এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নতুন কলম

    dee
    অন্যান্য | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ | ১৩৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dee | 102.3.***.*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:১০651597
  • রান্না !

    দ্বিরা

    "আজ শরীর কেমন লাগছে? প্যেইন স্কোর কতো ?"

    গত পাঁচ মাস ধরে এই কথাটা বহুবার বহুজনের মুখে শুনছে দ্বিরা।শারীরিক ব্যথাকে এক থেকে দশের অঙ্কের খুড়োর কলে বেঁধে ফেলে সাংখিক মাত্রানুযায়ি উপসম সমাধানের শারীরবিদ্যীয় প্রচেষ্ঠা।যারা জিজ্ঞাসা করে তারা কতটা সমব্যথী হয়ে জানতে চায় দ্বিরার গত পাঁচ মাস ব্যাপী যন্ত্রণার কথা আর কতটা নিজের বিফলপ্রয়াসী সাহায্যার্থু বিবেক দংশনের কাছে তাড়িত হয়ে, তা নিয়ে ইদানীং বেশ কিছুদিন আর ভাবছেনা সে ।ব্রতীন এই সময় টায় খুব ব্যস্ত থাকে।প্রায় চল্লিশ মাইল ড্রাইভ করে তাকে যেতে হয় কর্মক্ষেত্রে।এককাপ চা আর দু এক টুকরো টোস্ট ছাড়া আর প্রায় কিছুই সকালবেলাটায় তার পেটে পড়ে না।অভ্যস্ত দক্ষতায়, যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় সে গুছিয়ে নিচ্ছে তার ব্যাক-প্যাক , ল্যাপটপ , ফাইল , পেনড্রাইভ , ছবি লাগানো ল্যামিনেটেড পরিচয়পত্র আরও কত কি টুকিটাকি।প্রশ্ন করার সময় উত্তরদাত্রীর মুখের দিকে তাকানোরও অবকাশ থাকে না তার এইসময়টাতে।দ্বিরা জানে । মাত্র পাঁচ মাস আগেই এইরকমই নাকেমুখে গুঁজে হসপিটালে দৌড়ত সে নিজেও।দ্বিরা বাধা দেয় না ব্রতীন এর কর্ম-ছন্দে ।অভিমান করে না ।শুধু উত্তর দিয়ে যায় গতানুগতিক প্রশ্নের , হাসিমুখেই।ব্রতীন কাজে বেরোচ্ছে।কাজ।সাফল্য, ব্যর্থতা , সংশয় , প্রত্যয় মোড়া সুবিশাল কর্মজগত।জীবনের এই বিরাট একটা অংশ এখন পুরোপুরি অধরা হয়ে আছে দ্বিরার কাছে ।সুপ্ত বিষাদের চোরা স্রোতে ডুবে যেতে যেতে সদর দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো দ্বিরা ।
    "কি দরকার সোনা, আমি বেরিয়ে যাব। তোমার কষ্ট করতে হবে না, আমি চাবি লাগিয়ে ক্যী হোল দিয়ে ভিতরে ড্রপ করে দেবো"
    এইরকম অন্তরঙ্গ সম্বোধন তারা পরস্পরকে হামেশাই করে থাকে, মন থেকেই , স্নেহের সুরে। এতদিনের দাম্পত্যজীবন বিন্দুমাত্র ফিকে করেনি অতি স্বাভাবিক সুরে বলা এই ছোট্টো ছোট্টো শব্দ গুলিকে। ব্রতীন সম্পূর্ণ খোলা মনে বলেছে তার এইমাত্র বলা বাক্যটি। অথচ দ্বিরা কেনযে সাতসকালে উঠে নেমে এসেছে একতলায় , উষ্ণ লেপের তীব্র পিছুটান কাটিয়ে, সেটা এখন এই ব্যস্ততার সময় ,ব্রতীন কে বোঝাতে যাবার কোনও মানে হবে না।পৃথিবীতে যত ‘কেন’ জিজ্ঞাসা করা হয় তার সবগুলির অর্থ খোঁজা অর্থহীন।কিছু হয়ে ওঠে স্বতঃপ্রণোদিত উত্তর,কিছু সংসারের নিয়মকানুনের জটে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দশাননের মতো দশটি সমাধান দিতে পারে। আর কিছু ‘কেন’র উত্তর থেকে যায় শুরু থেকে শেষাবধি ধোঁয়াশায় মোড়া।মানব-মানবীর হৃদয়জগতের গোপনকুঠুরীতে লুকিয়ে রাখা বহু ‘কেন’র উত্তর চিরকাল এই শ্রেণীভুক্ত। ভাষায় বোঝাতে যাও,তক্ষুনি সেটা হয়ে উঠবে তুচ্ছ,পেটি, ইমোশনাল ব্যাপার।কোনও মানে হয় এসব কথার, এতদিন পরেও! দ্বিরা কথা বাড়াল না।চলে এল লাগোয়া লিভিং রুমে।টেলিভীশনটা চালিয়ে দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে দেখতে লাগলো বি বি সি র প্রভাতী সংবাদ, যেন সে না জানলে,না শুনলে, এই প্রতিবেদন বৃথা হয়ে যাবে এই মুহূর্ত থেকে।
    এই পশ্চিমী বিশ্বের একটি সুপরিচিত দেশের বেশিরভাগ বাড়ির ধাঁচে তৈরি একটি পূর্ণ দ্বিতল বাড়ির অর্ধ ভাগ বা সেমি ডিট্যাচ্ড হাউস নিয়ে তারা থাকে । একতলায় নিয়মমাফিক বসারঘর, লিভিং-রুম আর ডাইনিং কাম কিচেন । সকলের ব্যবহারযোগ্য স্টাডিও এই একতলায় । দোতলায় তিনটি শোবার ঘর তাদের চারটি প্রাণীর জন্য । গৃহস্বামী বা স্বামিনীর নেহাত কাছের মানুষ ছাড়া সেই জগতে প্রবেশাধিকার নেই বাইরের কারও । দুইতলাতেই কাঠের মেঝের উপরে পরত চাপানো হয়েছে পুরু কার্পেটের। শীতপ্রধান দেশের মহার্ঘ উষ্ণতাকে যা আগলে রেখেছে এই বাড়ির মানুষগুলির জাগতিক আরামের জন্য,বহির্জগতের শীতার্ত রুক্ষতাকে হার মানানোর মানানসই ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায়।
    উপরে মেঝের উপর হাল্কা খচমচ্ আওয়াজ হচ্ছে একটু।তাতান, তাদের বড়ছেলে, ঘুম থেকে উঠছে । ছোটোটি, কুটুন, একটু গাঁইগুঁই করে অবশ্য লেপ ছাড়ার আগে।তবে তার বড় দাদা টি কড়া হেডমাস্টার এসব ক্ষেত্রে ।সবেমাত্র এই শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে তারা দুজনেই এক স্কুলের যাত্রী।ভাই এর জন্য তার স্কুলে দেরী হতে দেওয়ার বান্দা সে নয়।শুরু হবে স্কুলের প্রস্তুতি তোড়জোড়।দ্বিরার অবশ্য কোথাও যাবার নেই । সে সারা সকাল ধরে যত খুশী টেলিভিশন দেখতে পারে।
    বেরোবার আগে ব্রতীন চকিত উঁকি দিলো লিভিং-রুমে । একটু কাছে টানলো সে দ্বিরাকে, উষ্ণ করতলের হাল্কা স্পর্শ। এটা নতুন যোগ হয়েছে ইদানীং ।জানিয়ে দেওয়ার স্পর্শ । কিছুটা স্নেহের , অধিকারের আর নিয়ন্ত্রণের । এই শেষের বিশেষণটাই দ্বিরা অনুভব করে সবচেয়ে বেশী । নিয়ন্ত্রণ ।উভয়পক্ষেরই অজান্তেই সমকক্ষতা থেকে ধীরে ধীরে পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে তূলাদন্ডের ভারসাম্যতা । একজন নিশ্চিত গতিতে উঠে যাচ্ছে তার দক্ষতার শীর্ষবিন্দুতে , আর দ্বিতীয়জন ক্রমশঃ সরে আসছে তার বিশেষ লব্ধ বিদ্যা থেকে । নিন্মগামে গতি এখন তার । নিয়ন্ত্রণ । হ্যাঁ , এইটাই সঠিক প্রতিশব্দ । বন্ধু , প্রিয়সখা, স্বামী হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রক । কিছুটা অনবধানে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবে ।
    "ওষুধ খেও ঠিকঠাক সময়ে। জি পি কে ফোন করে প্রেসকৃপশনটা আনিয়ে নিও, বাসে যেও, ড্রাইভ করতে যেও না শরীর ভাল না লাগলে।আর হ্যাঁ, রান্নাবান্না কিন্তু একদমই করতে যাবে না"।উপদেশ, আদেশ, নিয়ন্ত্রণ ।
    ব্রতীন বেরিয়ে যাচ্ছে এবার । সদর দরজার লক বাইরে থেকে বন্ধ হবার ধাতব শব্দে চমক ভেঙ্গে গেল দ্বিরার । সে কি সেভাবে শুনছিলোনা কিছু এতক্ষন তাহলে ? তাইই হবে । দ্বিরার চাবিটা দিয়েই দরজাটা বন্ধ করেছে ব্রতীন, তারপর লেটারহোল দিয়ে এইমাত্র সেটা ছুঁড়ে দেওয়া হোল উপরে ওঠার সিঁড়ির পাশের প্যাসেজটার ল্যামিনেটেড ফ্লোরের উপর। ঝনাৎ করে আছড়ে চাবি পড়ার শব্দ, তারপর বাইরের মোরামের উপর অপসৃয়মান গাড়ির চাকার সরে যাবার খড়মড় শব্দ । প্রতিটি শব্দ,প্রতিটি অবঘাত তাদের নির্দিষ্ট ক্রমশীলতায় দ্বিরাকে মনে করিয়ে দেয় এই বিশাল জঙ্গম জগৎ থেকে তার নির্বাসনের কথা। এবার তার দিন শুরু হবে।অলস দিন । কর্মহীন , রোগযন্ত্রনাময়, বন্দীত্বের জীবনের একটি দিন । তারপর এই দিনটা গড়িয়ে যাবে আরও একটা দিনের দিকে ।
    দুই ছেলে হুড়মুড় করে আগেপিছে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে । নিজেদের যাবতীয় ঝগড়া আপোস মিটিয়ে নিচ্ছে সিঁড়ির চোদ্দটা ধাপের মধ্যেই । ছোটো ভাই এর মাথায় আদরের আলতো চাঁটি মারছে তাতান । "স্টপ ইট নাও" প্রবল আপত্তি করছে কুটুন । সারল্যময় খুনসুঁটি । মনটার ভিতর যেন একঝলক তাজা বাতাস বয়ে যায় দ্বিরার । টানাটানি করে কোট স্ট্যান্ড থেকে কোট নিয়ে গায়ে চাপাচ্ছে ওরা । এদেশে বছরে নমাস শীতের জাঁকালো অবস্থান । কোট গুছিয়ে তুলে রাখার বাহানা খুব একটা আর করেনা এবাড়ির লোকজন ।
    "মাম , আর ইউ হোম টুডে এজওয়েল ?" এগারো বছরের সরল উদগ্রীব প্রশ্ন । ছোটোছেলে তাকিয়ে আছে মুখের দিকে । মুখে কি একটু মৃদু কুঞ্চন হয় দ্বিরার, বুকে একটু ঠান্ডা অনুভব ? "এজওয়েল" , " এখোনো", "আজও" - এই কথা গুলোই কেন বলে ওরা সবাই। একমুহুর্ত মাত্র , তারপরপরই সে অনুভূতি ঝেড়ে ফেলে কুটুনকে একটু কাছে টেনে নেয় দ্বিরা । " ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু ড্রপ ইউ টু স্কুল?
    "প্লিজ, কুড ইউ মাম, কুড ইউ?"
    " হোয়াই নট, আই এম নট গোয়িং টু ওয়ার্ক "
    বাইরে এসে গাড়ির উপর স্তূপাকৃত জমাট বরফ, যাকে গৌরবার্থে বলা হয় “ফ্রস্ট”, ঘসে ঘসে পরিষ্কার করতে লাগলো দ্বিরা। সাইডভিউ মিরারে চোখ পড়ে গেল একবার নিজের মেকাপহীন মুখের দিকে। দেখেছো চুলটাও তো ঠিকঠাক আঁচড়ে নেওয়া হয়নি!"স্কুল রান মাম!" এই ভুমিকাতেও বেশ কিছুদিন আগে প্রবেশ হয়েছে তার।ভালোই তো লাগছে! নিজের মনেই হাসল আবার দ্বিরা। বিষাদময়, ধুস্‌ শীতার্ত সকালে গাড়ির উষ্ণতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্ঠারত স্কুল রান মাম!
    00000000000000000000000000000000000000000000000

    ছেলেরা স্কুলে চলে যাবার পর একটা সুদীর্ঘ আপাতভাবে কর্মহীন দিন।সেই সাড়ে সতেরো বছর বয়সে মেডিকেল কলেজে প্রবেশ।আর তারপর প্রায় চব্বিশ বছর ধরে কোনোদিন কাজ ছাড়া ছুটি কাকে বলে তার কোনোরকম অভিজ্ঞতা হয় নি দ্বিরার। কাজের মানুষের ঘরে বসে থাকার মতো শাস্তি বোধহয় খুব কমই হয়।সারাদিনের নিরবিচ্ছিন্ন গৃহকর্মও সর্বদা মনে করিয়ে দেয় দ্বিরার জীবন থেকে আচমকা হারিয়ে যাওয়া বহির্বিশ্বের বিশাল কর্মযজ্ঞের কথা।
    গাড়ি পার্ক করে সদর দরজা খুলে বাড়ির ভিতরে এল দ্বিরা।লেটারহোল গলে মেঝের উপরে পড়ে আছে একরাশ চিঠি।বেশীরভাগই নানান ইউটিলিটি বিল,ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, কিছু মেডিকাল জার্নাল, তার, ব্রতীনের,দু একটা বিজ্ঞাপনী জাঙ্কমেল। চিঠিগুলো তুলে ল্যান্ডলাইন ফোনের পাশের ছোট্টো দেরাজ টার উপর রাখলো দ্বিরা। এবার এগুলো খুলে খুলে প্রয়োজনীয় কাজগুলি সারতে হবে।ব্রতীনই করে থাকে এসব পেপারওয়ার্ক। ইদানীং দ্বিরা করছে। সে বাড়িতেই থাকছে বেশ কিছুদিন। তার তো এখন অফুরান সময়।ব্রতীন অবশ্য বলেনি কোনোদিন। ব্রতীনের নিজস্ব কাজকর্ম হঠাৎ করে বেড়ে বা কমে যায় নি বা সে দ্বিরাকে এসমস্ত দায়িত্ব নিতেও কখোনো অনুরোধ করেনি। দৈনন্দিন কর্মকান্ডের ব্যাপারে সে কিছুটা নির্বিকার আপোসকামী গোছের মানুষ । সাংসারিক বিষয়ের চাকাটা মোটামুটি ঘুরতে থাকলেই ভারী সন্তুষ্ঠ থাকে সে । কিছুদিন চিঠিগুলো স্তূপাকৃতি হয়ে থাকলে সে নিজেই করবে নিশ্চয়ই কিন্তু কাজটা যে হয়ে থাকছে, তার জন্য পড়ে থাকছে না আর আগের মত, এই ব্যাপারস্যাপারগুলো সে খেয়াল করে না। ব্রতীনকে বলতে দ্বিধা হয় দ্বিরার।সন্ধ্যে সাড়েসাতটার পর ক্লান্ত হয়ে ফেরে হাসপাতাল থেকে, প্রায় দুঘন্টার লম্বা ড্রাইভ পেরিয়ে। বলা যায় না । এইসব ছোটোখাট কাজ । কেন জানি বলা যায় না । মসৃণ ভাবে সরে যায় সাংসারিক দায়দায়িত্বের তূলাদন্ড। ব্যস্ত কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে যেসব কাজ তারা ভাগাভাগি করেই করে এসেছে এতদিন ,অতীব দক্ষতায়, পারস্পারিক সমঝোতায় যেসব গৃহকর্মের অবকাশ তারা খুঁজে নিত, এখন সেইসব কাজগুলো দ্বিরাই করে। ব্রতীন বলেনি কোনোদিন, তবু করে সে। ছেলেদের স্কুলের পেরেন্টস্ ডে, ডেন্টিস্ট,হসপিটাল,বাজার, হাউসক্লিনিং এবং রান্না। রান্না! এই রান্নাটা ব্রতীন কোনোদিনই করতে চায় নি।তার কথায় ইংল্যান্ড এর মতো দেশে যেখানে প্রায় সমস্ত খাবার দাবার পাতে দেবার মতো তৈরী অবস্থায় সব সুপার মার্কেটে সহজলভ্য ,সেখানে অযথা কষ্ট করার মানে কি। যুক্তির দিক থেকে দৃঢ়, অনুভূতির দিক থেকে ভঙ্গুর। দ্বিরার তাই মনে হয়। রান্না শুধু করতে হয় এই কর্তব্যেই তো করা নয়,নয় শুধু উদরপূর্তির প্রয়োজনেও। দ্বিরা রান্না করে প্রয়োজনে, কর্তব্যে,ভালোবেসে ।
    সেই দাড়িদাদুর আমলের "রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পর রাধাঁ"র দিন আর নেই। রান্না নিয়ে এখন কতরকম ফিউশন হচ্ছে সারা পৃথিবীতে। দমবন্ধ করা, কোনঠাসা আলোবাতাস হীন রান্নাঘরের, রন্ধনপ্রণালীর কালিঝুলি মাখা শ্রমসাধ্য ব্যাপারটাকে করে তোলা হচ্ছে ঝকঝকে প্যাকেজে মোড়া পারফর্মিং আর্ট। নবীন শিল্পের নব্য শিল্পিরা পরিবেশন করছেন রকমারী টেলিভিশন শো,অংশ নিচ্ছেন চমকপ্রদ উত্তেজনাময় প্রতিযোগিতায়। কুকিং শো গুলোতে বেনারসী পরা, ভয়ঙ্কর মেকআপ করা মহিলারা যখন পোস্তচিকেন রান্না করেন তখন অবশ্য তার নিজেরও ব্যাপারটা একটু ওভার দ্য টপ্ মনে হয়েছে। ব্রতীন তো রীতিমতো হাসাহাসি করে। একবার বলেছিল "পরের এপিসোডে এই মা জননীরা কি উচ্ছের পায়েস রাঁধবেন?" তবে এইসব সাইড ইস্যুগুলো বাদ দিলে নতুন নতুন রান্নার ব্যাপারটা তার বেশ লাগে। সে এইসব ফিউশন ফুড-টুডে তেমন ইন্টারেস্টেড নয়। সাবেকী, সহজ সরল প্রণালীতে রোজ দিব্যি খাওয়া যায় সেইরকম দেশী ধরণের রান্না তার বেশী পছন্দের। তার দুই ছেলেও এইধরণের খাবারের ভক্ত, এদেশে প্রায় শৈশব থেকে বাস করা সত্বেও।আর মা মাসীদের কাছে হাতেকলমে শেখা না থাকলেও আজকাল আর অসুবিধা কোথায়।অন্তর্জালের দুনিয়া ছেয়ে গিয়েছে পাকপ্রণালীতে। সুদূর জন্মভূমিতে ফোন করে মাকে রেসিপি জিজ্ঞেস করার দরকার নেই আর! এ বাড়ির সবাই তাদের নিজস্ব জগতে বেরিয়ে যাবার পর প্রায় অসহনীয় একাকীত্বের, নিদানের পর নিদান দিয়ে রোগযন্ত্রণার উপশম প্রচেষ্ঠার সেই লম্বা দিন গুলিতে দ্বিরা যেন ফের আবিষ্কার করতে শুরু করলো এই অন্যধরণের সৃজনশীল জগতটা।আর করতে পেরে প্রায় বেঁচে গিয়েছিলো যেন সে।

    অবসাদ ঝেড়ে ফেলে রান্না ঘরে ঢুকলো দ্বিরা। এইদেশের বহুবাড়ির ধাঁচে বানানো ওপেন প্ল্যান রান্নাঘর, যা মাপেও নেহাত মন্দ নয়।সমস্ত উপকরণ সাজনো আছে হাতের নাগালে, নানান মাপের টিন বা প্যাকেট বন্দী অবস্থায়। প্রায় কিছুই কেটে কুটে ছেনে বেটে নেবার দরকার পড়ে না। ফ্রীজ পরিপূর্ণ থাকে নানান কাঁচা সামগ্রীতে। শুধু আরম্ভের প্রতীক্ষা।তার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। আজ দু একটার বেশী রান্নার ঝামেলায় যেতে চায় না দ্বিরা। এতেও তো কড়া নিষেধ করে গিয়েছে ব্রতীন। গৃহস্বামীর আদেশ অমান্য করা যাক তাহলে! হাসি পেল দ্বিরার। আদেশই তো একরকম। আজ সে জিরে ফোড়ন দিয়ে বেগুন আলু কুমড়োর হাল্কা ঝোল করবে শেষে একটু ধনেপাতা দিয়ে আর আলুপোস্ত। শেষেরটা তাতান বড্ড চেটেপুটে খায়।প্রাথমিক টুকটাক আয়োজন শুরু করে দিল দ্বিরা।
    বাড়িটি কেনার পরপরই এই রান্নাঘরটি তারা পূণঃর্নিমাণ করে। যেমন এখানে বহুমানুষই করেও থাকেন, নিজের একটুকু বাসায় নিজস্বতার ছোঁয়া রাখার জন্য। এই পাকগৃহটির ইট কাঠ পাথরের স্থাপত্যটুকু শুধু বাদ দিলে বাকি প্রায় সর্বস্ব যা চোখে পড়ে তার সবই ব্রতীনের মনোমত করে গড়া।বিপ্রতীপ শোনালেও এইই সবচেয়ে বড় সত্যি।এর ডিজাইন ব্রতীর।সোৎসাহে ,শতশতাংশ উদ্যোগে যন্ত্রগণক হাতে নিয়ে,খাতা পেন্সিল,ড্রয়িংবোর্ডে ইঞ্চিসেন্টিমিটারের সূক্ষ হিসাব কষেছে সে। এর প্রতিটি দেরাজ কাবার্ড সে একটি বিলিতি মিস্ত্রিকে প্রায় ডিরেকশন দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে লাগিয়েছে।দ্বিরাকে সঙ্গে নিয়ে এ দোকান সে দোকান ঘুরে নিজে পছন্দ করে করে কিনেছে এর টাইল্স, ফ্লোরি্ং,‌ আলোকসজ্জা। হাত লাগিয়েছে এগুলির সঠিক সস্থানোবস্থানে ।একসময়তো তাদের সুদক্ষ বিল্ডারটি পর্যন্ত দরাজ স্বীকারোক্তি মায় সার্টিফিকেট পর্যন্ত দিয়ে বসেছিলো "ডক্ ইয়্যু আর কোয়াইট গুড এট দিস!"
    বারবার হাসপাতালের আবাসনে থাকার কষ্ট পেয়েছে তারা এত্বাবধী।সেসব বাসস্থানে ইচ্ছামত কোনো বৈদ্যুতিক গ্যাজেট লাগানোর ব্যাপারেও থাকে নির্দেশাবলী। কখনো কখনো কড়া নিষেধাজ্ঞাও।নিজেদের মাথাগোঁজার ঠাঁই হবার পর, ব্রতীন কিনে এনেছে তাদের সাধ্যের ভিতর থাকা সর্বসেরা ওয়াশিংমেশিন, ডিস্ওয়াশার, ফুডপ্রসেসার আরো অজস্র রন্ধনসহায়িকা।
    অভিজ্ঞ মানুষেরা জানেন শুধু রাঁধা আর খাওয়াতে অর্থাৎ অশণ আর ভোজনেই শেষ হয় না রান্নাঘরের কাজ।অজস্র ছোটছোট অথচ পরিশ্রমসাধ্য কাজ পড়ে থাকে মূলপর্ব টি সমাধা হবার পর।নিঃসঙ্গ , ধন্যবাদহীন, ছকে বাঁধা মান্ ডেন যত কাজ। যা করতেই হয়, হবেও প্রতিদিন অথচ কেউ সচরাচর খেয়াল রাখে না কখন সেগুলো হয়ে রইল।ইদানীং ডিনারের পর পরই রান্নাঘর থেকে দ্বিরার ছুটি ।ব্রতীন নিজেই টেবিল পরিষ্কার করে, ভর্ত্তি ও খালি করে ডিসওয়াশার, পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে আগামী প্রভাতের প্রাতরাশের উপকরণ। ঠিক যা যা দ্বিরা করতো এতদিন পারিবারিক নৈশ ভোজনটি সমাপ্ত হবার পর।একমাত্র এই একটি ব্যাপার, শুধু এই রান্না করা টিতেই তার যমের ভয়।
    আদতে শিল্পমনষ্ক মানুষ হবার জন্যই এখানেও একটি ক্ষুদ্র স্বভাষী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির সাথে যুক্ত হয়েছে সে। নিয়মিত ব্যবধানে তারা আয়োজন করে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের । নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো তো হয়ই তাছাড়া এর ফলে ছেড়ে আসা মাতৃভূমির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায় পরবর্তী প্রজন্মকে । বেশ লাগে দ্বিরার নিরবিচ্ছিন্ন একঘেঁয়ে কাজের ফাঁকে দমকা তাজা হাওয়ার মতো এই ঘরোয়া উদ্যোগ গুলি। এছাড়া নিয়মিত তাদের মোলাকাতও হয় এর ওর বাড়িতে।আদানপ্রদান হয় সুখ দুঃখের তথা (যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার চেষ্ঠাই করো না কেন)পারস্পারিক হাঁড়ির খবরের - আর চারটি বাঙ্গালী একত্র হলে যা না হবারই নয় সেই নির্ভেজাল দেশী আড্ডার। তবে অল্ ফর দ্যি গুড রিজন। দ্বিরার মনে হয় এ যেন সূদুর বিদেশে পাড়ার মাসী পিসি দের অকৃত্তিম সাপোর্ট সিস্টেম, কেউ কেউ হয়তো বলবেন পশ্চিমী নিরিখে হতে পারে একটুবা গায়ে পড়া তবে জব্বর দাপুটে। তা এরা বিস্মিত হয়েছে শুনে যে ব্রতীন কোনোদিন হাত পুড়িয়ে ভাত রাঁধেনি। এই দেশেও। এতদিন দ্বিরা স্মিত হেসে শুনেছে এই আলোচনা।কিছুই মনে হয় নি, মনে করে নি।অন্যেরা যখন তির্যক হেসেছে, বলেছে "বরকে এত তোল্লাই দিও না বোনটি, এদেশে সব কাজে সবাই কে হাত লাগাতে দাও" দ্বিরা কি তখন হেসে উড়িয়ে দেয় নি সেসব কথা। ব্রতীন কে সে এসবের ভিতর টানতে চায় না।ব্রতীন অন্যরকম। সকলের চেয়ে।পুরো শরৎচন্দ্রের কাব্যিক নায়িকার মতো ব্রতীনকে সে সারাজীবন সামনে বসে থেকে খাওয়াতে চেয়েছে।তার মতো উচ্চশিক্ষিতা, উপার্জনশীল‌ একবিংশ শতকের একটি নারীর মননে একেবারে ইমোশনে টইটুম্বুর ভ্যাদভ্যাদে রোমান্টিক শোনালেও এইটাই ছিল তার চিরন্তন সত্য।কিন্তু আজ জানলার বাইরে এই অবিশ্রাম একঘেয়ে তুষারপাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই বিষাদময় রান্নাঘরে একা একা দাঁড়িয়ে তার চোখ জ্বালা করতে লাগলো।
  • de | 69.185.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৫:৩৫651600
  • এগোচ্ছে না আর?
  • dee | 102.3.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২১:২৫651601
  • Very soon. Thank you!
  • dee | 102.3.***.*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২১:৪৮651602
  • ব্রতীন

    ভারী অন্যমনষ্ক হয়ে আজ গাড়ি চালাচ্ছে ব্রতীন।বৃটিশ যুক্তরাজ্যের মোটোরওয়ে। প্রায়ঃশয়ই ঘন্টায় আশী নব্বই মাইল গতিতে যেখানে গাড়ি ছুটে চলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ব্যবধানে ।সামান্য অসতর্কতার পরিনাম যেখানে ডেকে আনতে পারে অপূরনীয় ক্ষতি, সেখানে এরকম অটোপাইলটের মতো অন্যমনষ্ক ভাবে ড্রাইভিং! এমন ক্ষমতা তার আছে আগে জানা থাকলে একবার ফরমুলা ওয়ানে ট্রাই নেওয়া যেত!
    নিজের মনেই হাসল ব্রতীন । ভারী অন্যমনষ্ক আজ সে। সে নিশ্চিত ভাবে জানে তার বেরিয়ে আসার পরপরই দ্বিরা খানিকটা কান্নাকাটি করবে।ব্রতীন জানে। প্রায় ছয় মাস ধরে অসুস্থ তার অতি প্রিয়তমা স্ত্রী। দেড়যুগাধিক দাম্পত্য জীবনের পরও যাকে সে প্রায় আজও নতুন ভাবে আবিষ্কার করে, পাগলের মতো ভালোবাসে, সমস্ত অনুভবে ছুঁয়ে থাকতে চায় শরীর মনের প্রতিটি তন্ত্রীতে।
    সেভাবে ফিরে দেখলে সেই কোন ছাত্রজীবনের শুরুর ধাপেই পরস্পরের পরিচয় তাদের। একসাথে তারা টপকে এসেছে ডিগ্রী পরীক্ষার গন্ডীগুলি। কর্মজীবনেও এই সেদিন পর্যন্তও তারা ছিল একই রেসের ঘোড়া। কিন্তু কই কোনো প্রতিদন্দ্বীতা ছিল কি? ব্রতীন মনে করে না। না রেষারেষি তো ছিল না তাদের উচ্চাকাঙ্খার প্রতিবন্ধক। চলার এই গতিময় পথে তারা কি ভাগ করে নেয়নি বহু অভিজ্ঞতা,হতাশা,সাফল্য আর হাসি! হাসি! কি তুচ্ছতিত্যুচ্ছ ব্যাপার নিয়েই না হাসাহাসি করেছে তারা। বিগত ছমাসের অসুস্থতায় কি বদলে যাচ্ছে দ্বিরা? তার দ্বিরা!
    দ্বিরা ব্রতীনের অনাবিল উর্দ্ধগতিকে ,তার সফলতাকে অসূয়া করে না। ব্রতীন জানে। কিন্তু দ্বিরা দুঃখ পায়।তাই কি এই দিনগত কর্মহীনতার শূণ্যতা ভরিয়ে রাখতে চায় যাকে বলে, অন্ততঃ ব্রতীনের মতে, মানডেন কর্মধারায়; ইন্টারনেট দেখে দেখে অজস্র রকম রান্নাবান্নায়! রান্না! এই রান্না করা নিয়েই খুচরো অশান্তি শুরু হয়েছিল প্রথম প্রথম।দুজনেই বাইরের কাজ নিয়ে অতি ব্যস্ত থাকার দরুন সাংসারিক কাজ তারা উইকএন্ডে ভাগাভাগি করেই করে এসেছে এতদিন।দ্বিরা করে রাখতো প্রায় গোটা সপ্তাহের রান্না যেটা তারা এদেশের নিয়মানুযায়ী স্বাস্থ্যসন্মতভাবে ফ্রোজেন করে রেখে দিত। সে করতো সকলের জামাকাপড় মেশিনে কাচা এবং ইস্ত্রি, বাগান পরিচর্চা আর যা না করলেই নয় সেইসব যাবতীয় পেপারওয়ার্ক।
    কিছুদিন অবশ্য আর করতে হচ্ছে না এই শেষোক্ত কর্তব্যটি কারণ দ্বিরাই বেশ কিছুদিন যাবৎ করে রাখছে সেসব। জানে ব্রতীন, খেয়াল করে সে প্রতিদিন এই ছোটো ছোটো স্নেহের স্পর্শগুলি। কিন্তু কেন যে তবু পাথরচাপা হয়ে আছে অনুভূতির উষ্ণ প্রস্রবণ। ভয় হয়। যদি ও ভুল বোঝে, মুখে না বলেই যদি তির্যক দৃষ্টিতে প্রকাশ করে ওর প্রত্ত্যুত্তর "এতদিনে বুঝি নজরে এল!" না, সে অবজ্ঞা আর সইবে না ব্রতীনের। তার চেয়ে এই থাক। পাহাড় প্রমাণ হয়ে উঠুক এই উষর নীরবতার দৈন্য। যতই না কেন অন্তঃরাত্মা তৃষিত হোক কোন কাঙ্খিত ইন্ধনের জন্য। নাঃ এইই থাক।

    গত ছয় মাসের দীর্ঘ অসুস্থতার কারনে বারবার হসপিটালে ভর্তি হয়েছে দ্বিরা, দীর্ঘসময় ধরে সেখানে থেকেছে সে। একসময় ফুরিয়ে গিয়েছে দ্বিরার রেঁধে রাখা ফ্রোজেন অনুপান।ব্রতীনকে তখন বাধ্য হয়ে জানতে হয়েছে জিরে ধনে হলুদের অনুপাত, নাড়াচাড়া করতে হয়েছে বেড়ী হাতা খুন্তি। ছেলেদের মুখে অন্যরকম লেগেছে তাদের বাবার রান্না করা ডাল,ঝোল,শাকসব্জি । সরস ঔৎসুক্যে তারা দেখেছে তাদের বাবার প্রথম হাতা খুন্তি নাড়া, ভারী উল্লাসে উপভোগ করেছে চিকেনকারী আর ডিমের ডালনা। মাছফাছের ঝামেলায় যায় নি ব্রতীন। ওসব দ্বিরার ডিপার্টমেন্ট।ছেলেরা সোৎসাহে হসপিটালের বিছানায় বন্দী তাদের মাকে শতখানা করে বলেছে তাদের বাবার রান্নার চমৎকারীত্ব।এইসবই কি কোনো অন্য সঙ্কেত পৌঁছে দিল দ্বিরাকে। দ্বিরাও কি অবচেতনে চাইছিল এবার থেকে সেও রান্না বান্নায় সমান উৎসাহ,সমান মনোযোগ দিক? এখন এ অনুসন্ধিৎসার উত্তর কোন ভাবেই আর অন্বেষণ করা যাবে কি?
    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
    ব্রতীন

    সপ্তাহ তিনেক আগে শেষবার হাসপাতাল থেকে ফিরে তাকে রান্নায় সাহায্য করতে ডেকেছিল দ্বিরা। তাদের যৌথজীবনের ইতিহাসে স্বতকীয় ভাবে এই প্রথমবার।ব্রতীনের ধারনায় রান্নাঘরের ব্যাপারটায় দ্বিরা একটু বেশীই স্পর্শকাতর যা প্রায় বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়ে। দ্বিরার মতো মেয়ে, যে কিনা প্রায় সমস্ত জীবন কাটিয়েছে পেশাদারী বৃত্তির আঙিনায়; যে কখোনো প্রথাগত ভাবে পারিবারিক বয়োজ্যেষ্ঠাদের কাছে রান্নাবাটির হাতেখড়ি পায়নি, যার কাছে কেউ দুবেলা পঞ্চব্যঞ্জনের প্রত্যাশাও করে না, তার পক্ষে এটা একটু বাড়াবাড়ি বৈকি।
    অবশ্য সেকথা দ্বিরাকে কখোনো বলতে যায় নি ব্রতীন। কি দরকার যেচে আনা উটকো ঝামেলায়। দ্বিরা ডাকলো বলেই না গিয়েছিলো সে। মাত্র ঘন্টা দেড়েকের ব্যাপার। কিন্তু তার মধ্যেই ছোটোখাটো ঠোকাঠুকি লেগে গেল তাদের ।
    আশ্বর্য মানুষের প্রবৃত্তি।বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে,ডিসেকশন রুমে,লাইব্রেরীতে তারা ঘন্টার পর ঘন্টা বিনিময় করছে পারস্পারিক মেধা,বুদ্ধি,সাহচর্য; অনাবিল স্বতঃস্ফুর্ততায়। সেভাবে দেখতে গেলে অনেক সহপাঠীদের তুলনায় নেহাৎই অল্পবয়সে ডাক্তারীবিদ্যার উচ্চতর শিক্ষাকালীন তাদের বিয়ে হয়েছিলো। তারপর এই দীর্ঘ উনিশ বছর যারা একসাথে মোকাবিলা করেছে জীবনের জটিল বন্ধুর প্রশ্নমালার; রান্নাঘরে তারা পাশাপাশি দেড়ঘন্টা কাটাতে পারলো না।এখন ভাবলেই গভীর বিষাদে দীর্ণ হয় ব্রতীনের হৃদয়।

    "তোমার আলুকাটা একদম ঠিক হচ্ছেনা ব্রতী, কাল রাতের মাছের ঝোলের মত লম্বা লম্বা স্লিক করে কাটো"
    -"কালকের ঝোলের আলুর সাইজ মনে করে রাখার মতো বাজে সময় নেই আমার।পছন্দ না হলে নিজে করে নাও।আর এই ডিকটেট করাটা বন্ধ করো দ্বি, ভীষণ ডিস্‌গাসটিং স্বভাব ওটা তোমার"
    -"জেনারালাইজ করোনা ব্রতী; রান্নায় একটু হেল্প চেয়েছি বলে এত মেজাজ গরম করার কি আছে? কোনোদিন কি বলেছি তোমায় এর আগে? এখন আমার শরীরটা খারাপ বলেই না--"
    "শরীর খারাপ যখন জানোই তখন শুয়ে না থেকে চৌষট্টিপদ রান্নার দরকারটা কি? যতসব বাড়াবাড়ি সবসময়"
    -"এতে বাড়াবাড়ির কি দেখছো আজ তুমি হঠাৎ? কবে থেকে আবার রান্না হয় না এ বাড়িতে?আর রান্না না করা হলে বাচ্চারা খাবেটা কি শুনি? টোস্ট আর ক্রয়সোঁ!এন্ড সিন্স হোয়েন ডিড ইউ টার্ণ ইনটু সাচ্ এ কন্ট্রোলফ্রিক?"
    -"সেরকম দরকার পড়লে বাচ্চারা ওই খেয়েই বা থাকতে পারবে না কেন? এদেশের কোন বাচ্চার সপ্তাহে দুদিন শুক্তো আর মাছের কালিয়া খাবার প্রয়োজন হয়? এখানকার খাবারদাবারে না পোষালে দেশে পাঠিয়ে দিতে পারো সেখানে দুবেলা ঝোল ঝাল অম্বল খেতে পারবে কিন্তু তাতে একটা ফার্স্ট ওয়ার্লড কান্ট্রিতে বড় হবার এডভান্টেজ গুলো পাওয়া যাবে না"

    এখানেই থামলে ভালো হতো কিন্তু ব্রতীন রেগে উঠেছিল। যা সে কদাচিৎ হয়। সে বরাবরই ঠান্ডা মাথার মানুষ। সেদিন হিসেব কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছিল তার। বোধহয় সচরাচর রাগে না বলেই সেদিনের তীব্র ক্রোধ আহত করছিলো ব্রতীনের পুরুষাকার,আচ্ছন্ন করছিলো তার চিন্তাশক্তি, ঝাপসা করে দিচ্ছিল তার দৃষ্টি। কন্ট্রোলফ্রিক বৈকি! কি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে সে? এই যে এতদিন ধরে অসুখে ভুগছে দ্বিরা, পেরেছে কি সে তার যন্ত্রণা একটু হলেও কমাতে? পেরেছে কি নিজের কাজকর্মের বোঝা একটু কমিয়ে দ্বিরাকে এইসব অবশ্য করণীয় অথচ টিডিয়াস কাজের থেকে খানিকটা রেহাই দিতে! কি নিদারুণ মানুষের নিয়তি!কত সীমাবদ্ধ মানুষের ক্ষমতা!যার স্বাচ্ছন্দের জন্য সমস্ত দুনিয়া করতলগ্রস্ত করতে ইচ্ছা হয় সেইই কিনা অভিযোগ করে নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালের,তারই ক্ষোভের মুখে পড়ে বারবার কুঁকড়ে যেতে থাকে আত্মবিশ্বাস।নাহ্‌,কিছুই সে কন্ট্রোল করতে পারে না। ক্ষুদ্র তার শক্তি, অতি সামান্য তার ক্ষমতা। থামা উচিত ছিল। কিন্তু সেদিন থামতে পারে নি ব্রতীন।
    -"আরও কিসব বলছিলে না তুমি একটু আগে? কন্ট্রোলফ্রিক! হুঁহ্‌! সত্যিকারের কন্ট্রোল কাকে বলে কোনদিন ফেস করোনি তাই এতশত গালভরা বুকনি! সত্যি সত্যি সেইরকম কোনো কন্ট্রোলিং স্বামীদেবতার পাল্লায় পড়লে এসব লেকচার দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে!"
    -"আমরা একটা সত্যি কথা বললেই তোমাদের কাছে সেটা লেকচার হয়ে যায় তাই না? আসল কথাটা বলছো না কেন? রান্নাবান্নায় একটু হাত লাগাতে হলেই তোমার আঁতে ঘা লাগে তাই না?দ্যিস ইজ্‌ বিনীথ ইয়্যোর সেলফইনফ্লিকটেড লেবেল্‌‌‌ অফ রেসপেক্টেবল্‌ ডোমেস্টিক ওয়ার্ক।ইট ডেন্টস্‌ ইয়্যোর মেল ইগো?”
    -“ন্যাউ, সি ফর ইয়্যোরসেলফ হ্যু ইজ্‌ জেনারালাইজিং দ্যিস কম্‌প্লিট নন্‌ ইস্যু! যাগ্‌গে ছাড়ো,তোমার সঙ্গে কোনোদিনই তর্কে পারবো না আমি।আর কোনো হেল্প লাগবে?আমার আরও অন্য কাজ আছে”
    -“নাহ্‌, ঘাট হয়েছে আমার! আর কিছু করতে হবে না তোমায়”
    কি কথার কি পরিণতি! দ্বিরার অভিমানাহত মুখখানা বুকে গেঁথে আছে ব্রতীনের। এখনও। ভালবাসার নিজস্ব শাস্ত্রমতে, তার রুলবুকের নাম্বার ওয়ানে একপক্ষের অভিমানের উত্তরের মানে অন্যজনের প্রত্যাশাহীন আত্মসমর্পণ হতে পারে; কিন্তু জাগতিক জীবনে এ নিয়ম চলে কি?দুটি বুদ্ধিমান মানুষ তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনার নিক্তিতে তুলে এ নিয়মের সূক্ষ্ণ হিসাব কষবেই।ধীশক্তি বিনিময়ের কিছু মূল্যমান যে দিতেই হয়!সে কেন পারেনি সেদিন দুপা এগিয়ে দ্বিরাকে টেনে নিতে দৃঢ় আলিঙ্গনে? দ্বিরা কেন পারলো না আত্মঅহং শিকেয় তুলে তার মুখের দিকে তাকাতে?পরে,সময়ের পলিতে নিভে আসা ক্রোধের নিভু আঁচে, যখনি সে ফিরে দেখেছে সেদিনের ঘটনা পরম্পরার দিকে তখনি তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে তার হৃদয়।ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি না মনে আসার ক্ষোভে,বেঠিক সময়ে বেঠিক কথাটি বলে ফেলার মর্মবেদনায়।
    সেদিন প্রায় নীরবে সমাপ্ত হয়েছিল নৈশভোজন।বাচ্চারা বুঝতে পেরেছিল একটা মেঘলা আকাশ থমকে আছে তাদের ডাইনিং টেবিলের উপর, নাড়া দিলেই বুঝিবা ঝরে যাবে অঝোর ধারায়।কুটুন খেতে বসলেই অজস্র প্রশ্ন করে।বারবার তাকে বলতে হয়
    -" স্টপ টকিং সো মাচ, বিষম খাবে"।
    -“এত প্রশ্ন না করে ট্রাই টু চ্যিউ ইয়োর ফুড"।
    সেদিন তার সে দু একটা হাল্কা অনুসন্ধিৎসা বাকিদের সুকঠিন নীরবতার হিমবাহের ধাক্কায় পর্যুদস্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিল।তাতান তার পনের বছরের সদ্য লব্ধ গাম্ভীর্যের ভারিক্কীপণায় ছোটোভাইকে বারদুয়েক নির্দেশ দিল খাওয়া শেষ করে নিজের নিজের বেডরুমে চলে যাবার।নিঃশব্দে ডিশওয়াসার ভর্তি করলো ব্রতীন । পরেরদিনের ব্রেকফার্স্ট এর উপকরণ সাজিয়ে রাখলো দ্বিরা।
    -"শরীর ভালো লাগছে না। আমি উপরে চলে যাচ্ছি। তোমার কি কিছু লাগবে ব্রতীন?"
    -"নাঃ, গুডনাইট"
    গুডনাইট! প্রতিদিনই রান্নাঘরের কাজের শেষে ব্রতীন খানিকক্ষণ টি ভি দেখে বা ল্যাপটপ নিয়ে বসে। দ্বিরাও পাতা ওলটায় কোনো ম্যাগাজিন বা জার্নালের। তাদের “আস” টাইম ।পাশাপাশি এক সোফায় খোলা অথচ না দেখা টেলিভিশনের মৃদু গুঞ্জনের সাথে সাথে তারা কোনো পুরোনো রসিকতা শুনে হাসে,ধরে থাকে পরস্পরের করতল,অনুভব করে তাদের প্রায় চব্বিশ বছরের সান্নিধ্য। বড় দূর্লভ্য,কবোষ্ণ সেই মুহূর্তগুলি।

    সেদিন দ্বিরা সরাসরি চলে গেল উপরে। ব্রতীন আধঘন্টা বেশী সময় কাটালো ল্যাপটপ নিয়ে। সে বোধকরি অপেক্ষা করছিলো দ্বিরার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। মেঘের মত গাঢ়, তীব্র তমসাময় দ্বিরার অভিমান।ব্রতীন জানে।বহুবার তারই সামান্য ছোঁয়ায় হয়ে গিয়েছে ধারাবর্ষন। তারপর নেমে এসেছে সুস্নিগ্ধ কোমল পেলবতা।বর্ষনক্ষান্ত সুশীতল সান্নিধ্যের সেই দিঘীতে কতবার ডুব দিয়েছে ব্রতীন।প্রতিবারই পেয়েছে অসীম প্রশান্তি। এবার পাবে কি? ব্রতীনের ভয় করছিলো।
  • de | 69.185.***.*** | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৩:০৩651603
  • বাঃ! চলুক!
  • dee | 102.3.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৬651604
  • দ্বিরা

    নারী পুরুষের সমাজসিদ্ধ সম্পর্কে রোম্যান্ট্যিক ভালবাসা ঊষর হয়ে এলেও অবশ্যম্ভাবি ভাবেই থেকে যায় সেক্স।বিয়ের পরপর প্রথম দু তিন বছরের মাতামাতিটা কেটে যাবার পরই হলো এই সেতুবন্ধন সূচক যৌনতার আসল ম্যারাথনের শুরু।কর্তা গিন্নির ঝগড়ার চোটে পাড়ায় কাক চিল বসার জো নেই কিন্তু ওদিকে বছর না ঘুরতেই ছানাপোনার উদয় হচ্ছে এরকম ঊদাহরন চাইলে ভুরি ভুরি মিলবে। অভ্যস্থ সম্পর্কের কানাগলিতে, তেল নুন চিনির হিসাবের ভুলভুলাইয়াতে,দাম্পত্য উষ্ণতা হারিয়ে ফেলা তখন খুব একটা কঠিন নয় । চেনা ছকে একবার পড়ে গেলেই চাকা চলতে থাকে তার স্বয়মক্রিয় গতিজাড্যে,মাঝেমাঝে নিয়মমাফিক শারীরিক সঙ্গ বিনিময় করা বা পারস্পারিক বোঝাপড়ার তেল-মবিল তাতে ঠিকঠাক সময়ে উচিত সঙ্গতে পড়লেই চলে।চারাগাছ অজান্তে হয়ে ওঠে মহীরূহ। শ্রান্তির সময় তার ছায়া পাওয়া চলে কিন্তু এক অতূলনীয় বিকেলে যে কুসুমটি অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিল তার সৌরভ তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
    কুড়ি বছর ধরে যাকে আদ্যপান্ত চিনি বলে জানি তাকে কি আর দুবেলা গায়ে লেপ্টে পড়ে সেই আদ্যিপচা ডায়ালগ গুলো বলতে পারা যায় যে "তোমায় ছাড়া বাঁচবো না" বা "তোমায় আমি ভালোবাসি"! যাঃ, বড্ড ন্যাকা ন্যাকা শোনাবে না! "আমি তো আর ওকে ছেড়ে যাচ্ছিনা"’র আশ্বাস তখন হয়ে ওঠে পায়ের তলার শক্ত জমি। মাথার উপর খোলা আকাশটার দাবি অবশ্য তাতে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় তা বলা চলে না, শুধু ধুলোর আস্তরণটা সরিয়ে তাকে খুঁজে নেবার দৃষ্টিটা হয়ে থাকে ঝাপসা । ইদানীং অবশ্য এটা খুবই হ্যাপেনিং ইশ্যু। “রিভাইভ ইয়োর রিলেশনশিপ”এর গুরুরা দিব্যি দুপয়সা করে খাচ্ছেন।
    দ্বিরার ধারনা দাম্পত্য সম্পর্কের এই আপাত নিয়ারসাইটেড নেসের চোখরাঙ্গানি টাই সে বরাবর স্বতপ্রনোদিত ভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। জয় করতে চেয়েছে বাঁধা গতের নিশ্চিন্ততার আশ্বাস। ব্রতীন বরাবরই কথা কম বলে। তার আবেগ মাপা,উচ্ছ্বাস অনুপস্থিতপ্রায়। কিন্তু সে সাথেসাথে না থাকলে কি পারতো সে এহেন গাড়িটা এতবছর দিব্যি চালিয়ে নিয়ে যেতে।গাড়ীর ভাষায় বলতে গেলে দু এক বারের বেশী সার্ভিসিং লাগেনি, সামান্য আয়াসেই “এম ও টি” পাস করে গিয়েছে তথাকথিত “সেভেন ইয়ার ইচ্‌” জাতীয় কোনো ঘটনা না ঘটেই।এখনও পারস্পরিক সান্নিধ্যে তারা আশ্রয় খুঁজে ফেরে।শারীরবৃত্তীয় প্রাপ্তির বাইরে কোনো অতীন্দ্রিয় সুখের সন্ধান করে রোজনামচার দাম্পত্যের গন্ডীর ভিতরে।কাব্যিক শোনাচ্ছে বোধহয়। জানে দ্বিরা। সে জন্ম রোমান্ট্যিক।প্রথম পরিচয়েই ব্রতীকে সে উপহার দিয়েছিলো মৈত্রেয়ী দেবীর “ন হণ্যতে”।প্রেমের শুরুতেই বিরহগাথা!ব্রতী পরে এই নিয়ে প্রভূত ঠাট্টা করেছে তাকে।জানতে চেয়েছে “ এ ব্যাপারটা ফেল মারলে তোর ব্যাকআপটা কি ছিল শুনি?” কিচ্ছু না।লাজুক ভাবে পালানোর চেষ্টা করতে হয়েছে।লাভ হয়নি।ব্রতী খোলা হেসে বলেছে “হোপলেসলি রোমান্ট্যিক দেখছি আমার পাগলী বউটা। আয় চা করছি, খাবি আয়”। একপক্ষের হৃদয়ভারাক্রান্ত সূচনার উত্তরে অন্যপক্ষের বাস্তব উপসংহার।এহেন মানুষকে কি করে রাবীন্দ্রিক কাব্য বা কালিদাসের মেঘদূতের “আষাঢ়স্য প্রথম দিবস—“ বোঝানো যাবে!
    তাদের পূর্বরাগের প্রাথমিক সময় পর্যন্ত দিব্যি বেঁচে ছিল চিঠি লেখার অভ্যাস। কচিদ্‌-কদাচিৎ গ্রিটিংস কার্ডের আদান প্রদান।অধুনার বিশ্বগ্রাসী মোবাইল মেসেজিং তখন কোথায়? ইন্টারনেটের দুনিয়া সবে হাঁটি হাঁটি পা পা ফেলার চেষ্টায় রত। অস্বীকার করলে মিথ্যাভাষণ হয় কারন দু চার খানা চিঠি ব্রতী লিখেছিল বটে। ইনল্যান্ড লেটার আর পোস্টকার্ড। পোস্টকার্ড! ভাবা যায়! একবার কলেজ ছুটিতে বাড়ী থাকাকালীন তার ভাই একখানা পোস্টকার্ড এনে দিয়ে মুচকী হেসেছিল “দিদিরে এ ম্যাটেরীয়াল তুই মানুষ করবি কি করে এখন থেকে ভেবে রাখ”। দ্বিরা অবশ্য অগুন্তি চিঠি লিখে সংখ্যার দৈন্য একপক্ষের তরফ দিয়েই পূর্ণ করে দিয়েছিল। প্রায় রোজই যাদের মোলাকাত হয়ে থাকে তাদের পক্ষে যাকে বাড়াবাড়ি রকমের রোমান্ট্যিকতা বলা যেতে পারে। তারপর সেই সব আবেগপ্রবণ মর্মবেদনার ঝাঁপি একদিন আত্মগোপন করলো কালের অতলে।দ্বিরা, তখন তারা সদ্য সদ্য বিবাহিত, বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে
    -“ব্রতী, আমাদের মানে আমার লেখা সেই চিঠি গুলো কোথায় গেল? এই মাঝেমাঝে আবার ফিরে পড়তে ইচ্ছা করে। কীসব ছেলেমানুষীই না করেছি সেসময় বলো” ইত্যাদী। দ্বিরার ছেলেমানুষীর প্রসঙ্গে ব্রতীন বরাবরই একমত।
    -“তুই কি এখনোও বড় হয়েছিস বলে তোর ধারনা?ওসব ভুলে যা।মা তোর জন্য কি একটা কিনেছেন পছন্দ হয় কিনা দ্যাখ গিয়ে যা--” মানে পত্রপ্রাপকের হাবভাব হল আসল যখন পাওয়া হয়েই গেছে তখন আর ওসব খুচরো সুদের তূচ্ছ্য হিসাব করার দরকার কি? কিন্তু পড়াশোনার প্রবল চাপের ফাঁকে ফাঁকে “বহুদিন ধরি বহু শ্রম করি” মক্স করে লেখা, বহু জবজবে কোটেশণ ভরা চিঠি গুলির সত্যি সত্যি মহাকাল প্রাপ্তি হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে দ্বিরা একবার চেপে ধরতে বহু চেষ্ঠায় শেষমেষ ঝুলির বেড়াল বেরোলো।ব্রতীন স্বীকার করলো
    -“ মানে আমার পুরোনো হোস্টেলের এক জুনিয়ার রুমমেটের ড্রয়ারে রেখেছিলাম বোধহয়। সুনীল। চিনতিস তো ওকে ।ও তো এখোনো ওখানেই আছে—তুই ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?আরে ঠিক আছেরে বাবা একবার সময় করে গিয়ে চেয়ে এনে দেব”
    -“তুমি কি বলে আমাদের ওইসব পার্সোনাল চিঠি সুনীলের ড্রয়ারে ফেলে চলে এলে? কেউ করে এরকম!সব খোলা চিঠি; নাকি খোলাই নয়?তুমিও কোনোদিন একটাও খুলে দ্যাখোনি?”
    -“ধ্যুত্‌! কি সব আবোল তাবোল বকছিস্‌, না না আমি পড়েছিরে বাবা।আরে তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? সুনীল একটু সুবোধ বালক টাইপ।ও অন্যের চিঠি পড়বে না।কাল ছুটি বলছিলি, চন্দননগর যাবি নাকি?ছোটোমাসী গতরোব্‌বার এসে মার কাছে অনেকবার আমাদের দুজনকে যেতে বলে গ্যাছে”
    অস্বীকার করলে অসত্যভাষণ হয়, সেগুলি কিছুদিন পর ব্রতীন উদ্ধার করে এনেছিল বটে।উদ্দিষ্ট প্রাপক মাত্র একবার(তার বেশী অসম্ভব)পড়ে থাকলে ওগুলির দশা ইংরাজী ভাষায় যাকে বলে অতখানি “ওয়েল লাভ্‌ড অ্যান্ড ওয়েল লিফ্‌ড” কি করে হয় সে বিষয়ে তার আজীবন ঘোরতর সন্দেহ রয়ে যাবে।
    অদ্যাবধী স্থিতাবস্থা বজায় থেকেছে তাদের সম্পর্কের নিঃভৃত পরতগুলিতে। একসাথে কখোনো সখোনো দোকান বাজারে গেলে নিজেই নিজের জন্য ফুল কেনে দ্বিরা।ব্রতীন চেক আউটে গিয়ে চাল ডাল এর সাথে সাথে মূল্য চোকায় আধফোঁটা গোলাপ কুঁড়িদেরও। নির্বিকার,অন্যমনষ্ক ভঙ্গীতে। কিন্তু নিজেদের প্রতি বন্ধুত্বের বিষয়ে বরাবর বিশ্বস্ত থেকেছে তারা । অন্যজনকে যে নির্দ্বিধায় বলা চলে জীবনযুদ্ধের প্রতিটি ঘাতপ্রতিঘাতের কথা এ সত্য ছিল অনস্বীকার্য, তাদের যৌথজীবনের প্রতিটি দিনযাপনে।এমনকী আদ্যরসের অতি নিভৃত অন্তঃরঙ্গ মুহূর্ত্ত গুলিতেও ওরা হয়ে উঠতে পারতো পরস্পরের আত্মাসঙ্গী। দ্বিরার মনে পড়ে এরকমই একবার, একটি সম্ মুহূর্ত্তে কি একটা রসিকতা মনে পড়ে অন্যমনষ্ক হয়ে হেসে উঠেছিল সে। তৎক্ষনাৎ সেটা খেয়াল করেছিল ব্রতী। দাবি করেছিল তাকে তক্ষুনি তক্ষুনি সেটা বলতেই হবে। তারপর দুজনেই আবার একচোট হাসাহাসির পর "এবার অমনোযোগী হবার ডবল শাস্তি দেওয়া হবে" বলে গভীর আশ্লেষে আপ্লুত করেছিল ওকে।ব্রতী এখন আর সে সব কথা মনে রাখে না।সারারাত পাশে শুয়ে থাকে, নিঃশব্দে,খানিকটা উসখুস করার পর সারাদিনের কর্ম ক্লান্তিতে অবশ্যম্ভাবি ভাবেই তাকে গ্রাস করে নিদ্রা। অতি ভোরে উঠে চলে যায় নিজস্ব কাজে।

    ব্রতীন

    আচমকা তীব্র হর্ণের শব্দে যেন চিন্তার তার ছিঁড়ে জেগে উঠলো ব্রতীন। পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গাড়ীর ড্রাইভার ভৎসনা সূচক মাথা নাড়ছে। এইদেশে হর্ণের শব্দ প্রায় শোনা যায় না বললেই চলে। হর্ণ মানেই হল তোমার আনাড়ী গাড়ী চালানোকে কড়া বকুনি দেওয়া হল।
    -"অলরাইট, অলরাইট, আই ন্যো!"
    মোটোরওয়ে ছাড়ার মুখে বড় রাউন্ডএবাউট টায় গাড়ীর গতি নিয়মমাফিক ভাবে কমাতে দেরী হয়েছে তার। সে অত্যন্ত সাবধানী ড্রাইভার, কুশলীও। কিন্তু আজ তার হাত পা যেন তার মস্তিষ্কের বশবর্তী ছিল না। "অটোপাইলট না আরো কিছু!" তিক্ত হাসিতে কুঞ্চিত হলো ব্রতীনের ঠোঁট। হসপিটালে গাড়ী পার্ক করার পরও আজ তার হাতে আধঘন্টা সময় থাকবে। অন্যান্যদিন প্রায় পড়িমড়ি করে ছুটতে হয় ডিপার্টমেন্টে। এখানেও অবশ্য তার একটা ছোটো মাথা গোঁজার ডেরা আছে। হাসপাতালের নিজস্ব সাদামাটা সিংগল একোমোডেশন। সপ্তাহে নিয়মমাফিক একদিন অনকল ডিউটি পড়ে তার । সেদিন ছাড়াও আরও দিন দুয়েক সে কিছুদিন ধরে এখানেই রাত্রিযাপন করছে। প্রতিদিন লম্বা ড্রাইভিং এর ধকল এড়ানোর জন্য এ সিদ্ধান্ত তারা যৌথভাবেই নিয়েছিল। কিন্তু এখন আফসোস হয় ব্রতীনের। ইদানীং কেন জানিনা তার মনে হতে শুরু করেছে দ্বিরা যেন বহু ছোটোখাট তূচ্ছাতিতূচ্ছ্য ব্যাপার নিয়ে অনবরত ভুল বুঝছে তাকে। দ্বিরার দীর্ঘকালীন ব্যাপী অসুস্থতার কারনে নানান সাংসারিক ক্ষেত্রে এখন তাকে কিছু কিছু দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। প্রায় একা একাই। অবচেতনে কাজ করে প্রকৃতিকে আগলে রাখার পুরুষের আদিম প্রবৃত্তি। নিজের অজান্তেই সে হয়ে পড়ে অনমনীয়, প্রটেক্টীভ। তারপর অবধারিত ভাবেই এই প্রচেষ্ঠা প্রতিহত হয় অন্যজনের ব্যক্তিত্ত্বের দেয়ালে। একটিও বাক্যবিনিময় না করেও নিঃশব্দে কখন তূনীর থেকে বেরিয়ে আসে নীরব অবহেলার শানিত শস্ত্র। যুযুধান পক্ষের মতো ক্ষতবিক্ষত হয় দুজনেই। সমাধান মেলে না। দ্বিরা কিভাবে তার এই আপাত রিজিড মনোভাব কে পড়ে এখন? নিজের মানদন্ডে সে কি এইই ভাবে যে ব্রতীন হুকুম করছে তাকে,নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে দ্বিরার যাবতীয় ইচ্ছা অনিচ্ছাকে। সেদিন যদি জোর করতো সে এই একা ফ্ল্যাটটা না নিয়ে রোজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করার ব্যাপারে তাহলে কি এইসব মান অভিমান দুঃখ টুঃখ ঘটতোই না তাদের জীবনে!কে জানে? দ্যি হাইন্ড সাইট ইজ্ এ বিউটিফুল থিং!
    সেই সেদিনের সামান্য রান্না ঘরের ঘটনাটা কেন যে হয়ে উঠলো এত প্রলম্বিত!সেই শুরু। তারপর টানা দু সপ্তাহ দ্বিরা ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে নি ব্রতীনের সঙ্গে। এক ছাদের নীচে বসবাস করা দুটি অন্তঃরঙ্গ মানুষ বেশী দিন এরকম ছেলেমানুষি নীরবতা চালিয়ে যেতে পারে না। সংসারের কেজো কথাগুলো তো বলতেই হয়। দ্বিরাকে চিকিৎসার প্রয়োজনে যেতে হয়েছে বিভিন্ন ক্লিনিকে, ব্রতীন সঙ্গে গিয়েছে প্রায় প্রতিবারই, নিখুঁত অভিনয় করেছে তারা পারস্পারিক সহযোগিতার। নিটোল দাম্পত্যের। কিন্তু দ্বিরা যেন বা তাকাতেই ভুলে গিয়েছে তার চোখের দিকে। যেন দৃষ্টিপ্রক্ষেপণেই এক সমুদ্র নোনাজল উপছে যাবে বহিরাঙ্গের এইসব মিথ্যা অভিনয়ের নুড়ি পাথরে জোর করে আটকে রাখা সীমানা। একই অভিমান কষ্ট দিচ্ছে তাদের দুজনকে। সেই কলেজের ছেলেমানুষির দিনগুলোর মতো। একই অস্ত্র ক্ষতবিক্ষত করছে তাদের হৃদয়। তার পাশে রাতের পর রাত নিঃসাড়ে শুয়ে থাকে দ্বিরা। যার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাড়া মেলে তাকে করা যায় না কোনো প্রীতিসম্ভাষণ। আজীবন ভালোবেসে আসা তার প্রেমিকাকে সে ছুঁতেও পারেনি গত দু সপ্তাহ। ওকে জাগিয়ে তোলার কামনায় মাঝে মাঝে জ্বালা করতে লাগে ব্রতীনের শরীরে। জোর করে বুকে চেপে ধরলে ও কি সাড়া না দিয়ে পারবে? কিন্তু কোন জীয়ণকাঠির ছোঁয়ায় ওর ঘুম ভাঙ্গানো যাবে? সে কাজটা যে কেন ক্রমশঃ অনতিক্রম্য হয়ে উঠছে ব্রতীনের কাছে।
    তার নিজের হৃদয় তীব্র অভিমানে, প্রগাঢ় দুঃখে ক্রমশঃ পুড়ে যেতে থাকলেও সে সময় দিতে চাইছিল দ্বিরাকে। বড় কঠিন অসুখে দীর্ঘদিন কষ্ট পেয়েছে ও,এখোনো পাচ্ছে। বড় নরম হয়ে আছে ওর মনের জমি, অল্পে আঁচড় লাগে। নিক সময় ও। ব্রতীন অপেক্ষা করতে ভয় পায় না। কিন্তু গতকাল ততোধিক তূচ্ছ্য আর একটা ঘটনায় সব আবার কেমন উল্টেপাল্টে গেল।
    প্রায় তিনদিন পরে গতকাল বাড়ি ফিরেছিল ব্রতীন। সে যখন গাড়ী পার্ক করতে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল দ্বিরা। হাতে শপিং ব্যাগ। বাজারে যাচ্ছে। জানলার কাঁচ নামিয়ে চেঁচিয়ে ডেকেছিল ব্রতীন
    -"চলে এসো ,আমি নিয়ে যাচ্ছি"
    অন্ধকার রাস্তায় তখনো পথে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ীকে চিনে উঠতে পারেনি দ্বিরা। চমকে তাকিয়েছিল, খুঁজছিলো চেনা স্বরের উৎস। তারপর সেই একই গাঢ় অভিমান ভরা সুরে বলে উঠেছিল
    -"থাকনা,আমি তো বেরোচ্ছিলামই। তুমি বাড়িতে যাও। এতটা ড্রাইভ করে এসেছো"
    -"আরে দুৎ! আমি তো গাড়িতেই আছি এখোনো; তোমার আবার উইন্ডস্ক্রীন গরম করতে সময় লাগবে, হাজার ঝামেলা, কি দরকার , চলে এসো। আর টেসকো তো মোটে দেড়মাইল দূর; ও কিছু না, চলে এসোতো"
    একটু বুঝিবা দ্বিধা ছিল ওর পায়ে, কিন্তু তর্ক করলো না দ্বিরা। কথা বলার ব্যাপারটাই কিজানি কেন এড়িয়ে যেতে চাইছিল যেন ও। তাইই মনে হচ্ছিল ব্রতীনের। গাড়িতেও নীরব হয়ে বসে রইল দ্বিরা। তারপর নিঃশব্দে ঘুরতে লাগলো সুপারমার্কেটের আইল গুলোতে। মুখে আষাঢ়ের মেঘ,শূন্য দৃষ্টি। কিছুই যেন কেনার নেই আজ ওর। ভালবাসার মানুষ বকাঝকা করুক ,ঝগড়া করুক সেসবের তবু একটা মানে হয়। কিন্তু সমস্তদিন ব্যাপী পরিশ্রমক্লিষ্টতার সাথে সাথে প্রিয়জনের উপেক্ষার গ্লানি আর যেন সইছিল না ব্রতীনের। তিক্ততার সাথে বিন্দু বিন্দু মিশছিলো অসহায় বিরক্তি। কিছুই যখন কেনার নেই তাহলে একটু আগে ঘটা করে বাজারে আসার অত তোড়জোড় করা হচ্ছিলটা কেন? অপ্রয়োজনে,শীতের সন্ধ্যায়, এইসব ঝুটঝামেলা করার দরকারটা কি বাপু। নাকি ব্রতীনের সঙ্গই আর ভালো লাগছে না, কিছুতেই যেন তাকে আর সইছে না দ্বিরার।
    এসব দৈন্যন্দিন গ্রসারি কেনাকাটির ব্যাপার ট্যাপার গুলোতে দ্বিরার পছন্দ অপছন্দই বরাবর নির্দ্ধিধায় মেনে এসেছে ব্রতীন । সুবিধা,প্রয়োজন ,সাশ্রয় সবই একাধারে মিটে যায় তাতে। কিন্তু আজ আর এসব প্রশ্ন করাকরিতে যেতে চাইছিল না সে। কি দরকার অযথা ঝামেলা বাড়িয়ে। এতদিন বাড়িতে সে যা যা মোটামুটি রোজ ব্যবহার হতে দেখেছে সেই সব সামগ্রী যা তার চোখে পড়ছিল স্মৃতির ভরসায় সুপারমার্কেটের সাজানো তাক থেকে টেনে টেনে ট্রলীতে তুলছিলো সে। কোনরকমে বাড়ি ফিরে এক কাপ চায়ের জন্য কন্ঠ তৃষিত হয়ে উঠছিলো তার।
    মিল্ক আর ডেয়ারী আইল পেরোনোর পর তার খেয়াল হল নির্বাক বিষাদপ্রতিমাটি আর যেন তার পাশে পাশে হাঁটছেনা। ট্রলী নিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল ব্রতীন। ফিরে আসতে গিয়ে দেখলো দ্বিরা থেমে গিয়েছে আইলের মাঝখানে,তারপর তাকটার দিকে একটু এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ফুল ক্রীম মিল্ক কার্টেনগুলোর স্ট্যাকটার দিকে।
    -"আবার ওইসব মিষ্টিফিস্টি বানানোর ধান্দায় আছো তুমি? বারবার বলেছিনা শরীর খারাপ নিয়ে একদম ওসব করতে যাবে না,সারাদুপুর শুয়ে থাকবে নয়তো টি ভি দেখবে"
    তীর বেঁধা পাখীর মতো আহত ভঙ্গীতে দ্বিরার হাত ফিরে এল তাক থেকে। কিন্তু একটিবারের জন্যও সে তাকালো না পর্যন্ত ব্রতীনের মুখের দিকে। ফিরে আসা হাতটি নিজের থেকেই চেপে ধরল ব্রতীনের ছেড়ে দেওয়া ট্রলীর হাতল। তারপর সোজা ঠেলে নিয়ে গেল চেকআউটের দিকে। পয়সা মেটালো নিজের কার্ড দিয়ে, ব্রতীনের হাতে ধরে থাকা পার্সের দিকে ভ্রুক্ষেপও না করে। টিলের হাস্যমুখী মহিলাটির “দ্যেয়ার ইজ আ লাকি ম্যান, ডিডিন্ট নীড ট্যু স্পেন্ড আ পেনি” এর মধুর পরিহাসের উত্তরে ফিরিয়ে দিতে হোলো প্রত্যুৎহাস। এইসব দেশের আবেগের উপর চাপিয়ে দেওয়া মাপা বহিঃপ্রকাশের নিয়োমানুযায়ী। তারপর ধীর পায়ে তারা এগিয়ে গেল পার্কিং লটের দিকে। ফিরতি পথে একটিও বাক্য বিনিময় হলো না তাদের মধ্যে।

    তাতান

    গভীর মনোযোগ সহকারে ফিজিক্সের অঙ্ক কষছে তাতান। কিছুদিন হল তার একটি নতুন গৃহশিক্ষক লাভ হয়েছে। এখানকার একটি স্কুল ছাত্রের শিক্ষাব্যবস্থার হিসেবে এটি শুধু অভিনবই নয় রীতিমতো প্রগতিশীল ধাপ। আর যাই হোক তাতানের উপর মাম আর ড্যাড এই যে হাল্কা প্রেশারটা চাপিয়ে দিচ্ছে আরও আরও বেশী ভালো মার্কস নিয়ে আসার সেটা তাতান যে বোঝেনি তা নয়, তবে এতে তার কোন দুঃখ নেই। সে তো আর কুটুনটার মতো বাচ্চা নেই। এক আধটু স্ট্রেস, কিছু কিছু ডেডলাইন এর চাপ তাকে নিতে পারতে হবে বৈকি। তবে এই টিচারটি বড্ডো কড়া। তিলমাত্র ত্রুটিবিচ্যূতি হলেই তিনি ভারী তিরষ্কারমূলক একটি তেরছা হাসি দিয়ে থাকেন। সহ্য করা শক্ত হয় সেসব। সুতরাং অঙ্কগুলো ঠিক হওয়া দরকার।
    মাত্র পনের বছর বয়সেই সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ত্ব, প্রখর আত্মসন্মানবোধ গড়ে উঠেছে তাতানের। এর পুরো ক্রেডিট অবশ্যই সে তার বাবা আর মা কে দিতে চায়। নিছক বাল্যকালেই সে এসে পড়েছিল তার জন্মভূমি থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মাইল দূরে মহারানীর দেশে। এখানেই তার নিয়মিত স্কুলজীবনের সূচনা। একথা অনস্বীকার্য যে স্কুল এদেশে একটি আনন্দময় পরিবেশ গঠন করে দেয় প্রতিটি শিশুর মানসকোরকে। এখানে নেই সুবিশাল স্কুলব্যাগের বোঝা, নেই দৃঢ়বন্ধন হোমওয়ার্কের চোখরাঙ্গানি। শিক্ষকেরা স্নেহময় এবং শ্রুতিশীল, ছাত্রদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি। প্রতিদিন স্কুল যাবার জন্য মুখিয়ে থাকে তাতান। প্রতি ছমাস ছাড়া ছাড়া পেরেন্ট টিচার মিটিং ডে তে হয় বাবা নতুবা মা আর কোনো দূর্লভক্ষণে দুজনেই যখন টেব্‌ল থেকে টেব্‌ল’এ বিভিন্ন টিচার দের মুখে শুনতে পান তাতানের আকাঙ্খিত সাফল্যের কথা তখন বাবার চোখ আর মার মুখের দিকে তাকালে তাতানের বুক আনন্দে ভরে ওঠে। স্কুল তাকে করে তুলছে আত্মবিশ্বাসী, গড়ে দিচ্ছে তার সাফল্যের সিঁড়ির প্রাথমিক ধাপগুলি। পরিশ্রম চালিয়ে গেলে সে বোর্ডের পরীক্ষায় প্রত্যাশিত সাফল্য পাবেই। জানে সে। তার ছোটো ভাইটিও স্কুলে নেহাত খারাপ ফল করছে না। তারা একটি ভদ্র পাড়ায় মোটামুটি শান্তিতে দিনযাপন করে। তার বাবা মা দুজনেই কঠিন পরিশ্রম করে থাকে এই সুদূর পরবাসে তাদের হাতের মুঠোয়, প্রথম বিশ্বে বড় হয়ে ওঠার যাবতীয় সুযোগসুবিধা এনে দেওয়ার জন্য। ভালো,এই সবই খুব ভালো ব্যাপার। কিন্তু বিগত দু তিন সপ্তাহ ধরে এই সব ভালো ব্যাপার গুলোই যেন তার কাছে একটু অন্যরকম সুরে বাজতে শুরু করেছে। তার বাবা অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে রয়েছে; তার মা একেবারেই হাসছে না।
    তার বাবা আর মা অবশ্য দুজনেই একটু পাগলাটে গোছের। তাদের জেনারেশনের ভাষায় কিঞ্চিৎ “ঊইয়ার্ড”। আরো প্রাঞ্জল করে বলতে গেলে ড্যাড খানিকটা “নরম্যাল ঊইয়ার্ড” আর মাম পুরো “উইয়ার্ড ঊইয়ার্ড”। এটা অবশ্য সে দিব্যি বোঝে যে তার বাবা তার মাকে এখোনো পাগলের মতো ভালোবাসে আর তার মা কোনরকম কারন ছাড়াই ছোটো ছোটো সুখের মুহূর্ত খুঁজে নিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে থাকতে চায়। তার বয়েস পনেরো পেরিয়েছে তার মানে এদের চেনাশোনার বয়স আরও নাহোক কয়েক বছর বেশী । এরা পারে কি করে এইরকম ছেলেমানুষী করে যেতে?
    পশ্চিমী দুনিয়ায় বেড়ে উঠছে সে। প্রতি তিনটি বিয়ের একটি এখানে ভেঙ্গে যায়। অন্তর্জালের জগতে অবাধ যাতায়াতের ফলে এসব পরিসংখ্যান তার অনায়াসায়ত্ত্ব। তার ক্লাসের বহু সহপাঠীদের বাবা মায়েদের জীবনে ঘটে গিয়েছে সম্পর্কের পালাবদল। তার বাবা মা কি করে পারছে এই ব্যাপারটা বিয়ের এই এত গুলো বছর পরেও ? কিন্তু কি এক অদ্ভুদ্‌ সুখে কেন জানিনা টইটুম্বুর হয়ে থাকে তাতানের বুকটা।
    নিজে সে সদ্য বুঝতে শিখছে শরীরের ডাক। বয়ঃসন্ধির প্রথম আহ্বান! প্রাইমারী স্কুলের তার যেসব সহপাঠিনীদের সে এতদিন নাকে সর্দিঝরা পুঁচকে মেয়ে ভাবতো হঠাৎ কোন ভোজবাজিতে তাদেরই শরীরে ঝম্‌ঝম্‌ করে জানান দিচ্ছে যৌবনের জয়ধব্বনি। এরকম কোনো কোনো স্বর্ণকেশীনি বিধুমুখী বা স্বদেশীয়া সুতনুকাদের দিকে তাকালে রীতিমতো চোখ ঝলসে যাবার জোগাড় হয়। তাদের স্কুলে নিয়মিত হয়ে থাকে যৌনশিক্ষার ক্লাস। এখানকার বহু কিশোর কিশোরীরা যৌবনারম্ভের ভালবাসার অনুভূতির আগেই ভালবাসার খেলা খেলতে শিখে যায়। এসব তাতানের অজানা নয়। কিন্তু এত খোলামেলা মেলামেশার জন্যই বোধহয় তাতানের কাছে এসব কোন বিশেষ যৌনচেতনা বয়ে আনছে না। সে ভীষণই ফোকাস্ড এখন। তার পাখির চোখ এখন শুধু স্কুলের শেষ পরীক্ষার দিকে। সেসব নিয়ে তাতান কি অলরেডী ইন্যাফ্‌ ঝামেলাতে নেই? এর মধ্যে মাম আর ড্যাড এসব কি পেটি ব্যাপার শুরু করে দিল!
    এদেশের বেডরুমগুলোর মাঝে থাকে হাল্কা কাঠের আস্তরণ। সে আজকাল প্রায়শঃই গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে। কোনো আচম্‌কা মধ্যযামে তার হঠাৎ কানে এসেছে মৃদু প্রিয়সম্ভাষণ। তারপরপরই অবশ্যম্ভাবী ভাবে “এই! কি হচ্ছে কী!আস্তে কথা বলো, ছেলে জেগে আছে বোধহয় এখোনো!” সিলি রোমান্ট্যিক ফুলস্‌! তাতান ভাবে। এতদিন পরেও তার বাবা মা কি করে এ রসে আপ্লুত হয়ে থাকে এটাই তার কাছে একটা বিস্ময়ের ব্যাপার। একদিন সে কথা সে জিজ্ঞাসাও করে বসেছিল “ ইউ ট্যু গাইস্‌ আর স্যো ভেরী ডিফারেন্ট ইন নেচার; হাউ ক্যুড ইউ স্টিক ট্যু ইচ্‌ আদার ফর সো মেনি ইয়ারস্‌?” হো হো করে হেসেছিল বাবা “এই জন্যই এই প্রশ্নটা তুই আজ করতে পারলিরে বেটা!” ফেয়ার এনাফ্‌। মনে হয়েছিল তাতানের। প্রায় দশ বছর বিলেত বাসের ফলে বাংলাটা তেমন সড়গড় ভাবে বলতে না পারলেও বুঝতে কোনোই অসুবিধা হয়না তার। মাম আর ড্যাড তাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে সবসময় বাংলায় কথা বলে বলেই হয়তো। ইদানীং মা তাকে টিভি তে কিছু বাছা বাছা বাংলা সিনেমা দেখতে উৎসাহিত করছে। সাবটাইটেল থাকার জন্য বুঝতে কিছুই অসুবিধা হচ্ছে না তাতানের। ভালো লাগতে শুরু করেছে তার গোটা ব্যাপারটাই। আর সেই জন্যই সে চিনতে পারে ছুটির দিনের সকালে মাম আর ড্যাডের ঘর থেকে ভেসে আসা হাল্কা সুরে পড়া কোনো একটা বাংলা পেপার। মা বাবাকে “আ-ন-ন্ড-বা-জ্যা-র” পড়ে পড়ে শোনাচ্ছে। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এসব আ্যাকসেস করতে তো প্রবলেম কিছু নেই। কিন্তু পড়ে দিতে হচ্ছে কেন? বাবার তো বাংলা না পড়তে পারার কোনো কারন নেই। বাবা মার গলার স্বর শুনতে চায়! সেটাই আসল। দ্য হোল থিং ইজ্‌ দ্যাট সিলি হরমোন ম্যান – লাভ্‌! ভালো । খুবই ভালো!
    তাহলে এই চাইল্ডিশ ব্যাপারটা হঠাৎ কি শুরু করলো এরা দুজন? অবশ্য মাঝে মাঝেই তুমুল ঝগড়াঝাঁটিও এরা করে থাকে বটে। মা দু চার দিন মুখ ফুলিয়ে রাগ রাগ ভাব করে বলবে “টেল ইয়্যোর ড্যাড দিস্‌” বা “সি দ্যাট ইয়্যোর ড্যাড টেকস্‌ দ্যাট উইথ হিম অ্যান্ড রিমেম্বারস্‌ ট্যু কাম হোম” এট্‌সেট্‌রা -- এট্‌সেট্‌রা। বাবা একটু উদাস উদাস ভাবে কাজকর্ম কি খাওয়াদাওয়া করবে। তারপর মাম একদিন হাপুস ভাবে কান্নাকাটি করবে আর ড্যাড “প্লিজ্‌ সোনা কেন কাঁদছো” এইসব বলবে টলবে। ব্যাস্‌ অল ক্লিয়ার আবার। সব হ্যাঙ্কি ড্যোরি। এইই তো হয়ে আসছে বরাবর। এইই তাতান বোঝে। এবার এসব কি বাড়াবাড়ি শুরু হোলো তাহলে? দাঁতে দাঁত চেপে আবার জোর করে অঙ্কে মন দিচ্ছে তাতান। নাহঃ, ভালো লাগছে না তার একদম। ভাইটা বেজায় ছেলেমানুষ, অলমোস্ট বেবি অফ্‌ দ্যি হাউস! ওকেও এখন আগলে রাখতে হচ্ছে তাতানকে। এই অসহ্য তাপপ্রবাহ থেকে। মাম একটু কান্নাকাটিও তো করতে পারে! লাইক ইচ্‌ আ্যন্ড এভরি টাইম। তাহলেই তো ড্যাড মেল্টডাউন করে যাবে। কেন কিচ্ছুটি করছে না মাম। কেন? এবার এত কি প্রবলেম হলো? নাহঃ ভালো হচ্ছে না এসব। মাম আ্যন্ড ড্যাড নিডস্‌ ট্যু ডু সামথিং ড্রাসটিক নাও। আ্যবাউট টাইম। গোয়িং অন ট্যু লঙ নাও!নিজের অজান্তেই রেগে উঠছে তাতান। সবদিকে চোখ কান বুজে রেখে অঙ্কই তো করতে চাইছে সে। কিন্তু ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।
  • neepa | 113.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১০651605
  • পড়ছি --- ভাল লাগছে।।।
  • dee | 102.3.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৩:৪২651606
  • দ্বিরা

    কলেজ লাইফে দু একবার ছুটকো ছাটকা কাফ লাভ কার না হয়ে থাকে? ওসব হল গিয়ে ওই বয়সটারই ধর্ম। হরমোনের খেলা। হিন্দি সিনেমার বাবা কাকারা যেমন তাদের সুপুত্র-পুত্রীদের মিষ্টি দুষ্টুমি টুষ্টুমির’র পর আকছার বলে থাকেন “জওয়ানি মে তো ঐসী গলতী হো হি যাতী হ্যায়!” আনেকটা সেই রকমই আরকি! এদের সবাইই যে “যদিদং হৃদদয়ং তব” অবধি পৌঁছতে পারে তা হয়তো নয়; আর হলেও যে সেই সব সম্পর্কই ভবিষ্যতে দারুণ টেঁকসই হবে তাওও নয়। আবার যাদের হাত ধরাধরি শেষাবধি গোল লাইন থেকে হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে তারাও যে পরবর্ত্তিকালে সেসব তিক্ততা মনে পুষে রেখে দিয়েছে তেমনও খুব একটা হয় না। সেইসব ঝোড়ো উদ্দাম দিনগুলির দশ বিশ বছর পরে আবার কলেজের পুরোনো সাথীদের কোনো পূণঃর্মিলনের সময় সেদিনের মারকাটারি এক দুজে কে লিয়ে দের দ্যাখা গেছে বুকে রিইউনিয়নের রঙ্‌চঙে ব্যাজ লাগিয়ে হাসিমুখে তাদের পারস্পারিক এবং ঠিকঠাক বেটার-হাফ্‌ দের দিব্যি সেদিনের সখা বা সখীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। আবার তার মধ্যেই কয়েক জন খুঁজতে থাকে গরল মথিত অমৃতের । সেই নিকষিত হেম অমূল্যরতনের সন্ধানে তাদের কেটে যায় সারাজীবন।
    তার আর ব্রতীনের পরিচয়ের মলাট খানা ছিল নেহাতই সাদামাটা। কিন্তু ভূমিকা নিস্তরঙ্গ হলেও পরবর্ত্তি অধ্যায়গুলিতে নানান চমকপ্রদ ঘটনা ঘটতে লাগলো। প্রেমে পড়ার পর ছেলেমেয়েরা সাধারণত গোল্লায় যায় বলে কেতাবে লেখা হয়ে এসেছে। তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু ফল হতে লাগলো উল্টো । সমস্ত ছুটির সকালগুলো কাটতে লাগলো রেফারেন্স বইয়ে মুখ ডুবিয়ে, সারা দুপুর কলেজ লাইব্রেরীতে। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা দ্বিরার কাছে খুব নতুন কিছু নয়। কিন্তু ব্রতীন যেন শীতঘুম ভেঙে জেগে উঠলো। এরপর যা হল তা তার ছাত্র জীবনের ক্যারিয়ারের মাপে প্রায় মেটেরিয়োরিক উর্দ্ধগতি। দুইপক্ষের বাড়িতেই তাদের ঘুরে আসা হয়ে গেল পরিচয়ের মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই। কোনো তরফের থেকেই কোনোরকম আপত্তি ঝামেলা ইত্যাদিতো তো হলই না বরং জুটলো অকুন্ঠ আশীর্বাদ। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে রীতিমত বৈপ্লবিক ফরোয়ার্ডনেস্‌ বলা যেতে পারে। একসঙ্গে তারা শেষ করলো ইন্টার্ন-শিপ। তখোনো পর্যন্ত না হওয়া স্ত্রীভাগ্যে, এম-ডি,এম-এস এর কঠিনতম সর্বভারতীয় স্নাতকোত্তর প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলিতে ব্রতীনের রেজাল্ট হল তাকলাগানো। ধর্মতলার মোড়ে একটি গ্যাজেটশপে ফলাফলের লিস্ট পাওয়া যাচ্ছে শুনে পড়িমড়ি করে ছুটে দেখতে গিয়েছিলো ওরা দুজন। দুজনেরই নাম ছিল বটে সে ক্রমতালিকায় কিন্তু সেই প্রথম ব্রতীনের সাফল্য বহুগুণে ছাড়িয়ে গিয়েছিল দ্বিরাকে। রেজাল্ট দেখে জনা তিরিশেক উচ্চশিক্ষার্থী উৎকন্ঠিত জুনিয়ার ডাক্তারের সামনেই সেদিন, সপ্রতিভ দ্বিরা, লাজুক ব্রতীনকে একটি জম্পেশ চুম্বন করে। সর্বসমক্ষে সেই প্রথম এবং একমাত্র। নাহলে এই খোলামেলা আবেগের দেশে বাস করেও ঘরের চৌকাঠের বাইরে তারা অত্যন্ত রিজার্ভ। তবে আজও রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটলে ব্রতীনের বাহু ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকা,দ্বিরার প্রিয় ব্যসন। সেসব কি আর মনে আছে ব্রতীনের আজকাল?
    ০০০০০০০০০০০০০০০০০
    পোস্টগ্রাজুয়েট ডিগ্রী লাভের পর দেশেই মোটামুটি ভালো প্রাকটিশ শুরু করেছিলো তারা। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফলতাও আসছিলো ধীর কিন্তু নিশ্চিত সমে। তারপর একদিন ইচ্ছা হলো দেখে আসা যাক পৃথিবীর ওদিকটার জীবনটাই বা কেমন। ব্যাস্‌ ! ঊঠলো বাই তো বিলেত যাই! আবার হাঁচোড় পাঁচোড় করে ছাত্র জীবনে পূনঃপ্রবেশ। ফের সংগ্রাম, ফের পরিশ্রমায়ত্ত সাফল্যের নস্টালজিক মদিরতা। তারপর একদিন একখানা স্যুটকেশেই ডালের পুঁটুলি আর ডাক্তারী পুস্তকের চাপাচাপি সহাবস্থান করিয়ে দুম করে এখানে এসে পড়া। এদেশে আসার পরপর, নতুন চাকরীর প্রচন্ড ব্যস্ততার ভিতরেও, একটানা নাইটশিফটের ফাঁকে ফাঁকেই, অগুন্তি নিত্যনতুন রান্না করেছে দ্বিরা। এই মাইক্রোওয়েভ ট্যু মাউথ পিজা পাস্তা পানিনির দেশে সেরকম সত্যিই কোনো প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও। তার বড়োপুত্রের অন্যতম প্রিয় ডিশ পোস্তোর বড়া। এ পরবাসে দশ বছর কাটানোর পরও। ব্রতীন তো মিষ্টির পোকা। এখোনো আগের মতোই ভালোবাসে রসোগোল্লা, সন্দেশ। কুটুন ভাগাভাগি করে নিতে শিখছে বাবা আর দাদার পছন্দ অপছন্দ। এরপর আর সে রান্নাটা না করে থাকবেই বা কি করে।
    অথচ সেভাবে রান্না শেখার সুয়োগই বা সে পেয়েছে কোথায়। সাড়ে সতেরো বছর বয়েসে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের কারাবাস শুরু। আর সেখানের জেলার আর শান্ত্রিরা করতো ঘন ঘন স্ট্রাইক! ছুতোনাতায় হস্টেল মেস বন্ধ। অগত্যা বঁটির ব্যবহার না জেনেই একদিন সাহস করে শিখতে হল ডিমসেদ্ধ থেকে ডিমের কারি। ছুরি দিয়েই আলু পেঁয়াজ রসুন কেটে। সেই শুরু । তারপর ধীরে ধীরে সর্ষে ইলিশের ডিগ্রী অর্জন, কষা মাংসের নুনঝালমিষ্টির সঠিক অনুপাতের সিদ্ধিলাভ, রসমালাই এর উচ্চতায় উত্তরণ।
    ব্রতীন জানে। ব্রতীনই জানে। ব্রতীনের তো ভুলে যাবার কথা নয় হোস্টেলের সেই দিনগুলোর কথা। ব্রতীনের ঝকঝকে হাসিই ছিল তার আনাড়ী হাতের এলোমেলো রান্নাবাটির আস্তে আস্তে পরিণতি প্রাপ্তির সবচেয়ে বড়ো প্রশংসাপত্র। সে ভারী অনুসন্ধিৎসু প্রকৃতির মানুষ। এখনও খুব কম ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয় তার নতুন কোন এক্সপেরিমেন্ট। ভারী চমৎকার বর্ণ নেয় তার হাতের বিরিয়ানী, রাজভোগ হয়ে ওঠে নিটোল বর্তুলাকার। একটু কি বেশী বেশীই স্পর্শকাতর হয়ে পড়ছে সে ? নাকি দীর্ঘসূত্রী অসুস্থতা অনাবৃত করে তুলছে তার স্নায়ুতন্ত্রীদের,তাদের স্বাভাবিক স্নেহপদার্থের সুরক্ষাবর্ম থেকে। প্রতিদিন তার প্রয়োজন হয় অসংখ্য যন্ত্রনানিরোধক ওষুধের, যার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসার পথ ক্রমশঃই যেন শক্ত হয়ে উঠছে। আর কতদিন লাগবে তার পুরোপুরি সেরে উঠতে? কবে আবার সে ফিরে পাবে তার কর্মমূখর বহির্জীবন। সেই মাঝরাতে হাসপাতালের নির্জন করিডোরে ছুটে যাওয়া এক দায়িত্ব থেকে দ্বিতীয়টিতে, সহকর্মীদের সাথে চক্কিৎবিশ্রামক্ষণে ভাগ করে নেওয়া এককাপ চা, সেই রোগীদের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার সাক্ষী হয়ে থাকার মুহূর্তগুলি! যেন কোন এক অন্য জগতের ক্ষনিক পটদৃশ্য বলে মনে হয় এখন। কখনো কুশীলব ছিল কি সে এই জগতটার? আবার কখনো সে ফিরে যেতে পারবে এই দুনিয়াটায়? হয়তো। কিন্তু আজই নয়। এখনও নয়।
    এই অভাব ভুলে থাকতে চেয়েছে দ্বিরা, কিছু না কিছু হাত পা চালানো কাজ দিয়ে। অন্য একটা আকাঙ্খিত কর্মজগতকে ডেকে আনতে চেয়েছে তার এখনকার দুনিয়াটাতে। কাজের জগতটাকে ভুলে থাকার কোনো একটা টেঁকসই বিকল্প বড় দরকার ছিল তার। বেশী বাড়াবাড়ি কিছু করার ব্যাপারে অবশ্য বাড়িতেও আজকাল রয়েছে কড়া নিষেধাজ্ঞা। তার রোগক্লিষ্ট শরীরের, তার মনের ক্ষিন্নতার প্রতি ব্রতীনের আশঙ্কা,প্রোটেকটিভনেস। দৃঢ় জেলারের কড়া নিয়ম।
    -“এটা কিনতে হবে না...তাহলেই তুমি নির্ঘাত দু চারটে রান্না করতে বসবে...”
    -“এত শরীর খারাপ নিয়ে এত কষ্ট করে এইসব সন্দেশ রসোগোল্লা বানানোর দরকারটা কি? সবই তো এশিয়ান সুপারমার্কেটগুলোতে কিনতে পাওয়া যায়। ক টিন চাই বলোনা,কালই হসপিটাল থেকে ফেরার পথে এনে দেব”
    ব্রতীন কেন যে কিছুতেই বুঝতে পারে না। দ্বিরাকেও তো কিছু করতে হবে সারাদিনের এই নিঃশব্দ শূণ্যতা ভরানোর জন্য। সে প্রতিদিনের মধ্যাহ্ণকালীন টেলিভিশন দেখবে না বলে ঠিক করেছে। দু এক দিন তবু ঠিক আছে , তা বলে রোজ রোজ নয়। তার মতে সেটা হল অকর্মণ্যতার কাছে নির্বিরোধ আত্মসমর্পন। সে কাজের মানুষ। সে কাজ চায়। অন্তঃত যতটা পারা চলে ভগ্ণস্বাস্থ্য নিয়ে। হাত পা চালানো সক্ষম মানুষের কাজ একটা। পূর্ণভাবে মস্তিষ্ক,বুদ্ধি প্রোথিত করার মতো কোন ক্রিয়েটিভ, মননশীল কাজ; বাড়িতে থাকলে যার একমাত্র উপলব্ধি সে পায় “বসন ব্যসন” না হোক, “অশন আসন”এ তো বটেই।
    তার হৃদয়ের প্রতিটি শিরার মধ্যে মিশে আছে ব্রতীন। তার ব্রতীন। যে এখনো তার মুখের মাংস-পেশীর সূক্ষতম কম্পনে নির্ভূল পড়ে নেয় তার হৃদয়ের স্পন্দনের ওঠাপড়ার গতি । সেই ব্রতীনই সবচেয়ে রূক্ষ হয়ে ওঠে রান্নার প্রসঙ্গ উঠলেই। একী নিষ্ঠুর নীরবতা ব্রতীনের! প্রিয় মানুষটির হৃদয়ে রক্তক্ষরন না হলে বুঝিবা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায় এর উদ্দেশ্য? ব্রতীন জোর করে বন্ধ করে রেখেছে তার হৃদয়ের এই প্রকোষ্ঠের সবকটি দরজা জানলা । ব্রতীন বুঝতে চায় না।

    ব্রতীন

    তাদের পরিচয় হয়েছিল অতি অনাটকীয় ভাবে। লাভ এট ফার্স্ট সাইট টাইটের তো কোনো গল্পই নেই। কলেজে এই সহপাঠীনি টিকে সে দেখেছে কলেজ ফেস্টে স্টেজে উঠে দাপটের সাথে হালফিলের ফিল্মি গান গাইতে , আবৃত্তিতে জিতে আনতে প্রথম পুরস্কার। মেধার অঙ্কে তো বরাবরই আসতো প্রথম কয়েক জনের ভিতর। প্রথম যৌবনের সেই মহার্ঘ দিনগুলিতে একপক্ষের ইত্যাদি চমকপ্রদ ঘটনাবলী সচরাচর বিপরীত লিঙ্গের নজর এড়িয়ে যায় না। তা অবশ্য যায়ওনি। তবে চেনা খুব শক্ত নয় বলেই দ্বিরাকে চিনতো ব্রতীন। আপাত দৃষ্টিতে শুধু সেইটুকুই। শুরুরদিকে এনাটমি ক্লাসে,বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে, কি কলেজের পিকনিকে এক আধটু উপর উপর মোলাকাত হলেও দু একবারের বেশী বাক্যালাপ পর্যন্ত তাদের মধ্যে হয়েছে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া এহেন সপ্রতিভ একটি অল্পবয়স্ক ছেলে বা মেয়ের দু একজন স্তাবক থাকবেনা এতো একটা অসম্ভব ব্যাপার। ছিলোও। কলেজে এবং তার বাইরেও। অথচ সে কখনোই নিজেকে এদের প্রতিদ্বন্দী বলে ভাবেনি। সে এই দৌড়ে শামিলই ছিলনা।
    কিন্তু দৃষ্টিপরিধির বাইরে অবচেতন আকাঙ্খার আবেদন একদিন ঠিকই পৌঁছে যায়। পৌরাণিক যে দেবতাটি অলক্ষ্যে তার পুস্পধনুটি বাগিয়ে ধরে আরও বহু মানব মানবীর জীবনে প্রণয় নামক মধুর দূর্ঘটনাটি ঘটিয়ে আসছেন এক্ষেত্রেও তাঁর শরসন্ধান ব্যর্থ হলনা। এই ঝকঝকে,আপাত ভিন্নগ্রহের দুঃস্প্রাপ্য মেয়েটি,খুব ক্লিশে শোনালেও,প্রায় পুস্পাঞ্জলির মতো নিজেকে নিবেদন করলো তার কাছে। সেভাবে বলতে গেলে তার তরফে সেরকম কোনও কষ্টকর আয়াস ছাড়াই। অতশত বহুবিধ কর্মকান্ডের ভিতর দ্বিরা কি দেখে, কি করেই বা খুঁজে নিয়েছিল এই লাজুক, শ্যামবর্ণ সহপাঠী টিকে তা এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হয় ব্রতীনের। তারপর কেটে তো গেল এতোগুলো বছর।
    পূর্বরাগ পর্ব চলাকালীনই ব্রতীন আবিষ্কার করলো তার ঝকঝকে প্রেমিকাটি গড়পড়তা বাঙ্গালী মেয়েদের একটি স্টিরিওটিপিক্যাল অবশ্যপালনীয় কর্তব্যেও দিব্যি ডিস্টিংশন প্রাপ্তির দাবী করতে পারে। এর হাতের রান্না ভারী চমৎকার, প্রায় অসাধারণ মাপের ভালো। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে; হাসি, গল্প, স্পর্শে পরস্পরকে জানাজানির কলেজ জীবনের সেই পরম মূল্যবান হীরকদূত্যি দিনগুলিতে, হৃদয়ের উষ্ণতার সাথে সাথে মাত্র কিছুদিন কাটতে না কাটতেই আদান প্রদান হতে লাগলো হাতেগরম টিফিনবাক্সেরও। ভর্ত্তি এবং খালি। খালি অবশ্য শুধু আক্ষরিক অর্থে মাত্র। খালি বাক্স গুলিতে ভরা থাকতো ছিল ব্রতীনের অকূন্ঠ ভালবাসার পুস্পাঞ্জলি, তার প্রাণের অধিষ্ঠাত্রি দেবীর উদ্দেশ্যে। দেবী তা গ্রহনও করতে লাগলেন অনায়াস প্রাপ্তিতে। কলেজজীবনের শেষলগ্নে যখন তারা উচ্চতরশিক্ষার দোরগোড়ায়, তখন দুই পক্ষের অভিভাবকবৃন্দ দরাজ আশীর্বাদ সহ তাদের প্রজাপতি নির্বন্ধনের জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। ব্রতীনের তখন রীতিমত আত্মশ্লাঘা হয়েছিল যে তার বেছে নেওয়া এই মেয়েটির হাতযশের কাছে শুধু তার হৃদয় কেন তার পাকস্থলীটি, তার যাবতীয় স্বাদকোরক কোষগুলিও নতজানু হয়ে থাকতে গররাজি হবে না। দ্য ওয়ে ট্যু এ ম্যানস্ হার্ট ইজ .. সূচক বিশ্বপ্রসিদ্ধ আপ্তবাক্যটিতে তার বিশ্বাস জমাট বেঁধে গেল। আর বৌ এর হাতের রান্না খেয়েই যদি লাইফে সুখ না হোল তবে বিয়ে করে লাভটা কি? বলাবাহুল্য আরও বহু বাঙ্গালী স্বামীর মতো ব্রতীনও এ সৌভাগ্যে বঞ্চিত হয় নি।
    এই নারীটিকেই সে নিবিড় আশ্লেষে কামনা করে এসেছে আজীবন। এরই পেলব শরীরে তার যৌবরাজ্যে অভিষেক। তাদের যৌথজীবনের ফসল দুটি পরম আকাঙ্খিত সন্তান। প্রতিদিন যাদের মুখ দেখলেই আদ্র হয় তার হৃদয়। এখনো ছুটির সকালে তার প্রিয় ব্যসন দ্বিরার মুখে দেশের খবরের কাহিনী শোনা। নিজেই অবশ্য সে করে আনে তাদের প্রভাতী চা। তারপর আবার ফিরে যাওয়া লেপের অভ্যন্তরে। দ্বিরাই তাকে বহুবার পড়ে শুনিয়েছে আনন্দবাজার এর রবিবাসরীয়,সমসাময়িক সাহিত্য, নানান ব্লগের তর্কাতর্কি, সম্পুর্ণ ফেলুদাকাহিনী। কোনোকালেই সে নিজে কবিতা টবিতা তেমন বোঝে টোঝে না। তবে কবিতা পাঠরতা তার প্রিয়ার মুখখানি দেখেই সারাজীবন অসীম কাব্য সুখ অনুভব করে এসেছে ব্রতীন।
    সে ভারী নিয়মানুবর্তী মানুষ। তাদের ছেলেরাও জানে যে তাদের বাবা পার্সের ডান্‌দিকে কলম আর বাঁদিকে রুমাল রাখে। তারা কখনো কখনো তামাশা করে উলটেপালটে রেখেছে সেসব আর ফের এগুলির সস্থান প্রত্যাবর্তনের সময় ব্রতীন দরজার ওপাশে তাদের খোলা হাসি শুনেছে। তাদের মাও প্রায়ঃশই যোগ দিয়েছে এই ছেলেমানুষী খুন্‌সুঁটিতে। কিন্তু এখন যেন বহিঃপ্রকৃতির রূক্ষতার চেয়েও ক্রমেই অনতিক্রম্য হয়ে উঠেছে প্রিয়জনের অন্তরশৈত্য। এই তুষারপ্রতিমাকে কি একবার নাড়া দিলেই ঝরে যাবেনা ঝুর্‌ঝুরে বরফ? তবু কেন একবার ছোঁয়া যায় না ওকে? চোখে যেন জল এসে পড়ছে ব্রতীনের! ভালোবাসার দুঃখ! তাকেও কি কাব্যরোগে ধরলো নাকি? এই বয়সে এসে!এক গভীর শ্বাস ফেলে উঠে পড়লো ব্রতীন। গাড়ির দরজা বন্ধ করে করলো অসীম ক্লান্তিতে। তারপর ভারী পা টেনে হাঁটা দিলো ডিপার্টমেন্টের দিকে।
    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

    কুটুন

    গোমড়া মুখে স্কুল লাইব্রেরীর বইটার পাতা ওল্টাচ্ছিল কুটুন। এটা সে বহুক্ষন আগেই শেষ করে ফেলেছে। তার রিডিং স্কিল খুবই ভালো। স্কুলের টার্ম রেজাল্টে সে বরাবর সর্বোচ্চ সান্মানিক অক্ষরটি অর্থাৎ কথ্য ভাষায় "এ" পেয়ে আসছে। পেরেন্ট টিচার মিটিং গুলোতে হয় মাম বা ড্যাড বা কোনো দূর্লভ দিনে যখন দুজনেরই কাজ ছিলনা ( সে অবশ্য প্রায় হয়ই নি লাস্ট পাঁচ মাস ছাড়া) তখন বোথ ওফ্ দেম সেসব শুনে টুনে এসে তারপর হাসি হাসি মুখে কুটুন কে কত্ব কত্ব আদর করেছে । আর এখন সেসব ব্যাপার গুলো কি করে দুজনেই পুরো ভুলে গেল!
    লাস্ট টু উইক ধরে কুটুনের ওপর শাস্তি জারি হয়েছে যে সে শুধ্যু মাত্র উইক এন্ডে ট্যু আওয়ারস্ ছাড়া একদম কোনো রকম ভিডিও গেম খেলতে পারবে না। তাকে বাকি সময়টা স্কুল লাইব্রেরী থেকে দেওয়া বই পড়তে হবে। ড্যাড থিঙ্কস্ কুটুন নাকি স্ক্রিন এ এডিক্টেড হয়ে যাচ্ছে। আর এর জন্য নাকি দায়ী কুটুনের এক্স-বক্স এর যত ভিডিও গেম গুলো আর টেলির “টপগিয়ার সিরিয়াল”! কোন ছোট্টোবেলা থেকে কুটুন গাড়ি এত ভালোবাসে। নানান গাড়ির মেক, মডেল জন্মবৃত্যান্ত তার কন্ঠস্থ । এই মাম আর ড্যাড ই তো তাকে কিনে দিয়েছে বহু গাড়ি বন্দনামূলক ছবি ওয়ালা বই আর অজস্র কার রেসিং গেম। আর এখন গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কেন? আর বই পড়তে যে বলা হচ্ছে ,তা স্কুল থেকে তো ঊইকে মোটে একটি বই বরাদ্দ। সে তো কুটুন দুদিনে শেষ করে ফেলেছে। ইচ্ছা হলে ওরা টেস্ট নিক কুটুনের। জিজ্ঞেস করুক ওকে। এক্ষুনি পুরো স্টোরীটা বলে দেবে না কুটুন! না হে না , ফাঁকিবাজ সে নয়। তাহলে বাকি সময়টা কেন সে ইচ্ছামত গেমস খেলতে পারবে না? আদেশানুযায়ী বইতো সে পড়ে শেষ করেছে সেই কখোওন। তবে এবার সে প্রাণের চেয়ে প্রিয় এক্স-বক্স গেম না খেলে , তার নয়নমণি টপগিয়ার সিরিয়ালের চোখ ধাঁধানো গাড়ি গুলোর গা শিরশিরোনো কেরামতি না দেখে সে বাঁচে কি করে? নাঃ বড় দের ব্যাপার স্যাপার বোঝাই মুশকিল!
    তার উপর এখন মাম আবার ওর সাথে প্রায় সবসময় ইংলিশে কথা বলছে। আর ড্যাড যদিও বাংলাই বলছে কিন্তু ডাকছে ওকে "টুমি" বলে। পুরোনো এস্কপিরিয়েন্স থেকেই কুটুন জানে এই দুটোই হল খুবই ভাবনার বিষয়। এই দুটোর মানেই হলো ইমিন্যান্ট ডেঞ্জার। তার কারণ হলো এই যে, সে নিজে বাংলা বলায় খুব সড়গড় না হলেও এরা দুজন বাড়িতে প্রায় কক্ষোনো তার সাথে ইংলিশ বলে না। আর সেই জন্যই এতদিন ইন্ডিয়া ছেড়ে আসলেও, প্রায় শৈশবাবধি বিলেত বাস হলেও, বাংলা বুঝতে তার কোনো প্রবলেমই হয় না। তার স্কুলের বহু ইন্ডিয়ান ক্লাসমেটরা তো তাদের মাতৃভাষা জানেই না। কিন্তু এই ব্যাপারটা খুব বেশী দিন চলতে থাকলেই কুটুন ঝামেলায় পড়বে । কারন এর মানে হল মাম আর ড্যাড কোনো কারনে নিজেদের উপর রেগে আছে আর তার যত ঝড় ঝাপ্টা পড়বি তো পড় যাবে তারই উপর দিয়ে। সোজা হিসেব। তাতান কে তো আর ওরা বেশী কিছু বলবে না। ফর ওয়ান, হি ইজ্ নাও ফার টু টল টু লুক ডাউন আপন আর তাতান তো জাস্ট এসব বকা টকা ইগনোর করে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে নিজের হেডফোন আর স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে পড়বে। কুটুনের এদুটোর একটাও নেই। সিম্পল রিজন্ ,হি ইজ্ স্টিল দ্যি বেবি ওফ্ দ্যি হাউস! তারতো এসব পাবার বয়সটাই হয়নি এখোনো। ড্যাডের রিজনিং। সো কোনো আর্গুমেন্টও চলবে না। মাম অবশ্য এত কড়া টড়া হয়ে থাকে না, আর মাঝেমাঝেই কুটুন কে না চাইতেই এটা ওটা টুকটাক টয়েস কিনে দেয়। ড্যাড তো সবসময়ই মামকে বলছে "ছোটো টা কে বড্ড বেশী লাই দিচ্ছিস দ্বিরা, পুরো মাথায় চড়ে বসবে কিন্তু" এট্ সেট্ রা , এট্ সেট্ রা। এই “লাই দেওয়া” মানে যে প্যামপারিং তা কুটুন দিব্যি বুঝতে পারে তবে মাথায় চড়াটা ঠিক লিটারেলি কি সেটা এখোনো গেস্ করতে পারেনি। তবে লাস্ট ট্যু উইক, মাম এতো এতো বেশী গম্ভীর হয়ে আছে যে কুটুনের সব হিসেব ওলোটপালট হয়ে যাচ্ছে। মাম স্মাইল না করলে যে কুটুনের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় এটা মাম কেন যে বুঝতে পারছে না!
    তার উপর এই “টুই” আর “টুমির” ব্যাপারটাই হল আরও সবচেয়ে গোলমেলে। এই যেমন ড্যাড মাম কে সবসময়ই "টুই" বলে। দ্যে ওয়ের ক্লাসফেলোস্ ইন দ্যেয়ার মেডিক্যাল স্কুল আর এটাই নাকি নর্মাল এড্রেস করার নিয়ম ওখানে। ফেয়ার এনাফ। তাহলে মাম কেন সবসময়ই ড্যাড কে "টুমি" বলে আর ড্যাড রেগে থাকলে মাম কে "টুমি" বলে? উফফ্ কি কমপ্লিকেটেড ব্যাপার রে বাবা! ওনলি সিম্পল ব্যাপারটা হলো এরা দুজনেই রেগে থাকলে কুটুন কে “টুমি” বলে ডাকে। এই যেমন মাম "কুটুন সোনা আয় খাবি আয় বাবা" না বলে বলছে " কুটুন,হাউ মেনি টাইমস্ ড্যু আই হ্যাভ টু কল ইয়্যু ফর ডিনার?" অথবা " কুটুন যাও টোস্ট খেয়ে নাও"। আর ড্যাড এর ক্ষেত্রে তো বিপদ আরও বেশী। হসপিটাল থেকে ফিরেই হল্লা গুল্লা করে " কুটুবাবা আয় তো তোকে একটা বওড়ো করে হাগগ্ দিই" বলে সেই প্রায় দমবন্ধ করা জাপটানিটা না দিয়ে বলছে "কুটুন তোমাকে কতবার বলতে হবে যে জুতোর স্নো টা ঝেড়ে তবে ঘরের ভিতরে আসবে" , "কুটুন হ্যাভ ইয়্যু ফিনিশড্ ইয়োর হোমওয়ার্ক বিফোর কামিং ডাউন টু ওয়াচ টি ভি?" । নাও, হ্যাভ দ্যে কমপ্লিটলি গণ ক্রেইজি লেটলি? কোনোদিন করেছে কি কুটুন এরকম গর্হিত কাজ যে জেনেশুনে বেছেবুছে ঠিক এই সময়টায়ই করতে যাবে; যখন ক্লিয়ারলি বোঝা যাচ্ছে সামথিং ইজ্ কোয়াইট নট স্মাইলি বিট্যুইন দ্যিজ্ টু গাইজ্‌? কুটুন কে এরা এতো বোকা ভাবলো কি করে? কবে থেকে আবার কুটুনের স্কুল গাদাখানেক হোমওয়ার্ক দিতে লাগলো? ওরা যে জানে না তাতো নয় যে তার স্কুলেই হোমওয়ার্ক প্রায় সব করিয়ে দেওয়া হয়। আর হোমওয়ার্ক দিলেও কতক্ষণই বা লাগে তা শেষ করতে তার, একটু আধটু আটকে গেলে তাতান কে জিজ্ঞেস করে নেয় সে। তাতান অবশ্য রিটার্ন হিসাবে কিছু না কিছু ঠিকই আদায় করে নেবে তার থেকে। মাম একবার হেসে একটা খুব হার্ড বাংলা টার্ম বলেছিল , মনে পড়েছে , ইয়েস " গুরুডক্‌শিনা" । তা নিক কিন্তু কতো হেল্পও তো করে তাতান তাকে ।
    এই যে মাম একদম ভুলে গেছে লাস্ট ট্যু উইক ধরে যে রাত্তিরে শোবার আগে সে রোজ মাম এর সাথে কয়েক মিনিট সময় কাটায়। বকবক করে স্কুলের কথা ,সে কি কি বিশাল কাজ করেছে সারাদিন তার কথা, আরো কত কি র‍্যানডম্ ওফ্‌ দ্য ট্রাক কথা বলে মামের সাথে সে তখন। কতোদিন সেটা যে সে করতে পারছে না। কী মনখারাপ হচ্ছে তার শুধ্যু মাত্র সেই জন্য। মাম অবশ্য তাকে কিছু বলছে টলছে না আর বকছেও না। শুধু সাপার এর পর চুপচাপ এসে নিজের বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে । কুটুনকে একবার ডাকছেও না নিজের বেডরুমে। এই তাতানই না বাঁচিয়ে দিচ্ছে তাকে এইসময়টাতে। তাতানের ঘরে বসে তাতানের সঙ্গেই সে কতকি কথা বলছে এখন। তাতান যে সব শুনছে তা পসিব্‌লি নয়, কিন্তু আগে হলে যে বলতো "স্টপ টকিং , গো টু বেড" সেটা অন্তত এই কদিন বলছে না। আর মোস্ট ইম্পরটান্ট্‌লি, তাতান ওর ফোনটা নিয়ে কুটুন কয়েক মিনিট কয়েক গেমস খেলতে দিচ্ছে। আচ্ছা এটা আবার স্ক্রীন দেখা হয়ে যাচ্ছে না তো? কি জানি বাবা, একটু ভয় ভয় করতে লাগলো কটুনের। ইনাফ্ ট্রাবল তো হয়েই আছে , আরও বেশী বেশী হোক মোটেই চাইবে না সে।
    এসব এর উপর সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে এই ভিডিও খেলার উপর ভয়ঙ্কর চোখরাঙ্গানিটা। নিষেধ অমান্য করার মতো অবাধ্য সে নয়। মানে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ঘরে আওয়াজ টাওয়াজ মিউয়ুট করে খেললে ওরা তো বুঝতেও পারবে না। কিন্তু কুটুন তা মোটেও করবে না। তার আত্মসম্মান জ্ঞান প্রখর। নিজের জিনিস কেন সে স্নিকিংলি করতে যাবে? আচ্ছা, মাম আর ড্যাড কি আবার আগের মতোই হয়ে যাবে না? হবে না ? ক্যান্ট ইভন থিঙ্ক ওফ্‌ ইট! ইন্‌করিজবল ! কি হয়েছে মাম আর ড্যাডের? আর দ্যে গোয়িং ট্যু বি সেপারেটেড? ডিভোর্সড! আ্যন্ড দেন আর দ্যে গোয়ীং ট্যু ফাইট ওভার হ্যু গেটস্‌ , হোয়াটস্‌ ইট কলড্‌ , ইয়েস “কাস্টডি” অফফ্‌ হিম ট্যু স্ট্যে উইথ? ব্লাই মি! কি হবে তার তখন? খুব, খুবই দুঃখের সময় যাচ্ছে এখন তার। কে এখন হেল্প করতে পারে কুটুন কে?
    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
  • de | 69.185.***.*** | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৪:১৬651607
  • আহারে!!
  • dee | 102.3.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৯:২৬651598
  • ব্রতীন

    যুক্তরাজ্যের হাসপাতাল গুলির নিরবিচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে যান্ত্রিক ক্রমানুবর্তিতায়। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিগত দশ বছর ধরে ব্রতীন এই কর্মযজ্ঞের সামিল হয়ে এসেছে। হাল্কা প্রীতিভাষ বা নিছক ভদ্রতার সম্ভাষণ ছাড়া কারও সময় নেই সহকর্মীর মুখের দিকে তাকানোর। তাই বাঁচোয়া, নয়তো আজ এই স্বভাবমধুর মানুষটির শুষ্ক উদাসীনতা ধরা পড়ে যেত অন্য দের নজরে। আজ একেবারেই ভালো লাগছিলো না ব্রতীনের। আধ ঘন্টার মধ্যাহ্ণ ভোজন বিরতিতে হাসপাতালের কফিশপ থেকে নেহাৎ অপ্রয়োজনীয় একগাদা রেডি টু ইট প্যাকেট জাত খাবার দাবার কিনে ফেলল সে। এককাপ চা ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই দিতে ইচ্ছে করছিলো না তার আজ। হসপিটালের ক্যান্টিনগুলোতে আজকাল নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে হাসিখুশি ভলান্টীয়ার মহিলারা এসে নানান টুকিটাকি জিনিস বিক্রি করেন। অর্জিত অর্থ কাজে লাগে হসপিটালেরই নানান সেবামূলক কাজে। ইদানীং প্রায়ই দেখা যায় এঁদের, এককোনে ছোট্টো টেবিল পেতে হাসিমুখে বসে থাকতে। ব্রতীন নিজেও মাঝে মাঝে কিনেছে কোনো পছন্দসই বই বা সফ্টটয়। একবার ঝোঁকের মাথায় কিনে ফেলেছিলো একটা গার্নেটের মণিবন্ধ। দ্বিরা রসিকতা করে জানতে চেয়েছিলো তার আবার নতুন কোনো গার্লফ্রেন্ড-ট্রেন্ড হয়েছে কিনা, নতুবা গয়না-টয়নার দিকে ব্রতীনের হঠাৎ নজর পড়ছে কিকরে ! আজ এঁরা বসেছেন হোমমেড কেক পেস্ট্রি আর কুকবুক নিয়ে। তার মা হলে সুর করে বলতেন “টকের ভয়ে পালিয়ে এলাম,তেঁতুল তলায় বাস” ! রান্না বান্নার ভূত আজ আর পিছু ছাড়বে না দেখছি ব্রতীনের। ট্যিপিকাল “অভাগা যেদিকে চায়”! এত মনখারাপের ভিতরও হাসি পেল ব্রতীনের। ফিরে এসে ওয়ার্ডের শেষপ্রান্তে নিজের ছোট্টো অফিস ঘরে ক্যারিয়ার ব্যাগ গুলো ফেলে রাখলো সে। আজ সে বাড়ি ফিরতে চায়।
    তারপর আরও চার ঘন্টা অবসরহীন নিশ্ছিদ্র কাজ। এই কাজটা অবশ্য সে ভালোবেসেই করে। মানুষের জীবনের সঙ্কটক্ষনের সাথী হয়ে তার অধিত বিদ্যা আর শাণিত বুদ্ধি প্রয়োগের সাথে সাথে এই পেশাটির মানবিক দিকগুলোও সর্বদা স্পর্শ করে তার হৃদয়। কিন্তু আজ সে সত্যি সত্যিই বারবার তাকাচ্ছিল ঘড়ির কাঁটার দিকে। অবসানের প্রতীক্ষা । গ্লানিময় ক্লক ওয়াচিং। সাড়ে পাঁচটারও পর শেষ হল সেদিনের শিফ্ট। তারপরও প্রায় আরও আধঘন্টা লাগলো পরের শিফ্টের ডাক্তার সহকর্মীটিকে পুংখানিপুংখ্য হ্যান্ডওভার দিতে। মানসিক ক্লান্তিতে আজ আগ্রাসিত তার সমস্ত শরীর। নিজস্ব অফিস ঘরে ফিরে এককোনে পড়ে থাকা দুপুরের কেনা খাবারের প্যাকেট ভর্ত্তি ক্যারিয়ার ব্যাগ গুলোকে কিছু ব্যাকপ্যাকে আর কিছু হাতে ঝুলিয়ে বেরোচ্ছিলো ব্রতীন। তার পাশের ডেস্ক টা স্যামের। স্কটল্যান্ডের এক সুদূর গ্রামের এই বিশালদেহী যুবকটির সাথে তার একটি অনাবিল সখ্যতা গড়ে উঠেছে। স্যামও আন্তরিক ভাবেই পছন্দ করে তার শান্ত মিতভাষী ভারতীয় সহকর্মীটিকে। একবার তার লাঞ্চ বক্স থেকে দ্বিরার পাঠানো চিকেন পকোড়া কাড়াকাড়ি করে খেয়েছিল। স্যামের শিফ্টও তারই সাথেসাথে শেষ হয়েছে।
    -"হাই ব্রোটিন, উড ইয়্যু কেয়ার ফর এ কাপ ওফ কফি? শ্যাল উই গো টু দ্যি ডক্টরস্ মেস?"
    -"থ্যাঙ্কস্ স্যাম, মে বি নট টুডে; ফিল আ বিট আন্ডার দ্যি ওয়েদার"
    স্যামের চোখ পড়ে গেছে ব্রতীনের মুখের দিকে,কোমল হয়ে উঠেছে তার দৃষ্টি।
    -" ইয়া লুকস্ লাইক ইয়্যু নিড আ গুড স্লিপ ; হাউ আর থিংস্ এট হোম?ওয়াইফ্ এনি বেটার?"
    -"গেটিং দেয়ার স্লোলি। টেকিং ইটস্ ওন গুড টাইম্ । থ্যাঙ্কস্ ফর আসকিং স্যাম! স্যি ইয়্যু টুমোর‍্যো।"
    -"স্যি ইয়্যু মেট্ । ড্রাইভ হোম সেফলি!"
    -"ইয়্যু ট্যু; বাই স্যাম"
    সারাদিন উচাটন হয়ে থাকা মনটায় যেন একটু শান্তির প্রলেপ পড়লো। এতটুকু মিষ্টি কথার জন্য এমন উন্মুখ হয়ে আছে ব্রতীনের অন্তর? এতই অসহায় হয়ে পড়ে মানুষের হৃদয়! ভারী কোটটা, এদেশের ভাষায় যাকে বলে পার্কা, গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো ব্রতীন। কারপার্ক অবধি হেঁটে আসতেও যেন পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি শৃঙ্খলিত করছে তার দুই পা। ক্যারিয়ার ব্যাগ গুলো গাড়ীর বুটে রেখে উইন্ডস্ক্রীনের উপর জমে থাকা শুকনো বরফ সরাতে লাগলো ব্রতীন। এবার গাড়িটা গরম করার পালা। এত ক্লান্তি আসে কেন আজ? এখান থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে তার একক বাসার মায়া মমতা অভিমানের বন্ধনহীন, নিস্পৃহ অথচ গরম ঘরটা ডাকছে তাকে। বাড়িতে ওরা জানে তার আজ এখানেই থাকার কথা। ও ঘরটায় একবার ফিরতে পারলেই হয়। কাউকে কোনো কৈফিয়ৎ দেবার প্রয়োজন নেই, শুধু যা হোক কিছু পেটে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিলেই হল। কমপক্ষে একরাতের মতো শান্তি। বড় তীব্র, সামনের এই শীতার্ত তুষার ক্লিষ্ট চল্লিশ মাইল পথের বিপরীতে, বড়ই অমোঘ এই টান । সে আজকে নিয়মভাঙ্গা দিনে ঘরে ফিরছে, এ পথের শেষে কোনো সাগ্রহ প্রতীক্ষা তার ফেরার পথ চেয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু না, তবু সে আজ বাড়ি যেতে চায়। ব্রতীন গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

    দ্বিরা

    রান্না করতে করতেই বারবার চোখের জল মুছছিলো দ্বিরা। বোকার মতো কোনও নোটিশ ছাড়াই উদ্বাস্তু দলের মতো হুড়মুড় করে এসে পড়া অশ্রূ। চক্কিত গতিতে ক্ষণে ক্ষণে এসে ভিড় করছে তার দুচোখের পাতায়। তার মতো উচ্চশিক্ষিতা,ধীমতি মানুষের একি দূর্বলতা! একবার চোখ মুছতে মুছতে সত্যি সত্যি লংকাবাটার ঝাঁজ লেগে গেল তার চোখে। এই রান্নাঘরের লাগোয়া একটি ছোট্ট ওয়াশরুম আছে এই একতলাতেই। গ্যাসের হব নিভিয়ে সেখানে ছুটলো দ্বিরা। চোখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে চোখ দুটো লাল টক্‌টকে হয়ে টয়ে একসা। দেয়ালে ক্যাবিনেটের আয়নায় নিজের মুখ দেখে এবার সত্যি সত্যি হাসি পেল দ্বিরার। এতশত শারীরিক মানসিক উথাল পাথালের ভিতরও। হ্যাঁ,এইবারে ঠিক মানিয়েছে! এক্কেবারে বিয়োগান্ত নাটকের রোরুদ্রমানা নায়িকা। কিচেনে ফিরে ডাইনিং টেবিলে একটু বসলো দ্বিরা। সে যথেষ্ঠ স্থিরমনষ্ক মানুষ বলেই তার বিশ্বাস,তবে রান্নার ব্যাপার টায় সে মাঝে মাঝে সরল সংখ্যাতত্বে গন্ডগোল করে ফেলে। এই নিয়েও আগে ব্রতীনের সাথে তার ছোটিমোটি মন কষাকষি হয়েছে। হিসেব মত অবশ্য দুটোই আইটেম করার কথা ছিল আজ তার। কিন্তু কাজের ছন্দে আরও একটা পদ করে ফেলেছে সে। বাটামাছের ঝোল,কাঁচালঙ্কা, বড়ি টড়ি দিয়ে। এটা ব্রতীনের অন্যতম প্রিয় পদ। ব্রতীনের! পৃথিবীর যাবতীয় পাকপ্রনালীতে যার বিপ্রতীপ মনোগতি, এই বাড়িতে খাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁতুনি তারই সবচেয়ে বেশী। বাইরে থেকে কেনা বা টেক-এওয়ে’র মশলাদার খাবার তারই সহ্য হয় সবচেয়ে কম। পাই,পিজা,পাস্তায় তার তীব্র অনীহা। সেইই সবচেয়ে বেশী সাদামাটা ডাল ভাতের দলে। হোস্টেল জীবনে কম অসুবিধা পোহাতে দেখেনি কি দ্বিরা তাকে। এই নিয়েই।
    সেভাবে বলতে গেলে বিদেশে আসার আগে আগে দ্বিরাই বা দায়িত্ব নিয়ে রান্না করেছে কোথায়। বিয়ের পরপর প্রথম তিনবছর ছিল স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রবল পড়াশোনার চাপ। তারপর পেশাদার জীবনে প্রবেশ করা,তাতান,কুটুন,এখানে আসার প্রস্তুতি। কখন কেটে গেল দশ দশটা বছর। শ্বশ্রূগৃহে বিশাল যৌথপরিবারে দিনযাপন কালে রান্নার অবকাশ বা আবশ্যিকতা কোনোটাই ছিল না। আত্মীয়স্বজন সমাগম হলে আদরের পুত্রবধূ স্বেচ্ছায় দু-একবার পাকস্পর্শ করলেই সবাই বেজায় খুশী হয়েছে সেখানে। মহারানীর দেশে এসেই সে হয়েছে রান্নাঘরের ঝি! যাঃ, ক্যাড শোনাচ্ছে। তবে বাস্তবিক ভাবেই বিগত নয় বছর এ ডিপার্টমেন্টটা বলতে গেলে পুরোপুরি তারই। অবশ্য কোনো অনুযোগ ছিলনা তার এই নিয়ে। সে ক্রিয়েটিভ মানুষ। কলেজ লাইফে বেশ তাকলাগানো গোছের গান গাইতে পারতো, সেরকম কোন প্রথাগত তালিম ছাড়াই। ছবিআঁকা , লেখালেখি সবই সে এক আধটু মক্স করেছে। চঞ্চলা পাহাড়ী তটিনীর মতো তার অনুসন্ধিৎসু মন জীবনের গিরিখাতের উপলসঙ্কুর বাঁকে সর্বদা খুঁজে ফিরেছে নিত্যনতুন অভিনবত্ব। ব্রতীন,অন্যদিকে,ধীর স্থির শান্ত, গভীর দিঘীর মতো। তার সমস্ত উচ্ছ্বাসের প্রশান্তি লাভ হয়েছিল সেই গভীরতায়। কিন্তু ব্রতীনের মনোগতি তাই বলে স্থবির নয়। কবিতা টবিতা নিজে খুঁজে পেতে পড়তে না চাইলেও, শুনতে চাইতো তার প্রতিধ্বনি,দ্বিরার কন্ঠে। অপোজিটস্‌ য়্যাটট্রাকট্‌! তাইই হবে। নিজের অজান্তেই হাসছিলো দ্বিরা। তার দৃঢ়বন্ধন কর্মজগতের দূর্লভতম অবকাশে তার স্থিতধী,প্রিয়দর্শন স্বামীটিকে সে আর কি নিত্যনবীন উপহার দিতে পারতো ? নানান রকম রান্নার পদ ছাড়া! নিজের মুখে সেরকম কোন প্রশংসা সচরাচর করে না ব্রতীন। আহা উহু করা তার স্বভাব নয়। কিন্তু কখনো “কেমন হয়েছে এটা?” জিজ্ঞেস করলে জোড়া ভ্রূরেখার নীচে স্থির দৃষ্টিতে একমুহূর্ত নিরীক্ষণ করে সে দ্বিরাকে। তারপর অনুচ্চ গভীর স্বরে বলা “দারুণ” উত্তরটা কদাচিৎ হয়েছে অনৃতভাষন।
    মাছের ঝোলের টগ্‌বগে ফোটার শব্দে চিন্তার তার ছিঁড়ে জেগে উঠলো দ্বিরা। এবার ওটাকে গ্যাস থেকে নামিয়ে একটু ঠান্ডা হতে দেবার পালা। তারপর ঢেলে রাখতে হবে আঁটসাট বায়ুনিরোধক পাত্রে। ব্রতীন অবশ্য আজ আসছে না। এমনিতেই সে বুধবারে বাড়ি ফেরে না। আর তারপর কালকের সুপারমার্কেটের ঘটনাটার জের আবার এখন কদিন চলবে কে জানে। তারমানে ঠান্ডা হলেই বাক্সবন্দী করে চালান দেওয়া যাবে ফ্রীজের গভীর অন্দরে। ছেলেরা মাছের বেশী ভক্ত নয়। সেই সপ্তাহন্তের আগে তো এটার আর দরকার পড়ছে না। আর তারপরও যে ব্রতীন তেমন উৎসাহ দেখাবে তা তো মনে হয় না। সপ্তাহদুয়েক আগে বিশেষ করে এই নানাবিধ রান্না নিয়েই জোরদার অশান্তি হয়েছে তাদের । যাগ্‌গে যাক। সে এলে খাবার গরম করে টেবিলে তার সামনে সাজিয়ে দিলেই হল। তারপর কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সাধাসাধি করবে না দ্বিরা। একক আবাসনটিতে রাত্রিযাপনের দিনগুলিতে,দ্বিরার রেঁধে দেওয়া দু একটি অনুপান নিয়ে যাবার অনুনয় রূক্ষ ভাবে প্রত্যাখান করেছে ব্রতীন। আর অবজ্ঞা সইবে না দ্বিরার। রোগজীর্ণ শরীরে, ক্লিষ্ট মনের ভার আর বইছে না যেন তার। এইই ঠিক আছে।
    রান্নাঘরের উপকরণ সামগ্রী সস্থানে পাঠিয়ে আর একবার ওয়াশরুমটায় এলো দ্বিরা। তার ছেলেদের স্কুল থেকে ফেরার আর বেশী দেরী নেই।প্রতিদিন বাড়ি ফিরে তারা তাদের মাকে দেখে জীর্ণ মলিন,শোকাক্লিষ্ট ছায়ার মতো। আজ আর তা হতে দেবে না দ্বিরা। আজ সে ঠিক করেছে প্রায় বাইরের পার্টিতে যাবার মতো করে প্রসাধন করবে। এদেশের একটি প্রখ্যাত প্রসাধন বিপননী সংস্থার বিজ্ঞাপনী শিরোনাম হলো “লেট আওয়ার মেক্‌আপ মেক ইয়োর ডে”। অতখানি না হোক কিছুটা প্রসন্নতা অন্তঃত জোগাক এই সব মহার্ঘ প্রসাধন সামগ্রী। সেলফ্‌-প্রিজার্ভেশন। জীবনে কচ্চিৎ কদাচিৎ এরও দরকার আছে বৈকী। একটু “মি-টাইম” চাইছে প্রাণটা এখন দ্বিরার। দোতলায় উঠে কাবার্ড থেকে নতুন কেনা লঙ্‌ড্রেসটা বার করলো দ্বিরা। দু মাস পরেই তাদের বিবাহ-বার্ষিকী। সেদিনের কথা ভেবেই খানিকটা ঝোঁকের মাথায় কেনা মহার্ঘ বসন। না হলে পোষাক-আষাকের সূক্ষাতি সূক্ষ্ণ সৌখীনতা নিয়ে বিশেষ খুঁতখুঁতুনি নেই তার। কর্মজীবনে হাসপাতালের যাতায়াত সে দু চার খানা প্রিয়দর্শণ স্কার্ট ট্রাউজার্সেই দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে। থাক্‌গে পড়ে বিশেষ মুহূর্তের অপেক্ষা, আজই এটা পরবে সে।
    উষ্ণ ধারাস্নানের পর খুব যত্ন করে মেকাপ করলো দ্বিরা। কতদিন ঠিক ভাবে তাকায়নি সে নিজের মুখের দিকে। আজ দর্পণই যেন তাকে সেই প্রশ্ন করে বসেছে। নাঃ ,তেমন ভয় পাবার মতোও কিছু হয়নি এখনো পর্যন্ত। তার মুখের সহজাত লাবন্য অটুট আছে প্রায় একইরকম। দুই কুড়ি পরেও, এই উত্তর চল্লিশেও তার ত্বক বিস্ময়কর রকম মসৃণ। চর্চিত ভ্রূযুগলের নীচে বুদ্ধিদীপ্ত শানিত দৃষ্টি। ভাঁঝহীন নিটোল অধরোষ্ঠকোন। ডিম্বাকৃতি মুখখানিকে ঘিরে রাখা ঝক্‌ঝকে উজ্জ্বল, ঈষৎ পিঙ্গল নিবিড় কেশগুচ্ছে এখনো অতিশয় বিরল রুপোলী রেখা। কলেজ জীবনের সেই মধ্যেক্ষামা চক্কিত তন্বীভাবটি আর না থাকলেও, দুটি সন্তান লাভের পরও সেরকম কিছু মেদাধিক্য হয়নি তার। অতি সামান্য প্রসাধনেই দারুণ ব্যক্তিত্বময়ী দেখায় তাকে। কুটুনের ভাষায় “মাম ইয়্যু শুড ট্রাই ট্যু গো ফর দ্যাট গক্‌ ইয়েনস্‌ টেলি শো, দ্যাট টেন ইয়ারস্‌ ইয়াংগার থিঙ, ইয়্যু উইল লুক ফ্যাবুলাস! “অমৃতম বালভাষিতম”। স্মিত হাসিতে মনটাতে যেন একটু খুশির বাতাস বয়ে যেতে চাইলো দ্বিরার। মেকআপ্‌ শেষ হলে পোষাকের সাথে মানানসই হাল্কা কসট্যিউম জ্যুয়েলারী পরলো সে । ইয়ার্ডলের সুঘ্রাণ ছড়ালো শরীরের আনাচে কানাচে। আর এখন কিছু করার নেই তেমন। নিচের তলার লিভিংরুমের সোফায় এসে বসলো দ্বিরা। এবার একটু একটু লজ্জাই করছে তার। ভাগ্যিস ছেলেদের নিজস্ব চাবি থাকে আজকাল, নাহলে উঠে দরজা খুলতে গিয়ে তাদের হাঁ করা মুখের সামনে পড়তে হলে ভারী অস্বস্তি লাগতো আজ তার। চলমান টিভির পর্দার দিকে অন্যমনষ্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে শুনতে পেল কুটুন, তাতান ফিরলো স্কুল থেকে। দরজার পাশে ধুপধাপ করে ব্যাগ রাখছে ওরা। কোট স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখছে ভারী কোট, থাবড়ে থাবড়ে কুচিকুচি তুষার কনা তার থেকে ঝেড়ে ফেলার পর। এক্ষুনি এক্ষুনি অবশ্য এঘরে আসবে না ওরা। তাদের সন্তানেরা দুজনেই নিজস্ব ছন্দে এই দেশের আশাপোনুযায়ী সাবলম্বী হয়ে উঠছে। নিজেরাই ওরা নিয়ে নেয় চট্‌জলদি প্রস্তূতিকৃত খাদ্যবস্তু,পছন্দসই ঠান্ডা বা উষ্ণ পানীয়।
    রান্নাঘরে বৈদ্যূতিক কেট্‌লীর শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে এবার। তাতান চা করছে নিশ্চয়ই। এটির একক ব্যবহারে সে সদ্য স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাতানের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকেই আসছে। টিভির শব্দে আকৃষ্ঠ হয়েছে সে। নচেৎ তার মা সাধারণতঃ ডে-টাইম সোপ সিরিয়াল দেখে না। তাতান উঁকি দিল লিভিং-রুমের দরজায়।
    -“ওয়াও! গোয়িং সামহোইয়্যার মাম?”
    -“না;না রে বাবা, এইই এমনিই”
    -“লুকিং রিয়্যেলি নাইস, মাম। তুমি কি চা খাবে? করছি আমি”
    -“আচ্ছা, দে তবে এককাপ। সাবধানে করিস, আসবো আমি?”
    -“নো মাম, আই ক্যান হ্যান্ডেল দিস মাইসেলফ্‌। তুমি বোসো না, আসতে হবে না”
    লঘুপায়ে চলে গেল তাতান, রান্নাঘরের দিকে। হাসল দ্বিরা। দ্রূত পশ্চিমী কেতায় দুরস্ত হয়ে উঠছে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি। চাপা আবেগ,মাপা কৌতূহল। অপরের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি সর্বদা রক্ষা করে চলা এক সন্মানসূচক দূরত্ব। আবার টিভির দিকে মন ফেরাতে চাইল সে । অনুচ্চ শব্দতরঙ্গের ওঠাপড়ার সাথে সাথে বর্ণময়, চলমান, আলোকরশ্মির ছটা কাঁপছে আধুনিকতম টেকনোলজি সমৃদ্ধ আয়ত বাক্সটিতে। দ্বিরা শূন্যদৃষ্টিতে কাঁপনটা দেখল কিছুক্ষণ। তার ভালো লাগছেনা আজ কিছুই। ভারী অমনোযোগী আজ তার হৃদয়।
    দূরদর্শনের নিরবিচ্ছিন্ন ছবি থেকে জোর করে চোখ সরাল দ্বিরা। বাইরেও আজ হয়ে চলেছে বিরামহীন তুষারপাত। প্রথম প্রথম, নতুন নতুন এই পশ্চিমী দেশগুলিতে আসা মানুষের চোখে এই তুষারবৃষ্টি দারুণ অভিনব লাগে। কিন্তু বড়ো শীঘ্রই ফুরিয়ে আসে এর তথাকথিত রোমাঞ্চকর, থ্রিলিং, চার্ম এর ব্যাপারটা! বৃষ্টিপতনের একটা টুপ্‌টাপ,রিমঝিম,ঝম্‌ঝম্‌ ছন্দ আছে। ধারাবর্ষণের সঙ্গীতময়তার মেদুর স্মৃতির বিপরীতে এই সুরহীন তুষারপাতের সাথে জড়িয়ে থাকে এক ক্লিষ্ট বিষাদ। আজও নিশঃব্দ বিষন্নতা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার ধূসর অঞ্চল। শীত প্রতিহত করার জন্য এ বাড়ির প্রতিটি জানালায় লাগানো পুরু ডবল গ্লেজিং কাঁচ। দৃঢ় কাঁচে ধাক্কা খেয়ে তুষারদানাগুলি গলে যাচ্ছে। তারপর গড়িয়ে চলেছে অবিশ্রাম আঁকাবাঁকা জলরেখায়। যেন অঝোরে ঝরে পড়া আকাশের অশ্রুধারা পাত! তাইই হঠাৎ মনে হল দ্বিরার। একটু আগেও খানিকটা রোদ্দুর প্রাণপণে তার নিস্তেজ আভা বিতরণ করার ব্যর্থ চেষ্ঠা করে হঠাৎ কোথা থেকে আঁকশি দিয়ে টেনে এনেছে এক আকাশ জল। ফুরিয়ে যাবার আগে শেষ বিকালের মরা আলো একফালি উজ্জ্বলতার বেশে দুই সারি কাঁচ টপ্‌কে হঠাৎ এসে পড়ল ঘরের মেঝেয়। লুটোপুটি খেল দ্বিরার পায়ের কাছে তার যথাসাধ্য প্রসন্নতার ডালি নিয়ে। পরমুহূর্তেই ঘন কার্পেটে মিলিয়ে গেল তার শেষ আকুতি।
    চরম আনন্দ আর প্রবল বিষন্নতার এক অদ্ভুত মিল আছে। দুটিই বিরল, দুটিই অতীব দ্রূতগামী। আসা আর যাওয়া দুইদিকের পথেই। এই মুহূর্তে ঠিক কোন অনুভূতি হচ্ছে দ্বিরার? এক একটা সময় আসে যখন এই নিঃশব্দ তুষারপাত, এই চরাচর ব্যাপী শুভ্র বর্ণহীনতার বিপরীতে তীব্র ভাবে টানতে থাকে অযত্নে বিবর্ণ,অপ্রসাধিত,তবু হাসি কান্নার স্মৃতিতে রঙিন, বিগত রৌদ্রজ্জ্বল দিনগুলি। ছেড়ে আসা বিস্মৃতপ্রায় প্রিয়জন, ফেলে আসা অনাদৃতা জন্মভূমি। বড়ো মারাত্মক,বড়ো মনখারাপ করা এই টান। বুকের ভিতর যেন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে দ্বিরার। অতি ধীরে ঘোলাটে অন্ধকার নেমে আসছে বাইরের অবিশ্রাম তুষারপাতের উপর। ফুরিয়ে যাচ্ছে ছোট্টো শীতের বেলা। জানলার ভারী পর্দাগুলো টেনে দিতে হবে এবার। শুধু যে অন্দরের গোপনীয়তা রক্ষা এর উদ্দেশ্য তাইই নয়, আভ্যন্তরীন উষ্ণতারও সাশ্রয় হয় এতে। কিন্তু বড়ো যে আলিস্যি লাগে। থাক তবে আজ। আবার চোখদুটো ঝাপসা লাগছে দ্বিরার। নামী প্রসাধন বিপণনের ওয়াটারপ্রুফ মাস্কারা! অশ্রুজলে কি পরাজিত হবে এর স্থায়িত্ত্বের অঙ্গীকার ;ধুয়ে যাবে গাঢ় কালিমা? হাত বাড়িয়ে কফি টেবিলের উপর ফেলে রাখা ফেস-ট্যিসুর রঙচঙে বাক্সটা টেনে নিল দ্বিরা। এগুলোরই দরকার পড়বে তার এখন!

    --------------------------
  • dee | 102.3.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৯:৪০651599
  • দ্বিরা

    কুটুন স্কুলের পোষাক পাল্টে টিভি রুমে এসে উকিঁ দিয়েছে। তার প্রিয় টিভি প্রোগ্রাম হোলো “টপগিয়ার”। এটি একটি নানান ধরনের গাড়ীর জয়গান মূলক টিভি সিরিয়াল। যে দেশে গাড়ী ছাড়া সামান্য মুদির দোকান টুকুও স্বস্তিতে করা যায় না সে দেশে গাড়ীবন্দনা তো জনপ্রিয় হবেই। একটি চ্যানেল এবং ম্যাগাজিন সর্বতোভাবে নিবেদিত এই স্তুতিগাথার প্রতি। দেশবন্দিত সঞ্চালকরা তাদের বিপুল ফ্যানফলোয়ার সমেত গদগদ হয়ে সর্বদা গাড়ীর গুণকীর্তন করে চলেছেন এই বিশেষ অনুষ্ঠানটিতে। জীবনের প্রায় নব্বই ভাগ সময় বিদেশবাসের ফলে তাদের কনিষ্ঠ পুত্রটি হয়ে উঠেছে গাড়ীঅন্তপ্রাণ। অন্যান্য সময় অবশ্য দ্বিরা কুটুনকে জোরজার করতে থাকে কোন জ্ঞানবর্ধক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের প্রতি মনোসঞ্চালন করতে। আজ সে শুণ্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টিভির পর্দার দিকে। শিশুদের ষষ্ঠইন্দ্রিয় চমকপ্রদ রকমের শানিত হয়ে থাকে। মায়ের দিকে অপাঙ্গে দৃষ্টিপাতেই কুটুন বুঝে গেল যে আজ তার সাম্রাজ্যবিস্তারে সেরকম কোন বাধাবিঘ্ন হবার সম্ভাবনা নেই। আঙ্গুলের চকিত ছোঁয়ায় বদলে গেল রিমোটবাহী চ্যানেল। তার অনুমান ভুল হয় নি। তারপর হাতে আধখাওয়া টোস্ট নিয়ে কুটুন গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগলো তার প্রিয় গাড়ীগুলির জয়যাত্রা। মা যে তার পাশে পুতুলের মতো চুপ করে বসে আছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার মতো বাজে সময় মোটেও নেই তার। হিমালয়ের দূর্গম গিরিকন্দরে, আফ্রিকার মরুপথে, আমাজনের অরণ্যানীতে বীরদর্পে চলতে থাকা গাড়ীগুলির সাথে সাথে তারও চলতে লাগলো মানসভ্রমণ। কিন্তু এ পথেও যে একজন যাত্রাসঙ্গী না হলে চলে না। বিভিন্ন গাড়ীর মেক মডেল ইতিহাস ইত্যাদি ব্যাপারে সে একটি ছোটোখাট বিশেষজ্ঞ । এসব বিষয়ে বিস্তর পড়াশুনা আছে তার। বলাইবাহূল্য যে জ্ঞানের কলস যখন উপচে পড়ার উপক্রম হয় তখন তার কিছুতো বিতরন না করলেই নয়। সুতরাং দেখার সাথে সাথে চলতে লাগলো পার্শপবেশিনী নীরব শ্রোত্রীকে অনর্গল ধারাবিবরণী। এ এমনই একটা বয়েস যেখানে বক্তার কাছে শ্রোতার ঔৎসূক্যের চেয়ে নীরব একনিষ্ঠতাই বেশী কাম্য হয়। আজ এ ব্যাপারটার অন্ততঃ কোনো অভাব হচ্ছে না। মা যে কোনরকম প্রতিবাদ না করে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে এই না ঢের বেশী! সে দিব্যি বুঝে গিয়েছে আজ সে কোনধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই প্রায় ডিনারটাইম পর্যন্ত টিভি দেখে যেতে পারে। গুড, ভেরী গুড্‌! জাস্ট টেক দ্যি চান্স হ্যোয়াইল ইট লাস্টস্‌ !
    সন্ধ্যার পর সব জানলার ভারী পর্দাগুলো টেনে দেওয়াই দস্তুর। শীতপ্রধান দেশে ঘর গরম রাখার ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রায়ান্ধকার ঘরে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলা হৃদয়ভারাক্রান্ত মা বা তার গাড়ীমোহাবিষ্ট পুত্র কেউই আজ সে কথা খেয়াল করে নি। তাদের চমক ভেঙ্গে গেল একসঙ্গেই যখন সেই গাড়ীরই হেড লাইটের তীব্র আলো ঘর ভাসিয়ে দিয়ে এসে পড়লো টেলিভিশনের পর্দার উপর। প্রথম প্রতিক্রিয়া হোল কুটুনের। তারুণ্যের মাসল্‌ মেমারীর যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায়, একলাফে সোফা ডিঙ্গিয়ে সে পৌঁছে গেল অর্ধচন্দ্রাকৃতি “বে” উইন্ডোর কাছে। বাড়ির সামনে এইমাত্র পার্ক করা গাড়ীটা বাবার না? হেডলাইট এর আলোটা জ্বলছে এখোনো তাই ভালো দেখতে পাচ্ছে না কুটুন। এবার নিভলো হেডলাইটটা। জানলা থেকে সরে আসতে আসতেই গাড়ীর দরজা খোলার আওয়াজ পেল কুটুন। তারপর বুট খোলার মৃদু ধাতব শব্দ।
    “ মাম---মাম---ড্যাড ইজ্‌ হিয়ার! –ড্যাড--। বাট হি ডাজন্ট ইউস্যুয়ালি কাম অন্‌ ওয়েডনেজ্‌ডেইস্‌ ,ডাজ্‌ হি?—মাম---মাম---আরন্ট ইউ লিসনিং? ড্যু ইউ ওয়ান্ট মি ট্যু ওপেন দ্যি ডোর ফর হিম? ---মাম---মা—আ—আ—আ—আ—ম!”
    “লিসনিং” ঠিকই করছিলো দ্বিরা। বুকের ভিতর হাতুড়ী পেটার শব্দটা ছাপিয়ে যতটা লিসনিং করা যায় আরকি। এত জোরে জোরে বাজছে কেন ও শব্দটা? এখোনো এমন হয়? এত বছর পরেও! কুটুনটা চেঁচামেচি করে কি সব বলছে যেন –
    “মা-আআআম! ড্যু- ইঊ-ওয়ান্ট-মি-ট্যু-ওপেন-দ্যি-ডোর ফর হিম ? মা—আআ--ম—”
    হৃদ্‌পিন্ড লাফিয়ে উঠেছে। “লাব্‌ডাব্‌ লাব্‌ডাব্‌”। এই তার সঙ্কেত চলে গেল মস্তিষ্কের ধূসরকণিকায়। সেখান থেকে নির্দেশ ছড়িয়ে পড়ছে সুষুম্নাবাহী শাখা প্রশাখা দিয়ে। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলিতে। এবার তাদের সকর্মক হয়ে ওঠার পালা।
    “ডোন্ট ওয়ারি ব্যাউট দ্যাট, হি হ্যাজ্‌ গট্‌ হিজ ক্যীইস, হ্যাজন্ট হি? ইউ ফিনিস ইয়্যোর টপ্‌গিয়ার”
    কুটুনের দিকে চেয়ে প্রশয়ের হাসি হাসল দ্বিরা। তারপর সে উঠে পড়ল সোফা ছেড়ে।

    ব্রতীন

    গাড়ী পার্ক করে তার ভিতরেই কিছুক্ষন বসে রইল ব্রতীন। বাহনটি আরামদায়ক, মধুর উষ্ণ; বহির্পৃথিবী কঠিন, নিদারুণ শীতার্ত। উপরে তাতানের ঘরে আলো জ্বলছে। পড়ছে নিশ্চয়ই। তাতানটা ভারী বাস্তবমূখী ছেলে। ভালো, তাই হোক। আশা করা যায় হৃদয়ঘটিত কষ্ট টষ্ট কম পাবে জীবনে। নীচের লিভিংরমেও জ্বলছে মৃদু আলো। ভারী পর্দাগুলো আজ টেনে দেওয়া হয়নি দেখছি। দ্বিরা ভুলে গেছে নিশ্চয়ই। টিভির নীলাভ দ্যূতি কাঁপছে জানলার কাঁচের উপর। এবার তার নজরে পড়ল টিভির পর্দায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে চলমান গাড়ী। টপগিয়ার! জানলার লাগোয়া বড় সোফাটার উপর যেন কুটুনের ছোট্টো মাথার আভাস পাওয়া যায় না? ওকে এত রাত পর্যন্ত টিভি দেখার অনুমতি দিয়েছে দেখছি ওর মা! অতি বিরল ঘটনা। গাড়ীর দরজা খুলে ব্যাগ আর ল্যাপটপ্‌টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ব্রতীন। এবার বুট থেকে এক গন্ডা ব্যাগ নামাতে হবে। কেন যে তখন ঝোঁকের মাথায় কিনতে গেল এসব। কে যে খাবে এগুলো কে জানে। থাগ্‌গে পড়ে ফ্রীজের মধ্যে। ভালো না লাগলে ফেলে দেবে ওরা। চরাচর প্লাবিত করে অঝোরে নেমে আসছে শুভ্র তুষারকণা। একটু দাঁড়ালেই বহিঃর্বরণ সাদাটে হয়ে আসে। মোটা কোটের ভিতরেও হাড় অবধি যেন কনকন্‌ করছিলো ব্রতীনের। কুটুন টিভি ছেড়ে নড়বে না এতো জানা কথাই। কী অসীম ক্লান্তি তাকে গ্রাস করছে গাড়ী থেকে মাত্র পাঁচ ছ পা হেঁটে সদর দরজার কাছে পৌঁছতে। ব্যক্তিস্বাধীনতার দেশ। প্রত্যেকের আছে নিজস্ব চাবি। অন্য কারও জন্য দরজা খুলে দেবার কেউ আর থাকে না আজকাল। দরজার কাছে এসে পার্কার পকেটে চাবিটা খুঁজতে লাগলো ব্রতীন। পাচ্ছে না। কোথায় রাখলো আবার সেটা? মনে পড়েছে। গাড়ীর গ্লাভবক্সে ফেলে এসেছে নিশ্চয়ই। বিষন্নতার সাথে এবার মিশে যাচ্ছে তীব্র বিরক্তি। ধ্যূত্‌তেরি! বাড়ি আসার এতো হাঙ্গামা জানলে কে আসতো আজ ফেরত। দরজা থেকে আবার গাড়ীর দিকে ফিরলো ব্রতীন। সামান্য ঝুঁকে ফের খুলতে গেল গাড়ীর দরজা। ঠিক তখনি এক ঝলক আলো এসে পড়লো তার উপর । ভিতর থেকে সদর দরজাটা খুলে দিয়েছে কেউ। অপাঙ্গে একটা অবয়ব যেন দেখা যায়। কুটুনই হবে। থাক চাবিটা পড়ে আপাতত গাড়ীতেই। নীড়ের উষ্ণতার টান বড়ো তীব্র। অতশত না তাকিয়েই খোলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল ব্রতীন। না কুটুন না তো! দ্বিরা। বাইরের নিঃর্দয় তুষারপাতের ভিতর নিষ্পলক ভাবে দাঁড়িয়ে রইল ব্রতীন। খোলা দরজায়, সামনের প্যাসেজেটার উজ্জ্বল আলোয়, উষ্ণতার বলয়ের নিচে নিথর হয়ে দাঁডিয়ে আছে দ্বিরা। ঈস্‌, এতো সাজগোজ করেছে কেন ও? ঠিক যেন সেই কতো বছর আগে দেখা কলেজের মেয়েটির মতো। কোথাও নেমতন্ন্য আছে বুঝি? কই ব্রতীন জানে না তো। তারপর তার হঠাৎ মনে পড়লো । তাইতো, তার তো আসারই কথা নয় আজ। সেই জন্যই কি দ্বিরা একাএকা বেরোচ্ছিলো কোথাও,এতো সাজগোজ করে ? কোথায়? বুকের ভিতর কেমন একটা মোচড় দেওয়া কষ্ট হতে লাগলো ব্রতীনের। আর তার সাথে সাথেই নিজের অকস্মাৎ হৃদয়দ্রৌবল্যের প্রতি অসহায় ক্রোধ। কিন্তু দ্বিরা হাসছে কেন? হ্যাঁ, ঠিকই, হাসছেই তো। তারপর ব্রতীনকে সম্পূর্ণ হতবাক করে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিল সে।
    -“কি হল, তাড়াতাড়ি এসো। ঠান্ডার মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আর অত কি বাজার করা হল আবার? এইতো কাল গিয়েছিলাম সবে। না খেয়ে ফ্রীজে ফেলে রেখে নষ্ট করলে বাপ ব্যাটা তিনজনকেই এবার ধরে পিট্টি দেবো আমি। দেখেছো, দেখেছো-ল্যাপটপ্‌টা পড়ে যাবে তো এবার! কি হল কি তোমা----”
    ঝুপঝাপ করে খাবারের ক্যারিয়ার ব্যাগ গুলো হাত খসে পড়ে গেল খোলা দরজার চৌকাঠের উপর। মহার্ঘ ল্যাপটপ্‌ অবহেলায় পড়ে রইল তাদের স্তূপের উপর। ব্রতীনের তীব্র আকর্ষণে দ্বিরা এসে পড়ল তার বুকের উপর।
    “উঃ ছাড়ো ছাড়ো, তোমার কোট ভিজে একসা, ঠান্ডা লাগে না আমার---”
    “জো হুকুম মেমসাব!” একটানে পার্কা’র জিপার খুলে দিল ব্রতীন। কোটের উষ্ণ অন্তরদেশে তার বুকের উপর পড়ে দুহাতে তাকে আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলো দ্বিরা। ব্রতীন ওর কোটটা অসীম মমতায় জড়িয়ে দিল দ্বিরার পিঠের উপর দিয়ে। তারপর তার গালের পাশে ঠোঁট রেখে সে আকন্ঠ পান করতে লাগলো সেই নোনতা জল। চেনা স্পর্শ , চেনা গন্ধ, চেনা ,অতি পরিচিত গভীর ভালবাসাময় আশ্রয়। এ কান্না যাঞ্চা করে না কোন আশ্বাসবাক্য। কাঁদুক একটু নাহয় ও। এতদিনের তীব্র নিদাঘে ব্রতীনের বুকের ভিতরেও মরুভূমি হয়ে আছে। তার প্রিয়ার অশ্রূজল ছাড়া শান্তির সিঞ্চন হবে না সেখানে। চোখের জলে মেকআপ্‌ ধুয়ে যাওয়া, বৃষ্টিভেজা মুখ তুলে দ্বিরা তার মুখের দিকে তাকাবে আবার। তখন তার তৃষিত ওষ্ঠ আবার ছোঁয়ার অনুমতি পাবে ওর চোখের পাতা। দ্বিরা মুখ তুলে একটু হাসুক আবার। ব্রতীন অপেক্ষা করে আছে। ব্রতীন অপেক্ষা করতে ভয় পায় না।

    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

    কুটুন

    মাকে উঠে পড়তে দেখে কুটুনও সঙ্গে সঙ্গে টিভি বন্ধ করে দিয়েছিলো। মাকে সে প্রায়ই কড়ে আঙ্গুলে বেঁধে রাখে বটে তবে বাবা বড় কঠিন ঠাঁই। এত রাত পর্যন্ত টিভি দেখার জন্য না জানি আজ কপালে কত বকুনি জুটবে। ড্যাড বাড়ি ঢুকে তার প্রতি ঠিকঠাক মনোযোগ দেবার আগেই দরজার পাশের প্যাসেজটা টপকে, দোতালার সিঁড়ির ধাপগুলো উর্দ্ধশ্বাসে লাফিয়ে তাকে পৌঁছে যেতে হবে তার নিজের ঘরের নিরাপদ আশ্রয়ে। ভয়ঙ্কর বকুনি আশা করেই টিভিরুম থেকে বাইরের প্যাসেজে বেরিয়ে এসেছিলো কুটুন, কিন্তু সামনের দৃশ্যাবলীতে সে একটু হক্‌চকিয়ে গেল। তার মাম আর ড্যাড প্রায়ই নিজেদের হাগ্‌ করে থাকে বটে তবে এটা যেন একটু ওভার ড্রামাটিক লাগছে! মহারানীর দেশের বিশ্ববন্দিত মহাকবির “মাচ্‌ এডো এবাউট্‌ নাথিং” নামক কাহিনীটির অস্তিত্ত্বের কথা এখনো পর্যন্ত তার জানা থাকার কথা নয়, নতুবা বলা যেতেই পারতো যে এইমুহূর্তে যে অনাবিল হাসিটি তার চোখেমুখে ঝলমল করছে তাতে সে এর সাথে দাম্পত্যকলহের “বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া”র দিব্যি মিল দেখতে পাচ্ছে। অবশ্য শেকস্‌পীয়ারের কমেডি বা সংস্কৃত শ্লোক না জানা থাকলেও পূর্ববর্ণিত ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের জোরেই সে নিমেষের মধ্যে বুঝে নিল আবহাওয়া অনুকূল। আ্যন্ড ইট ক্যুড ওয়ার্ক ইন হিজ ফেভার। হি ইজ গোয়িং ট্যু মেক শিওর ইট বেটার ডাজ্‌! তারপর আর কোনোদিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে সে উঠে গেল দোতলায় ।

    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

    ধীমান পাঠকেরা এতক্ষণে অনুধাবন করে নিয়েছেন যে এই কাহিনীর এখানেই সমাপ্তি। এই গল্পে না ছিল কোন শিহরণদায়ী পরকীয়ার সুড়সুড়ি, না কোন তাকলাগানো বর্ণনাময় দৃশ্যাবলী। যা ছিল তা শুধু চারটি সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনযাত্রার ওঠানামা, কিছু মেদুর স্মৃতিচারণা, কয়েকটি আবেগঘন মুহূর্ত। যা, লেখকের বিশ্বাস, রোজ আপনাদের জীবনেও কখোনো কখোনো ঘটে নিশ্চয়ই। এই “আজ কাল পরশুর গল্পে”র সাথে সাথে থাকার জন্য লেখকের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইল। আগেই বলেছি যে পাঠকেরা এর শেষটুকু অনুমান করে নিলেও এ কাহিনীর উপসংহারের আসল কুশীলব হলো দ্বিরা আর ব্রতীনের পুত্রদ্বয়। পাঠকেরা যাতে এর সঠিক রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত না হন তাই এদের দুজনের নিন্মলিখিত কথোপকথনের বঙ্গানুবাদ থেকে বিরত থাকা গেল।

    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
    -“কুটুন স্টপ্‌ ওয়াচিং টপগিয়ার ফর ওয়ান্স আ্যন্ড ক্লোজ দ্য ডোর! ইটস্‌ ফ্রিজিং আউট দেয়ার”
    -“আই এয়াম নট ইন দ্য টিভি রুম । আ্যন্ড এনিওয়ে ড্যাড ইজ হিয়ার”
    -“ওহঃ ডিয়ার! আই ন্যো-ও-ও-ও!বাট হি’জ গন ইন্ সাইড, হ্যাজ হি নট? ক্লোজ দ্য ডোর ম্যান”
    -“আই ক্যান্ট। ড্যাড ইজ স্টান্ডিং দ্যেয়ার”
    -“হ্যোয়াইই-- হ্যোয়াট্‌ আর ইউ টকিং আ্যবাউট? হ্যোয়াটস্‌ হি ডুয়িং স্ট্যান্ডিং এট্‌ দ্য ডোর?”
    -“ওয়েল---এররর---ইটস্‌ কাইন্ড ওফফ্‌ কমপ্লিকেটেড--- ইউ ন্যো”
    -“কুটুন স্টপ্‌ টকিং ইন রিডলস্‌, হ্যোয়াট্‌ ইজ ড্যাড ডুয়িং এট্‌ দ্য ডোর?”
    -“ওয়েল, হি ইজ হাগগিং আ্যন্ড কিসিং মাম”
    -“হ্যোয়ায়ায়ায়াট্‌! র‍্যিয়ালি? বাট ডিডিন্ট আই জাস্ট হিয়ার হার ক্রাই?”
    -“ইয়াআআআ! বাট শি ইজ অলসো কিসিং হিম ব্যাক”
    -“অ্যলরাইট্‌! অ্যলরাইইইইট্‌! গট্‌ ইট ন্যাও!----কুটুন ইউ ওয়ান্ট ট্যু প্লে এক্স-বক্স উইথ মি?’
    -“হাঊ? রিমেম্‌বার হ্যোয়াট ড্যাড স্যেইড? ওনলি অন ঊইকএন্ডস্‌। হি ঊইল বি র‍্যিয়ালি ক্রস উইথ মি”
    -“ন্যো হি ওয়ন্ট! টেক ইট ফ্রম মি! উই গট ট্যু সলিড হাওয়ারস্‌ টিল ডিনারটাইম। লেটস্‌ প্লে। অ্যান্ড ইয়াআ—গ্যো গেট মি আ ক্যান অফ কোক ফার্স্ট”
    -“ন্যো আই ওন্ট! স্টপ অর্ডারিং মি আরাউন্ড! গ্যো গেট ইট ইয়্যোরসেলফ”
    -“কুটুন আই আয়ম টেলিং ইউ ন্যাও, গ্যো—গেট –মি--আ—কোক”
    -“ন্যো!ইফ্ ইউ ওয়ান্ট ইট দ্যেন গ্যো ইয়োরসেলফ”
    -“কুটুন! গো!”
    -“ন্যো”
    -“ইউ আর গেট্যিং ইট ফর মি”
    -নেভার! ইউ গো!”
    -ন্যো ,ইউ”
    -“ইউ!”

    ০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন