বেনেগাল লিখেছেন, "বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সবসময়েই ভেবেছে, সত্যজিৎ রায় ভারতের জন্য ঠিক কাজ করছেননা। রাজকাপুরের সঙ্গে তাঁর একবার বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। রাজ কাপুরের সিনেমা 'জাগতে রহো' পরিচালনা করেছিলেন বাংলার বিখ্যাত নাট্যপরিচালক শম্ভূ মিত্র। সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের যা উচ্চতা, নাটকে তিনি তার সমানই ছিলেন। শম্ভূ সিনেমাটা বানিয়েছিলেন, এবং ১৯৬৪তে কারলভি ভেরি উৎসবে সেটা রাজকাপুরকে সেটা একটা পুরষ্কারও জিতিয়ে দেয়। ওই একই বছর ভেনিসে অপরাজিত জেতে স্বর্ণ সিংহ। তারপর রাজকাপুর এবং সত্যজিৎ রায়ের কোনো একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়। সত্যজিৎ বলেন, বাংলা সিনেমার জন্য এটা একটা বিরাট সম্মান।
রাজ কাপুর বলেন, 'বাংলা কেন, আপনি ভারতীয় না? আপনি কেন বলেন, আপনি একজন বাঙালি চিত্রপরিচালক?'
সত্যজিৎ বলেন, কারণ, 'আমি একজন বাঙালি চিত্রপরিচালক'।
রাজ কাপুর বলেন, 'ভগবানের দিব্যি, আপনি নিজেকে ভারতীয় চিত্রপরিচালক বলতে পারেননা কেন?'" *
বোম্বের সঙ্গে, দিল্লির সঙ্গে বাঙালির এই দড়ি-টানাটানি সেই ১৯৪৭ থেকে। দেশভাগের পর এই সেই সময়, বাংলা যখন প্রবল গাড্ডায় । বাংলা সিনেমার বাজার এক ধাক্কায় অর্ধেক হয়ে গেছে, বিপুল সংখ্যক হল পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেছে, এক তৃতীয়াংশ স্টুডিওর কাজ নেই। তদুপরি ফিনান্সের সংকট, একটা একটা করে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নিউ থিয়েটার্স সহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলি ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা সিনেমা রপ্তানির ব্যবস্থা না বোম্বের সিনেমাকে বিশ্বজুড়ে প্রোমোট করছে। কলকাতা থেকে বোম্বেতে ব্রেনড্রেন চলছে। হিন্দি সিনেমাকেই সরকারি মদতে "ভারতীয়" সিনেমা হিসেবে প্রোজেক্ট করা হচ্ছে। যার একমাত্র অর্থ হল, সিনেমার অন্য কেন্দ্রগুলিকে ধ্বংস করা। বাংলার সিনেমা তারপরেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। একদিকে সত্যজিৎ রায়রা। অন্যদিকে মায়ামায় সাদাকালো জনপ্রিয় জলছবি। বাঙালি রোমান্স, বাঙালির রূপকথা, উত্তম-সুচিত্রার মহাজুটি এমনি আসেনি। চড়াদাগের রঙিন মোটাদাগের হিন্দি সিনেমার জবাবে সেই ছিল বাংলার শৈল্পিক প্রতিরোধ। সত্যজিৎ রায় নামক ঢ্যাঙা লোকটি, একটুও উচ্চকিত না হয়েই, এই প্রতিরোধের প্রতীক ছিলেন। বল্লভভাই প্যাটেল বলেছিলেন, বাঙালি শুধু কাঁদতে জানে। নার্গিস বলেছিলেন সত্যজিৎ রায় দারিদ্র্য বেচেন। ভুল কিছু বলেননি, ওঁরা ভারতীয়ত্বর নামে মোটা দাগের হিন্দুস্তানি বেচেন, এইটা কেবল বলেননি।
তো, তারপর যা হয়। মহানায়কের স্বর্ণযুগ তো আসলে ততটা স্বর্ণালী ছিলনা। স্রোতের মতো আসছে, হলে-হলে চলছে, বোম্বের সস্তা সিনেমা। যে পদ্ধতিতে ইংরেজ ধ্বংস করেছিল বাংলার বস্ত্রশিল্পকে, বাংলা সিনেমার ধ্বংস হওয়া তার চেয়ে আলাদা কিছু না। স্বয়ং মহানায়ক এবং মহানায়িকাও দৌড়চ্ছেন বোম্বেতে সিনেমা করতে, স্বর্ণযুগ যে আসলে পতনের যুগ, তার অব্যর্থ প্রমাণ এর চেয়ে বেশি আর কী হয়। এরপর বাংলার লো-টেক, লো-বাজেট শৈল্পিক উৎকর্ষময় সিনেমা-টিনেমা ক্রমশ উঠে যাবে, রাজত্ব করবে চড়া-দাগের হিন্দি সিনেমা। এই নিয়েও চমৎকার মন্তব্য আছে রায়বাবুর। শোলে বেরিয়েছিল ৭৫ সাল নাগাদ। পরবর্তীতে শোলে নিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, "খুবই দক্ষ, খুবই যোগ্য সিনেমা, যদিও শৈল্পিক ভাবে খুবই নিচু মানের"।** এর চেয়ে ভদ্র হ্যাটা আর কী হতে পারে। যে, ব্যাটারা ওয়েস্টার্ন টুকে একটা ফ্ল্যাট ভারতীয়ত্ব খুব দক্ষতার সঙ্গেই বানিয়েছে। কিন্তু ওটা শিল্প হয়নি। এটা কিন্তু "শিল্প হয়নি" বলে এলিটদের নাক কোঁচকানো নয়। এটা হল নকলনবিশীকে হ্যাটা।
হিন্দি সিনেমা, গান-টান সমেত, এইসময় মূলত টুকে-টুকেই চলেছে। আর দিগ্বিজয় করে ফেলার পর, বাঙালি মননও ক্রমশ ওটাকেই মোক্ষ বলে ভেবেছে। যেভাবে ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড় বাজারে জনপ্রিয় হয়েছিল, ফর্মুলা সেই একই। ওটাই বেঞ্চমার্ক হয়ে গেছে। তারপর বাঙালি সেই হিন্দি সিনেমা টুকে-টুকে খারাপতর সিনেমা বানিয়েছে ক্রমশ। সৃষ্টিশীলতা উবে গেছে। মধ্যও না, ক্রমশ নিম্নমেধার কারবার চারদিকে।
তো, সে যা হবার তাইই হচ্ছে, হবে। কিন্তু শোলের কথা উঠলেই, বারবার, ঢ্যাঙা লোকটির "যদিও শৈল্পিক ভাবে খুবই নিচু মানের", কথাটা মনে পড়ে।
*মিহির বোসের বলিউড আ হিস্টরি, পাতা ১৮৮-৯ থেকে অনুদিত।
** সাক্ষাৎকার। ইন্ডিয়া টুডে। ১৯৮৩।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।