এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিহাব হায়দার মুন (সপ্তক) | 183.34.***.*** | ২৬ মার্চ ২০১৩ ২১:৩২600083
  • সাম্প্রদায়িকতা অথবা মৌলবাদ!! উৎস কি?।
    শিহাব হায়দার মুন (সপ্তক)

    সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদ কি সমার্থক?। অথবা যা সাম্প্রদায়িকতা তা মৌলবাদ নাও হতে পারে কিন্তু যা মৌলবাদ তা সাম্প্রদায়িকতা? ।
    সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা বিশ্বকোষে যাই থাকুক ভারতবর্ষে এর অর্থ মৌলবাদী র সমার্থক, অর্থাৎ ধর্মের চিরচরিত নিয়মে সবকিছু পরিচালনা করা। একটু পার্থক্য করলেও করা যায় সাম্প্রদায়িকতার আর তা হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট জাতি- গস্টির স্বার্থ রক্ষ্যা করা নেতিবাচক অর্থে। ভারতবর্ষে এটিই এখন প্রচলিত। অনেকে এর পার্থক্য টান্তে চান নুতনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চান মৌলবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাকে অর্থাৎ ইতিবাচক ভাবে। আর ভারতবর্ষ শব্দটিতেও অনেকে এখন আপত্তি করেন ,যেহেতু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এখন ভিন্ন রাষ্ট্র।
    ধর্ম শব্দটি নিয়েও বেশ কথা আছে, যতীন সরকারের মতে “ বাংলায় আমরা ধর্ম শব্দটিকে Religion এর প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহার করি।তবে এ কথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ধর্ম আর Religion শব্দের মরমগত অর্থ এক নয়... এর অর্থ যা ধারন করে”... আর সে অর্থে প্রতিটি বস্তুর ই ধর্ম আছে ব্যবহার গতভাবে। যেমন আগুনের ধরম,পানি ও বায়ুর ধর্ম। তাহলে আমাদের ধর্ম যার মাধ্যমে আমরা উপাসনা করি তার নামও কেন ধর্ম?। তারমানে কি মানুষ মাত্রেই এমন কিছু থাকতে হবে যার মাধ্যমে সে উপাসনা করবে অথবা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সমাধান পাওয়া যাবে ধর্মের মাধ্যমে। যাই হোক না কেন বাংলায় যা ধর্ম তা ইংরেজির Religion এর প্রতিনিধিত্ব করে না। মানুষ মাত্রেরই যে ধর্ম থাকতে হবে তা পদার্থের ধর্মের সাথে তুলনা করলে একরকম আর মানবীয় গুনাবলীর দৃষ্টি কোন থেকে দেখলে অন্যরকম এবং চলতি অর্থে দেখলে হিন্দু,মুস্লিম,খ্রিস্টান ইত্যাদী। সাম্প্রদায়িক হানাহানি বিশ্বে নুতন কিছু নয়। পশ্চিমের সাদা কালো বর্ণ দাঙ্গা আমাদের উপমহাদেশের ধর্মীয় দাঙ্গার সাথেই তুলনীয়। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন ভাবে পশ্চিমে এখনও বর্ণ দাঙ্গা হলেও তার প্রকপ এতটাই কম যে সহনীয় বলা যায়। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে ধর্মীয় দাঙ্গা মোটেও বিচ্ছিন্ন বা সহনীয় নয় কেন?। কেন আমরা এখনও দেশ ভাগের ৬৫ বছর পরেও এখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা ধর্মীয় দাঙ্গায় মেতে উঠি। এর থেকে মুক্ত না হতে পারলে এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ যে খুব উজ্জ্বল নয় তা বলাই বাহুল্য। কোন একক রাষ্ট্র এর দায় নিতে পারে না। একে রুখতে হবে সম্মিলিত ভাবে?। কিন্তু কিভাবে?, কোথা থেকে শুরু করব আমরা?, প্রাচিন এ সমস্যা কি আমাদের কূড়ে কূড়ে খেয়ে শেষ করে দেবে।
    বাঙলাদেশে মৌলবাদের জন্ম ও বিকাশকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে পাকিস্তানে মৌলবাদের জন্ম ও বিকাশের কার্যকারণ বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ প্রথমতঃ পাকিস্তানের জন্ম ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রবক্তা। সে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশের দু’প্রান্তে অবস্থিত দু’টি মুসলিম প্রধান অঞ্চলকে নিয়ে গঠিত হোয়েছিল পাকিস্তান (যদিও তা ছিল ঐতিহাসিক লাহের প্রস্তাবের পরিপন্থী) । আজকের বাঙলাদেশ ছিল সেদিনের পূর্বপাকিস্তান। তাই ১৯৪৭ সালে জন্ম থেকে ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের অভ্যূদয় পর্যন্ত দু’দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হলো এক ও অভিন্ন।
    দ্বিতীয়তঃ জন্মের অব্যবহিত পর হতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ, এতদবিষয়ে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এবং সস্তা জনপ্রিয়তা ও ধর্মভীরু আমজন গণের ভোটের আশায় মৌলবাদী শক্তির সাথে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর অপরিণামদর্শী আপোষকামীতা প্রভৃতি পাকিস্তানে মৌলবাদের জন্ম ও বিকাশে যে ভূমিকা রেখেছে, সে ইতহাসের বিস্ময়কর রেপ্লিকা হলো বাঙলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস।
    দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বৃহত্তর ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র দাবী করলেও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বস্তুতঃ কোন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রবক্তা ছিলেন না। তার স্বপ্ন ছিল মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তান গণপরিষদে(১১ই আগস্ট, ১৯৪৭ ইং) তার প্রদত্ত প্রথম ভাষণে-যেখানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন-“আমরা একটি রাষ্ট্রের নাগরিক-এই প্রতিপাদ্য থেকেই আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত। এটিকেই আমাদের আদর্শ হিসাবে সামনে রাখা প্রয়োজন এবং আপনারা দেখবেন সময়ের ব্যবধানে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমানেরাও মুসলমান থাকবে না। ধর্মীয় অর্থে নয়। কারণ ধর্ম হলো মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্র। একটি জাতির নাগরিক হিসাবে তথা রাজনৈতিক অর্থে-পাকিস্তানের নাগরিক হিসাবে” । তার এ বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, তিনি পাকিস্তানকে মূলতঃ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। (যদিও তা অর্জনে তিনি ধর্মকেই হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা সোনার পাথরবাটির মত অবাস্তব)। একইভাবে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লেয়াকত আলী খানও ছিলেন পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থক। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করলেও তারা কখনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন নি। ধর্মভিত্তিক দলগুলো-বিশেষভাবে ‘জামায়াতে ইসলাম’ ও ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’-পাকিস্তানের আন্দোলনেরই বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান জন্মের অব্যবহিত পর তারা কিভাবে ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে নিজেদের স্থান করে নেয়, সে ইতিহাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও চমকপ্রদ। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধীতার কারণে ‘জামায়াতে ইসলামী’ ও ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ প্রভৃতি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তান জন্মের পর অত্যন্ত কোণঠাসা হোয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসার জন্য তাদের কোন ধর্মীয় নোতুন ইস্যুর প্রয়োজন ছিল। এমতাবস্থায় তারা ‘কাদিয়ানীরা মুসলমান নহে’ এবং ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে’-এরকম একটি অবান্তর-সদ্যস্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতির প্রশ্নে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ও অর্থহীন-হাস্যস্পদ ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৪৯ সালে কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণার দাবী করে ‘মজলিশে আহরার এ ইসলাম’ কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার আহবান করে। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তাত্ত্বিক গুরু মৌলানা মওদুদী। তাদের প্রত্যক্ষ উস্কানীতে পাঞ্জাবে কাদিয়ানী বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়-দ্রুত লাহোরেও ছড়িয়ে পড়ে এ দাঙ্গা এবং তা ক্রমে ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে। দীর্ঘ চার বছর ব্যাপী চলার পর ১৯৫৩ সালে দাঙ্গা এমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যে, পাকিস্তান সরকার লাহোরে সামরিক শাসন জারী করতে বাধ্য হয়। জেনারেল আইয়ুব ১৯৬২ সালে তার ঘোষিত সংবিধানে পাকিস্তানের নাম থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি বাদ দিলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন করলেন- গোঁড়া মোল্লাদের কট্টর বিরোধীতা সত্ত্বেও- মুসলিম পারিবারিক আইনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। কিন্তু তার এ ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানও বেশী দিন টিকল না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারও সস্তা জনপ্রিয়তার প্রয়োজন অনুভত হলো এবং সে লক্ষ্যে কিছু দিনের মধ্যেই ১৯৬২ সালের সংবিধানে আবারো সংশোধনী এনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র শব্দ কয়টি যোগ করল। সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ বিষয় হলো-১৯৬৫ ইং সালে ফাতেমা জিন্নাহের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে গিয়ে এক শত আলেম থেকে ফতোয়া আদায় করল-ইসলামী রাষ্ট্রে কোন মহিলা রাষ্ট্র-প্রধান হতে পারে নাসকল বিরোধী দলের সমর্থন ও প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও মৌলিক গনতন্ত্রীদের ভূঁয়া চেক প্রদান সহ নানা কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হলো আইয়ুব খান। তার এ বিজয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে মোল্লাদের অবস্থান আরো সুসংহত হলো। অবিভক্ত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল সেদিনের পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন দমিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তানী শাসকেরা বরাবরই ধর্মকেই ব্যবহার করেছে। সর্বশেষ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঠেকাতে গিয়ে যে গণহত্যা-নারী ধর্ষণ-এ সকল অপকর্ম তারা করেছে ধর্ম রক্ষার নামে। মাত্র ২৪ বৎসরের মধ্যে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার বিপদ সম্পর্কে-কী পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ, কী সামরিক
    জান্তা-কেউ আদৌ কোন শিক্ষা নেয়নি। বরং সে বিপজ্জনক পথেই পাকিস্তানের অভিযাত্রা অব্যাহত থাকল। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে নির্বাচনে জিতলেও জুলফিকার আলী ভূট্টোর স্বৈরাচারী অপশাসন ও নির্বাচনে প্রচণ্ড কারচুপির বিরুদ্ধে বিরোধী জোটবদ্ধ আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠে, তখন ধর্মীয় দলগুলোকে হাতে নেওয়ার জন্য এবং আমজনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ভূট্টো কিছু শরীয়া আইন প্রণয়ন করলেন। ভুট্টোই প্রথমবারের মত জামায়তের দাবী মোতাবেক কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে ঘোষণা করলেন। ভূট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে জেনারেল জিয়া-এতদিন ধরে পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা তিলে তিলে যে কাজটি করছিলেন-ধর্মীয় মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করা-তার ষোলকলা পূর্ণ করল। ভূট্টো কাদিয়ানীদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করেছিলেন, জিয়াউল হক তাদের অমুসলিম ঘোষণা করলেন। তাদের সরকারী চাকুরী থেকে অপসারণ করলেন। কাদিয়ানীদের মসজিদগুলো বন্ধ করে দিলেন। কাদিয়ানীদের আলাদা পরিচয় পত্র, তাদের জন্য আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা করা এবং দেশে হুদুদ আইন চালু করে শরীয়া আদালত গঠন করলেন। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহের স্বপ্নের বিপরীতে তার উত্তরসুরীরা পাকিস্তানকে একটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করল। চুরি করলে হাত কেটে ফেলা, যৌন ব্যভিচারের জন্য মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারা, একজন পুরুষ সাক্ষীর বিপরীতে দু’জন নারী সাক্ষী হাজির করা-হুদুদ আইনের নামে সকল মধ্যযুগীয় আইন আজ পাকিস্তানে বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জিয়াউল হকের পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা ভাবধারায় প্রশিক্ষিত বেনজির ভূট্টো ক্ষমতাসীন হলেও জিয়াউল হকের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে কোন সংস্কার পদক্ষেপই নেন নি। তৎপরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন নেওয়াজ শরীফ এর আমলেই-পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায়-তালেবানদের উত্থান। আজকের সামরিক শাসক মোশারফ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে-যেখানে রাষ্ট্রই মৌলবাদী-সেখানে ইসলামী মৌলবাদীদের কিভাবে রুখবেন তা আদৌ বোধগম্য নয়। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে মৌলবাদ আজ পাকিস্তানে অনেক শক্তিশালী।বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার পরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে একাত্তুরের যে সকল যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় ছিল, জিয়ার সময় তাদেরও ক্ষমা করে দেওয়া হলো। জামাতে ইসলামী সহ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মের নামে রাজনীতি করার লাইসেন্স ফিরিয়ে দিলেন। জামাতের আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে দেশে এনে রাজনীতিতে পূনর্বাসিত করলেন। কতিপয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ-বিশেষভাবে সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্য নিয়ে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্রতর করল- যার মূল লক্ষ্য ছিলো বাঙলাদেশের স্বাধীনতাকে ভুল প্রমাণ করা এবং বাঙলাদেশকে তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর করা। পচাঁত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও আমজনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। মেজর জিয়া তার সকল বক্তব্য শুরু করার আগে প্রকাশ্যে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা শুরু করলেন। জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতাসীন খলনায়ক, তুলনাহীন দুশ্চরিত্র হোসেন মোঃ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যে– তার সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিলেন । ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রের প্রবর্তন করে নোতুন মাত্রা যোগ করলেন । তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের কাছে যেতে শুরু করলেন এবং এসব গণ্ডমুর্খ ও ভণ্ড পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতেন। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারকে এরশাদ এমন এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, যখন তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন তীব্র হয়ে উঠল, তখন তিনি প্রতি শুক্রবারে কোন না কোন মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যেতেন। মসজিদে গিয়ে তিনি পূর্বরাত্রে স্বপ্নাদিষ্ট হোয়ে সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন বলে ডাহা মিথ্যা অবলিলায় বলে যেতেন; অথচ মানুষ জানত, এরশাদ আসবেন বলে দু’তিন দিন পূর্ব থেকেই সরকারী লোকেরা ঐ মসজিদ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা ও নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত ছিল। এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসাবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারত বিরোধীতাকে কাজে লাগাল। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তারা এতটুকু গেল যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলু ধ্বনি হবে- দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে- ইত্যাকার কথা জোরেশোরে বলে বেড়াতে লাগল । বলাবাহুল্য তারা এ অপকৌশলে সফল হয়ে নির্বাচনে জিতেছিল এবং ক্ষমতাসীন হোয়ে তারাও রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচারানুষ্ঠানে-ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-সম্ভবতঃ ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে- তাদের রাজনৈতিক আচার আচরণেও ধার্মিকতা প্রদর্শণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো। জয় বাঙলা শ্লোগানের সাথে তারা ও “লা-ইলাহা ইল্লালাহু-নৌকার মালিক তুই আল্লাহ”-প্রভৃতি শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগল। বিএনপি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় বিভিন্ন উপনির্বাচনে বিএনপির সীমাহীন কারচুপি একটি দলীয় সরকারের অধীনে যে কোন নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলল। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে স্থায়ীরূপ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করল। সে আন্দোলন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যুগপৎ কর্মসূচী গ্রহণ করল জামায়াতে ইসলামীর সাথে। আন্দোলনের মুখে প্রথমে বিএনপি একতরফা একটি নির্বাচন-অতঃপর সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাশ এবং সে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি সরকারের সর্বাত্মক ব্যর্থতার পটভূমিতে আবারো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলো। সুদীর্ঘদিন পর এবার ক্ষমতায় এলো মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্ববধায়ক সরকারের আন্দোলন করতে গিয়ে জামায়াতের সাথে অঘোষিত ঐক্য করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কী ক্ষতিটা আওয়ামী লীগ করেছে সে উপলব্ধি আওয়ামী নেতৃত্বের এখনো হয়েছে কিনা জানি না। শুধু তা নয়, আওয়ামী লীগ ও তার রাজনৈতিক আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন আনল যা প্রকারান্তরে ধর্মীয় রাজনীতিকেই উৎসাহিত করল। দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনর্বাসনের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগত গ্রহণ করলই না, বরং তাদের দলীয় কর্মসূচী এবং রাষ্ট্রীয় কর্মসুচীতে তারা ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করতে শুরু করল পূর্ণোদ্যমে। সংসদে প্রত্যেক সাংসদদের মাথায় টুপি পরে বসা এবং যে কোন বক্তব্যের শুরুতেই জোর গলায় “বিসমিল্লাহীর রাহমানির রাহিম” বলা, কোন কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে মোনাজাত করা, যে কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলোয়াত করা, নেতা-নেত্রীর ফি বছর হজ্জ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণের সাথে রাজনৈতিক আচরণকে গুলিয়ে ফেলে অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণের সাথে আওয়ামী লীগের আচরণের পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে পড়েছিল-যা বস্তুতঃ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই বৈধতা প্রদান করছিল। মজার ব্যাপার হলো, ক্ষমতাসীন হয়ে বিএনপিতো নয়ই, আওয়ামী লীগও এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার কথা চিন্তাও করল না। কিন্তু এত কিছু করেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারলনা, তেমনি যে সকল ধর্মীয় গোষ্ঠীর মন জয় করার জন্য আওয়ামী লীগ এতকিছু করল-তাদের মন থেকেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা মুছে ফেলতে সক্ষম হল না। বরং জাতীয়তাবাদী দল আরো এক ধাপ এগিয়ে জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট নামক দলের সাথে জোট বেঁধে নির্বাচন করে আজ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো-রাজনৈতিক স্বার্থে-ক্ষমতার লোভে- যে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মকে নিজেদের সুবিধামত রাজনীতিতে ব্যবহার করছে, শেষ পর্যন্ত তারা কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না বরং তাদের এ রাজনৈতিক আচরণ মৌলবাদীদের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে দিবে। ক্ষমতাসীন হয়ে জোট সরকার ধর্মপালনের দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাঁধে তুলে দিল। ক্ষমতান্ধ হয়ে এ সামান্য বোধটুকু আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা হারিয়ে ফেলল যে, রাষ্ট্র একটি সামাজিক সংগঠন-কোন সংগঠনের কোন ধর্ম থাকে না। ধর্ম, তথা উপসনা-ধর্ম (worship religion) থাকে মানুষের-কোন বস্তু বা সংগঠনের নয়। বস্তু বা সংগঠনের ইহকাল পরকাল নেই। তারা স্বর্গ-নরকে যাবে না। তাই তাদের ধর্মের প্রয়োজনও নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্ম পালনের ফলে প্রকারান্তরে বৈধতা পেল ধর্ম নিয়ে রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এভাবে সেক্যুলার রাজনীতির শিকড় কাটা হতে লাগল একে একে। বলাবাহুল্য, কেবল ক্ষুদ্র বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো-জনমনে যাদের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষীণ-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির শ্লোগান অব্যাহত রাখল। কিন্তু তাদের কণ্ঠের আওয়াজ এতই ক্ষীণ যে তা আমজনগণ পর্যন্ত পৌছে না। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা যেভাবে ক্ষমতার স্বার্থে তিলে তিলে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে পাকিস্তানকে একটি ধর্মভিত্তিক সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন, র্ঠিক সে পথেই আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন। তফাৎ শুধু এই যে, আমাদের জনগণের প্রতিরোধের মুখে সামরিক আমলা এদেশে পাকিস্তানের মত শেকড় বিস্তারে সক্ষম হয়নি।

    ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাঃ
    ধর্মীয় রাজনীতির জন্য উপরোক্ত উর্বর ভূমিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিপুল পেট্রো-ডলার পেয়ে জামাতে ইসলামী ইতোমধ্যেই নিজেদের খুব সংগঠিত দল হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এতদ্ব্যতীতও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, জামায়াতে মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-যাকে অনেকে জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র শাখা বলে মনে করে-হরকাতুল জিহাদ, খতমে নওবুয়াত আন্দোলন-জামাতে ইসলামী যাদের পৃষ্টপোষক-জিহাদ আন্দোলন প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্ম হয়-যদিও তথাকথিত ইসলামী শাসনব্যবস্থার স্বরূপ নিয়ে তাদের মধ্যেও তীব্র মতবিরোধ বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় পরিচালিত বিভিন্ন ইসলামী এনজিওদের প্রধান কাজ হলো এসমস্ত ধর্মীয় দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করা। এভাবে বিদেশী, বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় উপরোক্ত রাজনৈতিক দলগুলো এদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আল্লাহের দুনিয়ায় আল্লাহের শাসন কায়েমের জিগির তুলে দেশের বিশেষভাবে গ্রামের দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সমর্থকগোষ্ঠী সৃষ্টি করতে পেরেছে। এজন্য তারা বিশেষভাবে টার্গেট করেছে গ্রামের মাদ্রাশাগুলোকে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের সুযোগে তারা তাদের তরুণ ছেলেদের সহজে প্রলুদ্ধ করতে পারছে। নগর সভ্যতার বিকাশ ও পাশাপাশি গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার সীমাহীন দারিদ্র্য ও পশ্চাদপদতা, শহরের সাথে গ্রামের বৈষম্য মৌলবাদী ধারণা প্রসারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র তৈরী করে রেখেছে।
    আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট :বাঙলাদেশ প্রেক্ষিত
    মৌলবাদ প্রসারের আরো একটি মূল কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা। স্বাধীনতার দীর্ঘ তিন দশক পরেও আমাদের দেশে যেমন একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উন্নয়নের অব্যর্থ মডেল হিসাবে গ্রহণ করা হলেও বস্তুতঃ দেশে কাঙ্খিত শিল্পায়ন ঘটেনি। ফলতঃ সমাজে যেমন শ্রেণী বৈষম্য তীব্র হোয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য। উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কহীন এক শ্রেণীর শহুরে লুঠেরা ধনিকদের সীমাহীন জৌলুস-আধুনিক জীবন যাপন-আর অন্যদিকে গ্রামের বিশাল দারিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার প্রাণান্তকর আদি সংগ্রাম-এ স্ববিরোধী বৈশিষ্ঠমণ্ডিত কোন সমাজ কখনো স্থিতিশীল হতে পারে না। বেকারের সংখ্যা তিন কোটির উপরে। ফি বছর ২১/২২ লক্ষ শিক্ষিত বেকার শ্রমের বাজারে প্রবেশ করছে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করে পুরো সমাজকে গিলে ফেলেছে। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের কলঙ্ক তিলক আমাদের মাতৃভূমির ভালে শোভা পাচ্ছে বিগত চার বছর ধরে। স্বাধীনতার পর হতে আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর ধারাবাহিক ব্যর্থতার ফলশ্রুতিতে আজ গ্রামীণ ও শহুরে নিন্ম-মধ্যবিত্ত দরিদ্র যুবশ্রেণীর মনে যে হতাশা দানা বেঁধেছে তাকেই সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগাবার প্রয়াস পাচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো। আলজেরিয়া, মিশর ও তুরস্কের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলেও আমরা একই রকম চিত্র দেখতে পাব যে, সে সব দেশেও সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র দূরীকরণে মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ব্যর্থতা মৌলবাদের উদ্ভব ও বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছে। এহেন একটি আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন চক্র মৌলবাদকে মোকাবেলার পরিবর্তে তাদের কর্মসূচীকেই আত্মীকরণ করে ফেলেছে। এক্ষেত্রে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো কে কতটুকু ধার্মিক, তা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম চালু করার পরিবর্তে তারা ধর্মীয় অনুশাসন নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে।
    রুখতে হবে মৌলবাদ
    মৌলবাদী শক্তিকে কেবল রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করে-ঊনিশ শ’ একাত্তুরে যেমনটি আমরা করেছিলাম-রোখা যাবে না। চুড়ান্তভাবে ঠেকাতে হলে তাকে রুখতে হবে আদর্শিকভাবে। সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা মাদ্রাশাগুলোতে শিক্ষার নামে যা ছড়ানো হচ্ছে তা মূলত ধর্মাশ্রয়ী কুপমণ্ডুকতা ও অজ্ঞতা। অথচ মৌলবাদের প্রধান আশ্রয় হলো অজ্ঞতা। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও নারী শিক্ষার বিস্তার সে অজ্ঞানতা রোধে প্রধান ভূমিকা নিতে পারে। বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক শিক্ষা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটাবে ও তার লালন মৌলবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। এ লক্ষ্য অর্জনের প্রধান শর্ত হচ্ছে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্ত করা। মৌলবাদীদের সন্তুষ্ট করার জন্য সরকার যদি একের পর এক ধর্ম পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, তাতে মৌলবাদের ভিত্তি কেবল শক্তই হবে। তাই বৈজ্ঞানিক যুক্তি বিস্তারের মাধ্যমে সর্বাগ্রে আমাদের মৌলবাদী মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার অসারতা, অপ্রাঙ্গিকতা-পশ্চাদপদতা ও গণবিমুখতা তুলে ধরতে হবে আম জনগণের কাছে-বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। সেজন্য একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
    মৌলবাদের মূল উৎস যেহেতু ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং এ গোঁড়ামীর উর্বরক্ষেত্র যেহেতু অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সেহেতু তাকে রুখতে হলে আমাদের সর্বাগ্রে শিক্ষা, বিশেষভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে একই শিক্ষা পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করতে হবে এবং ধর্ম নিয়ে রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্য বিমোচন, আইনের শাসন কায়েম, গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূরীকরণ-বিশেষভাবে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন-ইত্যাদি আশু পদক্ষেপ মৌলবাদ উত্থানের বিরুদ্ধে বর্ম হিসাবে কাজ করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্রোতস্বিনী নদীতে যেমন কোন শেওলা-শৈবাল জন্মাতে পারে না, তেমনি একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক ও উন্নত আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে মৌলবাদসহ কোন প্রকার কুসংস্কারের আগাছা শিকড় গাড়তে পারবে না।
    **** মুক্তমনায় প্রকাশিত জানে আলম রচিত (মৌলবাদের জন্ম ও বিকাশ-রুখতে হবে কিভাবে) অবলম্বনে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন