প্যালেস্টাইন মিনি কড়চা ৩৩
বুলডোজার ও একটা মেয়ের গল্প
বুলডোজার বস্তুটির রাজনৈতিক ব্যবহার এখন আমাদের দেশে একেবারেই অপরিচিত নয় এবং গোবলয়ের এক বিশেষ রাজনীতিবিদ তো এই বস্তুটিকে মোটামুটি নিজের ফ্যাশন স্টেটমেন্টই বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে অন্য অনেক ভালো ভালো ব্যাপারের মতো এটিরও পেটেন্ট ইসরায়েলের। আমি এখানে এরিয়েল শ্যারনের কথা বলছি যে কঠোর ইসরায়েলী জায়নবাদী নেতাটিকে প্যালেস্টাইনের মানুষ "বুলডোজার" নাম দিয়ে ডাকতেন এবং এই নামে ডাকার কারণটিও সহজেই বোধগম্য, এই নেতাটি ইতিহাসে কুখ্যাত বুলডোজার দিয়ে অধিকৃত প্যালেস্টাইনের জমিজিরেত অলিভ গাছ ঘরবাড়ী ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য । এই মানুষটির আরো একটি অন্যতম কৃতিত্ব হচ্ছে ১৯৮২ সালে অধিকৃত বেইরুটের সাবরা ও শাতিলা নামক দুটো প্যালেস্টিনিয়ান রিফুজি ক্যাম্পে বেশ কয়েক হাজার মানুষের গণহত্যার নেতৃত্ব দেওয়া।
তা এহেন বুলডোজারের সামনে অনেক সময়ে সাধারণ মানুষও এসে যেতেন অনেকে। যথারীতি মেনস্ট্রিম পশ্চিমী মিডিয়া (দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যেটি এখনো অনেক বাঙালীর কাছে ওই এলাকা থেকেই কোনো খবর আসার প্রথম ধাপ ) তাদের নাম প্রকাশ করেনি যেমন এখনো গাজার হাসপাতালের ইসরায়েলের বোমাতে মৃত শিশুদের নাম প্রকাশ করছেনা। তবে একটি মানুষের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল এই বুলডোজার নিয়ে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের একটি ঘটনাতে। আমি অবশ্য এই মানুষটির নাম জেনেছিলাম আল জাজিরা থেকে তবে আমার নিজের প্যালেস্টাইন নিয়ে ভাবনাচিন্তা পুরোপুরি বদলে গেছিলো এই মানুষটির নাম জানার পর থেকে।
এই মানুষটাই হলো রাচেল কোরি। এই মেয়েটা আজকে বেঁচে থাকলে আমার থেকে কয়েকটা বছরে বড়োই হতো। এর প্রথম খবর পাই ২০০৩ সালে যেখানে বলা হয় যে গাজাতে একজন শান্তিকামী (পিস এক্টিভিস্ট) আম্রিকি যুবতী ইসরায়েলের বুলডোজারের সামনে মারা গেছে। আমি তখন সবে শুরু করেছি এই পশ্চিম এশিয়ার ব্যাপারে একটু আধটু পড়াশোনা করতে। সেসময়ে পশ্চিম এশিয়াতে আকাশে বারুদের গন্ধ, সদ্য ইরাকে হামলা করেছেন বুশ মহোদয়, শোনা যাচ্ছে ইরাকের পরে এবার সিরিয়া ও ইরানের পালা, মাত্র দুবছর আগেই 9/11 হয়ে গেছে আর আফগানিস্তানে তখনো আম্রিকি সেনা যদিও তালিবান হোমল্যান্ড সিকিউরিটি আর ইসলামোফোবিয়ার নাম মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে । এই পরিবেশেই ইসরায়েলে গদীতে বসছেন শ্যারন আর শুরু হচ্ছে লেবার পার্টির রাজনীতিটারই শেষ হবার পালার যে ব্যাপারটি আমি এর আগে এই সিরিজের ইসরায়েল করচাতে উল্লেখ করেছি । প্যালেস্টাইন অপেক্ষা করছে ঠিক যেভাবে হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া বলির পাঁঠা কাপালিকের জন্য অপেক্ষা করে। পশ্চিম এশিয়াতে চারদিকেই তখন একটা ত্রাহিত্রাহি ভাব তার মধ্যেই প্রথম সামনে এলো এই তেইশ বছরের মেয়েটার ব্যাপারটা।
রাচেল কোরি (১৯৭৯ - ২০০৩ )
২০০৩ সালে একটি সৌদি নিউস চ্যানেলকে দেওয়া রাচেলের শেষ ইন্টারভিউ। এই ইন্টারভিউটির কয়েকদিন পরেই ইসরায়েলের বুলডোজারের সামনে রাচেলের মৃত্যু হয়। (সূত্র The গার্ডিয়ান পত্রিকা)
আম্রিকার ওয়াশিংটন প্রদেশের অলিম্পিয়া শহরে বেড়ে ওঠা মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই নব্বই দশকের বেড়ে ওঠা আর পাঁচটা আম্রিকি মেয়ের মতো ছিলোনা। ডায়েরি লিখতে ভালোবাসতো আর দশ বছর বয়েস থেকেই ওর মনে হতো পৃথিবীতে সব কিছু ঠিকঠাক নয়, আম্রিকাতে ওরা একটা খুব নিরাপদ আশ্রয়ে থাকে কিন্তু আসে পাশের বাইরের দুনিয়াটা এতো সহজ সরল নিরাপদ নয়। এর পরেই এলো 9/11 আর সারা আম্রিকাতে তখন বদলা নেবার আর ইসলামোফোবিয়ার হিড়িক পরে গেছে। তার মধ্যেই মেয়েটার মনে হলো যে চারদিকে ওর নিজের দেশে প্রতিশোধ আর ঘৃণা এতো বেড়ে গেছে যে শুধু আম্রিকাতে বসে বক্তৃতা দিয়ে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে কিছু হবেনা কিছু একটা করতে হবে।
গুরুচন্ডালির পাঠকদের আবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে এইটা সেই সময় যখন রাচেলের বয়সের গড়পড়তা ছেলেমেয়ে হয় আম্রিকি মিলিটারিতে যোগ দিয়ে আফগানিস্তানে বা ইরাকে ট্যুর অফ ডিউটি তে যাচ্ছে অথবা ইয়েল হার্ভার্ড সিলিকন ভ্যালি ওয়াল স্ট্রিট বা নিদেনপক্ষে হলিউডে যাবার কথা ভাবছে। আর এই মেয়েটা তখন কি করলো ? ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি মুভমেন্ট (ISM) একটি NGO যেটি মূলতঃ অহিংস ভাবে প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের চন্ডনীতির বিশেষ করে যত্রতত্র বুলডোজার চালাবার নীতির বিরোধীতা করে তাতে যোগ দিয়ে গাজাতে চলে এলো । রাচেল এদের সঙ্গে গাজাতে মূলতঃ ইসরায়েলের বুলডোজার চালিয়ে বাড়িঘর অলিভ গাছ উপড়ে ফেলবার বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদ করতো।
এখানেই ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে গাজার রাফা এলাকাতে ইসরায়েলের বুলডোজার চলছিলো ইচ্ছেমতো। পুরো এলাকার বাড়িঘর উপড়ে সাফ করে ফেলাই ছিলো উদ্যেশ্য। রাচেল আর ওর সঙ্গের কয়েকজন আম্রিকি আর ব্রিটিশ ছেলেমেয়ে যেখানে যেখানে ইসরায়েলী বুলডোজার চলতো সেখানেই বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে মাইক নিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করতো ইসরায়েলের বুলডোজার ড্রাইভারদের যে এলাকার মানুষদের বাড়িঘর উপড়ে না ফেলবার জন্য। ওরা দাঁড়িয়ে পড়তো বুলডোজারের সামনে যাতে ওদের অল্পবয়েসী মুখগুলো দেখে ইসরায়েলী বুলডোজারের ড্রাইভাররা ছেড়ে দেয় গাজার কিছু নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি জমি অলিভ গাছ।
গাজাতে ইসরায়েলী বুলডোজারের সামনে রাচেল।
গাজার রাফা অঞ্চলে ২০০৩ সালের ১৬ই মার্চ এরকমই একটা ইসরায়েলী বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো রাচেল। ওর আশা ছিলো যে হয়তো ওর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ইসরায়েলী ড্রাইভার বুল্ডোজারটা থামাবে। কিন্তু অন্যদিনের তুলনাতে সেদিন অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছিলো। অন্যদিনে বুলডোজারের ড্রাইভাররা হয় তাদের বুলডোজার থামিয়ে দিতো অথবা গতি কমিয়ে দিতো। কিন্তু সেদিন থামেনি বুলডোজার। জোরে এসে সোজা উঠে পড়েছিলো ............ রাচেলের উপরে। রাচেলের জীবনের ওটাই শেষ মুহূর্ত ছিলো।
রাচেলের জীবনের শেষ মুহূর্ত। গাজাতে ইসরায়েলী বুলডোজারে চাপা পড়বার পরে। (সূত্র বিবিসি )
যে বুলডোজারটি এই কাজটি করে সেটি আম্রিকি ক্যাটারপিলার সংস্থারই তৈরী ছিল। তবে পশ্চিম এশিয়া কোনো পশ্চিমের মানুষকে এরকম ভাবে আগে দেখেনি। পশ্চিম এশিয়া অভ্যস্ত পশ্চিমের মানুষকে ক্রুসেডার কলোনিয়ালিস্ট occupier বা সেটলার হিসেবে দেখতে যে পশ্চিম এশিয়ার মাটিতে পা রাখে শুধু সেখানকার মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, পশ্চিম এশিয়ার মানুষের অনেক দিনের গড়ে তোলা বিশ্বাস আর সংস্কৃতি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার মানুষের জন্য লড়তে এবং প্রাণ পর্যন্ত দিতে !!!! নাহ এরকম পশ্চিম এশিয়া খুব বেশি দেখেনি। রাচেল তাই এমন একজন শহীদ যাকে গাজার মানুষ কখনো ভোলেনি ভুলতে পারবেনা।
রাচেলের বাবা মা, তার NGO অনেক চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে রাচেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী যারা তাদের জন্য ন্যায়বিচার আনতে। কিন্তু না আম্রিকা না ইসরায়েল কোথাওই এখনো ন্যায়বিচার হয়নি। তবে আমার নিজের মনে রাচেলের মৃত্যু একটা প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছিলো যার উত্তর এখনো পাইনি। কেন এইরকম কিছু মানুষ এইরকম কিছু করে ? কিসের জন্য ? ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে পপুলারিটি পেতে ? নাকি অন্য কিছু ? জানিনা মেলেনি উত্তর এখনো।
পুনঃশ্চ : রাচেলের বাবা মা কি তার জন্য সুবিচার পাবে ? জানিনা। শুধু জানি রাচেলের মতো মানুষদের জন্যই নিচের কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন প্যালেস্টাইনেরই একটি মানুষ যিনিও আজ থেকে ২০০০ বছরের কিছু বেশি সময় আগে তৎকালীন ইহুদী সমাজের চক্ষুশীল হয়েছিলেন এইসব কথাবার্তা বলবার জন্য এবং শেষ পর্যন্ত তাকে তৎকালীন ইহুদী সমাজের বিচারে "ব্ল্যাসফেমি" অপরাধে অপরাধী হয়ে নিজের প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হয়েছিলো।
Blessed are the pure in heart,
for they will see God.
Blessed are the peacemakers,
for they will be called the Sons of God.
Blessed are those who are persecuted because of righteousness,
for theirs is the Kingdom of Heaven.
(সূত্র sermon on the mount, Gospel of Mathew, New Testament)