১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকা প্রতিবাদে লিখছে, “শ্রীযুত মণ্ডলের করাচী হইতে ভারতে আসিতে ছদ্মনাম বা ছদ্মবেশের প্রয়োজন হয় নাই। সরকারী কর্মচারীদের সহিত যোগসাজসে বেনামে এবং বিনা ফটোগ্রাফে পাসপোর্টেরও প্রয়োজন হয় নাই, সাধারণ যাত্রী হিসাবেই তিনি আসিয়াছেন।”
করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে এক দিন বিশ্বস্ত সূত্রে আচমকা জানা গেল, সেই যোগেন মণ্ডলের একমাত্র ছেলে জগদীশ মণ্ডল এখনও বেঁচে। চার দিকে এত মতুয়া-মতুয়া রব, আর ভারত-ইতিহাসের ব্যতিক্রমী চরিত্রটিকে খতিয়ে দেখব না?
কোনও ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নেই, পূর্বপরিকল্পনা নেই। রটনা আদো কতটা ঘটনা, সেটা জানতে এক সকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক মৈনাক বিশ্বাস, তাঁর বন্ধু সুদীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গী হলাম। গড়িয়া স্টেশন থেকে আরও দূরে, কলকাতা শহর যেখানে আচমকা শেষ হয়ে গিয়েছে, কাঁচা ড্রেন আর সিমেন্টের রাস্তা, সেই পাঁচপোতা অঞ্চলে বৃদ্ধ জগদীশ মণ্ডলের নিবাস। পাকা বাড়ি, সামনে গাছগাছালি-সহ পুকুর। জগদীশবাবু রেলে চাকরি করতেন, দীর্ঘকাল প্রায় একক চেষ্টায় খোঁজাখুঁজি করে সংবাদপত্রের বিভিন্ন ছবি ও ক্লিপিং, সরকারি ও বেসরকারি হরেক নথিপত্র নিয়ে সাত খণ্ডে ‘মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ’ নামে বই লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে এ রকম পরিশ্রমী পিতৃস্মৃতি বিশেষ নেই।
বৃদ্ধ জগদীশবাবু তখনও কথা বলেন, কিন্ত মাঝে মাঝে খেই হারিয়ে ফেলেন। সাত খণ্ডের বইটি কেনা গেল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিতরাও সেই বইয়ের কিছু তথ্যকে মান্যতা দেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর না করে তত্ত্বনির্ভর রাজনীতির সন্ধানেই কি যোগেন্দ্রনাথ পথ হারালেন? এর বদলে অন্য পদ্ধতিটি যদি তিনি গ্রহণ করতেন, তা হলে তিনি ভাবতেন না লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষের কোনটা করা উচিত। বরং অনুমান করার চেষ্টা করতেন, তারা কোনটা করতে পারে অথবা করতে চলেছে, সেই মতো নিজের কর্তব্য স্থির করতেন।” সমাজবিজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত, “এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটা তত্ত্বনির্ভর নয়, তা হলো স্ট্র্যাটেজি, হালের বাংলায় যাকে বলা হয় কৌশল।” তাঁর কথার রেশ টেনে বলা যায়, আজকের মতুয়া রাজনীতিতে হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ কেউই নেই। আছে শুধু কৌশল।
‘আইডেন্টিটি পলিটিক্স’ যে কী ভয়াবহ, যোগেনবাবুর শেষ দিনগুলিই তার প্রমাণ। জগদীশবাবু বলছিলেন, তখন ওঁরা টালিগঞ্জের সুলতান আলম রোডে থাকতেন। ১৯৫২ সালের পর তাঁর বাবা প্রায় সব নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন ও হেরেছেন। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর আম্বেডকরের রিপাবলিকান পার্টির হয়ে ১৯৬৮ সালে ভোটে দাঁড়ান, সেই ভোটপ্রচারেই তাঁর মৃত্যু। যোগেন মণ্ডল তখন কুপার্স ক্যাম্প, বাগজোলার উদ্বাস্তু শিবিরে আর নমশূদ্র আইডেন্টিটির কথা বলেন না, বামপন্থীদের সঙ্গে জোটের কারণে সেখানে স্লোগান তোলেন, ‘আমরা কারা? বাস্তুহারা’।
এ ভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল নমশূদ্র রাজনীতির সেই ব্যাতিক্রমী ঝলকানি। খবর পেয়েছি, করোনা-পর্বের শেষে ২০২২ সালে জগদীশবাবুও এই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছেন।