আমি চুপচাপ পরিস্থিতিটা বুঝবার চেষ্টা করছিলাম। আমার মর নিকৃষ্ট একটা মানুষ কী করবে না করবে, তাতে এদের কীই বা এসে যায়? এ নিয়ে এরা এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন?ওরা নিজেদের মধ্যে ফের আলোচনায় ডুবে গেল। যি বুঝলাম আমার স্বামীও চান না আমি জুরিখে ফিরে যাই।
ওরা কথা বলছিল, আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না, আমি মনে করবার চেষ্টা করছিলাম, এই সেই লোক, যার ফোটো সহ সাক্ষাৎকার ছেপেছিল কাগজে। আমরা ঝুঁকে পড়ে সাগ্রহে পড়েছি এর কৃতিত্বের কাহিনি। পরে এরই বৌ আমার বন্ধু হয়ে গেল। এর বৌ অন্য লোকের সঙ্গে মেশে, শোয়। আহারে, লোকটা কিচ্ছু জানে না। লোকটা আজ ভিখিরির মত আমার কাছে এসেচে একটা অনুরোধ নিয়ে, আমি যেন জুরিখে ফিরে না যাই। তবে তার কাকুতি মিনতির স্বর ভিন্ন, হুংকারের মত শোনাচ্ছে।
লোকটা বলল — ঐখানে গিয়ে তোমার মেয়ে পড়াশোনায় খারাপ করলে? তখন কী করবে তুমি?
এ জিনিসটা তরজার আকার নিল। আমি বললাম, ও তো কখনই পাড়াশুনোয় ভালো নয়, সেটা আমার প্রায়োরিটিও নয়। ভালো মানুষ তৈরি হলেই চলে যাবে।
— তোমার যদি চাকরি না থাকে? তখন তো ফিরে আসতে হবে। তখন কী করবে?
— ফিরে আসব।
— আর মেয়ে? ও তো তখন স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না এখানে।
— তা ঠিক। কোনও ইস্কুলই নেবে না ওকে?
— না, নেবে না। প্রাইভেটে মাধ্যমিক দিতে হবে। তারপর কী করবে?
— বিয়ে দিয়ে দেব।
— ইয়ার্কি হচ্ছে!
আবার হুংকার মিস্টার স্ট্যান্ড করা ছাত্রর।
এবার তিনি অন্য চাল চাললেন। আমার স্বামীকে এখুনি একটা ভাল দেখে মোটা মাইনের চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। সুবারু কেনিয়াতে। চায়ের প্ল্যান্টেশনে ও ফ্যাক্টরির লাইনে। আমার স্বামী আমাদের নিয়ে কেনিয়া যাবেন । সেখানে আমরা থাকব।
বলতে গেলে চাকরিটা তখুনি হয়ে যায় আর কি।
আমি মনে মনে ভাবছি, কেনিয়ার ইস্কুল আর সুইটদারল্যান্ডের ইস্কুলের মধ্যে কোথায় পড়লে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ বেটার হবে। আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওই লোকের এত চিন্তা কেন? ওর নিজেরও তো একটা ছেলে আছে, কোলকাতার নামকরা ইস্কুলে পড়ে। ওর যদি অপশন থাকত নিজের, যে কোন দেশে যাবে, ওকি সুইটজারল্যান্ডের বদলে কেনিয়া বেছে নিত? নিজের ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ও কেনিয়া চলে যেত সপরিবারে?
বিদ্যুতের মত মাথার মধ্যে এই পুরো ব্যাপারটার কার্যকারনের উত্তর আমার মাথার মধ্যে খেলে গেল। যতদিন আমি তোমাদের চেয়ে ছোট ছিলাম, গরীব ছিলাম, করুণার পাত্রী ছিলাম, তোমরা আমাকে ভালোবেসেছো। আজ আমি তোমাদের ছাড়িয়ে গেচি, যা তোমরা হয় আগে গেস করতে পারো নি, কিন্তু এখন আমায় যে করে হোক টেনে নামাতে চাচ্ছো। আমায় কি তোমরা একেবারেই বোকা ভাবো?
আমি উত্তর রেডি করে ফেলেছি।
— এটা কিন্তু ভালো অপশন। কেনিয়ায় গেলে উনি ভালো রোজগার করতে পারবেন, আমিও সংসারের কাজ করতে পারব। মেয়ের পড়াশুনোর জন্যেও বাড়িতে যতটা পারি হেল্প করব আমি।
— তাহলে যাচ্ছ না তো জুরিখ?
— আমার সব অরিজিনাল ডকুমেন্ট ওখানে রয়ে গেছে। আমার বর কেনিযার চাকরিটা পেলেই আমি ওখানের পাট চুকিয়ে ফিরে আসব। আমিও আর একা একা ওখানে পেরে উঠছি না।
ব্যস। সব সমস্যা মিটে গেল। আমার স্বামীও এখন দু এক লাইন যোগ করলেন — আমি বলেই বিয়ে করা বৌকে বিদেশে যাবার পার্মিশান দিয়েছি।
ওরা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল — তাইত! সেতো বটেই।
স্বামী বললেন — আমার অফিসের জুনিয়র এক কোলিগ আছে নাম গৌরব। তার ওয়াইফ ইংল্যান্ডে যায়, শাড়ি নিয়ে। বিক্রি করে আবার ফিরে আসে। যোষিতা যদি ঐরকমের কোনও বিজনেস করে আমার আপত্তি নেই। আদারওয়াইজ হেরিটেজ স্কুলে পড়াতে পারে, আমার চেনা আছে, চাকরি পেয়ে যাবে।
ওরা আবারও সায় দিল।
আমি মিষ্টি মেয়ের মতো বড়োদের উপদেশ শুনে নিলাম। মাইরি! আমি হেরিটেজ ইস্কুলের টিচার হবো? কী পড়াবো? আমি তো ইংরিজিই ভালো করে বলতে পারি না। মনে মনে হাসি পাচ্ছে। হাসা চলবে না। আমাকে বাধ্য মেয়ের মত সব কিচু মেনে নিয়ে যে হোক করে বেরিয়ে যেতে হবে।
চলে যাবার আগে নিভাশশীর বর আমায় জ্ঞান দেবার লোভ সামলাতে পারল না।
— আমি তোমার হাজবেন্ডকে রেসপেক্ট করি। পারিজাতকে অযাডপ্ট করবার জন্য। আজকাল এরকম মহানুভবতা বিরল।
সবাই বিনয়ে গদোগদো হয়ে গেল।