইছিল না। অনেক কথা কাটাকাটি, অনেক তিক্ততার পর মেয়েটার মেজদা তার দায়িত্ব নিল।

    এক আশ্রয় থেকে মেয়েটা এল আর এক আশ্রয়ে। কিন্তু কেউ কি আর কাউকে বসিয়ে খাওয়ায়? পড়াশোনা চুকল, মেয়েটার কাজ হল এ বাড়ির হেঁসেল ঠেলা আর বাচ্চা পালন। দাদা বউদি দুজনেই চাকরি করতেন, বাচ্চাটা থাকত সব সময়ের কাজের লোকের কাছে। মেয়েটা আসায় সেই খরচটা বাঁচল।

    মেয়েটার তখন বয়েস মোটে উনিশ। তার একটা বিয়ে দেওয়ার কথা, বিয়ের চেষ্টাটুকু অন্তত করার কথা সবাই খুব গুছিয়ে ভুলে গেল। মেয়েটা নিজের সংসার করতে গেলে এত এত কাজ সব নিজেদের করতে হবে, সে তো কল্পনার বাইরে! তার থেকে নিখরচার কাজের লোকটা যেমন আছে থাক না।

    মেয়েটা ছিল ঠিকঠাকই, শুধু চাপা স্ট্রেস ফুটে বেরোত একটা পিকিউলিয়ার অভ্যেসে। মেয়েটা সারাদিন নিজের মাথার চুল টেনে টেনে তুলত। মাথার সামনেটা অনেকখানি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। সবাই হাসত। মেয়েটা নিজেও হাসত।

    অদ্ভুতভাবে, মেয়েটা আর পুঁচকি ভাইঝিটা হয়ে উঠল সবথেকে বন্ধু। সেই মেয়েটার উনিশ বছর বয়েস থেকে আজ পর্যন্ত। প্রথম দিকে মেয়েটার ওপর হওযা অত্যাচারগুলো দেখে ভাইঝি শুধু কাঁদত, সে যে তখন বড্ডো ছোটো ছিল। পরের দিকে সজোর প্রতিবাদ করতে ছাড়ে নি।

    তখন আবার তার ওপরে ঘুরে চার দিক থেকে ব্যঙ্গবাণ ছুটে আসত, ‘অত যে পিসি পিসি করস, বিয়া হইলে কি পিসিরে হউরবাড়ি লইয়া যাইবি’? ভাইঝি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলত, ‘যাবই তো’। পিসিকেও অনেক বলা হত, ‘তর নিজের মাইয়া ত না, বিয়া হইলে, তর ম্যাজদা না থাকলে তর কী হইব ভাইব্যা দেখিস। মাইয়া তার মায়েরে দেখব, তরে দেখব ক্যান? নিজের পিসিও ত না, বাপের খুড়াইত্যা বইন।’ অন্তর্নিহিত অর্থ, তখন আমাদের কারো বাড়িতে এসে ঝি-গিরি করিস। পিসি বিশেষ কান করে নি।

    মেয়েটা এখন তিয়াত্তর। ভাইঝির সঙ্গেই আছে। ভাইঝিজামাই তাকে নিজের মায়ের থেকেও বোধহয় ভালোবাসে। মেয়েটা যদিও সারা জীবনের শিক্ষাটা ভুলতে পারে না, মাঝে মাঝে একটু কমপ্লেক্সে ভোগে। সারাদিন সংসারের হাজারটা কাজ নিয়ে পড়ে থাকে, পাছে বসে আরাম করলে কেউ কিছু মনে করে? ভালো খাবারটা, বড়ো মাছটা নিজে না খেয়ে তুলে রাখে।

    একটু কানে কম শোনে, একটু চোখে কম দেখে, একটু ভুলে যায়। একটু আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগে। পুরনো দিনগুলো আর মনে করতে চায় না। ভাইঝি যদিও মাঝে মাঝেই রেগে ফোঁস ফোঁস করে।

    মেয়েটা আর চুল টেনে তোলে না। ভালোই আছে। হয়তো।
  • Suhasini | 213.99.***.*** | ২৫ জুন ২০১৫ ১১:৫০681660
  • 'বাজারে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলেন মেয়ের দাম ভালোই উঠবে। একদিন মেয়েকে ট্যাক্সি চড়িয়ে তিনি নিয়ে চললেন।' - শিউরে উঠি পড়ে... ভাইঝি আর ভাইঝিজামাইয়ের মরুদ্যানটুকু ছিল ভাগ্গিশ!
  • সে | ২৫ জুন ২০১৫ ১২:০৭681661
  • পিসিমার গল্প খুব ভালো লাগল অকার।
  • de | 69.185.***.*** | ২৫ জুন ২০১৫ ১২:১৯681662
  • এমনও বাবা হয়!!!!

    শেষ বয়সে সম্মান পেয়েছেন এটুকু অন্তত সান্তনা!
  • - | 109.133.***.*** | ২৫ জুন ২০১৫ ১২:৫৫681663
  • সান্ত্বনা।
  • | 77.98.***.*** | ২৫ জুন ২০১৫ ১৮:১৮681664
  • বড় মন খারাপ করা লেখা..
  • AS | 125.187.***.*** | ২৬ জুন ২০১৫ ১২:০৩681665
  • এমনও হয় খুব ভালো লাগলো
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন