এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  সিনেমা

  • মলয়ের লেখাপত্তর

    মলয় রায়চৌধুরী
    সিনেমা | ০৭ এপ্রিল ২০২০ | ৮৪০০০ বার পঠিত
  • গোদার-এর মাওবাদী পর্ব : একটি সমালোচনা
    [ মাওইস্ট ইনটারন্যাশানালিস্ট মুভমেন্ট পত্রিকার ২৬ জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যায় প্রকাশিত ]

    ‘চীনা, বা বরং, চীনা পদ্ধতিতে: ফিল্ম নির্মাণ’, সাধারণত ‘ল্যা চিনোয়া’ নামে পরিচিত, যা ১৯৬৭ সালের ফরাসি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে জাঁ-লুক গোদার পরিচালনা করেছিলেন।
    ১. লা চিনোয়া [ চীনা], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৬৭
    ২. লে ভনদে [ পুর্ব দিকের বাতাস ], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৬৯
    ৩. তু ভা বিয়ঁ [ সব ঠিক আছে ], পরিচালক জাঁ-লুক গোদার, ১৯৭২

    ২০০৪ সালে এই ফিল্মগুলো দেখে আমরা একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই এবং তা হল গোদার সিরিয়াস ছিলেন কি না । আজ আমরা যখন দেখি পশ্চিমে মাওয়ের ইমেজ অভিনব বিজ্ঞাপনের সাথে মিশে গেছে, তা আসলে মাওকে বিদ্রূপ করার কৌশল এবং তার মাধ্যমে সংস্কৃতিগুলোতে ভোক্তা আবেশের শক্তি প্রদর্শন করা হয়, এমনকি চীন থেকে দূরে থাকলেও। সর্বোপরি, আজ মাওয়ের ইমেজ মূল স্রোতোধারায় ব্যবহারটি বিপরীতমুখী, কারণ এটি চীনে দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন প্রচারের গুরুত্ব পায় আর সবাই জানেন যে মাও একজন কমিউনিস্ট ছিলেন। বিপরীতে, সংস্কৃতি বিপ্লবের (১৯৭৬ সালে) সময় গোদার একজন উন্নত চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে মাওয়ের ইমেজগুলো পুরোপুরি গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করেছিলেন -- এবং এমনকি মাওয়ের জন্য একটা জিংগল তৈরি করেছিলেন। আমরা বলতে পারি যে এই ফিল্মগুলোতে যাথার্থ্য আছে, মাওবাদী রাজনীতি, তত্ত্ব এবং পদ্ধতির বোঝাপড়া আছে।

    ১৯৬৭ সালে "লা চিনোয়া" মুক্তি পেয়েছিল দেখে অবাক হতে হয় । গোদার যে কেবল মাও আর সোভিয়েত সংশোধনবাদী নেতাদের মাঝে ভাঙনকে ধরতে পেরেছেন তা-ই নয়, গোদার সেই ভাঙনকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।তিনি ছিলেন সময়োচিত । "লা চিনোয়া" এবং "উইন্ড ফ্রম দ্য ইস্ট" -এ গোদার সোভিয়েত সংশোধনবাদ, ফরাসী "কমিউনিস্ট পার্টি", সামাজিক-গণতন্ত্র এবং শ্রমিক আমলাতন্ত্রের নিন্দা করেছেন।

    "পূর্ব দিকের বাতাস" ফিল্মে প্রচুর আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে তবে ফিল্মের সবচেয়ে বড়ো অবদান এবং তর্কসাপেক্ষভাবে গোদারের সামগ্রিক অবদানগুলি চলচ্চিত্র নির্মাণ-তত্ত্বের অন্তর্গত কারণ "পূর্ব দিকের বাতাস" এবং "লা চিনোয়া" ফিল্মগুলো সম্পর্কে গোদার জানান যে তিনি ঠিক কোন কারণে মাওবাদীদের বিশ্বাস করেন এবং কেমন করে ফিল্ম তৈরি করা উচিত । গোদার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন তা হল প্রলেতারিয়েত কীভাবে সংগ্রাম করবে এবং ফিল্মের দ্বারা কীভাবে সর্বহারা শ্রেণীর পক্ষে উপকার পাওয়া যায়, যদিও বর্তমানে আমরা যে সমস্ত ফিল্ম দেখি তাতে বেশিরভাগ উপস্থাপনা এবং পদ্ধতিগুলি শাসকদের উপকার করে।

    মাও-যুগের গোদার বলেছিলেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর অবস্হা নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক চলচ্চিত্রগুলো যদি সংঘর্ষের চিত্রণ বাদ দেয় তবে তারা কার্যকর হয় না।শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থা প্রকাশের ফলে হতাশা ঘটবে কিন্ত পাশাপাশি কর্মকাণ্ডও ঘটতে পারে, সুতরাং কীভাবে বিদ্রোহ করা যায় তা ফিল্মে দেখানো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

    রাজনৈতিকভাবে এই ফিল্মগুলোতে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা আমাদের পছন্দ নয়, বিশেষত "তু ভাঁ বিয়ঁ"[ সব ঠিক আছে] ফিল্মটি, যা মূলত একটি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রকে ফরাসী কর্মীদল কর্তৃক অধিগ্রহণ সম্পর্কে । ফ্রান্সে গোদারের সময়ের ঘটনাগুলো আজকের দিনে যেমন, তার তুলনায় সেই সময়ের সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিকদের অবস্হা আরও ঘোলাটে ছিল ।
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, ফরাসিদের তাদের অর্থনীতৈক অবস্হা পুনর্গঠন করতে হয়েছিল এবং এমনকি বুদ্ধিজীবীরাও ভেবেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী ঝোল টানা ভালো, কেননা তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি পৌঁছানোর পক্ষে সহায়ক হওয়া যাবে আর মার্কিন জীবনের মানদণ্ডে পৌঁছোনো যাবে।

    গোদার তাঁর সময়ের অন্যান্য অনেকের মতো ভেবেছিলেন যে তিনি সম্ভবত এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন যেখানে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে ফরাসিদের দেখাদেখি সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আসবে। যদি এটা সত্য হতো যে ফরাসি শ্রমিকরা শোষিত হচ্ছিল, তবে তাদের সম্পর্কে গোদারের দৃষ্টিভঙ্গি মাওবাদী মানদণ্ড দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক হতো। অন্যান্য বেশিরভাগ ব্যাপারে গোদার সঠিক হলেও এই একটি ব্যাপারে তিনি ভুল ।

    ২০০৪ সালের সুবিধাজনক অবস্হান থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ১৯৬৮ সালের মে মাসে সংঘর্ষময় ধর্মঘটে বিজয়ের দরুন বেতন অনেক বেড়ে গিয়েছিল এবং মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছিল যা কিনা ফ্রান্সে সাম্রাজ্যবাদী পরজীবিতার হাতকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। "তু ভাঁ বিয়ঁ"[ সব ঠিক আছে]-এর মাংস-প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মহিলা শ্রমিকের চরিত্র যা বলে তার চেয়ে বেশি কিছু প্রমাণ করার দরকার হয়নি, যে কিনা অলঙ্কৃত উক্তিতে জানায় যে, বস যদি এক ডলার দেয় তবে শ্রমিকরা প্রত্যেকে এক হাজার ডলার চায় -- যেন সেই পারিমাপের মান কোথাও থেকে উড়ে আসে। ফিল্মের শেষে একদল তরুণ একটি সুপার-মার্কেটে "ভাঙচুর" ধরণের গোলমালের আয়োজন করে যেখানে লোকেরা টাকাকড়ি না দিয়ে ঠেলা ভরে-ভরে জিনিসপত্র নিয়ে পালায়।

    অবশ্যই এটি একটি ভাল প্রসঙ্গ যে কেনই বা লোকেরা সুপার মার্কেটের দোকানগুলোকে টাকা দেবে, যখন সমাজ অর্থ যোগাতে পারে না, কিন্তু ফিল্মটির পুরো সুরটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবির দিকে খুব বেশি ঝুঁকে ছিল - সাম্রাজ্যবাদীরা কীভাবে নিজের এবং তাদের দালালদের সুবিধার জন্য তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করে তা দেখানোর পরও গোদার সামাজিক-গণতন্ত্র এবং সংশোধনবাদ থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে পেরেছিলেন ।

    ফরাসী শ্রমিকদের প্রতি গোদারের বিশ্বাসকে বাদ দিয়েও, যাদের শোষণ করা হচ্ছে এবং তাদের সমর্থন করার উপযুক্ত কারণ আছে, এই চলচ্চিত্রগুলোর সাথে আমাদের খুব কমই দ্বিমত রয়েছে। একথা বলা একটা কঠিন শর্তের মতো মনে হতে পারে, তবে বাস্তবে, গোদার তাঁর চলচ্চিত্রগুলোয় চিন্তা করার পদ্ধতিগুলো শেখান। "লা চিনোয়া" দর্শকদের বোঝাবার চেষ্টা করে যে তাঁর সময়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ কীভাবে বিজ্ঞান ছিল। অতএব অর্থনৈতিক জীবনের তথ্যগুলি পরিবর্তিত হতে পারে, কিন্তু সত্যে পৌঁছানোর কয়েকটি প্রাথমিক পদ্ধতি বদলায় না । এই কারণেই আমরা এখনও গোদারের মাওবাদী পর্বকে, ফরাসি শ্রমিকদের প্রকৃতির সাথে তাঁর সঙ্গে আমাদের মতবিরোধ সত্ত্বেও তরতাজা হিসেবে দেখি । ফ্রান্স সম্পূর্ণরূপে একটি পরজীবী জাতিতে পরিণত হয়েছিল, তবে গোদার এই ফিল্মগুলোতে যা বলেছিলেন তার বেশিরভাগ আজও বর্তমান।

    “পূর্ব দিকের বাতাস” ফিল্মে যখন গোদার তত্বনির্মাণকে ফিল্ম প্রোডাকশনের মূল কাজ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, তখন তাঁর সময়ে ফরাসি কর্মীদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী তার গুরুত্ব ছিল না। চলচ্চিত্রের প্রধান দায়িত্বের প্রশ্নটি এখনও অবধি অনুত্তরিত রয়ে গেছে। আরও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ফরাসি কর্মীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভুল ছিল, তবে মূল কাজটি নিয়ে প্রশ্ন এখনও থেকে গেছে।

    প্রধান দায়িত্বের বিষয়ে গোদারের সঙ্গে আমরা একমত নই, কারণ আমরা একে বলি, "জনগণের মতামত সৃষ্টি এবং ক্ষমতা দখলের জন্য নিপীড়িতদের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নির্মাণ"। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, "লা চিনোয়া"-র চেয়ে "ম্যাট্রিক্স" এর অবদান বেশি । তবে, আমরা যদি গোদারের মাপকাঠিকে গ্রহণ করি তবে বলতে পারি যে "লা চিনোয়া" ফিল্মটা "ম্যাট্রিক্স" এর চেয়ে বড় অবদান রেখেছে, কারণ "লা চিনোয়া" সাংস্কৃতিক বিপ্লবে উৎপন্ন মাওবাদী পদ্ধতি এবং নির্দিষ্ট তত্ত্বগুলিকে সরাসরি সামলায়। বিপরীতে, "ম্যাট্রিক্স" সম্ভবত বাইরের ভারী হস্তক্ষেপ ছাড়া মাওবাদের গুরুত্বর বিবেচনা করতে পারে না। এর মধ্য দিয়ে আমাদের এই প্রশ্নটি উত্থাপনের অর্থ হল যে, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণি এবং এর সাম্রাজ্যবাদী দেশ বিশেষত মিত্রদের, আসলে কী প্রয়োজন। তত্ব নির্মাণ বা আরও দ্রুত এবং বিস্তৃত আবেদন সহ এমন কোনও কিছুর মধ্যে আমাদের বেছে নিতে হবে। এটিও একটি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন - মূল কাজটি সম্পর্কে আমরা অথবা গোদার সঠিক কিনা। হয় এক বা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।

    কেউ কেউ বলতে পারেন যে এই ফিল্মগুলো উপদেশ দেবার মতো "ডাইডাকটিক", তবে বাস্তবে গোদার দর্শকদের বিভিন্ন শিবিরের পার্থক্য করার চেষ্টা করেছেন: ১) পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শিবির ; ২) ব্রেজনেভের সোভিয়েত সহ সামাজিক-গণতান্ত্রিক / সংশোধনবাদী ও শ্রম আমলা শিবির ইউনিয়ন ; ৩) সর্বহারা শিবির। প্রতিটি শিবির এই সিনেমাগুলিতে তার বক্তব্য রাখে এবং গোদার দেখান যে প্রথম দুটি একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত । মানুষ এই সংঘর্ষগুলোর দিকগুলো আলাদা করতে পারার সময়, গোদার সম্ভবত "ডাইডাকটিক" চলচ্চিত্রটিকে বুর্জোয়া চলচ্চিত্র হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন, সংঘর্ষ ছাড়াই উপস্থাপনা করেছিলেন।

    গোদারের তত্ত্ব নির্মাণের প্রধান কাজটা, দর্শকদের আর অর্থ-বিনিয়োগকারীদের এড়াবার খাতিরে চলচ্চিত্র পরিচালকদের উপর একটি ভারী বোঝা চাপিয়ে দেয়। সম্ভবত তাঁর কাজের অনুরণনটির বেশিরভাগ অংশই "শৈল্পিক বিশ্বস্ততা"র প্রশ্নে মাথা গলানো থেকে উদ্ভূত, এটা এমন একটা প্রশ্ন যা যে-কোনও শৈল্পিক পাতি-বুর্জোয়াকে ক্ষুব্ধ করে । তত্ব নির্মাণের দায়টা গোদারের জনপ্রিয় "আর্টসি" বা "হাই ব্রাউ" ভাবমূর্তির সঙ্গে খাপ খায়।

    ওনার এই ফিল্মগুলোর সাথে আমাদের উপরোক্ত কয়েকটি মতবিরোধ সত্ত্বেও, আমাদের এও বিশ্লেষণ করা উচিত যে গোদারের মাওবাদী পর্বটি সঠিক ছিল কিনা। সোভিয়েত সংশোধনবাদকে বারবার মারাত্মকভাবে আক্রমণ করাটা সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির মতন উপগ্রহ দলগুলোর দেউলিয়াপনা প্রমাণ করেছে । কেবলমাত্র সবচেয়ে বিভ্রান্ত রুশপ্রেমীগুলোই বিশ্বাস করত যে খ্রুশ্চেভ / ব্রেজনেভ যুগটি ছিল "সমাজতন্ত্র"।

    "পূর্ব দিকের বাতাস"-এ দেখা যায় ফিল্মটি স্ট্যালিনকে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছে। তখনকার দিনে এবং আজকালও একটা জনপ্রিয় চর্চা হল - স্টালিনের কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক পদ্ধতির বিপরীতে "স্বায়ত্তশাসন"। গোদার "স্বায়ত্তশাসন" আন্দোলনের ইতিহাসে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন, কীভাবে তা সর্বহারা শ্রেণিকে অবহেলা করে পাশ কাটিয়েছে।গোদার স্টালিনের সময়কার শিল্পকে দোষারোপ করার সময় স্ট্যালিনের অধীনে সমস্ত শিল্পীদের তার জন্য দায়ি করেছিলেন -- এমনকি তখন থেকে ট্রটস্কির অত্যধিক শৈল্পিক প্রভাব লক্ষ করে ব্রেস্ট-লিটোভস্কের সন্ধি হওয়ার পরেও লেনিনকে খোঁচা দিয়েছেন - “স্বায়ত্বশাসনের” প্রশ্নে গোদার পুরোপুরি স্ট্যালিনের পক্ষ নিয়েছেন এবং টিটোর যুগোস্লাভিয়ায় "স্বায়ত্তশাসন" এর আদর্শগত অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন। মাও ১৯৬৩ সালে তাঁর প্রবন্ধে শ্রমিক আভিজাত্য, শ্রমিক আমলাতন্ত্র এবং সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নগুলিকে একসাথে যুক্ত বলে প্রতিপাদন করে কড়া জবাব দিয়েছিলেন । গোদার সম্ভবত " যুগোস্লাভিয়া কি সমাজতান্ত্রিক দেশ? " প্রবন্ধটা পড়েছিলেন।

    ১৯৬০ এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত প্রতিবিপ্লবীরা মার্কস ও লেনিনের অনুগামীদের মতামতকে সরিয়ে যুগোস্লাভিয়াকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন যাতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ থেকে পুঁজিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এমন লোকদের মাঝ-পথের ঘর হিসাবে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন । যুগোস্লাভিয়া ছিল “স্বায়ত্বশাসিত উদ্যোগের” সঙ্গে "বাজার সমাজতন্ত্র "। লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল মাও বা স্ট্যালিন ধাঁচের কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক শক্তি।তবু যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে স্ট্যালিনের প্রভাব শেষ হয়ে গিয়েছিল আর গর্বাচভ/ইয়েল্তসিন বুর্জোয়াজি খোলাখুলি আবির্ভুত হল, তখন সবচেয়ে হিংস্রভাবে যুগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল । সেই গণহত্যার সন্ত্রাস আমাদের মতন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন এবং মাওয়ের অনুসারীদের অবাক করেনি, কারণ যুগোস্লাভিয়ার জনগণের বৈষয়িক ভিত্তি এবং পথনির্দেশক ছিল স্হানীয় স্তরে। "বিশ্বব্যাপী চিন্তাভাবনা করুন, স্থানীয়ভাবে কাজ করুন" স্লোগানের এটা একটা গভীর ভুলের উদাহরণ হতে পারে । অর্থনৈতিক "স্বায়ত্তশাসন" যা করেছিল তা হ'ল প্রদেশগুলোকে একে অপরের ঘাড়ে চাপতে উৎসাহিত করেছিল। সেটাই সংকীর্ণ প্রাদেশিক যুদ্ধের বৈষয়িক ভিত্তি তৈরি করেছিল।

    "স্বায়ত্তশাসন" প্রিয় যুগোস্লাভিয়ার ভয়ংকর পতন প্রমাণ করে যে পুঁজিবাদের পর তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি হল কেন্দ্রিয় সমাজতন্ত্র এবং তা সম্পর্কে মার্কস এবং এঙ্গেলসের তত্ত্বগুলি একেবারে সঠিক। সর্বহারা শ্রেণীর সংহতি ভঙ্গ করার জন্য "স্বায়ত্তশাসন" আরেকটি শব্দ। "স্বায়ত্তশাসন" আসলে সর্বহারা ও পুঁজিবাদী শ্রেণীর উভয়ের ওপরে লাঠি ঘোরাতে চাইছে এমন পাতি-বুর্জোয়া শ্রেণীর শব্দ। নারীদের প্রশ্নের ক্ষেত্রেও একই কথা। অবশ্য, জেনডার ব্যাপারটা শ্রেণীর প্রশ্ন থেকে তুলনামূলকভাবে স্বায়ত্তশাসিত, কারণ সমস্ত নারীই শ্রমিক নন, তবে একথা সত্য যে স্বায়ত্তশাসন এবং জেন্ডার প্রশ্নে ব্যক্তিবাদ নিপীড়িত ও শোষিতদের একতা ভঙ্গ করে। নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক গোষ্ঠী-স্তরের উত্তর খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। এটা ব্যক্তির স্বতন্ত্র অনুভূতি, বা স্বতন্ত্র ক্ষমতা বা এমনকি বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন নয় ।

    মার্কসের মূল্যের শ্রম তত্ত্ব জোর দিয়েছিল যে শ্রমিকরা কীভাবে একটি নিরপেক্ষ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে - অর্থাৎ যা তাদের নিজস্ব শ্রম। কারা শোষিত এবং কারা নয় সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপায় না থাকলে সর্বহারা ঐক্যের ক্ষতি হবে। শোষণ এবং ক্ষতিপূরণের প্রশ্নগুলিকে খুব গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে তা না হলে এর পরিণতি হবে গণহত্যার যুদ্ধ যেমন যুগোস্লাভিয়ায় দেখা গিয়েছিল। কেবলমাত্র তাদের কারখানা বা প্রদেশে নয় পুরো দেশ এবং পুরো পৃথিবীর অন্যান্য শ্রমিকদের সাথে কীভাবে চলতে হবে তা শেখা শ্রমিকদের একটি মূল কাজ। "স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে" শোষিতদের "মূল্যমানের শ্রম তত্ত্ব" প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই একে অপরের পরিস্থিতি দৃঢ়ভাবে জানতে সহায়তা করতে সফল হতে হবে। শ্রমিকরা যদি একে অপরের বস্তুগত অবস্থা দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে অক্ষম হয়, তবে তারা পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য স্তরে ব্যর্থ হবে। একটি কেন্দ্রিয় অর্থনৈতিক শক্তির মাধ্যমে শ্রমিকরা একে অপরের মধ্যে তাদের সম্পর্কগুলোর সামঞ্জস্য করতে পারে। সেই ক্ষমতা না থাকলে যুগোস্লাভিয়া-ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতে বাধ্য।

    এই ফিল্মগুলোর সংলাপসমূহের শব্দাবলী মাও-যুগের গোদারের চলচ্চিত্রগুলিতে অগ্রগতির প্রধান বোঝা বহন করে। দ্বিতীয়ত, গোদার সীমাবদ্ধ ক্রিয়া ব্যবহার করেন, রক্ত-লাল রঙ নিক্ষেপ করে এবং চরিত্রগুলোকে রক্তাক্ত করে তুলে ফিল্মে তুলে ধরা তাঁর পরিচিত ক্রিয়া। তৃতীয়ত, গোদার এছাড়াও দর্শকদের বোঝাবার জন্য ব্যবহার করেছেন এবং দেখিয়েছেন ফটোগ্রাফি বা ফিল্মের ছবিগুলো কীভাবে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষে সহজেই কাজে লাগানো যেতে পারে ।”তু ভাঁ বিয়ঁ" ফিল্মের শেষে, গোদার ফ্রান্সের এমন ফুটেজ দেখিয়েছেন যার পটভূমিতে নির্বোধ ট্যুরিজম বা ফরাসী জাতীয়তাবাদী জিংগলগুলো বাজিয়ে শুনিয়েছেন । "পূর্ব দিকের বাতাস" ফিল্মে গোদার সাধারণ ফুটেজ ব্যবহার করে বুর্জোয়া চলচ্চিত্র নির্মাণকারী দুটি চরিত্রের অভিনয় উপস্হাপন করেছেন। আমরা দুর্দান্ত মেক-আপ, প্রপস এবং ম্লান আলো দিয়ে একটি কংকুইস্তাদর ফিল্মের ভাবনা কল্পনা করে নিই, তবে গোদার আমাদের দেখিয়েছেন একজন লোক একজন বন্দীকে, প্রকাশ্য দিনের আলোয়, বিশেষ ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই টেনে নিয়ে চলেছে --যা প্রকৃত অভিনেতারা দেখতে পায় কোনোরকম প্রপস ছাড়াই --- যা বেশ সাদামাটা। বুর্জোয়ারা যখন কিনা দর্শকদের দুর্দান্ত পটভূমির সৌন্দর্য দেখায়, তাঁর মাওবাদী পর্বে গোদার আমাদের দেখান যে সৌন্দর্য আসলে থাকে সংগ্রামে ।
    [ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ]
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:২৮735252
  • । শুনলাম জীবনানন্দ দাশের জীবন অনুসারে একটা সিনেমা হচ্ছে, নাম- 'ঝরা পালক'। শুনলাম সেখানে জীবনানন্দের চরিত্রে অভিনয় করছেন ব্রাত্য বসু। ব্রাত্য বসু এই মুহূর্তে অন্যতম সেরা বাঙালি অভিনেতা, নট ও নাট্যকার। তাঁর প্রতিভা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু জীবনানন্দের চরিত্রে তাঁকে মানাবে না। জীবনানন্দ দাশ একজন গ্রাম্য চেহারার সম্পূর্ণ অনাগরিক মুখের মানুষ ছিলেন। তিনি চরম অন্তর্মুখী, ঈর্ষাকাতর, যৌনকাতর, অমিশুক, অবান্তর একটা ইমেজের অধিকারী ছিলেন। ব্রাত্য বসু একজন বহির্মুখী, দৃঢ় মুখায়ববের অধিকারী অভিনেতা। তাঁর চোখে কোনো মার খাওয়া লোকের ভাব নেই। যে জীবনানন্দ দাশ নিজের স্ত্রীর দ্বারা দলিত ছিলেন, যে জীবনানন্দ নিজের খুড়তুতো বোন শোভনাকে শারীরিকভাবে কামনা করতেন, ডায়রিতে লিখে রেখেছিলেন যৌনসংগমের পরে শোভনার হট ব্যাগ লেগেছিল, যে জীবনানন্দ জানতেন তিনি একজন কুৎসিত চেহারার লোক, এবং সেটাও ডায়রিতে লিখেরেখেছিলেন, যে জীবনানন্দ চাকরি পেয়েছিলেন বাবার সুপারিশে একের পর এক, কিন্তু সেই চাকরি টেঁকাতে পারেননি, যে জীবনানন্দ বারবার ক্ষমতাশালী লোকেদের চিঠি লিখে কখনও চাকরি চেয়েছেন কখনও নিজের কবিতার প্রশংসা, যে জীবনানন্দ অসামান্য কিছু উপন্যাস লিখেও ট্র্যাঙ্কে বন্ধ করে রেখেছিলেন, যে জীবনানন্দ 'বাংলার ত্রস্ত নীলিমা'-র মতো একটা কাব্যগ্রন্থ লিখেও প্রকাশ করেননি, তাঁর চরিত্রে উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী ব্রাত্য বসুকে আমি কল্পনাও করতে পারি না।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:২৯735253
  • জয় গোস্বামীর কবিত্বশক্তি নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সেটা তাঁর প্রথম দিকের কবিতা পড়লেই বোঝা যায়। কিন্তু তাঁর কবিতা শেষ অবধি কোথাও গেল না। এটা কিছুটা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। শক্তি আর জয়, এই দুজনকেই যখন পড়ি, বুঝতে পারি এঁদের মধ্যে বিপুল কবিত্ব আছে। কিন্তু কবিতা লেখার ক্ষেত্রে সেই কবিত্ব এঁরা চ্যানেলাইজড করতে পারেননি। এক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশকে মনে পড়ে। জীবনানন্দ দাশ শুরু করেছিলেন নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদারকে নকল করে। তারপর তিনি এলান পো, ইয়েটস আর হুইটম্যানকে নকল করলেন। কিন্তু একটা লড়াই তাঁর চলল। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে কবিত্ব ব্যাপারটা প্রতিভা ছিল না, ছিল তাঁর চয়েস। জীবনানন্দ দাশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জীবনের বিনিময়ে হলেও কবি তাঁকে হতেই হবে। এই যে সাধ, তা তাঁর সাধ্যকে অতিক্রম করে তাঁকে একটা মহৎ জায়গায় নিয়ে গেল 'মহাপৃথিবী' 'সাতটি তারার তিমির' আর 'বেলা অবেলা কালবেলা' এই তিনটি কাব্যগ্রন্থে। এখানে তিনি একজন প্রভাবমুক্ত মহাকবি। কবিত্বশক্তি বা প্রতিভার জোরে নয়, নিজের সিদ্ধান্ত আর সংগ্রামের জোরে। এই সংগ্রাম শক্তির মধ্যে নেই, জয় গোস্বামীর মধ্যে একেবারেই নেই। আমি কবির কবিত্বকে গুরুত্ব দিই না, তার কবিতাকে দিই। কবিত্ব ব্যাপারটা কেমন বলুন তো? একজন বডি বিল্ডার বাড়িতে বাস করে, বাড়িতে যখন ডাকাত পড়ল, সে খাটের তলায় ঢুকে পড়ল, আর বাড়ির একজন রোগা লোক ডাকাতদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। তাল তাল পেশি নিয়েও একজন কাপুরুষ হতে পারে। প্রচুর কবিত্ব নিয়েও একজন মিডিওকার কবি হতে পারেন- উদাহরণ জয় গোস্বামী।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩০735254
  • সেই কলকাতায় বসে তিরিশের দশকের শিক্ষিত মেধাবী আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সচেতন কবিদের মধ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের ‘বিরুদ্ধে’ একটাও জ্বলন্ত কবিতা কেউ লিখেছেন কি, যেটার কারণে তাঁদের জেল হতে পারত বা চাকরি যেতে পারত? এটা তাঁদের প্রতি কোনো নালিশ নয়। কবি সেটাই লিখবেন যেটা তাঁর প্রাণ চায়। কবিতার দাবিই সবার আগে। কিন্তু একাধিক কবির সামাজিক অবস্থান অনেক সময় এক বা একাধিক কবির সামাজিক সুবিধা বা অসুবিধার কারণ হয়েই ওঠে। তিরিশের দশকের কবিদের কবিতায় দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী ও পরবর্তী মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের তিক্ত হতাশ ক্ষুধার্ত ছবি ফুটে ওঠে, সেই ছবি ব্রিটিশের পক্ষে ততটা অস্বস্তিকর নয়, যতটা বাঙালির নিজের পক্ষে। সমর সেনের কবিতাও এমনকি এ-ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতার মতো কোনো প্রত্যক্ষ পলিটিকাল গুরুত্ব বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের কবিতার ছিল না। ব্রিটিশ শাসন যে একটা অসহ্য ব্যাপার, সেটা এঁরা সরাসরি একটা লাইনেও বলেননি। বরং সযত্নে বাংলা কবিতা থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন কবিতার যতটুকু গ্রামীণ স্বভাব। এবং আমরা আমাদের ডিএনএন-তে তিরিশের কবিদের ধারণ করেছি, জেনে বা না জেনেই।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩১735255
  • ৩০শে এপ্রিল ১৮৯০ তারিখে মা আর বোনের উদ্দেশে একটা চিঠিতে ভিনসেণ্ট ভ্যান ঘগ লিখছেন, 'যে মুহূর্তে শুনেছি আমার কাজ কিছুটা হলেও সাফল্য পেয়েছে, আর ঐ লেখাটা পড়েছি, তখন থেকে আমার ভয় হয়েছে যে এর জন্য আমি নিশ্চয়ই শাস্তি পাবো। শিল্পীর জীবনে প্রায় সব সময়ই এ-ই ঘটে, সাফল্যের মতো নিকৃষ্ট জিনিস আর হয় না।'
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩২735256
  • এই মুহূর্তে কঠিনতম কাজ হল গল্প লেখা। পৃথিবী অসম্ভব ছোট হয়ে গেছে। প্রতি মুহূর্তে গল্প ঘটছে মানুষের চোখের সামনে। প্রতিটি মানুষ এখন কাহিনির মানুষ। প্রতিটি মানুষই তার নিজ নিজ চরিত্রে রচিত।
    এমতাবস্থায়, একজন লেখক যখন গল্প লিখতে বসেন, তাঁর সামনে কবিতা বা উপন্যাস লেখার চেয়ে অনেক বড় কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়। কী এমন গল্প তিনি আজ বলতে পারেন, যা পাঠক আগেই শোনেননি? এই চ্যালেঞ্জ মঁপাসার ছিল না, চেখভের ছিল না, রবীন্দ্রনাথের ছিল না। আজ আছে। আজ একজন গল্প লিখতে বসে হয়ত নতুন করে বরফ আবিষ্কারের কাহিনিও আর বলতে পারবেন না।
    মানুষের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিকে অবলম্বন করে, সঞ্চয় করে, খনন করে আজ একজন গল্পকার কী লিখতে পারেন, যা এর আগে লেখা হয়নি, যা লেখা কোথাও না কোথাও এই মুহূর্তেই হচ্ছে না, অথবা, লেখা হয়েছিল কিন্তু মানুষ ভুলে গেছে, বা খুব অবহেলার সঙ্গে কেউ সেই গল্প লিখতেই অস্বীকার করেছে?
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৩735257
  • চলে গেলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। বাংলা কবিতা থেকে বিদায় নিলেন পঞ্চাশের দশকের শেষ সৈনিক, সুনীল-শক্তিদের শেষ বান্ধব। শরৎকুমার আমার প্রিয় কবি ছিলেন। তীব্র শীতের মধ্যে দুঃসংবাদ এল।
    কিন্তু বিদায় নিলেন বলছি কেন? বাংলা কবিতায় তিনি থেকে যাবেন। থেকে যাবে তাঁর বেপরোয়া মধ্যবিত্ত সুর।
    শরৎকুমার লিখেছিলেন— ‘রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক/ চৌরঙ্গী ভবানীপুর থেকে শ্যামবাজার বদ্বীপ’— এই পংক্তিগুলো আজ কিংবদন্তি। কখনও ছন্দে কখনও ছন্দহীনতায় তাঁর কবিতা অপরূপ।
    পরবর্তী কবিদের মধ্যে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতায় তাঁর প্রভাব লক্ষ্যনীয়। প্রথম জীবনে 'নমিতা মুখোপাধ্যায়' নামে কবিতা লিখতেন, তাঁর ধারণা হয়েছিল মেয়েদের নামে লিখলে কবিতা আরো অনায়াসে ছাপা হবে।
    এই যে নিরপরাধ ছেলেমানুষি, তা তাঁর লেখার মধ্যেও কোথাও অমলিন হয়ে আছে চিরকাল।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৪735258
  • কেউ আপনাকে কবিতা লেখা শেখাতে এলে তাকে অবিশ্বাস করুন। যদি সে কবিতা কী করে লিখতে হয় জানে, সে আপনাকে সেটাই শেখাবে যেটা সে জানে। অর্থাৎ, আপনাকে নিজের মতো কবিতা লিখতে শেখাবে। আপনি তার এঁটো করা পথে হাঁটতে শুরু করবেন। ল্যাংবোট হবেন। আর, যদি সে এমন কোনো পথ জানে, যেটা তার নিজের কবিতা লেখার পথ নয়, কিন্তু তার নিজের চেয়েও উৎকৃষ্ট কবিতা সেই পথে লেখা যায়, তাহলে সে সেটা আপনাকে শেখাবে কেন? নিজেই তো লিখবে সেই পথে! কেউ কি চায় অন্য কেউ তার চেয়ে ভাল লিখুক? নিজের বাপও চায় না। কবির অমরত্বের ক্ষেত্রে কোনো আপনজন নেই, ওয়ারিশ নেই।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৫735259
  • বাংলাদেশের কিছু ইন্টেলেকচুয়াল পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবকে এত খারাপ চোখে দ্যাখেন কেন? এখনো তো আশি বছরও হয়নি দুই বাংলা এক ছিল! পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস কতটা বিস্তৃত হতে পারে? আশি বছর খুবই ক্ষুদ্র সময়কাল। এর মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। কিন্তু আজও পশ্চিমবঙ্গে অনেক মানুষ বেঁচে আছেন যাদের কাছে দেশভাগ বইয়ে পড়া ইতিহাস নয়, বরং তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাঁরা আজও বরিশাল চট্টগ্রাম শিলেট বা ঢাকাকে তাঁদের দেশ মনে করেন। সেটা তাঁদের অন্যায় নয়। দেশ মানুষের হৃদয়ে থাকে, রাষ্ট্র থাকে মানচিত্রে।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৭735260
  • কবিতার কোনো গুরু হয় না। শিষ্য হয় না। সিনিয়র হয় না। জুনিয়র হয় না। কবিতা এক নিঃসঙ্গ হাওয়ার মতো। কবিরা গাছ। একলা একেক গাছ। হাওয়া এক গাছ থেকে আরেক গাছে সঞ্চারিত হয়। পাতার শব্দ হয়। শুকনো পাতা খসে পড়ে। পাখিদের ডানার ঝাপট। একই হাওয়া অনেকসময় একাধিক গাছকে স্পর্শ করে থাকে।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৩৯735261
  • আমাকে দেখে কি আজকের নতুন লিখতে আসা বাঙালি কবি শিক্ষা নিতে পারেন? না। কিন্তু কেন পারেন না! সেটা নিয়ে বলি।
    ধরুন আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে আমি বাংলা বাজারের প্রায় সব 'গুরুত্বপূর্ণো' পত্রিকায় কবিতা লিখতাম। আজ প্রায় কোথাও লিখি না। যা লিখছি ফেসবুকে দিয়ে দিচ্ছি। আসন্ন কলকাতা বইমেলায় আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণো পত্রিকাতেই কবিতা লিখছি না। আপনার মনে হতে পারে, এর ফলে আমি একটা চরম অরক্ষিত অবস্থায় পড়েছি। তাহলে লেখা ছেড়ে দিন। আপনি ২০২১-২২-এ লেখার জন্য আসেননি। কেন সেটাও একটু বলি।
    একজন কবি কী? পশ্বাচার, বীরাচার পেরিয়ে একজন সাধক দেবতা হয়ে ওঠেন। একজন কবিও তাই। আপনি যখন সর্বত্র লিখতে চাইছেন, তখন আপনার পশুভাব চলছে, আপনি জিভ লকলক করে বিখ্যাত হতে চাইছেন। তারপর বীরাচারী হবেন, যখন আপনি বাছতে শুরু করবেন কোথায় লেখা যায়, এবং কাদের আপনার লেখা পাওয়ার যোগ্যতা নেই। দেখা যাবে আপনি লিখছেন বেশি, ছাপছেন খুব কম। এরপর দেবভাব, অর্থাৎ তখন আপনার লেখা পেলে একটা পত্রিকা ধন্য হবে। এই শিক্ষা আপনি আমার থেকে নিতে পারেন। লেখা চাইলে এক সেকেন্ডের মধ্যে 'না' বলা অভ্যাস করুন। যদি নবাগত হন, অন্তত না চাইতেই এক ঝুড়ি লেখা পাঠানোর অভ্যাসে রাশ টানুন। সেটা কি পারবেন? পারবেন না। কাজেই আমাকে দেখে শিক্ষা নেওয়া আপনার কম্ম নয়।
    ‘তবুও প্রয়াস’ থেকে প্রকাশিত আমার ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের অর্ধেকও বিক্রি হয়নি, এমন বই নিয়েও লোকজন যে পরিমাণে নাচানাচি করছে, ওই বই নিয়ে হয়নি। সেটা কি খুব খারাপ ঘটনা মনে করেন? ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ বইটি কোথাও কোনো পুরস্কার পাবে না। পুরস্কৃত করতে চাইলেও করতে দেব না। এর ফলে কি আমি পিছিয়ে গেছি মনে হয়? তাহলে আমাকে দেখে শিক্ষা নেওয়ার আশা ছেড়ে দিন। কারণ পুরস্কার আসে উপর থেকে। যাদের দেখে সত্যিই মনে করবেন আপনার উপরে বিরাজ করেন, তাঁদের হাত থেকে পুরস্কার নিন।
    তেমন কেউ এই পশ্চিমবঙ্গে নেই যে অনুপম মুখোপাধ্যায়কে পুরস্কার দ্যায়। আপনার উপরে আছে কি না আপনিই বিচার করুন। আর নাচানাচি দেখতে চাইলে ক্যাওড়া দলে নাম লেখান।
    আমাকে দেখে শিক্ষা নিতে চান? গত পাঁচ বছরে আমি যে কবিতাগুলো লিখেছি, কেবল কবিতা, অন্য লেখাগুলোর কথা ছেড়েই দিলাম, শুধু কবিতার বইগুলো যদি ধরেন, এটা যদি অশিক্ষিত দেশ না হত, আমাকে নিয়ে অনেক সেমিনার হত। এখানে কিছু হয় না। তাহলে কি আমি ব্যর্থ হলাম? সেটা ভাবলে আমার দিকে তাকানো ছেড়ে দিন। অশিক্ষিত দেশে যাদের নিয়ে সেমিনার হয় তারা মৃতদেহ, সব সেমিনার আর আলোচনাচক্র এখানে মূলত শব-ব্যবচ্ছেদ মাত্র। জীবিত লোককে নিয়ে হয় না। আলোচনার আশা করবেন না। এখানে আলোচনার পেছনে লম্বা লম্বা গল্প থাকে।
    আমাকে দেখে শিক্ষা নেবেন না, সেটা আপনার কম্ম নয়। আফটার অল, আপনি যে সময়টায় বাস করছেন, সেটা অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সময় বলে চেনার চোখও তো আপনার থাকতে হবে।
    আরে, আপনি আজও রবীন্দ্রনাথকেই চিনেছেন কি?
     
     
     
     
     
     
     

     
     
     
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৪০735262
  • ছাপোষা সাহিত্যিকে ছেয়ে গেছে। এরা খারাপ লেখে এমন নয়। এরা লেখার কায়দা জানে। রপ্ত করেছে। কিন্তু এদের মধ্যে উন্মাদনা নেই। উন্মাদনা ছাড়া নতুন কিছু হয় না। আর আছে এদের বিগ্রহ পূজা। এরা ভাবে জীবনানন্দ দাশ এদের নাগালের বাইরে। এরা ভাবে এরা অমিয়ভূষণ মজুমদারের মানের বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র স্তরের উপন্যাস কোনোদিন লিখে উঠতে পারবে না। এমন কি এরা জয় গোস্বামীকেও একটা অন্য গ্রহের ব্যাপার মনে করে। এরা নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধে আর একে অন্যকে দিয়ে নিজের নিজের সফলতা ব্যর্থতা মাপে। এরা মনের অনুভূতি প্রকাশ করাকে একরকম সফলতা মনে করে। ঘটনা হল খিদে পেলে বিড়াল যে ম্যাও করে, সেও নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করে, কিন্তু তার কোনো শিল্পমূল্য নেই, কারণ সব বিড়াল ওই একই সুরে ম্যাও করে, খিদে পেলে।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৪২735263
  • 'বব বিশ্বাস' দেখলাম। যাঁরা এতদিন অভিষেক বচ্চনকে মিম আর ট্রোলিং-এর খোরাক বানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁরা হতাশ হবেন। হতাশ হবেন নাকউঁচু বাঙালি আঁতেলরাও। আমার ভাল লেগেছে। গল্পটা অতি মাঝারি মানের। কিন্তু গল্পের জন্য আমি সিনেমা দেখি না, গল্পের জন্য গল্পের বই-ই পড়ি। একটা সিনেমার গল্প খারাপ হলে আমি বেশ খুশিই হই, কারণ অন্য দিকগুলো সেক্ষেত্রে আরো ভাল করে এনজয় করা যায়। এই সিনেমা অভিষেক বচ্চনের প্রতিভা চিনিয়ে দ্যায়। তাঁর প্রজন্মের তিনিই সেরা অভিনেতা, মোটেই হৃতিক রোশন নন, এটা প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। এই অভিষেককেই একটা সময় দেখা গিয়েছিল 'যুবা', 'গুরু', 'রাবণ', 'ব্লাফমাস্টার'-এর মতো ছবিতে। মাঝখানে কী হয়েছিল কে জানে, মানুষের জীবনে খারাপ সময় আসে। সেই সময়টা কেটে গেছে, বোঝা যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, এই রোল শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে হত বলে আমার মনে হয় না, কারণ শাশ্বত একজন চরিত্রাভিনেতা, হিরো-মেটেরিয়াল তাঁর মধ্যে নেই, খুবই কুশলী অভিনেতা হলেও এই চরিত্রের মধ্যে অভিষেক যতগুলো রং খেলিয়েছেন শাশ্বতর দ্বারা হত না। আমার এই কথার জন্য যেন আবার 'বাংলা পক্ষ'-এর হাতে ধোলাই খাওয়াবেন না। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্দান্ত।।
  • | 106.213.***.*** | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৪৪735264
  • হে তরুণ কবি, এই শীতের দিনে তোমাকে কিছু কথা বলি। পছন্দ না হলে 'বুল শিট' বলে চলে যেও। আজ যারা প্রশংসা করছে, তাদের নামগুলো মনে রাখো। ১০ বছর পরে তাদের কেউই প্রায় আর তোমার নাম মুখে আনবে না। ওরা জানে তুমি আজ নিজের কবিতা লিখতে পারছ না, ওদের হয়েই লিখছ, তাই ওরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ যারা অপ্রিয় কথা বলছে, কিন্তু সদয়ভাবে, তাদেরও মনে রাখো। ১০ বছর পরেও তাদের সুর বদলাবে না। এই লোকগুলোকে তুমি তখনও পাশে পাবে, যদি ১০ বছর টিকতে পারো বাংলা কবিতায়। ১০ বছর পরে যারা অকথ্য নিন্দা করবে তোমার, তাদের কেউ কেউ আজ তোমার প্রশংসা করছে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যারা সেদিন অকথ্য নিন্দা করবে, ৫ বছরের মধ্যেই হয়ত তোমার কাছে অনুতপ্ত ফিরেও আসবে। যদি ১৫ বছর টিকতে পারো বাংলা কবিতায়। যদি ২০ বছর টিকতে পারো, হয়ত তোমার নাম ১০০ বছর স্থায়ী হবে, যদি সত্যিই সৎভাবে কবিতায় নিজেকে রাখো, যদি নামের বদলে স্থায়ী যশ আর টাকার বদলে গভীর অর্থের লোভ থাকে তোমার। যশের লোভ বজায় রেখো আজীবন। ওই লোভ জরুরি। আর অন্য কবিদের থেকে ঠিক ততটাই দূরত্ব রাখা জরুরি, যেমন ইউরেনাস গ্রহ রাখে অন্য গ্রহদের সঙ্গে। বিশেষ করে তোমার সমবয়সী কোনো কবিই তোমাকে কিছু দিতে পারবে না।।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:১৩738491
  • জাঁ লুক গোদার এবং জিগা ভার্তোভ গ্রুপ : মলয় রায়চৌধুরী

    জিগা ভার্তোভ গ্রুপ (ফরাসি: Groupe Dziga Vertov) ১৯৬৮ সালে দুই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, জাঁ-লুক গোদার এবং জাঁ-পিয়ের গোরাঁ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। জঁ অঁরি রোজে এবং আরমাঁ ম্যাকো ১৯৬৯ সালে এই গোষ্ঠীতে যোগদান করেন। তাদের চলচ্চিত্রগুলি প্রাথমিকভাবে ব্রেখটিয়ান আঙ্গিক, মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং রচনা থেকে  লেখকর স্বামীত্ব বাদ দেবার প্রচেষ্টা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। ১৯২০-৩০ এর দশকের সোভিয়েত চলচ্চিত্র নির্মাতা জিগা ভার্তোভের নামে এই গ্রুপটা ১৯৭২ সালের Letter to Jane : An Investigation About a Still-এর  পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

    এটা ছিল প্যারিসের ষাটের দশকের ছাত্র-বিপ্লবের পৃষ্ঠপটে একটি রাজনৈতিকভাবে র‌্যাডিক্যাল ফিল্ম গোষ্ঠী । মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং মাওবাদী তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, যা প্যারিসের সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আবহাওয়াকে গভীরভাবে প্রবাভিত করেছিল আর ফিল্মনির্মাণকে বুর্জোয়া উদ্যোগ হিসাবে  মর্যাদায়  অসন্তুষ্ট হয়ে এই গোষ্ঠীটি কেবল রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, রাজনৈতিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল।

    ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাতের পর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিদেশ নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর জন্ম ঘটিয়েছিল, যারা চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ লুক গোদার এবং জাঁ পিয়ের গোরাঁর নেতৃত্বে ডিজিগা ভার্তোভ গ্রুপ ছিল সত্যিকার অর্থে  সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনৈতিক সিনেমার ব্র্যান্ড গড়ে তোলার  এমনই একটি প্রচেষ্টা।

    জিগা ভার্তোভ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত সিনেমাটিক ব্যবস্হার প্রতিটি দিককে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল এবং তার দরুন, নির্দিষ্ট কয়েকটি সহমর্মী সম্প্রদায়ের বাইরে খুব কম প্রচারিত হয়েছে ও দর্শক আকৃষ্ট করতে পেরেছে।  একটি বিপ্লবী সিনেমার উদ্দেশ্যে কাজ করার এবং প্রযোজনা, নির্দেশনা এবং প্রদর্শনীর জনপ্রিয় মডেলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার এই বিরোধিতামূলক অবস্থান গোষ্ঠীর পক্ষে এক ধরণের অচলাবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। যাইহোক, সত্যিকারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা রয়েছে এমন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর সংশ্লিষ্ট লোকজনদের জন্য এই গোষ্ঠীর চলচ্চিত্রগুলি অপরিহার্য সমাবেশ-কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।

    Letter to Jane  (১৯৭২ ) ছিল  একটি ফিচার-ফিল্ম দৈর্ঘ্যের প্রযোজনা যা   উত্তর ভিয়েতনামী প্রতিরোধ বাহিনীর মাঝে শুধুমাত্র জেন ফণ্ডার স্থির ছবি জুড়ে-জুড়ে  ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে  একটি একক চিত্রকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করে। অকল্পনীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নির্মমভাবে সমালোচনামূলক, ছবিটি ইমেজ তৈরির রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয় ফিল্ম।

    সম্ভবত অন্য যে-কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের চেয়ে বেশি, জিগা ভার্তোভ গ্রুপটি প্রচলিত সিনেমাটিক মডেলকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার মানে কেবল জনপ্রিয় সিনেমা এবং আর্টহাউস প্রযোজনা উভয়েরই প্রত্যাখ্যান নয়, যাকে গ্রুপটা মনে  করেছিল যে ওগুলো শুধু প্রভাবশালী পুঁজিবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করে আর  প্রযোজনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনীর পুঁজিবাদী মডেলগুলোকে রক্ষা ধরে।

    .প্রতিরূপের সমস্যাটি ছিল জিগা ভার্তোভ গ্রুপের অন্যতম দুশ্চিন্তা, যার চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয় ইমেজ তৈরির  রাজনৈতিক অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করতে চাইছিল। নন-ন্যারেটিভ এবং প্রাবন্ধিক বিন্যাস প্রয়োগ করে, গোষ্ঠীর ফিল্মগুলো শব্দ, ইমেজ এবং দর্শকদের একটি অসংলগ্ন কেরামতির মাধ্যমে ব্যবহার করতো যাতে মানে তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য  প্ররোচিত হয়। এই চলচ্চিত্রগুলি  লেখকসত্বের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করতো, যা স্পষ্ট হয়ে উঠতো তাদের যৌথ স্বাক্ষর থেকে ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:২৭738492
  • জাঁলুক গোদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গ্যাভিন স্মিথ :মলব রায়চৌধুরীর অনুবাদ
    ............................................................................
    গ্যাভিন : ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’তে  (Histoire(s) du cinema )  সিনেমার শুরু থেকে আপনি যে ফিল্মগুলো তৈরি করেছেন সেগুলো আপনার আগের কাজগুলোর চেয়ে বেশি সংবেদনশীল । প্রত্যেকটাই  সিনেমার সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা বলে মনে হয় ।

    গোদার : হ্যাঁ । আমিও তাই মনে করি, যদি আমি তা  বলতে পারি,  তবে এটা পিকাসোর একটিা কথার মতন আমাকে একবার চোট দিয়েছিল : "চিত্রকর্মটি আমাকে প্রত্যাখ্যান না করা পর্যন্ত আমি আঁকা পছন্দ করি।" আমি বলব যে সিনেমা আমাকে আরও কয়েকটা ফিল্ম, আরও কয়েক দশক ধরে অস্বীকার করবে না, সুতরাং এটা একটা সমঝোতা। আমি যা চাই তা দিয়ে নয়, কারণ আমি কী চাই তা আমি নিজেই জানি না, তবে আমার যা আছে তা থেকে আমি যা চাই তা তৈরি করতে পারবো।  আরও কিছু প্রশ্ন তুলতে সক্ষম না হওয়ার জন্য, কিন্তু যা আমি সত্যিই পছন্দ করি তা করার জন্য, আমার যা আছে তাই দিয়ে  মোকাবেলা করতে পারি। এটা একটা শান্তিপূর্ণ মনোভাব। আমি যখন কোনও ফিল্ম করি, তখন তা ভালভাবে করা না হলেও আমি আর ক্রুদ্ধ হই না। রাগ করা উচিত নয়, কেননা যে ছবিটা এইভাবে বা অন্য কোনও ভাবে  হওয়া উচিত ছিল , তা চিন্তা না করে  কেবল নিজের মতো করে চালিয়ে যেতে হবে ।

    গ্যাভিন : তবুও আপনার ফিল্ম নির্মাণের কাজটা সর্বদা একটা বিপরীত চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে।

    গোদার : আজকাল এটা ঘটনা, তবে আমি আর তা নিয়ে চিন্তা করি না। আমি যখন একটি বড় ফিল্ম তুলি, তখন আমি নিজেকে বলি না, এটা হলিউডের কোনো জাতীয় চলচ্চিত্র-প্রথার বিরুদ্ধে, এই ধরণের ফরাসি ছবি --- এটা আমি করছি কেবল ফিল্মে । আমি জানি যে আমি অবশ্যই বিরোধীপক্ষে, তবে এটা একটি বড় এলাকা।

    গ্যাভিন :  সমালোচক হিসাবে আপনার কাজসহ পুরো ক্যারিয়ার, তাকে দেখা যেতে পারে আলোচনার প্রক্রিয়া হিসেবে , সিনেমার সাথে বোঝাপড়ার পদক্ষেপ হিসেবে।

    গোদার: আমি পরিচালনা এবং সমালোচনার মধ্যে পার্থক্য করি না। আমি যখন প্রথমফিল্ম দেখতে শুরু করি, তা তখনই চলচ্চিত্র নির্মাণের অংশ ছিল। আমি যদি এখন হাল হার্টলির ছবি দেখতে যাই, তাও সিনেমা তৈরির অংশ। তাতে  কোনও পার্থক্য নেই । আমি ফিল্ম নির্মাণের অংশ আর যা এই এলাকায় ঘটে চলেছে, আমাকে তা অবশ্যই দেখতে হবে।  আমেরিকান ছবিগুলোর ব্যাপারে, প্রতি বছর কমবেশি একটা দেখাই যথেষ্ট: সেগুলো কমবেশি সব একইরকম হয়। তবে এটা আমাদের দেখার  একটা অংশ কেননা  আমরা তো এই জগতে বসবাস করছি।

    গ্যাভিন : চলচ্চিত্র নির্মাণ কি এক অর্থে আপনার কাছে একটি ইউটোপিয়ান কার্যকলাপ ?

    গোদার: আমার ফিল্ম যেভাবে হওয়া উচিত তা ইউটিপিয়া , তবে সিনেমা বানানো, তৈরি করা, ইউটিপিয়া নয়।

    গ্যাভিন : “জার্মানি বছর ৯০ নয় শূন্য” [ Germany Year 90 Nine Zero] এবং “সিনেমার ইতিহাসগুলো”[Histoire (s) du cinemaতে] আপনি সিনেমাকে একটি পতিত মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করেছেন।

    গোদার : হ্যাঁ, সেটাই আমার মতামত ।

    গ্যাভিন : কোন মুহুর্তগুলো সেই পতনকে  সংজ্ঞায়িত করেছে?

    গোদার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান ফিল্মগুলোর ফরাসি ফিল্মগুলোকে পরাস্ত করার একটা সুযোগ ছিল, যা সেই সময়ে আরও শক্তিশালী এবং সুপরিচিত ছিল। প্যাথে, গাউমঁ, মেলিস, ম্যাক্স লিন্ডার ছিলেন বড়ো একজন তারকা। যুদ্ধের পরে ফরাসিরা দুর্বল ছিল এবং আমেরিকানদের পক্ষে প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় সিনেমাতে ঢুকে পড়ার রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর তারা জার্মান ফিল্মের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। অর্ধেক হলিউড ভরে ফেলেছিল জার্মানরা; ইউনিভার্সাল  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কার্ল ল্যামেল। নরম্যান্ডির সৈকত ছিল দ্বিতীয় আক্রমণ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছিল ইউরোপকে নিশ্চিতভাবে দখল করার উপায় । আর  এখন,  তুমি রাজনীতিতে দেখতে পাও যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নির্দেশ না দিলে ইউরোপ স্বেচ্ছায় কিছু করতে অক্ষম। এখন ফিল্মগুলোতে আমেরিকা পুরো পৃথিবীর দখল নিয়েছে। সুতরাং  যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ধারণা ছিল তা লোপাট হয়ে গেল  । আমি আমার পরবর্তী “সিনেমার ইতিহাসগুলো” [Histiore (s) cinema]তে - এক বিশেষ সময়ের, কনসেনট্রেশান শিবিরের সত্যতা  দেখাবো, যা এখনও ফিল্মে প্রদর্শিত হয়নি ।  সিনেমায় , এর জবাব দেওয়া হয়নি।

    গ্যাভিন : এই প্রসঙ্গে ‘শিন্ডলার্স  লিস্ট’ ফিল্মটা আপনার কাছে কী বোঝায়?

    গোদার : ফিল্মটার কোনোই মানে হয় না। কিছুই দেখানো হয়নি, এমনকি সেই আগ্রহসঞ্চারী জার্মান শিন্ডলার-এর গল্পও নয় ফিল্মটা।আসল গল্পটা বলা হয়নি। ওটা একটি মেলানো-মেশানো ককটেল।

    গ্যাভিন : আপনি কি মনে করেন যে ইতালীয় নিওরিয়ালিজম এবং ফরাসী নিউ ওয়েভ যুদ্ধের পরের পুনরুদ্ধারের প্রতিনিধিত্ব করেছিল?

    গোদার : না, তারা ছিল সর্বশেষ বিদ্রোহ। আমরা যেটাকে আভাঁ গার্দ বলি তা আসলে ‘আরিয়ের গার্দ’ [রিয়ার গার্ড] ছিল।

    গ্যাভিন : আপনি কি বলছেন যে ফ্রান্সের ষাটের দশকে আপনাদের সিনেমা আমেরিকান আধিপত্যের অধীন ছিল?

    গোদার : আমরা তা ভাবিনি, কারণ একই সময়ে আমরা বেশিরভাগ নিজেরা তর্ক  করেছি কোনো এক ধরণের আমেরিকান সিনেমার পক্ষ নিয়ে ।  আমরা উইলিয়াম ওয়াইলার বা জর্জ স্টিভেন্সের চেয়ে স্যামুয়েল ফুলার বা বাড বোয়েটিচারকে পছন্দ করেছি। আমাদের ইচ্ছে, অন্তত রিভেতে আর আমার ইচ্ছে ছিল যে , একটা বড় সেটে  সংগীতচিত্র তৈরি করতে আমরা সক্ষম হব। সেটা এখনও একটা আশা! আমরা বলেছিলুম যে হিচকক হলেন একজন দুর্দান্ত চিত্রশিল্পী, দুর্দান্ত ঔপন্যাসিক, কেবল মাত্র খুনের গল্পের পরিচালকই নন, তাই ব্যাপারটা আরও গণতান্ত্রিক ছিল। তবে তা ইউটোপিয়ান ছিল, কারণ সত্যিকার অর্থে কী ঘটে চলছে তা বুঝতে পারার পক্ষে আমরা বয়সে খুব ছোট ছিলাম। আমি আজ এই কথা বলছি কারণ  সম্ভবত আমিই একমাত্র এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গী দেখাচ্ছি। আমি ইতিহাস পড়ার জন্য আমার চোখ এবং কান ব্যবহার করছি। শব্দ পড়ার জন্য অন্য লোকেরা তাদের চোখ ব্যবহার করে।

    গ্যাভিন : কিন্তু আমেরিকান সিনেমার কয়েকটি বিষয়কে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আপনি কি তাহলে  তখন শত্রুদের ডেকে আনছিলেন ?

    গোদার : একেবারেই না. আমরা হিচককের পক্ষে ছিলুম, তবে আমরা শর্লি ক্লার্ক বা জন ক্যাসাভেস বা এড এমশওইলারের পক্ষেও ছিলুম। আমি  সম্প্রতি যখন পড়েছিলুম যে একজন আমেরিকান সমালোচক লিখেছেন যে “হায় আমার জন্য” ( Hélas pour moi )  স্ট্যান ব্রাখাজের ছবির মতো লাগছিল, তখন আমি খুব খুশি হয়েছিলুম। কাইয়ে দ্যু সিনেমায় যোগদানের অনেক আগে থেকে গ্রেগরি মার্কোপৌলোসের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। পরে  তাঁর ছবিগুলো আমার ভাল লাগেনি,  তবে ওনাকে  আর অন্যান্য লোকদের  যারা অকপট সিনেমার পক্ষে ছিলেন তাঁদের আমার মনে আছে। তা ছিল গণতন্ত্র। আমরা বুঝতে পারি নি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র আর রাশিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের  মধ্যে তফাত নেই।

    গ্যাভিন : ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire (s) du cinema]র দ্বিতীয় কিস্তিতে আপনি বলেছেন, "প্রযুক্তি জীবন থেকে প্রাণ এবং পরিচয় পুনরুৎপাদন ও নিকাশ করতে চেয়েছিল।" তার মানে কী ?

    গোদার: আমাদের এই সত্যটি বিশ্লেষণ করা উচিত যে, যখন ফটোগ্রাফি আবিষ্কার হয়েছিল, তা প্রথম থেকেই রঙিন হতে পারতো, তা সম্ভব ছিল। তবে  এটি দীর্ঘকাল ধরে কালো এবং সাদা হওয়ার কারণ, তা আকস্মিকতাজনিত নয়। তাতে নৈতিক দিক থাকতে পারে, কেননা ইউরোপীয় ও পশ্চিমাবিশ্বের  শোকের রঙ হলো কালো। সুতরাং আমরা  প্রকৃতি থেকে তার পরিচয়টি নিচ্ছিলুম এবং একটি নির্দিষ্ট উপায়ে তাকে হত্যা করছিলুম—

    গ্যাভিন : সাদা-কালোয় তার ফোটো তুলে ?

    গোদার : কেবল ফটোগ্রাফির মাধ্যমে, ভান করছিলুম যে পাসপোর্টে থাকা ছবিটা সেই ব্যক্তির পরিচয় — তা কেবল তার ফোটো , পরিচয় নয়। এবং তারপরে এটা  পেইনটিঙের  ক্ষেত্রে একটা বড় পরিবর্তন আনে : আরও বিশদ করে আঁকা আরম্ভ হয় , তথাকথিত বাস্তবতার আরও বাস্তব চিত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমরা প্রকৃতির পরিচয়কে টেনে বের করে নিচ্ছিলুম, আর যেহেতু  সংস্কৃতিতে কিছুটা নৈতিকতা ছিল, তাই  সাদা-কালো রঙে করা হয়েছিল, শোকের রঙে ।  আমি আরও যোগ করতে চাইব  যে, প্রথম টেকনিকালার এবং টেকনিকালার  আজও, কম-বেশি আসল ফুলের মতন নয়, বরং তা শবযাত্রার  ফুল।

    গ্যাভিন : ১৯৭৯ সালে আপনার সিনেমায় ফিরে আসার পর থেকে সিনেমাটিক সৌন্দর্যের ওপর নতুন করে জোর দিয়েছেন । দেখে মনে হয় আপনি ব্যাপারটাকে ফিল্মে রহস্যের ধারণার সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছেন।

    গোদার : হ্যাঁ. বেশিরভাগ সময় কোনও রহস্য থাকে না, আর কোনও সৌন্দর্য থাকে না — কেবল মেকআপ থাকে । ‘শিণ্ডলার্স লিস্ট’ বাস্তবতা গড়ে তোলার একটা ভাল উদাহরণ। তা হল ম্যাক্স ফ্যাক্টর। তার রঙের স্টক বর্ণনা করা হয়েছে কালো এবং সাদায়, কারণ ল্যাবগুলোর আসল কালোরঙ এবং সাদা করে তোলার মতন সামর্থ আর নেই। স্পিলবার্গ ভেবেছেন রঙের চেয়ে কালো এবং সাদা বেশি সিরিয়াস দেখায় ।  আপনি আজও কালো এবং সাদা ফিল্ম নিঃসন্দেহে করতে পারেন, কিন্তু তা কঠিন, তাছাড়া কালো এবং সাদা ফিল্ম করার খরচ রঙিনের চেয়ে  বেশি। সুতরাং তিনি  সিস্টেমের প্রতি বিশ্বস্ত  — এটা একটা ফালতু চিন্তা। ওনার কাছে ব্যাপারটা কৌতুকপূর্ণ নয়, আমি মনে করি তিনি নিজের প্রতি সৎ, তবে তিনি খুব বুদ্ধিমান নন, যার দরুন ফল হয়েছে ফালতু । যেন আমি একটি তথ্যচিত্র দেখছি, যা ভাল নয়, তবে শিন্ডলার লোকটা সম্পর্কে  আপনি আসল তথ্য জানতে পারছেন। স্পিলবার্গ  সেই মানুষটাকে আর এই গল্পকে এবং সমস্ত ইহুদি ট্র্যাজেডিকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যেন তা এক বিশাল অর্কেস্ট্রা, এক সহজ গল্প থেকে একটা স্টেরিওফোনিক আওয়াজ তৈরি করেছেন।

    গ্যাভিন : মানে, উনি ঐতিহাসিক তথ্য দেননি--

    গোদার : উনি সক্ষম নন। হলিউড সক্ষম নয়। আসলে, ব্যাপার হল, আমি যে ছবিটি করতে চাই,  তা করতে আমি সক্ষম নই। আমি তার জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারি এবং এর অংশ তৈরি করতে পারি, দুই তৃতীয়াংশ বা কখনও কখনও নয়-দশ অংশ। স্পিলবার্গ একজন নিয়মনিষ্ঠ পরিচালকের মতন ‘শিণ্ডলার্স লিস্ট’ করতে সক্ষম নন ।  প্রতিভাবান  নন, বরং যেমন উইলিয়াম ওয়াইলারের মতো পরিচালক, যিনি  যুদ্ধের ঠিক পরে, ‘আমাদের জীবনের সেরা বছরগুলি’ ফিল্মটি  তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন । আজ আপনি যখন ফিল্মটা  দেখবেন, আপনি এই বিষয়টি দেখে অবাক হবেন যে হলিউডে কিছু সৎ লোক এবং ভাল কারিগর কারও-কারও কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন।  ওয়াইলারের ফিল্মের চেয়ে সামগ্রিকভাবে সিনেমার সম্ভাবনা অনেক বেশি,  তিনি  সম্ভাবনার শতভাগ অবদান দিয়েছিলেন। আজ, এটি লোপাট হয়ে গেছে। যদি কোনও একশো গজের দৌড় হয়, উইলিয়াম বারো সেকেন্ডের মধ্যে তা সম্পূর্ণ করবেন; স্পিলবার্গ দৌড়োতে দুই মিনিট সময় নেবেন।

    গ্যাভিন : ‘হায় আমার জন্য’( Helas pour moi )-এর একটি প্রধান বিষয় হ'ল যে ন্যারেটিভগুলো সভ্যতার মঙ্গলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হলেও,  সত্য ও সত্যকে নথিবদ্ধ করা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে এটি অপ্রতুল ।

    গোদার : ‘হায় আমার জন্য’-তে সেই জিনিসটি মিস করেছি, তবে আমি যেহেতু স্পিলবার্গের চেয়ে কিছুটা ভাল, আমার ছবি আরও ভাল হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে  ততটা সফল হয়নি। আমি পয়েন্টটা  মিস করে গিয়েছিলুম। ছবিটি শুরু হওয়ার আগে যা ছিল তা থেকে একেবারে আলাদা হয়ে হাজির হল।

    গ্যাভিন : সাক্ষীদের সাক্ষাৎকার দিয়ে ন্যারেটিভের পুনর্গঠন যিনি করছেন তাঁর সঙ্গে তদন্তকারী / বর্ণনাকারীর ভূমিকা আমাকে ওয়েলস-এর আরকাদিন-এর ( Mr. Arkadin ) কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

    গোদার : হ্যাঁ, আমি, ‘মিঃ আরকাদিন’ আমার মনে আছে, আর  আমি সেকথা ভেবেছিলুম। তদন্তকারী চরিত্রটা  সম্পাদনা অর্ধেক করে ফেলার পরে যোগ করা হয়েছিল, কেননা তা নাহলে ফিল্মটা একসঙ্গে বেঁধে রাখা যেতো না । এটা একটা ভাল চলচ্চিত্র তবে তা হতে পারতো আরও.…।  ফিল্মটার উদ্দেশ্য তা ছিল না। ‘মিঃ আরকাদিন’ ফিল্মে সেই উদ্দেশ্য ছিল। এ কারণেই আমি বলছি এটা একটা আরও ভাল ছবি, কারণ অরসন ওয়েলস, যদিও তাঁর কাজ করার পদ্ধতি সেই সময়ে ছিল আশি শতাংশ , শেষ পর্যন্ত তা ছিল ফিল্মের অংশ ।

    গ্যাভিন : ‘জেএলজি দ্বারা জেএলজি’র কথা বলা যাক ।

    গোদার : সঠিক টাইটেল হল ‘জেএলজি / জেএলজি’। কোনও ‘দ্বারা’ নেই । আমি জানি না কেন গৌমঁ শব্দটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যদি সেখানে একটি "দ্বারা" থাকে তবে এর অর্থ হবে এটা জেএলজি সম্পর্কে একটা গবেষণা, আমার নিজের সম্পর্কে নিজের দ্বারা  যেন একধরনের জীবনী, যাকে ফরাসী ভাষায় বলা হয় ‘বিবেকের পরীক্ষা’ ( un examen de conscience );  যা ফিল্মটা একেবারেই নয়। এজন্য আমি বলি ‘জেএলজি / জেএলজি আত্ম-পোর্ট্রেট’।  নিজের প্রতিকৃতিতে কোনও "আমি" থাকে না । তার মর্মার্থ  কেবল পেইনটিঙে থাকে, অন্য কোথাও নয় ।  শুধু পেইনটিঙে নয়, চলচ্চিত্রেও তা  থাকতে পারে কিনা তা জানতে আমি আগ্রহী ছিলুম।

    গ্যাভিন : ফিল্মটি আপনাকে বেশিরভাগ সময় নিঃসঙ্গ হিসাবে তুলে ধরে -- এটি কি আপনার জীবনের প্রতিচ্ছবি নাকি স্ব-প্রতিকৃতি ঘরানার  ফিল্ম ?

    গোদার : আমি খুবই নিঃসঙ্গ, এটাই — আমি তা বাতিল করতে পারি না। অন্তরজগতে, আমি প্রচুর মানুষ এবং জিনিসপত্রের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছি, যাঁরা একেবারেই জানেন না যে আমি তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে চলেছি। তবে বাইরে, হ্যাঁ, এটা আমার চরিত্র এবং এটাই আমার জীবনের সত্য, যা মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে  অত্যন্ত একাকী । মাঝে মাঝে আমি সেই মানুষদের বুঝতে পারি যাঁরা ওয়াল্ডেনের বা থোরোর মতো জীবন কাটিয়েছেন। তবে এটাও হতে পারে যে আমি যখন ছোট ছিলুম তখন আমি  এক বিশাল ধনী পরিবারের সদস্য  ছিলুম, অনেক খুড়তুতো ভাই আর কাকারা ছিলেন। আমার যৌবনে  অনেক কিছুই ছিল যে আজকে আমি মনে করি এটা একরকম ন্যায়বিচার যে আজকে  আমার কাছে সমস্তকিছু কম।

    গ্যাভিন : আপনি কী ‘জেএলজি / জেএলজি’ ফিল্মকে মৃত্যুচিন্তা হিসাবে দেখছেন? মৃত্যুর অনেক কথা আছে।

    গোদার: মৃত্যুর? না, একদম না ।  অন্য যে কোনও সময়ে হলেও ফিল্মটা খুব আলাদা হত না। তোমার যদি একটা ফাঁকা ঘর থাকে, তাহলে  আমি এই কথা ভেবে অপরাধবোধ এবং বেদনা উভয়ই অনুভব করতে পারি না, যে দেয়ালগুলো ফাঁকা, আমার পরিবার নেই, কিংবা কোনও পারিবারিক ফোটো দেয়ালে ঝোলানো, কেননা আমার পরিবার নেই, মাত্র একজন বা দুইজন বন্ধু আছে । কিন্তু ফিল্মটায় যদি অন্য লোকেদের রাখতুম তাহলে সেটা আত্মজীবনীমূলক হয়ে উঠতো আর তারপরে তা অন্যরকম কিছু হয়ে যেতো,  আর স্ব-প্রতিকৃতি থাকতো না। একটা স্ব-প্রতিকৃতি মূলত আয়নাতে বা ক্যামেরায় কেবল একটি মুখ। নয়তো তা হাস্যকর, কারণ তখন তুমি  একটা শিশুকে অভিনয়ের জন্য নিতে, তোমার শৈশব দেখাবার জন্য আর...এটা হাস্যকর । অমন করা যায় না।

    গ্যাভিন : " মৃত্যুর পথে জীবন একটি বাধা, এবং এই ফিল্মটি আমার অন্তিম বিচার নির্ধারণ করবে" - এটি কি মৃত্যুর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি নয়?

    গোদার : হ্যাঁ…. না, কারণ যখন আমি আমার এই ছোট ছবিটি [চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী চিত্র] আবিষ্কার করলুম, তখন আমি ভাবছিলুম যে কেন আমি ছয় বছর বয়সেই এতো মনমরা দেখাচ্ছি। তা এইজন্য নয় যে  আমার মা আমাকে চড় মেরেছিলেন; আমি মনে করি তাতে গভীরতর কিছু ছিল। তাই সেই সময়েই আমি পৃথিবী সম্পর্কে  খুশি ছিলুম না!
    গ্যাভিন : আপনার বলা চূড়ান্ত কথা হ'ল: “আমি বেঁচে থাকব। আমাকে ভালবাসার মাধ্যমে আত্মত্যাগ করতে হবে যাতে পৃথিবীতে প্রেম থাকে। ” ওগুলো কি আপনার নিজস্ব কথা না উদ্ধৃতি ?

    গোদার : আমার মনে হয় ওটা একটৱা উদ্ধৃতি, তবে এখন আমার কাছে উদ্ধৃতি আর আমার কথা প্রায় একইরকম। আমি জানি না তা কার কাছ থেকে এসেছে; কখনও কখনও আমি তা  না জেনে ব্যবহার করছি।

    গ্যাভিন :  উদ্ধৃতিটির  পুনরাবৃত্তি করে, এক অর্থে আপনি তা নিজেই বলছেন।

    গোদার : এর সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার কোনও কিছু করার আছে,  তবে তা ঠিক কী বলতে পারব না। ব্যাপারটা রঙের মতন, তবে শব্দ দিয়ে তৈরি।

    গ্যাভিন : আমার কাছে, ‘জেএলজি / জেএলজি’ যাত্রা করে শীতকাল, নির্জনতা এবং ঘেরাটোপ থেকে বসন্তঋতু, খোলামেলা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার পুনর্নবীভূত বোধের দিকে ।

    গোদার : হ্যাঁ ।

    গ্যাভিন : শেষ শটগুলির মধ্যে একটা হ'ল বসন্তকালের অবিশ্বাস্য সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। এটা জীবনের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি  বলে মনে হয়।

    গোদার : হ্যাঁ। আমি মনে করি বিশ্বের একখানা রূপক তৈরি করা ভাল ছিল, আর তারপরে ছায়া নেমে আসে । তবে  তার মানে দুঃখজনক  নয় -- তা হল কেবল দিনশেষের কথা ।

    গ্যাভিন : ফিল্মের শুরুতে আপনি বলেছেন, "যে জায়গাগুলোয় দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে তাতে শৈশবের প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যগুলো কারও অন্তরজগতে নেই ।” প্রতিটি প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যে কি  একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত অনুরণন আছে?

    গোদার: না, আমি নিজে ওটার শুটিঙ করিনি; একজন ফটোগ্রাফার গিয়ে ওগুলো শুটিঙ করে এনেছিল, আর আমি সেগুলো থেকে বেছে নিয়েছিলুম । উনি ছিলেন জেনেভার ফটোগ্রাফার, ইভস পলিকুয়েন, যিনি প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যের শুটিঙ করতে  ভালোবাসেন। বেশিরভাগ ফটোগ্রাফার প্রাকৃতিক-ভূদৃশ্যের শুটিঙ করতে পছন্দ করেন না, তাঁরা আলোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান না [অর্থাৎ — obéir] । ব্যাপারটা আলোকসজ্জার পক্ষে ভাল নয়, তবে উনি তথ্যচিত্র নির্মাণকারী মানুষ  হিসাবে একা যেতে  পছন্দ করেন।  তিনি কেবল মেঘের ছায়ার ছবি নেওয়ার জন্য তিন ঘন্টা ব্যয় করতে দ্বিধা করেন না, এবং তার ফলে প্রাকৃতিক দৃশ্যটি  প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

    গ্যাভিন : তা কি আপনি নিজেই করতে চাইতেন না?

    গোদার : হ্যাঁ, তবে তখন আমি খুব দুর্বল ছিলুম। যাইহোক, আমি সেই জায়গাগুলো খুব ভাল করে জানি, কারণ তা আমার আসপাশের, কারণ এই বিশেষ ফিল্মটার জন্য আমি খুব বেশি দ্বিধা বোধ করছিলুম — এটা করব নাকি ওটা ? যেহেতু উনি নতুন ছিলেন এবং অনেকগুলো শট তুলে আনার আদেশ দেওয়া হয়েছিল, সেটা বেশ ভালভাবে কাজে দিয়েছিল। আমার এমন অনুভূতি ছিল যে আমি ফিল্মটা একা তৈরি করছিলুম না, বেশ কয়েকজন লোক ছিলেন, শুধু আমি একা নই, তথাকথিত প্রতিভাবান বা নৈরাজ্যবাদী ।

    গ্যাভিন : ‘জেএলজি / জেএলজি’-তে একটি ভিজ্যুয়াল মোটিফ হ'ল স্কুলর এক্সারসাইজ খাতাগুলো: প্রথমে আপনি তাতে শিরোনাম লেখেন, তারপরে বাচ্চাদের নামগুলি লেখেন  যাদের খাতার পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা , তারপরে সবশেষে আপনার নিজের বইতে ফিরে যান, যাতে তখনও খালি পৃষ্ঠা ছিল । এই ফাঁকা পৃষ্ঠাগুলো ভবিষ্যতের আরেকখানা ছবির মতন মনে হয়, যে ইতিহাস এখনও লেখা বাকি ।

    গোদার : হ্যাঁ ।

    গ্যাভিন : তার মানে এই ফিল্মটা ফেয়ারওয়েল বা এপিটাফ নয়, যা কারও কারও  মনে হয়েছে । আপনি কি বলতে চাইছেন যে আপনার ভবিষ্যত একজন শিশুর  সম্ভাবনা বা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে একইরকম ?

    গোদার : আমার তেমন অনুভূতি আছে, হ্যাঁ । হতে পারে  যখন তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, একরকম ভাবে তুমি নিজেকে আরও কমবয়সী বোধ করবে অথচ বুড়ো হয়ে গেছ — অল্প বয়স্ক বার্ধক্য, যদি সেকথা বলা যায়, যা খুবই... সান্ত্বনাময়।

    গ্যাভিন : শিশুদের সঙ্গে আইডেনটিফাই করার জন্য ?

    গোদার:  হ্যাঁ, তবে তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ সেই  সত্যকে এড়িয়ে নয় । তোমার কাছে এখনও আবিষ্কারের জন্য সমস্ত কিছু পড়ে রয়েছে। সাধারণত তাদের দ্বিতীয় ফিল্মের ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র নির্মাতারা বলেন, "আমি কী করতে পারি? আমি সবই করে ফেলেছি।” এখন আমি বলি, "আমি কিছুই করিনি,  আরও অনেককিছু করতে হবে।" কিন্তু আমি তা করার সময় পাবো কী না তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন নই। আমি জানি যে প্রচুর ব্যাপার করার থাকলেও আমি আগে ভাবিনি যে ফিল্মে তা করা সম্ভব হতে পারে --- যা-কিছু মোশন পিকচারে  ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ফলে ঘটছে — পুরানো বইয়ের শেলফের একটা শট  অনেক কথা বলতে পারে।

    গ্যাভিন : শেষ অবধি, আপনি নিজের বাড়ি না ছেড়ে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেন।

    গোদার : তেমনটাই তো কমবেশি করেছি ।.

    গ্যাভিন : ‘জেএলজি / জেএলজি’-র উদ্বোধনী শট চলাকালীন, ক্যামেরা যখন  আপনার অল্পবয়সী ছবিতে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্যামেরার আর  ক্যামেরাম্যানের ছায়া বেশ স্পষ্ট দেখা যায় ।

    গোদার : কেবল একবারের জন্য, আমি দর্শকদের কথা মনে রেখে করেছিলাম --বেশ সংক্ষিপ্ত, যাতে  বুঝতে পারা যায় যে এটি "আমি এবং আমি"। চিত্রশিল্পীদের স্ব-প্রতিকৃতিগুলির সাথে যেমন ঘটে, প্যালেট এবং পেইন্টব্রাশ হাতে ছবি আঁকছেন । 

    গ্যাভিন : ভিডিও ক্যামেরায় পেছন থেকে জানালার বাইরের বেশ কয়েকটি শট নেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ ইমেজের  চেয়ে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে পাওয়া শটটিতে ফোকাস কেন?

    গোদার : মানে, দর্শকদের ফোকাস করার কথা ভাবানোর জন্য, ফোকাসের ধারণা দেবার খাতিরে। সাহিত্য, চিত্রকলা বা সংগীতে  ফোকাস করার কোনও ধারণা নেই; ফিল্ম তার বিষয়বস্তুতে ফোকাস করে।

    গ্যাভিন : একইভাবে, “হায় আমার জন্য” ( Helas pour moi)তে,  রাশেলের (লরাঁ মাসলিয়াহ) একটি অসাধারণ শট রয়েছে মিডিয়াম লঙ শটে নেয়া, বেশ আউট অফ ফোকাস; মেয়েটি ক্যামেরার দিকে এগিয়ে যান এবং ক্লোজ-আপ হলে ফোকাসে আসেন ।

    গোদার : হ্যাঁ, আমি অমনটা পছন্দ করি । ‘সিনেমার ইওতিহাসগুলো’[Histoire ( s ) du cinema]র ছবিগুলোতে ‘বিউটি অ্যাণ্ড দ্য বিস্ট’ [ La Belle et la bete]এর শট আছে, যখন জোসেটি ডে দীর্ঘ করিডোর ধরে হেঁটে আসেন ; ককতো কোনও ট্র্যাকিং শট তৈরি করেননি, তিনি তাকে একটি ছোট্ট ডলিতে রেখে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। বাস্তবে এটি একই ব্যাপার, তবে অর্থ একই নয়। “হায় আমার জন্য” [Helas pour moi]-এর শটে তুমি মর্মার্থ খুঁজে পাচ্ছ: মেয়েটি ফোকাসে আসছে। ব্যাপারটা এমন, কেউ যেন জলের তলদেশ থেকে ওপরে পৃষ্ঠতলে ভেসে উঠছে,  কারণ সর্বোপরি, পর্দা হল একটা পৃষ্ঠতল । আমাকে দর্শকদের চিন্তা করতে প্ররোচিত করতে হবে। এটি সংগীতের মতো - যা  নির্দিষ্ট নয় ; এমন বা অমন বোঝানোর ভান করা নয়। আমেরিকান লোকেরা বলতে পছন্দ করে, "
    আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন?" আমি উত্তর দেব: "আমি বলতে চাইছি বটে তবে ‘ঠিক’ তা নয়।" [ গোদার হাসেন]

    গ্যাভিন :  “হায় আমার জন্য”[Helas pour moi ]তে  একটা স্তরে আপনি সিনেমার প্রযুক্তিগত শব্দভাঁড়ার অন্বেষণ করছেন বলে মনে হয়েছিল: ফোকাস, এক্সপোজার, ক্যামেরা মুভমেন্ট, মন্তাজ এমনকি একটা জুম আউট এবং ইন, যা আমি মনে করি আপনি প্রায় কখনও করেন না--

    গোদার : না । খুবই কম ।

    গ্যাভিন : প্রথম থেকেই  কি তেমন অভিপ্রায়  ছিল?

    গোদার : না, শুটিংয়ের সময় সেটা ছিল। কারণ ফিল্মটা আমার আয়ত্ব থেকে পালাচ্ছিল, সম্ভবত আমি কিছু কিছু করার চেষ্টা করলুম যেগুলো আমি করতে সক্ষম নই তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাচ্ছিল।  বাক্যটির থেকে ব্যকরণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বা ব্যাকরণ হয়ে যাচ্ছিল বাক্যগুলোর [un souvenir] একটা স্মৃতি । বাক্য তৈরি করা হয়নি, ব্যাকরণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এটা গাণিতিক উপপাদ্যের মতো যা বিজ্ঞানীদের কাছে একেবারেই সাফল্য পায় না, কারণ উপপাদ্যের যোগ, বিয়োগ, সমান চিহ্ণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

    গ্যাভিন : কিন্তু মাধ্যমটার ব্যাকরণের  শুদ্ধ নিশ্চয়তা দেখার বিষয়ে উত্তেজক কিছু আছে নিশ্চয়ই, তা কেবলমাত্র  জ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও।

    গোদার : হ্যাঁ, এটাই সিনেমার শুরু। এই ক্ষমতাটাকে আরও একবার সম্মান জানাতে পর্যাপ্ত পরিমিত হয়ে আমরা সময়ে সময়ে তা করতে পারি। তুমি যদি তা গণিতের ক্ষেত্রে করো, তবে এর কোনও অর্থ পাওয়া যাবে না । তুমি এটা সাহিত্যে করতে পারবে না, কারণ বাক্য এবং ব্যাকরণটি এতটা নিবিড়ভাবে সংযুক্ত , তুমি তাদের কেটে আলাদা করতে পারবে না। তবে সিনেমায় তুমি তা পারবে। আর কিছু না করে তুমি যদি কেবল কোনও ট্র্যাকিং শট বা ভূপ্রকৃতির দৃশ্য তোলো...। এই কারণেই আমি কিছু আনডারগ্রাউণ্ড আমেরিকান ফিল্ম পছন্দ করি, উদাহরণস্বরূপ মাইকেল স্নোর দুর্দান্ত ফিল্ম, ‘লা রিজিওন সেন্ত্রালে’, যা কেবল একটি দীর্ঘ প্যান। তা হল একটা ছবি, একেবারে খাঁটি সিনেমা।

    গ্যাভিন : কিন্তু “হায় আমার জন্য” [Helas pour moi]তে  ব্যকরণগত অনুশীলনগুলো মনে হয় “ন্যারেটিভের” সঙ্গে সমন্বিত ।

    গোদার : আমি ভেবেছিলুম আমার হাতে একটা ভাল চিত্রনাট্য আছে,  কিন্তু তাড়াতাড়ি শুট করা  হয়ে গিয়েছিল । প্রথম খসড়াটা আমি প্রায় ১০০-১২০ পাতা লিখেছিলুম, আর আমাদের তিন সপ্তাহ পরে শুটিং করতে হয়েছিল। তাই আমি প্রযোজক এবং তারকাকে বলেছিলুম, "এটা সম্ভব নয়, আমাদের আরও তিন মাস বা সম্ভবত আরও তিন বছর সময় দরকার । তোমরা রাজি আছো?"  কেউ রাজি ছিল না, তাই আমি ফিল্মটা করলুম, কারণ সর্বোপরি একটা ফিল্ম মানে তো একটা ফিল্ম, ব্যাপারটা জীবনের মতন। আমরা প্রতিদিন যখন খেতে পারি, তখন খাই। তাছাড়া আমাকে কয়েকটা নির্দিষ্ট ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়, তাই সম্ভবত অবচেতনায় আমি সেই ব্যাকরণগত সিনেমাটিক প্রতিমাগুলোকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছি।

    গ্যাভিন : “সিনেমার ইতিহাসগুলো” [Histoirte ( s ) du cinema] দেখার আগে আমি কখনও ভাবিনি যে ভিডিওর ছবি অতো সুন্দর আর প্রলোভনসঙ্কুল হতে পারে । আপনি মনে হয় সম্ভাবনাকে আয়ত্ব করার উপায় আবিষ্কার করে ফেলেছেন ।

    গোদার : আমি সোনি কোম্পানির চালু যন্ত্র ব্যবহার করি [ হাসেন ] -- আমি ওটা ব্যবহার করছি আর আশা করি comme un aspirateur ( নতুন ভ্যাক্যুয়াম ক্লিনারের মতন ) জিনিসটা ভালো । আমি দেখতে ভালো আর পরিচ্ছন্ন জিনিস পছন্দ করি ; সাইকেল হোক কিংবা মোটরগাড়ি, দেখতে ভালো হওয়া চাই । টেলিভিশন ভালো করে তৈরি হয় না কিন্তু তুমি টেলিভিশনে দারুন সুন্দর প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারো -- জিনিসটা যেমনকার তেমনই, নিজের কাজ যতোটা পারে ভালোভাবে করে । কিন্তু আমি মনে করি যে তা এমন প্রতিচ্ছবি যেন কোনো পেইনটারের আঁকা স্কেচ, যা অসাধারণ পেইনটিঙের মতনই ভালো দেখতে লাগবে ।

    গ্যাভিন : আপনার আগের ভিডিওর কাজগুলো ততো পেইনটারসুলভ ছিল না । “সিনেমার ইতিহাসগুলো” [Histoire ( s ) du cinema] যেন বয়নবিন্যাসের ব্যাপারে পেইনটিঙে ।

    গোদার : সেটা ঠিক ।এটা চিত্রাঙ্কনের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত আর এটা খাঁটি চিত্রাঙ্কন, কিন্তু সিনেমাটিক পেইন্টিং---এটা সিনেমার একটা দিক , যা বেশিরভাগ লোক বাতিল করে দিয়েছে। আর শুধু বিজ্ঞাপনই নয়। বিজ্ঞাপনগুলোও পেইন্টিঙ করে, বা সেই পোলিশ ভিডিও নির্মাতা রাইবজাইন্স্কি — সেগুলো কেবল বিজ্ঞাপন, তার কোনও মানে হয় না, স্রেফ সাজসজ্জা। আমি মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনগুলোকে পছন্দ করি,  কারণ ওই এক মিনিটের মধ্যে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়, আর তারা এমন জিনিস তৈরি করে যা মোশন পিকচারে অসম্ভব,  কারণ ব্যাপারটা খুব ব্যয়বহুল হবে। তবে এগুলো বিক্রি করার জন্য তাদের মর্মার্থ এবং সেগুলোর বোধবুদ্ধি এবং তাদের লক্ষ্য, এটা বিক্রি সেটা বিক্রি --- তা মোটেও ভালো নয় ।  ৩০ সেকেন্ডে এক মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা ভাল নয় ... আমি জানি না, একটি জেনারেল মোটরসের গাড়িও তো মিলিয়ন  ডলার দাম নয়। তবে আমি  মানি : এটি চিত্রাঙ্কন এবং উপন্যাস। আমার কাছে সিনেমা কেবল আমার লক্ষ্য, তবে তা সম্ভব নয়, কারণ সিনেমা পেইনটিঙ নয় ।  আমার কাছে সিনেমা হ'ল [ একটি পেইনটিঙের পত্রিকায় ভূদৃশ্যের বেশ কয়েকটি চিত্রের একটি  চিত্রকর্মের দিকে নির্দেশ করে ] তবে আমি সেই লোকগুলোর সঙ্গে [ যাদের আঁকা]  কথা বলতে ভালোবাসি, আর তারপরে আছে নাটক  — তবে সেইরকম পেইন্ট-করা নাটক। কোনও উপন্যাসের মতো নয়। আমি প্রায়শই পেইনটিঙগুলোর দিকে তাকাই আর নিজেকেই বলি, ও কী বলছে? এই লোকগুলো --- তারা কী ভাবছে? আমার মনে আছে আমার প্রথম নিবন্ধটা, একটি প্রিমিনজার ছবি এবং ইমপ্রেশনিস্ট পেইন্টিংয়ের মধ্যে  তুলনা ছিল। হয়তো তা সম্ভব নয়, তবে আমার কাছে এটা সম্ভব বলে মনে হয় — ফিল্মটা তো আমার। সেই জন্যই তা  পেইনটিঙের কাছাকাছি এবং আরও কাছাকাছি চলে আসছি। এখন যদি আমি  ফিল্মে [আর্ট ম্যাগাজিনে পেইন্টিং] রাখি, তাহলে আগের প্রতিচ্ছবি কী হওয়া উচিত এবং এর পরের প্রতিচ্ছবি কী হওয়া উচিত? চিত্রকলাতে আমি যা পছন্দ করি, তা হ'ল এটি কিছুটা ফোকাসের বাইরে হয় আর তুমি তার পরোয়া করো না। সিনেমায় তুমি আউট অফ ফোকাস থাকতে পারবে না, তবে তুমি যদি সংলাপ যোগ করো, যদি তুমি ফিল্মে তা দেখাও,   বাস্তবতার দিকে ওই ভাবে চেয়ে দেখা, তবে তোমার ফোকাস-করা সিনেমাটোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি এবং শব্দের মধ্যে এমন একটা জমি রয়ে যায় যা আউট অফ ফোকাস , আর এই আউট অফ ফোকাস হল আসল সিনেমা।

    গ্যাভিন : ‘সিনেমার ইতিহাসগুলোর’ ভিজ্যুয়াল টেক্সচারগুলি প্রায়শই এমনভাবে স্তরান্বয়ন করা হয়েছে যে প্রায়ই কিছু জায়গায় যেন একটি পেইনটিঙ ইন্দ্রিয়জ আর ঐশ্বর্য্যময় হয়ে উঠেছে ।

    গোদার : হ্যাঁ, ইন্দ্রিয়জ একটি ভাল শব্দ। চিত্রকলার সংবেদনশীলতা, যা উপন্যাসগুলিতে থাকে না, তা ভাল, কারণ প্রতিটি রূপের প্রকাশের নিজস্ব আঙ্গিক থাকা উচিত যা অন্য জনারদের হাতে নেই, অন্যথায়  প্রকাশের শুধু একইরকম রূপ থাকবে। শুরু থেকেই ফিল্মগুলো প্রতিটি পরিবারের অংশ। আমার কাছে ফিল্মগুলো হ'ল শৈল্পিক পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য যার জন্ম সব শেষে হয়েছে, মানে ব্ল্যাক শিপ । কিন্তু তা একটা সাদা ভেড়া — কেননা পর্দাগুলো  তো সাদা [হাসি]। সংবেদনশীলতা এমন কিছু, যা সিনেমায় পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই, যা নীরব যুগে বেশি ছিল এবং স্বাভাবিকভাবে টকিজের সাথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    গ্যাভিন : তা সিনেমাকে বন্দি করল না ইমেজকে ?

    গোদার : হ্যাঁ, একভাবে দেখতে গেলে তাইই । আমি প্রায়ই প্রযুক্তি ব্যবহার করার  চেষ্টা করি,  যেমন ডলবির কথা ধরা যাক, আওয়াজকে ছবি থেকে আলাদা করতে, আর হঠাৎ যখন নাট্যদৃশ্যের সেটার প্রয়োজন হয়, তখন তারা আবার দুজনেই একসঙ্গে হয়ে যায় । এটা [স্পষ্ট], বিশেষত আমেরিকান সিনেমায়, তুমি ক্যামেরা নিয়ে বিশেষ কাজ করো না, এই তথ্যে নির্ভর করে যে,  তা আরও বেশি করে কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে ।  আমি সম্প্রতি The Pelican Brief দেখেছি। ওটা স্রেফ বিজ্ঞাপন। ক্যামেরা চলতে থাকে, অথচ ক্যামেরার চলাচল বা স্থিরতার সঙ্গে বা শট পরিবর্তনের সঙ্গে ভন স্ট্রোহিম বা ভন স্টার্নবার্গের   কোনও যোগসূত্র নেই। এর কোনও মর্মার্থ গড়ে ওঠে না, কেবল আমরা ফিল্ম করছি এরকম ভান করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

    গ্যাভিন : আপনি অনুভব করেন না যে এটি যৌনতার অন্য রূপ?

    গোদার : না, ওটা বেশ্যাবৃত্তি ।

    গ্যাভিন : ‘জেএলজি / জেএলজি’-র আরেকটি উদ্ধৃতি: “একটি ইমেজ গড়ে ওঠে মনের দুটি পৃথক বাস্তবকে একত্রিত করে ; বাস্তব যতো দূরে যায় আরও নিখুঁত হয়, ইমেজ ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

    গোদার : ওটা একটা পুরানো উদ্ধৃতি। ‘জেএলজি / জেএলজি’তে আমার নিজস্ব প্রায় একটি শব্দও নেই, তবে যেহেতু আমি সেগুলি পড়ছিলুম আর তা নোট কর রাখছিলুম, সেগুলো আমার হয়ে গেল।

    গ্যাভিন : Passion ফিল্মের পরিচালক সে-কথা বলেন ।

    গোদার : ওটা  ‘কিং লিয়ারে’ [King Lear] রয়েছে। এটা পিয়ের রেভেরদির একটি কবিতা,  ডাডার পরাবাস্তববাদীদের প্রথম একজন, ১৯২১ সালে জুরিখে যখন ডাডার সূত্রপাত হয়েছিল তখন থেকে । কবিতাটা আমার মতামত খুব ভালভাবে প্রকাশ করেছিল যে, কোনও ইমেজ এই জন্যে শক্তিশালী নয় কারণ আপনি একজন মৃত ব্যক্তিকে দেখছেন…। অনেকসময়ে, বলতে গেলে কম সময়েই,  কেবল একজন মৃত ব্যক্তির প্রভাব গড়ে ওঠে । ভিয়েতনাম যুদ্ধ এইজন্যে শেষ হয়ে যায়নি যে আমরা অনেক মৃত মানুষকে দেখেছিলুম ,বরং এই কারণে যে একবার  আমেরিকান জনগণ একটি আমেরিকান ছাত্রকে কেন্ট রাজ্যে খুন হতে দেখেছিল --- কেবলমাত্র একজন,হাজার নয় -- তাই ছিল যথেষ্ট । পরের দিন সকালে তারা আর সক্ষম হয় নি, [তবে] তিন বা চার বছর সময় লেগেছিল আর তারপরে হ্যানয়তে বোমা ফেলা হলো।

    গ্যাভিন : কীভাবে আপনি এই আইডিয়াকে ব্যবহার করবেন,  সম্পূর্ণ বিপরীতে দিক থেকে একটি নির্দিষ্ট ইমেজ তৈরি করবেন?

    গোদার : কিন্তু  একটি ইমেজ তো বিদ্যমান থাকে না। এটা কোনও ইমেজ  নয়, এটা একটা ছবি। ইমেজ হ'ল আমার সাথে সম্পর্কিত আর সেই দিকে তাকিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার স্বপ্ন দেখছি । ইমেজ হল একটা অনুষঙ্গ।
    গ্যাভিন : আপনার সত্যিকারের মন্তাজ সম্পর্কে ধারণাটি এখানেই ঘটে?

    গোদার : হ্যাঁ । La vrai mission, সিনেমার আসল লক্ষ্য  ছিল মন্তাজ কী তা বিশদ করা আর তা প্রয়োগ করা। কিন্তু আমরা সেখানে কখনও পৌঁছোইনি; অনেক পরিচালক বিশ্বাস করেছিলেন যে তাঁরা সেখানে পৌঁছে গেছেন, কিন্তু তাঁরা করেছিলেন অন্য কাজ । বিশেষত আইজেনস্টাইন। উনি মন্তাজের  পথে এগিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে পৌঁছোতে পারেননি। উনি তো সম্পাদক ছিলেন না, উনি কোনাকুনি ছবি তুলতেন। আর যেহেতু কোনাকুনি নেওয়ার ক্ষেত্রে উনি বেশ ভাল ছিলেন বলে, সেখানে মন্তাজের আইডিয়া ছিল। অক্টোবরের তিনটি সিংহ, একই সিংহ কিন্তু তিনটি ভিন্ন কোণ থেকে নেওয়া, তাই সিংহটিকে দেখে মনে হচ্ছে প্রাণীটা  চলমান । আসলে বিভিন্ন কোণের অনুষঙ্গের কারণেই মন্তাজ এসেছিল ।  মন্তাজ অন্য কিছু, কখনও আবিষ্কার হয়নি। টকিজ আসার ফলে তা বন্ধ হয়ে যায়; টকিজগুলো তাকে কেবল থিয়েটারের মতন ব্যবহার করেছিল ।

    গ্যাভিন : আপনি যখন এলিজাবেথ টেইলরের ইমেজকে Place in the Sun-এ উনোনের ভেতরের দেহগুলোর ওপর ‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’তে [Histoire ( s ) cinema] সুপারইমপোজ করেন ---তখন তা মন্তাজ।
    গোদার :  ওটা ঐতিহাসিক মন্তাজ। এটা একটা সমালোচনামূলক কাজ: এলিজাবেথ টেলরের হাসিখানা কেন এমন হাসি তা ব্যাখ্যা করে—

    গ্যাভিন : হলোকস্টের কারণে--

    গোদার : হলোকস্টের কারণে। এবং যেহেতু জর্জ স্টিভেনস হলোকস্টের শুটিঙ করেছিলেন, অনেক অনেক  বছর ধরে সেটা  তাঁর সেলারে লুকিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন A Place in the Sun  শুটিং করছিলেন তখন তাতে একইসঙ্গে  একধরণের হাসি এবং বিপর্যয় দেখা দেয়। এমনকি তা কোনও অসাধারণ চলচ্চিত্র না হলেও, অত্যন্ত তীব্র আর তুমি তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না। জর্জ স্টিভেন্স পরে যে  ছবিগুলো করলেন তার কোনওটিই অতো ভাল ছিল না। মিলি পার্কিন্সকে নিয়ে The Diary of Anne Frank, যা শিণ্ডলার্স লিস্ট-এর চেয়ে ভাল কিন্তু খুব ভাল ফিল্ম নয়; উনি  মিলি পার্কিন্সের হাসি সেইভাবে নিতে পারেননি  যেভাবে এলিজাবেথ টেইলর মৃদু হেসেছিলেন ।

    গ্যাভিন : পুরো ‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’ [ Histoire (s) du cinema] জুড়ে আপনি অসাধারণ সৌন্দর্য্য ও মাহাত্ম্যের ইমেজের বিপরীতে আতঙ্ক ও  নৃশংসতার ইমেজগুলো উপস্হাপন করেছেন । মনে হয়  আপনি বলতে চাইছেন যে সিনেমা এই দুটির মাঝে তৈরি হয়।

    গোদার : হ্যাঁ, অতিক্রম করার ধারণা তাতে রয়েছে। আমি যখন থামে-বাঁধা চোখবন্ধ বন্দির নিউজরিল ফুটেজ মেশাচ্ছিলুম — তুমি তো জানো তিন মিনিটের মধ্যেই তাকে গুলি করে মারা হবে  — আমি ওটাকে মিশিয়েছিলুম An American in Paris, জিন কেলি এবং লেসিলি কারন সিন নদীতে নাচের সঙ্গে। এটা অবচেতন কাজ ছিল, কিন্তু পরে আমি নিজেকে বলেছিলুম, যে, হ্যাঁ, আমার তা করার অধিকার আছে কেননা An American in Paris সম্ভবত একই সময়ে তোলা হয়েছিল।

    গ্যাভিন : ‘ইতিহাসের সিনেমাগুলো’র [ Histoire (s) du cinema] প্রথম অংশে আপনি ভিডিও প্রয়োগ করেছেন যাতে সম্পাদনার প্রভাবগুলোয় লক্ষণীয় বৈচিত্র্য অর্জন করা যায় --- দুটি শট দ্রুত পরস্পরকে কাটতে পারে, কোনো ওয়র্ড প্রসেসরে একটা বাক্য টাইপ করার ছন্দ দিয়ে কাটতে পারা যায়। আপনি ঠিক কী জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন?

    গোদার : না কেটেই ইমেজগুলোকে মেশানোর চেষ্টা করা হয়েছিল -- খুব দ্রুত আরোপন, যাতে কেবল একটা ইমেজ থাকে, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলুম যে দুটো আছে।

    গ্যাভিন : ওটা আমাকে ফিল্মে ২৪-ফ্রেম-প্রতি সেকেন্ডের প্রভাব বজায় রাখা সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি চেষ্টা করছেন --

    গোদার : বিশদে তা বলতে হলে বলব, হ্যাঁ ।

    গ্যাভিন : অত্যন্ত ধিমে তালে চলা ডিজলভগুলো সম্পর্কে কী বলবেন ?

    গোদার : সেই সমস্ত পুরোনো কৌশল  মোশন পিকচার ব্যবসার শুরু থেকেই ছিল , যা আমরা নিউ ওয়েভে ভেঙে ফেলতে সক্রিয় ছিলুম — আর এখন ভিডিও আসার ফলে ওটা ফিরে এসেছে, তবে ভালভাবে।

    গ্যাভিন : কিন্তু ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [ Histoire (s) du cinema] এর মধ্যেও সংক্রমণগত প্রভাব রয়েছে, যার কোনও সিনেমাটিক নজির নেই: যেমন ধরা যাক, যখন কোনও ইমেজ ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে আর শেষে আগের ইমেজটাকে মুছে ফ্যালে। মোশন পিকচারগুলোতে ওয়াইপস আর স্প্লিট-স্ক্রিন প্রভাব আছে, কিন্তু এরকম বিস্তারিত কিছু নেই। সেই ব্যাকরণটা অনন্যভাবে ভিডিওর।

    গোদার : হ্যাঁ, তবে এটা তো সিনেমা। আমার কাছে ভিডিও মোশন পিকচারের একটা বিভাগ। যখন তুমি ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [ Histoire (s) du cinema] দেখো, তখন তোমার স্বাভাবিক ভিডিওর অনুভূতি হয় না না, তখন তোমার সিনেমার অনুভূতি হয়।

    গ্যাভিন : আমি ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [Histoire (s) cinema] ভিডিওতে দেখেছি আর টিভির টেপেও দেখেছি---
    গোদার : ওটা টিভিতে দেখা ভাল, যদি তোমার টিভি সেটটায় ঠিকমতো সামঞ্জস্য করা থাকে আর  মোটামুটি ভাল স্টেরিও সরঞ্জাম থাকে । টিভিতে কোনও প্রজেকশান নেই । একটা প্রত্যাখ্যান আছে---তুমি তোমার আরামকেদারা্য বা  বিছানায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছো।সিনেমায় তুমি প্রজেকটেড, কিন্তু তা সত্বেও তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কী হয়ে উঠতে চাও । টিভিতে কেবল কোনও কিছুর ট্রানসমিশন থাকে ।  সিনেমায় প্রজেক্ট করার ব্যাপারটা অদ্ভুত, হ্যাঁ।

    গ্যাভিন : আবার, ‘সিনেমার ইতিহাসগুলো’ [ Hisdtoire (s) du cinema] থেকে একটা উক্তি: “থিয়েটার ব্যাপারটা বেশ পরিচিত; সিনেমা খুবই অচেনা।”

    গোদার : রবার্ট ব্রেসঁ ?...

    গ্যাভিন : আমি এটিকে আপনার “histoire de la nuit” , রাতের গল্প, আর ইমেজ সম্পর্কে বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত করি এবং এই দুটি বাক্যাংশ থেকে আমি যে আইডিয়া পাই  তা এই যে  সিনেমা একখানা রহস্যের এলাকা । আপনি কেন মনে করেন যে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তৈরি আপনার ফিল্মগুলো রহস্য ন্যারেটিভের রূপ সম্পর্কে  ক্রমশ জড়িয়ে পড়েছে? ডিটেক্টিভ [Detective], হেইল মেরি [Hail Mary], নভেল ভিগ [Nouvelle Vague], হেলাস পোর মোই [ Helas pour moi] সব কয়টাই কোনও কেন্দ্রীয়, অদৃশ্য রহস্য বা ধাঁধাকে  ঘিরে আবর্তিত হয়।

    গোদার :  তুমি যখন বয়স্ক হয়ে যাও, তখন কাঠামোর বিশ্লেষণ উপন্যাসেরই একটা অংশ। এটা হ'ল জেমস জয়েসের ইউলিসিস এবং এরেল স্ট্যানলি গার্ডনার মধ্যে পার্থক্য। পেরি ম্যাসনে রহস্যটি বর্ণনা করার রহস্য মাত্র, [যেখানে জয়েসের কাছে ] লেখার রহস্য নিজেই উপন্যাসের অংশ। পর্যবেক্ষক এবং মহাবিশ্ব একই মহাবিশ্বের অঙ্গ।  এই শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞান সেটাই আবিষ্কার করেছিল, যখন তারা বলল যে তুমি পারমাণবিক কণা কোথায় তা বলতে পারবে না। তুমি জানো যে তারা কোথায়, কিন্তু তাদের গতি জানো না ; বা তুমি তাদের গতি জানো কিন্তু তাদের অবস্থান জানো না, কারণ তা তোমার ওপর নির্ভর করে। যিনি  বর্ণনা করেন তিনি সেই বর্ণনার অংশ ।

    গ্যাভিন : ষাটের দশক ও সত্তরের দশকে আপনি যে রহস্যগুলি সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন তা ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদ ভিত্তিক ছিল আর আকাঙ্খা, আদর্শ, ভাষা এবং শক্তিক্ষমতার মতো ব্যাপারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। আশির দশকের পর থেকে, যদিও আপনার ফিল্মগুলো এই বিতর্কমূলক প্রশ্ন অব্যাহত রেখেছে, এখন ফিল্মগুলো দর্শন আর অধিবিদ্যার চিরন্তন রহস্যগুলোর সাথে বেশি সম্পৃক্ত।

    গোদার : আমিও তাই মনে করি,  আর তুমি যদি সাধারণ ব্যাপারের মাধ্যমে অধিবিদ্যাটা আনতে পারো তাহলে খুব ভাল হয়। এটা শিল্পীর একটা দায়িত্ব। সেজানের আঁকা একটা সাধারণ আপেল একটা সাধারণ আপেলের চেয়ে বেশিকিছু । বা কেবল একটা সাধারণ আপেল।

    গ্যাভিন : Nouvelle Vague এবং Helas pour moi ফিল্মে প্রকৃতিকে ব্যবহারের পেছনে কি তাইই আছে ?

    গোদার : হ্যাঁ ।

    গ্যাভিন : এই দুটো ফিল্মে আপনার উজ্জ্বল প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার অস্বাভাবিক — ক্যামেরা ভেতরে থাকলেও,  বা দিগন্তের জন্য, মনে হয় যেন তা বাইরে শুটিঙ করা । বৈসাদৃশ্যে কেন এমন জোর দিয়েছেন ?

    গোদার : কারণ আমি বৈশাদৃশ্য দেখছি। এটা দুটো ইমেজ রাখার উপায়, একে অপরের থেকে অনেক দূরে, একটা অন্ধকারময় এবং একটা রোদযুক্ত । আমি আলোর মুখোমুখি হতে চাই, আর তুমি যদি আলোর মুখোমুখি হও তবে বৈপরীত্য দেখা যায় এবং তারপরে তুমি  রূপগুলো দেখতে সক্ষম হও... যা সর্বদা ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যা ছিল,  তবে রোমান্টিকদের আর দেলাক্রয়ার সময় থেকে আরও সচেতনভাবে। আমি চাই পেছনে আলো  থাকবে না, কারণ পেছনের আলো প্রজেক্টরের অন্তর্গত, ক্যামেরার সামনে  আলো থাকা জরুরি, যেমন আমরা নিজেরাই জীবনে তা পাই। আমরা গ্রহণ করি এবং [পরে] তা প্রজেক্ট করি।

    গ্যাভিন : তার মানে ক্যামেরার পেছনদিকে আপনি নকল আলো কখনও রাখেননি ?

    গোদার : কখনই নয় ।

    গ্যাভিন : কিন্তু আপনি তো নকল আলো ব্যবহার করেন ?

    গোদার : শুধুমাত্র এই কারণে যে আমার তেমন কোনও ফটোগ্রাফার নেই যিনি ৫০ বছর আগের দুর্দান্ত ফটোগ্রাফারদের মতো ভাল । সুতরাং আমি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করতে পছন্দ করি,  তবে জিনিসগুলি পরিবর্তন না করে: আমাদের প্রয়োজন হলে ফোকাস করার জন্য শক্তিশালী আলো প্রয়োজন হবে। আমার মতে আর প্রায়  ফটোগ্রাফার বলতে কেউ নেই। তাদের মেরে ফেলা হয়েছে, যেভাবে পুরো সেট জুড়ে তারা  টিভির ছবি তোলে আর একই লোকজন দিয়ে ভরাট করে, কোনও ছায়া থাকে না, কিছুই না । আমি সিনেমাটোগ্রাফারদের ব্যবহার করি যারা অতিরিক্ত লাইট ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয় আর প্রধানত ভাল অ্যাপারচার খোলার ক্ষেত্রে কাজ করার চেষ্টা করেন।

    গ্যাভিন : ‘ডিটেক্টিভ’ ফিল্মে একটি লাইন  আছে: "এখানে কখনও কোনও আলো হয় না, কেবল কঠিন  আলোর ব্যবস্হা ।” 

    গোদার: ‘ডিটেক্টিভ’ বেশ ভাল আলোকিত ছিল, একজন ভাল ফটোগ্রাফার [ব্রুনো নুয়াইটেন]। তিনি অজানা অভিনেতাদের ভাল করে আলোকিত করেছিলেন কারণ দৃশ্যটায় তাদের দেখা না গেলেও তারা ভয় পেতো না। কিন্তু  নাথালি বে বা জনি হ্যালিডের মতো তথাকথিত বিখ্যাত তারকারা আসার সাথে সাথে তিনি কৃত্রিম আলো ফেলেছিলেন আর তা মোটেই ভাল হয়নি। তিনি তাদের প্রতি আলোকপাত করেছিলেন কারণ তারা টিভিতে স্পিকার দেখতে চান। স্পিকার দেখার গুরুত্ব কী? আমাদের কেবল দরকার তারা যা বলছে তা শোনা।

    গ্যাভিন : আর আপনি তার সাথে একমত হতে পারেননি ।

    গোদার : ওহ, পুরোপুরি [হাসি]। একটা জবরদস্ত তর্কাতর্কি হয়েছিল। কিন্তু আমি তা এড়াতে পারিনি কারণ  চুক্তিতে স্বাক্ষরিত ছিল ব্যাপারটা।  একটি সমঝোতা করতে হয়েছিল। একটা ফিল্ম সব সময়েই একখানা আপস ।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৩২738493
  • ইঙ্গমার বার্গম্যান-জাঁ লুক গোদার বিতর্ক
    মলয় রায়চৌধুরী

    জাঁ লুক গোদার-এর ‘ব্রেথলেস’ নামের ফিল্মটি ১৯৬০ সালে ইউরোপের ফিল্ম-সমালোচকরা দেখার পর যে ধরনের প্রশংসা পেয়েছিল, আমার মনে হয়, ১৯৬০ সালে কলকাতায় অমন একটা ফিল্ম, বোদ্ধাদের দেখানো হলেও প্রশংসা জুটতো কিনা সন্দেহ । সেসময়ে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে রমরমিয়ে চলতো উত্তম-সুচিত্রার ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, পথে হলো দেরী’, ‘হারানো সুর’ ইত্যাদি । সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ওই সময়ের ফিল্ম হলেও তাতে গোদারীয় বুদ্ধিবৃত্তি ছিল না, সেগুলো টানা রৈখিক ন্যারেটিভের গল্প ছিল ।  বাংলায় গোদার প্রশংসিত হয়েছেন বহু বছর পরে ; ফিল্ম-বোদ্ধাদের নতুন প্রজন্ম আসার পর এবং তাঁর ফিল্মগুলো কখনও ব্যবসায়িক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। ‘ব্রেথলেস’ মুক্তি পাবার পর গোদার হয়ে ওঠেন  ফরাসি নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রধান পুরোধাদের অন্যতম, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সমালোচক এবং বিতর্কিত ও প্রভাবশালী পরিচালক । ৯১ বছর বয়সে তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর পর যতো লেখালিখি তাঁকে নিয়ে হচ্ছে, এপার-ওপার বাংলায়, ততো তাঁর জীবদ্দশায় হয়নি। 

    গোদারের কাজের প্রশংসা যে সবাই করেছেন, তা কিন্তু নয় । যাঁরা তাঁর কাজ পছন্দ করতে পারেননি তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এর্নস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান, সুইডেনের চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, মঞ্চ পরিচালক, ফিল্ম নির্দেশক এবং নাট্যকার।  মার্কিন চলচ্চিত্রকার উডি অ্যালেনের মতে  এযাবৎ যত চলচ্চিত্রকার জন্ম নিয়েছেন তাদের মধ্যে বার্গম্যান সবার সেরা। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং রেডিও,  সব মাধ্যমেই বার্গম্যান কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক আসরে তাঁর  দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস (১৯৫৭), থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), উইন্টার লাইট (১৯৬১), দ্য সায়লেন্স (১৯৬৩), এবং ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২) ফিল্মগুলোর জন্য তিনি খ্যাত । অসাধারণ চিত্রগ্রহণ আর খণ্ডিত আখ্যানশৈলীর মাধ্যমে বার্গম্যান ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব আর কষ্টবোধ । সিনেমা আর টেলিভিশনের জন্য তিনি ষাটটার বেশি ফিল্ম তৈরি করেছেন যার  লেখক ও পরিচালক  তিনি নিজে । এছাড়া বার্গম্যান পরিচালনা করেছেন ১৫০ টিরও বেশি মঞ্চনাটক। 

    যদিও বার্গম্যান আর গোদার দুজনেই  মূলধারার হলিউড সিনেমার মূল্যবোধের বিরুদ্ধচারী চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, তাঁদের সংবেদনশীলতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বার্গম্যান আবেগগতভাবে অত্যন্ত তীব্র এবং গভীর ছিলেন আর বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্হাপনাকে ঘৃণা করতেন । পক্ষান্তরে গোদার  মূলত বুদ্ধিজীবী ছিলেন সিনেমার প্রকৃতি, চলচ্চিত্রের ভাষার প্রচলন এবং যোগাযোগের অসুবিধা, সিনেমা এবং দর্শকদের মধ্যে এবং সেইসাথে একটি চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলির মধ্যেও তাঁর জীবনব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান কাজ কেছে । গোদার তাঁর ফিল্মগুলোতে একটি কাব্যিক মনের সাথে  ক্ষুর-তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। 

     গোদার সম্পর্কে বার্গম্যান  বলেছিলেন: “আমি কখনই তাঁর কোনও চলচ্চিত্রের প্রশংসা করতে পারিনি, এমনকি সেগুলি বুঝতেও পারিনি। আমি তাঁর চলচ্চিত্রগুলিকে  বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মমগ্ন আর সিনেমা হিসাবে অনাগ্রহী,  এবং খোলামেলাভাবে নিস্তেজ বলে মনে করি। আমার সবসময় মনে হয়েছে যে তিনি সমালোচকদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।

    বার্গম্যান আর গোদারের মধ্যে কোনও পেশাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না । যা ছিল তা হলো দুটি ভিন্ন ব্যক্তির একে অপরের থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গী। যাঁরা দর্শক, চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, তাঁদের কাছে দুই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে প্রায় সমান সজাগ-মননে  উপভোগ করা সম্ভব । তবু অনেকে বার্গম্যানকে উচ্চতর চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন যখন কিনা গোদার , সিনেমার উচ্চতর চিন্তাবিদ, যিনি কলমের বদলে ক্যামেরা দিয়ে লিখতেন এবং ন্যারেটিভকে ক্যামেরা কৌশলের মাধ্যমে ভেঙে ফেলতেন ।

    বার্গম্যান সম্পর্কে চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “বিশ্বে খুব কম ছবি-করিয়েই আছেন যাঁরা চলচ্চিত্র ও মঞ্চে পাশাপাশি কাজ করে গেছেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান এমনই এক মহা-পরিচালক, আর তাই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষ। বহু দিন দুটো মাধ্যমেই কাজ করেছেন, আর চূড়ান্ত সফল ভাবে। বার্গম্যানকেই এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন মাধ্যমটা আপনার বেশি পছন্দের? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সিনেমা আমার স্ত্রী, আর থিয়েটার উপপত্নী। বার্গম্যানের যত ছবি দেখেছি, মনে হয়েছে, বার্গম্যান এমন এক জন পরিচালক, যিনি খুব গভীর ভাবে ‘মানুষ’ নামের অস্তিত্বটাকে দেখেছেন, সেই অস্তিত্বের এক একটা পরত ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে একেবারে আদত মানুষটাকে বার করে এনেছেন। নিজেই বার বার বলেছেন, আমার ছবিতে মানুষই প্রধান। একটা দৃশ্যকে আমি কী করে নির্মাণ করব, সেটা তো ভেবেচিন্তে করে ফেলাই যায়। কিন্তু আসল শুরু মানুষেই, আর মানুষই শেষ কথা। একটা জ্যান্ত (বা মৃত) মানুষের সব উপাদান, তার আনন্দ-দুঃখ-বেদনা-শয়তানি-রসিকতা-অমানুষিকতা, এই সব কিছু তিনি ওঁর ছবিতে ধরতে পেরেছেন। বলতেন, নারী-পুরুষের সমস্যা নিয়ে আমরা লাখ কথা বলি, আসলে সমস্যাটা নারী বা পুরুষের নয়, মানুষের। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের। সম্পর্কের খুব গহন, গোপন, যে জায়গাগুলোতে মানুষ খুব একলা, বা খুব অমানবিক, সেগুলো নিয়েই ওঁর ছবি। ‘সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ’ (যে ছবিটা উনি থিয়েটারেও করেছেন) দেখে মনে হয়েছে, মানুষকে এই ভাবে হাড়-মজ্জা-কঙ্কাল সহ দেখার এই লেন্সটা সবার হাতে নেই।”

    অনিন্দ্য সেনগুপ্ত বলেছেন, “গোদার সবসময়ে ছাত্র হিসেবে পুরোধায় ছিলেন। তিনি অন্যদের থেকে শিখতেন, কিন্তু নিজের মত করে।গোদার ‘মহান’ শিল্পী নন। বার্গম্যান, তারকভস্কি মহান; মহান বুনুয়েল, হিচকক, আন্তোনিওনি। বিশ্বজুড়ে গোদারের ছবিতে দূর্বোধ্য বুদ্ধিজীবিতা নিয়ে দূর্নাম আছে। কিন্তু ধরুন আপনি বার্গম্যানের ছবি থেকে অস্তিত্ববাদের পাঠ পাবেন, বুনুয়েলের ছবি থেকে পরাবাস্তবতার – গোদারের ছবি থেকে সেরকম কিছুর পাঠ পাবেন না। ওনার প্রথম দিকের ছবি মোটেও এক্সিস্টেনশিয়ালিজমের আকরচিত্র নয়, ওনার মধ্যভাগের ছবিও মার্ক্সবাদের শ্রেষ্ঠ পাঠ্য নয় (সেক্ষেত্রে গুরুর গুরু ব্রেখটের কাছেই যাওয়াই সমীচিন)। গোদার মহান নন । আমার কাছে গোদার ইন্টিমেট লাগে, অন্তরঙ্গ লাগে বলেই ওনার কাছে কিছু জিনিস শিখেছি।যেমন ব্যর্থ হতে ভয় না পাওয়া। বস্তুত পৃথিবীর প্রথম সারির সিনেশিল্পীদের মধ্যে জঁ-লুক এমন একজন যিনি সবচেয়ে বেশি ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন। কিসের ব্যর্থতা? নতুন কিছু করতে গিয়ে মাঝেমাঝে মুখ থুবড়ে পড়ার। সেটা একটি আস্ত ছবি হতে পারে, বা একটি দৃশ্য, বা একটি শট। পৃথিবীর বেশিরভাগ ‘সফল’ শিল্পীই হয় ব্যাপকার্থে যা পরীক্ষিত পদ্ধতি, বা তার বিগত কাজের নিরিখে যা সফল – তারই পূণরাবৃত্তি করেন। গোদার প্রায় প্রতিটি শটেই না হলেও, প্রতি পঞ্চম শটে এমন কিছু একটা করার চেষ্টা করেন যা নতুন, যা একটি নতুন অ্যাটেম্পট। ব্যর্থতা বা সাফল্যের সেখানে কোনো পূর্বনির্ধারিত মাপকাঠি নেই। অতএব এই প্যারাগ্রাফের প্রথম বাক্যের সাথেই জুড়তে হবে – নতুন কিছু করতে গেলে ব্যর্থ হতেই হতে পারে, ভয় পেলে চলবেনা। আর নিয়ম না ভাঙলে নতুন কিছু করা/বলা যায়না। নতুন সেক্ষেত্রে হল চেনার সীমানার ওপারে যার বাস। ঋত্বিক, বুনুয়েল, বার্গম্যান, তারকভস্কি মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতেন – তাদের দার্শনিক-তাত্ত্বিক সিস্টেম তৈরি ছিল। তারা জানতেন ছবির মাধ্যমে তারা কি করতে চান। গোদার তাদের স্থিরতায় দীর্ঘদিন পৌঁছোতে পারেননি, কারণ তিনি মাধ্যম ও ভাষা দুটিকেই সন্দেহ করেছেন। অর্থাৎ ক্লাসরুমে এলে তিনি ভাবতেন যে এই ৫০-১০০ মিনিটের সময়টুকু কি সন্দেহের উর্দ্ধ্বে? কাদের পড়াবো? সিলেবাস কে ঠিক করবে? সিলেবাস নির্মাণ করার পদ্ধতি কি প্রশ্নাতীত?

    তাঁদের উল্লেখযোগ্য সিনেমার পরস্পরের সাথে  চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতির পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়, যেমন, 'Cries and Whispers' এবং Two or Three Things I Know About Her' ফিল্ম দুটোর কথা বলা যেতে পারে'। 'Cries and Whispers'-এ বার্গম্যানের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো ফিল্মের সংবেদনশীল উপাদানকে তীব্র করার জন্য রঙের টোন এবং চরম ক্লোজ আপ শট ব্যবহার করা হয়েছে। এটি গোদারীয়  সিনেমায় দেখা যায় না । 'Two or Three Things I Know About Her'-এ, গোদার প্রটাগনিস্টের মাধ্যমে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত  এবং নাগরিক আধুনিকিকরণ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্হাপন করেছেন। গোদারের কাছে সিনেমা হল একটি সাংস্কৃতিক মাধ্যম যার সাহায্যে গোদার তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত কাব্যিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন। বার্গম্যান এই পদ্ধতিকে অপছন্দ করেন  কারণ তিনি যা বর্ণনা করেন তার আবেগপূর্ণ বিষয়বস্তুকে আরও তীব্র করে তোলেন।

    ইঙ্গমার বার্গম্যান এবং জাঁ লুক গোদার দুজনেই  চলচ্চিত্র জগতের  অভিজাত স্তরের পরিচালক, যাঁরা সিনেমার বিবর্তনকে সহজ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা  বিশ শতকের কয়েকটা ফিল্ম মাস্টারপিস তৈরি করে গেছেন, যার মধ্যে রয়েছে Persona এবং Pierrot le Fou-এর মতো কাজ ।  তাঁদের কাজগুলো তাদের  ভিন্ন শৈল্পিক সংবেদনশীলতার কারণে একে অপরের সাথে ডিসকোর্স হিসাবে ক্রিয়া করেছে কিন্তু দুজনের  চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একটাই – সিনেমাকে শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করা।

    বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, বার্গম্যান প্রায়শই আলফ্রেড হিচককের মতো সর্বকালের সেরাদের জন্য প্রশংসা প্রকাশ করেছেন, যাঁকে বার্গম্যান "খুব ভাল প্রযুক্তিবিদ" বলে মনে করতেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে কয়েকজনের খোলা মনে প্রশংসা করতেন। বার্গম্যান ফেদেরিকো ফেলিনির চলচ্চিত্র এবং তাঁর "দাহক সৃজনশীলতা" এবং সেইসাথে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর "দর্শকের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপায়" উপভোগ করার কথা বলেছেন।  সবার ওপরে, তিনি আন্দ্রেই তারকোভস্কিকে স্থান দিয়েছেন এবং তাঁকে "সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ" হিসাবে ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে , বেশ কয়েকজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বার্গম্যান পাত্তা দেননি। তিনি মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনিকে নিছক একজন "নন্দনতাত্ত্বিক" হিসাবে চিহ্ণিত করেছিলেন এবং সিনেমাটিক পরাবাস্তববাদের গুরু  লুই বুনুয়েলকে তাঁর নিজেরই আহ্লাদের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু  ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম পথিকৃৎ জাঁ লুক গোদারকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন, ‘অসহ্য’ তকমা দিয়ে।

     ব্রেথলেস’ নামের পালাবদল ঘটানো ফিল্ম দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে, গোদার ফরাসি সিনেমার এনফ্যান্ট টেরিবল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি একজন পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি পেলেন, যাঁর সিনেমাটিক প্রচলিত কায়দার জন্য ধৈর্য্য ছিল না, এবং যিনি ফিল্ম তোলার জাঁকজমক দৃশ্য লুকানোর বদলে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ক্যামেরার ক্ষমতা ব্যবহার করাকে গুরুত্ব দিলেন। দর্শকদের বললেন, "প্রতিটি সম্পাদনাই মিথ্যা।"

    গোদারের সিনেমাটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তাঁর উত্তর-আধুনিক আত্মপ্রতিবর্তিতা কখনও বুঝতে পারেননি বার্গম্যান। তিনি গোদারের কাজগুলোকে "প্রভাবিত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মমগ্ন" হিসাবে বাতিল করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তিনি গোদারের শৈল্পিক উদ্দেশ্যগুলির প্রশংসা করতে অক্ষম বা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে সক্ষম হননি। গোদারের চলচ্চিত্র এবং তাঁর  সিনেমাটিক সংবেদনশীলতার একটি কঠোর সমালোচনা করে  বার্গম্যান বলেছিলেন: "আমি তাঁর চলচ্চিত্র থেকে কিছুই পাইনি। ফিল্মগুলো যেন কৃত্রিমভাবে বানানো, বুদ্ধিজীবীর নকল এবং সম্পূর্ণরূপে মৃত মনে হয়েছে। ফিল্মগুলো সিনেমাটোগ্রাফিকভাবে অরুচিকর এবং অত্যন্ত বিরক্তিকর। গোদার একজন ‘ফাকিঙ বোর’ । তিনি সমালোচকদের জন্য তাঁর চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। একটি চলচ্চিত্র, Masculin Féminin (1966), এখানে সুইডেনে শুটিং করা হয়েছিল। এটা মন দমিয়ে দেবার মতো বিরক্তিকর ছিল।"

    ১৯৭১ সালের একটা সাক্ষাৎকারে, গোদারের কাজগুলো অপছন্দ করার সঠিক কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “এই পেশায়, আমি সর্বদা এমন লোকদের প্রশংসা করি যারা চলেই চলছে, যাদের এক রকমের ধারণা রয়েছে আর তা যতই পাগলামো হোক না কেন, তা দিয়ে যাচ্ছেন ; তাঁরা মানুষ এবং জিনিসগুলোকে মেলাতে পারছেন, আর তাঁরা অন্তত কিছু  তো বানাচ্ছেন । আমি সবসময় এই ব্যাপারগুলোর প্রশংসা করি। কিন্তু গোদারের ফিল্ম দেখতে পারি না। আমি সম্ভবত পঁচিশ বা ত্রিশ বা পঞ্চাশ মিনিটের জন্য বসে থাকি আর তারপর উঠে বেরিয়ে যাই, কারণ তাঁর ছবি আমাকে বেশ নার্ভাস করে তোলে। আমি পুরো সময়টা বোঝার চেষ্টা করি যে উনি আমাকে কিছু বলতে চান, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না যে ব্যাপারটা কী, এবং কখনও কখনও আমার মনে হয় যে উনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।"

    গোদারের ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার বিখ্যাত মাস্টারপিসগুলির প্রতি বার্গম্যানের অপছন্দের বিপরীতে, গোদার সবসময় বার্গম্যানকে তাঁর প্রাথমিক প্রভাবগুলির মধ্যে একজন হিসাবে উল্লেখ করেছেন।যখন গোদার চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে কাজ করছিলেন, ১৯৫৮ সালের একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: “বার্গম্যান, প্রকৃতপক্ষে, তাৎক্ষণিক সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র  বর্তমান মুহুর্তে নায়কের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠে, আর সেই প্রতিফলনকে সময়ের স্থানচ্যুতি দ্বারা গভীর করে তোলে – ঠিক যেমন প্রুস্ত তাঁর উপন্যাসে করে গেছেন ।”

    বার্গম্যান সম্পর্কে গোদার নলেছেন, “কিন্তু আরও শক্তিশালীভাবে, যেন প্রুস্তকে  জয়েস এবং রুসো উভয়ের দ্বারা দ্বিগুণ করেছেন বার্গম্যান – তাৎক্ষণিকতার ওপর এক বিশাল, সীমাহীন ধ্যানে পরিণত করেছেন। একটি ইঙ্গমার বার্গম্যান ফিল্ম, বলা যায়, একটি সেকেন্ডের চব্বিশ ভাগের একাংশে রূপান্তরিত এবং দেড় ঘণ্টায় প্রসারিত। দুইবার চোখের পাতা ফেলার মাঝের জগৎ, দুই হৃদস্পন্দনের মাঝের বিষণ্ণতা, দুই হাততালির মাঝে উল্লাস।"

    গোদারের জীবনে, তাঁর বৈপ্লবিক চেতনাকে তরতাজা রাখতে অন্য কারোর পিঠচাপড়ানির দরকার হয়নি । তাঁর পরের ফিল্মগুলোয়, যেমন Goodbye to Language এবং The Image Book কাউকে পরোয়া করেনি । গোদারের এই উক্তিটি এক্ষেত্রে উল্লেখ্য :  "যে শূন্যে ঝাঁপ দেয় তার, যারা দাঁড়িয়ে দেখছে, তাদের কাছে ব্যাখ্যা দেবার কোনও দায় নেই।" ফেলিনি, ত্রুফো, বার্গম্যান, আন্তনিয়নি, প্রমূখ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের পাশে গোদার নিজের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। বলতে পেরেছিলেন, “আমরা সবাই কমবেশি পতিতাবৃত্তিতে বসবাস করছি।”

    বার্গম্যান যেমন বলেছেন, যে, গোদার তাঁর কাজগুলো ফিল্ম-ক্রিটিকদের জন্য তৈরি করেন, তেমনই সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, গোদারের সিনেমা পরিচালকদের জন্য, ইউরোপের শিক্ষিত দর্শকদের জন্য ; ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতদের জন্য নয়। উৎপল দত্ত যেমন বলেছেন, ব্রেখতের নাটকগুলো শিক্ষিত জার্মানদের জন্য । এপার-ওপার দুই বাংলাতেই রৈখিক গল্প ছাড়া ফিল্ম বা নাটক সম্ভব নয় । ফিল্ম তুলতে প্রচুর টাকা লাগে, আর কেই বা অতো টাকা খরচ করতে চাইবে যা ফিল্ম দেখিয়ে তোলা যাবে না । বলিউডের ফিল্মের জন্য তাই আণ্ডারওয়র্লডের টাকা দরকার হয় । জনপ্রিয় সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, নাটক টিকে যায় বাণিজ্যিক প্রচারের জোরে। কর্পোরেট মিডিয়া, কর্পোরেট লবি জনসাধারণের রুচি, শিক্ষা, বোধ, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এর সিনেমা জনপ্রিয় হয় না। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি এদেশে দেখাবার সিনেমা হল পায় না । আজকাল তো বাংলা বাণিজ্যিক ছবিকে হল থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হিন্দি ফিল্ম দেখানো হয় ।

    শুটিং এর আগে গোদারের হাতে সুচিন্তিত আর লিখিত চিত্রনাট্য  থাকত না। ফালি কাগজে গোদার  ছবির আইডিয়া লিখে রাখতেন। কি কি শট নেওয়া হবে, কোন কোন দৃশ্যবস্তুকে গ্রহণ করা হবে এইসব ভাবনা  তার মাথায় থাকত । চিত্রনাট্যের গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তিনি স্বীকার করতেন না। সত্যজিৎ রায় তাঁর আগামী ফিল্মের দৃশ্যগুলোও এঁকে রাখতেন । গোদার ছিলেন বেপরোয়া, একজন প্রতিবাদী চিত্রনির্মাতা, যিনি ফিল্মের মাধ্যমে মার্কসবাদের সামাজিক অর্থনৈতিক দার্শনিক ব্যাখ্যা করতেন, ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ  করতেন। ফলে প্রযোজক পাওয়া কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে ।  ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আর ক্যামেরাকেই ভাবনাচিন্তা করতে বলতেন । সিনেমার বাণিজ্যিক দিক তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। ফিল্মের গণমাধ্যম এতই শক্তিশালী যে প্রতিটি দেশের সরকার এবং পুঁজির মালিকরা পরিচালনা আর প্রযোজনা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আমাদের দেশে অমন ফিল্ম তৈরি করলে কেবল কারোর বাড়ির বৈঠকখানায় কয়েকজনকে দেখানো যাবে ।

    মিশেল অ্যাজানাভিশ্যু, যিনি গোদার আর তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে ‘রিডাউটেবল’ফিল্ম তৈরি করেছেন, তিনি মনে করেন, অনেক লোক জাঁ লুক গোদারকে ঘৃণা করেন  ।  যখন জাঁ লুক গোদার  শুনলেন যে তার জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, তখন তিনি বলেছিলেন: "আমি ব্যাপারটা পছন্দ করি না, একেবারে বোকা, বোকা ধারণা।" ফরাসি সিনেমার এক সময়ের বিদ্রোহী ফিল্ম নির্মাতা তখন ৮৭ বছর বয়সী, এবং প্রায় ৫০ বছর পর পর্দায় আনা অভিনেত্রী এবং প্রেমিকা অ্যান ওয়াইজেমস্কির সাথে তার বিবাহ সম্পর্কে একটি গল্প নিয়ে -রিডাউটেবল’ নামের চিত্র নির্মাণে তাঁর  সন্দেহ ছিল । ‘রিডাউটেবল’-এ, স্ট্যাসি মার্টিন অভিনয় করেছেন গোদারের স্ত্রী ওয়ায়েজেমস্কির চরিত্রে , লুই গ্যারেলের বিপরীতে, যিনি গোদারের  চরিত্রে অভিনয় করেছেন।সময়কাল ১৯৬৭-৬৮, যখন ছাত্র বিক্ষোভ প্যারিস জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে । ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনের নেতা হিসাবে, Breathless এবং Vivre Sa Vie-র মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করার পরে গোদার তখন একজন প্রধান বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্মানিত । গোদার সম্পর্কে অ্যাজানাভিশ্যু বলেছেন, "আমি বলব না যে তিনি আমাদের সেরা পরিচালকদের একজন," বলা যায়  “তিনি সবচেয়ে মুক্ত মনের পরিচালক। তিনি  খুব আকর্ষণীয় পথ গ্রহণ করেছেন। তবে আমি তাঁকে সেরাদের একজন মনে করি না।”

    অ্যাজানাভিশ্যু মনে করেন, “ফ্রান্স গোদারকে নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত। “কিছু লোক তাকে মহান হিসেবে তুলে ধরতে  চায়। তিনি ফ্রান্সের সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের কাছে একটি টোটেমের মতো, যা আমি মনে করি হাস্যকর। "কিন্তু অনেক লোক তাঁকে ঘৃণা করে কারণ তারা তাঁকে বোঝে না, কারণ তারা তাঁকে ভয় পায়, কারণ গোদার সবসময় একজন প্রতিপক্ষ - গোদার অনেক কিছুর বিরোধী। অনেক লোক এর জন্য তাঁকে ঘৃণা করে, কারণ তারা মনে করে গোদার একজন বুদ্ধিজীবী আর অভিজাতদের অংশ।"
     
     
     
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 223.229.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৬738494
  •  গোদার এবং দর্শনের উপস্হাপনা : একরকম দর্শন হিসাবে সিনেমা
    জন ই ড্রাবিন্সকি, আমহার্স্ট কলেজ
    জার্নাল অফ ফ্রেঞ্চ অ্যাণ্ড ফ্রাঙ্কোফোন ফিলোজফি [ Vol XVIII, No 2 (2010) ] তে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী
    ফিল্মে পরিসর নিজেকে ভিন্ন একটি চেহারায় উপস্হাপন করে, যা এখন আর আগের মতন সম্পূর্ণ নয়, বরং তা কয়েকটি রদবদলের মিশেল,  অনুভূতির সমষ্টি, যা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়,  অর্থাৎ ব্যাপারটা হলো সময়।
    জাঁ-লুক গোদার আর কিছু না হোন, তিনি রহস্যে মোড়া । তাঁর ব্যক্তি-প্রতিস্বের নিজেরই জীবন রয়েছে, বিশেষ করে যুববেলার আদরায় : সিগারেট, কালো চশমা, বাঁকা হাসি, গমগমে বৈপ্লবিক স্লোগান, আর গুরুত্বপূর্ণ বই । কেবল নিছক ব্যক্তি-প্রতিস্বই নয়, আমরা সবাই জানি, কেননা তাঁর আইকনিক প্রতিস্ব নিখুঁতভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে ‘ব্রেথলেস’ থেকে শুরু করে ক্যামেরার বেপরোয়া বৈপ্লবিক ব্যবহারে । গোদারের পর ফিল্ম নির্মাণ আর একই রকম রইল না ।  ছবি এবং তাদের অনুক্রমগুলো —- গোদার সেগুলোকে কালো চশমায় ঢাকা দিয়ে মুচকি হাসির আড়াল তুলেছিলেন ।  তিনি তাদের বিপ্লবী করেছেন। এটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। এমনকি বয়স্ক গোদারও একটি আইকনিক ফটোর যোগ্য : রুক্ষ মুখে দাড়ির চুল, শিল্পীর চশমা, হাসি এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর ফিল্মগুলো বজায় রেখেছিল তাদের অনির্দেশ্য,  টানটান এবং বৈপ্লবিক বিশেষত্ব । 
    ফটোতে সৌম্যকান্তি এবং কমনীয় হতে কখনই অসুবিধা হয়নি । আইকনিক উপস্থিতি এবং মনোভাব,  চোখ ও মনকে জাগিয়ে রাখতো। সিনেমা, সর্বোপরি, শিল্পের আঙ্গিকের ওপর ভর করে চিত্র এবং প্রচারের  অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি করে  - বাণিজ্য এবং খ্যাতির । কেননা সিনেমাও অবশ্যই একটা শিল্প, যা প্রযুক্তি এবং মানুষের কল্পনার সংযোগে তৈরি হয়, যার সম্ভাবনা এই দুটিরই সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনা দিয়ে ঘেরা ।  গোদারের প্রতিভায় কিছু একটা আছে যা তাঁর আইকনিক ভঙ্গিকে ছাপিয়ে যায়। নিঃসন্দেহে, তিনি প্রধান স্টুডিও সিস্টেম এবং গণসাংস্কৃতিক জায়গাগুলোর বাইরে কাজ করেন - এমনকি টেলিভিশনের জন্যও, তিনি অস্বস্তিকর এবং জটিল ফ্রান্স/ট্যুর/ডিট্যুর/ডিউক্স/এনফ্যান্টস তৈরি করেছেন - এবং তাঁর সেই নিজস্ব সিনেমাটিক কন্ঠস্বর , কিন্তু গোদারের প্রতিভা এবং রহস্য দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নিয়ে আসা শব্দ এবং ছবিগুলোতে । তাঁর সিনেমা এবং সিনেমার ভাষাটি দার্শনিক। আইকনিক পোজ, ক্যারিশমা, স্টাইল এবং গুরুত্বপূর্ণ বই।  ঠিক যেমন রয়েছেন আইকন গোদার, আর ফিল্মে  তাঁর আইকনিক শট, মুখ এবং দৃষ্টিকোণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৃহত্তর ভাবনার দৃষ্টি আর চমৎকারিত্ব : ফিল্মে গোদার একজন আইকন থেকে চিন্তকে পরিবর্তিত হন । গোদারের কাজগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যোগসূত্র রয়েছে; আমরা দেরিদা, বাতাইলে, মেরলো-পন্তি, লেভিনাস এবং অন্যান্যদের বক্তব্য তাতে পাই। বইগুলো অবশ্য ধারণার সংকেত দেয় এবং ঘুরপথে জটিল পথচলার মানচিত্র দেয়, টুকরো-টাকরা এবং  এমনকি নৈতিক বার্তা । কেন দেরিদার ‘অফ গ্র্যামাটোলজি’ ? ‘নোত্রে মিউজিক-এর সংকটের মুহূর্তে লেভিনাসের এনত্রে নউস দ্বারা কী উদ্ভূত হয়েছে ? ইত্যাদি । সেসব মুহূর্তগুলো তাত্বিক আর ভাষ্যকাররা তালিখে গেছেন । আরও বহু বক্তব্যকে আলোকিত করার প্রয়োজন আছে ।
    বইয়ের গুরুত্ব আছে গোদারে, আর লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো  এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত বইগুলোর মধ্যে কতকগুলোয় দার্শনিকদের নাম রয়েছে । জাঁ লুক গোদারকে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সিনেমাটিক কৌশল এবং প্রবণতার উদ্ভাবক হিসাবে বিবেচনা করাই যথেষ্ট। তার প্রচুর উপাদান আছে, কেননা, তাঁর সিনেফিলিয়ার বিশালতা এবং তীব্রতার জন্য, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সিনেমার শিল্পের উদ্ভাসিত উদ্দীপনার কারণে, প্রায়শই বামপন্হী  রাজনীতি একজন বুদ্ধিজীবীকে সারাজীবন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা বলতে পারি যে গোদারের সিনেমা সম্পর্কে লেখালিখির  সর্বোত্তম কাজগুলো এই সবে শুরু হয়েছে।  কেই বা তাঁর চলচ্চিত্রের মানে ফুরিয়ে যাবার ভান করবে? কেউ করবে  না । বলার মতো আরও অনেক কিছু আছে, আরও অনেক ফিল্ম দেখতে হবে । সম্পূর্ণরূপে বিকশিত নান্দনিকতা এবং রাজনীতিতে সূক্ষ্মভাবে  বিস্ফোরণগুলো সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে হবে । বুড়ো লোকটা এখনও চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছে। সেই চলচ্চিত্রগুলো এখনো ব্যাখ্যাকারের অপেক্ষায় রয়েছে । 
    গোদারের প্রসঙ্গ এবং ইঙ্গিতগুলোকে অনুসরণ করা - তা শটে হোক, ফ্রেমের মার্জিনে একটি বই, বাক্যাংশের একখানা মোচোড় , বা একটি সম্পূর্ণ অনুক্রম এবং মন্টেজ হোক - অবশ্যই তাঁর সিনেমা সম্পর্কে প্রচুর চিন্তাভাবনার ফসল। নীচের পৃষ্ঠাগুলিতেও কিছু থেকে যায় ।  তবুও, একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে, আমাদের বিশ্লেষিত প্রবন্ধগুলো গোদারকে নিয়ে একটি ভিন্ন কথোপকথন শুরু করে । একটি ভাবনা শুরু হয়েছিল, গোদারের সিনেমাটিক কাজের ভেতরেই। চারটি পথনির্দেশক প্রশ্ন। দর্শন সম্পর্কে গোদারের ফিল্মগুলো কী কথা বলে ? গোদারের কাজ সম্পর্কে দর্শন কী বলে বা বলতে পারে? অথবা, আরও বিশদ করে বলতে হলে, কীভাবে আমরা গোদারের কাজকে দর্শনের একটি রূপ হিসাবে দেখতে পারি?
     দর্শন কি এক ধরনের সিনেমা হতে পারে? দার্শনিকরা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেন। ফিল্ম তাত্ত্বিকরা দর্শন নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু  সিনেমা এবং দর্শনের মাধ্যমে চিন্তা করার ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ তার একটি অংশ হল প্রশ্নটির সমস্যা: সিনেমা এবং দর্শনকে একই সাথে ভাবার মানে কী দাঁড়ায় ? নাকি  একটি ফিল্ম বা শটের অনুক্রমের ওপর দার্শনিক ধারণা যান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হবে ?  সম্ভবত দর্শন এবং সিনেমা, আমরা যাকে দার্শনিক বলি, সেই ভাবনাগুলোর  একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা গড়ে তোলে। যেমন ধরা যাক, ১৯৬৮ সালে  নিৎশেকে নিয়ে একটা ছোটো সাক্ষাৎকারে বলা গোদার সম্পর্কে জিলে দেলিউজের কথা বিবেচনা করুন। সেই মন্তব্যে দেলিউজের উদ্বেগের বিষয় ছিল ইমেজের ভাগ্য – দর্শনে কীভাবে ইমেজটি সমালোচনার এলাকা হিসাবে কাজ করে, আর সেই সঙ্গে  বাস্তবতার কিছু আধিভৌতিক ধারণায় আটক পশ্চিমা ঐতিহ্যের আবেশের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য একটা সমালোচনামূলক এলাকা হিসাবে গড়ে ওঠে। গোদারের সিনেমা সম্পর্কে একটা মন্তব্য চিন্তাকে উসকে দেয়, যেমনটা দেলেউজ বলেছেন : গোদার  সিনেমার মধ্যে চিন্তাভাবনার প্রবর্তন করে তার রূপান্তর ঘটিয়েছেন। সিনেমা নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, সিনেমায় তিনি কম-বেশি বৈধ চিন্তা রাখেন না; তিনি সিনেমাটাকেই চিন্তা করতে প্ররোচিত করেন, আর তা সিনেমায় প্রথমবারের মতো ঘটতে দেখা গেলো, যদি আমি ভুল না করে থাকি।
    তাত্ত্বিকভাবে, গোদার কান্টের ‘ক্রিটিক’ বা স্পিনোজার ‘নৈতিকতা’ চিত্রায়ন করতে সক্ষম হবেন আর তা  বিমূর্ত সিনেমা বা সিনেমাটোগ্রাফিক প্রয়োগ হবে না। গোদার জানতেন কেমন করে  একটা নতুন উপায় আর একটা নতুন 'ইমেজ' দুটোকেই খুঁজে বের করতে হয় - যা অগত্যা বিপ্লবী বিষয়বস্তুকে আগাম অনুমান করে নেয় । সুতরাং, দর্শনে, আমরা সকলেই আনুষ্ঠানিক পুনর্নবীকরণের এই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি ।  তাঁর মনের ভেতরে  কী ঘটছে তা জানা মুশকিল, কারণ দেলিউজ যেমন বলেছেন, গোদার ফিল্ম জগতকে একের পর এক  গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘উইক-এন্ড’, ‘২ অর ৩ থিংস আই নো অ্যাবাউট হার’ আর ‘লে চিনয়েস’, তার আগে ‘ম্যাসকুলিন-ফেমিনিন’, ‘মেড ইন ইউ.এস.এ’, এবং ‘পিয়েরো লে ফাউ’ - শুধুমাত্র কয়েকটা উল্লেখ করা যেতে পারে । এগুলি সবই তাতিয়ে তোলার চলচ্চিত্র, উদ্ভাবনামূলক এবং উদ্ভট, তবুও আমরা বলতে পারি যে গোদার সম্পর্কে দেলিউজের বক্তব্য যেমন বর্ণনামূলক তেমনি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক। দেলিউজের মন্তব্যের পরের  দশকগুলোয়, গোদার  তৈরি করলেন  সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, আত্ম-প্রতিফলিত, আত্ম-সমালোচনামূলক এবং অত্যন্ত তাত্ত্বিক ফিল্মগুলো।
    ‘কমেন্ট কাভা?’র মতন কঠিন কাজগুলো  এবং ‘ন্যুমেরো দেউ’, পরবর্তী দশকে তৈরি, অনেকটা ভাঙা আখ্যানের চেয়ে প্রবন্ধের মতো কাজ করে, আর  Ici et ailleurs এবং অন্যান্য  চলচ্চিত্রগুলোতে আমরা যে আত্ম-সমালোচনা পাই, যেখানে ‘অপর’-এর প্রতিনিধিত্ব করার সমস্যাটি এমন কঠোর পরিভাষায় উপস্হাপিত , যা, ফ্রান্সে এবং অন্যত্র ঘটে যাওয়া ১৯৭০  দশকের অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং জরুরী দার্শনিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে উৎসারিত হয়েছিল । ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে যা একটি দার্শনিক প্রতিশ্রুতি হিসাবে দেখানো হয় , তাকে ১৯৭০  এবং তার পরে একটি ঘন, পলিসেমিক সিনেমাটিক ভাষায় নিয়ে আসা দর্শনে পরিণত  করা হয়েছিল । যদি দর্শন, যেমনটা দেলিউজ বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা তৈরির সাথে সম্পর্কিত বিষয় হয়, তাহলে গোদারের সিনেমাকে বলা যেতে পারে শব্দ এবং ছবি দিয়ে গড়া ধারণা  - যা এতোকাল, সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত, দর্শনের পদ্ধতি ছিল।
     এখন, আসুন, সামান্য বিরতি দেওয়া যাক এবং ভাবা যাক সিনেমাকে এক ধরণের দর্শন হিসাবে মান্যতা দেয়ায় কী ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তা বিবেচনা করি। দেলিউজ এখানে একটি সত্যিকারের অবিশ্বাস্য দাবি করছেন, যদিও তা ইঙ্গিতপূর্ণ এবং এখনও পদ্ধতিগত নয় (যদিও  সিনেমা বিষয়ে দুটি বইয়ে গোদার সম্পর্কে তাঁর বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা এই দাবিকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে)। দেলিউজের মতে,  গোদারের  সিনেমা, কেবলমাত্র দর্শনের প্রতিফলনের জন্য একটি বিশেষ সমৃদ্ধ স্থান হতে পারে, কিন্তু  গোদারের চিত্রের স্থাপনাতেও দর্শন তৈরি হতে পারে । দেলিউজের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, অবশ্যই, এটি নিখুঁত অর্থবহ এবং তাঁর দাবিকে মূর্ত করে, যে, দর্শনের কাজ ধারণা তৈরির মধ্যে নিহিত, পাঠ্যের বিশ্বস্ত (প্রচলিত) ব্যাখ্যা করা নয় এবং শুধুমাত্র ঐতিহ্যকে পুনঃস্থাপন করা নয়। সিনেমা, সেই প্রেক্ষাপটে, চিত্র এবং শব্দের স্তরে ধারণা তৈরির জন্য একটি নিখুঁত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে কার্যকর ব্যাপার। আর তাই, সিনেমাও এমন একটা মাধ্যমের ব্যাপার যা দর্শনের উদ্ভাবন করে। কিন্তু তার মানে এই দাঁড়ালো  যে সিনেমার ঐক্যকে ধরে রাখার জন্য  দর্শন একটি ব্যাখ্যামূলক বিষয় হিসাবে চালিত হয় না ।  বরং সিনেমা হল এক ধরনের দর্শন। দর্শন হল এক ধরনের সিনেমা। ধরা যাক দেলিউজ তাঁর চরিত্রায়নে সঠিক। এর মানে যা দাঁড়াচ্ছে, অবশ্যই, তা হলো আমাদের মতন দার্শনিক-মনোভাবাপন্ন ভাষ্যকারদের জন্য গোদারের কাজ সম্পর্কে বিশ্লেষণের নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে । তাঁর চলচ্চিত্রে দর্শন প্রয়োগ করা বা প্রদত্ত মন্তেজ বা চরিত্রের অনৈক্য থেকে একটি বা দুটি ধারণা সনাক্ত করা যথেষ্ট নয়। গোদারের সিনেমাকে দার্শনিক ডিসকোর্স হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই লক্ষ্যে, এবং সেই ফ্রেমের মধ্যে, গোদারের দর্শন বিশ্লেষণ  করার জন্য তিনটি সাধারণ কৌশল দরকার। এই কৌশলগুলোতে  দর্শন আর সিনেমার মিলনের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা দেখতে পাই।
     প্রথমত, বিশেষ দার্শনিকদের সাথে গোদারের সিনেমাটিক খেলা এবং ভাষাকে জড়িত করার কৌশলের মিল - এখানে, দেলিউজ, ফেলিক্স গুত্তারি এবং অ্যালাঁ বাদিউ - যা সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের পাশাপাশি গোদারের চিত্র এবং শব্দের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে।  আর সিনেমা দার্শনিককে কী বলে? দ্বিতীয়ত, সিনেমার ভাষা কীভাবে মানেগুলোকে ছড়িয়ে দেয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যার অর্থ দার্শনিক বর্ণালী জুড়ে ভাষা, লেখা, ইতিহাস ইত্যাদির প্রশ্ন গড়ে ওঠে । কিভাবে সিনেমা একটি তাত্ত্বিক ডিসকোর্স হিসাবে কাজ করে? আমরা কীভাবে সিনেমাটিক ভাষা এবং তার প্রভাব, ধারণা এবং ধারণাগুলির পাঠ(গুলি)র সংক্রমণকে তাত্ত্বিক করতে পারি? এবং তৃতীয়, বৃহত্তর দার্শনিক (এবং বিস্তৃতভাবে তাত্ত্বিক) প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে গোদারকে কোথায় স্থাপন করা যায় সেই প্রশ্ন রয়েছে।
    গোদার কীভাবে চলচ্চিত্র এবং কবিতার ইতিহাসের সাথে আরও সাধারণভাবে সম্পর্কিত? আর কীভাবে সেই সম্পর্কটা শর্ত হিসাবে তাঁর একক চিত্র তৈরির সম্ভাবনার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে?  ডেভিড স্টারিট এবং মাইকেল ওয়ালশ বলেছেন   গোদারের কাজকে দেলিউজ, গুত্তারি এবং বাদিউয়ের সমালোচনামূলক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন । স্টেরিট বলেছেন গোদার তাঁর শেষের দিকের ফিল্মগুলোতে ইমেজকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে বোঝা যায় তিনি মানুষ ও বিশ্বের মাঝে ছবির মাধ্যমে সংযোগ গড়ে তুলতে চেয়েছেন ।   স্টারিট বিশেষ করে আলোকপাত করেছেন গোদারের ১৯৮৫ সালের  ‘হেইল মেরি’ ফিল্মে বিমূর্তের মুখোমুখি পণ্যসমষ্টির ব্যাপারে যেখানে  অবতার হিসাবে মাদার মেরি আকাঙ্ক্ষিত এবং পবিত্র ।
    ওয়ালশ তাঁর "হ্যাপিনেস ইজ নট ফান: গোদার, ২০থ সেঞ্চুরি অ্যান্ড বাদিউ,"  প্রবন্ধে বলেছেন যে বাদিউ-এর চিন্তাভাবনা গোদারের  অনেক কাজ জুড়ে অনুরণিত হয় । ১৯৬০-র দশকের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ছোট কাজগোলুর মধ্যে বিশেষ করে রহস্যময় ছোট ফিল্ম De L'Origine du XXIe Siècle. একই থিম নিয়ে বাদিউয়ের চিন্তাভাবনার বিশ্লেষণ করে  ওয়ালশ দেখিয়েছেন যে কীভাবে "শতাব্দীর" ধারণাটা গোদার, লাকাঁ এবং বাদিউয়ের মধ্যে একই পাটাতনে খুঁজে পাওয়া যায়,  যার সবকটিই সিনেমা বা দার্শনিক চিন্তাভাবনায় কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষামূলক। ওয়ালশের বিশ্লেষণে আমরা যা দেখি তা হল প্রদত্ত চিন্তকের ধারণাগত বক্তব্যটি কীভাবে তাত্ত্বিক ডিসকোর্সের মতো কাজ করে: মানে, যা দেখা যায় না তা আলোকিত করা।  সিনেমা তার নিজস্ব দার্শনিক অর্থগুলোকে বিশেষভাবে সঞ্চারিত করে। শব্দ, চিত্র এবং ফ্রেমের খেলা অন্য এক ধরণের তাত্ত্বিক ভাষাশরীর গড়ে তোলে। এই ভাষার সম্ভাবনার বিকাশ এবং কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে, গোদার অবশ্যই জটিল এবং প্রায়শই হতবুদ্ধি করে দেন । 
    ডেভিড উইলস তাঁর "দ্য অডিবল লাইফ অফ দ্য ইমেজ" প্রবন্ধে  গোদারের নিজস্ব ধরনের ইমেজকে বিশ্লেষণ করেছেন । গোদারের  ভিজ্যুয়াল অদৃশ্য হওয়ার কায়দা বিশ্লেষণের মাধ্যমে, ‘হিস্টোয়ার (গুলি) ডু সিনেমা’ এবং ‘এলোজে দে ল'আমোর-এর উপর বিশেষ জোর দিয়ে, উইলস দেখান যে কীভাবে সিনেমাটিক ভাষা, গোদারের হাতে, শ্রবণে অর্থ উৎপন্ন করে, যা একইসঙ্গে দৃশ্যমান আবার ইমেজ তৈরির   বাইরে কাজ করে। তাঁর "শট অ্যান্ড কাউন্টার-শট: প্রেজেন্স, অবস্কিউরিটি, অ্যান্ড দি ব্রেকডাউন অফ ডিসকোর্স ইন গোদারর্স নোত্রে মিউজিক’  বার্লিন বার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে শট এবং কাউন্টার-শটের খেলা ঐতিহাসিক, স্মারক এবং শেষ পর্যন্ত অর্থের একটি অদ্ভুত সংক্রমণ তৈরি করে যা , উত্তেজকভাবে রাজনৈতিক লক্ষণযুক্ত এবং তাৎপর্যময়। , ‘নোত্রে মিউজিক’ বারের দৃষ্টিতে, এমন একটি সিনেমাটিক কাজ এবং দিসকোর্স যার শক্তি এবং অর্থ উৎপন্ন হয় মাঝে-মাঝে বাধা তৈরি করে । জনাথন লাহে ড্রন্সফিল্ড একটি ভিন্ন তর্ক দিবেছেন, যদিও তা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, গোদারের লিখিত পাঠবস্তুর ওপর জোর দেয়াকে  কখনও কখনও ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে ।
    গোদারের কাজের "উৎস" কী এবং সেই উত্সগুলি কীভাবে তার সিনেমাটিক প্রযোজনায় কাজ করে? ড্রনসফিল্ড তাঁর ‘পেডাগগি অফ দি রিটন ইমেজ’ প্রবন্ধে এই উদ্ধৃতিগুলিকে প্রস্থানের একটি প্রাথমিক বিন্দু হিসাবে গ্রহণ করেছেন, সেই প্রস্হানবিন্দু থেকে একটি বৃহত্তর তত্ত্বের বিকাশ ঘটে যে কীভাবে আগে থাকতে লিখে রাখা ছবি—- আন্তঃপাঠ, ফটোতোলা বই, ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদি - গোদারের কাজে হস্তক্ষেপ করে, যেন সেগুলো চলমান চিত্রের এবং শব্দের প্রত্যাশিত খেলা । উইলস, বার এবং ড্রনসফিল্ড প্রমুখের বক্তব্য থেকে, আমরা প্রভাব এবং ধারণার সংক্রমণের এলাকা হিসাবে সিনেমাটিক ভাষার প্রতি গোদারের দৃষ্টিভঙ্গির গাম্ভীর্য এবং সূক্ষ্মতা টের পাই । অর্থাৎ গোদারের দর্শনের উৎস হলো শব্দ, চিত্র, ফ্রেম ইতর‌্যাদির  দার্শনিক ডিসকোর্স ।
     গ্যাব্রিয়েল রকহিল তাঁর "মডার্নিজম অ্যাজ মিসনোমার: গোদার্স আর্কিওলজি অফ দ্য ইমেজ," প্রবন্ধে বলেছেন যে গোদারের  ইমেজ আসলে বিপ্লবী পুনর্বিবেচনার মর্মার্থের প্রসারণ ঘটায় । শার্ল বোদলেয়ারের নন্দনতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, রকহিল বলেছেন গোদারের প্রাথমিক কাজের বেশিরভাগ অংশ   - বিশেষ করে ‘ব্রেথলেস’ - অন্য ধরণের সিনেমা তৈরি করার জন্য তাঁর সংগ্রামকে ইতিহাসভুক্ত করার প্রয়াস, যা পরীক্ষামূলক এবং উদ্ভাবনী উভয়ই, কিন্তু যা মূলত এক "পুনরাবিষ্কার” । সিনেমার অত্যাবশ্যকীয় শক্তিকে ফিরিয়ে আনার পুনরাবিষ্কার । গোদারের এই বিশ্লেষণে, রকহিল সেই কঠিন জায়গায় গোদারকে স্থাপন করতে সক্ষম হন যা বিংশ শতাব্দীর দর্শনকে  সংজ্ঞায়িত করে যেখানে  বিনয় এবং দৃঢ়তার সাথে নান্দনিক কৌশল, চিত্রের সময়, এবং আকাঙ্ক্ষা এবং একটি কাব্যিক প্রকল্প হিসাবে আধুনিকতার ব্যর্থতা পুনর্নবীকরণ করার প্রয়াস করা হয়েছে ।  সর্বোপরি, গোদারকে নিয়ে দার্শনিক কথোপকথনের সূচনা  করছি আমরা ।যার অভিযোজন শুরু থেকেই জটিল, ভাষ্যের অর্থের জটিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং গোদারের চলচ্চিত্রগুলি থেকে উত্তেজক বিতর্কজড়িত।   সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিখুঁত স্পষ্টতা রয়েছে: দর্শক এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে, গোদার একটি নির্দিষ্ট ধরণের দর্শন তৈরি করে গেছেন: সিনেমা এক ধরনের দর্শন হিসেবে। হ্যাঁ,  কিন্তু দর্শনও এক ধরনের সিনেমা হিসেবে।
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.69.***.*** | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:০১738499
  • জাঁ লুক গোদার : জীবন ও সিনেমা
    মলয় রায়চৌধুরী
    আমি পেশাদার ফিল্ম ক্রিটিক নই । কিন্তু একজন আইকনোক্লাস্ট, ফোটোগ্রাফারের ছেলে আর নাতি এবং চিন্তার টেকনিশিয়ান হিসাবে অন্যান্য আইকনোক্লাস্টদের শ্রদ্ধা করি ; তাঁদের কাজ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহী। জাঁ লুক গোদার, যাঁর মৃত্যুতে উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,  "তোমরা যারা সিনেমার ছাত্র, তাঁকে ভালোবাসো— তিনি আমাদের শেষতমদের আইকোনোক্লাস্ট, আ্যনার্কির মহা-মহাশয়, তিনি নিজেই তাঁর বিদায়কালের সময়টা বাছলেন— মনে রেখো তোমরা— এই ইস্কুল চলবে— বন্ধ হবেনা। আর আমাদের এই শোক বিশ্বজুড়ে এ মূহুর্তে রাজতন্ত্রের গেঁজিয়ে ওঠা শোকের মুখে সপাট খাবলে দিক। সিনেমার জয় হোক। আদিউ জিনিয়াস!" আমি এই ইস্কুলের একজন ছাত্র । গোদার সম্পর্কে একসময়ে কিছু অনুবাদ করেছিলুম আর ওতেয়া তত্ব সম্পর্কে লিখেছিলুম । এখন ওনার জীবন আর সিনেমা সম্পর্কে আমার ভাবনা জড়ো করার চেষ্টা করছি  । 
    .
    মৃত্যুর জন্য গোদার যে ১৩ তারিখ বেছে নিলেন, সেটাও আমার মনে হয়েছে গোঁড়া খ্রিস্টধর্মীদের প্রতি ওনার বিদায়বার্তা । লাস্ট সাপার (যিশুর শেষ খাবার গ্রহণের রাত্রি)-এ ১৩ জন মানুষ ছিলেন এবং কথিত আছে যে ১৩ তম আসন গ্রহণের জন্য যিশু অথবা জুডাস (যিশুকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী) নিজে আগ্রহী ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন লাস্ট সাপার গ্রহণ করা হয়েছিল নিসান মাসের ১৩ তারিখে। নিসান হলো ইহুদী ক্যালেন্ডারের একটি মাস। আর কেউ কেউ বলেন ক্রুসবিদ্ধকরণের তারিখ-ও ছিল ১৩ নিসান।ইনকুইজিশনের সময়ে   ফাঁসি কাঠে ওঠার সিঁড়িতে ১৩টি ধাপ থাকত।প্রচলিত আছে যে কারোর নামে যদি ১৩ অক্ষর থাকে, তবে আপনি অভিশপ্ত হতে বাধ্য। ভাগ্য গণনার জন্য বহু বছরের পুরোনো যে অশুভ ট্যারট কার্ড রয়েছে তার মোট ৭৮টি কার্ডের ভিতরে ১৩ নম্বর কার্ডটির মানে হল মৃত্যু! । আগে বিমানে ১৩ নম্বরের কোনও সিট থাকত না। ইউরোপ বা বিশেষ করে আমেরিকায় বহুতল ভবনের লিফটে ১৩ নম্বরের কোনও বোতাম থাকে না, হোটেলে থাকে না ১৩ নম্বর রুম। অভিত্তিকর শোনালেও বেশ কয়েকটি কুখ্যাত খুনীদের নাম যেমন, চার্লস ম্যানসন (Charles Manson), জ্যাক দ্য রিপার (Jack the Ripper), জেফরি দামের (Jeffrey Dahmer), থেডর বানডি (Theodore Bundy) এবং আলবার্ট ডি স্যালভো (Albert De Salvo) ১৩ অক্ষর রয়েছে । Jean Luc Godard নামেও তেরোটি অক্ষর ।
    .
    ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার,  চলচ্চিত্র পরিচালক,  এবং চলচ্চিত্র সমালোচক  জাঁ-লুক গোদার ৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে  প্যারিসের সপ্তম ওয়ার্ডে জন্মেছিলেন । তাঁর বাবা পল  গোদার ছিলেন একজন সুইস ডাক্তার এবং মা ওলদি মনোদ। ছিলেন ব্যাঙ্ক পারিবাসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়েন মনোদের মেয়ে, ধর্মতত্ত্ববিদ আদলফ মনোদের প্রপৌত্রী। জাঁ লুক গোদারের  মায়ের পক্ষের অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে উল্লেখ্য সুরকার জ্যাক-লুই মনোদ, প্রকৃতিবিদ থিওডোর মনোদ, যাজক ফ্রেদেরিক মনোদ, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং পরে পেরুর রাষ্ট্রপতি পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি। জাঁ-লুকের জন্মের চার বছর পর, তাঁর বাবা সপরিবারে ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ড চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময়, গোদার ফ্রান্সে ছিলেন এবং অসুবিধার কারণে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। তিনি যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে, যদিও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জেনেভা হ্রদের ফরাসি দিকটায় তাঁর দাদুর  বাড়িতে লুকিয়ে যাতায়াত করতেন । তাঁর ধনী বাবা-মা ফ্রাঙ্কো-সুইস বংশোদ্ভূত প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারের সদস্য ছিলেন ।
    .
     জাঁ লুক পড়াশুনা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের নিয়নে স্কুলে । ১৯৪৬ সালে, তিনি প্যারিসের বুফোঁ হাইস্কুলে ভর্তি হন আর বৈভবশালী পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্যারিসের  অভিজাত সাংস্কৃতিক সদস্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান। ১৯৪৮ সালে স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করে জাঁ লুক সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানই লুসানে পড়াশোনা করতেন আর বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন, যাদের বিয়ে ভেঙে যাবার কানায় পৌঁছে গিয়েছিল।  তাঁর বড়ো বোন রাচেল তাকে আঁকতে উৎসাহিত করায় জাঁ লুক বিমূর্ত শৈলীতে আঁকা আরম্ভ করেন। থোননের একটা বোর্ডিং স্কুলে  আবার পরীক্ষা দেবার পর, জাঁ লুক পাস করে ১৯৪৯ সালে প্যারিসে ফিরে যান। জাঁ লুক প্যারিস সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু কখনও ক্লাস করেননি ।
    .
    ঘন ঘন সিনেমা দেখার নেশা ছিল না জাঁ লুক গোদারের ।  তিনি প্রথম আন্দ্রে ম্যালরোর প্রবন্ধ আউটলাইন অফ আ সাইকোলজি অফ সিনেমা পড়ার পর  এবং ১৯৪৬  সালে যখন লা রেভ্যু দ্যু সিনেমা পত্রিকা আবার প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হলো তখন  সিনেমার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে । প্যারিসে, ১৯৫০ সালের ঠিক আগে লাতিন কোয়ার্টারে, সিনে-ক্লাবগুলো (চলচ্চিত্র সমিতি) বুদ্ধিজীবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । জাঁ লুক গোদার এইসব ক্লাবে যাতায়াত আরম্ভ করেন—সিনেম্যাথেক ফ্রানসেইজি, সিনে-ক্লাব দ্যু কোয়ার্টিয়ার ল্যাটিন (CCQL), ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার সিনে ক্লাব এবং অন্যান্য—সেগুলোতে গোদার নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন । ১৯৩৬ সালে হেনরি ল্যাংলোই এবং গেয়র্গে ফ্রাঞ্জু  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সিনেমাথেক’। ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার’ নামে শ্রমিকদের জন্য একটা শিক্ষা গোষ্ঠী আরম্ভ করেছিলেন অঁদ্রে ব্যাজাঁ যে মঞ্চে যুদ্ধকালীন চলচ্চিত্র প্রদর্শন আর আলোচনা করা হতো যা লিবারেশনের পরে পুরো ফ্রান্সে মডেল চলচ্চিত্র ক্লাব হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল ।  CCQL, যার প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ বা ১৯৪৮ সালে হয়, তা মরিস শেরারের নেতৃত্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
    এই ক্লাবগুলোতে তিনি জ্যাক রিভেত, ক্লুদ শ্যবরল এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সহ  চলচ্চিত্র উৎহীদের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পান । বন্ধু সংসর্গে গোদার হয়ে উঠলেন এমন একটা প্রজন্মের যুবক যাদের কাছে সিনেমা ব্যাপারটা  বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছিল। গোদার বলেছিলেন: "১৯৫০-এর দশকে সিনেমা ছিল রুটির মতো গুরুত্বপূর্ণ –-কিন্তু এখন আর তা নেই। আমরা ভেবেছিলাম সিনেমা  জ্ঞান প্রসারণের একটি যন্ত্র, একটি মাইক্রোস্কোপ... একটি টেলিস্কোপ হিসাবে নিজেকে জাহির করবে। সিনেমাথেকে  এমন এক জগত আবিষ্কার করেছিলাম যে বিষয়ে কেউ আমাকে আগে কিছু বলেনি। তারা আমাদের গ্যেটে সম্পর্কে বলেছিল, কিন্তু ড্রেয়ার সম্পর্কে নয়। আমরা টকির যুগেও নীরব চলচ্চিত্র দেখতাম। আমরা চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখতাম। আমরা মাটির তলাকার ঘরের খ্রিস্টানদের মতো ছিলাম।"
    .
    চলচ্চিত্রে গোদারের পথচলা শুরু হয় ফিল্ম সমালোচনার এলাকা থেকে । মরিস শেরার (যিনি এরিক রোহমার নামে খ্যাত) এবং জ্যাক রিভেতের সাথে, তিনি স্বল্পস্থায়ী চলচ্চিত্র জার্নাল ‘লা গেজেট দ্যু সিনেমা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১৯৫০ সালে পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশ করে । যখন অঁদ্রে ব্যাজাঁ  ১৯৫০ সালে প্রভাবশালী সমালোচনামূলক ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema,[ সেনেমার নোটবুক ] শুরু করেন, তখন গোদার CCQL/Cinémathèque [ লাতিন কোয়ার্টারের সিনে ক্লাব/ফরাসি সিনেমাথেক] গোষ্ঠীর  প্রকাশিত সমালোচকদের মধ্যে  ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় রুডলফ ম্যাটে পরিচালিত একটি আমেরিকান মেলোড্রামা, ‘নো স্যাড সংস ফর মি’ ফিল্মের রিভিউ করেন গোদার। 
    ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তাঁর "ডিফেন্স অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশন অফ ক্লাসিক্যাল ডিকোপেজ", প্রবন্ধে তিনি  অঁদ্রে ব্যাজাঁর একটি আগের নিবন্ধকে আক্রমণ করেন এবং শট-রিভার্স শট টেকনিকের ব্যবহারকে সমর্থন করেন, তা ছিল সিনেমা সমালোচনায় তাঁর প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির  একটি। অটো প্রিমিংগার এবং "সর্বশ্রেষ্ঠ আমেরিকান শিল্পী-হাওয়ার্ড হকস" এর প্রশংসা করে, গোদার তাদের কঠোর মেলোড্রামাগুলিকে "ওয়েলেস, ডি সিকা এবং ওয়াইলারের আরও "আনুষ্ঠানিক এবং প্রকাশ্যভাবে শিল্পপূর্ণ চলচ্চিত্রের উপরে তুলে ধরেন যা ব্যাজাঁ অনুমোদন করেছিলেন"। সেই মুহুর্তে গোদারের পরিকল্পনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ  ছিল না। বরং, তিনি চলচ্চিত্র দেখতেন, এবং সেগুলি সম্পর্কে লিখতেন, আর অন্যদের চলচ্চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করতেন, বিশেষত রোহমারকে, যাঁর সাথে তিনি Présentation ou Charlotte et son steak [ শার্লট এবং তার মাংসের ফালির উপস্হাপনা ] ফিলমে কাজ  করেছিলেন।
    .
    ফরাসি প্রভাবশালী ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema-এর চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে তাঁর প্রথম কর্মজীবনের সময়, গোদার মূলধারার ফরাসি সিনেমার "ঐতিহ্যের গুণমান"-এর সমালোচনা করেন, যা উদ্ভাবন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিতো না। অমন সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় , তিনি এবং সমমনা সমালোচকরা তাঁদের নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ  শুরু করেন, আর ফরাসী সিনেমার পাশাপাশি হলিউডের ঐতিহ্যকে  চ্যালেঞ্জ করেন। গোদার তাঁর প্রথম ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’-এর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাবার ফলে তিনি ও সমমনা বন্ধুরা ফরাসি La Nouvelle Vague [ নিউ ওয়েভ]  আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন । গোদারের কাজে পাওয়া যায় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং প্রায়ই তাঁর রাজনৈতিক মতামতের প্রকাশ ; তিনি অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদী দর্শনের একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্হাপনের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে  Dziga Vertov Group   [জিগা ভার্তোভ গ্রুপ ] গঠন করেন। নিউ ওয়েভের কিছুকাল পরে, তাঁর রাজনীতিতে উগ্রবাদ ফিকে হয়ে আসে আর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণের বদলে মানবতাবাদী বিশ্বাস, মানব সংঘাত এবং শৈল্পিক উপস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছে ।
    .
    ১৯৫২ সালের শরৎকালে প্যারিস ছাড়ার পর, গোদার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান এবং লুসানে তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকা আরম্ভ করেন । তিনি তাঁর মায়ের প্রেমিক, জাঁ-পিয়ের লবশারের বন্ধু হয়ে ওঠেন । লবশার গ্র্যান্ডে ডিক্সেন্স বাঁধের শ্রমিক ছিলেন। লবশার-এর মাধ্যমে তিনি বাঁধের প্লাজ ফ্লুরি  সাইটে  কর্মী হিসাবে চাকরি করা আরম্ভ করেন। তিনি বাঁধ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কথাও ভেবেছিলেন । তাঁর প্রাথমিক চুক্তি শেষ হলে, চাকরির মেয়াদ বাড়াবার জন্য, গোদার টেলিফোন সুইচবোর্ড অপারেটর পদে যোগ দেন। ডিউটিতে থাকাকালীন, ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে, লবশারের ফোনে তিনি জানতে পারেন যে তাঁর মা ওদিল মনোড  স্কুটার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন । সুইস বন্ধুরা গোদারকে  একটা ৩৫ মিমি মুভি ক্যামেরা ধার দিয়েছিল । সেই ক্যামেরায় তিনি বাঁধটা নিয়ে একটা ফিল্ম তোলেন আর তার নাম দেন ‘অপারেশন কংক্রিট’ । বাঁধ পরিচালন সংস্থা ছবিটি কিনে নিয়ে প্রচারের উদ্দেশ্যে  ব্যবহার করতো ।
    .
    গোদার যখন Cahiers-এর জন্য কাজ করছিলেন, সেসময়ে জেনেভায় Une femme coquette (১৯৫৫), [ একজন ফ্লার্ট মহিলা ] নামে একটা দশ মিনিটের ছোট ফিল্ম তৈরি করেন; আর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে  প্যারিসে ফিরে যান। গ্যোটে-র ‘ইলেকটিভ অ্যাফিনিটিস’ নিয়ে ফিচার ফিল্মের  পরিকল্পনা রূপায়িত করতে পারবেন না অনুমান করে তা বাতিল করেন  । ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সেসময়ে একজন ছিঁচকে অপরাধী মিশেল পোরতাইল-এর সত্যকার অপরাধ-জীবনের ঘটনা নিয়ে একটা  ভাবনাকে ফিল্মে রূপান্তরণের  জন্য গোদারের সাহায্য চান। মিশেল পোরতাইল একজন মোটরসাইকেল-আরোহী পুলিশকে গুলি করে আর তার বান্ধবী তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় । ফিল্মটা তুলতে ত্রুফো ব্যর্থ হন। কোনও আগ্রহী প্রযোজক পাননি তিনি। ত্রুফোর সাথে আরেকটা পরিকল্পনা, প্যারিসে আসা একটি গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে  কমেডি, তাও পরিত্যক্ত হয়েছিল। গোদার তখন দুই তরুণী, শার্লট এবং ভেরোনিকের জীবনকে কেন্দ্র করে একটা ছোটো ফিল্মে রোহমারের সঙ্গে কাজ করছিলেন; আর ১৯৫৭  সালের শরৎকালে, পিয়ের ব্রোনবেয়ার-এর  সিরিজের প্রথম ফিল্ম ‘অল দ্য বয়েজ আর কলড প্যাট্রিক’ , রোহমারের স্ক্রিপ্ট নিয়ে, গোদার পরিচালনা করেন।
    .
    ১৯৫৮ সালে ‘এ স্টোরি অফ ওয়াটার’  মূলত ত্রুফোর অব্যবহৃত ফুটেজ থেকে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে, জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং অ্যান কোলেটকে নিয়ে গোদার তাঁর শেষ ছোটো ফিল্ম Charlotte et son Jules [ শার্লট এবং তাঁর জুলস] তৈরি করেন, যেটা ছিল কবি ও ফিল্মনির্মাতা জাঁ ককতোর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন । ফিল্মটা গোদারের রেনে রোডের হোটেলঘরে শ্যুট করা হয়েছিল আর ফিল্মটায় সেই সময়ে গোদারের নিজের জীবনের ‘টাকা বাঁচানোর রোমান্টিকতা’ প্রতিফলিত হয়েছিল। তার সুইস বন্ধু রোল্যাঁ টলম্যাচফ জানিয়েছেন যে; "প্যারিসে গোদারের হোটেলের  দেওয়ালে শুধু একটা হামফ্রি বোগার্ট পোস্টার ছিল আর অন্য কিছুই ছিল না।”
    .
    ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে, গোদার ত্যুরের ফেস্টিভ্যাল অফ শর্ট ফিল্ম  থেকে প্রতিবেদন পাঠান আর জ্যাক ডেমি, জ্যাক রোজিয়ার এবং অ্যাগনেস ভার্দার কাজের প্রশংসা করেন এবং তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব করেন–-তিনি আগে থেকেই অ্যালাইন রেসনাইসকে চিনতেন যার ফিল্মের তিনি প্রশংসা করেন । কিন্তু গোদার এই সময়ে চাইছিলেন নিজের একটা ফিচার ফিল্ম তৈরি করতে।  ১৯৫৯ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়ে গোদার ত্রুফোকে অনুরোধ করেন সেই গাড়ি চোর মিশেল পোরতাইল সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে যে গল্পটা তাঁরা করতে চেয়েছিলেন তা তাঁকে ব্যবহার করতে দিতে । গোদার প্রযোজক জর্জ দ্য বোগোদেয়ারকে প্রস্তাব দিলেন ফিল্মটার জন্য টাকা খরচ করতে । গোদার তাঁর সাথে আগে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের প্যারিস অফিসের প্রচার বিভাগে কিছুদিন কাজ করার সময় থেকে জানতেন । বোগেদেয়ার পিয়েরে লোটির গল্পের উপর ভিত্তি করে দুটি প্রযোজনা করে বেশ ঋণী হয়ে গিয়েছিলেন । শেষে, ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর রেনে পিগনিয়েরেসের কাছ থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব পেলেন গোদার।
    .
    ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, অ্যাগনেস ভার্দা, এরিক রোহমার এবং জ্যাক ডেমির মতো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে তিনি ষাটের দশকের ফরাসি নিউ ওয়েভ ফিল্ম মুভমেন্টের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি  যুদ্ধোত্তর যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন। আখ্যান, ধারাবাহিকতা, শব্দ এবং ক্যামেরাওয়ার্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর কাজ "মোশন পিকচার ফর্মে বিপ্লব ঘটিয়েছে"। তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে রয়েছে ব্রেথলেস (১৯৬০ ), ভিভরে সা ভি (১৯৬২), কনটেম্পট (১৯৬৩), ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স (১৯৬৪), আলফাভিল (১৯৬৫ ), পিয়েরোট লে ফাউ (১৯৬৫), ম্যাসকুলিন ফেমিনিন (১৯৬৬), উইকেন্ড (১৯৬৭ ) ), ভাষাকে বিদায় (২০১৪)। পরিচালক হিসেবে গোদারের সবচেয়ে চর্চিত সময়কাল তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ব্রেথলেস ( ১৯৬০) থেকে উইক এন্ড (১৯৬৭ ) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে করা তাঁর কাজগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচলিত চলচ্চিত্রের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যা প্রায়শই চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিভিন্ন দিক নির্দেশ সম্পর্কিত। যদিও এই সময়ের কাজগুলো গোদারের ফিল্মনির্মাণ জীবনের নিজস্বভাবে যুগান্তকারী হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে পরবর্তী সময়ে গোদার আদর্শগতভাবে সিনেমার ইতিহাসের বেশিরভাগ অংশকে বুর্জোয়া হিসাবে নিন্দা করেছেন আর বলেছেন তারা যোগ্যতাহীন ।
    .
    গোদারের জলবিভাজক ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’ (À bout de souffle, ১৯৬০ ), জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং জিন সেবার্গ অভিনীত ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের শৈলীকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়েছে— বিশেষ করে আমেরিকান সাদাকালো ফিল্ম থেকে । ফিল্মটিতে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে যেমন জাম্প কাটের উদ্ভাবনী ব্যবহার (যা সেই সময়ে অপেশাদার হিসেবে বিবেচিত হত), চরিত্রকে বাদ দিয়ে, এবং ধারাবাহিকতা সম্পাদনায় দৃষ্টিরেখার মিল ভাঙা। ব্রেথলেসের আরেকটি অনন্য দিক ছিল শুটিংয়ের দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্রনাট্য লেখা - এমন একটি কৌশল যা অভিনেতাদের অস্থির করে তুলেছিল - যা চলচ্চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত, তথ্যচিত্রের মতো পরিবেশে ছিল নতুন অবদান ।
    .
    তাঁর কর্মজীবনের শুরু থেকে, গোদার তাঁর ফিল্মে নিউ ওয়েভ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি চলচ্চিত্রের উল্লেখ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ব্রেথলেস-এ, তার উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে রয়েছে হামফ্রে বোগার্টকে দেখানো একটি সিনেমার পোস্টার- দ্য হার্ডার দ্য ফল থেকে, তাঁর শেষ চলচ্চিত্র–(যাঁর অভিব্যক্তি প্রধান অভিনেতা জাঁ-পল বেলমন্ডো শ্রদ্ধার সাথে অনুকরণ করার চেষ্টা করেন) - ইঙ্গমার বার্গম্যান, স্যামুয়েল ফুলার, ফ্রিৎস লাঙের চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল উদ্ধৃতি ; এবং মনোগ্রাম পিকচার্সের প্রতি একটি অনস্ক্রিন উৎসর্গ, একটি আমেরিকান বি-মুভি স্টুডিও। যাঁদের উদ্ধৃতি, এবং সাহিত্যের উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন উইলিয়াম ফকনার, ডিলান থমাস, লুই আরাগঁ, রিল্কে, ফ্রাসোয়াঁ সাগাঁ এবং মরিস শ্যাক্স প্রমুখ। ছবিটিতে ইমেজ বা সাউন্ডট্র্যাকের উদ্ধৃতিও রয়েছে—মোৎসার্ট, পিকাসো, জে এস বাখ, পল ক্লি এবং অগাস্ট রেনোয়ার। "ব্রেথলেস ফিল্মটা পরিচালকের অভিজ্ঞতা নয়, তাঁর উপস্থিতিকে জাহির করেছে"।
    .
    ১৯৬৮ সালের মে মাসের ঘটনার পর, যখন প্যারিস শহর চার্লস দ্য গলের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে  একটি যুবছাত্র  উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল তখন গোদার তাঁর পেশাগত উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হব। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সহযোগী ছিলেন জিন-পিয়ের গোরিন,  (লুই আলথুসার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক লাকাঁর মাওবাদী ছাত্র )। গোরিনের সিনেমার প্রতি আবেগ গোদারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। 
    .
    ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে, গোদার আর গোরিন দুজনে মিলে মাওবাদী বার্তা প্রচারের  মোট পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সহযোগিতার সবচেয়ে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রটি ছিল Tout Va Bien ( ১৯৭২ )। ফিল্মে জেন ফন্ডা অভিনয় করেছিলেন, যিনি সেই সময়ে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা রজার ভাদিমের স্ত্রী ছিলেন। ফন্ডা তাঁর অভিনয় জীবনের তুঙ্গে ছিলেন সেসময়ে , সদ্য Klute (১৯৭১ ) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য একাডেমি পুরস্কার জিতেছেন এবং একজন বামপন্থী যুদ্ধবিরোধী কর্মী হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। নায়ক ছিলেন কিংবদন্তি ফরাসি গায়ক এবং অভিনেতা ইভেস মন্ট্যান্ড, যিনি জর্জেস ক্লুজট, অ্যালেন রেসনাইস, সাচা গুইট্রি, ভিনসেন্টে মিনেলি, জর্জ কুকর এবং কোস্টা-গাভরাসের  চলচ্চিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন।
    .
    ১৯৬৮ সালের মে থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত গোদারের জীবনের বিস্তৃত সময়কালকে বিভিন্ন লেবেল দেওয়া হয়েছে - তাঁর "জঙ্গি" সময় থেকে তাঁর "রেডিকাল’ বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের  সাথে "মাওবাদী" হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছেন  এবং "রাজনৈতিক" ফিল্মনির্মাণকারী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন।  এই কালখণ্ডে গোদার তাঁর চলচ্চিত্রে এবং সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায়  বৈপ্লবিক সমাজবদলের ওপর জোর দিয়েছেন। ১৯৬৮  সালে ছাত্রদের মে অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে, গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’র সাথে, ছাত্র ও শ্রমিকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৯৬৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বন্ধ করে দিতে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। শ্রমিকদের গোদার বলেছিলেন যে উৎসবে একটিও চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে না যা তাদের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে। "একটি ফিল্মও নয়, তা সে ফরম্যান মিলোস , আমি নিজে, রোমান পোলানস্কি বা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, যারই হোক না কেন। একটাও ফিল্ম নেই। আমরা সময়ের থেকে অনেক পেছনে রয়েছি।”
    .
    ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে গোদার "রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ" সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যদিও ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তাঁর অনেকগুলি ফিচার-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ছিল কম বাজেটের এবং এই ফিল্মগুলোয় একটি চলচ্চিত্র কী হতে পারে তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে আরম্ভ করে। মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ পরিত্যাগ করার পাশাপাশি, গোদার তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের কাল্ট থেকেও মুক্তি পেতে চাইছিলেন । তিনি অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে  বেনামে কাজ করছিলেন, বিশেষত জাঁ-পিয়ের গোরিনের সঙ্গে , যাদের নিয়ে তিনি ডিজিগা-ভার্তোভ সিনেমা গোষ্ঠী গঠন করেছিলেন। এই কালখণ্ডে গোদার ইংল্যান্ড, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, প্যালেস্টাইন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ফ্রান্সেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
    .
    তিনি এবং গোরিন তাঁদের ফিল্ম নিয়ে বিভিন্ন কলেজে গিয়ে বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতেন ।  ইয়েভেস মন্ট্যান্ড আর জেন ফন্ডা অভিনীত বেশি বাজেটের ফিল্ম Tout Va Bien [ সবকিছু ভালোভাবেই চলছে ] তৈরি করার সময়ে তাঁর জীবনের বাঁকবদল ঘটলো । একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে গোদার গুরুতরভাবে আহত হবার ফলে গোরিন প্রায় এককভাবে  তাঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত এই কাজটি পরিচালনা করেছিলেন। Tout va bien-এর পরবর্তী পর্ব হিসাবে, তাঁরা দুজনে Letter to Jane নামে একটি পঞ্চাশ মিনিটের ফিল্ম তৈরি করেন যাতে  জেন ফন্ডার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েত কং যোদ্ধাদের সাথে মেলামেশার স্হির ছবিগুলোকে সাজিয়ে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রটি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিনির্মাণ। এটাই ছিল গোদার আর গোরিনের একসঙ্গে তৈরি শেষ চলচ্চিত্র।
    .
    গোদার  তাঁর "উগ্র রাজনৈতিক মতামত" এর জন্য পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে নিয়মিত রাজনৈতিক বিষয়বস্তু দেখাতেন। তাঁর প্রথম দিকের ফিল্মগুলোর মধ্যে একটি, দ্য লিটল সোলজার, যার বিষয়বস্তু ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ,  বিবাদটার জটিলতা উপস্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য উল্লেখ্য ।  আন্তর্জাতিক সমস্যার পাশাপাশি গোদার  ফ্রান্সের সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিচলিত ছিলেন। এর প্রথম এবং সর্বোত্তম উদাহরণ হল Vivre sa vie-তে কারিনার  পতিতা চরিত্রে শক্তিশালী চিত্রায়ন। ষাটের দশকের প্যারিসে, রাজনৈতিক পরিবেশ কোনও একটা নির্দিষ্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েনি ; নানা ছোটোবড়ো আন্দোলন চলছিল ।  উত্তর আফ্রিকা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলোর  আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে যুদ্ধ-পরবর্তী একটি স্বতন্ত্র আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল ফরাসি সমাজে। La Chinoise এবং Weekend ফিল্মের পর গোদারের মার্কসবাদী মনোভাব স্পষ্ট হতে থাকে, আর তা ধরা পড়ে তাঁর  Pierrot [চড়ুই ] আর Une femme mariée [একজন বিবাহিতা মহিলা ] ফিল্মগুলোতে ।
    .
    জার্মান কবি ও নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের সাথে গডার্ডের সম্পর্ক ছিল মূলত ব্রেখটের এপিক থিয়েটারের তত্ত্বকে ফিল্মে প্রয়োগ ।  ব্রেখটের প্রভাব গোডার্ডের বেশিরভাগ কাজের মাধ্যমে গভীরভাবে অনুভূত হয়, বিশেষ করে ১৯৮০ সালের আগে, যখন গডার্ড নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের জন্য সিনেমাটিক অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন। যেমন, ব্রেথলেস ফিল্মে  এলিপটিকাল সম্পাদনা, যা দর্শককে মূলধারার সিনেমার  সরল ন্যারেটিভ শৈলীকে বর্জন  করে, দর্শকদের আরও সমালোচনামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য করে । গোদারের বেশিরভাগ রাজনৈতিক ফিল্মে , বিশেষ করে Weekend, Pierrot le fou এবং La Chinoise-তে  চরিত্রগুলো সরাসরি দর্শকদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতিকে বার্তা পাঠায় ।
    .
    গোদারের প্রথম দিকের সব কয়টা ফিল্মে দেখা না গেলেও বেশিরভাগ ফিল্মের মার্কসবাদী পাঠ সম্ভব। মার্কসবাদের সাথে গোদারের সরাসরি মিথস্ক্রিয়া Weekend ফিল্মের আগে স্পষ্ট হয় না, যে ফিল্মে কার্ল মার্কস নামটি যিশু খ্রিস্টের মতো অবতারের সঙ্গে একইসাথে উচ্চারিত। গোদারের সিনেমার পুরো কালখণ্ড জুড়ে একটা নিরবিচ্ছিন্ন অভিযোগ হল বুর্জোয়াদের ভোগবাদ, দৈনন্দিন জীবন ও কার্যকলাপের পণ্যীকরণ, এবং মানুষের এলিয়েনেশান—- মার্কসের পুঁজিবাদের সমালোচনার সমস্ত কেন্দ্রীয় বিতর্ক।
    .
    ১৯৬৮ সালে দুই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, জাঁ-লুক গোদার এবং জাঁ-পিয়ের গোরাঁ জিগা ভার্তোভ গ্রুপ নামে একটা গোষ্ঠী তৈরি করেন। জঁ অঁরি রোজে এবং আরমাঁ ম্যাকো ১৯৬৯ সালে এই গোষ্ঠীতে যোগদান করেন। তাদের চলচ্চিত্রগুলো প্রাথমিকভাবে ব্রেখটিয়ান আঙ্গিক, মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং রচনা থেকে  লেখকর স্বামীত্ব বাদ দেবার প্রচেষ্টা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। ১৯২০-৩০ এর দশকের সোভিয়েত চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিজিগা ভার্তোভের নামে এই গ্রুপটা ১৯৭২ সালের Letter to Jane : An Investigation About a Still-এর  পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
    .
    এটা ছিল প্যারিসের ষাটের দশকের ছাত্র-বিপ্লবের পৃষ্ঠপটে একটি রাজনৈতিকভাবে র‌্যাডিক্যাল ফিল্ম গোষ্ঠী । মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং মাওবাদী তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, যা প্যারিসের সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আবহাওয়াকে গভীরভাবে প্রবাভিত করেছিল আর ফিল্মনির্মাণকে বুর্জোয়া উদ্যোগ হিসাবে  মর্যাদায়  অসন্তুষ্ট হয়ে এই গোষ্ঠীটি কেবল রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, রাজনৈতিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাতের পর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিদেশ নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর জন্ম ঘটিয়েছিল, যারা চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ লুক গোদার এবং জাঁ পিয়ের গোরাঁর নেতৃত্বে ডিজিগা ভার্তোভ গ্রুপ ছিল সত্যিকার অর্থে  সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনৈতিক সিনেমার ব্র্যান্ড গড়ে তোলার  এমনই একটি প্রচেষ্টা।
    .
    জিগা ভার্তোভ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত সিনেমাটিক ব্যবস্হার প্রতিটি দিককে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল এবং তার দরুন, নির্দিষ্ট কয়েকটি সহমর্মী সম্প্রদায়ের বাইরে খুব কম প্রচারিত হয়েছে ও দর্শক আকৃষ্ট করতে পেরেছে।  একটি বিপ্লবী সিনেমার উদ্দেশ্যে কাজ করার এবং প্রযোজনা, নির্দেশনা এবং প্রদর্শনীর জনপ্রিয় মডেলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার এই বিরোধিতামূলক অবস্থান গোষ্ঠীর পক্ষে এক ধরণের অচলাবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। যাইহোক, সত্যিকারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা রয়েছে এমন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর সংশ্লিষ্ট লোকজনদের জন্য এই গোষ্ঠীর চলচ্চিত্রগুলি অপরিহার্য সমাবেশ-কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।
    .
    Letter to Jane  (১৯৭২ ) ছিল  একটি ফিচার-ফিল্ম দৈর্ঘ্যের প্রযোজনা যা   উত্তর ভিয়েতনামী প্রতিরোধ বাহিনীর মাঝে শুধুমাত্র জেন ফণ্ডার স্থির ছবি জুড়ে-জুড়ে  ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে  একটি একক চিত্রকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করে। অকল্পনীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নির্মমভাবে সমালোচনামূলক, ছবিটি ইমেজ তৈরির রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয় ফিল্ম। সম্ভবত অন্য যে-কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের চেয়ে বেশি, জিগা ভার্তোভ গ্রুপটি প্রচলিত সিনেমাটিক মডেলকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার মানে কেবল জনপ্রিয় সিনেমা এবং আর্টহাউস প্রযোজনা উভয়েরই প্রত্যাখ্যান নয়, যাকে গ্রুপটা মনে  করেছিল যে ওগুলো শুধু প্রভাবশালী পুঁজিবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করে আর  প্রযোজনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনীর পুঁজিবাদী মডেলগুলোকে রক্ষা ধরে। প্রতিরূপের সমস্যাটি ছিল ডিজিগা ভার্তোভ গ্রুপের অন্যতম দুশ্চিন্তা, যার চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয় ইমেজ তৈরির  রাজনৈতিক অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করতে চাইছিল। নন-ন্যারেটিভ এবং প্রাবন্ধিক বিন্যাস প্রয়োগ করে, গোষ্ঠীর ফিল্মগুলো শব্দ, ইমেজ এবং দর্শকদের একটি অসংলগ্ন কেরামতির মাধ্যমে ব্যবহার করতো যাতে মানে তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য  প্ররোচিত হয়। এই চলচ্চিত্রগুলি  লেখকসত্বের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করতো, যা স্পষ্ট হয়ে উঠতো তাদের যৌথ স্বাক্ষর থেকে ।
    .
    গোদার তাঁর পরিচালিত ফিল্মের দুই নায়িকাকে বিয়ে করেছিলেন: আনা কারিনা (১৯৬১-১৯৬৫) এবং অ্যান উইজেমস্কি (১৯৬৭-১৯৬৯)। ১৯৭০ সালের শুরুতে, তিনি অ্যান-মারি মিভিলের সাথে ফিল্ম নির্মাণের সূত্রে পেশাগতভাবে এক সঙ্গে কাজ করা আরম্ভ  করেন। গোদার ১৯৭৮ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের রোলেতে মিভিলের সাথে বসবাস করতেন ।তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী করিনা গোদারকে "নির্জনবাসী" হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷ গোদারের একজন উপদেষ্টা প্যাট্রিক জেনারেটের মতে, ২০১০ সালে গোদার মিভিলকে বিয়ে করেন৷
    .
    কারিনার সাথে তাঁর সম্পর্কের সময়ে গোদার সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে সংবাদপর্র ও পত্রিকায় ব্যাপকভাবে খবর বেরোতো: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট তাঁদের  দুজনকে “১৯৬০ এর দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত জুটিগুলির মধ্যে একটি" হিসাবে বর্ণনা করেছিল৷ ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতাকে "তর্কাতীতভাবে   সবচেয়ে প্রভাবশালী জুটি যাঁরা সিনেমার ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখে গেছেন।" জীবনের শেষ দিকে,, করিনা বলেছিলেন যে তাঁরা আর একে অপরের সাথে কথাবার্তা বলেন না।
    .
     মিশেল অ্যাভেনিয়াশূ ২০১৭ সালে ওয়ান ইয়ার আফটার (ফরাসি: Un an après; ২০১৫) নামে ওয়াইজামস্কির লেখা রচিত স্মৃতিকথার উপর ভিত্তি করে গোদার সম্পর্কে  Redoubtable ফিল্ম চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। ফিল্মটা ষাটের দশকের শেষের দিকে তার জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি, যখন গোদার আর ওয়াইজেমস্কি একসঙ্গে ফিল্ম  তৈরি করতেন। ফিল্মটা ২০১৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। গোদার বলেছিলেন যে ছবিটা তৈরি করার ধারণা একদম বোকা, বোকা ।
    .
    করিনার সাথে তার সহযোগিতায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম তৈরি হয়েছিল, যেমন Vivre sa vie ( ১৯৬২ ) Bande a part ( ১৯৬৪ ),  এবং Pierrot le Fou (১৯৬৫ ) যেগুলো সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ফিল্মগুলো "তর্কাতীতভাবে সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজ" । ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন ২০০২  সালের একটি ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ জরিপে, জাঁ লুক গোদার সর্বকালের সেরা দশ জন পরিচালকের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ২০১০ সালে, গোদার একাডেমির অনারারি পুরস্কারে ভূষিত হন, কিন্তু তিনি পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি ।
    .
    গোদার Sauve qui peut ( la vie) ( ১৯৮০) ফিল্মের সময় থেকে কিছুটা ঐতিহ্যগত কথাসাহিত্যে ফিরে যান, যেগুলোতে  আত্মজীবনীমূলক ঘটনার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় । তিনি মূলধারার চলচ্চিত্রগুলোর অনুসরণে একটি সিরিজের করেন: Passion, ( ১৯৮২ ) Lettre a Freddy Bauche ( ১৯৮২ ) ,Prenom Carmen ( ১৯৮৩ ) এবং Grandeur et decadence d’un petit commerce de cinema ( ১৯৮৬ ) ।  Je vous salue, Marie ( ১৯৮৫) ফিল্মটা নিয়ে আরেকটা বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, যেটাকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ  ধর্মদ্রোহিতার নামে  নিন্দা করেছিল আর এছাড়াও উইলিয়াম শেক্সপিয়রকে নিয়ে  প্রবন্ধমূলক চলচ্চিত্র King Lear ( ১৯৮৭ ) নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয় ।
    .
    তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলি অসাধারণ আনুষ্ঠানিক সৌন্দর্য এবং প্রায়শই শোকের অনুভূতিতে প্রচ্ছন্ন : Nouvelle Vague  (নিউ ওয়েভ, ১৯৯০), আত্মজীবনীমূলক JLG/JLG, autoportrait de decembre (JLG/JLG: সেলফ-পোর্ট্রেট ইন ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ), এবং For Ever Mozart (১৯৯৬)। Allemange annee 90 neuf zero (জার্মানি ইয়ার 90 নাইন জিরো, ১৯৯১ ) যা Alphaville ফিল্মের পরিশিষ্ট, তবে ফিল্মটিতে  সুমধুর এলেজিয়াক  সুরের মিশ্রন ছিল এবং বয়সের অনিবার্য ক্ষয়কে প্রদর্শন করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে, গোদারকে ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ফিল্ম ক্রিটিকস-এর পক্ষ  থেকে একটি বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮-এর মধ্যে, তিনি বহু-অংশযুক্ত Histoire( s ) du cinema সিরিজ  তৈরি করেছিলেন ; এটি একটি স্মারক প্রকল্প যা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সমস্যাগুলি নিয়ে তৈরি ।
    .
    ২০০১ সালে, Éloge de l'amour (In Praise of Love) মুক্তি পায়। সিনেমাটায় ফিল্ম আর ভিডিও দুটিরই ব্যবহার করেছিলেন গোদার  - প্রথমার্ধটি ৩৫ এমএম কালো এবং সাদাতে তোলা হয়েছে, পরবর্তী অর্ধেক ডিজিটাল ভিডিওতে রঙিন শট নেয়া হয়েছে - তারপর তাকে  সম্পাদনার জন্য চলচ্চিত্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ফিল্মটায় বার্ধক্য, প্রেম, বিচ্ছেদ আর ফিরে পাওয়াকে বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে । ফিল্মটায়  এডগার নামের এক তরুণ শিল্পীর  প্রেমের চারটি পর্যায়কে পর্যালোচনা করা হয়েছে ।  Notre musique (২০০৪) ফিল্মে  গোদার আরেকবার যুদ্ধের দিকে দর্শকদের চোখ আর মনকে ফেরত নিয়ে আসেন, বিশেষ করে সারাজেভোর যুদ্ধ, এমনকি নানা যুদ্ধের ক্ষতিকর দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, যেমন আমেরিকান গৃহযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে যুদ্ধ এবং ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত সহ সমস্ত যুদ্ধের দিকে ক্যামেরার চোখ ঘুরিয়ে ছিলেন গোদার। ফিল্মটি ডিভাইন কমেডির তিনটি দান্তীয় রাজ্যকে অবলম্বন করে তৈরি: নরক, প্রায়শ্চিত্তের এলাকা এবং স্বর্গ। কূটাভাসের প্রতি গোদারের আকর্ষণ এই ফিল্মের দেখতে পাওয়া যায় । ফিল্মটি যুদ্ধের ছবিগুলোর একটা দীর্ঘ, বিস্ময়কর মন্তাজ দিয়ে শুরু হয় যা মাঝে মাঝে হাস্যরসের উদ্রেক করে । দেখানো হয়েছে সমুদ্র সৈকতে  মার্কিন সৈন্যরা গাছগাছালিতে ভরা স্বর্গে অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে ।
    .
    গোদারের Film Socialisme (২০১০)  কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে Un Certain Regard বিভাগে ২০১০ সালেই প্রিমিয়ার হয়েছিল। ফিল্মটা ২০১০  সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ২০১৩ সালে, গোদার Les trois désastres (The Three Disasters) চলচ্চিত্র নির্মাতা পিটার গ্রিনওয়ে আর এডগার পেরার সাথে  3X3D এর অংশ হিসাবে তৈরি করেন। 3X3D ২০১৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিল। গোদারের ২০১৪  সালের চলচ্চিত্র Goodbye to Language, থ্রি ডাইমেনশনে তোলা, এমন এক দম্পতিকে ঘিরে যারা একে অপরের সাথে বার্তা বিনিময় করতে পারেন না আর তাই তাদের পোষা কুকুর তাদের জন্য দোভাষী হিসাবে কাজ করে । ফিল্মটিতে নিকোলাস ডি স্টায়েলের চিত্রকর্ম এবং উইলিয়াম ফকনারের লেখার  বিস্তৃত  উল্লেখ আছে, সেইসাথে গণিতবিদ লরেন্ট শোয়ার্টজের প্রসঙ্গে এবং নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের কথা —গোদারের ওপর যাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ফিল্মটা ২০১৪ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রধান প্রতিযোগিতা বিভাগে পালমে ডি'অরের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল আর  জুরির পুরস্কার পায় । চলচ্চিত্রটির জন্য ব্যবহৃত গোদারের হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট আর ছবির কোলাজকে শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ।
    ..
    ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে, মিলানের ফন্ডাজিওন প্রাদা-তে গোদারের তৈরি একটি আর্ট ইনস্টলেশন দেখানো হয়। লে স্টুডিও ডি'অর্ফি শিরোনাম, ইনস্টলেশনটি গোদারের একটি পুনঃনির্মিত কর্মক্ষেত্র হিসেবে উপস্হাপিত হয়েছিল আর সেখানে সম্পাদনা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র এবং গোদারের পোস্ট-প্রোডাকশনে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণ রেখে প্রদর্শনী করা হয়েছিল ।
    .
    গোদার ২০২০ সালে Les Inrockuptibles পত্রিকাকে বলেছিলেন যে তাঁর নতুন ফিল্মটা একজন  “হলুদ ভেস্ট প্রতিবাদী” সম্পর্কে হবে এবং ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আর্কাইভাল ফুটেজের সাথে " শুটিংও হবে। আমি জানি না যে  অভিনেতাদের খুঁজে পাব কিনা... আমরা নিউজ চ্যানেলে যে লোকদের দেখি তাদের নিয়ে ফিল্ম করতে চাই আর তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই যেখানে তথ্যচিত্র এবং কথাসাহিত্য এক হয়ে যায়।" ২০১৮ সালের মে মাসে পোস্ট করা একটা অনলাইন পিটিশন প্রায় দশ লক্ষ লোক স্বাক্ষর ণ করার পরে, ফ্রান্সে ১৭ নভেম্বর গণ বিক্ষোভ শুরু হয় যাতে সরকারি হলুদ ভেস্ট পরা প্রতিবাদীর সংখ্যা বেশি ছিল। আন্দোলনটি প্রাথমিকভাবে অপরিশোধিত তেল আর জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে শুরু হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা যুক্তি দিয়েছিল যে ফ্রান্সে করের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝা শ্রমিক এবং মধ্যবিত্তদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ।
    .
    ২০২১ সালের মার্চ মাসে  কেরালার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি ভার্চুয়াল সাক্ষাত্কারের সময় গোদার বলেছিলেন যে তিনি দুটি নতুন ছবি নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। গোদার বলেছিলেন "আমি আমার চলচ্চিত্র জীবন শেষ করছি - হ্যাঁ, আমার চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবন - দুটি স্ক্রিপ্টের ফিল্ম করে... তারপর, আমি বলব, 'বিদায়, সিনেমা'।
    .
    গোদার  বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম নেতা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৯ সালে, চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট সিনেমায় গোদারের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন: “গোদার একেবারে প্রথম সারির একজন পরিচালক; ষাটের দশকে অন্য কোনো পরিচালক ফিচার-লেংথ ফিল্মের বিকাশে তাঁর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেনি। কথাসাহিত্যে জয়েস বা থিয়েটারে বেকেটের মতো, তিনি একজন পথপ্রদর্শক যাঁর বর্তমান কাজ সাধারণ দর্শকদের কাছে ততো গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু অন্যান্য পরিচালকদের উপর তাঁর প্রভাব ধীরে ধীরে এমন একদল দর্শক তৈরি এবং শিক্ষিত করে তুলছে যা, সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলির দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য  হবে এবং দেখতে পাবে যে এখান থেকেই তাদের সিনেমা শুরু হয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো একটি প্রযোজনা সংস্থার নাম দেন ‘এ ব্যান্ড অ্যাপার্ট’, যা ছিল গোদারের ১৯৬৪ সালের একতা চলচ্চিত্রের নাম। ইতালীয় পরিচালক বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চি তাঁর চলচ্চিত্র দ্য ড্রিমার্স-এ গোদারের ‘ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স’ ফিল্মকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে ছিলেন।
    .
    গোদারের কাজ এবং উদ্ভাবনগুলো মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি, সত্যজিৎ রায় এবং অরসন ওয়েলেসের মতো উল্লেখযোগ্য পরিচালকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে । পরিচালক হিসেবে গোদারের অসাধারণ ফিল্মনির্মাণের কারণে ফ্রিটজ ল্যাং গোদারের চলচ্চিত্র Le Mepris-এ অংশ নিতে রাজি হন। আকিরা কুরোসাওয়া 'ব্রেথলেস'কে তার একশোটি প্রিয় চলচ্চিত্রের অন্যতম হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন৷ রাজনৈতিক কর্মী, সমালোচক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা তারিক আলী ২০১২  সালের সাইট অ্যান্ড সাউন্ড সমালোচকদের জরিপে গোডার্ডের চলচ্চিত্র Tout Va Bien-কে তার সর্বকালের দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন৷ মার্কিন ফিল্ম সমালোচক আরমন্ড হোয়াইট একই জরিপে গোদারের ফিল্ম Nouvelle Vagueকে তাঁর সেরা দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন।
    .
    ভারতে, Adieu Godard ফিল্মের প্রযোজক স্বস্তিক চৌধুরী বলেছেন যে অনুরাগ কাশ্যপের ‘গুলাল’, ‘দেব.ডি’ এবং ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলি গোদারের নিয়ম ভাঙা সিনেমার সাক্ষ্য দেয়। পরিচালক কমল স্বরূপের ‘ওম-দার-বি-দার’, ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দ্বারা প্রযোজিত ১৯৮৮ সালের একটি পোস্টমডার্নিস্ট ফিল্ম, বলা হয় যে সেটি গডার্ড এবং তার মুক্ত-প্রাণ, অস্থির এবং নাটকীয়ভাবে তীব্র গল্প দ্বারা প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
    .
    ষাটের দশক থেকে, নব্বইয়ের দশক হয়ে, এবং সহস্রাব্দের মধ্যে, ভারতে গোদারের সমসাময়িক - মণি কৌল, কুমার শাহানি, সত্যজিৎ রায়, অদুর গোপালকৃষ্ণান, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক - ফরাসি ফিল্মের নতুনত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আর ভারতে নিজস্ব তরঙ্গের সূচনা করেছিলেন যাকে অনেকে বলেন কমার্শিয়াল সিনেমার বিপরীতে সমান্তরাল সিনেমা।
    .
    তাঁর মার্কসবাদী ঝোঁকের কারণে, গত কয়েক দশকের মালয়ালম এবং বাংলা সিনেমায় গোদারের প্রচুর শিষ্য গড়ে উঠেছে। ডন পালাথারা'র ‘এভরিথিং ইজ সিনেমা’ (২০২১) শুধু যে গোদারের জীবনী থেকে এর শিরোনাম নিয়েছে তাই নয়. এমনকি তাঁর জাম্প কাট, সাউন্ড ডিজাইনিং এবং দর্শকদের গল্প বলার অভিজ্ঞতার সাথে নিমগ্ন ও বাধা দেওয়ার উপায়গুলিও নিয়েছে। কেরালায় গল্পের দিক থেকে গোদারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র, ‘মায়ানাধি’, আশিক আবু দ্বারা পরিচালিত এবং সহ-প্রযোজিত। গোদার যে সামাজিক-রাষ্ট্রিক আধিপত্য এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং  প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মুখ হয়ে উঠেছেন তা কেরালার সিনেমায় স্পষ্ট নজরে পড়ে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি সাজানো-গোছানো নয়, তাঁর নান্দনিকতা জৈব, স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাঁর শৈলীতে একটি অতি সত্যতা এবং স্পষ্টতার অনুভূতি রয়েছে। তাঁর পরে প্রতিটি সিনেমাই তাঁর কাছ থেকে নিয়েছে। গোদারের আগে এবং পরবর্তী সিনেমাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে  ফর্ম, ভাষা এবং শৈলীতে বিশাল পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:২৬738529
  • অভিশপ্ত কবিরা – ভেরলেন, রেঁবো, মালার্মে, করবিয়ের প্রমুখ : মলয় রায়চৌধুরী
      ‘পোয়েত মদি’ ( Poète maudit ) বা ‘অভিশপ্ত কবি’ নামে ১৮৮৪ সালে ফরাসি প্রতীকবাদী ও ‘ডেকাডেন্ট’  কবি পল ভেরলেন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন । অভিধাটি ১৮৩২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন অ্যালফ্রেদ দ্য ভিনি ( Alfred de Vigny ) তাঁর  ‘স্তেলো’ উপন্যাসে ; তিনি বলেছিলেন ‘পোয়েত মদি’ হিসাবে চিহ্ণিত লোকগুলোকে জগতের ক্ষমতাধর মানুষেরা চিরকাল অভিশাপ দেবে।  ত্রিস্তঁ করবিয়ের (Tristan Corbière ) , জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, মারসেলিঁ দেবোর্দে-ভামো ( Marceline Desbordes-Valmore ) এবং আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে  আদঁকে ( Auguste Villiers de l’Isle-Adam ) পল ভেরলেন চিহ্ণিত করেছিলেন অভিশপ্ত কবি হিসাবে । এই তালিকায় তিনি নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পুভ লেলিয়ান ( Pauvre Lélian ) ছদ্মনামে । উল্লেখ্য যে ১৮৮৪ সালে স্ত্রী মাতিলদে ভেরলেনকে আইনত ডিভোর্স করেছিলেন ।
              পল ভেরলেন তাঁকে ‘অভিশপ্ত কবি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ত্রিস্তঁ করবিয়ের ( ১৮৪৫ – ১৮৭৫ ) ফরাসি আলোচকদের কাছে সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিলেন ; বহুকাল পরে এজরা পাউণ্ড ও টি. এস. এলিয়ট তাঁর কবিতা বিশ্লেষণের পর ত্রিস্তঁ করবিয়েরকে কাব্যসাহিত্যে গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হয় । করবিয়েরের মা, মারি-অঞ্জেলিক-আসপাসি পুয়ো’র বয়স যখন উনিশ তখন করবিয়েরের জন্ম হয় । তাঁর বাবা আঁতোয়াঁ-এদুয়া করবিয়ের ‘লে নেগরিয়ের’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । রাজকীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ১৮৫৮ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত পড়ার সময়ে তিনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন এবং রিউমেটিজমের কারণে হাত-পা বিকৃত হয়ে যায় । বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুলে দেবার এবং শারীরিক বিকৃতির দরুন তিনি বাবা-মাকে দোষ দিতেন । স্কুলের কড়া নিয়মনীতি ও শিক্ষদের প্রতি ঘৃণা তাঁর কবিতায় একটি বিশেষ কন্ঠস্বর গড়ে দিতে পেরেছে।করবিয়ের মারা যান যক্ষ্মারোগে, মাত্র তিরিশ বছর বয়সে । করবিয়েরের একটি কবিতা :
    বিপরীত কবি
    আরমোরিকার সাগরতীরে । একটি নির্জন মঠ ।
    ভেতরে : বাতাস অভিযোগ করছিল : আরেকটা হাওয়াকল ।
    এলাকার সমস্ত গাধা বীজসুদ্ধ আইভিলতায় তাদের দাঁত ঘষতে এসেছিল
    ফুটোয় ভরা এমনই এক দেয়াল থেকে যা কোনও জীবন্ত মানুষ
    দরোজার ভেতর দিয়ে ঢোকেনি।
    Advertisements
    REPORT THIS AD
    একা— তবু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, ভরসাম্য বজায় রেখে,
    একজন বুড়ির থুতনির মতন ঢেউখেলানো
    তার ছাদ কানের পাশে চোট দিয়েছিল,
    হাবাগবা মানুযের মতন হাঁ করে, মিনারটা দাঁড়িয়েছিল ।
              অভিশপ্ত কবি জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর ( ১৮৫৪ – ১৮৯১ ) কবিতার সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত ; তাঁর ‘ইল্যুমিনেশানস’ বইটির নামকরণ করেছিলেন পল ভেরলেন । বইটি থেকে ‘শহর’ শিরোনামের গদ্যকবিতা :
    এক মহানগর যাকে এই জন্যে আধুনিক মনে করা হয় যে বাড়িগুলোর বাইরের দিক সাজানোয় আর নগরের পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার জন্য পরিচিত উপলব্ধিগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ; তারই  আমি এক ক্ষণজীবী আর তেমন বিচ্ছিন্ন নাগরিক নই । এখানে তুমি কুসংস্কারের একটিও স্মৃতিস্তম্ভের হদিশ পাবে না । সংক্ষেপে, নৈতিকতা আর ভাষাকে সরলতম প্রকাশে নামিয়ে আনা হয়েছে ! লক্ষাধিক এই লোকজন যারা পরস্পরকে জানার প্রয়োজন অনুভব করে না, নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মকাণ্ড, বার্ধক্যে এতো মিল যে  তাদের আয়ু  মহাদেশের গোলমেলে সংখ্যাতত্ব যা বলেছে তার চেয়েও বেশ  কম । তাই, আমার জানালা দিয়ে, দেখতে পাই নতুন প্রেতরা শাশ্বত ঘন ধোঁয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে — আমাদের বনানীঘেরা ছায়া, আমাদের গ্রীষ্মের রাত ! — প্রতিহিংসর নতুন গ্রিক দেবতারা, আমার কুটিরের সামনে, যা আমার স্বদেশ, আমার সমগ্র হৃদয়, কেননা এখানে সবকিছুরই পরস্পরের সঙ্গে মিল আছে — ক্রন্দনহীন মৃত্যু, আমাদের সক্রিয় কন্যা আর চাকরানি, রাস্তার কাদায় বেপরোয়া ভালোবাসা আর ফালতু অপরাধ ফুঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ।  
     স্তেফান মালার্মে ( ১৮৪২ – ১৮৯৮ )  বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ কবিতাটির টাইপসেটিং সাজানোর ও সেকারণে মর্মার্থের বহুত্বের জন্য পরিচিত হলেও, বর্তমানে খুব বেশি পঠিত নন । বলা যায় যে ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ ইউরোপের কবিতার ধারায় বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল; ঘুটির চাল ডিগবাজি খেতে-খেতে এঁকে বেঁকে যেভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেইভাবে পঙক্তিগুলো সাজিয়েছিলেন মালার্মে ।কবিতার মধ্যে সহজাত শুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতা আনার প্রচেষ্টায়  ভাষাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে না পেরে তিনি প্রায়ই উদ্ভাবনী শব্দ বিন্যাস, জটিল উপমা ও পরীক্ষামূলক মুদ্রণবিদ্যা প্রয়োগ করে কবিতা লিখে পাঠকের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মালার্মের সাহিত্য চর্চায় সারা জীবনের গোঁ ছিল যে, পাঠকরা প্রতীকের অর্থ বুঝুক । সাহিত্য ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক তুষ্টিকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । তাঁর বাড়িতে প্রতি মঙ্গলবার সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো, কিন্তু স্কুলে শিক্ষকতা করার দরুণ তাঁর আর্থিক অবস্হা কোনো দিনই ভালো ছিল না ।স্বাভাবিক যে পাঠকদের মনে হয়েছে তাঁর কবিতার ভেতরে ঢোকা যায় না । এখানে তাঁর ‘কবিতার আবির্ভাব’-এর বাংলায়ন দিচ্ছি
    দু:খি হয়ে পড়ছিল চাঁদ। কাঁদুনে দেবশিশুরা স্বপ্ন দেখছিল।
    শান্ত ও বাষ্পীয় ফুলের তোড়ায় তাদের তীরবাহী আঙুল
    যেন তাদের মরণাপন্ন বেহালার তার বাজছিল
    আর আকাশ-নীল ফুলের পাপড়িতে গড়িয়ে পড়ছিল স্বচ্ছ অশ্রু।
    সে ছিল তোমার প্রথম চুমুর আশীর্বাদ-পাওয়া দিন,
    আর আমি  আমার স্বপ্নের কাছে শহিদ হলুম,
    যা বিষাদের সুগন্ধীর উপর ভর করে বেঁচেছিল,
    এমনকি কোনও পরিতাপ বা দূর্ঘটনা ছাড়াই
    একটি স্বপ্নকে সেই হৃদয়ের কাছে রেখে গিয়েছে
    যে প্রথম স্বপ্নটি তুলেছিল।
    এখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, পাথরে বাঁধানো রাস্তায়
    আমার চোখ নাচছিল।
    যখন তুমি চুলে সূর্যের উচ্ছাস নিয়ে, রাস্তায় আর রাতের বেলায়
    হাসিমুখে  আমার কাছে এসেছো,
    আর আমি ভাবলুম  আলোর টুপি পরা এক পরীকে দেখছি,
    যে আমার ছোটোবেলাকার ঘুমে স্বপ্নে দেখা দিত,
    আর  যার আধখোলা-মুঠো থেকে
    সুগন্ধী নক্ষত্রের দলে ঝরে পড়তো  তুষারপুঞ্জ
    গাছেদের সরু ডালে ।
             মহিলা কবি মার্সেলিন দেবোর্দে-ভামো’’র ( ১৭৮৬ – ১৮৪৯ ) জন্ম রনেঁর দুয়া তে। ফরাসি বিপ্লবের কারণে তাঁর বাবার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায় এবং আর্থিক সাহায্যের জন্য মায়ের সঙ্গে গুয়াদালুপ চলে যান; সেখানে তাঁর মা জনডিসে মারা যান আর ষোলো বছর বয়সী মারসেলিঁকে প্যারিসে ফিরে নাটকের দলে যোগ দিয়ে রোজগারের পথ বেছে নিতে হয় । ১৮১৭ সালে নাটকদলের একজন মামুলি অভিনেতা প্রসপার লাশান্তাঁ-ভামোকে বিয়ে করেন । ১৮১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্হ ‘এলেজি এবং রোমান্স’ । ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ক্রীতদাসদের নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অ্যান্টিলেসের সন্ধ্যা’ । তাঁর ‘উদ্বেগ’ কবিতার বাংলায়ন দিচ্ছি এখানে ; ওনার নাম বাঙালি পাঠক শুনেছেন বলে মনে হয় না ; বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি সত্যিই অভিশপ্ত :
    কি যে আমাকে বিপর্যস্ত করে ? কেনই বা অপেক্ষা করব ?
    এই শহরে, বড়ো বেশি বিষাদ ; তা থেকে, প্রচুর অবসর ।
    আধুনিক সুখানুভব নামে যা চলছে
    প্রতি ঘণ্টার পেষাই থেকে আমাকে সুরক্ষিত করতে পারে না ।
    একসময়ে বন্ধুত্ব ছিল, কোনো বইয়ের আকর্ষণ
    চেষ্টা ছাড়াই ভরে তুলতো অতিরিক্ত সময় ।
    ওহ এই অস্পষ্ট আকাঙ্খার উদ্দেশ্য কি ?
    আমি তা এড়িয়ে যাই, কিন্তু উদ্বেগ আমাকে ফিরে দেখতে বলে ।
    আনন্দ যদি আমার হর্ষে ধরা না দ্যায়
    তাহলে আমি তাকে দুঃখের বিশ্রামেও পাবো না,
    তাহলে কোথায়ই বা পাওয়া যায় আমোদপ্রমোদ ?
    আর তুমি যে আমাকে যা চাইছি তা দিতে পারো,
    তুমি কি আমাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে যাবার নির্ণয় নিয়েছ ?
    আমাকে বলো, যুক্তিতর্ক, অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর,
    তুমি কি প্রেমের ক্ষমতাকে  অনুমতি দেবে আমায় দখল করতে ?
    হায়, নামটা শুনলেই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে !
    কিন্তু যে ভয় উদ্বুদ্ধ করে তা অমায়িক আর সত্যি ।
    যুক্তিতর্ক, তোমার কাছে ফাঁস করার মতন আর কোনো গোপনীয়তা নেই,
    আর আমি ভাবি এই নামটি তোমার চেয়ে তাদের কথা বেশি বলেছে ! 
              এবার জানা যাক আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে আদঁ-র ( ১৮৩৮ -৮৯ ) কথা । ব্রিট্যানির এক অভিজাত পরিবারে জন্ম, যদিও তাঁদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না আর নির্ভর করতে হতো মায়ের কাকিমা মাদামোয়াজেল দ্য কেরিনুর দান-খয়রাতের ওপর । তার ওপর ভিলিয়ার্সের বাবার গোঁ চাপে যে তিনি মালটায় গিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে লুকোনো গুপ্তধন উদ্ধার করবেন । ফলে তিনি জমি কিনতেন আর গুপ্তধন না পেয়ে বেচতেন । এই করে ফতুর হয়ে যান । ভিলিয়ার্সকেও ডজনখানেক স্কুল পালটাতে হয় । ১৮৫০ এর পর তিনি বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়ে কাজের খোঁজ করে কিছুই যোগাড় করতে পারেননি । পাকাপাকি প্যারিসে থাকার ব্যবস্হার জন্য তাঁর এক আত্মীয়া মাসিক খরচের ব্যবস্হা করেন । তিনি ল্যাটিন কোয়ার্টারের মদ্যপ কবি-লেখকদের আড্ডায় যোগ দ্যান এবং শার্ল বোদলেয়ারের পরামর্শে এডগার অ্যালান পোর রচনাবলী পড়া আরম্ভ করেন । ১৮৫৯ সালে নিজের টাকায় প্রকাশ করেন ‘প্রথম কবিতাবলী’ । বইটা কোথাও আলোচিত হলো না । উপরন্তু তিনি লুইজি দায়োনে নামে এক বহুবল্লভা যুবতীর সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করলেন ; তাঁর পরিবারে সদস্যদের চাপে ১৮৬৪ সালে যুবতীটিকে ছেড়ে গীর্জায় আশ্রয় নিতে হয় । ভিলিয়ার্স অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করার মতন যুবতী পাচ্ছিলেন না ; তিনি থিয়োফিল গতিয়েকে তাঁর মেয়ে এসতেলে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে গতিয়ের তাঁকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন যে তিনি ভবঘুরে মাতাল অখ্যাত কবির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না । অ্যানা আয়ার পাওয়েল নামে বৈভবশালী ইংরাজ যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হন । শেষে তিনি এক বেলজিয় ঘোড়ার গাড়ির চালকের অশিক্ষিতা বিধবা স্ত্রী মারি দানতিনের সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করেন আর ১৮৮১ সালে তাঁর ছেলে ভিক্তরের জন্ম হয় । কিন্তু কবিস্বীকৃতি, ভেরলেনের বইতে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে, তিনি পাননি । এখানে ভিলিয়ার্সের  ‘স্বীকৃতি’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    যবে থেকে আমি শব্দগুলো ভুলে গেছি, যৌবনের
    ফুল আর এপ্রিলের টাটকা বাতাস…
    আমাকে তোমার ঠোঁট দুটি দাও ; তাদের সুগন্ধি যৌতুক
    গাছেদের ফিসফিস কথাবার্তা হয়ে দেখা দেবে !
    যবে থেকে আমি গভীর সমুদ্রের দুঃখ হারিয়েছি
    মেয়েটির কান্না, তার অস্হির টান, তার মৃত্যুর আলয়…
    একটা শব্দেরও শ্বাস ফেলে না ; তা বিষাদ বা আনন্দ
    হয়ে উঠবে ঢেউদের কলকল-ধ্বনি !
    যবে থেকে আমার আত্মায় অন্ধকারের ফুল
    আত্মমগ্ন, আর পুরোনো সূর্ষেরা উড়াল নেয়…
    প্রিয়তমা আমাকে তোমার মলিন বুকে লুকিয়ে নাও,
    আর তা হয়ে উঠবে রাতের প্রশান্তি !
              কিন্তু অভিশপ্ত কবিদের তালিকায়  তাঁর গুরু শার্ল বোদলেয়ার, কোঁতেদ্য লুতিয়ামোঁ (Comte de Lautréamont ) , অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( Alice de Chambrier ), আঁতোনা আতো ( Antonin Artaud ), জঁ-ফিয়ে দ্যুফে ( Jean-Pierre Duprey )  প্রমুখকে যোগ করেন পরবর্তীকালের আলোচকরা ; বস্তুত পল ভেরলেনই ছিলেন সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত। এই কবিরা তাঁদের কবিতার জন্য অভিশপ্ত নন ;  তাঁদের জীবনের দুঃখ, বিষাদ, আর্থিক দৈন্য, পরাজয়বোধ, অবহেলা, মাদকে আসক্তি, যৌনরোগ ইত্যাদির কারণে তাঁদের মনে করা হয়েছে ‘অভিশপ্ত’। তাঁর মৃত্যুর পর Fin de siècle বা শতাব্দী শেষের কবিদের অন্যতম মনে করে হয় পল ভেরলেনকে। 
            প্রথমে পড়া যাক শার্ল বোদলেয়ারের গদ্য কবিতার বই ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ এর একটি রচনা : 
    আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।
    আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।
    তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।
    তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।
    আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।
    আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।
              কঁতে দ্য লুতিয়ামোর ( ১৮৪৬ – ১৮৭০ ) প্রকৃত নাম ইসিদোরে লুসিয়েন দুকাস, জন্মেছিলেন উরুগুয়েতে । তাঁর জন্মের পরেই মা মারা যান ; তখন আর্জেনটিনা আর উরুগুয়ের যুদ্ধ চলছে । তাঁর বাবা, যিনি ফরাসিভাষী ছিলেন, তাঁকে তেরো বছর বয়সে প্যারিসে পাঠিয়ে দ্যান স্কুল শিক্ষার জন্য । সতেরো বছর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দাঁতে, মিলটন, বোদলেয়ার এবং রাসিনে মুখস্হ বলতে পারতেন বলে শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন । কিন্তু নির্ণয় নেন যে তিনি নিজে ‘নিষ্ঠুরতার আনন্দবোধ’ নিয়ে কবিতা লিখবেন । ‘মালদোরোরের গান’ নামে তিনি একটি কাব্যোপন্যাস লেখেন, ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মাঝে,  তাঁর এই নির্ণয়কে রূপ দেবার জন্য । নায়কের নাম মালদোরোর । বইটি ছয় পর্বে আর ষাটটি কবিতাংশে বিভাজিত । ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিশেষ করে সালভাদোর দালি,  তাঁর এই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বইটির বহু দৃশ্যের এচিং করেছিলেন দালি । আমি বইটি থেকে একটি কবিতাংশ তুলে দিচ্ছি:
    আমি নোংরা । আমার সারা শরীরে উকুন । শুয়োররা, যখন আমার দিকে তাকায়, বমি করে। আমার চামড়া কুষ্ঠরোগের মামড়ি আর আঁশে ছয়লাপ, আর তার ওপরে হলুদ রঙের পুঁজ । আমার বাঁদিকের বগলে এক ব্যাঙ পরিবার বসবাস আরম্ভ করেছে, আর, তাদের কোনো একটা নড়াচড়া করলে, কাতুকুতু দ্যায় । মনে রাখতে হয় যাতে বাইরে বেরিয়ে মুখ দিয়ে কান আঁচড়াতে না আরম্ভ করে ; তাহলে সেটা মগজে ঢুকে যাবে । আমার ডানদিকের বগলে রয়েছে একটা গিরগিটি যে সব সময়ে ওদের তাড়া করে যাতে খাবার না জোটায় মারা যায় : সবাইকে তো বাঁচতে হবে । আমার পোঁদের ভেতরে একটা কাঁকড়া ঢুকে গেছে ; আমার কুঁড়েমিতে উৎসাহিত হয়ে, ঢোকার পথটা নিজের দাড়া দিয়ে পাহারা দ্যায় আর আমাকে দ্যায় অসহ্য যন্ত্রণা ।
    অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( ১৮৬১ – ১৮৮২ ) একুশ বছর বয়সে কোমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার কিছুকাল আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘ঘুমন্ত সুন্দরী’ । তাঁর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর । এখানে তাঁর ‘পলাতক’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    আমরা সবাই আগন্তুক আর পৃথিবী হয়ে চলে যাই
    খেলার সময়ে উধাও আলোর নৌকোর মতো
    হালকা হাওয়ায় চুপিচুপি চুমুর আড়ালে,
    আর নীল দিগন্ত ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় ;
    উড়ালের সময়ে যদি হলরেখার খাত গড়তে পারে তাহলে আনন্দিত
    সে চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ;
    যে পথ সে দ্রুত যাত্রায় খুঁজতে চেয়েছিল
     কোনো ঘুর্ণিঝড় তাকে মুছে দিতে  পারে না;
    আনন্দিত, যদি অদৃষ্ট আমাদের টেনে বের করে আনে
    আমরা তবুও হৃদয় হয়ে বাঁচি যেখানে থেকেছি চিরকাল,
    সুদূর সমুদ্রতীর পর্যন্ত যে হৃদয় আমাদের অনুসরণ করে
    তাহলে এখানে এক মৃত মানুষের সমাধিকে কী বলা হবে ?
              আঁতোনা জোসেফ মারি আতো ( ১৮৯৬ – ১৯৪৮ ), যিনি আঁতোনা আতো নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, নাট্য পরিচালক এবং ইউরোপীয় আভাঁগার্দ আন্দোলনের পুরুষদের অন্যতম । ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ তত্বটির জন্য তিনি অধিকতর পরিচিত । যদিও তাঁর জন্ম ফ্রান্সের মার্সাইতে, তাঁর বাবা-মা ছিলেন গ্রিক । জাহাজের মালিক ছিলেন তাঁর বাবা । তাঁর মায়ের নয়টি বাচ্চা হয়েছিল, চারটি মৃত অবস্হায় জন্মায় আর দুটি শৈশবেই মারা যায় । পাঁচ বছর বয়সে আতো আক্রান্ত হন মেনেনজাইটিসে, যার দরুন কোমাটোজে ছিলেন কিছুকাল এবং বিভিন্ন স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসার জন্য পাঁচ বছর ভর্তি ছিলেন । ১৯১৬ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে হয়েছিল কিন্তু মানসিক অস্হিরতার কারণে ছাঁটাই হন । দীর্ঘ রোগভোগের দরুণ তাঁকে ল্যডানডাম ওষুধ ( অ্যালকোহলে গোলা আফিম ) নিতে হতো আর সেখান থেকেই তাঁর আফিমের নেশা ।সাতাশ বছর বয়সে তিনি এক গোছা কবিতা ‘নতুন ফরাসি রিভিউ’ ( Nouvelle Revue Française ) পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠান ; তা প্রত্যাখ্যাত হলেও সম্পাদক তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে চিঠি লেখেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁদের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হয় । এখানে তাঁর কয়েকটা কবিতার বাংলায়ন দিলুম, কেননা তাঁর কবিতার বই সহজে পাওয়া যায় না :    
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।
    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।
    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।
    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    আমি
    আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।
    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।
    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।
    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা–
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
              ১৯৫০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, জাঁ ফিয়ে দুফের (১৯৩০ – ১৯৫৯ ) প্রথম কবিতার বই ‘দ্বিতীয়ের পেছনে’র পাণ্ডুলিপি পড়ে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন । এক বছর পরে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর্যে আগ্রহী হন, আর পাঁচের দশকের পুরো সময় লোহা আর সিমেন্টের কাজ করেন, সেই সঙ্গে চারকোল ও কালির কাজও করেন । ১৯৫৯ সালে ব্যক্তিগত দ্রোহ প্রকাশ করার জন্য আর্ক দ্য ত্রয়েম্ফে অজানা সেনাদের শিখায় পেচ্ছাপ করার সময়ে ধরা পড়েন আর জনগণের পিটুনি খেয়ে প্রথমে কারাগারে আর তারপর পাগলাগারদে যেতে হয় । ছাড়া পেয়ে আবার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন এবং ‘শেষ ও উপায়’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি স্ত্রীর হাতে দিয়ে নির্দেশ দ্যান তা ব্রেতঁকে ডাকে পাঠিয়ে দিতে । বাড়ি ফিরে স্ত্রী জ্যাকলাঁ দেখতে পান যে ছবি আঁকার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে জাঁ ফিয়ে দুফে আত্মহত্যা করেছেন । কাব্যগ্রন্হটি থেকে ‘সম্পূর্ণ’ শিরোনামের গদ্য কবিতাটির বাংলায়ন :
             জগতসংসার সম্পূর্ণ । কে সেই লোক যে রাতকে প্রতিবার একই ফাঁদে ফ্যালে ? আমি, যদি বলা হয়, কাউকেই চিনি না আর যে আকাশ আমার ওপর মনের ঝাল মেটায়, ওর বড়ো ইঁদুরের হাত আমাকে কখনও, কখনও দেখায়নি ।
              কেউ একজন দরোজাটা খুললো : ভেতরে ছিল না কেউ, ভেতরে তার ছিল হাড় আর হাড়, আর আমি প্রতিজ্ঞা করে সবাইকে জানিয়েছি যে আমি জ্যান্ত ওর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো ।
             জগতসংসার ভয়ঙ্করভাবে সম্পূর্ণ ছিল আর জিনিসপত্রের টানাটানি চলছিল । কেউ একজন দুঃস্বপ্নকে সাজিয়ে রাক্ষসদের আলোকিত করছিল আর তাকে বলা হচ্ছিল বর্তমান, এখন…
             এই বর্তমানগুলো আমাদের বহু সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল, আমি থেকে আমিতে, আমার থেকে আমার সঙ্গে আর অন্য অনেকের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে অন্য অনেকের…কিন্তু অনেকসময়ে সবচেয়ে বিচক্ষণ ভাগাভাগিও আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু মাথা কখনও, আর আমি বলতে চাই কখনও, কাঁধের ওপরে স্হিতিশীল থাকেনি ।
    দুই
              ‘অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবীদের’ কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে যে পল ভেরলেন চল্লিশ বছর বয়সে কয়েকজন কবিকে ‘অভিশপ্ত কবি’ চিহ্ণিত করে একটা বই লিখলেন কেন ? তিনি কি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি নিজেকে দেখতে চাইছিলেন সেই কবিদের সারিতে যাঁদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে করলেও তখনকার ‘বুর্জোয়া পাঠক’ কোনও পাত্তা দিতেন না । চল্লিশ বছর বয়সে র‌্যাঁবোকে খুনের চেষ্টার দায়ে জেল খেটে ফিরেছেন, একজনকে ( অনেকের মতে নিজের মা-কে ) মারধর করার কারণে আবার জেলে গিয়েছিলেন, রোমান ক্যাথলিক হিসাবে দীক্ষা নিয়েছেন, তবু তাঁর কেন মনে হয়েছিল তাঁর মতনই কয়েকজন কবি অভিশপ্ত ? সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁরা ছিলেন অখ্যাত, সমাজ তাঁদের প্রতি উদাসীন ছিল কেননা তাঁদের কবিতা তারা বুঝে উঠতে পারছিল না । কেবল রসপণ্ডিতরা তাঁদের কবিতায় আগ্রহী ছিলেন আর সেকারণে তাঁদের জীবন দুর্দশাপূর্ণ ছিল । উপেক্ষার, এমনকি ‘বুর্জোয়া অশিক্ষিতদের দ্বারা’ পদদলিত হবার চর্চিত বোধ, হয়তো ছিল প্রথম পর্বের আভাঁ গার্দ লেখক-কবিদের ধ্রুপদি দাবি।ফরাসিদেশের কবি-চিত্রকরদের মাঝে আত্মক্ষয়ের গৌরব প্রশংসনীয় ছিল তাঁদের নিজেদের গণ্ডিতে ।
             অভিশাপটি একই সঙ্গে যতোটা নৈতিক ও আত্মিক মনে করেছিলেন ভেরলেন, ততোটাই সামাজিক, যে মানসিকতা থেকে এই বোধের সূত্রপাত যে ‘সত্যকার শিল্পীকে’ প্রতিভার চাপ সহ্য করে ক্লেশ ও নিদারুণ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় । চল্লিশ বছর বয়সে ভেরলেন মাতলামি, স্ত্রী ও মাকে মারধর করে, বাচ্চাকে যাতনা দিয়ে, সিফিলিসে ভুগে, বস্তিতে জীবন কাটিয়ে, ভিক্ষাবৃত্তি করে, জীবনের মর্মভেদী যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে অতিপরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং কবিদের ক্ষেত্রে ‘অভিশাপ’ যে কেবল সমাজের দেয়া নয়, তাঁরা নিজেরাও এমন সমস্ত কাজকর্ম করেছেন যে প্রকৃতি তাঁদের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে, তাঁদের দেহ ও অন্তরজগতকে ক্ষইয়ে দিয়েছে, তা টের পেয়েছিলেন তিনি ।
              পল ভেরলেনের কাছে ‘অভিশপ্ত কবির’ প্রধান দৃষ্টান্ত ছিলেন শার্ল বোদলেয়ার ( ১৮২১ – ১৮৬৭ ) যাঁর ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ), ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত, ছিল উনিশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ এবং পৃথিবীর সাহিত্যে অতুলনীয় । বইটির কবিতাগুলোয় ছিল সৌন্দর্যের সঙ্গে ইতরতার বৈপ্লবিক মিশ্রণ, তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল  চরম আধ্যাত্মিকতা যার জন্য আধুনিক যুগ বহুকাল অপেক্ষা করছিল, যা একই সঙ্গে ছিল স্বর্গে ঝড়-তোলা ও নাছোড়বান্দাভাবে  নারকীয় । মর্ত্যে নরকভোগের অভিজ্ঞতা শার্ল বোদলেয়ারের ছিল, এবং তার অধিকাংশ তাঁর নিজের গড়া নরক । লাতিন কোয়ার্টার থেকে তুলে এনেছিলেন এক শ্যামলী বেশ্যাকে, আর তার থেকে প্রেমের পাশাপাশি পেয়েছিলেন সিফিলিস । তেত্রিশ বছর বয়সে মাকে বোদলেয়ার লিখেছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই জঘন্য।” অথচ উত্তরাধিকারসূত্রে যা টাকাকড়ি পেয়েছিলেন, তিনি সারাজীবন আরামে জীবন কাটাতে পারতেন । আঁতোনা আতোর মতন বোদলেয়ারও লডানডাম ( মদে মেশানো আফিম ) মাদকের নেশা ছাড়তে পারেননি । যে লোক নিজেকে অভিশপ্ত মনে করে, সে তার কারণ খোঁজে । বোদলেয়ারে পাওয়া যায় যিশুখ্রিস্টের উপহাস । ‘সেইন্ট পিটারের অস্বীকৃতি’ কবিতায় বোদলেয়ার বলছেন:
    আহ ! যিশু, অলিভের বাগানকে মনে করো !
    তোমার সারল্যে তুমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছিলে তার কাছে
    যে স্বর্গে রয়েছে সে হাসছিল পেরেকের শব্দে
    যেগুলো নীচ জল্লাদেরা তোমার মাংসে পুঁতে দিচ্ছিল ।
              বিশোধক যন্ত্রণাবোধের ধারণাকে বোদলেয়ার দিয়েছেন এক বিশেষ উতরাই, যা টেনেছিল পল ভেরলেনকে । ভেরলেন জানতেন যে বোদলেয়ারের নায়ক ছিলেন এডগার অ্যালান পো, যিনি, বোদলেয়ারের মতে, অত্যধিক মদ খাবার কারণে মারা যান, ‘অভিশপ্ত কবি’র সৃষ্টিক্ষমতা ও আত্মধ্বংসের ক্ষমতা দুটিই ছিল অ্যালান পোর অহংকার । বোদলেয়ারের চরস আর আফিমের নেশা ছিল যা তিনি ক্ষতিকর মনে করেও ছাড়তে পারেননি ; ‘অভিশপ্ত কবির’ যদি মনে হয় মাদক তাঁর চেতনাকে উন্নীত করছে, তাহলে তার ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিভার দাম চোকানো হিসেবে তিনি মান্যতা দেবেন । এডগার অ্যালান পো, শার্ল বোদলেয়ার ও পল ভেরলেনের মাতাল-অবস্হায়-থাকা হয়ে উঠেছিল এক ধরণের আধ্যাত্মিক নিয়মনিষ্ঠা ।
             পল ভেরলেন মধ্যস্হ, মীমাংসক, শান্তিস্হাপকের বেদিতে বসিয়েছিলেন শার্ল বোদলেয়ারকে । ভেরলেন লিখেছেন, “আমার কাব্যিক অনুভূতিকে, এবং আমার গভীরে যা রয়েছে, তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বোদলেয়র।” একুশ বছর বয়সে ভেরলেন লিখেছিলেন, “শার্ল বোদলেয়ার উপস্হিত করতে পেরেছেন সংবেদনশীল মানুষকে, এবং তিনি তাকে উপস্হাপন করেন একটি আদর্শ হিসাবে, বা বলা যায়, নায়ক হিসাবে ।” ভেরলেন আরও বললেন যে, শার্ল বোদলেয়ার “একজন দ্রষ্টা ; তাঁর রয়েছে তীক্ষ্ণ, স্পন্দমান সংবেদন, একটি যন্ত্রণাময় নিগূঢ় মন, তাঁর ধীশক্তি তামাকে প্লাবিত, তাঁর রক্ত বিশুদ্ধ সুরাসারে প্রজ্বলন্ত ।” যেহেতু অভিশপ্ত, তাই আশীর্বাদপূত ।
               বোদলেয়ারকে নায়কের বেদিতে বসিয়ে তাঁর জীবনযাত্রা অনুকরণের প্রয়াস করলেন পল ভেরলেন । মদে চোবানো অফিমের বদলে তিনি আসক্ত হলেন আবসাঁথে । আবসাঁথে আর কিছু মেশাতে হয় না, সরাসরি পান করতে হয় এবং গাঢ় নেশা হয় । বন্ধুরা নিষেধ করলে ভেরলেন তাঁদের সঙ্গে তরোয়াল বের করে মুখোমুখি হতেন । ভেরলেনের হাতে দেশলাই দেখলে তাঁর বন্ধুরা ভয় পেতেন । স্ত্রীর চুল সুন্দর বলে তাতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করেছিলেন । যখন ‘অভিশপ্ত কবি’ ভেরলেন লিখছেন, এবং দুঃখদুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি জানতেন না যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছেচে । কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে ক্ষোভ মৃত্যু পর্যন্ত ছিল যে তাঁকে আর তাঁর কবিতাকে কেউ ঠিকমতন বুঝতে পারেনি ; তাঁর মনে হতো একজন কবির কাব্যিক প্রতিভার কারণে যে আবেগের ঝড় তাকে পুষতে হয় তা লোকে টের পায় না ; প্রথানুসরণ সত্যকার শিল্পের শ্বাসরোধ করে, তাই সীমালঙ্ঘন জরুরি হয়ে ওঠে মৌলিকতাকে আয়ত্ব করার জন্য, নয়তো কবিতা হয়ে উঠবে আহরিত ; জীবনকে আত্মাহীন হলে চলবে না, তাকে হতে হবে অকৃত্রিম ও বিশ্বাসযোগ্য ।
              বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে, ইউরোপেও, অভিশপ্ত কবির যুক্তি খাটতো, কিন্তু এখন সেগুলো কিংবদন্তি মনে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় নৈতিক বিপথগামীতার নতুন সংজ্ঞা বাজারের চালচলনের সঙ্গে বদলাতে থাকে । এমনকি ভারতেও বোদলেয়ার বা ভেরলেনের মতন অভিশপ্ত কবির যুগ শামসের আনোয়ার ও ফালগুনী রায়ের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে । এখন এসেছে অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবির কালখণ্ডে । যাতে উপেক্ষার অভিশাপে না পড়তে হয় তাই কবি-লেখকরা এখন শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সময়ে যাঁরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করতেন তাঁরা অনেকেই তৃণমূলের মন্ত্রীর পাশে বসে ফোটো তোলাতে কার্পণ্য করেন না। রাষ্ট্র এখন এমনই বেপরোয়া যে কাকে কোন অভিযোগে জেলে পুরে দেবে তার নিশ্চয়তা নেই । কেবল রাষ্ট্র নয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীও বুদ্ধিজীবিদের খুন করতে ভয় পায় না । নকশাল নামে একদা বহু বুদ্ধিজীবি লোপাট হয়ে ছিলেন ; এখন ‘শহুরে নকশাল’ নামে কয়েকজনকে জেলে পোরা হয়েছে । ধর্মবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্রের কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ।
             সমাজের যাঁরা নৈতিকতার জ্যাঠামশায়, তাঁরা সাহিত্যিকদের আত্মধ্বংসে সমাজেরই পচন দেখতে পান । বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে ইউরোপের সমাজে ও রাজনীতিতে বিপুল রদবদল ঘটছিল, যা আমরা দেড়শো বছর পরে ভারতেও প্রত্যক্ষ করছি । এখন ইউরোপ আমেরিকায় ধর্মহীনতা ও যৌন-যথেচ্ছাচারকে অধঃপতন মনে করা হয় না, যা ভেরলেনের সময়ে করা হতো । ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ারের ছয়টি কবিতাকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এখন ভারতীয় মাপকাঠিতেও হাস্যকর মনে হয় । ভেরলেনেরও মনে হয়ে থাকবে, যে, কবিতাগুলো কোন যুক্তিতে জনগণের নৈতিকবোধে আঘাত হেনেছে, যখন কিনা জনগণ নিজেরাই জীবনে বহু ঘটনা চেপে যায় । কলকাতায় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন কবি অবিনাশ কবিরাজ লেনে যেতেন অথচ আত্মজীবনী লেখার সময়ে তা চেপে গেছেন । বোদলেয়ারের ছয়টা কবিতা থেকে নিষেধ তোলা হয় ১৯৪৯ সালে । অথচ তার কয়েক বছর পরেই দেখা দিয়েছিলেন আমেরিকার বিট জেনারেশনের কবিরা ; অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ঝড় তুলেছে । প্যারিস থেকে তার আগে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’ । অতিযৌনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, নেশা ইত্যাদি সত্বেও হেনরি মিলার নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেননি ।
              বোদলেয়ারের নিষিদ্ধ কবিতা ‘লিথি’, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে :
    উঠে আয় আমার বুকে, নিষ্ঠুর নিশ্চেতনা
    সোহাগী ব্যাঘ্রী আমার, মদালস জন্তু ওরে
    প্রগাঢ় কুন্তলে তোর ডুবিয়ে, ঘণ্টা ভরে,
    চঞ্চল আঙুল আমার — হয়ে যাই অন্যমনা ।
    ঘাঘরায় গন্ধ ঝরে, ঝিমঝিম ছড়ায় মনে
    সেখানে কবর খোঁড়ে আমার এ-খিন্ন মাথা,
    মৃত সব প্রণয় আমার, বাসি এক মালায় গাঁথা
    নিঃশ্বাস পূর্ণ করে কি মধুর আস্বাদনে !
    ঘুমোতে চাই যে আমি যে-ঘুমে ফুরোয় বাঁচা,
    মরণের মতোই কোমল তন্দ্রায় অস্তগামী
    ক্ষমাহীন লক্ষ চুমোয় তনু তোর ঢাকবো আমি–
    উজ্বল তামার মতো ও-তনু, নতুন, কাঁচা ।
    শুধু তোর শয়ন ‘পরে আমার এ-কান্না ঘুমোয়,
    খোলা ঐ খন্দে ডুবে কিছু বা শান্তি লোটে ;
    বলীয়ান বিস্মরণে ভরা তোর দীপ্ত ঠোঁটে
    অবিকল লিথির ধারা বয়ে যায় চুমোয় চুমোয় ।
    নিয়তির চাকায় বাঁধা, নিরুপায় বাধ্য আমি,
    নিয়তির শাপেই গাঁথি ইদানিং ফুল্লমালা ;
    বাসনা তীব্র যতো, যাতনার বাড়ায় জ্বালা–
    সবিনয় হায়রে শহিদ নির্মল নিরয়গামী !
    এ-কঠিন তিক্ততারে ডোবাতে, করবো শোষণ
    ধুতুরার নেশায় ভরা গরলের তীব্র ফোঁটায়
    ঐ তোর মোহন স্তনের  আগুয়ান দৃপ্ত বোঁটায়–
    কোনোদিন অন্তরে যার হৃদয়ের হয়নি পোষণ ।
               সমালোচকদের স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না বোদলেয়ার, ফলে যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের পথে, তাঁর কবিতা সহজে কোনো পত্রিকা ছাপতে চাইছিল না, বোদলেয়ারের মনে হচ্ছিল অস্বীকার ও যন্ত্রণালাভের মধ্যে দিয়ে তাঁর স্খালন ঘটছে, কবিতায় ইতরতার সঙ্গে সৌন্দর্যের মিশেলে গড়া তাঁর পাঠবস্তুতে তিনি তাঁর প্রতি ঈশ্বরের অবিচারের প্রসঙ্গ তুলেছেন । তিনি এডগার অ্যালান পো-কে ফরাসী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে পো-এর জীবনেও মদ্যপানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা তাঁর জন্য হয়তো জীবনবিনাশী ছিল, কিন্তু তা তাঁকে করে তুলেছিল প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ, কেননা, বোদলেয়ারের মতে,  পো কখনও নেশাহীন প্রকৃতিস্হ থাকতে চাইতেন না । বদল্যার বলেছেন যে পো সাধারণ মানুষের মতন মদ খেতেন না, খেতেন বর্বরদের ঢঙে, মার্কিনী তেজে, যাতে এক মিনিট সময়ও নষ্ট না হয়, যেন তিনি খুন করার জন্য তৈরি, এমন একটা পোকাকে খুন করতে চাইছেন যা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে আছে আর মরতে চায় না ।
             বদল্যারের মতে, মত্ততা এডগার অ্যালান পো-কে কেবল যে মহান কবি করে তুলেছে, তা নয়, তাঁকে করে তুলেছে মহান মানুষ ; পো-এর মত্ততা ছিল স্মৃতিবর্ধনের ক্রোনোট্রোপ ( সময়/পরিসর ), সাহিত্যকর্মের খাতিরে একটি সুচিন্তিত ও স্বেচ্ছাকৃত উপায়, তা মারাত্মক দুর্দশাপূর্ণ হলেও, তাঁর স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল । ভেরলেন যেমন বদল্যারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি, একই ভাবে বদল্যার আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি গড়ে তুলেছিলেন এডগার অ্যালান পো-এর মাধ্যমে ।
              উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে কবিদের রচনা আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যকে রূপ দিয়েছে, তাঁদের প্রতি ফরাসি প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্ব্যবহার ব্যাখ্যার অতীত । ভেরলেন যাঁদের অভিশপ্ত কবি হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ভেরলেনের জীবনযাত্রা বেছে নেয়ায় পার্থক্য আছে । আবসাঁথের নেশার প্রতি ভেরলেনের টানের কারণ তিনি তাঁর ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানাননি, এবং আবসাঁথ খাবার পর যে সমস্ত দানবিক আচরণ তিনি করতেন তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই । অনেকে মনে করেন তাঁর বাবার পালিত মেয়ে এলিজা তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে ভেরলেন হীনম্মন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করেন এবং আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে যান । পরবর্তীকালে তিনি তো যথেষ্ট রয়ালটি পেতেন এবং তা থেকে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি আঁচ করে থাকবেন ।
             র‌্যাঁবোর অভিশপ্ত হবার কারণ পাওয়া যায় বাবার অনুপস্হিতিতে । তাঁদের পাঁচ ভাইবোনের কারোর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান, ফলে শৈশব থেকে তাঁকে আর তাঁর মাকে টিটকিরি শুনতে হতো। তাঁর মা নিজেকে বলতেন বিধবা । অনুপস্হিত বাবাকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে র‌্যাঁবো ঈশ্বরনিন্দা ও খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করেছেন তাঁর কবিতায় । ঈশ্বরই তাঁর ও তাঁর মায়ের দুঃখদুর্দশার জন্য দায়ি । সেই অনুপস্হিত বাবাকে তিনি প্যারিসের অগ্রজ কবিদের মধ্যে পেতে চেয়ে অবহেলিত হন । 
              ভেরলেনও জেলে থাকার সময়ে রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তবু তিনি ঈশ্বরভক্তি ও ঈশ্বরনিন্দার মাঝে দোটানায় পড়ে কবিতা লিখেছেন । খ্রিস্টধর্মের প্রফেটদেরও যেহেতু যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে, যিশুকে ক্রূশকাঠে পেরেকে গেঁথা অবস্হায় ঝুলতে হয়েছে, তাই একজন কবিও, যে মানবসমাজের জন্য কবিতা লিখছে, তাকেও প্রফেটদের মতন অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হবে, মনে করেছেন ভেরলেন । আঘাত পাওয়াকে তাঁরা অপরিহার্য সত্য বলে মান্যতা দিয়েছেন । রসাস্বাদন করেছেন শহিদত্বের, জাহির করেছেন তাকে । মন্দভাগ্যের সাধনা তাঁদের অন্তরজগতকে বড়ো বেশি দখল করে নিয়েছিল, বিশেষ করে ভেরলেনের । খ্রিস্টধর্মমতে মানসিক অবস্হানটি ‘ইপিফ্যানি’ । এই মনস্হতিকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ‘দৈব উন্মাদনা’, ইউরোপীয় রেনেসাঁর গবেষক বলেছিলেন ‘শনিআক্রান্ত স্বভাবচরিত্র’।
             যাঁরা আচমকা সেই ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হন, তাঁরা,  ‘বিশুদ্ধ’ অভিজ্ঞতার খাতিরে, মনের ভেতরে সন্ধান করেন সীমাহীনতার, যে পরিসরে তিনিই নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, আত্মক্ষয় তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না ; মাদক, যৌনতা, মৃত্যু, ধর্মহীনতা, কোনো কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, কেননা তিনি আত্মক্ষয়ের গৌরবে আহ্লাদিত  পরিসরের সার্বভৌম মালিক । সেই গায়ক, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্হপতির আহ্লাদের শক্তিক্ষমতা, তাঁদের যন্ত্রণাদায়ক যাত্রাপথে এগোনোয় প্ররোচিত করে ; তাঁরা জানেন যে প্রয়াস না করলে তাঁরা কিছুই নন, তাঁরা একজন ‘নেইমানুষ’ ।
             যৌনতা তাঁদের কাছে বংশরক্ষার অথবা সন্তানের জন্ম দেবার প্রক্রিয়া নয়, যেমন মাদক নয় নেশাগ্রস্ত থাকার জন্য, এগুলো তাঁদের ‘নেইমানুষ’ হতে দেয় না । বংশরক্ষা বা সন্তানোৎপাদনের যৌনতা,  ব্যক্তিঅস্তিত্বকে ধারাবাহিকতার বাইরে নিয়ে যায়, গতানুগতিকতায় বেঁধে ফ্যালে। ধারাবাহিকতাহীনতা হলো অভিশপ্ত কবিদের প্রতিদিনের জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা । জনসাধারণের মাঝে একজনের সঙ্গে আরেকজনের বাধা থাকে, অনেকসময়ে দূরতিক্রম্য, ধারাবাহিকতাহীনতা থাকে, পতিত-অঞ্চল থাকে । মানুষের ব্যক্তিএকক-বোধ জন্মায় তার সামনের বস্তুপৃথিবীর জিনিসগুলোর ব্যবহারের কারণে — তাদের দরুণ বস্তুদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন থাকে । ‘নেই-বোধ’ হলো অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, এবং এই ধারাবাহিকতার সন্ধান করেন আত্মক্ষয়ের আহ্লাদে আক্রান্ত অভিশপ্ত কবিরা । ‘নেই-বোধ’ হলো অহং-এর সমাপ্তি, যা মানুষটি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, এবং সেই কারণেই আশেপাশের জনসাধারণকে সরিয়ে দিতে চাইছেন ।
             অমন মানুষটি আত্মবলিদানের গোমরে ভুগছেন কেন ? কেননা তাঁর কাছে আত্মবলিদানের গোমর হলো কেবলমাত্র ধ্বংস, তা নিশ্চিহ্ণ হওয়া নয় । আত্মবলিদানের গোমর বস্তুদের প্রতি আনুগত্যকে ধ্বংস করে ; প্রয়োজনীয় দৈনন্দিনের উপযোগীতাবাদী জীবন থেকে টেনে বের করে আনে, এবং মানুষটিকে প্রতিষ্ঠা করে দুর্বোধ্য খামখেয়ালে , স্বকীয় পবিত্রতায়, যার খোলোশা কেবল তিনিই করতে পারবেন । তাঁর এই ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ ঘটে তাবৎ সীমাগুলোর বিদারের মাধ্যমে, যাবতীয় নিষেধ অতিক্রমের দ্বারা, যা তাঁকে একযোগে আহ্লাদ ও পীড়নের স্হিতিতে নিয়ে গিয়ে একাকী ছেড়ে  দেয় । ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ হলো ‘নেই-স্হিতি’, এবং সেহেতু মানসিক ও দৈহিক আত্মক্ষয় সম্পূর্ণ পরিবর্তন-পরিশীলনের জন্য একান্তই জরুরি । অভিশপ্ত কবির ভেতরে-ভেতরে যে সন্ত্রাস চলছে তা অন্য কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারে না ; তার জন্য তাঁর গানে, সঙ্গীতে, কবিতায়, ভাস্কর্যে, পেইনটিঙে, স্হাপত্যে, প্রবেশ করতে হবে ।
               ব্যক্তিএককের বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার ক্রোনোট্রোপে বাস্তব জগত আর মিথ মিলেমিশে গেলে তার যে মানসিক অবস্হা গড়ে ওঠে তাকে ভেরলেনের আলোচকরা বলেছেন ‘নুমিনাস’, যে অবস্হায় ব্যক্তিএককের অন্তরজগতে নিদারুণ তোলপাড় ঘটতে থাকে, সে তখন বাইরের জগতের প্রতি উৎসাহহীন, তার মনে হয় সে বাইরের জগতের দ্বারা অবদমিত, হতোদ্যম অবস্হায় সে নিজের ভেতরে আরও বেশি করে ঢুকে যেতে থাকে, তখন সে বিপজ্জনক আত্মক্ষয়ের স্বাদ পেতে আরম্ভ করেছে, খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে, বুঝে উঠতে পারছে না ঝাঁপ দেবে নাকি ফিরে যাবে ।
             সুইডেনের নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গ, যিনি খাদের কিনারায় গিয়ে ফিরে এসেছিলেন, বেশ কিছু সময় মানসিক হাসপাতালে ছিলেন, তিনি নিজের অবস্হাটা যাচাই করে বলেছিলেন যে, ‘যারা উন্মাদ হবার সুযোগ পায় তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান’ । মার্কিন কবি জন বেরিম্যান, যাঁর বাবা শৈশবে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং যিনি বাবার আত্মহত্যার স্মৃতি থেকে কখনও মুক্তি পাননি , বলেছিলেন, ‘যে কবি অত্যন্ত ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে, যা তাকে মেরে ফেলতে পারতো অথচ যা তাকে প্রকৃতপক্ষে বাঁচতে সাহায্য করেছে, তার অদৃষ্টের প্রশংসা করা উচিত’।
        অভিশপ্ত কবির ভেতরে এক সৃজনশীল ক্ষমতা প্রবেশ করে ; সে চেষ্টা করে যায় যাতে বিস্ফোরণে সে নিজেই না উড়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে চেষ্টা করে কখন সৃজনশীলতার আবেগ ও সংবেদনকে প্রয়োগ করতে হবে । সব সময় একটা ভীতি কাজ করে, কেননা সৃজনশীল মানুষটি খাদের ধার পর্যন্ত যাবেনই, আবার একই সঙ্গে তাঁর ভেতর এই ভীতি কাজ করে যে তিনি বড়ো বেশি মার্জিত রুচিশীল বিবেকী সুস্হতাবিশিষ্ট স্হিরমস্তিষ্ক হয়ে উঠছেন না তো ! সাধারণ মানুষের তুলনায় সৃজনশীল মানুষ, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে খানিকটা ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হয়ে পড়েন, এবং ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হবার কারণে তাঁরা যখন ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হন তখন, সাধারণ মানুষের তুলনায়, অস্তিত্বের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে পারেন, অন্তদর্শী হতে পারেন, প্রতিক্ষেপক হতে পারেন । আমেরিকায় লেনি ব্রুস নামে একজন প্রতিসাংস্কৃতিক কমেডিয়ান ছিলেন, অশ্লীল ভাষায় সবায়ের সমালোচনা করতেন, যে কারণে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল,  এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা মাফ করে দেয়া হয়, তিনি উন্মাদ বুদ্ধিমত্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তিনি নিজেও আত্মক্ষয়ে ভোগেননি ।
             ডাক্তারি ভাষায় আত্মক্ষয়ের গৌরবকে বলা হবেছে ‘হাইপোম্যানিয়া’ । কোনো সৃজনশীল মানুষকে যদি হাইপোম্যানিয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে তাঁর কাছে তা সৃজনের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি । সৃজনশীল মানুষ তাঁদের কাজের জন্য যে কাঁচা মাল ব্যবহার করেন, তা আসে তাঁদের অন্তর্জীবনের বুনিয়াদি বা আদিকালীন স্তর থেকে — যৌন কল্পনা, পূর্বপক্ষতা, আগবাড়া চারিত্র্য, বহুবিধ যৌনাঙ্গিকের ভাবনা থেকে । শৈশব থেকে মানুষের ভেতরে এই বোধগুলো কাজ করে, সে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে যৌবনে পৌঁছোয় । বয়সের সঙ্গে সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, আদিম-চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে শেখে, সামাজিক বাধানিষেধকে মান্যতা দিতে শেখে । কিন্তু সৃজনশীল মানুষ এগুলোর সংস্পর্শে থাকেন, আর তাদের বোঝার জন্য নিজের সঙ্গে লড়তে থাকেন, আর নিজের আদিম চারিত্র্যের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার অভিপ্রায়ে তিনি উন্মাদনা ও মতিস্হিরতার মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন আবার কখনও বা সেই ভারসাম্য হারিয়ে অভিশপ্ত হন।
    তিন
              পল-মারি ভেরলেনের জন্ম ১৮৪৪ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপূর্ব ফ্রান্সের মোৎসেল আর সেইলি নদীর সঙ্গমস্হল মেৎজ শহরে ।   সমরবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাঁর বাবা নিকোলাস অগুস্তে ভেরলেন  ১৮৫১ সালে মেৎজ থেকে প্যারিসে পাকাপাকি  বসবাসের জন্য চলে যান । সেখানে পল ভেরলেনকে বোনাপার্ত উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । স্কুলের তথ্য অনুযায়ী চোদ্দো বছর বয়সে তাঁকে দেখতে কুৎসিত মনে হতো । জীবনের প্রথম সাত বছর বাবার চাকুরির দৌলতে বিভিন্ন শহরে বসবাস করতে হয়েছিল ভেরলেনকে, যার দরুণ শৈশবে তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিলেন তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া খুড়তুতো বোন এলিজা । এলিজার অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কিশোর ভেরলেন ; এলিজা  ছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম,  যদিও এলিজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর একটা বাচ্চা ছিল তবু ভেরলেন তাঁকে দৈহিকভাবে চেয়েছিলেন; এলিজাকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘দুর্দান্ত উৎসব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, এলিজার মৃত্যুর পর । 
               ১৮৬২ সালে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  ভেরলেন প্রথমে বীমা কোম্পানির  চাকুরিতে যোগ দেন। ১৮৬৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান । দুই বছর আইন পরীক্ষা পড়ার পর ছেড়ে দ্যান। ১৮৬৭ সালে  এলিজা মোনকোঁলের মৃত্যুর ফলে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন আর বেয়াড়া হয়ে যান, বাবা-মায়ের কাছে তাঁর আবদার বেড়ে যায়, খামখেয়ালি, অব্যবস্হিতচিত্ত, স্বার্থপর, অপরিণত যুবক হয়ে ওঠেন ।  তাঁর মা মদ খাবার টাকা যোগাতেন না বলে বাড়িতে প্রায়ই ঝগড়া হতো । উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর আবসাঁথ খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । মদ্যপ অবস্হায় দু’বার মাকে খুন করার জন্য তাঁর পেছনে তরোয়াল নিয়ে দৌঁড়েছিলেন । ভেরলেনের বন্ধু তাঁদের দুজনের মাঝে গিয়ে ভেরলেনকে কাবু করেন । মাকে দ্বিতীয়বার আক্রমণের ব্যাপার চলেছিল সাত ঘণ্টা কথা কাটাকাটির মাঝে । মা পরের দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে আদরের ছেলেকে ক্ষমা করে দিতেন ।
             শার্ল বোদলেয়ারের ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ) পড়ার পর পল ভেরলেনের কবিতা লেখার ইচ্ছা হয়। ১৮৬৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মসিয়ঁ প্রুধোম’ প্রকাশিত হয় । তিনি ‘সমসাময়িক কবিতা’ ( Le Parnasse Contemporain ) পত্রিকার সম্পাদক কাতুলে মেনদেস-এর সঙ্গে দেখা করেন । পত্রিকাটিতে তাঁর আটটি কবিতা প্রকাশিত হয় । উনিশ শতকের ফ্রান্সে একদল কবি আরম্ভ করেন পারনাসিয় আন্দোলন ; নামটি নেয়া হয়েছিল অ্যাপোলো আর মিউজদের পবিত্র গ্রিক পাহাড়ের নাম থেকে । পারনাসিয়রা বিষয়বস্তু এবং শৈলীর বিস্তার প্রদর্শন করলেও, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন কারিগরি, অশেষ সৌন্দর্য ও বস্তুনিষ্ঠাকে। রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দিয়েছিল পারনাসিয় আন্দোলন এবং তা ক্রমে প্রসারিত হয় প্রতীকবাদ ও ডেকাডেন্ট কাব্যিক ঐতিহ্যে । পারনাসিয় আন্দোলনের প্রধান কবি বলে মনে করা হয় শার্ল-মারি-রেনে লেকঁত দ্যলিজেকে, কিন্তু আন্দোলনের অংশ হিসাবে মান্যতা দেয়া হয় থিয়োদোরে দ্যবাঁভিল, অঁরি কাজালিস, ফ্রাঁসোয়া কোপি, আনাতোল ফ্রাঁসে, থিয়োফিল গতিয়ে, জোসে-মারিয়া দ্যহেরদিয়া, সালধ প্রুধোম, পল ভেরলেন ও শার্ল বোদলেয়ারকে। ১৮৬৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৬  সালে সবসুদ্ধ নিরানব্বুইজন কবির তিনটি সংকলন প্রকাশ করেন আলফোঁসে লেমেরে, কাতুলে মেন্দেস আর লুই জেভিয়ার । এই তিনটি সংকলনের প্রকাশকে ফরাসী সাহিত্যে বাঁকবদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হয় । তবে থিয়োফিল গতিয়ে যখন ‘আর্ট ফর আর্টস শেক’ স্লোগান দিলেন তখন পারনাসিয় কবিরা একটা বৌদ্ধিক গতিমুখ পেলেন । ভেরলেন নিজেকে পারনাসিয় আন্দোলনের একজন সদস্য বলে মনে করতেন না ।
               ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ভেরলেনের প্রথম কাব্যগ্রন্হ Poemes Saturniens এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ Gallant Parties প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে । মেনদেসের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য পারনাসিয় কবি লেকঁতে দ্যলিজে, থিয়োদির দ্য বাঁভিল, লুই জেভিয়ার দ্য রিকার্দ, ফ্রাঁসোয়া সিপ্পি প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং সুফলো রোড-এর সস্তা মদের দোকানে সবাই মিলে আড্ডা দিতেন । বিয়ারের স্বাদ সেসময়ে ভালো ছিল না বলে আবসাঁথের প্রতি আসক্ত হন ভেরলেন ও অন্যান্য কবিরা । ভেরলেন নিজেই ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানিয়েছেন যে তিনি একবার সারারাতে দুশোবার অর্ডার দিয়ে আবসাঁথ খেয়েছিলেন । Poemes Saturniens এর “হেমন্তের কবিতা” লিখে ভেরলেন কবিদের প্রশংসা পেয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই কবিতাটির প্রথম ছয় লাইন মিত্রপক্ষের সৈন্যবাহিনী নরম্যাণ্ডি অবতরণের কোড হিসাবে বিবিসি থেকে প্রসার করেছিলেন ; প্রথম তিন লাইন পয়লা জুন আর দ্বিতীয় তিন লাইন পাঁচুই জুন :
    হেমন্তের বেহালার
    দীর্ঘ ফোঁপানিগুলো
    আমার হৃদয়কে আহত করে
    একঘেয়ে সুরের অবসাদে ।
    সমস্তকিছু শ্বাসহীন
    আর ফ্যাকাশে, যখন
    সময়ের কাঁসর বেজে ওঠে,
    আমার মনে পড়ে
    বিগত দিনগুলো
    আর আমি কাঁদি
    আর আমি চলে যাই
    এক অশুভ বাতাসে
    যা আমাকে নিয়ে যায়
    এখানে, সেখানে,
    যেন গাছের এক
    মৃত পাতা ।
              বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির শিরোনাম যদিও ‘হেমন্তের গান’, প্রতীকবাদী অন্যান্য কবিদের মতো ভেরলেনও, র‌্যাঁবোর সঙ্গে পরিচয়ের আগে, ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’কে মান্যতা দিয়ে কবির অন্তরজগতকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি যে বলতেন কবিতাকে সঙ্গীতময় হয়ে উঠতে হবে, তার পরিচয় মেলে এই কবিতায় ; তিনি বলতেন যে কবিতায় সঙ্গীতই প্রথম এবং প্রধানতম । যাঁরা কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য, ফরাসি ভাষায় না পড়লে কবিতাটির সঙ্গীতময়তা অনুধাবন করা যায় না । এই কবিতাটির অনুকরণে উনিশ শতকের শেষ দিকে বহু কবি কবিতা লিখেছেন । এই কবিতার আনুয়ি বা অবসাদ হয়ে ওঠে ভেরলেনের কবিতার বৈশিষ্ট্য। ভেরলেনের কবিতায় ক্ষয় বা অপচয় ঘুরে-ঘুরে এসেছে । কবিতাটির ধীর লয় কবির অবসাদকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োগ করেছেন ভেরলেন । পারনাসিয় কবিদের প্রভাবে র‌্যাঁবো ‘দি ড্রাঙ্কন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু পরে নিজেই এই কবিতার ধারাকে সমর্থন করেননি, এবং গদ্যকবিতার দিকে ঝোঁকেন ।
              উনিশ শতকের প্যারিসে লাতিন কোয়ার্টার ছিল যেন এক বোহেমিয়ান দ্বীপ, যেখানে জড়ো হতেন অজস্র লেখক, শিল্পী, নাট্যকার আর কবিযশোপ্রার্থী । ভিক্তর য়োগো, শার্ল বোদলেয়ার প্রমুখের মতন পল ভেরলেনও বেছে নিয়েছিলেন এলাকাটা, সস্তার মদ আর বেশ্যাসঙ্গের আকর্ষণে । প্যারিসের ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল প্যারিস কোয়ার্টারের খ্যাতি-কুখ্যাতির কারণ — এখন তা একেবারে বদলে গিয়েছে । যারা এই এলাকায় বাস করতো তাদের কাছে পাড়াটা ছিল নরক । অত্যন্ত গরিব শ্রমজীবিদের পাড়া, দুবেলা খাবার জোটেনা, অসুখে পড়লে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয় ইত্যাদি । তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চল থেকে এসে সস্তায় থাকার জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিল পাড়াটা, আর বাড়তি রোজগারের জন্য ঘর ভাড়া দিতো, বেশ্যাগিরি করতো, সস্তার মদ বিক্রি করতো । ক্রমশ তারা লেখক-কবি-শিল্পীদের চাহিদা মেটাবার জন্য সারারাতের যৌনহুল্লোড়ের ব্যবস্হা করতো । ফরাসি সাহিত্যে দেখা দিচ্ছিল রোমান্টিক ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তা, আদর্শের পরিবর্তে ‘পাপের ফুলের’ বা ‘নরকে ঋতুর’ প্রতি আকর্ষণ । ফাউস্তের জায়গা নিয়ে নিচ্ছিল মেফিসতোফিলিস । ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে দোটানায় ছিলেন কবি-লেখক-শিল্পীরা । পেত্রুস বোরেল নামে এক কবি, যিনি বোদলেয়ারের বন্ধু ছিলেন, লাতিন কোয়ার্টারে গরিব সেজে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁকে বলা হতো “নেকড়ে বাঘে পরিণত মানুষ।”    
               ভেরলেনের মতিগতি ফেরাবার জন্য তাঁর মা তাঁর বিয়ে প্রথমে ঠিক করেন কড়া মেজাজের এক মামাতো বোনের সঙ্গে,  কিন্তু তা এড়াবার জন্য ভেরলেন পছন্দ করেন এক বন্ধুর সৎবোন,  তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো  সুন্দরী তরুণী মাতিলদে মত দ্য ফ্ল্যেওরভিলেকে, বিয়ে হয় ১৮৭০ সালে ; মাতিলদের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে যুবতীটির বয়স ছিল ষোলো, তাঁর মা-বাবা ভেরলেনকে জানান যে তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে । ১৮৬৯ সালের জুনমাসের এক দুপুরে, মদ খাবার জন্য বন্ধু শালর্ক দ্য সিভরির মমার্তর বাড়িতে গিয়েছিলেন পল ভেরলেন । শার্ল তাঁর মা আর সৎবাবা থিওদোর মতে দ্য ফ্লেওরভিলের সঙ্গে থাকতেন । দুই বন্ধু যখন গল্প করছিলেন তখন ষোলো বছরের একটি সুন্দরী যুবতী ঘরে ঢোকেন, ভেরলেনের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢোকেন, তিনি শার্লের সৎবোন মাতিলদে মতে । ভেরলেনের কবিতা তাঁর পড়া ছিল এবং পড়ে কবিকে ভালো লেগেছিল, তিনিও ভেরলেনের প্রেমে পড়েন । বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই মাতিলদে গর্ভবতী হবার দরুন ভেরলেন বিষাদে আক্রান্ত হয়ে আবার লাতিন কোয়ার্টারে যাতায়াত আরম্ভ করেন ।তাঁদের একটি ছেলেও হয় ।  
             মাতিলদে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে প্রথম দুই বছর ভেরলেন তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। ভেরলেনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্হ ‘ভালো গান’-এর কবিতাগুলো  মাতিলদেকে মনে করে লেখা । কিন্তু মাঝে-মাঝে ভেরলেনের রুদ্ররূপ বেরিয়ে পড়তো আর তিনি মাতিলদের গায়ে হাত তুলতেন । একবার তিনি মাতাল অবস্হায় তাঁর ছেলে জর্জকে তুলে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন । তাঁর মা, শশুর-শাশুড়ির উপস্হিতিতেও এরকম আচরণ করতেন তিনি ।
              ভেরলেন  মিউনিসিপালিটির সরকারি চাকরিতে যোগ দেন  ১৮৭০ সালে । কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতনের পরবর্তী দ্রোহের সময়ে প্যারিস-শহর ও চাকরি ছেড়ে পালান । ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৮৭১ পর্যন্ত প্রুসিয় সেনারা প্যারিস শহর ঘিরে ফরাসিদের জব্দ করতে চায় । সমস্ত কিছুর অভাব দেখা দেয় । কবি-লেখকরা লাতিন কোয়ার্টারের যে পাড়ার পানশালায় গিয়ে আড্ডা দিতেন সেখানেের ভোজন-তালিকায় ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল এমনকি ইঁদুরের মাংস বিক্রি হতো । নারী আর পুরুষ বেশ্যারা এই খাবার একপেট খাবার বিনিময়ে সঙ্গমে রাজি হয়ে যেতো । এই সময় খবর রটে যায় যে বিসমার্ক পরামর্শ দিয়েছেন প্যারিসের ওপরে চারিদিক থেকে কামান দাগা হোক, কিন্তু ব্লুমেনথেল তা সামলে দেন এই তর্কে যে ফরাসি সেনার বদলে সাধারণ মানুষ তাতে মারা পড়বে । ভেরলেনসহ অনেকেই, যাঁরা প্যারিস কমিউনে যোগ দিতে চাননি, তাঁরা প্যারিস ছেড়ে পালান । ভেরলেন অবশ্য কমিউনের প্রেস অফিসার হিসাবে ১৮৭০-এ কাজ করেছিলেন আর কমিউন ভেঙে যাবার পর রাস্তায়-রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হলে অন্যান্য কবি-লেখকদের সঙ্গে গা ঢাকা দেন  ।
              পল ভেরলেনের জীবনযাত্রা, অপরাধ আর সাধাসিধে ছলাকলাশূন্যতার মাঝে দোল খেয়েছে । স্তেফান মালার্মে ও শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে তাঁকে প্রতীকবাদী কবিতার ত্রিমূর্তির অন্তর্গত করলেও, দুটি প্রতীতি প্রাধান্য পায় : প্রথম হল যে কবির অহং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ; দ্বিতীয় যে কবিতার কাজ হল চরম সংবেদন ও একক ধৃতির মুহূর্তগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখা । Poemes saturniens ( ১৮৬৬ ) কাব্যগ্রন্হে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “একে মিলোর তৈরি ভেনাস বলা হবে নাকি নিছক শ্বেতপাথর ?” তাঁর কবিতায় আপাত-অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা সত্বেও, তিনি কবিতার কারিগরিতে সহজ ও সঙ্গীতময় শব্দ প্রয়োগ করে সাবধানি কারুনৈপূণ্য বজায় রেখেছেন । ফরাসি ধ্রুপদি কবিতার খোলোসের মধ্যে থেকেও ছন্দবর্জনের খেলা খেলেছেন, যেমন ১৮৭৪-এ রচিত Romances sans Paroles কবিতায় লিখেছেন :
    “আমার হৃদয়ে ক্রন্দন
    শহরে বৃষ্টি পড়ার মতো”
              মাতিলদেকে নিয়ে ভেরলেন ভালোবাসার অনেকগুলো কবিতা লিখেছিলেন Le bonne chanson ( The Good Song ) কাব্যগ্রন্হে । কয়েকটার বাংলায়ন :
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে,
    এক গিন্নিমা তাঁর মিনারে,
    মহিমা ও ভালোবাসা
    যা মানুষের শব্দাবলীতে আছে ;
    সোনার বার্তা যা বাঁশি
    বহুদূরের বনানী থেকে বাজায়,
    অবলা গর্বের সঙ্গে বিবাহিত
    যা বহুকাল আগের মহিমাময়ীদের ;
    তার সাথে, ধরা পড়ে না এমন সৌন্দর্য
    এক তরতাজা বিজয়িনী হাসির
    যা ফুটে উঠেছে রাজহাঁসের পবিত্রতায়
    আর এক নারী-শিশুর লজ্জায় ।
    মুক্তার মতো আদল, শাদা আর গোলাপি,
    এক মৃদু অভিজাত স্বরসঙ্গতি :
    আমি দেখি, আমি এই সবকিছু শুনতে পাই
    মেয়েটির শার্লমেনিয় বংশধরের নামে ।
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম …
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম,
    বেদনাদায়ক অনিশ্চিত
    তোমার প্রিয় হাত  ছিল আমার পথনির্দেশক।
    তাই দূরে দিগন্তের উপর ফ্যাকাশে
    ভোরের একটি দুর্বল আশা ছড়াচ্ছিল দ্যুতি;
    তোমার দৃষ্টিতে ছিল ভোর।
    চারিদিক নিঃশব্দ, তোমার সুরেলা পদক্ষেপ ছাড়া শব্দ নেই,
    ভ্রমণকারীকে উত্সাহিত করেছো তুমি।
    তোমার কন্ঠস্বর আমাকে বলেছিল: “এগিয়ে চলো !”
    আমার ভয়ঙ্কর হৃদয়, আমার ভারী হৃদয়
    একা কেঁদেছিল দুঃখের পথযাত্রায়
    ভালবাসা, আনন্দদায়ক বিজয়ী,
    আমাদের আনন্দের বাঁধনে আবার  একত্র করেছে।
           ১৮৬৫ সালে শার্ল বোদলেয়ার সম্পর্কে লেখা দুটি প্রবন্ধে ভেরলেন জানিয়েছিলেন যে একজন কবির অন্বেষন কেবল সৌন্দর্য । কবিতা রচনায়, তিনি বলেছেন, প্রেরণা আর আবেগের যৎসামান্য স্হান থাকলেও কবির থাকা দরকার কারিকুরির সৃষ্টিশীলতা । ব্যক্তিগত আবেগকে যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে ছন্দ, ধ্বনি এবং চিত্রকল্পকে একত্রিত করে একটি কাব্যিক সঙ্গীত গড়ে নিতে হবে এবং সেই জগতে কোনোকিছুই আপতনিক নয় । ভেরলেনের কারিগরির ফল হল তাঁর কবিতার সঙ্গীতময়তা ; ধ্বনিরা একত্রিত হয়ে এক সুরেলা ঐকতান সৃষ্টি করে । ১৮৮২ সালে তিনি বলেছিলেন, “L’Art poetique” কবিতায়, “কবির উচিত বিজোড়-মাত্রার পঙক্তি, যথাযথ-নয়-এমন শব্দভাঁড়ার এবং প্রচ্ছন্ন চিত্রকল্প ব্যবহার করা ; রঙের বদলে অতিসূক্ষ্ম তারতম্যকে গুরুত্ব দেয়া । কবিকে ইচ্ছাকৃত ছন্দ, বৈদগ্ধ্য ও বাগ্মীতা এড়াতে হবে । কবিতা হবে হালকা, বাতাসে ভাসমান, যৎসামান্য সুগন্ধময় ও ক্ষণিক । এছাড়া সমস্তকিছু কবিতা হয়ে ওঠার পরিবর্তে হয়ে উঠবে সাহিত্য ।” 
              সমসাময়িক বাস্তববাদ এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ অলঙ্কার বর্জন করে অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের মতো পল ভেরলেনও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন মেজাজ, সত্তা । তাঁর কাব্যগ্রন্হ Fetes gallantes  এর অন্তর্গত Clair de Lune ( Moonlight ) “চাঁদের আলো” কবিতাটিকে মনে করা হয় তাঁর সবচেয়ে ভালো কাজ । যেভাবে চাঁদ তার আলো সূর্য থেকে পায়, ভেরলেন চাইলেন এমন বিষয়বস্তু বেছে নিতে যা সহজে অভিগম্য নয়, তাই চাঁদের মতো পরোক্ষভাবে বিষয়বস্তুকে দীপ্ত করতে চাইলেন, যা প্রতিফলন সৃষ্টি করে ।
               ভেরলেনের কবিতাটিতে আছে মুখোশ আর নৃত্য, অভূতপূর্ব ছদ্মবেশ, আহ্লাদিত ঝর্ণাদের ফোঁপানি, চাঁদের আলো : বিশেষকিছু না বলেই কবিতাটিতে ইশারামূলক ছবির স্লাইড চলে যায় একের পর এক । ডেভিড ওইসত্রাখ ও ফ্রিদা বাওয়ের এই কবিতাটিকে নিয়ে একটি নৃত্যনুষ্ঠান করেছেন । ক্লদ দেবুসি, রেনাল্দো হাহন, পোলদোস্কি, গুস্তাভ কার্পেন্তিয়ের এবং গ্যাব্রিয়েল ফাওরে নিজেদের মতো করে সুর দিয়েছেন কবিতাটিতে । ইংরেজিতে যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা বলেছেন কবিতাটি অনুবাদ করা কঠিন। 
    Moonlight
    Your soul is like a landscape fantasy,
    Where masks and Bergamasks, in charming wise,
    Strum lutes and dance, just a bit sad to be
    Hidden beneath their fanciful disguise.
    Singing in minor mode of life’s largesse
    And all-victorious love, they yet seem quite
    Reluctant to believe their happiness,
    And their song mingles with the pale moonlight,
    The calm, pale moonlight, whose sad beauty, beaming,
    Sets the birds softly dreaming in the trees,
    And makes the marbled fountains, gushing, streaming–
    Slender jet-fountains–sob their ecstasies.
              আমি এখানে শুভদীপ নায়কের করা বাংলা অনুবাদ দিলুম । উনি নামকরণ করেছেন ‘জ্যোৎস্না’
    জ্যোৎস্না
    ( clair de lune / Moonlight)
    তোমার অন্তর এক প্রশস্ত কল্পনার মতো
    সেখানে মুখোশ ও মুখশ্রী দুই-ই প্রজ্জ্বলিত
    বীণার তার এবং নৃত্য, যা আসলে বেদনামথিত
    তোমাকে লুকিয়ে রাখে সৌন্দর্যের আড়ালে
    সঙ্গীতকে ধীরে ধীরে করে তোলো বৃহৎ জীবন
    ভালবাসাময়, নিশ্চল ও শান্ত
    তাদের সুখের ওপর বজায় রাখো বিশ্বাস
    সেইসব সঙ্গীত তুমি ধরে রাখো জ্যোৎস্নায়
    শান্ত পরাভব সেই জ্যোৎস্না, অপূর্ব ক্লেশে বিকশিত
    পাখিদের মতো এসে বসে স্বপ্নময় গাছের ডালে
    হয়ে ওঠে ঝর্ণা, চিত্তের প্রবাহ
    ঝর্ণার ঋজুতায়, — নিজস্ব উল্লাসে
              একজন মানুষের আত্মার রুপকশোভিত ছবিতে, ‘চাঁদের আলো’ জাগিয়ে তোলে সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর প্রশান্তির আকাঙ্খা । কবিতাটি থেকে ক্রমবর্ধমান হতাশার যে আবহ গড়ে ওঠ তাতে পাওয়া যায় ভেরলেনের আত্মমগ্নতার কন্ঠস্বর । ভেরলেন পাঠকের মনে সন্দেহ তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয়, বাস্তবে কি সত্যিই ভালোবাসা আর আনন্দ পাওয়া সম্ভব । প্রধান উপমাটিকে প্রয়োগ করে তিনি বলতে চেয়েছেন যে প্রত্যেক মানুষই তার অন্তরজগতে একটা ভূদৃশ্য বহন করে, আর এই ক্ষেত্রে, যে উপাদান তৈরি হয় তা হলো একই সঙ্গে সুন্দর আর আশাহীন । অস্তিত্ব এবং যা দেখা যাচ্ছে, তার বৈপরীত্য কবিতাটির গুরুত্বপূর্ণ থিম । দৈহিক সৌন্দর্য আর বিষাদের মিশ্রিত অবস্হান ভেরলেন পেয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে । তাঁর মতে, মানুষের জীবনে এবং আত্মায়, অর্থাৎ মৃত্যুর পর, তার নিখুঁত হবার প্রয়াস কখনও পুরণ হবে না । জীবনের সত্যকার সত্তা উপরিতলে পাওয়া যাবে না ।
              ভেরলেনের সযত্নে রচিত কবিতার বনেদ প্রায়শই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর, নিঃসন্দেহে নাটকীয় এবং আবেগমথিত বিষয়বস্তু । তাঁর “Poemes saturniens”     প্রস্তাবনায় স্পষ্ট যে তিনি নিজের অবজ্ঞাত, দৈন্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত নিয়তি আঁচ করতে পেরেছিলেন । এই কাব্যগ্রন্হের সব কয়টি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন অসুখী থাকার স্বপূরক প্রত্যাশার একাধিক বিন্যাস । আনন্দের ক্ষণিক মুহূর্ত ভেরলেনের  সমস্ত কবিতায় ছেয়ে আছে । এমনকি “Sagesse” গ্রন্হে, যেখানে রোমান ক্যাথলিক রহস্যময়তার কথা বলেছেন, এবং বলেছেন যে তাতেই আছে সর্বোচ্চ আনন্দ, ঈশ্বরের সঙ্গে শান্তিময় আলাপনের সময়েও তিনি অধঃপতনের সময় ফিরে আসার ভয়ে আতঙ্কিত । যেহেতু যৌনতা, ঈশ্বর আর আবসাঁথ তাঁর ‘শনিআক্রান্ত নিয়তি’ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত অন্য আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, এবং তা হল ঘুম । শেষ দিকের কবিতায় বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে ঘুমের কথা, চিত্রকল্পগুলো ঘুমের, যেন কমনীয় ঘুমপাড়ানি গানের মনোরম ছবি — তা থেকে রঙ, হাসি, তীক্ষ্ণতা, জমকালো, মাত্রাধিক ধ্বনি বাদ দেয়া হয়েছে — কবির ক্ষতবিক্ষত মনকে ঘুমের আরামে শান্তি দিতে পারে । বেশ কিছু কবিতায় এক মাতৃমূর্তিকে পাওয়া যায় দোলনার পাশে কিংবা এক মাতৃমূর্তি লক্ষ রাখেন ঘুমন্ত কবির পাশে দাঁড়িয়ে । যে কবিতায় ঘুমের মোটিফ নেই, তাতেও কবিতার শেষের পঙক্তিগুলোয় এসেছে মুছে যাবার রিক্ততাবোধ ।
              আলোচকরা ভেরলেনকে তাঁর কবিতার শিল্পানুগ ও গভীর অনুভূতির বৈশিষ্ট্যের কারণে ফরাসী প্রতীকবাদের অগ্রদূতদের একজন হিসাবে চিহ্ণিত করলেও, তিনি তাঁর কবিতাকে ডেকাডেন্ট বা প্রতীকবাদের তকমা দিতে অস্বীকার করে বলেছেন যে তিনি নিজেকে একজন ‘ডিজেনারেট’ বা অপজাত কবি বলতে চাইবেন, কেননা তাঁর কবিতায় থাকে অহংকার ও অরাজকতার প্রবণতা ; প্রতীকবাদীদের তুলনায় তিনি প্রচলিত ভাষাকে সঙ্গীতময় করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকৃতপক্ষে ভেরলেনের জীবনের ঘটনাবলী ছেয়ে ফেলেছে তাঁর কবিতার গুণাগুণ ও কাব্যিক প্রতিভা । যেমন তাঁর জীবনে, তেমনই তাঁর কবিতায়, অবিরম লড়াই দেখা যায় তাঁর অন্তরজগতের সঙ্গে তাঁর ইন্দ্রিয়ের, লাম্পট্য ও পশ্চাত্যাপের । তাঁর চরিত্রকে আক্রমণ সত্বেও, ভেরলেনকে মনে করা হয় একজন সুসম্পূর্ণ কবি, যাঁর অসাধারণ প্রতিভা দেখা যায় কবিতার অঘনিভূত মাত্রায়, ইশারামূলক ও লাক্ষণিক ভাষায় এবং প্রতিচ্ছায়াময় বাক্যালঙ্কারে । ফরাসি কবিতাকে ভেরলেনই পরিভাষাগত প্রাবল্যের বাইরে বের করে আনেন এবং ফরাসী ভাষার সহজাত সঙ্গীতময়তাকে ব্যবহার করা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছেন কবিতা হওয়া উচিত  সুখশ্রাব্য ও সন্মোহক, অস্পষ্ট ও দ্রবনীয় ; পাঠক কবিতাকে বিভিন্ন থিমে চিহ্ণিত করতে পারবেন, এমন কবিতা লেখা তিনি পছন্দ করেন না  । সেকারণেই তাঁর কবিতার অনুবাদে তাঁকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না। তাঁর বক্তব্য বোঝাবার জন্য ভেরলেন কবিতার শিল্প (Art Poetique )    শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ; আমি বাংলায়নের চেষ্টা করেছি :
     সবকিছুর আগে সঙ্গীতময়তা–
    আর এর জন্য আরও অস্বাভাবিকতা–
    অস্পষ্ট ও আরও বেশি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া, 
    তাকে ভার বইতে হয় বা বেঁধে ফেলতে হয় তাকে বাদ দিয়ে দাও
    তাকে এমন হতে হবে যে তুমি খুঁজে বেড়াবে
    তোমার শব্দগুলোয় কোনোরকম গাফিলতি ছাড়াই :
    ধূসর গান ছাড়া প্রিয় আর কিছু নেই
    যেখানে বিচলন ও যথাযথের মিল হয় ।
    আনেকটা কালোজালের আড়ালে সুন্দর চোখের মতন, 
    অনেকটা ছড়িয়ে-পড়া দুপুরের স্পন্দনের মতন,
    অনেকটা ( যখন হেমন্তের আকাশ শোভনীয় করে তোলে )
    সুস্পষ্ট নক্ষত্রদের নীল বিশৃঙ্খলা !
    কেননা আমরা আরও বেশি চাই সূক্ষ্ম তারতম্য–
    রঙ নয়, সূক্ষ্ম তারতম্য ছাড়া কিছু নয় !
    ওহ ! কেবল সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে আসে
    স্বপ্নকে স্বপ্নের মধ্যে আর বাঁশিকে শিঙায় !
    খুনির ধারালো বক্তব্য থেকে দূরে রাখো,
    নিষ্ঠুর বৈদগ্ধ  আর পঙ্কিল হাসি,
    যা নীল শূন্যতার চোখে অশ্রূজল এনে দ্যায়—
    আর মৃদু আঁচের যাবতীয় রসুনরান্না ।
    বাগ্মীতাকে ধরে তার ঘাড় মুচড়ে দাও !
    তোমার তাতে ভালো হবে, কর্মচঞ্চল মেজাজে,
    যাতে কবিতার মিলকে কিছুটা সুবিচার করা যায় ।
    যদি না লক্ষ রাখা হয়, তাহলে তা কোথায় যাবে ?
    ওহ, কে আমাদের বলতে পারে মিলের ভ্রষ্ট আচরণ ?
    কোন বধির বালক কিংবা উন্মাদ কালো মানুষ
    আমাদের জন্য বানিয়েছে এই এক পয়সার খেলনা,
    যা ফাঁপা শোনায় আর শুনে মনে হয় নকল
    সঙ্গীতকে হয়ে উঠতে দাও, অনেক বেশি করে আর সবসময় !
    তোমার কবিতা হয়ে উঠুক চলমান জিনিস
    যাকে অনুভব করে মনে হবে তা বদলে যাওয়া আত্মা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে,
    অন্য আকাশ থেকে অন্য প্রেমের দিকে ।
    তোমার কবিতাকে আনন্দময় ঘটনা হয়ে উঠতে দাও,
    অস্হির ভোরের বাতাসের মাঝে,
    যা পুদিনা আর থাইমলতার সুগন্ধ নিয়ে উড়ে বেড়ায়…
    আর বাদবাকি সমস্তই সাহিত্য ।
              ফ্রান্সে, রোমান্টিসিজমের পর, তখন রোমান্টিসিজম বলতে যা বোঝাতো, আর পারনাসিয়দের দ্ব্যর্থহীন, ধ্রুপদি, অতিরিক্ত যত্নবান,  চিত্তাকর্ষকভাবে মোহনীয় কবিতার যুগের পর, সমাজ যখন কলকারাখানার আধুনিকতাবাদী সমাজে অনিশ্চিত জীবনযাপনের মুখোমুখি হওয়া আরম্ভ করল, গ্রাম থেকে দলে-দলে পরিবার শহরে অনিশ্চিত জীবনধারায় বসবাস করতে আরম্ভ করল,তখন পল ভেরলেনের মতন কবিরা কবিতায় অনিশ্চয়তার ও অনির্ণেয়তার প্রয়োজন অনুভব করলেন । পল ভেরলেনের ‘আর্ট পোয়েটিক’ কবিতাটি বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার উপস্হিতিকে কবিতায় আনতে চেয়েছে । তিনি অনুভব করলেন যে মানুষ চায় না  তাকে সীমা দিয়ে বেঁধে রাখা হোক, সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায় । নিজের বিবাহিত জীবন এবং পায়ুকামীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও কারাগারের জীবন থেকে তেমনটাই তাঁর মনে হয়ে থাকবে । ১৮৭৪ সালে যখন তিনি বললেন, ‘প্রথম এবং সর্বাগ্রে সঙ্গীত’, তখন ফরাসি কবিতায় নতুন কিছুর কথা বললেন তিনি । ফরাসি কবিতা চিরকালই সঙ্গীতময় ছিল, কিন্তু ভেরলেনের আগে কেউ বলেননি যে সঙ্গীতই কবিতায় মূল ব্যাপার । তার আগে তো ছিলই উপলবব্ধির গভীরতা, দৃষ্টিলব্ধ অবধারণা, বাচনিক নমনীয়তা ও পারিপাট্য । ভেরলেন সঙ্গীতকে কবিতায় গৌরবান্বিত করলেন । কবিতায় সঙ্গীত অদেখা বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ হবার উপায় বাতলায় এবং যে বাস্তবতা স্পষ্টভাবে প্রভাবান্বিত করে তাকে কবিতার সিংহাসনে বসায় ।
    চার
              পল ভেরলেন আদেনেস থেকে জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে সতেরো বছরের এক কবিযশোপ্রার্থীর চিঠি আর চিঠির সঙ্গে তার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন,  আর তাকে গাড়িভাড়া পাঠিয়ে বললেন প্যারিসে চলে আসতে । ১৮৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শার্লভিল থেকে প্যারিস পৌঁছোলেন র‌্যাঁবো, সঙ্গে নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যার মধ্যে একটি কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘দি ড্রাঙ্কেন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ । স্টেশনে কেউ ছিল না তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য। ভেরলেন, তাঁর বন্ধু শার্ল গ্রস্ত-এর সঙ্গে গার দু নর্দ আর গার্দ দ্যলেস্ত-এর মাঝে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তরুণ অতিথির জন্য । শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মমার্ততে মাতিলদের বাবা-মায়ের বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন ; পল ভেরলেন বিয়ের পর শশুরবাড়িতে থাকতেন । পথে তাঁরা খুঁজে পেলেন রোদে পোড়া গম্ভীর-মুখ, নীল চোখ, তরুণটিকে, যে, তাঁদের সঙ্গে আরদেনেসের বাচনভঙ্গীতে হ্যাঁ-হুঁ করে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে কথা বলল ।   
              বারো বছর পরে তাঁর স্মৃতিচারণে ভেরলেন লিখেছেন যে, “তরুণটি ছিল দীর্ঘ, শক্ত কাঠামোর, খেলোয়াড়দের মতো আদরা, নিখুঁত ডিম্বাকার মুখ, যেন নির্বাসন থেকে ফেরা এক দেবদূত ; দেহের শক্ত কাঠামোর ওপরে শিশুসূলভ গালফোলা মুখ, হাবভাবে বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে দ্রুত বেড়ে-ওঠা জবুথবুপনা ।” ভেরলেনের স্ত্রী আর শাশুড়ি তরুণটিকে বাড়িতে নিয়ে আসা যে ভালো হয়নি তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কিন্তু তাড়াতে পারলেন না কেননা ভেরলেনের শশুর সেসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন । এক দিনেই তাঁরা টের পেলেন যে অতিথিটি চাষাড়ে, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে উলঙ্গ হয়ে রোদ পোয়ায়, যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল তাকে করে ফেলেছে নোংরা আর লণ্ডভণ্ড, যিশুর ছোটো ক্রস ভেঙে ফেলেছে, চুলে উকুন । ভেরলেন যা করতে চাইতেন অথচ করার সাহস পেতেন না, অতিথিকে সেসব করতে দেখে পুলক বোধ করছিলেন । 
              অতিথিকে বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে গেলেন ভেরলেন । লিয়ঁ ভালাদে নামে ভেরলেনের এক বন্ধু তাঁর আরেক বন্ধুকে লিখে জানিয়েছিলেন, “তুমি পল ভেরলেনের নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পেলে না, ভেরলেন যে তরুণটির জন দ্য ব্যাপটিস্ট ; বড়ো-বড়ো হাতের চেটো, বড়ো-বড়ো পা, মুখ যেন তেরো বছরের বাচ্চার, চোখ দুটো নীল, আর তরুণটি ভিতু মনে হলেও, মতামত অসামাজিক মনে হলো, কল্পনাশক্তি অজানা কুকর্মে ঠাশা, বন্ধুরা তো সবাই তাকে দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ আর আতঙ্কিত । তরুণটি যেন ডাক্তারদের মাঝে একজন শয়তান ।” প্রকাশক গঁকুরভাইদের একজন জানিয়েছেন যে ভেরলেনের অতিথির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সবচেয়ে বজ্জাত কোনো খুনির হাত । 
              মাতিলদের বাবার ফেরার আগের দিন ভেরলেনের অতিথিকে নিজের বাড়িতে কয়েকদিন রাখলেন শার্ল ক্রস ; তারপর পারনাসিয় কবি থিয়োদোর দ্যবাঁভিলের বাড়িতে চাকরানির ঘরে স্হান পেলেন । প্রথম রাতে জানলা দিয়ে নিজের ভিজে জামা-কাপড় রাস্তায় ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেললেন তরুণটি, চিনামাটির বাসন ভেঙে ফেললেন, বিছানায় কাদামাখা জুতো পরে শুলেন, আর গোপনে কয়েকটা আসবাব বেচে দিলেন । বাঁভিলও এক সপ্তাহ কাটতেই ভেরলেনকে বললেন নিজের অতিথিকে ফেরত নিয়ে যেতে । তরুণটির আচরণে একমাত্র ভেরলেনই আহ্লাদিত হচ্ছিলেন । মাতিলদেকে নিয়ে কবিতাগুলো লেখার পর ভেরলেন নতুন কবিতা লেখার সময় পাননি। তরুণটি তাঁকে ওসকাচ্ছিলেন অনভিজাতের মতো জীবন কাটাতে এবং মদে চুর হয়ে দ্রষ্টার মতো কবিতা লিখতে । তাছাড়া পল ভেরলেন পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পায়ুকামের আদর্শ সঙ্গী, যাকে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রক্ষিতার মতন লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। ভেরলেন তাঁর অভিজাত পোশাক ছেড়ে নামানো-টুপি আর গলায় মাফলার ধরেছিলেন, অতিথির জন্য টাকাকড়ি খরচ করছিলেন প্রচুর । তাঁদের পায়ুকামের সম্পর্ক যখন আর গোপন রইলো না তখন ভেরলেনের বন্ধুরা তাঁর পাশ থেকে সরে যেতে লাগলেন । দুজনে মিলে গুহ্যদ্বার নিয়ে একটা সনেট লিখলেন ( Sonnet du trou cul ), যার প্রথম আট লাইন ভেরলেনের এবং পরের ছয় লাইন র‌্যাঁবোর । কবিতাটা ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনেকে অনুবাদ করেছেন ; আমি পল শ্মিট-এর অনুবাদটা দিলুম এখানে :
    Hidden and wrinkled like a budding violet
    It breathes, gently worn out, in a tangled vine
    (Still damp with love), on the soft incline
    Of white buttocks to the rim of the pit.
    Thin streams like rivers of milk ; innocent
    Tears, shed beneath hot breath that drives them down
    Across small clots of rich soil, reddish brown,
    Where they lose themselves in the dark descent…
    My mouth always dribbles with its coupling force;
    My soul, jealous of the body’s intercourse,
    Makes it tearful, wild necessity.
    Ecstatic olive branch, the flute one blows,
    The tube where heavenly praline flows,
    Promised Land in sticky femininity.
              র‌্যাঁবোকে একই সঙ্গে চরস আর আবসাঁথ খাইয়ে ভেরলেন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে, যার অন্বেষণ করছিলেন তিনি, ‘ইন্দ্রিয়গুলোর অপরিমেয় ও নিয়মানুগ বিশৃঙ্খলা’ ঘটানোর জন্য । ২১ অক্টোবর ১৮৭১ ভেরলেনের ছেলের জন্ম হলো এবং সংবাদটিতে আনন্দিত হবার বদলে ক্রুদ্ধ হলেন তিনি । মাতিলদে জানিয়েছেন যে অক্টোবর ১৮৭১ থেকে জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভেরলেন তাঁকে মারধর করতেন আর খুন করার হুমকি দিতেন, একদিন সত্যিই গলা টিপে ধরেছিলেন, হাতখরচ না পেয়ে । স্বামীর দুর্ব্যাবহার আর মা-বাবার কাছে লুকোতে পারলেন না মাতিলদে, কেননা মাতিলদের দেহে আঘাতের চিহ্ণ আর স্বামীর কথা জিগ্যেস করলেই তাঁর কান্না থেকে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে চাষার ছেলেটা আসার পরে কি ঘটছে মেয়ের শোবার ঘরে । জামাইয়ের পায়ুকামের প্রতি আকর্ষণের খবরও তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল । ডাক্তার ডেকে মাতিলদেকে পরীক্ষা করিয়ে মেয়ে আর মেয়ের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের পারিবারিক বাড়ি পেরিজিউতে ।
              স্ত্রী চলে যাবার পর ভেরলেন বিয়েটা বাঁচানোর চেষ্টায় র‌্যাঁবোকে বললেন বাড়ি ফিরে যেতে ; সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দুজনে আবার একত্রিত হতে পারবেন । প্যারিসে আসার ছয় মাস পরে মার্চ ১৮৭২ সালে বাড়িমুখো হলেন র‌্যাঁবো ; তিনি জানতেন যে তাঁকে ছাড়া ভেরলেনের চলবে না । মাতিলদে ছেলেকে নিয়ে প্যারিসে ফিরলেন, তাঁর মনে হলো মিটমাট হয়ে গেছে, চাষার ছেলেটা বিদেয় হয়েছে । ভেরলেনও চাকরি খুঁজতে লাগলেন । কিন্তু গোপনে চিঠি লিখতে লাগলেন র‌্যাঁবোকে, জানতে চাইলেন কেমন করে কোথায় দুজনে মিলিত হবেন । পায়ুকামর নেশায় ভেরলেনের কবিতা থেকে মিনার্ভা আর ভিনাস বিদায় নিয়েছিলেন । র‌্যাঁবোর প্রভাবে ভেরলেন তাঁর অন্তরজগতে লুকিয়ে থাকা দানবটাকে বাইরে বের করে আনার সুযোগ পেয়ে গেলেন । ভেরলেনের দানবকে সহ্য করতে না পেরে ১৮৭২ সালে মেয়ের সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন মাতিলদের বাবা, তখনও ডিভোর্স প্রচলিত হয়নি । ১৮৮৪ সালে ডিভোর্স আইনসঙ্গত হলে মাতিলদের সঙ্গে ভেরলেনের ডিভোর্স হয় । মাতিলদে আবার বিয়ে করেছিলেন এবং একষট্টি বছর বয়সে মারা যান ।
            ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরলেন আর র‌্যাঁবো লণ্ডন পৌঁছোলেন ; সেইসময়ে লণ্ডন ও বিশেষ করে সোহো ছিল ফরাসি কমিউনের পলাতক সদস্যদের লুকোবার পক্ষে ভালো জায়গা । কমিউনের প্রতি ভেরলেনের আগ্রহ থাকলেও র‌্যাঁবোর ছিল না । ভেরলেনকে তাঁর বুর্জোয়া মানসিক গঠন থেকে মুক্তি দেবার জন্য র‌্যাঁবো তাঁকে উৎসাহিত করলেন মুসেত এবং লেকঁত দ্যলিজের কবিতা পড়তে, ফরাসি কবিতার বারো মাত্রার ঐতিহ্য এবং ব্যালাডের আট মাত্রা অনুসরণ না করে দশ মাত্রার কবিতা লিখতে । র‌্যাঁবো তাঁকে পরামর্শ দিলেন কবিতা থেকে মানবিক কাহিনি, বাস্তববাদী ছবি আর ভাবপ্রবণ প্রতিকৃতি বাদ দিতে । পল ভেরলেনের মতে র‌্যাঁবোর ভালো লেগেছিল লণ্ডন ; তিনি ভেরলেনকে বলেছিলেন যে লণ্ডনের তুলনায় প্যারিসকে শহরতলি মনে হয়, লণ্ডনে রয়েছে কয়লা-চালিত ফ্যাক্ট্রি, টেমস নদীর ধারে জাহাজের ডক এবং সর্বোপরি একটি সাম্রাজ্যের রমরমা। ভেরলেন সেসমস্ত ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কেবল কচি-তরুণ র‌্যাঁবোর সঙ্গে দৈহিক মিলনেই বেশি আনন্দ পেতেন, লণ্ডনে তাঁদের যথেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ ছিল না । র‌্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’ কবিতার ‘ফুলিশ ভার্জিন’ প্রসঙ্গ ভেরলেন সম্পর্কে । তাঁরা ডেরা নিয়েছিলেন কামডেনের গ্রেট কলেজ স্ট্রিটে ( এখন রয়াল কলেজ স্ট্রিট ); বাড়িটিতে একটা প্লেট লাগানো আছে যে তাঁরা দুজনে সেখানে ছিলেন । নিজেদের ‘উৎকট দম্পতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন র‌্যাঁবো । লণ্ডন থেকে প্যারিসে এক বন্ধুকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আমি আর ফরাসি সংবাদপত্র পড়িনা ; পড়ে হবেই বা কি?” তাঁরা দুজনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্হাগারে যেতেন বটে কিন্তু পল ভেরলেন যেতেন শহরের শীত থেকে বাঁচার জন্য, যখন কিনা র‌্যাঁবো  যেতেন বিনে পয়সায় কাগজ-কলম-কালি পাওয়া যেতো বলে। বইপত্র পড়তেন । লণ্ডনের বাইরে বেড়াতে যেতেন দুজনে, ভেরলেন হ্যাম্পস্টেড হিথের কথা লিখেছেন, গ্রামাঞ্চল দেখার জন্য । র‌্যাঁবোকে ছাড়তে না পারার কারণ হিসাবে ভেরলেন লিখেছেন যে, এক ধরণের মিষ্টতা ঝলকাতো ওর নিষ্ঠুর ফিকে-নীল চোখে আর লালচে ঠোঁটের কটু ইশারায় । ইতিমধ্যে র‌্যাঁবো তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মত্ত নৌকো’র আঙ্গিক ছেড়ে নতুন ধরণের গদ্য-কবিতার দিকে ঝুঁকছিলেন, যার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ আর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর কবিতাগুলোতে ।
           লণ্ডন তাঁদের দুজনকেই অবাক করেছিল, আহ্লাদিত করেছিল । ভেরলেন বিস্মিত হয়েছিলেন দিগন্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ আর লোহার সেতু দেখে, আর পথে-পথে নির্দয়, বারফট্টাই-মারা জনগণকে দেখে । ভেরলেন লিখেছেন লণ্ডন ছিল অতিশালীন, কিন্তু অসচ্চরিত্র হবার সব রকমের সুযোগ ছিল অবারিত, আর প্রচুর খরচ সত্বেও, তাঁরা সদাসর্বদা থাকতেন এইল, জিন আর আবসাঁথে মাতাল । আবসাঁথের সবুজ পরী র‌্যাঁবোকে ডাক দিয়েছিল ‘স্বরবর্ণ’ নামের কবিতাটি লিখতে ।
    স্বরবর্ণ
    A কালো, E শাদা, I লাল,  U সবুজ, O নীল : স্বরবর্ণ
    কোনো দিন আমি তোমার জন্মাবার কান্না নিয়ে কথা বলবো,
    A, মাছিদের উজ্বল কালো মখমল জ্যাকেট
    যারা নিষ্ঠুর দুর্গন্ধের চারিধারে ভন ভন করে,
    ছায়ার গভীর খাত : E, কুয়াশার, তাঁবুগুলোর অকপটতা,
    গর্বিত হিমবাহের, শ্বেত রাজাদের বর্শা, সুগন্ধলতার শিহরণ :
    I, ময়ূরপঙ্খীবর্ণ, রক্তাক্ত লালা, নিঃসঙ্গের হাসি
    যার ঠোঁটে ক্রোধ কিংবা অনুশোচনায় মাতাল :
    U, তরঙ্গ, ভাইরিডিয়ান সমুদ্রের দিব্য কম্পন,
    চারণভূমির শান্তি, গবাদিপশুতে ভরা, হলরেখার শান্তি  
    কিমিতির চওড়া পড়ুয়া ভ্রুজোড়া দিয়ে বিরচিত :
    O, চরম তূর্যনিনাদ, অদ্ভুত কর্কশ আওয়াজে ভরপুর,
    জগত আর দেবদূতে রেখিত নৈঃশব্দ :
    O, সমাপ্তি, মেয়েটির চোখের বেগুনি রশ্মি !
            র‌্যাঁবো খ্রিসমাসের জন্য বাড়ি ফিরলেও ভেরলেন ফিরতেন না ;র‌্যাঁবোর সমস্যা ছিল মা সবসময় বলতেন একটা চাকরি খুঁজে জীবনে স্হির হতে । ভেরলেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সংসারের বাঁধন থেকে, দায়িত্ব থেকে, এবং পাপবোধে ভুগে কাঁদতেন মাঝেমধ্যে ; তাঁর কাছে র‌্যাঁবো ছিলেন ‘দীপ্তিময় পাপ’ আর র‌্যাঁবোর কাছে ভেরলেন ছিল ‘ক্ষুদে প্রিয়তমা’ । ইংরেজি শব্দের তালিকা তৈরি করেছিলেন এবং লণ্ডনে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করেছিলেন ভেরলেন। ফ্রান্সের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে পল ভেরলেনের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছিল। তাঁর ভবিষ্যতের জীবনীকার এদমন্দ লেপেলেতিয়েকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই একটা বড়ো সংস্হায় চাকরি পাবো, যেখানে প্রচুর রোজগার করা যাবে, ইতিমধ্যে আমি কয়েকটা আমেরিকান সংবাদপত্রের জন্য কাজ করছি যারা ভালো পয়সাকড়ি দ্যায় ।” লেপেলেতিয়ে তার কোনো প্রমাণ পাননি, এবং সবই ভেরলেনের বানানো, ফরাসি কবিদের ঈর্শ্বান্বিত করার জন্য । দুজন ভবঘুরে লণ্ডনের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কাজের জন্য কিন্তু কারোর সাড়া তাঁরা পাননি । লেপেলেতিয়ে একটা কাগজের বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পেরেছিলেন, সম্ভবত র‌্যাঁবোর তৈরি খসড়া :
    এক ফরাসি ভদ্রলোক ( ২৫ ), অভিজাত সমাজে যাঁর ভালো যোগাযোগ আছে, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসি ডিপ্লোমাধারী, ইংরেজিতে সড়গড়, এবং বিপুল সাধারণ জ্ঞানের মানুষ, ব্যক্তিগত সচিব, পর্যটনের সঙ্গী কিংবা গৃহশিক্ষকের চাকরি খুঁজছেন । সম্ভ্রান্তদের সুপারিশ আছে । ঠিকানা : ২৫ ল্যানঘাম স্ট্রিট ।
              র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর ‘ভবঘুরে’ কবিতাটি ( ১৮ নং ইল্যুমিনেশান ) তাঁদের দুজনের সেই সময়টিকে ধরে রেখেছে :
    সমব্যথী ভাই ! ওর কাছে আমার কোনও নৃশংস নিশিপালন আছে ! ‘আমি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টাকে দখল করে নিতে বিফল হয়েছিলুম । আমি ওর অকর্মণ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম । যদি আমাদের নির্বাসনে যেতে হয়, কেনা-গোলমী করতে হয়, তা হবে আমার দোষ।’ অদ্ভুত দুর্ভাগ্য আর বোকামির জন্য ও আমার প্রশংসা করেছিল, আর তার সঙ্গে জুড়েছিল অশান্তিকর কারণ ।
    এই শয়তান পণ্ডিতকে আমি বিদ্রুপ করে উত্তর দিয়েছি, আর জানালার কাছে গিয়ে তা শেষ করেছি । বিরল সঙ্গীতরেখার চালচলনের অপর পারের চারণভূমিতে আমি ভবিষ্যতের রাতের বিলাসের মায়াপুরুষ গড়েছি ।
    এই অস্পষ্ট স্বাস্হবিধিসন্মত চিত্তবিক্ষেপের পর, আমি খড়ের মাদুরের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তুম । এবং, বলতে গেলে প্রতি রাতে, যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম, বেচারা ভাইটি উঠে পড়তো, মুখে দুর্গন্ধ, চোখে দেখতে পাচ্ছে না — যেমন ও নিজের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতো — আর নিজের নির্বোধ কান্নার স্বপ্নে বিভোর আমাকে ঘরের ভেতরে টানাটানি করতো !
    বাস্তবিক, সত্যি বলতে কি, আমি ওকে ওর সূর্যসন্তানের প্রাগৈতিহাসিক স্হতিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলুম — আর আমরা ঘুরে বেড়ালুম, গুহার মদে ভরণপোষণ করে, আর পথের বিসকিট খেয়ে, আমি পরিসর আর ফরমুলা খুঁজে পাবার জন্যে অধৈর্য ।
              তাঁদের দুজনের ঝগড়া গ্রেট কলেজ স্ট্রিটেই আরম্ভ হয়েছিল । তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল । র‌্যাঁবো মাঝে একদিন ছুরি দিয়ে ভেরলেনের উরুতে আঘাত করেছিলেন । প্রেমিকের আঘাতের আদর বলে মেনে নিয়ে কাউকে জানাননি ভেরলেন । এই বিষয়ে ভেরলেন লিখেছেন, “আমি বাড়ি ফেরার সময়ে দেখলুম জানলা দিয়ে র‌্যাঁবো আমায় দেখছে । অকারেণেও আমাকে দেখে অপমানজনক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে লাগলো। যাহোক আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠলুম আর ঘরে ঢুকলুম । ‘তোমার কি কোনো ধারণা আছে এক হাতে একবোতল তেল আর অন্য হাতে একটা মাছ ঝুলিয়ে কেমন দেখাচ্ছিল তোমায় ?’ বলল র‌্যাঁবো । আমি তার জবাবে বললুম, আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাকে মোটেই উপহাসাস্পদ দেখায়নি ।’  ভেরলেন মাছটা দিয়ে র‌্যাঁবোর  মুখে সপাটে মারলেন আর জানালেন যে তিনি আত্মহত্যা করে নেবেন । ভেরলেন চটে গিয়ে জাহাজ ধরে সোজা চলে গেলেন বেলজিয়াম, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার উদ্দেশে । সেখানে মাতিলদে ছিলেন ।  
             র‌্যাঁবো কিছুক্ষণ পরেই ডকে পৌঁছে টের পেলেন যে ভেরলেন, তাঁর ‘বুড়ি শূকরী’ , সত্যিই চলে গেছেন । নিষ্কপর্দক র‌্যাঁবোকে সাহায্য করার কেউ ছিল না, আর যারা ছিল তারা দুজনের দৈহিক সম্পর্ক জানতে পেরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল ।  র‌্যাঁবো ভেরলেনকে চিঠি দিলেন :
    তুমি কি মনে করো যে আমার বদলে অন্য লোকেদের সঙ্গে থাকলে তুমি আনন্দে থাকবে ? ভেবে দ্যাখো ! নিশ্চয়ই না ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ভবিষ্যতে আমি তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব । আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি, আর তুমি যদি ফিরতে না চাও, কিংবা আমি তোমার কাছে যাই তা না চাও, তুমি একটা অপরাধ করছ, আর তার জন্য তুমি সমস্ত স্বাধীনতা হারিয়ে বহুকাল আফশোষ করবে, আর এতো ভয়ঙ্কর দুঃখদুর্দশায় ভুগবে যার অভিজ্ঞতা তোমার কখনও হয়নি ।
              ১৮৭৩ সালের ৮ জুলাই র‌্যাঁবোকে টেলিগ্রাম করলেন ভেরলেন ব্রুসেলসের হোটেল লিজে পৌঁছোতে । ভেরলেনের জামাকাপড় বেচে র‌্যাঁবো পৌঁছোলেন বেলজিয়ামের হোটেলে যেখানে ভেরলেন ছিলেন । দুজনের মনের মিল হল না, টানা কথা কাটাকাটি চলল । ভেরলেন একের পর এক আবসাঁথের বোতল খালি করে মাতাল হয়ে থাকতে চাইলেন । ১০ জুলাই তিনি একটা রিভলভার আর গুলি কিনলেন, আত্মহত্যা করবেন ভেবে । চারটে নাগাদ মাতাল অবস্হায় দুটো গুলি চালালেন র‌্যাঁবোকে লক্ষ করে । একটা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হল, অন্যটা লাগল র‌্যাঁবোর কনুইতে । আঘাতকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সঁ-জাঁ হাসপাতালে ড্রেসিং করিয়ে ব্রুসেলস ছাড়ার কথা ভাবলেন র‌্যাঁবো । সন্ধ্যা আটটা নাগাদ র‌্যাঁবোকে গারে দু মিদি রেলস্টেশনে ছেড়ে দেবার জন্য ভেরলেন আর ভেরলেনের মা গেলেন । আদালতে র‌্যাঁবোর সাক্ষ্য অনুযায়ী ভেরলেন পাগলের মতো আচরণ করছিলেন আর তাঁর পকেটে পিস্তলও ছিল । র‌্যাঁবো পুলিশের একজন টহলদারকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললেন তাঁকে ভেরলেনের থেকে বাঁচাতে । ভেরলেন গ্রেপ্তার হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল, আদালতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে উকিল আর ডাক্তারদের প্রশ্নের মুখে পড়লেন ভেরলেন । 
              ১৭ জুলাই র‌্যাঁবোর বুলেট বের করার পর তিনি নালিশ তুলে নিলেন । পুলিশকে দেয়া বয়ানে র‌্যাঁবো লিখেছিলেন যে, গুলি চালিয়েই ভেরলেন তাঁর অপরাধের জন্য তক্ষুনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন । পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন তাঁর কপাল লক্ষ করে গুলি চালাতে। তাঁর আচরণ ছিল গভীর অনুতাপের । ভেরলেনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ তুলে নিয়ে কেবল আঘাত করার অভিযোগ বজায় রইলো । তাঁদের পরস্পরের পায়ুকাম নিয়ে আদালতে অপমানজনক কথাবার্তা হলেও তাকে অপরাধ বলে মনে করা হয়নি এবং পুলিশ আরোপ করেনি । ৮ই আগস্ট ১৮৭৩ ভেরলেনের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হল ।
              র‌্যাঁবো শার্লভিল ফিরে গিয়ে ‘নরকে এক ঋতু’ লেখা শেষ করলেন । তাতে ভেরলেনকে তিনি ‘উন্মাদিনী ভার্জিন’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, আর নিজেকে ‘নারকীয় স্বামী’ হিসাবে আর তাঁদের একসঙ্গে বসবাসকে বলেছেন ‘গার্হস্হ প্রহসন’। ১৮৭৪ সালে র‌্যাঁবো ফিরেছিলেন লণ্ডনে, কবি জারমেইন নোভোর সঙ্গে, তিন মাস ছিলেন একসঙ্গে । এই সময়ে তিনি ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর গদ্য-কবিতাগুলো লেখা শেষ করেন । কিন্তু পায়ুকামের নায়ক-নায়িকা বা আদম-ইভের কাহিনি এখানেই ফুরোয়নি । জেল থেকে র‌্যাঁবোকে চিঠি লিখতেন আর নিজের নতুন লেখা কবিতা পাঠাতেন, যেগুলো পড়ে র‌্যাঁবো মোটেই উৎসাহিত হতেন না । র‌্যাঁবো তখন কবিতা ও সাহিত্যজগত সম্পর্কে উদাসীন এবং নতুন জীবনের সন্ধান করেছেন, বাবার মতো উধাও হয়ে যেতে চাইছেন । পরস্পরের দৈহিক ভালোবাসার বদলে যিশুখ্রিস্টকে ভালোবাসার কথা বলছেন তখন ভেরলেন । র‌্যাঁবো ঠাট্টা করে তাঁকে লিখলেন যে ‘লয়োলা’ স্টুটগার্টে এলে দেখা হবে । লয়োলা ছিলেন এক যিশুভক্ত পাদ্রি ।
            পরস্পরের সাক্ষাতের সেই মুহূর্তটা এলো এবং কমেডি ছাপিয়ে গেল ট্যাজেডিকে । ভেরলেন গোঁ ধরলেন র‌্যাঁবোকে দীক্ষিত করার জন্য, একটা শুঁড়িখানায় দুজনে একত্রিত হয়ে । ভেরলেন আর র‌্যাঁবো দুজনেই মাত্রাহীন মদ টেনে মাতাল হলেন এবং আবার কথা কাটাকাটি আরম্ভ হল । শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে দুই বিখ্যাত কবির মধ্যে হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হল। র‌্যাঁবোর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব ছিল ভেরলেনের পক্ষে । মার খেয়ে মাতাল ভেরলেন, রক্তাক্ত, পড়ে রইলেন পথের ধারে ।
               সাত এম-এম ছয়গুলির পিস্তলটা ক্রিস্টির নিলামে  কেউ ষাট হাজার ডলারে সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন ; তার আগে পিস্তলটা ছয়বার নিলাম হয়েছিল । মায়ের দেয়া টাকায় ‘নরকে এক ঋতু’ ছাপিয়ে, মাকে এক কপি দিয়ে, কবিতার প্রতি র‌্যাঁবোর আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল ; ইল্যুমিনেশান্স’ আর ছাপাবার প্রয়োজন বোধ করেননি, যা করার কোরো বলে পাণ্ডুলিপি ভেরলেনকে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন আফ্রিকায়, ভিন্ন জীবনের সন্ধানে । ভেরলেন কবিতাগুলো মে-জুন ১৮৮৬-এ  ‘প্যারিস লিটেরারি রিভিউতে’ প্রথমে প্রকাশ করার জন্য দেন । তারপর গ্রন্হাকারে প্রকাশের ব্যবস্হা করেন ১৮৮৬ সালের অক্টোবরে । 
    ————————————————————-XXXXXXXXXXX————————
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৫০738531
  • অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর গদ্য বুঝে ওঠার চেষ্টা
    মলয় রায়চৌধুরী
              পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন অর্ঘ্য, দাঁড়ান গুনে বলছি কতোগুলো গদ্য আছে বইটায়, হ্যাঁ, সাতটা, তবে মাসখানেকের বেশি নানা সময়ে পড়েছি বলে জানি না, একআধটা হারিয়ে ফেললুম কি না । 
              পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় এলো, তাহলো এই যে কতো বছর বয়সে লেখকীয় ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বক্সী ?
              কোনো কিছু পড়ায় আমার বদভ্যাস হল যে অবান্তর চিন্তায় হারিয়ে যাই, ফলে আবার ফিরে আসতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলুম সেখানে ; এই করে অর্ঘ্যর গদ্যগুলো পড়ে উঠতে বেশ সময় লেগে গেল । সাতাত্তর বছর বয়সে ডাইগ্রেশন স্বাভাবিক, নয়কি ?
             এই বয়সে সাহিত্য আলোচনা করতে আমি বড়োই অনাগ্রহী ।
              লরেন্স স্টার্ন অবশ্য বলে গেছেন যে ‘পড়তে বসে হারিয়ে যাওয়া হলো সূর্যের আলো, জীবন, বই পড়ার আত্মা’। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে যে গদ্যটা পড়ছিলুম, দুপুরে অন্য একটা গদ্যে আটকে যাই ; পরের দিন আবার আরেকটা অন্য গদ্য।
              পাণ্ডুলিপি পড়ে বইয়ের সামনে দিকে দুচারপাতা লিখতে বলেছেন অর্ঘ্য আর ওনার বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর । 
              প্রস্তাবটা পেয়ে ভাবছিলুম যে আমার মতন একজন কমব্যাট্যান্টকে কেন ! আমাকে যা ক্রুদ্ধ করে, প্যাশনেট করে তোলে, অসংযত করে তোলে, বিরক্ত করে, মানুষের যা অপছন্দ করি, তা কি অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ক্ষেত্রেও একই ? তিনিও কি আমার মতন সমাজের হাতে বিধ্বস্তদের পক্ষে ভাবতে বসে ডিসটার্বড ? মানে খুঁজে বেড়ান যা কিছু অতর্কিত, তাইতে ? পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতন অর্থহীন শব্দবন্ধের বদলে ইনোভেটিভ শব্দটা ব্যবহার করতে চান ?
              প্রথম পাঠে মনে হলো, অর্ঘ্য সম্ভবত স্বীকার করেন যে লেখকীয় কাজ যদি সত্য হতে হয়, তাহলে তাকে মানব-মনের গভীর, অন্ধকার, অসুস্হ, হেজে-যাওয়া, বিরক্তিকর  কোনগুলোতে জোর-জবরদস্তি ঢুকে পড়তে হবে, কেবল ইনোভেশান দিয়ে সামলানো যাবে না। তারপর তো পাঠকের দায়িত্ব সেই কাজে  অজস্র রাস্তা খুঁজে পাওয়া ।
              কিন্তু আমি অনেক বইকে কেবল ফিকশান বলে মনে করি, যেমন সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই, এতো ভালো উপন্যাস কম লেখকই লিখেছেন । আমি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সবই ফিকশান বলে মনে করি, ইতিহাস বলে মনে করি না ; যেমন মঙ্গলকাব্যের কাহিনিগুলো । তাই কোন চরিত্র কেন অমন আচরণ করলো, তার দায়-দায়িত্ব পাঠকের বলে মনে করি, লেখকের নয় । 
              পুতুল নাচের ইতিকথায় শশির এরেকটাইল ডিসফাংশান ছিল কিনা তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যাননি, তার কারণ ওটা একটা ফিকশান । যে যেমন চায় ব্যাখ্যা করবে ।
              একটি সাহিত্যকর্মকে তার নিজের গুণে দাঁড়াতে হয়, যেমন রামায়ণ মহাভারত দাঁড়িয়ে আছে , কৃতিত্বটা বাল্মীকির ও ব্যাসদেব নামের লেখকদের । বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছি, অযোধ্যায় বহুবার গেছি চাকুরিসূত্রে । আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে রামায়ণ কাহিনির রামের ওটা জন্মস্হান আর জন্মশহর । কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর গেছি । সবই গল্প । বরং কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে-থাকা মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি আসল, এখনও কিশোরীরা অমন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
              রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে অর্ঘ্যর আগ্রহ এবং মহাকাব্যগুলির চরিত্রদের নিয়ে তিনি খেলেছেন নিজের মতন করে, সেঁদিয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে । 
               আমি ভাবি যে রামায়ণ-এর গল্পটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আশেপাশে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছড়িয়ে পড়ার সময়ে মূল রামায়ণ থেকে সরে গিয়ে যে-যার নিজের মতো করে গল্পটা তৈরি করে ফেলল, চরিত্রদের ওলোট-পালোট করে ফেলল । এই একই ব্যাপার মহাভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন ? ব্যাসদেবরা মহাভারতে যেমন যে-যার নিজেদের লেখা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, তা কেন সম্ভব হয়নি রামায়ণের বেলায় ? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধাকেই বা কারা জুড়ে দিয়েছিল, মহাভারতে তো নেই ! 
              বাঙালিদের বাড়িতেও দেখি গোপাল, নাড়ুগোপাল, দোলগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ, রাধাকেষ্ট ইত্যাদি । তা বাঙালিরা রাধাকে কবে আর কোথা থেকে পেলো ? বঙ্গদেশে আমদানি-করা উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণরা এনেছিল কি নিজেদের পুঁটলিতে বেঁধে ? ব্রাহ্মণরা বঙ্গদেশে আসার আগে এখানকার দেবী-দেবতা এবং মিথগুলো কেন হারিয়ে গেল ! বৌদ্ধধর্মের দেবী-দেবতারাই বা চিরকালের জন্য কেন লোপাট হয়ে গেল !
              ন্যারেটিভে সোমরস প্রসঙ্গ এলে বেশ হতো, কেননা ওটা যে ঠিক কী জিনিস আমি আজও জেনে উঠতে পারিনি ।
              সরি, আবার ডাইগ্রেশন ঘটিয়ে ফেলছি ।
              সে যাক, পুতুল নাচের ইতিকথা নিজের গুণে দাঁড়িয়ে আছে ।
              একজন লেখক স্রেফ তার সৃজনকর্মের গাদ । রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ লেখকদের মতন তাঁদের আড়ালে চলে যাওয়া উচিত ।
              এর আগে কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধ বা ইনট্রো, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের, যা-ই বলুন, লিখেছি বটে, কিন্তু ন্যারেটিভ নিয়ে এরকম নিজের সঙ্গে নিজে বার্তা-বিনিময়ের একাধিক কন্ঠস্বরের নিরীক্ষা, মেইনস্ট্রিমের বাইরে বেরিয়ে, ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেবার ইনোভেশানের লেখা নিয়ে লিখিনি । 
              বলা যেতে পারে, অর্ঘ্য আমাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন । 
              পড়তে গিয়ে আমি কোন গদ্যের পর কোন গদ্য, তাও বিছানায় শুয়ে, আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে ঠ্যাঙ তুলে,  আর ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ার সময়ে গোলমাল করে ফেলেছি । অবশ্য জানি, অর্ঘ্যর তাতে খুব-একটা কিছু আসে যায় না । ছাপাতে দেবার আগে সাজিয়ে নেবেন ।
              অর্ঘ্য তাঁর প্রোটোফিকশানগুলোকে বলেছেন প্রগল্প । মনে হয় প্রথানুগত গল্প বলার কায়দাকে তিনি কনটেম্পচুয়াস মনে করেন । স্বাভাবিক । বালজাক বলেছিলেন যে, ফিকশান লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনরত মূল্যবোধের ভয়াবহ প্রকোপ ফাঁস করে দেয়া । বালজাকের সময় থেকেই নয়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করেছে, সভ্যতার প্রসারে তা কাজে লাগিয়েছে । তা সত্ত্বেও ভাবুক ও সাহিত্যিকরা আশা করেন যে মানুষ মানবতাবাদী হবে, সাম্যবাদী হবে, কল্যাণকামী হবে, যুক্তিতে বিশ্বাস করবে, ইত্যাদি । এদিকে দেখতে দেখতে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থব্যবস্হার রক্ষিতা বা জিগোলো ।
              অর্ঘ্য ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, চিন্তার স্রোত বজায় রাখার কারণে, আমিও লিখতে বসে মগজে ইংরেজি শব্দ এসে গেলে তা-ই করবো ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যে বিদেশি লেখদের কথা মনে এলো, তাঁরা উলিয়াম বারোজ, ইশমায়েল রিড, টেরি সাদার্ন, কার্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, টমাস পিনচন নয়, কেননা এঁরা একরৈখিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যেতে পারেননি, এঁরা নির্ভর করেছেন প্রচলিত ন্যারেটিভের ডিভাইসের ওপর ; ফিকশান ও গদ্যের প্রথাকে ভেঙে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসের বদলে ফিকশানের ফিকশানালিটিকে মান্যতা দিয়েছেন ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যাঁদের কথা মাথায় এলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেরি গেইটস্কিল, কেথি অ্যাকার, গ্যারি ইনডিয়ানা, কারেন ফিনলে, ডেনিস কুপার, ডেভিড ওজনারোইজ প্রমুখ । 
              হয়তো অর্ঘ্যের অবচেতনায় জাঁ জেনে, লুই ফার্দিনান্দ সেলিনে, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশোঁ প্রমুখের রচনা পাঠের রেশ থেকে গেছে । এঁদের গদ্য ভিশনারি ও কাব্যিক মোডের । অর্ঘ্য নিজেই স্বীকার করেছেন ঋত্বিক ঘটক থেকে পাওয়া তাঁর প্রোটোফিকশানের উপাদান প্রাপ্তির ।
               হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার সুভাষ ঘোষ ও সুবিমল বসাকের কথাও উল্লেখ করতে চাইবো, তুলনা নয়। তবে প্রথানুগত ন্যারেটিভ টেকনিকের কারণে বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যের তুলনা করবো না । একই কারণে উল্লেখ করতে চাই না সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফিকশান এবং শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের । শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররা মুক্ত সূচনা দিয়ে আরম্ভ করলেও তাঁরা একরেখিকতা ও বদ্ধ সমাপ্তির বাঁধন থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁদের চরিত্ররা কেলাসিত রয়ে গেছে ।
                উল্লেখ করতে চাইবো রবীন্দ্র গুহ, অজিত রায়, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সৌগত বালী প্রমুখের ইনোভেটিভ  গদ্য । 
                সুবিমল মিশ্রকেও উল্লেখ করতে চাইবো, তাঁর টাইপোগ্রাফিকাল ইমেজখেলা ও অক্ষরকোলাজ বাদ দিয়ে। সুবিমল মিশ্রের একজন  শিষ্য, স্বপনরঞ্জন হালদারের একটা বই আমি আলোচনা করেছিলুম, কিন্তু সেই সময়ের কমিউনিস্টদের রোগ থেকে বেরোতে পারেননি উনি, মুখ ফুটে বলতে পারেননি রক্তচোষার দিগ্বিজয়, উল্টে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গুরুঘণ্টাল পিঁজরাপোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অপমানজনক সমালোচনা করেছিলেন । 
                 ইনোভেটিভ গদ্যের এই এক বিপদ, কে যে কোথা থেকে ঢুকে পড়বে আর জিনিয়াসগিরির দাবি করবে স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
                যাঁদের নাম উল্লেখ করলুম, তাঁরা সকলেই, অর্ঘ্যের মতন, জানতেন যে সাহিত্যের রিসেপশানের মণ্ডপে ঢোকার মুখে তাঁদের পড়তে হবে বাউন্সারদের পাল্লায় । কারণ এনারা ফিকশানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধের মালিকানা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন ।
                আগের প্রজন্মের ওই লেখকদের লেখনজগতকে সরিয়ে এগোবার রাস্তা বের করতে হয়েছে অর্ঘ্যকে । শব্দ মুচড়ে গড়া ভাষা এবং আইডিয়া ও চিন্তা দিয়ে গড়া ভাষার যে গভীর পার্থক্য আছে তা নিজের গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য ।
                এক বাসুদেব দাশগুপ্তকে ছাড়া, মেইনস্ট্রিম বাংলা সাহিত্য অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তা করেনি, তার কারণ অবিরাম বদলাতে থাকা সংস্কৃতির, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি, আলোচকরা খেয়াল নিয়োজিত করেননি। 
                অর্ঘ্যর হাতে পড়ে প্রতিটি অবজেক্ট মর্মার্থে ভরপুর হয়ে উঠেছে, কিন্তু অবজেক্টের মর্মার্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেবে, তা আশা করা যায় না, কেননা অর্ঘ্যের মতামত তাতে কুঁদেকুঁদে ব্যক্তিগত গোপনতাসহ রাখা আছে, সবায়ের অভিজ্ঞতার বনেদ তো একই নয় ।
                অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে কোনো বিশেষ জনারে চিহ্ণিত করা যাচ্ছে না বলে আমি বলেছি প্রোটো-ফিকশান ; গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে অর্ঘ্য একজন Neo-gnostic, গোপন জ্ঞানের ভাঁড়াররক্ষক।
                শিরদাঁড়ার শীতল সিরসিরানিকে নিজের গদ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন অর্ঘ্য । সম্ভবত যখনই এই সিরসিরানি তাঁর অস্তিত্বে ঘটে তখন তিনি বাক্যগুলোয় যাতে তা থাকে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, তার প্রয়াস করেন । পড়ার সময়ে পাঠক টের পান ঠিক কী ধরণের শীতলতার টর্চার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে রাস্তা থেকে, চায়ের ঠেক থেকে, গ্রন্হ থেকে, স্মৃতি থেকে, পুরাণ থেকে,  তুলে আনার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, কিংবা হয়তো কল্পনায় তৈরি করে নিতে হচ্ছে,  ন্যারেটিভের জটিলতার সূক্ষ্ম তারতম্যকে বাছাই করতে হচ্ছে, কেননা মুহূর্তবিশেষের প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল দিতে হচ্ছে অর্ঘ্যর ন্যারেটিভকে ।
                কতো কতো ফিকশান পৃথিবী জুড়ে লেখা হয়ে চলেছে । তাদের লেখক-নির্মিত চরিত্ররা কি পৃথিবীর অদৃশ্য জনসংখ্যার একটা সমান্তরাল খাড়া করছে না ? পরের প্রজন্মের লেখকরা ওই অদৃশ্য জনসমুদায়ের সঙ্গে মিশে তাদের একজন হবার প্রয়াস করেন এবং সেই অদৃশ্য জগত থেকে বেরিয়ে এসে দৃশ্যমান জগতে নিজেই গড়ে তোলেন অদৃশ্য চরিত্রদের, পাঠকদের সামনে ছেড়ে দেন তাদের ।
                গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে আমরা জগতসংসারকে আর আধিবিদ্যক এবং মিসটিকাল পাটাতনে ফেলে বিচার না করলেও, ব্যাপারটা হলো যে ভারতীয় মিথগুলো আমাদের জাগিয়ে তোলার অপেক্ষায় থাকে, যাতে আমরা তা খোলা চোখেই দেখতে পারি । দুর্ভাগ্য যে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক- সংস্কৃতিকে ঘেরাও করে নিয়েছে কিৎশ -- যেন একেবারে হোস্টেজ সিচুয়েশান ।
                অর্ঘ্যকে সংলাপ আবিষ্কার করতে হয়েছে, যাতে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটছে, তার সঙ্গে সংলাপগুলো খাপ খেয়ে যায় । আমরা তো সদাসর্বদা শব্দের মাধ্যমে চিন্তা করি না ; আমাদের ভেতরের গভীরতম এলাকাকে পুরোপুরি ধরতে সক্ষম হয় না কথাবার্তা । শব্দদের নিজস্ব সত্য ও সত্তা থাকে, এবং তা বেরিয়ে পড়ে তার আওয়াজের বা স্ফোটনের সূত্রে । ফলে বস্তু-বিশেষের সঙ্গে শব্দেরা হুবহু মিলে যেতে অস্বস্তি বোধ করে । বিভাবসু, কবি, এই কারণে শব্দগুলোকে ধ্বনিভিত্তিক করে নিয়ে লেখেন ।
                শব্দগুলোর নিজের নিজের ক্ষুধা থাকে এবং তারা তা-ই খেতে চায় যার অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে। সমস্যা হল যে পাঠক-বিশেষের সেই একই অভিজ্ঞতা না-ও থাকতে পারে । ভিন্ন কিছু গড়ে তোলার জন্য ভাষাকে প্রয়োগ করতে অর্ঘ্য বাধ্য হন, কেননা জীবন আর ভাষা একই ব্যাপার নয় । বস্তুত পরাবাস্তব তখনই কাজ করে যখন তা বাস্তব থেকে চাগিয়ে উঠছে । 
              যা বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তা এক ব্যাপার, কিন্তু যা বলা হচ্ছে না, বা লেখা হচ্ছে না, তাও উপস্হিত থাকছে অর্ঘ্যর গদ্যে । যা লেখা হয়নি অথচ তা লিখিত পাঠবস্তুর সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা লেখক অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর লেখাটা এমনই হওয়া দরকার যে পাঠকও ওই ভাসতে থাকা মর্মার্থের সঙ্গে নিজেকে মিশ-খাওয়াতে পারবে ।
              অর্ঘ্যর বাক্যগুলো এলিপটিকাল, অনেকসময়ে ছোটো-ছোটো স্ফোটন জুড়ে-জুড়ে তৈরি, বাস্তব জগতকে অবিরাম স্ক্যানিং করার জন্য, যে বাস্তব জগত অর্ঘ্যর বয়সি যুবকের কাছে সতত পরিবর্তিত ও উপস্হাপিত হয় মেটাবলিজমের ও হরমোনের, প্রধানত প্রজেস্টেরনের, মাধ্যমে । 
              গদ্যের মাঝে  আচমকা উদয় হন অর্ঘ্য। মেইনস্ট্রিম আলোচনায় শৈলীটা মনে হতে পারে সাধারণ্যের শৌখিন শোভনতাকে আক্রমণের পরিবর্তে এক ধরণের অমার্জিত মর্ষকামী বিকৃতি । ওই সাহিত্যিক প্রেজুডিসকেই তো বিধ্বস্ত করতে চাইছেন অর্ঘ্য, গদ্যের নান্দনিক স্ট্র্যাটেজির বর্শাফলক দিয়ে ।
              বেশ আনন্দের সঙ্গে স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন অর্ঘ্য । স্যাটায়ার ব্যাপারটা একই সঙ্গে নীতিমূলক আর রাজনৈতিক । বলা চলে লেখকের বুনো ক্রোধের তরোয়াল লুকোবার খোপ । স্যাটায়ার হলো বাঁশের তৈরি ‘হস্তশিল্পের’ চোঁচ, যা ফুটে গেলে সময়মতো বের করে না দিলে বিষিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারে ।
              অর্ঘ্য ওনার গদ্যে নিজের প্রতিস্বে ব্যক্তিএককের ইউনিকনেস যেমন দিয়েছেন, তেমনই ওই ইউনিকনেসকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন । পাঠককে ধৈর্য ধরে এগোতে হবে । গ্রিক দেবতা জানুসের যেমন দুটো মুখ ছিল, মুক্ত সূচনার ও মুক্ত সমাপ্তির, যে দেবতার কোনো পুরোহিত ছিল না, অর্ঘ্যর গদ্যকে তেমনই দুই দিক থেকে বুঝতে হবে ।
              অর্ঘ্যকে প্ররোচিত করে আইডিয়া ও চিন্তা, এবং তাঁর অ্যাড্রেনালিনের উৎস ওনার আইডিয়া-বিশেষ, এক-একটি আইডিয়া উদয় হয় আর তা থেকে কথন-প্রক্রিয়া ধার নিয়ে এগোতে থাকেন । আইডিয়ার ফিকশান, যদিও অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে ফিকশনের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা ভুল হবে, অবহেলিত থেকে গেছে, যেমন অতীন্দ্রীয় পাঠকের গদ্যগুলোর ক্ষেত্রে ।
             অর্ঘ্যর উদ্ভাবনা আনফেটার্ড, হয়তো বাক্যগঠনে আকস্মিকতা তাঁর অজানিতেও ঘটে গেছে, প্রতিরূপ উপস্হাপনে অবসেসিভ, বারবার বলেছেন একই কথা বা ঘটনা, তাঁর কনসেপচুয়ালাইজেশান নির্বাধ ।
              সাহিত্যিক ইনোভেশান বিকল্পকে দৃষ্টিগোচর এবং কল্পনাসাধ্য করে তোলে, আর এই সমস্ত বিকল্পের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যতের বনেদ গড়ে ওঠে, লেখালিখির সম্পূর্ণ নতুন পাটাতন, যা কালক্রমে মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে চুয়ে পড়ে । ইনোভেশানকে বলা যায় সাহিত্যিক রদবদলের ও পুনরুদ্ধারের ইনজিন ; সাহিত্য নিজেই নিজেকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরাবিষ্কার করে । 
              ইনোভেশান হলো জড়তাহীন, লৌকিকতাবর্জিত, রীতিনীতি অস্বীকারকারী, কাটিং-এজ সাহিত্য, যাতে থাকে অভিঘাতের লক্ষ্য, অপমানকরার উদ্দেশ্য, আইকনোক্লাজম ও জটিলতার মারপ্যাঁচ ।
              অর্ঘ্য লক্ষ্য স্হির করেছেন নিপুণ বাক-প্রতিবেদন আবিষ্কারে, আসঙ্গময় কন্ঠস্বরে, এবং প্রয়োগ করেছেন তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভা, পথ কেটে বের করেছেন ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে, এবং স্ট্রোব লাইটের ঝলকানির সাহায্যে এগিয়ে গেছেন, জীবন প্রকৃতপক্ষে কী তার  রহস্য অনুসন্ধানে, লিঙ্গোথ্থান হয় না এমন যৌন-প্রসঙ্গ এনেছেন, চুরো-করা বাক্যাংশের দুমড়ে ফেলা ছবি উপস্হাপনের সাহায্যে । পাঠকদের ধাঁধিয়ে দিতে পেছপা নন অর্ঘ্য ।
              নিৎশে বলেছিলেন ‘অশুদ্ধ চিন্তা”র কথা । তাঁর মতে, জীবনের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে যখন বিমূর্ততা মিশে যায় তখন ‘অশুদ্ধ চিন্তা’ প্রশ্রয় পায়, পেয়ে বসে মানুষের ওপর, দুটোকে ছাড়িয়ে তারপর আলাদা করা যায় না । অর্ঘ্য বহু ক্ষেত্রে বিমূর্তের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলীকে উস্হাপন করেছেন । 
              অর্ঘ্য মনুস্মৃতির প্রসঙ্গ এনেছেন কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতির প্রসঙ্গে তোলেননি, যখন কিনা কাব্যিক আঙ্গিকে রচিত যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে সাহিত্যিক কাজ বলা যায়, এবং যা মনুস্মৃতির পরবর্তীকালে লেখা । ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য, প্রথম জনগণনার সময়ে  ব্রাহ্মণদের সাহায্য নিয়ে মনুস্মৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, অথচ ততোটা গুরুত্ব দেয়নি যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে। প্রথম সেনসাসের চতুবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র থেকে হিন্দু বাঙালি সমাজ আর বেরোতে পারেনি ; ব্রাহ্মণরা বাঙালি ক্ষত্রিয়দেরও শুদ্রে বর্গীকরণ করে দিয়েছিল, যে কারণে পিছড়াবর্গের কোটা নিয়ে মারাঠা, জাঠ, গুজ্জর, প্যাটেলদের মতন বর্গ বঙ্গসমাজে নেই ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতি তিনটি খণ্ডে রচিত, আচারকাণ্ড ( রীতিপ্রথা ), ব্যবহারকাণ্ড ( বিচার ব্যবস্হা ) এবং প্রায়শ্চিত্ত কাণ্ড ( অপরাধের শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত ) ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্য ছিল যে মানুষের রয়েছে তেজোময়তা বা কর্মশক্তির উদ্বৃত্ত, যার একটা হিল্লে প্রতিটি ব্যক্তিএকককে করতে হয় । সেই উদ্বৃত্তই হলো জীবন । উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে জীবন সম্ভব নয় । একটি জনসমাজের মানুষ সমবেত উদ্বৃত্ত দিয়ে যা করে, তার দ্বারা সংস্কৃতিটির তো বটেই, মনেরও, আদল-আদরা নির্ধারিত হয় । এই দিকটি অর্ঘ্য নিয়েছেন, যদিও যাজ্ঞবল্ক্যের উল্লেখ তিনি করেননি ।
              অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো, বিশেষ করে একরৈখিক একেশ্বরবাদীদের মতো, সনাতন ভারতীয় চিন্তায় দেবতারা প্রথমে আসেননি । এসেছিলেন প্রজাপতি, এবং তিনি যে কে তা মিথই রয়ে গেছে । প্রজাপতির পর এসেছিলেন ঋষিরা । তারপরে দেবতারা । অতএব লেখক যখন মিথের জগতে প্রবেশ করছেন তখন বেশ ঝুঁকি নিয়েই তা করছেন, এবং মানুষ নিজের ভেতরে মিথের মাধ্যমে পুলক সৃষ্টি করে। 
              মিথের রহস্যে , সেই বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করেন লেখক, কেননা ওই এলাকাটি অজানা । লেখক যা-ই করুন না কেন, তিনি একটি উপকথার জগতে ঢুকে পড়েন, এবং উপকথার সংজ্ঞানুযায়ী, তা মানুষের চেতনায় পুলক গড়ে তোলে । 
              মিথ কখনও একটি গল্পে ফুরোয় না । মিথ আনন্দ আনে এবং আনন্দ হলো এক বিস্ময়কর অসুখ । এই কারণেই দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে কেন্দ্র করে এতো অপমানজনক গল্প সংস্কৃতভাষীরা লিখে গেছেন যে মনে হয় বেচারা রাজা না হলেই পারতো ।
              সে যাক, এবার অর্ঘ্যের গদ্যের কিছু-কিছু অংশ পড়া যাক :
    নিম্নবর্গের খিস্তিমাত - চায়ের দোকানের Salanguage
              ব্লেড বা কাঁচির নাগাল পাবার আগেই যাবতীয় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের ঋতবানস্বামী গুম মেরে বসে বসে নাকি পোঁদ উল্টে মটকা মেরে ধূমকেতুর মতোন “পাশের বাড়ির বৌদিকে ন্যাপা চুদে” নামক দেশী পর্ন দেখতে থাকে অথচ স্ফূতি পায় না যাহার নিকট মেয়ে দুই প্রকার, এক যারা চুষে দেবে, আর যারা চোষে না -- এই একমাত্র criteria তার কাছে মেয়ে বিষয়ক, নারীগুণ, --- একেও এক ব্যতিক্রমী নিম্নবর্গীয় চেতনা বলি, আক্ষরিক অর্থেই উন্নতবর্গে নিম্ন শ্রেণীর চেতনা ব্যতিক্রম, বিরল প্রাণী ঋতবান -- ঋত+বান -- এই সেই “ঋত”, ঋগ্বেদের, যাহা হইতে বরুণাদি দেবতা সৃষ্টি, যাহার অনুকরণ করেন পরমদেব ইন্দ্র, যাহাই প্রকৃতিস্বরূপ, যাহার মাধ্যমে গাভী, অন্ন প্রাপ্ত হয় ও যজ্ঞ যাহার অনুগামী, অনুগামী সকল দেবতা, ঋত -- যাহার উর্দ্ধে, যাহা অপেক্ষা কেহ নাই, সকলেই ঋতবান -- সেই অর্থেই যৌনতা আমাদের এ বালকে ও সকল বালকেই প্রায়, বিশেষত বাজার ঋত অর্থে ইহাই উপাসনা করে ।
              ---লাইক ব্রিটনি বিচ, ইটস জোডি বিচ…
              ---tell one more time and i will be off…
              ---ইটস জোডি জোডি জোডি বিচবিচারি
              ---ok, it’s over, bye, see u…
              হাসতে হাসতে যে সম্পর্ক শেষ করি সে এক ব্রিটেনের অজ পাড়াগাঁর নিম্নবর্গ কিশোরী, যে কিনা সদ্য রিহ্যাব-ফেরত ও লিভটুগেদারি । প্রেমটা অফুরন্ত হাসি আর ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে ভাঙল, i’m suffering from too much happiness…
              আমি বিলেতি নিম্নবর্গ, গরিব মানুষ চিনলাম, যারা তাদের মাতৃভাষা ইংরেজির বানান লেখে ধ্বনিভিত্তিক, আমাদের ডিকশনারীও প্রপার স্পেলিং নয়, যারা ব্যবহারকে অসোংখো চলতি ইংরেজি, যা কেবোল মাতৃভাষাতে কথা বলার সময়ি ব্যাবহার করা যায়, খোদ ব্রিটিশের মাত্রিভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করি ধ্বনিভিত্তিক বানানেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ, ইহাই প্রোতিষ্ঠান বিরোধিতার ভাষা এখন, ভবিষ্যতে ইহাই নিওম হইবে…
              এবং আমি যখন একটি লেখার শেষ স্তরগুলি edit করে যোগ করি তখন এ ভেবেই করি অ্যাখন অব্দি যাবতীয় চিন্তা ম্যাচিওরিটি অভিজ্ঞতা এতে সর্বোৎকৃষ্টরূপে একত্র ও লিপিবদ্ধ থাক । এই লেখাই যদি শেষ লেখা হয় তবে কোনো খেদ যেন না থাকে । চলছে এরকমই, চলুক, কারণ কখন যে মাথা বিগড়োয় কিচ্ছু বলা যায় না…
              সন্ধ্যেবেলা সেদিন এক হিজড়ের দল এল তারকের দোকানে ।
              তারা বলিল --- আসবি ?
              প্রবল আমোদ হইল তারকের । সে নিজ বাম হস্তের কনিষ্ঠাটি দেখাইল । মধ্যমাটি  দেখানোর বদলে । ইহাও সাংকেতিক অর্থে তোদের গুদও নেই পুরুষ মানুষের মতো বাঁড়াও নেই । আছে এক প্রতিবন্ধী বাঁড়া । না চোদা যায়, না চোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।
              তবুও তারা রাগিল না । তারকের দোকান হইতে চা কিনিয়া আমাকে ও তারককে চায়ের ভাগ দিল । আমার যথারীতি আপত্তিতে বলিল --- পি লে, পেয়ার বড়েগা ! তারক মাইতে হাত বুলাইল, তাহারা হাসিল, চলিয়া গ্যালো, তারক গান ধরিল, মহাতৃপ্তিতে, যৌনসঙ্গীত…
              সে নিম্ন, তাহা অপেক্ষা নিম্ন পাইয়া সে তো আহ্লাদিবেই । এই তো পিরামিড, সমাজের শ্রেণী পিরামিড, কেউ তোমার জ্বালায় মরে, তুমি কারো জ্বালায় মরো ।
    কিশোরের নীতা ও নামস্তোত্র
              কিশোর + নবনীতা
              Kishore + Nabanita
               কি Share + Na ব
               Ki শোর + ন Ba
              
               যে বয়সে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, তখনো কিশোর মেয়ে দেখে নাই । মেয়ে চেনে নাই । তখন অবধি মা, দিদা, মাসী, জেঠী, দিদি ছাড়া মহিলা কি বোঝে নাই কিশোর ।
              যে বয়সে মেয়েরা ঝাড়ি মারা কি বুঝে ফেলে, সে বয়সে কিশোর মেয়ে বানান লিখিত ‘মে’ । গৃহশিক্ষকের চপেটাঘাত, ভর্ৎসনা ও ভ্রম সংশোধন শিখিল প্রকৃত মেয়ে বানান -- মেয়ে দিবস হয়ে ওঠে সেই জিয়ানস্টাল ! তবুও তখনো মেয়ে কি বস্তু -- মেয়ে নাম কেন, কেন উহাদের মেয়ে বলে শেখে নাই ।
               ---মা, যাদের লম্বা চুল তারাই কি মেয়ে ?
               ---মেয়ে কি তুই শুধু লম্বা চুল দিয়েই চিনিস ?
              কাহাদের মেয়ে কয়, কাহারা মেয়ে, কারাই বা ছেলে -- ইহা পৃথক করিতে শিখে নাই যখন, তখন মেয়েরা শিখে গেছে ঝাড়ি মারা কাকে বলে । যখন তাহার ক্লাসমেটরা প্রাথমিক শিশুযৌনতা -- শিশু যৌনঘটনা কিছু কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে চুপি চুপি -- অথচ দ্যাখো মেয়ে কাকে বলে কেহই শেখায় নাই -- শেখায় নাই জাতীয় গ্রন্হ কি টেক্সটবুক তাহাকে উহা শেখায় নাই বলে কিশোরের কাছে যদ্যবধি মেয়ে না আসিল -- মা, দিদা, মাসী,জেঠী ব্যতিরেকে যখন সে মেয়ে দেখিল সে তখনও বোঝে নাই কাহাকে মেয়ে কয়, কি করে মেয়ে দিয়ে, কি ভাবে করে তা জানা তো প্রশ্নাতীত ।
               কিশোর অন কিশোর
               Kishore on Kishore
               নব অন নব
               Naba on Naba
                কিshore অN Kiশোর
                Niবস  Oন নিBs
    যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি ।
    নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি ।।
     
              কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে আশ্চর্যান্বিত হই, ১০৮টি নাম মাহাত্মের তৎকালীন যুগানুযায়ী তা কর্ম পরিচায়ক । অর্থাৎ যে জীবনে মহৎ যে কাজগুলি করেছে ও তার চারিত্রিক গুণাবলী অনুযায়ী পরবর্তীকালে নামগুলি “আরোপিত” হয় । এগুলি বর্তমানের মতো জন্মকালীন নাম নয় । যথা মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ । দুটিই পরবর্তীকালে । তার কীর্তির পরিচায়ক বিশেষণ । এ পর্যন্ত ভীষণ সাধারণ । কিন্তু কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে চমকিত হয়ে যাই । ১০৮ জন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠী ১০৮ রকম নাম দিচ্ছে । যা নাম দিচ্ছে তা সবই কৃষ্ণের attribute, গুণ, বৈশিষ্ট্য, সুতরাং উহারা নাম বিশেষণ । এতো গেল । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, যে যে কৃষ্ণকে যা যা নাম দিচ্ছেন, তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যও তাইই । কৃষ্ণ যে mirror maze ; এতে যেরকম সে কৃষ্ণের মধ্যে তাই দেখছে । নিজেকেই দেখছে, নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে। নাম--নামী--নামকারী অভেদ হয়ে যাচ্ছে । উদাহরণ দেয়া যাক ।
              যুধিষ্ঠির নিজে রাজা ও তার কাছে যাদব রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্বই সর্বপ্রধান । তাই যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর ।
              বিদুর মহামন্ত্রী হলেও কুরুক্ষেত্রের পরান্নভোজী দাসীসন্তান । তাই বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর ।
              নারদ ভক্তশ্রেষ্ঠ । নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন ।
              অহল্যা যদিও রামায়ণের যুগের চরিত্র, তবু অহল্যার পাষাণ শাপমুক্তি celebrate হচ্ছে এই বলে যে অহল্যা রাখিল নাম পাযাণ-উদ্ধার ।
              প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহমুরারী।
              এই নাম সাহিত্যে  এমন অসংখ্য রেফারেন্স পাওয়া যাবে যা কৃষ্ণযুগের বহু আগের চরিত্রের উল্লেখে পূর্ণ, বৈদিক যুগের, এমনকি দেবতাদেরও জননী আদি দেবী অদিতি থেকে বহু পরবর্তীকালের, মহাভারতের বহু বহু পরবর্তীযুগের চরিত্রদের উল্লেখ বর্তমান । এ লেখা তাই ইতিহাস চর্চার এক মহৎ উপাদান, manifold, অত্যন্ত অর্বাচীন যুগের এক রচনা এক অতি উত্তম গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ।
              যা বলছিলাম, যার যা বৈশিষ্ট্য তাই কৃষ্ণ বৈশিষ্ট্য ।
              অত্রিমুনি হলেন বিশেষ একটি নক্ষত্র অত্রি যা সপ্তর্ষিমন্ডলের অন্তর্গত, অর্থাৎ আকাশ সম্বন্ধীয় । অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর । 
              রুদ্রগণও ঋগ্বেদে আকাশের দেবতা ও পসুত্ব, উগ্রতা, শত্রুবিনাশকারী, ভয় উৎপাদক, ধ্বংসকারী ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা যার সব বৈশিষ্ট্য পরে মআদেব আরোপিত । রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল ।
              এ জাতীয় বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে ঈশ্বর আমি স্বরূপ । আমিত্বের শ্রেষ্ঠত্বই ঈশ্বরত্ব ও আমার গুণলক্ষণ, বৈশিষ্ট্য, আমার মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী, আমার যা মত ততই ঈশ্বর । কিশোরের নীতা পপেম নবনীতাই ঈশ্বরী । তার নামার্থ বদলে যায়, আসলে নীতাতেই অষ্টোত্তর শতনাম অর্পিত হতে গেলে কিশোর নিজেকে ১০৮ ভাগে, বৈশিষ্ট্যে, মতে, পরিস্হিতিতে সময়ে বাস্তবচাহিদায় বিভক্ত করে । করে নাম-নামী-নামকারী অভেদ হয় । কিশোর কৃষ্ণ হয়ে ওঠে । কারণ যার যা শ্রেষ্ঠ গুণ তা বিভূতিযোগে ঈশ্বরপ্রতিম হয়ে ওঠে ।
    কর্ণ-কৌরব সংবাদ --- অবতার সংস্করণ --- হোমো ফ্লেবার্ড --- একটি বাজে প্রগল্প
              ---কৌরব, আমি ও আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল ফুল, বড় সেন্সেটিভ । বড় স্পর্শকাতর, অস্বাভাবিক কম রোধযুক্ত, ঘণ্টায় যেমন বাধ্যত ৬০টি একক, তেমনি বাধ্যত ওর নিত্য সেবা । না দিলে বড় সাফোকেশন হয়, বড্ড তার ছোঁয়াছুঁয়ি বাই, বড্ড তার খালি ক্ষরণ করা চাই...। এবং জলের বোতল, কল, টিপট ইত্যাদি যা যা থেকে লিঙ্গসদৃশ ক্ষরণ হয়, তা নারী ব্যবহার করছে দেখলে আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল বড্দ সেন্সেটিভ হয়ে যায় । যথা যথা নেত্র পড়ে তথা তথা লিঙ্গ স্ফূরে, তথা তথাই কৌরব as a পুরুষোত্তম স্ফূরে স্ফূরে ওঠে…
              মাঝে মাঝে লিঙ্গ অণ্ড চেপে জঙ্ঘার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে নারীযৌনাঙ্গ সুলভ এক ফিল আনি মুখ্যবিন্দুদেশে । সেখানে হাত বোলাই যেন যোনি নিয়েই খেলছি । পুরুষের আর কি আছে -- তার খেলার সঙ্গী তো ওই এক, সাত রাজার ধোন এক লিঙ্গ । স্বমিথুন করি । করে বীর্য উরুতে ফেলি । দেখি তার মুক্তাসম শ্বেতত্ব -- হোয়াইটনিং ফিলোজফি । পারদ, জল, বীর্যে ষড়বলের এক বল ( সারফেস টেনশন ) ধর্মতা দেখি । বীর্যকে দেখতে থাকলে -- কি ভাবে সে ঘনত্ব হারিয়ে তরল হয়ে ওঠে ক্রমশ যত ঠাণ্ডা হতে থাকে -- ধর্মের বিপরীত এই নিয়মে টেনশন কমে, রিলিজেই রিলিজড হয়ে কিছি বাস্তবোপযোগী উপদেশ দিয়ে যায়, বীর্য বেরিয়ে এসে দর্শন দিলে সিদ্ধাবস্হাই বলা হোক তাকে । আমি ভর পেট ভাত খেতে পাই বা পাই না, এই দেহামৃত ঘৃত আমি জানোয়ার শাস্ত্রানুযায়ী প্রেইজ করি । বীর্যময় বিবিধ প্রোডাক্ট ( স্পার্মস্যুপ কি স্পার্ম ডিও বা স্পার্ম ফ্লেবার্ড কন্ডোম । মার্কেটে লঞ্চ করা যায় কি না সে সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে থাকি।
    কর্ণ আপন মনে প্রশ্ন করে --- কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    কর্ণই উত্তর করে --- আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ও রাত জাগানিয়া, তোমায় গান শোনাবো…
              সেলফ হিপনোটিক স্বমিথুন যেন ন্যায়া কুছ করনে কো মিলা । স্বমিথুন পুরুষভাবনা ধীরে ধীরে যা বোঝা যায় চলে আসবে কর্ণে, পুরুষের Porn আর ভালগার লাগবে না স্বমিথুন করে । বক্ষাকাশ, জঙ্গলশরীর, উদরসাগরে প্রাকৃতিক ধাতুবৃষ্টি কাদা কাদা করে দিলে আদিম আদিম ব্যঞ্জন হয় । তবে স্নানাগারে যাই । মৃতেঞ্জোদারোর স্নানাগার মনে হয় কাজের পর এই উঠে যাওয়ার প্রবল প্রযত্ন । ক্রমশঃ চুল ভেজে, বালী হয় ; গ্রীবায় জল আসে, সুগ্রিব হয় ; কন্ঠায় আসে, নীলকন্ঠ হয় ; হনুতে হনুমান হয় ; বক্ষ ভেজে -- সাহারায় হড়কায় স্নেহ ; উদর ভেজে, আদ্যা হয় ; নাভি সীতা হয় ; জঙ্ঘা জঙ্ঘুমুনি, পুরুষের নিতম্ব সৌন্দর্য নিয়ে একটা উপন্যাস হয়ে যাক --- শরীর বেয়ে নদী বেয়ে যায়, নাড়ির টানে এ-শরীর সদাশিব হয় । পুরুষ স্নান করে সঙ্গমোত্তর ।
              না, মিখায়েল বাখতিনের কারনিভালের প্রসঙ্গ তোলার জন্য অর্ঘ্যর পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিইনি ; বাখতিন থেকে আজকের সমাজে, সব দেশের সমাজেই, যা প্রাসঙ্গিক, তা হলো শরীরের ফাটলগুলোর আহ্লাদ । আজকের দিনে ফিকশানের ন্যারেটিভ আঙ্গিকগুলো আগেকার-কালের উপন্যাসের একটি চরম ও আত্মসচেতন, আত্মসচেতন কথাটায় লক্ষ্য রাখুন, রূপ, নানা রূপের মধ্যে একটি রূপ । 
              অর্ঘ্য নিজের পছন্দের রূপ বেছে নিয়েছেন প্রতিটি গদ্যে । অর্ঘ্যের গদ্যগুলো, প্রতিটি গদ্য,  নিজের আঙ্গিককেই সমালোচনা করতে করতে এগিয়েছে, ডিসকোর্সের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ককে যাচাই করতে করতে এগিয়েছে । আসলে সমস্ত আর্ট ফর্মই, ফিকশানের তো বটেই, সে তাকে প্রগল্প বলা হোক বা অন্য নাম দেয়া হোক, স্বয়ংসমালোচনায় আবিষ্ট । ওপরে যে উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি তা সেই অবসেশনকে পরখ করার উদ্দেশে ।
             অর্ঘ্য কী করছেন ? তিনি আর্ট ও বাস্তবের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সরাসরি সন্দেহ করছেন, পাঠককে ফাঁসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নিজেরই নান্দনিক আত্মপরিচয়ে । এর ফলে তাঁর গদ্যগুলো সাহিত্য ও জীবনের সীমায় আত্মসচেতনতা নিয়ে উপস্হিত থাকছে, আর তার মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে লেখক-সহযোগী পাঠকের সূক্ষ্ম পার্থক্য গড়ে তুলছেন ।
              অর্ঘ্যের গদ্যের আঙ্গিক এবং বিষয় ( কেন্দ্রহীন বিষয় ) দুটিই একযোগে যুক্তিতর্ক-নির্ভরতা, প্রচলিত রীতি ও আধিপত্যের কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে, বা বলা চলে, অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ঘটিয়ে এগিয়েছে। বাখতিন কিন্তু ব্যক্তিকে ততো গুরুত্ব দেননি যতোটা অর্ঘ্য দিচ্ছেন তাঁর গদ্যগুলোয় । আমরা পাই ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট, ইয়ার্কি, বিভ্রান্তি, বোকামির উল্টো টাঙানো, প্রায় অভাবনীয় একখানা জগত ।
              অর্ঘ্যর অন্তর্ঘাত অনেক সময়ে তথাকথিত উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আদল-আদরা পায় । এমনকি পাঠককে চমকে দেবার, বিহ্বল করে দেবার জন্য তিনি বর্তমান কালখণ্ডের যে সমস্ত যৌন আচরণ যুবক-যুবতীরা পছন্দ করেন, মূলত সন্তানোৎপাদন এড়াবার জন্য, সমকাম, বীর্য নিয়ে খেলা, যোনির বাইরে বীর্য ফেলা বা ওনানিজম, মুখমেহন ইত্যাদিকে সন্দর্ভে তুলে এনেছেন । সবকিছুই স্পার্মফ্লেভার্ড হোক । 
              সন্তানোৎপাদনের বাইরে যৌনতার কথা বাংলা সাহিত্য এতোকাল এড়িয়ে গেছে, যে কোনো কারণেই হোক । অথচ সন্তানোৎপাদনের ভীতির কারণে যৌনতার মজা নষ্ট হয়ে যায় । সন্তানোৎপাদনের ভীতিকে যদি জলাঞ্জলি দেয়া যায়, যা আমরা অর্ঘ্যর গদ্যতে পাই, তাহলে যৌনতা হয়ে ওঠে আহ্লাদের, আনন্দের, সুখের, বিজয়প্রাপ্তির, জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার, নারী ও পুরুষ উভয়েরই ।

     

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৫৩738532
  • অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর গদ্য বুঝে ওঠার চেষ্টা
    মলয় রায়চৌধুরী
              পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন অর্ঘ্য, দাঁড়ান গুনে বলছি কতোগুলো গদ্য আছে বইটায়, হ্যাঁ, সাতটা, তবে মাসখানেকের বেশি নানা সময়ে পড়েছি বলে জানি না, একআধটা হারিয়ে ফেললুম কি না । 
              পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় এলো, তাহলো এই যে কতো বছর বয়সে লেখকীয় ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বক্সী ?
              কোনো কিছু পড়ায় আমার বদভ্যাস হল যে অবান্তর চিন্তায় হারিয়ে যাই, ফলে আবার ফিরে আসতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলুম সেখানে ; এই করে অর্ঘ্যর গদ্যগুলো পড়ে উঠতে বেশ সময় লেগে গেল । সাতাত্তর বছর বয়সে ডাইগ্রেশন স্বাভাবিক, নয়কি ?
             এই বয়সে সাহিত্য আলোচনা করতে আমি বড়োই অনাগ্রহী ।
              লরেন্স স্টার্ন অবশ্য বলে গেছেন যে ‘পড়তে বসে হারিয়ে যাওয়া হলো সূর্যের আলো, জীবন, বই পড়ার আত্মা’। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে যে গদ্যটা পড়ছিলুম, দুপুরে অন্য একটা গদ্যে আটকে যাই ; পরের দিন আবার আরেকটা অন্য গদ্য।
              পাণ্ডুলিপি পড়ে বইয়ের সামনে দিকে দুচারপাতা লিখতে বলেছেন অর্ঘ্য আর ওনার বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর । 
              প্রস্তাবটা পেয়ে ভাবছিলুম যে আমার মতন একজন কমব্যাট্যান্টকে কেন ! আমাকে যা ক্রুদ্ধ করে, প্যাশনেট করে তোলে, অসংযত করে তোলে, বিরক্ত করে, মানুষের যা অপছন্দ করি, তা কি অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ক্ষেত্রেও একই ? তিনিও কি আমার মতন সমাজের হাতে বিধ্বস্তদের পক্ষে ভাবতে বসে ডিসটার্বড ? মানে খুঁজে বেড়ান যা কিছু অতর্কিত, তাইতে ? পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতন অর্থহীন শব্দবন্ধের বদলে ইনোভেটিভ শব্দটা ব্যবহার করতে চান ?
              প্রথম পাঠে মনে হলো, অর্ঘ্য সম্ভবত স্বীকার করেন যে লেখকীয় কাজ যদি সত্য হতে হয়, তাহলে তাকে মানব-মনের গভীর, অন্ধকার, অসুস্হ, হেজে-যাওয়া, বিরক্তিকর  কোনগুলোতে জোর-জবরদস্তি ঢুকে পড়তে হবে, কেবল ইনোভেশান দিয়ে সামলানো যাবে না। তারপর তো পাঠকের দায়িত্ব সেই কাজে  অজস্র রাস্তা খুঁজে পাওয়া ।
              কিন্তু আমি অনেক বইকে কেবল ফিকশান বলে মনে করি, যেমন সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই, এতো ভালো উপন্যাস কম লেখকই লিখেছেন । আমি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সবই ফিকশান বলে মনে করি, ইতিহাস বলে মনে করি না ; যেমন মঙ্গলকাব্যের কাহিনিগুলো । তাই কোন চরিত্র কেন অমন আচরণ করলো, তার দায়-দায়িত্ব পাঠকের বলে মনে করি, লেখকের নয় । 
              পুতুল নাচের ইতিকথায় শশির এরেকটাইল ডিসফাংশান ছিল কিনা তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যাননি, তার কারণ ওটা একটা ফিকশান । যে যেমন চায় ব্যাখ্যা করবে ।
              একটি সাহিত্যকর্মকে তার নিজের গুণে দাঁড়াতে হয়, যেমন রামায়ণ মহাভারত দাঁড়িয়ে আছে , কৃতিত্বটা বাল্মীকির ও ব্যাসদেব নামের লেখকদের । বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছি, অযোধ্যায় বহুবার গেছি চাকুরিসূত্রে । আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে রামায়ণ কাহিনির রামের ওটা জন্মস্হান আর জন্মশহর । কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর গেছি । সবই গল্প । বরং কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে-থাকা মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি আসল, এখনও কিশোরীরা অমন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
              রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে অর্ঘ্যর আগ্রহ এবং মহাকাব্যগুলির চরিত্রদের নিয়ে তিনি খেলেছেন নিজের মতন করে, সেঁদিয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে । 
               আমি ভাবি যে রামায়ণ-এর গল্পটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আশেপাশে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছড়িয়ে পড়ার সময়ে মূল রামায়ণ থেকে সরে গিয়ে যে-যার নিজের মতো করে গল্পটা তৈরি করে ফেলল, চরিত্রদের ওলোট-পালোট করে ফেলল । এই একই ব্যাপার মহাভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন ? ব্যাসদেবরা মহাভারতে যেমন যে-যার নিজেদের লেখা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, তা কেন সম্ভব হয়নি রামায়ণের বেলায় ? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধাকেই বা কারা জুড়ে দিয়েছিল, মহাভারতে তো নেই ! 
              বাঙালিদের বাড়িতেও দেখি গোপাল, নাড়ুগোপাল, দোলগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ, রাধাকেষ্ট ইত্যাদি । তা বাঙালিরা রাধাকে কবে আর কোথা থেকে পেলো ? বঙ্গদেশে আমদানি-করা উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণরা এনেছিল কি নিজেদের পুঁটলিতে বেঁধে ? ব্রাহ্মণরা বঙ্গদেশে আসার আগে এখানকার দেবী-দেবতা এবং মিথগুলো কেন হারিয়ে গেল ! বৌদ্ধধর্মের দেবী-দেবতারাই বা চিরকালের জন্য কেন লোপাট হয়ে গেল !
              ন্যারেটিভে সোমরস প্রসঙ্গ এলে বেশ হতো, কেননা ওটা যে ঠিক কী জিনিস আমি আজও জেনে উঠতে পারিনি ।
              সরি, আবার ডাইগ্রেশন ঘটিয়ে ফেলছি ।
              সে যাক, পুতুল নাচের ইতিকথা নিজের গুণে দাঁড়িয়ে আছে ।
              একজন লেখক স্রেফ তার সৃজনকর্মের গাদ । রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ লেখকদের মতন তাঁদের আড়ালে চলে যাওয়া উচিত ।
              এর আগে কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধ বা ইনট্রো, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের, যা-ই বলুন, লিখেছি বটে, কিন্তু ন্যারেটিভ নিয়ে এরকম নিজের সঙ্গে নিজে বার্তা-বিনিময়ের একাধিক কন্ঠস্বরের নিরীক্ষা, মেইনস্ট্রিমের বাইরে বেরিয়ে, ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেবার ইনোভেশানের লেখা নিয়ে লিখিনি । 
              বলা যেতে পারে, অর্ঘ্য আমাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন । 
              পড়তে গিয়ে আমি কোন গদ্যের পর কোন গদ্য, তাও বিছানায় শুয়ে, আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে ঠ্যাঙ তুলে,  আর ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ার সময়ে গোলমাল করে ফেলেছি । অবশ্য জানি, অর্ঘ্যর তাতে খুব-একটা কিছু আসে যায় না । ছাপাতে দেবার আগে সাজিয়ে নেবেন ।
              অর্ঘ্য তাঁর প্রোটোফিকশানগুলোকে বলেছেন প্রগল্প । মনে হয় প্রথানুগত গল্প বলার কায়দাকে তিনি কনটেম্পচুয়াস মনে করেন । স্বাভাবিক । বালজাক বলেছিলেন যে, ফিকশান লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনরত মূল্যবোধের ভয়াবহ প্রকোপ ফাঁস করে দেয়া । বালজাকের সময় থেকেই নয়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করেছে, সভ্যতার প্রসারে তা কাজে লাগিয়েছে । তা সত্ত্বেও ভাবুক ও সাহিত্যিকরা আশা করেন যে মানুষ মানবতাবাদী হবে, সাম্যবাদী হবে, কল্যাণকামী হবে, যুক্তিতে বিশ্বাস করবে, ইত্যাদি । এদিকে দেখতে দেখতে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থব্যবস্হার রক্ষিতা বা জিগোলো ।
              অর্ঘ্য ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, চিন্তার স্রোত বজায় রাখার কারণে, আমিও লিখতে বসে মগজে ইংরেজি শব্দ এসে গেলে তা-ই করবো ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যে বিদেশি লেখদের কথা মনে এলো, তাঁরা উলিয়াম বারোজ, ইশমায়েল রিড, টেরি সাদার্ন, কার্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, টমাস পিনচন নয়, কেননা এঁরা একরৈখিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যেতে পারেননি, এঁরা নির্ভর করেছেন প্রচলিত ন্যারেটিভের ডিভাইসের ওপর ; ফিকশান ও গদ্যের প্রথাকে ভেঙে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসের বদলে ফিকশানের ফিকশানালিটিকে মান্যতা দিয়েছেন ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যাঁদের কথা মাথায় এলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেরি গেইটস্কিল, কেথি অ্যাকার, গ্যারি ইনডিয়ানা, কারেন ফিনলে, ডেনিস কুপার, ডেভিড ওজনারোইজ প্রমুখ । 
              হয়তো অর্ঘ্যের অবচেতনায় জাঁ জেনে, লুই ফার্দিনান্দ সেলিনে, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশোঁ প্রমুখের রচনা পাঠের রেশ থেকে গেছে । এঁদের গদ্য ভিশনারি ও কাব্যিক মোডের । অর্ঘ্য নিজেই স্বীকার করেছেন ঋত্বিক ঘটক থেকে পাওয়া তাঁর প্রোটোফিকশানের উপাদান প্রাপ্তির ।
               হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার সুভাষ ঘোষ ও সুবিমল বসাকের কথাও উল্লেখ করতে চাইবো, তুলনা নয়। তবে প্রথানুগত ন্যারেটিভ টেকনিকের কারণে বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যের তুলনা করবো না । একই কারণে উল্লেখ করতে চাই না সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফিকশান এবং শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের । শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররা মুক্ত সূচনা দিয়ে আরম্ভ করলেও তাঁরা একরেখিকতা ও বদ্ধ সমাপ্তির বাঁধন থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁদের চরিত্ররা কেলাসিত রয়ে গেছে ।
                উল্লেখ করতে চাইবো রবীন্দ্র গুহ, অজিত রায়, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সৌগত বালী প্রমুখের ইনোভেটিভ  গদ্য । 
                সুবিমল মিশ্রকেও উল্লেখ করতে চাইবো, তাঁর টাইপোগ্রাফিকাল ইমেজখেলা ও অক্ষরকোলাজ বাদ দিয়ে। সুবিমল মিশ্রের একজন  শিষ্য, স্বপনরঞ্জন হালদারের একটা বই আমি আলোচনা করেছিলুম, কিন্তু সেই সময়ের কমিউনিস্টদের রোগ থেকে বেরোতে পারেননি উনি, মুখ ফুটে বলতে পারেননি রক্তচোষার দিগ্বিজয়, উল্টে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গুরুঘণ্টাল পিঁজরাপোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অপমানজনক সমালোচনা করেছিলেন । 
                 ইনোভেটিভ গদ্যের এই এক বিপদ, কে যে কোথা থেকে ঢুকে পড়বে আর জিনিয়াসগিরির দাবি করবে স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
                যাঁদের নাম উল্লেখ করলুম, তাঁরা সকলেই, অর্ঘ্যের মতন, জানতেন যে সাহিত্যের রিসেপশানের মণ্ডপে ঢোকার মুখে তাঁদের পড়তে হবে বাউন্সারদের পাল্লায় । কারণ এনারা ফিকশানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধের মালিকানা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন ।
                আগের প্রজন্মের ওই লেখকদের লেখনজগতকে সরিয়ে এগোবার রাস্তা বের করতে হয়েছে অর্ঘ্যকে । শব্দ মুচড়ে গড়া ভাষা এবং আইডিয়া ও চিন্তা দিয়ে গড়া ভাষার যে গভীর পার্থক্য আছে তা নিজের গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য ।
                এক বাসুদেব দাশগুপ্তকে ছাড়া, মেইনস্ট্রিম বাংলা সাহিত্য অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তা করেনি, তার কারণ অবিরাম বদলাতে থাকা সংস্কৃতির, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি, আলোচকরা খেয়াল নিয়োজিত করেননি। 
                অর্ঘ্যর হাতে পড়ে প্রতিটি অবজেক্ট মর্মার্থে ভরপুর হয়ে উঠেছে, কিন্তু অবজেক্টের মর্মার্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেবে, তা আশা করা যায় না, কেননা অর্ঘ্যের মতামত তাতে কুঁদেকুঁদে ব্যক্তিগত গোপনতাসহ রাখা আছে, সবায়ের অভিজ্ঞতার বনেদ তো একই নয় ।
                অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে কোনো বিশেষ জনারে চিহ্ণিত করা যাচ্ছে না বলে আমি বলেছি প্রোটো-ফিকশান ; গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে অর্ঘ্য একজন Neo-gnostic, গোপন জ্ঞানের ভাঁড়াররক্ষক।
                শিরদাঁড়ার শীতল সিরসিরানিকে নিজের গদ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন অর্ঘ্য । সম্ভবত যখনই এই সিরসিরানি তাঁর অস্তিত্বে ঘটে তখন তিনি বাক্যগুলোয় যাতে তা থাকে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, তার প্রয়াস করেন । পড়ার সময়ে পাঠক টের পান ঠিক কী ধরণের শীতলতার টর্চার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে রাস্তা থেকে, চায়ের ঠেক থেকে, গ্রন্হ থেকে, স্মৃতি থেকে, পুরাণ থেকে,  তুলে আনার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, কিংবা হয়তো কল্পনায় তৈরি করে নিতে হচ্ছে,  ন্যারেটিভের জটিলতার সূক্ষ্ম তারতম্যকে বাছাই করতে হচ্ছে, কেননা মুহূর্তবিশেষের প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল দিতে হচ্ছে অর্ঘ্যর ন্যারেটিভকে ।
                কতো কতো ফিকশান পৃথিবী জুড়ে লেখা হয়ে চলেছে । তাদের লেখক-নির্মিত চরিত্ররা কি পৃথিবীর অদৃশ্য জনসংখ্যার একটা সমান্তরাল খাড়া করছে না ? পরের প্রজন্মের লেখকরা ওই অদৃশ্য জনসমুদায়ের সঙ্গে মিশে তাদের একজন হবার প্রয়াস করেন এবং সেই অদৃশ্য জগত থেকে বেরিয়ে এসে দৃশ্যমান জগতে নিজেই গড়ে তোলেন অদৃশ্য চরিত্রদের, পাঠকদের সামনে ছেড়ে দেন তাদের ।
                গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে আমরা জগতসংসারকে আর আধিবিদ্যক এবং মিসটিকাল পাটাতনে ফেলে বিচার না করলেও, ব্যাপারটা হলো যে ভারতীয় মিথগুলো আমাদের জাগিয়ে তোলার অপেক্ষায় থাকে, যাতে আমরা তা খোলা চোখেই দেখতে পারি । দুর্ভাগ্য যে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক- সংস্কৃতিকে ঘেরাও করে নিয়েছে কিৎশ -- যেন একেবারে হোস্টেজ সিচুয়েশান ।
                অর্ঘ্যকে সংলাপ আবিষ্কার করতে হয়েছে, যাতে যে অভিজ্ঞতা তাঁর ঘটছে, তার সঙ্গে সংলাপগুলো খাপ খেয়ে যায় । আমরা তো সদাসর্বদা শব্দের মাধ্যমে চিন্তা করি না ; আমাদের ভেতরের গভীরতম এলাকাকে পুরোপুরি ধরতে সক্ষম হয় না কথাবার্তা । শব্দদের নিজস্ব সত্য ও সত্তা থাকে, এবং তা বেরিয়ে পড়ে তার আওয়াজের বা স্ফোটনের সূত্রে । ফলে বস্তু-বিশেষের সঙ্গে শব্দেরা হুবহু মিলে যেতে অস্বস্তি বোধ করে । বিভাবসু, কবি, এই কারণে শব্দগুলোকে ধ্বনিভিত্তিক করে নিয়ে লেখেন ।
                শব্দগুলোর নিজের নিজের ক্ষুধা থাকে এবং তারা তা-ই খেতে চায় যার অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে। সমস্যা হল যে পাঠক-বিশেষের সেই একই অভিজ্ঞতা না-ও থাকতে পারে । ভিন্ন কিছু গড়ে তোলার জন্য ভাষাকে প্রয়োগ করতে অর্ঘ্য বাধ্য হন, কেননা জীবন আর ভাষা একই ব্যাপার নয় । বস্তুত পরাবাস্তব তখনই কাজ করে যখন তা বাস্তব থেকে চাগিয়ে উঠছে । 
              যা বলা হচ্ছে বা লেখা হচ্ছে, তা এক ব্যাপার, কিন্তু যা বলা হচ্ছে না, বা লেখা হচ্ছে না, তাও উপস্হিত থাকছে অর্ঘ্যর গদ্যে । যা লেখা হয়নি অথচ তা লিখিত পাঠবস্তুর সঙ্গে ভেসে বেড়াচ্ছে, তা লেখক অনুভব করতে পারেন এবং তাঁর লেখাটা এমনই হওয়া দরকার যে পাঠকও ওই ভাসতে থাকা মর্মার্থের সঙ্গে নিজেকে মিশ-খাওয়াতে পারবে ।
              অর্ঘ্যর বাক্যগুলো এলিপটিকাল, অনেকসময়ে ছোটো-ছোটো স্ফোটন জুড়ে-জুড়ে তৈরি, বাস্তব জগতকে অবিরাম স্ক্যানিং করার জন্য, যে বাস্তব জগত অর্ঘ্যর বয়সি যুবকের কাছে সতত পরিবর্তিত ও উপস্হাপিত হয় মেটাবলিজমের ও হরমোনের, প্রধানত প্রজেস্টেরনের, মাধ্যমে । 
              গদ্যের মাঝে  আচমকা উদয় হন অর্ঘ্য। মেইনস্ট্রিম আলোচনায় শৈলীটা মনে হতে পারে সাধারণ্যের শৌখিন শোভনতাকে আক্রমণের পরিবর্তে এক ধরণের অমার্জিত মর্ষকামী বিকৃতি । ওই সাহিত্যিক প্রেজুডিসকেই তো বিধ্বস্ত করতে চাইছেন অর্ঘ্য, গদ্যের নান্দনিক স্ট্র্যাটেজির বর্শাফলক দিয়ে ।
              বেশ আনন্দের সঙ্গে স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন অর্ঘ্য । স্যাটায়ার ব্যাপারটা একই সঙ্গে নীতিমূলক আর রাজনৈতিক । বলা চলে লেখকের বুনো ক্রোধের তরোয়াল লুকোবার খোপ । স্যাটায়ার হলো বাঁশের তৈরি ‘হস্তশিল্পের’ চোঁচ, যা ফুটে গেলে সময়মতো বের করে না দিলে বিষিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটাতে পারে ।
              অর্ঘ্য ওনার গদ্যে নিজের প্রতিস্বে ব্যক্তিএককের ইউনিকনেস যেমন দিয়েছেন, তেমনই ওই ইউনিকনেসকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টাও করেছেন । পাঠককে ধৈর্য ধরে এগোতে হবে । গ্রিক দেবতা জানুসের যেমন দুটো মুখ ছিল, মুক্ত সূচনার ও মুক্ত সমাপ্তির, যে দেবতার কোনো পুরোহিত ছিল না, অর্ঘ্যর গদ্যকে তেমনই দুই দিক থেকে বুঝতে হবে ।
              অর্ঘ্যকে প্ররোচিত করে আইডিয়া ও চিন্তা, এবং তাঁর অ্যাড্রেনালিনের উৎস ওনার আইডিয়া-বিশেষ, এক-একটি আইডিয়া উদয় হয় আর তা থেকে কথন-প্রক্রিয়া ধার নিয়ে এগোতে থাকেন । আইডিয়ার ফিকশান, যদিও অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে ফিকশনের চৌহদ্দিতে আটকে রাখা ভুল হবে, অবহেলিত থেকে গেছে, যেমন অতীন্দ্রীয় পাঠকের গদ্যগুলোর ক্ষেত্রে ।
             অর্ঘ্যর উদ্ভাবনা আনফেটার্ড, হয়তো বাক্যগঠনে আকস্মিকতা তাঁর অজানিতেও ঘটে গেছে, প্রতিরূপ উপস্হাপনে অবসেসিভ, বারবার বলেছেন একই কথা বা ঘটনা, তাঁর কনসেপচুয়ালাইজেশান নির্বাধ ।
              সাহিত্যিক ইনোভেশান বিকল্পকে দৃষ্টিগোচর এবং কল্পনাসাধ্য করে তোলে, আর এই সমস্ত বিকল্পের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যতের বনেদ গড়ে ওঠে, লেখালিখির সম্পূর্ণ নতুন পাটাতন, যা কালক্রমে মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে চুয়ে পড়ে । ইনোভেশানকে বলা যায় সাহিত্যিক রদবদলের ও পুনরুদ্ধারের ইনজিন ; সাহিত্য নিজেই নিজেকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনরাবিষ্কার করে । 
              ইনোভেশান হলো জড়তাহীন, লৌকিকতাবর্জিত, রীতিনীতি অস্বীকারকারী, কাটিং-এজ সাহিত্য, যাতে থাকে অভিঘাতের লক্ষ্য, অপমানকরার উদ্দেশ্য, আইকনোক্লাজম ও জটিলতার মারপ্যাঁচ ।
              অর্ঘ্য লক্ষ্য স্হির করেছেন নিপুণ বাক-প্রতিবেদন আবিষ্কারে, আসঙ্গময় কন্ঠস্বরে, এবং প্রয়োগ করেছেন তাঁর দৃষ্টিপ্রতিভা, পথ কেটে বের করেছেন ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে, এবং স্ট্রোব লাইটের ঝলকানির সাহায্যে এগিয়ে গেছেন, জীবন প্রকৃতপক্ষে কী তার  রহস্য অনুসন্ধানে, লিঙ্গোথ্থান হয় না এমন যৌন-প্রসঙ্গ এনেছেন, চুরো-করা বাক্যাংশের দুমড়ে ফেলা ছবি উপস্হাপনের সাহায্যে । পাঠকদের ধাঁধিয়ে দিতে পেছপা নন অর্ঘ্য ।
              নিৎশে বলেছিলেন ‘অশুদ্ধ চিন্তা”র কথা । তাঁর মতে, জীবনের বাস্তব ঘটনাবলীর সঙ্গে যখন বিমূর্ততা মিশে যায় তখন ‘অশুদ্ধ চিন্তা’ প্রশ্রয় পায়, পেয়ে বসে মানুষের ওপর, দুটোকে ছাড়িয়ে তারপর আলাদা করা যায় না । অর্ঘ্য বহু ক্ষেত্রে বিমূর্তের সঙ্গে বাস্তব জীবনের ঘটনাবলীকে উস্হাপন করেছেন । 
              অর্ঘ্য মনুস্মৃতির প্রসঙ্গ এনেছেন কিন্তু যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতির প্রসঙ্গে তোলেননি, যখন কিনা কাব্যিক আঙ্গিকে রচিত যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে সাহিত্যিক কাজ বলা যায়, এবং যা মনুস্মৃতির পরবর্তীকালে লেখা । ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য, প্রথম জনগণনার সময়ে  ব্রাহ্মণদের সাহায্য নিয়ে মনুস্মৃতিকে গুরুত্ব দিয়েছিল, অথচ ততোটা গুরুত্ব দেয়নি যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতিকে। প্রথম সেনসাসের চতুবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র থেকে হিন্দু বাঙালি সমাজ আর বেরোতে পারেনি ; ব্রাহ্মণরা বাঙালি ক্ষত্রিয়দেরও শুদ্রে বর্গীকরণ করে দিয়েছিল, যে কারণে পিছড়াবর্গের কোটা নিয়ে মারাঠা, জাঠ, গুজ্জর, প্যাটেলদের মতন বর্গ বঙ্গসমাজে নেই ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের স্মৃতি তিনটি খণ্ডে রচিত, আচারকাণ্ড ( রীতিপ্রথা ), ব্যবহারকাণ্ড ( বিচার ব্যবস্হা ) এবং প্রায়শ্চিত্ত কাণ্ড ( অপরাধের শাস্তি ও প্রায়শ্চিত্ত ) ।
              যাজ্ঞবল্ক্যের বক্তব্য ছিল যে মানুষের রয়েছে তেজোময়তা বা কর্মশক্তির উদ্বৃত্ত, যার একটা হিল্লে প্রতিটি ব্যক্তিএকককে করতে হয় । সেই উদ্বৃত্তই হলো জীবন । উদ্বৃত্ত বাদ দিয়ে জীবন সম্ভব নয় । একটি জনসমাজের মানুষ সমবেত উদ্বৃত্ত দিয়ে যা করে, তার দ্বারা সংস্কৃতিটির তো বটেই, মনেরও, আদল-আদরা নির্ধারিত হয় । এই দিকটি অর্ঘ্য নিয়েছেন, যদিও যাজ্ঞবল্ক্যের উল্লেখ তিনি করেননি ।
              অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো, বিশেষ করে একরৈখিক একেশ্বরবাদীদের মতো, সনাতন ভারতীয় চিন্তায় দেবতারা প্রথমে আসেননি । এসেছিলেন প্রজাপতি, এবং তিনি যে কে তা মিথই রয়ে গেছে । প্রজাপতির পর এসেছিলেন ঋষিরা । তারপরে দেবতারা । অতএব লেখক যখন মিথের জগতে প্রবেশ করছেন তখন বেশ ঝুঁকি নিয়েই তা করছেন, এবং মানুষ নিজের ভেতরে মিথের মাধ্যমে পুলক সৃষ্টি করে। 
              মিথের রহস্যে , সেই বিপজ্জনক এলাকায় প্রবেশ করেন লেখক, কেননা ওই এলাকাটি অজানা । লেখক যা-ই করুন না কেন, তিনি একটি উপকথার জগতে ঢুকে পড়েন, এবং উপকথার সংজ্ঞানুযায়ী, তা মানুষের চেতনায় পুলক গড়ে তোলে । 
              মিথ কখনও একটি গল্পে ফুরোয় না । মিথ আনন্দ আনে এবং আনন্দ হলো এক বিস্ময়কর অসুখ । এই কারণেই দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে কেন্দ্র করে এতো অপমানজনক গল্প সংস্কৃতভাষীরা লিখে গেছেন যে মনে হয় বেচারা রাজা না হলেই পারতো ।
              সে যাক, এবার অর্ঘ্যের গদ্যের কিছু-কিছু অংশ পড়া যাক :
    নিম্নবর্গের খিস্তিমাত - চায়ের দোকানের Salanguage
              ব্লেড বা কাঁচির নাগাল পাবার আগেই যাবতীয় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের ঋতবানস্বামী গুম মেরে বসে বসে নাকি পোঁদ উল্টে মটকা মেরে ধূমকেতুর মতোন “পাশের বাড়ির বৌদিকে ন্যাপা চুদে” নামক দেশী পর্ন দেখতে থাকে অথচ স্ফূতি পায় না যাহার নিকট মেয়ে দুই প্রকার, এক যারা চুষে দেবে, আর যারা চোষে না -- এই একমাত্র criteria তার কাছে মেয়ে বিষয়ক, নারীগুণ, --- একেও এক ব্যতিক্রমী নিম্নবর্গীয় চেতনা বলি, আক্ষরিক অর্থেই উন্নতবর্গে নিম্ন শ্রেণীর চেতনা ব্যতিক্রম, বিরল প্রাণী ঋতবান -- ঋত+বান -- এই সেই “ঋত”, ঋগ্বেদের, যাহা হইতে বরুণাদি দেবতা সৃষ্টি, যাহার অনুকরণ করেন পরমদেব ইন্দ্র, যাহাই প্রকৃতিস্বরূপ, যাহার মাধ্যমে গাভী, অন্ন প্রাপ্ত হয় ও যজ্ঞ যাহার অনুগামী, অনুগামী সকল দেবতা, ঋত -- যাহার উর্দ্ধে, যাহা অপেক্ষা কেহ নাই, সকলেই ঋতবান -- সেই অর্থেই যৌনতা আমাদের এ বালকে ও সকল বালকেই প্রায়, বিশেষত বাজার ঋত অর্থে ইহাই উপাসনা করে ।
              ---লাইক ব্রিটনি বিচ, ইটস জোডি বিচ…
              ---tell one more time and i will be off…
              ---ইটস জোডি জোডি জোডি বিচবিচারি
              ---ok, it’s over, bye, see u…
              হাসতে হাসতে যে সম্পর্ক শেষ করি সে এক ব্রিটেনের অজ পাড়াগাঁর নিম্নবর্গ কিশোরী, যে কিনা সদ্য রিহ্যাব-ফেরত ও লিভটুগেদারি । প্রেমটা অফুরন্ত হাসি আর ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে ভাঙল, i’m suffering from too much happiness…
              আমি বিলেতি নিম্নবর্গ, গরিব মানুষ চিনলাম, যারা তাদের মাতৃভাষা ইংরেজির বানান লেখে ধ্বনিভিত্তিক, আমাদের ডিকশনারীও প্রপার স্পেলিং নয়, যারা ব্যবহারকে অসোংখো চলতি ইংরেজি, যা কেবোল মাতৃভাষাতে কথা বলার সময়ি ব্যাবহার করা যায়, খোদ ব্রিটিশের মাত্রিভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উপলব্ধি করি ধ্বনিভিত্তিক বানানেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ, ইহাই প্রোতিষ্ঠান বিরোধিতার ভাষা এখন, ভবিষ্যতে ইহাই নিওম হইবে…
              এবং আমি যখন একটি লেখার শেষ স্তরগুলি edit করে যোগ করি তখন এ ভেবেই করি অ্যাখন অব্দি যাবতীয় চিন্তা ম্যাচিওরিটি অভিজ্ঞতা এতে সর্বোৎকৃষ্টরূপে একত্র ও লিপিবদ্ধ থাক । এই লেখাই যদি শেষ লেখা হয় তবে কোনো খেদ যেন না থাকে । চলছে এরকমই, চলুক, কারণ কখন যে মাথা বিগড়োয় কিচ্ছু বলা যায় না…
              সন্ধ্যেবেলা সেদিন এক হিজড়ের দল এল তারকের দোকানে ।
              তারা বলিল --- আসবি ?
              প্রবল আমোদ হইল তারকের । সে নিজ বাম হস্তের কনিষ্ঠাটি দেখাইল । মধ্যমাটি  দেখানোর বদলে । ইহাও সাংকেতিক অর্থে তোদের গুদও নেই পুরুষ মানুষের মতো বাঁড়াও নেই । আছে এক প্রতিবন্ধী বাঁড়া । না চোদা যায়, না চোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে ।
              তবুও তারা রাগিল না । তারকের দোকান হইতে চা কিনিয়া আমাকে ও তারককে চায়ের ভাগ দিল । আমার যথারীতি আপত্তিতে বলিল --- পি লে, পেয়ার বড়েগা ! তারক মাইতে হাত বুলাইল, তাহারা হাসিল, চলিয়া গ্যালো, তারক গান ধরিল, মহাতৃপ্তিতে, যৌনসঙ্গীত…
              সে নিম্ন, তাহা অপেক্ষা নিম্ন পাইয়া সে তো আহ্লাদিবেই । এই তো পিরামিড, সমাজের শ্রেণী পিরামিড, কেউ তোমার জ্বালায় মরে, তুমি কারো জ্বালায় মরো ।
    কিশোরের নীতা ও নামস্তোত্র
              কিশোর + নবনীতা
              Kishore + Nabanita
               কি Share + Na ব
               Ki শোর + ন Ba
              
               যে বয়সে মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়, তখনো কিশোর মেয়ে দেখে নাই । মেয়ে চেনে নাই । তখন অবধি মা, দিদা, মাসী, জেঠী, দিদি ছাড়া মহিলা কি বোঝে নাই কিশোর ।
              যে বয়সে মেয়েরা ঝাড়ি মারা কি বুঝে ফেলে, সে বয়সে কিশোর মেয়ে বানান লিখিত ‘মে’ । গৃহশিক্ষকের চপেটাঘাত, ভর্ৎসনা ও ভ্রম সংশোধন শিখিল প্রকৃত মেয়ে বানান -- মেয়ে দিবস হয়ে ওঠে সেই জিয়ানস্টাল ! তবুও তখনো মেয়ে কি বস্তু -- মেয়ে নাম কেন, কেন উহাদের মেয়ে বলে শেখে নাই ।
               ---মা, যাদের লম্বা চুল তারাই কি মেয়ে ?
               ---মেয়ে কি তুই শুধু লম্বা চুল দিয়েই চিনিস ?
              কাহাদের মেয়ে কয়, কাহারা মেয়ে, কারাই বা ছেলে -- ইহা পৃথক করিতে শিখে নাই যখন, তখন মেয়েরা শিখে গেছে ঝাড়ি মারা কাকে বলে । যখন তাহার ক্লাসমেটরা প্রাথমিক শিশুযৌনতা -- শিশু যৌনঘটনা কিছু কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে চুপি চুপি -- অথচ দ্যাখো মেয়ে কাকে বলে কেহই শেখায় নাই -- শেখায় নাই জাতীয় গ্রন্হ কি টেক্সটবুক তাহাকে উহা শেখায় নাই বলে কিশোরের কাছে যদ্যবধি মেয়ে না আসিল -- মা, দিদা, মাসী,জেঠী ব্যতিরেকে যখন সে মেয়ে দেখিল সে তখনও বোঝে নাই কাহাকে মেয়ে কয়, কি করে মেয়ে দিয়ে, কি ভাবে করে তা জানা তো প্রশ্নাতীত ।
               কিশোর অন কিশোর
               Kishore on Kishore
               নব অন নব
               Naba on Naba
                কিshore অN Kiশোর
                Niবস  Oন নিBs
    যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি ।
    নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি ।।
     
              কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে আশ্চর্যান্বিত হই, ১০৮টি নাম মাহাত্মের তৎকালীন যুগানুযায়ী তা কর্ম পরিচায়ক । অর্থাৎ যে জীবনে মহৎ যে কাজগুলি করেছে ও তার চারিত্রিক গুণাবলী অনুযায়ী পরবর্তীকালে নামগুলি “আরোপিত” হয় । এগুলি বর্তমানের মতো জন্মকালীন নাম নয় । যথা মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ । দুটিই পরবর্তীকালে । তার কীর্তির পরিচায়ক বিশেষণ । এ পর্যন্ত ভীষণ সাধারণ । কিন্তু কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়ে চমকিত হয়ে যাই । ১০৮ জন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠী ১০৮ রকম নাম দিচ্ছে । যা নাম দিচ্ছে তা সবই কৃষ্ণের attribute, গুণ, বৈশিষ্ট্য, সুতরাং উহারা নাম বিশেষণ । এতো গেল । কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, যে যে কৃষ্ণকে যা যা নাম দিচ্ছেন, তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যও তাইই । কৃষ্ণ যে mirror maze ; এতে যেরকম সে কৃষ্ণের মধ্যে তাই দেখছে । নিজেকেই দেখছে, নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছে। নাম--নামী--নামকারী অভেদ হয়ে যাচ্ছে । উদাহরণ দেয়া যাক ।
              যুধিষ্ঠির নিজে রাজা ও তার কাছে যাদব রাজনৈতিক শক্তির গুরুত্বই সর্বপ্রধান । তাই যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর ।
              বিদুর মহামন্ত্রী হলেও কুরুক্ষেত্রের পরান্নভোজী দাসীসন্তান । তাই বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর ।
              নারদ ভক্তশ্রেষ্ঠ । নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন ।
              অহল্যা যদিও রামায়ণের যুগের চরিত্র, তবু অহল্যার পাষাণ শাপমুক্তি celebrate হচ্ছে এই বলে যে অহল্যা রাখিল নাম পাযাণ-উদ্ধার ।
              প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহমুরারী।
              এই নাম সাহিত্যে  এমন অসংখ্য রেফারেন্স পাওয়া যাবে যা কৃষ্ণযুগের বহু আগের চরিত্রের উল্লেখে পূর্ণ, বৈদিক যুগের, এমনকি দেবতাদেরও জননী আদি দেবী অদিতি থেকে বহু পরবর্তীকালের, মহাভারতের বহু বহু পরবর্তীযুগের চরিত্রদের উল্লেখ বর্তমান । এ লেখা তাই ইতিহাস চর্চার এক মহৎ উপাদান, manifold, অত্যন্ত অর্বাচীন যুগের এক রচনা এক অতি উত্তম গবেষণার বিষয় হয়ে উঠতে পারে ।
              যা বলছিলাম, যার যা বৈশিষ্ট্য তাই কৃষ্ণ বৈশিষ্ট্য ।
              অত্রিমুনি হলেন বিশেষ একটি নক্ষত্র অত্রি যা সপ্তর্ষিমন্ডলের অন্তর্গত, অর্থাৎ আকাশ সম্বন্ধীয় । অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর । 
              রুদ্রগণও ঋগ্বেদে আকাশের দেবতা ও পসুত্ব, উগ্রতা, শত্রুবিনাশকারী, ভয় উৎপাদক, ধ্বংসকারী ইত্যাদি গুণসম্পন্ন দেবতা যার সব বৈশিষ্ট্য পরে মআদেব আরোপিত । রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল ।
              এ জাতীয় বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে ঈশ্বর আমি স্বরূপ । আমিত্বের শ্রেষ্ঠত্বই ঈশ্বরত্ব ও আমার গুণলক্ষণ, বৈশিষ্ট্য, আমার মতাদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গী, আমার যা মত ততই ঈশ্বর । কিশোরের নীতা পপেম নবনীতাই ঈশ্বরী । তার নামার্থ বদলে যায়, আসলে নীতাতেই অষ্টোত্তর শতনাম অর্পিত হতে গেলে কিশোর নিজেকে ১০৮ ভাগে, বৈশিষ্ট্যে, মতে, পরিস্হিতিতে সময়ে বাস্তবচাহিদায় বিভক্ত করে । করে নাম-নামী-নামকারী অভেদ হয় । কিশোর কৃষ্ণ হয়ে ওঠে । কারণ যার যা শ্রেষ্ঠ গুণ তা বিভূতিযোগে ঈশ্বরপ্রতিম হয়ে ওঠে ।
    কর্ণ-কৌরব সংবাদ --- অবতার সংস্করণ --- হোমো ফ্লেবার্ড --- একটি বাজে প্রগল্প
              ---কৌরব, আমি ও আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল ফুল, বড় সেন্সেটিভ । বড় স্পর্শকাতর, অস্বাভাবিক কম রোধযুক্ত, ঘণ্টায় যেমন বাধ্যত ৬০টি একক, তেমনি বাধ্যত ওর নিত্য সেবা । না দিলে বড় সাফোকেশন হয়, বড্ড তার ছোঁয়াছুঁয়ি বাই, বড্ড তার খালি ক্ষরণ করা চাই...। এবং জলের বোতল, কল, টিপট ইত্যাদি যা যা থেকে লিঙ্গসদৃশ ক্ষরণ হয়, তা নারী ব্যবহার করছে দেখলে আমার লিঙ্গ বড্ড ইমোশানাল বড্দ সেন্সেটিভ হয়ে যায় । যথা যথা নেত্র পড়ে তথা তথা লিঙ্গ স্ফূরে, তথা তথাই কৌরব as a পুরুষোত্তম স্ফূরে স্ফূরে ওঠে…
              মাঝে মাঝে লিঙ্গ অণ্ড চেপে জঙ্ঘার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে নারীযৌনাঙ্গ সুলভ এক ফিল আনি মুখ্যবিন্দুদেশে । সেখানে হাত বোলাই যেন যোনি নিয়েই খেলছি । পুরুষের আর কি আছে -- তার খেলার সঙ্গী তো ওই এক, সাত রাজার ধোন এক লিঙ্গ । স্বমিথুন করি । করে বীর্য উরুতে ফেলি । দেখি তার মুক্তাসম শ্বেতত্ব -- হোয়াইটনিং ফিলোজফি । পারদ, জল, বীর্যে ষড়বলের এক বল ( সারফেস টেনশন ) ধর্মতা দেখি । বীর্যকে দেখতে থাকলে -- কি ভাবে সে ঘনত্ব হারিয়ে তরল হয়ে ওঠে ক্রমশ যত ঠাণ্ডা হতে থাকে -- ধর্মের বিপরীত এই নিয়মে টেনশন কমে, রিলিজেই রিলিজড হয়ে কিছি বাস্তবোপযোগী উপদেশ দিয়ে যায়, বীর্য বেরিয়ে এসে দর্শন দিলে সিদ্ধাবস্হাই বলা হোক তাকে । আমি ভর পেট ভাত খেতে পাই বা পাই না, এই দেহামৃত ঘৃত আমি জানোয়ার শাস্ত্রানুযায়ী প্রেইজ করি । বীর্যময় বিবিধ প্রোডাক্ট ( স্পার্মস্যুপ কি স্পার্ম ডিও বা স্পার্ম ফ্লেবার্ড কন্ডোম । মার্কেটে লঞ্চ করা যায় কি না সে সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে থাকি।
    কর্ণ আপন মনে প্রশ্ন করে --- কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    কর্ণই উত্তর করে --- আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ---কে কৌরবকে ভালোবাসে ?
    ---আমি কর্ণ ।
    ও রাত জাগানিয়া, তোমায় গান শোনাবো…
              সেলফ হিপনোটিক স্বমিথুন যেন ন্যায়া কুছ করনে কো মিলা । স্বমিথুন পুরুষভাবনা ধীরে ধীরে যা বোঝা যায় চলে আসবে কর্ণে, পুরুষের Porn আর ভালগার লাগবে না স্বমিথুন করে । বক্ষাকাশ, জঙ্গলশরীর, উদরসাগরে প্রাকৃতিক ধাতুবৃষ্টি কাদা কাদা করে দিলে আদিম আদিম ব্যঞ্জন হয় । তবে স্নানাগারে যাই । মৃতেঞ্জোদারোর স্নানাগার মনে হয় কাজের পর এই উঠে যাওয়ার প্রবল প্রযত্ন । ক্রমশঃ চুল ভেজে, বালী হয় ; গ্রীবায় জল আসে, সুগ্রিব হয় ; কন্ঠায় আসে, নীলকন্ঠ হয় ; হনুতে হনুমান হয় ; বক্ষ ভেজে -- সাহারায় হড়কায় স্নেহ ; উদর ভেজে, আদ্যা হয় ; নাভি সীতা হয় ; জঙ্ঘা জঙ্ঘুমুনি, পুরুষের নিতম্ব সৌন্দর্য নিয়ে একটা উপন্যাস হয়ে যাক --- শরীর বেয়ে নদী বেয়ে যায়, নাড়ির টানে এ-শরীর সদাশিব হয় । পুরুষ স্নান করে সঙ্গমোত্তর ।
              না, মিখায়েল বাখতিনের কারনিভালের প্রসঙ্গ তোলার জন্য অর্ঘ্যর পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিইনি ; বাখতিন থেকে আজকের সমাজে, সব দেশের সমাজেই, যা প্রাসঙ্গিক, তা হলো শরীরের ফাটলগুলোর আহ্লাদ । আজকের দিনে ফিকশানের ন্যারেটিভ আঙ্গিকগুলো আগেকার-কালের উপন্যাসের একটি চরম ও আত্মসচেতন, আত্মসচেতন কথাটায় লক্ষ্য রাখুন, রূপ, নানা রূপের মধ্যে একটি রূপ । 
              অর্ঘ্য নিজের পছন্দের রূপ বেছে নিয়েছেন প্রতিটি গদ্যে । অর্ঘ্যের গদ্যগুলো, প্রতিটি গদ্য,  নিজের আঙ্গিককেই সমালোচনা করতে করতে এগিয়েছে, ডিসকোর্সের সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ককে যাচাই করতে করতে এগিয়েছে । আসলে সমস্ত আর্ট ফর্মই, ফিকশানের তো বটেই, সে তাকে প্রগল্প বলা হোক বা অন্য নাম দেয়া হোক, স্বয়ংসমালোচনায় আবিষ্ট । ওপরে যে উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি তা সেই অবসেশনকে পরখ করার উদ্দেশে ।
             অর্ঘ্য কী করছেন ? তিনি আর্ট ও বাস্তবের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সরাসরি সন্দেহ করছেন, পাঠককে ফাঁসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর নিজেরই নান্দনিক আত্মপরিচয়ে । এর ফলে তাঁর গদ্যগুলো সাহিত্য ও জীবনের সীমায় আত্মসচেতনতা নিয়ে উপস্হিত থাকছে, আর তার মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে লেখক-সহযোগী পাঠকের সূক্ষ্ম পার্থক্য গড়ে তুলছেন ।
              অর্ঘ্যের গদ্যের আঙ্গিক এবং বিষয় ( কেন্দ্রহীন বিষয় ) দুটিই একযোগে যুক্তিতর্ক-নির্ভরতা, প্রচলিত রীতি ও আধিপত্যের কাঠামোয় অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছে, বা বলা চলে, অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ঘটিয়ে এগিয়েছে। বাখতিন কিন্তু ব্যক্তিকে ততো গুরুত্ব দেননি যতোটা অর্ঘ্য দিচ্ছেন তাঁর গদ্যগুলোয় । আমরা পাই ব্যথা, যন্ত্রণা, কষ্ট, ইয়ার্কি, বিভ্রান্তি, বোকামির উল্টো টাঙানো, প্রায় অভাবনীয় একখানা জগত ।
              অর্ঘ্যর অন্তর্ঘাত অনেক সময়ে তথাকথিত উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আদল-আদরা পায় । এমনকি পাঠককে চমকে দেবার, বিহ্বল করে দেবার জন্য তিনি বর্তমান কালখণ্ডের যে সমস্ত যৌন আচরণ যুবক-যুবতীরা পছন্দ করেন, মূলত সন্তানোৎপাদন এড়াবার জন্য, সমকাম, বীর্য নিয়ে খেলা, যোনির বাইরে বীর্য ফেলা বা ওনানিজম, মুখমেহন ইত্যাদিকে সন্দর্ভে তুলে এনেছেন । সবকিছুই স্পার্মফ্লেভার্ড হোক । 
              সন্তানোৎপাদনের বাইরে যৌনতার কথা বাংলা সাহিত্য এতোকাল এড়িয়ে গেছে, যে কোনো কারণেই হোক । অথচ সন্তানোৎপাদনের ভীতির কারণে যৌনতার মজা নষ্ট হয়ে যায় । সন্তানোৎপাদনের ভীতিকে যদি জলাঞ্জলি দেয়া যায়, যা আমরা অর্ঘ্যর গদ্যতে পাই, তাহলে যৌনতা হয়ে ওঠে আহ্লাদের, আনন্দের, সুখের, বিজয়প্রাপ্তির, জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপার, নারী ও পুরুষ উভয়েরই ।

     

     
  • | 223.229.***.*** | ০৮ অক্টোবর ২০২২ ১২:৪৩738561
  • Malay Roychoudhury, The Cultural Outsider
    One
    I was probably born in 1939 and lived my first fourteen years in Imlitala slum with thatched mud houses in narrow lanes without electricity and piped drinking water in any of them,  of Patna town of Bihar state in India, with an extended family of twenty members whom my father had to take care of after my grandfather’s death. I have used the word ‘probably’ because Ma did not ever go to school and Dad learned his alphabet late. Other six brothers of Dad and their wives  did not go to school either. The first member in our dynasty to go to high  school was my elder brother Samir. 
    The year I was born, in 1939, a month before the birth of World War II, the world was tense, the night was dark. Everyone in the house blamed my birth, the second war and the fear of bombs and the lack of relatives, relatives from Calcutta also came to our house. From then on, uncle Promod used to tie a knot on the four legs of his lungi to serve as a big bag and start buying very cheap vegetables from Musallahpur Hat, hanging them on the handlebars of his bicycle. 
    Imli means tamarind  and ‘tala’ means beneath the tree. No one in the locality knew where and when there had been a tamarind tree – may be during During the reign of Emperor Ashoka in the 3rd century BCE, when it was one of the world's largest cities, with a population of about 150,000–400,000 or maybe when Megasthenes was a Greek ambassador of Seleucus I Nicator in the court of Chandragupta Maurya or may be it is just a figment of someone's imagination. However, when I visited the locality after forty years, it had completely changed, the inhabitants were upper caste people living in brick houses, not in thatched huts. Drains had been covered, electricity and drinking water had entered lanes and bylanes as well as houses. 
    My childhood was spent with the impoverished lower caste Hindus, then called Antyaj, and the poor Shia Muslim inhabited neighborhood of Imlitala in Patna, whose inhabitants lived in the experience of surrealism, improbability, cultural assumptions, myths, social legends. In their morality, the place of binary opposites  was not in their equation. They did not think that anyone could be very bad or very good. There was no idea of ​​being fallen. Everyone in the neighbourhood knew that a person named Bakaria Pande used to copulate with his own goats but the people of the neighbourhood did not mind. It seemed ridiculous to think that life could one day be better.  Holi was played in the neighbourhood for two days, toddy and rice liquor were gulped without limit in which everyone participated, drums and flute were played and obscene songs were sung, the women of the neighbourhood used to do whatever they wanted, which is why elder brothers and I were not allowed to go out. Even so, we would go out wearing torn pants. The body and the senses used to be the source of the festival, the two days of breaking the secrets of the people with the people. Holi was  played with sewage water, mud, dung etc. It can be said that even though the feeling of shame disappeared, nobody felt humiliated. We urchins could enter any house in the neighbourhood while playing, no one would stop us, even in the mosque of the neighbourhood we could hide behind the mat. Elder brothers and I and our family were never considered outsiders in Imlitala.
    The Kushwaha caste people  of Imlitala believed that they were descendants of Emperor Ashoka, although they used to go out at night to steal and did not usually bathe. Dusadhs believed that they were descendants of Dushasan and were employed in the company of Company Bahadur or Lord Clive, although they also went out to steal at night. . The Kurmis believed that they were born from a tortoise, an incarnation of god Vishnu, although they would go out during the day to  blackmail movie tickets. Some believed that they were the descendants of Jarasandha, although they carried out robberies and pickpockets. The Pasis or toddy tappers believed that they were descendants of Bhrigu Muni, although their job was to fetch juice and toddy from the palm and date forests of Rajendranagar and sell them in the neighbourhood. The blacksmiths, who called themselves Bishwakarma, believed that Parvati gave birth to them from dust so that they could make weapons for Shiva to kill two monsters, even though they had hoppers in their huts, Making chapatis from deya and putting pin on our tops for us for free, etc. Nai or the barber caste believed that Shiva created them from his own navel, to cut Parvati's nails, although they carried a box full of combs, scissors, soap, nail-cutter etc to cut  hair, shave armpits, trim beard and nails. We all believed them.
    Kulsum Apa’s family believed that they were descendants of Wazed Ali Shah, although everyone in the house made bidis in a dark room and sold pet ducks and hen eggs. . They believed in three kinds of angels made of light, angels of rain and food, angels of doomsday and angels of death. Even a smirk could not be smiled in front of anyone to show disbelief. None of them thought  time to be linear  and the history of the dynasty was not supernaturally bizarre. Those who thought of themselves as Emperor Ashoka, Prince Dushasana, Vishnu, Bhrigumuni, descendants of Shiva, were carrying the blood of Emperor, Prince, Goddess, God, down to the very bottom of the society and stealing, robbery, snatching became the way for them to take revenge against that society. Pickpocketing etc. Even when science and rationalism did not enter Europe, there was no Mandal Commission. What they believed was beyond doubt, unquestionable. In realistic or mundane environments, they thought it was normal to have unreal or magical elements. We believed them all.
    I didn't think their work was something wrong or illegitimate in my childhood, I thought that just like everyone earns money, they also did it in their own way. When a red-turbaned police team came looking for someone in the neighbourhood on charges of theft or robbery, someone would run from the street corner and report the news, and the men would get on top of their tiled hut and run to the back mango orchard on the roundabout for fear of being caught. When their  dogs saw the police, they would bark in a special wayl and warn them. The police were a symbol of the tyrannical, ruthless, brutal power, so the relatives would be overjoyed to be able to deceive them. There was a Hulas Chacha or Hulas uncle in the neighbourhood, an old Kayasth person, who  on the basis of Ramcharitamanas written by  Tulsidasa would predict the future of a person of the neighbourhood who thought he was in danger. He  would go to him for help. Hulas uncle  had a ramshalaka or iron stick,  with which the concerned person with closed eyes  marked a stanza. By reading out the stanza, Hulas uncle would predict the person’s fate.. Everyone believed in him. Everybody in the neighbourhood had a black horse's hooves stamped on the front door of the house, so that evil spirits could not enter their house, so that no one could do 'black magic', family members lived happily in peace, even in our house  there was a horseshoe nailed on the door frame. The elders of the house believed in its power. A list was pasted on the kitchen door of Imlitla's house, which indicated which vegetable and fruit should be eaten on a particular day of the week, although the list was not used by Ma after shifting to Dariapur. Everyone in the house believed in the omen as to what could happen if the lizard fell on the body or on the side of a person, as indicated in the annual Hindu almanack.

    Eyes closed, holding a tiny steel chisel between forefinger and thumb for cutting my nails, Ma would reminisce of a devastating earthquake in Bihar when she lost the family’s blackbuck and couple of swans, yes swans she insisted, not ducks that you find at Imlitala searching for food in the open dirty stinking drains in which the slum children shitted in early morning. That mudhut was in the Bajaja area, another slum, which crumbled in a few seconds and everybody had to flee for life. 
    The family pooled their resources and purchased the thatched Imlitala residence which had to be reconstructed to suit the requirements of a big family like ours. There was a water well within the house which had to be closed by filling with debris as local women had been using it for their marriage rituals during which they sang songs considered obscene by the male elders of the family. However, a sign of a circle remained on the floor which was not considered auspicious by Granny. 
    Compared to other areas in Patna the Imlitala abode was cheaper not only because it was in a slum also because the inhabitants were, almost all, members of untouchable castes who were forced to work for or in the  underworld, eaking out their living by resorting to banditry, hooching, bootlegging, dacoity, thievery, pickpocketing, mugging, counterfeiting cheap items, looting, illegally tapping toddy etc. Most of them came from villages where they were ostracised for some reason and did not dare to go back. They were not organised criminals but got together when needed, the reason being, though all belonged to the lowest of castes among Hindus, at that time labelled as ‘untouchables’  there were various types of castes, some of whom felt they were of higher order. Some of them fled from their villages because a certain upper caste landlord wanted the favour of his wife for a few nights. From the complexion of the skin it was easy to make out that his mother was sexually exploited by a fair skinned landlord. Some fled their village to avoid slave labour.
    People living outside this locality considered the inhabitants to be untouchables. The Vedic texts neither mention the concept of untouchable people nor any practice of untouchability. The rituals in the Vedas ask the noble or king to eat with the commoner from the same vessel. Later Vedic texts ridicule some professions, but the concept of untouchability is not found in them. Our family, having uprooted from Bengali society, was accustomed to live among people who were considered untouchables or mleccha or nimnobarna. Bengalis of Patna never ventured to enter Imlitala. We were outsiders to Bengali culture, impure, half-literates and we generally avoided telling other Bengalis that we were descendants of Lakshmikanto, the warrior minister of Maharaja Pratapaditya or our ancestors sold rent rights of Kolkata to the British.
    The slum had a Muslim part as well and they were all Shia Muslims who were members of harems of various landlords and Nawabs of Lucknow who fled the town when the East India Company dethroned Wazed Ali Shah.Asaf-ud-Dowlah, the fourth Shia Nawab of Awadh,  had shifted his capital from Faizabad to Lucknow. They were soon joined by Muslim families, mostly Shias, who also hailed from Kashmir, and were directly or indirectly connected to the royal family and its court or served the Awadh state as high-ranking officials. Then came the British, cutting the mutinous Shia down to size after 1857. Imlitala Muslims were those driven out from Lucknow by the British. The Muslim area was much more poorer as they did not resort to crime but lived on earnings from selling duck and hen eggs, chickens, goats and preparing Biri, an Indian home made cigarette. My initiation to literature, specially poetry, developed because of a Muslim family whose members still held their Lucknow fascination for urdu poetry and strangely, now forbidden, songs. At that time I did not know there were various divisions among Muslims. The Muslims of Imlitala used to beat one's own self with ropes or chains and bled intentionally during muharram . Such behaviour was not seen among the Muslims of Dariapur, the area where Dad shifted later. Once I thought of entering the mosque at Dariapur and was stunned when the cleric said, “looks like you have come to steal shoes.” In the frontside room of Kulsum Apa’s family Biri used to be prepared with tobacco in leaves tied with a string then placed on a net kept over an oven. I also participated in their Biri preparation though I had to wash my hand at the roadside tap so that Ma did not know about it. In that room they had a replica of a flying horse made of tin and a framed photo of Karbala which they revered.
    The Muslim family did not have much knowledge of the Moghal kings who ruled India for more than two hundred years. But they eulogised Nader Shah who had sacked Delhi and killed thousands of citizens. They were proud of Wajid Ali Shah and Tipu Sultan. . Once Wajid Ali Shah had been a wealthier monarch and was deported to Kolkata after his deposition by the East India Company. In Kolkata he reigned over only an estate. The sheer number of followers cramped into his premises, however, gave some impression of pomp—the grounds hosted over 7,000 people, including prostitutes, household guards, and dozens of disgruntled begums, not to speak of a menagerie of monkeys, bears, and 18,000 pigeons. Kulsum Apa’s family was probably from one of the rich members of Wajid Ali Shah’s court. I did not have much knowledge of Nader Shah and Tipu Sultan at that time. Today that area of Kolkata has become dingy, Congested and dirty, the descendants of Wajid Ali Shah’s harem have mostly become members of the darkside of Khidirpur port. 
    In Bengali upper caste families of other areas if you touched a Muslim you have had to either take bath or elder sprinkled Ganges water on you to remove your impurity. This was not applicable to our family members as grandpa and granny had lived in Peshawar and Lahore for a longtime with their children. Moreover Imlitala was a lower caste locality. But there was a strange rule in our Imlitala house which was discontinued after we shifted to Dariapur. At Imlitala, every male member had to go to the latrine wearing just an Indian towel even in winter. If a male member entered the latrine wearing his daily clothes he was required to wash them and wear fresh clothes. Female members invariably went with their clothes on and took baths and changed to fresh clothes. With the latrine clothes on the person was not allowed to touch any other family member. In case he or she touched someone accidentally, Ganges water was sprinkled on the person who was touched. For going to the latrine there was a bell metal ewer for the entire family which was one day sold off by Arun. Thereafter we used tin-cans in which chemicals came to Dad’s shop.
    Aunt Nandarani, being from a priest's family, followed the Hindu almanack which directed as to which fruit or vegetable should not be eaten on a particular day. Such items were listed on a piece of paper and pasted on the wall of the kitchen. This rule was also discontinued when we shifted to Dariapur house. Nandarani used to hum songs of Lalon Sai about whom I came to know much later. Nandarani knew the songs but did not know who Lalon sai  was a prominent Bengali philosopher, author, Baul saint, mystic, songwriter, social reformer and thinker in British India.Regarded as an icon of Bengali culture, he inspired and influenced many poets, social and religious thinkers including Rabindranath Tagore, Kazi Nazrul Islam, and Allen Ginsberg although he  rejected all distinctions of caste and creed. He resorted to the human body to discern the genesis and root of the creative principle. In his universal practice and at the root of the meaning behind his songs, the human body and respect for human birth are given the foremost acknowledgment. In this he transcended the doctrines of all religions. Samir came to know first about Lalon and said he was a baul. Bauls constitute both a syncretic religious sect and a musical tradition. Bauls are a very heterogeneous group, with many sects, but their membership mainly consists of Vaishnava Hindus and Sufi Muslims. They can often be identified by their distinctive clothes and musical instruments. Lalon Shah is regarded as the most celebrated Baul saint in history. Nandarani might have picked up the songs from the bauls and fakirs visiting her priest father and brother as her paternal house had a big temple compound which served as night shelter for visiting religious men and women.

    The Imlitala public tap was just in front of the small square of our house. When ladies came to fetch water in buckets or wash their clothes, they used to keep their children with my friend Kapil’s grandfather. The old man used to teach obscene abuses to the children who did not know the meaning of the words. Sometimes a kid used to ask the old man whether he should abuse the lady or the man at the tap. Nobody seemed to bother being abused by kids and laughed away. In our house, however, we were forbidden to sit near the window and listen to those obscene abuses, though I learned all the abuses from the old man’s school. The Imlitala of my childhood was frozen in time and I loved it.
    There were no restrictions for us children of the area to enter any house during playing hide and seek or any other game. A boy could even hide below a cot on which someone was having an evening nap. We could enter the house of the Muslim families and the adjacent mosque. We could hide behind prayer mats kept inside the mosque – this is unthinkable these days. I visited a particular Muslim family to purchase duck eggs as our family was prohibited from eating chicken eggs. There were no restrictions either from our family elders. Ladies of those families came to our house to gossip with Ma and aunts. Their language was rustic and only when we grew up we came to know that several expressions that Ma and aunts picked up from them were considered obscene by the educated and cultured wing of the society, both Hindi speaking and Bengali.
    During such visits a Muslim teenage girl took fascination in me and I had my first exciting experience of my skin touching female skin. This was happening even though India had been partitioned in 1947 and relations between Hindus and Muslims had turned sour. Strangely, Ilmitala slum was not affected. Her name was Kulsum and I called her Kulsum Apa as she was four years older than me. She had big black eyes and eyelashes looked so artificial that just a stare at them created hallucination. Her skin was glazing black reminding that she was carrying the history of an African slave girl sold to a king by Portugese slave merchants. She had dimpled cheeks. She took me to a dark dingy damp room full of hens, ducks, goats and sheeps, told me to close my eyes, and started reciting a poem of Faiz Ahmed Faiz, while her lips travelled all over me. She took my right hand and I wondered if the female organ was so soft and grew fine hairs like mine. Another day, when a nanny goat was giving birth to kid goats, she told me that human babies are born in the same way and showed me a hairy vagina again.
     I could not check my strong urge to put my lips on it. I had to reduce my frequency of visits as one of the cousin sisters, Dolly, uncle Sushil’s daughter, asked me why Kulsum was in search of me. Arun seemed to be aware and advised me not to get into any trap. Arun used to be annoyed with Kulsum Apa’s younger brother Nazim. Once Arun secretly lifted the ewer of Imam of the mosque and kept it in Kulsum Apa’s house for which Nazim was beaten up by his father. The ewer was used by Muslim men for washing their penis after urination. The practice has probably been discontinued because of fast city life. But in Ram Mohan Roy Seminary I had observed Muslim class mates carrying a piece of blotting paper during urination. Same I had found when I joined a job in Reserve Bank of India where Muslim workers used to carry either blotting paper or a piece of absorbable stone to the toilet. Some used to keep their own piece of stone in a corner of the toilet. A Senior colleague Abdul Quyauum told me that The Islamic faith has specific rules regarding urination. One of these rules is called Istinjaa` which means washing the private parts after urinating. It’s an obligatory practice of purification mentioned in the Quran, and its procedures vary for people with a vulva and people with a penis. According to the rule, cleaning can be done with toilet paper, stone, or water. If you have a penis, you’re to wash from back to the front. But if you have a vulva, you’re to wash from front to back. This is so that the genitals aren’t in contact with the bacteria from the anus. In addition, the rule states that if you have a penis, you’re not allowed to clean yourself with your right hand. The preferred practice for both genitals is to clean the area with toilet paper and then wash with water. You can use soap to clean the area if you’d like, but it’s not a requirement. After following Istinjaa`, you’re to cover yourself immediately.
     
    The lane on the left side of our house was a blind one at the end of which there was a semicircle compound in the middle of which there was a five feet deep ditch surrounded by huts and cannabis shrubs which grew all through the year. The ditch was used for slaughtering pigs for celebrating a successful banditry by the residents. Whenever I saw that a pig was being brought, legs tied to a bamboo pole, carried on the shoulders of two men, I could make out that they had a good booty some days back. In the evening when we used to study in kerosine lantern light, we used to hear the frightening shriek of the pig put in the pit and being killed by hot iron rods pierced in its body. Nevertheless, the next day Samir, Arun and myself would visit them for our share of cooked pig meat to be taken with palm-toddy or rice liquor. A couple of inhabitants in that compound also ate roasted greater bandicoot rats and we three brothers tasted the flesh which did not seem different in taste from other flesh except for the smell. My initiation to toddy, country liquor, cannabis, pig and rat meat was through these men who loved us all three brothers, though they had a special bonding with Arun. 
    There were two dogs in that lane which were considered Hindu dogs. Similarly there were two dogs near Kulsum Apa’s house which were considered Muslim dogs. Dogs of one side did not venture into that of the other. When a pig was killed and cooked the dogs knew they are going to have their share. The dogs also knew how to bark when a police party arrived in search of suspected criminals. Such barks were an indication to the criminals who would get upon the roof of thatched huts and walk over them in light foot and disappear into the mango orchard behind the blind lane. We went to our terrace to watch their creepy disappearance. Having seen white pigs in the adjacent ground of catholic school I told these men about such animals which they did not believe and thought I was making a fool of them.
    Urchins of the area would annoy the muslim area dogs by singing the slogan, ‘Puri kachauri tel mein, Jinnah beta jail mein’. Similarly muslim urchins would raise the same slogan in Gandhi’s name when they saw the dogs of the Hindu area. But there was never any fight between the communities. When I visited Imlitala after several decades, all the four dogs had died and their progeny could not recognise me. The mosque was well painted with green oil colour and two high minar had been raised atop which loudspeakers were tied for calling the faithful, During my childhood a fakir would roam through the lanes and recite something in arabic to call the faithfull ; he had a strange stick and smoke burning out of his dry pumpkin shell censer. Though there was a Shia mosque, Imlitala did not have a Hindu temple and none of the residents bothered about it.

    In that lane there was a milkman family with a few cows and goats who sold milk and cow dung for living. The family had a male member who was considered mad and was kept chained where the goats and cows were tethered. He used to drink milk directly from udders with his mouth and copulated with the animals. Members of his family knew about his activities but did not bother as they felt his mind and body was satisfied and that is what they wanted. All the residents of Imlitala knew about it and felt nothing wrong with it, though the children called him ‘Bakaria goala’.
    There was also in that lane an widow nicknamed Billi because of her eyes who had two male goats, that is bucks or billies, one white with long neck and another black and sturdy. Both of them were always in a fighting mood with each other for which the lady chained them separately, one inside her hut and another outside tethered in metal chains. People who wanted to get their nannies or doe mated knew of their goats' estrous cycle,the beginning of one estrus (heat) to the beginning of the next estrus . To bring the female goat to heat, the lady would rub a cloth on one of the bucks and let the nanny goat smell it. She charged double for the white one and argued that when one searches for a fair complexioned groom he pays more dowries than a dark skin groom. Moreover, the breed of the white one was more in demand during Muslim festival of Bakrid for their better quality of meat. During Bakrid we used to get a front leg of the slaughtered goat from Kulsum Apa’s house. Uncle Promod would invariably check the hoof to be sure that it was that of a goat.
    On one night Arun unchained both of the billies quite silently and allowed them to fight each other. The sound was such that several people got up with a kerosene lamp in their hands to find out as to what was happening. Arun had come back and peeped through the window to enjoy the ruckus. He whispered to us and all brothers and sisters gathered in the room without light to peep through. The widow came out hearing the sound of billies fighting each other during the night. Along with her came out a fair complexioned person, the widow’s paramour, whom we recognized as the sweetmeat seller on the main road. Arun, who did not sleep during the night , had known about their love affair. The fellow had to marry the widow. We joined in the marriage for goat meat, sweets and toddy.
    An old lady in that lane used to fry chickpeas on hot sands and grinded them in her grindstone for sale to rickshaw pullers and labourers who mixed it with water and green chillies cut in pieces and made small balls to gulp them with water. Some of them drank it like sharbat after adding a few drops of lemon in it. When she did not have saved money she would tell me to provide her with wood from the packing boxes in which Dad received items from her shop. I would take two big planks of wood everyday and tie them like a cross just as I had seen at the Catholic school and carry it on my shoulder and move around Imlitala lanes for some time ending my journey at the old lady’s home to hand over the cross to her. All the urchins of the locality would follow me and shout Hip Hip Hurray, in the same fashion the football team of the locality shouted when they won against a team of another locality. For children of the locality once in a while she prepared a Bihari food item called ‘Litti’. It is a dough ball made up of whole wheat flour and stuffed with gram flour, pulses and mixed with herbs and spices and then roasted over coal or wood then it is tossed with much ghee. It may be eaten with yoghurt, baingan chokha, aloo chokha, and papad.] The litti are traditionally baked over wood fire. Herbs and spices used to flavour the litti include onion, garlic, ginger, coriander leaves, lime juice, carom seeds, nigella seeds and salt. Tasty pickles can also be used to add spice flavour.
    She used grindstones for making the powder. We three brothers gave her a helping hand in grinding as we were conversant with it, our wheat flour was made by grinding wheat on grindstones. Until then the machines had not arrived. Might have arrived in other areas with electricity. There was no cold storage facility and we purchased potatoes of which the rotten portion had been cut and removed. Cauliflower was dried during winter so that it may be cooked in summer.

    On the right side lane there was an old man named Hulas Babu,who was considered to be a soothsayer, expert in Tusidasa’s Ramcharitmanas. He had a pen made of lead. Whenever someone had a problem he or she would visit him. The person was advised to close his eyes, open a page of Ramcharitmanas and point the lead pen to any stanza on the page. Hulasbabu would explain the meaning of the stanza and forecast what is going to happen to the person, good or bad. Hulasbabu did not talk of remedies to get out of the problem. 
    Two festivals, one by Hindus and another by Muslims were observed in which we did not participate but we got eatables from those festivals. Hindu families observed the ‘Chhath’ festival. Prayers during Chhath puja are dedicated to the solar deity, Surya, to show gratitude and thankfulness for bestowing the bounties of life on earth and to request the granting of certain wishes.Chhathi Maiya, the mother goddess and Sun's sister, is worshipped as the Goddess of the festival. It is celebrated six days after Diwali, on the sixth day of the lunar month of Karthika (October–November) in the Hindu calendar Vikram Samvat. The rituals are observed over four days.They include holy bathing, fasting and abstaining from drinking water (vrata), standing in water, and offering prasad (prayer offerings) and arghya to the setting and rising sun.  Some devotees also perform a prostration march as they head for the Ganges river. For the people from Bihar and other nearby areas, Chhath Puja is considered as Mahaparva. On the third day of Chhath puja, an arghya is offered to the Sun God during the Kartik Shukla Shashthi. In the evening, a bamboo basket is decorated with fruits, thekua and rice laddus. We got various types of thekua and laddus from almost all families.
    Muslim families observed Bakrid or Eid al-Adha or 'Feast of the Sacrifice.  It honours the willingness of Ibrahim or Abraham  to sacrifice his son Ismail (Ishmael) as an act of obedience to God's command. Before Ibrahim would sacrifice his son, however, God provided him with a lamb which he was supposed to sacrifice in his son's place. In commemoration of this intervention, animals are ritually sacrificed. One third of their meat is consumed by the family which offers the sacrifice, while the rest of the meat is distributed to the poor and the needy. Sweets and gifts are also distributed. Our family got a goat’s leg from Kulsum Apa’s family ; none of the families slaughtered lamb or sheep because they were costly. All members of the families wore new dresses and boys and gents wore caps and gathered for Namaz. Children of the area got Eidy or a piece of copper coin from Kulsum Apa’s father. When I was in Lucknow, descendants of a Nawab family used to invite us to their community lunch ; on a huge silver plate Biriani used to be spread and one could take as many morsels from it. On that day men embraced each other just like we Bengalis did at the end of Durga Puja.

    I was born during a lagoon coloured autumn at Patna in the Prince of Wales Hospital, now called Patna Medical College and Hospital, five or maybe five and half years after the earthquake that demolished the hutment Dad with five brothers and a sister lived in. I was called Fauna at home though formally named Malay because the Hindu Zodiac indicated the letter ‘M’ on the day of my first rice ritual. The ward in which I was born has been demolished and the hospital has been renamed after India’s independence, giving me no chance to check the exact date on which I was born from the records of the Hospital.
    Dad consulted the Hindu almanack, deciding on an auspicious date at the time of my admission to junior kindergarten at Saint Joseph's convent, in order to convince the Irish doe-eyed nun of the fact of my birth on October 29, 1939. We were a very poor family to afford payment of fees for studying at a convent school. It was just by chance that I was playing at my father’s photo shop at the age of three when Father Hillman, a German priest and an ameteur photographer, had come to the shop and wondered why I had not been admitted to a good school. When Dad spoke of his financial condition, Father Hillman arranged for my admission and allowed remission of fees. Ma contested this birthdate till she died of an enlarged heart in 1982, as she thought I was born on a Friday on the eleventh day of the month of Kartika with metal forceps nurses used to pull me out of her body, for my legs had come out first. Elder brother Samir studied at a vernacular school and was packed off to our maternal uncles’ house for studying at City College, Kolkata. Dad feared that Samir may be spoiled for his association with the teenagers of Imlitala.
    A devout Brahmin, revelling in his puritanic logic, Dad insisted, A Hindu Aryan was born of his sacred thread ceremony and that we were descendants of Bidyadhar Roychoudhury, the great zemindar who was forced by the Mughal king’s agent in Bengal to hand over the villages Kolikata,  Gobindapur and Sutanuti to Job Charnok of East India Company for a meagre sum, which became joie de vivre called Calcutta, now Kolkata. Bidyadhar  was great grandchild of Lakshmikanto, who was awarded the Roychoudhury title and the villages along Sundarbans by Mughal emperor Jehangir. 
    Lakshmikanto,  was originally from Jessore, now in Bangladesh, as a minister of King Pratapaditya. Pratapaditya was a Mughal vassal of Jessore and one of the most powerful zamindars of lower Bengal, before being crushed by the Mughal Empire. He was eulogised, in an ahistorical manner, by 20th century Bengali nationalists as a Hindu liberator from foreign (Islamic) rule. Tradition asserts that Pratapaditya had his uncle Basanta Ray murdered around 1598 - 1600, with support from the Portuguese, and declared his independence. In return, he  allowed the Christian Missionaries to settle in his territories — the first Church in Bengal would be opened at Chandecan in about 1600.  Lakshmikanto had left king Pratapaditya when the king conspired and killed his own uncle Basanta Ray. The Mughals came into conflict with Pratapaditya for various reasons and the king of Jessore was defeated, chained and died while being taken to Delhi. Lakshmikanto had settled at Barisha-Behala at the end of the then Calcutta. As his family became quite big with brothers and their children, one of the descendants, Ratneshwar, shifted to western side of Hooghly river in 1709 and established a new town named Uttarpara.  The house on Choudhury Para Street was built by Ratneshwar  based on Turkish architectural design and called ‘Sabarna Villa’. The villa was dismantled in 1990 and housing colonies constructed in its place.
     My grandmother, Apurbamoyee, who died at the age of ninety four at Savarna Villa, used to say that we became poor because the Roychoudhurys mated with several wives and bred like pigeons. 
     Laksminarayan, youngest of three children of Jadunath, was the first professional Indian photographer-painter born in 1866. Lakshminarayan had two elder brothers, Harinarayan and Baikunthanath.  The descendants of Ranteshwar Roychoudhury had crossed hundreds through his three wives and wives of his sons by the 1800s which forced members to branch out and seek their own livelihood. The main source of income of Sabarna Choudhury zamindars had been revenue from vast tract of land and gold corpus given to them by Emperors Akbar and Jahangir.The Roychoudhury title was bestowed on the family by Mughal Emperors. The family’s surname was, in fact, Gangopadhyay or Ganguly till the doyen of the clan Lakshmikanta Gangopadhyay ( 1570-1649) received the title. They were Brahmins.
    Consequent on acquisition of Calcutta and villages around it by the East India Company in 1698, the clan had started disintegrating. They had also sided with Nabob Sirajuddaula during the battle of Plassey resulting in disfavour from the British when they became rulers. Lakshminarayan had the knack of drawing sketches from childhood. After his marriage to thirteen year old Apurvamoyee Mukherjee of Central Calcutta, when he was in search of a source of income other than doles from his father, he came across 19th Century gentries known to his father in law, and was thus introduced to the evolving culture of writing and painting of his time. He learned the rudiments of formal drawing from the circle of intellectuals of the Brahmo Samaj ; however, his conservative Hindu father Jadunath and mother Matangini were against his friendship with the members of the Brahmo Samaj. During this period of indecision he could impress a representative of the Emir of Bahawalpur with his art who invited him to paint portraits of members of the Emir’s family. The representative had gone to Calcutta in connection with some business. Being a member of the Sabarna Choudhury clan, Lakshminarayan knew pre-British state language Persian as well as Arabic which proved helpful for him in getting his first job.
    Bahawalpur was far away from Calcutta. Lakshminarayan preferred to get out of the family restrictions imposed by his father, and reached Bahawalpur with his wife after about six months. The Emir was quite impressed with his art work and assigned paintings of his family members to young Lakshminarayan. It is said that a few of the drawings made by Lakshminarayan later found their way to the postage stamps of the state. His popularity in Bahawalpur got him invitations from Chitral, Hunja, Fulra and Makran kingdoms — places now in Pakistan. He also visited Kabul on receipt of invitation from the members of the King’s court. Having saved sufficient money he moved to Lahore to settle at the place as his wife was pregnant with their first child.
    In Lahore Lakshminarayan met John Lockwood Kipling, father of famous colonial writer Rudyard Kipling, in search of a job so that he may have a fixed source of income and at the same time improve his skill. In 1875 John Lockwood Kipling was appointed Principal of Mayo College of Arts, Lahore ( present day National College of Arts, Pakistan ). John Lockwood Kipling also became curator of Lahore Museum. Lakshminarayan came to know about photography from Kipling. By this time photography had progressed in Europe and Daguerreotype cameras had been replaced by bellow-lens cameras ; the processing of photographs had undergone revolutionary changes. In Daguerreotype photography, invented in 1830, an image could be made only once by immersing it in salt water. In 1841 Fox Talbot had invented the Calotype process ; in it a negative was made from which unlimited copies could be made. However, these were on paper.
    In 1848 Frederic Scott Archer had invented the wet Collodion process image. This process produced a negative image on a transparent photographic medium ; the photographer could make multiple prints from just one negative. This process required a darkroom for processing. Lakshminarayan got the opportunity to learn photography from John Lockwood Kipling and purchased a bellow-lens camera. In 1880 he  established a photographic company styled as Roychowdry & Co with a darkroom at his residence. The Collodion process had been replaced by gelatin dry plates — glass plates with a photographic emulsion of silver halides suspended in gelatin.
    With the new invention, painting portraits of regal women became easier for Lakshminarayan. Earlier it was quite difficult for him to convince conservative  family heads of Maharaja, Raja, Raje, Deshmukh, Nabob, Baig, Khan, Mirza or Emirs to allow their female members to be seated for quite sometime in front of him in order to draw their sketches to be converted into paintings. Now he could just take a photograph and draw a painting based thereon. The feudal kings were also fascinated with photographs.
    Lakshminarayan started receiving offers from other Indian kingdoms. Thus his journey as a mobile photography company began. He had three sons by now. Pramod, Sushil and Ranjit. It is said that my grandmother was so fascinated with stories about Maharaja Ranjit Singh that she named their third son Ranjit. Whenever Lakshminarayan received calls from faraway Kings or Emirs he took his entire family along with him. As a result the children could not have regular education and had to be taught by a teacher of the court deputed by the Kings or Emirs. They, nevertheless, learned the skills of the trade from their father which became quite helpful for them later in life.
    Promod had grown up and helped his father  in carrying the bellow-lens camera in a wooden box whenever Lakshminarayan was invited for family photographs of clients. Sushil carried the camera tripod on which the field camera used to be placed and Ranjit carried the black hood which was required at the time of focusing the lens before a photo was shot. If there was lack of sufficient light all the three boys held burning magnesium wires during the photo shoot.
    Grandfather had three more sons, Anil, Sunil and Bishwanath. He decided to station his family at Uttarpara when he received a call from his father Jadunath who wanted to divide his property among his three sons. Apurvamayee was pregnant and gave birth to a daughter who was named Kamala. The three younger sons and the daughter remained at Uttarpara with Apurvamayee whereas Lakshminarayan moved from one feudal kingdom to another with Pramod, Sushil and Ranjit. Among his sons he loved Ranjit the most as Ranjit perfected not only photo shooting but also in darkroom work and making collodion emulsion for photo processing. The emulsion was a mixture of silver bromide, pyrogallic acid, potassium bromide and ammonium carbonate in prescribed proportions.
    Lakshminarayan got his two sons Pramod and Sushil married during this time to Nanadarani and Karuna. Since Apurvamayee stayed at Uttarpara, ladies were required for kitchen etc work when Lakshminarayan and the three sons moved from place to place. Later, when Kishorimohan Bandyopadhyay approached him for preparing slides for magic lantern to be used for Bandyopadhyay’s anti-malaria campaigns in Bengal villages, Lakshminarayan got his son Ranjit married to Kishorimohan Bandyopadhyay’s daughter Amita. Kishorimohan Bandyopadhyay was research assistant of Ronald Ross. Ross was awarded the Nobel Prize while Kishorimohan Bandyopadhyay was awarded with a gold medal by King Edward VII.
    On an invitation from the Maharaja of Darbhanga to the Maharaja’s Patna palace ( now a Patna University Building ) Lakshminarayan went to Patna and called Apurvamayee along with the other children since Patna was quite close to Uttarpara. Unfortunately Lakshminarayan had a heart attack and died at Patna in 1933.
    Death of Lakshminarayan created a great financial burden on his children as they were not personally known to their father’s feudal clients. Lakshminarayan handled this aspect himself. Apurvamayee pursued with his cousin brother Troilokyanath Mukhopadhyay, who was a reputed author as well as Assistant Curator of Calcutta Museum. On Troilokyanath’s recommendation Pramod got the job of ‘Keeper of Paintings and Sculpture’ at the Patna Museum. However, his salary was not sufficient for the family. The brothers decided to open a photographic shop at Patna and Chhapra in Bihar and one at Uttarpara itself. Sushil was sent to Chhapra, Anil to Uttarpara and Ranjit took the responsibility to run the main shop at Patna. Anil was married to Amiya of Calcutta so that he may take interest in the business and run the shop and earn profit.
    Both Sushil and Anil failed in their ventures,  and went back to Patna with their family. Apurvamayee decided to stay alone at the Sabarna Villa which had started crumbling due to neglect. The business venture henceforth remained centred at Patna with a photographic shop in front of the Bihar National College on Ashok Rajpath, which later shifted to Dariapur in front of Patna Collegiate school on Bari Road. Since there was no competition and Roychowdry & Co held agencies of photographic material and equipment companies it became famous in a very short time. It also became popular among the young freedom fighters of the Indian National Congress. Sushil and Anil were given the work of converting photos into paintings.
    The company shifted to Dariapur in 1954. It started receiving even 50 year old photographs from various clients to be retouched and remade. In many cases such old photographs had only the face intact ; either Nandarani, who was plump, or Amita, who was thin, posed as models so that the face of the lady was placed on their torso. Sushil and Anil were experts in reconstructing such photographs. At that time there were neither mobile phones, computers or photoshopping techniques. Dad wished to stay at Uttarpara when young but lived instead 550 kilometres away at Patna, the seat of the Buddhist Emperor Ashoka during 264-223 B.C.E.
    After the death of Ranjit in 1991 the business venture has undergone sea change in view of digitization of photography. It is now run by Ranjit’s grandson Hridayesh, elder son of Samir, who has received special training in digital photography. He has widened the scope of the business venture to suit the fast paced world of modern-day photography.
    Two
    Despite Grandpa’s adventurous life, Dad cocooned in an orthodox seed : a vegetarian, devoted to a 333 million pantheon, fasting on the eleventh day of lunar fortnight, mantras at lunch and dinner, a change of sacred thread once a month, no eating cereals cooked by untouchable castes, a daily mustard-oil bath in cold water. 
    Both Dad and Ma were not interested in going to the temple for worship or pilgrimage; I think Dad freed himself for the pressure of work. After elder brother Samir evicted Dad from the shop to install his elder son, Dad took refuge in Hinduism and the gods and goddesses. I have never seen my parents go on pilgrimage. Neither the elder cousins ​​nor the uncles were interested; If they wanted to go out of Patna, they would go only to the country house, i.e. Uttarpara. However, Dad used to change his sacred thread regularly and eat fried pancakes on the eleventh day of the moon. Kali of Kalighat being our family deity, she was installed by one of our ancestors, so there was no need to take care of another family deity at home like other conservative families. Uncle Pramod and younger uncle Biswanath used to wear sacred thread hanging around their necks like a garland, although they did not obey any prohibition of eating, uncle Sushil sometimes wore the thread and sometimes kept it in the niche of his room. My elder brother and I had our thread  when we were young, but we came on our own before the end of the year. Dad never seemed to have been offended by our lack of interest in family customs or rituals; He never ever spoke in this regard.
    Grandma lived alone in Uttarpara, a auburn twenty kilometres away from Kolkata, across the Hooghly river, in the ancestral edifice, in ruins inhabited by hundreds of wild pigeons and bats, with incorrigibles weeds shooting out of a miasma of tentacles from the salty wind-eroded, moss eaten greenish clay bricks. Here she roamed with a torn napkin around her skinny waist, dried teats dangling on her topless bust. Her companions were single-room tenants using the same dingy dark toilet built probably hundred years earlier, and a couple of black cows she milked with her own hands for a living till her death at ninety four years of age. There were guava and strapple trees within the compound and near the gate, creeper reaching roof directed with the help of ropes unable to bear gourds-- ash gourds, bottle gourds -- festooned precariously overhead. In the courtyard, there was a remnant of a wood-stalk for slaughtering goats and buffaloes : The age-old tradition was  prevalent during Ratneshwar’s time,  to please Goddess Kali. Kali Puja took place during Diwali, which is celebrated every year on Amavasya night in the months of October or November.
    In the unused upper floor rooms there were very old swords, spears and other such items which were used by bodyguards of Ratneshwar, as well as various Persian, Arabic and Sanskrit books, which unfortunately, we did not take interest at that time and were disposed of by Biswanath. Biswanath also disposed of palm-leaf Bengali and Sanskrit manuscripts, Mughal coins and huge brass utensils of Ratneshwar when he moved childless to Uttarpara from Patna. He also persuaded Grandma to legally hand him over the lands owned by the family in Uttarpara and around. On one of the lands he built a brick house in which he constructed small staircases in one of the rooms to reach a tiny sculpture of goddess Kali made of stone. He issued leaflets about the appearance of goddess Kali in his land while building the house in order to collect money for running his daily expenses, which was not much as he was childless. He collected vegetables and cereals from the market in the name of goddess Kali. As the couple grew older they adopted the daughter of his elder brother in law and got her married so that a young man is available at hand to help them. On the advice of Biswanath’s adopted daughter, he got an apartment building constructed on the land, selling off a few flats and shops on ground floor, consigning goddess Kali in Ganges river and installing idols of Radha-Krishna made of silver in one of the rooms. When climbing became difficult for them they sold off their flat and shifted to a ground floor flat at Uttarpara, where uncle Biswanath and aunt Kuchi died. 
    Aunt Kuchi’s family was tenants at Uttarpara house, Her and Biswanath’s affair was teenage love but Granny was not in favour of their marriage because the district and village of Bengal to which they belonged were not known to Granny. Kuchi’s father Foni Ganguly was a famous actor in a mobile theatre company which visited various places for performances. Foni Ganguly’s wife as well as Granny thought that the company had female actors with whom he might be in relationship as he was good looking and had a bass voice. They also belonged to the same gotra as ours and marriages were considered taboo. In Hindu culture, the term gotra is considered to be equivalent to lineage. It broadly refers to people who are descendants in an unbroken male line from a common male ancestor or patriline. Generally the gotra forms an exogamous unit, with the marriage within the same gotra being prohibited by custom, being regarded as incest. Uncle Biswanath was adamant and told Granny that if she disagreed then he would elope with her. Granny had to give in. But after their marriage Granny gave the family one day’s notice to vacate her premises. Kuchi-Khemi's mother's name was Bibasna, which meant a lady without clothes. I do not know how her parents gave her such a  sophisticated name, of a woman who  has no clothes on her body? I do not know if Bibasana was a Hindu goddess of any myth.
    Aunt Kuchi had a sister named Khemi who visited Imlitala during her summer holidays. In summer we used to sleep on the open roof beneath the stars with a bedsheet for cover for several of us. One day Khemi and I found each other side by side and started silently kissing. The two of us got hot, the sum of that heat was three times more than the heat of both our bodies. The stars  dazzling in the sky watched our fleshy games, the zodiac watched us, the moon watched us. After leaving Imlitala, such a clear sky was nowhere to be found; Khemi took that sky with her and passed through the smoky diesel factory chimney breathing sky. Whispering, Khemi means Mili: Do you understand that? It's raining, it's raining, it's raining, it's raining, it's raining; Nothing happening to you? You mean, like, saltines and their ilk, eh? Anything in mind? Or chest? I tied the rag to keep my hand moving. In excitement I said, oh, you have tied yours. Why don't you give me that hand?  She allowed my hand to travel on her breasts which were developing as buttons. She caught my dick and I ejaculated. She seemed to know what was going to happen and had kept a handkerchief ready. When I touched her part I found it was tied with cloth. She whispered that she was in period and it was her bleeding time. As long as she stayed at Imlitala we slept side by side and silently kissed and embraced each other. WeI started licking each other's lips. The first day happened by itself. Her style of speaking and the recklessness I have used in my detective novel’s teenage character Mili. I have immortalised her dialogue in the novel :
    Khemi or Mili: You idiot, blood oozes during this period, I will open it tomorrow, then you may touch as many times as you want. Khemi or Mili  loosens her cloth to allow my hand to touch it. I found it sticky. Khemi or Milli wiped my hand on her frock and said, “I see! you couldn't wait for tomorrow. But you really are a bull. I had  once seen in market place,  a big sturdy bull doing that. Very pink. Why? You are fair. The next day, Mili or Khemi said with the middle finger of my left hand, put it here, just keep it, don't move it, but if you move it, I will sleep in another place from tomorrow. I moved my finger and said, what happens when I move the finger? Mili or Khemi put her hand on my button-open pants and began to swell and say, this is, this is, this is, this is, this is, this is mine, this is mine. - Let's see tomorrow during the day. - What will you do again? Want to see hair? Khemi showed up on the terrace, at noon, when everyone was  relaxing after lunch. It was better to see, than to touch.  Feel the tingling near the veins. 
    Before Khemi, at Imlitala ,  a similar affair had taken place with Kulsum Apa. I had the experience that I knew that overdoing it could lead to what happened to me, scattering and suffering. In 1949,  where else could she  find a silent fascinated listener like me, who is addicted to watching her black deep looking round thick lips and cheeks. When the listener is fascinated by the smell of the meat being cooked in her house, when the boy wanted to eat such meat, not cooked in his own house, Kulsum Apa brought a bowl and the boy ate it. She told me never to tell anyone that I ate beef. she wiped my lips with her tongue. I always blackmailed her whenever  meat was cooked, before we started the love game.
    Khemi never came back as she died of pox after going back to Uttarpara. Her eldest brother who had turned rogue like our brother Arun was found murdered in Calcutta port area. Uncle Biswanath had left behind a big metal trunk at Patna. Several years later, when I was in college, cousin brother Ajay, eldest son of Kamala, Dad’s only sister, had come for a visit to Dariapur and encouraged us to open the trunk and find out whether the coins were there. We opened the lock with a hammer and found out, instead of costly things, the box contained many naked photographs of uncle Biswanath’s wife Kuchi, in various poses that we find in paintings of old masters. Biswanath and Kuchi used to sleep in the studio hall of Dariapur house and those photographs were certainly shot during night and prints taken in the darkroom which was adjacent to the studio. The photos were verymuch sex appealing but we decided to destroy them, Ajoy keeping one with him as memento. I never thought aunt Kuchi had such a perfect body and smooth skin. At Imlitala house she never participated in kitchen work or washing utensils. She was always found lying on her cot in Biswanath’s room and whiling away her time. Probably being childless caused depression in her. Instead of taking her to a psychologist, I do not know whether there were any at Patna at that time, she was taken for treatment to our family MBBS doctor Akshay Gupta. 
    After Granny’s death in December 1964, Uttarpara’s Savarna Villa looked deserted except for strange tenants who did not know to whom to pay the rent. It is at this time that Biswanath arrived and occupied eastern portion. After a few years, Sunil, another uncle, arrived to occupy the western portion. Since the building had four staircases intact, the brothers, who were at loggerheads, had separate entries and exits. Seven years after Granny’s death, when the roof of the biggest ground floor room crashed and it became haunted, as cousin Puti, Uncle Sunil’s eldest daughter, uprooted the noose of a heifer and hung herself from the exposed wooden beam of the ceiling to be discovered in the night chill by a tenant who took her to be a flying ghost. Puti was in love with a Marxist revolutionary, dubbed by the government as ‘Naxalite’ who was killed in a staged ‘encounter’. Sunil had three sons and four daughters. Sunil’s eldest son Nilkumar eloped with a girl of lower caste and left Uttarpara for Hyderabad. Sunil was the only uncle who had attended primary classes in school at Patna which drew a railway officer to select him as his son in law and appoint as an employee at railway catering, the job which he liked and got posted at several cities in India. 
    After Dad and his brothers shifted to Imlitala house, ours was the only brick dwelling in the entire slum, the house having been constructed in instalments, each brother and his family got a small room with a common bath  and toilet. Water had to be fetched in buckets by male members including Samir and myself from a roadside tap. Dad got a ten-foot-by-ten-foot room facing west  on the first floor, a cot beneath which our belongings were kept, a wooden packing box used as our bookshelf cum table, and a wall to wall wire for hanging our clothes. The packing box was one in which photographic items came from various suppliers and we got them changed quite frequently, mainly because wood pieces were used for firing coal ovens when dung cakes were not available or there was shortage of coal. Coals were purchased in big chunks which had to be broken in small pieces by Samir and myself.
    The eclectic ideal of the Imlitala family was such that several people came from Uttarpara or other places in Bengal, who were our distant relatives, and stayed for some time with us. Some came to help Dad in his shop, others came when they fought with family members or on their way to pilgrim places. I remember an old person who was addicted to opium. Another named Nitai who had come to help Dad and ate two raw eggs everyday in the morning, who left after a few months and he failed to adjust in Hindi speaking society. Biswanath’s brother in law came to learn photography but stayed for a longer time as by then the Dariapur house was being constructed and he took refuge in it. I was also sent to Dariapur house under construction as it had running water and electricity. Granny’s brother, who lived in Benaras and was reported to lead a life of a sanyasi, used to come to Dad for financial help ; once he came in frail health with a lady and her son and requested Dad to take care of them. He died after a few days and we came to know that the lady was a widow and Granny’s brother had developed a relationship with her. The lady and her son stayed in Imlitala house till the boy became school going and the lady got a job in that school. 
    Dad’s sister Kamala’s eldest son Ajay whom we called Sentuda, used to come quite often ; everytime trying his hand in a business. I remember once he came with a large number of hand held mirrors for sale in the local market. All of them were defective, having bubbles on them. He pasted labels of ‘Belgian Glass’ on those bubbles to hide the defect. Another time he came with broken biscuits. He tried his hand in all sorts of business but failed to succeed. He was ageing and wanted to get married with a girl whose father would allow him to stay with them. Ajay loved his country liquor drinks and evening visits to prostitutes just like his own father Tinkori Halder. When Samir was posted as District Fisheries Officer at Madhubani, he requested Samir to find such a bride for him. Samir, through his office workers, could succeed in locating an uneducated dark complexion girl. The father of the girl, his only child,  was a wholesaler of clarified butter, searching for such a groom for his daughter. A bald headed friend of Samir had to act as Ajay’s father for negotiations of marriage. The marriage went well except that the make-shift father of Ajay was drunk on that night and started talking in his native Bengali of Dhaka, whereas Ajay was from Calcutta. Ajay stayed in his father in law’s house for entire life.
    Ajay’s Kolkata house at Ahiritola  was in more dilapidated condition than our Uttarpara house and there were dozens of members of the clan who lived in one or two rooms. Ajay’s father Tinkori Halder had one room on the ground floor and on top of it a room where all members of the family used to live. The children slept on the floor and Tinkori with wife Kamala on the bed. Since the room was small, some of the children slept below the cot. There were several brothers and sisters : brothers were Ajay, Bioy, Sanjay, Dhanajay, Babli, Tabli and the sisters were Gita and Khuku. Except for Sanjay, none of the brothers went to college. Tinkori Haldar had a fixed routine for his evenings. He would go to a country liquor den, have a few drinks, visit the prostitute he loved and come home with puja flowers shouting Oh Mother, Oh Mother, Oh Mother right upto home. When his house was being sold, including his portion, he committed suicide on a semmer night by jumping from the terrace where all the children used to sleep. Rest of the family shifted to a thatched house in the suburb called Konnogar which granny had gifted to her daughter. Before shifting they got both the daughters married. Gita, the elder daughter, was not happy with her husband as the man was dark and unsmart. One day Gita just eloped with the nephew of her husband, an act which was approved by all in a family meeting of both parties.
    Aunt Kamala’s dwelling being the only place to stay during our visits to Kolkata, the floor of the room meant for guests was also where we sat and ate steamed rice, pigeon pea pulse,and shrimp fried in mustard oil served in brass plates. The toilet was slippery, without doors, and I used to keep coughing to notify my presence to any intruder. The brothers roamed on Ahiritola roads even in their sisters’ clothes. Uncle Tinkori Halder was a famous swimmer in his youth and several of his photographs were hung at the office of a local swimming pond. The cups and shield won by him were sold one by one by his sons to free the room from extra items in order to make room for keeping clothes and other family items.
    On the land gifted by granny the brothers constructed  a house, mainly funded by Sanjay who was educated and had a job. All the brothers had a very small room and a smaller room to cook. Ajay never returned. Aunt Kamala was very angry at Samir as he got Ajay married without involving them. Aunt Kamala had become blind at Kolkata house as the cooking room on the ground floor was very dark, even with a high power bulb which was switched off only during night. She had to spend most of her time in that dark room which gradually made her blind, though she told me once that after looking at a man’s feet with six fingers she became blind. Dhanjay was sent to Patna to learn photography. He was at Dariapur for several years. Dad fundeed him to open a photoshop in another area but he could not succeed. Aunt Kamala reprimanded Dad telling him that he should have handed over the main shop to Dhanjay. He went back to his mother and got a job in a photo company in Kolkata. All the brothers got married except for Bijoy who had a strange dislike for women. 
    Each year aunt Nandarani’s mother, an aged widow of about seventy, used to visit us on her way to Benaras, Haridwar ets pilgrim places. She used to exchange her silver coins with copper and alloy metal coins with Samir, Arun and me. We collected those coins from the funeral processions that passed through the main road which was straight from the square where Imlitala tap was installed. Whenever a funeral procession of a lower caste or business caste passed they used to shout Ram Naam Sat Hai, and we would run to join it in order to collect coins. The person leading the funeral procession would throw coins with rice krispies in front of the bamboo cot on which the corpse was carried. Children of the area collected those coins. The first chair that we purchased was with the money that Samir saved from funeral coins supported by funds from Ma’s kitchen expenses. There was no table in our house.
    Imlitala was a Hindi speaking area, the Hindi being a mix of Bhojpuri, Magdhi and other dialects ; hoochers and gamblers had their nights, no neighbours’ children went to school, women in veils kneaded dung cakes for fuel as well as for sale. The outer wall of our house was used to paste and dry the dung cakes, which our family purchased at regular intervals in order to fire two coal ovens in the kitchen. Nobody knew of tooth-brush paste, we brushed our teeth with fresh coal ash powder using our forefingers. Once in a month we were advised by elders to brush our teeth with salt and mustard oil to make them shine. Dad also preferred Neem tree fibrous twig to cleanse his teeth. All male members had to take bath at the roadside tap. Ma, aunties and sisters took baths with the water that was stored in a cement tank at the corner of the toilet. 
    Uncle Promod’s daughters, Sabu and Dhabu, were married before my birth, prompting him to purchase a male infant from a Punjabi prostitute whom he did not legally adopt and could not decide what to do with as the boy grew up to become a ruffian and mugger at fifteen, exhibiting unabashed scorn for everything Bengali to deculturise himself. Uncle Promod admitted him to various schools but he never took interest in studying and ultimately got rusticated from each school. He was three years junior to Samir but Samir could never recollect the mother of this boy, who was named Arun. Except for Sabu, Dhabu and Samir none of us cousin brothers and sisters knew that he was a purchased brother. We came to know of it when he turned rouge.  I was a few years junior to him and in complete awe of the fearful respect he generated in neighbours. As he reached his teens, he procured a country made revolver spinning on his forefinger. One day he allowed me to shoot at a sitting popinjay – I got my thumb bruised. I learned shooting with revolvers and rifles when I joined the National Cadet Core after entering College.
    Sabu and Dhabu were married to two brothers of a family. Their uncle was a famous criminal lawyer at Patna High Court, but was childless. When a landlord of Gaya was exonerated of several murders in a criminal case, the landlord transferred a large cultivable area and a market to the lawyer. He did not legally pass on his huge zamindari house to his younger brother whose sons were married to Sabu and Dhabu. The aunt stayed at the Gaya property which the brothers would visit for collecting monthly rent from persons who had shops in the market and for sale of crops when they were harvested. The aunt became religious minded and a few sanyasis took advantage in getting some cultivable land transferred in the name of their organisation. The brothers did not do any work which led to their separation in the same building. After several years of court cases they could retain the huge Patna house where an eight storied building now stands. Sabu and Dhabu both learned classical music from Pandit Bulakilal at Imlitala house and introduced uncle Promod to the elder brother which led to Sabu’s marriage to Dinanath. Promod loved music and played clarinet himself. Lots of musical items had been brought from Uttarpara on boats through Ganges river. Imlitala house had sitar, harmonium, organ, tabla, gramophone and gramophone records. After Sabu and Dhabu’s marriage most of the items were not in use. When in college I had tried my hand on violin and organ but left practising because of tough studies.
    I remember Arun whose nickname was Buro – an affectionate name in Bengali families for a lovable male child — brought a whore home with him secretly, double his age, and the thud of the wooden bolt woke up an aunt whose midnight yell pulled out sleepy  adults and children from their rooms, an event sufficient to provoke Dad and my uncles to dismantle the Imlitala establishment. In 1953 we, Dad Ma Samir and myself shifted to the thatched hut that Dad had purchased for construction of an alternate shop. 
    Arun had a sad death, Aunt Nandarani, Promod uncle's wife and Buro’s foster mother, who loved the boy like his own son, on advice from some quack of a sanyasin, devised an enchantment potion made of intoxicant herbs, fed to him weekly with the food items Buro loved to eat, resulting in slow poisoning. He grew weak and dropped dead right on the circle which demarcated the water well which was filled up and closed at the time of constructing our Imlitala house. Aunt Nandarani wailed uncontrollably over his corpse. Uncle Promod refused to go to the burning ghat for cremation. There were discussions as to who should burn the fire and perform last rites. Sabu’s husband was selected to do the job. Aunt Nandarani ordered that everything that belonged to Buro should be consigned on the burning pyre so that all memories are wiped off. The chickpea powder seller lady and Kulsum Apa’s granny also wailed with aunt Nandarani. Kulsum Apa’s granny shouted in full voice and declared that this family has killed the son of Imlitala.
    Uncle Pramod worked as a keeper of paintings and sculptures at Patna Museum. He tucked his shirt inside his dhoti and wore a sun hat.  I sat at the back of his bicycle and visited it during our school holidays. The Museum was not air conditioned at that time ; uncle Promod would sit in his room with curtains drawn and fill a few inches of the floor with water from the tap in his room. As he took his nap I roamed around the Museum halls for hours to become a part of ancient and prehistoric mysteries amid granite apsaras, Egyptian mummies, fossilised monsters, remnants of various Indian kings, going back home with him on his bicycle, the only movable asset of the household, cleaned and oiled in turns by children. I learned how to cycle on it and in 1956 Dad purchased a bicycle for me, enabling me to learn by heart the town’s alleys and joints. I also watched the activities of some visitors. Ladies would touch the penis of a bust without head, probably of Alexander ; gents would touch the breasts of an apsara while passing through. This made the two parts shine and this shine itself attracted others who felt like touching.
    In 1956 I was in college and had a class friend named Tarun whose uncle owned several lorry trucks. We travelled to various Indian cities on those trucks carrying salable items as well as goats, sheeps, cows etc. Transportation of animals was prohibited on trucks from one state to another. The owner of the animals would take them down before interstate border crossing and take the animals to the other side through cultivable fields. The drivers took rest during the day on roadside hotel cots, drank country liquor with roasted chicken and drove during the night. They knew about the villages on the road where young ladies would be waiting for customers to make a few quick bucks, even with the knowledge of their family members. Those ladies, when they saw truck lights from a distance, used to signal by lifting their clothes up to their thighs. They would stop the truck and carry a tarpaulin to spread over grass for a shot. They requested us also to participate but both Tarun and me were scared of syphilis and gonorrhea, transmissible deaseses through sex. Moreover we had our fill of country liquor and chicken roasts which made us sleepy. 
    Imlitala was considered to be a dangerous locality by the Bengali cultural gentry who did not venture to come to our house even if they were friends of Dad or any uncle. Even my  friends avoided the locality. We were thus outsiders to the Bengali culture of the town. We had to create our own happy cultural events. Aunt Nandarani, who came from a family of priests, used to make various types of sweets on auspicious days of Hindu calendar and we enjoyed the feasts. The kitchen, however, was controlled by Ma as Dad was the main earning member of the family. While going to his shop he would hand over a list of items needed in the kitchen to the grain merchant who would deliver the items and the children had to compare them with the list. Unlike Dad, Ma was a nonvegetarian like all other members except uncle Biswanath who also was a vegetarian, and she loved to eat small fishes of various types since my maternal grandfather had two ponds at Panihati, which have now been sold of by maternal uncles, as they found it difficult to maintain after influx of Bengali refugees and forcible occupation of land because of India’s partition. 
    The government failed to relocate most of the refugees who had to resort to forcible occupation of other people’s lands and properties. The West Bengal government wanted to settle them in Andaman and Nicobar islands and convert them into Bengali colonies but the then communist party leaders misguided the refugees for their own benefit and the proposal did not succeed. Later the same communists after forming government, killed thousands of refugees on the island of Marichjhapi at the Sundarbans where the refugees had resettled themselves, built roads, water connection etc. A few who survived the bullets were bundled on trucks and sent outside West Bengal to some arid places for resettlement. I have visited several of those settlements during my tenure as Rural Development Expert and found that the children have forgotten to talk and write Bengali. The refugees who came from Punjab were mostly cultivators whereas the refugees who came from East Bengal were of various castes and most of them did not know how to cultivate land and grow crops. Some refugees had been settled at Motihari in Bihar and I remember Ma was stunned to find a Bengali rickshaw puller as she thought Bengalis could never go down to such a lower level. She started crying on Bari Road as she was not much aware of the political nightmare of the time. 
    Uncle Promod Loved picnics. On holidays our entire clan except  Dad would go out to cook and eat by a slim stream in a mango orchard or near a wellspring. Sometimes other Bengali acquaintances were invited to join the picnics, probably as an effort to overcome alienation from mainstream Bengalis of Patna. One of the ladies or Sabu and Dhabu would burst out singing, invariably a Hindu religious song, as film songs were taboo and Rabindranath Tagore songs considered un-Hindu. Rabindranath Tagore’s songs, novels, poems were banned at Imlitala as Granny and uncle Promod considered Brahmo religion harmful. Tagore entered our house without anybody knowing that the beautiful songs they were listening to were composed by Tagore. 
    Since uncle Pramod, a patient of diabetes, did not have a son when he died – in 1966 during a hectic election campaign for an obscure Marwari candidate — I performed the funeral rituals by setting fire to the pyre on which lay his cold body embalmed by me with clarified butter.  He was a fat man who turned to ashes in two hours in a yelling blaze that licked the horizon on the other side of Ganges river. Satish Ghoshal, our family priest, directed me to collect a few bones from the ashes, which I immersed in the river. This was my first encounter with the beyond, as I was not allowed earlier to accompany Arun’s dead body to the shores of Ganges for his funeral, a plight Satish Ghoshal sermonised not to give importance to as it happens to all when you came to burn or bury the dead.
    Uncle Pramod used to practice homoeopathy and the Marwari family, who had more faith in homoeopathy than allopathy, was his client. Uncle Pramod treated us as well during fever or stomach trouble. The Marwari family used to invite our entire family whenever there was a function at their house, which was quite frequent. We brothers and sisters used to pocket extra sweets to enable us to eat them during the week. Uncle Promod loved to sniff perfumed snuff. Various types of persian perfume vials were brought from Uttarpara, which had become almost sticky in hundred years and kept in an almirah in Sushil’s room. Uncle Promod used to mix one perfume at a time. If any of us children touched a vial he could make just by sniffing him or her and the punishment was a few taps by twigs kept beneath his bed ; the twigs were very old and broke just after a few strikes on the palm. 
    A couple of years later Aunt Nandarani died of burn injuries she received when her cooking stove exploded. I was not allowed to perform the funeral rites in her case as Sabu and Dhabu thought this might lead to a claim by me on the Imlitala property, although their own zamindari building called ‘Sylvan House’ was quite big with a dust road leading up to their main building, there being tall flowering trees  and flower gardens on both sides which gradually disappeared due to neglect and lack of resources. There were guava, jackfruit, and many other fruit trees. I used to visit them and played with my nieces who were a few years younger than me. Aunt Nandarani used to stay on the upper floor and gave the first floor on rent to two families. They belonged to the milkman caste to which the Chief Minister of Bihar belonged. Despite efforts by Sabu and Dhabus husbands, they did not vacate and ultimately the house had to be sold to them at throwaway prices. When I visited the area in 1990 everything had changed. I could not recognize Imlitala in my childhood. Two or three storied brick houses had come up in place of thatched ones. The mahadalit caste families had left and in their place office going middle class other caste families had taken over. Kulsum Apa’s house had also been rebuilt and the adjacent mosque had four minarets with loudspeakers tied thereto for azan;  the domes were painted green with oil paints. Ladies were seen in that area wearing black burqa, eyes peeping through nets. On enquiry I learned that Kulsum Apa has been married to someone in an Arab country after her father’s death ; other members of the family had dispersed to strong Shia localities. 
    Once we four, Subarna, Barin, Tarun and myself decided to visit the area where prostitute of Patna do their business. We did not know the locality but had heard that it was near what is now called Patna Saheb, at that time called Phulwari Sharif or Patna City. Tarun was ready to fund the visit and if we felt like it we should pick up a girl. We did not want anyone to know what we were going to do. We knew that the tongas called khadkhadi which had a cot-like top on which eight to ten people sat for travelling assembled at Sabzibagh for onward journey to Phulwari Sharif. We talked to an old mule cart Khadkhadi driver and divulged our secrets. He said we may hide inside a canopy room on his cart which he prepares for the Bihari bride and groom after their wedding when the groom takes the bride along with him to his house. The cart driver inserted four sticks on four side of his cart. There were holes meant for it. He covered the top of the cart from all sides and we four sat inside so that nobody could see us. We travelled in that position for an hour when the cart puller told us to alight and pointed towards a big gate of a building which looked like some zamindar’s old house, probably not repaired ever. Tarun paid the cart driver who went inside, came back and told us there was nothing to worry about as the girls are all free.
    We went inside and saw ladies of various ages either taking bath at the compound well or drying their hair or gossiping among themselves. They started laughing after a look at us and called for a girl standing on the upper floor verandah. We were directed to go to her as she had completed har bath and performed her puja and had her breakfast. We went upstairs, the staircase being dirty with paan spit and marks of puking. The lady we met was about thirty years of age. She asked whether all four of us will sleep one by one and if so then let us take a boat and go to a hut on the sand ait in the middle of river Ganges as her room was yet to be cleaned. She said that we have to pay the boatman two rupees and she will charge two rupees for each of us. Tarun whispered to us that he could fund only one person as we have to retain funds for returning home.
    All five of us came back and entered the makeshift room atop the cart and went for the rivershore. For the first time had a close look at a prostitute. She was going to apply lipstick when we all at the sametime told her not to look like she looks in the evening. I told her that her eyes were quite big and black. She replied, adoring my chin with left hand, Babua,  eyes were the reason why she was thrown into the fire of this hell. Then she added, Babua, you come again when I become old and perform my last rites. At Imlitala the ladies called me Babua or baby. Her touch was electrifying. But I was scared of sexually transmitted deseases as one of my maternal uncle Chheni’s father in law suffered from unbearable because of STD and had to take heavy dose of opium for relief. Those days intoxicating drugs were not banned and one could purchase from government shops. Chheni was a football player at Uari Football club. His wife was beautiful but bulky and once left home to be found at Tarakeswar station singing Rabindra Sangeet. Another time she was kidnapped and was being carried in a car when police intercepted at the East Pakistan, now Bangladesh border. Their elder son married a very low caste girl who was not accepted by Chheni and told his son to live separately. Chheni’s younger son developed an illicit relationship with an elderly housewife. These incidents made Chheni and his wife quite deranged at old age. I had visited them when they were old and both of them failed to recognize me.
    The prostitute asked us whether any of us had slept with a woman so far as we looked very boyish and innocent. We said we never had the opportunity. She asked whether we were going to pay separately or one of us would pay for it all. Tarun said he will pay. We got down at the river shore, paid the mule cart driver, went down the steps behind the lady and sat on a boat which seemed to be earmarked for the purpose. When we had crossed some distance the boatman looked at us and said slyly, ‘what are you paying for, you should enjoy the trip, kiss her, embrace her, undress her blouse, press her teats’. The lady started laughing loudly and said, the boys are novice and scared even to touch me and you are talking of kissing and undressing. She herself started removing her green front-hook blouse when we had to tell her to stop. Despite our warning she revived har blouse. Both she and the boatman started laughing. Her brown teats scared me instead of titillating. 
    We got down from the boat on the sandbank and walked towards the hut. There were watermelons and cucumbers growing around the hut. The boatman probably was the cultivator and went for tending them or plucking those ready for sale. Who first, the lady asked, and without waiting held Tarun’s hand and went inside the hut. We had nothing to do, found a skull on the sand and started playing football with it. The skull might have been some murdered person’s head. 
    Tarun came out after sometime looking morose. The lady said she had herself undressed Tarun quite slowly but the fellow was so scared that he did not have an erection. We three said that was enough for our experience. Tarun paid the full amount and the boatman took all of us back. The lady alighted at Phulwari Sharif and directed the boatman to take us to Patna town. We felt happy to get down at Mahendrughat near Subarna, Barin, Tarun’s house, as all three resided within walking distance. I took Subarna’s cycle and paddled to Dariapur.
    Two similar incidents had happened later in my life. During my trial at Kolkata an American poet, David Garcia, had come to meet us after raising money working as a cobbler in Greece. He wanted to sleep with a Bengali girl. Saileswar, Bsudeb and Abani were regular visitors to Sonagachhi, the famous red light area of Kolkata and one evening we took David to one house known to them. Seeing a foreigner customer the pimps started accosting our group telling us they have more beautiful girls than Anarkali. We purchased rice liquor from a shop at the corner of the entry lane and went upstairs to a house. The girl’s name was Baby, probably twenty years old. We pooled money and said we would drink in her room and do some touchy-feely. Thereafter the foreigner and one of us would sleep with her. In her room the bed was on the floor on which we sat and drank rice liquor in glasses provided by her. She also drank with us and kept on giggling with our combined touches and kisses. We all except David came out of the room and waited at the verandah. Meanwhile Basudeb and Abani went for a view of other girls. When David came out and Baby asked as to who was coming, Saileswar jumped on her and went inside. Basudeb and Abani had talked to two girls named Deepti and Meera for afternoon sojourns to which they had agreed. Saileswar, Basudeb and Abani had become their regular customers ; probably each of them fell in love with the three girls and used to financially help them when requested. In later years Basudeb used to lament when Baby shifted to a rich person’s house as a mistress.
    Another incident happened after I rejoined my job at Reserve Bank Of India. Employees were on relay hunger strike at the gate within a tent raised for the purpose. I sat beside Shibu Palit, in the tent, who was lying down and smoking. I could make out it was hashish and had a few plumes of puff. He said this was the best drug, the local people and Bengalis are still in prehistoric age taking ganja, bhang, toddy and rice liquor. I told him toddy was the best among all as your health is not affected. Phanishwar Nath Renu drank toddy after sprinkling cardamom powder on it. Shibu Palit informed me that they are going for a picnic to Rajgir on the next day and invited me to join them.
    Eric Page and Mohammad Zohair, two of my colleagues informed that they have formed a group which arranges a chit fund scheme of sex and picnic, and invited me to join as I was not required to join in hunger strike. I enquired about the sex part of it. Eric Page informed that he has purchased a matador van within which the seats on both sides could be pulled to make a bed for the lucky couple when the group is not going out for picnic. When they go out for a picnic a game is played somewhere to enable a person to find out the girl who would be hiding. The person who finds her gets the girl as well as the rest of the pooled fund. Shibu Palit had talked about this picnic cum sex game.
    Next day morning I went to Shibu Palit’s house at Ashiana complex. He was wearing half pants and waiting in the van. He told me to wait and went to pick up someone in a dinghy area behind Golghar. He returned after fifteen minutes with a girl about eighteen or nineteen years old. I had never seen a girl so dark, almost like an African but with an Indian body. She was wearing sky colour plastic bangles in both hands, firoza colour nosepin, black chiffon sari, sky colour blouse, eyeliner applied to eyes, and a garland of jasmine flowers around her coiffure. I wondered how such a lively girl lived in such a godforsaken place. Men hound out beauties from the worst of places. She came into the van and jumped in between us, looked at me directly and said, I have never seen you earlier. Shibu told her that I was a first timer. In a somewhat Hindi tone the girl said that her name was Shefali and everybody called her Tu ; her father was a Behari Brahmin at a jute mill with whom her mother had eloped. She placed two of her hands on our shoulder and shouted Hurray. The van took a sudden jerk and Shibu had to tell her to control herself. But she appeared to be beyond control.
    As per schedule everybody took  rest for the night at Devendra Singh’s ancestral palatial building at Rajgir. In the morning we proceeded for the ruins of Nalanda University at the gate of which Robin Dutta, the group leader for this outing, gave a lecture by starting : “Friends, Romans, fellow workers, lend me your ears; we  come to bury sanity,  to praise sexuality. The evil that men do lives after them, The good is often interred with their bones; So let it be with social rulers. The noble Shefali hath told you she was ambitious; If it were so, it was a life to rejoice, And insanely we have responded. Here, under leave of we hungry wolves and the rest,--”
    Eric Page shouted, bloody idiot stop your pseudo Shakespeare and let us know the programme. Robin Dutta explained that Shefali will enter the ruins first and she has the freedom to change her dress and looks as many times as she likes. Rest or the sex starved will enter after half an hour. Shefali gets five thousand rupees and the one who first finds out Shefali gets her for the night at Rajgir and ten thousand rupees. Once someone comes out he will be disqualified. Shefali winked at me . I thought there probably is no difference between love and perversion. I went inside and watched the perverted part of my colleagues running around in search of a black whose energy was to be sucked by a young man. I was tired in the sun and came out after ten minutes. Abhijit came out in the afternoon holding her tightly. Shefali had changed to an orange colour silk sari, bifocal specs, powdered face, plastic bag hanging from left hand.
    The next picnic was arranged at Sonepur fair. I did not join but had seen the faces of fifty girls in an album which was being circulated secretly in office. They were, I was informed, call-girls and the phone number on photos was that of their pimps since mobile phones had not arrived till then. Only one of them was supposed to be a part of the game, the winner receiving one lac rupees and the girl. The winner would get a room on a tugboat to spend the night on Ganges river. Asim  had won the game but for unknown reasons he committed suicide by jumping into the river at midnight when the girl was sleeping. The boatmen said they did not hear the sound of anything falling in the river.  However, Asim’s diary was found in the couple’s sleeping room, and on all pages he had scribbled Om Ramakrishna Namoh for hundred and eight times each day. The girl was arrested.
    I had helped Nishith, a friend of mine, who had come back from the  short service commission in the army, to get the job of Caretaker in the new office building in which we shifted. Nishith got a flat in the same building and fell in love with Aleya, a lady employee with whom he used to copulate in his flat  during her menstruation days, as those days were supposed to be safe. The girl wrote a big letter to Nishith indicating that she will commit suicide if Nishith did not marry her. Nishith came to me and requested to write a reply as he was from Hindi medium school and did not have much command over Bengali. I wrote a reply on his behalf telling her that she need not worry as parents have been convinced and a date would be fixed soon for marriage. Instead of copying my letter Nishith just signed it and delivered it to Aleya which enraged her. Next day she came in front of my table and in the presence of other employees and loudly said that  the love letter was written by me and  I should marry her ; otherwise she would show the letter to my parents after tearing off Nishith's signature portion. It was really scandalous. Other employees knew that Nishith was having an affair with Aleya and they were meeting in his flat. Aleya threatened that she remembers every line of my poem, in fact most of the girls have had a photocopy of my poem. Aleya said that it would not be difficult to convince my parents as her name features in the poem. Nishith’s parents had to talk to Aleya and her parents to solve the problem. I felt like a rat caught in the trap till they got married.  Somehow the news reached my parents and Ma informed a few marriage brokers who started bringing girls of marriageable age to the office to select one of them. It was so silly that I had to express my anger to my parents.
    In another incident, one day a retired peon came to meet me along with a girl of his granddaughter’s age and informed me that she has purchased the girl out of his provident fund money and married her as his sons and grandchildren were grown up and busy with their families and he feels lonely after his wife’s death. He also claimed that the girl was already pregnant with his child. Since marriageable girls were meeting me, he advised me, I may purchase a good looking fair girl and either marry or keep her as mistress. He was ready to arrange for a selection meeting at his village which falls in Vaishali district, famous for the courtesan Amrapali. I felt that right from peon upwards everybody took me as a lecher after my court case and newspaper reports thereabout.
    My only friend and supporter in office Sushant,  had met with an accident. He was waiting at a road crossing on his motorcycle when an elephant standing beside his motorcycle raised its trunk suddenly and hit Sushant’s head. He lost consciousness and had to be hospitalised for bone resettlement. My school friends Tarun and Barin were busy with their new jobs and Subarna had left Patna after he got a scientist’s job at Sindri. The elephant, I was told by hospital staff, was the same on which prime minister Indira Gandhi had travelled to Belchhi village to meet family members of Kalicharan Mallah, Daso Paswan, Ramchandar Mochi, Mahavir Majhi, Shravan Paswan, Rajo Paswan and others  who were killed by upper caste Mahatos. I used to visit Sushant in the evening and spend time with him. 
    It was the same hospital where my Hindi and Maithili poet friend, and Bengali translator Rajkamal Choudhary would die in 1967. He was a bridge between the Hungryalists and Hindi writers. He was in Kolkata for several years and would take me to the Chinese area behind Lalbazar police station to procure intoxicants and meet Chinese women. These Chinese families have since been shifted to Chinatown in Kolkata to enable them to retain their culture and let tourists visit the place. His father Madhusudan Choudhary remarried a girl, after the death of Rajkamal's mother. Arrival of step mother in his house was the beginning of a tumultuous relationship between Rajkamal and his father. Because his step mother was of similar age as Rajkamal was, he could never relate himself to her in the same manner as he used to see his own mother or his earlier step mother. Prior to Madhusudan Chaudhary's marriage to Rajkamal's mother, he had a previous marriage but did not have a child from that marriage. Being a "mother" to a man just a little younger than her,  Rajkamal developed a complex love relation with his step mother. For this marriage, Rajkamal never forgave his father. To forestall any sexual relations between them Rajkamal’s father took him to the mass marriage of Saurath sabha and got him married. Later, Rajkamal fell in love with his wife’s relative and married her. When he was working as an assistant editor with a Kolkata based Hindi newspaper I had visited his village Mahishi, sixteen  kilometres west of the Saharsa district headquarters . It is a place of utmost religious importance due to Shaktipeeth of Goddess Ugratara. We had gone during the tantric festival of the goddess when buffaloes were slaughtered and the cooked flesh eaten as prasad. It was really carnivalesque with villagers drunk with rice liquor gulping roasted buffalo meat, some of them as well as we two having buffalo blood on our shirts.
    Rajkamal was allotted a separate room in the hospital unlike Sushant who was in the general ward. One day Rajkamal had requested me to bring a packet of condoms for him ; pointing to a nurse he said that she was agreeable. The nurse nodded in affirmation. Next day when I reached the hospital the bed was empty. The nurse said that Rajkamal had died during the night itself. His body was handed over to the first wife who performed the last rites.
    Three
    As any venture uncle Sushil embarked upon was a flop he joined Dad at the photography shop on the main road that shifted later to Dariapur in 1953. The shop which had been opened for him at Chhapra, on the other side of Ganges had to be closed when aunt Karuna, uncle Sushil’s wife developed tuberculosis. In a  room on the ground floor of Imlitala house was given to her, where she lay on the bed on cement floor, our family doctor Akshay Gupta visiting and prescribing whatever medicine he thought fit as tuberculosis at that time was considered untreatable and contagious. She died in that room leaving her husband and two daughters, Dolly and Monu, to be looked after by Dad and Ma. Dad performed her funeral rituals as uncle Sushil did not take much interest.  Dolly and Monu regularly flunked school. Whenever they attended school regularly they brought lice in their hair for which their hair had to be regularly shaved.
    I have recollections of uncle Sushil as a snuff inhaling afternoon dreamer though an artist par excellence. Whatever money Dad gave him for daily expenses he would purchase sweetmeats or fruits and eat on the road as if nobody is looking at him. He, Dolly and Monu had a big room upstairs where all three preferred to sleep on the floor. Uncle Sushil got up quite late and went to Dad’s shop to attend to the work given to him. He and Satish Ghoshal, the family priest, were friends, and loved to watch Hindi films on Tuesdays when the shop was closed. They discussed the beauty and dresses of  heroines which Dad found quite embarrassing. He reprimanded Satish Ghoshal for discussing the beauty of female stars despite being a Hindu priest with considerable knowledge of vedas. Satish Ghoshal argued that most of the Hindu puranas talk of beautiful ladies as goddesses as well as of apsaras who enticed legendary saints with their beauty, even Amrapali belonged to the city where Sushil had a shop, and had enticed king Ajatshatru and his father. 
    At Imlitala house films were forbidden for us brothers and sisters. Arun did not have any interest in films. Samir and his school friends, including cousin brother Ajay, were very much attracted to certain actresses. But there were instructions that all children should come back home before sundown, it was difficult to be absent from home for three hours. During those days Cinema Halls used to have intervals when audiences could go out to pee or smoke or eat something. For them gate passes used to be issued. Samir made arrangements with me that he would watch a film upto  interval, give me the gate pass, telling me the row and seat number so that I watched the later half. Next day I would watch the first half and Samir would watch the second half. Thus we would not be absent from Imlitala house for three hours. English films were shown during morning hours and there were no difficulties watching them as Tarun funded our ticket expenses ; by our I mean four of us school mates, Tarun, Barin Gupta, Subarna Upaddhyay, a friendship which continued during college days though we studied different subjects. Barin had a cycle and he would identify the film to be watched, depending on the sex appeal of the actress on the poster. Barin was expert in whistling and did so in kissing scenes.
    Uncle Sushil’s daughter Dolly was packed off in a negotiated marriage with a relative of her maternal uncles which I could not attend. Dolly died in 2000 at Kolkata after her son in law, younger daughter’s husband died. Monu decided to marry a local non-Brahmin Hindi-speaking boy whom uncle Sushil and Dad did not approve of, so the responsibility of solemnising the marriage in a Shiva temple at a place called Khusrupur in Bihar befell me, I was attired in a pink dhoti and yellow shawl given by Monu’s inlaws, with collyrium in my eyes, applied by them, and performed priest directed rituals I was not conversant with, as they were different from our Bengali rituals. I placed my trousers and shirt in a bag I had carried with myself. It was a mass scale marriage at the temple, there being other couples and their families. When everything was over I took the train back to Patna and changed my dress at the station after washing off the collyrium from my eyes. Monu now lives in Patna with husband, son and grandchildren and talks to us whenever there is a Hindu festival. Uncle Sushil died in 1968 at Patna of a hernia he was too shy to get treatment for, on the day I was getting married at distant Nagpur. Since I had decided to marry field hockey player Shalila Mukherjee my parents did not think it was right to inform me about uncle Sushil’s death. Dolly, who had arrived at Patna to attend her father’s post-funeral rituals, was quite angry with me and had said that I should have married at a later date. After that heated exchange she died without talking to Dad, Ma,  me or Shalila.
    Anil, the brother next to Dad, had a photo studio at Uttarpara at the time of his negotiated marriage with Omiya, a school educated lady who was already in love with a guy living in the erstwhile French colony of Pondicherry, now called Puducherry. She continued the relationship despite her marriage, provoking uncle Anil to abandon his shop and become a recluse. Dad, who  had gone to Uttarpara to persuade him, found hundreds of letters from suppliers and customers lying unopened,  to run the shop and live his life his own way. But he was adamant and said that his life had failed. He could have gone for another marriage but seemed to love Omiya despite having been betrayed. I thought he was nuts when he, along with daughters Khuku and Rakhi came down to live with us at Imlitala house in 1947. 
    Initially the couple was happy. They ran a nursery school in the outer hall of Uttarpara house. There were lots of students. I remember I was once sent to manage the class. The kids were being taught only Bengali alphabets and drawing. The school was named after granny, Apurobomoyee Smriti Vidyalaya, probably to keep granny happy so that she does not interfere. But the school had to be shut the day Omiya’s lover gave a visit to Uttarpara house. Most sad person was granny, who said that at least the house was alive with the children. 
    Aunt Omiya did not give a damn to uncle Anil. She took a teacher’s job at a primary school for small kids and introduced newspaper reading in the family, creating in us a fascination for her. Among the children she had a strange soft spot for me though I should have drawn her hatred as I somewhat resembled Anil uncle. The daughters were not good at studies ; the elder was sent to her maternal uncle’s place to get rid of her array of boyfriends. She married a Kolkata based underworld young man of non-Brahmin caste, a refugee from Assam, as she was pregnant with his son. She could not adjust, came back to Imlitala, and enticed another plumpy young man. They both went to Kolkata and the young man sent the son to Delhi, where he resided with his relative. Later they opened a school for kids and gradually got it upgraded while giving birth to four more sons. Aunt Omiya got her second daughter married to a Doctor who was from Silchar in Assam. I had visited them during their son’s marriage and found that the rituals were completely different. They also loved to eat small fishes stored underground for several months in small bamboo cups. Though I had experience of having eaten various types of meat since childhood, I failed to consider this item to be a delicacy. 
    The frequency with which aunt Omiya visited Pondicherry Aurobindo Ashram, uncle Anil’s dementia, instability, distraction, and mania increased. The couple lived in the same room left by us at Imlitala, husband and wife not talking to each other, a menage of dissent with a window opening inside. He stopped wearing shoes and walked barefoot even in the scorching sun. Washed his own clothes. Stopped eating dinner. Whatever work Dad gave him he took them to Imlitala house and handed them over after finishing. Uncle Sushil used to eat on the road, visit cinema halls but uncle Anil did not talk to anyone and I do not know what he did with the money Dad gave him. He used to address even a small child as Sir or Madam. When Omiya died of breast cancer, after one of her teats were removed, he also developed cancer of the nose which started looking  cauliflower shaped. After Omiya’s death he went back to Uttarpara house and lived on financial help from daughters. When I visited Uttarpara to handover my share to the new apartment builder for a meagre sum of rupees sixty thousand, the tenants who were still there informed me that Anil used to wail for Omiya.
    Unhappy with his three daughters and three sons, after elder daughter Puti’s suicide, Uncle Sunil, who had a catering job in the Eastern Railway, broke Imlitala eating taboo by including varieties of forbidden food into the menu of the children, depending on items knocked of from pantry car he was travelling in. The train would pass through Patna rail station and he would hand over to us a packet containing the items. He had sent his son Khoka to Dariapur for studies at Patna University from where Khoka did his Bachelors in Economics. Khoka went back to Uttarpara and got a job. Uncle Sunil had by then settled himself at a portion of the house. When Khoka eloped and married the non-Brahmin tutor of his brothers and sisters, Uncle Sunil told Dad that it was because of bad company at Dariapur house, meaning me. He got a good reply to this allegation when one of his daughters married a youngman of washerman caste. He got the other daughters married quickly in succession to avoid such eventualities. His two sons flunked school after the departure of the tutor and tried to start a broiler farm in the gloomy rooms of Uttarpara that made the fowls sick and mad. They brothers got small jobs such as cooking gas vendors or shop assistants. Uncle Sunil died on the day after I met him in February 1989, in unbound glee that he was on the verge of getting out of the mess his incorrect decisions had created. 
    At imlitala, Ma was in charge of cooking which she did for twenty persons on two coal ovens made of clay placed on the kitchen floor. Through day and night she sat there beside a large wooden box containing spices stored in phials of used medicines and cereals in tin canisters bought out of a collective fund. She would detect sudden shortages while cooking and haul me or Samir up from studies for an immediate purchase in the smallest quantity, which we would procure in a jiffy from the shopkeeper outside the lane to enable her to complete the dish. Sometimes uncle Promod would like to cook himself when he brought fishes of his choice. Ma loved to apply vermilion on her parted hair twice a day after birth. And her favourite vegetarian dish was dhoka -- asafoetida-flavoured cakes of steamed and grinded chick-pea. Since we did not have electricity, I do not know whether mixies and grinders had been invented by that time. 
    Grinding of every item was done on a big stone with a smaller stone. On the bigger stone marks had to be made with chisel for which a person came every month to do the job. Spices were prepared on the big stone grinder by our part time servant Shivnandan Kahar, on whose back we brothers and sisters climbed while he swayed to and fro pulping turmeric, chillies, ginger, cumin, onion, coriander, garlic and spearmint for an hour or two in the evening before our study time. We had to study seated around a kerosene lantern before dinner. When powdered spices arrived in the market, grinding continued till we shifted to Dariapur as most of the members felt that powdered spices available in the market did not create the requisite taste.
    Each of my uncles had his own time for lunch and dinner, when he ate alone, served by his wife, whereas the children and ladies ate together each on a small piece of mat sitting cross legged, except for Sundays, which was a meat eating day, when lunch was late. We ate goat meat, since chicken, duck, cow, buffalo, rabbit, deer, frog, horse, turtle etc meat were prohibited, either because of family tradition or because we were a Brahmin family. Even those fishes like eel or flounder were taboo as they did not have scales.  We ate some of the meat at cheap roadside restaurants when we grew up and accumulated some pocket money. There was a famous shop called ‘Mahangoo’s Meat’ where we ate all sorts of meat balls sprinkled with poppy seeds and white sesame. Ma never went beyond goat meat though she cooked fowl for us after we shifted to Dariapur. Our neighbour at Dariapur was a bangle seller Muslim family who taught Ma how to cook various dishes of fowl and biriyani. The Muslim family shifted to Pakistan later as they did not feel comfortable in Bihar. 
    Four
    As I have said earlier, Samir, about five years my older, was the first individual of our family to complete school and college, as he was first sent to our maternal uncle’s place in Panihati for studying at Kolkata when Dad decided to keep him culturally incorrupt, though Samir shifted to Uttarpara house after some time when he became friends with young poets and required freedom to smoke, drink and talk loudly which was not a suitable behaviour in Panihati. He studied science in City College, joined Satyajit Ray’s drama group Harbola, and started frequenting joints visited by the reigning Bengali poets of the thirties, about whom he talked to us in bated breath, often brandishing books of verse written in a Bengali diction foreign to our tongue ; not even Aunt Omiya used such words while talking to her guests. 
    Panihati was just a boat ride across the river Hooghly, which is wrongly called Ganges river by the boatmen. Nowadays the boats are run on motor. In my childhood it was plied on oars by boatmen, who were mostly from Bihar and were happy when I talked to them in their language. During my vacations I was sent to Panihati to keep in touch with Bengali language and culture, as also to improve my health, as I was quite skinny, and my health did improve at Panihati as maternal uncles had a huge garden full of fruit trees and two ponds full of various fishes. The maternal uncles were comparatively richer and educated, had a radio, a gramophone, a library full of books in both English and Bengali, read the English daily newspaper The Statesman, a status symbol for Bengalis of upper echelons, talked among them sometime in English, and were interested in political developments. The library walls were adorned with photographs of leaders of Bengal renaissance. In fact I learned about the Bengal renaissance from maternal uncles. 
    Ma was called Bhulti at Panihati and Amita at Patna. She did not know how to read and write when she was married. Once while we were crossing the river on the ferry boat, I remember she jumped out into the deep water, presented us with her memory of cross current swimming, and came out with tiny transparent crablings crawling down her un-coiffured hair.At Patna, every time she went to the bank with Samir or me, to withdraw from her savings, she misspelt Amita in her laboriously practiced signature. Ma was scared of pox inoculation, locking herself up in the lavatory whenever the municipal doctor arrived for the annual prick.
    In 1948 I was withdrawn from the Catholic School and admitted to the Bengali-medium Ram Mohan Roy Seminary, a Brahmi Samaj school, primarily, I learned later, because Dad came to know we were having a prayer class everyday at the Catholic cathedral of the school, meeting with folder hands Jesus Christ in agony in flowing Italian marble surrounded by azure-tipped candle flickers. I was showing how to cross the thumb while praying to my cousin sisters,  which gave away the news of Bible class. I used to tell them stories from the Bible as well about Moses, Exodus, Ten Commandments, Abraham, Christ etc. Dad did not have high opinion about Brahmos though, as the sect had been advocating against idol worshipping. Ma did have weakness about Brahmos as maternal uncles had photographs of Brahmo leaders on the walls of their library. But this might have added to the source of my religious pacifism which I had gained from the lower caste inhabitants of Imlitala. I do not consider myself an apostate or atheist and may probably define myself as vaguely Hindu without much to do with religious rituals, gods and goddesses. I still remember the prayer we used to say before class everyday;
    Our Father in Heaven Holy by your name 
    Your Kingdom Come
    Your will be right on earth as in heaven 
    Give us today Our Daily Bread 
    And forgive us our sins 
    As We Forgive those Who Sin Again 
    Come Do not bring us to the test 
    But Deliver Us From Evil
    Amen. 
    As soon as the prayer was over, everyone ran to their class. On the first day a  sister-nun took me by the hand and led me into a classroom. I don't know what the 'Sin' thing was then, I still don't know. Now all I know is Gilt. 
    The Catholic School to Ram Mohan Roy seminary was a non healing journey of cultural hiatus for me, because of the schism that still invades my poems, novels, drama and other writings. Doe-eyed nuns carrying a bleeding Jesus made of soft marble through the bazaars of Patna float in my dreams even at this age. Like the Catholic School this school was also coeducation where I met Namita Chakrabortyl, an upper class girl who also doubled as librarian and introduced me to Brahmo poets and writers : that is when I started reading Rabindra Nath Tagore, Jibananada Das, Sukumar Ray and others. Crush for her will lead me to a greater journey in scholarship, literature and knowledge. She had dimpled cheeks like Kulsum Apa. 
    At Ram Mohan Roy Seminary the ‘Anandaloke Mangalaloke’ song before class had been written by Tagore, as told to me by classmate Tarun Sur, who directed me to shout along with others because the entire school is booming with this prayer. In English translation the song would be somewhat like this:
    You are honourably present with the halo at the blissful world.
    Your majestic appearance gorgeously fills the sky,
    The mortal world coiled around your adorned feet.
    The Sun, Moon, the planets, stars anxiously drink and bathe
    In your everlasting beam, with incredible speed.
    Springs dance down the earth, what a beauty
    Flowers, leaves, melodious sound add to colours.
    Ever new stream of life continues to flow day and night,
    Your kindness is reflected in life and death without rest.
    Love-affection, kindness, respect softens the heart,
    Your raining consolation cools down.
    What a grand celebration all around, revere the whole world
    In the carefree, omnipresent shelter, where beauty is wealth.
    Ram Mohan Roy Seminary, a three kilometre walk everyday, sun or rain, had boys and girls of same lower class milieu as that of mine to whom I was initially embarrassed to divulge my fleabag Imlitala residential area considered infested by criminals, deterring classmates to visit me at home, until I shifted to Dariapur house. I did not have personal friends for long and learned to adjust to my loneliness, Samir always at Panihati, Arun away with his ruffians, other cousins very junior to me. Sari-clad girl students were there in my class but the mystery seized me late, when I came close to a girl named Anjali, who left the school leaving a lengthy letter informing me that she is being sent to a newly built religious Hindu school in Nabadwip in West Bengal. I can remember three other sari-clad girls with effort : Hashi, Juthika, and Bijoya, probably because of their colourful attire, big teats and buttocks. A classmate named Rakshit used to bring a pencil cutter sized mirror to enable us to look at their teats bursting out of blouses. 
    Lack of a cricket bat, white dress, shoes of my own did not give me much scope  to have a place in the school games and I could not do well in football either because of my weak physique, so I found my way into the library and reading room, Namita Chakraborty chaperoning my interest in school editions of Homer, Edmund Spencer, Miguel de Cervantes, Shakespeare, Voltaire and Sanskrit classics compendium, finding finally in the last year of my school text writings of six persons who changed the condition of my loneliness : George Gordon Byron, William Wordsworth, Samuel Taylor Coleridge, Percy Byshee Shelly, John Keats, and Alfred Lord Tennyson. Unfortunately I carried impressions of these poets for a long time and have been criticised when I started writing poems in Bengali. Except for Tagore, the Bengali poets in the text had only moral sermons to deliver, whereas Hindi poets talked about greatness of the creator in a never-changing rhythm. I learned later that some poems and stories had been included by writers who were members of the syllabus committee. After the death of T.K.Poddar, the principal of our school, his son became principal, and teaching Bengali was discarded as the school could not get Bengali teachers. The only Bengali teacher, Karmakar,  who continued for some time was a Brahmo and had to be busy with marriage etc rituals of his community. T.K.Poddar used to wear dhoti on his pyjama.
    In the final years of school I made friendships with three boys who were themselves unable to make friends, Subarna Upadhyay, Barindranath Gupta, and Tarun Sur. This is a strange way of connecting people ; you just become friends with certain men who suffer from the same strength and weaknesses as yours. Subarna could not afford to have a cricket uniform, white shirt and pants, and was removed from the team though he was a good bowler because of his six feet plus height. Barin was a myopic. Tarun a short and weak boy who talked little but was from a rich family, his ancestors being liquor suppliers to the East India Company. We sat at the shore of Ganges river, talked about whatever we knew, pooled resources to watch Sunday morning English movies, ate at cheap restaurants, and roamed about from camp to camp during the three day festival of the goddess Durga. Barin had a good voice, sang Tagore and Atulprasad songs at the river bank and old film songs at a locale full of palm trees out of town where toddy was available quite cheap. Subarna played music with the ring on his finger on the empty toody pipkin. After getting drunk we all joined the song in nasal tone, imitating Sachindev Burman :
    O bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney
    Nishithe jaiyo phulo boney re bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney 
    Jalaye chandero baati
    Jege robo sara rati go
    Jalaye chandero baati
    Jege robo sara rati go
    Aami kobo katha
    Aami kobo katha shishirero shone re bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney 
    Nishithe jaiyo phulo boney bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney
    Jodi ba ghumaiya pori
    Swapanero patho dhori go
    Jodi ba ghumaiya pori
    Swapanero patho dhori go
    Tumi nirobe chorine jaiyo re bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney 
    Nishithe jaiyo phulo boney bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney
    O bhromora
    Aamar daal jeno bhange na 
    Aamar phool jeno bhange na
    Phooler ghoom jeno bhange na
    Tumi nirobo chorone jaiyo re bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney
    Nishithe jaiyo phulo boney bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney 
    Jalaye chandero baati
    Jege robo sara rati go
    Jalaye chandero baati
    Jege robo sara rati go
    Aami kobo katha
    Aami kobo katha shishirero shone re bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney 
    Nishithe jaiyo phulo boney bhromora
    Nishithe jaiyo phulo boney
    For the main three days of the Durga Puja festival, Subarna wore saffron, white and green shirts stitched out of discarded silk national flags of earlier years supplied to his father’s office each year by the government. His father was an engineer in charge of a high and huge tank that supplied drinking water to the city. When I shifted to Dariapur and Dad had yet to bring his old shop to Dariapur, we four assembled to avoid the rain and strong sun. We were joined by uncle Biswanath’s brother in law Buji who had come to Patna to get trained in photography. Bujida used to cook for himself and me. During the night we had noticed that our Punjabi neighbour brought a new prostitute each time with him. Bujida would put off our lights and climb his stairs, knock at his door to ask for his torch. After a few nights the Punjabi neighbour understood our motive and the moment we knocked at the door it opened and just in front of us stood a completely naked young woman. He told us, ‘take this torch with you, you both will get more light from her than any torch’. Bujida, while coming down, had said, we should have accepted his offer, it is only because of you I was in two minds. Whenever he was annoyed he would repeat his anguish to have lost an opportunity of free sex with a good looking young woman. After completion of his training in photography, Bujida went back to his native place Kotrong and opened a photographic shop and married a girl who was dark and not good looking because he had opened the shop with the dowry he got in his marriage.
    In 1948, I experienced the punishment of ‘kneeling down’ at the Ram Mohun Roy Seminary, on the verandah outside Hindi Sir's class, as he found out that my Hindi books were soaked wet in the rain. He had  said, "Learn to respect the state language, you donkey ." It was raining outside the verandah, but I did not know that Hindi was not the state language but an official language. I had seen donkeys standing quietly, soaking wet in the rain, and looking at people with umbrellas, dancing and laughing.
    The first stand-up on the bench was experienced by me in 1949, when in English class, while the teacher was explaining Wordsworth's Daffodils poem, I showed him  dried daffodil flowers kept in my book which nun Irene had brought from Ireland. I  said, "I know, sir, took the dried flower out of the fold of the book." The teacher said, "There is no place for a joker like you in my class, stand up on the bench." He explained that the purple flowers of water hyacinth were called daffodils. When I went to Europe, I saw daffodils on the side of the road, obviously they were not like hyacinths, and red flowers which Europeans call poppy, but not poppy flowers that produce opium. In 1949, at  Dariapur , in the evenings when drunk and stoned  bullies would start shouting and screaming, I would try to read my books even in a louder voice. As a result  the outside shouting would  stop. Our house in Dariapur was on the edge of a ruined cemetery; one Allu Mian, the caretaker of the Muslim  cemetery, used to make huts and do business with his two daughters at night. Their grooms used to work as brokers. That was my higher standard of learning abuse after Imlitla’s primary abusive words.. 
    In 1950, I was knocked unconscious in the Rammohun Roy Seminary, and the scars are still there. Signs of being infected. After reading  negative criticisms, I applied  my hand on the forehead and forgot the negotiator. When my father died, I was not present  during his funeral proceedings. After a few months, I was so depressed for not being at Dad’s bedside during his death,  that when I saw a saloon on the road in front of me, I went straight in and got my head shaved. I stood on the street and cried for him. Standing among the pedestrians and crying, it felt good, which was not the cry of collective mourning. I had tasted ice cream for the first time one day at school after we were tired after playing hide and seek in the evening. Tarun purchased a stick of ice cream and told us. “Today I am going to teach you all what is meant by communism. Take this ice cream and lick just once and pass it on to the next friend seated beside you and at the end let it come to me.” We were eight friends seated in half circle and licked the ice cream as much as we could ; Tarun did not get much and was happy with the stick left at his end.
    Overreading strained my eyesight even though there was electricity at Dariapur. I got specs in 1952, the year of my sacred thread ceremony when our family priest Satish Ghoshal gave me a mantra of goddess Gayatri.. My head was shaved and I wore a saffron Dhoti. I was required to perform puja twice a day, observe celibacy, eat only vegetarian dishes, no cereals on the eleventh day of the moon, no talking while eating out, and the sacred thread continuously on my left shoulder. I tried for a couple of weeks, gave up thereafter, just what Samir had done. Subarna was also from a Brahmin family and he continued to have the sacred thread entire life. Barin was from the Vaidya caste who got their sacred thread during their marriage. Tarun was from the lower caste. Once when we travelled to Kolkata on his maternal uncle’s truck and stayed with Tarun’s family, they arranged a separate place for me to stay. Tarun’s maternal granny came to meet me with lots of fruits and sweetmeats, placed them at my feet and paid obeisance. I was not accustomed to such behaviour even at Imlitala where we were surrounded by lower caste families. Tarun explained that the old lady continued with her custom and I should not bother. Thankfully such  practises have disappeared from urban Bengali society, though it still persists in far away villages despite left front rule for three decades in West Bengal.
    Performance wise I was average in High School, completed in 1954. Then I left home with Tarun, hitchhiking to Kolkata on his uncle’s truck illegally carrying old and sickly goats for slaughter and sale as meat. As interstate carriage of animals was prohibited by road transport, we feigned ourselves shepherds and herded the goats on the roadside grasslands, heigh-going them at the border checkpost into West Bengal where the empty truck was waiting after showing documents of an empty truck at the crossing. We took a bath at a village well in a bucket full of coldwater. At sundown, stopping at a Punjabi dhaba or roadside open restaurant, we ate handmade bread fried in sheep lard, p[ickled onion, and liquor made of mahua – my first taste of this intoxicant. The driver bargained with a village whore, went with her into the paddy field under a neap-tide eroded moon while we fought phantoms inside the dim-lit truck, after the driver offered us to go with the whore first. 
    During 1954-55 we made several such forays in bus, train, steamer, or jeep, visiting Allahabad, Jhansi, Kanpur, Ranchi, a hundred to a thousand kilometres from Patna. Anjali used to write me letters at Tarun’s address but she never gave me her own address. Amongst us Tarun married early and died also early, of leukaemia, though his father once visited Dariapur to tell Dad that Tarun died because of his association with a lecher like me. Tarun’s father had come across a letter written by Anjali after his death. Dad told Tarun’s father, I still remember, that it was Tarun who misguided me and I left home several times without telling Ma or Dad as to where I was going. Dad remembered my disappearance from Dariapur home and had talked to my daughter about it. Once my daughter Anushree, she was four or five years old, had asked me why I used to leave home without telling Dad or Ma. Strangely, neither Ma nor Dad admonished me after each of my return. But since then I have visited thousands of towns and villages in India. 
    My first two years in college were a real academic disaster. At school I had studied physics, chemistry, biology, mathematics, history, geography, along with Sanskrit, Hindi, Bengali and English. At college, on Samir’s advice, I opted for economics, political science and mathematics, though I was interested in English. I found interest in none, devoting most of my time at various libraries of the town gobbling up the history of literature of various languages, history of art, philosophy, and the lives of poets : Western and Eastern names started reeling in my brain. I felt shy of meeting Namita Chakraborty, who had become a teacher in the same school in which aunt Omiya was teaching the kindergarten children. I could not gather courage to visit Imlitala to meet Kulsum Apa either, just to tell her that I have entered college.
    For a year I joined the Infantry Division of National Cadet Corps run by the college as they visited several places for setting up camps and training the cadets in revolver and rifle shooting. We visited several places and enjoyed our collective visit to jungles before sunrise for shitting as the makeshift bamboo latrine was dirty. We sat in a circle and competed for the loudest fart. The mug with which we washed our arse had to be used for drinking water, tea and evening sweet rice-milk. Six or seven of us were accommodated in tents, practice marches in morning and evening and once a week we went for training in foring of two types of rifles and a heavy revolver. One of my classmates was so short and thin that the instructor had to press him down on the ground as everytime he fired the rifle he was pushed back because of the thrust. Even then I felt alone. After returning from camps I felt rootless, obscure, anonymous. My exam results were weepable, mainly because Dad,  Samir, Ma and my school teachers thought I was a good student. I was pulled down by mathematics as I did not like the subject and lost concentration whenever I tried to solve the mathematical problems.
    In 1956 I got admitted in Bachelors of Arts Honours in Economics, regular subjects being English, Bengali, Hindi, and politics. At Dariapur, an exclusive room on the first floor was at my disposal now, a steel table without drawers and a wooden chair without handles, a three feet wide bed, and three wall almirahs for college books and other books of my interest. These would become full when I would get introduced to Lawrence Ferlinghetti and Beat poets through Allen Ginsberg. I also got world classics from Prof Howard McCord of Washington State University who met me and my poet friends Debi Roy and Subimal Basak at Kolkata’s Ramkrishna Institute of Culture in 1965. Unfortunately, most of the books were stolen by young writers, during my thirtyfive month's absence due to the obscenity trial of my poem Stark Electric Jesus, who came to meet Ma in search of my whereabouts, but actually to steal books. Some of them told Samir after a few decades that they used to steal books from our home.
    The complete ground floor was used as a photoshop by Dad, with a studio having powerful bulbs the size of a football each, as photography was not invaded till them by electronics. Because of the electricity those bulbs consumed once they were switched on, the power line would snap and Dad had to send someone to the electricity company for an early connection. When Ma shifted from Imlitala to Dariapur, Dad would also inform Ma from downstairs that he was going to switch on the bulbs. 
    At Dariapur everybody slept on their respective mattresses spread on the floor. Dad was a few inches short that five feet. He purchased a five feet cot at a cheaper rate from our family priest Satish Ghoshal. After the death of a person  a ritual is performed on the 13th day. This ritual is performed to place the departed soul with the ancestors and God. During this ritual items are offered to the departed which he loved in his life. These items were collected by priests. One family had given the cot alongwith other things to Satish Ghoshal which he sold to Dad. Since most of the cots Satish Ghoshal used to get were not more than five feet, we did not purchase for other members and continued to sleep on quilt-mattresses spread on the floor. I purchased my own cot out of the money that I saved from teaching two school going boys at their home. Samir, when he got a job purchased a bigger cot for himself and his wife which was mostly used by Ma as Samir remained out of Patna till retirement being posted at various district head quarters as District Fisheries Officer. He used to bring lots of fresh fishes in his office vehicle when he came to Patna.
    Alone in my room I felt despair for no known reasons and attempted in March 1956 to get a few crystals of potassium ferricyanide from the downstairs photo studio used for making sepia prints. The pent up emotion withered of its own. To keep me absorbed Ma purchased a gramophone and some records containing songs of Rabindranath Tagore. I added some records of Hindi songs on Barin’s advice. Music did not become an industry till then. ্Playing gramophone records  became necessary to avoid the sounds of fighting between various groups of ruffians who also used weapons. Sometimes the Sunnis fought with Shias when police arrived and intervened. Once something was written in Urdu on a donkey which triggered a threeway fight between Sunnis, Shias and Hindus.
    I climbed this fence in 1956 to graduate in Economics. I can never memorise, so I would write a whole book over and over again to remember. Due to this writing, I could  impress a dimpled-cheeked Nepali classmate named Bhubanmohini Rana, a Mongol beauty wearing thick glasses; She requested for the copied books as my handwriting was good. We two became friends, Bhubanmohini agreed to my offer of kisses, whose name is Rano in the novel 'Rahu Ketu'. Only women know the magic of making a pulse. The subtle secret of repeatedly saying "I hate you" while having sex. I was a whirlwind in the previous birth, I will be a graveyard in the next birth. Many events will pass by, let go, as well as unimportant events will suddenly assert themselves with a blow, however, the chronological sequence of time does not seem urgent. 
     I wrote a poem in English for her, that is one of my last English love poems. Bhubanmohini was the only student in my class who drank liquor. She drank costly foreign liquor. Once I gave her rice liquor in a medicine phial and she gulped it straightway, Later, I talked about the  incident to Hindi writer Phanishwar Nath Renu, who said, “what have you done, do you know how powerful the Ranas are in Nepal, if they come to know about your affair, they will bury you alive”. I knew Phanishwar Nath Renu,  a famous Hindi writer  since 1950, who was injured in Nepal when he was fighting the Ranas, as a result had been admitted to a nursing home in Bhomra Pokhara, Patna, right in front of Sylvan House of my elder cousin sisters' in laws palace. Latika was a nurse there who fell in love with him and got married. Renu didn't know that I had started writing. After Samir's and my arrest in 1964, he found out, and regularly wrote about us in Hindi newspapers and magazines, while the Bengali newspapers and magazines were attacking us at that time. Renu also inspired S.H. Vatsayan Ajneya, who  took the pen for us. In Renu's book "Bantulsi Ka Gandh '', he has discussed our literary movement  in an article titled "Rampathak Ka Diary ''. I used to go to his house in Rajendranagar often in the evening to drink wine or toddy. I used to take marijuana with me. Renu was a rebel from the start of his authorial careerer. In 1942 he took part in the Indian Freedom Struggle. Later he participated in the Nepali revolutionary movement in 1950 which resulted in the establishment of democracy in Nepa Many young Hindi poets and writers also used to come. When they arrived in the morning, they used to drink palm toddy, by spreading cardamom powder on the drink. Renu died in 1986. Latika was taken by Renu's sons from first marriage  to their village, where she died of old age; she was childless. All his life he had raised the voices of the oppressed people in his novels and short stories. The way peasants’ issues were handled at the top level, worried him. He believed that people who are not aware whether paddy is a plant or tree, make policies for the farmers.  
     I kissed Bhuvanmohini in the dark of the evening, when I became sure that she was drunk, a state in which she allowed me to kiss her. After the kiss she slapped me so hard that I was scared someone might hear the sound of the slap and come to find out what was happening at the river bank . The sound might have reached the oarsmen of the tugboats who were ferrying bananas, lychees, mangos from the opposite shore of Hajipur. In return for the kiss, I wrote this poem for her called 'Exchange a Kiss': 
    Let your perfumed hallo 
    Fall for a few seconds 
    To enable me in picking up 
    Memory of Your Glance 
    You left in the notes I lent you
    Not for nothing! 
    At least you should Kiss on the exchange, 
    Even flying will do. 
    After listening to my poem she exclaimed, “my God, the cultural bastard has become a poet!” Thereafter she always kept me at a commoners distance, never allowing me to touch her queeny complexion, even while taking the notebooks from me, as if she was doing a great favour. I felt like a lecher, always getting attracted to girls with dimpled cheeks. I remember an incident with another teenage dimpled girl named Shefali who belonged to a refugee family staying in a forcefully occupied house, at Panihati whom I used to send Christmas and New Year cards to, as I was sure she had never seen such cards. Strangely, she knew who was mailing the cards to her and the cards reached Ma through my maternal uncles. But none of them ever talked about my shenanigans. 
    The years 1957-58 were the period of my introduction to poetry in a big way. I stumbled upon Bengali poet Madhusudan Dutt, who exemplified moral violence in his epic work ‘Murder of Meghnad’ in such deft rhyming that he proved somewhat curative for me — a stunning perceptual accuracy that instilled purpose. There was something beyond experience in him I became enamoured to. I hero-worshipped him, read the story of his turbulent life, allowed my scanty beard and moustache to grow like him, for which Subarna, Barin and Tarun made fun of me. Madhusudan embraced Christianity at the Old Mission Church, Kolkata, in spite of the objections of his parents and relatives. He experimented ceaselessly with diction and verse forms, and it was he who introduced amitraksar, a form of blank verse with run-on lines and varied caesuras, the Bengali sonnet—both Petrarchan and Shakespearean—and many original lyric stanzas.. 
    Ma found out that I was trying to write and infomed Dad, who instead of scolding  gave me an expensive diary of Agfa-Gevaert Company in 1956, and that's when I started composing poetry. When I found out that I wanted to build a collection of English language books at home, Dad would ask me to make a list of books. I would go to the bookstore and pick up the books and get them. Samir used to bring Bengali books, especially poetry books, from Calcutta. Later I also read a lot of books and magazines from foreign friends. During the Hungry Movement, the Calcutta police came to arrest me and took my books and threw them all over the house. They smashed the glass cupboards in the shop. The old costly sari of Ma’s marriage was torn from the fold when her  wedding trunk was opened with an iron rod. Police could have very well asked for the key. But when the police took me by the shirt collar and handcuffed me, I saw Dad in a state of shock, which was not normal. As a child I ran away from home several times; Back then, Dad didn't seem upset; He would not ask me anything in this regard. Later, he told my daughter that I was running away from home without informing them.
    Five
    My memory of India’s liberation movement is strewn with opaque scenes of Ma waving a tricolour in a crowd of Bihari ladies at Patna, horsemen ploughing through a procession, a fat lady donating her bangles to Gandhi under a green canopy, a leader in marigold garland, and a burned junk of a 1942 van on a road crippled with monsoon weeds. Ma told us a story about uncle Pramod one day came rushing with the news of firing and death of students who were trying to hoist the Indian flag at the Patna secretariat not far from his office. It was the morning of 11th August 1942, three days after the Quit India Movement was launched. Uncle Promod had described that around  6,000 students rushed into the gates of the erstwhile Patna Secretariat. They bore no arms and had a singular objective–to hoist the flag on the building of the Secretariat, without causing any damage–neither to lives nor the public property. It was also a reaction to the imprisonment of eminent Gandhian Dr Anugrah Narain, when he tried to unfurl the national flag in Patna. But the British were firm in their resolve to sabotage the movement. Their Military Police, under the command of the District Magistrate W G Archer, was tasked with nipping the movement in the bud.The Force tried to keep the students from reaching the Secretariat until 2 in the noon, but despite the resistance, the students marched on. Archer knew their strength was unmatched. He decided to open fire.But alas, the Brit Magistrate had forgotten that the men in his own police were Indians.When the Bihar Military Police and the Rajputs put their guns down, the British decided to use the loyalty of the Gurkhas against the students. They did not fire on the crowd directly. Their shots were measured and targeted at the group which broke away from the crowd.They wanted to kill the one bearing the flag. But the spirit of the men was such that when one flag-bearer was gunned down, he passed the flag on to his companion. The companion too was pushed to the ground by the barrage of bullets. And like flies they fell, one after the other.By the time the gunshots stopped, all seven were dead. Martyred in the name of the flag they wanted to hoist atop the Secretariat. A sculpture of those gunned down has been installed in front of the Secretariat. 
    Patna Secretariat had a clock like the Big Ben and the person who operated the machines was known to my Ram Mohan Roy Seminary classmate Tarun Sur. One day in 1952  he took us to the top of the secretariat where the clock machine was installed. We waited for some time and saw how the bell struck eleven times. We could see the entire office complex from there, though not the Ganges river. 
    When the British quit in 1947 I was eight years old, a student in Catholic school about to leave and join Ram Mohan Roy Seminary. I remember, most of foreign nuns and priests were leaving India along with the British rulers. Sweets were distributed by the school on the day of Independence. My Catholic school had the presence of Jesus, Mary, Joseph and saints in their premises and in the adjacent church, Ram Mohan Roy Seminary had none. If Hindu boys wanted to celebrate the festival of goddess Saraswati, they had to gather at the house of a Hindu clerk who used to install her in his house for a day. Samir had started worshipping goddess Saraswati at Imlitala after his thread ceremony due to which I did not go anywhere else. Samir maintained this habit till his death but I am unable to explain as to why I gradually lost interest in organised religion. 
    From the talk among elders I could make out that Dad had no good opinion of Gandhi, did not forgive Jawaharlal Nehru, who he insisted was responsible for the partition of the country and eventual plight of the Bengalis. He highly esteemed Subhas Chandra Bose, the nationalist leader, and believed that Gandhi and Nehru had conspired to evict Bose from leadership. But he thought that murder of Gandhi by Nathuram Godse was unnecessary as Gandhi had become irrelevant after Independence. Other uncles also did not have much knowledge or what was going on in the country, though uncle Biswanath used to make fun of Nehru and Edwina Mountbatten, wife of the last viceroy of India, based on gossip among the customers who visited our photoshop. He talked of open marriage of Edwina and Mountbatten, which he explained was a form of non-monogamy in which the partners of a dyadic marriage agree that each may engage in extramarital sexual relationships, without this being regarded by them as infidelity, and consider or establish an open relationship despite the implied monogamy of marriage. We failed to understand the relationship until we grew up. He also made fun of many leaders of the Indian National Congress party, who used to visit our shop to get hundreds of copies of their stylised portrait photographs for distribution among their followers and reporters. Discovery of electronics, computers and mobile phones have obviously been a boon for politicians and their publicists.
    We did not have photographs of any politician at Imlitala or Dariapur. Sabu and Dhabu’s Inlaw’s house had photographs of the British King and Queen Victoria, which was very strange as the family was staunch supporters of  Hindu Mahasabha, a Hindu nationalist party. Leaders of Hindu Mahasabha used to gather in their house and we were informed to enter their house through the side gate or not to visit during certain periods. 
    Pre Partition communal riots I do remember. Relatives from undivided Bengal had started to arrive at Imlitala house during 1946-47, whom we had not met earlier but our elders were known to and seemed happy to meet them after decades. There was a hush-up discussion about killings, we children could not make out for what purpose as our knowledge on such subjects were limited to ghost stories. Gradually it became clear that Hindus and Muslims are killing each other, but I could not make out why since relations were peaceful at Imlitala. Both Hindu and Muslim family members gathered at the tap square to fetch water. We purchased duck eggs from Kulsum Apa’s house as usual. Dogs of Hindu area were whiling away yawning time just as dogs of the Muslim area. When guests started talking about burning hutments, kidnapped teenage girl, religious howls in their village, shrieks, mutilated bodies lying in fields, vultures in the sky, people being chased by gangs, army patrols, caravans proceeding towards nowhere, I felt that something was wrong beyond Imlitala. 
    Dad had taken on rent a flat in the side lane of his shop in front of Bihar National College in which his shop helper Ram Khelawan Singh used to stay. We called him Dabur as he was earlier a worker in Dabur company. Dabur had to visit Imlitala house everyday for lunch and dinner. Though he was illiterate he knew by heart certain lines of saint poets such as Kabir, Rahim, Dadu and others. Since he was a servant, not authorised to scold us, he would be using lines from those poets in order to identify our mistakes. For housing the new guests who arrived at our place for shelter, the flat meant for Dabur was also used for them. Thereafter it became a regular place for housing distant relatives who came as  guests from Bengal, annoying Dabur who had to adjust with them.
    The seriousness of the situation percolated down to us when Dad informed us that he may have to keep the shop closed for some days and purchase our Durgapuja dress and shoes would be delayed. Dad used to go to his shop through either of the two roads : Gola Road surfaced with granite blocks or the dusty Bakarganj Lane. He had a fixed Muslim tailor in the Lane, and the members of the tailor family were all deaf and dumb. Probably as a favour, Dad had selected that family for the dresses of his brothers when things were peaceful and the relationship continued after children were added to our family. Dad would purchase in bulk the same cloth for all members of the family so that no member felt discriminated against. We had just to go to the tailor shop, they would take measurements and stitch our shirts or kurta or frock. Only I had another set of shirts and pants for my school uniform. We did not communicate with them as we did not know how to. Our dresses were ready in time before  Puja each year and this set of dresses was the only set for the entire year. But from 1946 onwards the system had to be discontinued as the tailor family, scared of riots in Bihar, left for Karachi where they had a few relatives. Dad replaced the Muslim tailors with a Bengali one whose products were not liked by any member as a result the system of a fixed tailor was discontinued. Similar to dresses Dad had a fixed shoe shop from where we had to purchase our shoes ; this was also for the entire year till the next Durga Puja. Samir used to use his shoes as goal posts during football in the nearby lawn with Imlitala boys and forget to wear the shoes while returning home. There had been occasions when Samir had to go to school without shoes. Ma had told me to go with the football team so that Samir did not forget to wear his shoes while returning home.
    It was Samir among the children who came to know that communal riots were occurring between Hindus and Muslims in Bihar as a repercussion of the killings of Hindus in Kolkata and a place called Noakhali in East Bengal. From him we came to know about Kolkata killings which started on 16th August of that year ; that for the Indian Muslim community a Direct Action Day was declared by their leader Muhammad Ali Jinnah, who wanted a separate country for them. Samir had the benefit of reading newspapers at Hulas Babu’s house. He was told not to discuss these matters with us children in the presence of our guests. Though the riots did not effect Imlitala, the urchins started annoying the dogs of Muslim area by shouting this slogan at them “Puri Kachauri Tel Mein, Jinnah Beta Jail Main.” After the country was partitioned a new slogan emerged for the urchins of Imlitala, composed by Hulas Babu, “Jawahar Lal Gelai Bangal, Tukra Karke Karlai Kangal.” Samir had gathered information that someone named Suhrawardy was responsible for the 1946 Calcutta Killings, referred to as the "Butcher of Bengal''.
    One day, when aunt Nandarani was hospitalised for a tumor operation, Gandhi was murdered. I learned of it in the evening sitting inside mosquito netting and completing class work, as uncle Pramod told everybody in a hushed voice. Dad was worried because Samir was to be sent to our maternal uncle’s house for admission at City College, Kolkata, after his matriculation in 1949. From our maternal uncle’s house at Panihati he was required to commute daily from Sodpur to Sealdah station and then on foot to City College. Sealdah railway station at that time was a site of refugee ‘settlement’ in the aftermath of Bengal’s partition. From 1946 to the late 1960s, the platforms of Sealdah remained crowded with Bengali Hindu refugees from East Pakistan. Some refugees stayed a few days, but many stayed for months, even years. Sealdah was a very busy railway station that uniquely shaped the experiences of partition refugees.T he railway platforms of Sealdah provided these refugee residents with certain opportunities. Many preferred to stay at Sealdah instead of moving to any government facility. However, even for the most long-term residents of Sealdah, it remained a temporary home, from where they were either shifted to government camps or themselves found accommodation in and around the city. The plight of these refugees were the first fount of our anger that catapulted our thoughts to a movement which came to be known as Hungryalism. On his way to college Samir had seen that both within and without the station buildings refugee families were living clustered together in filth and misery compared to which Imlitala slum was paradise and the dead body carriers tying together several male and female dead bodies of refugees being carried away for mass cremation. 
    Partition brought unknown Bengali families and their lingo to our surroundings. I will know more about the scattered refugees in India during my tenure as a rural development facilitator. In Bihar, these Bengali  refugees were first set up in a camp near Paschim Hazari area. They were then relocated to the 46 refugee colonies spread across West Champaran. Bihar still has 115 refugee colonies. West Champaran has the maximum, followed by 38 in Purnia and 13 in East Champaran. Many of the Hindu refugees from East Pakistan settled in Bihar are yet to be granted land and have no source of income. In a state in which caste plays a major role, these Bengali-speaking people are struggling for recognition. Each of the displaced families were given two types of land -- five acres for farming and 18 decimal to build a house, or four acres and 18 decimal land. They were given voting rights only  in 2015. Most of the refugees from the then East Pakistan belonged to the communities of Namasudra, Jalia Kaibarta, Sunri, Dawgarh, Pond, Bhimali, Mochi etc. Those communities were recognized as Scheduled Caste in the then East Pakistan. On their migration to the territories of India and settling in the State of Bihar, they were entitled to be declared as Scheduled Caste people and get the benefits available to the Scheduled Castes. 
    At Ram Mohan Roy Seminary just a couple of refugee students joined our class, Arabinda Ghosh and Mohan Rai. I developed friendship with Arabinda and visited his camp and was dismayed to find that several families were accommodated in makeshift bamboo rooms on a platform which earlier was a fish market. Even the smell persisted. The toilet was common and they had to take baths in the open. I met his father who came to know I lived at Imlitala and said he was working in a tin factory near our locality. From Arabinda I came to know that his father was a school teacher at Faridpur in what is now Pakistan and had to flee after their house was looted and set on fire, as a result he could not collect his certificates, degree and other documents.
    One day Arun came running and told us ‘someone is hanging, let us go and see, the entire Imlitala has gone there to find out who was hanging and why’. I accompanied him and found out that it was Arabinda’s father who had committed suicide by hanging. But I wondered how he climbed on that high beam. His stiff body was swinging two ways, once left another right. I had written a poem on the incident :
    Someone is hanging
    Arun said, “come, lets go and see, at tin factory someone
    Is hanging in circles.” I ran with him, hoping to see magic—
    They cut canisters and straighten them with a wooden hammer.
    How does the thin person wearing a shirt and dhoti climb so high ?
    Wearing specs ! I noticed carefully and exclaimed, “Hey Brother
    He is father of my class mata Arabinda ; because of partition
    He had to flee from Faridpur, used to teach at a school there,
    Had to leave behind his certificates etc in their burning house
    That is why did not get any job, at last the sounds of
    Beating tins told him everyday, “What a shame ! What a shame !”
    How did he climb so high ! Collecting the rope from tied tins
    Prepared a noose and now hanging, taking turn, once left
    H…i…n…d…u…s…t…a…n… then right.. P…a…k…i…s…t…a…n
    H….i….n….d….u….s….t…..a....n….P….a….k….i….s….t….a….n
    Arabinda left school after that tragic incident. I had visited the makeshift camp but Arabinda’s family had left. I found him many years later. That too at Uttarpara. He was entering a cinema hall. I thought he must have adjusted with life like millions of other partition affected refugees. 
    Not until 1956-57 was I able to get out of several self-contradictory opinions and confusion about Indian politics of our family members and allow the formation of my own ideas and views, clashing then with Dad and other uncles. Samir had the benefit of staying at Panihati where the maternal uncles regularly read newspapers and periodicals and mixed with local politicians. The leftists of various shadows were emerging in West Bengal due to refugee pressure. But Samir’s progressive and liberal leanings had been worrying our family eldes for quite some time. One day Samir had a heated discussion with Sabu’s husband Dinanath who was a rightist as well as communally inclined man, having huge cultivable land in a Bihar village named Tarwan. 
    Dinanath’s house was palatial. Samir used to organise dramas on assembled cots on which we brothers, sisters, nieces, nephews performed various plays. Since Sabu and Dhabu had command over various musical instruments we performed several plays by Tagore. Historical plays were also performed. But it had to be stopped after Samir’s friend Niranjan got an electric shock while connecting wires. Since we had a lot of space in our Dariapur house, uncle Pramod started an ameteur drama group after his retirement when aunt Kuchi’s father who was a famous actor in a professional Kolkata company came to visit us. He had come alone ; his wife Bibasana did not come with him. They staged mainly nonpolitical works, Hindu mythologies . There were no women in the group and some actors with somewhat feminine voices acted as female characters. Dad’s shop was closed for the weekly holiday on Tuesdays. Members of the group rehearsed their parts on Tuesdays only. Voices of silky goddesses or woolly monsters barged into my study upstairs in gargling voices, characters in beards of jute with silver painted wooden swords and tin crowns delivered dialogues in nineteenth century textbook Bengali occasionally interrupted by a sudden spurt of harmonium followed by a line of a song. There were lots of moustaches-clips which were kept in a room along with artificial weapons, smelly dresses, shoes for kings made of cloth and jute painted in black for women characters. 
    I never heard Dad singing or humming, nor other uncles. Uncle Pramod who had a sort of holiday gaiety, had a clarinet of his own and used to play it every week at Imlitala, though due to irregular use it had gradually become junk. Aunt Kuchi knew some imitation bharatnatyam. Nandarani Sang religious songs which everybody listened with folded hands. Ma did a little bit of one line when in a good mood.  That's all. My indulgence in music had to wait till a gramophone and records were purchased at Dariapur.  Samir, before he left for studies at Kolkata, sang  Ye Duniya Toofan Mail, a Hindi song from the 1942 movie Jawab in which the heroine and singer Kanan Devi sang it: that’s the name of a fast train of those days.
    Travelling from Patna to Uttarpara was a nightmare. None at Imlitala wanted to go to Uttarpara unless it was absolutely necessary. Grandpa used to travel by tug boat in those days on Ganges river upto Allahabad and from there to Delhi on Yamuna river. At that time there was information panic about the band of thuggees roaming on grand trunk road forcing him to avoid road travel till Allahabad, His travel to various places in present day Pakistan must have been for days and nights as he tagged his entire family with him. Probably the princely states might have provided their vehicles and boats. At Uttarpara house there were western dresses of grandpa which Samir and I wore for a long time. There were saris made of jute which were called koushiki which granny wore in winters. 
    Everybody who had to get to Uttarpara, first went to Howrah and took a passenger train back to Uttarpara. Obviously travel had to be in third class, the lowest and cheapest during British rule as Dad was not able to fund higher class travel.Third class consisted of plain carriages with wooden benches having insufficient space or facilities for sleeping and without lights, fans, toilets or even bars on the windows at first. These had doors opening outside, instead of inside, as was the norm in those days. Indians usually travelled in these and the coaches were filled with dirt and filth. They were like the general second class compartments of today, but only far worse. Dad talked of travelling next time in Inter Class which was better than third class.
    Fourth class was abolished by the expedient of providing benches in the carriages, thereby reclassifying these carriages as Third class. Consequently, the existing Third class was then started to be provided with cushioned seats and renamed as “Intermediate  Class” or  “Inter Class' '. These were, more than often, of five berth variety, with a central lower berth. This was possible owing to the width of compartments, there being no corridors. This gave more seating space during the day, which also meant they were more crowded than the First or Second Class compartments, which were very rarely overcrowded. Intermediate Class also had cooling fans but toilet facilities were of the Oriental variety rather than the Western style! Inter class was seen to be a class between the Second and Third, providing an economical form of travel with better seating and bit of better comfort for those Indians who were better off than the poorer majority who could only afford the lowest class of accommodations, and where they would not be bothered by the 'low-class' travellers travelling in Third class. 
    During British rule, First class and Second class were generally the domain of Europeans, although very wealthy Indians did occasionally travel in First class. The class system of the British Period as enumerated above, continued till 1955. During 1955, First-class was abolished and the erstwhile Second  and Inter classes were renamed as First and Second respectively, Third remaining Third. I remember, when Ma, Dad, Samir and I travelled to Uttarpara, Dad shove Samir, me and Ma through the window which did not have iron bars in a jam packed third class compartment. It was full of luggage and passengers, no space to drop a pin. I hoisted myself throughout the night on a gunny bag from which fresh potatoes peeped out. 
    Later a Janata Express was introduced which had only Third Class compartments. An extra coach used to be stationed at Patna for passengers to be joined to the main train. Whenever any member of our family went to Uttarpara, I would go to the railroad station a few hours in advance, occupy a berth in the compartment attached to the train, and keep a space for them so that they could join me about half an hour prior to departure. The train was invariably late, sometimes hours together, and the afternoon heat was unbearable as the fans were switched on only after the coach  was attached to the main train. Most of the trains ran on steam engines and that might be the reason for their delay. Samir, after he joined City College at Kolkata visited Patna only once a year to avoid train journeys. Travel might have been the main reason why elders did not bother to go on pilgrimages.
    Six
    My result of a B. A. in Honours Economics turned out quite good though I did not get the first position. A professor said that a lot of caste politics are at work in the University. Being a Bengali it would be difficult to secure first position. I was satisfied with my result but in later days when I entered the employment market I found out that securing the first position gives a boost to one’s curriculum vitae. It was easier to get admitted for an M.A. in the same subject in Patna University, where in the beginning of 1959 I got a glimpse of Toynbee, Marx and Spengler. Pages of their books had been removed in several places with the help of a blade in the copies available at the University Library. I went to other libraries, took notes, revelling in Spenglarian prophecy taking off from celebration of decentralisation espoused by Bakunin, Kropotkin, Godwin and wrote a hundred page postmodernist treatise, The Marxist Heritage. For the moral vacuum laid bare, the printed book gave me shivers. Moreover the responsibility of publishing the book was given by Samir to his poet friend Shakti Chattopadhyay, who was a drunkard and got the book printed on cheap paper with a dirty cover. I was annoyed with everything related to the book. I visited Shakti Chattopadhyay’s house at Ultadanga, Kolkata, and dunked all copies in gasoline and set them on fire, allowing Spengler to haunt me till I launched our Hungryalist movement with Samir and Debi Roy.
    Samir got a fisheries officer’s job and was posted first at Dhanbad where I met his poet friend Dipak Majumdar who inspired me to read about philosophy of history. Samir was then posted at Bhagalpur where he stayed with a few bachelor friends one of whom was Biplab Bandyopadhyay who got married to a girl named Dolly whose marriage Samir attended at Chaibasa. There Dolly’s elder sister Monti fell in love with Samir after listening to him about poets of Kolkata and their activities. Samir got attracted to her and got himself transferred to Chaibasa, at that time a tiny hilly township of tribals surrounded by green sal, sesame, and teak trees splashed in spring with scarlet splendour of kapok and kino flowers. He took on rent a two-room thatched hut on a hillock touching the moon. Distant cool nights flickered in the villages below amid the sweet aroma of hand pounded tribal rice, roasted pigs, faint drum beats, sparking laughter of Santhal and other tribal women. During the day fowls fought each other with knives tied to legs, a gambling sport, and overloaded ricketty buses passed by. I visited Chaibasa during vacation, and again after completing my M.A. The results were exemplary in view of my preparations. The caste factor did not allow me to top the batch and some professors again egged me to approach University Syndicate to re-evaluate my papers. I did not get into the caste politics of the University.
    Samir wanted to stay at Chaibasa to be in touch with Monty and decided to marry her younger sister Bela. Dad had no objection as he did not know the reason for Samir’s sudden decision to get married. When Monty was asked by Samir’s poet friend Shakti Chattopadhyay as to how she was maintaining a balance between her husband and lover, she replied that she has informed her engineer husband that Samir was a man of literature and she was in love with him and she did not want to desert her children and husband. Monty and Samir maintained this strange platonic balance lifelong. Bela knew about it which made Samir somewhat dependent on her wishes and orders. It was some sort of a family straight out of Emile Bronte fiction with the gentlemen having eight daughters and two sons. I thought it better to keep myself out of the reach of the ladies though Bela used to bring her sisters one at a time to enable me to get involved.
    Ma and Dad never knew about Samir’s involvement with Monty though Shakti Chattopadhyay had written about the affair in his novel ‘Kinnor Kinnori’. Though they were sometimes surprised by the behaviour of Bela. They never enquired as to why Samir got himself transferred to Chaibasa quite frequently even after getting married. When Samir constructed a house at Kolkata and resided there after retirement, Monty used to arrive at his house as a guest along with her children. After Ma’s death, Bela seized Ma’s gold and silver ornaments, prizes of grandpa received by him at various photo exhibitions, property documents etc. She threw away the portraits of aunt Nandarani, Omiya and granny painted by Anil as well as landscape paintings by Pramod. She also threw away the large photographs of Tolstoy and Tagore. She dismantled Ma’s puja table and did away with the small idols of goddess Saraswati and lord Ganesha – Ma had become a little religious at the end of her life. All these things happened during Ma and Dad’s absence from Patna as they were with me at Lucknow. Ma died in Lucknow due to a heart attack. I feel that I am responsible for her death. When I visited Patna after her death I was stunned to find that attempts had been made to erase her memory from Dariapur house. Samir probably suffered from guilt and kept quiet.  Since Samir had installed his elder son on Dad’s photoshop and did not allow Dad to take his regular seat he left Patna and went to Kotrong to live with Biswanath and Kuchi. When I went to meet Dad at Kotrong I found that Dad also believed in the tricks of Biswanath regarding the supernatural power of goddess Kali in their room. Samir was worried that Biswanath may trick Dad and get a legal document signed to get Dariapur house transferred in Biswanath’s name ; he went to Kotrong and brought Dad back to Patna.
    Dad was not happy at Patna and wrote letters to my wife and daughter about his treatment by Bela. I was posted at Mumbai at that time and both me and my wife were office going and the children were school going. I thought who would look after Dad in our absence and did not bring him to Mumbai, a decision for which I repent whenever I think about him. Dad had directed my wife and children to write him letters at Sabu-Dhabu’s address so that Samir and Bela could not read the letters. I used to send him money at Sabu-Dhabu’s address. When Dad died I was on official tour at Bhubaneswar and could not attend his funeral. About a year later I felt very depressed and got my head shaved in memory of Dad. When I visited Dariapur after Dad’s death I found that his memory has also been erased by Samir’s son. His studio had vanished and stacked with photo items. The name of the shop was changed. Most of the side doors of the shop were blocked with bricks. 
    I am getting carried away remembering Ma and Dad. Let me return to my University. After my disastrous start as an author I indiscriminately stormed through whatever works I could lay my hands on : Rimbaud. Poe, Baudelaire, Apollinaire, Pound, Eliot, Rilke, Mallarme, Mayakovsky, Lorca and obviously the thirties poets of Bengal , Jibanananda Das, Vishnu Dey, Buddhadev Basu, Premendra Mitra, Samar Sen, Amiya Chakraborty, Sudhindra Dutta, whose books Samir brought to Patna to add to my personal library. He also brought little magazines run by mentors of various groups.  Surrealism thrilled me. I could imagine myself on the streets of Paris, Madrid or Moscow with a young Andre Breton or Jean Coctau. Samir published the first collection of poems of Sunil Gangopadhyay from his first salary as a Fisheries Officer.
    From the notebooks I maintained, Samir copied a couple of poems and got them printed in Krittibas poetry magazine in 1959 which was edited by Sunil Gangopadhyay and funded from time to time by Samir. I feel quite embarrassed even now for these poems as I wanted to do something historical, an entry with a bang, an event to remember in literary history, which I eventually did in 1961 with launching the Hungryalist movement. 
    My perception of Bengali literature was that it had a place in the sun. notwithstanding its treatment in Western academic circles and the media as a language of a handful. A Nobel prize to Tagore was the last glory in 1913. I wondered about the limitations of Bengali not being talked about  in international literature as French, German, Italian, Spanish, Russian, Portuguese were, though some of those countries had less population than Bengali speaking people. No doubt the Indian government was spending millions to sponsor Hindi which was not my mother tongue ; something had to be done in Bengali literature itself. I felt.
    I found that most of the editors of literary periodicals, called ‘Little Magazines’,  were not conversant with international writing standards, read very little, detested the avant garde, and had contempt for experiments in prose and poetry. Bengali novels, mostly pulp fictions, thrived on the market of half-literate ladies. Poems were time servers, filling up spaces for which no advertisement could be procured. Bearded gentries in kurta-pyjamas stitched in handloom cloth, which Allen Ginsberg copied when he stayed in India during Sixties, with dirty sling bags passed for poets, even the films invariably depicted them in such fixed attire. The entire corpus after Tagore had been a soft option for the creative writer, articulated in a language not spoken in a common Bengali household. Most of the poets till then were from upper castes, that is, Brahmin or Kayastha from urban areas. Poetry magazine edited by Buddhadeva Basu, Sunil Gangopadhyay and Aloke Sirkar abstained from publishing works by lower caste writers. 
    I was a tortured soul after watching the plight of refugees at Sealdah station while going with Samir from Panihati to Kolkata. Samir was also very disturbed. We knew we could not do anything alone. We did not have money. We  did not have access to reputable periodicals. We did not have any group ; Samir was not in favour of associating Krittibas with our vision. We did not have a mentor or a sponsor. I did not know famous writers and poets in Kolkata. Samir thought those intellectuals were urban and did not have a background such as that of Imlitala. 
    I found a queer name in a little magazine in early 1961,  Mr Haradhan Dhara, traced him out in a notorious slum at Howrah on the other side of river Ganges on the shores of which Kolkata stood. The slum was stinky, winding through a buffalo-shit lane on to a hay-roofed mud tiled clayhut with small cane windows nibbled by termites. In the middle of the room lay a high squeaky antique bed beneath which were stacked old magazines, newspapers and books gathering dust. Further magazines were sprawled around with no room to move about except for a folding chair offered to me.  De Roy, which was Haradhan Dhara’s pen name, belonged to lower cultivator ‘Kaibarta’ caste, had worked as an errand boy in a pedestrian restaurant, as a taxi washer, did not have any knowledge of world literature till then, had written a few poems rejected by reputed periodicals, and could not speak English well. Could be a genuine anchorman, I felt. His parents, like mine, had never gone to school. He himself had completed school studies and was thinking of completing graduation after sometime. Presently, he was employed as a clerk of the Indian Postal Service, a Central government secure job.
    We sat together on the clay verandah beside heaps of gourdseed and pond snails which were to be shelled by his mother for sale in the market. There were other such one-room huts around a clay compound the residents of which did not have an attached bath and had to take bath outside the compound in a tube well meant for all, the toilet also was common and the residents were required to put their washing mug outside the door to indicate that someone was inside.
    I gradually explained my views of unleashing a sociocultural and literary movement to be called “Hungryalism”. I had concentrated on the word ‘Hungry’ from Chaucer’s prophetic line “In the sowre Hungry tyme” with a Spenglarian perspective of the assimilation of cultures and ultimate decline thereof in view of the overwhelming infiltration of an alien ethos into Bengali culture. Oswald Spengler wrote a book ‘The Decline of the West’ in 1918, in which he wrote that the fate of civilization was a matter of ‘destiny’. He saw society moving in continual cycles of growth and decay. The Roman Empire rose to power and then gradually collapsed. The British empire grew strong, and then deteriorated. Spengler believed that social change may take the form of progress or of decay, but that no society lives forever. Arnold J. Toynbee, the noted English historian, has also propounded a cyclical theory of the history of world civilization. He maintained that civilizations pass through three stages, corresponding to youth, maturity and decline. I told him that Hungryalism was a postmodern idea, not a philosophy, but rather the apotheosis of self-expression, which accepted contradictions as a part of the human condition. Not a theory.
    Debi Roy was happy with the coinage from a different perspective, as he thought Hunryalism suited for economic nightmare of a post partition society suffering from unemployment, shortages of food and clothing, inhuman living conditions, hunger of body and soul, mind and being, essence and existence, matter and spirit, known and unknown.
    Samir discussed the idea with poet Shakti Chattopadhyay who was staying as Samir’s guest at Chaibasa continuously for three years, drinking mahua-made liquor in the evening and writing love poems for Samir’s sister in law Sheela. Samir brought Shakti to Patna and I invited Debi to come down. We four sat together and discussed our future course of action. It was decided to print one-page handouts initially, when and as money permitted, for distribution, not for sale, bringing gradually within our fold like minded poets, writers, artists, activists as a beginning of a multicentered formlessness pervading all diversity where the individual was whole and the whole was individual.
    In April 1961 I got a job in the Reserve Bank of India with a monthly salary of one hundred and seventy rupees ( ten dollars at that time ) which required me to write owners' names on gilt-edged bonds. From this work I was shifted to another type of job which forced me to leave the Reserve Bank of India. At that time rotten, soiled, torn etc bank notes were recounted before destruction and put into an incinerator for burning. The notes were so dirty and fungus ridden that I started suffering from various ailments. There were risks involved as well. It was difficult to keep a watch on those young men who used to recount sample packets before destruction because one never knew whether some banknotes were being pilfered. When I left the job and joined Agricultural Refinance and Develop Corporation, some fellows were arrested by the Police for pilfering banknotes in an organised way. Based on the bank notes burning experience I wrote my first novel in 1994 titled ‘Dubjaley Jetuku Proshwas’ which was published in ‘Haowa49’, a literary periodical started by Samir in early nineties after he constructed a house at Kolkata.
    It was difficult to get Bengali scripts printed at Patna at that time since the printing presses did not have arrangements to get Bengali matters printed other than funeral, wedding etc cards. I was forced to write in English, a language in which I did not have command, to get a thousand copies of handouts printed for distribution at Kolkata’s intellectual joints. First such handout I wrote was on poetry in November 1961, and sent the entire lot by mail to Debi Roy. He distributed it in the Albert Hall Coffee House on Kolkata’s College Street, Language departments of Kolkata University, Colleges, newspaper offices and residences of poets and writers. 
    The effect of the first handout was stunning as it started a swelling of the ranks and provoked editorials and literary headlines in newspapers and periodicals. Free distribution created a magic as compared to selling magazines, though some people thought them to be advertisements of some sort, crumpled the handout and threw it away. The Hungryalis – later Hungrealist – bulletin went from one page to twenty pages, in Bengali, in quarto to scroll size, woodcut designed cover to offset, black and blue prints to hand paint, when Samir and I both started sending money to Debi Roy for getting the bulletins/manifesto printed at Kolkata. 
    Between 1961 and 1965 about a hundred bulletins were released by participants, of which nine are preserved Sandip Dutta in the archives of the Little Magazine Library and Research Centre and a few at Bangla Academy, Dhaka. Samiran Modak, a researcher, is trying to collect as many bulletins as possible from various sources in order to compile them in an anthology. 
    Poets, authors, artists, activists who had joined the movement are Subimal Basak, Rabindra Guha, Sankar Sen, Arupratan Basu, Basudeb Dasgupta, Ashok Chatterjee, Pradip Choudhuri, Binoy Majumdar, Amit Sen, Amrita Tanay Gupta, Sayyad Mujtafa Siraj, Bhanu Chatterjee, Utpalkumar Basu, Tridib Mitra, Alo Mitra, Falguni Ray, Satindra Bhowmik, Sambhu Rakshit, Tapan Das, Sandipan Chattopadhyay, Anil Karanjai, Subhas Ghosh, Karuna Nidhan Mukhopadhyay, Ramananda Chattopadhyay, Subo Acharya, Saileswar Ghose, Debasis Bandyopadhyay, Sukumar Mitra, Mihir Pal, Arani Basu, Arunesh Ghosh and Abani Dhar. Subimal Basak did the woodcut covers and line drawings, Anil Karanjai and Karuna Nidhan painted posters. The posters and line drawings on paper were regularly pasted on the walls of Albert House Coffee House and Presidency College.
    I had drafted the manifestoes on poetry, prose, politics,  religion and obscenity for the Hungryalist movement, reprinted at that time in ‘Kulchur’ 15, USA, edited by Lita Hornick, Salted Feathers 8/9, Portland, USA edited by Dick Bakken and Lee Altman, Klactoveedsedstene  edited by Carl Weissner of Germany. Carl Weissner later edited ‘Intrepid #10’ along with Alan De Loach which included our works.
    The Bengali press had started writing against the movement. Here is a news item published in the 16th July 1964 issue of The Daily Jugantor : The news of the staff reporter in the daily Jugantor under the headline 'Beatlemie in literature'.
    "The real place of the politician in modern society will be pointed out - that place is somewhere between the corpse of a prostitute and the tail of an ass. - The announcement is made by a group of people who identify themselves as a literary group. However, they also have politics and this quote above is one of the ten point objectives of that politics that has been declared. Their declaration of poetry is even more striking - ‘the collection of poems is more beautiful and enduring than the wife. A married woman becomes a cover under a two-day-old book, but the woman of poetry clings to you day after day. 'The young people in Calcutta who started this movement of 'extra adventure' and 'ignoring guardians, society, literary decency, even the police' in 1971, have dubbed themselves 'Hungry Generation'. According to their spokesperson, the movement has attracted at least 50 young people in Kolkata in the last two years. They range in age from 18 to 32. Among these young people there are people of different levels like employees, professors, students etc. They hang out in a few restaurants, bars, sometimes on the sidewalk in central Kolkata. They have no aversion to cannabis etc. The police are keeping a close eye on the gangsters in search of sewage pantaloons and needle shoes, while the Hungarians object when they identify themselves as Beatles who are going to pull marijuana from the Ganges. (Because they are intellectuals). Global Yoga: This group's communication is global. Photostat copies of their bulletins can be found in the New York Public Library and the British Museum. A well-known London publisher has decided to publish a paperback collection of their poems. The Citylights Journal of San Francisco (No. 1) has published a manifesto on their poetry. Mexico's Elcarno Emplomado introduces them to Spanish speakers. Angry people from England and Europe contacted and applauded the Hungarians. Who pays to run this movement? They say the money comes from a sari-wearing minister, Jharia Mining Workers Association, Baruipur Exercise Society, Jogmaya Club, an actress, an influential person from Pakistan and a secretary of the Hindu Mahasabha. Bibliography: Members of their group publish bulletins on literature, politics, society, and practice literature in a few Little magazines. The names of some of their members' books - 'Triangle of flesh and us',' Ghost talk with horse ',' Broken car porch ',' Devil's face ',' Round darkness', 'Bastard', 'False cable', 'Rape' etc. Their works are not published in any of the literary magazines which were once started by them. So one day they went to a paper office and said with a few foolscap papers - this is a story that needs to be printed. They sent a shoebox to 'review' the book review column. "
    Reacting to the political manifesto The Daily Jugantor wrote main editorials on two consecutive days. 
    On 19th July 1964 the editorial had the Title: 'No More A City of Processions’ : "The long-standing distrustful politics in West Bengal is busy chewing its head today. Is it because of this weather that a kind of pessimism is emerging in the society, whose appearance is like a drainpipe mastani, whose voice is being terribly expressed in the whistles of the street romeos and the ‘frivolity’ of literature? It is not surprising, therefore, that the worshipers of these perversions, who bear the name of 'Hungry Generation', want to point out the place of politicians 'somewhere between the corpse of a prostitute and the tail of an ass' in utter disrespect. Is this the curse of the infertile politicians or the curse of the sick society?”
    Tabloids had headlines such as ‘Hungry Dynasty in Anglo-Bengali Literature ( Desh ) ‘Angels are dangerous’ ( Chatushparna ), ‘Is it irresponsible madness’ ( Darpan ), ‘What is waywardness in literature and why’ ( Amrita ), ‘Sexual perversion in the name of literature’ ( Janata ), ‘Erotic lives and loves of the Hungry Generation’ ( Blitz ), ‘Vagabond community’ ( Jalsa ). In order to react to these senseless headlines we printed REMOVE YOUR MASKS on hundred paper masks of various animals and demons and sent them to the editors of these tabloids as well as to various persons considered to be leaders of Kolkata’s cultural establishment. In another lot we got printed this slogan inside Bengali wedding cards : FUCK THE BASTARDS OF GANGSHALIK SCHOOL OF POETRY. There was no such school of poetry but poets who used nature as their subject got offended. The same card invited persons to visit Lindsay Street to view a topless exhibition. Nobody thought that a wedding card could be sabotaged in such a way.
    Hungry activists had gathered in Khalasitola to celebrate Jibanananda Das's birthday. Abani Dhar got up on the table and started singing this song with dance, which he used to sing while working on the ship, with the foreign sailors. Everyone present, even some from the Hungry Movement, thought the song was nonsense, because they did not know such words in English. The journalists who came to cover the news also thought that the song was an insult to the Hungry Movement. The next day, The Statesman broke the news. In that week's Amrita magazine, a two-page joke was written under the headline 'Lost Generation', with a cartoon of Abani Dhar.
    The person who used the term 'Lost Generation' in 'Amrita' did not know that the phrase was coined by Gertrude Stein and Ernest Hemingway, F. Scott Fitzgerald, T., who took refuge in Paris in the twentieth century. S. Elliott, John dos Pass, E. E. Cummings, Archibald McLeish, Hart Crane and others were called members of the Lost Generation. The song is sung to a special tune by Mozart:
    Ging Gang Goolee, Goolee,
    Goolee, Goolee Watcha
    Ging Gang Goo Ging Gang Goo
    Ging Gang Goolee, Goolee,
    Goolee, Goolee Watcha
    Ging Gang Goo Ging Gang Goo
    Hayla, Hayla Shayla, Hayla Shayla Hayla Ho-o-o!
    Hayla, Hayla Shayla Hayla Shayla Hayla Ho-o-o!
    Shalawally hallway shalawally shalawally!
    Oompah, Oompah, Oompah, Oompah! 
    Many people are not familiar with the name of Abani Dhar. Those who have not heard his name and have not read his only book, One Shot, know that the definition of short story is to say that Abani Dhar was the greatest short story writer of the Hungry Movement.
    Dancing together was a favourite act of the Hungryalists when friends got together. Once myself and Subimal Basak had gone to Champahati with Ashok Fakir who arranged opium for us and we danced like mad at the station in the rain. Ashok Fakir ditched his Bengali wife at Champahati and went to the USA with an American lady. We also danced when we gathered at American poet David Garcia’s hotel room in blaring western music. Later I danced with poet Kedar Bhaduri and Uttam Das after a few pegs in Kedar’s small room. 
    Actually I did not know all the Hungryalists personally as it was Debi Roy and later Subimal Basak who did the organisational work. I knew the authors, however, who came to be known as major Hungry Generation writers, poets and artists and was in correspondence with them : Sandipan Chattopadhyay, Shakti Chattopadhyay, Debi Roy, Saileswar Ghose, Subimal Basak, Pradip Choudhuri, Utpalkumar Basu, Subo Acharya, Falguni Ray, Alo Mitra, Tridib Mitra, Subhas Ghose, Arunesh Ghosh, Anil Karanjai and Karuna Nidhan. Binoy Majumdar wanted to be designated as leader of the movement, which I did not know, as he was a schizophrenia patient and crossed the border without a passport and went to the then Pakistan where he lived a happy life with poets of Faridpur and one day surrendered to local police who helped him to cross the border to India.
    Later Falguni died of real hunger and overdose of drugs like his elder brother Tushar who was associated with Krittibas group. Falguni used to complain, when he came to Patna to reside with his sister, that Tushar beats him up every now and then for being a part of the Hungryalist movement. Falguni was in love with a Kolkata girl who was married to a Patna boy. Arunesh Ghose died by drowning, probably a suicide. Saileswar Ghose died on the operation table after a heart attack. Same was the case with Subhas Ghose who had joined the Communist Party of India ( Marxist ) and had become a local committee member at Chandannagar, a strange decision as he posed as an anti-establishment activist at Kolkata and a part of the ruling party at Chandannagar. Tridib and Alo gave up writing due to machinations of Saileswar and Subhas. Subo Acharya joined a religious sect led by Anukul Thakur and discarded literary activities. Basudeb Dasgupta and Abani Dhar got a house at Ashoknagar under refugee settlement scheme. Funny to note, a police informer by the name of Pabitra Ballabh had infiltrated the movement keeping a tab on us ; we did not even notice till he spilled the beans by becoming a police witness against me during my obscenity trial. 
    Till 1963 I visited Kolkata quite frequently, staying at our ancestral house in Uttarpara, aunt Kamala’s house at Ahiritola, Debi’s place at Howrah, or in Subimal Basak’s uncle’s goldsmith shop, which did not have a window, ceiling fan, lavatory, compelling me to go to the nearby Sealdah railroad station, where I used the toilets of arriving long distance trains. We slept on the cement floor using old magazines wrapped in our shirts for pillows. The shop had a castor oil lamp which Subimal Basak made use of at night for drafting his novel ‘Chhatamatha’ , written in the dialect of horse cart pullers of Dhaka. Subimal himself did not have a permanent place to stay at that time and mostly lived with his uncle at Dumdum. He later constructed a house after his marriage just by the side of Belgharia station. Subimal was beaten up in December 1963 at the entrance of the Albert Hall Coffee House by a group of status quoists hostile to our movement. 
    The Bengali press was comparing our movement to the Beat Generation. They never bothered to compare our financial and cultural background with those of Beat generation writers and poets. We all came from poor families as cultural outsiders or The Other. Subimal Basak’s goldsmith father had committed suicide by drinking nitric acid as a result of gold control orders of Moraji Desai and had to look after his mother, brother and sisters. He belonged to the weaver caste. Subhas, Saileswar, Pradip, Subo, Abani, Basudeb were from refugee families trying to get settled in West Bengal. 
    Most of us were first generation literates, whereas the Beats came from rich educated families. Allen Ginsberg’s father was himself a poet. Burroughs was born into a wealthy family in St. Louis, Missouri. He was a grandson of inventor William Seward Burroughs I, who founded the Burroughs Corporation, and a nephew of public relations manager Ivy Lee. Kerouac was a capable athlete in football and wrestling. Kerouac's skills as a running back in football for Lowell High School earned him scholarship offers from Boston College, Notre Dame, and Columbia University. He spent a year at Horace Mann School, where he befriended Seymour Wyse, an Englishman whom he later featured as a character, under the pseudonym 'Lionel Smart', in several of Kerouac's books. He also cites Wyse as the person who introduced him to the new styles of jazz, including Bop. After his year at Horace Mann Kerouac earned the requisite grades for entry to Columbia. Gary Snyder’s mother , Lois Snyder Hennessy (born Wilkey)] worked  as a reporter for The Oregonian. Diane Di Prima’s  father Francis was a lawyer, and her mother Emma (née Mallozzi) was a teacher. All these Beat writers and poets had enough money to travel all over the world whereas the Hungryalists found it financially difficult to go to Kolkata from their home.
    There were other strange happenings too. Several Kolkata presses refused to print Hungryalist bulletins ; some of the owners said that they had been warned by reputable persons. Pradip Choudhuri was expelled from Visvabharati University, Santiniketan for his poems. Subhas Ghose was notified to vacate his rented apartment by the owner. Pritam Book Stall at College Street Corner was threatened by a gang for keeping our bulletins for sale.Pressure kept on mounting. Refusal of auditoria led us to read and recite our poems at Howrah station platform, parks, graveyard of famous Bengali poet Madhusudan Dutt, crematorium at Nimtala, Khalasitola rice liquor den to the attention of growing crowds everyday. The main theme that our movement was foreign inspired and against Bengali culture continued in the afternoon papers. 
    Allen Ginsberg had met Samir in 1962 when he visited Chaibasa. He met me at Patna in 1963. I translated his HOWL and Kaddish much later, in 1985-86 after receiving copies from Lawrence Ferlinghetti. None of the other Hungryalists had read Beat literature till then and none had met Ginsberg, Orlovsky and Snyder when they came to Kolkata. In the sixties I had translated poems of Neruda, Lorca and Artaud. 
    All these three years from 1961 to 1963 I had been working  on ‘Shoytaner Mukh’, a collection of my poems. Samir selected some of them for their ratiocinative abstraction and total effect in terms of sound and sight. Sunil Gangopadhyay of Krittibas Publishers agreed to publish the book. There were guarded critical reactions to the book at that time. Sunil did not talk about the book as he proceeded to Iowa Poetry Workshop and was disturbed to find the Hungryalists being published and talked about in American little magazines whereas Krittibas poets were not even known to readers. The cover of ‘Shaoytaner Mukh’ was based on a drawing made available by American poet Margaret Randall, editor of El Corno Emplumado, who was based at Buenos Aires at that time. Margaret Randall is now known as a rebel poet both in English and Spanish ; she was later associated with sandinistas. 
    Explaining Bengali etymology in the costume of a Bengali jester, I wrote a drama, ILLOT, assured of being staged by Nripen Saha of Gandharva. He retained the manuscript for a year then developed cold feet because of its political overtones. Sandipan Chattopadhyay gave the manuscript to Kumar Roy, the editor of Bahurupi who refused to print ILLOT in their magazine. 
    Seven
    Sunil Gangopadhyay’s friends were instigating him about our activities in Kolkata which agitated him at Iowa. I also wrote a letter to him about the upheaval created by us. He responded by writing angry letters to me, Sandipan Chattopadhyay, Shakti Chattopadhyay and Utpalkumar Basu. He did not write a similar letter to Samir as Samir was trying to convince him that there was not much difference between the Hungryalists and Krittibas. The letter written by him to Sandipan has been translated in English and available in the net which reads as follows :
    313 South Capital, Iowa City, Iowa, USA, 15th June 1964
    Sandipan
    Right now I am resting beneath the canopy of a big tree on the bank of this river. It is quite breezy. And 5 dozen cans of beer lie littered. Been watching that blonde girl in a swimsuit . Once in a while I am mildly adoring her bottom with my feet—- how does that look visually ? I am literally resting in this state. But I am not part of this scene though. As soon as I bring my palm closer to my eyes, everything disappears. No woman’s face. No hunger. No thirst. But beer—- yes, that is a reality. Have been resting on the grass for hours so to say. Tried at least 5 times to catch a rabbit but failed miserably.
    I was in love with your letter for a couple of days. Especially the words highlighted with red pencil. I knew pretty well that you would not like my story. I have no illusion of delighting you ever with my prose. That is because you have written some great prose at one point. Not any more. But the kind of magic you have produced—- we are simply not nearer to you. I cannot write such prose. I will not write such prose. But that kind of prose pulls me irresistibly. That you will be one of my readers makes me fearful. Still I write prose. Mostly for money. I do not recall indulging in prose but for pecuniary considerations. Once I had written a novel— quite unlikely that it would ever get published. I do not fear you though for my poetry. I write poetry similar to prose and shall continue to do so. I have no qualms about that kind of style. Shakti ( Chattopadhyay ) has written some extraordinary lines. Much, much deeper and greater than me—- that is Shakti. I respect him a lot. But his poems are headless. I cannot write like him and do not want to write like that simply because I do not live that kind of life. I can relate much more to Utpal ( Kumar Basu ). But this, my slumbering in beer, makes me oblivious to all poetry. There is no poetry, no heart, nothing.
    Sandipan, why have you not written much in recent times ? What are these quirks of occasional pieces ? This habit of yours has attracted you to the Hungryalist hullabaloo– the latest fad. I had forbidden you. But you did not trust me. And then you quietly distanced yourself from me. I did not stop Shakti. Shakti is greedy. Utpal too has chosen that path. However, I thought you were not that greedy. I have often shared a bed with you, stood in the same shadow while walking in sunlight. I very well have the understanding of my own greed. And, as a result, I could instinctively estimate that your greed is less than mine. I became deeply uncomfortable with, in fact felt strong aversion to this New Phenomenon. I had always felt that writing poems in English in order to earn cheap accolades from the West is the worst possible example of greed and a manifestation of utter narcissism.  This inner feeling has deepened this time after coming here, to Iowa. Would you ever like to be an object of curiosity and pity to non-Bengalis ? I have met some Hungryalists here– it is these people who are  attracted to  them. Every single day I receive some request or the other to contribute in English. I have been refusing, steadfastly. There are seven crores of potential Bangla readers for me. Much more than French and Italian. I am fine with it. I write poetry and have no intention to translate my sensibilities. If you wish to enter my world of thoughts in English— then get me translated. In gay abandon. I had officially come here to do this kind of quid pro quo back-thumping. Till now I have resisted this trap.
    But the real problem with Hungryalism is not English. Their Bengali is even worse. They are trying short-cut narratives — the idea is to taste ready-made fame by criticising and denigrating others in this business. I hope you do not end up thinking that Malay (Roychoudhury )  really has some authorial qualities in him ! I am amazed because recently I have read in a Hindi literary periodical an eulogising piece by you about the Hungryalist fad. I was rather surprised that a thinker so abstract as you could consider that contributions in the Illustrated Weekly ( edited by Khushwant Singh ) merit any real literary discussion ! I know the Hungryalist participants have made efforts to challenge  Krittibas ( periodical ) or Sunil ( Gangopadhyay ). I could have destroyed their Movement. Yes, I could. But I refrained. I am telling you these things because I so much admire you as a writer and thinker. There is no conspiracy in this exhortation of mine, Sandipan.
    I could not properly comprehend  the events that have been taking place at your end. Why did you write the same letter to four of your friends—- to us ? I could not fully grasp this technique. Nevertheless, who has ordained me the right to understand how your mind functions! That point is that once I return to Kolkata, I shall sleep peacefully, will roam around light-footed quite happily. I do not require any Literary Movement. I was wonder struck to know as to why Malay ( Roychoudhury ) had published my letter. I hope he has not published any truncated version. That will be so out of context. These are the words I recently wrote to him : “If you edit sections of the head or tail of my letters and use some fashionable dotted spaces or some such tricks, I shall box your ears and slap you real hard once I return.” The same is true of your letter. Shakti’s, yours and my dirty linen are being exhibited in public.
    However, these are just ephemera—to conclude. No one would dare touch you. And I shall stand by you always. We have fought over many issues, Sandipan. But I did ponder about you pensively ; we can not do without you. I can not. In a simpler way to tell you, you are my obverse. Your split-up, fragmentary character, your follies and your treachery—- to all these qualities I aspire. It is like a life I never had but wished for it so much. Whenever I think of any writer of our generation who has some real promise, I think of you and only you ( except for Tanmay Datta ). There is no one in the city of Kolkata—who will dare touch your delicate being. You lie there softly, oh so softly beside Rina ( Sandipan’s wife ) and keep telling her those adventures to Mars.
    I shall reach Kolkata on 18th August. I have been detained here for strange reasons. As a result of my idiocy, yes, really. There is a faint chance of staying in Paris during late July or early August. But prior to that, by mid-July, I shall travel to New York city and thereafter to England. How could you presume that I may join a Masters degree course here in Iowa ! You have lost all sense of proportions ! I have troubled you a lot about your narratives in Krittibas, but this time I became apprehensive when I could not find your imprint in the periodical. Any command for me from you to get something from here?
    With love
    Sunil
    And here is the letter Sunil Gangopadhyay wrote to me five days before he wrote to Sandipan Chattopadhyay :
    Iowa, USA, June 10, 1964 
    Malay, 
    I don't know if you wrote this letter bragging about all the incidents in Calcutta. What are you doing? Some of my friends have written vaguely about all the troubles in the coffee house. Your focus is more on movement and commotion than on writing. Do you sleep at night? None of this - I don't have a headache. You can go as far as you want with the movement - Bengali poetry doesn't matter. I think you have a greed for a shortcut to fame. You can get it, it can't be said. I have never done these movements; I am so busy with my heartbeat. But that's right, the city of Calcutta is mine. When I return, I will reign there. You can't change one of his hairs. Many of my friends are emperors. I would be afraid of you if I could see a little glitter in you till now. Tanmoy Dutt, the youngest of me, came to Bengali poetry with a sword in his hand. He was at least six years younger than me. With great arrogance he left. That's why I still feel sorry for others. I haven't written anything myself yet, I'm just trying to write; But it never occurred to me to make a poem like yours a 'commercial'. Like Balzac, I set my vocabulary apart in poetry and prose. As much as I love you Malay, but I still have no interest in your poetry. Of course I'm waiting. Many people think that fame will not survive in the hands of the next generation of poets. That's why some of my friends once became your mentors. I don't care. I have enough strength on my own feet, even to stand alone. My point is: come close to whatever friend you have, come close to whoever writes good poems - write to bad friends, write bad poems, get away from them. I like the age gap very much. Continue the hypocrisy of those movements or generations. I enjoy reading or watching. From a distance. I don't know how the greed of one party to get the Maursi lease on literature comes. But it is better to keep one thing in mind. You must have seen me as a calm, good man. I am so, even though I have Padma riverbank blood on my body. So, you should keep me away, not push me too hard. Otherwise you can't say what to do if you get excited suddenly. I have been so excited a quarter of the time in my life. Last year Having a couple of friends in the O-team didn't break your Hungry Generation at the beginning out of sheer affection. I still hold that power, you know. However, he still does not want to break the O-playhouse. A friend of mine reported that you printed some of my letters. I do not write letters for the sake of literature. My letter is nothing. Of course, there is nothing to hide. But if anyone has printed any of my letters for cunning, let alone dot-dot - let alone slap him twice in the ear two-and-a-half months later. I hope you are well. 
    Take my love 
    Sunilda
    One can make out the position of Kolkata intelligentia from this letter written by poet and editor Jyotirmoy Datta, son in law of famous Bengali poet Buddhadev Basu, Written to Dick Bakken who wanted to publish a special issue on us. Jyotirmoy Dutta had also gone to Iowa just like Sunil.
    Iowa, December 12, 1966
    Dear Mr Bakken
    I am still bewildered why should anyone in Portland, Oregon, be interested in publishing a special issue on the ‘Hungry Generation’. Is there no local talent in Oregon to fill up the pages of ‘Salted Feathers’. Which you described as a small magazine ? Or is it due to an interest in the out-of-the-way, the quaint, the fantastic ? It is like someone in Bhopal, Madhya Pradesh, bringing out a special number on the ‘Trotskyite poets’ revolutionary American poetry by bringing out ‘Penny Paper of Iowa City’. Hurrah for the public relation work and promotion by Allen Ginsberg, TIME magazine, and the silly magistrate who convicted Malay.
    Very Sincerely yours
    Jyotirmoy Dutta
    After returning from Iowa, Sunil wrote the following editorial in his magazine ‘Krittibas’: “Since many people are asking, we are forced to inform in writing that Krittibas has no relation with any institution or movement named Hungry Generation. We do not believe in such movements and never wanted to associate the name of Krittibas with it. Some poets identified as Hungry do write in Krittibas and would write in future, but just individually like other poets, not as a representative of a group. We do not believe in organised literature. Rather our invitation is to all poets of Bengal. We do not know whether the Hungry Generation movement is good or bad. We do not have any opinion on the future or outcome of that movement. So far nothing literary  important has been found in their leaflets. Ordinary efforts to do something new. Certain childish behaviour has also been observed. Apart from this some activities create annoyance. It was beyond our comprehension that a group of young men of Bengal would suffer from the greed of writing in pidgin English even after nineteen sixty. Nevertheless, if that movement ever creates new literature – we would definitely be happy.”
    Sunil was the High Priest of Krittibas. But our movement did not have any high command, polit bureau, headquarter or power centre. Anyone who considered himself to be a Hungryalist was free to publish his own or friend’s work from anywhere. Our movement brought the marginal discourse to the notice of readers. It had spread to North Bengal, Tripura, Assam, Benaras, Kathmandu and even then East Pakistan where the ‘Kanthaswar’ group was called Hungryalists. 
    That the gatekeepers of Bengali culture are conspiring against us became clear afterwards when I received a letter dated 27 January 1965 from Mr. A.B.Shah, Executive Secretary of Indian Committee for Cultural Freedom in which he wrote: “I met the Deputy Commissioner of Police the day after we met at the office of the Radical Humanist in Calcutta. I was told that they would have not liked to bother themselves with the ‘Hungry Generation’, but for the fact that a number of citizens to whom the writings of your group were made available, insisted on some action being taken.”
    When Sunil Gangopadhyay was annoyed with the Hungryalist movement Samir Roychoudhury tried to pacify him as may be seen in this letter :
    Bombay May, 25, 1963
    Sunil
    Received your long letter. I am really hurt after learning about your mental stress. It is we who have made Shakti so large. Its main responsibility is yours, mine and Malay’s. And even now I want to make all my friends quite big. You were the first who first goaded Shakti to write. Every now and then you were the first to say “Best Poet of Bengal”. The difference is that Shakti claims the same thing today. While at Chaibasa, quite some time ago, Utpal and Shakti had planned to remove you and sit on the throne of Art. I had to be present in these discussions. The plan to bring out a magazine was taken in that meeting. The matter of launching the literary  movement was also repeatedly asked by the Malay. I had always said that I would not be able to leave Krittibas. For various sentimental reasons, I consider Krittibas as my own magazine. It is not possible to think of  it as 'Sunil's paper' like many others. I don't think Shakti and Utpal can start Zebra magazine without you.. At least Malay won't let it happen. Moreover, even in the midst of all baseness, Shakti may not be able to avoid the sting of subtle feelings. I do not believe there will be a breakdown in our relations. If it happens, it would harm Shakti the most. He wants money for Art, Sheela is also there, needs intellectual loans from Samir and Malay and  he knows very well that if he drops you then he might be in great trouble. Shakti has written to me that your works will be there in Zebra magazine. It will probably come out after two months. Rather Utpal is  a little more against you. Maybe jealousy, maybe some other reason. Shakti is creating complications to keep Utpal happy. Malay’s anguish is that you do not care for him at all ; very childish. Last time when Sheela was to be admitted at Patna University, I had taken Shakti with me. There Malay convinced him about the literary movement. The short story ( Khutkator Akromon ) that he has written, its plot and plan was given to Shakti by Malay. It was decided that we shall go to Calcutta and start with publishing a booklet. WEe all will be in it. Without waiting for our instructions Shakti returned to Calcutta and immediately started the matter. Meanwhile I came here for training. Malay was at Patna. At Calcutta Shakti adopted various methods to create his throne. You're not joining it, which got slowed down,  due to misunderstandings, the situation has reached this stage. Malay has also talked about it. Malay wants you at all costs.  Maybe the attacks have arisen because of it. Strange complications. He wants to bring out a poetry anthology titled KHUDHARTO. He has written to me to request you to send a poem. He wants to edit it himself by avoiding Shakti’s machinations. Sandipan may also bring out a prose collection. I have sent short stories for Chinho, Chhotogapo and Zebra on their request.
    For Shakti, the temptation of power to fame has all along been there. Maybe it's normal according to his environment. In fact, it is possible to become an artist without being a human being. Underdogs, scoundrels and thieves can also be artists. These things help to be an artist. As a result, there is a rift between friendship and humanity. 
    In an instant, maybe all the pride, arrogance and meanness of Shakti can be shattered and openly presented before Bengalis. I have no shortage of suitable examples; But it is never possible for me to take revenge against  Shakti or against anyone. I have my own ideals, whether they are right or wrong, I want to live with them. I do not want to live the life of a reactionary..
    You have to hold on to your ideal for Krittibas too, there is nothing to be embarrassed by the screams of anyone around. We shall surely keep on publishing Krittibas.  I personally love people more than Art. Shakti is much bigger as an Artist and thinks Art is much bigger than humans. I can’t think of Art as separate. 
    It is normal and appropriate for everyone to have a different point of view. I don't believe in such juvenile arguments that if one does not  write poems like Shakti or Utpal he is not a poet. Just as some poems of Shakti make me crazy and bewildered, some poems of Alokranjan opens me up. At that moment Alokranjan seems to be the owner of all my being. How do I deny him? Similarly, there may be someone who is cured by Tarapada’s verse. Who are we to measure these excellences? One should leave it to those who read poetry, to time, instead of fighting over beating their drums. If this continues, Shakti will make a big mistake. As great as he can be he will cut it short with his own hands. Maybe he's a little excited to see Allen's worldwide fame. Shakti has told me this many times. 
    I shall  leave this place  and reach Chaibasa on the 17th. You  come at that time. I will tell Shakti to come too. If the three of us are together, many misunderstandings will  automatically disappear. We may visit the places around us. Bella’s health has also improved.      
    Please reply. Why not write some fierce prose and verse against the Hungry Generation. I will publish in a special booklet of Hungry Generation; Malay will also agree. In fact, the movement of the heart is needed before all such movements. 
    This is how I will have to absorb all suffering of loneliness throughout my life. Yet and perhaps for this reason I cannot separate human beings from Art. I am unable to  find reasons to think someone is greater and smaller. 
    Samir Roychoudhury
    But Sunil Gangopadhyay never pardoned me and Samir. Though Samir funded Krittibas for a longtime Sunil did not invite him to write in Krittibas. When Samir started HAOWA49 magazine in the 1990s, Sunil did not contribute to it.                   
    Eight
    On September 2, 1964, Sub Inspector Kalikinkar Das of the Kolkata Police lodged a complaint based on a copy of a Hungryalist bulletin — made available to him by Pabitra Ballabh, a poet – claiming that it came within the purview of Section 120B and 292 of the Indian Penal Code, and I should, along with other members who had contributed in that particular issue be prosecuted. Section 120B laid down that, “Number One, whoever is a party to a criminal conspiracy to commit an offence punishable with death, [imprisonment for life] or rigorous imprisonment for a term of two years or upwards, shall, where no express provision is made in this Code for the punishment of such a conspiracy, be punished in the same manner as if he had abetted such offence. Number Two, whoever is a party to a criminal conspiracy other than a criminal conspiracy to commit an offence punishable as aforesaid shall be punished with imprisonment of either description for a term not exceeding six months, or with fine or with both.” Though this Section was irrelevant in our case, it was applied so that during arrest we may be handcuffed and a rope tied to our waist like ordinary criminals, in order to humiliate us before ordinary public.
    Section 292 laid down that, (1) For the purposes of sub-section (2), a book, pamphlet, paper, writing, drawing, painting, representation, figure or any other object, shall be deemed to be obscene if it is lascivious or appeals to the pruri­ent interest or if its effect, or (where it comprises two or more distinct items) the effect of any one of its items, is, if taken as a whole, such as to tend to deprave and corrupt person, who are likely, having regard to all relevant circumstances, to read, see or hear the matter contained or embodied in it. [(2) ] Whoever—(a) sells, lets to hire, distributes, publicly exhibits or in any manner puts into circulation, or for purposes of sale, hire, distribution, public exhibition or circulation, makes, produces or has in his possession any obscene book, pamphlet, paper, drawing, painting, representation or figure or any other obscene object whatsoever, or (b) imports, exports or conveys any obscene object for any of the purposes aforesaid, or knowing or having reason to believe that such object will be sold, let to hire, distributed or publicly exhibited or in any manner put into circulation, or (c) takes part in or receives profits from any business in the course of which he knows or has reason to believe that any such obscene objects are for any of the purposes aforesaid, made, produced, purchased, kept, imported, exported, conveyed, publicly exhibited or in any manner put into circulation, or (d) advertises or makes known by any means whatsoever that any person is engaged or is ready to engage in any act which is an offence under this section, or that any such obscene object can be procured from or through any person, or (e) offers or attempts to do any act which is an offence under this section, shall be punished  [on first conviction with im­prisonment of either description for a term which may extend to two years, and with fine which may extend to two thousand rupees, and, in the event of a second or subsequent conviction, with imprisonment of either description for a term which may extend to five years, and also with fine which may extend to five thousand rupees]. [(Exception) —This section does not extend to—(a) any book, pamphlet, paper, writing, drawing, painting, repre­sentation or figure— (i) the publication of which is proved to be justified as being for the public good on the ground that such book, pamphlet, paper, writing, drawing, painting, representation or figure is in the interest of science, literature, art or learning or other objects of general concern, or (ii) which is kept or used bona fide for religious purposes; (b) any representation sculptured, engraved, painted or otherwise represented on or in— (i) any ancient monument within the meaning of the Ancient Monu­ments and Archaeological Sites and Remains Act, 1958 (24 of 1958), or (ii) any temple, or on any car used for the conveyance of idols, or kept or used for any religious purpose.
    In the case of Samir an additional Indian Penal Code Section 293 was added which said, “Sale, etc., of obscene objects to young persons.—Whoever sells, lets to hire, distributes, exhibits or circulates to any person under the age of twenty years any such obscene object as is referred to in the last preceding section, or offers or at­tempts so to do, shall be punished 2[on first conviction with imprisonment of either description for a term which may extend to three years, and with fine which may extend to two thousand rupees, and, in the event of a second or subsequent conviction, with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, and also with fine which may extend to five thousand rupees.
    On September 4, 1964, I was arrested by Police Officers S.M.Barori and Amal Mukherjee based on the complaint registered at Kolkata’s Jorabagan Police station. I was handcuffed with a rope tied to my waist, and paraded to the Bankipore Police station of Patna. A posse of policemen searched Dariapur house, broke open Ma and Dad’s boxes, seized a number of books, magazines, letters, manuscripts and a typewriter which were never to be returned.
    I was incarcerated without food and water in a dark cell with crooks and criminals. The corner of the lockup was used as a toilet by inmates, the flow of urine and shit blocked by a tattered rug on which was lying a dead drunk pickpocketer ; rodents moved around in search of food crumbs and bugs crawled the walls with mosquitoes singing slum anthem in the stinky air. Through the night I stood at a corner like a statue of flesh and bone aside the crooks and criminals, who thought I was absurd having been arrested for having written a poem. In other lockup I could hear the scream of some prostitutes who were picked up for soliciting on the streets and now being raped by interested constables in the dark. In the morning, rope tied to my waist, I was told to go towards the back of the building to finish my morning shit. It looked like a garden of shit with no place left. Even then I relieved myself at a place and washed my arse in a standing position with my back at the constant flowing tap.  When I came back, the constable holding the other end of the rope said, “Are you a fool ? You could have easily untied yourself, climbed the outer wall and fled away. The Bengali police would not come again in search of a person for having written something.”
    In the afternoon, along with other seven persons who were in the lockup with me, including the pickpocketer who seemed to be still out of senses as he was loudly abusing the police, were handcuffed with rope tied to our waist, goaded on foot like dogs on leash, marched toward the local court. One reporter who knew me asked the accompanying policemen about me and published a derogatory report the next day. The editor of the newspaper The Searchlight knew me and had published a supplement on Hungry Generation movement, probably as a sort of atonement. The local court released me on bail of ten thousand rupees with orders to present myself at Kolkata’s Bankshall court. My lawyer at Patna was Basanta Bandyopadhyay, father of Minakshee Mukherjee and Enakshi Bandyopadhyay. Minakshi’s husband was our English teacher for a few months at Ram Mohan Roy Seminary and later became professor at JNU.
    The first thing that happened was that I was suspended from my job, making money scarce. Worse still, granny was shocked to hear about Samir’s arrest and suffered a heart attack and died. She helped her grandsons by dying as all her sons had to reach Uttarpara for her last rites and attend to the problems arising out of the court case. Aunt Kamala’s husband Tinkori took Dad to a lawyer, who Tinkori thought was a very good criminal lawyer as any prostitute and pimp arrested by Kolkata police are compelled to set them free because of his arguments. Tinkori was a regular at Sonagachhi, Kolkata’s famous red light area and thus knew the lawyer Chandi Charan Moitra. His chamber was just opposite the lane through which one enters Sonagachhi, the redlight area and while waiting in his chamber I could watch through the window the poets of Krittibas group entering the lane led by Parboti Mukhopadhyay, member of one of the old residents of Kolkata. 
    I surrendered at Bankshall court as directed by Patna court and got bail. I was not chargesheeted immediately, the Police required me to report to the Lalbazar press section every alternate day. At the Lalbazar police headquarters myself and Samir were interrogated by a group of officials in the Commissioner's chamber which consisted of the Home Secretary, Legal Remembrancer, Culture Secretary, Deputy Commissioners and the Police Commissioner himself. They probably wanted to be sure whether we were just half literate nuisance or really educated. They must have been baffled by our knowledge of literature and philosophy. The Police Commissioner said, “your one page leaflets seem like you people are selling tooth powder on the streets.”
    I was chargesheeted on 3 May 1965, when I came to know that all others have been freed as they have decided to become witnesses against me.The chargesheet stated : “In August 1964 a printed booklet entitled Hungry Generation published by Samir Roychoudhury was found in circulation in Calcutta. The poetry captioned ‘Prachanda Baidyutik Chhutar’ by Malay Roychoudhury was found obscene and Director of Public Prosecution West Bengal being consulted observed that the book was actionable under Section 292 IPC and suggested prosecution of Malay Roychoudhury with printer and publisher. Accordingly, Jorabagan Case No 360 dated 2 September, 1964 under Sections 120B and 292 of Indian Penal Code was instituted and Saileswar Ghose and Subhas Ghose who contributed in the book were arrested on 2 September 1964 from their Calcutta residence and a number of said booklet were recovered from their possession. Malay Roychoudhury was arrested at Patna on 4 September 1964 and on search of his house more copies of the poem in question and a copy of the booklet were found and seized. Then Samir Roychoudhury named as publisher and a few other contributors namely Debi Roy alias Haradhan Dhara and Pradip Choudhuri were also arrested in connection with this case. Samir Roychoudhury disowned the publication and the printer could not be traced despite serious efforts. The opinion of the handwriting expert and oral testimony of the witnesses indicate that Malay Roychoudhury was responsible for the production and circulation of the booklet containing an obscene poem composed by himself.  Evidence forthcoming does not establish direct responsibility of other persons. In view of the above circumstances, Malay Roychoudhury, who is on criminal bail till today may be prosecuted under Section 292 of Indian Penal Code. Names of witnesses :
    1. Tarak Nath Sen of 48/A Sankar Halder lane
    2. Samir Basu of 5/1 Motilal Sil Lane
    3. Utpal Kumar Basu of 23 Royd Street
    4. Subhas Ghose of 16A Shyamacharan Mukherjee Lane
    5. Saileswar Ghose of 16B Shyamacharan Ghosh Lane
    6. Pabitra Ballabh of 28/A Paik Para Row
    7. Pradip Choudhuri of Kulai Tripura
    8. Shakti Chattopadhyay of Adhar Chandra Lane
    9. Sandipan Chattopadhyay of 18 Sarada Chatterjee Lane, Howrah
    10. Pashupati Banerjee, Handwriting Expert, Anderson House
    11. S. M. Barori, Sub Inspector of Police, Detective Department
    12. Amal Mukherjee, Sub Inspector of Police, Detective Department
    13.  Kalikinkar Das, Investigating Officer, Detective Department
    14. Shri Brojendra Prosad Sharma, Patna Municipal Worker
    15. Shri Ramnath Prasad, Patna Municipal Worker
    16.  Krishna Kumar Sinha, Sub Inspector of Patna Police Station and others.
    Along with the chargesheet, Police gave copies of statements by freed Hungryalists, from which relevant portions reveal how scared my associates had become and turned against me :
    Shakti Chattopadhyay : According to my estimation the writings of Malay manifested mental perversion and his language is vulgar. I also saw a copy of the booklet and strongly condemned the poem captioned Prachanda Baidyutik Chhutar written by Malay.
    Utpal Kumar Basu : According to my estimation the writings of Malay Roychoudhury carry a sense of disgust and nonsense. I feel that their literary movement degenerated into depravity and I have disassociated from the Hungry Generation.
    Sandipan Chattopadhyay : As a poet myself I do not approve the theme or the language of the poem of Malay Roychoudhury captioned Prachanda Baidyutik Chhutar. I have severed all connection with Hungry Generation.
    Saileswar Ghose : I know Malay Roychoudhury who is the creator of Hungry Generation. After the recent issue of Hungry Generation which was published without my knowledge and consent, I have cut myself off from the said organisation. In future neither I shall keep relations nor I shall contribute to the Hungry Generation.
    Subhas Ghose : I never liked to be acquainted with such a type of magazine which in my opinion is bad and never thought that my article would have been published in such a magazine. I do not believe in the motto of Hungry Generation and have cut off every relation with it after publication of my article.
    I felt depressed except for some letters of encouragement from Octavio Paz, Allen Ginsberg, Lawrence Ferlinghetti and others, which were edited and published by Tridib Mitra and his fiance Alo Mitra in 1969. On a few days of hearing Subimal Basak, Falguni Ray, Tridib Mitra and Alo Mitra used to come to court. Otherwise I was all alone and loitered in other courtrooms to find out stories of the cases. A lawyer, Satyen Bose, volunteered to defend me alongwith Chandi Charan Moitra and intervened to stop my visits to Lalbazar police headquarters. Dipak Majumdar, a poet of the fifties and one of the founders of Krittibas magazine initiated a signature campaign in my favour, got rebuffed by a senior editor and other writers and had to abandon the initiative. Most of the writers of my group were avoiding me ; I was feeling alone, tormented, frustrated, estranged, abandoned and angry. 
    News of my persecution appeared in Indian and foreign periodicals and papers. Commissioned by Bonnie Crown of Asia Foundation, Prachanda Baidyutik Chhutar, translated as Stark Electric Jesus was printed in Lawrence Ferlinghetti edited City Lights Journal with an essay on the poem and our movement by Professor Howard McCord. It was also published separately in the United States in 1965-66 in three ditto editions by Tribal Press with a verifax cover showing the sorcerer of the Trois Freres. It is a poem based on mourning with fundamental questions about life and love based on speech rhythms.
    Nine
    Allen Ginsberg was very much disturbed with my arrest and wrote letters to several persons in India and abroad as well as to me. I got letters supporting me from other poets as well. Here are a few :
    Allen Ginsberg, 704 East, 5th Street, New York
    28 September, 1964
    Dear Malay,
    I saw clippings from BLITZ, Sept 19, 1964 p6 and also I think Calcutta STATESMAN 17 September 1964 that you were arrested as well as Samir and two boys named Ghosh whom I don’t know, for your HUNGRY GENERATION manifestoes. Are these the same as were printed in the issue of KULCHUR#15? As soon as I read about it, I racked my brain what I could do to help, and so today wrote a whole bunch of letters to the following:-
    A.S.Raman, Editor, Illustrated Weekly, Dr. Dadabhai Naoroji Road, Bombay.
    Sharad Deora, Editor,Gyanodaya, 18 Brabourne Road, Calcutta.
    Abu Sayeed Ayub, Editor, Quest ( sent a message to him indirectly), and member of Indian Congress for Cultural Freedom.
    Shyam Lall, Editor, Times of India, New Delhi.
    Khushwant Singh, novelist and member of Congress for Cultural Freedom, 49 East Sujan Singh Road, New Delhi.
    I also wrote to Jyoti Dutta and phoned Lita Hornick of KULCHUR. I asked them, the Indians above all, what they could do to help you, suggested they activate the congress for Cultural Freedom as this sort of thing is the proper activity of the Congress and Quest magazine, and told them that the manifestoes were printed here in CITY LIGHTS JOURNAL and KULCHUR, and were not obscene. So the whole mess was scandalous bureaucratic illiteracy. Please if you need literary help or advice do try to contact these people for support. And in addition perhaps ask for advice/help from Mrs. Pupul Jayakar, 130 Sundar Nagar, New Delhi---she was our proteress in India, we stayed with her, she’s a friend of Indira Gandhi and others. I also notified Bonnie Crown here in New York, the Asia Society, 112E 64 Street, NYC---she commissioned poetry to be translated by Sunil and others and that pack of poems plus your rhythms etc. will be printed together by CITY LIGHTS. She can send you a letter on her official stationary saying your manifestos are known, published and respected in the US and not considered obscene. I will also enquire about Mr. S.K.Roy, the Indian Consul General here in New York who I do not know what he can do at this distance.
    If there is anything you want me to do let me know. Write to me and let me know what the situation is and what is the cause of the trouble. In judging from BLITZ I suspected jealous ideological Marxists or something. Are you ruined at the bank?? I hope not. Regards to your family. Get the Congress for Cultural Freedom to supply you with a good lawyer who’ll take no fee. If the Indian Congress doesn’t cooperate, let me know, we’ll explain to the European office. Who are the Ghosh brothers? The manifestoes on prose and politics are pretty funny. I thought they were a little literary-flowery, but they MUST HAVE HIT SOME MENTAL NAIL ON THE HEAD. Good Luck.
    Jai Ram
    Allen Ginsberg
    Allen Ginsberg, 704 East 5th Street, NYC
    January 11, 1965
    Dear Malay,
    Enclosed copies of letters from KULCHUR, from Abu Sayeed ayub ( 3 letters in answer to mine---each letter 2 pages) and one from A.B.Shah---Congress in Bombay. You should follow their letter up. Congress office in Paris has been contacted & they will probably send some note, notice to the Indian Committee.
    I answered some of your letters via Utpal---I sent copies of these letters, also, to show Sunil, Jyoti, etc.
    CITY LIGHTS JOURNAL#2 is on its way to you.
    That Jyoti, Sunil, Sandipan & yourself are all working at slight cross-purposes is making things difficult. I suppose they are embarrassed by your ‘brashness’ (as TIME magazine might term it) or your slight edge of naivete as I would term it. However, if it is possible to reconcile with them & put up a united front it would be best for everybody’s safety. Best thing is to stop all cutty gossip, for it is only mainly gossip that Abu Sayeed is using as an excuse. Obviously they also were questioned by the Police, and so, feel a common threat with you. Don’t get angry at them---just work out a basis where you can all defend each other---and try you now---the only present basis (since there seems to be some literary disagreement) being freedom of literary expression.
    They all don’t want to be grouped as Hungry exclusively apparently, and they may resent or be scared or not want you to lump them all under your Hungry banner. And this is natural. Once a MOVEMENT gets name and publicity it is also a drawback as I’ve found. Also, the name is irrelevant & a drag sometimes to one’s individuality. See the first sentence of my letter to Shakti, Feb10,1963 that was published in a Hungry type magazine in Bengali.
    Best not to get angry at anyone---Jyoti, Abu Sayeed---even the police. Think carefully & coolly & get all working together if it is possible. I leave for Cuba in a week and will be back in 2 months.
    Love & Happy New Year
    Allen
    Howard McCord, 304 Oak Street, Pullman, Washington.
    22 May 1965
    Dear Malay Roychoudhury:
    I have enjoyed reading your letter and coming in contact with your thoughts very much. Artaud, Genet, Burroughs:yes.They are the dialecticians of chaos presiding at the dissolution of the west. They describe, with joy and exactitude, the destruction in which they are themselves involved. Burroughs, to me, is a man performing an autopsy on himself. They are all quite mad, and therefore speak the truth. We can only trust the mad anymore. The West began to die around 1750, and it has been the function of poets to recite, in series, the long funeral oration. William Blake began it. Goethe, Baudelaire, Lautremont, Rimbaud, Huysmans(unknowingly), Pound, Eliot, Crane, and all the other familiar names have continued the chant. We are their heirs, and perhaps the culmination, for our anguish and despair, the aesthetic suicide of which we are capable, may mark the end. Perhaps it will go on. Sometimes it seems as though it is the plan for it to go on.
    The inadequacy of my coming, touristic encounter with India is deeply felt. I am not an Indian, I will not become one in two months of hurrying through the landscape. I will be richer only by the validity of my meetings, the openness I can maintain. Here in my own country I am alien enough, separated from the culture by an aversion to much of it, by a self-imposed identification with the Mexican part of my life (perhaps it is as if you felt yourself drawn to Tibet), by a long-standing estrangement from its more common goals. I identify most closely with the folk of the southwestern deserts---the American Indians---Apache, Navajo, Pueblo, Hopi, Zuni, Yaqui, Tarhumara, Comancha---and the ranchers. (My family has for a century run cattle ranches in Texas, New Mexico and Arizona---all poor people in a poor land). My wife is Mexican, my second language is Spanish: my children, blond & blue-eyed though they be, are technically mestizos---the mixed-blood that is the strength and heart of Mexico. And here I sit, perfumed with education, owning not an acre of ground, lost from the desert, 2000 miles from Mexico, a poet in my decadence and reality. My children are apt to be technicians, I pray they will be artists.
    I have plans, most vague and tenuous, for a book of Contemporary Indian Poetry. University published. Likely no money would come of it, but some passing fame. I ask now for some of your poems for this nebulous enterprise, and your aid in contacting other Indian poets.
    From the foregoing you can see some of the difficulty in raising money from letters in the USA. Raising money per se is not to hard. It is raising it in a way that feels decent that is difficult.
    Such fantastics we are!
    I look forward to seeing the poem that has been the cause of all your trouble. I envy you for your courage, for the more I understand about contemporary Indian society, the greater your courage and daring seem.There are no longer any words we can not use in literature, nor any scenes we can not describe. Our only constraint lies in the definition of hard-core pornography where the obvious intention lies in the excitation of base impulses without any redeeming social features. The change in the last ten years has been tremendous. I remember first reading Miller’s TROPICs in their prohibited Paris editions and actually worrying about official interference were the fact of my reading known. Now the TROPICs are available everywhere and professors use them in discussion groups (though not in class here, perhaps elsewhere). It would be stupid of me to laugh or denigrate Indian society in which movies, for example, may not show kissing or the like, and in which mention of the sexual organs is prohibited. I do not like censors or censorship, but I do not expect Indian censorship to cease with my dislike. You have a hard, long battle before you, for a society of great and unyielding complexity must be moved before you are free. If free you must be. And I suppose you must. But may I say, from the point of view of one who can say in print fuck, shit, cunt, prick, whatever, describe scenes of fellatio, cunnelingus, hetero (Praise God) sexual intercourse or homosexual intercourse, and all (Please pardon my spelling, for I have been drinking very much). My bloody prose style suffers!
    That saying these things is not very important. I have one poem in which the cunts of women are sweet and moist as peaches, and one other in which ‘the fuck of voices’ appears as an image. Henry has more, and we ought to be able to say these words, because the mind is like the penis, coming out of the spinal column, sewn to the belly, hard as sugarcane, it talks.
    But I will say that there is more. That the societal context is more, that the identity of the speaker and spoken to is more. (As I could not honestly, without compunction, use Fuck in conversation with my parents). For they do not so much respond to it as they are defended by it, and do not hear. (So for me Kandel’s POEMS FOR PERVERTS misses, collapses; fatigues itself). What must we use to drive the mule? WE SHALL SAY ANY WORD.
    WHEN ANY WORD NEEDS SAYING.
    This is an oblique way of saying that I do not trust EVERGREEN REVIEW. There is the stink of money about that magazine. Money that comes from the hard-on, the erection (it is the intellectual’s PLAYBOY, complete with airbrushed nudes. Something coy, cute, cloying---and dead). Hard words for a magazine that has published great writers like Eastlake………
    Send me a translation of your poem: for obviously, I have worked myself into a blue-eyed stupor about the problem.
    I see you as trying to survive as an artist in a society 70 years detained. India is strangely Victorian in its public morals. (How did this come about? Considering Khajuraho, etc.?) Were the English that potent? Or is it Muslim? Hindu? Who digs the mithuna couples now to save us degenerate foreigners? All right. The pattern: woman’s position in marriage/household: the corporate family (security at the cost of independence?), the precarious economy (do not rock boats, ever), the tension with the West. The civil service.
    Now I must go to bed.
    Next day:
    The questions still seem to be here.And tomorrow I must lecture three hours on Epictetus, the Enchiridon, and stoic philosophy. Later in the week a special lecture on Blake’s THE MAARRIAGE OF HEAVEN AND HELL (which I contend is the first modern poem, the very beginning of all of us). It is so fine. I am translating it into Spanish for the Goosetree Press, which will publish it next year, with fragments from Blake’s drawings. So, I best get busy and to work.
    Best wishes. And I hope that we can meet. Write again soon, please.
    Howard McCord
    Margaret Randall, Mexico City
    June 17, 1965
    Dear Malay,
    Please, please excuse so much time without writing, and now that I finally am able to sit down to write, this jumpy typewriter is driving me out of my mind. The man promised to come this week to fix it but this is Mexico (land of ‘manana’) etc!. How are things going for you---the trial; your case, the things taken from you and your friends, etc.??? All over the world, through EL CORNO, people write asking about you and wish you well, it has caused an international scandal among people in the arts, at least. I hope for good news, please write!!!
    And the book with Carlos Coffeen’s drawing on the cover---did it come out???
    Under separate cover and by regular surface mail I have sent you two copies of our 13 in which I printed your letters. Hope they arrive one of these days and in good shape. Naturally: when the issue was printed I sent you a copy, but it must have gone astray. I don’t know why Samir Ray received his and you didn’t.
    Here we are in deep problems with the magazine. No money, for one thing, and tremendous work. Just when EL CORNO seems to have become a world wide interest spiritually and literally, it faces a quick death financially. The change of government here in Mexico in December has thrown us into utter gloom. All our base patronage was cut out from under us, and we were faced with stopping publication altogether, and so we had to turn to a thousand improvised plans to get us through. At the moment we are having a giant art show (more than 50 painters and other artists have donated works to sell for the benefit of the magazine). The show opened at a local gallery a week and a half ago. So far we have sold 18 works, keeping the linotype purring at least through the first part of 15. 15 is now at press and we hope to get through all of it, fingers crossed. I’ll try to use your poem in the first part of next year, but it isn’t at all sure. We have so much work at hand and so little space and money. In reality, space and money are the same thing!
    Otherwise we are fine. Working like hell! Translating; writing, praying, trying to keep the mag going. Learning daily from our children (now there are three), the youngest is a year old today!
    Be well. Write. Good luck with the court case!
    Love
    Margaret Randall
    Allen Ginsberg, c/o City lights, 261 Columbus, SF, Calif
    July 11, 1965
    I have been wandering around from Moscow to Havana to Warsaw to Prague & thus didn’t get your letter of Jan 29th, much of which is obsolete by now?
    I have gotten so many conflicting letters & gossip from every body, I actually have no idea who’s doing what to who in India. Is your trial over or not, & what’s what? I’ve done all I can from here.
    I went to Cuba, as judge of a poetry contest ( and later got kicked out for talking too much). It was a Latin American contest, the judges (as myself) all had to be able to read Spanish. Also they’d published poetry of mine & I had friends there and I had spent years in South America. So I got invited. I’ve been back a week & leave again for San Francisco in 2 days. Then settle down to solitary poesy again. Write me news. I haven’t much time to correspond, tho, except in big emergency.
    As ever
    Allen
    Carol Berge
    15 January 1966
    Dear Malay,
    Now I have the third letter from you. Now I have news for you. First of all, I have sent you books, or rather magazines, and in a separate package my own copy of ‘Lady Chatterly’---but if you don’t get my book that’s okay, since we can get them here. The magazines are for the most part just literary types, and they are a ‘test’ to see if you will indeed receive things I send you. They have no risky stuff in them. If they arrive, let me know at once.
    News: our Ed Sanders has just been arrested for pornography and is out on $500 bail. We’ve all been waiting for this move for years. This will probably not hurt him, since he is by now a national figure, and many of this country’s finest literary figures are published in his magazine, over the five years it’s been going. But it should be an interesting trial---if it gets to that stage. He is just ready to publish another issue, in which I believe your poem would be included. I’ll tell you more later.
    It is so beautiful of you to speak of love to me. Let me put my hand on your cheek and tell you something about me and about my child. Although many men have been in love with me in my small time, it is not a good idea.
    I am the kind of woman who has the innate temperament of all writers. It is not so easy for me to remain calm and easy, as the women of your country. We Americans are troubled and difficult. My ideal is to become gentle and fine and quiet, but I am not like that. I love to be active and alive and making things happen. Of course this applies to things literary, such as the group of poets
    Who needs guidance and action here in New York. Now we have arranged for a new and more comfortable place for the group to read poetry (we used to be at a place called Le metro but the owners were such racists and I felt as did many others that we could and should move out). There is more news. About twenty of us made a recording which will be issued on Folkways Records soon. It is called Jazz Poets’, a category which does not always apply but was used to attract buyers. You shall have a copy if I have any way to get it to you for sure.
    I am so very glad to hear that you’re free and safe. I had worried about you. There is a good pride in your being the first to go through this ordeal. Of course, if your friend does the essay on your writings, send it along to me at once; I will go over it and give it in to AMERICAN DIALOG or another good mag, and hope they print it.
    You don’t say how old you are but I will tell you I am now in my thirties and my son is 9. He and I are both dark hair and eyes. I am a small woman and very intense, somewhat pretty, and the boy is very beautiful, with shining eyes and tremendously strong ways. It is getting very difficult to raise him alone. What he needs is to go out into the woods the way we did this summer, and run wild a bit. But it isn’t so easy for me to make this happen. Yes, I love the countryside as much as he does. But I don’t feel safe without a man. So we go very very timidly. But this is a good city to live in. I wish you were here, so that we could share some of it with you. We too believe in love, any and all love, which is all that is worth living for. I love the writing too, as it gives us our friends. Here we have friends and in many cities of this world. Japan, London, Helsinki, Cologne, Mexico, you know. I wish we could come there to visit you. But I too don’t see how it is possible. I have saved some money but it will have to go toward our next long summer---the boy is out of school over three months---I must find a place outside the city for us.
    But Malay---somehow I am with you---we all feel alone most of the time---‘the sanctity of the skull’---it is not easy to be a writer and a human---I think of philosophical ideas much of the time these days---how it is to live on earth in this time---how each man is the centre of his world---how we move toward and away from each other---I would give you the warmth of your wishes if I could---with this New Year. O yes there is a great difference between being alone and being lonely, which you know. I have so much respect for the struggle of many of my friends, whose work is strong and true. I just wrote a book review on the book LAST EXIT TO BROOKLYN, by friend Hubert Selby Jr., which is a major book because it tells in true language about a group of so-called depraved and perverted types---and in the review I defended them and him, because those people have had no choice about how to spend their lives. They (and we) have become what they are, because of the circumstances of their birth and their experience. Of course, Selby has run into a lot of unfavourable comments on his book. And you have heard o0f the trial and subsequent suppression of magazine EROS, whose contents are obvious from the title. Well, Selby had to go through a court trial for one section of his book, called ‘Tralala’ as published in the magazine PROVINCETOWN REVIEW. I think they seized and suppressed all copies of that issue. But eventually, all such cases win out. You know, they have to. Because we writers are dealing with the mediaeval morality of the masses---who, after all, can use the kind of FREEDOM and LOVING , which we are able to teach them. To me, this is a prime reason for being a writer: to use this gift for a good purpose. It strikes me this is as strong a cause to work for as the Peace Foundation. How do you feel about it? Though I feel I already know your answer; of course. I would like you to send me one of these things: most important, a picture of you. Or, and, a small woodcut or print of any kind which speaks to me about ‘your’ India, and which I can put on my wall and know you are there. Tell me in your next letter about the room in which you live, or the house. Where are your parents? Who are your friends and how do they live? Let me share your in any way you can. I am absolutely your loving friend. The skin on my back says so to you. My boy Peter is your boy and your friend as well. You would find us always loving and sharing. In future I will try to be more faithful about answering your mail. I will send you some more books if you get the magazines I sent. And I will send you a photo and also a print or such, for those moments when the world seems too dry and too difficult or alone. You have our love, Malay---
    I kiss you.
    Carol Berge
    Daisy Aldan, 325 East 57 Street, New York
    February 1, 1966
    My dear Malay Roychoudhury
    A friend of yours, Howard McCord, has sent me your address. I am distressed to hear about your plight, and hope that the situation will be ameliorated as soon as possible, even though, I do not at present, agree with the kind of poetry you and your friend are writing. I think YOU ARE EXTREMELY TALENTED. I am a poet myself and Editor, and a great associate of the Avant Garde. I consider myself in the forefront of the true Avant Garde. I published a magazine called FOLDER which presented poets whose work could not be published elsewhere because of its contemporaneity. But I think what you are doing now is first of all, passé, and second of all, a debasement of the spirit and language. I also think it is all wrong for India, and that there is room for excellence and contemporaneity without debasement. However, this is just my opinion, and I am sure you have good reasons for yours. You certainly should not be persecuted for your poems.
    The major reason for this letter is to let you know that I am editing a book for Thomas Crowell called POEMS OF INDIA and I would be happy to consider some of your poems, and those of your friends. I wish to include poems of every region of India. Since the book is directed to young people, I can not publish any of the poems of the nature of the one Howard McCord published (a copy of which I have). If you wish to choose poems that do not deal with sex in this way, then I shall be more than happy to consider including them. I am eager to publish much contemporary work. Also any suggestions you may have about poems of the past which should definitely be included would be deeply appreciated. If any of your friend wishes to send me poems, then they should include a brief biography and permission for me to use.
    I will send you under separate cover, my own poems: THE DESTRUCTION OF CATHEDRALS, SEVEN:SEVEN, and A NEW FOLDER:AMERICANS:POEMS AND DRAWING, an anthology. Since it takes months for mail to get to India, I hope your answer will arrive before you receive them. All submitted poems, by the way, must be in English or translations.
    I spent four months in India last year---mostly in Bombay and gave a lot of readings of my work. I met many poets whose work I admire, among them, Padgaonkar, Karandikar, Ezekiel, Bapat, Katrak.
    I love India, and am happy to be involved in this project. My best wishes to you, and I look forward to hearing from you soon.
    Fraternally,
    Daisy Aldan
    Daisy Aldan, 325 East 57 Street, New York 10022, NY
    February 25, 1966
    Dear Malay Roychoudhury,
    Thank you so much for answering my letter so promptly. I shall certainly do all I can to see that your booklet is publicised. I have a copy of it myself. It has some great beauties in it, but contains what I was referring to in my last letter. Perhaps I am wrong, and perhaps I am conditioned by the fact that we here in the West are so bored by now with sexual references, and no longer shocked by them. We feel that the purpose of this shock is now over, and it is the mission of the poet to give humanity hope and not to bore him with these petty sexual references, for example to the pubic hairs of one’s love. There was certainly a time for this when Apollinaire introduced this type of a technique in 1917 and our ‘Beats’, inspired by Miller, drained such words as s -t and f-k to the limit.
    I feel, as you, that the poet must be “free”, yes, but “freedom” that we mean is a consciousness. It does not abrogate inner morality based on intuition. (I am not speaking about outer moral laws). Then when one becomes truly FREE, one is also released from pettiness---of concept. This is so hard to write in a letter. Also I feel that modern man (as Krishna himself indicated), cannot be absolutely free of the earth and of men. If he becomes TOTALLY free , as you indicate, even of himself, he no longer has the need to write poetry either. This totality will only come to be in a future that is far distant---and if we poets develop true consciousness. True consciousness also assumes a certain responsibility. Am I contradicting myself? Ask yourself deeply and truly. Malay (please forgive the first name, but I hope it is all right), what was your intention in writing about masturbation and pubic hairs? Was it because you were truly deeply expressing a Free Divine---earthly concept? Or was it shocking? Be honest with yourself. Was it to destroy Indian rigidities? Or was it a false Luciferic temptation, disgusting itself in Light?
    I do not demean your nobility, and am willing to be convinced. Once again, I am not speaking from the point of view of prudishness, heaven knows. I was one of the leaders of the American “avant garde”. But we have moved past the destructiveness into a direction of wholeness and spirit.
    “Spirit”, yes, but in a contemporary idiom. I am sending you my books. They will arrive in about four months, no doubt. Please send me your poems SOON, as time is limited as far as the publisher is concerned. The poets will receive compensation or a book for works used..
    My deepest wishes for your vindication in that disgraceful trial. What can I do for you? I am ashamed of India for this.
    With reverence,
    Daisy Aldan
    Lawrence Ferlinghetti
    26 March, 1966
    Dear Malay: I have read the legal decision on your case, and thank you very much for sending it. I find it laughable. I want to publish it together with your poem STARK ELECTRIC JESUS in the next ‘City Lights Journal’ which will be out this coming summer, and I enclose a small payment immediately, since I know you must need it desperately. I am sending a Copy of this letter to Howard McCord. Perhaps he knows the answers to the following questions and will send them to me right away, since time is of essence, and it may take some time to get a reply from you. I think it is a wonderful poem, and I will certainly credit McCord for having first published it. Bravo.
    Allen is in NY and his new address is: 408 East 10 Street, (Apt 4C), New York, NY.
    I need to know the answers to the following questions: (1). Was the poem first written in Bengali and was it the Bengali or the English version which was seized and prosecuted? (2). Is this your own translation, or whose is it? (3) Do you wish me to use the typewritten copy of the poem which you sent me last year, or the version printed by McCord? (I find some differences.)
    Let me hear as soon as you can. Holding the press.
    And Good Luck. I hope you are still able to survive! With love.
    Lawrence Ferlinghetti
    Robert Kelly
    5 June 1966 (birthday of Garcia Lorca)
    Dear Malay,
    How hungry we all are---and that is that Associative Energy brings prick to its house, food to our bellies, friends to our table, my hand to this paper to wish you “News and well”. I write by the light of two green candles, the smaller one moulded from the melt-wax of the larger---its wick burns faster---the wax is softer; only the hard endures, keeps enough of its divine form to let itself petrify in form, become amorphic fossil of itself ---alive in sports if not in conditions. (Last month I finished a very long poem, weeks, in 150 Sections---it represents a non-linear structure which is nevertheless deeply committed to receiving what happens around me, to me: what emerges. Work had been started just a year before, right on the heels of that dancer Round Dances was: her body. Now there is a much shorter long poem, “Map of Annandale”). Obscenity we must finally begin to praise and pornography as such, as genre, legitimate form: too long we have hedged about with art vs pornography. Be well and strong, in the image of the body- --I look to see your poems in English.---Courage, love.
    Robert
    Octavio Paz, New Delhi
    The 16th of July, 1966
    Dear Mr. Choudhury:
    Last time I was in Calcutta, I met some of your friends who talked to me about you.
    I hope I shall find an opportunity to meet you when I visit your city or whenever you get a chance to come to Delhi
    Meanwhile please accept my best regards.
    Cordially yours,
    Octavio Paz
    Ameeq Hanfee, 104 Gandhi Park Colony, Indore
    26 July 1966
    My dear Malay,
    I am extremely grateful to you for your permission to translate your poem ‘Zakhm’
    into Urdu. I assure that the Urdu version of your poem will do full justice to it and may even sound better than the Hindi one. The Hindi translator has done his job very well, no doubt, but at places either he or the press has not been vey careful in the use of ka! ki! ke!
    etc., as well as certain Urdu words. On the whole the Hindi version seems to be a fairly faithful reproduction of the mood, spirit and expression of the original
    I had written to Basak to send me literature of and on the Hungryalist writings and movement, and he had promised to enlighten me, but I did not get anything except his own article, the Calcutta Presidency Court judgement and the Hindi version of ‘Zakhm’. Whatever I know about your movement is through what I read in BLITZ, TIME, DHARMAYUG, MARAL, GYANODAYA, ANIMA, and LAHAR. I wish to go still deeper before venturing to write about the Hungryalists in Urdu. I am a poet and find your poetry---Hungryalist poetry---full of inspiration, freshness, fire and oxygen.
    I am looking forward to the day when we will meet and not only compare notes but also exchange heart and mind.
    I was all the more interested in ‘Zakhm’ because I found that you and I share a lot of common ground. There are so many lines in ‘Zakhm’ which express the same or similar experiences I have expressed in my long poems ‘Sindbad’, ‘Sharzad’ and ‘Shabgasht’. I must give you the credit of being more modern---rather up to date in your imagery, diction and poetic statements than I could be. Still your wound is not very different from mine.
    Let us all succeed in exploding the atom for real peace and freedom---the atom of our individual experience. After all the subterranean source is the same from which we all have our blood-lines connected.
    With admiration, regards and love
    Ameeq Hanfee
    Gordon Lasslett, 67 Acton Street, Hurlstone Park, NSW, Australia
    August 20th, 1966
    Dear Mr. Choudhury---
    Having recently read your ‘In Defense of Obscenity’ I wish to say that I agree almost completely with you. Consider this one a fan letter!
    Magazines & books (of poetry) from India are not unknown here but they are all so very very stuffy. Could you recommend some decent titles, perhaps your own, and tell me where I could obtain them.
    The maternal side of my family has associations with India in that they were officers in the very British ‘Indian Army’. Perhaps my great grandfather kicked your great grandfather!
    How do Indians feel about migration to Australia.This is one of my ideals and I speak in favour of it whenever possible---but Australia is too ‘white’. This country is so bloody empty and in need of cultivation (pastoral as well as artwise) that one goes in to fits of manic depression to see such waste. All because a few sit on their unwritten ‘white Australia’.
    With that, in view of Americanization and the growth of authoritarian nationalism, Asian migration is the only hope of keeping our freedom.
    Kiss the Additional Chief Presidency Magistrate
    for me
    please,
    Gordon Lasslett
    Dan Georgakas, Box 418, Stuyvesant Station, New York, New York 10009
    August 23, 1966
    Dear Malay,
    Sorry to be so long about writing but you can see I have been moving around. Your ‘In Defense of Obscenity’ is a beauty. Allan Van Newkirk is going to print it in GUERILLA. Allan and I are not connected with Artists Workshop except for in the most casual way. Smyrna Press is separate and so too is the new GUERILLA.
    Karl Heinz Weissner tells me he has contacted you (at my urging), and he is tuned on by Stark Electric Jesus. I hope you will dig my own Manifesto For The Grey Generation.
    Allen and I have founded a group called The League of Revolutionary Poets: Torp. We combine politics with poetry-in-happening---action events. Example: On August 6th we attended a peace parade and hung Johnson in effigy and flew the NLF flag. August 7th we attended the Festival of People at Artists Workshop, and held a mock trial (they had no warning) of love-dove poems, which angered many in the audience. August 9th: Anti-war poems: reading at downtown rally. August 13th: letter to paper congratulating Detroiters on letting their Greek Theatre die since any nation supporting a Vietnam atrocity could not support Gk Theatre too. New activities: war crime tribunal in Detroit, melon poetry reading in Pittsburgh, trial of love in Chicago. We seek creative vandalism. Today I read a foul story in Village Voice. Wiped my ass with it and sent it in to the paper. I am getting a squirt gun and will fill it with paint. Shoot when ready, the Grey Generation. I want to go to the opening night of the Opera when all the shitheads are there, and hurl anti-war poems from the galleries when the war-criminals enter. DADA lives. SURREALISM returns. Lasslett in Australia, Weissner in Germany. Nutall in Britain. Partisan of the world unite. Towers, open fire.
    Doubleday & Co will anthologize a poem for me. Story in homosexual magazine. Poem in communist magazine. Makes me a capitalist homosexual communist dog or a chameleon. Clifton de Berry is our man. io! ee! This is the world, begins with a BaaaaaaaaaaannnnnnnngggggggGGGGGGGGG…..’’’’’
    Wichita Vortex Sutra-----wonderful. Ginsberg reads in Washington Square on Sunday to test new law about pornography and such.
    Allen says he has sent Miller’s Sexus.
    Prices sky high in New York. Faces ugly. Squalor everywhere. But a vitality. The Blacks are beautiful. Anger. Revolution. You must stay in India and smash them. This is the age of sabotage and subversion. Smash the word. Destroy the logic. Warp the system until it snaps. Love, oxygen, semen, tulip buds, serendipity syringes----breakthrough in the grey room---dan georgakas
    Dan
    Carl Weissner
    24 September 1966
    Dear loving brother guru
    This finds me in the process of recovery from illness & series of bringdowns & now again working diligently on issue 4 of the mag….before the sickness had led my metabolic blues astray. I got me a job & they had to pay me for the whole period of illness which is the only pleasant thing about a job,…I have been able to cut costs for printing the mag down to something like 150 bucks, but still…
    Tell me: did you get yr copy of the manifesto? (I mailed two copies to Subimal Basak) and did you get my last letter? What abt the proceedings of appeal? already over? And what is the outcome? favourable for you I hope!....Yes, I will write to Donatella…..she has just sent an English translation of her Ginsberg essay which appeared in ‘Studi Americani’ in Italy last year…also good letters from Carol and Dan….
    YES! BY ALL MEANS SEND THE TYPE SCRIPT OF LIFE , ARREST, TRIAL, GINSBERG, CALCUTTA!!!!! Listen:!! Gerard Malanga just sent a large and fantastic collection of poems, 4 of them dedicated to Allen! Also magnificent photos of Allen and himself! He will probably also write for KLACT abt his friendship with Allen! And Diana Di Prima sent a collection of cute short poems, all from 1957….all this will be included in KLACT 5 (spring 67)…I have also written to Allen & asked him to contribute original work, hoping he be willing to do so…COULD YOU WRITE HIM AND TELL HIM A FEW GOOD WORDS ABOUT ME AND KLACTO PLAN AND URGE HIM TO SEND STUFF??!!!! He is at 408 East 10th Street, Apt. 4C, New York, NY 10009…
    I have not yet found time to contact the people you told me, but will do so any day now….I will concentrate on Subimal’s and your work, tho… in No 5….but may be I will also contact Howard McCord (please give me his address!)….if it shd turn out that I have space left for more Bengali/Indian in No 5…..
    DID YOU RECEIVE THE ‘ICONOLATRE’ ISSUE I SENT YOU??!!!
    Also Larry Eigner sent me more poem: today, which will be in KLACT 5…yeah, things are really swinging now!....I am also thinking of publishing George Dowden’s new great visionary poem RENEW JERUSALEM in a limited edition, sometime later this year, if I have the money….(!)…..
    The English original of your article of course will be in KLACT, and I will translate it into German, too, and look around for possible publication in German mag…ok? O YEAH! Looking forward to translated passages from ‘JAKHAM’ plus one page in original BENGALI! GREAT! Please note: Bengali page, if possible, should be written on white sheet of paper in black ink, and should be sent whole, that is, not folded----so that it can be used for repro….
    Do you know MAHENJODARO (ed. Samir Roy, 55/4 Natabar Pal Road, Howrah)? What it is like?---and POETRY TODAY (ed. Nissim Ezekiel, The Retreat, Bellasis Road, Bombay 8)? Qk. So much for this time.
    All best to you
    Love
    Carl
    Carl Weissner
    5 December 1966
    Dear malay
    The great sky is open----northern Italy washed away in vast mud & storm chaos & deluge----desperate letters from Donatella Manganotti----priceless artwork destroyed forever---and just a few minutes ago I hear in the news that they are in for yet another meterologic showdown---Bihar province like a vast dried-up cunt I gather---hunger & revolts everywhere---German government collapsed, neo-Nazi movement scoring for the gaps: Christian & Social Democrats joining forces to make a last desperate attempt at saving the old ship St. Nanana already half drowned---Hanoi set ablaze by efficient hordes of technicians of death masterminded by sick pentagon eunuchs & a corny Texan cowboy putting out fake charismatic vibrations that materialize in tons of explosives & charred remnants of Asian bodies enabling Wall Street to hang on for another fiscal year---you see how they are caught in loops and spins of lethal genetic roulette---a uniform grey generation scurrying among nuclear debris of heavily infected areas of cancerous mind like rats in terminal stage of dream withdrawl eating erogenous holes in huge chaotic setup of punch-cards that represent lives marked for Total Disposal---one more turnstile before the whole shithouse blows up---Nova Criminals wishing up dwarfed marks everywhere on this sick planet---SECONDS TO GO---you can already hear that heaving human blues heading for its irrevocable Dead Whistle Stop---so? Burning heavens, mister---nova armies conspiring across the wounded galaxies---icarus, nova-directed asteroid, due to blot out a terrestrial spot of bother the size of new york or tokio or London, on june 15, 1967---or September 13, 1968---what’s the difference---with the impact of one thousand hydrogen bombs---you see how things have grown to hitherto unimaginable bad proportions---a disarmament conference would have to include representatives of Nova, Interzone & Minraud, and there’s little chance that one could ever bomb this intergalactic gook rot to parley---and god knows how many of their agents are already operating among us disguised as word & image technicians seconds to go---we’ve got to attune our paranoiac feelers to that vast danger around us, spot them wherever they show a blind spot & stop them dead in their tracks---
    In order to achieve this we have to provide ourselves with an insight into their methods & operating schedules, and the work of Bill Burroughs & a few other semantic cosmonauts shows precisely who they are & how they operate---in supersonic patterns of sense-wave control---or long, medium, short & ultra short waves of the world---in cosy bed sitters, court-rooms, arenas, parliaments, newspapers, or gone streets---in subcutaneous offices of annexed brains around the paralyzed globe---right where you are sitting now there in Bad News Department walking in on you cool & casual with a perfunctory ‘hello there’---and metamorphosing you into an obedient Hate Virus host in a matter of seconds---if you are not fully aware---each second & if you do not know who they are & how to fight them---now---in forthcoming issue of KLACTOVEEDSEDSTEEN you will find more details & outlines of steps to be taken towards an immediate universal survival training in a piece by Mr. Burroughs & Mr. Weissner; called LAGUERRE PARTOUT (war everywhere), precisely showing some of the hideous techniques by which the nova criminals try to mono-police & control & manipulate so-called ‘reality’ in order to subvert & takeover mind & consciousness of every single of us---
    Carl
    Howard McCord
    10 January, 1967
    Dear Malay,
    It is a joy to receive your last three letters, for I see in them your good spirits and your kindness in telling me of the various Indian drugs. I do hope things turn for the better with you from now on, and that your appeal is successful. I have sent today the copy of the CITY LIGHTS JOURNAL you requested. I sent it directly to you by airmail. Yesterday I sent you a copy of my new book. Just today I received a copy of Gary Snyder’s reaction to the book, and it was wonderful. I admire him greatly as a poet, and he found my own poetry worthy and exciting, so I too am in good spirits.
    Yes, I would like some things from India: either ganja, bhang, or charas. I like the hemp/hashish derivatives of cannabis sativa (here in America the plant is generally weaker than in India, and the leaves and flowers are only smoked). But I do not care for any of the opiates. They are physiologically addictive, and depressants, additionally, cannabis is a psychedelic. In working over your letters, I have found INDIAN MATERIA MEDICA, by A.K.Nadkarni---and it is a great store of information about Indian medicinal plants. It has an especially good section on cannabis(marijuana).
    I have just been through many of the proofs of the new SALTED FEATHERS. It has a fine production, and should be out in a month. Dick may well already have sent one of the flyers, but I enclose one also. He has also written to Ferlinghetti for permission to publish once more STARK ELECTRIC JESUS, with more money coming to you, and I hope Ferlinghetti grants his request.
    My anthology goes along---I think by Feb I shall have the manuscript finished. Most of your things---like SEJ---will be included and as soon as I have a good list of contents, I’ll send it along to you.
    I really liked the paragraph about your mother & your youth. It would make a good poem.
    Ether is probably a good bash & drunk, but I wonder if it does what LSD does. In the old days Nitrous Oxide (laughing gas---as anaesthetic) also provided researchers with interesting experiences---William James for one. If, by the way, you should get into bad LSD trip, THORAZINE, a tranquilliser, is supposed to be a good antidote.
    A thick letter could probably also contain enough ganja, etc., for a cigarette or two and not be too noticeable, yes?
    Much love to you, and I hope the poem in
    FABLES AND TRANSFIGURATIONS talks.
    Howard
    Carol Berge
    March 7, 1967
    Dear Malay,
    Now I have your photo. McCord sent me a copy, or was it Dick Bakken! .Anyway, one of the friends here. You seem a fine handsome man---and I am glad to see
    Samir’s daughter as well. Your face sits opposite me, it is over my kitchen table, on the wall, so that each day when I break bread, I can share with you.
    Sometimes I don’t like being a part of a big city, but I never feel alone. This is trouble, in a way: there are always too many things to see and do: too many people and friends. The hardest thing is to be alone and do the work, too much temptation to go out and be busy. I tend therefore to be a recluse in my own way, though quite active to other eyes, in writing activities. I stay home almost all day everyday, to write or read or answer letters etc. I go out three or four nights a week, reading poetry or listening, going to dance programs, or to hear music etc.,---there are many activities within just a four-block radius of where I live.
    Yes, of course, I received your resume, didn’t I acknowledge it yet? I gave copies to McCord, to David Antin, to Joel Oppenheimer (I think), and to Bob Creely up at Buffalo (State Univ). I have no idea what might happen but all I can do is to try for you, with those friends who are academically affiliated…..I wish you so much good luck!
    Sure, I would like to have a double-volume of poems out, your poems and mine. I shall make the suggestion to Nelson Ball, Apt 4, 22 Young St., Kitchener, Ontario, Canada, who publishes VOLUME 63, at University of Waterloo, Canada. Nelson recently let me edit a section of New York poets for his magazine. He is also editing a series of small poetry books. Let me get him to write to you; in the meantime, you could write to him if you wish, offering him 15-18 pages of poetry for him to select from. What do you think? I had the idea of giving him two or three ‘long’ poems, each about three pages long. You might do the same. This is one of the propositions that he would be interested in the idea of double volume. I think it would be very interesting indeed & it is possible it would give us a nice public interest, and a tiny bit of money maybe. How are you doing for money these days? Are you still working? Tell me.
    What you say about always having felt that in your life there is always something pending, something big about to happen----no, my story is that I did not go anywhere or do anything at all of any importance till I was 30 years of age---so that at 30 I still looked around 22, and my mind and emotions were that of an adolescent. I’ve done all of my growing up in the last eight years. This keeps me naïve and still 10 years behind my peers in my work and my ideas. But I sure did live a fast and hectic 8 years, trying to catch up. All the work of mine that you’ve seen comes from this period. All of everything. I think it is a question of working against fate to get the world to accept you on your own terms. You could call it ‘the Establishment’ too if you wanted to. Of course here we don’t have
    The desperate poverty and the simple physical argument you have in India---although I was poor as a child. But each artist constructs its irritant against which the struggle seems stronger. All of us seem ill---suited to fit into the society in most ways. I think it has always been thus, as we shall always have wars. Part of the human condition. And the artist representing the human condition has to extend to cover all of human experience somehow---the rich, the satisfied, the ugly, the lovely---all of it---you know all of it no matter where you live or how you live. And so do I, somehow….
    A friend, Wendell Metzger, a strange fine man who is a playwright, is going to be in India soon. I gave him your address so that he could contact you if he was able. He is not a part of our ‘hip’ scene as with Allen G. & our other friends, somewhat older too, but a good friend. See him if you can.
    Today I think that life means only resisting; there seem to be no easy steps or solutions. I wish for too much and then I wish for the peace of no-wishing. This has been a good year until now but begins to get difficult and moody again. But my health is good and there are a few people who understand, and a few others who love me, and always the writing, so one continues. I haven't any idea what sustains any of us, do you? I call it ‘The Infernal Spirit’ in my own mind sometime.That doomed flame. You will be a popular success in this country before you are accepted on your own! And how often this has been the case. US writers succeeded in England before the US, and our musicians certainly find more success and response in European Opera halls, concert halls and Jazz cellars than in the slow sedentary stiff minds of their own countrymen. Stubborn!
    Write to me again soon, now I feel we’ve had some kind of long talk about the condition of being creative----at least a beginning----
    With love as always, yr friend
    Carol
    Ameeq Hanfee, 140 Gandhi Park Colony, Indore 1
    April 12, 1967
    My dear Malay,
    I am sorry that my correspondence stood still for the last two months or so. I found myself quite barren to create and produce anything. NO communication was possible. A very turbulent emotional and neurotic storm was raging within me. My intellect failed to play the Noah’s Ark. Somehow I am emerging out of this and feel better and fertile. It was quite an experience I never had before. Though incomplete, I find it has filled a gap. When I look back, I feel that only a storm could wash my inner self that had accumulated a lot of dirt and the wet dusters of reason could not clear it off.
    I feel it was a process of catharsis. It was like a surgical operation of the heart of my soul and the suffering and pain was because no anaesthesia was given. Now, when the wounds are healing up, I have a different vision. It is a pleasure that fills me. The words break, the images crack and the expressions burst when I try them to contain this new experience---perhaps because it is still too hot. I very much doubt if LSD and other drugs can bring forth the images and ecstatic patterns that this semi-mystic experience is projecting before the inward eye. Language is a very weak vehicle to convey this
    Well I am anxiously awaiting the finale of your trial. It is not you but all of us on trial. It is freedom, in you, on trial.
    I am glad to hear that the Hungryalists have warmed up again and are assailing the literary scene with more vigour and virulence.
    ‘Zakhm’ is waiting to appear in print. The mag in which two of my articles and ‘Zakhm’ have been accepted for publication has been delayed and I have not been told when it will be published.
    Your suggestion that I must bring out a cyclostyled collection of my translated poems strikes me immensely. I am inclined to take to it.
    Sincerely
    Ameeq Hanfee
    George Dowden, London.
    22 April 1967
    Dear Malay,
    Good to hear from you; glad you have some kind of job now. I’ve gotten together with Utpal Basu here, good bloke, but doesn’t seem to be doing any writing here; just teaching. He introduced me to the shehnai (recording: The Magical Shehnai of Bismillah Khan), which is a lovely instrument. I dig the morning raga on that recording, but not the evening one particularly. I also wrote to Dick Bakken about collecting SALTED FEATHERS, just yesterday. I am about to write to the National Library of India about Ginsberg, as you suggested. Meanwhile, if you have spare copies of any Indian mags he was in, please send, like UTTARSURI of Dec 1963, MOHENJODARO of 1963 etc. AS I said, I’ll pay---or send you things in exchange. You mentioned wanting books on Cubism, Surrealism and Dadaism---there is a good series here, which includes all of these, a book on each; the publisher is Thomas Hudson; the Cubism book is by Edward f. Fry, Surrealism by Patric Waldberg, Dadaism by Hans Richter. Do you have these available there? If not, I’ll get them for you and send. Let me know.
    Did RENEW JERUSALEM arrive all right? Let me hear you about it. Seeing lawyers now, wanting to safely bring out an edition here.
    America is getting worse and worse; lies and destruction, threat to the whole world. Fortunately the youth are not listening to their bullshit except to jeer at it, and as long as that goes on, can not be stopped, there is hope. If the totalitarian impetus in America gets its own way, and all the power, then all hope is gone. South America would become the next Vietnam, and so on. But I think they will be stopped---though not until more blood flows.
    Let me know how you are doing. Write soon.
    Cheers,
    George Dowden
    Ten
    In the issue dated 20th November 1964 TIME magazine wrote, “A thousand years ago, India was the land of Vātsyāyana's Kāma Sūtra, the classic volume that so thoroughly detailed the art of love that its translators still usually leave several key words in Sanskrit. Last week, in a land that has become so straitly laced that its movie heroines must burst into song rather than be kissed, five scruffy young poets were hauled into Calcutta's dreary Bankshall Court for publishing works that would have melted even Vātsyāyana's pen. The Hungry Generation had arrived. Born in 1962, with an inspirational assist from visiting the U.S. Beatnik Allen Ginsberg, Calcutta's Hungry Generation is a growing band of young Bengalis with tigers in their tanks. Somewhat unoriginally they insist that only in immediate physical pleasure do they find any meaning in life, and they blame modern society for their emptiness. On cheaply printed paper, they pour forth a torrent of starkly explicit erotic writings, most of them based on their own exploits ("In the Taj Mahal with My Sister") or on dreams. "My theme is me," says Hungry Poet Shaileshwar Ghose, 26, a schoolteacher. "I say what I feel. I feel frustration, hunger for love, hunger for food." Three Widows. To all appearances, their appetites are unlimited. In a short story, Bank Clerk Malay Roychowdhury, 25, tells of a starving poet who first devours his fiancée, then his poetry notebook, then a building and Calcutta's huge Howrah Bridge. A poem by Schoolteacher Ghose crows that "I impregnated three widows at a time, and now I am lying in bed happy. What next?" Absurd as they seem, the Hungries see themselves as the spokesmen of a betrayed and miserable people. "Our frustration is not just personal," says a 28-year-old geology lecturer. "It comes from the strains, the poverty, the squalor of our society." And in a series of violent manifestoes, the Hungries singled out their enemies, including hypocrites, conventional writers and politicians whose place in society lies "somewhere between the dead body of a harlot and a donkey's tail." To "let loose a creative furor," the Hungries last summer sent every leading Calcutta citizen—from police commissioner to wealthy spinsters—engraved, four-letter-worded invitations for a topless bathing suit contest. Done-for World. With that, the entire Calcutta establishment rose up in rage. Newspaper editorials, quoting passages from their works, proved conclusively that they were dangerous and dirty—so much so that Calcutta's reading public began to look for them. Under civic pressure, the police hauled away 26 of the "poets" for questioning. Five were suspended from their jobs and booked on charges of obscene writing and conspiracy against society. The evidence for last week's trial was irrefutable, but meanwhile the Indian government had been approached by sympathetic intellectuals at home and abroad. Looking for a face-saving exit, the Calcutta prosecutor, temporarily, requested a postponement in court. To celebrate their temporary freedom, the hungry beats raided an art gallery, beat up three painters, then walked happily away to resume their pursuit of the Hungry Generation's declared goal—"to undo the done-for world and start afresh from chaos."
    Allen Ginsberg hsd gifted a copy of City Lights Journal  to Buddhadev Basu in which our poems were published and he wrote about Bengali poetry. Buddhadev Basu wrote to Sunil Gasngopadhyay that Ginsberg had no idea of Bengali poetry. The copy gifted to Buddhadev Basu by Ginsberg was later purchased by Adrish Biswas from College Street footpath. The letter Ginsberg wrote to Abu Sayed Ayyub, a member of Indian Congress for Cultural Freedom and Ayyub’s reply have appeared in several periodicals. Abu Sayed Ayyub’s mother tongue was Urdu. The letters give a glimpse of the thought process of gatekeepers of Bengali Culture: 
    Allen Ginsberg’s letter to Abu Sayed Ayyub :
    704 East, 5th Street, NYC, Apt 5A, USA, October 6, 1964
    Dear Abu Sayyed
    Obviously my note to you was stupidly peremptory or short witted and I am sorry I got your goat, possibly or probably I deserve to be put down for the irritant discourtesy of my writing & the presumption in it, telling you what to do, etc. butting in where it is not my affair and possibly ignorant of the quality of the texts. And chiding a senior. For which I do wish to apologise, offering as an excuse that I wrote in great haste — many letters on the same subject the same afternoon — and that the situation as I understand it is a little more threatening to the young scribes than you understand it to be. Maybe it has settled a lot since I wrote. But from what I understand, from the letters from Malay, as well as Sunil Ganguly & Utpal Basu ( & the latter two seem to be mature in judgement ) ( Malay I like as a person & do actually admire the liveliness of his englished manifestos — to my mind a livelier prose wit than any other Indian English Writing. ) ( though I realise he is inexperienced & impetuous and part of the charm is the naivete of the manifestos. or, better, innocence of them ) ( this simply being a matter of of gut taste preference intuition & certainly not the sort of literary matter to be settled by police action ) : the police situation at one time was that not only Malay but his brother Samir ( an excellent philosopher ) as well as Debi Roy as well as two young boys I never met Saleswar and Subhash Ghose were all arrested. Then let out on bail. In addition to a general police investigation, according to Utpal, “those arrested are already suspended from their jobs & if they are convicted they may lose it.” Further Ananda Bazar Patrika, Jugantar, Janata and other Bengali papers fanned the fire against “obscene literary conspiracy.” Simultaneously the Supreme Court judgement of Lady Chatterley as obscene also, has, according to a clipping I read, from Times of India, “led many people to complain about the lewdness in the writings of many Bengali poets and novelists. Says Basu, “impossible to get any other job if one is lost.” The arrested five were tied and locked up for one or two days each. Utpal Basu was detained by police and questioned for five hours. I also understand that Sunil was questioned by police. As far as I know it is still not decided whether or not the police will actually prosecute, and that decision will depend on the support given to the younger writers by older established writers and like the cultural groups Indian Congress For Cultural Freedom. Everyone I hear from has said that the Congress for Cultural Freedom has not spoken up in any way. All told the situation, whether or not one approves of the literary quality of the texts, is much more threatening than I would gather from your letter. My own experience of the bureaucratic complications of police investigation in India — it is endless and Kafkian grimness — led me to a much less light-hearted view of the matter than yourself. As you may remember I was followed for months in Benares, visited by the police, threatened by Marxists, given a ten day quit India notice on vague charges of distributing obscene literature & corrupting the young. It took intervention by friends in the Home Ministry in Delhi & a letter from the Indian Consulate in New York to begin to straighten it out. So I have no confidence that a dismal legal process on literary matters once started, is so easily dismissed. Particularly where young apolitical inexperienced enthusiasts are concerned..
    I do not agree with you at all in your evaluation as obscene & filthy the sentence :”Fuck the bastards of Gangshalik School of Poetry”. Not that I even know which school that is. But it is common literary parlance both in speech and public texts from cafes of Paris or Calcutta to old manifestos by Tristan Tzara. The style, the impetuousness, the slight edge of silly ill-will, the style of “Burn the Libraries' ', an old charming XX Century literary cry. I do not really feel very “shocked” to hear that they let a lady show people her breasts in public. Do you seriously find that offensive ? I suppose it is a little bit against the law — of course they had a woman completely naked on the balcony last year of the Edinburgh Festival — brightest moment of the Fete I hear tell — Yes, certainly I do approve. However I did not think of it myself nor “promote” it from halfway around the world. And I do not really think that mere publicity is the deepest motive one can find in such typical Dada actions. In that I think you are really doing them an injustice, however low you grade their literary productions. Because, after all there is considerable difference of opinion, as to the literary quality. Ferlinghetti, who does not know these writers, is publishing a self-translated section of writings by Malay, Sunil & basu in his City Lights Journal. The texts were collected by Mrs Bonnie Crown of the Asia Society, who found them as interesting as any translated texts she had been able to collect. The magazine KULCHUR here — which has considerable avant-garde circulation — also reprinted three of the manifestos in question ( on prose, poetry & politics ) earlier this year. This is independent of my correspondence with anyone.
    In sum, what I do know, in translation of the poetry & manifestos of Malay & the other poets arrested or questioned by the police, was pleasing. So, despite half a world difference, and acknowledging your greater familiarity with the literature, I must claim my prerogative as poet and also as critic ( since I edited and acted as agent here for such unpublished writers as Kerouac & Burroughs & Artaud as well as several different schools of US poetry ) to stand by my intuition and say I do definitely see signs of modern life well expressed in their works. Not claiming they are geniuses or even great — simply that in certain precise areas expressing psychic dissatisfaction with their society, they do reflect well their thoughts, and reflect uniquely –their other contemporaries & seniors being more interested in classical piety or “sociological” mature formulations, Marxism, Humanism etc. I do not think it would be correct to term them Beatnik much less Beatnik imitators, since that is primarily a journalistic stereotype that never even fit the US supposed “Beatniks.”
    Regarding the Congress for Cultural Freedom, I do stand by my fear that it is 1) possibly supported by Foundation funds connected with the US government. 2 ) Less alert to dangers of suppression within the Western world and allies than within the Iron Curtain. In the US we have been all this year undergoing a siege of legal battles over stage works, books, movies, poetry etc. which has nearly crippled the public activity of avantguard. I contacted the US Committee for Cultural Freedom head Mr A. Beichman who said himself, the Congress is only a skeleton group in the US now inactive. And this year I contacted John Hunt from New York to move the Congress to defend Olympia Press in Paris. This is a lag. My criticism was more just than you will allow, though overstated. OK Best Conscience.
    Allen
    [PS]
    Do you really insist that the Manifestos can NOT be classed as “Literature” & therefore it is not a literary repression problem ??? Really ?????????????????????????????????
    I will write to the Paris Office as well as Mr Karnick. You must remember that the Russians denounce Brodsky and Yevtushenko/Voznesensky as 3rd rate writers, worth no official attention. And I have heard that often enough about myself from US Police agencies.
    Abu Sayed Ayyub’s letter dated 31 October 1964 to Allen Ginsberg :
    Dear Mr Ginsberg,
    I am amazed to get your  pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with the Communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate did not, however, surprise me; for I never thought the Congress had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeois’ or ‘respectable’.
    If any known Indian literature or intellectual comes under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of any kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertizing leaflets and printed letters abusing distinguished people in filthy and obscene language ( I hope you agree that the word ‘Fuck’ is obscene and ‘Bastard’ at least in the sentence “Fuck the bastards of the Gangshalik School of Poetry’, they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avant garde exhibition  ! You may think it your duty to promote in the name of Cultural Freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
    It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now ) thus giving the publicity and some public sympathy—publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
    I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik Poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language —- a language of which you choose to remain totally ignorant.
    With all good wishes in spite of  our grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
    Yours Sincerely
    Abu Sayeed Ayyub
    The legal battle at Bankshall Court went on for twenty to thirty minutes every week which was creating big holes in my pocket, without any place to stay or have lunch and dinner. My health was deteriorating. The prosecution produced witnesses to prove it was my poem, written and circulated by me, seized from my custody, and that it was obscene. Police informers Pabitra Ballabh and Sasmir Basu claimed that they knew me very well, though I did not meet them earlier, and that the poem was vulgar and obscene, and that they had seen me distributing the booklet in Albert Hall Coffee House. My associates, Subhas Ghose, Saileswar Ghose, Shakti Chattopadhyay, Sandipan Chattopadhyay, Utpal Kumar Basu, though did not say that the poem was obscene but were vague in their reply at the cross examination. 
    The courtroom was very dirty, with a two blade British ceiling fan above your head which made more sounds than air. The walls were layered with spit, red colour betel leaf spit at the corner of the room. Most of the chairs were without handles and some benches at the back, all full of bugs. The light bulb was dim. My lawyers did not take any seats. They just argued and proceeded towards another room for another client’s argument. I was made to stand by the side of a big cage in which undertrial bandits and murderers who did not get bail, assembled. They came from jail through the back door. One day one of the bandits, who was listening to arguments, suddenly told me in a hushed voice, “Those fellows were members of your gang and now speaking against you ? Do not spare them. Cut off their heads after your trial.”
    To counter the arguments of these persons my lawyer Chandi Charan Moitra advised me to approach some writers or poets who would argue in favour of the poem. Ginsberg had written to Sunil to become a defence witness. Jyotirmoy Datta and Tarun Sanyal themselves approached me and offered to be defence witnesses. I also approached poet Ajit Dutta;s son Satrajit Datta who was a psychiatrist at Kolkata’s Lumbini Park Mental Hospital. Sunil, in cross examination, told the judge that he had read the poem and read it out loud if the court permitted it. ‘Stark Electric Jesus’ was a beautiful poem, he said. The expression of an important poet. Tarun said that his students had liked the poem, that it was a piece of creative art. Jyotirmoy testified that it was an experimental poem and not at all immoral or obscene. Satrajit said there was no question of inflaming passion or depraving the mind of a reader.
    The trial came to a close at Bankshall Court on December 28, 1965, which means my ordeal at this lower court took one year and three months. The judge Amal Mitra, in his ten page verdict, found me guilty, directed me to pay a fine of two hundred rupees or be imprisoned for one month, and gave orders for the destruction of all copies of the issue. The judgement created such fear among poets and writers that they not only destroyed this particular issue but all the bulletins they had saved, Daniella Capello who has worked for a doctoral thesis on our movement has found several bulletins and photographs at various universities in USA and Europe. The Indian author Uttaran Das Gupta found them in the British Library. 
     It being the maximum penalty, the judge did not permit me to appeal to Kolkata High Court. I filed a revision petition at the High Court and started searching for a good criminal lawyer. Stark Electric Jesus was the first legally condemned poem in Bengali literature. The judge did not rely on prosecution or defence testimony, but rather drafted his own piece of literary criticism, aware of its going down in our literary history, as evident from the last passage of his verdict which is as follows :
    “By no stretch of imagination can it be called, what has been argued. An artistic piece of erotic realism opening up new dimensions to contemporary Bengali literature or a kind of experimental piece of writing, but ot appears to be a report of a repressed or a most perverted mind that os obsessed with sex in all its nakedness and thrives on, or revels in, utter vulgarity and profanity preoccupied with morbid eroticism and promiscuity in all its naked ugliness and uncontrolled passion for opposite sex. It transgresses public decency and morality substantially, rather at public decency and morality by its higher morbid erotic effects unredeemed by anything literary or artistic. It is an affront to current community standards, decency, and morality. The writing viewed separately and as a whole treats sex, that great motivating force in human life, in a manner that surpasses the permissible limits judged from our community standards, and as there is no redeeming social value or gain to society which can be said to preponderate, I must hold that the writing had failed to satisfy the time-honoured test. Therefore it has got to be stamped out.” 
    Eleven
    The hearing at the High Court takes several months, even years, as thousands of cases pile up. Jyotirmoy Datta introduced me to Karuna Sankar Roy who had practised in London and had started to act as an assistant solicitor to famous criminal lawyer Mrigen Sen. Mr Roy informed me that fighting a case in the High Court requires big money. He however assured that he has talked to Mrigen Sen who is aware of the case and would not charge much, but his assistant lawyers Ananga Dhar and A.K.Basu should be paid the expenses they incur while filing the case. I gave him all the papers and files containing court documents. I also handed over to Ananga Dhar whatever money I had pooled till then to enable him to get the vakalatnama or the power to fight the case on my behalf signed by me. He said I need not bother about the trial as they are going to argue the case at the High Court whenever it comes up for hearing. 
    Although The Searchlight, a daily newspaper, published a special supplement on the eve of my conviction by lower court, with a twenty thousand words essay by its editor, Subhas Chandra Sarkar. Life for me had become miserable all those six months. Living in a dark, damp, dilapidated room at Uttarpara most of the time, alone, shrinking, taking a bath once or twice a week in the Hooghly river to get rid of lice, eating at anybody’s expense, begging around money for the court expenses, in dwindling health, suffering harsh criticisms and with dementia creeping in, I felt shattered. All these experiences I was getting bit by bit, being a slow writer, in JAKHAM, a long poem  alternating sighs and shrieks as I abandoned traditional metrics. It was translated by Carl Weissner in German in 1967, who had translated William Burroughs in German and reprinted by Joan Silva in NETWORK, translated into Hindi by Kanchan Kumar. 
    Prof Howard McCord had raised some money from three editions of STARK ELECTRIC JESUS. Crore Berge organised a poetry reading at Saint Marks Church, New York, where poems were read by Paul Blackburn, Allen Hoffman, Clayton Esleyman, Armand Shwerner, Carol Rubenstien, Gary Youree, Allen Planz,  Ted Berrigan, Jerome Rothenberg, Bob Nichols, David Antin, Jackson McLaw. Special Indian issues of INTREPID by Alan de Loach, SALTED FEATHERS, FACT, SAN FRANCISCO EARTHQUAKE, IMAGO, WHERE, TRACE, WORK, ICONOLTRE, PANAROMA were printed in USA and UK and the proceeds sent to me. In Calcutta I got help only from Asok Mitra and Kamalkumar Majumdar. I also raised some loans to meet the fees of my solicitors.
    With my conviction at lower court most of the Hungryalists started deserting me ; it was difficult to hold them together. Debi and Saileswar, Subo and Ramananda, Subhas and Tridib developed a sort of George Oppen-Louis Zookofsky relationship, making it very difficult to carry on the group with me. Those who were sitting on the fence, a large number of them, just disappeared from the literary scene. Myself, Subimal and Tridib made a trip to Subo’s Bishnupur house for a change. Subo had fled to a Tripura village when the Police issued arrest warrants and reappeared after my conviction. I had not been to Bishnupur earlier, which was  150 km away from Kolkata by road. Bishnupur was the seat of power for the Malla dynasty, which built the famous terracotta temples during the 17th and 18th centuries. We found that Subo had devoted himself to Hindu religion. His family background and the place might have influenced him. The origins of Bishnupur as a religious and cultural hub with its distinctive temple architecture is closely tied to the Gaudiya Vaishnava devotional movement of the sixteenth century in eastern India and Bengal in particular (then known as Gaud or Gaur). The bhakti saint and social reformer, Chaitanya Mahaprabhu (1486–1533), founded Gaudiya Vaishnavism, a brand of spiritualism marked by an emotive and intimate devotion to the Hindu god Krishna, the central deity of the tradition. Vrindavan—the mythical site where Krishna spent his youth, believed to be located in the woods by the river Yamuna in north India—held a profound fascination for devotees of the Vaishnava faith. Pika Ghosh argues that Bishnupur’s emergence as an important centre for Gaudiya Vaishnava is tied to the transformation of the forests of Bishnupur into a hallowed centre in an attempt to recreate a ‘Gupta Vrindavan’, that is, a hidden Vrindavan in Bishnupur. It is unfortunate that we could not take Allen Ginsberg and Gary Snyder to Bishnupur. 
    We forced Subo to spare a day for us and saw the town’s terracotta work and conch shell bangles cutting and weaving of Baluchari sarees famous for depicting events from Ramayana on borders. Thereafter we had a few puffs of cannabis and started walking aimlessly through the green paddy fields. We came to a river bank and took off our clothes and waded through the river water. After crossing the river we sat beneath a tree all naked and smoked the leftovers. Next day we went to meet Ananda Bagchi who taught Bengali at a local college. He was very happy to meet us. Years later, he was the first academician to include Stark Electric Jesus in a poetry anthology. 
    My next trip was to Berhampur in Murshidabad with Subimal Basak as our bulletins and books used to be printed at a local press after Calcutta presses refused to print our works. We met famous poet and author Manish Ghatak. He was also happy to meet us. I felt that those poets and writers who lived out of Calcutta were supportive of us. Manish Ghatak's parents were Suresh Chandra Ghatak and Indubala Devi. Noted Bengali film director Ritwik Ghatak was his youngest brother. Ghatak married Dharitri Devi, who was from the well known Chaudhuri family in Dhaka, in undivided Bengal, with Sankho Chaudhuri, the noted sculptor and Sachin Chaudhuri, the founder-editor of the Economic and Political Weekly of India, being her siblings. Mahasweta Devi is their eldest daughter.  His eldest grandson, Mahasweta Devi's son, Nabarun Bhattacharya was also a very well-known writer. Apart from Manish Ghatak I have not met any of them. Subimal took me to a village where his aunt’s mother resided. While we were sleeping inside a mosquito net, in the morning we got up after hearing shrieks of children. We found a cobra on the roof of the mosquito net, which might have fallen from the wall or ceiling. We had Hungryalist bulletins with us with which we succeeded in throwing away the snake. The old lady saw that the snake had entered a hollow of a tree. She took lots of sugar and with it drew a trail from needle ants to the place where the snake had hidden. By afternoon we say the snake has been eaten by the needle ants and only its head remained looking at us. I remembered that at our Imlitala house we used to see a large number of ants coming out of holes and fighting among themselves. At Imlitala house we also encountered scorpions.
    Along with Subimal and David Garcia I visited Samir, who was now posted at a place called Dumka. The house was quite big but the lavatory did not have doors. In front of the lavatory there was a big jackfruit tree from which jackfruits hung right from the ground. Those who went to the lavatory for shitting would hang their clothes on any of the jackfruit. Most of the hippies who visited Dumka for tasting mahua liquor found the lavatory very funny. 
    Hippiedom had started by then and a large number of hippies arrived at Benaras in search of Karuna Nidhan who arranged for their stay and food as well as the pot joints to be visited at Benaras. Hippie ladies paid him in sex. He would have sex with any foreigner women, even older than him. Whatever he earned from the Hippies he would send to his wife through someone or go himself to handover the money. His wife knew about his sexual life. Karuna Nidhan lived with a hippie woman in a hut on the other side of Ganges river. When I went to meet them in a boat they were both naked. The hippies inherited various countercultural views and practices regarding sex and love from the Beat Generation; "their writings influenced the hippies to open up when it came to sex, and to experiment without guilt or jealousy.One popular hippie slogan that appeared was "If it feels good, do it!"] which for many meant "you are free to love whomever you please, whenever you please, however you please". This encouraged spontaneous sexual activity and experimentation. Group sex, public sex, homosexuality; under the influence of drugs, all the taboos went out the window. This doesn't mean that straight sex or monogamy were unknown, quite the contrary. Nevertheless, the open relationship became an accepted part of the hippie lifestyle. This meant that you might have a primary relationship with one person, but if another attracted you, you could explore that relationship without rancour or jealousy.
    Hippies embraced the old slogan of free love of the radical social reformers of other eras; it was accordingly observed that "Free love made the whole love, marriage, sex, baby package obsolete. Love was no longer limited to one person, you could love anyone you chose. In fact love was something you shared with everyone, not just your sex partners. Love exists to be shared freely. We also discovered the more you share, the more you get! So why reserve your love for a select few? This profound truth was one of the great hippie revelations.
    Ginsberg and Orlovsky had made Benaras quite famous. The hippies followed a route from Amsterdam which came to be known as Hippy Trail, the name given to the overland journey taken by members of the hippie subculture and others from the mid-1950s to the late 1970s  between Europe and South Asia, mainly from Turkey through Iran, Afghanistan, Pakistan,  India, to Nepal; an alternative route ran from Turkey to the Levant. The hippie trail was a form of alternative tourism, and one of the key elements was travelling as cheaply as possible, mainly to extend the length of time away from home. The term "hippie" became current in the mid-to-late 1960s; "beatnik" was the previous term from the later 1950s. In every major stop of the hippie trail, there were hotels, restaurants and cafés for Westerners, who networked with each other as they travelled east and west. The hippies tended to interact more with the local population than traditional sightseers did. The hippie trail largely ended in the late 1970s with the advent of a military dictatorship in Pakistan that banned many hippie attractions, the Iranian Revolution resulting in an anti-Western government, and the Soviet invasion of Afghanistan starting a major war, closing the route to Western travellers.
    Most of the hippies while travelling to Nepal would make a stopover at our Dariapur house for a day. Ma felt they were quite dirty as they did not take bath regularly. She was, however, conversant with their naked bath as Ginsberg had come and stayed at our Dariapur house for sometime in 1963. Like Ginsberg they had accustomed themselves to eat by sitting on a mat on the floor. In Nepal, housing and all drugs were very cheap. Ma used to sit with them and ask whether they liked her cooking. Ginsberg had learnt a little bit of Hindi. So it was not difficult to converse with him. I had taken Ginsberg to Khuda Bakhsh Library, Patna Museum, Golghar and the Ganges river bank. He had recited SunFlower Sutra inside Golghar inside which the sound reverberates for twentyone times. But I did not like his interest in taking photos of beggars, lame men, wayward sanyasis etc. Dad also was angry about it and told him, ‘your foreigners find only these things in India, whether you are an ordinary tourist or a famous poet’. That was the correct opinion. I have not taken photographs of beggars or destitute people when I visited Europe.
    Sometime before my case came up in High Court Karuna Nidhan wrote me a letter to come urgently to Kathmandu in Nepal as he had gone there with some Hippies and that there were lots of women, cannabis and hashish of good quality. Myself, Samir, Anil, Subimal, Kanchan Kumar and Samir went to Kathmandu and stayed in a room in a huge building flocked with Hippies. It was a three storied old wooden palace in an area called Thamel. There were hundreds of residents. Toilets were limited. We stopped taking baths. We were provided with hay mattresses on the floor and had to pay one rupee per head per month. On the news of our arrival the Nepal Academy arranged for our food, drink, poetry reading and visits to various places. We drank Nepalese liquor Rashki with raw buffalo meat crushed by hand, not cooked as well as pickles made of deer flesh. Famous Nepali lady poet Parijat invited us for a drink made of wheat. A painting exhibition for Anil and Karuna’s works were organised by the Afro-American owner of Max Gallery at Kathmandu, Anil’s paintings were sold off but some of Karuna’s paintings remained unsold which were gathered by Karuna and put on fire. The Hippies who had assembled started singing and dancing  around the fire.
    The Hippies could not utter Swayambhunath, so the ancient Buddhist shrine became known  as The Monkey Temple. I did not know what a monkey temple was when Karuna talked about it. There were lots of monkeys and hippies high on hash lying around. Most of the Hippies had fled home to avoid going to the Vietnam war. They were getting their expenses sent by parents through American Express. A fat American lady, Madeline Coreitt,  probably was impressed with the news about the Hungryalist movement and my photo in TIME magazine. She used to kiss me on my lips in the morning as long as I was there. I have written about her in my novel ARUP TOMAR ENTOKANTA.The bamboo and brick palace in which we stayed has since been demolished. It is a modern city area now.
    Freak Street was the epicentre during the Hippie trail from the early 1960s to late 1970s. During that time the main attraction drawing tourists to Freak Street was the government-run hashish shops. Hippies from different parts of the world travelled to Freak Street in Basantapur in search of legal cannabis. Direct bus services to Freak Street were also available from the airport and borders targeting the hippies looking for legal smokes. Freak Street was a hippie nirvana, since marijuana and hashish were legal and sold openly in government licensed shops. A young restless population in the west, seeking to distance itself from political and social frustration, had firsthand contact with the culture, art and architecture, and lifestyle that attracted them to Freak Street. Subsequently, like all other countries Nepal also banned cannabis and hashish. 
    I returned to Uttarpara. The building was desolate without granny. Number of pigeons had multiplied. Trees had grown in crevices of the building. My lawyers informed that the case had not even been listed and may take time. I was feeling very lonely. When I visited the Albert Street Coffee House and took a seat at a table all others would leave to avoid me. Subimal bought me a train ticket for Patna, which I reached in stupor and delirium ; Ma weeped at my trauma, and I remained bedridden for a month. Tridib’s letters were awaiting my recovery. He had written that Subhas, Basudeb, Saileswar and Arunesh had launched a separate group using the word Khudhartho which is the Bengali of Hungry – keeping me out – and that their magazine contained a vituperative attack on me. I felt that I was a cultural outsider to even my friends. In the ‘Indian Writing’ edited by and published by Penguin, Sandipan Chattopadhyay claimed that “he was also responsible for starting the Hungryalist movement in Bengal along with Shakti Chattopadhyay and Utpal Kumar Basu.”  Khudharto's first issue was published in 1969 and Saileswar wrote ‘Malay was a Bihari Babu,. I was attacked by Subhas Ghose as late as in 1975 though he himself had joined the Communist Party Marxist, becoming a local committee member, storing party flags and publicity material in his house. The Party was  was creating havoc in West Bengal about which Subhas kept silent. My erstwhile friends were unable to forget me probably because the demon of my Outsiderness was haunting them. 
    Music was there to fall back on as I came to know Robin Dutta, who drew me first into stories from Palestrina, Monteverdi, Purcell, Handel, Haydn, Berlioz, Franck and then to his discs and cassettes of compositions by Bach, Mozart, Beethoven, Schubert, Chopin and Brahms, an engaging experience relieving my burden. Dad purchased for me a record player with a sitar recital disc of maestro Ravishankar and thumri of Bade Gulam Ali. Ferlinghetti sent me Ginsberg’s reading of Kaddish and Ezra Pound reading his cantos, which I listened to in the evenings. I had, on doctor’s advice, stopped smoking except for a rolled tobacco once in a while. 
    Subimal’s younger brother informed Dad that the hearing at the High Court was fixed for July 26, 1967. I did not feel like going to Calcutta. The life I had spent there was horrifying ; I shuddered at the thought. July 26 came and passed away. Subimal arrived after a week, smiling, with newspaper reports of my exoneration and a certified copy of the verdict of Justice T.P.Mukherji of Calcutta High Court castigating the lower court judge for his judicial blunder and the Calcutta police for their harassments. There was only one congratulatory postcard. It was froom Sandipan Chattopadhyay.
    I felt blank, gave Subimal whatever books, correspondence files, diaries he wanted, gave up meeting people, withdrew into my Outsiderness. I was unable to write, no images flittered by, lines refused to be composed in my mind. I sat at the table doing nothing, for weeks, for months, nervousness galloped, without a purpose ; there were no letters from friends and editors. 
    Twelve
    In the winter of 1968, at Nagpur, I was introduced by Sulochana Naidu, a Telugu lady, to her bespectacled friend Shalia Mukherjee, a frail lady of peacock gait, a couple of schoolgirl tresses, deep wide eyes and a voice shy enough to make me fumble for words as I controlled myself from placing my head on her lap and weeping. She had lost her mother when a baby, had two sisters, elder married, younger teaching in a Chrstian school. Har father, Sudhir Mukherjee, had left them with the maternal grandfather and disappeared to appear again after several decades with a wife and little son in her lap but was ordered to get out of the house for his irresponsible behaviour. He did not arrive again to claim his children. Sudhir Mukherjee was a rich smart man in tuxedo working as a manager in a big hotel at Murree Hills, now in Pakistan. Shalila’s maternal grandfather’s family members had heard that he was secretly serving the interests of leaders of the freedom movement which became known to the British owners of the hotel. He was incarcerated for sometime and did not get a suitable job to sustain. This might have changed the flamboyant young man to a destitute, forcing him to leave his wife with the rich father in law.
    Shalila knew nothing about my literary activities and was informed about it by Sulochana Naidu who showed her my photographs and write ups by Hindi writers in well circulated Hindi magazines. For Sulochana I seemed to be a somewhat famous guy. Shalia seemed to have no interest in such activities of mine. Rather she was more keen to know about my parents and other family members. 
    On my first visit to one of her uncles, who seemed to handle family issues, probably wanted to indicate that you better leave the girl to herself as she is an asset for us earning sufficient amount to run our extended family, showed me eight rifles and double barrel guns, the heads of predators his father had hunted now mounted and hanging on walls of drawing room, and then whistled for two pet pomeranians, Suzie and Ceasar. I have been scared of dogs ever since I left the dogs of  Imlitala and not as scared of guns as I had handled them during my National Cadet Corps days. I did not propose to Shalila and neither had we talked about our marriage but somehow we silently agreed that we should marry. Our feelings were exchanged without words and things moved within forty eight hours of our meeting.
    I got the message and obliquely told the uncle to get in touch with Dad or Samir in case he felt uncomfortable about me. They were an overtly rich family whereas we were well to do but did not show off. We did not have a landline telephone, as we never felt the need for one, despite Dad being a businessman. Shalila’s house had a landline phone. They told me to ring up my Dad so that they could talk to him. I told them that we do not have any. I was told to send  phonograms to Dad and Samir informing them to come to Nagpur, which I did. I found that they did not have much knowledge of present day West Bengal and its culture. Their conversations were overloaded with Marathi and Hindi words for which they felt some sort of pride. They had not heard about the Sabarna Roychoudhury family of Calcutta, which was obvious but I felt somewhat sad for it. Their drawing room, however, was full of English paperbacks which had yellowed over ages as nobody read them after the death of her maternal grandfather. There were cups and shields which, I was told, belonged to Shalila as she was a field hockey player for her State and won them. Photographs on the walls were testimony to her having played field hockey.
    Ma must have jumped with delight after receiving my telegram as now she was sure that her younger son was going to get away from his wayward life. I wrote a letter as well to Samir, who was posted at Chaibasa, and I am sure he was happy that his brother’s lecherous days are over. Dad and Ma did not come though I had expected them to come to Nagpur. Instead Samir came alone to take stock of the situation, had a talk with Shalila and her family members, confirmed the marriage on behalf of our family and returned back the same day with a photo of Shalila to be shown to Dad and Ma. The family had informed Samir that a girl of the family, elder daughter of the gun-loving uncle, was going to get married to an Mumbai Airport Officer within a few days on 4th December and that they wanted our marriage to be solemnised on the same day. 
    Samir Came back with his wife and daughter on 2nd December. Dad or Ma had not come ; instead Samir had brought with him his mother in law. He said it was not possible for them to arrange for tickets as there were no direct trains and that they did not want to keep the shop and house shut for so many days as there was a theft earlier. I expected that our family priest Satish Ghoshal, who travelled even in bullock carts to visit places would have come but he also did not come.
    I married Shalila on December 4, 1968, reciting full throated Sanskrit mantras I vaguely understood, prompted by a bearded priest in a saffron robe who had Old Testament prophet looks, in front of crackling holy fire and tear augmenting smoke, angels, gods and goddesses, friends and relatives, in a carnival of midnight glory and glamour. When in school Samir used to laugh at marks scored by me in Sanskrit and that might be the reason why he was giving a sly smile. The marriage rituals generated my lust for life, Wordworthian fullness, an inspiration to live that was robust, Shalila’s cousin had married the airport officer at the same venue an hour earlier and the joint marriage created a sort of flutter in the sleepy town. Shalila informed me that some of the young men who wanted to marry her and sent proposals to her uncles were present at the venue with morose faces.
    Samir did not take us to Patna, as he had to drop his mother in law at Chaibasa first. He had already booked train tickets for our circuitous journey, after paying the requisite bribe to the booking clerk. Since there were no direct trains from Nagpur to Chaibasa, we went up to Chakradharpur and from there took taxis to Chaibasa. The journey was short through Chaibasa forest and we reached it in forty minutes. There were Samir’s young sister in laws who were eager to marry me and whom Samir had brought to Patna one by one but Dad as well as Ma were not inclined to bring the second bride from the same family. For me, none caught my eye. 
    We spent a couple of nights there. Samir said that we have to go to Patna from Jamshedpur which means from Chaibasa to Jamshedpur and then Jamshedpur to Patna. We must have been a great burden on the family which I am sure was being taken care of by Samir. He showed me Ma’s approval letter in which he directed Samir that there was no need for all marriage rituals to be followed ; just follow the sindoor ritual and that would be enough to solemnise the marriage. 
    We reached Patna in the morning. On reaching Dariapur house Ma came out on the street and greeted the bride by feeding honey with her finger and putting honey in both ears telling Shalila that whatever you hear would be sweet. This was not the ritual that is expected when the groom reaches his home with the bride. Ma was not wearing new clothes though the house was full of relatives as is expected during a marriage of the groom from the family. After entering the house we came to know that uncle Sushil had died on the same day my telegram reached Dad. After receiving my telegram Samir had sent Sentu, who was at Chaibasa with him at that time, to Patna in an office jeep so that Dad may accompany him to Chaibasa for onward journey to Nagpur. Dad and Ma informed Sentu about uncle Sushil’s death and instructed him that this news should not reach me and Shalila till we reached Dariapur. Thus no marriage rituals were performed at Patna and the ceremony having been dubbed as half-marriage half-live in. All the relatives were happy except uncle Sushil’s elder daughter Dolly who told me angrily that I could have chosen another time to get married ; she did not believe that I was not informed of uncle Sushil’s death. Thereafter she never talked to me in her life.   
    Those who would not otherwise have attended my marriage had also arrived on hearing of uncle Sushil’s death. Those who wanted to get married without much waywardness, such as cousin sisters Sabu-Dhabu had come with their daughters, son in laws and grandchildren. Dasarathi uncle, a retired high court lawyer at Patna, about whom I forgot to tell, was also present. He was a fat old man with old style whiskers and came to sleep in Dad’s studio in the night in order to avoid family problems of several of his sons ; his bed and pillow was kept in an almirah. He claimed to be a relative of ours as we had the same forefathers. Funny thing about him was that his tummy touched the roof of his mosquito net and it went up and down with his breath and snores. In the morning he left for his own house.
    I left Patna with Shalila for the tribal jungles of Palamau, four hundred kilometres away by train, in the grip of spring, with a whiff of blooming kino and kapok. We had lunch there of coloured rice, barbecued meat, boiled snails, and a dash of liquor made of mahua or madhuca indica, rejuvenating my lazy tendencies of pluralist happiness. Pangs of not being able to write were subsiding. Palamau was soothing. During a short period when my case was yet to start at the lower court at Kolkata I had visited the place where Samir was posted  and feasted on deer meat. 
    I got back the job after winning the case at High Court and joined service, paddling my old college bicycle to the office. A Punjabi coworker proposed that we visit his village near Ropar in Punjab and from there we may go to Shimla where snowfall has already started. At that time I did not know that he is taking his family to his native place so that the elders could advice his wife to control her association with a Sikh male with whom the lady was having a sexual relation and my coworker friend loved her so much that he accepted what was going on. After returning to Patna the lady eloped with the Sikh man and their whereabouts were not known to my coworker for three decades. When the lady wanted to come back to my coworker he gladly accepted her. But she again went away and my friend had to die of cancer quite lonely in Delhi after retirement.
     We went to his village in Punjab where they were growing sugarcane, mustard and other winter vegetables. They did not have a lavatory and the ladies had to go to the sugarcane field in the morning to ease themselves. Shalila participated in it. I was accustomed to my National Cadet Corps days. They had very small doors in their house for entering from one room to another. We had a good reception as we were the first non-Punjabi guests in their house. We visited the nearby mango garden of Ropar famous for mass massacres during Partition which looked eerie in its green darkness. The Punjabi family seemed unable to forget the scars.
    We took a bus to Kalka and from there another bus to Shimla. I got down in knee deep snow experiencing the first snowfall in my life. For Shalila also it was a fascinating experience. Our luggage on the top of the bus was also covered with snowThe Honeymoon suite was strange with mirrors fixed on the ceiling so that couples could see themselves naked. With snow falling outside we had no desire to look at the mirrors. We drank old monk rum and drank till we felt warm within our embraces. Next morning we went out but unfortunately my friend and his wife accompanied us ; she seemed to be pregnant and I was sure, like her husband, that she was carrying her lover’s child. She actually did carry her lover’s child. When she eloped with her paramour after the child’s birth she took the child with her.
    Many years later I met this friend of mine in Mumbai. He was in the Reserve Bank but I had left it for NABARD. On his request I visited his flat at Prabhadevi and found that his wife had returned. It was quite embarrassing to talk to her. I again met this friend at Delhi when he had retired and learnt that his wife had left him. She had come for a short stay at Mumbai just to fool my friend; she wanted to ensure that she was still his pension nominee. Since there had been no legal divorce, she remained a nominee and enjoyed a family pension after my friend’s death.
    When we were back at Patna, Kaviraj George Dowden, an American hippie settled in England had come to meet me, in a saffron dhoti, with flowing hair of a sanyasi, with the help of his Indian guru Muktananda, he had spiritualized into the persona of the “Kaviraj. George Dowden liked to imagine that he was a sort of direct literary and spiritual descendant of Whitman. He was working on Ginsberg’s bibliography, which he had sold to Texas University for $4000 to stay at Muktananda’s Ashram in Mumbai.Ginsberg had become so famous that he could appoint Bob Rosenthal, as Secretary and Bill Morgan to catalogue all his belongings before they were sold to Stanford University for one million dollars. Both Rosenthal and Morgan had come to Calcutta and met me at my Naktala flat. Before  Kaviraj George  Dowden died in 2014 he wrote several books and taught Beat Literature once in a while in Colleges. Like many minor Beat writers, he also seems to have disappeared from the pedestal of their icons.
    Shalila introduced a Marathi dimension to our Bengali cuisine. Their family had no contact with West Bengal, did not have any relatives there. Maternal uncles and relatives of their wife were all from Maharashtra or the then Madhya Pradesh of which Nagpur was capital. They talked in funny Bengali. Earlier we did not have dining tables, sofa sets, curtains on windows and doors, flowerpots in rooms. Shalila arranged to introduce them in stages. Dad being a staunch believer in Hindu customs, still sat on the floor-mat while eating his lunch and dinner. Sometimes he forgot what he was doing and wiped his wet hands on the door curtains. We used to eat on various sizes of brass plates. Shalila introduced stainless steel. In fact, before she introduced stainless steel, some of her Nagpur cousin sisters, on a visit to Patna made fun of our use of brass utensils. We also appointed an old lady as a part time cook in the morning. However Dad’s rice had to be cooked either by Ma or Shalila as Dad wanted the rice to be cooked by a Brahmin. Whenever Dad went out of Patna for any purpose, he would eat roti. The maid was earlier working only in the morning. Now she started coming both in the morning and evening.
    Ma was now free ; she seized the opportunity to revive her interest in Hindu gods and goddesses she had forgotten after coming to Patna at a young age. At Imlitala the duty of pleasing gods and goddesses was bestowed on aunt Nandarani and there was a room in which small idols and photos were housed, the same room in which aunt Karuna had died of tuberculosis and the room was disinfected with Ganges water after her death. I do not know what happened to those idols after Aunt Nandarani’s death and forced sale of the Imlitala house to two families on rent by Sabu and Dhabu’s sons. I came to know the fellow downstairs was having cows and the walls were plastered with cow dung cakes as the fellow upstairs did not allow him to dry in the sun. I realised that I have never lived in the same room, in the same house, on the same street, in the same area, in the same town all my life. I have been an outsider even in my own space.
    Ma and Shalila enjoyed each other’s pagan faith. Shalila probably had faith in all Hindu gods and goddesses which waned with her age and association with friends of various faiths, ultimately losing interest in all. Ma’s favourite god was Ganesha at Dariapur, a marble replica originally worshipped by granny. Ma did abandon her interest in Ganesha later and transferred her interest to stitching kantha, a patchwork bedsheet for my daughter. Ganesha was neglected for a longtime after Ma’s death and our departure from Patna to Lucknow. It landed with Samir’s elder son Toton when he took over the charge of Dad’s shop. But the idol was kept in a place and kept on gathering dust, the shop being just on a busy road.
    Dimple, as we called our daughter, born on September 5, 1969, got her name changed to Anushree fourteen years later when a film star named Dimple hit the screen. She introduced me to an infant’s universe of wordless communication that I never knew so closely, her vocabulary growing sound by sound, deciphered by Ma and Dad in their new vocation of baby sitting after Shalila went out to her job. Annoyed with my patience of teaching Anushree the English alphabet and numbers, she appointed a tutor.
    On a day of cloudburst, driblets trickled down the ceiling and entered one of the bookshelves, which had been shut for more than a year. I opened it to find corridors of hefty termites revelling through several books. Most of the important books were stolen during my absence from Dariapur because of the trial at Kolkata. Howard McCord had sent Autobiography of Malcolm X, Genert’s Our Lady of The Flowers. Volumes of World Literature, Complete Havelock Ellis, Works of Surrealists and Symbolists. Some Beat poets had sent Fanny Hill and various magazines. Lawrence Ferlighetti had sent Beat literature published by him. Samir had collected lots of modern Bengali poetry books. All were stolen. After watching the Roman march of the white ants I closed the bookshelf and allowed them to spread their colony. Why did I have this acquisitive streak ? Since then I have been giving away books and magazines to others after I have read them. Lithe turning to water, Ezra Pound had written.
    Thirteen
    As I have stated earlier, after a change in my job I began to understand the life and living of cultivators and artisans, the social system at work on ground level. I loved the job. Now I could tell from afar whether a stalk was of rice, wheat, barley or millet pulses of various plants and various types of vegetables. I could make out the differences between various sweet water fishes which Ma loved to eat and which I could not purchase in Machuatoli market. At Imlitala fishes were purchased by Promod uncle and he rarely purchased all types of sweet water fishes, preferring mostly rohu, katla and mrigel. I could now identify, though I did not like to eat them and Ma relished, were tangra, bata, puti, banspata, bacha, eel, chanda, mourola, boyal, chitol and of course hilsa. I developed a liking for hilsa or ilish after we purchased a pressure cooker in which hilsa was steamed in curd, poppyseed and mustard powder.  I had earlier purchased a fridge and gas oven which Ma avoided using for unknown fear but with Shalila’s presence she started using them. 
    I loved the job and read a lot about my job requirements. I acquainted with the daily life of a farmer’s family, the ruthlessness of rural poverty, machinations of caste substratrums, village violence, names of birds, herbs, shrubs and trees I had not known, men and women ploughing, harvesting, threshing, levelling, jungle clearing with their own hands. I thought of Whitman, Neruda, Mayakovsky and the Bengali poets Jibanananda Das and Sukanta Bhattacharya but was unable to write any line myself. The thought of writing itself disappeared gradually. 
    I am an introvert but now talking to people was a part of my job – farmers, labourers, social servicemen, government officials, rural headmen, bank workers, craftsmen, tribal heads – characters fluttering through experience. Hundreds of thousands of kilometres I traversed from village to village – more than fifteen days a month – on train, steamer, boats, van, bus, horsecart, elephant, camel, bullock cart – whatever was available to go from one place to another. Alone on a bed in a hotel or a rest house or someone’s guestroom, I thought of literature. I was barren. Secretly, I felt happy about it. Shalila bought me a lambretta scooter on my birthday in 1973. We started celebrating birthdays after the birth of my daughter. Ma and Dad had not been aware of the custom. We drove into town Sunday evenings entertaining ourselves with Chinese dishes. I had become fond of rum and cola, given up smoking, and gathered fat around my waist. Our son Jitendra, known as Bappa to all and sundry, was born on February 19, 1975.
    Saint Joseph’s Convent, my first school, where I got Anushree, later Bappa admitted, has expanded like a deep sea fish out of water ; cement crawled to eat up violets, roses, marigolds, dahlias, chrysanthemums. Doe eyed nuns were replaced by serious looking Keralite nuns ; children spilled out like mustard seeds from multi storey blocks onto grassless playgrounds ; Saint Joseph’s statue was full of crowshit. I visited the other school, Ram Mohan Roy Seminary, changed beyond recognition, physically and ideologically, under the new principal, who was the son of the earlier principal. 
    I had become fond of goat meat available at a muslim butcher’s shop ; in fact he taught me which portions are to be purchased for what type of dishes. I became a regular and ate a lot of red meat and eggs.The inevitable stroke in the winter of 1975 ; I pissed blood, my blood pressure shot up beyond limits, infraction of the heart, bedrest for two months, medicines and medicines, sleeping pills even during the day. This led to a lot of restrictions on my food which I gradually forgot and started eating everything as I am a foodie and have relished food of all types wherever I have visited. In fact I brought sweets and salted eatables from the places visited for my children and Saris for Shalila.
    My office, the Agricultural Refinance and Development Corporation, in the summer of 1979 transferred me to Lucknow, city of Nabobs during the British Raj, which saw to the decimation of Muslim aristrocracy and departure of Kulsum Apa’s family for Imlitala slum. Historically, Lucknow was the capital of the Awadh region, controlled by the Delhi Sultanate and later the Mughal Empire. It was transferred to the Nawabs of Awadh. In 1856, the British East India Company abolished local rule and took complete control of the city along with the rest of Awadh and, in 1857, transferred it to the British Raj. Under the rule of the Nawabs, Lucknow flourished like never before. After 1755, Lucknow grew by leaps and bounds under the rule of the fourth Nawab Asaf-ud-Daula. Kulsum Apa claimed that their family carries the bloodlines of Asaf-ud-Daula. 
    Though Patna has now become a developed modern town, at that time Lucknow seemed better than Patna. I could not get a house immediately and stayed for sometime with Abdul Karim, A telugu speaking agricultural economist, who later accommodated Parabhakara and Madan Mohan, who prevented me from lapsing into disorder as I was damn scared of loneliness. Karim was unmarried and had no problem to accommodate such guests as another junior officer Kurkure also arrived. Prabhakara was a Karnataka Brahmin and took up cooking south Indian dishes. When we wanted to eat non-vegetarian food we went out to some hotel at Hazratganj or Chowk. Kurkure took up the work of sweeping whereas myself and Madan Mohan took up washing of utensils. Sometimes Karim wanted to eat Andhra preparation of chicken or meat which he had to purchase based on his religious norms. We ate it irrespective of the norms followed by him. What was strange for us is that he used to keep the meat submerged in water for an hour so that all blood oozed out of it. Similarly he directly burnt the chicken on fire to remove blood. Before Prabhakara introduced it I did not know that Sambar was cooked with various types of spices and it differed from state to state. I love sambar and every now and then I try different types.
    The incharge of my office was a south Indian christian with several children and he loved to go on tour in order to earn extra money. Obviously he wanted to keep his staff happy and sent them on tour as well. I got tours to several places in Uttar Pradesh and for several purposes. The one tour which I remember quite vividly was to the terai areas of Himalaya where me and my veterinary doctor assistant had been sent to find out whether purebred Indian cows are still there or all Indian cows are now mixed up with foreign breeds. We did find pure Indian cows, small in size, with pointed horns, which did not give enough milk to be domesticated and lived in the jungles of the foothills. Some Sikh refugee families who had been settled at the foothills try to domesticate oxen for cultivation purposes but are not satisfied. They had tried to artificially inseminate with other breeds but the pregnant cows died because of the size. 
    The story that intrigued me during this tour was the death of a tiger in a cemented canal which could not crawl up and died. Since it was deep in the interior the district authorities requested my assistant to perform a postmortem. The news of a dead tiger spread to nearby villages and all and sundry from villages gathered to collect tiger flesh, blood and bones. I did not know that these are eaten by Hindus. It was a female tiger and its rozy vagina attracted me. I told my assistant about it. He arranged to keep the corpse in a tractor shed of a Punjabi cultivator who arranged bottles of rum for us. In the night I got drunk, went into the garage and lied down over the tigress, sucking at its teats. My penis also responded. Next day its flesh, blood and bone was distributed among villagers. A Brahmin priest of the local temple brought cooked tiger meat for us which we ate, though the smell was different from goat or sheep meat. The skin was sent to the district authorities.
    The same area had lots of artesian wells.In places where the overlying impermeable rocks are broken by joints or faults, water escapes through them to rise to the surface as artesian springs. We had to request our office to take up the matter with the state government so that these are capped and water is gainfully utilised. Just like the Punjabis, many Bengali refugee families had been given land for cultivation without taking into account the caste factor. The Punjabis were of cultivator caste whereas the Bengalis belonged to various castes such as carpenter, potter, blacksmith, fishermen etc who were not conversant with cultivation and had to work as labourers in Punjabi cultivator’s lands who had taken over lands of Bengalis. Punjabis had gurudwaras to look after the education of children but Bengalis had started forgetting their mother tongue.
    Office allotted me a newly constructed Bungalow across the Gomti river and adjacent to the Kukrail crocodile sanctuary in early 1980 when Shalila and the children joined me. Getting the children admitted in schools was very difficult and I had to approach various schools. Ultimately I got both of them admitted to English medium schools. Anushree used to go to school as it was closer to our house. Bappa had to go to his school in a shared rickshaw specially built for carrying six children of his age. Myself and Shalila went on a scooter as we used to in Patna. Our house had to be kept locked with the main door key hidden in a hole to enable the child who arrived first, to enter. Shalila used to keep food for them on the table. Over time things fell into routine.
    I developed a lawn of Bermuda grass and a rose garden in front, having brought various types of roses from the rose nursery ; Shalia took care of the kitchen garden at the rear. At Imlitala and Dariapur we used packing boxes from my Dad’s shop, filling them with earth, to plant flowers and spices. Now I had the freedom of a complete garden and the earth was virgin for plants and trees to grow faster. I planted guava, jujube, plum, banana, papaya, horseradish, maize, drumstick and kept on changing. We distributed the fruits among friends and neighbours. On the gate we had multi-coloured bougainvillaea through the entire year spreading a soft carpet for visitors. I regained my health. 
    Prabhakara and Karim had taken houses nearby. Karim brought a lot of items for my son whenever he went on tours or to his village in Khammam. Karim proved to be conservative after the death of his wife. He constructed a seven room house in his village but unfortunately his wife died of cancer. His son married a Hindu girl whom Karim did not accept and disowned his son Hasnain whom he loved. Karim grew white long beard like maulvis and died alone in his big house.
    The entire period from 1979 had been one of regaining helplessness for me. I was a drawing room intellectual, retheorising frightening abstractions, suffering from an inexplicable sense of guilt capped with a secret gnawing anxiety of not being able to write, which aggravated my nervous system. By now I knew that less than ten percent of people had the freedom to pursue happiness, the rest were nonpersons, invisible pariahs of our polity. There was nothing I could do, nothing. Sometimes I wonder how I have journeyed my way from Imlitala slum to the centre of town dropping back people of Imlitala whose faces I had started to forget. Ma and Dad came to lucknow to spend the winter of 1981 with us, Samir Having shifted with his family to Dariapur house. We enjoyed winter, sitting in wicker chairs placed on the lawn on holidays with Dad and Ma reminiscing their busy days at Imlitala, dozing off during sunny, shaded afternoons, disturbed occasionally by a couple of grumbling doves nesting in the bougainvillaea creepers. Flocks of low-flying Russian white cranes glided towards Bharatpur Sanctuary a hundred kilometres away. Parrots nibbled ripe guava and maize ; there were sparrows, swifts, woodpeckers, mynahs, bitterns, thrushes, buntings, cuckoos, falconets, larks, kites, orioles, storks, warblers visiting the garden, and the insects, frogs, butterflies of endless creations, and earthworms and lizards. It was a long way from Imlitala and Dariapur days. But there were no fresh water fish markets nearby. Small fishes preferred by Ma were rare. I had to go to a market to purchase big sized fishes and small prawns. 
    As the astrologers had predicted Dad would die first, Ma did not reveal the severe arthritis and pain in heart she was suffering from, detected when her legs swelled, but not before wrong medicines prescribed by a physician led to a massive heart attack, hospitalisation, and death two days after the 1982 Diwali festival of lights. My neighbour, Hayder Ali, descendant of a nawab family said we should have informed him as he knew most of the doctors of Lucknow. Yes, I agreed. Abdul Karim was of great help as he sat through the night in Ma’s room in the hospital and met doctor’s directions. Ma had been in a coma for two days, cut off from us, in her suffering, oxygen pipe in her nostrils, eyes closed, soundless. Where was she ! I always ponder over what Hyder Ali had said and suffer from the guilt feeling that somehow I am responsible for Ma’s death.
    I had to send a telegram to Samir as the telephone had to be made from the main post office at that time which was far away. Samir rushed from Patna and scolded me and Shalila that we had neglected Ma and overburdened her with the upkeep of my children as we both went to office. For taking her to the Gomti river bank Abdul Karim, Prabhakara and others helped me. She was cremated on a funeral pyre the next morning on the banks of the Gomti river. Getting a Brahmin priest was a problem as I was, as usual, a cultural outsider in Lucknow as well. A Brahmin employee of my office was contacted who gave part time service to a priest and last rituals were performed according to his direction. Samir went back to Patna to arrange for Ma’s Hindu rituals to be completed by our family priest Satish Ghoashal. I remained in ritual mourning for thirteen days in a single piece of loincloth, barefoot, without shaving or combining my hair and went to Patna with Dad, Shalila and children to join Samir and other family members for ritual mourning. We all came back after the Brahmins were fed for Ma’s peace.
    Personal loss is the exact description of the depressive void created by her absence. I brooded in blank anguish and aching insight ; no death had absorbed me earlier. A few months later, returning from the office, I found myself weeping one day in the busy market square of Lucknow, overwhelmed by a sudden feeling choking my throat. Shalila felt a different type of absence as she had never had the presence of her own Ma in her life and had filled up the space with my Ma’s presence in her life. 
    I booked train tickets for Dad, Shalila and the children, journeyed two nights to south India, which I had visited during my college days but Dad and Shalila had not. For a month we visited various towns and Dad’s favourite temples he had read about in books but could not visit due to his preoccupation with the shop. I returned confused, mystified, unsettled, words and images in a whirling chaos in me searching for an expansive flow of ideation. A letter was waiting for me from an editor of a Bengali magazine from Dhaka, East Pakistan requesting for a few poems. I felt delighted that at least some readers are still in search of me. I started writing poems and sent them to Dhaka. At that time postal expenses were nominal and I received requests from several magazines from Dhaka. Later Kamal Chakraborty, editor of ‘Kaurab’ magazine asked for prose and I wrote them in my own way, without bothering about them being literary pieces. They did create interest for my works and I wrote a magic realist novella titled ‘Ghog’ based on India’s partition and main characters of the then political firmament. Floodgates were sprung open.
    That spread the word. Poet and researcher Prof Uttam Das with his wife Malabika, visited us at Lucknow with the proposal for a book on the Hungryalist movement for which I made available whatever papers and court documents I had. His book created a stir in the hornet's nest again, but of a different kind. During my absence from Calcutta, some of my friends had started a smear campaign against me, specially Saileshwar Ghosh who wrote and told his young friends that the trial was against him for a poem written by him in a Hungryalist bulletin. Prof Uttam Das’s book had published the declaration given to the Police by Saileshwar, Subhash, Shakti, Sandipan and Utpal and that they had testified against me as police witness at the lower court which led to my conviction. The book included letters written to me by Allen Ginsberg, Felinghetti, Sunil Gangopadhyay as well as letters between Ginsberg and Abu Sayeed Ayyub. I had to give several interviews, clarifying my current thoughts on life, literature, past and present. There was now a generation of writers who were born or were infants when Hungryalist movement was launched and I was convicted, and they had their own image of me. I came to know that some young writers from North Bengal, such as Aloke Goswami, Raja Sarkar, Jibotosh Das, Malay Majumdar, Manoj Raut, Bikash Sarkar had tried to revive Hungryalist movement but it was sabotaged by Saileswar and Subhas as they thought that the young boys are trying to steal their limelight. Aloke Goswami has written a book titled ‘Memory Local’ on those events.
    Prof Uttam Das, who had his own publication, Mahadiganta Publishers, got the available manifestos and earlier poems collected and published in two volumes in 1985 with covers designed by Charu Khan, turning them into avant garde collectors items. I dedicated the manifesto collection to Malabika, whose voice resembles Parijat, and the poetry collection to Bhulti, my mother.
    I reciprocated Prof Das’s consideration by a visit to his house and farm at Baruipur, near Calcutta, a cool country green with fruits, foliage, coconuts, and bamboo. We had poetry reading and binge drinking. Malabika, a teetotaler, cooked steamed prawns, my favourite dish. I visited Debi Roy and his wife Mala at their fourth floor one room flat at Golf Green, Calcutta as well as at Subimal Basak’s house which he had constructed at the outskirts of Kolkata at Belgharia. They had greyed and become old. Debi had become a prolific writer but did not keep in touch with Hungryalist writers who were still publishing a Hungryalist magazine called ‘Khudharto’. Subimal had translated several Hindi writers and published an ‘Anthology of Superstitions’. 
    On a request from Prof Sibnarayan Ray, a ‘Radical Humanist’ who had recently returned to Kolkata after teaching at an Australian University, and launched a magazine for original thinkers called ‘Jijnasa’, I wrote an essay for his periodical recounting the Hungryalist days, leading to an avalanche of special issues of Godhulimone, Swakal, Uttarapath, Giraffe, Pather Panchali, Goddo Poddo Samvad, Atlantic etc. 
    I was now experimenting with a post-Hungryalist eugenic ethos in my poems, a new type of diction to overcome the traditional musical pattern of Bengali poems, a possible perfection in timelessness, and closing myself in the back room during the night. Prakash Karmakar, a reputed Bengali painter, who was in France for a few years and returned to stay in Allahabad in India suggested that we bring out a one page offset magazine with my poem and his drawing on the theme of violence. Every month during 1985 and 1986 a sheet was published. These poems were collected and publisher poet Mrityunjay Sen of Mahadiganta Publishers brought out my poetry collection ‘Medhar Batanukul Ghungur’ during the Kolkata Book Fair of 1987, with a cover designed by Jogen Choudhuri, head of the department of painting and sculpture, Visva Bharati University, Santiniketan. The book was a great success.
    Before I left Lucknow on transfer to Mumbai, I had to experience a terrifying proposal. A lady junior officer, twenty years younger than me, caught hold of my wrist at the long distance bus depot from where I was going to attend a meeting, and whispered, “let us elope”. She seemed serious. She said, “I love you, I have told your wife that I love you.” I was unable to respond and took a minute to absorb the shock. She was having a rucksack behind her back and was really prepared to flee. I asked her whether she wanted to leave her home and whether there was any problem at her home. She did not leave my wrist which was quite embarrassing as I knew several employees are daily passengers between Kanpur and Lucknow. If we are noticed in this position it would be scandalous. I remembered that this lady was coming to the office dressed in a Bengali sari with conch shell bangles in her hands and a red bindi on forehead just like young Bengali ladies. I could not gauge that a young lady was secretly in love with me. I shook off her hand and just got up on an auto rickshaw which was passing by and took another route to catch a bus to where I had to attend the meeting. She did not come to the office for several days. She had committed suicide. Sometimes I remember my father in law who left his wife and children for another woman. 

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 122.17.***.*** | ০৯ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৮738574
  • দার্শনিক-সাহিত্যিক, কবি সমীর রায়চৌধুরী
    মলয় রায়চৌধুরী
    প্রাচীন ও নবীনের প্রান্তসীমা ধ’রে
    গভীরে প্রবেশ তাঁর ; মধ্যমণি যাঁকে
    বিহঙ্গদৃষ্টিতে মেনে, রন্ধন স্বপাকে
    প্রস্তুতির বেশি কিছু ব্যর্থতার জ্বরে
    বিপন্ন যে কতবার ! কিন্তু এতে সুখ
    গোপন করিনি, জানে শ্বেত পারাবত ;
    উদ্ডীন, তথাপি খুঁজে অগ্রদানী ক্ষত
    নিরস্ত হয়েছে । তুমি প্রতিমার মুখ
    সম্যক আয়ত্ত করে এই নষ্টপ্রায়
    সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে রাবণসম্মতি
    অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত করেছো বান্ধব--
    ঋষির পাণ্ডিত্যে তাই শিশুর সভায় 
    মানায় তোমাকে, তুমি স্পর্শগন্ধশ্রুতি
    স্বয়ং স্বতঃসিদ্ধ -- ক্ষান্ত হলে জনরব ।
                                          ( শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, ‘সমীর রায়চৌধুরী’ )
              সমীর রায়চৌধুরী একজন দার্শনিক-সাহিত্যিক ; কেবল ভাবুক বা কবি বা গল্পকার বা প্রাবন্ধিক বললে ওনাকে বোঝানো যায় না । ইউরোপে যেমন ছিলেন স্তেফান মালার্মে, উমবের্তো একো, এজরা পাউণ্ড, জাঁ পল সার্ত্রে, আতোয়াঁ আর্তো, আলবেয়ার কামু, মিলান কুন্দেরা, টি এস এলিয়ট, অলডাস হাক্সলি, জাঁ জাক রুশো, ফিয়োডোর ডস্টয়েভস্কি প্রমুখ, যাঁদের লেখায় আমরা তাঁদের বিশ্ববীক্ষা পাই । বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকের পর থেকে আমরা কেবল প্রাবন্ধিক বা গল্পকার বা কবি বা ঔপন্যাসিক পেয়েছি বলে সমীর রায়চৌধুরীর কাজকে বুঝে ওঠা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি -- তাঁরা সমাজকে বুঝতে চেয়েছেন কেবল বাংলা ভাষাসাহিত্যের জ্ঞানের মাধ্যমে । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার যে বিশেষ সংখ্যা ওনার কাজ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাতেও দেখা গেছে কেউ-কেউ, অন্ধের হাতি দেখার মতন, কেবল একটি ডাইমেনশানকেই তুলে ধরেছেন, হয় তাঁর গল্প বা কবিতা বা শব্দভাবনা ; হাংরি আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে লিখতে দেখলুম না কাউকে, সম্ভবত হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাই এমন । দাদা, তাঁর গভীর পড়াশুনা আর ব্যাপক অভিজ্ঞতার দরুণ, ছিলেন মাল্টিডিসিপ্লিনেরিয়ান । 
              অলোক গোস্বামী দাদার ছোটোগল্পের বই “খুল যা সিমসিম” আলোচনায় ( বোধ, মার্চ, ২০০৯ ) একটি ঘটনার কথা বলেছেন, “কফিহাউস থেকে বেরুনোর পথে এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক বলেছিলেন, সমীর রায়চৌধুরী পড়েছি । তবে কী যে লেখেন, গল্পের আকারে প্রবন্ধ না প্রবন্ধের আকারে গল্প, বুঝতে পারিনি।” উমবের্তো একোর “দি নেম অফ দি রোজ” সম্পর্কে কয়েকজন আলোচক, বুঝতে না পেরে, এরকম কথাই বলেছিলেন ; এজরা পাউণ্ডের কবিতা সম্পর্কে এখনও এমনতর মন্তব্য ইনটারনেটে পাওয়া যায় । দাদা তাঁর ছোটোগল্পে অন্ধকারকে, জ্যামিতিকে, ভারসাম্যকে, সন্ত্রাসকে, ভয়কে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন, যখন কিনা বঙ্কিমচন্দ্রের পর থেকে গল্প লেখা হয়ে আসছে ব্যক্তিএকককে নিয়ে । দাদা তাঁর অন্তর্ঘাতী, ক্যাননভঙ্গকারী, সৃজনশীল রচনাগুলোয় যা ধরার প্রয়াস করেছিলেন তা হল “মানবেতিহসের প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তের সংঘর্ষময় নবাঞ্চল”। তাঁর ইতিহাসবোধ কেবল সময়কেন্দ্রিক ছিল না । তাঁর পাঠবস্তুর শরীরেই জ্ঞানের বিকাশে অভিজ্ঞতার ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন, রৈখিক সময়ের একটিমাত্র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বস্তুত ‘সময়বোধ’-এ বিপ্লব আনতে চেয়েছেন, এবং চল্লিশ বছরের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংঘর্ষময় জায়গাটাকে ভরে তুলতে চেয়েছেন নবাঞ্চলের ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা দিয়ে, অভেদের সন্ধান দিয়ে  । 
              ১৯৬৩ সালে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ‘জলছবি’ নামে, তা শেষ হয়েছে স্বমেহনের অবিকল বাৎসায়নি বর্ণনা দিয়ে, যা বহু পাঠক ধরতে পারেননি, সম্ভবত অতো আগে তেমন পাঠক গড়ে ওঠেনি :
                         “উরুসন্ধিতে সাবান বোলাতেই বুক ফুঁড়ে অসংখ্য বুলবুলি উঠে যায় ।
                         দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ায় । ক্ষিপ্ত মুঠোয় নির্মমভাবে সাপ ধরে ফেলে ।
                         শিরাউপশিরা ধমনিতে উষ্ণরক্ত টগবগ করে ওঠে । অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া
                         ছোটে সীমান্তের দিকে । একত্রিত অনিমেষ দ্রুত নিক্ষেপে শরীর ফুঁড়ে
                         ছিটকে বাইরে বেরোয় । একটা স্তব্ধ মুহূর্ত । বার্তা পৌঁছোয় ।”
              যে ধরণের প্রশ্নাবলী সাধারণত বিতর্কমূলক দর্শনে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়, তা দাদা তাঁর কবিতা ও ছোটোগল্পে বুনে দিয়েছেন । দাদার কবিতা ও ছোটোগল্প কেউ-কেউ বুঝে উঠতে পারেননি তার কারণ বঙ্গসমাজের বর্তমান কালখণ্ডে অজ্ঞানতা ও শিক্ষাহীনতা হয়ে উঠেছে গর্ববোধের ব্যাপার । বাঙালির সমাজে পাড়ায় পাড়ায় কোমসোমোলদের চূড়ায় একজন করে ইলিয়া এরেনবুর্গ দিব্বি তাদের সাংস্কৃতিক মধ্যস্হতার পণ্ডিতিয়ানা চালিয়ে রাজত্ব করছিল, যখন দাদা হাংরি আন্দোলনের  পরে, নব্বুই দশকের গোড়ায়, পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরলেন। দাদা বুঝতে পারলেন যে এই কলকাতা, এই পশ্চিমবাংলা, তাঁর সিটি কলেজে পড়ার সময়কার, পাণিহাটিতে থাকার সময়কার, উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির খণ্ডহরে থাকার সময়কার বাস্তবতার শহর ও রাজ্য নয়, এই বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন । যে সমস্ত পত্রিকা সে সময়ে প্রকাশিত হচ্ছিল, সেগুলো তাঁর মনের মতো ছিল না, বেশিরভাগ পত্রিকা ছিল, আছে এখনও, বিশেষ-বিশেষ বৌদ্ধিক কমপার্টমেন্টে কিংবা গোষ্ঠীতে বিভাজিত ।
              কলকাতায় ফিরে দাদা “হাওয়া৪৯” নামে একটি সাহিত্যিক-দার্শনিক পত্রিকা প্রকাশের তোড়জোড় করলেন, বন্ধুদের বাড়ি-বাড়ি গেলেন, কিন্তু কেউই আগ্রহ দেখালেন না । কোন বন্ধু ? যে বন্ধুর প্রথম কাব্যগ্রন্হ তিনি নিজের টাকায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর চাইবাসার নিমডি টিলার বাসায় টানা আড়াই বছর ছিলেন, মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু মদ খাবার পরের দিন সকালে খাঁটি দুধ খেতে চান বলে দাদা তার জন্য বাড়ির সামনে দুধ দোয়াতেন, মানে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ; যে বন্ধু তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় বছর খানেক থেকে উপন্যাস লিখে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন, মানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার প্রস্তাব শুনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “হাঃ হাঃ, সমীর চিরকাল নতুন-নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে, ও কলেজের সময় থেকেই অমন।” বার্ধক্যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শরীর যখন ভেঙে পড়েছে, তখন ভূমেন্দ্র গুহকে বলেছিলেন, “সবাই আমার কাছে আসে, শুধু সমীরটাই আসে না, ও কি পুরস্কার চায় না !”
              বয়স্ক বন্ধুদের বাড়ি না গেলেও চলতো । দাদা লক্ষ করেননি যে তাঁর অবর্তমানে কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের জেলা সদরগুলোয় নতুন প্রজন্মের কবি ও লেখকরা দেখা দিয়েছেন, যাঁদের ভাবনাচিন্তা প্রায় দাদার সমান্তরাল, যাঁরা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক প্রথানুগত চলতি-আড্ডার গুমোট  নয়, ভাষাসাহিত্যের ক্যানন  অস্বীকার করতে চাইছেন, যাঁদের পাঠবস্তু ট্র্যান্সগ্রেসিভ এবং অন্তর্ঘাতী । ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে দাদা প্রকাশ করলেন “হাওয়া৪৯” পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ।
              ১৯৪৯ সালে, যে-বছর দাদা ম্যাট্রিক পাশ করলেন, আমার বয়স ছিল দশ, আমাকে একটা ফিল্ম দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, দাদা পাটনার এলফিনস্টোন সিনেমা হলের মর্নিং শোতে ফিল্মটা আগেও কয়েকবার দেখেছিলেন, আর ভালো লেগেছিল বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ফিল্মটার নাম ‘দি উইজার্ড অফ অজ’, নায়িকা জুডি গার্ল্যাণ্ড, পরবর্তীকালে এই ফিল্মটার ডিভিডি কিনে আমি আমার স্কুলপড়ুয়া ছেলে আর মেয়েকে প্রায়ই দেখাতুম । ১৯৯০ সালে, অবসর নিয়ে যখন দাদা কলকাতায় ফিরলেন, তখন বলেছিলেন, গল্প রচনার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক ক্রমশ ভেঙে পড়ছে, আর ‘দি উইজার্ড অফ অজ’ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, সমাজের ভেতরের সংঘর্ষে ব্যক্তিজীবনের ব্যাখ্যার অতীত দুর্ঘটনাগুলো ওই ফিল্মের জাদুবাস্তব চরিত্রদের মতন হয়ে চলেছে । বস্তুত, তরুণ আর অতিতরুণদের কাছে, কলকাতায় এসে, দাদা দেখা দিলেন সাহিত্যের নবাঞ্চলের উইজার্ড হিসাবে । ২২শে জুন ২০১৬ তাঁর মৃত্যুর পরে ২৪ জুন তেইশটি পত্রিকা একত্রিত হয়ে কলকাতার অবনীন্দ্র সভাঘরে যে স্মরণসভার আয়োজন করেছিলেন, তা থেকেই তাঁর উইজার্ডরির জাদুবাস্তব খেলার সঙ্গে পরিচিত হই ।
              ১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলনেও দাদা ছিলেন উইজার্ডের ভূমিকায়, কেবল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের আন্দোলনের প্রতি প্রত্যয় উৎপাদনের জন্যই নয়, অনেক সময়ে বুলেটিন ছাপার খরচ দেবার জন্যও নয়, কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে মননভূমি আগে থেকেই গড়ে তোলা দরকার সে-বিষয়ে পরামর্শের জন্যও । এখন সকলেই জানেন যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আইওয়া থেকে চিঠি লিখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখকে হাংরি আন্দোলন ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য প্ররোচিত করছিলেন, কিন্তু দাদাকে তিনি তেমন কোনো চিঠি লিখছিলেন না । ওনারা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু দাদা হাংরি আন্দোলনে ম্যাটাডরের মতন লাল চাদর নিয়ে ষেঁড়ো লেখকদের থামাচ্ছিলেন । অবশ্য বিবিসি থেকে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডোমিনিক বার্নের একটি রেডিও প্রোগ্রামের জন্য অসুস্হ শরীরে উৎপলকুমার বসু সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি একজন হাংরি আন্দোলনকারী, তার মাস কয়েক পরেই উৎপলকুমার বসু মারা যান । 
              ওনারা তিনজনেই যখন আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হলেন তখন দাদা বলেছিলেন, “অবাক হবার কিছুই নেই”। শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ যখন ছাড়া পাবার জন্য হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করার  মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেল, তখনও দাদা বলেছিলেন, “ওরা সারাজীবন এই পরাজয়বোধ বয়ে বেড়াবে আর লেখালিখি করবে সেই ক্ষয়রোগের সমর্থনে।” একেবারে অব্যর্থ বলেছিলেন দাদা । দাদার বিরুদ্ধে একটা বাড়তি পেনাল কোডের সেকশান চাপানো হয়েছিল, তরুণদের বিপথগামী করার । চাইবাসার মতন ছোটো জায়গায় দাদার গ্রেপতারি বেশ অপমানজনক ছিল নিশ্চয়ই, দাদার শশুর একজন মোক্তার ছিলেন বলে, আর জেলা শাসক দাদার লেখালিখির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলে, তাঁকে লকআপে ঢোকানো হয়নি।
              এখানে একটা ঘটনা বলে নিই, নয়তো লিখতে বসে ভুলে যেতে পারি । বড়োজ্যাঠা-মেজজ্যাঠার পরপর মেয়ে হবার দরুণ ঠাকুমা, বংশধরের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন । দাদাকে ঠাকুমা তাই খুব ভালোবাসতেন। হাংরি আন্দোলনে দাদা গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনে ঠাকুমার সেইদিনই হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আর মারা যান । ঠাকুমার মৃত্যুর কারণে হাংরি আন্দোলনের সময়ে বাবা আর জেঠা-কাকারা জেঠিমা-কাকিমারা সবাই উত্তরপাড়ায় একত্রিত হয়েছিলেন । বড়োজ্যাঠা ন্যাড়ামাথায় গিয়েছিলেন আমাদের মকদ্দমার প্রথম দিনে, আর কোনো ভাই ন্যাড়া হননি ।
              ঠাকুমা, যাঁর নাম ছিল অপূর্বময়ী, আর ঠাকুর্দা যাঁর নাম ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ, ওনাদের ছয়  ছেলে প্রমোদ, সুশীল, রঞ্জিত, অনিল, সুনীল, বিশ্বনাথ আর এক মেয়ে কমলা । বাবা ছিলেন তৃতীয়, রঞ্জিত, লাহোরে জন্মেছিলেন বলে মহারাজা রঞ্জিত সিংহের নামে ওনার নামকরণ । একান্নবর্তী পরিবারটিকে মোটামুটি একা বইতেন বাবা । নিম্নবিত্ত বলতে যা বোঝায়, তাই । থাকতুমও আমরা পাটনার অতিদরিদ্র পাড়ায় । দাদার শেষ কাব্যগ্রন্হের নাম “অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়”। উত্তরপাড়ার বসতবাড়ি খণ্ডহর হবার আগে, নকাকা-নকাকিমার সবে বিয়ে হয়েছে, তখন ওনারা সাবর্ণ ভিলার দুটো বিশাল ঘরে “অপূর্বময়ী  বিদ্যালয়” নামে বাচ্চাদের একটা স্কুল খুলেছিলেন ; স্কুলটা উঠে যায় ওনাদের দুজনের মধ্যে অবনিবনার কারণে, তখনকার দিনে তো কথায়-কথায় ডিভোর্স ব্যাপারটা ছিল না ।
              দাদার প্রধান অবদান দুটি শতকের সাহিত্যিক-নান্দনিক বৈভিন্নকে দুই হাত দিয়ে টেনে নিজের বুকের কাছে এনে একটা সেতু গড়ে ফেলা, এবং সেকারণেই দাদা আগ্রহী করতে পেরেছিলেন আগের শতকের প্রভাত চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী প্রমুখের পাশাপাশি পরের শতকের অনুপম মুখোপাধ্যায়, তুষ্টি ভট্টাচার্য প্রমুখকে, অথচ দাদা কোনো সংবাদপত্র বা পাবলিশারের পেটোয়া লেখক ছিলেন না ; ওপরে শঙ্করনাথ চক্রবর্তীর কবিতাটা পড়ে স্পষ্ট হয়ে গিয়ে থাকবে । দাদার এই ধরণের বক্তব্য যে, “শব্দের ভেতরে শব্দেরা পাশ ফিরে থাকে”, “একটি বাক্যের ভেতরে লুকিয়ে থাকে একাধিক বাক্য”, “গল্পেরা আমার মাধ্যমে জন্মায়, কলম থেকে নয়”, “তুমি নিজের পারিবারিক ইতিহাসের ভেতরে যেমন জন্মাও, তেমনই স্বদেশের ইতিহাসের ভেতরে” ইত্যাদি কথাগুলো তাঁর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত । 
             অভিজ্ঞতা জমেছে শৈশবে পাটনা শহরে অন্ত্যজপাড়া ইমলিতলায় থাকার সময় থেকেই । তাঁর সময়ের আর কোনো বাঙালি সাহিত্যিক কি এমনতর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছেন, তাঁদের শৈশবে ! ছোটোবেলায় দাদার একটা চোখ ট্যারা ছিল, ট্যারা চোখ সোজা করার জন্য ডাক্তার দেখাবার মতন টাকাকড়ি বাবার ছিল না কেননা ওনাকে কুড়িজনের একান্নবর্তী পরিবার চালানো ছাড়াও উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার খরচ আর বসতবাড়ির ট্যাক্স পাঠাতে হতো ; বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন এক বৃদ্ধ, যিনি ছিলেন বিখ্যাত চোখের ডাক্তার দুকখন রামের ( জগজীবন রামের বাবা ) কমপাউণ্ডার, তিনি আরেকজন বালকের ট্যারা চোখ সোজা করার প্রেসক্রিপশানের নকল এনে দিলে বাবা দাদার চশমা করিয়ে দিয়েছিলেন, গান্ধিছাপ গোল চশমা, ডাঁটিটা স্প্রিঙের ; দাদার ট্যারা চোখ বছর দুয়েকে সোজা হয়ে গেল কিন্তু বাঁ-চোখটা সারাজীবনের মতন খারাপ হয়ে গেল । 
              ইমলিতলা ছিল অন্ত্যজ বিহারি আর অত্যন্ত গরিব শিয়া মুসলমানদের পাড়া ; এই পাড়ায় চোর-পুলিস খেলার সময়ে যেকোনো বাড়ির ভেতরে ঢোকা যেতো, কেউই বারণ করতো না, মসজিদের ভেতরে মাদুরের আড়ালে লুকোনো যেতো, যদিও বড়োজ্যাঠামশায় তা পছন্দ করতেন না। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যে কানা গলি ছিল তার শেষে একটা বস্তি ছিল, বস্তিতে গাঁজা গাছের ঝোপ, ওই গাছের ফুল শুকিয়ে বউ-মরদরা ফুঁকতো, দাদার গাঁজা ফোঁকার হাতেখড়ি সেখানেই হয়ে গিয়েছিল, আমার আর মেজদারও । দাদার কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বন্ধুরা গাঁজা ফুঁকতেন বলে মনে হয় না । দাদা আমাদের সঙ্গে নেপালে গেলে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে, হিপিদের জমায়েতে, গাঁজা হ্যাশিশ আর এল এস ডি নিয়েছিলেন, মোষের কাঁচা মাংসের পদ চাল-গমের মদ রাকসির সঙ্গে খেয়েছিলেন । নেপালের সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দাদার ছবি ছাপা হয়েছিল । পরে দাদা নেপালি কবিলেখক আর হাংরি আন্দোলনকারীদের একটা যৌথ সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন অনিল করঞ্জাই ।
              কানা গলির শেষের বস্তিতে শুয়োর মেরে খাওয়া হতো, তাড়ি সহযোগে । সন্ধ্যাবেলায় গনগনে লোহা ঢুকিয়ে গর্তে ফেলা শুয়োর মারার আর্তনাদ পেলে দাদা পরের দিন বলতেন, চল শুয়োরের মাংস খাব তাড়ি দিয়ে, রান্নাঘর থেকে এলাচ নিয়ে নে, ফিরে এসে ফিটকিরি দিয়ে দাঁত মেজে নিস । সেই সব গরিব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা চুরি-ডাকাতি-পকেটমারি করে সংসার চালাতো, তাদের কাউকে গ্রেপতার করার জন্যে পাড়ায় পুলিশ ঢুকলে দাদা বলতেন চল চল ছাদে চল ; ছাদে গিয়ে দেখতুম সন্দেহজনকরা গোলটালির ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে পেছনের আমবাগানে । পাড়ায় দাদার সমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে একজনের বাবা পকেটমার ছিল, সেই বন্ধুও বাপের কাছে পকেট মারা শিখছিল, দাদা তাকে বদ্রি পাটিকমার বলে ডাকতেন । দাদা বাড়িতে এসে বলেছিলেন, বদ্রির কুঁড়েঘরে ইশকুলের মতন ব্যাপার, এ-পাড়ার আর অন্য পাড়ার অনেক ছোঁড়া শিখছে, দুআঙুলে পার্স তোলা, আধখানা ব্লেডে কাটা, এইসব । 
              আমাদের বাড়িতে খাঁচাকলে ইঁদুর পড়লে বস্তির দুসাধদের দেয়া হতো, পুড়িয়ে খাবার জন্য । দাদা, মেজদা আমি শৈশবে ইঁদুরপোড়া চেখেছি । যদি জাঁতিকলে ইঁদুর পড়তো তাহলে দাদা ছাদে গিয়ে কিংবা মাঠে গিয়ে, ইঁদুরের ল্যাজ ধরে “চিল কা বাচ্চা চিলোড়িয়া” বলে ঘোরাতেন আর আকাশে চিলেরা পাক খেতে আরম্ভ করলে ছুঁড়ে দিতেন, একটা চিল ঠিকই ইঁদুরটাকে ধরে নিয়ে পালাতো । পরে আমি আর মেজদাও এই খেলা খেলেছি ।
              ইমলিতলায় গুলি, টেনিসবলের ফুটবল, ড্যাঙগুলি, লাট্টুখেলায় দাদা ছিলেন ওস্তাদ, সাইকেলের টায়ারকে কাঠি মেরে মেরে গোলা রোডের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাবার প্রতিযোগীতায় দাদা জিততেন প্রতিবার । কিন্তু কাঁইবিচি মানে পাকা তেঁতুলের বিচি আর কলকে ফুলের বিচি যাকে পাড়ায় বলা হতো কানায়েল, সেগুলো গর্তে ফেলার আর টিপ করে মারার খেলায় মেজদা জিততো । টেনিসবল নর্দমায় পড়ে গেলে গুয়ের ভেতর থেকে কাঠি দিয়ে বের করে আনতে হতো, আর বাড়ির কেউ দেখে ফেললে, সন্ধ্যায়, শীতকাল হলেও, চান করে গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো । কম বয়সে পৈতে হয়ে গিয়েছিল বলে বকুনিটা বেশি করে খেতে হতো দাদাকে । বড়দি-ছোড়দির বিয়ে হয়ে যাবার পর সন্ধ্যার সময়ে গামছা পরে চৌকাঠগুলোয় গঙ্গাজল ছেটাবার আর শাঁখ বাজাবার কাজ ছিল দাদার ।
              বাবা তাই দাদাকে একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন । দাদা পাড়ায় ফুটবল টিম গড়ে অন্য পাড়ার টিমের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতার আয়োজন করতেন । শিল্ডটা দাদা নিজে তৈরি করতেন, পিচবোর্ডকে শিল্ডের মতন কেটে তার ওপর ব্রুকবণ্ডের রাঙতা মুড়ে আর লাল রঙের রিবন সেঁটে । মাঠে খেলতে গেলে, এখন তার নাম গান্ধি ময়দান, একদিকের গোলপোস্ট হতো দাদার দুপাটি জুতো দিয়ে, অন্য দিকেরটা বিরজু নামে দাদার এক পাড়াতুতো খোঁড়া বন্ধুর, তার মা ছাতু বিক্রি করতেন । দাদা ফেরার সময় জুতো পরে আসতে ভুলে যেতেন আর পুজো পর্যন্ত বিনা জুতোয় থাকতেন, স্কুলও যেতে হতো খালি পায়ে, কেননা বাবা সকলের জুতো বছরে ওই একবারই কিনে দিতেন, মহালয়ার আগে । খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া এড়াতে দাদা একজন জজের জুড়িগাড়িতে, পেছন দিকে যেখানে আর্দালি দাঁড়ায়, সেখানে বসে চলে যেতেন, জজ সায়েবকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময়ে আর্দালির দাঁড়াবার জায়গা তো ফাঁকা থাকতো ।
               ইমলিতলায় শাসনের ভার ছিল বড়োজ্যাঠার ওপর । ওনার খাটের তলায় শরকাঠির গোছা ছিল তা থেকে একটা টেনে বের করে হাতের চেটোয় মারতেন, শরকাঠি অবশ্য দুতিনবারেই ভেঙে যেতো । বড়োজ্যাঠা দাদার নাম ধরে হাঁক পাড়লেই দাদা আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ মেরে হুলাসবাবুদের বাড়ির ছাদে গিয়ে ওনাদের চারটে সিঁড়ির কোনো একটা দিয়ে নেমে পালাতেন, ফিরতেন বড়োজ্যাঠা অফিস চলে গেলে কিংবা ভুলে গেলে । দুটো বাড়ির মাঝের গলি ছিল অন্তত চার ফিট । হুলাসবাবু তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ নিয়ে একটা খেলা খেলতেন যা দাদার পছন্দ ছিল ; কুরুশকাঠির মতন একটা লোহার কাঠি যাকে ‘শ্রীরামশলাকা’ বলা হতো, সেটা কোনো একটা খোপে চোখ বুজে রাখা ; যেখানে-যেখানে  রাখা হতো সেই অক্ষরগুলোর সাহায্যে কোনো দোহা চিহ্ণিত করে  ব্যাখ্যা করে হুলাসবাবু ভবিষ্যত বলতেন । এই খেলা নিয়ে “টিনিদির হাত” নামে দাদার একটা গল্প আছে ‘খুল যা সিমসিম’ গল্পগ্রন্হে ।
              স্কুলের শেষ ধাপ পর্যন্ত, অর্থাৎ ম্যাট্রিকুলেশান অব্দি, দাদার পড়ার টেবিল বলতে ছিল একটা বড়ো মাপের প্যাকিংবাক্স, বাবার ফোটোগ্রাফির দোকান থেকে আনা, তার ওপর মায়ের পুরোনো শাড়ি পাতা । দাদাকে মেঝেয় বসে পড়তে হতো, রাতে লন্ঠনের আলোয় । লন্ঠনের কাচের ভুষো দাদাকে পরিষ্কার করতে হতো । কাচ ভেঙে গেলে দাদা বাতি জ্বেলে রসুন দিয়ে জুড়ে নিতেন যতো দিন চলে । মা ছিলেন রান্নাঘরের ইনচার্জ, সুতরাং মায়ের আদেশে দাদাকে কয়লা ভাঙতে হতো, বাতিল প্যাকিংবাক্সের কাঠ টুকরো করতে হতো উনোনের জন্য, অনেকসময়ে সকালে পোড়া কয়লা  বের করে উনোন সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে হতো । পোড়া কয়লার সাদা অংশ আলাদা করে রেখে দিতে হতো যাতে তার সঙ্গে ফটকিরির গুঁড়ো মিশিয়ে বাবা বাড়ির সকলের জন্য দাঁতের মাজন তৈরি করে দিতে পারেন ।
              মেজজ্যাঠা জামের ভিনিগারের ব্যাবসা আরম্ভ করার তোড়জোড় করে ছিলেন, যদিও চলেনি । আড়াই-তিন ফিটের এনামেলের গামলা জামে ভরে  দাদাকে তার ওপর লেফ্ট-রাইট করতে বলতেন, পরে আমিও করেছি । লেফ্ট-রাইট করার সময়ে দাদা একটা গান গাইতেন, “তুফান মেল, ইসকে পইয়ে জোর সে চলতে, অওর অপনা রাস্তা তয় করতে, সবহি ইসসে কাম নিকালে, বচ্চে সমঝে খেল, তুফান মেল”, কাননবালার গান সম্ভবত, স্মৃতি থেকে লিখছি ।
              সন্ধ্যাবেলা পড়াশুনার শেষে বড়োজেঠিমা আমাদের গল্প বলতেন, ঠাকুমার ঝুলি, পঞ্চতন্ত্র, ইশপের ফেবল, আরব্য রজনীর খিচুড়ি বানিয়ে ওনার নিজস্ব গল্প । আমরা জাঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনরা লন্ঠন ঘিরে ওনার গল্প শুনতুম । শুনতে-শুনতে দাদা লন্ঠন নিভিয়ে দিতেন, বলতেন, “আলো জ্বললে গল্পটা দেখতে পাবো না”। দাদার গল্পে যে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তব তার উৎস বড়োজেঠিমার অবিশ্বাস্য গল্পগুলো । দাদার গল্পগুলোয় জাদুবাস্তবতার আরেকটা কারণ হলো, যেকারণে দাদা তাঁর পত্রিকার নাম রেখেছিলেন “হাওয়া-৪৯” বা ঊনপঞ্চাশ বায়ু, তা হল এই যে পাটনা কলেজিয়েট স্কুল, যে স্কুলে দাদা পড়তেন, তা এক সময়ে ছিল পাগলাগারদ, সেই বিলডিং ভেঙে স্কুলের বিলডিঙ তৈরি হয়, পরে পাগলাগারদ রাঁচিতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় । স্কুলের ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে পাগলদের সম্পর্কে নানা আজগুবি কুহকের গল্প ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে আদান-প্রদান করতো, চোর-পুলিশ লুকোচুরির বদলে পাগল আর সুস্হমগজের খেলা খেলতো । অবসরের পর বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি থাকার সময়ে দাদা এক মুসলমান চাবিঅলা, ঠেলাগাড়ির সবজিঅলা আর নাপিতের সঙ্গে বাড়ির বারান্দায় খোশগল্প করতেন আর তাদের কাছ থেকে যে জাদুবাস্তব জগতের আভাস পেতেন তা তাঁর গল্পে কাজে লাগতো। “তোমাদের বাড়ির রোদ”, এই অভিব্যক্তি দাদা পেয়েছিলেন তাঁর বাংলাদেশি কাজের-বউয়ের কাছ থেকে, যে রোদ, দাদার মনে হয়েছিল, একযোগে স্হাবর ও অস্হাবর সম্পত্তি । তেমনই বাড়ির নিজস্ব অন্ধকার, যা পাওয়া যাবে দাদার ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে ।
              দাদার আরেকটি স্মৃতি ছিল পাণিহাটির রাঙাদিদুকে কেন্দ্র করে, যিনি কম বয়সে বিধবা হয়ে যাবার দরুন সংসারছাড়া হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁকে সবাই নেড়ি পাগলি বলতো, তিনি দাদাকে ভালোবাসতেন আর কোলে বসিয়ে নানারকম আজগুবি গল্প শোনাতেন । মামার বাড়ির ব্যানার্জি পাড়া রোডে যখন যার বাড়িতে ইচ্ছে খেতেন রাঙাদিদু, দাওয়ায় শুতেন, মাথা গোলমাল হলেও সমাদৃত ছিলেন, পাড়ায় পাড়ায় সারাদিন টোটো করে বেড়াতেন । উনি ছিলেন দাদামশায়ের কোনো ভাইয়ের স্ত্রী । নাপিত দেখলেই বেলতেন, ‘এই হারু, আমার মাথাটা ন্যাড়া করে দে দিকিনি’ ।
              দাদার কাছে একটা খেলা শিখেছিলুম যা আমি “ছোটোলোকের ছোটোবেলা” স্মৃতিকথায় লিখেছি । একটা নীল মাছিকে মেরে, সুতোর একদিকে বেঁধে দাদা ছুঁড়ে দিতো গোপাল হালুইকরের জিলিপির পাহাড়ের ওপরে, সেই পাহাড়ে ভিমরুলের ঝাঁক । একটা ভিমরুল মাছিটাকে কামড়ে ধরে মিষ্টির বদলে ননভেজ খাওয়াই পছন্দ করতো, মুখ থেকে ছাড়তে চাইতো না, পেট না ভরা পর্যন্ত । দাদা অন্য প্রান্তটা ধরে ঘুড়ির মতন ওড়াতে-ওড়াতে ইমলিতলার এগলি-সেগলি দৌড় মারতেন, পেছনে পাড়ার ছেলেরা ।
              গোলা রোড দিয়ে শব গেলে শববাহকরা ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ বলতে বলতে যেতো, যা শোনা যেতো ইমলিতলার বাড়ি থেকে । মৃতের আত্মীয় শবের সামনে হাঁটতে-হাঁটতে খইয়ের সঙ্গে তামার পয়সা ছেটাতো । শববাহকদের কন্ঠস্বর শুনতে পেলে দাদা বলতেন, “চল চল পয়সা লুটবো” । আমি আর মেজদা দাদার পেছন -পেছন দৌড়োতুম, আর পয়সা কুড়োতে-কুড়োতে ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনি তুলতুম । দাদা পয়সা জমিয়ে আলুকাবলি খেতেন বা সিনেমা দেখতেন, একেবারে সামনের শ্রেণির, যাকে তখন বলা হতো ছওআনিয়া, বা তখনকার চব্বিশ পয়সা। সিনেমা দেখা আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিল, বড়োজ্যাঠা আর ঠাকুমা পছন্দ করতেন না, সিনেমাকে বলতেন লোচ্চাদের তামাসবিনি । বয়স্করা লক্ষ্য রাখতেন যে তিনটে থেকে ছ’টা টানা তিন ঘণ্টা ছোটোরা কেউ বাড়িতে অনুপস্হিত থাকছে কিনা । দাদা একটা উপায় বের করেছিলেন ; একদিন প্রথমার্ধ উনি দেখে গেটপাসটা আমায় দিতেন দ্বিতীয়ার্ধ দেখার জন্য, পরের দিন আমি প্রধমার্ধ দেখতুম আর দাদা দ্বিতীয়ার্ধ । মরনিং শো দেখতে গেলে বাড়িতে কেউ টের পেতেন না । অমন একটা মরনিং শোতে দাদা আমাকে ‘উইজার্ড অফ অজ’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন ।
              দাদার জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগণার পাণিহাটিতে, মায়ের মামার বাড়িতে, ব্যানার্জি পাড়া রোডে, এখন রাস্তাটার অন্য কোনো নাম হয়েছে ; দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কম বয়সে মারা যাওয়ায় দিদিমা ছেলে মেয়েদের নিয়ে বড়ো ভাই অনাদিনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় পান । মায়ের বাপের বাড়ি, যার নাম “নিলামবাটি”, তা ছিল অনাদিনাথের বাড়ির উল্টোদিকে । পাণিহাটিতে দাদার নাম রাখা হয়েছিল বাসুদেব, সেখানে সকলে বাসু নামেই চেনে দাদাকে, মা-ও দাদাকে বাসু নামে ডাকতেন । পাটনায় আসার পর, জাঠতুতো দিদিরা দাদাকে মিনু বলে আদর করা আরম্ভ করেন, দাদা মীনরাশির জাতক বলে । সমীর নাম রাখা হয়েছিল জন্মছকে ‘স’ উঠেছিল বলে । জাঠতুতো দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলে ওনাদের বাড়িতে ভাইফোঁটা করতে যেতুম দুজনে, মেজদা যেতো না। ইমলিতলার বাড়িতে ভাইফোঁটা হতো তার আগের দিন, প্রতিপদে, সাবর্ণ চৌধুরীদের পারিবারিক সংস্কার রক্ষার খাতিরে ।
              ইমলিতলায় দাদার জিভে বাংলা আর পাটনাইয়া হিন্দির খিচুড়ি তৈরি হচ্ছিল বলে দাদাকে ভর্তি করা হয় বাঙালি পরিবার পরিচালিত মহাকালী পাঠশালায় । দাদার জন্ম যদিও ১৭ আগস্ট, কিন্তু ভর্তির সময়ে পুরুত মশায় সতীশ ঘোষালের উপদেশে দাদার জন্ম তারিখ পাল্টে করে দেয়া হয়েছিল ১লা নভেম্বর, ১৯৩৩ । ইমলিতলার বাড়িতে জন্মদিন পালনের কোনো ব্যাপার ছিল না ; দাদার জন্মদিন পালনের কোনো ঘটনা দরিয়াপুরে চলে যাবার পরও ঘটেনি । জন্মদিন যে উৎসব হিসেবে পালন করা হয় সেই সাস্কৃতিক স্তরে ছিল না আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ।
              মহাকালী পাঠশালায় পড়া শেষ করলে দাদাকে ভর্তি করা হয় পাটনা কলেজিয়েট স্কুলে । এই স্কুলে দাদা পাটনার খ্যাতনামা বাঙালি পরিবারের ছেলেদের পান, যেমন বিমানবিহারী মজুমদার, গোপাল হালদারের ভাই রঙিন হালদার, প্রভাতী পত্রিকার সম্পাদক মানিক ভট্টাচার্য, জহর রায়ের বাবা সতু রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ । দাদার আগ্রহে একটা নাটকের দল গড়ে ওঠে, আর বন্ধুরা মিলে বড়দির শশুরের বিশাল জমিদারবাড়ির দালানে নাটক অনুষ্ঠান করতেন । দাদার পাটনার বন্ধুরা কিন্তু আমাদের ইমলিতলার বাড়িতে আসতেন না, ছোটোলোকদের পাড়া বলে।
              ম্যাট্রিকুলেশানের পর দাদাকে কলকাতায় পড়তে পাঠাবার নির্ণয় নেন বাবা-মা, তার কারণ আমার মেজদা ( যাকে বড়োজেঠা এক বেশ্যার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন ) নিজের জন্মের কথা কোনো সূত্রে জানার পর, যাকে বলে “খারাপ হয়ে যাওয়া” তাই হয়ে যাচ্ছিল, বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। দাদাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মায়ের মামার বাড়িতে । মামারা দাদাকে সিটি কলেজে আই এস সি পড়ার জন্য ভর্তি করে দেন । মামার বাড়িতে ছোটোমামা ছিলেন মার্কসবাদে আকৃষ্ট, প্রচুর বই ছিল ওনার সংগ্রহে, নিজের সংগ্রহের শতাধিক বই দাদাকে দিয়ে দিয়েছিলেন । তাছাড়া ওই বাড়িতে বৈঠকখানায় ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের একটি গ্রন্হাগার ছিল, পুরোনো আমলের পত্রিকা ছিল,  দেয়ালে টাঙানো ছিল উনিশ শতকের মনীষীদের ছবি, সেই ঘরে সন্ধ্যাবেলায় পাণিহাটির বয়স্করা একত্রিত হতেন দার্শনিক তর্কাতর্কির জন্য   । 
              মামার বাড়ির শিক্ষা আর পারিবারিক সংস্কৃতি দাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পেরেছিল । দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ আবিষ্কারকারী স্যার রোনাল্ড রসের সহগবেষক, গ্রেট ব্রিটেনের সপ্তম এডোয়ার্ডের স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । পাণিহাটির কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন দাদামশায় । তাঁর নামে পাণিহাটিতে একটি রাস্তা আছে । ব্যাঙ্কে তাঁর ফোটো  ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত টাঙানো ছিল, পাণিহাটির মিলিউ পালটে যাবার পর ছবিটি  ফেলে দেয়া হয়েছে । তাঁর সঙ্গে আমার ঠাকুর্দা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরীর পরিচয় ছিল, এবং সেই সূত্রেই মা-বাবার বিয়ে । মায়ের নাম অমিতা। দাদা আর আমি দুই ভাই, নিজেদের কোনো বোন নেই।
              মায়ের মামার বাড়ির শৃঙ্খলা দাদার ইমলিতলা চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না । তাছাড়া সেসময়ে ইলেকট্রিক ট্রেন আরম্ভ হয়নি, প্যাসেঞ্জার ট্রেনে শেয়ালদায় আসা-যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় ছিল না । শেয়ালদা স্টেশানও হাওড়া স্টেশানের তুলনায় পুর্বপাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুতে ছিল ছয়লাপ, প্রতিদিন যাদের দুরবস্হা দেখতে-দেখতে দাদার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছিল । তাছাড়া ঠাকুমার পছন্দ ছিল না যে দাদা পাণিহাটিতে মায়ের মামার বাড়িতে থাকুন । দাদা চলে এলেন উত্তরপাড়ায় ঠাকুমার বারো ঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহর সাবর্ণ ভিলায়, বেছে নিলেন চিলেকোঠার ঘর,  ঠাকুমাকে এড়িয়ে এই ঘরে সিগারেট ফোঁকা যেত। পাণিহাটিতে রাতে বাড়ি ফিরতেই হতো, তার কারণ মামারা কলকাতায় চাকরি করতে যেতেন আর ফিরতেন, তা যতো রাতই হোক, ট্রেন পাইনি বলে ওজর দেবার সুযোগ ছিল না । ঠাকুমা একা থাকতেন, তাই রাতে কলকাতায় থেকে গেলে তাঁকে যা হোক কোনো গল্প শুনিয়ে দিতে পারতেন দাদা । উত্তরপাড়ার বাড়িতে আদ্যিকালের একটা পেল্লাই বিছানা দাদাকে বরাদ্দ করেছিলেন ঠাকুমা, যার পায়াগুলো ছিল বাঘের পায়ের মতন ।
              উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে প্রতিবেশী অমিত মৈত্র নামে একজনের সঙ্গে দাদা “লেখা’ নামে একটা পত্রিকা আরম্ভ করেন । সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় একজনের কবিতা প্রশংসনীয় মনে হওয়ায় দাদা আর্টস বিভাগে গিয়ে সেই ছাত্রটির সঙ্গে পরিচয় করেন । ছাত্রটির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । দাদার সঙ্গে এই সময়ে পরিচয় হলো আনন্দ বাগচি, দীপক মজুমদার, শংকর চট্টোপাধ্যায়, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, শিবশম্ভু পাল, ফণীভূষণ আচার্য প্রমুখের , যাঁরা প্রায়ই ছুটির দিনে দাদার চিলেকোঠায় আড্ডা মারতে আসতেন । এনারা কেউ না কেউ দাদার জন্যে খাবার আনতেন ছুটির দিনে । কলেজের দিনে দাদা কলকাতার পাইস হোটেলে খেতেন, সাধারণত কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পাইস হোটেলে বা শ্যামবাজারের পাইস হোটেলে । “কৃত্তিবাস” পত্রিকা আমি প্রথম দেখি দীপক মজুমদারের হাতে, শ্যামবাজারের পাইস হোটেল থেকে খেয়ে দাদা আর আমি বেরিয়েছি, ওনার সঙ্গে দেখা। দাদা ওনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দ্যান প্রখ্যাত কবি আর সম্পাদক হিসেবে ।
              ইমলিতলার পরিবেশ থেকে মুক্ত করার জন্য দাদাকে সিটি কলেজে পড়তে পাঠানো হলেও পিসতুতো ভাই সেন্টু ওরফে অজয় হালদার দাদাকে কলকাতার সেই পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করাতে কার্পণ্য করলেন না । পিসেমশায় থাকতেন আহিরিটোলার শরিকি বাড়িতে, নিয়মিত সোনাগাছি যেতেন আর ধেনো মদ খেতেন। সেন্টুদার সঙ্গে পরিচয় ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের, সম্ভবত কোনো মদের জমঘটে তাঁদের প্রথম আলাপ । দাদার সঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পরিচয় হলো । দাদার চিলেকোঠার ঘরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন আর দীপক মজুমদার গাইতেন হিন্দি ফিলমের গান । সেন্টুদা আর দীপক মজুমদারের তর্কাতর্কি হতো হিন্দি ফিলমের রেহানা, কুলদীপ নায়ার, সুরাইয়া, মধুবালার যৌনতা নিয়ে । একবার তর্কে হেরে যেতে যেতে সেন্টুদা হঠাৎ দীপক মজুমদারকে বলে ওঠেন “তুমি রেহানার ওখানে হাত দিয়ে দেখেছো নাকি !”
              ও, হ্যাঁ, দাদার সম্পর্কে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল, ভুলে যাবার আগে লিখে ফেলি । বেনারসে কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে যোগ দিলে ওর বন্ধু হাংরি আন্দোলনের ছবি-আঁকিয়ে অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে আকৃষ্ট হয়েছিল । এই ঘটনাটা নেপাল থেকে আমরা ফেরার পর । নেপাল থেকে অনিল আর করুণা একটা করে ‘রেড বুক’ কিনেছিল, আমিও কিনেছিলুম । সস্তায় পাওয়া যাচ্ছিল বলে ওরা দুজনে চিনে তৈরি লাল টকটকে মাও সে তুঙ কোট কিনেছিল । আমি আর দাদা কিনিনি, আমার রঙচঙে পোশাকের অ্যালার্জি আছে, আর বিহারের জাতপাতে আক্রান্ত মার্কসবাদ দেখে দাদা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল । বেনারসে অনিলের বাঙালিটোলার স্টুডিওতে কিংবা কাঞ্চনের বাড়ির গ্যারাজের ওপরের ঘরে বেনারসের নকশালদের জমায়েত হতো । বেনারসের বাঙালিটোলার পেইনটারদের সঙ্গে অ্যালেন গিন্সবার্গ আর পিটার অরলভস্কির পরিচয় হয়েছিল ।
              একদিন একজন সাংবাদিকের কাছে ওরা জানতে পারলো যে অনিলের স্টুডিওয় পুলিসের রেইড হতে পারে আর হয়তো ওদের গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে । কলকাতায় নিয়ে যাওয়া মানেই মাঝপথে কোতল । অনিল দিল্লি পাড়ি মারলো আর  আমেরিকান বন্ধুনির সঙ্গে পালালো আমেরিকা, কাঞ্চনও আমেরিকা চলে গেল । করুণার বউ-ছেলে ছিল, ও এসে আমাদের পাটনার বাড়িতে লুকোলো । দাদার পরামর্শে করুণা চুল-দাড়ি কামিয়ে প্রায় ন্যাড়া হয়ে ধুতি-গেঞ্জিতে বিহারি সীতেশবাবু হয়ে গেল, আর দাদা করুণার জন্য একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিলেন । মাসখানেক বাদে বউ-ছেলেকে পাটনায় ডেকে পাঠালো করুণা । বছর দুয়েক পরে অনিল দিল্লি ফিরলে করুণাও চলে গেল দিল্লি ; কাঞ্চন ফিরল কলকাতায় । নকশাল আন্দোলনের দরুণ বেনারসের বিশাল বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয় কাঞ্চনকে । অনিল আশির দশকে আইরিশ শিল্পসমালোচক জুলিয়েট রেনোল্ডসকে বিয়ে করেছিল । জুলিয়েট পরে অনিলের স্টুডিওতে গিয়েছিলেন, ওর লেখাপত্র আর পেইনটিঙ রেইডের সময় নষ্ট করে দিয়েছিল পুলিস, কিছুই উদ্ধার করা যায়নি । 
              ওফ হো, আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল, এই সুযোগে বলে নিই । ১৯৬৮ সালে আমি অফিসের কাজে গিয়েছিলুম নাগপুর, সেখানে নভেম্বরের শেষে পরিচয় হল সহকর্মী সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । কয়েকদিন পরে ওকে বললুম, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আপনাদের বাড়িতে কার সঙ্গে কথা বলতে হবে । সলিলা বলেছিল, বড়ো মামার সঙ্গে । ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলুম সলিলা রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় ছিল, ড্রইংরুমে শিল্ড আর নানা মাপের কাপ । বিয়েতে ওর মত আছে দেখে দাদাকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম আর বউদিকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিলুম । পাটনায় বাবাকেও টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলুম । দাদা প্রথম ট্রেনেই চলে এলেন নাগপুর, সেসময়ে নাগপুরের প্লেন চালু হয়নি, হলেও দাদাকে চাইবাসা থেকে জামশেদপুর হয়ে কলকাতা গিয়ে নাগপুর পৌঁছোতে হতো । দাদা চক্রধরপুর থেকে সোজা পৌঁছে গিয়েছিলেন নাগপুর । সলিলার বড়োমামার সঙ্গে কথা বলে ফিরে গিয়েছিলেন । বিয়েও ঠিক হয়ে গেল ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৬৮ । দাদা তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন আর বউদি, মেয়ে হনি আর দাদার শাশুড়িকে নিয়ে চলে এলেন । বাবা-মা এলেন না কেন, তখন টের পাইনি । ভেবেছিলুম প্রেমিক হিসাবে আমার কীর্তিকলাপ সম্পর্কে ওনারা রুষ্ট বলে হয়তো আসেননি । বউদিও তড়িঘড়ি চলে এসেছিলেন একই কারণে, আমার প্রেমিকত্বর সিরিজ শেষ করার জন্য । বিয়ের পর পাটনায় যাবার বদলে দাদা টিকিট কাটলো চক্রধরপুরের । চক্রধরপুর থেকে গাড়িতে চাইবাসা । চাইবাসায় গ্যাঁদাফুলে গ্যাঁদাশয্যা, খাটও এমন যে ক্যাঁচোর-ম্যাচোর আওয়াজ হয় । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম করার অভিজ্ঞতা ছিল খাটখানার । কয়েক দিন পরে পাটনা গেলুম। গিয়ে জানতে পারলুম যে মেজ জ্যাঠামশায় মারা গেছেন আর ওনার অশৌচ চলছে । অশৌচের মধ্যেই বিয়ে করে ফিরলুম আর যেদিন লোক খাওয়ানো সেইদিনই বউভাত হলো । দাদা সব চেপে গিয়েছিলেন যাতে বিয়েটা বানচাল হয়ে না যায় । মা সেন্টুদার হাতে একটা চিরকুট পাঠিয়ে দাদাকে লিখেছিলেন, “সিঁদুর পরিয়ে আনলেই হবে।” মানে, মাও চাইছিলেন যাতে বিয়েটা ফসকে না যায় । 
              উত্তরপাড়ায় ফিরি । দাদা বি এস সি পাশ করে জার্নালিজমে ভর্তি হয়েছিলেন । বাবা ডেকে পাঠালেন পাটনায় । বাবার দোকানে আড্ডা মারতে আসতেন বিহার সরকারের মৎস্য দপতরের বিভাগীয় প্রধান মিস্টার ভর্মা । তিনি বাবাকে বলেছিলেন দাদাকে যদি ফিশারিজ ইন্সপেক্টরের চাকরিতে ভর্তি করতে চান তাহলে ডেকে পাঠাতে । দাদা পাটনায় ফিরলে চাকরিটা পেয়ে গেলেন । তাঁর নিয়োগে একটাই অসুবিধে ছিল যে তিনি বাঁচোখে দেখতে পেতেন না । মিস্টার ভর্মার সহৃদতায় ডাক্তারি পরীক্ষার সময়ে ডাক্তারই বলে দিয়েছিল কেমন করে চোখের চেকআপটা করাতে হবে । চাকরি পাবার পর দাদার পোস্টিং হল বিভিন্ন জেলা সদরে মিষ্টিজলের মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য । তারপর বিহার সরকার পাঠিয়ে দিল কোচিতে, সামুদ্রিক মাছ সম্পর্কে প্রশিক্ষণের জন্য ; এই সময়ে দাদা মাছ ধরার জাহাজে বেশ কিছুকাল আরব সাগরে কাটিয়েছিলেন ।
               ফেরার পর দাদার পোস্টিঙ হল চাইবাসায় । দাদার বন্ধু বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ভাগলপুরে দাদার সঙ্গে একই মেসে থাকতেন, তাঁর বিয়ে হল চাইবাসায় মধুটোলা নিবাসী সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মেজ মেয়ে ডলির সঙ্গে । দাদা চাইবাসাতেই চাকরি করেন জেনে মধুটোলা বাড়ির সদস্যরা বললেন, সময় কাটাবার জন্য মাঝে-মাঝে আসতে । দাদা কবিতা আর গল্প লেখেন, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জেনে ওই বাড়ির বড়ো মেয়ে মন্টি, যাঁর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, তিনি দাদার প্রতি আকর্ষিত হন । দাদা আর মন্টি নির্ণয় নেন যে দুজনে যেমন আছেন তেমনই থাকবেন, পরিবার ভেঙে বেরোবার প্রয়োজন নেই । এই ঘটনাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় “কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে বিস্তারিত লিখেছেন, সেখানে দাদার নাম শম্ভু আর শক্তির নাম পার্থ । 
              উত্তরপাড়ার চিলেকোঠায় দাদার যে বন্ধুরা আড্ডা মারতে যেতেন, তাঁরা এবার চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে আড্ডা মারতে যাওয়া আরম্ভ করলেন, প্রধানত হাটে সবুজ শালপাতায় করে হাড়িয়া খাওয়া, মহুয়ার মদ খাওয়া, যা তাঁরা সকলেই প্রথমবার চাইবাসায় খেলেন, আর আসেপাশের জঙ্গলে-ঝর্ণায় ঘুরে বেড়ানো । দাদার বাড়িতে কবি-লেখকরা প্রায়ই আসেন জানতে পেরে মধুটোলার বাড়িতেও তাঁরা খাবার আমন্ত্রণ পেতেন । দাদা নিমডি টিলার ওপরে একটা চালাঘরে একা থাকতেন বলে একাকীত্ব কাটাবার জন্য কলকাতা থেকে বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে থাকার জন্য ডেকে আনলেন । শক্তি তখন “কুয়োতলা” উপন্যাস লিখছিলেন । দাদা অফিসের কাজে বাইরে গেলে শক্তিকে মধুটোলার বাড়িতে অতিথি হিসাবে রেখে যেতেন । শক্তিকে মাসের পর মাস কলকাতায় অনুপস্হিত পেয়ে একবার সুনীল আর সন্দীপন চাইবাসায় গিয়ে দ্যাখেন নিমডির চালায় দাদা নেই, ট্যুরে গেছেন, ওনারা দুজনে মধুটোলায় গিয়ে শক্তিকে দেখে অবাক, দুজনের কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘কী রে, তুই এখানে ইস্টিশন পুঁতে ফেলেছিস !’ 
              কৃত্তিবাস পত্রিকার ২৫ তম সংকলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ‘চাইবাসা চাইবাসা’ নামে একটা ছোটো গদ্য লিখেছিলেন, বেশ ইনটারেসটিং, তুলে দিচ্ছি এখানে । “বিশ্বস্তসূত্রে এই উড়োখবর আমরা পাই যে শক্তি চাইবাসার সেন্ট্রাল জেলে রয়েছে, তছরুপের কথাই আমি শুনি । এটা শুনে, তখন আমরা ছেলেমানুষ ছিলুম বলে, আমার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের খুব মনোকষ্ট হয় । আমি ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তির দুই বন্ধু, আমরা সেদিন রাত্রেই, সম্বলপুর প্যাসেঞ্জার ধরি । এটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ । আমি নিই হাওড়ার চেনা দোকান থেকে তিনটে খালি সোডার বোতল, চাইবাসায় এক্সচেঞ্জ করার কথা ভেবে, এটা সুনীলও যুক্তিযুক্ত মনে করেছিল । সুনীল একটা ক্যাপস্টানের টিন নিয়েছিল, যা গরাদের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে ডোরাকাটা শক্তির হাতে ওর দেবার ইচ্ছে ছিল । টিনটা আমরা ট্রেনে খুলিনি । মাইরি ।”
              “চাইবাসায় গিয়ে এবারও সমীরকে পেলুম না, ট্যুরে । কিন্তু শক্তি ? পরদিন  জেলে গিয়ে খবর নিলেই হবে এরকম ভেবে, ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে টিনটা ও ওপরে তিনটে সোডার বোতল রেখে, ডাকবাংলো ছেড়ে আমরা বেরিয়ে পড়লুম নদীর দিকে, চাইবাসার শ্মশানের দিকে শীতের রাত্তিরে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলুম গান গাইতে গাইতে । মধুটোলার কাছে ফটাস করে একটা বাড়ির দরোজা খুলে গেল, ‘এতো রাত্তিরে চাইবাসায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় কে রে’, বলতে বলতে শক্তি বেরিয়ে এলো । এখানে হঠাৎই মনে পড়ল, এই মধুটোলার রাস্তাতেই, ‘সাইকেল কি সাঁতার কেউ কখনো ভোলে ভাই’, বলে তড়াক করে সাইকেলে লাফিয়ে উঠে ঐ বাড়ির পাঁচ বোন ও তিন বন্ধুর সামনে সুনীল উলটে দড়াম করে রাস্তায় পড়ে যায় । যাই হোক সেদিন রাতে, নভেলে-পড়া যায় এমন মধ্যবিত্ত প্রবাসী বাঙালির লাল টালির বাড়ির মধ্যে বসে আমরা দুজনে আধ ঘণ্টার মধ্যে বুঝতে পারি যে শক্তি জেলে নেই । ক্যাপ্সটেনের টিন খুলতে আমরা ডাকবাংলোয় ফিরে যাই । ঐ বাড়ির দুটি মেয়ে সমীরের ও শক্তির বান্ধবী ( একজন পরে সমীরের স্ত্রী ) এটা বুঝতে আমাদের দু’দিন সময় লেগে যায় । এটা বুঝে, মধুটোলায় ওরা সান্ধ্য চা-পান করতে গেলে আমি ও সুনীল তখন সোডার বোতলগুলি ( তখন ভর্তি ) একের পর এক জ্বলন্ত হ্যারিকেন লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারি । সমীরের লেপ তোশক ও মশারিতে আগুন লেগে যায় । আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে রো-রো নদীর ওপারে গিয়ে আমাদের জীবনের প্রথম আদিবাসী রমণীর কাছে জীবনের প্রথম মহুয়া খাই । তার শারীরিক সৌন্দর্য ছিল ।”
              “চাইবাসা থেকে ফিরেই আমি মায়ের কাছে কাশীতে চলে গেলুম । সম্ভবত ঐ একই ট্রেনে, ডুন এক্সপ্রেসে, সুনীলের চিঠিটাও আমার সঙ্গে যায়, কারণ হিসেবমতো ১৪/১/৬০ তারিখে আমি সেবার কাশী পৌঁছেছিলুম । যাই হোক, ঐ চাইবাসা পরে আমাদের তিনজনের লেখাতেই বেশ একটা ভূমিকা নিয়েছিল বলতে হবে । আমি সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী নামে গল্প লিখি, সুনীল যুবক যুবতীরা ও অন্যান্য । শক্তির লেখার এক অংশে চাইবাসা হাহাকারের মতো ছড়িয়ে রয়েছে।”
              “চাইবাসা থেকে অদূরে পাহাড়ের ওপর হেসাডির ডাকবাংলোয় বড়ো প্যাঁচে পড়েই কবি তথা লেখক হিসেবে আমাদের ডি এফ ও শ্রীকমলাকান্ত উপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল । প্রমাণস্বরূপ  শক্তি ওঁর সামনে একটা ছোটো কবিতা রচনা করে, যার মধ্যে ‘ছুটে কে তুলিলে শালবন বাহুবন্ধন চারিধারে’ এরকম একটা লাইন ছিল । বস্তুত ছোটো ও বড়ো দলে চাইবাসায় আমাদের একাধিকবার যেতে হয়েছিল । শক্তি বারংবার গেছে । চাইবাসায় যাওয়ার জের আমাদের পরবর্তী জীবনেও বেশ কয়েক বছর ধরে চলে । ওখানে না গেলে আমরা হয়তো এরকম হতুম না । কী হতুম ? রাজা হতুম, আবার কী । রাজা হতুম কথার কথা । এতটা প্যাঁচে পড়তুম না ।”    
              শক্তি মধুটোলার বাড়ির মেয়ে শীলার প্রেমে পড়েন এবং তাকে শোনাবার জন্য অজস্র কবিতা লেখা আরম্ভ করেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বাড়ির কিশোর সন্তুর চরিত্রটিকে নিজের কাহিনিতে ভূমিকা দিলেন, যে কাহিনিগুলোয় তিনি নিজেই কাকাবাবু । সুনীল চাইবাসাকে কেন্দ্র করে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লিখলেন “অরণ্যের দিনরাত্রি”, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখলেন “জঙ্গলের দিনরাত্রি”, শক্তিও শীলার সঙ্গে প্রেম এবং চাইবাসা-হেসাডি-বেতলায় কাটানো অভিজ্ঞতা এনেছেন ‘‘কিন্নর কিন্নরী” উপন্যাসে। 
              চাইবাসার স্মৃতি নিয়ে দাদাকে একটা চিঠি ১৯৬৮ সালে লিখেছিলেন সন্দীপন, নসট্যালজিক, বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার অনুশোচনারও যেন আভাস একচিলতে ।
    ১৬/৯ বরানগর
    ৭১ কাশীনাথ দত্ত রোড, দোতলা
    কলকাতা - ৩৬
    প্রিয় সমীর,
              অনেকদিন আগেই ঠিকানা লিখে ফেলেছিলুম, আমার মেয়ে জুলেখা টিকিটটা ছিঁড়ে নিয়েছিল । অর্থাৎ আমার মেয়ে বেঁচে আছে । ক’দিন আগে গিয়েছিলুম সুনীলের কাছে -- মদ্যপানজাত মারামারির ফলে প্রহৃত ও গুরুতর আহত হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে জেনে যাই, সন্ধের দিকে রিক্সা করে একটি ও.টি. পাঁইট এনে দুজনে খেলুম, তোমাকে নিয়ে কথা বলছি দেখলুম । সুনীল তোমাকে একটা চিঠি দিয়েছে বলল ও তোমার ঠিকানা আমি চেয়ে নিলুম । স্বাতী দিল্লিতে ।
              তোমাদের একটি ছেলে হয়েছে শুনলুম । তুমি অনেকদিন কলকাতা আসোনি । চাইবাসার কথা মনে পড়লে তোমার কথা মনে পড়ে । তুমি সৎ-ব্যবহার করেছিলে যা মনে পড়ে । রো-রো নদীর ধারে বসে শ্মশানে গল্প মনে পড়ে । নিমডির বাড়ির উঠোনে তেল মেখে হাঁড়িয়া-খাওয়া মনে পড়ে । বেলাদের বাড়ি মনে পড়ে । মধুটোলা, বাজারের দোকানে চা ও সিঙাড়া  -- কানপুরে অস্ট্রেলিয়া হেরে গেছে তোমাদের খবর দিলুম -- হেসাডিতে এসে তুমি এক রাত্তির কাটিয়ে গিয়ে আমাদের ঋণমুক্ত করে গেলে -- এসব ও অন্যান্য মনে পড়ে।
              চাইবাসা আমার মনে ইমপ্রেশান রেখে গেছে যা মোছার নয় -- তখন সরল ও ছেলেমানুষ ছিলুম । আজো তাই আছি । চাইবাসা ও তোমাকে একসঙ্গে মনে পড়ে ।
              ভেবে দ্যাখো, এ-রকম হওয়া সম্ভব, এ-রকম মনে পড়া । বয়স ৩৫ হল, আজো ৩০-দিকে গড়াচ্ছি -- ২৫এর দিকে । আমার হাংরি জেনারেশান-ফেশান মনে পড়ে না । তোমাকে ও চাইবাসাকে আজও মনে পড়ে ।
              তুমি অ্যাকসেপ্ট করো বা না করো আমার বাস্তবিক কিছু এসে যায় না । কাফে খালি হয়ে গেলেই আমার মাথাও খালি হয়ে যায় না ।
                                                                                                  শুভেচ্ছাসহ
                                                                                                     সন্দীপন
              সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই চিঠির পাশাপাশি দেবী রায়কে হাংরি বুলেটিনে ছাপার জন্য পাণ্ডুলিপি পাঠাবার সময়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৬৩ তারিখে যে চিঠি উনি লিখেছিলেন তা পড়লে পাঠক বেশি আনন্দ পাবেন বলে মনে হয় :-
    প্রিয় হারাধনবাবু,
              হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট -- এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন । 
              ছাপলে সবকটি এক সঙ্গে ছাপতে হবে --- নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে। দরকার করলে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
              অমৃত-তে আমার বইয়ের যে-বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে, দেখেছেন ! নইলে পাবলিশার-এর কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যবস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটা দেশে বেরোবার কথা আছে -- যদি বেরোয়, তার প্রুফটা কাইণ্ডলি দেখে নেবেন । আনন্দবাজারে কোনো লেখকদের বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
              সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো এক মাস থাকবো না ততদিন । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ‘ছোটোগল্পে’ আবার লেখা দিতে পারলাম না , সম্ভব হলে, ক্ষমা করবেন ।     
         
    পুনশ্চ : লেখাটা প্রকাশ করার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে খুব নরম করে সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
    *) হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, কী হল ! পাঁচ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন ।
    **) কমাগুলো ভেবে চিন্তে দিয়েছি, ওইগুলো আসল জিনিস, যেন থাকে ।
    ***) শেষের তারিখটা যেখানে আছে, সেখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
    ****) ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
    ****) আগামী সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাব । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর --- এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানানে কী ‘ন’ না ‘ণ’?
                                                                   ভালোবাসা নিন । সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি।
                                                                                          সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
              
              ১৯৬২ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও পিটার অরলভস্কিও গিয়েছিলেন চাইবাসায় দাদার নিমডির কুঁড়েঘরে, ছিলেন দিনকয়েক । ওনারা গিয়েছিলেন চাইবাসায় উপজাতিদের তৈরি হাড়িয়া আর মহুয়া মদের কথা শুনে । দাদা ওনাদের তালশাঁস আর জাম খাইয়েছিলেন । ওনারা ওগুলোকেই ভেবেছিলেন মাদক । জাম খেয়ে জিভ বেগুনি হয়ে গিয়েছিল বলে আশঙ্কিত ছিলেন । পরে সন্ধ্যায় ওনাদের নিয়ে হাটে গিয়ে হাড়িয়া খাওয়ান দাদা আর দাদার ড্রাইভার গুলাব সিংকে দিয়ে সদ্য চোলাইকরা গরম-গরম মহুয়ার মদ আনিয়ে খাওয়ান । গিন্সবার্গ পাটনায় আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন এপ্রিল ১৯৬৩ সালে ।
              ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী ডেবোরা বেকার অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারতে থাকা নিয়ে একটা বই লিখেছেন “দি ব্লু হ্যাণ্ড” নামে ; সেই বইতে তিনি হাংরি আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছেন অথচ তিনি কোনো হাংরি আন্দোলনকারীর সঙ্গে দেখা করেননি, তাঁর বইতে তিনি ব্লার্বে লিখেছেন যে বাংলা জানেন অথচ ইনডেক্স দেখলেই টের পাওয়া যায় যে বাংলার একটিও বই-পত্রিকা-বুলেটিন তিনি পড়েননি, তিনি কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গুলগল্প লিখেছেন । বলাবাহুল্য যে হাংরি আন্দোলনকে বিদেশি পাঠকের কাছে ফালতু প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন । গিন্সবার্গের সঙ্গে যে হাংরি আন্দোলনকারীদের পরিচয় হয়েছিল, তাদের সঙ্গে দেখা করেননি বা তাদের উল্লেখ করেননি । সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে হাংরি আন্দোলনের পৃথক সংগ্রহ দেখারও আগ্রহ হয়নি ডেবোরা বেকারের । দাদা সেসময়ে কলকাতাতেই ছিলেন, দেখা করেননি কেন তা এক রহস্য । অথচ ইতালির গবেষক ড্যানিয়েলা লিমোনেলা কলকাতায় এসে দাদার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, সন্দীপ দত্তের লাইব্রেরি থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন । বিবিসির ডোমিনিক বার্নও দাদার সাক্ষাৎকার নিয়ে গিয়ে প্রচার করেছেন । ডোমিনিককে দাদা বলেছিলেন “আমি এক হাজার বছর বাঁচবো”। 
              দাদা মধুটোলার বাড়ির সেজ মেয়ে বেলাকে বিয়ে করেন । বরযাত্রী হিসাবে কলকাতা থেকে এসেছিলেন উত্তরপাড়ার চিলেকোঠার কবি-বন্ধুরা । বিয়ের পর দাদা নিমডি টিলার চালাঘর ছেড়ে রোরো নদীর ধারে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলেন । সেই বাড়িতে সন্তোষকুমার ঘোষ  এবং আরও অনেকে গিয়েছিলেন । কলকাতার কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এক্সকারশানে যাবার আগে দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আর দাদা তাদের থাকার ব্যবস্হা করতেন । হাড়িয়া আর মহুয়ার মদের কথা শুনে অচেনা তরুণ কবি-লেখকরাও পৌঁছে যেতেন । 
              একদিন পাটনায় আমি অফিস যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলুম, বাবা ডেকে পাঠিয়ে বললেন, মিনু একটা মেয়েকে বিয়ে করবে বলছে, তুই দেখেছিস ? আমি মধুটোলার বাড়িতে বারকয়েক গেলেও কাউকে তেমন লক্ষ্য করিনি ; মা মধুটোলার বাড়ি গিয়েছিলেন, বললেন যে উনি মেয়েটিকে দেখেছেন, ভালো সেলাই-ফোঁড়াই, রান্নাবান্নার কাজ জানে । দাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা-মা’র সামনে, আমাকে বললেন, চারপাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে নে । বরযাত্রীদের জন্য সেনটোলায় একটা বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্হা হয়েছিল। বিয়ের পর দাদার বন্ধুদের আমরা জিপে করে জামশেদপুর স্টেশান পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলুম, তখনও ওনারা সিল্কের পাঞ্জাবি আর জমকালো ধুতিতে  ।
              হাংরি আন্দোলনে সবাইকে জেরা করেছিল ইন্সপেক্টার অনিল ব্যানার্জি, নকশাল আন্দোলনের সময়ে যাঁর বেশ নামডাক হয়েছিল, কিন্তু দাদাকে আর আমাকে জেরা করে একটা ইনভেসটিগেটিং বোর্ড । পুলিশ কমিশনার পি সি সেনের ঘরে কমিশনার ছাড়াও উপস্হিত ছিলেন ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার দেবী রায়, যাঁর ধারণা ছিল হারাধন ধাড়া তাঁকে অপমান করার জন্যই  দেবী রায় ছদ্মনাম নিয়েছেন, আর ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিগাল রিমেমব্রানসার, চব্বিশ পরগণার ডিসট্রিক্ট ম্যাজিসট্রেট, স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক, ফোর্ট উইলিয়ামের মিলিটারি অফিসার । বোঝা যাচ্ছিল যে আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে বিশেষ করে অভিযোগ এনেছেন কলকাতার তদানীন্তন এলিটরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য আবু সয়ীদ আইয়ুব, সন্তোষকুমার ঘোষ এবং সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র মালিক । স্বরাষ্ট্র দপতরের আধিকারিক বোধহয় জানতেন না যে হাংরি বুলেটিন বেরোয় ফালি কাগজে, তাই জিগ্যেস করেছিলেন, “আন্দোলন চালাবার জন্য কোথা থেকে টাকা পান?” ফালি কাগজ কিনতে আর ছাপাতে পঞ্চাশ টাকা লাগে শুনে পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন “আপনারা সাহিত্য করছেন না দাঁতের মাজন বিক্রি করছেন ।”
              হাংরি আন্দোলনে বন্ধুদের গোলমেলে ভূমিকার পর দাদা তাঁদের সঙ্গে সাহিত্যিক যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছিলেন । তাঁর লেখালিখির প্রথম পর্ব বলতে গেলে মামলার পর শেষ হয়ে যায় । পড়াশুনায় একাগ্র হন, পাটনা থেকে ইংরেজি বইপত্র নিয়ে যেতেন । বন্ধুরা কিন্তু কলকাতা থেকে পালাবার জন্য দাদার পোস্টিঙের জায়গাগুলোয় যেতেন, মজফফরপুর, দ্বারভাঙ্গা, ধানবাদ, দুমকা, ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি জায়গায় । আমি ডেভিড গারসিয়া নামে একজন হিপি ও সুবো আচার্য আর সুবিমল বসাককে দুমকায় নিয়ে গিয়েছিলুম । দুমকার বিশাল বিহারি টাইপ বাড়িতে পায়খানা ছিল বেশ দূরে, আর পোশাক খুলে টাঁঙাতে হতো সামনের একটা কাঁঠাল গাছের ঝুলন্ত এঁচোড়ে, পায়খানায় দরোজা ছিল না, গাছটা আড়ালের কাজ করতো । তরুণরা যাতে তাঁর বাসায় দলবেঁধে যায়, দাদা একবার বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। তাঁর লেখালিখির দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয় অবসরের পর কলকাতায় নিজের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে পাকাপাকি থাকতে এসে,  যখন ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করলেন ।
               “কালিমাটি “ পত্রিকার ( ৯৩ নং )  জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে দাদাকে প্রশ্ন করেছিলুম, “তোমার কলেজজীবনের সময় থেকে দীপক মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, বিমল রায়চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ পাটনা, উত্তরপাড়া, চাইবাসা, ধানবাদ, ভাগলপুর, দ্বারভাঙ্গা, মজফফরপুর, দুমকা ডালটনগঞ্জ ইত্যাদি বাসায় নিয়মিত যেতেন । তাঁদের স্মৃতিচারণামূলক লেখায় তোমার উপস্হিতির অভাব দেখা যায় । তা কি তুমি দীর্ঘ দিন বাইরে ছিলে বলে ? নাকি হাংরি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলে বলে ? অথবা তোমার ট্রাইবাল ইন্সটিংক্ট নেই বলে ?”
              উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “স্মৃতিচারণায় না থাকা স্বাভাবিক, কেননা অনেক তথ্য ও সত্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে, নানা ধরণের পার্থিব ভীতি তাঁদের মনে কাজ করে, হিসেব করে লেখেন, বাদ দেওয়াকেই সহজ উপায় বলে মনে করেন । আবার হয়তো দীর্ঘ দিন বাইরে থেকেছি, কলকাতার কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারিনি । হাংরি আন্দোলন বা অধুনান্তিক চিন্তাভাবনা বা কোনো নতুন ধারণা আধুনিকতামনস্ক বন্ধুদের কাছে একটি বিশাল অন্তরায় । তাছাড়া, তাঁরা অনুগামী গড়ে তুলতে অধিক মনোযোগী । তাঁদের বেশিরভাগকে আবিষ্কারকের ভূমিকায় দেখি না, সংযোজনমনস্ক নয় ।”
              লেখক-কবির কাজ সম্পর্কে দাদা বলেছিলেন, “চিন্তার মাধ্যমে ভাব ও ভাষার সামঞ্জস্য গড়া, প্রকাশময়তার সম্প্রসারণ ও ব্যাপ্তি ঘটানো, যার ফলে পূর্ব অবস্হান থেকে ভাষা আরও সমৃদ্ধ হয়ে নবাঞ্চলের সংযোজন করে নতুন প্রজন্মের ভাষা হয়ে উঠবে, সম্প্রসারণ মানেই তো অতিক্রম, আর কবি ও লেখকের প্রধান দায়বদ্ধতা ভাষার প্রতি, কেননা ভাষাকে উত্তরোত্তর সমাজের আরও যোগ্য করে তোলা । ভাষা বদলে গেলে সামাজিক প্রক্রিয়া স্বতঃপ্রভাবিত হয় । উনিশ শতকে যেভাবে প্রভাবিত হতো আজ আর সেভাবে সম্ভব নয় । বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখেরা নিজেদের লেখালিখির মাধ্যমে আইনকানুনকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, আজ যেমন অরুন্ধতী রায়কে দেখা যায় মেধা পাটকরের সঙ্গে আন্দোলন করছেন, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা হ্রাস এবং সংলগ্ন জনবসতিগুলোর পুনর্বাসন সম্পর্কে, তাঁদের আন্দোলনের ফলে সমাজ রাষ্ট্র প্রভাবিত হয়েছে, আন্দোলন অনেকটা সফলতা পেয়েছে । মুশকিল এই যে, আজ রাষ্ট্র স্বয়ং প্রতিবাদীর ভূমিকা নেয় । যার ফলে কবি-লেখকের প্রতিবাদী ভূমিকাকে হজম করে নেয় বা বানচাল রাখে । ইনটারনেট আর ব্লগ ব্যবহার আজ অন্যতম উপায়, এবং কবি-লেখকরা আজ ঠিক তাই করছেন । আরেকটা কথা, বাংলা ভাষা ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা, প্রত্যেক শব্দের একাধিক অর্থ । কেননা, ব্যক্তি, দাম্পত্য, সমূহ সবই সেই অর্থময়তার পরিসরে অন্তর্ভুক্ত, যেকারণে শব্দগুলির অর্থময়তার বীজমন্ত্রে যথেচ্ছ সম্প্রসারণের খোলা-সম্ভাবনা । মনুষ্যসমাজ বা মানবপ্রজাতি টিকে আছে তার চিন্তাচেতনার ও ভাষার উত্তরোত্তর সম্প্রসারণের মাধ্যমে ।”
              দাদার লেখায় পরিসরের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করেছিলেন অরবিন্দ প্রধান তাঁর “পরিসরের ভিন্ন মন্তাজ : সমীর রায়চৌধুরীর ছোটোগল্প” ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রবন্ধে । পরিসরের গুরুত্বের কারণেই হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা দেখা দিয়েছিল । দাদা দেখিয়ে ছিলেন যে এটি একটি দার্শনিক প্রতর্ক । কৃত্তিবাস ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান কতৃক ইতিহাসকে একরৈখিক অনুমান করার জন্য গলদটা গড়ে উঠেছিল । ভুলটা ঘটেছিল স্পেস বা ভাবনা পরিসরকে গুরুত্বহীন মনে করে, টাইম বা ঘটনার অনুক্রমকে অতিগুরুত্বপূর্ণ মনে করার ফলে । সময়কে একটিমাত্র রেখা বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন তাঁর ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যান্য দিকে চলে গেছে, বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যালে । ফলে জসীমউদ্দিন বাদ যান, নজরুল বাদ যান । মাইলফলক কেবল একটা রাস্তাতেই থাকে না । সব রাস্তাতেই থাকে । তাবৎ মাইলফলক বরাবর একটা রেখা টানা যায় না । শ্রীরামপুরের প্রটেস্ট্যান্ট ইংরেজরা  একটিমাত্র রেখা বরাবর লাইনগুলোকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিল, যার ফলে বহু মাইলফলক বাদ যেতো । দাদা এটা প্রমাণ করার জন্য প্রথমে ইংরেজিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “পোস্টমডার্ন বাংলা পোয়েট্রি” ও “পোস্টমডার্ন বাংলা শর্ট স্টোরিজ” এবং হিন্দিতে সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন “অধুনান্তিক বাংলা কবিতা”, যে সংকলনগুলোয় সেই মাইলফলকগুলোকে তিনি পুঁতলেন যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক একরৈখিক পথের বাইরের । 
             দাদার কাছ থেকে আমরা জানলুম যে ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ডিসকোর্সটি ঔপনিবেশিক নন্দনবাস্তবতা বা কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি দ্বারা তাড়িত বলে তা টাইম কেন্দ্রিক । কিন্তু হাংরি আন্দোলনের ডিসকোর্সটি স্পেস বা স্হান বা পরিসরলব্ধ, কেননা তা উত্তরঔপনিবেশিক টানাপোড়েন উপজাত । ‘কৃত্তিবাস’ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কাউন্টার ডিসকোর্সরূপে উদ্ভূত হয়েছিল উত্তরঔপনিবেশিক পরিসরের হাংরি আন্দোলন, যে আন্দোলনটি আরম্ভ করার প্রধান উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন দাদা । ইউরোপীয় ভাবনার ধারকবাহক হিসাবে যে নতুন ধরণের দার্শনিকতা জন্মেছিল, তাঁরা নিজেরা ছিলেন স্হানিক বা ভূমিক পরিসর থেকে উৎপাটিত ; এই যে পরিসরহীনতা, এটা একরৈখিক দর্শনে জরুরি ছিল । দাদা বললেন ,হাংরি আন্দোলনের আনা পরিবর্তন-প্রয়াস হল চিন্তাতন্ত্রের, সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র থেকে পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার । ইংরেজরা আসার আগে প্রাকঔপনিবেশিক ভাবনা-পরিসরটি ছিল বিশেষ-বিশেষ মনন-প্রবৃত্তির এলাকা । দাদার বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিচলিত হয়েছিলেন, এবং তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় লেখা ১৯৬৬ সালের তাঁর এই সম্পাদকীয়তে, তখনও হাংরি মকদ্দমা আদালতে চলছে এবং কেস সাবজুডিস :
              “অনেকেই প্রশ্ন করছেন বলে আমরা লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য হলুম যে হাংরি জেনারেশান নামে কোনো প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের সঙ্গে কৃত্তিবাস সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্কিত । ঐ প্রকার কোনো আন্দোলনে আমরা বিশ্বাস করি না । কৃত্তিবাসের নামও যুক্ত করতে চাইনি কখনো । ‘হাংরি’ নামে অভিহিত কোনো-কোনো কবি কৃত্তিবাসে লেখেন, বা ভবিষ্যতে অনেকে লিখবেন, কিন্তু অন্যান্য কবিদের মতোই ব্যক্তিগতভাবে, কোনো দলের মুখপাত্র হিসেবে নয় । সংঘবদ্ধ সাহিত্যে আমরা আস্হাশীল নই । পরন্তু বাংলাদেশের যেকোনো কবির প্রতিই কৃত্তিবাসের আহ্বান । হাংরি জেনারেশানের আন্দোলন ভালো কি খারাপ আমরা জানি না । ঐ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ বা পরিনাম সম্পর্কে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই । এ-পর্যন্ত ওদের প্রচারিত লিফলেটগুলিতে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি চোখে পড়েনি । নতুনত্ব প্রয়াসী সাধারণ রচনা । কিছু-কিছু হাস্যকর বালক ব্যবহারও দেখা গেছে । এছাড়া সাহিত্য-সম্পর্কহীন কয়েকটি ক্রিয়াকলাপ বিরক্তি উৎপাদন করে । পিজিন ইংরেজিতে সাহিত্য করার লোভ উনিশশো ষাট সালের পরও বাংলাদেশের একদল যুবক দেখাবেন --- আমাদের কাছে তা কল্পনাতীত ছিল। তবে ঐ আন্দোলন যদি কোনোদিন কোনো নতুন সাহিত্যরূপ দেখাতে পারে -- আমরা অবশ্যই খুশো হবো ।”
              মনে রাখা দরকার যে হাংরি আন্দোলনে দাদাও চাইবাসা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, আর এই মামলা চলাকালীন সম্পাদকীয়টি লিখছেন দাদার সেই বন্ধু যাঁর “একা এবং কয়েকজন” কাব্যগ্রন্হটি দাদা নিজের টাকায় “সাহিত্য প্রকাশক” নামে একটা সংস্হা খুলে ছাপিয়েছিলেন । সুনীল কেন এই সম্পাদকীয়টি লিখেছিলেন, দাদা গ্রেপ্তার হওয়া সত্বেও তা এখন কিছুটা আঁচ করা যায় । দৈনিক পত্রিকায় চাকুরি ও লেখা প্রকাশ ছাড়াও, মনে হয়, পুলিশের চাপ ছিল । শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় “নতুন কৃত্তিবাস” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন। আমার চার্জশিটের সঙ্গে সেই মুচলেকাগুলোর কপি পুলিশ দেয়নি বলে ঠিক জানি না, পুলিশ আমায় কেবল শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষের মুচলেকার কপি দিয়েছিল, সম্ভবত তারা মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিল বলে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অ্যালেন গিন্সবার্গকে লিখেছিলেন যে মোট ছাব্বিশজনকে পুলিশ জেরা করেছিল, অর্থাৎ হাংরি বুলেটিনে যাদের নাম ছিল তাদের তো জেরা করা হয়েই ছিল, দাদার সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব ছিল তাদেরও জেরা করা হয়েছিল, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও । উৎপলকুমার বসুকে লেকচারারের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলে অ্যালেন গিন্সবার্গের সৌজন্যে তিনি লণ্ডনে একটি স্কুলে পড়াবার চাকরি পান ।          
              ২ অক্টোবর ২০১৫ ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত, আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা অ্যালেন গিন্সবার্গের  চিঠি দুটি থেকে ব্যাপারটা কিছুটা স্পষ্ট হবে :
    প্রথম চিঠি:-
    ৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, অ্যাপট ৫এ, নিউ ইয়র্ক
    অক্টোবর ৬, ১৯৬৪
    প্রিয় আবু সয়ীদ,
              আপনার কাছে পাঠানো আমার চিঠিটি নিতান্তই বোকার মতো উদ্ধত এবং বুদ্ধিহীন হয়ে গিয়েছে এবং আমি দুঃখিত যে, সেটি আপনাকে রীতিমতো ক্ষুব্ধ করেছে । আমার লেখায় যে বিরক্তিকর অসম্মান প্রদর্শন এবং ধৃষ্টতা ফুটে উঠেছে তার জন্য আমার চুপ করে থাকাই শোভন, যেমন আপনার কী করা উচিত নয়, এসব ব্যাপারে অযথা নাক গলিয়েছিলাম, হয়তো লেখার গুণগত মান না বুঝেই । এবং এক অগ্রজকে বকাঝকা করা । আমি ক্ষমাপ্রার্থী, সেই সঙ্গে অজুহাত হিসাবে এটাও জুড়ে দিই যে, আমি অত্যন্ত দ্রুত লিখছিলাম -- একই বিষয়ে, একই দুপুরে অনেকগুলো চিঠি --- এবং অবস্হাটি আমি যেমনটা বুঝতে পারছি, আপনি যেমন ভাবছেন, অল্পববসী লেখকদের কাছে সেটি আর-একটু বেশি আশঙ্কাজনক । সম্ভবত আমার লেখার পর, এতদিনে অবস্হাটি অনেক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে । কিন্তু আমি মলয়, এমনকি সুনীল গাঙ্গুলি এবং উৎপল বসুর ( শেষোক্ত দুই ব্যক্তির মনে হয় বিচক্ষণতা বেশি ) চিঠি থেকে যা বুঝতে পারছি, মলয় মানুষ হিসাবে আমার পছন্দের এবং ওর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে --- আমার মতে যেকোনো ভারতীয় ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত । যদিও আমি এটা বুঝেছি যে ছেলেটি অনভিজ্ঞ, আবেগপ্রবণ এবং ওঁর ম্যানিফেস্টোগুলির ছেলেমানুষি, কিংবা বলা ভাল, সারল্যের মধ্যেই তার আবেদন 
    ( আসলে ব্যাপারটি নিছকই পছন্দ, রুচি বা ধারণার ওপর নির্ভরশীল, এবং নিশ্চিতভাবেই এমনতর সাহিত্যসংক্রান্ত ঘটনা নয় যার মীমাংসা করতে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে ); পুলিশের কাণ্ডকারখানা এমনই যে কেবল মলয়ই নন, তাঁর ভাই সমীর ( তরুণ দার্শনিক ) দেবী রায় এবং আরও দুই যুবক, যাঁদের সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, শৈলেশ্বর এবং সুভাষ ঘোষ, এঁরা প্রত্যেকেই গ্রেপতার হয়েছিলেন । তারপর জামিনে ছাড়া পান । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিসের তদন্ত, উৎপলের বয়ান অনুযায়ী, “যাঁদের গ্রেপতার করা হয়েছিল তাঁদের এর মধ্যেই চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং দোষ প্রমাণিত হলে সেটি তাঁরা খোয়াতেও পারেন ।” আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে এই “অশ্লীল সাহিত্যের ষড়যন্ত্র” ব্যাপারটায় ইন্ধন যুগিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, জনতা ও অন্যান্য বাংলা সংবাদপত্রগুলি । পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের আদালতের নির্দেশমতে ‘লেডি চ্যাটার্লি’ অশ্লীল আখ্যা পাওয়ায়, আমার সংগ্রহে রাখা টাইমস অফ ইনডিয়ার একটি খবরে জানানো হয়েছে, ‘অনেক বাঙালি কবি ও ঔপন্যাসিকের রচনার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনতে বহু মানুষ এগিয়ে এসেছে।’ বসু লিখেছেন, ‘একটি চাকরি খোয়ালে আর-একটি জোটানো অসম্ভব।’ গ্রেপতার হওয়া পাঁচজনকে আটক রাখা হয়েছিল প্রায় দু’দিন । উৎপল বসুকে আটক করে পাঁচ ঘণ্টা জেরা করে পুলিশ । আমি বুঝতে পারছি, সুনীলকেও পুলিশ জেরা করেছে । যতদূর জানি, পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে কিনা, সেটি এখনও স্হির করা হয়নি এবং সেই সিদ্ধান্ত অনেকখানি নির্ভর করবে এই তরুণ লেখকরা অগ্রজ এবং প্রতিষ্ঠিত লেখক, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম) এর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে সমর্থন পাবেন কিনা, তার ওপর । আমি অবশ্য প্রত্যেকের কাছেই শুনেছি, কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এ-ব্যাপারে একেবারেই মুখ খোলেনি । এই লেখকদের রচনার গুণগত মান কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, আপনার চিঠি থেকে যা প্রকাশিত হয়, তার চেয়ে আদত পরিস্হিতিটি কিন্তু আরও অনেক ভয়াবহ । ভারতে পুলিশি তদন্তের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার -- তার অন্তহীনতা ও কাফকিয়ান নির্মমতা -- যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে, তাতে ব্যাপারটিকে আপনার মতো হালকা চালে আমি কিছুতেই দেখতে পারছি না । আপনার হয়তো মনে আছে, বেনারসে মাসের পর মাস আমায় লোক অনুসরণ করেছে, পুলিশ এসেছে, মার্কসবাদীরা হুমকি দিয়েছে, দশ দিনের মধ্যে ভারত ছাড়ো নোটিস এসেছে, অশ্লীল সাহিত্য বিলি করা ও তরুণদের নষ্ট করার ভিত্তিহীন অভিযোগে । দিল্লির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের বন্ধুদের মধ্যস্হতায় এবং ভারতীয় কনস্যুলেট থেকে নিউ ইয়র্কে পাঠানো চিঠির সাহায্যে সব সামাল দেয়া গিয়েছিল । সাহিত্যক্ষেত্রেও একবার এহেন সাংঘাতিক আইনি ব্যবস্হা চালু হয়ে যাওয়ার পরও তা দ্রুত খারিজ হয়ে যাবে, এমন আত্মবিশ্বাস আমার নেই, বিশেষ করে যেখানে তরুণ অরাজনৈতিক অনভিজ্ঞ উৎসাহীরা জড়িয়ে । ‘Fuck the Bastards of Gangshalik School of Poetry’ -র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারে সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না । কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা -- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও । সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমায়েসি, বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই । আমি সত্যিই তেমন শকড হইনি, যখন ওনারা বলেছিলেন, জনসমক্ষে একজন মহিলা তাঁর স্তন অনাবৃত করে দিক । আপনার সত্যিই ব্যাপারটি আপত্তিকর মনে হয় ? বড়োজোর এটা আইনবিরুদ্ধ, এই পর্যন্ত । অনেকের কাছেই শুনেছি, গতবছর এডিনবরা ফেস্টিভালের উজ্জ্বলতম মুহূর্তটি ছিল ব্যালকনিতে এক সম্পূর্ণ নগ্ন মহিলার উপস্হিতি -- আমি অবশ্যই ব্যাপারটা সমর্থন করি। তবে আমি নিজে বিশ্বের অপরপ্রান্ত থেকে এটি ‘প্রোমোট’ করতে আসিনি । আর আমার এটাও মনে হয় না যে, এই ধরণের ডাডামার্কা কাজকর্মের নেপথ্যের গভীরতম প্রেরণাটি কেবলমাত্র সস্তা আত্মপ্রচার । সেকারণেই আমার মনে হয়, এঁদের প্রতি আপনি সত্যিই অবিচার করছেন, এঁদের সাহিত্যকৃতিকে আপনি যতোই নিচু নজরে দেখুন না কেন । কারণ সাহিত্যগত মান নিয়ে নানাবিধ মতামত থাকবেই । মলয়, সুনীল বা বসুকে ফারলিংঘেট্টি চেনেনও না, কিন্তু ‘সিটি লাইটস জার্নাল’-এ ওনাদের অনুবাদ প্রকাশ করছেন । এশিয়া সোসায়টির শ্রীমতী বনি ক্রাউন টেক্সট যোগাড় করে দিয়েছেন । যতো অনুবাদ তিনি সংগ্রহ করেছেন, এই লেখাগুলিও তাঁর কাছে ততটাই কৌতূহলোদ্দীপক মনে হয়েছে । এখানে KULCHUR পত্রিকাটিও -- আভাঁগার্দ কাগজ হিসেবে যার বেশ নামডাক -- তাতে আলোচ্য তিনটি ম্যানিফেস্টো ( গদ্য, পদ্য এবং রাজনীতি বিষয়ক ) চলতি বছরের গোড়ায় পুনর্মুদ্রণ করেছিল । এব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও প্রয়োজন হয়নি ।
              “অনুবাদ পড়ে আমি এটুকু অন্তত বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, তাঁদের কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক । সুতরাং অন্য গোলার্ধের বাসিন্দা হয়েও এবং সাহিত্যের সঙ্গে আপনার অন্তরঙ্গতা স্বীকার করেও, আমি কবি এবং সমালোচক হিসেবে ( যেহেতু আমি এখানে কেরুয়াক, বারোজ, আর্তো, এবং মার্কিন কবিদের বিভিন্ন ধারার অপ্রকাশিত লেখার সম্পাদক এবং এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছি ) আমার মতামত প্রকাশ করবই, আমার নিজের বিশ্বাসে স্হির থাকার জন্য, এবং আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনই ধ্রুপদী ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের ‘বিটনিক’ আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি মার্কিন ধারণা অনুযায়ী ‘বিটনিক’দের সঙ্গেও এটি খাপ খায় না ।
              “আর কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্পর্কে আমার কিছু ভীতি আছে, যেমন ১) সংস্হাটি সম্ভবত মার্কিন সরকারের সঙ্গে যুক্ত ফাউণ্ডেশান ফাণ্ডগুলির সাহায্য পায় ; ২) আয়রন কার্টেন অন্তর্গত শাসনব্যবস্হার চেয়ে পশ্চিমী দুনিয়ার দমননীতির বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কে এরা কম সতর্ক । আমেরিকায় সারা বছর ধরে নাট্যশিল্প, বই, চলচ্চিত্র, কবিতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে আইনি যুদ্ধ চলে, যার ফলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আভাঁগার্দ চিন্তাভাবনা প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছে । মার্কিন কমিটির মাথা মিস্টার এ. রাইখম্যান-এর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম । তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকায় কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কোনো অস্তিত্বই নেই, নিতান্তই কঙ্কালটুকু পড়ে আছে । আর এই বছর আমায় নিউ ইয়র্ক থেকে জন হান্টের যোগাযোগ করতে হয় প্যারিসের অলিম্পয়া প্রেসকে বাঁচানোর জন্য । গাফিলতি কিন্তু আছেই । আপনি যতখানি মঞ্জুর করবেন, তার চেয়ে আমার সমালোচনা খানিক বেশিই হয়ে গেল । বেশ -- নিষ্পাপ বিবেক --- অ্যালেন ।
              “পুনশ্চ: আপনি সত্যিই একথা জোর দিয়ে বলছেন যে ম্যানিফেস্টোকে সাহিত্য বলা যাবে না এবং সেকারণেই ঘটনাটি সাহিত্যে দমননীতির উদাহরণ নয় ? সত্যি ???????????????
              “আমি প্যারিসে অফিস এবং মিস্টার কারনিক দুজায়গাতেই চিঠি লিখব । আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আছে, রাশিয়ানরা ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো, ভজনেসেন্সকিদের তৃতীয় শ্রেণির শিল্পী হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছিল, যাদের কোনো সরকারি গুরুত্ব পাওয়ার প্রয়োজন নেই । এবং মার্কিন পুলিস এজেন্সিগুলির কাছ থেকে এই একই কথা আমাদের সম্পর্কেও শুনেছি ।”
    দ্বিতীয় চিঠি:-
    ৭০৪ ইস্ট ফিফথ স্ট্রিট, এন ওয়াই সি-৯, অ্যাপ্ট-৫এ
    ১৩ অক্টোবর ১৯৬৪
    প্রিয় আবু সয়ীদ,
              “জঘন্য ! আপনার বাগাড়ম্বর আমায় বিভ্রান্ত করে তুলেছে, মাথা গরম করে দিচ্ছে আমার । আপনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন, ‘আমার কোনও পদমর্যাদা নেই’, এসব কথার মানে কী? ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডামের উদ্যোগে চলা চতুর্মাসিক পত্রিকার সম্পাদক আপনি । আপনার নিজস্ব লেটারহেড রয়েছে । কমিটির ভারতীয় এক্সিকিউটিভদের তালিকা আপনার হাতের কাছেই আছে, ভারতে কমিটির ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কেও আপনি ওয়াকিবহাল । চিনের ভারত আক্রমণের সময় আমি কলকাতায় একটি বড়সড় সমাবেশে উপস্হিত ছিলাম, সেখানে আপনার সহসম্পাদক মিস্টার ( অম্লান ) দত্ত সাংস্কৃতিক বর্বরতা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছিলেন। যা হোক, মিস্টার বি. ভি. কার্নিককে আমি চিঠি লিখেছিলাম, যদিও আমার মনে হচ্ছিল যে, কলকাতা কমিটির কোনও সদস্য বা কমিটির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই কাজটি করা দরকার ছিল । আর বাগাড়ম্বর বলতে আমি বোঝাতে চাইছি ‘আপত্তিকর উপাদান’-এর কথা । মহাশয়, আপনি ও পুলিশই সেগুলিকে আপত্তিকর বলছেন । সেগুলি নিছক আপত্তিকর তকমা পাওয়া উপাদান মাত্র, প্রকৃত আপত্তিকর নয় । পরের দিকে যে বলেছেন ‘প্রশ্নাতীত আপত্তিকর’, তাও নয় । আমি আপনাদের আপত্তি তোলা নিয়েই প্রশ্ন করছি, তাই তা এতোটুকুও ‘প্রশ্নাতীত’ নয় । আসলে পুরোটাই হলো রুচি, মতামত ইত্যাদির ব্যাপার । পুলিশ তাদের নিজেদের ও অন্যদের রক্ষণশীল সাহিত্যরুচি চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে । আমার মতে এটি কালচারাল ফ্রিডাম বা সাংস্কৃতিক স্বাধীনতারই বিষয় । আশা করছি, এ-বিষয়ে ইন্ডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম, বিশেষ করে সেটির কলকাতা শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা-ও একমত হবেন । আমার আরও অদ্ভুত লাগে জেনে যে, এক্ষেত্রে কারওকে সাহায্য করা মানে নবীন লেখকদের বলা, তাদের মতাদর্শ থেকে পিছু হটতে, নিজেদের অবস্হান পালটাতে, ইত্যাদি । ব্রডস্কি, ইয়েভতুশেঙ্কো প্রমুখের ক্ষেত্রে যেরকম করা হয়েছিল, সেরকমই একেবারে । এমনকী, তারা যে ‘ফালতু’ লেখক, সেটাও । আমি আপনাকে ফের রাগাতে চাই না । আপনি ক্ষুব্ধ হন এমনকিছু বলছি না । কিন্তু একটি কথা বলতেই হবে যে, বর্তমান ইশ্যু নিয়ে আমার-আপনার চিঠি আদান-প্রদান আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে ওই নবীন রুশ কবিরা কেন আপত্তিকর বা ‘ফালতু’, তা নিয়ে আমার সঙ্গে রুশ আমলাদের কথোপকথন । ‘দায়িত্বহীন, ‘নিম্ন মানের লেখা’, ‘নিম্ন রুচি’। ব্রডস্কির মামলার সময়ে, আপনার মনে থাকতে পারে, বিচারক প্রায় সারাক্ষণ ব্রডস্কিকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘কোন প্রতিষ্ঠিত লেখক কবে আপনার মর্ম স্বীকার করেছে।’ বেচারা মলয় --- যদি ও একজন নিম্ন মানের লেখকও হয় --- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সম্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম ।
              “ওরা সকলেই সম্পূর্ণ বুদ্ধিহীন, জ্যোতি ( দত্ত ) যদি একথায় আপনার সহমত হয়, তাহলে ও আপনার আত্মগরিমা তুষ্ট করার জন্য সাধুতার ভান করেছে । দলের সবাই, ছাব্বিশজন যাদের জেরা করা হয়, সুনীল উৎপল বসু, সন্দীপন, তারাপদ তো আছেই, এরা ছাড়া অন্য যারা গ্রেপতার হয় সেই সব মধ্যমানের লেখকরা -- যদিও মলয়ের নির্যাতনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের সপসপে মনোভাব দেখে মলয়ের অনভিজ্ঞতার প্রতি আমার মমত্ব জাগছে -- এরা সবাই ফালতু এরকম দাবি করা আপনার পক্ষে বা জ্যোতির পক্ষে অসম্ভব । কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ও হাংরি আন্দোলনের সদস্যদের -- এই মামলায় যারা সকলেই পুলিশের দ্বারা হেনস্হা হয়েছে --- সমর্থন করেন, এমন কোনও বাঙালি লেখক বা সমালোচককে যদি আপনি না চেনেন, তাহলে আপনার মতামত সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে । নিজেকে একদম আলাদা রেখেও বুদ্ধদেব বসু তাদের গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেমন দিয়েছেন বিষ্ণু দে ও সমর সেন । আমি শুধু মলয় নয়, সমস্ত সদস্যদের কথা বলছি ।
              “এর পাশাপাশি আপনার আর একটি বিরক্তিকর বক্তব্যে আমি স্তম্ভিত, যে পশ্চিমের দমননীতির বিরুদ্ধেও কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম)কে  একইরকম ভূমিকা নিতে হবে । আপনি বলেছেন, ‘আমি পর্তুগাল, স্পেন ও পাকিস্তানের কথা ভাবছিলাম’। এখনও পর্যন্ত আমার শোনা আপনার বক্তব্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর এটি । লরেন্স, ফ্যানিহিল, জেনে, বারোজ, মিলার, আপনাদের কামসূত্র, কোনারকের আলোকচিত্র -- এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডে ধারাবাহিকভাবে, বহুল-প্রচারিত আইনি মামলা চলছে, শায়েস্তা করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া ফ্রান্সে একাধিক সংবাদপত্র ও আলজেরিয় যুদ্ধবিষয়ক বই দমননীতির কোপে পড়েছে, পড়ছে । রাজনৈতিক কারণেই এই দমন । এমনকী কংগ্রেসও ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) এর কয়েকটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যদিও তা নিতান্ত অনিচ্ছুকভাবেই । কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) সম্ভবত আয়রন কার্টেন দমননীতির বিরুদ্ধেই সরব হতে পছন্দ করে, পাশ্চাত্য দমননীতির বিরুদ্ধে নয় --- আমার এ ধারণা আরও বেশি করে দৃঢ় হচ্ছে, বিশেষ করে আপনার প্রতিক্রিয়ার ধরণ-ধারণ দেখে । এই বিগত এক বছরেই নিউ ইয়র্ক শহরে চলচ্চিত্র, বই সম্পর্কে পুলিশি ধরপাকড় তো হয়েইছে, এমনকী কমেডিয়ানরাও ( লেনি ব্রুস-এর ঘটনা ) বাদ যাননি । আমার মনে হয়, আপনার এ-সম্পর্কে যতোটা জানা দরকার ততটা আপনি জানেন না । ভদ্রভাষায় বললে তাই দাঁড়ায় আরকী । যেমন, আপনি কি জানেন যে, ইংরেজি ভাষায় যে প্রকাশক ডুরেল, মিলার, বারোজ, নবোকভ, টেরি সাদার্ন, দ্য সাদে ও প্রাচ্য প্রণয়গাথা প্রকাশ করেছিল, সেই অলিম্পিয়া প্রেস ফরাসি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে ? এ ব্যাপারে ফরাসি কংগ্রেস ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) কিছু করতে তেমন উৎসাহী ছিল, তা নয় । অলিম্পিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক আন্তর্জাতিক কেচ্ছায় পরিণত হওয়ায় একটু নড়েচড়ে বসে তারা একটি পিটিশন চালু করেছে । নিশ্চয়ই এটা জানেন যে, ভারতে লেডি চ্যাটার্লিজ নিষিদ্ধ ? ভারতীয় কমিটি কি এ বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে ? হাংরিরা তো হালের ।
              “যা হোক, এসবই তত্ত্বকথা, আমার ক্ষোভ উগরে দেওয়া -- মতের বিনিময় -- ঈশ্বরের দোহাই, মাথা গরম করবেন না --- মলয় ও তার বন্ধুদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ মনে হয় এখনও রুজুই আছে --- মলয় লিখেছে যে ২৮ ডিসেম্বর বিচার শুরু হবে --- এই অদ্ভুত পরিস্হিতি থেকে মুক্ত হওয়ার মতো প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকে কোনও সহায়তাই পাওয়া যায়নি এখনও অবধি --- ও বলেছে, বোধহয় ওর কথাগুলো সত্যিই, যে, ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার ফলে কবি ও লেখকরা এতোটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যে, তারা প্রায় সকলেই তাদের লেখার ধরনটাই পালটে ফেলেছে ।’ অবশ্য ও যে লেখক দলকে চেনে, তাদের কথাই বলছে, ‘প্রতিষ্ঠিত’ বয়স্কদের কথা নয় । ও জানিয়েছে কংগ্রেসকে ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) চিঠি লিখেও কোনো উত্তর পায়নি ও । আপনিও এড়িয়ে গেছেন । আর ‘আমাদের গ্রেপতার হওয়ার পর আমাদের কোনো ম্যাগাজিন বা বুলেটিন আমরা ছাপাতেই পারছি না ।’ পুলিশের ভীতি । উৎপল বসু আজ একটা চিঠিতে লিখেছে, ‘ভীষণ বাজে খবর । আজ আমার কলেজ কর্তৃপক্ষ ( যেখানে আমি জিওলজি পড়াই ) আমায় পদত্যাগ করতে বলল । আমার কোনো যুক্তিই ওরা শুনতে নারাজ । আমার তো একরকম সর্বনাশ হয়ে গেল । ওরা টাইম পত্রিকা খুলে দেখিয়ে বললে, এই তো আপনার ছবি ও বক্তব্য । আপনার মতো কোনো লোক আমাদের এখানে থাকুন, এ আমরা চাই না...আমার চিঠিপত্র পুলিস ইনটারসেপ্ট করছে । আপনি আমার শেষ চিঠিটা পেয়েছেন ?...ইত্যাদি।’ এ একেবারে অসুস্হকর এক পরিস্হিতি । এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে প্রাথমিকভাবে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম । কারণ পুলিশি শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে ।এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ । প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্কৃতি সম্ভব নয় । বোধহয় ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডমের প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না । যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতায় কংগ্রেসের ( ফর কালচারাল ফ্রিডাম ) দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন । আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন । তবে চিঠিতে অন্তত আপনাকে কথাগুলি সোজাসুজি বলছি । এই মুহূর্তে আপনার-আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্হিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।--- অনুগত, অ্যালেন গিন্সবার্গ ।
              “পুনশ্চ : আমার বিলম্বিত উত্তরের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী । পিটার ( অরলভস্কি ) ও আমি গত এক মাস হারভার্ডে বক্ততৃতাদানে ব্যস্ত ছিলাম । আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই কেমব্রিজ থেকে ফিরেছি ।
             দাদাকে সম্ভবত জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করতে । আমরা দুজনে দেখা করেছিলুম । কিন্তু আইয়ুব সাহেব এ-ব্যাপারে মুখ খোলেননি, এমন ভাব করেছিলেন যেন দুটো ভিখারি ওনার ড্রইংরুমে ঢুকে পড়েছে । দাদাও জানতো না, আমিও জানতুম না যে গিন্সবার্গ আর আইয়ুব সাহেবের মধ্যে আমাদের কেস নিয়ে কথাবার্তা চলছে । ব্যাপারটা আমরা জানতে পারি পরে যখন দাদাকে আর আমাকে কলকাতায় র‌্যাডিকাল হিউম্যানিস্টের দপতরে কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডামের ভারতীয় সচিব এ. বি. শাহ দেখা করতে বলেন । এ. বি. শাহ পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে জেনেছিলেন যে কলকাতার এলিটবর্গের কারা আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ ঠুকেছেন । এ. বি. শাহ বললেন, তিনি কিছু করতে পারবেন না । এলিটবর্গের কলকাঠি ছাড়া তো জানার কথা নয় যে উৎপলকুমার বসু কোথায় অধ্যাপনা করেন, এবং তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে উচিত শিক্ষা দেওয়া উচিত ।
              অ্যালেন গিন্সবার্গের চিঠির জবাবে আবু সয়ীদ আইয়ুব ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪ এই চিঠিটি লেখেন । চিঠিটির কপি পরে গিন্সবার্গই আমাদের পাঠিয়েছিলেন, জানাবার জন্য যে আইয়ুব সাহেব কতোটা ক্রুদ্ধ :-
    Pearl Road
    Calcutta
    31 October, 1964
    Dear Mr Ginsberg,
              I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate, did not, however surprise me ; for I never thought the Congress had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeoisie’ or ‘respectable’.
              If any known litteratur or intellectual had come under police repression for their literary or intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile work to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy language ( I hope you agree that the word ‘fuck’ is obscene and  ‘bastard’ filthy at least in the sentence ‘Fuck the Bastards of the Gangshalik School of Poetry’; they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avantgarde exhibition ! You may think your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
              It was of course foolish of the police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now) thus giving the publicity and some public sympathy --- publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
              I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language --- a language of which you chose to remain totally ignorant.
              With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
    Yours sincerely
    Abu Sayeed Ayyub
              আইয়ুব সাহেব যখন এই চিঠিটা লিখছেন তখন পর্যন্ত চার্জ শিট দেয়া বাকি আছে, প্রদীপ চৌধুরীকে ত্রিপুরা থেকে গ্রেপতার করে কলকাতায় আনা বাকি আছে । আইয়ুব সাহেব দাদার “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি”  কাব্যগ্রন্হ তখনও পড়েননি, উৎপলের কবিতাও পড়েননি, তা তিনি স্বীকার করেছিলেন আমাদের কাছে । তিনি জানতেনই না যে উৎপলের চাকরি চলে গেছে, জানতেন না যে দাদাকে চাইবাসায় গ্রেপতার করা হয়েছিল, আর তখনও পর্যন্ত সাসপেন্ড রয়েছেন । কারা তাঁকে খবর যোগাচ্ছিল জানি না । যারা যোগাচ্ছিল তারাই আমাদের বুলেটিন, পত্রিকা ইত্যাদি কলকাতায় ছাপাতে দিচ্ছিল না । দাদার এক বন্ধু, অদ্রীশ বর্ধনের দাদা, নতুন প্রেস খুলেছিলেন বহরমপুরে, সিগনাস প্রিন্টিং নামে, দাদা সেখানে ছাপার ব্যবস্হা করে দেন তাঁকে বলে ।
              অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিঠিগুলো পড়লেন তো ? এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি চিঠি পড়ুন, একটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা, হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে, তাতে দাদার কোনো উল্লেখ নেই, অন্য চিঠিটা এক বছর পরে দাদাকে লেখা, যাতে লিখছেন যে মলয় কবিতা লিখতে জানে না, বোঝাই যায় যে পরের দশকগুলোর কবিতায় আসন্ন বাঁকবদলের হদিশ পাননি, এমনকী তরুণীরাও যে বাঁকবদলের অন্যতম কারণ হবেন, তা আশা করেননি, নকশাল আন্দোলনের আগাম আঁচ করতে পারেননি  । পরের প্রজন্মের কবিদের সম্পর্কে তাঁর হিংসে তিনি লুকোননি, বোধহয় ভেবে দেখেননি যে চিঠিগুলো কখনও প্রকাশিত হলে ছবিটার ফ্রেমে ঘুণ ধরে যেতে পারে, কিংবা হয়তো ভেবেছিলেন যে বহুল প্রচারিত পত্রিকার গদিতে বসে সময়কে রৈখিকতার বাইরে যাবার তত্বকে হাপিশ করে দিতে পারবেন ।
    15 June 1964
    313 South Capital
    Iowa City
    USA
    সন্দীপন, 
              নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি । কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি --- সবকিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম । থাকতে পারিনি । ঘাসের ওপর গড়িয়ে গেলাম । একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
              কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু, কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতার লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়ো, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারবো না, চাই না, কারণ আমি ওরকমভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করেছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
              প্রিয় সন্দীপন, দু’দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে। বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠি লিখলেন ? আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন ? 
              সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছর তিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারণ করিনি, কারণ আর যতো গুণই থাক, শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । সেইজন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদরুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে যে দুএকজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতোদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষায় কথা বলে সাত কোটি লোক -- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতা লেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নয়, ও কাজ অন্যের । তোমার দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও। এই ধরণের সূক্ষ্ম পিঠচাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদগ্রন্হের কাজ, যে জন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
              হাংরির এই ইংরেজির মতলব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এতো পছন্দ করছেন --- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাবস্ট্র্যাক্ট লেখক কি করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের ব্যাপার মনে করেন । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি হাংরির কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা ওটাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আমার পক্ষে নীচতা হতো । খুবই । বিশ্বাস করুন, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় । 
              এবারে নতুন করে কি ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে-ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে একসঙ্গে লিখেছেন, যেটা চারজনকে এক সঙ্গে পাঠানো যায় না, সেটা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কি জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কি দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্বি দিয়েছে এই আষাঢ় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্ত ভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে ঘুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই --- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেছিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি. ‘সামনে পেছনে বাদ দিয়ে, ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছাপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব’। আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে সেটাই খারাপ(*) --- যা লিখেছেন, তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার, শক্তির বা আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে?  আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
              কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি । অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কতো ঝগড়াঝাটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি --- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না-পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটি যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্পর্কেই আমি একথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ম শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
              আমি কলকাতায় পৌঁছোবো ১৮ই আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আগস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েক দিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি  জুলাইয়ের বারো তারিখ পর্যন্ত অন্তত, তারপর নিউ ইয়র্ক ও ইংল্যাণ্ড। এখানে থেকে এম এ পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারণা এলো কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাবার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
                                                                                                       ভালোবাসা
                                                                                                       সুনীল
    (*) এটি চিঠি নয় । দেবী রায়কে লেখা -- হারাধন ধাড়াকে নয় --- নানা রঙিন পেনসিলে লেখা হাংরি বুলেটিনের জন্য গদ্য । বুলেটিনে এই গদ্যটি প্রকাশিত হয়েছিল । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবিরাম উপন্যাস লেখা আরম্ভ করলে আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাস প্রকাশ অসম্ভব করে দিয়েছিলেন । সেকারণে সন্দীপন আজকাল পত্রিকায় যোগ দেন । দাদাও কৃত্তিবাস পত্রিকায় লেখা পাঠানো বন্ধ করে দেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদার কাছ থেকে কবিতা দাদার পোস্টিঙের জায়গায় গিয়ে নিয়ে আসতেন, তখন দাদার কবিতার ধারা কৃত্তিবাসের ধারা থেকে পালটে গেছে । এবার দাদাকে লেখা চিঠিটা পড়ুন :-
    ৩২/২, যুগীপাড়া রোড, দমদম
    কলকাতা - ২৮
    ৯ নভেম্বর ১৯৬৫
    সমীর,
              মলয়ের ৫ তারিখের মামলার বিস্তৃত বিবরণ নিশ্চয়ই ওদের চিঠিতে জানতে পারবি, বা জেনে গেছিস । সে সম্পর্কে আর লিখলুম না ।
              দুটি ব্যাপার দেখে কিছুটা অবাক ও আহত হয়েছি । তুই এবং মলয় ইত্যাদি ধরেই নিয়েছিলি আমি মলয়ের স্বপক্ষে সাক্ষী দেবো না --- বরং অন্যান্যদের বারণ করব, কোনোরকম সাহায্য করবো না । তোর অনুরোধ ছিল ‘শেষ অনুরোধ’ --- যেন আমি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বা চতুর্থ অনুরোধ আগে প্রত্যাক্ষ্যান করেছি । মলয়ও কয়েকদিন আগে সকালে আমার বাড়িতে এসে বললো, ওর ধারণা আমি চারিদিক থেকে ওর সঙ্গে শত্রুতা করছি এবং অপরকে ওর সঙ্গে সহযোগীতা করতে বারণ করছি !
              অপর পক্ষে, মামলার রিপোর্ট কাগজে বেরুবার পর --- কফি হাউসের কিছু অচেনা যুবা, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসে । আমি নাকি খুবই মহৎ ব্যক্তি --- হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে কখনও যুক্ত না থেকেও এবং কখনও পছব্দ না করেও যে ওদের স্বপক্ষে সাক্ষী দিয়েছি --- সেটা নাকি আমার পক্ষে পরম উদারতার পরিচয় ।
              ওদের ওই নকল উদারতার বোঝা, এবং তোদের অন্যান্য অবিশ্বাস --- দুটোই আমার পক্ষে হাস্যকর মনে হল । মানুষ কি স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ভুলে গেছে ? আমার ব্যবহার আগাগোড়া যা স্বাভাবিক তাই । আমার স্ট্যাণ্ড আমি আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি । আমি হাংরি জেনারেশন পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ) । আমি ওদের কিছু-কিছু পাজি ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি । মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না --- আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা । অপরপক্ষে লেখার জন্য কোনো লেখককেই পুলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই --- একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি । পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যা-ই হোক না ) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি । কারুর লেখা আমি অপছন্দ করি বলেই তার শত্রুতা করবো, কিংবা অন্য কারুকে নিবৃত্ত করবো তাকে সাহায্য করতে -- এরকম নীচতা কি আমার ব্যবহারে বা লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে ? এসব ছেলেমানুষী চিন্তা দেখলে -- মাঝে মাঝে রাগের বদলে হাসিও পায় ।
              যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি । মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই --- এবং ওর লেখাটা আমার ভালোই লেগেছে । ধর্ম সাক্ষী করে আমি দ্বিতীয় কথাটা মিথ্যে বলেছি । কারণ, কয়েকদিন আগে মলয় যখন আসে --- তখন আমি বলেছিলুম যে ওর লেখা আমি পছন্দ করি না । কিন্তু শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্নটি জেনারাল, এবং সেই জেনারাল প্রশ্নে আমি অশ্লীলতা বলে কিছুই মানি না । সুতরাং সেই হিসেবে মলয়ের লেখাও যে বিন্দুমাত্র অশ্লীল নয়, তা আমি সাক্ষীর পক্ষে উঠে স্পষ্ট ভাবে বলতে রাজি আছি । তখন মলয় আমাকে অনুরোধ করে, আমি যদি ওকে সাহায্য করতে চাই, তবে জজসাহেবের সামনে ওর কবিতা খারাপ লাগে এটাও যেন না বলি । আদালত তো আর সমালোচনার জায়গা নয় । বরং ওর কবিতা ভালো লাগে বললেই নাকি মলয়ের পক্ষে সুবিধে হবে ।
              সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়।(*) পড়ে আমার গা রি-রি করে । এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পড়তে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি --- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না--- এসব কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না । মলয়ের তিনপাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই । মলয় যদি আমার ছোটো ভাই হতো, আমি ওকে কবিতা লিখতে বারণ করতাম অথবা গোড়ার অ-আ-ক-খ থেকে শুরু করতে বলতাম । যাই হোক, তবু আমি বেশ স্পষ্ট গলাতেই দুবার বলেছি ওর ঐ কবিতা আমার ভালো লেগেছে । এর কারণ আমার কোনো মহত্ব নয় --- আমার সাধারণ, স্বাভাবিক সীমাবদ্ধ জীবন । যে কারণে আমি আনন্দবাজারে সমালোচনায় কোনো বাজে বইকে ভালো লিখি --- সেই কারণেই মলয়ের লেখাকে ভালো বলেছি । যাই হোক, সেদিন আদালতে দাঁড়িয়ে মনে হল, হাকিম এবং পুলিশপক্ষ এ মামলা ডিসমিস করে দিতে পারলে বাঁচে । কিন্তু মলয়ের প্রগলভ উকিল মামলা বহুদিন ধরে টেনে নাম কিনতে চায় ।
              ডিসেম্বর ৮-৯ তারিখে পাটনায় আমেরিকান সাহিত্যের ওপর একটা সিমপোজিয়াম হবে । আমি তাতে যোগদান করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছি । ঐ সময়ে পাটনা যাবো । আশা করি ভালো আছিস ।
                                                                                                                  সুনীল ।
    (*) কবিতাটির নাম ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কবিতাটি প্রথমবার পড়েন । তার আগে তিনি কবিতাটি পড়েননি ।
               ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘কৃত্তিবাস’ দ্বিতীয় সংকলনের সম্পাদকীয় লেখার সময়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের প্রতি ঈর্ষাজনিত ক্ষতের কথা ভুলতে পারেননি । তিনি লিখেছিলেন, “অ্যালেন গিনসবার্গের প্রভাবেই কিনা জানি না, এই সময় কৃত্তিবাস লেখক গোষ্ঠীরই একটি অংশ হাংরি জেনারেশন নামে একটি আন্দোলন শুরু করে । প্রায় একই লেখক গোষ্ঠী হলেও, কৃত্তিবাস পত্রিকা ঘোষিতভাবে হাংরিদের সঙ্গে সম্পর্ক-বিযুক্ত থাকে, আমি নিজেও কখনো হাংরিদের দলে যোগ দিইনি । দু’এক বছরের জন্য হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের সোরগোল কৃত্তিবাসের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়েছিল এবং তা একদিকে টাইম ম্যাগাজিন অন্যদিকে আদালত পর্যন্ত গড়ায় । আমি হাংরিদের থেকে সব সময়ে দূরে দূরে রইলেও অশ্লীলতার অভিযোগে যখন শ্রীযুক্ত মলয় রায়চৌধুরীর বিচার হয়, তখন আমি তার পক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম ।”
               হাংরি আন্দোলনের দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় কারোর সঙ্গে গিন্সবার্গের দেখা হয়নি । দাদার সঙ্গে হয়েছিল ১৯৬২ সালে আর আমার সঙ্গে ১৯৬৩ সালে । হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে । বস্তুত কৃত্তিবাস গোষ্ঠীই গিন্সবার্গের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাঁদের অনেকেরই কবিতায় সেকারণে এই সময় বাঁকবদল ঘটেছিল, যখন কিনা তাঁরা কবিতা লিখছিলেন পঞ্চাশ দশক থেকে । গিন্সবার্গের তোলা ফোটোও তাঁরা কৃত্তিবাস পত্রিকার কভারে ছেপেছেন । কোনো হাংরি বুলেটিনে গিন্সবার্গের অস্তিত্ব নেই ।
               ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার হাংরি সংখ্যার জন্য নাসের হোসেন দাদাকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, “হাংরি আন্দোলন চলাকালীন নানাধরণের ঘটনা ঘটেছে । এমনকি পরস্পরের সঙ্গে বিচ্ছেদও ঘটেছে । এই ঘটনার প্রভাবে মেইনস্ট্রিমের কিছু-কিছু ভূমিকা সম্পর্কে কিছু কি বলবেন ?”
               দাদা তার এই উত্তর দিয়েছিলেন, “দেখ, আমার প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে সুনীল বাইরে থেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ভাঙন ধরাতে সচেষ্ট ছিলেন । শক্তিকে নেতা করা হয়েছিল বলে সুনীল অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ছিলেন । আর প্রিয় কবি শঙ্খ ঘোষ মহাশয় ভেতর থেকে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অনেকটা সফল হয়েছিলেন । এগুলি যে কেউ গবেষণা করলেই টের পাবেন ।”
              দাদার জন্য তাই জরুরি ছিল কলকাতায় এসে “হাওয়া-৪৯” পত্রিকার মাধ্যমে নিজের দর্শনকে প্রতিরোধ হিসাবে এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতরূপে তুলে ধরা । এক সাক্ষাৎকারে ( চন্দ্রগ্রহণ, হাংরি সংখ্যা ) নাসের হোসেন দাদাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হাংরি জেনারেশন থেকে আপনি অধুনান্তিক অবস্হানপন্নতায় গেলেন কীভাবে ? আমার ধারণা এ-দুটোর দূরত্ব বিস্তর।” 
              উত্তরে দাদা বলেছিলেন, “আধুনিকতা বা ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে উত্তরঔপনিবেশিক অধুনান্তিকতায় যাত্রাপথ চিহ্ণিত করা তোমার পক্ষেও সহজ । দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেও, স্বাধীনোত্তর চেতনা তারিখের কাঁটায় সায় দিয়ে বদলে যায় না । হাংরি আন্দোলন স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে ঘটেছিল ষাটের দশকে । এবং ক্রমশ ভেদের সনাক্তকরণ থেকে অভেদের সন্ধানে যাত্রার মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে প্যারাডিম শিফট বা বাঁকবদলের অনিবার্যতা । ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসার পরিস্হিতি । হাংরি আন্দোলন সবার আগে এই পরিস্হিতি অনুধাবন করতে পেরেছিল ; এবং আন্দোলনের অপরিহার্যতাকে উপলব্ধি করেছিল । কেননা এই ধরণের পরিবর্তন আন্দোলনের মাধ্যমেই সম্ভব । যার ফলে পরবর্তীকালে পর পর একাধিক আন্দোলন ঘটতে থেকেছে । স্বাধীনোত্তর পর্বে ঘটলেও, সেই আন্দোলনগুলির কাঠামো ছিল ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় আক্রান্ত । আমরা এ-কথা বুঝতে পেরেছিলাম যে আগের কাঠামো থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে পড়তে হবে । এবং সাহিত্যের প্রথম শর্ত আগের ভাষাকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাষার পরিমণ্ডল গড়ে তোলা । আমরা প্রত্যেকেই কবিতা-গল্প ইত্যাদিতে ভাষার পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট থেকেছি । যেমন মলয় তাঁর কবিতার নাম দিলেন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, শৈলেশ্বর ঘোষ দিলেন ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’, প্রদীপ চৌধুরী নাম রাখলেন ‘চর্মরোগ’, বাসুদেব দাশগুপ্ত তাঁর গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘রন্ধনশালা’, সুবিমল বসাক তাঁর উপন্যাসের নাম রাখলেন ‘ছাতামাথা’, আমি আমার গল্পের নাম দিলাম ‘স্মৃতির হুলিয়া প্রতুলের মা অমলেট অবধি’, ‘জলছবি’, ‘অতিক্রম’, কাব্যগ্রন্হের নাম রাখলাম ‘জানোয়ার’ । প্রত্যেকের ভাষা, উপস্হাপনা, প্রয়োগ সম্পূর্ণ পৃথক । এগুলো ঠিক রাতারাতি ঘটেনি । বিষয়গুলোকে নিয়ে আমি ও মলয় দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করেছি, আলোচনা হয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায়ের ( হারাধন ধাড়া ) সঙ্গে । দেবী রায়ের কবিতা প্রথম থেকেই গঠন ও মেজাজ-মর্জিতে অভিনব । আমাদের পূর্বে যাঁরা লেখালিখি করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না । ফালগুনী রায় তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’ । হাংরি আন্দোলনের মধ্যেই এবং ষাট দশকের অধিকাংশ আন্দোলনের মধ্যেই অধুনান্তিকতার বীজ অন্তর্নিহিত ছিল । কেননা যে পরিবর্তন ঘটছিল তা সময়কেন্দ্রিক প্রশ্নময়তা থেকে পরিসরভিত্তিক অবস্হানপন্নতার দিকে তার চেতনার অভিমুখ ক্রমশ রচনা করছিল । এই প্রসেসটা এমন ছিল যে সেখানে প্রাধান্য ছিল গড়ে তোলার চেয়ে উঠে আসার দিকে গুরুত্ব দেওয়ার স্বতশ্চল তাগিদ । হাংরি আন্দোলনের কোনো হেড অফিস/হাই কমাণ্ড/পলিটব্যুরো বা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র ছিল না । ঠিক যেমন অধুনান্তিকতার কোনো কেন্দ্র থাকে না, অধুনান্তিক লেখালিখির চরিত্র একটি বিকেন্দ্রিক উপস্হাপনা । ফলে ষাট দশকের অন্যান্য সাহিত্য আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল না, অধুনান্তিক বীজ সেখানে নিহিত ছিল । হাংরি আন্দোলন থেকে অধুনান্তিকতায় পৌঁছে যাওয়া যেজন্য খুব স্বাভাবিক । হাংরি আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক আন্দোলন । সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্ম, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি জীবনচর্যার সবদিকেই এই আন্দোলন মনোযোগ দিয়েছিল । “হাওয়া ৪৯” পত্রিকার সংখ্যাগুলিতে বিষয়গুলির ক্রমান্বয়কে যদি লক্ষ্য করো, তাহলে দেখতে পাবে, সমস্ত দিকেই ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের গভীর অভিনিবেশ । ঔপনিবেশিক শাসন থেকে কাগজে-কলমে মুক্তি পাওয়ার পর হাতেনাতে সেই মুক্তি প্রতিষ্ঠার দায় প্রবলভাবে অস্হির রাখে সমাজচিত্তকে । সঙ্গে থেকে যায় ঔপনিবেশিকতার চাপিয়ে দেওয়া খেসারতগুলো । মাথাচাড়া দেয় আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত সত্তার নিজস্ব ভৌমতার অনিবার্যতা । অধুনান্তিকতা সেই সময়ে আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না, যদিও তার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল আমাদের ডিসকোর্সে । পরিবর্তনই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য । অধুনান্তিকতা উঠে এসেছে বোধের সমস্তরকম স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে । কোনো পরিকল্পনা থেকে উঠে আসেনি। আধুনিকতা বা মডার্নিজমের থেকে বেরিয়ে এসে তুমি যে জায়গাটায় পৌঁছোলে বা পৌঁছোচ্ছ, তার একটা নামকরণ দরকার এবং সেই ভিন্ন পরিসরটির নামকরণ করেছেন আলোচকরা । অধুনান্তিকতা একটি পরিসর ; অনেকে তাকে আন্দোলন ভেবে ভুল করেন ।”
              ‘হাওয়া-৪৯’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাজানো বাগানের পরের স্টপ’ প্রবন্ধে ‘অধুনান্তিক’ শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন বহুভাষাবিদ প্রবাল দাশগুপ্ত ।
              তাঁর “উত্তরাধুনিক প্রবন্ধ সংগ্রহ” গ্রন্হে দাদা একটা তালিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট করার জন্য যে আধুনিকতার সঙ্গে অধুনান্তিকতার পার্থক্য কোথায়, তুলে দিচ্ছি এখানে :
    আধুনিক                                                                         অধুনান্তিক
    যুক্তির প্রাধান্য, যুক্তির প্রশ্রয়,                                       যুক্তিবিপন্ন, যুক্তির কেন্দ্রিকতা থেকে
    সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কের মতো যুক্তি                                     মুক্তি, যুক্তির বাইরে বেরোনোর প্রবণতা,
    ধাপে-ধাপে এগোয়, কবিতার                                        আবেগের সমউপস্হিতি, কবিতার শুরু
    আদি-মধ্য-অন্ত এই ভাবগুলো                                        হওয়া আর শেষ হওয়াকে গুরুত্ব না
    বজায় থাকে, একরৈখিক                                             দেওয়া, ছেতরানো, ক্রমান্বয়হীন, আবেগ
    ক্রমঅগ্রসর, কেন্দ্রাভিগ, যুক্তির                                     যুক্তির দ্বৈরাজ্য কেন্দ্রাভিগ, যুক্তি ও
    দিকে কবিতার অভিমুখ, আঁটো                                     আবেগের দ্বৈরাজ্যের দিকে কবিতার অভিমুখ,
    সাঁটো, স্বয়ংসম্পূর্ণ ।                                                    এলোমেলো দেখায় ।
        
    বদ্ধ সূচনা, বদ্ধ আঙ্গিক, বদ্ধ                                        মুক্ত সূচনা, মুক্ত আঙ্গিক, মুক্ত সমাপ্তি ।
    সমাপ্তি ।
    ডিসটোপিয়া ।                                                          হেটারোটোপিয়া ।
    সুনিশ্চিত মানে, পরিমেয়তা ও                                       মানের নিশ্চয়তা এড়িয়ে যাওয়া, অফুরন্ত
    মিতকথনের প্রতি গুরুত্ব, কবির                                     মানে, যা ইচ্ছে তা মনে করে নিতে পারেন
    ঠিক করে দেয়া মানে, স্হাবর ।                                     পাঠক, মানের ধারণার প্রসার, প্রচলিত মত 
                                                                               অস্বীকার ।
    তলে-তলে মানে, বাইরে মুখোশ।                                       যা আছে তা-ই, লুকোনোর কিছু নেই,
                                                                                 স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতা ভিতর-বাহির
                                                                                 আলাদা নয় ।
    ‘আমি’ পাঠবস্তুর কেন্দ্রে, ‘আমি’র                                     একক আমির অনুপস্হিতি, আমির বন্ধুত্ব,
    নির্মাণ, একক আমি, পূর্ব                                               ক্যানন থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ক্যানন
    নির্ধারিত মানদণ্ড, ক্যানন দাঁড়                                        ভেঙে দেওয়া, সীমা আবছা, সীমায় ভাঙন,
    করানো, সীমা স্পষ্ট, আত্মপ্রসঙ্গই                                      মিশ্রতা, লিমিন্যালিটি, সংকরায়ন,
    মূল প্রসঙ্গ, শুদ্ধতা, ‘আমি’র                                            সংকরত্ব ।
    পেডিগ্রি ( কুলুজি )।
    একক মালিকানা, স্পষ্ট মালিকানা,                                     মালিকানার রুবরিক, মালিকানার বহুত্ব,
    শেকড় -- গোপন গভীরে, কবিই                                       মালিকানা বিপন্ন, মালিকানা বিসর্জন,
    টাইটেল হোলডার ।                                                       পাঠকই টাইটেল হোলডার, শেকড় 
                                                                                  ছড়িয়ে পড়ে, রাইজোম্যাটিক ।
    একরৈখিক, লিনিয়ার, লিনিয়রিটি,                                    প্লুরালিজম, বিদিশাগ্রস্ত বহুস্বরের আশ্রয়,
    দিশাগ্রস্ত, একক গলার জোর, কবি                                     দিগ্বিদিকে গতিময়, ভাবুক, জগৎ
    ধ্বনি মিল দেন, প্রগতি ।                                                আয়োজনের মেলবন্ধন উসকে দেন,
                                                                                  অ্যাক্টিভিস্ট ।
    কবি একজন বিশেষজ্ঞ ।                                                 কবিত্ব হোমোসেপিয়েন্সের প্রজাতিগত
                                                                                  বৈশিষ্ট্য ।
    শ্রেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবি,                                       বিবেচন-প্রক্রিয়া থেকে কেন্দ্রিকতা 
    একজনকে তুলে ধরা, হিরো, গুরু                                      সরিয়ে দেয়া, কবির বদলে সংকলনের
    কবির গুণগান, একসময়ে একজন                                     গুরুত্ব, কবিতার প্রধান পাঠকৃতি বিচার্য,
    বড়ো কবি, ব্র্যাণ্ডনেম তৈরি, বিশেষজ্ঞ                                 সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা, শ্রেষ্ঠত্ববোধক
    সেন্সেলাইজেশান, আইকন ।                                             ফাঁস করে দেয়া, সার্বিক চিন্তা-চেতনা,
                                                                                  জেনেরালাইজেশান ।
    কথা খেলাপ, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, শব্দার্থকে                                 কথা চালিয়ে যাওয়া, কথার শেষ নেই,
    সীমাবদ্ধ রাখা, কবিতার জন্য কবির                                  শ্বব্দার্থের ঝুঁকি, কবিতাকে আত্মমনস্কতা
    আত্মধ্বংস, কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন ।                               থেকে মুক্তি ।
    বাদ দেবার প্রবণতা, এলিমিনেশন,                                     জোটবাঁধা, যোগসূত্র খোঁজা, শব্দজোট,
    ঝকঝকে, ছাড়া-ছাড়া স্পষ্ট শব্দ ।                                      অর্থ-জোট, বাক্যজোট, উগ্র মতকেও
                                                                                  পরিসর দেয়া ।
    একটিমাত্র মতাদর্শ, ইজম, তন্ত্র                                            বহুমতাদর্শের পরিসর, ভেঙে-ভেঙে 
    অনুযায়ী চলবে, হাইকমাণ্ড,                                                টুকরো ইজমের সমাজ অনুযায়ী
    পলিটব্যুরো-নির্দেশিত ।                                                     প্রতিনিয়ত রদবদল, ক্রমাগত
                                                                                     পরিবর্তন, ভঙ্গুরতা, জীবন থেকে
                                                                                     উঠে-আসা ধারণা ।
    নিটোল কবিতা, শক্তিমত্তার পরিচয়,                                     এলোমেলো কবিতা, বহুরঙা, শক্তি
    গুরুগম্ভীর, কবিতার নির্দিষ্ট মডেল                                       জাহির করা মুশকিল, হালকা মেজাজ,
    যেমন সনেট, ওড, ব্যালাড ইত্যাদি,                                      নির্দিষ্টতার বাইরে, অপরিমেয় নাগাল ।
    অনুভবের গভীরতার খোঁজ ।
    কবিকে প্রকৃতির বাইরে সাংস্কৃতিক জীব                                 সব মানুষই প্রকৃতির অংশ,
    মনে করা, নিসর্গবন্দনা ।                                                  ইকোফ্রেণ্ডলি কবি ।
    প্রতীকের প্রাধান্য, প্রতীকের                                               প্রতীক এড়িয়ে যাওয়া, ভেঙে দেয়া,
    চমৎকারিত্ব, প্রতীকের আহামরি,                                         যা বলার সরাসরি বলা ।
    ঘুরিয়ে বলা ।
    স্হিতাবস্হার কদর, পরিবর্তন শ্লথ।                                      পরিবর্তনের তল্লাশি, প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ
                                                                                     স্বীকৃত ।
    নাক-উঁচু সংস্কৃতি, প্রান্তিককে অশোভন                                   সাংস্কৃতিক বিভাজন বিলোপ, অভেদের
    মনে করা, শ্লীল ও অশ্লীল ভেদাভেদ,                                      সন্ধান, একলেকটিক, বাস্তব-অতিবাস্তব-
    ব্যবধান তৈরি করা, ভেদের শনাক্তকরণ ।                              অধিবাস্তবের ব্যবধান বিলোপ ।
    ‘বড়ো কবি’ বলে দেবে কাকে কবিতা                                     যেমন ইচ্ছে হয়ে ওঠা কবিতা, বহুপ্রকার                        
    বলে, ভালো কবিতা ও খারাপ কবিতা,                                   প্রবণতা গ্রাহ্য, কবি বেপরোয়া ।
    বাইনারি বৈপরীত্য, উতরে যাওয়া
    কবিতা, কবিতা হবে সমরূপী ।
    খণ্ডবাদী, রিডাকশানিজম,                                                  কমপ্লেকসিটি, জটিলতা, অনবচ্ছিন্নতার
    অবিচ্ছিন্নবোধ ।                                                               দিকে ।
    কেন্দ্রিকতায় উদ্ভূত, গ্র্যাণ্ডন্যারেটিভ ।                                     প্রান্তিকতায় উদ্ভূত, মাইক্রোন্যারেটিভ।
    পরমসত্য, অকাট্যসত্য, ধ্রুবসত্য ।                                        সাময়িক প্রত্যয়, তত্বের বহুবিধ
                                                                                      অনুশীলন ।
    কবিতা বিষয়কেন্দ্রিক, কবিতা                                             কবিতা ফ্লাক্স থেকে জাত, কেন্দ্রিয়
    দর্শন নির্ভর ।                                                                   বিষয়ের অনুপস্হিতি ।
    কবিতার শিরোনামের গুরুত্ব,                                                 কবিতার শিরোনাম গুরুত্বহীন,
    শিরোনামের সঙ্গে কবিতার দার্শনিক                                         না থাকলেও চলে, প্রান্তিক শব্দ, পথচলতি
    বা ভাবগত সম্পর্ক, হিরো, গুরু,                                             অভিব্যক্তি ।
    প্রতিভা, মাস্টারপিস, ক্ষমতার মসনদ
    তৈরি, শব্দে মহিমাযোগ, মৌলিকতার
    হামবড়াই ।            
    একটিমাত্র বার্তার বাহক ।                                                     একসঙ্গে বহুকন্ঠস্বর ও বহুবার্তা,
                                                                                        এমনকী বার্তাবর্জন ।
    কবিতার লক্ষ্য অব্যর্থ, কবির                                                  কবিতার লক্ষ্য বহুত্ববাদী ।
    ব্যক্তিসত্তার বিবেচন ।   
    আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা ।                                                           আধিপত্যের বিরোধিতা ।
    ‘আমি’ যা বলব  সেটাই কবিতা,                                               ‘তুমি’ যা বলবে সেটাও কবিতা,
    এককেন্দ্রিকতা, বৃক্ষশাখার মতন                                               বহুকেন্দ্রিক বা কেন্দ্রহীন পাঠবস্তুর 
    ইন্টারলিংকড ।                                                                   অজস্র উপাদান, সংজ্ঞার সীমা
                                                                                         ছাপিয়ে যায়, ঘাসের মতন ইন্টারলকড,
                                                                                          রাইজোম্যাটিক ।
              ওপরের তালিকাটা থেকে স্পষ্ট হয় যে দাদার গল্প লেখার দ্বিতীয় পর্বে অধুনান্তিক জাদুবাস্তবতা এসেছে তাঁর বৈচিত্রময় অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি ও পাঠ থেকে সংগ্রহ করা  চিন্তাভাবনার হাত ধরে । বন্ধুদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে দাদা লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলেন প্রায় দেড় দশক । প্রথম পর্বের গল্পগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলোর ভাষায় ও কাঠামোয় পার্থক্য আছে । একইভাবে তাঁর প্রথম পর্বের কবিতা ( ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি, জানোয়ার, আমার ভিয়েৎনাম ) থেকে তাঁর দ্বিতীয় পর্বের কবিতা ( মাংসের কস্তুরীকল্প, পোস্টমডার্ন কবিতাগুচ্ছ, বিদুরের খড়ম, নির্বাচিত কবিতা, আপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয় ) সম্পূর্ণ পালটে গিয়েছে । ছোটোগল্পের যে সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে এসেছিল, অর্থাৎ একটি হুইপক্র্যাক এনডিং থাকতে হবে এবং ব্যক্তিএককের কাহিনি হবে, তা দাদার গল্প লেখার প্রথম পর্বেও ছিল না।
             রবীন্দ্র গুহ তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া’ প্রবন্ধে ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি-জুন ২০১১ ) বলেছেন, “আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ছোটো গল্পের প্রধান ধারক ভাষা ও আঙ্গিক । পৃথিবী জুড়ে যা কিছু লেখালিখি হচ্ছে তার মূল শক্তি বিষয় নয়, দায়বদ্ধতা নয়, আসল হচ্ছে কাঠামোটি । শাখা-প্রশাখা বিনোদনের উপকরণ সমৃদ্ধ হলেই গল্পটি উপভোগ্য হবে এমন নয় । ভাষার গুণে এবং সুঠাম কাঠামোর জন্য অনেক তুচ্ছ বিষয়ও ভাবনার স্তরে বিস্তর অতিরিক্ত ভাবনা ফুটিয়ে তোলে । যেমন আছে ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে, ‘শ্রীশ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’-এ এবং ‘আলজাজিরা’তে । ‘মেথিশাকের গন্ধ’তে ডিটেইলিং নেই, আছে অতি সহজবোধ্য সংকেতময়তা । অন্ধকার তুলকালাম আড্ডা জমায় । ছায়ার পিছনে বিনম্র ছায়া । আড়ালে গোছানো কথাবার্তা । নির্জনতার মোড়ক উন্মোচিত হয় এইভাবে :-
    ‘অন্ধকারে জুজুবুড়ি, রাক্ষস, খোক্কোস, শাঁকচুন্নি, একানড়েরা থাকে -- মা’র কথা না শুনলে খপ করে খেয়ে নেয়-- তারপর মা যখন মামার বাড়ি পাণিহাটিতে নিয়ে যেতেন-- রাঙাদিদু কাছে টেনে সবাইকে রাক্ষস খোক্কোস জয় করার রূপকথা শোনাতেন --- আমরা নিজেরাই কেউ রাজপুত্র সেজে জয়ের খেলা খেলতাম-- খেলতে খেলতে ভয় কেটে গেল --- রাঙাদিদু স্বামীর ঘর করার আগেই বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে বিধবা হয়ে গিয়েছিলেন -- ছোটোছোটো কদমছাঁট চুল -- ফর্সা রঙ -- রোগা হাত-পা --- পরনে থানকাপড় -- সবাই বলত নেড়ি পাগলি--- আমাদের রাগ দুঃখ বাড়ত --- সেই রাঙাদিদু হঠাৎ মারা গেলেন --- পরের বার পাণিহাটিতে গিয়ে আর দেখা হল না --- মা বললেন --- অন্ধকারের দেশে চলে গেছেন --- সেই প্রথম অন্ধকারের মধ্যে প্রিয়জনের বাস তৈরি হল --- তারপর এক-এক করে মা বাবা ছোড়দি মেজোজেঠা নকাকা বন্ধুবান্ধব কতো প্রিয়জন সেই অন্ধকারে চলে গেল----’ ( মেথিশাকের গন্ধ )
               ‘মেথিশাকের গল্প’তে অন্ধকারই প্রধান চরিত্র । অলোক গোস্বামী ‘খুল যা সিম সিম’ প্রবন্ধে ( বোধ, মার্চ ২০০৯ ) বলেছেন, “গল্পটিতে সমীর এই অন্ধকারকে, তার বহুমাত্রিকতা এবং ব্যক্তিত্ব সমেত তুলে ধরেছেন । পড়তে পড়তে বুঝি অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ জড়িয়ে আছে অস্তিত্ব-চেতনার সঙ্গে । যে অভিজ্ঞানগুলো মারফৎ কোনো ব্যক্তি নিজেকে সনাক্ত করে অন্ধকার নিমিষে সেসব অভিজ্ঞান হাপিস করে দিতে পারে । মুছে দিতে পারে পরিচিত ভূগোল । কেড়ে নিতে পারে সভাসামগ্রী । অর্থহীন করে দিতে পারে কোড অফ কম্যুনিকেশন, তছনছ করে দিতে পারে পারস্পরিক সম্পর্কক্ষেত্র । 
              “অন্ধকারের স্বরূপসন্ধান যেহেতু সভ্যতার কাম্য নয়, তাই শেফালির মারফত সমাজ বহুবচনে বিধিসম্মত সতর্কবার্তা পাঠায়, ‘যে যেখানে আছ সেখানেই থাকো -- মোমবাতি জ্বেলে নিয়ে আসছি…’।
              “কিন্তু অন্ধকারই তো পারে মনকে প্রশ্রয় দিতে, কল্পনাকে বিস্তৃত করতে । সেজন্যই সৃষ্টির আধার অন্ধকার । ভুলি কেমনে বাল্মীকির আশ্রমের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম তমসা, যা সমীরের ভাষ্যে, ‘কবিতার জন্ম হয়েছিল এই নদীতীরে, আরও সহজ করে বলা যায়, মানুষ নামের প্রাণীর কবিত্বের জন্ম কবিতার জন্ম এই তমসাতীরে । যে কবিত্ব এই প্রজাতির চালিকাশক্তি ।
              “হতেই পারে অন্ধকার মৃত্যুর নিজস্ব এলাকা । তার জন্য সেই স্হান ভয়ঙ্কর হবে কেন ? মৃতের তালিকায় প্রিয়জনও তো থাকেন ।
    ‘এখন আমার নিজেরই অন্ধকারের দেশে চলে যেতে তত দ্বিধা নেই...সেখানে বাঁধন আছে...শক্তি আছে...রাঙাদিদু মা বাবা ছোড়দি সবাই তো সেখানেই...অন্ধকার এখন প্রিয়জনের সংসার…’
              “আলোকে অন্ধকারের সাপেক্ষে রেখে সমীর বলেন, 
    ‘শীতের সকালের দিকে যেমন ব্রেকফাস্টের সময় ডাইনিং টেবিলের ডানকোনে একচিলতে চেনাজানা এ-বাড়ির নিজস্ব রোদ আসে । একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকারও সমান চেনাজানা । চলতে ফিরতে, সঙ্গ নিতে কোনো অসুবিধে নেই । এই অন্ধকার নিজস্ব বিষয়-সম্পদের বাইরে নয় ।”
              আরেকটি গল্পে অন্ধকারকে কেন্দ্রচরিত্র দিয়েছেন দাদা, ‘কালো রঙের কাজ : আঁধারের অবিনির্মাণ’। অন্ধকার সম্পর্কে দাদার গল্প দুটি আলোচনা কালে বিজ্ঞানের অধ্যাপক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প : কয়েকটি বিজ্ঞানময় অবলোকন’ প্রবন্ধে ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) বলেছেন, “বিজ্ঞানে, অন্ধকার স্হানিক বা অস্হানিক দুইই হতে পারে ( আলো কেবল স্হানিক ) যে অন্ধকারের বিন্দুগুলি পরস্পরের সংযুক্ত নয়, সেই অন্ধকার স্হানিক । অস্হানিকে অন্ধকারের এক বিন্দু নড়ে-চড়ে উঠলে, অন্য এক বিন্দুতেও টান ধরে । কথক ও তাঁর স্ত্রী শেফালির মধ্যে সেই অস্হানিক অন্ধকার সেখানে যোগাযোগসূত্রটি হল রান্নাঘরে নির্মীয়মান মেথিশাকের গন্ধ।”
              নীলাঞ্জন লিখেছেন, ‘মেথিশাকের গন্ধ’ গল্পে লেখক শুরুতেই অন্ধকারের পরিসরে নিজের জড়ো করা সত্ত্বার ( Acccumulating self ) বর্ণনা দিয়েছেন :-
    ‘অনেকদিন পর আবার হঠাৎ লোডশেডিং । যাকিছু আমার বলার মতো বিষয় সম্পদ জড়ো করেছি, সব আড়াল হয়ে গেল। টেবিল চেয়ার বেডরুম টিভি ফ্রিজ ওয়াশিং মেশিন শেফালি ঘরদোর বুকসেল্ফ সিলিংফ্যান কবিতার খাতা পাশবই, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এ-বাড়ির যাকিছু দৃষ্টোগোচর, এই মুহূর্তে নিজের নিজের অবস্হান থেকে সেই উপস্হিতি এই অন্ধকারে নিভে গেছে । যে অবস্হানগুলো নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে এই মহাবিশ্বে আমার জলজ্যান্ত থেকে যাওয়া।
              
              নীলাঞ্জন তারপর লিখেছেন, এর পরেই দেখি অন্ধকারের সঙ্গে আত্মীয়তা গঠনের চেষ্টা । অবশ্য তা হতেই পারে । ‘আমি আছি; এই বোধ যদি আলো হয়, তবে ‘আমি নেই’ এই বোধ অন্ধকার । দুই বোধই পাশাপাশি থাকে । কবির কাছে অন্ধকার এক গাঢ় তন্ময়তা ডেকে আনে । হয়তো বা তখনই উদ্ভাসিত হয় তৃতীয় নেত্র। দুই চর্মচক্ষুর কাজ ফুরোলেই, তৃতীয় নেত্র নড়েচড়ে ওঠে । লেখক মনে করিয়ে দিচ্ছেন তমসা নদীর কথা । তমসা সামান্য পাল্টালে তামস, যার মানে অন্ধকার । আবার তামস উল্টে দিলেই ‘সমতা’ । অন্ধকারে সবাই সমান । সেই মনের ওপর ভর করেই লেখক এগোন । চেয়ার ছেড়ে উঠে, হাতের স্পর্শে অন্ধকারকে চিনে চিনে, অন্ধকারের ভিতর কতো অলিগলি, লেন বাইলেন টেবিলের দুইপাশ দিয়ে বেরিয়েছে । অন্ধকারে ভিতর ফাটলের সন্ধান পাচ্ছেন লেখক । আমাদের মস্তিষ্কের ভিতরকার অন্ধকার । দুই স্নায়ুকোষের মধ্যবর্তী ফাটল, সেও এক অন্ধকার, বিজ্ঞানীরা যাকে বলেছেন Synaptic Cleft.      
              অভিজ্ঞতা ছেনে দাদা পেয়েছেন স্বপ্ন-কল্পনা-বাস্তবের অন্তরালে কুহকী বাস্তবতার ইন্দ্রজাল, যেখানে ব্যক্তিক সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তব তার সত্যগুলোকে চিনে নিতে পারে, কয়েকটি গল্প সেই সময়ে লেখা যখন পশ্চিমবঙ্গে চলছে রক্তচোষার দিগ্বিজয়, যার দরুণ রাজনৈতিক সামাজিক সমালোচনা মুড়ে ফেলতে হয়েছে জাদুবাস্তবে, দ্বৈততার সংমিশ্রিত আদরায়। বাস্তব সমাজকেই দাদা গুরুত্ব  দিয়েছেন, আর দ্বিতীয় পর্বে লেখা তাঁর গল্পগুলোয় বাস্তবের ভাঁজে খুলে দিয়েছেন প্যাণ্ডোরার বাক্স  । প্রচলিত কৃৎকৌশল বাদ দিয়ে দাদা তাঁর গল্পগুলোয় এমন এক আবহ সৃষ্টি করেন যা আপাত-অস্বাভাবিক, পার্থিব ও অপার্থিব এবং সময় ও পরিসরকে মিশিয়ে গড়ে তোলেন এক তৃতীয় স্হিতি, দুঃখ-কষ্ট-ভয়ের পাশাপাশি সৃষ্টি করেছেন আনন্দময় পরিবেশের আকস্মিকতা । ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ গল্পে আরবি ভাষায় ছিল ‘ইফতাহ ইয়া সিমসিম’, দাদা তাই গল্পগ্রন্হের নাম রাখলেন ‘খুল যা সিমসিম’, ‘চিচিং ফাঁক’ নয়, কেননা ‘চিচিং ফাঁক’ শব্দবন্ধটির মধ্যে বিশাল পাথরের দরোজা খোলার ধ্বনিসাম্য নেই, গুহা সামান্য ফাঁক করে আলিবাবা আর চল্লিশটা চোর তাতে ঢুকতো না । নৃসিংহমুরারি দে তাঁর প্রবন্ধ ‘মূল সূত্রটাই যে অণোরণীয়ান’ ( কালিমাটি, নং ৯৩ ) প্রশ্ন তুলেছিলেন হিন্দি নামকরণ কেন । বস্তুত সিমসিম শব্দটি হিন্দি নয়, আরবি। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ বাংলায় গল্পটি লেখার সময়ে ইংরেজি ‘ওপন সিসেম’কে  ‘চিচিং ফাঁক’ করে দিয়েছিলেন ।
              দাদার লেখায় জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ সম্পর্কে সর্বপ্রথম লিখেছিলেন রবীন্দ্র গুহ ( কবিতা ক্যাম্পাস, নং ৭১, জানুয়ারি জুন ২০১১ ) তাঁর প্রবন্ধ “সমীর রায়চৌধুরীর গল্পের ভূবন : গাণিতিক বহুকৌণিকতা ও উপভোগের প্রতিক্রিয়া” প্রবন্ধে । রবীন্দ্র গুহর প্রবন্ধটি থেকে প্রাসঙ্গিক আংশটি তুলে দিই আপনাদের কাছে:-
              “সহজ কথাটা সরাসরি বলাই ভালো, সৎ-সাহিত্যের দরোজাটা বাংলা সাহিত্যে খুলে দিয়েছে সমীর রায়চৌধুরীর পয়লা নম্বর গল্পবিশ্ব ‘খুল যা সিমসিম’। যাকে নিঃসঙ্কোচে বলা যায় রুবিক পৃথিবীর একটা মাল্টিক্রোম হাতছানি, অথবা আলো এখন বক্ররেখায় যায় । সমীরের ডায়াসপোরিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পাই সোজাসাপটা সরলতা, অনুভূতির অসনাক্ত বিন্দুসকল ও কালের পরিবর্তনশীলতা । আরও পাই অজস্র কিংবদন্তি, রূপনির্মিতি, ক্ষেত্রজ জাদুবাস্তবতা ।
              “আমরা যারা গদ্যের হিয়ায়, বাকশস্যে অফুরন্ত ইঙ্গিতময়তা প্রত্যাশা করি, শব্দের সম্পর্কায়ন ও দেহপুষ্টিতে যুগপৎ গুরুত্ব দিই, তাদের কাছে সমীর রায়চৌধুরী নামটির একটি একসেপশানাল গ্রামার আছে । সে শুধু সীমা ডিঙোয় না, ক্রিয়েটিভ প্রক্রিয়াকে ক্রমাগত মোচড়ায় না, তার আনতাবড়ি অন্ধকারেরও একটা শৈলীগত অর্থ আছে । যা আপাত-অচ্ছুত মনে হলেও আদৌ অচ্ছুত নয় । সে এক আশ্চর্য জাদুসৌন্দর্যের ইশারা, যেখানে অন্ধকার ততোটা অন্ধকার নয়, শূন্যতা ততো গভীর শূন্য নয় । সমীরের কাছে অন্ধকারও একটা সম্পদ, শূন্যতাও মধুময়, শব্দ ও ধ্বনিময় । ‘বহুজাতিক ভুতের গল্পের খসড়া’ একটি খসড়ামাত্র নয়, বিশ্বায়নের হাজার বাস্তব মজার মধ্যে একটি অতিবাস্তব মজা । সমীরের লেখায় এই ঐতিহাসিক ধরতাইটা সত্য, অ্যাবসলিউট সত্য । জীবনে কতো দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর্যোগ, কতো জ্যোৎস্না মেঘ কুয়াশা । অন্ধকারের ফাটল দিয়ে সব দেখতে পায় সমীর ---উত্তরঔপনিবেশিক অন্ধকারের অংশীদার সমীর বনাম কার্তিক । কার্তিককে ভুতের গল্প লিখতে হবে । এর আগে ছোটোদের ভুতের গল্প লিখেছে অনেকগুলো । সে লক্ষ্য করেছে পাঠক আগের থেকে অনেক বেশি ভুতপ্রুফ, সহজে ভয় পায় না । তাই সে এনেছিল উপাদান-বিভোর রেডিমিক্স । কিন্তু তাতে যে শর্টহ্যাণ্ডের সংক্ষিপ্ত ছোঁয়া, সেখান থেকে ভুতের গল্প বানানো বেশ দুষ্কর, সেসব বাকমালা পড়তে পড়তে প্রায়শই অন্যকিছু দেখতে পায় । যেমন সে দেখতে পেল :-
    ‘অনির্বাণের কথাই হয়তো ঠিক । লাইফ সেভিং ড্রাগ এদেশে ওই গন্ধমাদন । আস্ত পর্বত । পর্বে পর্বে গল্পের ভাঁজ । বহুজাতিকে হনুমানের ঝামেলা নেই, সবাই সমান হন্যমান । যেখানে ভাঙা কার্নিশ কথা বলে কবির সঙ্গে । চৈত্রের দুপুরে কুয়োর গভীরে শুয়ে থাকে নির্জনতা ।’
              
              বোধোদয়ের দোকান থেকে কার্তিক সেল্ফমেডের প্যাকেট নিয়ে আসে । এটা আশ্চর্য একটা প্যাকেট, প্যাকেটের মধ্যেই প্যাকেট, তার মধ্যে প্যাকেট, তার মধ্যে, তার মধ্যে । আরও ছোটো । আরও । কেবলই অনুমেয়র দিকে আরও ভুতভাবনের বহুব্রী ।
    ‘বড়ো প্যাকেট খুলতে না খুলতেই বেড়ে যাচ্ছে হতে-হবের ঝোঁক । আশশ্যাওড়ার মৌলিক গন্ধ । ছায়ারা খেলছে আনি বানি জানি না । সব কিছুই চাইছে হতে পারলে হয় । গড়ে উঠছে কুহককুহেলি । খসে পড়ছে নোনা ইঁট । এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত অবধি পোড়াবাড়ির ইতিহাসের আত্মবিলয়ের আতর । ভেসে উঠছে ভৌগলিক।’
    ‘রেডিমিক্সের প্যাকেট খুলতেই ছড়িয়ে পড়ছে আবছা, ক্রমশ আঁধারের তিথিমাপ বাড়ছে । কার্তিক খুঁজে দেখে মলিন না আবডাল । নক্ষত্র নিভিয়ে আসছে জোনাকি, দমকা হাওয়ায় ছাতা হারানোর বর্ষাকালীন দুঃখু । জেগে উঠছে পোড়ো বাড়ির একদা । অনুসন্ধানী প্যাঁচা সন্ত্রস্ত চামচিকে আর ইঁদুরের বাসাবদলের চিরনির্মাণ ভেসে উঠছে ইহভৌতিক ছাপিয়ে । সন্দিগ্ধ খোঁড়া হয়ে হাঁটছে ।’
    ‘সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে আমতা-আমতা দোটানা । সিলিঙে ঠেকছে হতভম্ব, মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা, বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব, অস্হির হয়ে উঠছে খামোকা, উঁকি মারছে তালগোল । জানলার কাছে ঝুলতে শুরু করেছে কাঁচুমাচু’
              গল্পটি শেষ হয়েছে একটি অবিশ্বাস্য জাদুবাস্তব-অধুনান্তিক আবহে--
    ‘চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে হাড়গিলে নিশুতির হামা । বাড়ছে ভুতুড়ে পুঁজির রমরমা । পরস্পরের জায়গা বদল করছে খুঁটিনাটি আর খুঁতখুঁত । কার্তিক ভেবে দেখছে এবার কি সে ভীতির মধ্যে যাবে না ভয়ের অন্তরায় হয়ে উঠবে । প্যাকেট থেকে বেরোনো ক্রমউপদ্রবী আবছায়ায় সে একা । এই মুহূর্তে ছায়া-প্রচ্ছায়া দিশেহারা । জানলায় ঝুলছে কাঁচুমাচু । হতভম্ব ঠেকছে সিলিঙে । ছড়িয়ে পড়ছে অনুপস্হিতির অনুপ্রবেশ । এলোমেলো হয়ে পড়ছে চিন্তাজনিত । মাটিতে গড়াচ্ছে খটকা । বুজকুড়ি কাটছে তাজ্জব ।’
              “স্বাধীনতার পরও ভারত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হাতে অবাধ মৃগয়া ক্ষেত । তাবড় তাবড় ভারতীয় বণিকরা ভিন্নদেশীয় বন্ধুদের মদতে চমকদার সাবান, তেল, কেশকালা, দাঁতের মাজন তৈরি করছে । এইসব সামগ্রীর গুণ বিচারের জন্য কোনও কোনও বাণিজ্য সংস্হা দশ মিলিয়ন টাকা খরচ করছে বিজ্ঞাপন বাবদ । এদের সমবেত আক্রমণের ফলে আমজনতা পিতৃনাম ভুলতে বসেছে । ক্রেতারা বিগবাজারে বলিপ্রদত্ত । আজও কেউ বুঝলেন না ভোগবাদ একটি রোগ ।
              “সে কলকাতাই হোক বা মুম্বাই বা শহর দিল্লি, মোড়ে মোড়ে বিশাল হোর্ডিং । বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন । কোলগেট, পণ্ডস, পেপসোডেন্ট -বিড়লা-টাটা-রিলায়েন্স-বাজাজ-হিন্দুজা-মহিন্দ্রা । কাগজে টিভিতে কতোরকম নখরা । গাজোয়ারি নয়, সব বুদ্ধির খেলা । এই বিজ্ঞাপনের খরচ তুলতে, কতো রকমের প্যাঁচ -- কতোরকম ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ ---’ওঁ হ্রী হ্রী শ্রী ওঁ লক্ষ্মীবাসুদেবায় নমঃ।” ক্রেতাকে বিব্রত না করে বাজার দখল করতে হবে । সে গল্প শোনায় পিনাকী । গল্পের নায়ক সুব্রত । কোম্পানির মাল্টিন্যাশানাল, কোম্পানিতে অনেক কবি-লেখক-ডকু ফিল্মমেকার একাধিক । সবাইকে টপকে অ্যাসাইনমেন্টটা পায় সুব্রত । অফিস থেকে ত্রিশ হাজার টাকা নিয়ে পুরীতে এসে হোটেলে ওঠে । সে খায় দায় আর লক্ষ্য করে কে কেমনভাবে টুথপেস্ট ব্যবহার করে । মুখশ্রীতে কেমন মহিমা খেলা করে । ব্রাশের ডিজাইন দ্যাখে, টিউবের প্যাকিং । ফেনা, গল্প, স্বাদ, মেজাজ । ব্রাশের আকার ছন্দ দ্যাখে । গাদা ব্রাশ-টুথপেস্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করে । এভাবেই সে পেয়ে যায় সূত্র । কেল্লা ফতে ---
    ‘স্রেফ টুথপেস্টের টিউবের মুখটা এক মিলিমিটার বাড়িয়ে দিতে হবে । গোপন থাকবে এই কৌশল । দাম মাত্র দুটাকা কমিয়ে একটা ঝুটো মিতব্যয়িতার গিমিক ধরে রাখা হবে বাজারে । অধবা গোড়ার দিকে সঙ্গে একটা গিফট বা কুড়ি পার্সেন্ট এক্সট্রা পেস্টের ভড়ং । মনোযোগের কেন্দ্র সরিয়ে দিতে । তাহলেই ফর্টি পার্সেন্ট অতিরিক্ত টুথপেস্ট ড্রেনআউট হয়ে যাবে । কেননা টিউবের মুখের ডায়ামিটার আগের চেয়ে বেড়ে গেছে । স্রেফ এক মিলিমিটার ।’ ( শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বচন )
              “কালখণ্ডের চমৎকার কৌতুক হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের বাজারায়ন তথা বিশ্বপুঁজিবাদ । একথা বোধহয় বাংলা সাহিত্যে আধিপত্যবাদীরা বুঝে ওঠার আগেই বুঝে ফেলেছিলেন কতিপয় গোত্রচিহ্ণহারা দ্রোহপুরুষ, যাদের মধ্যে অন্যতম সমীর রায়চৌধুরী । শৈলী বা প্রকরণ মেনে সমীর কখনও গল্প লেখেননি । তাঁর পাঠকাঠামোয় কারো প্রভাব নেই । একেবারেই ভিন্ন এবং তাৎপর্যপূর্ণ । স্তন্যপায়িনীর পৃথিবীতে চলতে চলতে আবার সেই জাদুবাস্তবতা --- আছে আর নেই । 
              “ভূখণ্ডের ক্ষয়, নিসর্গের ক্ষয়, এর মধ্যে জাদুবাস্তবতা খুব বাড়তি মনে হলেও ময়লা নয় । বিষয়টি আমাদের সাহিত্যে নতুন মনে হলেও বিশ্বসাহিত্যে নতুন নয় --
    The term magic realism, originally applied in 1920 to a school of painters, is used to describe the prose fiction of Jorge Luis Borges in Argentina, as well as the work of writers such as Gabriel Garcia Marquez in Colombia, Isabel Allende in Chile, Gunter Grass in Germany, and Joh Fowels in England. These writers interweave, in ever shifting pattern, a sharply etched realism in representing ordinary events and descriptive details together with fantastic and dreamlike elements, as well as with materials derived from myth and fairy tales ( A Glossary of Literary Terms, M.H.Abrams)
              “আমাদের জীবনে বাস্তবতা একাধিক । যেমন নিত্যবাস্তবতা, অদ্ভুত বাস্তবতা, রূঢ় বাস্তবতা, দিব্য বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা । দুঃখ এবং সৌন্দর্যে ভরা এইরকম লাগামছাড়া বাস্তবতার জীব আমরা নাটকের কুশীলব, চিকিৎসক, সমাজসেবিকা, মিথ্যাবাদী, কবি, ভিখিরি, যোদ্ধা । সবার জীবনযাপনে পদ্ধতির পার্থক্য আছে । এই পার্থক্যের ব্যাপারে যিনি যতোটা সচেতন তিনি ততোটাই সার্থক বস্তুবাদী । সমীরের চোখ সরাসরি নিত্যসুন্দরের দিকে থাকলেও, মার্কেস এবং গুন্টার গ্রাসের মতো জাদু-ভেল্কি-মন্ত্র-তন্ত্র বাদ যায়নি । বিশ্বায়নের মজা বাদ যায়নি । যেভাবে কল্লোল যুগের লেখকরা নতুন ঘরানার সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন, নির্মাণ করেছিলেন নতুন ভাষার, তেমনি সমীর আনলেন কল্লোল পরবর্তী অধুনান্তিক টাইমস স্টাইল, প্রকৌশল । গদ্যভাবনার গুণমাহাত্ম্য ভিন্নমাত্রা পেল । বিজ্ঞজনেরা ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে তার পাঠবস্তুর মাপজোক করল, পরিসর পরিস্হিতি এবং মুক্ত সূচনা, মুক্ত সমাপ্তির লক্ষণ খুঁজল, বিবাদ সৃষ্টি করতে পারল না ।
              “সময়ের ক্ষয়, আতঙ্ক, সন্ত্রাস, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বাতাবরণ মানেই উত্তরআধুনিক, একথা সমর্থন করেন না সমীর । তার চেনা-অচেনা শব্দসকল, সাবঅলটার্ন কথাবিশ্ব অধুনান্তিক বিশ্বায়নের সারবস্তু । সমীরের পাঠবস্তু ন্যারেটিভ নয়, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফর্মবর্জিত । তার রচনায় অদ্ভুত ভাষাবুলি ঝুড়িঝুড়ি, যেমন---
    দিলফাড়, ঠাওর-ঠিকানা, মিল্লত, উড়ানমনস্ক, বুজরুকি, আলিশান, কাঁটোকা হার, দিল-জ্বালানি, হিট-রহস্য, দীর্ঘ জুম ফোকাস, ফিলিম, তুক মেলানো, বেপর্দা, কাঁইয়া, স্তনের ডৌল, জৈবতাপ, মনমর্জি, লালফুটকি, চিৎপুতুল, ঢালাউপুর ( ‘খুল যা সিম সিম’ গল্পগ্রন্হ থেকে )
              ‘গোলগল্প থেকে গালগল্প : একটি অর্বাচীন ডায়ালগ’ প্রবন্ধে ‘শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর মাঙ্গলিক বাচন’ বিশ্লেষণকালে শাশ্বত সিকদার বলেছেন :-
              “সমীরের লেখায় আমরা স্পষ্টত যা পাচ্ছি তা হল স্মৃতি আর কল্পনার দোলাচল । কোথাও বোঝার সঙ্জ উপায় নেই, কোনটা রিয়েল লাইফ ফিকশনের অংশ, কোনটা বাজিয়ে তোলা । সদ্য নোবেলপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক কোয়েটজির ‘এলিজাবেথ কোস্টেল্লো’ উপন্যাসেও আশ্চর্যভাবে বাস্তব ও মনগড়া চরিত্ররা মিলেমিশে থাকে । এর পরে, সমীর পাঠবস্তুর বাইরে থেকে সবজান্তা চালে বানোয়াট গল্প ফাঁদছেন না । পা ফেলছেন না নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে । তিনি নিজে অংশগ্রহণ করছেন রচনার অন্তবর্তী ব্যবসাবিষয়ক প্রতিবেদনে । অনেকের স্বরের সাথে চালাচ্ছেন ইনটারাপ্টেড ডিসকোর্স । নিজের বৈচিত্র্যময় ডায়াস্পোরিক অভিজ্ঞতার লক্ষ্মীর ঝাঁপি খুলে তিনি বার করে চলেছেন একটার পর একটা রসদ ।
              “আমাদের মনে হয়েছে, সমীরের সব গল্পই আসলে, একভাবে, তাঁর অলিখিত আত্মজীবনীর টুকরো অংশ । পাণিহাটীর শৈশব আর কর্মসূত্রে বিহার-ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের দ্বৈত ডায়াস্পোরিক অভিঘাত সমীরের জীবনকে অনবদ্য সব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছে । সমীরের ভূগোল হয়েছে আশয়, তাই তাঁর ইতিহাসও হয়েছে সীমাহীন । আর তাই তাঁর গল্পে হাঁটাহাঁটি পা ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন পরিসরের ভূগোল, ইতিহাস, প্রান্তিক মানুষজনের ঘামের টাটকা গন্ধ । অবলোকন প্রতিভার জাদুতে বর্ণিত এইসব ঘটনাগুলোর চারপাশের অদ্যাবধি আলো-না-ফেলা অঞ্চলগুলো এসেছে প্রকাশ্যে । সমীর তাকে হিরের মতন শব্দের আলো ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা তরতরিকায় দেখেছেন ।”
              দাদার গল্পের পাশাপাশি যে বিদেশি  লেখকদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁরা হলেন টমাস বার্নহার্ড, পিটার হাণ্ডকে, জন ফাউলস, অ্যাঞ্জেলা কার্টার, জন বানভিল, মিশেল টোরনিয়ার, গিয়ানা ব্রাশচি, ইউলেম ব্রাকমান, লুইস ফেরন প্রমুখ --- যাঁদের গদ্য একযোগে জাদুবাস্তব ও উত্তরাধুনিক । পরাবাস্তবের প্রভাবের কথা বলব না, কেননা দাদা পাণ্ডুলিপিতে যথেষ্ট কাটাকুটি করতেন এবং স্বগতলিখন লিখতেন না, লেখার আগে কাহিনিটি নিয়ে প্রচুর চিন্তা করতেন, বিভিন্ন রেফারেন্স বই ঘাঁটতেন । “হাওয়া ৪৯”-এর যে বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিটির বনেদে একটি গল্প বা কবিতাগুচ্ছ প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দাদার চিন্তায়, যেমন জটিলতা, সংকরায়ন, অপর, অধুনান্তিকতা, উত্তরঔপনিবেশিকা, ইকোফেমিনিজম, সীমা, ভারতত্ব, ডায়াসপোরা ইত্যাদি। বস্তুত ম্যাজিক রিয়্যালিজম অভিধা এতো বেশি প্রয়োগ হয়েছে, বিদেশে তো বটেই, এদেশেও, যে এসকেপিস্ট ফিকশানকেও অনেকে জাদুবাস্তবের পর্যায়ে ফেলছেন, ফলে বিনোদনের জন্য বা বাজারকে সন্তুষ্ট করার জন্য যে অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিম ফিকশান লেখা হচ্ছে. তাদেরও জাদুবাস্তব বলে চালানো হচ্ছে ।
              জাদুবাস্তব এসকেপিস্ট ফিকশান নয়, বিনোদনের জন্য নয়, বাজার ধরার জন্য নয় । এই ফিকশান আমাদের জগতকে চিহ্ণিত করে এবং তাতে আমাদের অবস্হানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ; সত্যগুলোর বার্তা পাঠায় অথবা তাদের অন্বেষণ করে । জাদুবাস্তব অত্যন্ত সিরিয়াস ফিকশান এবং তাতে গদ্যবিন্যাসের কাজ জরুরি । লেখক চেষ্টা করেন একটি বাক্যের মধ্যেই অতীত-বর্তমান ভবিষ্যতকে উপস্হাপন করতে । প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক বাস্তব থেকে এই বাস্তব পৃথক । জাদুবাস্তব ফিকশান চিন্তার পরীক্ষানিরীক্ষা নয়, দূরকল্পনামূলক নয়, তার বিশ্ববীক্ষা অবজেকটিভ মেইনস্ট্রিমের বাইরে । 
              ‘সিগারেটের তিরোভাব’ গল্পটি নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন (কালিমাটি নং ৯৩), আমি প্রসঙ্গিক অংশগুলো তুলে দিচ্ছি :-
              “এই গল্পে রয়েছে কথক ও তাঁর দৌইত্রী পিংকির মধ্যে স্নেহমধুর ভাবের আদানপ্রদান ও পিংকির দাদানের ( ঠাকুরদা ) মৃত্যু নিয়ে জেগে ওঠা সামাজিক পারলৌকিক সংস্কারবাহিত কিছি চিত্র । এই গল্পে সিগারেট দেহের বিকল্প হিসাবে দেখা দিয়েছে । দাদান অবিনাশবাবু ছিলেন চেন-স্মোকার । তাঁর মৃত্যু যেন সিগারেটের তিরোভাব । তাঁর সহসা মৃত্যুতে বাড়িতে শোরগোল পড়ে গেল, শোকের ছায়া নেমে এল। পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের কাজ এগোতে লাগল। পিংকির মনে নানান প্রশ্ন । দাদুকে তার উত্তর যোগাতে হয় । পরদিন সন্ধ্যাবেলায় পুরোহিত এলেন শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ব্যবস্হার জন্য । কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখে বিধান দিলেন ---’ত্রিদোষ ঘটেছে । দানদক্ষিণা বেশি লাগবে । ষোড়শদান । আত্মাদেবতার তুষ্টি । বিশদভাবে অনুষ্ঠান প্রয়োজন।’ 
              “এক দৃষ্টিতে দেখলে ( আধুনিকতাবাদী ) এসব হল পুরোহিত অং-বং-চং । অবসলিট শাস্ত্রে এসব পাওয়া যায় । পরলোক অস্তিত্বহীন । কিন্তু তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান জানাচ্ছে, এগুলো ওরকম হুশ করে কালো কাকের মতো উড়িয়ে দিলে চলবে না, বরং এর ভিতরেও ফেলতে হবে সন্ধানী সার্চলাইট । মৃত্যু নিয়ে ভাবনার শিখা উসকে দিয়েছেন কাহিনিকার সমীর রায়চৌধুরী । লিখছেন:-
    ‘কিছুকাল আগে মরে যাওয়া ভাবলে কষ্ট পেতাম । যত দিন যাচ্ছে মৃত্যু নিয়ে ভাবনা পাল্টাচ্ছে । বাবা মা ন-কাকিমা ছোড়দি কিছু প্রিয় বন্ধুবান্ধব আর এই দাদান মারা যাওয়ার পর, মৃত্যুর এলাকাকে ফাঁকা লাগে না । একা বলে মনে হয় না । মনে হয় মৃত্যুও বসবাসের যোগ্য ।’
              
              “এককালে মৃত্যুর এলাকাকে ‘অমুত্র’ বলা হতো । আমি শব্দটির মধ্যে রস পাচ্ছি তাই একে ফিরিয়ে আনতে চাইছি : 
    ‘পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে... ন এব ‘ইহ, ন ‘অমুত্র’ ( হে পাত্র, বৈদিক কর্মত্যাগ করা সত্বেও যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি ইহলোকেও পতিত হয় না, পরলোকেও নিকৃষ্ট শরীর প্রাপ্ত হয় না ) [ গীতা, ধ্যানযোগ ৬.৪০ ]
              “পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান বলতেন, পদার্থবিদ্যার সমস্ত সমীকরণকে একটি মহাসমীকরণের মধ্যে পুরে ফেলা যায় । সেই মহাসমীকরণ হল Unworldliness = 0, সংক্ষেপে U = 0 এখন এই           Unworldliness এর বাংলা করছি ‘অমুত্র’ । এই সমীকরণের অর্থ পদার্থবিদ্যার সবকিছুই ইহসর্বস্ব ( Worldly) ; ইহলোকের বাইরে কিছুই নেই ; কিন্তু এই দৃষ্টিতে অধিবিদ্যার ( Metaphysics )             সম্ভাবনাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে । তৃতীয় তরঙ্গের পোস্টমডার্ন বিজ্ঞান কিন্তু তা চাইবে না । সে বলবে -- ‘অমুত্র’ আছে । আছে তার নির্দিষ্ট গঠন । মৃত্যুর পর সেখানে যাওয়া যেতেই পারে । একে বলি প্রেতলোকের অসমীকরণ। গল্পকার সমীর রায়চৌধুরী আন্দাজ করেছেন এই অসমীকরণের অন্ধকারে দৃষ্টি চালিয়ে--
    ‘যারা মারা যায় তারা বোধহয় স্বজনের মৃত্যুর দ্বিধা সংগোপনে চুরি করে নিয়ে যায় । প্রেতলোকে আর খারাপ লাগে না।
    এদিকে পুরুতঠাকুর বলেছেন, বৈতরণী, চতুর্ধাশান্তি, ষোড়সদান, ভোজ্যউৎসর্গ --- শ্রাদ্ধানুকল্প -- মনোময় কোশ --- সে অনেক ব্যাপার ।’
              “মনোময় কোশের পর হল বিজ্ঞানময় কোশ, যেখানে তৃপ্ত আত্মার বাস, যেখানে ‘ইহ’ (This) এবং ‘অমুত্র ( That ) -- দুই পৃথক নয়, দুই জুড়ে সন্ধি হয়ে রচিত হয়েছে  ‘ইহমুত্র’ যা স্বামী বিবেকানন্দের প্রিয় শব্দ ছিল । এই ইহমুত্রই গোটা জগৎ । মনোময় কোশে এদের দুই খণ্ডকে আলাদাভাবে দেখা হয় । আলাদাভাবে দেখা হলেও এদের মধ্যে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায় না, কোয়ান্টাম দর্শন এখানে কাজে লাগে । পিণ্ডদান কিংবা ভোজ্য উৎসর্গের পদ যেন এক একটি  Wave-packet । সেই পদগুলি, এক্ষেত্রে, গল্পকার জানাচ্ছেন, স্হির হল…
    ‘হিঙের কচুরি, বেগুনি, মোচার ঘণ্ট, কইমাছের ঝালদে, দই ইলিশ, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, এবং চা-সিগারেট’
              “সিগারেট তাহলে পুরুপুরি তিরোহিত হচ্ছে না, চলছে মৃতকের সহানুকল্পে --- অমুত্রের দিকে । তবু শ্রাদ্ধদিবসের দিনে অবিনাশবাবুর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের সিগারেট প্যাকেট খুঁজে পাওয়া গেল না, কিনেও আনা হল না, ভোজ্য উৎসর্গের থালায় একটি পদ রিক্ত থেকে গেল
             “এই না পাওয়া নিয়ে সমীর রায়চৌধুরীর গল্পে দ্বিতীয় এপিসোড । স্কুলে পিংকির জামার মধ্যে শুঁয়োপোকার প্রবেশ, শুঁয়ো ফোটানো ও পিংকির জ্বর, শুঁয়োপোকা বন্ধন ও প্রজাপতি মুক্তির প্রাণময় উপস্হিতি। সেই বন্ধন ও মুক্তি ক্রমশ ‘ইহ’ ও ‘অমুত্রে’ও ।
             “ স্কুলে গিয়েছিল পিংকি, তার গায়ে শুঁয়োপোকা উঠেছে, গায়ে ফুটিয়ে দিয়েছে শুঁয়ো । পিংকির বেশ জ্বর । ডাক্তারবাবু এসেছেন। সন্না দিয়ে শুঁয়ো তোলা হয়েছে, মলম লাগানো হল । দাদুকে দেখে পিংকির তোড়ে কান্না-- ‘শুঁয়োপোকা কেন স্কুলে গিয়েছিল ?’ জন্মদিনে পিংকিকে দাদু উপহার দিয়েছিলেন লতাপাতা আঁকা সবুজ জামা । সেইটি পরেই কি স্কুলে গিয়েছিল পিংকি ? উত্তর এখানে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ যাই হোক না কেন --- অন্তরালে দেখি সম-অভিযোজনের দোলা, পিংকি ও শুঁয়োপোকা একই বিন্দুতে পৌঁছোচ্ছে ।
              “কথক, পিংকির দাদু, পিংকির কান্না থামানোর জন্য তার ডলপুতুল ন্যান্সির খোঁজ করেন । সেই পুতুল পাওয়া যায়, জুতোর বাক্সের ভিতরে উল্টোনো অবস্হায়, এবং কী আশ্চর্য, সেই পুতুলের বুকের নিচে -- সেই আত্মার তৃপ্তিকর রিক্ত পদ --- সিগারেটের প্যাকেট । লোভনীয় সিগারেট, তবু কথক, পিংকির দাদু সেই প্যাকেট খোলেন না শেষ পর্যন্ত -- যেখানকার বস্তু সেখানেই ফিরে যাক । ওঁ নমো ।”
               দ্বিতীয় পর্বের ফিকশনে দাদার ন্যারেটিভ কেতা হয়ে উঠেছিল সহজাতভাবে অন্তর্ঘাতী, পরাভবী এবং তাতে রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার প্রতি খোঁচাগুলো মজার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যেমন, ওষুধের জন্য আমাদের দেশ সেই গন্ধমাদন পর্বেই রয়ে গেছে আর বিদেশ থেকে আনছে নানা ধরণের ক্যারদানি । একই ন্যারেটিভ কন্ঠস্বর প্রয়োগ করে তিনি বাস্তব এবং জাদুর মাঝে পর্যয়ানুবৃত্তি ঘটিয়েছেন, কিন্তু দুটির মাঝের পালাবদলকে এমনভাবে ন্যারেটিভে বুনে দিয়েছেন যে বোঝার উপায় নেই কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব। ফলে বাস্তব আর ইন্দ্রজালের বাইরে একটা তৃতীয় জঁর তৈরি করতে পেরেছেন, যেকারণে পোস্টস্ট্রাকচারালিস্ট তত্ত্বের মাধ্যমে বলা চলে যে তাঁর ন্যারেটিভের একাধিক ব্যাখ্যা হতে পারে । পর্যায়ানুবৃত্তির কারণে একটিমাত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কন্ঠস্বরকে প্রতিরোধ করে পাঠবস্তুগুলো । তাঁর ন্যারেটিভের কেতাটি সীমাগুলোকে অনুসন্ধানের পর লঙ্ঘন করে, সে সীমা রাজনৈতিক হোক বা ভৌগলিক হোক বা তাত্ত্বিক হোক বা বস্তুবর্গীয় হোক । সীমাগুলোকে ভেঙে তিনি উত্তরঔপনিবেশিক ভারতের সমাজ, গণতন্ত্র, ধর্মদ্বেষ, সন্ত্রাস, জাতিপ্রথা, দারিদ্র, দলীয় রাজনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির সত্যগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন । পাঠকের মনে সন্দেহ চাগিয়ে তোলেন যে বাস্তবের বৈশিষ্ট্য যদি চূড়ান্ত না হয় তাহলে সত্য সম্পর্কে যাবতীয় অনুমানই ঝুঁকিআক্রান্ত। ক্ষমতা থেকে যাদের বঞ্চিত করা হয়েছে সেই ‘অপরদের’ বাকজগতকে প্রয়োগ করতে হয়েছে তাঁকে । ঔপনিবেশিক ও উত্তরঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রকরা, এদেশে হোক বা বিদেশে, ‘অপর’ সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রেখে যে অবাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, জাদুবাস্তবতার মাধ্যমে তিনি তা উপস্হাপন করেছেন তাঁর ফিকশানগুলোয়।
              ১৯৯৯ সালে লেখা “খননকার্য” গল্পে কথকের মাসিমার শাবল হারিয়ে দিয়েছেন কোনো কবিবন্ধু কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে । শাবল দিয়ে একজন  কবি কেঁচো খুড়ছেন, কেন, তাঁর কেঁচো কেন দরকার, কথক সেকথা পরে জানিয়েছেন যে খোঁড়াখুঁড়ি কবিদের কাজ, অর্থাৎ এক ধরণের কবি কেঁচোর সন্ধান করে পুরস্কৃত হন । কথক কবিবন্ধু সম্পর্কে তাঁর খোঁচাটি লুকোননি, স্ত্রীকে বলছেন :
    ‘তা বড়ো বড়ো নামকরা কবিবন্ধু থাকলে ওসব একটুআধটু হবে, দাড়িওয়ালা ভক্তিপ্রসাদকে তো বহুবার দেখেছ, একটু বেশি মদ খেতে ভালোবাসে, একবার বাড়ি এলে সহজে যেতে চায় না, সাহিত্য অকাদেমি আনন্দ পুরস্কার, অনেক সব প্রাইজ পেয়েছে, তুমি তো আগে দেখেছ, আর ওই ঝাঁকড়াচুল জ্ঞানপীঠ পেয়েছেন পদ্যলেখার সবচেয়ে বড়ো প্রাইজ, খুব অসাধারণ সব লোক, একটু আধটু হুঁশ কম থাকে, কবি হলে ওসব হয়, অতশত তুমি বুঝবে না, পদ্য লিখলে বুঝতে, ব্যাপারই আলাদা । ওরা সব একধরনের অমর মানুষ ।’
              মাসিমার লোহার শাবলের বদলে ভালো স্টেনলেস স্টিলের শাবল কিনে এনে দেবার পর মাসিমা জানান যে পুরোনো শাবলটা ওঁর শশুরমশায়ের, ওঁর স্মৃতির, বাড়ি তৈরির সময়ের অনেক গল্প আছে পুরোনো শাবলে, নতুন শাবল তা যত ভালোই হোক মাসিমার চাই না, পুরোনো শাবলের সঙ্গে তাঁর জীবনের গল্পও হারিয়ে গেল । অর্থাৎ অন্যের পারিবারিক ঐতিহ্য সম্পর্কে কবিরা আগ্রহী নন, তাঁরা কেবল পদ্য লিখে প্রাইজ পেতে চান এবং ‘একধরনের অমর মানুষ’ হতে চান ।
            ১৯৯৩ সালে লেখা “টিনিদির হাত” গল্পে দাদা শৈশবের হুলাসচাচার ‘রামচরিতমানস’-এর প্রশ্নাবলীর খেলাকে এনেছেন এবং ন্যারেটিভে সংযোজন করেছেন বিভিন্ন মাত্রা, প্রেমের, হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, ছোটোলোক-ভদ্রলোক বিভাজন এবং ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসের গুরুত্ব, যা ঔপনিবেশিক চাপ সত্ত্বেও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনে টিকেছিল । হুলাসচাচার ‘রমাচরিতমানস’ খেলায় একটি শলাকা দিয়ে বইতে নির্দেশ করলে হুলাসচাচা নির্দিষ্ট চৌপাই ব্যাখা করে ভবিষ্যত বলে দেন । বালক কথকের প্রতিটি ইচ্ছে পূরণ হয়েছে শুনে তার বন্ধ সুলেমানও খেলতে আসে, মনস্কামনা পূর্ণ হয় কিন্তু তার গাছে চাকা-চাকা ঘা দেখা দেয় । কথকের হিন্দু পরিবার মনে করে গোরুর মাংস খাবার কারণে হয়েছে ; সুলেমান মনে করা হিন্দুর গ্রন্হের খেলা খেলার জন্য হয়েছে । কথকের বাবা ঘায়ের ওষুধ দেন যা কথক ভুলিয়ে খাওয়ায় সুলেমানকে, খুদাবক্স ডাক্তারও ওষুধ দেন, আনোয়ারের দোকানে গিয়ে গোরুর মাংস খায় সুলেমান, টিনিদি আদর করে হাত বুলিয়ে দেন সুলেমানের মাথায় । সুলেমানের অসুখ সেরে যায় । বালক কথকের মনে সন্দেহ জেগে ওঠে যে এইগুলোর মধ্যে ঠিক কোন কারণে সেরে গেল সুলেমানের অসুখ ।
              “টিনিদির হাত” গল্পটিতে জাদুবাস্তবতা হল ‘রামচরিতমানস’ এর রামশলাকা খেলা আর হুলাসচাচার ভবিষ্যৎবাণী প্রত্যেকের ক্ষেত্রে অব্যর্থ হওয়া । গল্পটির মাধ্যমে দাদা দৈব ঘটনাকে বাস্তবের রূপ দিয়েছেন, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে উদ্ভাবনাকে গুলিয়ে দিয়েছেন, যার দরুন চাপ সৃষ্টি করেছেন বাস্তব সম্পর্কিত ধারনায় । ইউরোপের আনা বিজ্ঞান ও যুক্তিনির্ভর ‘আলোকপ্রাপ্তির’ আঠারো শতকী প্রভূত্ববাদী সংস্কৃতির চাপকে আক্রমণ করেছেন সনাতন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আচরণের মাধ্যমে । আলোকপ্রাপ্তির ঔপনিবেশিক চাপ অনুগত করতে চেয়েছিল কেবলমাত্র বিজ্ঞান ও যুক্তির দ্বারা, যখন কিনা সাধারণ ভারতীয়রা যেযার সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের নিজস্ব সত্যকে বাতিল করতে চায়নি । ‘অপর’-এর দৃষ্টিতে দেখলে, যেটা দাদা তুলে ধরতে চেয়েছেন এই গল্পে, যুক্তিহীনতাও জীবনের বহু ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারে, এবং বাখতিনের বক্তব্য ধার নিয়ে বলা যায় এক্ষেত্রে দেখা দেয় হেটেরোগ্লসিয়া বা বহু পরস্পরবিরোধী কন্ঠস্বর, ভারতের চিন্তাভাবনার সাস্কৃতিক বহুত্ব, নানাধর্মিতা, পারস্পরিক বৈভিন্ন্যকে ফিকশনটি আলোকিত করে ।  
              হাংরি আন্দোলনের আগে এবং হাংরি আন্দোলনের সময়ে দাদার যে তিনটি কাব্যগ্রন্হ বেরিয়েছিল, সেগুলো নিয়ে দাদাকে একটা বই বের করতে বলেছিলুম, কিন্তু বইগুলো উনি নিজের কাছে রাখেননি, কারোর কাছ থেকে সংগ্রহ করতেও পারেননি । বইগুলো হল “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি”, “জানোয়ার” এবং “আমার ভিয়েৎনাম”। আমি কৃত্তিবাস সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে দাদার কয়েকটা কবিতা তুলে দিচ্ছি যা থেকে স্পষ্ট হবে যে কৃত্তিবাসের লিরিকাল ধারা থেকে কীভাবে উনি ধাপে-ধাপে বেরিয়ে গেলেন ।
              “ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি” পর্বের কবিতা ( দাদার মেয়ের নাম হণি, সেই সময়ের কবিতা ) কৃত্তিবাস পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল :
    হণির ভিতর দিয়ে দেখা যায়
    জাহান্নমে যাক গ্রহনক্ষত্রসমূহ ভেঙে পৃথিবীও যাক জাহান্নমে
    লাথি মেরে সব ভেঙে চুরমার করে দিলে, কাল আমি সহাস্যবদনে
    হাততালি দিয়ে মঞ্চে কোনোরূপ গ্লানিহীন নুরেমবার্গের আদালতে
    তুড়ি মেরে কাঠগড়া মুঠোয় গুঁড়িয়ে তোমাদেরও পারতাম ভেলকি সুবিস্তারে ।
    সৌরমণ্ডলের পথে তছনছ পৃথিবীর অন্ধকার ফেরি আবর্তন
    কোনোরূপ রেখাপাত সম্ভব ছিল না গ্রন্হে হৃদয়ে মেধায়,
    আমার শরীর ঘিরে ইহুদির হিন্দু শিখ মুসলিমের আততায়ী আদর্শের
                                                              ঘৃণ্য রক্তপাত--
    আমাকেও জয়োল্লাস দিয়েছিল মূত্রপাতে পোষা রাজনীতি ।
    তোমাদের আস্ফালনে বিনয়ী মুখোশ ঘিরে আমার হণির জন্মদিন
    আমারই মুখোশ ধরে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলে আর্ত চিৎকারে--
    ধান উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ এখন পেয়েছি শুঁকে কৃষকের উর্বর শরীরে
    কুমারী মহিলাদের উজ্জ্বল মসৃণ দেহে বহুবার হাত রেখে উত্তরনিশীথে
    পরাগ চমকে ওঠে, স্পর্শ করে নারীর সমগ্র দেহ জুড়ে
    আশ্রয় ছড়ানো আছে প্রীত এক ধরণের মিহি রুখু বালি ।
    ক্রমে এই সমস্তই নাভির ভিতরে আনে রুদ্ধ আলোড়ন,
    জেগে ওঠে মৃগনাভি, চেয়ারে টেবিলে গ্রন্হে অম্লান মাঠের ভিতরে
    ধু-ধু রিক্ত প্রান্তরের দিকে শাবক প্রসব করে রঙিন প্রপাত,
    চারিদিকে ফলপ্রসূ হয়ে গেছে রাশিরাশি প্রতিহারি ধান---
    #
    মনে হয় বহুক্ষণ মাঠে মাঠে গড়াগড়ি দিয়ে বিছানায় উঠে আসে নারী
    ক্ষুধার্ত শিকড়গুলি ঢুকে যায় নীড় আস্বাদনে,
    তখনই উৎপন্ন হওয়ার গন্ধ জাগে, কৃষকের উর্বর শরীরে
    প্লুত আবছা আঁধারে তাই বারবার মনে হয় পৃথিবীর সহজ সুদিন
    ফিরে এলো সুধাশান্তি
    আমার হণির জন্য তোমাদের কাছে আমি ঋনী চিরদিন ।
    এই কবিতাগুলো কৃত্তিবাস পত্রিকার কুড়ি নং সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল :-
    ব্যক্তিগত ন্যাপথালিন
    বাক্স খুললেই ভবঘুরে সুখ
                   ন্যাপথলিন তীব্র ন্যাপথলিন
    ন্যাপথলিনের গন্ধে সংসার উন্মুখ
    নিজস্ব ডেটল
    ছুটে আসে হাসপাতাল অতিউগ্র তরল শেফালি
    বুকে রাখা কোতোয়াল ভেদ করে তীব্র অশ্রুপাত
                                       স্পর্শ করে লুকানো ডুমুর ।
    হনির মুখশ্রীছবি আমাদের আবহাওয়া রিপোর্ট
                                       আমাদের বুঁদ জলবায়ু
    জারি রাখি উচ্ছন্ন মেয়াদ মৃত্যু বেহুঁশ টম্যাটো ।
    ক্রমশ হারিয়ে যায় আমার একান্তপ্রিয়
                                       টম্যাটোর লাল
    ছুটে আসে হাসপাতাল, অতিউগ্র তরল শেফালি
                            ছুটে আসে তিন লক্ষ উন্মাদ কুকুর
    নধর পালংশাক রেগে ওঠে হঠাৎ খুরপি লাগে বুকে--
    মনে হয় বেশ আছি ছেলেপুলে নিয়ে সুখে ।
    মৃতমন্ত্রীবিষয়ক নিধি
    আমিও শকুন হয়ে দেখতে চাই না আর নানাবিধ মড়া
    টক মিষ্টি ঝাল
    ওরা সব ছিল কাল
    আজ উঠে গেছে ঝাঁজ
    হঠাৎ পথের মোড়ে পুলিশের পক্ষে ওই মৃত বৃদ্ধ রেখে
    কিসের সুরাহা হবে ট্যাক্সিঅলা জানে
    এই অবসরে আমি চলে যেতে চাই কোনো আবছা আকাশে
    ঠুকরে দেখতে চাই টাটকা বিনোবা কতখানি ভেপসে উঠেছে ভেতরে
    ঝ্যান্ত মানুষ ঠুকরে
    দ্যাখা যায় গোপনীয় লাশ
    দ্যাখা যায় বাগানের লুকানো পলাশ
    এসোনা ঠুকরে দেখি তোমার প্রতিভা ।
              
              হাংরি আন্দোলনের সময়ে প্রকাশিত হয় দাদার কাব্যগ্রন্হ “জানোয়ার”, টের পাওয়া যায় কেন তিনি কৃত্তিবাসের কোটর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, কৃত্তিবাসের লিরিকাল জগত থেকে উত্তরঔপনিবেশিক বাস্তবতায় আক্রান্ত হয়েছিল তার সংবেদ, তা “রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক এই কবিতাটিতে স্পষ্ট :-
    ১.
    ঈশ্বরকে চিনে নেওয়ার জন্য আর আমার বেলপাতার দরকার নেই
    কবিতাকে চিনে নেওয়ার জন্য প্রয়োজন নেই ‘মতো’ আর ‘যেন’র
    জন্মভূমি স্বদেশ মাতৃভূমি চিনে নেওয়ার জন্য 
                                                দেশবাসীর এখন মানচিত্রের প্রয়োজন
    সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য চিনে নেওয়ার জন্য
                                               সমাজের দরকার পোশাক-পরিচ্ছদ
    নির্ধারিত উর্দি ভাগাভাগি করে গা্য়ে চড়িয়ে মানুষ
    অভিনেতা পুলিশ শুশ্রুষাকারী উকিল বিচারক আর নেতা হয়ে উঠছে
    আমি কলতলায় ন্যাংটো স্নান করে দেখে নিচ্ছি আমার গোপন পবিত্রতা
    শান্তি আর শৃঙ্খলার জন্য মানুষকে হত্যা করা প্রয়োজন
    স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জন্য কাঁদুনে গ্যাসের দরকার
    আদর্শ আর ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ আর শান্তির শর্তাবলী
    যে-কোনো ধারণার চেয়ে মানুষ আজ খাটো হয়ে পড়ছে
    ২.
    শিল্প ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    দেশ ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ধর্ম ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ভাষা ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সৌন্দর্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সংস্কৃতি ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    ঐতিহ্য ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    বিশ্বপৃথিবী ভালোবেসেছিল রবীন্দ্রনাথ
    সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তার সোনার বাংলা ভাগ হয়ে গেছে
    সেই রবীন্দ্রনাথের জন্মমৃত্যুর পরেও তারই গান গেয়ে
                          একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে খুন করছে
    ৩.
    কংগ্রেস আর মুস্লিম লিগের ক্ষমতার চেয়ে
    ধর্মান্ধ রাজনীতির বিশাল দাপটের চেয়ে
    রবীন্দ্রনাথের ক্ষমতা অনেক অনেক কম
    নজরুলকে মাসোহারা দিয়ে বিধানসভা চক্ষুলজ্জা ঢাকছে
    দশ হাজার শান্তিনিকেতন খুলে রেখে পৃথিবীকে শান্ত রাখা সম্ভব নয়
    দশ কোটি শান্তিনিকেতন খুলে রাখলেও
                        রাজনীতির হিংস্র বর্বরতা থামানো অসম্ভব
    পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ অব্দি ছুটে গিয়ে দেখেছি
                        পৃথিবীর কিছুই সুরাহা হয়নি
    মানুষকে ভালো করে তোলা আমার সাধ্যাতীত
    বহুদূর পথ হেঁটে গিয়ে আমি পুনরায় ফিরে যাচ্ছি 
                         আমারই অশ্লীল নিভৃত কোটরে ।
              “জানোয়ার” এর পর প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্হ “আমার ভিয়েৎনাম” । এখানে যে কবিতাটি তুলে দিচ্ছি, “পালামৌ -- ১৯৬৬”, তা “আমার ভিয়েৎনাম”  পর্বের। কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য দাদা লেখা পাঠাচ্ছেন না দেখে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দাদার কর্মস্হল ডালটনগঞ্জে গিয়েছিলেন কবিতা আনার জন্য । দাদা কবিতা লিখে দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিপে করে দেহরি অন শোন স্টেশানে ছেড়ে দিয়ে আসেন । দাদা ইচ্ছাকৃতভাবে হাংরি আন্দোলনকারীরা সেসময়ে যে ধরণের কবিতা লিখছিলেন, যা ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আমার আর সুবিমল বসাকের কবিতা পড়লে স্পষ্ট হবে, সেই ফর্মেই সামাজিক-রাজনৈতিক কবিতাটি দিয়েছিলেন ।
    পালামৌ -- ১৯৬৬
    পাঁচ হাজার কেঁচোর সঙ্গে মাটি খুঁড়ে ভেবেছিলাম
    ঘুম ভেঙে উঠে দেখব সবুজ বিশাল ভারতবর্ষ
    হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র ডেকে উঠবেন সমীর পালামৌ সমীর
    অথচ ভোটবাক্স নিয়ে আমি খুঁজে বেড়ালাম ভারতবর্ষের ভালোবাসা
    আমার গোপন তকমার লোভে কৃষকের লাঙল থেকে 
                             খুঁটে তুললাম প্রভূত ন্যাপথলিন
    কেননা পৃথিবীর সবচেয়ে নগ্ন আর মজবুত স্ত্রীলোকের নাম ভিয়েৎনাম
    এখন স্রেফ পাঁচ বস্তা চাল কিনে রেখে
                             আমি দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব সেরে নিচ্ছি
    কয়েকটা ব্যাপারে কেবল মহিলার আধিপত্য সহ্য হচ্ছে না
    আত্তিলার রক্তেও ছিল না একশো ভাগ নিরেট পৌরুষ
    বুঝতে পারছি না কেন আমার গর্ভধারণের ইচ্ছে হয়
    কেন আমার মসৃণ বুকে হাত রেখে মাঝরাতে হঠাৎ ককিয়ে উঠেছি
    আমারই যৌনতার মধ্যে খুঁজে দেখেছি নিজস্ব গোলাবাড়ি একান্ত বীজধান
    আমারই বীর্য থেকে স্রেফ আমারই শরীরে প্রসব চেয়েছি আমি
    অথচ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অভাবে মহিলাকে দিয়ে এলাম প্রেম আর কোকাকোলা
    ঠিক এই কারণেই কোথায় কতখানি সমীর পরখ করতে
    এক মহিলা থেকে ঘুরে বেড়ালাম অন্য শরীরের আনাচে কানাচে
    আমার বাঁ-চোখ থেকে খুঁটে তুললাম তিনশো জোনাকির হঠাৎ জ্বলে ওঠা
    গোলাপের চতুর্দিকে নিয়ন্ত্রিত কীটের উদ্বেগ অভিযান লক্ষ্য করে
    আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার বিবেকের তলপেট
    নিজের তৈরি বাস্তবিকতার সঙ্গে
                            পৃথিবীর বাস্তবিকতা মিলিয়ে দেখতে গিয়ে
    আমি টের পেলাম আমার ব্যক্তিগত ছাপাখানা
    কেননা প্রত্যেকবার একটা চৌরাস্তার কাছ-বরাবর এসে
                            আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাচ্ছি
    বাম আর দক্ষিণ কমিউনিস্টদের খেল কসরৎ ঈর্ষা দেখতে 
                          মার্কসের জরায়ু থেকে বের করে আনছি তিন লক্ষ সমীর
    ভোরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে কামরাজ পাতিল যেমন চোখে পড়া মাত্র
                          আমার মুখ তেতো হয়ে উঠছে
    স্বপ্নের প্রথম শর্ত
    মনে করো জেগে আছো তুমি
    শব্দ আর শব্দ বিনিময়ে কবিতার ধর্ম হয়ে ওঠে
    শপথের চেয়ে ঘৃণ্য কোনো পাপ নেই
    প্রতিটি গলির মোড়ে অন্য এক প্রতিজ্ঞায় রুখে
    এখন সাপের খেলা
    ভ্রূ-আঁকা পেন্সিলে আমি মহিলার চোখের পাতায় লিখছি অশ্লীলতা, নার্সারি রাইম ।
              কলকাতার বাঁশদ্রোণীতে পাকাপাকি আসার পর প্রায় দেড় দশক পর দাদা যখন লেখালিখি  এবং ‘হাওয়া ৪৯’ পত্রিকার সম্পাদনা আরম্ভ করলেন তখন তাঁর কবিতাভাবনায় এবং কবিতা রচনায় বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে । তার প্রধান কারণ সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের সমাজের রাজনীতির সংস্কৃতির যে নতুন রূপের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, তার সঙ্গে তাঁর কলেজ জীবনের অভিজ্ঞতার দুস্তর ফারাক অনুধাবন করতে পারলেন, প্রত্যক্ষ্য করতে পারলেন নবোদ্ভূত কেয়সকে, দেখলেন তার কেন্দ্রটি নিশ্চিহ্ণ । ফলত তাঁর কবিতায় কোনো ডমিন্যান্ট শৈলীর প্রভাব পড়ল না, কেননা কবিতার ক্র্যাফ্টকেই তুলে আনলেন কবিতার শরীরে ; তিনি ছবির সঙ্গে ন্যারেটিভকে এবং দার্শনিক বিবেচনা, প্রতিবর্তী ক্রিয়া, মুক্ত-সমাপ্ত পরস্পরবিরোধিতা, বুদ্ধিগত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, একই সঙ্গে একাধিক ঘটনা, দৃষ্টিভঙ্গীর পর্যায়ান্বন, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর, অসঙ্গতি, অপ্রত্যাশিত বাঁক, অর্থান্তর সৃষ্টিকারী ও আপাতবিচ্ছিন্ন চিন্তাপ্রবাহ মিশিয়ে দিতে লাগলেন । অনেক কবিতায় শৈলীটিকে ভঙ্গুর করে ফেলে তাকে ডায়েরির রূপ দিলেন । তাঁর কবিতাভাবনা পশ্চিমবঙ্গের তরুণদের মাঝে জলবিভাজকের কাজ করল ; একদিকে পরম্পরাবাদীরা এবং অন্যদিকে তাঁরা, যাঁরা কবিতার ক্র্যাফ্টকে কবিতারচনার প্রধান আগ্রহ করে তুললেন । কবিতায় “বিষয়”-এর মৃত্যু ঘোষণা করলেন, বললেন যে শিরোনাম হল কবিতার ‘রুবরিক’, তা কবিতাবিশেষের টাইটেল হোলডার নয় । প্রাগাধুনিক-প্রাকঔপনিবেশিক কবিতার মতন পরিসর তাঁর কবিতায় হয়ে উঠল শব্দমূল ও ধাতুকাঠামো সংক্রান্ত আগ্রহ । পাশাপাশি, যেমন তাঁর ছোটোগল্পে, তেমনই কবিতায় উঠে এলো বহুজাতিকতা ও ক্রনি পুঁজিবাদের দরুণ প্রভাবিত মানুষের অবদমন. মনোভঙ্গ, বিষণ্ণতা ; ব্যক্তিএককের বেদখল হয়ে যাওয়া চেতনা, পরিবেশ ও সংসার ।
              “জীবনানন্দ : সূর্য ও তপতী” প্রবন্ধে দাদা লিখেছিলেন, “কবিতার লক্ষ্য অনুভূতিদেশ । অনুভূতির গভীরে আছে আদি স্বাগতম । আছে সর্বভূতেষু জাগরণস্পৃহা । অহং ব্রহ্মাস্মি চেতনার অপেক্ষমাণ বুদবুদ । কবি সে আসঙ্গ-যুক্ততার কাতরতাকে উসকে দেন । শব্দ যোজনার সেই কালিক চেতনাকে অতিক্রমণ কবির লক্ষ্য । ঈষৎ অনন্যসাধারণ উত্তরসমাজকে ত্বরান্বিত ত্বরান্বিত ও আরো বেগবান করে তোলার তিনি চেতনার অভিমুখের মশালবাহক । সমাজ যত বেশি একলষেঁড়ে হয়ে পড়ে, একলপ্ততার প্রয়োজন তত বাড়ে । বহুরৈখিকতা, ময়ূরপঙ্খী বর্ণময়তা সেখান থেকে মুক্তি দেয় ।”
              তাঁর শেষ পর্বের কয়েকটি কবিতা এখানে তুলে দিই ।
    এই কবিতা দাঁড়াতে চায় না          
    কিছু কিছু শব্দের সকাল হয়ে আসছে
    কিছু কিছু শব্দের রিপেয়ারিং চাই দরকার জোড়া লাগানো
    কার সঙ্গে কিসের জোড়া সে-কথা পেয়ারিং শব্দের মধ্যেই আছে
    প্রয়োজন প্যার মহব্বত পিরিত পেয়ার
    পুরুষ প্রকৃতির তত্ত্বকথা না শোনালেও চলবে
     ছন্দ                                        
    প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু শব্দ পাশ ফিরে থাকে
    প্রত্যেক শব্দের মধ্যে কিছু অক্ষর থেকে যায় স্বল্প উচ্চারণে
    কিছু উপসর্গ প্রত্যেক ধাতুর সম্পর্কে থেকে যায় অর্থবিহীন
    বুঝ আর অবুঝের মধ্যে বোঝাপড়া রাখে কার্যসাধিকা
    নীলুদের সংসারে ছোটমাসি মুখ বুজে কাজ করে যায়---
    জটিলতার কাছে সোপর্দ রয়েছে 
            গতির অরৈখিক নকশা
                 অংশ-প্রীতি, ঘুম
                      যেভাবে বিশৃঙ্খলা ছন্দের মুখোশ ।
    নিজস্ব রোদের জন্য
    নতুন বাড়িটিতে যেদিন প্রথম বিকেলের রোদ এসে
    জীবনের খোঁজ নিয়েছিল সেদিন থেকেই এবাড়ির নিজস্ব রোদ
    নিজস্ব হাওয়া বাতাস নিজস্ব মেঘলার জন্ম
    সবকিছু যা একান্তই এবাড়ির
    যেভাবে কিছু রোদ কিছু বৃষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকা সংসার পাতে
    যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে
    যেভাবে ব্যক্তিগত রোদের কাতরতা নিয়ে একসময় 
    পশ্চিমের বারান্দায় অতসীলতাকে বাঁক নিতে দেখেছিলাম
    দেখেছিলাম রোদের জন্য ঠাকুমার হাপিত্যেশ
     এখনও মনে পড়ে যায় দ্বারভাঙ্গায় আমাদের ডাইনিং টেবিলে
                      চা পানের সঙ্গী এক চিলতে রোদ্দুর
    স্কুলের ছুটির ঘণ্টার সঙ্গে চলে যাওয়া রোদের অন্য এক সম্পর্ক ছিল
    যেমন কিছি কিছু ছায়ার সঙ্গে আমাদের নিভৃতের যোগাযোগ
    যেভাবে কিছু রোদ কিছু ছায়া ব্যক্তিগত সঞ্চয়ে জমা পড়ে
    যেভাবে স্হানিকতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চায় মহাভাষ্য থেকে ।
    আয়নাঘর
    ঘুম ভেঙে আয়নায় দেখি বাবার তিনকাল পেরোনো মুখ
    রাতে খুলে রাখা দাঁতের ডিবে খুঁজছে...
    ইসেবগোল খেয়ে ঘুমিয়ে ওঠা লোকটার শুকনো গলায় তেষ্টা…
    কোঁচকানো গালে ছ-দিনের দাড়ি, ভুরুর বাড়ন্ত চুল চোখ ঢাকছে…
    ফিটকিরির গুঁড়ো দিয়ে ঢিমেতাল মাড়ি শেষ যত্নে ধুয়ে নিচ্ছে…
    সাদা পাথায় তিনটে কালো চুল দেখে নির্বিকার ফোগলা শূন্য হাসছে…
    খুলে রাখা নাক কান চোখ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর দলিলে নেই
    বর্ণমালার ক্ষয়িষ্ণু অমৃতকণা ড্যাখে পরস্পর বর্ণগুলি মৌলকণা
    করোগেটেড কপালের বলিরেখায় কেওসের চিহ্ণ…
    ক’দিন বাদেই আসবে ডেটল না-রাখা টিনের কাঁচি চিরুনি…
    ইমলিতলার ভ্যানওয়ালা লটারি পাওয়ার গল্প শুনিয়ে যাবে…
    এমনই অনেক অনুভব ভব হয়ে উঠছে আয়নায় দেখা মুখের ভাঁজে…
    পেছন ফিরে দেখি চিরযৌবন আর কবিতার খাতা নিয়ে সমীর--
    শেফালির সঙ্গে বকখালিতে আজ ডেটিং
    পরস্পরের ভূপ্রকৃতি বাস্তুতন্ত্র গিরিখাত আগ্নেয়মুখ চিনে নিতে এখনও বাকি…
    কবিতার খাতা শেষ পাতায় লিখে রাখা ইজা
    আয়নাঘরে পেছনের আয়নায় বাবা পিতামহের মুখ দেখছে…
    প্রপিতামহ দেখছে প্রপৌত্রের মুখ
    পাঁচ রাউণ্ডের শেষে শেষ ডিফেন্সে আমি গোলপোস্টে একা
    নিশ্চিত গোল বাঁচিয়ে বিপক্ষের কর্ণার কিকের মুখোমুখি
    গোলার সামনে দুই জার্সি জটলায় পজিশন নিচ্ছে
    হেড-বেহেডে মাথার ওপর বল ঘুরছে ফিরছে
    পক্ষ বিপক্ষ বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছি
    ভয় এবার যদি পেনাক্টিকিকের হুইসল বাজে
    আয়নাঘরের মাঠে…
    [ রচনাকাল : জুলাই ২০১৬ ]
                                              
             
                                               
          
              

                                            

     

              
              
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১২:১৮738589
  • মলয় রায়চৌধুরীর নির্বাচিত কবিতা

    একা
    একাই লড়েছিলুম
    কেউ বলেনি 'হোক কলরব'
    একাই নেমেছিলুম
    ব্যাংকশাল কোর্টের ক্ষয়াটে সিঁড়ি বেয়ে
    সেদিন একাই
    কলকাতার পথে ঘুরেছিলুম
    সকাল পর্যন্ত
     
    লোভ
    হে দেবী সর্বভূতেষু আমি চাই না কিছুই
    তবু দৃষ্টিদানের আগে এইটুকু অভিশাপ দিও
    মাথা নামিয়ে কোনোদিন  যদি নিই উত্তরীয়
    বলির খাঁড়া দিয়ে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিও
    তাতে যেন তোমারই রক্তরোষ-চোখ আঁকা থাকে
    পুরস্কার নিতে যদি কোনোদিন বাড়িয়ে দিই হাত
    ছুটন্ত ট্রাকে বেঁধে আমাকে ঘসটানি খেতে দিও
    তাতে যেন তোমারই রক্তরোষ-চোখ আঁকা থাকে
     
     
    কদমবুছি
    এ নাও বাংলাভাষা, কদমবুছি নাও
    বাচিক বর্ণসংকরের কদমবুছি নাও
    এ নাও বঙ্গদেশ, কদমবুছি নাও
    অর্ধেক কাফেরের কদমবুছি নাও
    সামান্য ওপরে তোলো জামদানি
    পুর্ব ও পশ্চিম দুই পা এগিয়ে দাও
    ঠোঁট দিয়ে কদমবুছি দিই
    হে এপার হে ওপার
    কদমবুছির ছোঁয়া মনে রেখো
    যতোদিন পারো
     
    বাংলার ত্রস্ত নীলিমা
    সোনালী ডানার চিল নাই আর, কাঁদেও না, এখন কেবল
    সারাদিন ডিজেল-আকাশ জুড়ে শকুনেরা পাক খায়
    আপনার দেখা সেইসব বধূরাও নেই ; তারা সব ধর্ষিত হয়ে
    ধানসিঁড়ি নদীতীরে লাশ হয়ে আছে । উবে গেছে ব্রা্‌হ্মধর্ম--
    গাঁয়ে ও শহরে যখন-তখন দাঙ্গা লেগে যায়, লাশ পড়ে থাকে।
    .
    আমিও আপনার মতো মিশতে পারি না হায় সবায়ের সাথে
    মনে হয় বিশ্বাস করার মতো কিছি নেই, কেউ নেই
    বাংলার ত্রস্ত নীলিমা ছেড়ে, আত্মনির্বাসন আজ ভালো মনে হয় ।

    লারগা ভিদা আল কমান্দান্তে
    আমি রাইফেল চালাতে শিখেছিলুম
    আমি স্টেনগান চালাতে শিখেছিলুম
    আমি রিভলভার চালাতে শিখেছিলুম     
    শিখেছিলুম আপনার স্মৃতিকে নিজের ভেতরে পুষে রাখব বলে
    মার্গারেটের ডাকে বলিভিয়ায় গিয়েছিলুম
    নয়েস্ত্রা সেনিওরা দ্য লা পাজ-এ
    উচ্চতায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলুম
    লারগা ভিদা আল কমান্দান্তে
    চিলে আর পেরুর বাতাসে ঝড় তুলেছিল আমার চিৎকার
    বাতাস বইলে মনে হয় সবুজ রঙের ঘোড়ার দল ছুটছে
    আমিও একটা সবুজ ঘোড়ার ওপরে বসে দেখলুম গাছের ওপরে আপনার বাসা
    ম্যাকাও পাখির মেটিঙ কল যেন বুলেট ছুটছে
    কমান্দান্তে চে
    কমান্দান্তে, আপনি পৃথিবীর স্বপ্ন
    আপনি দুটো হাত দিয়ে স্বপ্ন দেখতেন আর দেখাতেন
    তাই শত্রুরা হাত দুটো কেটে নিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল
    নয়টা বুলেটে বিদ্ধ করেছিল আপনাকে
    বুলেটের আওয়াজ চিরকাল ধরে রাখবে ম্যাকাও পাখিরা
    আমার কবিতায় আপনার মোটর সাইকেল ছুটবে
    সারা লাতিন আমেরিকা জুড়ে
    আমি নিকারাগুয়ায় গিয়েছিলুম আরনেস্তো কার্দেনালের সঙ্গে দেখা করতে
    মার্গারেট র‌্যানডালের সঙ্গে কথা বলতে
    মার্গারেট আমার বিপ্লবের কবিতা প্রকাশ করতো
    আমাকে চুমু খেতে দিয়েছিল মার্গারেট
    যাতে ঠোঁটে বিপ্লবের উষ্ণতা নিয়ে দেশে ফিরি
    টুপাক আমারুর দলের গেরিলাদের আগে আমি গেরিলাদের সঙ্গে মিশিনি
    আমি ওদের দেখাদেখি টুপাক আমারুর নামে জয়ধ্বনি দিলুম
    কিউবায় যাইনি কমান্দান্তে
    আপনি কিউবা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন
    আপনি বুঝে গিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপোস করা যায় না
    কিউবা থেকে আপনার হাত দুটোও লোপাট হয়ে গিয়েছিল
    কিউবার নোটে আপনার সই থাকতো
    লারগা ভিদা আল কমান্দান্তে

    অংশুমালী, তোর ওই হরপ্পার লিপি উদ্ধার
    কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝা করে তোকে দেখে
    ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে আলফা গামা পাই ফাই
    কস থিটা জেড মাইনাস এক্স ইনটু আর কিছু নাই
    অনন্তে রয়েছে বটে ধূমকেতুর জলে তোর আলোময় মুখ
    প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে যাচ্ছে রকেটের ফুলঝুরি জ্বেলে
    কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরে ওরে ইউক্লিডিনি কবি
    নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস মঙ্গল থেকে অমঙ্গল
    মোটেই আলাদা নয় কী রে বাবা ত্রিকোণমিতির জটিলতা
    মারো গুলি প্রেম-ফেম, নাঃ, ফেমকে গুলি নয়, ওটার জন্যই
    ঘামের ফসফরাস ওড়াচ্ছিস ব্রহ্মাণ্ড নিখিলে গুণ ভাগ যোগ
    আর নিশ্ছিদ্র বিয়োগে প্রবলেম বলে কিছু নেই সবই সমাধান
    জাস্ট তুমি পিক-আপ করে নাও কোন প্রবলেমটাকে
    সবচেয়ে কঠিন আর সমস্যাতীত  বলে মনে হয়, ব্যাস
    ঝুঁকে পড়ো খোলা চুল লিপ্সটিকহীন হাসি কপালেতে ভাঁজ
    গ্যাজেটের গর্ভ চিরে তুলে নিবি হরপ্পা-সিলের সেই বার্তাখানা
    হাজার বছর আগে তোর সে-পুরুষ প্রেমপত্র লিখে রেখে গেছে
    হরপ্পার লিপি দিয়ে ; এখন উদ্ধার তোকে করতে হবেই
    অবন্তিকা অংশুমালী, পড় পড়, পড়ে বল ঠিক কী লিখেছিলুম তোকে–
    অমরত্ব অমরত্ব ! অবন্তিকা অংশুমালী, বাদবাকি সবকিছু ভুলে গিয়ে
    আমার চিঠির বার্তা তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে তুই আমাকে জানাস

    মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
    মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
    মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, "চলুন পালাই"
    ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
    নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
    ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, "ভালোবাসি" লেখা কার্ডসহ
    সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট
    তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাঝ ডুবিয়েছিলে
    তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি
    উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না
    গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গ দেখবার কোনো স্কোপ আর নেই
    চোখ খোলা আছে, তোমাকে দেখার জন্য সবসময়, আইড্রপ দিও
    গিফ্টপ্যাক আলতো করে খুলো, মুখ হাঁ-করাই আছে
    আমার পছন্দের ননভেজ, সন্ধ্যায় সিঙ্গল মল্ট, খাওয়াতে ভুলো না
    মাথাকে কোলেতে রেখে কথা বোলো, গিটার বাজিয়ে গান গেও
    ছ'মাস অন্তর ফেশিয়াল করিয়ে দিও, চন্দনের পাউডার মাখিও
    ভোর বেলা উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে চুমু খেও ঠোঁটে
    রাত হলে দু'চোখের পাতা বন্ধ করে দিও, জানো তো আলোতে ঘুমোতে পারি না
    কানে কানে বোলো আজও উন্মাদের মতো ভালোবাসো
    মাথা কেটে পাঠালুম, প্রাপ্তি জানিও, মোবাইল নং কার্ডে লেখা আছে
    নায়কত্ব
    আটাকলের চনমনে গমদানার কায়দায় নাচতে-নাচতে
    জুতোপায়ে বাজারে গিয়ে যখন খালি পায়ে নিজের মধ্যে ফিরি
    বাসন-ধোয়া আওয়াজে চমকে ওঠে কাঁসাপেতলের রান্নাবাড়ি
    বুঝতে পারি না অতো গান কেন ওইটুকু গলায় ধরে রাখে পাপিয়া
    মাটিতে কান পেতে শুনতে পাই আরশোলাদের শোকপ্রস্তাবের ফিসফিস
    .
    বয়স হবার পূর্বাভাস আয়না তো অনেক আগেই দিয়েছিল
    আমিই বরং ভেবেছি কাঁধে পাণ্ডবদের কালাশনিকভ নিয়ে বেরিয়ে পড়ব
    কিন্তু মাঝরাতে হাতের মুঠো যে উন্মাদ হয়ে যাবে তা কে জানতো
    .
    প্রথম চুমুর স্মৃতি রোমন্হন করতে যে বৃদ্ধ এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে
    নিজের ভুলগুলোকে সন্মান জানানো হয়ে ওঠেনি বলে
    মদ খেয়ে নর্দমায় পড়ে থাকার উচ্চাকাঙ্খা পূরণ হল না
    সমুদ্র তো অবিরাম ঝাঁপাই ঝুড়ে স্বাধীন হতে চায় তবু পারে না
    .
    ঝড়ের সঙ্গে লড়ছে বাড়িটা অথচ ভেতরে বসে লোকটা ভাবছে ওইই লড়ছে
    উত্তরটা কী ? উত্তরটাই তো প্রশ্ন ! প্রশ্নটা কী ? প্রশ্নটাই তো উত্তর !
    .
    অতো বেশি পালক রঙ রূপ নাচ নিয়ে ময়ূর ওড়ে না
    ওকে কেবল দেখুন আর প্রশংসা করুন ; ও-ই তো নায়ক
    টাপোরি
    আমি যে-কিনা পালটি-মারা তিতিরের ছররা-খাওয়া আকাশ
    জলে ডোবা ফানুসপেট মোষের শিঙ থেকে জন্মেছিলুম
    অলসচোখ দুপুরে পুঁতি-ঝলমলে নিমগাছটার তলায়
    থাবা-তুলতুলে আদর খাচ্ছিলুম ভুরু-ফুরফুরে শ্যামাঙ্গী গৌরীর
    হাত-খোঁপায় গোঁজা বৃষ্টির কাছে নতশির স্বর্ণচাঁপার কোলে
    .
    আমি যে-কিনা গ্রিলবসানো সকালমেঠো দিগন্তে দাঁড়িয়ে 
    মাড়ানো ঘাসের পদচিহ্ণ আঁকা শোকাচ্ছন্ন রোদের সোঁদাভূমিতে
    শেষ গড়াগড়ির বিছানায় কাঠকীটের রাতঘ্যাঙোর শুনেছি
    ভাবছিলুম উদ্দেশ্য প্রণোদিত হলেই খারাপ হতে যাবে কেন রে
    পদ অলঙ্কৃত-করা গতরের ঘামে কি খাটুনির লবণকলা নেই
    .
    আমি যে-কিনা ডাহুককে জিগ্যেস করেছি প্রজাপতির ডানায় কী স্বাদ পাস
    কানপটিতে খুরধ্বনি সেঁটে চিপকো খেলার তেজবরে কনের আদলে
    জাহাজ-এড়ানো লাইটহাউসের আলোয় এক করাতদেঁতো হাঙর
    যামিনী রায়ের আঁকা স্তনের কেরানির সঙ্গে মহাকরণের খাঁচালিফটে
    হেঁকেছিলুম আরোহী-ফেলা পুংঘোড়ার লাগামছেঁড়া হ্রেষা
    .
    আমি যে-কিনা উচ্চিংড়ের স্বরলিপিতে গাওয়া ফুসফাসুরে গান
    বেড়াজালের হাজার যোনি মেলে ধরে রেখেছি ইলশে-ঝাঁকের বর্ণালী
    স্বদেশী আন্দোলনের লাশঝোলা স্মৃতির গাবগাছের পাশের ঝোপে
    শুকপোকায় কুরে-খাওয়া লেবুপাতার পারফিউমড কিনার বরাবর
    পাথরকুচি কারখানা-মালিকের ঘাড়কামানো পাহাড় থেকে উড়ছি

    নেভো মোম নেভো
    আপনি আমার প্রিয় নারী, যদিও শুধুই শুনেছি ঘুমন্ত কন্ঠের কালো
    ফিল্মে দেখেছি, আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন
    দুঃখ হয় নাকি ? আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বুক ছোটো বলে
    হত্যা করতে গিয়ে কিছুটা ঝুঁকলেন, নয়তো বুক উঁচু করে বলতেন
    যা করি তা কারি, প্রেত তোর তাতে কী, তুই কি ঘুমের ইন্দ্রজালে
    শুধু বুক খুঁজে বেড়াস নাকি ! সত্যিই তাই, আপনার ঘুমে ঢুকে
    তাছাড়া কি খুঁজবো বলুন ? ফেরার ট্যাক্সিভাড়া ? গ্যাসের রসিদ ?
    যা ইচ্ছে করুন আপনি, জেনে নেবো, চলন্ত গাছেরা বলে দেবে,
    না জানলেও আকাশ তো ভেঙে পড়ছে না ; আপনি আমার প্রিয় নারী,
    মন খারাপ করে দিলেন আজকে বৃষ্টির দিনে, ছাতাও আনিনি,
    আপনার পাশ দিয়ে যেতে-যেতে ছাতার আড়াল থেকে আপনার
    ছোট্টো দুটো বুক জরিপ করে নিতে পারি, ব্র্যাঙ্কোর প্রেত আমি,
    ছোরা দুটো নিলেন দুহাতে তুলে, মনে হয়েছিল বুকের গরবিনি, হত্যা
    নেহাতই অজুহাত, কেউ তো আর মনে রাখবে না, উনিও জানেন
    তোমাকে দেখেই চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিল, না না, হাঁ-মুখের ঠোঁটে নয়
    পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
    নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
    খুলে বলি আপনাকে, আমি কীরকমভাবে নারীকে খুঁজি তা বলছি শুনুন,
    যেমন ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়িরা ঘোড়ার রেসবই খুঁটে খুঁটে পড়ে
    আমার ভেতর সেরকমই পোষা আছে কয়েকটা অসুখ
    বুঝলেন, যখন প্রথম পড়ি, প্রেমে পড়ে গিসলুম নগ্ন আপনার !
    লেডি ম্যাকবেথ ! আহা কি শঙ্খিনী নারী, কি ডাগর রক্তময়ী চোখ
    ঘুমন্ত হেঁটে যাচ্ছো মৃত্যুর মসলিনে সম্পূর্ণ পোশাকহীন, কোনো খেয়াল নেই,
    চেয়েছি জড়িয়ে ধরতে, বলতে চেয়েছি, লেডি, লেডি, নগ্ন পশ্চিমে
    একটা চুমু শেষবার দাও, পুরস্কার নিয়ে ডাইনিরা দাঁড়িয়ে রয়েছে
    রক্তাক্ত ছোরার সঙ্গে কথা বলো, বুকের নির্দয় ওঠা-নামা, লেডি
    ম্যাকবেথ, ওই যিনি ছোটো বুকে মনটা খারাপ করে ফিরছেন বাড়ি
    ওনাকে উৎসাহিত করো, বড়ো, আরবের সমস্ত আতর ধুতে পারবে না
    হত্যার মিষ্টি গন্ধ, যেমনই লোক হোক সে তো তার নিজস্ব দৈত্যের সৃষ্টি,
    তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
    ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার
    আপনার নগ্নতার ব্যক্তিগত ছন্দ লেডি ম্যাকবেথের মতো হাঁটছেন
    কলকাতার রাস্তা দিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ, আমাকে চিনতে পেরেছেন ?
    আমি ব্যাঙ্কোর প্রেত, প্রতিটি হত্যাদৃশ্যে উপস্হিত থেকে
    বুকের বর্তুলতা মাপি, যবে থেকে স্কুলপাঠ্য বইয়ে দুরূহ লেগেছিল
    লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
    বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
    ঘুমন্তকে নয়, ঘুমকে খুন করেছিলে তুমি, চিৎকার করছিলে
    'কে জানতো বুড়ো লোকটার গায়ে এতো রক্ত এতো রক্ত ছিল !'
    এসবই আপনার নারীত্বের রক্ত, ছোট্টো দুটো বুকের দুঃখের
    ভাববেন না বেশি, যৌবন ফুরোবার সঙ্গে এই দুঃখ চলে যাবে
    তখন দেখবেন ক্লিটোরিস সাড়া দিচ্ছে না, রসশাস্ত্রহীন দেহ
    আদিরস প্রথমে লোপাট, ঘুমন্ত হাঁটবার আহ্লাদ নামছে দুঃস্বপ্নে
    আপনার ছোট্টো বুক ছোট্টোই থেকে যাবে যতোই উদার ওন
    ভিখিরি দেখলেই বটুয়াতে কয়েনের ওজন কমান, লেডি ম্যাকবেথ
    ছাড়বে না, উচ্চাশার কি দুর্দশা, হাতে রক্ত, নেভো মোম নেভো
    কপিরাইট
    অবন্তিকা, অতি-নারী, অধুনান্তিকা
    পঞ্চান্ন বছর আগে চৈত্রের কোনারকে
    লোডশেডিঙের রাতে হোটেলের ছাদে
    ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট রেখে বলেছিলি
    চুমু প্রিন্ট করে দিচ্ছি সারা নোনা গায়ে
    ম্যাজেন্টা-গোলাপি ভিজে লিপ্সটিকে
    গুনেগুনে একশোটা, লিমিটেড এডিশান
    কপিরাইট উল্লঙ্ঘন করলে চলবে না ।
    অবন্তিকা, সাংবাদিকা, অধুনান্তিকা
    এ-চুক্তি উভয়েরই ক্ষেত্রে লাগু ছিল
    কিন্তু দুজনেই এর-তার কাছে থেকে
    শুনেছি কখন কবে কার সাথে শুয়ে
    ভেঙেছি ভঙ্গুর চুক্তি কেননা মজাটা
    ঠোঁটের ফাইনপ্রিন্টে লিখেছিলি তুই ।
    প্রজাপতি প্রজন্মের নারী তুই অবন্তিকা
    রবীন্দ্রনাথ, এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।
    অবন্তিকা বলছিল আপনি প্রতিদিন
    ওকে রুকে নিচ্ছেন, আপনাকে সাবান
    মাখাবার জন্য, বুড়ো হয়েছেন বলে
    আপনি নাকি একা বাথরুমে যেতে
    ভয় পান, আর হাতও পৌঁছোয় না
    দেহের সর্বত্র, চুলে শ্যাম্পু-ট্যাম্পু করা--
    পোশাক খুললে, আসঙ্গ-উন্মুখ নীল
    প্রজাপতি ওড়ে ওরই শরীর থেকে
    আর তারা আপনার লেখা গান গায় !
    এটা আপনি কী করছেন ? আপনার
    প্রেমিকারা বুড়ি থুতথুড়ি বলে কেন
    আমার প্রেমিকাটিকে ফাঁসাতে চাইছেন !
    পপির ফুল
    বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ অবন্তিকা
    শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
    আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
    চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
    টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা
    অন্তরটনিক
    বিড়ি ফুঁকিস অবন্তিকা চুমুতে শ্রমের স্বাদ পাই
    বাংলা টানিস অবন্তিকা নিঃশ্বাসে ঘুমের গন্ধ পাই
    গুটকা খাস অবন্তিকা জিভেতে রক্তের ছোঁয়া পাই
    মিছিলে যাস অবন্তিকা ঘামে তোর দিবাস্বপ্ন পাই
    পরমাপ্রকৃতি
    মেঘের রঙ দিয়ে ছুঁয়ে দিস অবন্তিকা
    চামড়া বাঘের ডোরা ধরে
    হাওয়ার রেশম দিয়ে চুল আঁচড়ে দিস অবন্তিকা
    মাথা বেয়ে ওঠে বুনো মহিষের শিং
    ঝড়ের মস্তি দিয়ে পাউডার মাখিয়ে দিস অবন্তিকা
    গায়ে ফোটে গোখরোর আঁশ
    হরিণের নাচ দিয়ে কাতুকুতু দিস অবন্তিকা
    ঈগল পাখির ডানা পাই
    রোদের আঁশ দিয়ে নখ কেটে দিস অবন্তিকা
    গজায় নেকড়ের থাবা হাতে-পায়ে
    নদীর ঢেউ দিয়ে ঠোঁটে চুমু খাস অবন্তিকা
    কাঁধে পাই রাবণের জ্ঞানীগুণী মাথা
    বৃষ্টির ঝাপটা দিয়ে জড়িয়ে ধরিস তুই অবন্তিকা
    হুইস্কির বরফ হয়ে যাই
    গানের সুর দিয়ে চান করিয়ে দিস অবন্তিকা
    ডুবে যেতে থাকি চোরা ঘূর্ণির টানে
    মর মুখপুড়ি
    এই বেশ ভাল হল অ্যামি, বিন্দাস জীবন ফেঁদে তাকে
    গানে-নাচে মাদকের জুয়ার পূণ্যে অ্যামি, কী বলব বল,
    অ্যামি ওয়াইন হাউস, অ্যামি, আমি তো ছিলুম তোর
    জানালার কাঁচ ভেঙে 'ল্যাম্ব অফ গড'এর দামামায়
    বাজপড়া গিটারের ছেনাল আলোয় চকাচৌঁধ ভাম,
    অ্যামি, আমি তো ছিলুম, তুই দেখলি না, হের্শেল টমাসের
    শিয়রে বিষের শিশি মাধুকরী লেপের নিঃশ্বাসে, অ্যামি
    স্তনের গোলাপি উলকি প্রজাপতি হয়ে কাঁপছি, দেখছিস
    লাল রঙে, অ্যামি, অ্যামি ওয়াইন হাউস, মুখপুড়ি
    হ্যাশের ঝাপসা নদী কোকেনে দোলানো কোমর, চোখ
    থ্যাবড়া কাজলে ঘোলা ঠিক যেন বাবার রিটাচ করা
    খুকিদের নকল গোলাপি ঠোঁট বয়ামে ভাসাচ্ছে হাসি
    সাদা কালো, হ্যাঁ, সাদা কালো, ব্যাক টু ব্ল্যাক গাইছিস
    বিবিসির ভিড়েল মাচানে কিংবা রকবাজ ঘেমো হুললোড়ে
    আরো সব কে কী যেন ভুলে যাচ্ছি ভুলে যাচ্ছি ভুলে...
    ওহ হ্যাঁ, মনে পড়ল, ক্রিস্টেন পাফ...জনি ম্যাককুলোস...
    রাজকমল চৌধুরী...ফালগুনী রায়...অ্যন্ড্রু উড...
    সেক্স পিস্টলের সিড ভিশাস...দার্বি গ্রেস...অ্যান্টন মেইডেন...
    সমীর বসু...শামশের আনোয়ার...কে সি কালভার...
    হেরোইন ওভারডোজ, ছ্যাঃ, ওভারডোজ কাকে বলে অ্যামি
    ওয়াইন হাউস, বল তুই, কী ভাবে জানবে কেউ
    নিজেকে পাবার জন্যে, নিজের সঙ্গে নিজে প্রেমে পড়বার জন্যে...
    য়ুকিকো ওকাকার গাইতে গাইতে ছাদ থেকে শীতেল হাওয়ায়
    ৱদু হাত মেলে ঝাঁপ দেয়া, কিংবা বেহালা হাতে সিলিঙের হুক থেকে
    ঝুলে পড়া আয়ান কার্টিস, কত নাম কত স্মৃতি কিন্তু কারোর
    মুখ মনে করা বেশ মুশকিল, তোর মুখও ভুলে যাব
    দিনকতক পর, ভুলে গেছি প্রথম প্রেমিকার কচি নাভির সুগন্ধ,
    শেষ নারীটির চিঠি, আত্মহত্যার হুমকি-ঠাসা, হ্যাঁ, রিয়্যালি,
    নরম-গরম লাশ, হাঃ, স্বর্গ নরক নয়, ঘাসেতে মিনিট পনেরো
    যিশুর হোলি গ্রেইল তুলে ধরে থ্রি চিয়ার্স বন্ধুরা-শত্রুরা,
    ডারলিং, দেখা হবে অন্ধকার ক্ষণে, উদাসীন খোলা মাই,
    দু ঠ্যাং ছড়িয়ে, একোন অজানা মাংস ! অজানারা ছাড়া
    আর কিছু জানবার জানাবার বাকি নেই, অ্যামি, সি ইউ...
    সি ইউ...সি ইউ...সি ইউ...মিস ইউ অল...
    সবুজ দেবকন্যা
    ওঃ তুই-ই তাহলে সেই সুন্দরী দেবকন্যা
    তুলুজ লত্রেক র‌্যাঁবো ভেরলেন বদল্যার
    ভ্যান গঘ মদিগলিয়ানি আরো কে কে
    পড়েছি কৈশোরে, কোমর আঁকড়ে তোর
    চলে যেত আলো নেশা আলো আরো মিঠে
    ঝলমলে বিভ্রমের মাংস মেজাজি রঙে
    বড় বেশি সাজুগুজু-করা মেয়েদের নাচে
    স্পন্দনের ছাঁদ ভেঙে আলতো তুলে নিত
    মোচড়ানো সংবেদন কাগজে ক্যানভাসে
    অ্যামস্টারডম শহরের ভিড়ে-ঠাসা খালপাড়ে
    হাঁ করে দেখছি সারা বিশ্ব থেকে এনে তোলা
    বিশাল শোকেসে বসে বিলোচ্ছেন হাসি-মুখ
    প্রায় ল্যাংটো ফরসা বাদামি কালো যুবতীরা
    অন্ধকার ঘরে জ্বলছে ফিকে লাল হ্যালো
    এক কিস্তি কুড়ি মিনিট মিশনারি ফুর্তির ঢঙে
    পকেটে রেস্ত গুনে পুরোনো বিতর্কে ফিরি
    কনটেন্ট নাকি ফর্ম কোনটা বেশি সুখদায়ী
    তাছাড়া কী ভাবে আলাদা এই আবসাঁথ ?
    যুবতী উত্তর দ্যান, শুয়েই দ্যাখো না নিজে
    এই একমাত্র মদ যা বীর্যকে সবুজ করে তোলে।
    তোর সুগন্ধ, মুখপুড়ি
    ঠিকই বলেছিলি, মুখপুড়ি, থাকুন না সঙ্গে সবসময়, কোঁকড়া দুর্গন্ধ হয়ে
    দেহের নৌকো জুড়ে, আগাপাশতলা, নোনা বাঁকে মাছেদের অপলকা ঝাঁকে
    কোথাও অ্যাড্রেনালিনে নীল তাঁতে বোনা গোড়ালি-গন্ধকে মাখা ভিজে-নাচ
    চামড়ায় মরে-যাওয়া জং-ধরা হাঙরের মিষ্টি হাঁ-মুখ ভরা খিলখিল আলো
    খুঁজুন না যা চাইছেন, ভিনিগারি ঘামের রোদ্দুর, গ্রন্হিল জ্বরের নিঃশ্বাস
    ছানাকাটা দুধেল উত্তাল, তাও হরমোনের তরল বারুদে তিতকুটে
    বলেছিলি তুই, প্রেম ? ছ্যাঃ, সুগন্ধ তো বানানো নকল তার সাথে, ডারলিং
    মাংসের মেদের মজ্জার আত্মীয়তা নেই। পেতে হলে শুধুই দুর্গন্ধ নিতে হবে
    যা তোর একান্ত আপন, বলেছিলি। চারিপাশে বাতাসের নিভাঁজ জারকে
    তোর ওই ঘোষণা উড়ছে: সি ইউ... সি ইউ... সি ইউ... সি ইউ...
    ফেলে গিয়েছিস তোর লনজারি টপ জিন্স বক্ষবন্ধনী হাইহিল। কই তোর
    দুর্গন্ধ কোথাও তো নেই মুখপুড়ি ; ফেলে-যাওয়া কিছুতেই নেই। সবই
    ভিনিভিনি খুশবু মাখানো। যতক্ষণ ছিলি, তোর গা থেকেও ওই একই
    পারফিউম উড়েছে, বানানো নকল, তোরই মতন মুখপুড়ি, কথার
    ফেনানো জালে টোপ বেঁধে যা তুই ফেলেই চলেছিস প্রতিরাত প্রতিদিন।
    তাহলে ফালতু তোর সি ইউ...সি ইউ.. ডাক হাতছানি উদোম ইশারা।

    সুফিয়ানা
    এ কেমন ক্রিমতোলা বাংলায় কথা কোস তুই
    যে ভেলকিবাজ রোদের ভয়ে ঝরে পড়া শিউলিফুলগুলো
    পাখিদের রোমান্টিক গানকে নার্ভাস করে তোলে
    যেন হাঁ-মুখে নার্সের থার্মোমিটার
    দোলের দিন ডেকে-ডেকে হাঁপানি ধরে গেল কোকিলটার
    আসলে তোর কেন মতামতহীন হবার আধিকার নেই
    একটা হ্যাঁ-এর সঙ্গে একটা না মিশিয়ে তখনই জানা যায়
    যখন প্রেমের ক্লাইম্যাক্সে মাটির সঙ্গে আমি যোগাযোগ হারাই
    শাঁতার কাটবার মতন তোর গভীর টলটলে সংলাপে
    যে-দিন জিরে-জিরে করে কুচোনো বিদ্যুতের সবুজ জোনাকি
    ঘোড়াহিন রেসের মাঠে তোকে ঘিরে বেশরম হ্রেষা হয়ে উড়বে
    ইরানি হরফে তোকে প্রেমপত্র লিখে রাখবে বটগাছের শেকড় ।

    বজ্রমূর্খের তর্ক
    আজকে শুক্কুরবার । মইনে পেয়েচি । বোধায় শরতকালের পুন্নিমে ।
    পাতলা মেঘের মধ্যে জোসনা খেলচে । মাঝরাত । রাস্তাঘাট ফাঁকা ।
    সামান্য টেনিচি তাড়ি । গাইচি গুনগুন করে অতুলপ্রসাদ ।
    কোথাও কিচ্ছু নেই হঠাত নেড়ি-কুকুরের দল
    ঘেউ ঘেউ করে ওঠে । তাড়া করে । বেঘোরে দৌড়ুতে থাকি ।
    বুঝতে পারিনি আগে । রাজপথে এসে হুঁশ হয় ।
    মাইনেটা পড়েচে কোথাও হাত থেকে । কী করে ফিরব বাড়ি ?
    কেধ তো বিশ্বাস করবে না । ভাববে খেলেচে রেস,
    গিয়েচে মাগির বাসা, বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেলেল্লা করেচে ।
    বন্ধুবান্ধব কেউ নেই । রেসও খেলি না কতকাল ।
    অন্য স্ত্রীলোকের খোলা-বুকে হাত শেষ কবে দিয়েচি যে
    ভুলে গেচি । জানি না বিশ্বাস করে না কেউ কেন ।
    আমার তো মনে হতে থাকে, যা করিনি সেটাই করিচি বুঝি ।
    যা কইনি, সেকথা বলিচি । তাহলে এ পুন্নিমের মানে ?
    কেন এই মাইনে পাওয়া? কেন গান ? কেন তাড়ি ?
    .
    আবার ঢুকতে হবে রামনোংরা গলির ভেতরে । নির্ঘাত কুকুরগুলো
    গন্ধ শঁকে টের পাবে । ছেঁকে ধরবে চারিদিক থেকে ।
    যা হবার হয়ে যাক । আজ শালা এস্পার কিংবা ওস্পার ।
    বাকদানো
    তোদের তো বলিছিলুম বাবা কিন্তু তোরা গা কল্লিনে
    তবলা-বাজিয়ের কানে আওয়াজের আগেই য-ভাবে বোল ফোটে
    অ্যাগবারে তেমনিই যে-দিকে মাথা করে শুই সে-দিকেই কেন সুয্যি ওঠে জানি না
    .
    আমাদের যুধিষ্ঠির, সেই যে, পাশাখেলার গ্র্যাণ্ডমাস্টার
    বেতলা ফরেস্টে দ্রোণাচার্যের সেমিনারে অর্জুনকে ধাতানি দিয়েছিল
    'পা নাচিয়ে কক্ষুনো নাচবিনে, সব্বোদা বাতাস নাড়িয়ে নাচবি'
    .
    তোদের ওদিকটায় তো সভ্যতা মানেই শহর, কী, ঠিক বলিচি না?
    জ্বরের ঘোরে-বলা প্রলাপ খানিক পরেই দেখবি আলোচনা হয়ে গেচে---
    কাব্যি করে বলতে হয়, 'ওগো এ যে গোঁজবঙ্গের পালতোলা শামুক ভাসিয়েচো'
    .
    যখুন দুঃখকষ্ট চেপে যেতে শেখার বয়েসে পৌঁছোলুম, অ্যাঁ
    ঘুমন্ত অবস্হায় যে-পাখিটা বিপদে পড়েচে তার মাঝরাতের ডাকে
    দেহের বিতর্কিত জায়গায় হাত দিয়ে ফেলার ভয়ে আমি তো থরহরি
    .
    বিড়ির শেস-ফুঁকের আয়েস টেনে মেয়েটি যখুন পোনয় নিবেদন কল্লে
    একাধটা অঙ্গকে বিশ্বেস করা মুশকিল হয়ে পড়েছিল রে
    তা, সবাই তো আর সবায়ের ব্যথার গন্ধ টের পায় না
    .
    এ-বাড়ির ঘড়িগুলোকে দ্যাখ, বড্ড কামচোর, সবুর করতে পারে না;
    কী করি ? আমি তো পাহাড় থেকে ঝাঁপ-দেয়া ঝর্ণার ফূর্তি দুমুঠোয় পুরে
    মৌমাছিদের রানিকে নিয়ে বরযাত্রীদের সঙ্গে ওইবঙ্গে কেটে পড়লুম...
    ডোমনি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, খয়েরি চাউমিন তাপের খোলসে
    জিভ দিয়ে পড়ে থাকি, টাকরা মন্দাক্রান্তা ছন্দে কাঁপে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, চরণ বিভক্ত তোর মধ্যযতি দিয়ে
    ঠোঁট চেপে পড়ে থাকি, বানভাসি ঢেউ খেলায় নদী ঢুকে আসে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, টানপ্রধান অনুষ্টুপ তোর তরল পয়ারে
    মুখ দিয়ে পড়ে থাকি শ্বাসযতি শ্বাসাঘাতে ছন্দখেয়ে টলি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, বুকের স্তবকে রসের স্পর্ধা এনে দিস
    নাক দিয়ে পড়ে থাকি হরিণেরা কস্তুরি নাচে চৌপদীলঘু
    ডোমনি, তুইই দয়াল, স্বর্ণলতা কোঁকড়া চুলের আয়েসে
    কান দিয়ে পড়ে থাকি, বাণের বাকসম্ভোগী ডাক শুনি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, আদি আলুথালু ক্রৌঞ্চী তোটক তৃণক
    গাল রেখে পড়ে থাকি, ত্রিগুণবারি বাকসম্ভোগে ঝরে কামচণ্ডালী
    ডোমনি, তুইই দয়াল, চাপল্যছাক্কস দ্রুতছন্দের আদিস্বরে
    গোঁফ দিয়ে সুড়সুড়ি দিই তোর কালিকাগহ্বরে, ধামালি দিগক্ষরা ওরে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, আমি খালিপিলি আকখা বিরামচিহ্ণে থামি
    মাথা গুঁজে পড়ে থাকি, অভেদ খুলে যায়, বেরোয় সিঙ্গলমল্ট মধু
    ডোমনি, তুইই দয়াল, স্হিতিস্হাপক লঘুদ্রূতি স্বরধ্বনি ওঠে
    হাত রেখে পড়ে থাকি, গোলাপরঙ ধরে, তোর মোহন আবসাঁথ উঁকি দেয়
    ডোমনি, তুইই দয়াল, অঙ্গটায় সুখ নেই, অঙ্গের চৈতন্যে পুরো সুখ
    বুক রেখে পড়ে থাকি, রঙমহলে ঢুকি, রিপুকে দমন করে নদীর রক্তমুখ
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মন বলতে যা বোঝায় তা ওই দেহযজ্ঞখেলা
    উরু তুলে পড়ে থাকি, দেহমাতাল হই, মানবিক দেহযজ্ঞে ফারাক করিনে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, শরীরে রসের ভিয়েন, কামেই কাম নিবারণ
    সারাদিন স্বভাবঘোরে ঠেকায় সুরবাঁধা, গাধার পরজন্ম হয়, আমার তো নেই
    ডোমনি, তুইই দয়াল, দেহরস উর্ধগামী করাই সাধনা, অন্ত্যমিলে কোনো মিল নেই
    স্হানের অর্চক আমি, ডুবতে চেষ্টা করি, মাংস ছেড়ে প্রেমের স্বদেশ নেই কোনো
    ডোমনি, তুইই দয়াল, ফাটলের গান না বেরোলে বহু কষ্টে রাতদিন কাটে
    যতো ঝড় সব খামোশ তোর ও-তল্লাটে, চাতক প্রায় অহর্নিশি, চরণদাস আমি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে দিয়েছিলি সেই ষাটের দশকে
    তেকোনা মানবঘর আজব কারখানা, বন্ধুরা শত্রু হল শাঁখ-গেঁড়ি-শামুকের চেলা
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মলয়দাস ভণে, শুনো গাণ্ডুগণ, কয়লাঅঙ্গ কালোলাল
    চাপান-ওতোর চলে, বিরল তিমিরজালে, মশকগৃহিণী বসে শত্রুদের নিতম্বপরে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, কৌশলে সাড়া দিস, বীজরস শুষে নিস, যেন চোরাবালি
    অনল-হিল্লোল-ধারা, মাথাথুয়ে বর্ত্মফাঁকে, বিচিত্র আলোকোদয়ে চাটি রসমধু
    ডোমনি, তুইই দয়াল, অলক্ষ্মী অলকায় যাক, অলক্ষ্মী অমরায় যায় যাক
    মাংসের ছটায় মজে, কালো পদ্মফুলে সেজে, চটচটে মাত্রাবৃত্তে অন্ধকার হবি
    ডোমনি, তুইই দয়াল, ঢুলু-ঢুলু দুই চোখে, ছটফটাস বেওকুফ মাস্তানের ঢঙে
    হাঁফাস আর বলে উঠিস, করুক্ষেত্র কোথাকার, ভেতরে ফেলিস না কেন
    ডোমনি, তুইই দয়াল, আমি তো বাউলক্ষ্যাপা, ওরে এটাই আসল শিক্ষে
    মলয়হাংরি বলেছেন জোয়ার ভাটায় চলে ফেরে সাগর কিন্তু শুকায় না রে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, কী করিতে কিবা করি, বীর্যে বোঝাই তরি
    ছিলুম কোথা এলুম হেথা যাবো কোথায় কার সনে প্রেমের উর্ধলোকে
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মনের মানুষ বলে কিছু নেই, সবই দেহের মানুষী
    আদিশক্তি পরম যুবতী আমার দেহ চালাস তুই মানুষ আড়তরসিক
    ডোমনি, তুইই দয়াল, সাধনসঙ্গিনী, বিরল তিমিরজালে ফাঁসালি আমাকে
    বাবা বলে কেন ডাকিস, আমার আলজিভ নেই, গানের কন্ঠস্বর নেই
    ডোমনি, তুইই দয়াল, তুই কালচেদেহ, ডাগর দু'চোখ, চেরিফল বুক
    মা বলে ডাকতে পারি না তোকে, মনে হয় ইনসেসচুয়াস এই বাউলসম্পর্ক
    ডোমনি, তুইই দয়াল, আলোজ্বলা এ-সম্পর্ক, ক্ষ্যাপাহাংরি সহ্য করে বেমালুম
    মাবুদ মজুদ তুই এই শরীরে থাকিস, তোকেই ভজনা করি আমার কবিতায়
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মলয়দাস বলে মিছে গণ্ডোগোল ভবে এসে শুনতে পাই
    এই যে বীজ বা বীর্য, এর কী আলাদা কিছু আছে ? চাঁদ সবায়ের এক, চাঁদের আলোও
    ডোমনি, তুইই দয়াল, মানুষের বীজে হয় না ঘোড়া, ঘোড়ার বীজে হয়না প্রজাপতি
    হিন্দু শিয়া-সুন্নি মুসলমান খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন শিখ আহমেদিয়া ইহুদি অনাস্তিক
    ডোমনি, তুইই দয়াল, খাজাবাবা খাজাবাবা মারহাবা মারহাবা, মস্ত কলন্দর ওরে
    ইশকের গাঁজা ফুঁকলে হয় রুহ তরতাজা যেন নৌকা চরস টেনে চলেছে মাতাল
    ডোমনি, তুইই দয়াল, সুকুমার চৌধুরীকে বল দেখি আশেক হলে মাশুক মিলবে ওর
    পড়ে থাকুক জিভ ঠোঁট মুখ গাল বুক ঠ্যাঙ হাত দিয়ে মন্দাক্রান্তা আমিষাশি বীর্যকবিতায়…
    মরে গেলি , অরুণেশ ?
    মরে গেলি ? সত্যিই মরে গেলি নাকি অরুণেশ ? 
    রূপসী বাংলার খোঁজে আসঙ্গ উন্মুখ শীতে বেপাড়া-ওপাড়া ঘেঁটে
    শেষমেশ জিলের সবুজ ঝাঁঝরিতে ডুব দিলি ! যবাক্ষারযানে কালো
    বিষগানে আধভেজা উলুপীর সাপ-রক্ত মিঠেল শীৎকারে
    হৃদযন্ত্রে দামামা বাজতেই বুক খামচে জলে নেমে গেলি
    বাড়িতো পিছনে ছিল, সেদিকে গেলি না কেন ? ডাঙার গেঁজেল হায়নারা
    যৌবনে ভালবাসা পেয়েছিল তোর, যখন অতৃপ্ত ছিলি ? কী খাচ্ছিল
    কে খাচ্ছিল নৌকোর পালে আঁকা তোর রাগি নমস্কার ? দেখেছিলি
    মোমে-জোড়া ডানা গলে ইকারাস সমুদ্রের আঁশটে ঘূর্ণীতে নেমে গেছে
    নিরিবিলি ওফেলিয়া পিরানহা মাছেদের বন্দনা মেশানো ঝাঁকে
    ড্রাগন উৎসবের ডিঙি থেকে ঝাঁপ দিলেন সৌম্য কুউয়ান
    ফেনার ওপরে লেখা কীটসের নশ্বর অক্ষরমাংস ঠোকরায় চিল
    হয়তো কাঁকড়ারা বুজকুড়ি কেটে-কেটে লি পোর কবিতা পোড়ে
    শোনাচ্ছে নাটালি উডের লাশে ভাসমান কাক গৃহিনীকে
    হার্ট ক্রেনও আছে নাকি তোর পাশে শুয়ে কিংবা ঠোঁটে
    চুমু কি দিচ্ছেন ওর নগ্ন আলিঙ্গনে টেনে ভার্জিনিয়া উলফ ?
    বউ ফেলে ষোড়শী মেরিকে নিয়ে কাটলেন পিসি বিসি শেলি
    দেখলি ডন হুয়ান নয় ; তিন দশকে ফ্র্যাংকেনস্টাইন খুড়ো
    জলে-পচা রাসপুতিন ছিঁড়ে খেলো তোর প্রিয় রূপসী বাংলাকে
    স্বপ্নের নীল নদে, টাইবার নদীতে, রাইনে, লিমমাতে, তিস্তায়
    অ্যামস্টারডামের খাল যার দুই ধারে রোজ বেশ্যা প্রেমিকারা
    রক্তাক্ত আলোয় বসে উলঙ্গ গোলাপি খুলে সন্ধ্যা ফেঁদেছেন
    পরমহংসের শোক শিখেছিলি রেঁবোর আবসাঁথ পান করে
    অথচ ঠান্ডা রক্তে জড়িয়ে ধরল জল ভালবেসে তোকে
    উকুন ও ছারপোকার কামড়ের মাঝে তৃপ্ত ঘুম ছেড়ে হ্যাঁ রে
    নেমে গেলি অমৃতমন্হনের ডাকে-- কোন দিকে যাবি তুই
    বুঝতে না পেরে অসুর ও দেবতার মাঝে পিষে গেলি, আজীবন
    পিষে গেলি...পিষে গেলি...পিষে গেলি...পিষে গেলি...পিষে…
    বিষবাউলের গান
    মলয় মলয় মলয় মলয় মলয় মলয়
    শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে
    এই নাম আর দেয়া যাবে না ছেলেকে নাতিকে
    নামের ভেতর কোনো নরম নদীর নারী নেই
    জোনাকি মালায় ওর হরিণীরা সঁপেনাকো গলা
    শীতের হাওয়ায় নেই আমলোকি-পাতাদের নাচ
    কী রেখেছে তাহলে ছাইপাঁশ ?
    বানভাসি-ফেলে-যাওয়া ধানখেতে হাঁটু-ডোবা বালি...
    আঁস্তাকুড়ে ফেলে-যাওয়া ভ্রুণ...
    শুয়োরের পচা মাংস তেবাষ্টে হাঙরের নোনামাছ...

    ফ্ল্যাট বিক্রি করে চলে যাচ্ছে এ-শহর ছেড়ে
    ৩৮৯৭ টি কবিতার বই বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল
    নেবার জন্য পাওয়া গেল না কাউকে
    কবিতার বই রাখবে না কোনো গ্রন্হাগার
    পাঠক নেই দেখভালে খরচ কে দেবে
    জাতীয় গ্রন্হাগার কপিরাইট আইনে বই পায়
    রাজ্য গ্রন্হাগার রাখে পার্টির লোকেদের বই
    কারোর বাসায় অত জায়গা নেই তরুণ কবিদের
    অতি ভালবাসা-মাখা কবিতার বই রাখবার তাক
    মলাট বাদ দিয়ে কিলো দরে কিনতে রাজি
    পোরোনো কাগজঅলা...প্রেম হাসি ক্রোধ সংবেদন
    শতশত উপহার নেবার জন্য কোনো লোক নেই
    পত্র-পত্রিকা জুড়ে হাজার হাজার সমালোচনার ঝাঁক
    সবই ফালতু বুঝি ? মগজ ধোঁয়াটে হয়ে ওঠে
    এত বই এত এত পত্রিকা কোথায় যাচ্ছে চলে ?
    তিরিশের পর থেকে ? দুই বাংলা জুড়ে !
    বাংলার টিচার ঠিক বাতলেছিলেন ক্লাসে:
    টেকার জন্যে চাই কুখ্যাতি-দুর্নাম-বিষবাউলের গান
    এ-সময় সে-সময় নয় : সে-সব বাউল আজ মৃত।

    কাহার কুর্মি ডোম দুসাধের ছোটোলোক পাড়া
    শৈশব কি গ্রন্হহীন ছিল ? কবির রহিম দাদু
    তুকারাম থিরুভাল্লুভার রামচরিতের ছেঁড়া পাতা ?
    এতটা আসার পর পিছন ফিরলে দ্যাখে
    সেদিকে কিচ্ছু নেই, দিগন্তবিহীন পচা-ছেঁড়া-ছাতাপড়া
    দশ-বিশ-হাজার টাকা নোটের দুর্গন্ধে টেকা দায়
    কী হবে তাহলে ? সযত্নে আদরে রাখা কাব্যগ্রন্হগুলো ?
    বাড়ি তো বিক্রি হবে চারদিন পর নতুন মালিক
    বলেছেন: না না ওসব বই ফই গতি করুন
    কারা পড়ে মশায় রবিঠাকুরই তো শুধু সাজেগোজে
    তো আপনাদের এই বেআফিমি কারেস্তানি নেশা...
    ওই তো মিউনিসিপালিটির জঞ্জালের ভ্যাট
    কাগজকুড়ানিরা আসে দলবেঁধে সকালবেলায়
    ক্যানিঙের ট্রেনে ভাড়া লাগে না কারোর

    বাবা বারণ করতে পারতেন মা বারণ করতে পারতেন
    শিক্ষক বলেছিলেন ওহে ঠাঁই নেই ছোটতরীর মানে
    নরম নদীর নারী সোনাগাছি নিয়নে থাকুন
    নদী থাক গলাটেপা বাঁধের বেড়ায় বাঁধা
    হরিণ ঝুলতে থাক শিকারীর রঙিন দেয়ালে শিং তুলে
    জোনাকিরা চলে যাক ফিনফিনে এনডোসালফিনে
    আমলোকি গলে যাক রামদেব-আশ্রমের চিমচিমি-মোড়কে
    শহরে আর আঁস্তাকুড়েরও জায়গা নেই
    বলেনিকো কেউ ? কবির রহিম দাদু কৃত্তিবাস
    কাশিরামদাস ময়মনসিংহী গান লেখকেরা ?
    এত কবিতার বই এত কবিদের লেখা শ্বাস-প্রশ্বাস

    ওরই নামের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে থাকবে আঁস্তাকুড়
    কলেজ স্ট্রিটের পথে ডাস্টবিনে ফেলে-দেয়া ভ্রুণ
    থাকবে ধাপার মাঠ শহরের জঞ্জালের বিরাট পাহাড়
    নামের ভেতর মৃদু হাওয়া নয় নশ্বর অবিশ্রাম ঝড়...
    ৬৫টি হাইকু

    অঙ্কের দোষ
    সাধক কবিও লেখে
    মাত্রা গুনে গুনে

    ফেসবুক আছে
    অরকুট টুইটার আছে
    তবু থাকে একাকীত্ব

    ভূমাধ্যাকর্ষণ
    আলো ও ক্যালকুলাস---
    নারীদেহ ছোঁননি নিউটন
     ৪
    বসন্তে মৌমাছি
    আফিমের ফুল থেকে
    মাদক পেল না

    শীতকাল--
    কোথায় পোশাক রাখল
    স্বপ্নের নগ্ন যুবতী
     ৬
    সকলেই জানে টাকমাথা
    কবিটি মিথ্যাচারী এবং অসৎ
    তাই বলে ওনার গবেষকও
    ব্যায়াম ব্রেকফাস্ট ভিড়
    অফিস ভিড় বাড়ি টিভি সঙ্গম
    মাসে লাখ টাকা

    শুধু শোনো
    বন্ধ রাখো মুখ
    কমরেডগণ

    ক্যাটরিনা কাইফ
    জানেন সুন্দরী নিজে
    চোখের নকল পাতা কেন
     ৯
    কটা বেজেছে
    জানতে চায় লোকটা
    এক মুহূর্ত থেমে যায় পৃথিবী
    ১০
    খরার খেতের মাঠ--
    হাজার হাঁ-মুখ খুলে রূপসী বাংলা
    নিঃশব্দে হাসছেন অট্টহাসি
    ১১
    মলে ও মার্কেটে
    দল বেঁধে ঘোরে যুবতীরা
    স্বপ্নে শুধুই একজন
    ১২
    মরা গাছ
    নিজেকে নিয়েই সুখী
    বৃষ্টি বাদলায়
    ১৩
    সেলফোন--
    রঙিন নানান গেমখেলা
    বিদেশী নারীর কন্ঠ
    ১৪
    এক দশক বন্দুকে
    আঁকাআঁকি কবিতায় আরেকটি
    ব্যবসার পাট কবে হবে
    ১৫
    চরসের ধোঁয়া---
    স্মৃতি থেকে অতীত ও বর্তমান
    মুছে ফেলল কাশ্মিরী বালক
    ১৬
    যে কবিরা
    রাজনেতাদের সাথে ঘোরে
    সংসারেও রাজনীতি করে
    ১৭
    নগ্ন নারীদেহ
    কতবার দেখেছে ফেরারি
    ধারাবাহিক হত্যা করে তবু
    ১৮
    শোপ্যাঁ...শোপ্যাঁ...
    ডানা বাজাচ্ছে ঝিঁঝিঁ
    শ্রাবণ সন্ধ্যায়
    ১৯
    একা থাকে
    কথা কইতে চায় না
    খারাপ হবে কেন
    ২০
    আওয়াজ...
    বাজির আলো
    জড়িয়ে ধরার সুযোগ
    ২১
    পাকা বটফল টুপটাপ
    মাটি থেকে তুলে নিলেন গৌতমবুদ্ধ
    অসুস্থ কাঠবিড়ালি
    ২২
    ওপারে তাজমহল
    শাজাহান দেখছেন দূষণে নোংরা মার্বেলপাথর
    কালো তাজমহল এলো
    ২৩
    পাক খেয়ে উঠছে শাড়ি
    নারী অঙ্গের বাঁকে নেচে উঠছে
    মরা পলুপোকা
    ২৪
    চিনিমুখে পিঁপড়েরা
    আখগাছের গোড়ায় সুখের বাসা পিঁপড়ের
    চাষির কাস্তে
    ২৫
    ঘুণপোকার উন্নতি
    ভালো বা খারাপ সময়টা যারই হোক যাই হোক
    মহামহিম মহামহিম
    ২৬
    লোডশেডিঙের গ্রীষ্ম
    এমনকী দেশি পোষা কুকুররাও ডাকছে
    ঝরঝরে তুষার
    ২৭
    পুরুষ শাঁখ: কে বেশি সুন্দরী?
    মাদি শাঁখ নাকি শাঁখা-রুলি পরা বউটি!
    কলম হারিয়েছে
    ২৮
    বালিতে জুতোর দাগ
    বর্ষা এলে বাঁকবদল চায়নি নদী
    শরতের খরা
    ২৯
    পথে পায়রার ঝাঁক
    থলে থেকে গম উপুড় করে গেছেন ব্যবসায়ী
    ভিখারির কাশি
    ৩০
    আমাদের শান্তি....নিকেতন
    ফুল ও শাড়ির রঙে বসন্তের নাচ
    ওপচানো ট্রেন
    ৩১
    পাতালপুরীতে ফাল্গুন
    দরজায় কড়া নাড়ছে মৌরলাঝাঁক
    মেয়েটির ভাসমান লাশ
    ৩৩
    যতটুকু ঝুঁকে দেখা
    বাতাসে ছড়ানো আকাশ
    ল্যাজের রক্তাভ আলো
    ৩৪
    কোমরে হাত মেয়েটি
    সম্রাট অশোক কাঁদছেন
    কালো ঠান্ডা পাথর
    ৩৫
    মেঠোপথে লাশ
    লেবু পাতায় সবুজ টুপটাপ
    স্যাঁতসেঁতে ঘাসফড়িং
    ৩৬
    সুন্দরী পাতার রস
    রক্তাক্ত হাত ছেলেটির
    মৌয়ালিরা ফিরছে মধু নিয়ে
    ৩৭
    শ্মশানে ধোঁয়ার কুন্ডলী
    জলে চিংড়ি মাছের ঝাঁক
    গৌতমবুদ্ধ হেঁটে গেলেন
    ৩৮
    হাসছে বুড়ো লোকটির ভুঁড়ি
    আমের গাছে লাল-হলুদ
    কেউ একজন চুমু খেল
    ৩৯
    শিমুলগাছে কোকিলের গান
    আঁস্তাকুড়ে ভিড় বাড়ছে
    কবিরদাস দোহা গাইতে-গাইতে গেলেন
    ৪০
    বর্ষার প্রথম সকাল
    বারান্দায় বাবার চটিজোড়া
    ডাকপিওনের হাঁক
    ৪১
    মুম্বাইয়ের তিরিশতলায়
    নাকতলার গলি
    কুকুরের পেছনে ছোঁড়ারা
    ৪২
    ছাদে কাপড় মেলছে বউটি
    দড়িতে ঘুড়ি আটক
    দুপুরের গান
    ৪৩
    দ্রুতিমেদুর শ্বেতাঙ্গিনীরা
    অকেজো কমপিউটার
    মেকানিকের মুঠোয় তিনগুণিতক
    ৪৪
    আকাশে ২৩৮ প্রার্থনায়
    পিছলে গেলেন ইষ্টদেবরা
    পেট্রলগন্ধী দাউ-দাউ
    ৪৫
    দিশি বন্দুকের ফটকা
    আলকুশির রোঁয়া
    উড়ছে। গোলা পায়রার ঝাঁক
    ৪৬
    শিশির ভেজা ঘাসে
    আজ সবুজ পায়ের দাগ
    বৈরাগির দোতারায় সন্ধ্যা
    ৪৭
    খুপরির অন্ধকার দিকটিতে
    পিছন ফিরে পূর্ণিমা
    ভিখারিণীর নোয়া
    ৪৮
    জ্বলন্ত শহরের ছাইয়ে
    গ্রিক সেনাপতি মিনান্ডার। পাটুলিপুত্রে
    নাগার্জুন ধুলো মাখছেন
    ৪৯
    কুয়াপুজোয় নাচছে হিজড়েরা
    রাধেশ্যাম রাধেশ্যাম
    কেঁদে উঠলো নতুন মানুষ
    ৫০
    আঙিনায় থই-থই
    ঝলমলে খিচুড়ির অমলতাস
    প্রগাঢ় চোখমুখ
    ৫১
    গোধুলি লগ্নের পানের বরজে
    অশ্রুসজল রুমাল
    বিসমিল্লা খান
    ৫২
    জুজুধান ঝড়ে বনজ
    মণিপদ্মে গোণ্ড-মুর্মু-ওঁরাও; উনি
    অশথ্থ গাছের তলায় চোখ বুজলেন
    ৫৩
    একটি মৃতদেহ
    সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে আছে
    পুরুষ মাকড়সা
    ৫৪
    দুরুদুরু শ্মশান
    সাজানো কাঠের ওপর চোখ বুজে
    ছানাসহ কুকুর
    ৫৫
    শ্রাবণের দ্বৈরথে ফ্ল্যাটবাড়ি
    দেড়শো বছর লড়ে পড়ে গেল
    পায়রারা পথে
    ৫৬
    চোরেদের স্মৃতি
    রবীন্দ্রনাথের চটি রয়েছে শোকেসে
    মাপে বড্ডো বড়
    ৫৭
    রক্তাক্ত কৃষক
    ঝুঁকে আছে ধানের শীষ
    অস্থির মাঠে
    ৫৮
    মহাষ্টমী
    গরদ-নোলক গৃহিনী
    হাতে ব্ল্যাকবেরি
    ৫৯
    রূপোলি টাকা
    সিঁদুর মাখা
    বৃষ্টির অপেক্ষায়
    ৬০
    তৃতীয় বউকে নিয়ে
    প্রথম ট্রামে
    মৌলভি যুবক
    ৬১
    চৈত্রের বাতাস
    নিখুঁত চাঞ্চল্য
    যুবতীর আঁচলে
    ৬২
    পাকা আম
    পাড়তে বারণ করছে
    গ্রীষ্মের লুবাতাস
    ৬৩
    সোজা গিয়ে বাঁদিকে
    কানা গলির শেষে
    প্রেমিকার শ্বশুরবাড়ি
    ৬৪
    মাইকে বলিউডি গান
    পোস্টারে মার্কস
    বিশ্বকর্মা পুজো
    ৬৫
    ওনার বিড়াল
    আমার বাড়ির মাছ
    তাঁর আনন্দ
     দুটি বিশ্ব
    আমরা তো জানি রে আমরা সেরে ওঠার অযোগ্য
    তাই বলে বৃষ্টির প্রতিধ্বনিতে ভেজা তোদের কুচুটে ফুসফুসে
    গোলাপি বর্ষাতি গায়ে কুঁজো ভেটকির ঝাঁক সাঁতরাবে কেন

    তোদের নাকি ধমনীতে ছিল ছাইমাখা পায়রাদের একভাষী উড়াল
    শুনেছি অন্ধের দিব্যদৃষ্টি মেলে গাবদাগতর মেঘ পুষতিস
    বগলে গুঁজে রাখতিস গাধার চিল্লানিতে ঠাসা রোজনামচা
    আর এখন বলছিস ভোটদান তো দানবীর কর্ণও করেননি

    কে না জানে শববাহকরাই চিরকাল অমর হয়েছে
    ঔরসের অন্ধকারে কথা বলার লোক পেলি না বলে
    ঘড়িঘরহীন শহরে ওয়ান-শট প্রেমিকা খুঁজলি
    কী রে তোদের কি ঠিক-ঠিকানা নেই না রক্তের দোষ
    যে বলিপড়া আয়নায় চোপরদিন লোলচর্ম প্রতিবিম্ব পড়ে
    ছি ছি ছি নিঃশ্বাস ফেলে সেটাই আবার প্রশ্বাস হিসেবে ফেরত চাস
    আমি তো ভেবেছিলুম তোরা সন্দেহ করার অধিকার প্রয়োগ করবি
    তা নয় সারা গায়ে প্রাগৈতিহাসিক চুল নিয়ে ঢুং ঢুং তুলো ধুনছিস
    শুভেচ্ছা রইল তোরা যেন দুঃশাসনের হাত দুটো পাস
    যা দিয়ে ধোঁয়ার দুর্গে বসে ফুলঝুরির ফিনকি গুনবি

    কী বিষয় কী বিষয়
          আররে রবীন্দ্রনাথ
    তোমার সঙ্গেই তো নেচেছিলুম সেদিন
    আঙুলের ইতিহাসে একতারার হাফবাউল ড়িং ড়াং তুলে
    ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের জমঘট থেকে সদর স্ট্রিটের লবঙ্গবাজারে
    যেতে-যেতে তুমি বললে আমাগো শিলাইদহ থিকা আসতাসি
    আলুমুদ্দিন দপতর যামু
           আগুন আর জলের তৈরি তোমার ঠোঁটে
    তখনও একচিলতে ব্রহ্মসঙ্গীত লেগেছিল কী গরম কী গরম
    গ্যাবার্ডিনের আলখাল্লা ফেলে দিলে ছুঁড়ে
    দেখলুম তোমার ফর্সা গায়ে জোঁক ধরেছে
    বড়ো জোঁক বর্ষার জোড়াসাঁকোয়
         সেলিমের দোকানে শিককাবাবের গন্ধে
    নেড়েগুলা কী রান্ধতাসে ? জানতে চাইলে
    ও বললে, না বুঝলুঁ ? সাঁড়কে ছালন ছে !
    আহাঁ দেখুঁ না চখকে
         চায়ের ঠেকে টাকমাথা চুটকি দাড়ি 
    ভ্লাদিমির ইলিচ আর সোনালিচুল ভেরা ইভানোভা জাসুলিচ
    আর তোমার মতন রুপোলি দাড়িতে অ্যাক্সেলরদ আর মারতভ 
    যার গাল আপনা-আপনি কাঁপছিল দেখে 
    তুমি বললে, উয়াদের ধড়গুলা কুথায় ?
         আমি আমার নাচ থামাতে পারছিলুম না বলে 
    তুমি নিজের একতারাটা দিতে চাইলে 
    কেননা তোমার পা থেকে নাচ যে পেরেছে খুলে নিয়ে গেছে
    আর এখন তো দিনের বেলাও হ্যালোজেন জ্বলে
    কী আনন্দ কী আনন্দ
         সদর স্ট্রিটের বারান্দায় 
    তোমার তিনঠেঙে চেয়ারখানা পড়ে আছে
    হুড়োহুড়ি প্রেম করতে গিয়ে পায়া ভেঙে ফেলেছিলে
    তারিখ-সন লেখা আছে জীবনস্মৃতিতে
    কী ভালোবাসা কী ভালোবাসা
         তোমার ফিটনগাড়ির ঘোড়া তো
    কোকিলের মতন ডাকছে দাদু রবীন্দ্রনাথ
    আর তোমার বীর্যের রেলিক্স থেকে 
    কতজন যে পয়দা হয়েছিল মাটি থেকে 
    ছোলাভাজা তুলে খাচ্ছে
         ওগুলা কী ? আমি বললুম কাক;
    ওগুলারে কী কয় ? আমি বললুম সেলিমকেই জিগেস করো
    ও এই অঞ্চলে তোলা আদায় করে ।
    কী ঐশ্বর্য কী ঐশ্বর্য
    আমি ভঙ্গুর হে
        আমি যে-নাকি গাইডের কাছে ইতিহাস-শেখা ফোস্কাপড়া পর্যটক
    ছায়ায় হেলান-দেয়া বাতিস্তম্ভের আদলে গিসলুম পিতৃত্ব ফলাবার ইসকুলে
    জানতুম যতই যাই হোক ল্যাজটাই কুকুরকে নাড়ায় রে
    .
        আমি যে-নাকি প্ল্যাটফর্মে ভবিষ্যভীতু কনের টাকলামাথা দোজবর
    বস্তাপ্রতিম বানিয়ার বংশে এনেছিলুম হাইতোলা চিকেন চাউনি
    কাদাকাঙাল ঠ্যাঙ থেকে ঝরাচ্ছিলুম ঘেসো ঝিঁঝির সাম্ভানাচ
    .
        আমি যে-নাকি ফানুসনাভি ব্যাঙ থপথপে শুশুকমাথা আমলা
    মাটিমাখা নতুন আলুর চোখে-দেখা দু'টাকা ডজন রামপ্রসাদী জবা
    চাষির ঢঙে বলদ অনুসরণ করে পৌঁছেছিলুম বিধানসভার কুয়োতলায়
    .
    আমি যে-নাকি পোলকাফোঁটা পুঁইফুলে দু'ভাঁজ করা হেঁইয়োরত বাতাস
    ঢেউ-চাবকানো ঝড়ে যখন বঁড়শি-খেলা পুঁটির পাশে ভাসছি
    তখন বুঝলি লম্বালম্বি করে কাটা কথাবাত্রার লাটিমছেঁড়া ঘুড়ি
    .
    আমি যে-নাকি ভূতলবাহী আওয়াজ-মিস্ত্রি হলদে-ল্যাঙোট বাবুই
    চোখে-চোখে শেকল আঁকা ভিড়ের মধ্যে এঁদো বিভাগের কেঁদো
    চি২ড়ি-দাড়া আঙুল দিয়ে খুলছি বসে জটপাকানো মুচকি ঠোঁটের হাসি 
    আলফা ফিমেল বিড়ালিনী
    ক্যাটওয়াকে শোস্টপার, শব্দহীন আলতো স্টিলেটো ফেলে দেহের আলোয়
    মেলে ধরছিস তুই বাঁকের বদলগুলো হাসির হদিস তুলে, ঠিক যেন
    ইমলিতলার তিন তলা থেকে বারবার ভাসাচ্ছিস দু'থাবার
    তুলোট ম্যাজিক, অবন্তিকা, আলফা ফিমেল বিড়ালিনী, কোলে নিয়ে
    আদর করিস যাকে তারই চরিত্র তোকে চেপে ধরে কালো শাদা বাদামি ধূসর
    নক্ষত্র ক্লোনিং চোখে অর্গলছেঁড়া তোর লিভ-ইন কোনো পৌরাণিক
    ঋষির রেশমি ঠোঁটে দরোজাবর্জিত কিছু অ্যাগ্রেসিভ আঁচড়-কামড়
    তুই কি নীলাভ দূরত্বে থাকা অরুন্ধতী ? নাকি তুই
    হবির্ভূ সন্নতি কলা অনসূয়া ক্ষমা শ্রদ্ধার কোঁকড়া ঘনান্ধকারে
    দু'পাশে দর্শক নিয়ে ক্যাটওয়াকে হাঁটছিস দেশ-কালহীন ?
    তাই তোকে বর্ণসংকর করা কতই সহজ দ্যাখ, আদুরে অ-নাস্তিক
    নিজেই নিজেকে চেটে অহরহ স্পিক অ্যান্ড স্প্যান থাকবার
    যৌনতার নরম মডেল তোর আদি-মা বা পূর্বপুরুষ ছিল কিনা
    কেউই জানে না দেখতে কীরকম গায়ের আদল কন্ঠস্বর
    শ্বাসে তোর পাখির উড়াল-গান ইঁদুরের মৃত্যুমুখী খেলা মাছেদের ঘাই
    অবন্তিকা, অধুনান্তিকা, তোকে সীমা দিয়ে বেঁধে ফেলা অসম্ভব !
    কোন পুরুষ ? কোন পুরুষ ? কোন পুরুষ ? কোন পুরুষ ?
    তৈমুর আত্তিলা-হুন ক্যালিগুলা পল-পট রোবেসপিয়ার ? নাহ--
    তোর প্রেম অনির্ণেয় তবু তুই ক্যাটওয়াকে গ্রীবা তুলে আমাকে খুঁজিস...
    চলো গুলফিঘাট
    কেউ মরলেই তার শব ঘিরে মৃত্যু উৎসব ছিল ইমলিতলায়
    বয়ঃসন্ধির পর দেহের ভেতরে অহরহ উৎসব চলে তাই
    তারা মারা গেলে কান্নাকাটি চাপড়ানি নয় বিলাপ কেবল
    শিশুদের জন্য করো বাচ্চা-বুতরুর জন্য কাঁদো যত পারো
    শবখাটে চারকোণে মাটির ধুনুচি বেঁধে গুলফি ঘাটের শমসানে
    ঢোলচি ঢোলকসহ সানাই বাজিয়ে নেচে আর গেয়ে পাড়ার ছোঁড়ারা
    কুড়োতুম ছুঁড়ে-ফেলা তামার পয়সা প্যাঁড়া আম লিচু আকন্দের মালা
    ফিরে এসে বিকালে রোয়াকে বসে বুড়ো বুড়ি কিশোর যুবক
    তাড়ি বা ঠররা আর তার সাথে শুয়োরের পোড়া পিঠ-পেট
    খেতে-খেতে ঠহাকা-মাখানো হাসি মাথায় গামছা বেঁধে গান
    আমি মরবার পর ছেরাদ্দ বা শোকসভা নয় ; ইমলিতলার ঢঙে
    উৎসব করবার কথা ছেলেকে মেয়েকে বলা আছে : মদ-মাংস খাও
    স্বজন বান্ধব জ্ঞাতি সবাইকে বলো অংশ নিতে শমসানের পথে
    বেহেড হুল্লোড় করে নাচতে গাইতে যেও ফিরো নেচে গেয়ে
    মেটালিকা পাঙ্ক-রক হিপ-হপ সুমন শাকিরা ক্যাকটাস
    বিটলস এলভিস কিশোর কুমার ও ইয়ুডলিঙে আর ডি বর্মণ...
     
    নুন ও নিমকহারামি
    তুই তো আমার ঘাম জিভ দিয়ে ছুঁয়ে
    বলেছিলি অবন্তিকা, 'আহ কি নোনতা
    অন্তরতমের প্রাণ পুরুষালি ঘ্রাণ--'
    সেইদিন, লক-আপ থেকে আদালতে
    হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ির
    ফাঁসে বাঁধা, হেঁটেছি ডাকাত খুনিদের
    সাথে, রাজপথে সার্কাসপ্রেমীর ভিড়...
    বিশ্বাসঘাতক যারা, আমার  বিরুদ্ধে
    আদালতে রাজসাক্ষী হয়েছিল,  তারা
    কাঠগড়া থেকে নেমে বলেছিল, নুন
    তো পায়নি, মিষ্টি ছিল আমার ঘামেতে;
    তাই বিশ্বাসভঙ্গের প্রশ্ন নেই  কোনো
    নিমকহারামি বলা চলবে না তাকে !                       
               
    আলফা পুরুষের কবিতা
    কী দিয়ে তৈরি তুই ? নারীকে কবিতায়
    আনা যাবেনাকো বলে তোর হুমকি,
    অবন্তিকা ! কোন ঋতু দিয়ে গড়া ? স্কচ
    না সিংগল মল্ট ? নাকি তুই হোমিওপ্যাথির
    শিশি থেকে উবে যাওয়া ৩৫ হাজার ফিট
    ওপরে আকাশে, প্লেনের হোল্ডে রাখা শীতে
    নদীর মোচড়ানো বাঁকে ইলিশের ঝাঁক ?
    আলোকে দেশলাই বলে ভাবলি কীভাবে ?
    কেন ? কেন ? কেন ? কেন ?  অ্যাঁ, অবু , 
    অবন্তিকা ? ভুলে গেলি তোরই ছোঁয়া পেয়ে
    আড়মোড়া ভেঙেছিল চকমকি পুরুষ-পাথর !
    বল তুই, বলে ফ্যাল, মিটিয়ে নে মিঠে ঝাল
    জমা করে রেখেছিস স্কচ-খাওয়া জিভে ;
    তোরই বাড়িকে ঘিরে তুষারের তীব্র আলো
    সূর্য ওঠেনি আজ পনেরো দিনের বেশি
    তবু তোর মুখশ্রী শীতে আলোকিত কেন ?
    আসলে অন্যের ওপরে রাগ, উপলক্ষ আমি
    হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুলে বল, দাঁতে দাঁত দিয়ে বল
    যে ভাবে ইচ্ছে তোর উগরে দে স্টক তোর...
    .
    তোকে নিয়ে লিখতে পারব না এ-নিষেধ
    অমান্য করেই তবে পাতছি চোরা শব্দফাঁদ
    অবন্তিকা মুখপুড়ি খুকিবাদী হে প্রেমিকা
    এই নে মাটির পোড়ানো আংটি হাঁটু গেড়ে
    দিচ্ছি তোর ক্রুদ্ধ আঙুলে, নিবি বা ফেলে দিবি
    তা তোর অ্যাড্রেনালিন বুঝবে অবন্তিকা
    আমি তো নাচার যতক্ষণ না যাচ্ছিস
    মগজের ছাইগাদা-বিস্মৃতির উড়ো আবডালে...
    স্প্যাম প্রেমিকা
    বাঃ বেশ, আচমকা ঢুকে এলি ডেস্কটপে সঙ্গে তোর ফোটো
    বহুরূপী আদুলগা, কুচকুচে হাসিমুখে ডাকছিস কালো সঙ্গমে
    দেখছি গোগ্রাসে তোকে বদলভারের জানজতব ভেনাস
    ভুলভাল ইংরেজি তলপেটে 'আই লাভ ইউ' লিখে
    কৃষ্ণকলি হুকার ললনা তোর ফাঁদপাতা প্রেম নিবেদন
    নরম উপাস্য উরু জাদুটোনা-করা নখে রঙ না রক্ত রে
    কোন দেশ থেকে এলি মুখপুড়ি ? কেনিয়া উগান্ডা জাম্বিয়া
    বুরকিনা ফাসো কংগো ক্যামেরুন সুদান নিঝের ?
    মুম্বাই এসে ঘাঁটি গেড়েছিস নাইজারওয়াডিতে দলবেঁধে !
    কী করে জানলি হ্যাঁ রে আফ্রিকার নারীসঙ্গ পাইনি কখনও ?
    বেশ তোর হাইপার রিয়্যাল যৌন আবেদন ল্যাপটপ আলো
    বিশদ জানিস তা । আসতে চাস আলিঙ্গনে তাই। কত টাকা
    নাকি ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যাবে ওই অভিজ্ঞতা
    লিখিসনি তো ? কেবল দেখা করতে বলেছিস মীরা রোডে
    জংশনের মোড়ে, ডিজিটাল রূপ ছেড়ে নামবি শহরে ।
    নখ কাটা ও প্রেম
    রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে:
    কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন,
    সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?
    যুবতীরা আপনার হাতখানা কোলের ওপরে নিয়ে নখ
    কেটে দিচ্ছেন, এরকম ফোটো কেউ তোলেনি যে
    ওকামপোর হাঁটুর ওপরে রাখা আপনার দর্শনীয় পা ? 
    .
    মহাত্মা গান্ধির দুই ডানা রাখবার সাথিনেরা
    বোধহয় কেটে দিত নখ; কেননা বার্ধক্যে পৌঁছে
    নিজের পায়ের কাছে নেইল-কাটার নিয়ে যাওয়া, ওফ, কি
    কষ্টের, আমার মতন বুড়ো যুবতীসঙ্গীহীন পদ্য-লিখিয়েরা
    জানে, প্রেম যে কখন বয়সের দাবি নিয়ে আসে ।
    .
    ফিসফিসে লোকে বলে সুনীলদার প্রতিটি নখের জন্যে 
    উঠতি-কবিনী থাকে এক-একজন। জয় গোস্বামীরও 
    ছিল, তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাগরের পাঁকে, জাহাজকে ছেড়ে। 
    চাইবাসার ছোটোঘরে শক্তিদার নখ কেটে দিচ্ছেন প্রেমিকাটি
    দেখেছি যৌবনে। বিজয়াদিদির নখ কেটে দ্যান কি শরৎ ?
    .
    যশোধরা তোর নখ কেটে কি দিয়েছে তৃণাঞ্জন কখনও ?
    সুবোধ আপনি নখ কেটে দিয়েছেন মল্লিকার পা-দুখানি
    কোলের ওপরে তুলে ? কবি কত একা টের পেতে, তার পা-এ
    তাকালেই বোঝা যায়। যেমন জীবনানন্দ, হাজার বছর
    খুঁজে চলেছেন কবে কোন বনলতা নখ কেটে দিয়ে যাবে তাঁর ।
    অমরত্ব
    সালিশি-সভার শেষে তাড়া করে পিটিয়ে মেরেছে যারা, তারা
    তোকেও রেয়াত করল না অবন্তিকা । আমরা দুজনে পচে
    চলেছি হুগলি ঘোলা জলে ভেসে ; কী দোষ বলতো আমাদের ?
    বউ তুই বৈভবশালীর : আমি গোপন প্রেমিক ছোটোলোক ।
    সাম্যবাদ নিয়ে কত কথা চালাচালি হল তিরিশ বছরে ;
    প্রেমিকের জন্যে নয় । কে জানে কাদের জ্ঞানে লেগেছে কেতাব...
    প্রেমে পচে গলে হারিয়া যাওয়া ছাড়া যা থাকে তা অর্থহীন
    সংসারের ঘানি টেনে কলুর বলদে মেটামরফোজড প্রাণী,
    পার্টির ফেকলু কর্মী । ভালো এই লাশ হয়ে সমুদ্র ফেনার
    বিশাল ঢেউয়ে ছেপে আঁশটে-আলোর পথে মৃত জড়াজড়ি…
    ডেথ মেটাল
    মুখপুড়ি অবন্তিকা, চুমু খেয়ে টিশু দিয়ে ঠোঁট পুঁছে নিলি !
    শ্বাসে ভ্যাপসা চোখের তলায় যুদ্ধচিহ্ণ এঁকে ডেথ মেটাল মাথা দোলাচ্ছিস
    চামড়া-জ্যাকেট উপচে লাল নীল থঙ গলায় পেতল-বোতাম চোকার
    ঝাপটাচ্ছিস সেকুইন গ্ল্যাম রকার খোলা বাদামি চুল কোমরে বুলেট বেল্ট
    বেশ বুঝতে পারছি তোকে গানে ভর করেছে যেন লুঠের খেলা
    স্ক্রিমিং আর চেঁচানি-গান তোর কার জন্য কিলিউ কিলিউ কিল
    ইউ, লাভিউ লাভিউ লাভ ইউ কাঁসার ব্যাজ-পিন কব্জিবেল্ট
    কুঁচকিতে হাত চাপড়ে আগুনের মধু'র কথা বলছিস বারবার 
    আমি তো বোলতি বন্ধ থ, তুই কি কালচে ত্বকের সেই বাঙালি মেয়েটা ?
    কোথায় লুকোলি হ্যাঁরে কৈশোরের ভিজেচুল রবীন্দ্রনাথের স্বরলিপি
    কবে থেকে নব্বুই নাকি শূন্য দশকে ঘটল তোর এই পালটিরূপ
    পাইরেট বুট-পা দুদিকে রেখে ঝাবড়া চুলে হেড ব্যাং হেড ব্যাং হেড ব্যাং
    ঝাঁকাচ্ছিস রঙিন পাথরমালা বুকের খাঁজেতে কাঁকড়া এঁকে
    পাগলের অদৃশ্য মুকুট পরে দানব-ব্লেড বেজ গিটারে গাইছিস
    বোলাও যেখানে চাই নেশা দাও প্রেমজন্তুকে মারো অ্যানথ্র্যাক্স বিষে
    মেরে ফ্যালো মেরে ফ্যালো মেরে ফ্যালো কিল হিম কিল হিম কিল
    কিন্তু কাকে বলছিস তুই বাহুতে করোটি উলকি : আমাকে ?
    নাকি আমাদের সবাইকে যারা তোকে লাই দিয়ে ঝড়েতে তুলেছে ?
    যে আলো দুঃস্বপ্নের আনন্দ ভেঙে জলের ফোঁটাকে চেরে
    জাপটে ধরছিস তার ধাতব বুকের তাপ মাইকে নিংড়ে তুলে
    ড্রামবিটে লুকোনো আগুনে শীতে পুড়ছিস পোড়াচ্ছিস
    দেয়াল-পাঁজিতে লিখে গিয়েছিলি 'ফেরারি জারজ লোক'
    ভাঙাচোরা ফাটা বাক্যে লালা-শ্বাস ভাষার ভেতরে দীপ্ত
    নিজেরই লেখা গানে মার্টিনা অ্যসটর নাকি 'চরম শত্রু দল'-এ
    অ্যানজেলা গস কিংবা নাইটউইশ-এর টারজা টুরম্যান
    লিটা ফোর্ড, মরগ্যান ল্যানডার, অ্যামি লি'র বাঙালি বিচ্ছু তুই
    লাল নীল বেগুনি লেজার-আলো ঘুরে ঘুরে বলেই চলেছে
    তোরই প্রেমিককে কিল হিম লাভ হিম কিল হিম লাভ হিম লাভ
    হিম আর ঝাঁকাচ্ছিস ঝাঁকড়া বাদামি চুল দোলাচ্ছিস উন্মত্ত দুহাত…
    ব্লাড লিরিক
    অবন্তিকা, তোর খোঁজে মাঝরাতে বাড়ি সার্চ হল
    এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
    যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
    .
    কী করেছি কবিতার জন্য আগ্নেয়গিরিতে নেমে !
    এ কি, এ কি, কী বেরোচ্ছে বাড়ি সার্চ করে
    কবিতায় ? বাবার কাচের আলমারি ভেঙে ব্রোমাইড সেপিয়া খুকিরা
    কবিতায় । হাতুড়ির বাড়ি মেরে মায়ের তোরঙ্গে ছিঁড়ে বিয়ের সুগন্ধী                                                                                                  বেনারসী
    কবিতায় । সিজার লিস্টে শ্বাস নথি করা আছে
    কবিতায় । কী বেরোলো ? কী বেরোলো ? দেখান দেখান
    কবিতায় । ছি ছি ছি ছি, যুবতীর আধচাটা যুবা ! মরো তুমি মরো
    কবিতায় । সমুদ্রের নীলগোছা ঢেউ চিরে হাড়মাস চেবাচ্ছে হাঙর কবিতায় । 
    পাকানো ক্ষুদ্রান্ত্র খুলে এবি নেগেটিভ সূর্য
    কবিতায় । অস্হিরতা ধরে-রাখা পদচিহ্ণে দমবন্ধ গতি
    কবিতায় । লকআপে পেচ্ছাপে ভাসছে কচি বেশ্যা-দেখা আলো
    কবিতায় । বোলতার কাঁটাপায়ে সরিষা ফুলের বীর্যরেণু
    কবিতায় । নুনে সাদা ফাটা মাঠে মেটেল ল্যাঙোটে ভুখা চাষি
    কবিতায় । লাশভূক শকুনের পচারক্ত কিংখাব গলার পালকে
    কবিতায় । কুঁদুলে গুমোট  ভিড়ে চটা-ওঠা ভ্যাপসা শতক
    কবিতায় । হাড়িকাঠে ধী-সত্তার কালো-কালো মড়া চিৎকার
    কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরলে না কেন
    কবিতায় । মুখে আগুন মুখে আগুন মুখে আগুন হোক
    কবিতায় । মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো তুমি মরো
    কবিতায় । এর মতো ওর মতো তার মতো কারো মতো নয়
    কবিতায় । যেন এমন যেন অমন যেন তেমন নয়
    কবিতায়, অবন্তিকা, তোর খোঁজে সার্চ হল, তোকে নিয়ে কই গেল না                                                                                                       তো !
    নেই কিন্তু ছিল
    সেই লাল ল্যাঙোট দুদিক থেকে ফিতে দিয়ে কোমরে বাঁধা
    আর সামনে দিকে লম্বা পাড় লাল নীল হলুদ সবুজ যে রঙ চাই
    লিঙ্গকে বেকাবু হওয়া থেকে বাঁচাবার জন্য
    লম্বাআআআআ খোলের ভেতর ভাঁজ-ভাঁজ টাকা
    টাকাগুলো ঠেশে কুঁচকির মাঝে
    যাতে অন্য লোকেরা মনে করে
    উরিব্বাপ কোন পাড়ার চাঁদু
    কী সাইজ রে
    আসলে নেই -- লিঙ্গই নেই লোকটার কিন্তু সিনেমার লাইনে
    মারামারি করতে হবে আলিয়া ভাটকে পর্দায় পেতে
    গায়ে সর্ষের তেলে মেখে ভিড়ে সেঁদিয়ে যাবার পেছল--
    দাদা এটা আলিয়া ভাটের ফিল্ম নয় -- কারিনা কাপুরের --
    তো কী হয়েছে, যাঁহা আলিয়া তাঁহা কারিনা, তারা তো পর্দায়--
    আসলে তো ল্যাঙোটে রয়েছে ডোডোপাখি
    ভয় পেতে হলে ডায়নোসর, লম্বাআআআআ গলা
    ঠেকাবেন কি করে ? কী আর করা যাবে বলুন !
    ফসিল তো আছে । লাল ল্যাঙোটের জীবাশ্ম !
     
    আমার স্বদেশ
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে আদিবাড়ি উত্তরপাড়া আমার দেশ নয়
    জানি গঙ্গায় অপরিচিতদের চোখ খুবলানো লাশ ভেসে আসে
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে পিসিমার আহিরিটোলা আমার দেশ নয়
    জানি পাশেই সোনাগাছি পাড়ায় প্রতিদিন তুলে আনা কিশোরিদের বেঁধে রাখা হয়
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে মামার বাড়ি পাণিহাটি আমার দেশ নয়
    জানি কোন পাড়ায় দিনদুপুরে কাদের খুন করা হয়েছে
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে শৈশবের কোন্নগর আমার দেশ নয়
    জানি কারা কাদের দিয়ে কাকে গলা কেটে মারতে পাঠায়
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে যৌবনের কলকাতা আমার দেশ নয়
    জানি কারা কাদের বোমা মারে বাসে-ট্রামে আগুন লাগায়
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে পশ্চিমবঙ্গ আমার দেশ নয়
    এদেশের লকআপে পিটুনি খেয়ে থেঁতলে মরার অধিকার আমার আছে
    এদেশের চা-বাগানে না খেতে পেয়ে দড়িদঙ্কা হবার অধিকার আমার আছে
    এদেশের চটকলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলার অধিকার আমার আছে
    এদেশের দলগুণ্ডাদের পোঁতা মাটির তলায় হাড় হবার অধিকার আমার আছে
    এদেশের ধনীদের ফাঁদে ফেঁসে সর্বস্বান্ত হবার অধিকার আমার আছে
    এদেশের শাসকদের বাঁধা লিউকোপ্লাস্ট মুখে বোবা থাকার অধিকার আমার আছে
    এদেশের নেতাদের ফোঁপরা বক্তৃতা আর গালমন্দ শোনার অধিকার আমার আছে
    এদেশের অবরোধকারীদের আটকানো পথে হার্টফেল করার অধিকার আমার আছে
    আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে বাংলাভাষা আমার স্বদেশ নয়       
     
    সোনাগাছিতে বৃষ্টি
    পাকানো সিঁড়ির শেষে, তিন তলার বাঁকে, বলল পিসতুতো দাদা
    "এই হল সোনাগাছি, শহরের রানি, ফি-রাত্তিরে পাঁচ লিটার
    খোকাখুকু জমা হয় এ-পাড়ায়, ভেবে দ্যাখ, মৌজমস্তিতে নষ্ট
    কত-শত মহান পুরুষ-নারী, জন্মাবার আগেই খাল্লাস ;
    ওই যে গুটকাঠোঁট মাসি, ওকে বললেই, যাকে চাই নিস--
    এখন তো চুলখোলা মেয়েদের নধর দুপুর, সকলেই ফাঁকা,
    হাফরেটে সুন্দরীতমাকে পেয়ে যাবি ; কাজ আছে, আমি চললুম ।"
    .
    'ঘরে নয়, বিছানায় নয়, চলো না কালবৈশাখিতে ভিজে
    প্রেমিকার অভাব মেটাই', বলি কালো মেয়েটিকে ।
    .
    চুড়িদার শ্যামলিমা আর আমি কোমর জড়িয়ে
    আহিরিটোলার ঘাটে ঝোড়োজল গঙ্গায় নামি--
    ও হয় ফোলানো পালের নৌকো, চিৎসাঁতার দোল খায়
    আমি হই লগিঠেলা ভাটিয়াল মাঝি ।
    .
    "আবার এসো কিন্তু, অ্যাঁ, প্রেমিকা ভেবেই চলে এসো
    যেদিন পড়বে বৃষ্টি, ভেতরে তো ভিজছি না
    বাইরের ভেজবার রোগটুকু দিয়ে চলে যেও ।"
    ঋতুর মানুষসংহার
    শরৎকাল এসে গেছে নাকি ! কই, বলেনি তো কেউ !
    বাড়িতে বাংলা ক্যালেণ্ডার নেই, পাঁজি নেই, জানি না কখন কোন ঋতু
    আসে আর চলে যায়, যৎসামান্য শরতের উঁকি মারা টের পাই
    যখন সংবাদে শুনি চাষিরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে
    শরৎকে নিমন্ত্রণ করে আনছে । বর্ষায় বৃষ্টি তো হয়নি ;
    যেখানে হয়েছে সেখানেও এতো বেশি ডুবে গেছে খেত--
    খরা আর বানভাসি মিলে শরতের টুঁটি টিপে চাষিকেই শুধু নয়,
    দালাল ও আড়তদারকেও বিপদে ফেলেছে ।
    শরতের আকাশের কথা বাল্যে যা পড়েছিলুম তার কোনো কিছু
    দেখি না আকাশে হাওয়ায় । শধু তো ডিজেলের গুঁড়ো
    কুয়াশার পরিবর্তে নীলাভ ধোঁয়ায় ঢাকা কসমোপলিস । 
    রাতে হয়তো চাঁদ কোনো চল্লিশতলার ছাদে নেমেও নামে না
    রেভ পার্টি চলছে সেখানে অর্ধেক উদোম নেশারিনীদের
    অ্যাসিড রকের সাথে মেটালিক বাজনায় চলছে নাচানাচি ।
    বোনাসের টাকা নিয়ে মধ্যবিত্তের দল নেমেছে বাজারে
    শরৎকে কিনে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে
    কিন্তু শরৎ তো উধাও, কেবল বাজার পড়ে আছে তার
    ধুন্ধুমার উৎসবের ফাঁকা ঢোল নিয়ে ।
    স্যানিটারি ন্যাপকিন
    ভালোবাসা ওই মেয়েটির মতো যার
    স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল ; মাসে 
    সাড়ে তিন দিন কাপড়ে শুকনো ঘাস
    বেঁধে, পরে থাকতে হবে ; বর্ষায়
    ঘাস তো সবুজ, তখন কাপড়ে ছাই
    মুড়ে, রক্ত শুষে রাখবার তরকিবে
    চুপচাপ বইহীন একা বসে থাকা ।
    আমার ঠাকুমাকে যেন বলবেন না
    উনি আমাকে পছন্দ করতে বারন করেছিলেন
    আপনি কেন পছন্দ করছেন, নীরা ?
    আমি আজো শুঁয়োপোকা-ঠাশা ঈশান মেঘে চিৎসাঁতার দিই
    উনি পঞ্চাশ বছর আগে আমার কবিতা চাননি
    আপনি কেন চাইছেন, নীরা ?
    আমি আজো জলের দশপা গভীরে বরফের লাঠি চালাই
    উনি আমার সাবজুডিস মামলায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন
    আপনি সম্পাদক হয়ে কেন লেখা চাইছেন, নীরা ?
    আমি আজো স্মোকড পেংগুইনের চর্বির পরোটা খেতে ভালোবাসি
    উনি আমার কবিতার বইয়ের প্রকাশক হয়েও স্বীকার করেননি
    আপনি কেন স্বীকৃতি দিচ্ছেন, নীরা ?
    আমি আজো দুপুর-গেরস্হের হাঁমুখে সেঁদিয়ে ফ্যামিলিপ্যাক হাই তুলি
    উনি আমার নাম উচ্চারণ করতে চাইতেন না
    আপনি কেন তরুণদের কাছে করছেন, নীরা ?
    আমি আজো রক্তঘোলা জলে টাইগার শার্কদের সঙ্গে বলিউডি নাচে গান গাই
    উনি বলেছিলেন ওর মধ্যে সত্যিকারের লেখকের কোনো ব্যাপার নেই
    আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
    আমি ইমলিতলায় জানতুম কাঠকয়লা ছাড়া ইঁদুরপোড়ার স্বাদ হয় না
    উনি বলেছিলেন ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই
    আপনি কেন মনে করছেন আছে, নীরা ?
    আমি অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যাঙ্কনোট পুড়িয়ে মড়ার গন্ধ পেতুম
    উনি বলেছিলেন ওর দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না
    আপনি কেন মনে করছেন হয়েছে, নীরা ?
    আমি অ্যামস্টারডামের খালপাড়ে হাঁ-করা বুড়োদের লিরিক শুনেছি
    উনি সেসময়ে দুঃখ থেকে রাগ আর রাগ থেকে বিতৃষ্ণায় উঠেছেন
    আপনি এতো উদার কেন, নীরা ?
    আমার ঠাকুমাকে যেন প্লিজ বলবেন না । 
    কমেডি হল ট্র্যাজেডির পরগাছা
    কী নাম ছিল যেন সেই সম্পাদকের ? 'জনতা' পত্রিকার ? ১৯৬১ সালে 
    লিখেছিলেন, 'টিকবে না, টিকবে না,' প্রথম পাতায় !
    উনি ? হ্যাঁ, বোধহয় মোগাম্বো ওনার নাম ।
    তারপরে ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৬
    কে যেন সেই বেঁটেখাটো লোকটা লিখেছিল দৈনিকে
    'ওঃ, ও আর কতোদিন, টিকবে না, টিকবে না,' সাহিত্য বিভাগে
    কী যেন কী ছিল নাম, আরে সেই যে, সপ্ল্যানেডে, বুকস্টলে,
    মনে পড়ছে না ? কোথায় গেলেন উনি, সেই যে !
    গাবদাগতর এক লিটল ম্যাগাজিনে লিখলেন--
    উনি ? হ্যাঁ, বোধহয় ডক্টর ডাঙ ওনার নাম ।
    তারপরে ১৯৬৭, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭২
    মনে আসছে না ? চোখে চশমা ? হন হন পাশ কাটিয়ে--
    উনি ? হ্যাঁ, বোধহয় গব্বর সিং ওনার নাম ।
    কেন যা পারোনি রাখতে মনে করে ওনাদের পিতৃদত্ত নাম ।
    পঞ্চাশ বছরেই ভুলে গেলে ? গেলেন কোথায় ওঁরা !
    আরে সেই যে সেই ঢোলা প্যান্ট চাককাটা বুশশার্ট ?
    লিখলেন অতো করে, 'টিকবে না, টিকবে না।'
    তারপরে ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৭৯
    ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫
    ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১, ১৯৯২
    ১৯৯৩, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৬, ১৯৯৭, ১৯৯৮, ১৯৯৯
    ২০০০, ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৭
    ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫
    কী ? মনে পড়ল না এখনও ! অদ্ভুত লোক তো তুমি !
    অতগুলো লেখক সম্পাদক কবি পই পই করে
    লিখে গেল, 'টিকবে না, টিকবে না, বেশিদিন টিকবে না
    শিগগিরই ভুলে যাবে লোকে ।' অথচ তাদেরই নাম
    মনে আনতে এত হিমশিম ? তবে তাই হোক ।
    মোগাম্বো ডক্টর ডাঙ ও গব্বর সিংহ নামে
    বাঙালির ইতিহাসে ওনাদের তুলে রেখে দিই ।
    .
    শাশুড়ির জন্য প্রেমের কবিতা
    বাঁশদ্রোণী বাজারে শাশুড়িদের ভিড়ের ভেতর হাঁটতে-হাঁটতে আমি
    আমার শাশুড়িহীন জীবনের অভাব মেটাবার চেষ্টায়
    ভারি-ভরকম এক শাশুড়িকে বলি, দিন থলেটা, পৌঁছে দিচ্ছি--
    উনি বলেন, না, আমার ড্রাইভার আছে
    একজন শাশুড়ির কাছে কি তাহলে ড্রাইভারের গুরুত্ব বেশি !
    বোঝা উচিত ছিল, কেননা ওনার শাড়ি থেকে 
    বিদেশি পারফিউমের সুগন্ধ পাচ্ছিলুম
    আরেকজন শাশুড়ির কাছে গিয়ে জামাইষষ্ঠীর দিনের অভাব মেটাবার জন্য
    কিছু বলার আগেই উনি বলে ওঠেন
    ও বাবা একটু মাছটা টাটকা কিনা দেখে দাও তো
    আমার জামাই চিতল মুইঠা খেতে ভালোবাসে
    শাশুড়ি ছিল না বলে চিতল মুইঠা খাইনি কখনও
    তবু বলি, চিতল এরকমই হয়, তেমন টাটকা তো পাবেন না
    জামাইষষ্ঠীর বাজারে এসে আজ মনে হচ্ছে পুরো জগতটাই
    শাশুড়িময়, শুধু আমার ভাগ্যেই শাশুড়ি জুটলো না
    জানতে পারলুম না জামাইষষ্ঠীতে জামাইদের ভূমিকা কি
    শাশুড়িরা সেদিন জামাইদের নিজের মেয়ের চেয়ে বেশি আদর করেন নাকি
    কেমনভাবে কি-কি করেন ধুতি-পাঞ্জাবিতে হিরো জামাইকে নিয়ে
    আমার শাশুড়ি থাকলে আমি তাঁকে প্রণাম করবার জন্য
    ঠোঁটে একটা চুমু খেতুম
    উনি আমায় জড়িয়ে ধরে সকলের সামনে আদর করতেন
    আমি ওনাকে সালমান খানের ফিল্ম দেখাতে নিয়ে যেতুম
    ম্যাকডোনাল্ড কে এফ সি ডোমিনোজ পিৎজায় নিয়ে যেতুম
    ব্ল্যাক ফরেস্ট আইসক্রিম খাওয়াতুম
    সারা বাঁশদ্রোণী বাজার আজ ছেয়ে গেছে শাশুড়িতে
    এনাদের অনেকের ঠোঁটেই চুমু খাওয়া যায়
    ভিড়ের ভেতরে আমি জামাইহীন শাশুড়ির খোঁজ করি
    শেষে পেয়ে যাই একজনকে, উনি বলেন, ওনার ভাগ্য বড়ো খারাপ
    মেয়েও হয়নি আর ছেলেও হয়নি, আর দ্যাখো, শাশুড়িগুলোর ঢঙ
    আমি বলি, চলুন, তাহলে বাজার করে দিচ্ছি
    আমারও শশুর নেই, শাশুড়িও নেই
    কিন্তু আপনার ঠোঁটদুটো খুবই সুন্দর, এই বয়সেও মেইনটেন করেছেন
    উনি বলেন, না করলে আর পথজামাইদের ধরব কেমন করে !
    কলকাতার স্ট্যাচু
    ওরে, তোরা কি জানিস
    মোড়ের মূর্তির বদলে ওর মাথায়-বসা গোলা-পায়রাটার খ্যাতি কেন বেশি ?
    স্ট্যাচুটাতো ছিল মরার আগের দিন ব্যাপটাইজ করা কলকেতিয়া কাঙাল
    উপমা দিতে হলে বলতে হয় উনি ছিলেন অতুলনীয় একজন ফক্কা
    ওড়ার অভ্যাস ভুলে আলো-নাচুনি মাদি ঝিঁঝির ফুররি
    .
    ওরে, তোরা কি জানিস
    বিলিতি সায়েবের নাম-মোছা কবরফলক ফিরে এসচে শিল-নোড়া হয়ে
    দাদু-দিদা প্রজন্মের সেসব ভুতুড়ে ব্যথা-বেদনা যখন মশলা বাটায় মেশে
    মৌজমস্তির দিলদার ছকেতে সেসব শিহরণ মাইরি বলবার নয়
    যখন কিনা মৌমাছির পাখনার হাওয়া ছাড়া ফুলের বুকের জ্বালা কমে না
    .
    ওরে, তোরা কি জানিস
    বিশৃঙ্খলায় ঘাপটি মেরে যেসব নিহিতার্থ হরবখত ভোল পালটায়
    তাদের মৃত্যু তো একরকম কৌমার্য যা ছিল আমার ছেলেবেলায়
    যখন জনগণের জিভে জমানো তিতিবিরক্ত ফিসফিসানিগুলো
    পেঁকো পথের দু'ধারে অশথগাছে কচিমেরুন পাতার ঢঙে বেরিয়ে পড়েছিল
    .
    ওরে, তোরা কি জানিস
    প্র্রভূ সেজে মানুষের হাঁটার কায়দা কেন নাগরিকের থেকে আলাদা হয় ?
    আসলে মেঘের কানায়-কানায় কালচে-কালো ভাষা নিয়ে মারকাটারি আলো
    ফোঁপরা ছায়ার টুপি পরিয়ে ওকে হিরোগিরিতে এমন বুঁদ করে
    যিন নিষ্কলুষ নোংরামির জোয়ার বেচবার একচেটে মালিকানা পেয়েছে
    ঘাস
    ঘাস হয়ে জন্মেছি আমি, একজন কচি
    যুবতীর দু'পায়ের মাঝে, ঘিরে আছি তার
    গোপন গন্ধমাদনের ঝর্ণা, বিগত অস্তিত্বে
    ঘাসই ছিলুম, আমার সবুজ রক্ত পান করে
    জেব্রা মহিষ ভেড়া ছাগলেরা রক্তকে লাল
    করে নিতে পেরেছিল, আমিষলোভী
    এই যুবতীর রক্তে এখন মিশেছি, তাই
    তার দু'পায়ের মাঝে কোঁকড়া কৃষ্ণ ঘাস
    হয়ে ক্রমে জন্মালুম, আমি তোতলাবো
    প্রজাপতি-ডানার গরম উড়ালে
    তখন শীতল আগুনে দাউ-দাউ পুড়ে 
    ঠাণ্ডা হবো, মহাগ্রন্হের মলাট দুই পাশে
    যার জন্য ট্রয়ের লঙ্কার যুদ্ধ, কতো গল্প
    রয়েছে ঘাসের পৃথিবীতে, অতল গহ্বরে
    তৃষ্ণার্ত খেলার সঙ্গী হই আমি, দুপুরে
    সন্ধ্যায় রাতে তাতাই একাকীত্ব দিয়ে
    প্রতি মাসে একবার ডিমের পোচ খাই
    কখনও বা আঙুলের বদলে অন্যকিছু
    আমাকে লুকিয়ে করা অসম্ভব, জানে
    তাই মাঝে-মাঝে সেফটি-রেজর কাঁচি
    ঘাসনাশক দিয়ে আমাকে লোপাট করে
    আমিও নাছোড় প্রেমিক, মাথাচাড়া দিই
    ঘাসের সঙ্গে কারো পেরে ওঠা অসম্ভব
    সারা বিশ্ব জুড়ে আমাদের ভূরাজত্ব
    মরি না কখনও আমরা, কৃষ্ণ বা
    সবুজ ঘাসেরা, আমরা মহীরুহ নই
    মনে হয় শুকিয়ে গিয়েছি, আসলে জিরোই
    খেলতে সাহায্য করি বাঁচতে খোরাকি
    ঢেউ তুলব ঘর্মাক্ত শরীরে, একদা
    সবুজ ঘাস আমি, নবজন্মে আজ
    প্রহেলিকা ইশারার ফাঁদ পেতে আছি
    জানি কোনো সৎ-কাপুরুষ আসবে
    তার বাড়তি বীজ ফেলার জন্য রাতে

    আমার মহাপরিনির্বাণ - একটি পোস্টমডার্ন কবিতা
    “রাস্তার সব আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে দেয়া হয়েছিল
    দরোজায় টোকা দিতে বাইরে বেরোলেই
    পেছন থেকে চুলের মুঠি ধরে গলায় কাস্তে চালিয়ে দিলুম
    জিভে রক্তের ছিটে এসে লাগল
    সেই থেকে রক্তের প্রতি আমার ভালোবাসা
    এখন করোটিতে ভরে রক্তপান করি
    তখন তো আমি সতেরো বছরের যুবতী
    এখন বয়স হয়েছে এখন আমি তন্ত্রসাধিকা
    অমাবস্যার রাতে চিতা থেকে আধপোড়া
    মাংস এনে দেয় ডোম, খাই ; আমি  ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে একাত্ম
    এখন আমি করোটিকে অমাবস্যায় জাগিয়ে তুলি
    মেয়েরা যে কংশাল ছিল তা অনেকে জানে না
    আমরা চারজন মেয়ে ছিলুম
    দুজনের কাজ ছিল গলার নলি কেটে দেবার পর
    লাশের মুখে আলকাতরা মাখানো
    ঠেলাগাড়িতে তুলে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে ভাসানো–
    আমার দোসর এই বাউল প্রাণেরপুতুল দাস
    ও নকশাল ছিল, বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা
    ওইই কেটেছিল”
    ..
    শুনে,  আমার চোখ নিজের  পাতা ফেলতে ভুলে গিয়েছিল
    ওনার চোখ দুটো এখনও বড়ো আর কাজলটানা
    শুনে,  আমার ঠোঁটদুটো হাঁ-মুখ বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল
    ওনার প্রৌঢ় গালে এখনও রক্তের পাউডার মাখানো
    মাটিতে গোঁজা ত্রিশূলে টাঙানো তেলসিঁদুর মাখানো করোটি
    দুটো করোটিতে তরল রক্ত রাখা
    করোটিগুলো হয়তো কোনো কবির
    করোটিগুলো হয়তো কোনো ভাস্করের
    করোটিগুলো হয়তো কোনো ছবি-আঁকিয়ের
    ছাগল বলি দিয়ে পূণ্যার্থী দিয়ে গেল তরল চটচটে রক্ত
    হাড়িকাঠে ছাগলেরর মাথা ঢুকিয়ে শিঙ ধরে টেনে রেখেছিল পূণ্যার্থী
    আমার গায়ে বরফমাখা ঘামের কাঁটা
    .
    বাউল প্রাণেরপুতুল দাস-এর দিকে তাকালুম
    তার মুখে হাসি হাতে একতারা রঙিন তাপ্পি দেয়া পোশাক
    বুক দেখা যাচ্ছে, চুল নেই
    অমাবস্যার অন্ধকার কেটে-কেটে ওনার কথা
    “হ্যাঁ, আমিই বিদ্যাসাগরের মূর্তির মাথা কেটেছিলুম
    আমি অনেক শ্রেণীশত্রুকে গুলি করে মেরেছিলুম
    অনেক জোতদারকে কুপিয়ে খুন করেছিলুম
    রক্তের প্রতি আমার টান আমায় এই সাধিকার কাছে এনেছে
    আমরা একই পথের যাত্রী, আমি প্রেমসুধা পান করি
    ও রক্তপান করে
    আমি প্রেমের গান গাই একতারা বাজাই নাচি
    ও মন্ত্র পড়ে ধুনো দেয় নাচে
    আমাদের গন্তব্য নেই তীর্থ নেই চাওয়া-পাওয়া নেই
    আমরা দুজনে একই জায়গায় রয়েছি আর থাকবো
    আমাদের মনে আর শরীরে যা ঘটার তা আমরা ঘটিয়ে ফেলেছি”
    .
    শুনতে শুনতে টের পাই
    শুনতে শুনতে বুঝি
    আমার মহাপরিনির্বাণ ঘটছে
    স্লেভ
    মিশরের পিরামিডগুলো দেখতে বারবার আসি
    মনে হয় হারানো কাউকে খুঁজি, কাকে,
    দু-আড়াই হাজার বছর আগের কোনো স্লেভ
    মমি হয়ে শুয়ে আছে, ধুলোর তবকে মোড়া
    তাকে নয়, আসলে মৃত্যুকে খুঁজি, তার মতো আরো অনেকের
    নয়তো জাদুঘরে কেন যেতে ইচ্ছে করে
    সবই তো প্রাচীন মৃত ইতিহাসে আবছা ধুলোট
    সেখানেও মমিটির দিকে চেয়ে দেখি বহুক্ষণ
    মনে হয় চিনি তাকে, মৃত্যুকে কতোভাবে চিনি
    কোমরে হাত রেখে মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি
    যে যুবতীকে কান কেটে উপহার দ্যান ভ্যান গঘ
    মদিগলিয়ানির নগ্ন যুবতীরা, বদল্যারের জাঁ দুভাল
    উড়ন্ত সারসদল ফিরে যাচ্ছে আকাশ গোলাপি করে
    কোথায় মারা যায় তারা, কোথায় মারা যায় তিমিমাছ
    ডায়নোসরদের পাথুরে কঙ্কাল ছুঁয়ে দেখি
    কোটি-কোটি বচ্ছর আগের মৃত্যু
    কেন তারা হারিয়ে গিয়েছে জানতে পারেনি কেউ
    অ্যাজটেকদের পিরামিডগুলো দেখতে আসি বারবার
    দেবতাকে হৃৎপিণ্ড কেটে উপহার দিত
    রক্ত খেতে ভালোবাসতো তাদের ঈশ্বরেরা
    আনন্দ উৎসবে মেতে, বুক থেকে ছিঁড়ে তখনও
    নাচছে হৃৎপিণ্ডখানা, মৃত্যুর আহ্লাদে বিভোর
    আসলে মৃত্যুকে খুঁজে ফেরে সকলেই
    শেষে পায় নিজের শরীরে, মৃত্যুর ক্রীতদাস
    তার বোধ মৃত্যুই লুপ্ত করে দিয়ে চলে গেছে
    সে তখন মৃত্যু সম্পর্কে বোধশক্তিহীন
    মাছি উড়ছে তার শবদেহটির ঠোঁটে
    ডানায় মৃত্যুর গান নিয়ে
    পাটলিপুত্রের সম্রাট
    কতো যে সাম্রাজ্য জয় করা হয়ে গেলো, আমার সুনাম-দুর্নাম
    ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, বাবার নিরানব্বুই ছেলেকে খুন করে
    বসেছি সিংহাসনে, এরকম কাহিনিও ছড়িয়েছে আমার শত্রুরা
    আমি নাকি চণ্ডাশোক, রেগে গেলে রেয়াত করি না কাউকে
    যা বলছে বলুক ওরা যা লিখছে লিখুক, আমার জন্ম নাকি দুইবার
    দুইটি আঁতুড়ে, এখন সেসব প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষে মানুষেরা
    পিকনিক করে, কুরুক্ষেত্রের মতো, আঠারোদিনের যুদ্ধ, শীতকালে
    বাঘের চামড়ার বালাপোষ পরে, আমি যুদ্ধ লড়েছি খালি গায়ে
    পাটলিপুত্র শহরের ইমলিতলার রেইনকোট পরিনি বৃষ্টিতেও
    পোশাকের মৃত্যুচেতনা থাকে, যেরকম রাবণের ছিল, এখন
    পাটলিপুত্রে পথের দুধারে বসে বাচ্চারা হাগে, আমার শিলালেখ
    পড়বার ভাষা এরা সব কেউই জানে না, জল জমে, বর্ষায়
    জঞ্জাল উঠে আসে বাড়ির ভেতরে, অলিগলি হামাগুড়ি দিয়ে
    বড়োরাস্তায় পৌঁছে দেখতে পায় ছটপুজো করতে চলেছে
    ঘোমটানশীন যুবতীরা, এরা কারা, কোথা থেকে এলো,
    কোথায় গেলেন সেলুকাসের দেয়া হাজার গ্রিক যুবতীরা
    প্রৌঢ়দের মুখে চব্বিশ ঘণ্টা যেন লেগে আছে ঘাটের মড়ার দুঃখ
    আমার রথের চিহ্ণ, অশ্বখুরের ছাপ রাস্তা থেকে মুছে গেছে
    লোকে ভাবে পাথরে খোদাই করে দুর্বোধ্য মেসেজ লিখে গেছি
    দেখছি চারিদিকে নিত্যযাত্রীদের নিত্য উজবুক যাত্রা
    সমুদ্র ফুরিয়েছে বাচ্চাদের খেলার ঢেউয়ে, কলিঙ্গ কোথায়
    লক্ষ লোক মরে গিয়েছিল, লক্ষাধিক ক্রীতদাস আনা হয়েছিল
    তাদের সন্তান পকেটে পিস্তল নিয়ে পাটলিপুত্রের পথে রাজনীতি করে
    অথচ একদিন হাত-পা-কোমর থেকে সব অলঙ্কার আমি ফেলে দিয়ে
    সাধারণ মানুষের মতো হতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি তা হয়ে ওঠা
    খুবই কঠিন, সেই পাটলিপুত্র আর নেই, এখন আমিই এই
    ভুলে যাওয়া শহরের একচ্ছত্র বৌদ্ধ-ভিখারি, বোধি-অধিকারী
    মৃত্যুচেতনা
    বাংলা ভাষার মাঝে মরে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করবার নেই
    শীতল নিথর শব, শরীরে পোশাক নেই, বুকের ওপরে দুই হাত
    শুয়ে আছি, কখন  আলোচকদের দল এসে, টানা-হ্যাঁচড়া করে
    তুলে নিয়ে যাবে, তাদের বাছাই করা ভাগাড়ে ফেলবে নিয়ে গিয়ে
    পচবো সেখানে, গায়ে পোকা দেখা দেবে, শকুন কাক নেড়িকুকুরেরা
    ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে, আমার ভেতরে যতো বাংলা ভাষার বীজ আছে
    খাবে তারা চেটেপুটে, কয়েকশো বছরে কঙ্কালের হাড়গুলো
    ধাপার মাটিতে মিশে যাবে, জংলি ফুলেদের জন্যে উপাদেয় সার
    বাংলা ভাষার মাঝে মরে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করবার নেই
    আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য
    চলে যাচ্ছি অতিপ্রিয় যশোহর ছেড়ে, আর ফিরবো না কোনোদিন
    কৃষ্ণবর্ণ ঘোড়া ছুটিয়ে পালাচ্ছি, বংশধরদের দিয়ে যাবো  খুরের গর্বধ্বনি
    জখমের রক্তে শুনতে পাচ্ছি বৃষ্টির অঝোর, ধুমঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছি
    প্রতাপাদিত্যের অনুচরেরা আমাকে হত্যার জন্য পেছু নিয়েছে, পর্তুগিজরাও
    আমি প্রতাপাদিত্যের পালক পিতাকে খুন করার ষড়যন্ত্রে শামিল হইনি
    পালক পিতাই কেবল নয়, রক্তসম্পর্কে প্রতাপাদিত্যের বাবার ভাই
    তাকে খুন করল প্রতাপাদিত্য, আমার তাতে সায় ছিল না
    বিক্রমাদিত্যের অপযশ পেয়েছেন মহারাজা, ছি ছি ছি ছি, চৌর্যবৃত্তি !
    ওর বাবা শ্রীহরি, দাউদ খানের সোনাদানা নিয়ে কেটে পড়েছিল
    নিজেই নিজেকে মহারাজা উপাধি দিয়েছিল, আমার তিরিশতম
    বংশধরদের সময়কার বেহায়া রাজনীতিকদের মতন
    স্বর্গে বসে শুনি আমার বংশধরদের পরিবার কুড়ি হাজার ছাড়িয়েছে
    আমি প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে ছিলুম বহু যুদ্ধে, কতো শত্রুসেনাকে
    কোতল করেছি, তাদের সেনাপতির মুণ্ড চুল ধরে উপহার দিয়েছি
    আফগান তুর্কি আরব দক্ষিণি মগ হার্মাদ সেনাপতির মুণ্ড
    প্রতাপাদিত্যের পায়ের কাছে, যদিও আমি ব্রাহ্মণের ছিলে, আমাকে
    অকুলীন ঘোষণা করা হয়েছে, কায়স্হ রাজার সঙ্গ দিয়েছি, তাই
    আমার বাবা কালীঘাটের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মা স্বপ্ন দেখেছিলেন
    সরোবরে সতীর হাত পড়ে আছে, অন্ধকার রাতে আমার কালো
    ঘোড়া ছুটছে বঙ্গোপসাগরের দিকে, আমি বসত গড়ব সেখানে
    আমি জানতুম না যে পর্তুগিজদের হার্মাদদের মগদের মতন
    জোচ্চোর সমাজ গড়ে তুলবে বাঙালিরা, তাদের ভাষা পালটে যাবে
    নখ চুল বিক্রি করার বাজার গড়ে উঠবে, বাজার বাজার বাজার
    বাজার মানে দোকানপাট নয় যেমন ছিল প্রতাপাদিত্যের রাজত্বে
    আমার বংশধরদের সময়কার বাজার মানে নিজেকে বিক্রি
    প্রতাপাদিত্য কিন্তু নিজেকে বিক্রি করেননি, লড়ে গেছেন
    ষড়যন্ত্র করেছেন, দুর্গ গড়ে তুলেছেন, নৌবহর গড়ে তুলেছেন
    কিন্তু প্রতাপাদিত্য প্রথম বাঙালি, তিনিই দিয়ে গেলেন বাঙালির
    রক্তে আত্মধ্বংসের বীজ, তখন থেকে বাঙালিরা নিজেরা
    লড়ে মরছে, শ্রীহরি যেমন নিজেকে মহারাজা ঘোষণা করেছিলেন
    জেলায় জেলায় অপরাধীরা নিজেদের মহারাজা ঘোষণা করছে
    গরিব চষির লক্ষ লক্ষ টাকা মেরে চিটফান্ড খুলে কেটে পড়ছে
    এরা সকলে দাউদ খানের ধনসম্পত্তি নিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে
    বাঙালিদের, যশ থেকে যে যশোহর হয়েছিল, সেই যশ আর নেই
    প্রতাপাদিত্য ছিলেন হিন্দুদের মহারাজা কিন্তু এখন লোকেরা
    নিজেদের হিন্দু বলতে কুন্ঠিত হয়, যদিও তাদের নুনু কাটা নয়
    আমি লক্ষ্মীকান্ত, আমার নুনুও কাটা নয়, কিন্তু আমার সেনায়
    অধিকাংশ নুনুকাটা আফগান তুর্কি আরব ঘোড়সওয়ার
    আমার ঘোড়ার পূর্বপুরুযও এসেছিল আরব দেশ থেকে, বাবরের
    সেনাবাহিনীর সঙ্গে, যদিও বাবর আরব ছিল না, বাবরের ছেলেরা
    এখানের যুবতীদের বিয়ে করে থেকে গেল, ওদের দেশে এরকম
    সুন্দরী কখনও দেখেনি তাতার বাহিনীর সৈন্যেরা, ওদের যুবতীদের
    চোখ ছোটো নাক চেপ্টা ঠোঁট পাতলা নয়, যদিও ব্রাহ্মণ সন্তান আমি
    তাতার আফগান তুর্কি ফিরিঙ্গি তরুণীদের সঙ্গে শোবার সুযোগ পেয়েছি
    অ্যাণ্টনি ফিরিঙ্গির রক্তে আমার বংশের রক্ত বইছে, ওর বাবা
    আমার বংশধরের রক্ষিতার ছেলে, শ্যাম রায়কে পুজো করতো লালদিঘিতে
    আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
    আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
    কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
    আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে
    ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে  মূর্খ মুণ্ড
    গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
    দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
    সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে
    যশোহর ছেড়ে চলে আসলেও ভুলতে পারিনি কখনও
    যশোহর ছেড়ে চলে আসলেও ভুলতে পারনি কখনও
    আমার বংশধরেরা যশৌ্র রোড দিয়ে যাবার সময়ে মনে করবে
    তাদের পিতৃপুরুষ এই পথে একদিন কালো ঘোড়া
    ছুটিয়ে একদিন জঙ্গল সাফ করে কলকাতা সুতানুটি গোবিন্দপুরের
    পত্তন করেছিল, ক্লাইভের পোঁদ চাটবার জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের মতো
    নিজেকে বিক্রি করিনি, আমার বংশধররাও নিজেদের শিরায় শিরায়
    আমার রক্ত নিয়ে প্রতিরোধ করে যাবে অন্যায়ের, শোষণ ও অত্যাচারের

    সান্টাক্রুজের মেছুনির সঙ্গে প্রেমের কবিতা
    চল্লিশ বছর পর আজ সান্টাক্রুজে গিয়েছিলুম মাছের বাজারে
    সেই মেছুনি যুবতীর খোঁজে যে প্রতি শনিবার
    খোঁপায় চাঁপাফুলের মালা জড়িয়ে আসতো–
    আমি ওকে বলেছিলুম একদিন ফিসফিস করে
    বড্ডো বদ গন্ধ বেরোয় তোর কাছে আসলে
    শাশুড়ির সামনেই আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করতো, আমিও করতুম
    বলেছিলুম, পচা মাছ চাপিয়ে দিসনি যেন
    যুবতী মেছুনি আমাকে তাজা মাছ চিনতে শিখিয়েছিল
    সমুদ্রের মাছ, তাদের নাম, কেমন করে রাঁধতে হয়
    সান্টাক্রুজ বাজারে গিয়ে আজ মন খারাপ হয়ে গেল
    এই মন খারাপই প্রেম, মেছুনির সঙ্গে লুকিয়ে রাখা প্রেম–
    বরকে ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে কোলহাপুরে চলে গেছে সে
    হাঁপানিরোগ, প্রিয়তমাসু
    এতো মনে রাখো তুমি, কখন হঠাৎ মাঝরাতে এসে টোকা দাও
    ঠোঁটের ওপরে ঠোঁট চেপে শ্বাস বন্ধ করে দাও, জেগে উঠি
    সঙ্গে আনো হাওয়ায় উড়ন্ত রাতের রঙিন পরাগ
    হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যে সমস্ত ভারি-ভারি ট্রাক যাচ্ছে
    কুরুক্ষেত্রে দুঃশাসনের রক্তপায়ী ভীমের অগ্নিচোখ জ্বেলে
    তাদের উন্মাদ ডিজেলের গুঁড়ো ট্যালকম পাউডারের মতো
    সারা গায়ে মেখে আসো, অগাধ ঘুম থেকে টেনে তোলো
    তোমার নিঃশ্বাসের সাথে আমার প্রশ্বাস মিলিয়ে ছন্দহীন
    বাজাও আয়ুসঙ্গীতের ফুলকি ক্ষণে ক্ষণে
    তোমাকে ছেড়ে আমি কৃত্রিম প্রিয়াকে হাতে তুলে নিই
    তার শ্বাস আমাকে শান্ত করে, তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমোই–
    জোর করে প্রেম করা যায়নাকো, কতোবার বলেছি তোমায়
    সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছি সকাল-বিকেল-মাঝরাতে
    আমাকে ছেড়ে তুমি চলে যাও, ভালো আমি তোমাকে বাসি না

    কালো বিধবা
    কালো বিধবার ডাক ফিরাতে পারি না
    সঙ্গম করার কালে মনোরম মৃত্যু চাহিয়াছি
    যেমত পুংমাকড়ের হয় ; স্ত্রিংমাকড়ানি
    থুতুর ঝুলন্ত রেশমে বাঁধি আহ্বান করিবে
    আষ্টেপৃষ্টে সবুজ পাতার উপরে ল’য়া গিয়া
    মোর পালপাসখানি যোনিদ্বারে লইবে টানিয়া
    দশবাহুর আলিঙ্গনে শুষিবে লক্ষ শুক্রাণু
    দিবাদ্বিপ্রহরে নিশিডাকে আক্রান্ত থরহরি
    ব্যকরণ বিন্যাস গণিত শিখাবে দশ নখে
    আমি ক্লান্ত হলে পর ক্রমশ খাইতে থাকিবে
    সঙ্গম চলাকালে চাখিবে সুস্বাদু ঝুরিভাজা
    উইপোকাসম লিঙ্গখানি কুরিবে প্রথমে
    প্রেমিকার উদরে প্রবেশ করিয়া কী আনন্দ
    বুঝাইব কেমনে, সমগ্র দেহ যে গান গায়–
    আহ্লাদের কর্কটরোগ তোমরা বুঝিবে না
    চলুন নরকে নিয়ে যাই
    যা ইচ্ছা লিখুন আপনারা, গালমন্দ, খিল্লি, খিস্তোনি
    আমি শুধু চাই ব্যাস, লেখা হোক, কিছু লেখা হোক
    লিখে যান, আশ মেটান, কিছুটা কুখ্যাতির অংশ
    বিলিয়ে তো যাই, নিন, নিন, হাত পাতুন, নতুবা মস্তক
    কলমে বা কমপিউটারে
    ঝেড়ে দিন সুযোগ পেলেই
    আমি জানতে চাইব না, কে আপনার বাবা ছিল
    কে ছিল পাথরে বীর্য থেকে জন্মানো দুর্বাসার কাগুজে বিদ্বান
    পঞ্চাশ বছরের বেশি লিখে তো যাচ্ছেন
    এখন আপনারা, তার আগে আপনার বাবারা মেসোরা
    এভাবে চলুক, যতো বছর আপনারা চালিয়ে যাবেন
    আরও পঞ্চাশ, আরও একশো, আরও কয়েকশো বছর
    কবিতা যখন আপনার বংশে আর কেউ পড়বে না
    তবুও আপনাদের বংশধরেরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন
    খিস্তিয়ে, গালমন্দ করে, খিল্লি উড়িয়ে
    ব্যাস, আমি চাই চলতে থাকুক, চলতে থাকুক, চলুক চলুক
    জোকারপুঙ্গবদের রঙ্গতামাশা
    কাতুকুতু
    প্রেমিকার হাসি খেতে আমার চিরটাকাল ভালোলাগে
    কোমরে দুদিক থেকে আচমকা প্যাঁক করে তর্জনী টিপে দিতেই
    যেই হাসতে আরম্ভ করে তখনই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে
    আমি ওর হাসি খেতে থাকি ওর কোমরে আমার 
    আঙুলের খোঁচা বজায় থাকে, আমারও হাসি খাওয়া বজায় থাকে
    ওর কাতুকুতু আর চুমু একই সঙ্গে খেতে ভালোলাগে
    তবুও ও বলে ওঠে লম্পট কোথাকার, তার মানে করতে পারি আমি
    আমি আরও হাসাই, হাসাতেই থাকি
    যতোক্ষণ না হাসতে হাসতে ওর চোখ দিয়ে জল বেরোয়
    জলভাত
    তখনকার দিনে আমি দলাপাকানো কাগজে লুকোনো ফিসফিসে গল্পে
    রামধনুর স্কার্ফবাঁধা বিকেলবেলায়
    পরীক্ষার খাতায় ঝর্ণাকলমের নার্ভাস নাচ প্র্যাকটিস করতুম
    তখনকার দিনে আঙুলের ডগায় কবিতা বয়ে-বেড়ানো খুঁতখুঁতে আলোতে
    পানাপুকুরে গোসাপের লিখনভঙ্গীমায়
    কতো তরল ছুপা-রুস্তম যে না-জেনে ভাসিয়েছিলুম তার ঠিকঠিকানা নেই
    তখনকার দিনে ব্যক্তিগত গোঙানিতে গড়া যৌথ স্লোগানের ইকড়ি-মিকড়িতে
    একদিনের শিশুর সঙ্গে যে-ভাষায় কথা বলি
    দেখতুম যে হাড়ভাঙা খাটুনির পর বেশ তরতাজা কুঁড়ি ফুটিয়েছে গোলাপ
    তখনকার দিনে খাল কাটার পর যখন কুমিরের বদলে ঠিকেদাররা এলো
    অধঃপতন টের পেতে যতোটা নামতে হয়
    নিজের চামড়া নিয়ে মনসাগাছটাই কতো চিন্তিত তো আমি কোথাকার কে
    তখনকার দিনে একটা দুঃখ চাপা দিতে আরেকটা দুঃখ যোগাড় না হলে 
    সবকটা মৃত্যুদণ্ডের নিজস্ব রূপকথায়
    দেখতুম অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির পর ব্যাঙাচিরা লেজ খসিয়ে ফেলেছে
    অথচ এখনকার দিনে যে-বয়সে মনে হয় এবার বড়ো হওয়া থামুক
    দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলোনে ঘেরাও জীবনে
    বসন্তঋতুর সঙ্গে একাত্ম হবার অনৈতিক সম্পর্ক চাগিয়ে ওঠে থেকে থেকে
    সব গর্তই ঊর্ধমুখীন, আহা
    আজে-বাজে স্বপ্ন যাতে না দেখে ফেলি
    তাই স্বপ্ন পাহারা দিচ্ছি এমন এক ভোরে
    জলের ঢেউয়ে গড়া অহংকারের পাঁচিল তুলে
    ছুঁচসুতো দিয়ে লেখা গল্পের শহিদটাকে
    খুঁজে পেলুম জাহাজডুবির লাশেদের সভায়
    সে একখানা বোড়ে-ঘেরা রাজার সভা বটে
    .
    অনেক গাছ তো হয়ে ওঠে কিন্তু কিচ্ছুটি করে না
    পালানো বউকে ফেরত নেয়া স্বামীর ঢঙে
    যে-উপমা কবিতার লাইনে আটকা পড়েছে
    যেন সধবার শব সাজাবার বিউটিশিয়ান
    যাঁর কারবার অতীতের বর্তমানটুকু নিয়ে
    দিব্বি থাকেন বাকোয়াসের খোশমেজাজি গুলগল্পে
    ইলোপকন্যা
    তোর বেডরুমে তোকে পেলুম না, কি ঝঞ্ঝাট, মানে হয়
    অবন্তিকা, কোন নদী নিয়ে গেছে, বরফের ডিঙি ভাসালুম
    দ্যাখ, কেলেঘাই চূর্ণী গুমনি জলঢাকা ময়ূরাক্ষী কংসাবতীর
    স্রোতে, তোর ঘাম নেইকো কোথাও, ভাল্লাগে না, জেলেরাও
    পায়নি তোর ফেলে দেয়া অন্ধছোঁয়া, পূর্ণিমাও অন্ধকারে,
    কি করে চলবে বল, পেঁয়াজের কান্না নেই, ধ্যাৎতেরি
    চুড়ির বাজনাহীন, চুমুগুলো কোন স্বপ্নে রেখে গিয়েছিস
    খুঁজে পাচ্ছিনাকো, কাউকে তো বলে যাবি, মুখের প্রতিবিম্ব
    আয়নাসুদ্দু ফেলে দিয়েছিলি, ওঃ কি মুশকিল, পাশে-শোয়া শ্বাস
    অন্তত রেখে যেতে পারতিস, আলমারি ফাঁকা কেন, বালিশে
    খোঁপার তেল নাভির তিল কাকেই বা দিলি, চেনাই গেল না
    তোর মনের কথাও, টুথব্রাশে কন্ঠস্বর নেই, চটিতে নাচও
    দেখতে পেলুম না, এমন কষ্ট দিস কেন অবন্তিকা, চুলের
    নুটিতে থাকত ডাকনাম, ফুলঝাড়ু চালিয়েও সাড়া পাচ্ছি না,
    অফিস যাবার রাস্তা এসে তোর জন্যে মাকড়সার জালে
    হাতের রেখা সাজিয়ে চলে গেল তোরই মুখের ইলিশস্বাদ
    নিয়ে। আরে, ওই তো, যে-ছোকরার সঙ্গে পালিয়েছিলি তুই
    তারই জুতোর ছাপের স্বরলিপি মার্বেল মেঝেয় আঁকা…
    আসমা অধরা, তুমি নীলাকাশ
    তোমার শাদা-কালো কায়াচ্ছবি, টের পাবার আগে, মন্দার পাহাড়ে
    লুকিয়ে খাচ্ছিলুম, আঃ, আটকে গেল কন্ঠনভোচরে, নীল বিষ হয়ে ;
    আমার দুই পা ধরে অসুরেরা আর দুই হাত ধরে দেবতারা,
    কালসাপ ভেবে মন্হন করতে লাগলো অমৃতের লোভে ;
    জানতো না ওরা, তুমি আছো আমার কন্ঠস্বরে অক্ষরে অভিধা ব্যকরণে
    নীলকূট হয়ে প্রিয়তমা, কয়ামত পর্যন্ত তুমি লোভীর আকাশ–
    তুমি তো নীলাকাশ তুমি তো ধরাছোঁয়া থেকে বহুদূর কবিতামানুষী
    শাশ্বত চাউনিতে, অসহ্য যন্ত্রণায় ক্ষুধার্তের গ্রাসনালিকায়, আঃ,
    দেখেছো তো দু’পক্ষই আতঙ্কিত এমনকী মূর্ছিত আমার মারণঘূর্ণনে,
    তোমার শাদা-কালো কায়াচ্ছবি, অষ্টাদশী, চুরি করে খেয়েছি যে–
    পুরোটা ব্রহ্মাণ্ড, তীর্যক তাকিয়ে আছো, উদ্গীরণ নিতে ঠোঁট খোলো
    আমার হাঁ-মুখে জিভ রেখে দ্যাখো সিংহাসনে তুমি বিশ্বরূপা, স্বাদ নাও
    বিষরসে ভেজা অক্ষর শব্দশ্বাস ব্যকরণ পিচ্ছিল আলো, আঃ আঃ
    কন্ঠনালিতে তুমি শাদা-কালো কায়াচ্ছবি আটক থাকবে চিরকাল
    কয়ামত পর্যন্ত, বিদেশিনী…
    তোমার আঙুলগুলি
    ভালো করে দেখিনি তোমার মুখ, আবছা মনে পড়ে,
    দেহ ও পোশাকও মনে নেই, কেমন ভাসাভাসা যেন–
    অথচ মনে আছে তোমার দশটি আঙুলের খেলা
    আমি তো স্তম্ভিত হতবাক থ, তালুতে রক্তসূর্য আঁকা
    প্রতিটি আঙুলও আলতায় অর্ধেক রাঙানো
    ত্রিশূল তাম্রচূড় মুকুল সামদাম হংসাস্য ভ্রমর কাঙ্গুল
    আঙুলে খেলাচ্ছ তুমি আমার হৃদপিণ্ডে নিঃশব্দ দামামা বাজিয়ে
    সিংহমুখ মৃগশীর্ষ সর্পশীর্ষ চন্দ্রকলা সূচী কপিথ্থ ময়ূর
    বুঝতে পারছিলুম বসে এক-ঠায় তোমাকে নয়
    ওই দশটি রক্তাভ আঙুলের অপার্থিব ইশারাকে ভালোবাসি
    বুঝতে পারো না কেন স্বমেহনে উসকে দিচ্ছে তোমার ইশারা
    তোমার তামাটে পা
    তোমার পায়ের দিকে চেয়ে থাকি, একদৃষ্টে সম্ভব নয় চেয়ে থাকা
    কী বলে এই দৃশ্য ও অদৃশ্যের মাঝে দ্রুত ঝরোয়ার তামাটে গোড়ালিকে ?
    পুরবীকল্যাণ, কামেশ্বরী, চারুকোষ, জনসন্মোহিনী আঙুলগুলোকে ?
    পায়ের অবিস্মরণীয় স্মৃতিশক্তি আর কারোর দেখিনি কখনো
    মনে হয় রেক্যুইয়েমের ইঙ্গিতবাহী তামাটে ঘনশ্যামা মন্দ্র সপ্তক
    অথচ শব্দ নেই, বাতাসও নিথর, কেবল তোমার দ্রুতিময়ী
    দুটি তামাটে পায়ের স্পর্শে পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরেই চলেছে
    বুঝতে পারো না কেন স্বমেহনে উসকে দিচ্ছে তোমার ইশারা
    তোমার অতল চোখ
    কেবল মনে আছে তোমার অতল দৃষ্টি : তাছাড়া কিছুই দেখিনি
    ক্ষিপ্রচটুল লাস্যে আরো কালো আর গভীর করেছ চোখ দুটি
    ভুরুতে পেনসিল চোখেতে কাজলের প্রয়োজন ছিল না তো
    তোমার সান্ধ্যতাণ্ডবের দৃষ্টি চোখের মণিকে ঘোরাচ্ছে দুদিকে
    চোখের কোণ দিয়ে আট রকমের চাউনি বিঁধে ফেলছে প্রতিক্ষণ
    তোমার আলারিপ্পু যতিস্বরম শব্দম বর্ণম তিল্লানা কিচ্ছু বুঝি না
    কেবল টের পাই ক্ষতবিক্ষত করছ চোখপল্লবের কৃষ্ণ আঘাতে
    সংযমের আবেগবৃত্ত তুমি ভেঙে দিচ্ছ চোখের প্রলয়তাণ্ডবে
    বুঝতে পারো না কেন স্বমেহনে উসকে দিচ্ছে তোমার ইশারা
    বুড়ি
    এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
    চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
    নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে–
    কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
    ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
    দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
    ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
    কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
    চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
    বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
    দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
    যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
    পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
    চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
    পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
    দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
    দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
    দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
    এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
    আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
    খারাপ, এই বুড়ি, যে আমার বউ
    বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
    কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
    এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
    কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।‘
    পদ্যঠাকরুণ 
    ঘুমের মধ্যে ঢুকে আসিস রবিবাবুর ভুতুড়ে বউ 
    সবাই তোকে বেচছে যে গো কালেজ স্ট্রিটে দেশ-বিদেশে 
    বয়সকালে প্রেমের বউদি ভুত হয়ে কি নেমে আসে 
    বদ্যিবাড়ির বনলতা নেড়ি সম্পাদিকার বেশে 
    এস্ছিল সেই ধোপা বউঠান লুঙ্গি কাচতো চণ্ডীদাসের 
    ওরাই আমার ভগবতী খেরোর-নথির অশ্লীলতা 
    দুই পা বেয়ে কাৎকুৎ দিস উঠে আসিস নাচনটী ছউ 
    তুলি-কলম বুরুশ জুড়ে ফস্টিনস্টি তুরুপ তাশে 
    জানিনে মাঝরাতের গন্ধে শুবি কি তুই আমার পাশে 
    জাপ্টে-জুপ্টে বুঝলি গাইবো বেম্মোগানের আদর-কথা 
    ‘যাকে পাচ্ছো ভালোবাসো’ এই নীতিরই সর্বনাশের 
    মজায় মজে কাটিয়ে দিলুম চার-কুড়ি দুই নানা মাংসে 
    দেহ শালা মানতে চায় না জড়িয়ে ধরলে শরীরলতা 
    যত্তোরকম আধভুতুড়ে শেমিজ-খোলা প্রাণেশ্বরী 
    ইমলিতলার কুচ-বিহারি আইরিটোলার কইলকাতা 
    সাতবাষ্টে মেম-হিপিনী চরসগন্ধ-গাঁজার ধোঁয়ায় 
    মগজে সব রাখা আছে সুন্দরীদের ভুতের চোথা 
    সঙ্গে করে নিয়ে যাবো ছাই-গাদাতে আষ্টেপিষ্টে
    বাসন মাজা
    রবীন্দ্রনাথ, আপনি কখনও বাসন মাজেননি সেটা জানি
    কেননা আপনি তো গুরুদেব যাঁরা বল্মীকের ভেতরে থাকেন
    বুদ্ধদেব বসু মহাশয়, রান্নাপটু, উনিও মেজেছেন কিনা সন্দেহ
    জীবনানন্দ বউকে একই সঙ্গে ভালো ও খারাপ বাসতেন
    ডায়েরিতে আইনস্টাইনি ফরমুলায় বলেননি বাসন মাজার কথা
    এবং বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্তেরা জানি না জানতেন কিনা
    কাজের মেমরা এসে কোথায় বাসন মাজেন ! অলোকরঞ্জন থাকেন
    অর্ধেক বিদেশে আর বাকি হাফ দেশে ; আলোক সরকারও
    হয়তো জানতেন না বাজারে এসে গেছে বাসন মাজাকে কবিতার চেয়ে
    সহজ করার জন্য ঝুরোসাবান তারের নানান জালিকা ।
    মহিলা ও পুরুষ কবিদের এটাই তফাত — অনেকে জানে না ।
    আমি আর দাদা শৈশব থেকে শিখেছি বাসন মাজার কারিকুরি
    এখন তা কাজে দিচ্ছে ; বুড়ি তো ঝুঁকতে পারে না, আমি পারি
    এই বয়সেও রোজই বাসন মাজি, ফুলঝাড়ু দিই, বুঝলেন আলবেয়ার ক্যামু,
    গারসিয়া মার্কেজ — প্লেগ নয়, করোনা ভাইরাসের দিনে বুড়ো-বুড়ি প্রেম !
    প্রেমিকার দুধ
    আমি কখনও কোনো প্রেমিকার স্তনে দাঁত বসাইনি
    প্রথম প্রেমিকারও নয়, যার খাঁজ-নিটোল
    বুকের দুঃখি পরাগরেণু আজও গালে লেগে আছে
    মায়ের তো দুধই হতো না অতিফর্সা বুকে, তাই
    ছোড়দি কোলে করে নিয়ে যেতো ইমলিতলায়
    পাড়ার বউদের কাছে ; কাহার কুর্মি ডোম দুসাধ চামার
    এমনকি দুস্হ মুসলমাননির এঁদো ভাঙাচোরা ঘরে ।
    মায়ের স্তনে কিংবা সেইসব বউদের মাইয়েতে দাঁত
    বসালে নির্ঘাৎ পাছায় চপেটার আদর পেতুম--
    তবে আজ ঘনদুধ খাই, সবুজ রক্তাভ নীল
    শাড়িপরা যুবতীর ব্র্যাণ্ডেড মাই থেকে
    টিপে টিপে দুই বেলা দুধ বের করি
    শেষ ওব্দি শাড়িও খুলে ফেলে যেটুকু দুধ বাঁচে
    তাও বের করে নিই ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমোতে যাবার আগে
    দাঁতকে ঝকঝকে করে তোলে ওনাদের দুধ
    সেই বয়ঃসন্ধির পর যখন ভস্ম থেকে ছাড়া পেয়ে
    টুথ পেস্ট টিউবের মাই থেকে প্রতিদিন টিপে টিপে দুধ বের করি
    সঙ্গিনী
    কয়েকগাছা পাকাচুল-টাকমাথায়  উষ্ণ তালু বুলিয়ে দিয়েছিলে তুমি
    জীবনে প্রথম ও শেষবার ভালোবেসে নিয়েছিলে লোকটাকে
    মারা গিয়ে তোমার স্বামী হয়ে-ওঠা লোকটাকে ইনসিনেটরে নিয়ে গেলে।
    ছেলে তো বিদেশে – ডেকে পাঠিয়েছো, শ্রাদ্ধাদি আর
    উত্তরাধিকারের আইনি কাজের জন্য ।
    সঙ্গমের সময়ে চোখ বুজে থাকতে ; জানতে এ ওনার নিছক রুটিন
    ঘুমোবার মাংস-ট্যাবলেট । অন্য নারীর গন্ধ পেতে ওঁর দেহে–
    যাঁকে উনি সারাটা জীবন ভালোবাসলেন, তোমাকে লুকিয়ে–
    উনিও জানতেন তুমি জানো ; ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে তুমি নেই
    নমিনিও তুমি নও, বাড়ির দলিলে তুমি নেই
    ওনার অস্তিত্বে কোথ্থাও ছিলে না ; সঙ্গী হতে দেয়নি লোকটা–
    তুমি একা-একা তোমার কবিতা-খাতাকে স্বামী করে তুলেছিলে।
    ভাগ্যিস কবিতায় আক্রান্ত হয়েছিলে ; নয়তো আজীবন
    সঙ্গী-বর্জিত থেকে যেতে, একা, একা, একা, এক্কেবারে একা…port this ad
     
    দেশপ্রেম : কে একজন ঝুলছে
    মেজদা বলল, “চল চল দেখে আসি, টিনের কারখানায় ঝুলে-ঝুলে
    পাক খাচ্ছে কেউ”। দৌড়োলুম, ম্যাজিক দেখবো ভেবে—
    ক্যানেস্তারা কেটে টিনগুলো কাঠের হাতুড়ি পিটে সোজা করে।
    অতো উঁচুতে কেমন করে চড়েছিল ধুতি-শার্ট পরা রোগাটে লোকটা?
    চশমা রয়েছে চোখে ! ভালো করে দেখে বললুম, “মেজদা
    ইনি তো আমাদের ক্লাসের অরবিন্দর বাবা ; ওরা দেশভাগে
    পালিয়ে এসেছিল ফরিদপুর থেকে, সেখানে ইশকুলে পড়াতেন,
    কিন্তু সার্টিফিকেট-টিকেট ফেলে জ্বলন্ত ঘর-দালান ছেড়ে
    চলে এসেছেন বলে কোথাও পাননি কাজ, শেষে এই টিনের
    শব্দ প্রতিদিন বলেছে ওনাকে, কী লজ্জা, কী লজ্জা, ছিছি…”
    কিন্তু অতোটা ওপরে উঠলেন কেমন করে! টিনবাঁধার দড়ি খুলে
    গলায় ফাঁস বেঁধে ঝুলছেন এখন, পাকও খাচ্ছেন, একবার বাঁদিকে
    হি…ন..দু…স…তা…ন…আরেকবার ডানদিকে…পা…কি…স…তা…ন
    হি……ন…..দু…..স…..তা…..ন…..পা…..কি…..স…..তা…..ন
    ভস্মাসুরের বংশধর
    তিরিশ বছর পর দেখতে এসছি ইমলিতলার বাড়ি
    সবাই যাবার পর কেবল জেঠিমা একা থাকতেন
    স্টোভে হরি-হে হরি-হে নাম জপে পাম্প করতে বসে
    সক্কোলের কথা ওঁর মনে পড়ছিল, যাঁদের ভালোবাসতেন
    যারা বাড়িটাকে গমগমে চাঙ্গা করে রেখেছিল বহুকাল
    স্টোভের বিদীর্ণ আগুনে লেলিহান জেঠিমা একা
    ইমলিতলার বাড়ি অন্ধকারের রঙিন দখলে চলে গেল
    অন্ধকারের কতো রঙ হয় ; আলোর তেমন রঙ নেই
    তিরিশ বছর পর দেখতে এসেছি ইমলিতলার ফাঁকা বাড়ি
    অন্ধকারের রঙে রাঙা আগুনের কালোকৃষ্ণ রঙ
    পাড়ার থুথ্থুড়ে বুড়ি  চিনতে পারলো দেখে
    কৈশোরে দোলের দিন চটকা-মটকি খেলেছিল আমাকে জাপটিয়ে
    কতো চুমু কতো লালা কতো সে জিভের আদর
    বলল, ওহ তুই ! তোরা তো ভস্মাসুরের বংশ !
    যেদিকে তাকাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিস ।
    সত্যিই ভস্মাসুরের আমি বংশধর ; পুড়ি ও পোড়াই !
    যারই দিকে চোখ মেলি দগ্ধ হয়ে ছটফট করে
    তাদের স্মৃতিতে বসে অস্তিত্ব পুড়িয়ে দিই
    মনে রাখবে না মানে ! প্রেমিকাও পুড়ে মরেছিল !
    পুড়বে আর মনে রাখবে ! জ্বলবে আর মনে রাখবে !
    আমি তো ভস্মাসুরের বংশধর ; পুড়ি ও পোড়াই—
    পুড়ুক পুড়ুক ওরা ঈর্ষায়  মরুক জ্বলেপুড়ে ।
    গন্ধের প্রণয়
    মহাভারতের গন্ধ মেখে আসে, খোঁপায় কণকচাঁপা গুঁজে
    আমাকে ফুসলিয়ে পচা মাছগুলো চাপিয়ে দেবে বলে
    রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি রামপ্রসাদ-রামকৃষ্ণের শ্যামা
    সত্যি মেছুনিটা কালো অথচ সমুদ্রের উত্তাল আদরে
    গোড়ালি গোলাপি ; সারা দেহে লইট্যার টাটকা-নরম
    বুকের খাঁজ জুড়ে জাল-পলায়নরত মাছের উড়াল
    চিংড়িগুলোকে ইশারায় টিপে ও দামের বার্তা দেয় 
    এ-নাও সুরমাই, রাওয়স, ভারতের তেলালো স্যামন
    পাপলেট, ওহ পমফ্রেট, নিলে জোড়া নিতে হবে, ভাবো
    এইখানা তুমি আর তার পাশে আমি, নয়তো গেদারে
    লিপস্টিক-রঙা  এ-হল টিউনা মাছ  দ্যাখো দ্যাখো ছুঁয়ে
    মেছুনির চোখে নিরক্ষর  পৌরাণিক ফাঁদে পড়ে কিনি
    ইশারার  উপমাগুলো ওর উত্তরাধুনিক প্রেম মনে করে
     
    প্রেম-রোগের স্প্যাজম
    এটা কি লিখেছ তুমি ? এ থেকে তো মানে অফুরান বেরিয়ে চলেছে
    শব্দের ভেতরে মানে, বাক্যের মধ্যে মানে, চিত্রকল্প মানে দিয়ে ঠাশা
    এমনকি ছেদ যতি কোলন সেমিকোলন ড্যাশ
    সেগুলোতে কুঁদে কুঁদে মানের ম্যাজিক, সম্পূর্ণ লেখাটা পড়ে বোঝা যাচ্ছে
    কিছু একটা বলবার চেষ্টা করে গেছো !
    কবিতার কোনো মানে বা অর্থ হয়নাকো ! কবিতা তো রোগের স্প্যাজম
    সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসা জলের গভীর কান্না
    শকুনের লাশ-খোঁজা উড়ালের উদাস বাতাস
    ফুলের ভেতরে ঢোকা দুর্গাটুনটুনির ফিকেনীল জিভ
    ফসলের মাঠে অস্তগামী সূর্যকে কাঠবিড়ালির হাঁটুগাড়া চকিত সেলাম—
    আর তুমি কিনা কবিতার গর্ভে চুপচাপ ঢেলে দিচ্ছ মানের বিষাক্ত শুক্রবিষ
    সে-বিষেতে জন্মাবে যারা তারা কি আস্ত রাখবে বাদবাকিদের
    ছেয়ে যাবে চারিদিক বিষাক্ত সন্তানে গ্রামে ও শহরে গঞ্জে গলিতে বাজারে
    আর সেটাই তো ঘটে গেছে বাঙালি-জীবনে, মানের ওপরে মানে চেপে বসে গেছে
    জগদ্দল কালোয়াতি পাহাড়ের দমবন্ধ প্রেমিকার ঋতুবন্ধ-গন্ধমাদক
     
    প্রেমিক-প্রেমিকার  বৃদ্ধাবাস
    আমরা দুজনে হাঙরের পেটে রাত কাটাই
    জোঁকশীতে কুঁজো অলস আপ্যায়নে
    আমরা দুজনে কুপির তলার ছায়াকে খাই
    ফুলুট-বাজানো রবিঠাকুরের গানে
    আমরা দুজনে খাবারের প্লেটে চাঁদ জোগাই
    বউ-বিরক্ত বুড়িরা সে-কথা জানে
     আমরা দুজনে ভাঙা ধনুকের ছিলা চেবাই
    গেছো-লেখকেরা আজও সে-কথা মানে
     আমরা দুজনে ভোটের বোতামে গ্যাস ঢোকাই
    গণধড়িবাজ পড়ে থাকে নির্জ্ঞানে
    আমরা দুজনে স্মৃতির মাথায় ঝড় চাপাই
    আত্মজনেরা তাই পিঠে ছোরা হানে
    আমরা দুজনে জোকারি করে হাসাই
    পরস্পরের গোপন রোমন্হনে
    এ-নাও হৃৎপিণ্ডখানা
    ‘নচ্ছার হৃদয়হীন বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিৎকার করেছিলে সকলকে শুনিয়ে
    প্রতিদানে আজ পাঠাচ্ছি হৃৎপিণ্ডখানা  কাচের স্বচ্ছ জারে,চুবিয়ে ফরম্যালিনে, 
    ধুয়েপুঁছে একেবারে পরিষ্কার করা, রক্ত লেগে নেই, কেবল স্পন্দন আছে আর
    জীবন্ত কাঁপন, প্রতিবার তোমার নাম নিয়ে আলোকিত হবে হৃৎপিণ্ড আমার ; 
    প্রতিটি স্পন্দন তোমার মুখশ্রীকে প্রতিমার জ্যোতি দেবে, হাতে নিয়ে দেখো,
    বিছানার পাশে টেবিলে রেখে দেখো, বেডল্যাম্প দরকার হবে না, এমনকী
    তোমার পাশে যে পুরুষ শুয়ে সেও শুনতে পাবে না আমার হৃৎপিণ্ডের ডাক
    অবিরাম অবিরাম তোমাকে না-পাবার কষ্ট জারের লেবেলে লেখা আছে
    যে-নাম আমার দেয়া সেই দীর্ঘশ্বাসে স্পন্দিত হবে ক্ষণে-ক্ষণে বহুবার
    ওই কাটা রক্তহীন নচ্ছার বিশ্বাসঘাতক হৃৎপিণ্ডকে পারলে ভালোবেসো
    এ নাও সর্বস্ব দিচ্ছি
    এ নাও সর্বস্ব দিচ্ছি, তোমার তালিকায় টিক দিয়ে নাও এক-এক করে
    পাটিপত্র পানখিল দধিমঙ্গল গায়ের হলুদে পাঠিয়েছিলুম মাথা কেটে
    পাণিগ্রহণ ধৃতিহোম অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন সম্প্রদানে দিয়েছি হৃৎপিণ্ডখানা
    এবার সাজের বাক্সে নাও হাতের রেখা থেকে সব নদী ও সমুদ্রের ঢেউ
    সাতপাক শুভদৃষ্টিতে নাও শিরায় বয়ে-চলা মোৎসার্ট সিমফনি
    মালা বদলেতে নাও আমার ঘামের গন্ধ সাভানার পুরুষ সিংহের
    অঞ্জলি ও সিঁদুরদানে দিয়ে দিচ্ছি অণ্ডকোষ-ভরা শুক্রকীটের সামগান
    সর্বস্ব চাইছ বলে দিয়ে দিলুম উদ্যত  লিঙ্গখানা উপড়ে তোমাকেই
    নোংরাপাড়ার প্রেমিকা
    ওভাবে লিখেছিস কেন ? কার নাম ? খাতা নোংরা করিস রোজ-রোজ ?
    আমি তো নিজেই জানি না কার নাম শুকনো খোলায় জিরে ভাজলে ওঠে !
    এসব তোমারই কাণ্ড, বাবা-মা শেখায়নি কী করে ডিগবাজি খাবে
    নদীর ভেতরে ডুবে ? মাছেদের সঙ্গে কী-কী কথা হয় ? ইলিশ না কালবোস?
    ধরে এনে থার্ড ডিগ্রি দিলেই পেট থেকে গলগল করে বেরোবে জাহাজ !
    এ-শালা সহজে মুখ খুলবে না, এককালে সরকারি খোচর ছিল ব্যাটা
    এখন সুপারি কিলার হয়ে বিদ্যুতের নলি কেটে গাঁ-গঞ্জ ভাসায়
    ঠ্যাঙ বেঁধে টাঙিয়ে দে, পোঁদে হুড়কো কর, হয়তো হীরেগুলো
    ঝরে পড়বে ঈগলের ডানা মেলে,  বখরা পাবি দোআঁশলা বাপ
    একাধিক, টেরি-কেটে বানভাসি শহরে গোঁত্তা মারবে, জেরা কর জেরা
    নির্ঘাৎ পাতলা হয়ে এসেছে শুক্ররসের সাঁতারুরা, হায় মৌলা কী করলা
    এ রে কয় জেরা ? হাত-পা-মুখ বেঁধে ওকে নদীতে ভাসাস যদি কোনো
    শালা কুমির-শুশুক-হাঙর মাস্তান ন্যাপালা বের করবে না, দেখে নিস
    লেখা ডান দিকে নাকি বাঁদিকপানে হেলে যায় ? জেরা করে বের কর
    কবে মরতে চায় ? পূণ্য তিথি আছে একটা এই থমথমে চৈত্রের সেলে…..
     
    লম্পটের জন্ম
    ইমলিতলায় দোল খেলছে ডোম চামার দুসাধ কাহার কুর্মি ব্‌উয়েরা
    নাচছে পাড়ার কলতলায়, আধখোলা বুক, ওথলাচ্ছে তামাটে আবীর
    মনুস্মৃতি থেকে কোরক উঠছে জেগে তাই, ও ছুট্টে গিয়ে খাঁজে মুখ গোঁজে
    মাংস কোনো জাতধর্ম তোয়াক্কা করে না, মনুস্মৃতি থেকে ঝরঝর আঠা
    প্রথম উদ্গীরণ আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরতে বলে, জন্ম হয় সেই বিষে
    লম্পট কিশোরের, তৃপ্তির এ-গূঢ় আবিষ্কার তাকে আহ্লাদে কুঁদছে আজীবন।
    দাম্পত্য
    তখন আমরাও নোংরা এমনকী অশ্লীল কথাবার্তা
    করেছি বলাবলি, হেসেছি রাস্তার মাঝে কেননা আমাদের
    ভাষা কেউই তো বুঝতো না । তখন বুড়ির ঢেউ-চুল
    কোমর পর্যন্ত সুগন্ধ মাখানো, মুখ গুঁজে ঘুমোতুম তাতে–
    চোখ দুটো, বুকও বড়ো-বড়ো, যা দেখে বড়দি বলেছিল
    “আমরা এরকম কনে তোর জন্যে খুঁজেই পেতুম না
    তার আগে পীরিতের কতো খেল দেখিয়েছিলিস বাবা
    তুই ঠিক ঈগলের মতো তুলে আনলি সাবর্ণ চৌধুরীর বাড়ি”
    তখন বুড়ির জামদানি আঁচল উড়তো ময়ূরপঙ্খী হয়ে
    মোজেক মেঝেয় ব্যালেরিনা হিল তুলতো সাম্বা নাচের ছন্দ।
    একান্ন বছরে বুড়ির স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে সেইসব ;
    মাঝে-মাঝে বলে তোমার গোঁফও ছিল রাজকাপুরের।
    বুড়ির পছন্দ মর্ত্যের হানি বাফনা আর ইন্দ্রজিৎ বোস
    আমি সুচিত্রা সেন নার্গিস মধুবালাকে আজও ভালোবাসি–
    বুড়ো বয়সে পৌঁছে বুড়ি বলে এটাই দাম্পত্য-জীবন
    যৌবনে সংসারের খাইখরচ-ঝক্কি-ঝামেলায় টেরই পাইনি
    দাম্পত্যের শেষ পর্বে শোক-দুঃখ-অপচয়ও আনন্দ আনে।
    অবন্তিকাবানুর জন্য প্রেমের কবিতা
    অবন্তিকা বানু, রাষ্ট্রের দিকে তোলা  তর্জনী থেকে 
    যে স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিলি তুই
    দেখেছিস, বোরখা থেকে বেরিয়ে এসেছেন বুড়ি আর তরুণীরা
    মাথায় হিজাবঘোমটা অবন্তিকাবানু
    প্রান্তকে টেনে এনে  মেইনস্ট্রিমে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিলি
    এই বদল একদিনের নয়
    এমনকি শুধুই বদল নয় তোর ওই তর্জনী তোলা
    ভেতরে-ভেতরে ভয়ংকর ওলোটপালোট করে দিলি
    তোর দেখাদেখি হিজাবঘোমটা ফেলে হাজার তরুণী
    রাষ্ট্রের দিকে ওঠাচ্ছে তর্জনী
    হয়তো তুই শুধু ছবি হয়ে থেকে যাবি কৌম-আয়নায়
    কিন্তু ওই তর্জনী তোলা ভুলবে না কেউ
    সশস্ত্র পুরুষদের তোর ধমকানি এবং হুঁশিয়ারি 
    আমার আশিতম জন্মদিনে সবচেয়ে দামি উপহার
    অবন্তিকার শতনাম
    আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া...বাঁদিকেরটা আদর করলেই গোলাপি হয়ে যায়...ডানদিকেরটা আদর করলেই হলদেটে রঙ ধরে...বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী...বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে...ডানদিকের বোঁটার নাম ও নিজেই রেখেছে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার যে লোকটা সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের ডিটেকটিভ...ডিটেকটিভ বই পড়তে ওর জুড়ি নেই...ছুঁলেই কাঁটা দিয়ে ওঠে তাই...যোগেন চৌধুরীর আঁকা ঝোলা মাই ওর পছন্দ নয়...প্রকাশ কর্মকারের আঁকা কালো কুচকুচে মাই ওর পছন্দ নয়...পেইনটিঙের নাম রাখা গেল না...যোনির কি নাম রাখবো চিন্তা করছিলুম...অবন্তিকা চেঁচিয়ে উঠলো পিকাসো পিকাসো পিকাসো...পিকাসোর যোনির কোনো আদল-আদরা নেই...কখনও বাদামি চুল কখনও কালো কখনও কিউবিক রহস্য...তাহলে ভগাঙ্কুরের...ও বলল সেটা আবার কি জিনিস...ওর হাত দিয়ে ছুঁইয়ে দিতে বলল অমঅমঅমঅম কি দেয়া যায় বলতো...পান্তুয়া চলবে...ধ্যুৎ...রস পানেই পান্তুয়া নাকি আরও কতো রকম মিষ্টি হয়...ছানার পায়েস...নারকেল নাড়ু...রসমালাই...নকশি পিঠা… রাজভোগ… লবঙ্গলতিকা...হলদিরামে ভালো লবঙ্গলতিকা পাওয়া যায়...আমি বললুম স্বাদ কিছুটা নোনতা...ও বলল দুর ছাই আমি নিজে টেস্ট করেছি নাকি যাকগে বাদ দে… হ্যাঁ… এগোই...পাছার কি দুটো নাম হবে...ডিসাইড কর...ডিসাইড কর...তুই কর আমি তো দেখতে পাচ্ছি না...না না ফের ফের...লাবিয়া নোনতা হলেও ওটার নাম দিলুম গোলাপসুন্দরী...পারফেক্ট হয়েছে...তাহলে পাছার একটাই নাম দিই...নরম নরম কোনো নাম...পাসওয়র্ড...ঠিক...এর নাম দেয়া যাক পাসওয়র্ড...ধ্যাৎ...পুরো রোমান্টিক আবহাওয়া ফর্দাফাঁই করে দিচ্ছিস......গ্যাস পাস হয় বলে পাসইয়র্ড হতে যাবে কেন...ছিঃ...তাহলে এর নাম হোক গরমের ছুটি...গরমে বেশ ভাল্লাগে পাউডার মাখিয়ে পাছায় হাত বোলাতে...ওক্কে...তারপর...ঘুমোবো কখন...বাঁ উরুর নাম দিই ককেশিয়া...ডান উরুর নাম দিই লিথুয়ানিয়া...রাশিয়ানদের উরু দারুণ হয় বিশেষ করে শীতকালে যখন ওরা চান করে না...ভোদকা খেয়ে ভরভরিয়ে প্রতিটি রোমকুপ দিয়ে গন্ধ ছাড়ে...শুয়েছিস নাকি কখনও রাশিয়ান মেয়ের সঙ্গে...না কল্পনার যুবতীদের ইচ্ছেমতন হ্যাণ্ডল করা যায়...ছাড় ছাড়...এগো...মানে নামতে থাক...তাড়াতাড়ি কর নইলে গাধার দুলাত্তি দেবো...তা্হলে পায়ের নাম রাখছি জিরাফ...বামপন্হী জিরাফ আর দক্ষিণপন্হী জিরাফ...এবার ওপরে আয়,,,মুখে...ঠোঁট...ঠোঁটের নাম দিই আফ্রিকান সাফারি...আচ্ছা...ঠোঁটের নাম আফীকান সাফারি...ব্লোজবে খণ্ড খণ্ড মাংস ছিঁড়ে খাবো...খাস...থুতনিতে সেকেন্ড চিন...পিৎজা কোক খাওয়া থামা...থুতনির নাম দিই গোলাপজাম...কেন কেন কেন...পরে বলব...এখন দুচোখের নামদিই...শতনাম হলো না তো...চোখ বোজ চোখ বোজ...তুই তো একশোসমগ্র আবার শতনামের কী দরকার...তাহলে আয়...আজ তুই ওপরে না নিচে?
    কেউ তো জানতে চায়নি
    কেউ কেন জানতে চায়নি কখনও কবিতার শিরোনামে
    ‘ছুতার’ শব্দটি কার কথা বলে ! অনুবাদে যিশু হয়ে গেল !
    মেরি ম্যাগডালেন তুমি তো লুকিয়ে আছো শুভাদেবী হয়ে
    কাঁধে ক্রুশকাঠ নিয়ে যিশু যতক্ষণ হেঁটেছেন, তুমি ছিলে
    তাঁর সঙ্গে ; অপরিসীম প্যাশন আমাকে বাল্যের স্কুলে
    বলেছিলেন ফাদার হিলম্যান, সংলগ্ন গির্জায় বাইবেল ক্লাসে--
    শুনে, আমার অদম্য বিচলন রয়ে গেছে রক্তের বুদ্বুদে
    কবিতায় দুইটি প্যাশন নিয়ে যে জাল বুনেছিলুম তা কেউ
    ধরতে পারেনি, এক মাস ঠায় নব্বুই লাইনের কবিতায়
    যিশু হয়ে ক্রুসবিদ্ধ হবার জন্য চলেছি সারাটা জীবন
    হে মেরি ম্যাগডালেন-শুভা যৌবনের উদ্বেল প্রেমিকা 
    তোমার জাগতিক মৃত্যুর খবর এলো আজই ভোরবেলা
     ক্রুসকাঠের মতো তুমিও অমর ওই একটি কবিতায়
    ছদ্মমুখের প্রেমিকা
    আসো দেখি রোজ রাতে কোনো এক ছদ্মমুখ নিয়ে
    সন্দেহ থেকেই যায় তুমিই তো সেই নারী, নদীর ওপার থেকো আসো
    নৌকোর ছইয়ে লুকিয়ে, মাঝির মেয়ের ঢঙে জলস্রোত মেখে
    বুঝতে পারি না  তুমি সত্যিই তুমি কিনা ! তুমিই কি তুমি ?
    দেহ তো একই যুবতীর, তবে মুখশ্রী বদলে যায় কেন ?
    আমাকে উন্মাদ করে দিতে চাও তো দেরি করছ কেন !
    কিন্তু এভাবে ? আমি তো আগেই উন্মাদ তোমাকে পাবার জন্য
     আর কতো ছদ্মমুখ নিয়ে নদী পারাপার করে
    মাঝরাতে স্বপ্নে নৌকোয় দাঁড় বেয়ে ঘুর্ণি তুলে আসো
    একদিন প্রকৃত  এলে কীই বা ক্ষতি হবে আমাদের
    হয়তো কানাকানি হবে । হয়তো লোকেরা বলবে, এই নারী
    মোটেই সে-মেয়ে নয়, নদীও নয় যে আপনার কাছে পৌঁছোবে 
    চিরকাল থেকে যাবে ছদ্মমুখে, চিরকাল ভুলিয়ে রাখবে আপনাকে
    একই যুবতী-শরীর  প্রতিদিন পালটাতে থাকে ছদ্মমুখ নিয়ে
     
    এ কেমন বৈরী
     
    ভাবা যায় ? কোনো প্রতিপক্ষ নেই !
    সবকটা আধমরা হয়ে আজ শুয়ে আছে জুতোর তলায় ?
    কিছুই করিনি আমি
    কেবল মুখেতে হাত চাপা দিয়ে চিৎকার করেছি থেকে থেকে
    হাহাহা হাহাহা হাহা হাহা
    পিস্তল কোমরে বাঁধা তেমনই ছিল সঙ্গোপনে
    ক্ষুর বা ভোজালি বের করিনিকো
    বোমাগুলো শান্তিনিকেতনি ব্যাগে চুপচাপ যেমন-কে-তেমন পড়ে আছে
    আমি তো আটঘাট বেঁধে ভেবেছি বদলা নেবো নিকেশ করব একে-একে
    সকলেই এত ভিতু জানতে পারিনি
    একা কেউ যুঝতে পারে না বলে দল বেঁধে ঘিরে ধরেছিল
    এখন ময়দান ফাঁকা
    তাবৎ মাস্তান আজ গাধার চামড়ায় তৈরি জুতোর তলায়
    কিংবা পালিয়েছে পাড়া ছেড়ে কোনো জ্ঞাতির খামারে
    আমি তো বিধর্মী যুবা এদের পাড়ার কেউ নই
    জানালার খড়খড়ি তুলে তবু যুবতীরা আমার ভুরুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে
    ছ্যাঃ এরকম জয় চাইনি কখনো
    এর চেয়ে সামনে শিখণ্ডী রেখে জেতা ছিল ভালো
    ভেবেছি চেংঘিজ খান যে-লাগাম ছেড়েছে মৃত্যুর কিছু পরে
    তার রাশ টেনে নিয়ে চুরমার করে দেবো এইসব জাল-জুয়াচুরি
    আগুন লাগিয়ে দেবো মাটিতে মিশিয়ে দেবো ধুরন্ধর গঞ্জ-শহর
    কিন্তু আজ সমগ্র এলাকা দেখি পড়ে আছে পায়ের তলায় ।
    ঘুণপোকার সিংহাসন
    ওগো স্তন্যপায়ী ভাষা পিপীলিকাভূক মুখচোরা
    ভূচর খেচর জলচর দাম্পত্যজীবনে তুষ্ট একশিঙা
    নীলগাই বারাশিঙা চোরাকিশোরীর হাতে মূল্যবান প্রাণী
    স্হলে বিচরণকারী উদবিড়াল গন্ধগোকোল বিনোদিনী
    শব্দগহ্বর খেয়ে নোকরশাহির রাজ্য এনেছো এদেশে।
    প্রেমিকের ক্রন্দন
    গর্ভের গোলাপি অন্ধকারে ছিলে হাসিমুখে
    বেরিয়েই কাঁদতে আরম্ভ করলেন
    না কাঁদলে থাবড়ে কাঁদানো হলো আপনাকে
    প্রথম আলোয় আপনাকে কাঁদতে হবেই
    কেননা আপনি একজন প্রেমিক
    ঘোড়া-গণ্ডার-হাতিও বেরোবার সময় 
    অতো উঁচু থেকে পড়ে, কিন্তু কাঁদে না
    ওদের মা গা-চেটে পরিষ্কার করে দিলে
    পড়েই আনন্দে লাফাতে আরম্ভ করে
    আলোর গুরুত্ব বুঝেছেন আলোকিত হয়েছেন
    তাই আপনি কাঁদুন আর অন্যদের কাঁদান
     
    আজল
    কেমন পুরুষ তুমি ? আজল জানো না !
    কী বিশাল যৌবন পড়ে আছে ! আজল জানো না ?
    এরকম দীর্ঘদেহ সৌম্যকান্তি উজ্বল শ্যামবর্ণ সুপুরুষ তুমি
    অথচ জানো না প্রেমের গূঢ় উন্মোচন ! জানো না আজল !
    অনেক প্রেমিকা পাবে - কুচ্ছিত কিংবা সুন্দরী
    কাজলনয়না বা কুতকুতে মোঙ্গোল চোখ
    পীনোন্নত ময়ূরের মতো গলা কিংবা বেঢপ থপথপে
    চকচকে কৃষ্ণাঙ্গিনী অথবা চাঁদের আলোর ত্বক মেয়ে
    কী করবে অমন প্রেমিকা পেলে ? ছেড়ে দেবে ?
    এই তো তরুণ হয়েছ সবে ! শিখে নাও শিখে নাও--
    আজল কাহাকে বলে । আজলের কোনো পাপ নেই ।
     
    মেরু বিপর্যয়
    অবন্তিকা, হিপি বিদেশিনী, স্লিপিং ব্যাগেতে তোর
    চুপচাপ ঢুকে যেতে দিয়েছিলি, শুনে আমি কবি
    টাইম পত্রিকা ফোটো ছাপিয়েছে, বিটনিকরাও
    লিখেছে আমার কথা বড়ো করে তাদের কাগজে–
    হ্যাশ টেনে ভোম মেরে দু-ঠ্যাং ছড়িয়ে সে-প্রণয়
    গিঁথে আছে চেতনায় কবিতা ভাঙিয়ে তোর শ্বাস
    না-মাজা দাঁতের ভাপ সোনালি শুকনো চুল ধরে
    বুকে ময়লাটে তাপে মুখ গুঁজে কবিত্ব করেছি ;
    বলেছিলি, ‘কবিতা তো জিভের ডগায় বাস করে
    তোমার ভাষায় লেখো জিভ দিয়ে রহস্য-গহ্বরে’।
    আমার পৃথিবী উল্টে দিয়েছিস সেই রাত থেকে :
    পা ওপরে মাথা নিচে, এ আমার সৃজন-জগত–
    হিপি বিদেশিনী তোর গন্ধ ভুলে গেছি : তোর নাম
    টিকে আছে অবন্তিকা হয়ে আরো নারীদের সাথে।
    মায়ের ভালোবাসা
    যতো বুড়ো হচ্ছি ততো বেশি মনে পড়ছে মায়ের মুখ
    বিভিন্ন বয়সের মুখ একই সঙ্গে
    ক্যাথলিক স্কুলে যাচ্ছি -- মা তো টা-টা করতে জানতেন না
    দরোজার কপাট একটু-একটু করে বন্ধ করছেন
    ইমলিতলার ঝোপড়ি থেকে তাড়ি খেয়ে ফিরেছি
    কিছুক্ষণ পর মা নাকে আঙুল চাপা দিয়ে ইশারা করেছেন
    ওপরে ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে নয়তো বাবা এসে জানতে পারবেন
    মায়ের মুখে ভীতি যা আসলে আমার
    ব্রা্হ্ম স্কুল থেকে ভিজে জামা সপসপে জুতোয় ফিরেছি
    মা আগে থেকেই তৈরি ছিলেন গামছা আর হাফপ্যান্ট নিয়ে
    অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে চিনেবাদাম দেয়া আটার হালুয়া নিয়ে
    বাটিটা মায়ের হাসির মতন তোবড়ানো
    কুড়ি জনের সংসার সামলাতে হয় মাকে -- উনি দেখান আমি কুড়ি নম্বরে
    মৃদু হাসি দেখে টের পাই আমিই এক নম্বরে
    বয়সের সঙ্গে তাল দিয়ে আমার আর মায়ের মুখ একইভাবে চুপসে গিয়েছে
    চোখ বুজে মায়ের হাজার খানেক মুখ মনে করতে পারি এখন
    গ্রেপ্তার হবার সময়ে মায়ের আতঙ্কিত মুখ বেশি করে মনে পড়ে
    অবাঙালি পত্রপত্রিকায় আমার ফোটো দেখে আবার মায়ের হাসি ফিরে আসে
    মা বেশ গর্বোদ্ধত নারী ছিলেন বুঝতে পারি চোখ বুজে
    যাবার সময়ে ওই গর্ববোধ দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মুখও মনে আছে…
     
    প্রস্তুতি
     
    কে বললে বিধ্বস্ত হয়েছি? দাঁত নখ নেই বলে? ওগুলো কি খুবই
    জরুরি? আবাঁট চাকুর মেধা তলপেট লক্ষ করে বিদ্ধ করে দিয়েছি সেসব
    এরই মধ্যে ভুলে গেলেন কেন ! পাঁঠার মুখের কাছে
    পাতাসুদ্ধ কচি এলাচের গোছা, সেই যে সেই সব কান্ড? ঘৃণাশিল্প, ক্রোধশিল্প
    যুদ্ধশিল্প ! পিছমোড়া মুখবাঁধা যুবতী সানথাল; গোলাপি ফুসফুস ছিঁড়ে
    কুখরির ধারালো আনচান — সেই সব?
    হৃৎমাংসে রক্তমেখে উঠে আসা চাকুর গরিমা? আমার তো গান বা
    সংগীত নেই; কেবল চিৎকার, যতটা হাঁ করতে পারি
    নির্বাক জঙ্গলের ভেষজ সুগন্ধ ; ঘুঁজি-পরিসর কিংবা হারাম-সন্ন্যাস
    বলিনি ‘জিভ দিন জিভ গোঙানি ফেরত নাও
    দাঁতে দাঁত দিয়ে সহ্য করার ক্ষমতা’ । নির্ভীক বারুদ বলবে:
    মূর্খতাই একমাত্র শিক্ষনীয়’। উদারহস্ত নুলো
    দাঁতে ছুরি নিয়ে আমি লাফিয়েছি জুয়ার টেবিলে, তোমরা ঘিরে ফ্যালো
    ছেঁকে ধরো রাবার বাগিচা কফি চায়ের বাগান থেকে
    গামবুটে স্বচ্ছন্দ চাকুরিসুদ্ধ এসো কে কোথায় আছো
    জরাসন্ধের পুং যেভাবে বিভক্ত হয় হীরকের দ্যুতি ছলকে ওঠে
    হাত-পা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর জ্ঞানগম্যি বলে কিছু নেই
    বাঁশির মতন ধরে সিঁধকাঠি বাজিয়ে দেখেছি আমি অসুখে অভাবে
    আপেল-ত্বকের মোমরেণু মাখা ভঙ্গুর স্নেহ
    সঙ্গমের আগে মাদি পিপীলিকা ডানা খুলে রেখে দেবে পাশে
    আমিও উরুত চাপড়ে বিকল্প চিৎকার দিচ্ছি: পৃথিবীকে খালি করো
    বেরোও বের হও সর্বশক্তিমান
    বান্দরের চুলকানিপ্রবণ চার হাতে শঙ্খ
    চক্র পদ্ম গদা নিয়ে নিজের ঘামের নুনে লবণ বিদ্রোহ হোক
    বারুদ সুতলি ধরে বিস্ফোরণের দিকে তুমাকার স্ফুলিঙ্গ ছুটুক
    সারা গায়ে অন্ধকার লেপড়ে এসো বাকফসলের কারবারি
    কুকুরযুবার মনোমালিন্যে ভরা মাঝরাতে
    কীটনাশকের ঝাঁঝে মজে থাকা ফড়িঙের রুগ্ন দুপুরে
    ভূজ্ঞানসম্পন্ন কেঁচো উঠে আয়
    চাকুর লাবণ্য আমি আরেকবার এ-তল্লাটে দেখাতে এসেছি।
    মুরগির রোস্ট
    পালক ফুলিয়ে ক্রোধে লড়ো মুর্গা, চাকু-মালিককে খুশ করো
    হুলেতে পরাগ মেখে ঝাপটাও ডানা
    বলেওছি : দুহাত মুচড়ে নতজানু করে রাখো
    মাঝরাতে ঘুমভেঙে মাদুর গুটিয়ে নেমে এসো ছাদ থেকে
    বুটজুতো --- রাইফেল --- ঘুরন্ত বুলেট --- চিৎকার
     
    বাড়ি নিয়ে চলো বলে কেঁদে ওঠে পাশের হাজতে বন্ধ বৃদ্ধ কয়েদি
    ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও যেতে দাও বাড়ি যেতে দাও
    ডিমের ওপরে বসে সিংহাসনে ঝিমোয় ডাহুক
    অন্ধকারে গলা টিপে ধরো
    লড়ো মুর্গা , মরো লড়ে , গর্জাও গুঙ্গার দলে ঢুকে
     
    জিভেতে কাঁচের ফুলকি --- নাচাচ্ছি বুকের পেশী
    মাছের কানকো খুলে জলেতে কুয়াশা মিশিয়েছি
    কড়ে আঙুলের টুকরো মোড়া ছিল গোলাপি কাগজে
    দুহাতে দুচোখ ঢেকে কে কাঁদে হাউ-হাউ করে জেলখানায়
    নারী না পুরুষ আমি বুঝতে পারি না
     
    এ নাও চোখের পাতা --- ফুঁ দাও বাঁহাতে রেখে
    শিশিরে ফণার পাঞ্জা খোলো
    মেয়েলি হিসির শব্দে তলপেট কাঁপে জাত-গোখরোর
    রক্ত গড়ালে নাকে তুলো গুঁজে শ্মশানে পাঠাও
    রাস্তায় পড়ে থাকবে চটিজুতো ভাঙা-ইঁট ঠ্যাঙ টেনে ছেঁড়া পাতলুন
     
    ঝড়ের সমুদ্র থেকে যে-ঢেউ খাবলে তুলে মেখেছি দু'পায়ে
    সে নব বর্ণমালা থেকে আজ হরফ এনেছি
    অন্নবিচার ও প্রেম
    মহিলাদের পোশাক পালটাবার মাংসল গন্ধে বুঁদ
    যে-ঘরটায় এক ডিভোরসি বোলতাবধু ডিম পার্ক করেছেন
    শহুরে পাখিদের ছ্যাঁচড়া জঞ্জালের ভজকট ভাষা ডানায় বয়ে
    ভেতরে ঢুকে ঝোড়ো ঝড় নিজে হাতে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে দ্যাখে
    জোরকদমে চর্চা চলছে দিলদরিয়া ভালোবাসার ঘিজতাঘিজাং
    যদিও ফাটলপ্রিয় ছারপোকারা নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল
     
    যে-যার মতন ভালো বা খারাপ হবার স্বাধীনতার দরুন
    ছাদ-উঁচু ওই ঘরের অ্যান্টিক পালঙ্কই শেষমেশ পেডিগ্রির খুঁত ধরে
    কেননা ডক্টরেট-করিয়ে ছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ ধর্ষণের পারিতোষিক
    ওই ঘরেই খেপে-খেপে বিলোনো হয় বুদবুদময় কন্ঠস্বরে
    অথচ অধ্যাপকবাবুর ঘিলু থেকে জোয়ারের বয়স তো কবেই খাল্লাস ---
    বলো দিকিন ওরা কী-বা দু'ছত্তর মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে লিখবে
    আলো
    আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
    পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলো-পড়া মেঝে
    আচমকা কড়া-আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
    তক্ষুনি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দুতিন বার
    কষ বেয়ে রক্ত গড়াতে থাকে টের পাই–
    আবার তীব্র আলো মুহূর্তে জ্বলে উঠে নিভে যায়
    গরম লোহার রড খালি-পিঠে মাংস ছেঁচে তোলে
    আমাকে লক্ষ্য করে চারিদিক থেকে আলো ঝলসে ওঠে ফের
    আপনা থেকেই চোখ কুঁচকে যায় দেখতে পাই না কাউকে
    একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
    পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।
    মনুষ্যতন্ত্র
    আক্রান্ত হবার জন্যে তৈরি হয়েই আছি এসো মারমুখি চামচিকে
    জামাগেঞ্জি ছিঁড়ে দাও বাড়ির দেয়ালে বোমা মারো
    রগে রিভলভার চেপে ভয় দেখাও হাজতে ঠেঙিয়ে জেরা করো
    ধাবমান ট্রেন থেকে ঠেলে দাও আমাকে আটকাও মেরে ফ্যালো
    আমি ভূকম্পনযন্ত্র আণবিক যুদ্ধ দেখব বলে বেঁচে আছি
    নীল গর্দভের লিঙ্গ মানবের শুক্রজাত কাফ্রি খচ্চর । 
    নেকড়ে বংশ
    রগেতে পিস্তল চেপে বলছে: দোগলা ফের এসেছো এখানে
    থাবা মেরে ছিঁড়ে ফেলব ধর্ষক্ষুধাতুর শালা নেকড়েবংশ তোর
    খসখসে জিভে চেটে নেব নখের রোদ্দুরকণা
    জটায়ুর কবজালাগানো লোহাডানা ঝাপটানোর বাজনা বন্ধ করে দেব
    শরীরে এখন ঝুলকালিমাখা পেশী বুঝলি বাঞ্চোৎ
    বাকল আড়াল করে সেগুনের এঁকে-রাখা আঁশ 
    একদিন আমারও হসন্ত গোলাপি ছিল রেফও সবুজ ছিল
    য-ফলাতে মনে হত নারীর রেশমি তলপেট
    কড়া পেচ্ছাপের গন্ধে কুচুটে হাজত ছিল স্বাধীন শহরে 
    শব্দনালিকা আজ ফোঁসে ক্ষোভে : তর্জনীর পোড়া মাংস খেতে দাও
    দাঁতে কেটে ছিঁড়ে ফেলছি নাভিসূত্র
    নেকড়ে নারীর কাছে দীক্ষা নিয়ে দুর্গন্ধ মেখেছি টাকরায়
    দুচোখে লঙ্কার গুঁড়ো ছুঁড়ে মারো
    মুখাগ্নি করার কালে দেখব না কার থ্যাঁতা মড়া
    গরম সাঁড়াশি দিয়ে ছিঁড়ে নাও ধাতুকোষ বংশলোপ হোক                                                    
     
    আবার আসবো ফিরে
    আবার আসবো ফিরে জানি, কিন্তু কোন বাংলায়?
    দু-বাংলাতেই আসবো ফিরে আমি, বুঝলেন জীবনানন্দ
    কাক বা কোকিল হয়ে নয়, ঘাস বা কমলালেবু হয়ে নয়
    মানুষের হাল-আমল রূপে ফেরবার কোনো আশা নেই
    কেননা এখন মানুষের সংজ্ঞা বেশ পালটে গিয়েছে
    চাকুরির দৌলতে পশ্চিমবাংলার গ্রাম গঞ্জ শহরতলি
    ঘুরে ঘুরে, চাষি তাঁতি জেলে মাঝি ছুতোর কামার
    শবর সাঁওতাল মাহাতের দাওয়ায় বসে যেসব দুর্দশার কথা
    শুনেছি পঞ্চাশ বছর ধরে, কাটাকাটি, খুনোখুনি
    খামার বসতবাড়ি সুখের সংসার পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া
    বিরোধ করেছে যারা তাদের গ্রামছাড়া করা
    মাটির তলায় সপরিবার জ্যান্ত পুঁতে দেয়া
    বুঝলেন জীবনানন্দ, সবই ঘটেছে দেশভাগের বহু পরে
    বহু পরে বহু পরে বহু পরে বিশ-ত্রিশ বছর তো হবেই
    ফেলানি ঝুলেছে কাঁটাতারে, ইলিশ এসেছে লুকিয়ে-চুরিয়ে
    এপার ওপার দুই দেশ থেকে কচি কিশোরীদের মুখচাপা দিয়ে
    তুলে এনে বিক্রি হয়েছে প্রতিদিন কুমারীত্ব কেনার বাজারে
    পরে তারা গোপন জাহাজে পাচার হয়েছে আরবের বন্ধ হারেমে
    তাই আর মানুষের রূপে ফিরতে চাই না আমি
    তবু ফিরতে চাই, বুঝলেন জীবনানন্দ, ফিরবোই আমি
    বাঙালির মুখের ভাষা হয়ে বেঁচে থাকব চিরকাল এপার-ওপারে
    হাঁচি আর ভালোবাসা
    মেয়েদের সিট-ঘেঁষে দাঁড়িও না, বলছিল বুড়ি
    মেয়েদের সিটের কাছে দাঁড়িও না, বকছিল বুড়ি
    হুঁশিয়ারি দেয়ার পরও এমনই টেসটোসটেরনের ডাক
    ভিড়ের গোঁতা খেতে-খেতে সেখানেই দাঁড়িয়েছিলুম
    সামনের তরুণী হাঁচলেন, হাত বা কনুই চাপা না দিয়েই
    বেশ ভালো লেগেছিল নাকটুকু স্ফীত হয়ে বুককে কাঁপানো
    বাসের ব্রেক মারায় ঠেলা খেয়ে তরুণীর কপালে হাত ঠেকে গেল
    বুঝলুম জ্বর ; হয়তো যাচ্ছে ডাক্তারের কাছে কিংবা অফিসে--
    যুবতীর প্রতি টেসটোসটেরনের টানে ভালোবাসা ছিল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ছিল--
    পরের সকাল থেকে টানা চার দিন জ্বরে ভুগলুম, আহা গো যৌনতা
    নিজেকে ভুগতে দিলুম ; হাঁচির মাধ্যমে পাওয়া তরুণীর ভালোবাসা
    অন্তত চারদিন পেরেছি রাখতে ধরে, বিছানায় আয়েস করে শুয়ে–
    আরেকবার উহুরু
    কালো কাপড়ের খোল মুখেতে পরানো, দুই হাত
    পিছমোড়া করে বাঁধা , দাঁড়িয়ে রয়েছি পাটাতনে,
    জল্লাদের ঘামের তিতকুটে গন্ধে ভোরের বাতাস থম –
    সময় গুনছে কারা ? ডাক্তার পুলিস জজ ওয়ার্ডেন ? নাকি কেউই গোনে না !
    আচমকা নেমে যাবো ঝুপ শব্দে যেখানে ঘোলাটে অন্ধকারে
    পোষা হয় ঘামলোনা নোংরা ইতিহাস ;
    কাঁপতে থাকবে দড়ি , প্রথমে খুবই ঘনঘন,
    দুর্বল ঝাঁকুনি , তারপর স্হির , বোবা চিৎকারে
    ওভাবে যেখানে কবি-খুনি নেমে গেছে বহুবার
    আমি তো উঠেছি আজ সেইখান থেকে জ্যান্ত হয়ে
    এ-ই একমাত্র ওঠা । এছাড়া উপায় নেই শব্দদানবের
    যাদের পায়ের কাছে পড়ে থাকে বিধ্বস্ত ভূগোল
    মরার জন্য যারা জন্মায় আমি সেই ধর্মবংশ
    বাঁচিয়ে রাখার জন্য বারবার ঝুলি না ফাঁসিতে ।
    অদ্রীশ বিশ্বাসের আত্মহত্যা
    হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    যখন আকাশের ইস্পাতে গিঁট বাঁধছিলে
    দেখে নিচ্ছিলে গিঁট শক্ত হলো কিনা
    পায়ের শিরাগুলো তাদের কুয়োর দড়ি দিয়ে রক্ত তো পাঠাচ্ছিল
    তোমার হৃৎপিণ্ডের দিকে, ভালভ খুলে এবং বন্ধ করে
    ওই দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম শুনে তাড়া পড়ে গিয়েছিল
    তোমার শরীর জুড়ে, অথচ তুমি বরফের তৈরি মাথায়
    জানি না কবে কোন দিন কখন নির্ণয় নিয়ে ফেলেছিলে
    আকাশের হুক থেকে ঝুলে পড়ে, ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করে নেবে
    শেষ প্রশ্বাসের সঙ্গে শেষ বীর্য ফোঁটা ঝরেও ঝরবে না
    কিছুটা হদিশ কি পাইনিকো ? পেয়ে তো ছিলুম–
    বলেও ছিলুম, এ কী করছো অদ্রীশ তুমি, উত্তর দিলে না
    নারীও পুরুষের মতো জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরে, জানাই ছিল না
    আমি তো জানোই, নারীদেরই জড়িয়ে ধরেছি চিরকাল
    পুরুষকে জড়িয়ে ধরার কথা ভাবলেই বিরক্তি ধরে, বমি পায়
    মনে হয় রাস্তাছাপ রাজনীতি শরীরে আশ্রয় নিতে এলো
    এও বলেছিলে তুমি, চিরকাল মুক্তযৌনতার পক্ষে
    রজনীশ-আশ্রমের যৌনতার খেলা সমর্থন করো, সম্পর্কের ব্যাগাটেলি
    তোমার যৌনজীবনের কথা জানতে চাইলে তবে লজ্জা পেয়েছিলে কেন
    ইউরোপে গিয়ে বিদেশিনী প্রেম করেছিলে কিনা, রোমান হলিডে,
    জুলিয়েট, জাঁ দুভাল, তার কোনো উত্তর দাওনি তো
    তোমাকে বুঝতে পারা ক্রমশ জটিলতর করে দিয়ে তুমি
    ফেলে গেলে বুদ্ধদেব বসুর উপহার দেয়া মিমিকে ১৯৬৫ সালে
    লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি সম্পাদিত সিটি লাইটস জার্নালের দ্বিতীয় খণ্ডটি
    যাতে হাংরিদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, হাওয়ার্ড ম্যাককর্ডের
    বিদ্যায়তনিক ভূমিকাটিসহ, ফুটপাথ থেকে কেনার সময়ে
    হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    তোমার কাছেই জানলুম, জীবনানন্দের মেয়ে মঞ্জুশ্রীর চাকরি গিয়েছিল
    সাউথ পয়েন্ট থেকে, মধুসূদন সান্যালের সাথে প্রেমের কারণে
    বলেছিলে তুমি, যে বিদ্রোহী সে তো সমাজবিহীন, তার কেউ নেই
    তার অদ্রীশ আছে, মলয়ের প্রথম সাক্ষাৎকার তুমি নিয়েছিলে
    যখন কেউই পাত্তা দিতে চায়নি আমাকে, আমার প্রবন্ধগ্রন্হের
    ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলে, জানি না কখন কবে প্রৌঢ় হয়ে গেলে
    সংবাদপত্রে পড়লুম, যখন আকাশের খুঁটি থেকে ঝুলছিলে, ঘরে ছিল
    আলো, নাকি অন্ধকার ঘরে তুমি শ্লেষ হাসি ঠোঁটে নিয়ে
    এনজয় করেছো প্রিয় একাকীত্ব ; তখনও কি নিজেকে নিজে নিঃশব্দে
    বলছিলে : এই বাংলায় দুইটি জিনিস আর ফিরবে না কোনোদিন :
    সুভাষচন্দ্র বসু আর সিপিএম । মার্কস বা লানিন নয়, স্তালিনও নয়
    মাও বা ফিদেল কাস্ত্রো নয়, কেবল সিপিএম ক্যাডারিত হাড়গিলে লোকেদের
    ঘেন্না করে গেছো, তুমি তো প্যারিস রোম ফ্লোরেন্স ভেনিস ব্রিটেনে গিয়েছিলে
    তবু তারা রাস্তায় তোমাকে ফেলে রায়গঞ্জে থেঁতো করেছিল
    যাদবপুরের চারতলা বাড়ি থেকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে পাগলাগারদে
    ইলেকট্রিক শক দিয়েছিল, অথচ তুমি তো নিজেই বিনয় মজুমদারকে
    হাসপাতালে দেখাশোনার ভার নিয়েছিলে, বিনয় মজুমদারের বউ রাধা
    আর ছেলে কেলোকে সোনাগাছি গিয়ে খুঁজে-খুঁজে ছবি তুলে এনেছিলে
    অর্ঘ্য দত্তবক্সির বইয়ের মলাটেতে দেখেছি তাদের, সত্যি বলতে কি
    কয় দিন কয় রাত ঝুলেছো নিজের ঘরে, তারপর পিস হেভেনের শীতাতপে নয়
    কাটাপুকুর মর্গে তিন দিন পড়েছিলে, বুক চিরে ব্যবচ্ছেদ হয়েছিল ?
    ডাক্তারেরা পেয়েছিল কিছু ? জমাট বেঁধে যাওয়া দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    জানি না । শুনিনিকো । দেহেতে পোশাক ছিল ? কোন পোশাক ?
    লাশকাটা ঘরে ? চোখ আর বন্ধ করোনিকো, সম্ভবই ছিল না
    সবুজ প্লাস্টিকে মোড়া, ফুল নেই, রজনীগন্ধার রিদ নেই
    সাজুগুজু সুন্দরীরা এসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নিকো তোমার মরদেহ ঘিরে
    কেওড়াতলায় উল্টো বন্দুক করে প্রতিষ্ঠানের সেলামি পাওনি তা জানি
    নন্দন চত্বরে প্রতিষ্ঠানের মোসাহেবদের মতো শোয়ানো হয়নি দেহ
    তোমার প্রিয় সন্দীপন ঘুরতো তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পিছনে পিছনে
    জিগ্যেস করোনি তাঁকে সিপিএম কেন তোমাকে টার্গেট করেছিল !
    আশে পাশে আরও কয়েকজনের শব ছিল, ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    দাদা নকশাল বলে শ্রীরামপুরের বাড়িতে হামলা করেছিল, তোমার কথায়
    সেই লোকগুলো যারা বাংলার রেনেসাঁকে ধ্বংস করে গড়িয়ার মোড়ে নেচেছিল
    বটতলা ফিরিয়ে আনলে তুমি গবেষণা করে, ভিক্টোরিয় বিদেশিরা যাকে
    অশ্লীল ছাপ দিয়ে আদিগঙ্গার পাঁকে ছুঁড়ে ফেলেছিল
    আর কমলকুমারের রেডবুক, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত প্রথম বাঙালি মহিলার
    লেখা উপন্যাস ‘মনোত্তমা’ খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরির তাকে অযত্নে রাখা
    তখন হৃৎপিণ্ডে ওঠেনি কি দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    যেমন প্রথমবার প্রেসিডেন্সির প্রথম বছরে ঝালমুড়ি খেতে খেতে
    প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়ায়, ক্যানিঙের ট্রেনে, গঙ্গার খেয়া নিয়ে এপার-ওপার
    মা ‘লীলাবতী’কে নিয়ে বই লিখে হয়তো ভেবেছিলে পৃথিবীতে কাজ সাঙ্গ হলো
    জানবো কেমন করে বলো, এই তো সেদিন ১৯৬৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
    জন্মেছিলে তুমি, মৃত্যুর দিনটাকে আকাশের খুূঁটিকে বলে চলে গেলে
    কেবল এটুকু জানি ২০১৭ সালে ১৬ই জুন কেওড়াতলার শ্মশানে প্রাঙ্গনে
    ডেডবডি ক্যারিয়ার সার্ভিস গাড়িতে গোপনে শুয়ে গন্তব্যে চলে গেলে
    পাখিরা কোথায় গিয়ে মারা যায় জানতে চেয়েছেন অরুন্ধতী রায়
    তিমিমাছ বুড়ো হয় মারা যায়, রুই ও কাৎলা বুড়ো হয়ে মারা যায়
    মারা গেলে তাদের গল্পগুলো জলের তলায় চাপা পড়ে থাকে–
    কতো কাজ বাকি রয়ে গেল, সেসব প্রজেক্টের কেউই কিচ্ছু জানে না
    যাকিছু বহুদিন সযত্নে সংগ্রহ করেছিলে সবই ফালতু মনে হলো
    যা জরুরি মনে হলো তা ওই এক ঝটকায় দ্রিদিম দ্রিদিম দ্রিম দ্রিম
    বন্ধ করে, নিঃশব্দে অট্টহাসি হেসে, আত্মনিধন করে ফেলা…
    নতুন বউ 
    আমরা দুজনে বাথরুমে বৃষ্টির তলায় নাচি
    আমাকে সাবান মাখাচ্ছে ও, আমি ওর চুলে
    শ্যাম্পু লাগিয়ে তুলছি বঙ্গোপসাগরের ফেনা
    মুখে ঢেউ বুকে বানভাসি হাসছি দুজনে
    দেড় ঘণ্টায় আমি ওর ও আমার মাংসে মিশেছে
    বন্ধ দরোজার ভেতরে আয়না লাগিয়ে
    দিয়ে গেছে দাদা, নতুন বউ  যে এসেছে সংসারে–
    দেখাচ্ছি দুজনের বেপরোয়া পেছলা তাণ্ডব
    প্রথম দিনের স্নানে জীবন্ত পেইনটিঙ
    বাথরুমে বনাঞ্চল ঝর্ণা নতুন নারীকে নিয়ে
    সাবান মাটিতে পড়লে চেঁচিয়ে উঠছে ও
    “এই এই ভালো হবে না কিন্তু বলে দিচ্ছি
    বাথরুমে নয়, কালই তো ফুলশয্যা করেছিলে”
     
    হঠাৎ বাইরে থেকে বাবার কন্ঠস্বর শুনি :-
    “আর কতোক্ষণ লাগবে তোদের, দুঘণ্টা তো হলো
    কখন করব চান, কখন বসব খেতে, আজকে পূর্ণিমা”
    মায়ের ফিসফিসানিও শুনতে পাই, বাবাকে বলছেন :-
    “আহ, দাও না দুজনকে একটু ভালোভাবে 
    পরিচয় করে নিতে, কাল থেকে তো সেই একঘেয়ে
    চাড্ডি মুখে গুঁজে নিয়ে দশটা পাঁচটার সংসার”’ 
     
    আমি তো লো কালচার
    আমি তো লো কালচার, একটা বরফকাঠি ছ’জন মিলে
    চুষে খেতুম ; রিকশ-টায়ার কঞ্চি মেরে  নিয়ে যেতুম
    গলির শেষে ; নালির গুয়ে লাট্টু পড়লে কাঠির খোঁচায় তুলে
    ধুয়ে নিতুম রাস্তার টিউকলে ; আমি তো লো কালচার
    সরস্বতীর বুকদুটো হায় লক্ষ্মীর চেয়ে ছোট্ট কেন হলো 
    জানতে চাইলে পুরুতমশায় চরণামৃত ঢেলে দিতেন মাথায়
    বৃষ্টি হলে চুলের ওপর বই আর খাতা চাপা দিয়ে যেতুম ইশকুলে
    আমি তো লো কালচার,  ঢিল লাথিয়ে  রফা করতুম জুতো–
    এখনও সেই একইরকম চলছে ফোকলা দাঁতে, একটা পিৎজা কিনে
    বুড়ির সঙ্গে তিনচার দিন খাই, আমি তো লো কালচার
    লোকের সামনে পাদি আর ঢেঁকুর তুলি ইউরোপেতে গিয়ে
    বুড়ি বলে ‘ভাগ্যিস তুমি ভদ্দরলোক নও, নয়তো জীবন 
    কি আর যাপন হতো, এই বয়সে নোংরা কাজ তো নেই
    নোংরা নোংরা লো কালচার কথাবার্তায় দিনগুলো বেশ কাটে’
    যুবতিদের লেখালিখি
    আমি যুবতিদের লেখালিখি আলোচনা করতে ভয় পাই
    স্মৃতিতে ভেসে ওঠে হাতে ঝোলানো রক্তাক্ত মুণ্ড
    পায়ের কাছে সোনার ঝাঁপিতে রাখা মোহর
    এক হাতে কবিতার বই আরেক হাতে বীণা
    দুই হাত দিয়ে বুকে গেঁথা বর্শা আর অন্য হাতে
    ত্রিশূল গদা চক্র খড়্গ কালদণ্ড বজ্র আরও কতো কী
    হাসিমুখে সিংহের ওপরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে
    এমনকী গাধার ওপরে বসতেও ভয়ডর নেই
    সারা গায়ে ফণা-তোলা অজস্র সাপ লেলিয়ে দিতে পারেন
    গলায় মুণ্ডের মালা ঝুলিয়ে পুরুষের বুকের ওপরে পা
    আমি নিরীশ্বরবাদী বলে আরও বেশী আতঙ্কিত
    ঈশ্বরীরা বলবেন তাঁদের অবজেকটিফাই করে তুলছি
    তীব্র প্রতিবাদ
    জরুরি অবস্হা চলছে, ১৯৭৬, প্রচণ্ড শীত
    বাঁদুরে টুপি, মাফলার, ডবল সোয়েটারে ঢেকে
    রিকশায় বসে, মুঙ্গের শহরের রাস্তায়, কাজে যাচ্ছি
    দেখি, কোতোয়ালির সামনের কালো কাঠের বরগায়
    উল্টো টাঙানো ঝুলছে পায়ে দড়ি বাঁধা
    এগারোটা উলঙ্গ পুরুষ, বুড়ো প্রৌঢ় তামাটে যুবক
    রিকশাঅলার মতে ‘এরা এই জেলার গুণ্ডা-বজ্জাত’
    সবাই ঝিমিয়ে সিঁটিয়ে আছে হাড্ডিকাঁপানো ঠাণ্ডায়
    এক প্রৌঢ়ের লিঙ্গ কিন্তু খাড়া, ঠিক যেন বেয়নেট–
    রিকশাঅলার মতে, ‘ওরটা জরুরি অবস্হার বিরুদ্ধে
    তীব্র প্রতিবাদ’
    আমি বাবার মতন শ্রমিক হতে পারলুম না
    রাজা, নবাব, জমিদারদের পরিবারের সুন্দরীদের
    পেইনটিঙ আঁকতেন দাদু আর মোটা টাকা পেতেন ;
    বাবা তরুণীদের বিয়ের জন্য ফোটো তুলে দিতেন
    রিটাচ করে সুন্দরী করে তুলতেন যাতে পাত্ররা ফোটোর প্রেমে পড়ে
    যাতে মেয়েগুলোর হিল্লে হয় আর যৌতুক কম লাগে
    বাবার মগজে এই তরুণীরা তেমন হেলডোল তুলতে পারতো না
    অথচ আমি তরুণীদের দেখলেই চনমনে হয়ে উঠতুম
    বারবার প্রেমে পড়ার রোগ ধরে গেল আমার
    এক ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আরেক ফাঁদে গিয়ে আটকে পড়তুম
    বেরোবার জন্য ছটফট করতে-করতে বেরিয়ে যেতুম
    আমি বাবার মতন শ্রমিক হতে পারলুম না
    কৌমকান্না
    এই শালা বিদ্ধস্ত পুরুষ, সটাসট গিলছে ককটেল
    কাউন্টারের কুর্সিতে বসে  কাঁদছে নিজস্ব কান্না
    সামনের প্লেটে পেস্তা আখরোট হ্যাজেলনাটগুলো
    মদের সঙ্গেই পায় অথচ খাচ্ছে না । এখানে তো জুটি ছাড়া
    ঢুকতে দেয় না, নিশ্চয়ই কোনো পথবেশ্যা তুলে এনে
    ডিসকোর শীতাতপ সুগন্ধী ঘেমো ভিড়ে  নাচতে পাঠিয়েছে
    সঙ্গীতের কানফাটা প্যাঁদানির চোটে উদ্দাম নাচছে যৌবন
    আমি নিশ্চিত, সারা দেশ জুড়ে, এই সময়ে, হাজার হাজার
    হাফ-প্রৌঢ়রা,  কাঁদছে কোনো না কোনো শুঁড়িখানার আধোঅন্ধকার
    গ্যাঞ্জামে । কালকে সকালে ফিরে যাবে লাৎখোর দিনানুদৈনিকে ।
    ভার্জিন বিরিয়ানি
    ছয় ফিট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা খুঁটি বাঁধা ষাঁড়টা দাপাচ্ছে মাটি
    অনেক সন্তান সন্ততি আছে ওর সারা দেশ জুড়ে
    কিন্তু বেচারা ভার্জিন, সঙ্গম বা ধর্ষণের সুযোগ পায়নি
    ধাতুরস দান করে পয়দা করে চলেছে সংকরগাই
    ইউরোপ আমেরিকা জুড়ে সারবাঁধা ভার্জিন গরু
    গড়ে উঠছে চর্বিদার মাংস দেবে বলে
    চিনে আর চিনে-টাইপের দেশে একইভাবে মাংস দেবার জন্য
    ভার্জিন গোলাপি শুয়োর তৈরি হচ্ছে খাওয়া হবে বলে
    ভার্জিন মুর্গির মাংস, ভার্জিন মুর্গির ডিম
    বিরিয়ানি হবে ভালো কলকাতায়, হায়দ্রাবাদে
    আমরা সেক্সের আমোদ নেবো বিলিতি মদ্য টেনে
    শীতলতমা
    কয়েকজন স্কুলছাত্র হাসাহাসি করছিল খিক-খিক
    এতো হাসাহাসি কেন ? যেদিকে তাকিয়ে হাসছিল
    চেয়ে দেখি সরেস যুবতী এক আইসক্রিম চুষছে আয়েসে
    মুখে পুরছে আর বের করছে টেনে : ব্লোজব ব্লোজব
    একটি ছাত্র  জানতে চাইল হেসে , কী কবি, কী দেখছেন ?
    ১৫ই আগস্ট
    পতাকা উত্তোলনের জন্য উনি দড়ি টানলেন
    পতাকা খুললো না
    ফুলসুদ্ধ পুঁটলি ওনার পায়ের কাছে এসে
    আছড়ে পড়ল
    উনি পতাকাহীন আছোলা দণ্ডের দিকে তাকিয়ে
    স্যালুট দিলেন
    যথারীতি কিছুক্ষণ দেশপ্রেমের বাজনা বাজলো
    ততোক্ষণ উনি গম্ভীর মুখে স্যালুট অবস্হায়
    দিল্লিওয়ালি গার্লফ্রেণ্ড
    পুরাণের সংস্কৃত পাতা থেকে নেমে এসে তুইই শিখিয়েছিলিস
    কবির লেখকের গণ্ডারের চামড়া খুলে রাস্তার ভিড়েতে মিশে যেতে
    তার আগে নিজেকে বড়ো উন্নাসিক ভেবে কাদার সুপারম্যান
    হাতঘড়ির কলকব্জায় ঝড়েতে মেটাফরগুলো চালুনিতে চেলে
    ভেবেছি পিস্তল পাশে নেই বলে আত্মহত্যা করিনি এখনও
    দিল্লির নিম্নচাপে চোখ এঁকে ফিরিয়েছিলিস শব্দ-ভিজুয়াল
    তরোয়ালে আইনি ঝলকে লিপ্সটিক-ছাপা অটোগ্রাফ
    প্রতিটি বিপ্লবের দাম হয় বদলের বাজারও তো বসে
    জুলিয়াস সিজারের গম্ভীর শেক্ষপিয়ারি সাহিত্যের গমগমা ছেড়ে
    সাধারণ মানুষের মতো প্রেমিক চাউনি মেলি তোর কথা মেনে
    বুড়ো বলে সক্রেটিস সাজবার সত্যিই দরকার ছিল নাকি
    গ্রিসের গাধার ওপরে বসে আথেন্স বা কলকাতার পচাগ্যাঞ্জামে
    ধুতি পরে ? কাঁধে উত্তরীয় ! সাহিত্য সভায় ? নাকের বক্তিমে ঝেড়ে ?
    ভুলে যায় লোকে । মজার এ মরে যাওয়া । গন ফট । খাল্লাস ।
    দিল্লিওয়ালি ! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদোহুদো বই লিখে
    বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
    কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি
    উলঙ্গ নাচো তো দেখি তাণ্ডবের আঙ্গিকবর্জিত তালে তালে
    চুমুর পুনঃচুমু পুনঃপুনঃচুমু দিল্লির নিম্নচাপ মেঘে
    এ দ্যাখ গণ্ডারের শিব-সত্য-সুন্দরের চামড়া খুলে ফেলে
    আজকে পেয়েছি নখে প্রেমিকার চুলের জীবাশ্ম
    সমাজ
     
    সমাজ বলে কি কিছু আছে ! যেমন ষোড়শ শতকে ছিল বঙ্গদেশে !
    আমরা গ্রামেতে থাকি, শহরে ছড়িয়ে থাকি
    চল্লিশতলা বিলডিঙে থাকি মেট্রোপলিসে
    চল্লিশতলায় যারা থাকে তারা পড়শিদের বিশেষ চেনে না
    এরকম বহু অট্টালিকা আছে মেট্রোপলিসে, তারা ভোট দ্যায়
    তারা ট্যাক্স দ্যায়, দূরের বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করতে যায়
    এরা কি সত্যই কোনো সমাজের সদস্য বলে মনে হয় !
    শহরে যেসব লোক থাকে তারাও পাড়ার সবাইকে যে চেনে
    তাও যাবে না বলা ; তাদের আত্মীয়স্বজন কদাচিৎ আসে
    পথে দেখা হলে পরে হাই-হ্যালো কেমন আছেন বলে কেটে পড়ে—
    রইলো গ্রামের কথা । সেখানে একে আরেকের দুর্ভোগের আত্মীয়–
    চণ্ডীমণ্ডপ নেই, কেউ যে মঙ্গলকাব্য লিখবে সেরকম দেবতাও নেই ;
    ছোকরা কয়েকজন মিলেমিশে পদ্য লেখে, চাকরি করে, চাষ করে
    রাজনীতি ঘিরে ঝগড়াঝাঁটি করে, কিন্তু তাকে কি সমাজ বলব ?
    আসলে সমাজের আঠা আর নেই, একজন যে আরেকের সুখদুঃখে
    ভাগিদার হবে, তেমন আবহ আর নেই, তাই সত্যই সমাজ
    রয়েছে কিনা সেই প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না
    বস্তুত সমাজের সংজ্ঞাই পালটে গিয়েছে, তা যেন বাষ্প বা ধোঁয়া
    উড়ে যায়, ধরতে পারা ভীষণ মুশকিল…প্রথম প্রেমিকার মতো
    আমার বাবা আর কার্ল মার্কস
    পেপারব্যাকের মলাটের ছবিটা দেখে বাবা জিগ্যেস করলেন
    “এর বুড়োটা আবার কে রে ? তোদের কোর্সের বই ?”
    বললুম, “না, উনি একটা ফরমুলা তৈরি করেছেন ;
    অনেক নামকরা লোক, তুমি চেনো না ?”
    বাবা বললে, ” তুই তো জানিস আমি ইসকুলে যাইনি
    লেখাপড়া ওই বাড়িতে যেটুকু হয় ।
    তা এই বুড়োটা কি ফরমুলা বানিয়েছে ? অ্যালজেব্রার ?
    অ্যালজেব্রার ফরমুলা ছেলেরা মনে রাখে শুনিচি
    কিন্তু শেষে গিয়ে অঙ্ক ভুল করে বসে আর নম্বর পায় না ।”
    বাবাকে কীই বা বলি !
    সত্যিই, এনার অ্যালজেব্রার ফরমুলার লোভে পড়ে
    দেশে-দেশে নেতারা কতো অঙ্ক কষলো
    কিন্তু শেষে গিয়ে সকলেই ফেল মেরেছে ।
    কেন যা সবাই ফেল মারে তা ওই ইসকুলের মতনই । 
    সমাধানের আগেই পরীক্ষাশেষের ঘণ্টা বেজে যায় ।
    বাবা বললে, “তা বুড়োটাকে দেখতে মন্দ নয়
    অনেকটা তোর দাদুর মতন ।”
    রূপকথার একশো বছর
    কেউ কি ভেবেছিল কখনও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে বাংলাভাষী একজন
    নেমে আসবে রূপকথা থেকে ? অখ্যাত কবির রোমকূপে হর্ষের ঝড় তুলে
    আত্মাভিমানকে তার অনন্তকালের আলো দেবে ! হ্যাঁ, মুজিব বঙ্গবন্ধু
    অখ্যাত বাংলাভাষী  আমি ও আমার পিতা, আমার বংশধরেরা, চিরকাল
    বেঁচে থাকবে আপনার ধ্বনি-দেয়া মর্ত্যলোকের অভূতপূর্ব বিস্ময়ে ।
    কেবল আমার বাংশধরেরা নয়, আমার মতন আরো কোটি-কোটি
    ভাষাসন্তানেরা বেঁচে থাকবে আপনার অমরত্বে, পৃথিবীর যেখানে থাকুক
    তারা, তাদের প্রতিটি উচ্চারণে আপনার নায়কোচিত আত্মবলিদান
    সেইসব যুবকের হাতে যারা নিজেরই মায়ের ভাষা বর্জনীয় ভেবে
    রূপকথা-বর্ণিত রাক্ষসপুত্রের ভূমিকায় দানবের দেয়া স্বর্ণের বিনিময়ে
    ভাবলো আপনাকে ও আপনার বাড়ির লোকেদের গুলিবিদ্ধ করলেই
    মৌন হয়ে যাবে জয়ধ্বনি । হয়নি যে তা তো তারা এবং তাদের
    দোসরেরা জীবৎকালেই জেনে গেছে । বাংলাভাষা তো ঘাসের মতন
    কখনও শুকায় না ; জঙ্গলে আগুন লেগে অলিভ-পোশাক-পরা গাছ
    ছাই হয়, কিন্তু সে-আগুন নিভে গেলে ঘাসেরা আবার আসে ফিরে–
    যেমনই সে ঘাসেরা হোক, ছোটো-বড়ো-গরিব-বৈভবশালী, দ্রুত
    ছোটে তারা জয়ধ্বনি দিতে-দিতে পৃথিবীর ভিজে বা শুকনো মাটিতে–
    জানে ওই সবুজ ঘাসেরা আপনার পায়ের ধূলিকণা তাদের অমরত্ব
    দিয়ে গেছে । যতোদিন পৃথিবীতে রয়েছে বাংলাভাষী আপনি আছেন
    রক্তে সেই সব মানুষের পূর্বপুরুষ হয়ে, আদিবন্ধু বঙ্গভাষী হয়ে
    চীনা মেয়ে
    বাদুড়খাকি চীনা মেয়ের ঠোঁটেতে তুই চুমু খাবি ?
    ওই মেয়ে তো কুকুর বেড়াল ঢোঁড়া সাপের মাংসখাকি !
    প্যাঙ্গোলিনের আঁশের গুঁড়োয় চাগিয়ে তোলে অরগ্যাজম !
    জেনেশুনে তার ঠোঁটে তুই চুমু খাবি ?
    খাবো খাবো খাবো । বুকের হলুদ-লালচে বোঁটায় টুসকি দেবো ।
    ওর দাদু যে মাও-জে দঙের লম্বা লাফে শামিল ছিল ।
    মাওয়ের মতন ওর দাদুরও গোটাকতক রাখেল ছিল ।
    বাবা তো ওর সাম্যবাদী দলের নেতা, অঢেল পুঁজি ।
    খাবো খাবো খাবো । স্বাদু ঠোঁটে কামড় দিয়ে চিপকে যাবো ।
    অরগ্যাজমের জোয়ার-রসে যা-হবার-তা-হোকগে বলে চুসকি দেবো ।
    আনন্দ
    দেখতেই পাচ্ছেন, আমরা দুই অশীতিপর হাসিমুখে বসে আছি
    আমরাও সেটাই দেখছি ।আপনারা  দেখতে পাচ্ছেন না 
    আমাদের কাঁধ, হাঁটু,  কোমরের ব্যথা
    কাজের বউ আসছে না, যদিও মাইনে দিতে হয়েছে যাতে না ছেড়ে যায়
    যদিবা বাসন মাজি, এমনকী গান গেয়ে, মেরে পিয়া গয়ে রংগুন
    ওঁহাসে কিয়া হ্যায় টেলিফুন, তুমহারি ইয়াদ সতাতি হ্যায় 
    কিংবা কভি আর কভি পার লাগা তিরে নজর
    সঁইয়া ঘায়ল কিয়া হ্যায় তুনে মেরা জিগর, কিংবা
    জাদুগর সঁইয়া ছোড়ো মোরি বাঁইয়া আবি ঘরি জানে দো
     বুড়ি বলে, ভাগ্নে জামায়ের হাতে হাজা হয়ে গেছে 
    স্যানিটাইজার আর বাসন মাজায় যাও টিভি দ্যাখো
    আমি বলি শশীর সুন্দরী বউ অতো বড়ো ফ্ল্যাটের কাজ তো
    একাই সামলায়, ওদের দশহাজারি কামওয়ালি চলে গেছে
    অগত্যা ফুলঝাড়ু দেবার কাজটা নিয়েছি আর কী আশ্চর্য
    এতো পাকাচুল মেঝেতে পড়ে থাকে তা তো বলত না ঝি
    ন্যাতাটা গোড়ালি দিয়ে মেঝের ওপর ঘষি, মাটিতে বসতে পারি না যে
    বুড়ি রিলাকসিল বা ব্যথার তেল মাখিয়ে দ্যায়, আমি ততোক্ষণ
    গান গাই এ গুলবদন এ গুলবদন, ফুলোঁ কি মহক, কাঁটো কি চুভন
    তুঝে দেখ কে কহতা হ্যায় মেরা মন, কহিঁ আজ কিসিসে পেয়ার
    না হো জায়ে । দেখতে  পাচ্ছেন তো আমরা দুই অশীতিপর কীরকম 
    মজাসসে আছি
    ম্লেচ্ছকুমারীকে 
    এ নাও অস্তিত্ব দিচ্ছি দাবি অনুযায়ী
    হিব্রু শাস্ত্র মতে চামড়া ছাড়িয়ে টাইগ্রিসের জলে ধুয়ে নেয়া
    উলটো টাঙানো আমি ঝুলছি স্টেনলেস হুকে
    করোটি ফাটিয়ে মন নিয়ে নাও
    হৃদযন্ত্র থেকে ভালভ উপড়ে হৃদয়ও নাও
    জিভ ছিঁড়ে নিয়ে নাও প্রেমের কথাগুলো যা বলেছি এতোকাল
    লিঙ্গ কেটে নিয়ে নাও প্রেমের কোটি-কোটি কীট
    এ আমার শব নয় ; এ হলো পার্থিব প্রস্তাব
    দুর্গন্ধের স্মৃতি
    ঠিকই বলেছিলি মুখপুড়ি, থাকুন না সঙ্গে সবসময়, কোঁকড়া দুর্গন্ধ হয়ে
    দেহের নৌকো জুড়ে, আগাপাশতলা, নোনাবাঁকে মাছেদের অপলকা ঝাঁকে
    কোথাও অ্যাড্রেনালিনে নীল তাঁতে-বোনা গোড়ালি গন্ধকে মাখা ভিজে নাচ
    চামড়ায় মরে-যাওয়া জং-ধরা হাঙরের মিষ্টি হাঁ-মুখ ভরা খিলখিল আলো
    খুঁজুন না যা চাইছেন, ভিনিগারি ঘামের রোদ্দুর, গ্রন্হিল জ্বরের নিঃশ্বাস
    ছানাকাটা দুধেল উত্তাল, তাও হরমোনের তরল বারুদে তিতকুটে
    বলেছিলি তুই, প্রেম ? ছ্যাঃ, সুগন্ধ তো বানানো নকল, তার সাথে, ডারলিং
    মাংসে মেদের মজ্জার আত্মীয়তা নেই । পেতে হলে শুধুই দুর্গন্ধ নিতে হবে
    যা তোর একান্ত আপন, অবন্তিকা । চারিপাশে বাতাসের নিভাঁজ জারকে
    তোর ওই ঘোষণা উড়ছে : সি ইউ…সি ইউ…সি ইউ…সি ইউ…
    .
    ফেলে গিয়েছিস তোর লনজারি টপ জিনস বক্ষবন্ধনী হাই হিল। কই তোর
    দুর্গন্ধ কোথাও তো নেই মুখপুড়ি ; ফেলে-যাওয়া কিছুতেই নেই। সবই
    ভিনিভিনি কুশবু মাখানো । যতক্ষণ ছিলি, তোর গা থেকেও ওই একই
    পারফিউম উড়েছে, বানানো, নকল ; তোরই মতন মুখপুড়ি, কথার
    ফেনানো জালে টোপ বেঁধে যা তুই ফেলেই চলেছিস প্রতিরাত প্রতিদিন ।
    তাহলে ফালতু তোর সি ইউ…সি ইউ…ডাক, হাতছানি, উদোম ইশারা
    জীবনানন্দের 'আটবছর আগের একদিন' কবিতার প্যাশটিস
    শোনা গেলো লাশকাটা ঘরে
    নিয়ে গেছে তারে, আর তার বউ ও শিশুকে
    কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
    যখন ভাঁড়ারে আর একদানা চাল নেই
    বধূ-শিশু খুন করে মরতে বাধ্য হলো ।
    .
    বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল
    প্রেম ছিল, ছিলনাকো কিছুই খাবার - জ্যোৎস্নায় - তবু সে দেখিল
    ক্ষুধার প্রেতিনী ? ঘুম তো আসে না রাতভর
    কেননা ক্ষুধার্ত পেটে হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার ।
    .
    এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি !
    বিষ-গ্যাঁজলা মাখা ঠোঁটে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
    আঁধার ঘুঁজির বুকে তিনজন খালি পেটে ঘুমায় এবার
    কোনোদিন এই পরিবার জাগিবে না আর
    খালি পেটে গাঢ় বেদনার
    অবিরাম অবিরাম ক্ষুধা
    তিনজনে সহিবে না আর --
    এই কথা বলেছিল তারে
    চাঁদ ডুবে চলে গেলে - বুভুক্ষু আঁধারে
    যেন তার মেটেল দুয়ারে
    মোটরসাইকেলবাহী ধর্ষকেরা এসে
    .
    তবুও তো নেতা জাগে
    লুম্পেনেরা এসে ভোট মাগে
    আরেকটি নির্বাচনের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ হুমকি দিয়ে
    .
    টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
    চারিদিকে র‌্যাশনের ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা ;
    নেতা তার আরামের সঙ্ঘারামে নেশা করে বুকনি ঝাড়তে ভালোবাসে ।
    .
    শ্রম ঘাম রক্ত চুষে আড্ডায় ফিরে যায় নেতা
    অবরোধ-করা মোড়ে অ্যামবুলেন্সে কান্না দেখিয়াছি ।
    .
    কাঠফাটা খরা নয় - যেন কোনো চালের ভাঁড়ার
    অধিকার করে আছে ইহাদের ভাব
    দলীয় গুণ্ডাদের হাতে
    বধূটি প্রাণপণ লড়িয়াছে
    চাঁদ ডুবে গেলে পর নিরন্ন আঁধারে তুমি বউটিকে নিয়ে
    ফলিডল খেয়েছিলে, শিশুটির গলা টিপে মেরে
    যে-জীবন ফড়িঙের দোয়েলের
    তা তোমার শৈশব থেকে ছিল জানা ।
    .
    পেটের ক্ষুধার ডাক
    করেনি কি প্রতিবাদ ? ডেঙ্গুর মশা এসে রুক্ষ চামড়ায় বসে
    রক্ত না পেয়ে দেয়নি কি গালাগাল ?
    জোয়ান লক্ষ্মীপেঁচা চালাঘরে বসে
    বলেনি কি : 'সংসার গেছে বুঝি দারিদ্রে ভেসে ?
    চমৎকার !
    হাড়গিলেদের ঘরে ইঁদুরও আসে না ?'
    জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল ক্ষুব্ধ সমাচার ?
    .
    জীবনের এই স্বাদ - সুপক্ক ধানের ঘ্রাণ
    কতোকাল পাওনিকো তুমি
    মর্গে আজ হৃদয় জুড়োলো
    মর্গে - শীতাতপে, তিনজন
    ফলিডলে গ্যাঁজলা-ওঠা ঠোঁটে !
    .
    শোনো এ তিন মৃতের গল্প - ফিবছর ধান
    কেটে নিয়ে চলে গেছে গাজোয়ারি করে
    বি পি এল কার্ডের সাধ
    মেটেনি বউকে পাঠিয়েও
    দরবারি নাশকতা নিচে টেনে বধূ
    মধু - আর মননের মধু
    যাপনকে করতে পারেনি ক্ষুধাহীন
    হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
    সইতে হয়েছে প্রতিদিন ;
    তাই
    লাশকাটা ঘরে
    তিনজন শুয়ে আছে টেবিলের পরে ।
    .
    তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
    জোয়ান লক্ষ্মীপেঁচা চালাঘরে বসে
    চোখ পালটায়ে কয়, 'সংসার গেছে বুঝি দারিদ্রে ভেসে ?
    চমৎকার !
    হাঘরের মেটে ঘরে ইঁদুরও আসে না।'
    .
    হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার ?
    স্বাধীনতার সত্তর বছর পর !
    সকলে তোমার মতো সুযোগ সন্ধানী আজ - বুড়ি চাঁদটাকে ওরা
    আদিগঙ্গার পাঁকে করে দিলে পার ;
    যারা আসে তারাই শূন্য করে চলে যায় টাকার ভাঁড়ার ।
     
    পাটনার রাস্তায় আমার মা
    ‘আরে, রিকশঅলাটা যে বাংলায় কথা বলছে’
    মা অবাক হয়ে বলে উঠলেন,
    রিকশঅলাকে জিগ্যেস করলেন
    ‘তুম বাংলা কহাঁসে সিখে ?’
    রোগা প্যাংলা লোকটা বলল
    ‘মা, আমি বাঙালি, মোতিহারি ক্যাম্প থিকা পলায়া আসতেসি’।
    মাকে বললুম, ‘দেশভাগে যে উদ্বাস্তুরা এসেছে তাদের মধ্যে
    নম্ঃশুদ্রদের মোতিহারি ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।’
    মায়ের কান্না পেয়ে গেল । বললেন,
    ‘কখনও ভাবিনি বাঙালিরা রিকশা চালাবে !’
     
    আমি একটি পশু
    আমাকে বুঝছেন না আপনি
    তা কেন আমার দোষ হবে
    হয়তো তা আপনার গুণ !
    .
    মানুষের মতন বাঁচতে হলে
    কতোটা দুঃখের প্রকোপ
    সহ্য করে যেতে হবে জানো ?
    .
    হয়তো জানেন না আপনি
    সুস্বপ্নের চেয়ে দুঃস্বপ্নকে
    গোপনে ভালোবেসেছেন !
    .
    এও তো জানেন আপনার
    জীবনের কোনও গল্প নেই
    সব গল্পে আরেকজন আছে !
    .
    চিতায় মাকে তুলে দিয়ে
    তাঁর যে নিপল পুড়ে গেল
    সে কথা কি মনে এসেছিল ?
    .
    চিতায় শবের পোড়বার
    শব্দ থেকে স্বরলিপিহীন
    গানগুলো ধোঁয়া হয়ে যায় !
    .
    যে যুবক যুবতীর মুখে
    মেরেছে অ্যাসিড ছুঁড়ে,জানে
    সে-ই শেষবার তার মুখশ্রী দেখেছে !
    .
    ম্যাক্স ব্রডকে কাফকা বলে ছিলেন
    ছাপিও না সব লেখা নষ্ট করে ফেলো
    ওনার কবর কেন প্রাগেতে রয়েছে ?
    .
    প্রেমের প্রতিশব্দ আরব ভাষায় নেই
    তাই ওনাদের চারজন বউ আর
    বাঁদি নিয়ে সমস্যা হয়না কখনও !
    .
    মৃত্যুকে চেনেন ? লোকটা আসলে
    ভাগ্য নিয়ে ব্যবসা করে খায়
    এ-বানিজ্যে মনোপলি কেবল ওনার !
    .
    আমার প্রেমিকা বলেছিল
    স্ট্যালিন হিটলারের মতো
    একনায়কের সঙ্গে শুয়ে সুখ !
    .
    অত্যন্ত সুন্দরী হলে তার সাথে
    সঙ্গমে ভরবে না মন কোনোদিন
    বহু অঙ্গ অবহেলা পাবে !
    .
    রাজনীতিকেরা আর ধর্মগুরুরা
    অর্শের মতন বসতে দেবে না শান্তিতে
    তবু বলবে অনুগত হয়ে বসে থাকো !
     
    আমরা সবাই গাধা
    আমরা সবাই খোজা, আমাদের এই রানির রাজত্বে
    নইলে মোদের রানির সনে মিলবে কী শর্তে?
    আমরা  হুকুম  তামিল  করি,  তাঁর আঙুল   নাড়ায় চরি,
    আমরা  মজায়  আছি  দাসের রানির ত্রাসের রাজত্বে
    নইলে  মোদের  রানির সনে মিলব কী শর্তে?
    রানি সবারে দেন মার,  সে মার আদর করে দেন,
    মোদের খাটো করে রাখলেই বা হাজার অসত্যে
    নইলে মোরা রানির সনে মিলবে মিলব কী শর্তে?
    আমরা চলব তাঁরি মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে,
    মোরা  মরলেই বা বিফলতার বিষম আবর্তে
    নইলে মোরা রানির সনে মিলবে কী শর্তে?
     
    বাঘিনীর ভালোবাসা
    বাঁশে চিৎ থাবাবাঁধা মরা বাঘিনীর
    ঘুষঘুষে বুকে শুয়ে পড়ি পূর্ণিমার রাতে
    উপুড় উলঙ্গ ঘ্যামা ওল্ড মংক স্খলিত সত্তা মুড়ে
    বাঘিনীর মাইয়ের বোঁটা মুখে কান্না পেয়ে গেল
    চুষি আর বেহেড ফোঁপাতে থাকি
    ক্রমে লিঙ্গ জেগে ওঠে, কান্না বন্ধ হয় ।
    বাঘিনীর যোনিতে মুখ রেখে বলি, ‘ভালোবাসি তোকে
    অবন্তিকা, ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি ।’
    রাষ্ট্রবিরোধিতা
    জ্ঞান ফিরিবার পর দেখিলাম, চতুস্পার্শে ছয়ইঞ্চি ক্ষুদ্র যুবতীরা--
    দেড়শো বৎসর পর ফিরিয়া আসিল জ্ঞান, ততোদিনে
    অতিউন্নত বাকচর্চা প্রয়োগ করতঃ ছয় ইঞ্চির হইয়া গিয়াছে মানুষেরা
    সুতা দিয়া আমাকে চতুর্দিক হইতে বাঁধিয়া ফেলিয়াছে
    শুইয়া আছি ঘাসের উপরে, কথাবার্তা শুনিয়া বুঝিয়াছি ইহা বঙ্গদেশ
    উলঙ্গ উহারা, কেহ বুকের উপরে কেহ পেটে কেহ উরুতে হাঁটিতেছে
    উহাদের কথোপকথন হইতে বুঝিলাম এখন এ-রাজ্যের নাম লিলিপুট
    কখনও বাকবিপ্লব ঘটিয়াছিল, তাই, মানুষেরা ক্ষুদ্র ও উদার হইয়া গিয়াছে
    বেঘোরে যা কহিয়াছিলাম তাহা উহাদের মতে অশ্লীল ও রাষ্ট্রবিরোধী
    জানিতে চাহিলাম তাহাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোন কর্ম করিয়াছি আমি
    আমার কুঁচকির ভাঁজে জনৈকা যুবতী হয়তো খুঁজিতেছিল স্বর্ণভাণ্ডার
    জঙ্গলের বাহিরে আসিয়া যুবতীটি চিৎকার করিয়া সবারে কহিলা
    "এই দৈত্যের চাড্ডির ভিতরে ছাগু দেখা যায়, ইহা রাষ্ট্রবিরোধী"
    মনসান্টো কোম্পানির বীজ
    লাঙলের ফলা লেগে মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি
    বেরিয়ে এলেন বলা ঠিক নয়, তিনি তো চিৎ হয়ে চোখ বুজে
    শাড়ি-শায়া-ব্লাউজ ছাড়াই শুয়ে । হারাধন চাষি তো অবাক 
    সেই কবে সীতা লাঙলের ফলা লেগে জন্মেছিলেন, তারপর
    অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে দুই-ফাঁক জমির ভেতরে গেলেন রামকে টাটা করে
    এখন আলুর ক্ষেতে দেখা দিচ্ছেন কেন, গোলমাল ঘটে গেছে নাকি
    অযোধ্যায়, দণ্ডকারণ্যে, বাল্মীকির ছিটেবেড়া-দেয়া আশ্রমে !
    এটা তো পশ্চিমবাংলার গণ্ডগ্রাম, শহরে যাবার রাস্তা তৈরি হয়নি
    বর্ষায় কিংবা গ্রীষ্মে আত্মীয়স্বজনেরা এমুখো হয় না, ভোটবাবু আসে
    বাকসো-প্যাঁটরা নিয়ে পুলিশের সাথে, শীতের সময়ে । 
    চাষা ঝুঁকে মুখ দেখে বুঝতে পারলো এই সীতা তো গ্রামেরই
    ফেলু সাঁতরার মেয়ে, তিন সপ্তাহ থেকে পাওয়া যাচ্ছিলনাকো--
    হারাধন ঝুঁকে চুমু খেলো ঠোঁটে ফেলু সাঁতরার মেয়ে নতুন সীতাকে
    মাটি দিয়ে ঢেকে আর, বুনে দিলো মনসান্টো কোম্পানির বীজ…
    সাংসারিক প্রেম : লকডাউনে দেবী-দেবতারা
    ওনারা দেয়ালে, রান্নাঘরের তাকে, ওপরে চৌকাঠে
    যেমনটি আমার স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউ নিজেদের
    পছন্দের চাকরি পাবার, পাশ করবার, বিদেশে যাবার
    আরাধ্য ও আরাধ্যাকে রেখেছিল কয়েক দশক আগে
    তেমনই আছেন কিন্তু লকডাউনের জেরে ধুলোয় এমন
    ঢাকা যে বোঝার উপায় নেই তিনি কোন দেবী বা দেবতা--
    বুড়ি স্ত্রী তো খাটতে পারছে না রান্নাবান্নার পর । আমি
    ফুলঝাড়ু দিয়ে ওনাদের ধুলোর মাস্ক খোলর প্রয়াস
    করেছি একদিন, তবে পাইনি অনুমতি নাস্তিক বলে ;
    ছেলে ও ছেলের বউ জেনে গেলে কেলেঙ্কারি হবে । যদিও
    খুদে মাকড়সাগুলো ওদের থুতু দিয়ে তৈরি করে দিয়েছে
    অক্সিজেনের নল যাতে করোনায় ফুসফুস নষ্ট না হয়।
    তবুও তেলচিটে পড়ে বোঝার উপায় নেই কোনজন
    বুড়ির, কেই বা ছেলের আর ছেলের বউয়ের শুকনো
    মালা পরে লকডাউন কাটাচ্ছেন একা-একা । কাজের
    মেয়েটি কবে ফিরবেন আর মুক্ত করবেন ওনাদের
    তা হায় মাস্ক-পরা দেবী-দেবতারা বলতে অপারগ ।
    কামাবশায়িতা
    তুমি তো ভার্জিন ! তাহলে কেমন করে যোনি আঁকো ?
    দেখেছ কি কখনও কারো যোনি কিংবা অনেকের যোনি
    যেমন ভেরলেন দেখতো প্রতিদিন বিভিন্ন নারীর, প্যারিসের
    লাতিন কোয়ার্টারে ? ভারতীয় শিল্পীরা এক খেপ ফ্রান্সে যাবেই
    যোনি দেখবার লোভে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীদের যোনি
    কৃষ্ণাঙ্গীর দ্যুতিময় যোনি, শ্বেতাঙ্গিনীর আলোকসম্পাতি যোনি
    খুঁজবে মমার্ত বা শঁজেলিজের গভীর রাতের গ্যাঞ্জামে, আর
    লুভরেতে যোনির রকমফের দেখে ফিরবে স্বদেশে, সেই সব
    যোনি এঁকে ঝুনঝুনওয়ালাদের বিক্রি করবে বলে, যারা যোনি
    দেখবার সুযোগই পায় না এতো ব্যস্ত তিজোরির বাণ্ডিল নিয়ে--
    প্রেম তুমি করেছিলে বটে কিন্তু যোনিটি পাবার প্রলোভনে
    সেই যে প্রত্যাখাত হলে রোজ রাতে আঁকছো বসে জগতের
    সমস্তরকম , চেষ্টা করে যাচ্ছো নারীবাদী যোনি আঁকবার !
     
    মায়া
    স্তনে এতো মায়া তুমি কোথা থেকে আনো হে কৌশিক সরকার ?
    কুচ জাগার আগে-পরে বা যখন তা মিষ্টির ফোয়ারা দুধের
    আফ্রিকার কুচকুচে কালো বা জার্মানির ঢাউস গোলাপি
    চিনা-ভিয়েতনামি-বার্মিজ-ক্যামবোডিয়া-থাইল্যাণ্ড পীতাভ
    মার্কিনি রোদে পোড়া রক্তিমভ বা তামাটে ব্রাজিলি কিংবা
    ভারতের নানান মাপের আর নানান ত্বকের স্তনে মায়া ভরো
    রুবেন রসেটি বত্তিচেলি ইনগ্রেস রাফায়েল রবি ভর্মার আঁকা
    মোলায়েম স্তনে যেরকম বেহেশতের জ্যোতিচ্ছটার প্রতিভাস
    নারীর স্তনের চেয়ে মায়াময় আশ্রয় আর কোথাও নেই, তা সে
    তুষারাচ্ছন্ন বা মরুবালুকার দেশ হোক, এতো মায়া এতো ?
    স্তনে এতো মায়া তোমরা কোথা থেকে আনো হে কৌশিক সরকার !
     
    আমার ভেতরে নিমাই সন্যাসী চোর-পুলিশ খেলছিল
    ভারি সোনার মোড়কে আমার লাশ, সে-ই আমার সখা
    আমার মুখের সোনালী মুখোশ খোলা হয়, লিনেনে প্যাঁচানো
    নুন-মাখানো পা থেকে তিন হাজার বছরের আটক নাচগুলো
    শতশত নদী হয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো জগতসংসারে
    নদীগুলোকে উড়তে শিখিয়েছিলুম বাষ্প হয়ে ভাসতে
    ওরা তো নাকে ছেঁদা করে ঘিলু বের করে নিয়েছিল মরে যাবার পর
    ফুসফুস নাড়িভুঁড়ি পাকস্হলী বৃক্ক কিচ্ছু নেই আমি একেবারে ফাঁপা
    না, ঠিক ফাঁপা নয়, করোটি থেকে পায়ের ডগা পর্যন্ত বাতাসে ভরপুর
    মৃত্যুর আরামে শুয়ে আছি আর সময়ের নদী তৈরি করছি
    অথচ আমি আমার মধ্যে নেই নিয়ে গেছে নদীদের ডাকাতদল
    আমি খুঁজে মরছি তাদের হেই থামো হেই থামো থামো থামো
     
    বাতিহীন বংশ
    পচা গন্ধ বেরোচ্ছিল ঘর থেকে, পড়শিদের নালিশ শুনে
    পুলিশ দরোজা ভেঙে দেখলো মরে পড়ে আছে বুড়ি
    সারা গায়ে ম্যাগটের কিলবিল কিলবিল কিলবিল
    একমাত্র বেঁচে আছেন পেতলের গোপাল ঠাকুর
    দিব্বি হাসিমুখে যদিও তাঁর গায়ে সবুজ কলঙ্ক
    বুড়ির কেউই ছিল না গোপাল ঠাকুর ছাড়া
    তাঁকে নিয়ে থাকতেন সকাল দুপুর রাত
    এখন বাতিহীন বংশের গোপাল ঠাকুর পুলিশের
    গাড়িতে চেপে চললেন থানার মহাফেজখানায়
    বছর বছর ময়লা মেখে থাকবেন উত্তরণ পেতে
    আরো বহু বাতিহীন বংশের সোনা রুপো পেতলের
    পাথরের চেনা ও অচেনা দেবী-দেবতার সাথে
     
     
    কমিউনিজমে দীক্ষা
    মাথার ওপরে মশার গুলতানি নিয়ে স্কুলের মাঠে আমরা আট সহপাঠী
    তরুণ শুরের দাদুর দাদুরা কোমপানি বাহাদুরের শুঁড়ি ছিল
    সেই মোহরের জোরে ওর বাবা-কাকারা চাকরি করেনি কখনও
    মলমের চোঙ টিপে দুধ বের করে বুরুশ দিয়ে দাঁত মাজে
    তরুণদের কুকুরের নাম কুকুর, ওই নামে ল্যাজ দোলায়
    ওর বোতামবুকো বোনকে বলেছি ফ্রক ছেড়ে এবার শাড়ি ধর
    তরুণদের বাড়িতে চকচকে সোভিয়েত দেশ পত্রিকা আসে
    তরুণকে জিগ্যেস করতে বলেছিল কমিউনিস্ট হয়ে যা ফ্রি পাবি
    পড়ার টেবিলের সামনে দেয়ালে রুশ মেয়েদের উরু কেটে সেঁটেছে
    অ্যালজেব্রা ট্রিগনোমেট্রি ফটাফট হয়ে যায়, চকাচক, জাস্ট টুসকি
    আমাদের মধ্যে ও-ই বাড়ি থেকে হাত খরচ পায়, খাওয়ায়
    একটা বাক্সঠেলা গাড়ি যাচ্ছিল, তরুণ সেইদিকে দৌড়িয়ে বলল
    দাঁড়া আনছি, কাঠিতে জড়ানো মালাই, কুলফি কিংবা র‌্যাঁদামারা
    রঙিন বরফকুচি নয়, দিল তররররররর হয়ে যাবে চাটতে চাটতে
    কিনে এনে ঘাসে বসে মোড়ক খুলে পুরোটা মুখে ঢুকিয়ে চাটলো
    এক -এক করে আমরা সবাই অমনভাবে তরররর-হৃদয়ে চাটলুম
    ঘুরে তরুণের কাছে পৌঁছোতে ও জিভ পাকিয়ে ডাঁটি চুষলো, বলল
    দেখলি তো, ভদ্দরলোকের পোলা থেকে কমিউনিস্ট করলুম তোদের
     
     
    পারিজাত
    নরম তোষকে পা ছড়িয়ে বসেছিলে তুমি, বালিশে হেলান দিয়ে
    দামি আলোয়ানে ঢেকে রেখেছিলে পা পর্যন্ত
    বললে, “আপনার কুখ্যাতি সৌম্যকান্তি করে তুলেছে আপনাকে”
    এরকম কথা শুনে বিব্রত বোধ করেছিলুম, মনে আছে
    তোমার সামনের ইরানি জাজিমে বসেছিলুম আমরা কয়জন
    তোমার আত্মীয়কে ডেকে আমাদের দিয়েছিলে নেপালি পানীয়
    গম থেকে তৈরি মদ, কাঁসার বাটি করে, সঙ্গে মোষের মাংস
    বলেছিলুম, “তুমি ক্লিওপেট্রার মতো বসে আছো, তেমনই গর্বিনী”
    বলেছিলুম, “তোমাকে দেখে সোয়ান লেকের ব্যালেরিনার কথা মনে পড়ে গেল”
    চাদর সরিয়ে তুমি শৈশবে পোলিও আক্রান্ত পা-দুটি দেখিয়েছিলে তুমি
    কতো সুন্দর লেগেছিল তোমার ওই দুইখানা পা, পারিজাত,
    তোমার সাহসকে প্রণাম জানিয়েছিলুম
    প্রতিষ্ঠানবিরোধী নেপালি কবিতার সম্রাজ্ঞী তুমি
     
    বৃদ্ধাবাস
    আমরা দুজনে হাঙরের পেটে রাত কাটাই
    জোঁকশীতে কুঁজো অলস আপ্যায়নে
    আমরা দুজনে কুপির তলার ছায়াকে খাই
    ফুলুটবাজানো রবিঠাকুরের গানে
    আমরা দুজনে খাবারের প্লেটে চাঁদ জোগাই
    বউ-বিরক্ত বুড়িরা সেকথা জানে
    আমরা দুজনে ভাঙা ধনুকের ছিলা চেবাই
    গেছো-লেখকেরা আজও সেকথা মানে
    আমরা দুজনে ভোটের বোতামে গ্যাস ঢোকাই
    গণধড়িবাজ পড়ে থাকে নির্জ্ঞানে
    আমরা দুজনে স্মৃতির মাথায় ঝড় চাপাই
    আত্মজনেরা তাই পিঠে ছোরা হানে
    আমরা দুজনে জোকারি করে হাসাই
    পরস্পরের গোপন রোমন্হনে
     
     
    রাজনীতিক
    ধেড়ে ইঁদুররা জাহাজ ছেড়ে পালাচ্ছে
    ফ্রিস্টাইল, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্ট স্ট্রোক, বাটারফ্লাই
    যে যেমন পারে
    .
    যাউক যাউক ! ইঁদুরনাদি তো ফেলে যাচ্ছে !

    নেংটি ইঁদুররা জাহাজ ছেড়ে পালাচ্ছে
    ফ্রিস্টাইল, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্ট স্ট্রোক এবং বাটারফ্লাই
    যে যেমন পারে
    .
    যাউক যাউক ! ইঁদুরনাদি তো ফেলে যাচ্ছে 
     
    বিড়ালের রঙ
    ঠিকই চিনেছি ; এই চিনা যুবতীই বাদুড়ের মাংস খেয়ে
    পৃথিবীকে অতিমারীর কবরে ঢেকলেছে । দৌড়ে
    জাপটে ধরি ওকে । কামড়ে ধরি ঠোঁট । কে জানে
    বাদুড়ের গন্ধ কেমন কেননা মেয়েটার মুখ থেকে
    যে গন্ধ পাচ্ছিলুম তা তো সোঁদা মিষ্টি সঙ্গমের ডাক--
    আমার গলার মধ্যে জিভটা গলিয়ে দেয় আর সেটা
    শঙ্খচূড় হয়ে নেমে যেতে থাকে তলপেট ছাড়িয়ে তলায়--
    জাপটে নিয়ে আমি ওর যোনিকে শক্ত করে ধরি, আর
    তখনই যোনির ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে ওড়ে
    চব্বিশ নদী আঠারো পাহাড় জুড়ে ঝাঁক ঝাঁক
    লাল রঙের নিশাচর ডানার বাদুড়, লাল টকটকে
    একটা বাদুড়কে ধরে দেখি, আরে, বাদুড় তো নয়,
    এটা তো মাও জে দঙের রেড বুক ! এখন বাদুড় !
    যুবতীর ফিসফিসে কথা শুনে ইশারাটা টের পাই :
    ‘তোমার বিড়াল কালো বা সাদা যাই হোক ,
    আসল কথা হলো ইঁদুর মারতে পারে কিনা৷'
     
    কবির অমরত্ব
    মফসসলের মর্গে পড়ে আছে বেচারা-যুবক চেয়েছিল কবি হতে
    কবেই তো রিগর মরটিস আরম্ভ হয়ে এখন ধরেছে পোকায়
    শীতঘর নেই ; কবি করে তোলবার প্রতিষ্ঠান-ফড়েটা এসেছে
    লাশগুলো নিয়ে গিয়ে খাড়া করে পুঁতবে গরম বালির চরে
    পচা মাংস ঝরে গিয়ে ঝকঝকে কংকাল সাবধানে আসবে বেরিয়ে
    বিকোবে অনেক দামে ; নিখুঁত কংকালের ভালো দাম পাওয়া যায়
    কোনো হাসপাতাল-করিডরে দাঁড়িয়ে থাকবে কবি অমরত্ব পেয়ে
    গ্রিস রোম পারস্য থেকে হারিয়ে গিয়েছে যেসব অমর কবিরা
    তাদেরই সারবাঁধা দলে ঘুলঘুলি চোখে দাঁড়াবে হাসিহাসি মুখে
    কল্লা
    গান গাইবেন না 
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    সোনার মাছি খুন করেছি
    বাজনা বাজাবেন না 
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    তবুও তো পেঁচা জাগে
    মূর্তি গড়বেন না
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    আপনা মাংসে হরিণা বৈরী
    কবিতা লিখবেন না
    কল্লা নামিয়ে নেবে
    আমার এক অংশে এক অবধূত আছে 
    ছবি আঁকবেন না
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে
    পুরুষ ছাড়া বাইরে বেরোবেন না
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী
    দাড়ি কামাবেন না
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও
    মদ খাবেন না
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    দুগগার মা ক’টায় আসে
    সাজগোজ করবেন না 
    কল্লা নামিয়ে দেবে
    স্বাধীনতা তুমি
     
    আমি তো কেউ নই
    আমি তো কেউ নই, তুমি তো বিখ্যাত
    কেউ না হওয়াও কি খ্যাতির প্রতিচ্ছায়া নয় ?
    তুমি তো জ্যোতির্ময়ী, তুমি তো অবিনশ্বরী
    আমি তো কেউ নই, তুমি তো পরমাপ্রকৃতি
    আমি প্রকৃতির অংশ, যৎসামান্য, বলা যায়
    উষ্ণতম মলয়বাতাস, আমি কার্তিকেয় যোদ্ধা
    অথচ কেউ নই । কেউ না হওয়ায় যে আনন্দ
    তা তুমি বুঝবে না আমি তো আমিও নই
    কেউ নই কিছু নই অস্তিত্ববিহীন তুমি ছাড়া
    তোমার হাত ধরে অন্ধ আমি ইতিহাসে
    তোমার সঙ্গে থেকে যেতে চাই
     
     
     
    খুরে-খুরে গড়’-এর পোস্টমডার্ন পদাবলী
    হিংমাখা হাতে থ্যাংকিউ লেখা সবুজ গান, নাটুকে ইশারা ট্যারাচোখ ভাসে রূপটানে, রেললাইনের তলপেটে বাঁধা ঘুমের ঝিম, হ্যালোজেন-মাখা টকে-যাওয়া হাসি বীররসে,পাইবেক পাইবেক, কাকের কাঁদুনি বোমার বারুদে অলস ডিম, কুমিরের নাকে সন্দেশ খাওয়া স্বপ্নঘোর, সুদিন আনবে দাড়ি কামাবার পুং-রোবোট, সেফটিবেল্টে ধাতবকুমারী বলেছিলেন, হইবেক হইবেক, ক্রেজি মাস্তুলে করোটির গোঁফে পাকানো তা, মঞ্চফকির সাপকে গেলায় স্বরহরফ, কষামাংসের দলজ ভোটার বুড়োশকুন, ভেঙে বরফের মোদো-উল্লাসে পথপবন, উড়িবেক উড়িবেক, অমোঘবাণীর ম্যাজিক পায়রা শিকড় খায়, ফড়িং-নাচের ভিকিরি যদি বা চিরন্তন, ধুতি খুলে ঘুঘু আকাশে দিয়েছে ট্রায়াল রান, কী ভাবে ইমেজ ঝুরো-ঝুরো রঙে মিথ ভেঙে, পুড়িবেক পুড়িবেক, ম্যাসাজতরুণী আঙুলনাচের সুখছোঁয়ায়, তেলমাখা পিঠে কাতুকুতু দিলে ব্যাংককে, দেশে ফিরে শিরা সুধাসংকেতে মদমুকুল,তরল কুসুম অজানায় মেতে ঝরতে চায়, ঝরিবেক ঝরিবেক, ছাগমাথা কাঁধে দক্ষবাবারা মসনদে, ফাটা সঙ্গীতে বোবা মগজের ভবিষ্যত, গড়ছেন মেঘে চতুরচিত্ত লাশভবন,কালের ইতর আবিরে নোংরা শালি-শ্যালক, হাসিবেক হাসিবেক, আর্সেনিকের বিষে নির্মল জল খেয়ে, চুঁইয়ে ভিজবে আগুন ফোঁটার উচ্চারণ, সাজানো শব্দ যুদ্ধের মাঠে শরে শুয়ে, অবৈতনিক কাগুজে পোকার গুড়ছোলা, খাইবেক খাইবেক

     
     
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫০738590
  • ইঙ্গমার বার্গম্যান-জাঁ লুক গোদার বিতর্ক
    মলয় রায়চৌধুরী
    জাঁ লুক গোদার-এর ‘ব্রেথলেস’ নামের ফিল্মটি ১৯৬০ সালে ইউরোপের ফিল্ম-সমালোচকরা দেখার পর যে ধরনের প্রশংসা পেয়েছিল, আমার মনে হয়, ১৯৬০ সালে কলকাতায় অমন একটা ফিল্ম, বোদ্ধাদের দেখানো হলেও প্রশংসা জুটতো কিনা সন্দেহ । সেসময়ে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে রমরমিয়ে চলতো উত্তম-সুচিত্রার ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, পথে হলো দেরী’, ‘হারানো সুর’ ইত্যাদি । সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ওই সময়ের ফিল্ম হলেও তাতে গোদারীয় বুদ্ধিবৃত্তি ছিল না, সেগুলো টানা রৈখিক ন্যারেটিভের গল্প ছিল ।  বাংলায় গোদার প্রশংসিত হয়েছেন বহু বছর পরে ; ফিল্ম-বোদ্ধাদের নতুন প্রজন্ম আসার পর এবং তাঁর ফিল্মগুলো কখনও ব্যবসায়িক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। ‘ব্রেথলেস’ মুক্তি পাবার পর গোদার হয়ে ওঠেন  ফরাসি নবকল্লোল চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রধান পুরোধাদের অন্যতম, খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সমালোচক এবং বিতর্কিত ও প্রভাবশালী পরিচালক । ৯১ বছর বয়সে তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর পর যতো লেখালিখি তাঁকে নিয়ে হচ্ছে, এপার-ওপার বাংলায়, ততো তাঁর জীবদ্দশায় হয়নি। 
    গোদারের কাজের প্রশংসা যে সবাই করেছেন, তা কিন্তু নয় । যাঁরা তাঁর কাজ পছন্দ করতে পারেননি তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এর্নস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান, সুইডেনের চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, মঞ্চ পরিচালক, ফিল্ম নির্দেশক এবং নাট্যকার।  মার্কিন চলচ্চিত্রকার উডি অ্যালেনের মতে  এযাবৎ যত চলচ্চিত্রকার জন্ম নিয়েছেন তাদের মধ্যে বার্গম্যান সবার সেরা। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং রেডিও,  সব মাধ্যমেই বার্গম্যান কাজ করেছেন। আন্তর্জাতিক আসরে তাঁর  দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস (১৯৫৭), থ্রু আ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), উইন্টার লাইট (১৯৬১), দ্য সায়লেন্স (১৯৬৩), এবং ক্রাইস অ্যান্ড হুইস্পারস (১৯৭২) ফিল্মগুলোর জন্য তিনি খ্যাত । অসাধারণ চিত্রগ্রহণ আর খণ্ডিত আখ্যানশৈলীর মাধ্যমে বার্গম্যান ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব আর কষ্টবোধ । সিনেমা আর টেলিভিশনের জন্য তিনি ষাটটার বেশি ফিল্ম তৈরি করেছেন যার  লেখক ও পরিচালক  তিনি নিজে । এছাড়া বার্গম্যান পরিচালনা করেছেন ১৫০ টিরও বেশি মঞ্চনাটক। 
    যদিও বার্গম্যান আর গোদার দুজনেই  মূলধারার হলিউড সিনেমার মূল্যবোধের বিরুদ্ধচারী চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, তাঁদের সংবেদনশীলতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বার্গম্যান আবেগগতভাবে অত্যন্ত তীব্র এবং গভীর ছিলেন আর বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্হাপনাকে ঘৃণা করতেন । পক্ষান্তরে গোদার  মূলত বুদ্ধিজীবী ছিলেন সিনেমার প্রকৃতি, চলচ্চিত্রের ভাষার প্রচলন এবং যোগাযোগের অসুবিধা, সিনেমা এবং দর্শকদের মধ্যে এবং সেইসাথে একটি চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলির মধ্যেও তাঁর জীবনব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধান কাজ কেছে । গোদার তাঁর ফিল্মগুলোতে একটি কাব্যিক মনের সাথে  ক্ষুর-তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। 
     গোদার সম্পর্কে বার্গম্যান  বলেছিলেন: “আমি কখনই তাঁর কোনও চলচ্চিত্রের প্রশংসা করতে পারিনি, এমনকি সেগুলি বুঝতেও পারিনি। আমি তাঁর চলচ্চিত্রগুলিকে  বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মমগ্ন আর সিনেমা হিসাবে অনাগ্রহী,  এবং খোলামেলাভাবে নিস্তেজ বলে মনে করি। আমার সবসময় মনে হয়েছে যে তিনি সমালোচকদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
    বার্গম্যান আর গোদারের মধ্যে কোনও পেশাদার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না । যা ছিল তা হলো দুটি ভিন্ন ব্যক্তির একে অপরের থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের পৃথক দৃষ্টিভঙ্গী। যাঁরা দর্শক, চলচ্চিত্র নির্মাতা নন, তাঁদের কাছে দুই চলচ্চিত্র নির্মাতাকে প্রায় সমান সজাগ-মননে  উপভোগ করা সম্ভব । তবু অনেকে বার্গম্যানকে উচ্চতর চলচ্চিত্র নির্মাতা মনে করেন যখন কিনা গোদার , সিনেমার উচ্চতর চিন্তাবিদ, যিনি কলমের বদলে ক্যামেরা দিয়ে লিখতেন এবং ন্যারেটিভকে ক্যামেরা কৌশলের মাধ্যমে ভেঙে ফেলতেন ।
    বার্গম্যান সম্পর্কে চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “বিশ্বে খুব কম ছবি-করিয়েই আছেন যাঁরা চলচ্চিত্র ও মঞ্চে পাশাপাশি কাজ করে গেছেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান এমনই এক মহা-পরিচালক, আর তাই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক জন মানুষ। বহু দিন দুটো মাধ্যমেই কাজ করেছেন, আর চূড়ান্ত সফল ভাবে। বার্গম্যানকেই এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন মাধ্যমটা আপনার বেশি পছন্দের? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, সিনেমা আমার স্ত্রী, আর থিয়েটার উপপত্নী। বার্গম্যানের যত ছবি দেখেছি, মনে হয়েছে, বার্গম্যান এমন এক জন পরিচালক, যিনি খুব গভীর ভাবে ‘মানুষ’ নামের অস্তিত্বটাকে দেখেছেন, সেই অস্তিত্বের এক একটা পরত ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে একেবারে আদত মানুষটাকে বার করে এনেছেন। নিজেই বার বার বলেছেন, আমার ছবিতে মানুষই প্রধান। একটা দৃশ্যকে আমি কী করে নির্মাণ করব, সেটা তো ভেবেচিন্তে করে ফেলাই যায়। কিন্তু আসল শুরু মানুষেই, আর মানুষই শেষ কথা। একটা জ্যান্ত (বা মৃত) মানুষের সব উপাদান, তার আনন্দ-দুঃখ-বেদনা-শয়তানি-রসিকতা-অমানুষিকতা, এই সব কিছু তিনি ওঁর ছবিতে ধরতে পেরেছেন। বলতেন, নারী-পুরুষের সমস্যা নিয়ে আমরা লাখ কথা বলি, আসলে সমস্যাটা নারী বা পুরুষের নয়, মানুষের। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের। সম্পর্কের খুব গহন, গোপন, যে জায়গাগুলোতে মানুষ খুব একলা, বা খুব অমানবিক, সেগুলো নিয়েই ওঁর ছবি। ‘সিন্স ফ্রম আ ম্যারেজ’ (যে ছবিটা উনি থিয়েটারেও করেছেন) দেখে মনে হয়েছে, মানুষকে এই ভাবে হাড়-মজ্জা-কঙ্কাল সহ দেখার এই লেন্সটা সবার হাতে নেই।”
    অনিন্দ্য সেনগুপ্ত বলেছেন, “গোদার সবসময়ে ছাত্র হিসেবে পুরোধায় ছিলেন। তিনি অন্যদের থেকে শিখতেন, কিন্তু নিজের মত করে।গোদার ‘মহান’ শিল্পী নন। বার্গম্যান, তারকভস্কি মহান; মহান বুনুয়েল, হিচকক, আন্তোনিওনি। বিশ্বজুড়ে গোদারের ছবিতে দূর্বোধ্য বুদ্ধিজীবিতা নিয়ে দূর্নাম আছে। কিন্তু ধরুন আপনি বার্গম্যানের ছবি থেকে অস্তিত্ববাদের পাঠ পাবেন, বুনুয়েলের ছবি থেকে পরাবাস্তবতার – গোদারের ছবি থেকে সেরকম কিছুর পাঠ পাবেন না। ওনার প্রথম দিকের ছবি মোটেও এক্সিস্টেনশিয়ালিজমের আকরচিত্র নয়, ওনার মধ্যভাগের ছবিও মার্ক্সবাদের শ্রেষ্ঠ পাঠ্য নয় (সেক্ষেত্রে গুরুর গুরু ব্রেখটের কাছেই যাওয়াই সমীচিন)। গোদার মহান নন । আমার কাছে গোদার ইন্টিমেট লাগে, অন্তরঙ্গ লাগে বলেই ওনার কাছে কিছু জিনিস শিখেছি।যেমন ব্যর্থ হতে ভয় না পাওয়া। বস্তুত পৃথিবীর প্রথম সারির সিনেশিল্পীদের মধ্যে জঁ-লুক এমন একজন যিনি সবচেয়ে বেশি ‘ব্যর্থ’ হয়েছেন। কিসের ব্যর্থতা? নতুন কিছু করতে গিয়ে মাঝেমাঝে মুখ থুবড়ে পড়ার। সেটা একটি আস্ত ছবি হতে পারে, বা একটি দৃশ্য, বা একটি শট। পৃথিবীর বেশিরভাগ ‘সফল’ শিল্পীই হয় ব্যাপকার্থে যা পরীক্ষিত পদ্ধতি, বা তার বিগত কাজের নিরিখে যা সফল – তারই পূণরাবৃত্তি করেন। গোদার প্রায় প্রতিটি শটেই না হলেও, প্রতি পঞ্চম শটে এমন কিছু একটা করার চেষ্টা করেন যা নতুন, যা একটি নতুন অ্যাটেম্পট। ব্যর্থতা বা সাফল্যের সেখানে কোনো পূর্বনির্ধারিত মাপকাঠি নেই। অতএব এই প্যারাগ্রাফের প্রথম বাক্যের সাথেই জুড়তে হবে – নতুন কিছু করতে গেলে ব্যর্থ হতেই হতে পারে, ভয় পেলে চলবেনা। আর নিয়ম না ভাঙলে নতুন কিছু করা/বলা যায়না। নতুন সেক্ষেত্রে হল চেনার সীমানার ওপারে যার বাস। ঋত্বিক, বুনুয়েল, বার্গম্যান, তারকভস্কি মাধ্যমটিকে ব্যবহার করতেন – তাদের দার্শনিক-তাত্ত্বিক সিস্টেম তৈরি ছিল। তারা জানতেন ছবির মাধ্যমে তারা কি করতে চান। গোদার তাদের স্থিরতায় দীর্ঘদিন পৌঁছোতে পারেননি, কারণ তিনি মাধ্যম ও ভাষা দুটিকেই সন্দেহ করেছেন। অর্থাৎ ক্লাসরুমে এলে তিনি ভাবতেন যে এই ৫০-১০০ মিনিটের সময়টুকু কি সন্দেহের উর্দ্ধ্বে? কাদের পড়াবো? সিলেবাস কে ঠিক করবে? সিলেবাস নির্মাণ করার পদ্ধতি কি প্রশ্নাতীত?
    তাঁদের উল্লেখযোগ্য সিনেমার পরস্পরের সাথে  চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতির পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়, যেমন, 'Cries and Whispers' এবং Two or Three Things I Know About Her' ফিল্ম দুটোর কথা বলা যেতে পারে'। 'Cries and Whispers'-এ বার্গম্যানের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো ফিল্মের সংবেদনশীল উপাদানকে তীব্র করার জন্য রঙের টোন এবং চরম ক্লোজ আপ শট ব্যবহার করা হয়েছে। এটি গোদারীয়  সিনেমায় দেখা যায় না । 'Two or Three Things I Know About Her'-এ, গোদার প্রটাগনিস্টের মাধ্যমে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত  এবং নাগরিক আধুনিকিকরণ নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্হাপন করেছেন। গোদারের কাছে সিনেমা হল একটি সাংস্কৃতিক মাধ্যম যার সাহায্যে গোদার তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক মতামত কাব্যিকভাবে প্রকাশ করতে পারেন। বার্গম্যান এই পদ্ধতিকে অপছন্দ করেন  কারণ তিনি যা বর্ণনা করেন তার আবেগপূর্ণ বিষয়বস্তুকে আরও তীব্র করে তোলেন।
    ইঙ্গমার বার্গম্যান এবং জাঁ লুক গোদার দুজনেই  চলচ্চিত্র জগতের  অভিজাত স্তরের পরিচালক, যাঁরা সিনেমার বিবর্তনকে সহজ করে দিয়েছিলেন। তাঁরা  বিশ শতকের কয়েকটা ফিল্ম মাস্টারপিস তৈরি করে গেছেন, যার মধ্যে রয়েছে Persona এবং Pierrot le Fou-এর মতো কাজ ।  তাঁদের কাজগুলো তাদের  ভিন্ন শৈল্পিক সংবেদনশীলতার কারণে একে অপরের সাথে ডিসকোর্স হিসাবে ক্রিয়া করেছে কিন্তু দুজনের  চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একটাই – সিনেমাকে শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করা।
    বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, বার্গম্যান প্রায়শই আলফ্রেড হিচককের মতো সর্বকালের সেরাদের জন্য প্রশংসা প্রকাশ করেছেন, যাঁকে বার্গম্যান "খুব ভাল প্রযুক্তিবিদ" বলে মনে করতেন। তিনি তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে কয়েকজনের খোলা মনে প্রশংসা করতেন। বার্গম্যান ফেদেরিকো ফেলিনির চলচ্চিত্র এবং তাঁর "দাহক সৃজনশীলতা" এবং সেইসাথে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর "দর্শকের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উপায়" উপভোগ করার কথা বলেছেন।  সবার ওপরে, তিনি আন্দ্রেই তারকোভস্কিকে স্থান দিয়েছেন এবং তাঁকে "সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ" হিসাবে ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে , বেশ কয়েকজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের বার্গম্যান পাত্তা দেননি। তিনি মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনিকে নিছক একজন "নন্দনতাত্ত্বিক" হিসাবে চিহ্ণিত করেছিলেন এবং সিনেমাটিক পরাবাস্তববাদের গুরু  লুই বুনুয়েলকে তাঁর নিজেরই আহ্লাদের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু  ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম পথিকৃৎ জাঁ লুক গোদারকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন, ‘অসহ্য’ তকমা দিয়ে।
     ব্রেথলেস’ নামের পালাবদল ঘটানো ফিল্ম দিয়ে কর্মজীবন শুরু করে, গোদার ফরাসি সিনেমার এনফ্যান্ট টেরিবল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি একজন পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি পেলেন, যাঁর সিনেমাটিক প্রচলিত কায়দার জন্য ধৈর্য্য ছিল না, এবং যিনি ফিল্ম তোলার জাঁকজমক দৃশ্য লুকানোর বদলে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ক্যামেরার ক্ষমতা ব্যবহার করাকে গুরুত্ব দিলেন। দর্শকদের বললেন, "প্রতিটি সম্পাদনাই মিথ্যা।"
    গোদারের সিনেমাটিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তাঁর উত্তর-আধুনিক আত্মপ্রতিবর্তিতা কখনও বুঝতে পারেননি বার্গম্যান। তিনি গোদারের কাজগুলোকে "প্রভাবিত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মমগ্ন" হিসাবে বাতিল করেছেন এবং দাবি করেছেন যে তিনি গোদারের শৈল্পিক উদ্দেশ্যগুলির প্রশংসা করতে অক্ষম বা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে সক্ষম হননি। গোদারের চলচ্চিত্র এবং তাঁর  সিনেমাটিক সংবেদনশীলতার একটি কঠোর সমালোচনা করে  বার্গম্যান বলেছিলেন: "আমি তাঁর চলচ্চিত্র থেকে কিছুই পাইনি। ফিল্মগুলো যেন কৃত্রিমভাবে বানানো, বুদ্ধিজীবীর নকল এবং সম্পূর্ণরূপে মৃত মনে হয়েছে। ফিল্মগুলো সিনেমাটোগ্রাফিকভাবে অরুচিকর এবং অত্যন্ত বিরক্তিকর। গোদার একজন ‘ফাকিঙ বোর’ । তিনি সমালোচকদের জন্য তাঁর চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। একটি চলচ্চিত্র, Masculin Féminin (1966), এখানে সুইডেনে শুটিং করা হয়েছিল। এটা মন দমিয়ে দেবার মতো বিরক্তিকর ছিল।"
    ১৯৭১ সালের একটা সাক্ষাৎকারে, গোদারের কাজগুলো অপছন্দ করার সঠিক কারণগুলি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “এই পেশায়, আমি সর্বদা এমন লোকদের প্রশংসা করি যারা চলেই চলছে, যাদের এক রকমের ধারণা রয়েছে আর তা যতই পাগলামো হোক না কেন, তা দিয়ে যাচ্ছেন ; তাঁরা মানুষ এবং জিনিসগুলোকে মেলাতে পারছেন, আর তাঁরা অন্তত কিছু  তো বানাচ্ছেন । আমি সবসময় এই ব্যাপারগুলোর প্রশংসা করি। কিন্তু গোদারের ফিল্ম দেখতে পারি না। আমি সম্ভবত পঁচিশ বা ত্রিশ বা পঞ্চাশ মিনিটের জন্য বসে থাকি আর তারপর উঠে বেরিয়ে যাই, কারণ তাঁর ছবি আমাকে বেশ নার্ভাস করে তোলে। আমি পুরো সময়টা বোঝার চেষ্টা করি যে উনি আমাকে কিছু বলতে চান, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না যে ব্যাপারটা কী, এবং কখনও কখনও আমার মনে হয় যে উনি আমাকে ঠকাচ্ছেন।"
    গোদারের ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ সিনেমার বিখ্যাত মাস্টারপিসগুলির প্রতি বার্গম্যানের অপছন্দের বিপরীতে, গোদার সবসময় বার্গম্যানকে তাঁর প্রাথমিক প্রভাবগুলির মধ্যে একজন হিসাবে উল্লেখ করেছেন।যখন গোদার চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে কাজ করছিলেন, ১৯৫৮ সালের একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: “বার্গম্যান, প্রকৃতপক্ষে, তাৎক্ষণিক সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্র  বর্তমান মুহুর্তে নায়কের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠে, আর সেই প্রতিফলনকে সময়ের স্থানচ্যুতি দ্বারা গভীর করে তোলে – ঠিক যেমন প্রুস্ত তাঁর উপন্যাসে করে গেছেন ।”
    বার্গম্যান সম্পর্কে গোদার নলেছেন, “কিন্তু আরও শক্তিশালীভাবে, যেন প্রুস্তকে  জয়েস এবং রুসো উভয়ের দ্বারা দ্বিগুণ করেছেন বার্গম্যান – তাৎক্ষণিকতার ওপর এক বিশাল, সীমাহীন ধ্যানে পরিণত করেছেন। একটি ইঙ্গমার বার্গম্যান ফিল্ম, বলা যায়, একটি সেকেন্ডের চব্বিশ ভাগের একাংশে রূপান্তরিত এবং দেড় ঘণ্টায় প্রসারিত। দুইবার চোখের পাতা ফেলার মাঝের জগৎ, দুই হৃদস্পন্দনের মাঝের বিষণ্ণতা, দুই হাততালির মাঝে উল্লাস।"
    গোদারের জীবনে, তাঁর বৈপ্লবিক চেতনাকে তরতাজা রাখতে অন্য কারোর পিঠচাপড়ানির দরকার হয়নি । তাঁর পরের ফিল্মগুলোয়, যেমন Goodbye to Language এবং The Image Book কাউকে পরোয়া করেনি । গোদারের এই উক্তিটি এক্ষেত্রে উল্লেখ্য :  "যে শূন্যে ঝাঁপ দেয় তার, যারা দাঁড়িয়ে দেখছে, তাদের কাছে ব্যাখ্যা দেবার কোনও দায় নেই।" ফেলিনি, ত্রুফো, বার্গম্যান, আন্তনিয়নি, প্রমূখ প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের পাশে গোদার নিজের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। বলতে পেরেছিলেন, “আমরা সবাই কমবেশি পতিতাবৃত্তিতে বসবাস করছি।”
    বার্গম্যান যেমন বলেছেন, যে, গোদার তাঁর কাজগুলো ফিল্ম-ক্রিটিকদের জন্য তৈরি করেন, তেমনই সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, গোদারের সিনেমা পরিচালকদের জন্য, ইউরোপের শিক্ষিত দর্শকদের জন্য ; ভারতবর্ষের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতদের জন্য নয়। উৎপল দত্ত যেমন বলেছেন, ব্রেখতের নাটকগুলো শিক্ষিত জার্মানদের জন্য । এপার-ওপার দুই বাংলাতেই রৈখিক গল্প ছাড়া ফিল্ম বা নাটক সম্ভব নয় । ফিল্ম তুলতে প্রচুর টাকা লাগে, আর কেই বা অতো টাকা খরচ করতে চাইবে যা ফিল্ম দেখিয়ে তোলা যাবে না । বলিউডের ফিল্মের জন্য তাই আণ্ডারওয়র্লডের টাকা দরকার হয় । জনপ্রিয় সিনেমা, গল্প, উপন্যাস, নাটক টিকে যায় বাণিজ্যিক প্রচারের জোরে। কর্পোরেট মিডিয়া, কর্পোরেট লবি জনসাধারণের রুচি, শিক্ষা, বোধ, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন এর সিনেমা জনপ্রিয় হয় না। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি এদেশে দেখাবার সিনেমা হল পায় না । আজকাল তো বাংলা বাণিজ্যিক ছবিকে হল থেকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হিন্দি ফিল্ম দেখানো হয় ।
    শুটিং এর আগে গোদারের হাতে সুচিন্তিত আর লিখিত চিত্রনাট্য  থাকত না। ফালি কাগজে গোদার  ছবির আইডিয়া লিখে রাখতেন। কি কি শট নেওয়া হবে, কোন কোন দৃশ্যবস্তুকে গ্রহণ করা হবে এইসব ভাবনা  তার মাথায় থাকত । চিত্রনাট্যের গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তিনি স্বীকার করতেন না। সত্যজিৎ রায় তাঁর আগামী ফিল্মের দৃশ্যগুলোও এঁকে রাখতেন । গোদার ছিলেন বেপরোয়া, একজন প্রতিবাদী চিত্রনির্মাতা, যিনি ফিল্মের মাধ্যমে মার্কসবাদের সামাজিক অর্থনৈতিক দার্শনিক ব্যাখ্যা করতেন, ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদ  করতেন। ফলে প্রযোজক পাওয়া কঠিন ছিল তাঁর পক্ষে ।  ক্যামেরা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আর ক্যামেরাকেই ভাবনাচিন্তা করতে বলতেন । সিনেমার বাণিজ্যিক দিক তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। ফিল্মের গণমাধ্যম এতই শক্তিশালী যে প্রতিটি দেশের সরকার এবং পুঁজির মালিকরা পরিচালনা আর প্রযোজনা কুক্ষিগত করে রেখেছে। আমাদের দেশে অমন ফিল্ম তৈরি করলে কেবল কারোর বাড়ির বৈঠকখানায় কয়েকজনকে দেখানো যাবে ।
    মিশেল অ্যাজানাভিশ্যু, যিনি গোদার আর তাঁর প্রেমিকাকে নিয়ে ‘রিডাউটেবল’ফিল্ম তৈরি করেছেন, তিনি মনে করেন, অনেক লোক জাঁ লুক গোদারকে ঘৃণা করেন  ।  যখন জাঁ লুক গোদার  শুনলেন যে তার জীবনের ঘটনাবলী নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে, তখন তিনি বলেছিলেন: "আমি ব্যাপারটা পছন্দ করি না, একেবারে বোকা, বোকা ধারণা।" ফরাসি সিনেমার এক সময়ের বিদ্রোহী ফিল্ম নির্মাতা তখন ৮৭ বছর বয়সী, এবং প্রায় ৫০ বছর পর পর্দায় আনা অভিনেত্রী এবং প্রেমিকা অ্যান ওয়াইজেমস্কির সাথে তার বিবাহ সম্পর্কে একটি গল্প নিয়ে -রিডাউটেবল’ নামের চিত্র নির্মাণে তাঁর  সন্দেহ ছিল । ‘রিডাউটেবল’-এ, স্ট্যাসি মার্টিন অভিনয় করেছেন গোদারের স্ত্রী ওয়ায়েজেমস্কির চরিত্রে , লুই গ্যারেলের বিপরীতে, যিনি গোদারের  চরিত্রে অভিনয় করেছেন।সময়কাল ১৯৬৭-৬৮, যখন ছাত্র বিক্ষোভ প্যারিস জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে । ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনের নেতা হিসাবে, Breathless এবং Vivre Sa Vie-র মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা করার পরে গোদার তখন একজন প্রধান বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্মানিত । গোদার সম্পর্কে অ্যাজানাভিশ্যু বলেছেন, "আমি বলব না যে তিনি আমাদের সেরা পরিচালকদের একজন," বলা যায়  “তিনি সবচেয়ে মুক্ত মনের পরিচালক। তিনি  খুব আকর্ষণীয় পথ গ্রহণ করেছেন। তবে আমি তাঁকে সেরাদের একজন মনে করি না।”
    অ্যাজানাভিশ্যু মনে করেন, “ফ্রান্স গোদারকে নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত। “কিছু লোক তাকে মহান হিসেবে তুলে ধরতে  চায়। তিনি ফ্রান্সের সমাজের একটি নির্দিষ্ট অংশের কাছে একটি টোটেমের মতো, যা আমি মনে করি হাস্যকর। "কিন্তু অনেক লোক তাঁকে ঘৃণা করে কারণ তারা তাঁকে বোঝে না, কারণ তারা তাঁকে ভয় পায়, কারণ গোদার সবসময় একজন প্রতিপক্ষ - গোদার অনেক কিছুর বিরোধী। অনেক লোক এর জন্য তাঁকে ঘৃণা করে, কারণ তারা মনে করে গোদার একজন বুদ্ধিজীবী আর অভিজাতদের অংশ।"
     
     
     
     
     
     
    •  
    •  
    •  
     
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫১738591
  •  গোদার এবং দর্শনের উপস্হাপনা : একরকম দর্শন হিসাবে সিনেমা
    জন ই ড্রাবিন্সকি, আমহার্স্ট কলেজ
    জার্নাল অফ ফ্রেঞ্চ অ্যাণ্ড ফ্রাঙ্কোফোন ফিলোজফি [ Vol XVIII, No 2 (2010) ] তে প্রকাশিত প্রবন্ধের অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী
    ফিল্মে পরিসর নিজেকে ভিন্ন একটি চেহারায় উপস্হাপন করে, যা এখন আর আগের মতন সম্পূর্ণ নয়, বরং তা কয়েকটি রদবদলের মিশেল,  অনুভূতির সমষ্টি, যা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়,  অর্থাৎ ব্যাপারটা হলো সময়।
    জাঁ-লুক গোদার আর কিছু না হোন, তিনি রহস্যে মোড়া । তাঁর ব্যক্তি-প্রতিস্বের নিজেরই জীবন রয়েছে, বিশেষ করে যুববেলার আদরায় : সিগারেট, কালো চশমা, বাঁকা হাসি, গমগমে বৈপ্লবিক স্লোগান, আর গুরুত্বপূর্ণ বই । কেবল নিছক ব্যক্তি-প্রতিস্বই নয়, আমরা সবাই জানি, কেননা তাঁর আইকনিক প্রতিস্ব নিখুঁতভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে ‘ব্রেথলেস’ থেকে শুরু করে ক্যামেরার বেপরোয়া বৈপ্লবিক ব্যবহারে । গোদারের পর ফিল্ম নির্মাণ আর একই রকম রইল না ।  ছবি এবং তাদের অনুক্রমগুলো —- গোদার সেগুলোকে কালো চশমায় ঢাকা দিয়ে মুচকি হাসির আড়াল তুলেছিলেন ।  তিনি তাদের বিপ্লবী করেছেন। এটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। এমনকি বয়স্ক গোদারও একটি আইকনিক ফটোর যোগ্য : রুক্ষ মুখে দাড়ির চুল, শিল্পীর চশমা, হাসি এবং গুরুত্বপূর্ণ বই। তাঁর ফিল্মগুলো বজায় রেখেছিল তাদের অনির্দেশ্য,  টানটান এবং বৈপ্লবিক বিশেষত্ব । 
    ফটোতে সৌম্যকান্তি এবং কমনীয় হতে কখনই অসুবিধা হয়নি । আইকনিক উপস্থিতি এবং মনোভাব,  চোখ ও মনকে জাগিয়ে রাখতো। সিনেমা, সর্বোপরি, শিল্পের আঙ্গিকের ওপর ভর করে চিত্র এবং প্রচারের  অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি করে  - বাণিজ্য এবং খ্যাতির । কেননা সিনেমাও অবশ্যই একটা শিল্প, যা প্রযুক্তি এবং মানুষের কল্পনার সংযোগে তৈরি হয়, যার সম্ভাবনা এই দুটিরই সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনা দিয়ে ঘেরা ।  গোদারের প্রতিভায় কিছু একটা আছে যা তাঁর আইকনিক ভঙ্গিকে ছাপিয়ে যায়। নিঃসন্দেহে, তিনি প্রধান স্টুডিও সিস্টেম এবং গণসাংস্কৃতিক জায়গাগুলোর বাইরে কাজ করেন - এমনকি টেলিভিশনের জন্যও, তিনি অস্বস্তিকর এবং জটিল ফ্রান্স/ট্যুর/ডিট্যুর/ডিউক্স/এনফ্যান্টস তৈরি করেছেন - এবং তাঁর সেই নিজস্ব সিনেমাটিক কন্ঠস্বর , কিন্তু গোদারের প্রতিভা এবং রহস্য দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর নিয়ে আসা শব্দ এবং ছবিগুলোতে । তাঁর সিনেমা এবং সিনেমার ভাষাটি দার্শনিক। আইকনিক পোজ, ক্যারিশমা, স্টাইল এবং গুরুত্বপূর্ণ বই।  ঠিক যেমন রয়েছেন আইকন গোদার, আর ফিল্মে  তাঁর আইকনিক শট, মুখ এবং দৃষ্টিকোণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে বৃহত্তর ভাবনার দৃষ্টি আর চমৎকারিত্ব : ফিল্মে গোদার একজন আইকন থেকে চিন্তকে পরিবর্তিত হন । গোদারের কাজগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের যোগসূত্র রয়েছে; আমরা দেরিদা, বাতাইলে, মেরলো-পন্তি, লেভিনাস এবং অন্যান্যদের বক্তব্য তাতে পাই। বইগুলো অবশ্য ধারণার সংকেত দেয় এবং ঘুরপথে জটিল পথচলার মানচিত্র দেয়, টুকরো-টাকরা এবং  এমনকি নৈতিক বার্তা । কেন দেরিদার ‘অফ গ্র্যামাটোলজি’ ? ‘নোত্রে মিউজিক-এর সংকটের মুহূর্তে লেভিনাসের এনত্রে নউস দ্বারা কী উদ্ভূত হয়েছে ? ইত্যাদি । সেসব মুহূর্তগুলো তাত্বিক আর ভাষ্যকাররা তালিখে গেছেন । আরও বহু বক্তব্যকে আলোকিত করার প্রয়োজন আছে ।
    বইয়ের গুরুত্ব আছে গোদারে, আর লক্ষ্য করার ব্যাপার হলো  এই বৈশিষ্ট্যযুক্ত বইগুলোর মধ্যে কতকগুলোয় দার্শনিকদের নাম রয়েছে । জাঁ লুক গোদারকে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং সিনেমাটিক কৌশল এবং প্রবণতার উদ্ভাবক হিসাবে বিবেচনা করাই যথেষ্ট। তার প্রচুর উপাদান আছে, কেননা, তাঁর সিনেফিলিয়ার বিশালতা এবং তীব্রতার জন্য, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সিনেমার শিল্পের উদ্ভাসিত উদ্দীপনার কারণে, প্রায়শই বামপন্হী  রাজনীতি একজন বুদ্ধিজীবীকে সারাজীবন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা বলতে পারি যে গোদারের সিনেমা সম্পর্কে লেখালিখির  সর্বোত্তম কাজগুলো এই সবে শুরু হয়েছে।  কেই বা তাঁর চলচ্চিত্রের মানে ফুরিয়ে যাবার ভান করবে? কেউ করবে  না । বলার মতো আরও অনেক কিছু আছে, আরও অনেক ফিল্ম দেখতে হবে । সম্পূর্ণরূপে বিকশিত নান্দনিকতা এবং রাজনীতিতে সূক্ষ্মভাবে  বিস্ফোরণগুলো সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে হবে । বুড়ো লোকটা এখনও চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলেছে। সেই চলচ্চিত্রগুলো এখনো ব্যাখ্যাকারের অপেক্ষায় রয়েছে । 
    গোদারের প্রসঙ্গ এবং ইঙ্গিতগুলোকে অনুসরণ করা - তা শটে হোক, ফ্রেমের মার্জিনে একটি বই, বাক্যাংশের একখানা মোচোড় , বা একটি সম্পূর্ণ অনুক্রম এবং মন্টেজ হোক - অবশ্যই তাঁর সিনেমা সম্পর্কে প্রচুর চিন্তাভাবনার ফসল। নীচের পৃষ্ঠাগুলিতেও কিছু থেকে যায় ।  তবুও, একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে, আমাদের বিশ্লেষিত প্রবন্ধগুলো গোদারকে নিয়ে একটি ভিন্ন কথোপকথন শুরু করে । একটি ভাবনা শুরু হয়েছিল, গোদারের সিনেমাটিক কাজের ভেতরেই। চারটি পথনির্দেশক প্রশ্ন। দর্শন সম্পর্কে গোদারের ফিল্মগুলো কী কথা বলে ? গোদারের কাজ সম্পর্কে দর্শন কী বলে বা বলতে পারে? অথবা, আরও বিশদ করে বলতে হলে, কীভাবে আমরা গোদারের কাজকে দর্শনের একটি রূপ হিসাবে দেখতে পারি?
     দর্শন কি এক ধরনের সিনেমা হতে পারে? দার্শনিকরা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেন। ফিল্ম তাত্ত্বিকরা দর্শন নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু  সিনেমা এবং দর্শনের মাধ্যমে চিন্তা করার ক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ তার একটি অংশ হল প্রশ্নটির সমস্যা: সিনেমা এবং দর্শনকে একই সাথে ভাবার মানে কী দাঁড়ায় ? নাকি  একটি ফিল্ম বা শটের অনুক্রমের ওপর দার্শনিক ধারণা যান্ত্রিকভাবে চাপিয়ে দেয়া হবে ?  সম্ভবত দর্শন এবং সিনেমা, আমরা যাকে দার্শনিক বলি, সেই ভাবনাগুলোর  একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা গড়ে তোলে। যেমন ধরা যাক, ১৯৬৮ সালে  নিৎশেকে নিয়ে একটা ছোটো সাক্ষাৎকারে বলা গোদার সম্পর্কে জিলে দেলিউজের কথা বিবেচনা করুন। সেই মন্তব্যে দেলিউজের উদ্বেগের বিষয় ছিল ইমেজের ভাগ্য – দর্শনে কীভাবে ইমেজটি সমালোচনার এলাকা হিসাবে কাজ করে, আর সেই সঙ্গে  বাস্তবতার কিছু আধিভৌতিক ধারণায় আটক পশ্চিমা ঐতিহ্যের আবেশের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য একটা সমালোচনামূলক এলাকা হিসাবে গড়ে ওঠে। গোদারের সিনেমা সম্পর্কে একটা মন্তব্য চিন্তাকে উসকে দেয়, যেমনটা দেলেউজ বলেছেন : গোদার  সিনেমার মধ্যে চিন্তাভাবনার প্রবর্তন করে তার রূপান্তর ঘটিয়েছেন। সিনেমা নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই, সিনেমায় তিনি কম-বেশি বৈধ চিন্তা রাখেন না; তিনি সিনেমাটাকেই চিন্তা করতে প্ররোচিত করেন, আর তা সিনেমায় প্রথমবারের মতো ঘটতে দেখা গেলো, যদি আমি ভুল না করে থাকি।
    তাত্ত্বিকভাবে, গোদার কান্টের ‘ক্রিটিক’ বা স্পিনোজার ‘নৈতিকতা’ চিত্রায়ন করতে সক্ষম হবেন আর তা  বিমূর্ত সিনেমা বা সিনেমাটোগ্রাফিক প্রয়োগ হবে না। গোদার জানতেন কেমন করে  একটা নতুন উপায় আর একটা নতুন 'ইমেজ' দুটোকেই খুঁজে বের করতে হয় - যা অগত্যা বিপ্লবী বিষয়বস্তুকে আগাম অনুমান করে নেয় । সুতরাং, দর্শনে, আমরা সকলেই আনুষ্ঠানিক পুনর্নবীকরণের এই একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি ।  তাঁর মনের ভেতরে  কী ঘটছে তা জানা মুশকিল, কারণ দেলিউজ যেমন বলেছেন, গোদার ফিল্ম জগতকে একের পর এক  গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘উইক-এন্ড’, ‘২ অর ৩ থিংস আই নো অ্যাবাউট হার’ আর ‘লে চিনয়েস’, তার আগে ‘ম্যাসকুলিন-ফেমিনিন’, ‘মেড ইন ইউ.এস.এ’, এবং ‘পিয়েরো লে ফাউ’ - শুধুমাত্র কয়েকটা উল্লেখ করা যেতে পারে । এগুলি সবই তাতিয়ে তোলার চলচ্চিত্র, উদ্ভাবনামূলক এবং উদ্ভট, তবুও আমরা বলতে পারি যে গোদার সম্পর্কে দেলিউজের বক্তব্য যেমন বর্ণনামূলক তেমনি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক। দেলিউজের মন্তব্যের পরের  দশকগুলোয়, গোদার  তৈরি করলেন  সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং, আত্ম-প্রতিফলিত, আত্ম-সমালোচনামূলক এবং অত্যন্ত তাত্ত্বিক ফিল্মগুলো।
    ‘কমেন্ট কাভা?’র মতন কঠিন কাজগুলো  এবং ‘ন্যুমেরো দেউ’, পরবর্তী দশকে তৈরি, অনেকটা ভাঙা আখ্যানের চেয়ে প্রবন্ধের মতো কাজ করে, আর  Ici et ailleurs এবং অন্যান্য  চলচ্চিত্রগুলোতে আমরা যে আত্ম-সমালোচনা পাই, যেখানে ‘অপর’-এর প্রতিনিধিত্ব করার সমস্যাটি এমন কঠোর পরিভাষায় উপস্হাপিত , যা, ফ্রান্সে এবং অন্যত্র ঘটে যাওয়া ১৯৭০  দশকের অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং জরুরী দার্শনিক চিন্তাভাবনাকে কেন্দ্র করে উৎসারিত হয়েছিল । ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে যা একটি দার্শনিক প্রতিশ্রুতি হিসাবে দেখানো হয় , তাকে ১৯৭০  এবং তার পরে একটি ঘন, পলিসেমিক সিনেমাটিক ভাষায় নিয়ে আসা দর্শনে পরিণত  করা হয়েছিল । যদি দর্শন, যেমনটা দেলিউজ বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা তৈরির সাথে সম্পর্কিত বিষয় হয়, তাহলে গোদারের সিনেমাকে বলা যেতে পারে শব্দ এবং ছবি দিয়ে গড়া ধারণা  - যা এতোকাল, সম্পূর্ণরূপে অবহেলিত, দর্শনের পদ্ধতি ছিল।
     এখন, আসুন, সামান্য বিরতি দেওয়া যাক এবং ভাবা যাক সিনেমাকে এক ধরণের দর্শন হিসাবে মান্যতা দেয়ায় কী ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তা বিবেচনা করি। দেলিউজ এখানে একটি সত্যিকারের অবিশ্বাস্য দাবি করছেন, যদিও তা ইঙ্গিতপূর্ণ এবং এখনও পদ্ধতিগত নয় (যদিও  সিনেমা বিষয়ে দুটি বইয়ে গোদার সম্পর্কে তাঁর বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা এই দাবিকে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে)। দেলিউজের মতে,  গোদারের  সিনেমা, কেবলমাত্র দর্শনের প্রতিফলনের জন্য একটি বিশেষ সমৃদ্ধ স্থান হতে পারে, কিন্তু  গোদারের চিত্রের স্থাপনাতেও দর্শন তৈরি হতে পারে । দেলিউজের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, অবশ্যই, এটি নিখুঁত অর্থবহ এবং তাঁর দাবিকে মূর্ত করে, যে, দর্শনের কাজ ধারণা তৈরির মধ্যে নিহিত, পাঠ্যের বিশ্বস্ত (প্রচলিত) ব্যাখ্যা করা নয় এবং শুধুমাত্র ঐতিহ্যকে পুনঃস্থাপন করা নয়। সিনেমা, সেই প্রেক্ষাপটে, চিত্র এবং শব্দের স্তরে ধারণা তৈরির জন্য একটি নিখুঁত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে কার্যকর ব্যাপার। আর তাই, সিনেমাও এমন একটা মাধ্যমের ব্যাপার যা দর্শনের উদ্ভাবন করে। কিন্তু তার মানে এই দাঁড়ালো  যে সিনেমার ঐক্যকে ধরে রাখার জন্য  দর্শন একটি ব্যাখ্যামূলক বিষয় হিসাবে চালিত হয় না ।  বরং সিনেমা হল এক ধরনের দর্শন। দর্শন হল এক ধরনের সিনেমা। ধরা যাক দেলিউজ তাঁর চরিত্রায়নে সঠিক। এর মানে যা দাঁড়াচ্ছে, অবশ্যই, তা হলো আমাদের মতন দার্শনিক-মনোভাবাপন্ন ভাষ্যকারদের জন্য গোদারের কাজ সম্পর্কে বিশ্লেষণের নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে । তাঁর চলচ্চিত্রে দর্শন প্রয়োগ করা বা প্রদত্ত মন্তেজ বা চরিত্রের অনৈক্য থেকে একটি বা দুটি ধারণা সনাক্ত করা যথেষ্ট নয়। গোদারের সিনেমাকে দার্শনিক ডিসকোর্স হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে। সেই লক্ষ্যে, এবং সেই ফ্রেমের মধ্যে, গোদারের দর্শন বিশ্লেষণ  করার জন্য তিনটি সাধারণ কৌশল দরকার। এই কৌশলগুলোতে  দর্শন আর সিনেমার মিলনের গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা দেখতে পাই।
     প্রথমত, বিশেষ দার্শনিকদের সাথে গোদারের সিনেমাটিক খেলা এবং ভাষাকে জড়িত করার কৌশলের মিল - এখানে, দেলিউজ, ফেলিক্স গুত্তারি এবং অ্যালাঁ বাদিউ - যা সমসাময়িক তাত্ত্বিকদের পাশাপাশি গোদারের চিত্র এবং শব্দের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করে।  আর সিনেমা দার্শনিককে কী বলে? দ্বিতীয়ত, সিনেমার ভাষা কীভাবে মানেগুলোকে ছড়িয়ে দেয় তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, যার অর্থ দার্শনিক বর্ণালী জুড়ে ভাষা, লেখা, ইতিহাস ইত্যাদির প্রশ্ন গড়ে ওঠে । কিভাবে সিনেমা একটি তাত্ত্বিক ডিসকোর্স হিসাবে কাজ করে? আমরা কীভাবে সিনেমাটিক ভাষা এবং তার প্রভাব, ধারণা এবং ধারণাগুলির পাঠ(গুলি)র সংক্রমণকে তাত্ত্বিক করতে পারি? এবং তৃতীয়, বৃহত্তর দার্শনিক (এবং বিস্তৃতভাবে তাত্ত্বিক) প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে গোদারকে কোথায় স্থাপন করা যায় সেই প্রশ্ন রয়েছে।
    গোদার কীভাবে চলচ্চিত্র এবং কবিতার ইতিহাসের সাথে আরও সাধারণভাবে সম্পর্কিত? আর কীভাবে সেই সম্পর্কটা শর্ত হিসাবে তাঁর একক চিত্র তৈরির সম্ভাবনার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে?  ডেভিড স্টারিট এবং মাইকেল ওয়ালশ বলেছেন   গোদারের কাজকে দেলিউজ, গুত্তারি এবং বাদিউয়ের সমালোচনামূলক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন । স্টেরিট বলেছেন গোদার তাঁর শেষের দিকের ফিল্মগুলোতে ইমেজকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে বোঝা যায় তিনি মানুষ ও বিশ্বের মাঝে ছবির মাধ্যমে সংযোগ গড়ে তুলতে চেয়েছেন ।   স্টারিট বিশেষ করে আলোকপাত করেছেন গোদারের ১৯৮৫ সালের  ‘হেইল মেরি’ ফিল্মে বিমূর্তের মুখোমুখি পণ্যসমষ্টির ব্যাপারে যেখানে  অবতার হিসাবে মাদার মেরি আকাঙ্ক্ষিত এবং পবিত্র ।
    ওয়ালশ তাঁর "হ্যাপিনেস ইজ নট ফান: গোদার, ২০থ সেঞ্চুরি অ্যান্ড বাদিউ,"  প্রবন্ধে বলেছেন যে বাদিউ-এর চিন্তাভাবনা গোদারের  অনেক কাজ জুড়ে অনুরণিত হয় । ১৯৬০-র দশকের চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক ছোট কাজগোলুর মধ্যে বিশেষ করে রহস্যময় ছোট ফিল্ম De L'Origine du XXIe Siècle. একই থিম নিয়ে বাদিউয়ের চিন্তাভাবনার বিশ্লেষণ করে  ওয়ালশ দেখিয়েছেন যে কীভাবে "শতাব্দীর" ধারণাটা গোদার, লাকাঁ এবং বাদিউয়ের মধ্যে একই পাটাতনে খুঁজে পাওয়া যায়,  যার সবকটিই সিনেমা বা দার্শনিক চিন্তাভাবনায় কাজ করা ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষামূলক। ওয়ালশের বিশ্লেষণে আমরা যা দেখি তা হল প্রদত্ত চিন্তকের ধারণাগত বক্তব্যটি কীভাবে তাত্ত্বিক ডিসকোর্সের মতো কাজ করে: মানে, যা দেখা যায় না তা আলোকিত করা।  সিনেমা তার নিজস্ব দার্শনিক অর্থগুলোকে বিশেষভাবে সঞ্চারিত করে। শব্দ, চিত্র এবং ফ্রেমের খেলা অন্য এক ধরণের তাত্ত্বিক ভাষাশরীর গড়ে তোলে। এই ভাষার সম্ভাবনার বিকাশ এবং কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে, গোদার অবশ্যই জটিল এবং প্রায়শই হতবুদ্ধি করে দেন । 
    ডেভিড উইলস তাঁর "দ্য অডিবল লাইফ অফ দ্য ইমেজ" প্রবন্ধে  গোদারের নিজস্ব ধরনের ইমেজকে বিশ্লেষণ করেছেন । গোদারের  ভিজ্যুয়াল অদৃশ্য হওয়ার কায়দা বিশ্লেষণের মাধ্যমে, ‘হিস্টোয়ার (গুলি) ডু সিনেমা’ এবং ‘এলোজে দে ল'আমোর-এর উপর বিশেষ জোর দিয়ে, উইলস দেখান যে কীভাবে সিনেমাটিক ভাষা, গোদারের হাতে, শ্রবণে অর্থ উৎপন্ন করে, যা একইসঙ্গে দৃশ্যমান আবার ইমেজ তৈরির   বাইরে কাজ করে। তাঁর "শট অ্যান্ড কাউন্টার-শট: প্রেজেন্স, অবস্কিউরিটি, অ্যান্ড দি ব্রেকডাউন অফ ডিসকোর্স ইন গোদারর্স নোত্রে মিউজিক’  বার্লিন বার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে শট এবং কাউন্টার-শটের খেলা ঐতিহাসিক, স্মারক এবং শেষ পর্যন্ত অর্থের একটি অদ্ভুত সংক্রমণ তৈরি করে যা , উত্তেজকভাবে রাজনৈতিক লক্ষণযুক্ত এবং তাৎপর্যময়। , ‘নোত্রে মিউজিক’ বারের দৃষ্টিতে, এমন একটি সিনেমাটিক কাজ এবং দিসকোর্স যার শক্তি এবং অর্থ উৎপন্ন হয় মাঝে-মাঝে বাধা তৈরি করে । জনাথন লাহে ড্রন্সফিল্ড একটি ভিন্ন তর্ক দিবেছেন, যদিও তা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, গোদারের লিখিত পাঠবস্তুর ওপর জোর দেয়াকে  কখনও কখনও ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে ।
    গোদারের কাজের "উৎস" কী এবং সেই উত্সগুলি কীভাবে তার সিনেমাটিক প্রযোজনায় কাজ করে? ড্রনসফিল্ড তাঁর ‘পেডাগগি অফ দি রিটন ইমেজ’ প্রবন্ধে এই উদ্ধৃতিগুলিকে প্রস্থানের একটি প্রাথমিক বিন্দু হিসাবে গ্রহণ করেছেন, সেই প্রস্হানবিন্দু থেকে একটি বৃহত্তর তত্ত্বের বিকাশ ঘটে যে কীভাবে আগে থাকতে লিখে রাখা ছবি—- আন্তঃপাঠ, ফটোতোলা বই, ব্ল্যাকবোর্ড ইত্যাদি - গোদারের কাজে হস্তক্ষেপ করে, যেন সেগুলো চলমান চিত্রের এবং শব্দের প্রত্যাশিত খেলা । উইলস, বার এবং ড্রনসফিল্ড প্রমুখের বক্তব্য থেকে, আমরা প্রভাব এবং ধারণার সংক্রমণের এলাকা হিসাবে সিনেমাটিক ভাষার প্রতি গোদারের দৃষ্টিভঙ্গির গাম্ভীর্য এবং সূক্ষ্মতা টের পাই । অর্থাৎ গোদারের দর্শনের উৎস হলো শব্দ, চিত্র, ফ্রেম ইতর‌্যাদির  দার্শনিক ডিসকোর্স ।
     গ্যাব্রিয়েল রকহিল তাঁর "মডার্নিজম অ্যাজ মিসনোমার: গোদার্স আর্কিওলজি অফ দ্য ইমেজ," প্রবন্ধে বলেছেন যে গোদারের  ইমেজ আসলে বিপ্লবী পুনর্বিবেচনার মর্মার্থের প্রসারণ ঘটায় । শার্ল বোদলেয়ারের নন্দনতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, রকহিল বলেছেন গোদারের প্রাথমিক কাজের বেশিরভাগ অংশ   - বিশেষ করে ‘ব্রেথলেস’ - অন্য ধরণের সিনেমা তৈরি করার জন্য তাঁর সংগ্রামকে ইতিহাসভুক্ত করার প্রয়াস, যা পরীক্ষামূলক এবং উদ্ভাবনী উভয়ই, কিন্তু যা মূলত এক "পুনরাবিষ্কার” । সিনেমার অত্যাবশ্যকীয় শক্তিকে ফিরিয়ে আনার পুনরাবিষ্কার । গোদারের এই বিশ্লেষণে, রকহিল সেই কঠিন জায়গায় গোদারকে স্থাপন করতে সক্ষম হন যা বিংশ শতাব্দীর দর্শনকে  সংজ্ঞায়িত করে যেখানে  বিনয় এবং দৃঢ়তার সাথে নান্দনিক কৌশল, চিত্রের সময়, এবং আকাঙ্ক্ষা এবং একটি কাব্যিক প্রকল্প হিসাবে আধুনিকতার ব্যর্থতা পুনর্নবীকরণ করার প্রয়াস করা হয়েছে ।  সর্বোপরি, গোদারকে নিয়ে দার্শনিক কথোপকথনের সূচনা  করছি আমরা ।যার অভিযোজন শুরু থেকেই জটিল, ভাষ্যের অর্থের জটিল তাত্ত্বিক প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং গোদারের চলচ্চিত্রগুলি থেকে উত্তেজক বিতর্কজড়িত।   সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিখুঁত স্পষ্টতা রয়েছে: দর্শক এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে, গোদার একটি নির্দিষ্ট ধরণের দর্শন তৈরি করে গেছেন: সিনেমা এক ধরনের দর্শন হিসেবে। হ্যাঁ,  কিন্তু দর্শনও এক ধরনের সিনেমা হিসেবে।
     
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫২738592
  • জাঁ লুক গোদার - জীবন ও সিনেমা : মলয় রায়চৌধুরী
    আমি পেশাদার ফিল্ম ক্রিটিক নই । কিন্তু একজন আইকনোক্লাস্ট, ফোটোগ্রাফারের ছেলে আর ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফার-চিত্রকরের নাতি এবং চিন্তার টেকনিশিয়ান হিসাবে অন্যান্য আইকনোক্লাস্টদের শ্রদ্ধা করি ; তাঁদের কাজ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহী। জাঁ লুক গোদার, যাঁর মৃত্যুতে উটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,  "তোমরা যারা সিনেমার ছাত্র, তাঁকে ভালোবাসো— তিনি আমাদের শেষতমদের আইকোনোক্লাস্ট, আ্যনার্কির মহা-মহাশয়, তিনি নিজেই তাঁর বিদায়কালের সময়টা বাছলেন— মনে রেখো তোমরা— এই ইস্কুল চলবে— বন্ধ হবেনা। আর আমাদের এই শোক বিশ্বজুড়ে এ মূহুর্তে রাজতন্ত্রের গেঁজিয়ে ওঠা শোকের মুখে সপাট খাবলে দিক। সিনেমার জয় হোক। আদিউ জিনিয়াস!" আমি এই আভাঁ গার্দ ইস্কুলের একজন ছাত্র । গোদার সম্পর্কে একসময়ে কিছু অনুবাদ করেছিলুম আর ওতেয়া তত্ব সম্পর্কে লিখেছিলুম । এখন ওনার জীবন আর সিনেমা সম্পর্কে আমার ভাবনা জড়ো করার চেষ্টা করছি  । 
    .
    মৃত্যুর জন্য গোদার যে ১৩ তারিখ বেছে নিলেন, সেটাও আমার মনে হয়েছে গোঁড়া খ্রিস্টধর্মীদের প্রতি ওনার বিদায়বার্তা । লাস্ট সাপার (যিশুর শেষ খাবার গ্রহণের রাত্রি)-এ ১৩ জন মানুষ ছিলেন এবং কথিত আছে যে ১৩ তম আসন গ্রহণের জন্য যিশু অথবা জুডাস (যিশুকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী) নিজে আগ্রহী ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন লাস্ট সাপার গ্রহণ করা হয়েছিল নিসান মাসের ১৩ তারিখে। নিসান হলো ইহুদী ক্যালেন্ডারের একটি মাস। আর কেউ কেউ বলেন ক্রুসবিদ্ধকরণের তারিখ-ও ছিল ১৩ নিসান।ইনকুইজিশনের সময়ে   ফাঁসি কাঠে ওঠার সিঁড়িতে ১৩টি ধাপ থাকত।প্রচলিত আছে যে কারোর নামে যদি ১৩টি অক্ষর থাকে, তবে তিনি অভিশপ্ত । ভাগ্য গণনার জন্য বহু বছরের পুরোনো যে অশুভ ট্যারট কার্ড রয়েছে তার মোট ৭৮টি কার্ডের ভিতরে ১৩ নম্বর কার্ডটির মানে হল মৃত্যু! । আগে বিমানে ১৩ নম্বরের কোনও সিট থাকত না। ইউরোপ বা বিশেষ করে আমেরিকায় বহুতল ভবনের লিফটে ১৩ নম্বরের কোনও বোতাম থাকে না, হোটেলে থাকে না ১৩ নম্বর গর। অভিত্তিকর শোনালেও বেশ কয়েকটি কুখ্যাত খুনিদের নাম যেমন, চার্লস ম্যানসন (Charles Manson), জ্যাক দ্য রিপার (Jack the Ripper), জেফরি দামের (Jeffrey Dahmer), থেডর বানডি (Theodore Bundy) এবং আলবার্ট ডি স্যালভো (Albert De Salvo) ১৩ অক্ষরের । Jean Luc Godard নামেও তেরোটি অক্ষর ।
    .
    ফরাসি-সুইস চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার,  চলচ্চিত্র পরিচালক,  এবং চলচ্চিত্র সমালোচক  জাঁ-লুক গোদার ৩ ডিসেম্বর ১৯৩০ সালে  প্যারিসের সপ্তম ওয়ার্ডে জন্মেছিলেন । তাঁর বাবা পল  গোদার ছিলেন একজন সুইস ডাক্তার এবং মা ওলদি মনোদ ছিলেন ব্যাঙ্ক পারিবাসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়েন মনোদের মেয়ে, ধর্মতত্ত্ববিদ আদলফ মনোদের প্রপৌত্রী। জাঁ লুক গোদারের  মায়ের পক্ষের অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যে উল্লেখ্য সুরকার জ্যাক-লুই মনোদ, প্রকৃতিবিদ থিওদোর মনোদ, যাজক ফ্রেদেরিক মনোদ, এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং পরে পেরুর রাষ্ট্রপতি পেদ্রো পাবলো কুকজিনস্কি। জাঁ-লুকের জন্মের চার বছর পর, তাঁর বাবা সপরিবারে ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ড চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  সময়, গোদার ফ্রান্সে ছিলেন এবং অসুবিধার কারণে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। তিনি যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে, যদিও তাঁর পরিবারের সদস্যরা জেনেভা হ্রদের ফরাসি দিকটায় তাঁর দাদুর  বাড়িতে লুকিয়ে যাতায়াত করতেন । তাঁর ধনী বাবা-মা ফ্রাঙ্কো-সুইস বংশোদ্ভূত প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারের সদস্য ছিলেন ।
    .
     জাঁ লুক পড়াশুনা করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের নিয়নে স্কুলে । ১৯৪৬ সালে, তিনি প্যারিসের বুফোঁ হাইস্কুলে ভর্তি হন আর বৈভবশালী পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্যারিসের  অভিজাত সাংস্কৃতিক সদস্যদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পান, অনেকটা তাঁর প্রিয় লেখক মার্সেল প্রুস্তের মতন । ১৯৪৮ সালে স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করে জাঁ লুক গোদার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানই লুসানে পড়াশোনা করতেন আর বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন, যাঁদের বিয়ে ভেঙে যাবার কানায় পৌঁছে গিয়েছিল।  তাঁর বড়ো বোন রাশেল তাকে আঁকতে উৎসাহিত করায় জাঁ লুক বিমূর্ত শৈলীতে আঁকা আরম্ভ করেন। থোননের একটা বোর্ডিং স্কুলে  আবার পরীক্ষা দেবার পর, জাঁ লুক পাস করে ১৯৪৯ সালে প্যারিসে ফিরে যান। জাঁ লুক প্যারিস সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু কখনও ক্লাস করেননি ।
    .
    ঘন ঘন সিনেমা দেখার নেশা ছিল না জাঁ লুক গোদারের ।  তিনি  আঁদ্রে ম্যালরোর প্রবন্ধ ‘আউটলাইন অফ আ সাইকোলজি অফ সিনেমা’ পড়ার পর  এবং ১৯৪৬  সালে যখন লা রেভ্যু দ্যু সিনেমা পত্রিকা আবার প্রকাশিত হওয়া আরম্ভ হলো, তখন  সিনেমার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে । প্যারিসে, ১৯৫০ সালের ঠিক আগে লাতিন কোয়ার্টারে, সিনে-ক্লাবগুলো (চলচ্চিত্র সমিতি) বুদ্ধিজীবীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । জাঁ লুক গোদার এইসব ক্লাবে যাতায়াত আরম্ভ করেন—সিনেম্যাথেক ফ্রানসেইজি, সিনে-ক্লাব দ্যু কোয়ার্টিয়ার ল্যাটিন (CCQL), ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার সিনে ক্লাব এবং অন্যান্য—সেগুলোতে গোদার নিয়মিত আড্ডা দিতে যেতেন । ১৯৩৬ সালে হেনরি ল্যাংলোই এবং গেয়র্গে ফ্রাঞ্জু  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সিনেমাথেক’। ‘ওয়ার্ক অ্যান্ড কালচার’ নামে শ্রমিকদের জন্য একটা শিক্ষা গোষ্ঠী আরম্ভ করেছিলেন অঁদ্রে ব্যাজাঁ, যে মঞ্চে যুদ্ধকালীন চলচ্চিত্র প্রদর্শন আর আলোচনা করা হতো, যা লিবারেশনের পরে পুরো ফ্রান্সে মডেল চলচ্চিত্র ক্লাব হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল ।  CCQL, যার প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ বা ১৯৪৮ সালে হয়, তা মরিস শেরারের নেতৃত্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
    এই ক্লাবগুলোতে তিনি জ্যাক রিভেত, ক্লুদ শ্যবরল এবং ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সহ  চলচ্চিত্র উৎহীদের সাথে আলাপ আলোচনার সুযোগ পান । বন্ধু সংসর্গে গোদার হয়ে উঠলেন এমন এক প্রজন্মের যুবক যাদের কাছে সিনেমা ব্যাপারটা  বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছিল। গোদার বলেছিলেন: "১৯৫০-এর দশকে সিনেমা ছিল রুটির মতো গুরুত্বপূর্ণ –-কিন্তু এখন আর তা নেই। আমরা ভেবেছিলাম সিনেমা  জ্ঞান প্রসারণের একটি যন্ত্র, একটি মাইক্রোস্কোপ... একটি টেলিস্কোপ হিসাবে নিজেকে জাহির করবে। সিনেমাথেকে  এমন এক জগত আবিষ্কার করেছিলাম, যে-বিষয়ে কেউ আমাকে আগে কিছু বলেনি। তারা আমাদের গ্যেটে সম্পর্কে বলতো, কিন্তু ড্রেয়ার সম্পর্কে নয়। আমরা টকির যুগেও নীরব চলচ্চিত্র দেখতাম। আমরা চলচ্চিত্রের স্বপ্ন দেখতাম। আমরা মাটির তলাকার ঘরে উপাসক খ্রিস্টানদের মতো ছিলাম।"
    .
    চলচ্চিত্রে গোদারের পথচলা শুরু হয় ফিল্ম সমালোচনার এলাকা থেকে । মরিস শেরার (যিনি এরিক রোহমার নামে খ্যাত) এবং জ্যাক রিভেতের সাথে, তিনি স্বল্পস্থায়ী চলচ্চিত্র জার্নাল ‘লা গেজেট দ্যু সিনেমা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ১৯৫০ সালে পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশ করে । যখন অঁদ্রে ব্যাজাঁ  ১৯৫০ সালে প্রভাবশালী সমালোচনামূলক ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema,[ সেনেমার নোটবুক ] শুরু করেন, তখন গোদার CCQL/Cinémathèque [ লাতিন কোয়ার্টারের সিনে ক্লাব/ফরাসি সিনেমাথেক] গোষ্ঠীর  প্রকাশিত সমালোচকদের মধ্যে  ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সী। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় রুডলফ ম্যাটে পরিচালিত একটি আমেরিকান মেলোড্রামা, ‘নো স্যাড সংস ফর মি’ ফিল্মের রিভিউ করেন গোদার। 
    ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তাঁর "ডিফেন্স অ্যান্ড ইলাস্ট্রেশন অফ ক্লাসিক্যাল ডিকোপেজ", প্রবন্ধে তিনি  অঁদ্রে ব্যাজাঁর একটি আগের নিবন্ধকে আক্রমণ করেন এবং শট-রিভার্স শট টেকনিকের ব্যবহারকে সমর্থন করেন, তা ছিল সিনেমা সমালোচনায় তাঁর প্রথম দিকের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির  একটি। অটো প্রিমিংগার এবং "সর্বশ্রেষ্ঠ আমেরিকান শিল্পী-হাওয়ার্ড হকস" এর প্রশংসা করে, গোদার তাদের কঠোর মেলোড্রামাগুলিকে "ওয়েলেস, ডি সিকা এবং ওয়াইলারের আরও "আনুষ্ঠানিক এবং প্রকাশ্যভাবে শিল্পপূর্ণ চলচ্চিত্রের ওপরে তুলে ধরেন, যা ব্যাজাঁ অনুমোদন করেছিলেন"। সেই মুহুর্তে গোদারের পরিকল্পনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ  ছিল না। বরং, তিনি চলচ্চিত্র দেখতেন, এবং সেগুলি সম্পর্কে লিখতেন, আর অন্যদের চলচ্চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করতেন, বিশেষত রোহমারকে, যাঁর সাথে তিনি Présentation ou Charlotte et son steak [ শার্লট এবং তার মাংসের ফালির উপস্হাপনা ] ফিলমে কাজ  করেছিলেন।
    .
    ফরাসি প্রভাবশালী ম্যাগাজিন Cahiers du Cinema-এর চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে তাঁর প্রথম কর্মজীবনের সময়, গোদার মূলধারার ফরাসি সিনেমার "ঐতিহ্যের গুণমান"-এর সমালোচনা করেন, যা উদ্ভাবন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিতো না। অমন সিনেমার প্রতিক্রিয়ায় , তিনি এবং সমমনা সমালোচকরা তাঁদের নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ  শুরু করেন, আর ফরাসী সিনেমার পাশাপাশি হলিউডের ঐতিহ্যকে  চ্যালেঞ্জ করেন। গোদার তাঁর প্রথম ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’-এর জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পাবার ফলে তিনি ও সমমনা বন্ধুরা ফরাসি La Nouvelle Vague [ নিউ ওয়েভ]  আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন । গোদারের কাজে পাওয়া যায় চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা, এবং প্রায়ই তাঁর রাজনৈতিক মতামতের প্রকাশ ; তিনি অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদী দর্শনের একজন আগ্রহী পাঠক ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী উপস্হাপনের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সঙ্গে  Dziga Vertov Group   [জিগা ভার্তোভ গ্রুপ ] গঠন করেন। নিউ ওয়েভের কিছুকাল পরে, তাঁর রাজনীতিতে উগ্রবাদ ফিকে হয়ে আসে আর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণের বদলে মানবতাবাদী বিশ্বাস, মানব সংঘাত এবং শৈল্পিক উপস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছে ।
    .
    ১৯৫২ সালের শরৎকালে প্যারিস ছাড়ার পর, গোদার সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান এবং লুসানে তাঁর মায়ের সঙ্গে থাকা আরম্ভ করেন । তিনি তাঁর মায়ের প্রেমিক, জাঁ-পিয়ের লবশারের বন্ধু হয়ে ওঠেন । লবশার গ্র্যান্ডে ডিক্সেন্স বাঁধের শ্রমিক ছিলেন। লবশার-এর মাধ্যমে গোদার বাঁধের প্লাজ ফ্লুরি  সাইটে  কর্মী হিসাবে চাকরি করা আরম্ভ করেন। তিনি বাঁধ নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কথাও ভেবেছিলেন । তাঁর প্রাথমিক চুক্তি শেষ হলে, চাকরির মেয়াদ বাড়াবার জন্য, গোদার টেলিফোন সুইচবোর্ড অপারেটর পদে যোগ দেন। ডিউটিতে থাকাকালীন, ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে, লবশারের ফোনে তিনি জানতে পারেন যে তাঁর মা ওদিল মনোদ  স্কুটার দুর্ঘটনায় মারা গেছেন । সুইস বন্ধুরা গোদারকে  একটা ৩৫ মিমি মুভি ক্যামেরা ধার দিয়েছিল । সেই ক্যামেরায় তিনি বাঁধটা নিয়ে একটা ফিল্ম তোলেন আর তার নাম দেন ‘অপারেশন কংক্রিট’ । বাঁধ পরিচালন সংস্থা ছবিটি কিনে নিয়ে প্রচারের উদ্দেশ্যে  ব্যবহার করতো ।
    .
    গোদার যখন Cahiers-এর জন্য কাজ করছিলেন, সেসময়ে জেনেভায় Une femme coquette (১৯৫৫), [ একজন ফ্লার্ট মহিলা ] নামে একটা দশ মিনিটের ছোট ফিল্ম তৈরি করেন; আর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে  প্যারিসে ফিরে যান। গ্যোটে-র ‘ইলেকটিভ অ্যাফিনিটিস’ নিয়ে ফিচার ফিল্মের  পরিকল্পনা রূপায়িত করতে পারবেন না অনুমান করে তা বাতিল করেন  । ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো সেসময়ে একজন ছিঁচকে অপরাধী মিশেল পোরতাইল-এর সত্যকার অপরাধ-জীবনের ঘটনা নিয়ে একটা  ভাবনাকে ফিল্মে রূপান্তরণের  জন্য গোদারের সাহায্য চান। মিশেল পোরতাইল একজন মোটরসাইকেল-আরোহী পুলিশকে গুলি করে আর তার বান্ধবী তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় । ফিল্মটা তুলতে ত্রুফো ব্যর্থ হন। কোনও আগ্রহী প্রযোজক পাননি তিনি। ত্রুফোর সাথে আরেকটা পরিকল্পনা, প্যারিসে আসা একটি গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে  কমেডি, তাও পরিত্যক্ত হয়েছিল। গোদার তখন দুই তরুণী, শার্লট এবং ভেরোনিকের জীবনকে কেন্দ্র করে একটা ছোটো ফিল্মে রোহমারের সঙ্গে কাজ করছিলেন; আর ১৯৫৭  সালের শরৎকালে, পিয়ের ব্রোনবেয়ার-এর  সিরিজের প্রথম ফিল্ম ‘অল দ্য বয়েজ আর কলড প্যাট্রিক’ , রোহমারের স্ক্রিপ্ট নিয়ে, গোদার পরিচালনা করেন।
    .
    ১৯৫৮ সালে ‘এ স্টোরি অফ ওয়াটার’  মূলত ত্রুফোর অব্যবহৃত ফুটেজ থেকে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে, জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং অ্যান কোলেটকে নিয়ে গোদার তাঁর শেষ ছোটো ফিল্ম Charlotte et son Jules [ শার্লট এবং তাঁর জুলস] তৈরি করেন, যেটা ছিল কবি ও ফিল্মনির্মাতা জাঁ ককতোর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন । ফিল্মটা গোদারের রেনে রোডের হোটেলঘরে শ্যুট করা হয়েছিল আর ফিল্মটায় সেই সময়ে গোদারের নিজের জীবনের ‘টাকা বাঁচানোর রোমান্টিকতা’ প্রতিফলিত হয়েছিল। তার সুইস বন্ধু রোল্যাঁ টলম্যাচফ জানিয়েছেন যে; "প্যারিসে গোদারের হোটেলের  দেওয়ালে শুধু একটা হামফ্রি বোগার্ট পোস্টার ছিল আর অন্য কিছুই ছিল না।”
    .
    ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বরে, গোদার ত্যুরের ফেস্টিভ্যাল অফ শর্ট ফিল্ম  থেকে প্রতিবেদন পাঠান আর জ্যাক ডেমি, জ্যাক রোজিয়ার এবং অ্যাগনেস ভার্দার কাজের প্রশংসা করেন এবং তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব পাতান–-তিনি আগে থেকেই অ্যালাইন রেসনাইসকে চিনতেন যার ফিল্মের তিনি প্রশংসা করেন । কিন্তু গোদার এই সময়ে চাইছিলেন নিজের একটা ফিচার ফিল্ম তৈরি করতে।  ১৯৫৯ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়ে গোদার ত্রুফোকে অনুরোধ করেন সেই গাড়ি চোর মিশেল পোরতাইল সম্পর্কে ১৯৫৬ সালে যে গল্পটা তাঁরা করতে চেয়েছিলেন তা তাঁকে ব্যবহার করতে দিতে । গোদার প্রযোজক জর্জ দ্য বোগোদেয়ারকে প্রস্তাব দিলেন ফিল্মটার জন্য টাকা খরচ করতে । গোদার তাঁর সাথে আগে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সের প্যারিস অফিসের প্রচার বিভাগে কিছুদিন কাজ করার সময় থেকে তাঁকে জানতেন । বোগেদেয়ার পিয়েরে লোটির গল্পের উপর ভিত্তি করে দুটি প্রযোজনা করে বেশ ঋণী হয়ে গিয়েছিলেন । শেষে, ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটর রেনে পিগনিয়েরেসের কাছ থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব পেলেন গোদার।
    .
    ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, অ্যাগনেস ভার্দা, এরিক রোহমার এবং জ্যাক ডেমির মতো চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে তিনি ষাটের দশকের ফরাসি নিউ ওয়েভ ফিল্ম আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি  যুদ্ধোত্তর যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি পান । আখ্যান, ধারাবাহিকতা, শব্দ এবং ক্যামেরাওয়ার্ক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর কাজ "মোশন পিকচার ফর্মে বিপ্লব ঘটিয়েছে"। তাঁর সর্বাধিক প্রশংসিত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে উল্লেখ্য : ব্রেথলেস (১৯৬০ ), ভিভরে সা ভি (১৯৬২), কনটেম্পট (১৯৬৩), ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স (১৯৬৪), আলফাভিল (১৯৬৫ ), পিয়েরোট লে ফাউ (১৯৬৫), ম্যাসকুলিন ফেমিনিন (১৯৬৬), উইকেন্ড (১৯৬৭ ) ), ভাষাকে বিদায় (২০১৪)। পরিচালক হিসেবে গোদারের সবচেয়ে চর্চিত সময়কাল তাঁর প্রথম ফিচার ফিল্ম ব্রেথলেস ( ১৯৬০) থেকে উইক এন্ড (১৯৬৭ ) পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সময়ে করা তাঁর কাজগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচলিত চলচ্চিত্রের থেকে তাঁর শৈল্পিক পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয় । যদিও এই সময়ের কাজগুলো গোদারের ফিল্মনির্মাণ জীবনের নিজস্বভাবে যুগান্তকারী হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, তবে পরবর্তী সময়ে গোদার আদর্শগতভাবে সিনেমার ইতিহাসের বেশিরভাগ অংশকে বুর্জোয়া হিসাবে নিন্দা করেছেন আর বলেছেন তারা যোগ্যতাহীন ।
    .
    গোদারের জলবিভাজক ফিল্ম ‘ব্রেথলেস’ (À bout de souffle, ১৯৬০ ), জাঁ-পল বেলমন্ডো এবং জিন সেবার্গ অভিনীত ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের শৈলীকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছিল যদিও জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে তৈরি হয়েছিল— বিশেষ করে আমেরিকান সাদাকালো ফিল্ম থেকে । ফিল্মটিতে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে যেমন জাম্প কাটের উদ্ভাবনী ব্যবহার (যা সেই সময়ে অপেশাদার হিসেবে বিবেচিত হতো), চরিত্রকে বাদ দিয়ে, এবং ধারাবাহিকতা  বর্জনের উদ্দেশে সম্পাদনায় দৃষ্টিরেখার মিল ভাঙা। ব্রেথলেসের আরেকটি অনন্য দিক ছিল শুটিংয়ের দিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্রনাট্য লেখা - এমন একটি কৌশল যা অভিনেতাদের অস্থির করে তুলেছিল - যা চলচ্চিত্রের স্বতঃস্ফূর্ত, তথ্যচিত্রের মতো পরিবেশে, ছিল নতুন অবদান।
    .
    তাঁর কর্মজীবনের শুরু থেকে, গোদার তাঁর ফিল্মে নিউ ওয়েভ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি চলচ্চিত্রের উল্লেখ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ব্রেথলেস-এ, তার উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে রয়েছে হামফ্রে বোগার্টকে দেখানো একটি সিনেমার পোস্টার— দ্য হার্ডার দ্য ফল থেকে, তাঁর শেষ চলচ্চিত্র–(যাঁর অভিব্যক্তি প্রধান অভিনেতা জাঁ-পল বেলমন্ডো শ্রদ্ধার সাথে অনুকরণ করার চেষ্টা করেন) — ইঙ্গমার বার্গম্যান, স্যামুয়েল ফুলার, ফ্রিৎস লাঙের চলচ্চিত্রের ভিজ্যুয়াল উদ্ধৃতি ; এবং মনোগ্রাম পিকচার্সের প্রতি একটি অনস্ক্রিন উৎসর্গ, একটি আমেরিকান বি-মুভি স্টুডিও। যাঁদের উদ্ধৃতি, এবং সাহিত্যের উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন উইলিয়াম ফকনার, ডিলান থমাস, লুই আরাগঁ, রিল্কে, ফ্রাসোয়াঁ সাগাঁ এবং মরিস শ্যাক্স প্রমুখ। ছবিটিতে ইমেজ বা সাউন্ডট্র্যাকের উদ্ধৃতিও রয়েছে—মোৎসার্ট, পিকাসো, জে এস বাখ, পল ক্লি এবং অগাস্ট রেনোয়ার। ব্রেথলেস ফিল্মটা পরিচালকের অভিজ্ঞতা নয়, তাঁর উপস্থিতিকে জাহির করেছে ।
    .
    ১৯৬৮ সালের মে মাসের ঘটনার পর, যখন প্যারিস শহর চার্লস দ্য গলের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে  একটি যুবছাত্র  উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিল তখন গোদার তাঁর পেশাগত উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হব। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে সমমনা লোকেদের সাথে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সহযোগী ছিলেন জাঁ-পিয়ের গোরাঁ,  (লুই আলথুসার, মিশেল ফুকো এবং জ্যাক লাকাঁর মাওবাদী ছাত্র )। গোরাঁর সিনেমার প্রতি আবেগ গোদারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। 
    .
    ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে, গোদার আর গোরাঁ দুজনে মিলে মাওবাদী বার্তা প্রচারের  মোট পাঁচটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সহযোগিতার সবচেয়ে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রটি ছিল Tout Va Bien [সবকিছু ভালোভাবেই চলছে] ( ১৯৭২ )। ফিল্মে জেন ফন্ডা অভিনয় করেছিলেন, যিনি সেই সময়ে ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা রজার ভাদিমের স্ত্রী ছিলেন। ফন্ডা তাঁর অভিনয় জীবনের তুঙ্গে ছিলেন সেসময়ে , সদ্য Klute (১৯৭১ ) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য একাডেমি পুরস্কার জিতেছেন এবং একজন বামপন্থী যুদ্ধবিরোধী কর্মী হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। নায়ক ছিলেন কিংবদন্তি ফরাসি গায়ক এবং অভিনেতা ইভেস মন্ট্যান্ড, যিনি জর্জেস ক্লুজট, অ্যালেন রেসনাইস, সাচা গুইট্রি, ভিনসেন্টে মিনেলি, জর্জ কুকর এবং কোস্টা-গাভরাসের  চলচ্চিত্রগুলিতে অভিনয় করেছিলেন।
    .
    ১৯৬৮ সালের মে থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত গোদারের জীবনের বিস্তৃত সময়কালকে বিভিন্ন লেবেল দেওয়া হয়েছে - তাঁর "জঙ্গি" সময় থেকে তাঁর "রেডিকাল” বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের  সাথে "মাওবাদী" হিসাবে চিহ্ণিত হয়েছেন  এবং "রাজনৈতিক" ফিল্মনির্মাণকারী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছেন।  এই কালখণ্ডে গোদার তাঁর চলচ্চিত্রে এবং সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায়  বৈপ্লবিক সমাজবদলের ওপর জোর দিয়েছেন। ১৯৬৮  সালে ছাত্রদের মে মাসের অভ্যুত্থানে অনুপ্রাণিত হয়ে, গোদার, ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’র সাথে, ছাত্র ও শ্রমিকদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৯৬৮ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবকে বন্ধ করে দিতে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। শ্রমিকদের গোদার বলেছিলেন যে উৎসবে একটিও চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে না যা তাদের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে। "একটি ফিল্মও নয়, তা সে ফরম্যান মিলোস , আমি নিজে, রোমান পোলানস্কি বা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, যারই হোক না কেন। একটাও ফিল্ম নেই। আমরা সময়ের থেকে অনেক পেছনে রয়েছি।”
    .
    ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে গোদার "রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ" সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। যদিও ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত তাঁর অনেকগুলি ফিচার-দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ছিল কম বাজেটের এবং এই ফিল্মগুলোয় একটা চলচ্চিত্র কী হতে পারে তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে আরম্ভ করেন। মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ পরিত্যাগ করার পাশাপাশি, গোদার তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্বের কাল্ট থেকেও মুক্তি পেতে চাইছিলেন । তিনি অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে  বেনামে কাজ করছিলেন, বিশেষত জাঁ-পিয়ের গোরাঁর সঙ্গে , যাদের নিয়ে তিনি জিগা-ভার্তোভ সিনেমা গোষ্ঠী গঠন করেছিলেন। এই কালখণ্ডে গোদার ইংল্যান্ড, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, প্যালেস্টাইন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ফ্রান্সেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
    .
    তিনি এবং গোরাঁ তাঁদের ফিল্ম নিয়ে বিভিন্ন কলেজে গিয়ে বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করতেন ।  ইয়েভেস মন্ট্যান্ড আর জেন ফন্ডা অভিনীত বেশি বাজেটের ফিল্ম Tout Va Bien [ সবকিছু ভালোভাবেই চলছে ] তৈরি করার সময়ে তাঁর জীবনের বাঁকবদল ঘটলো । একটি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে গোদার গুরুতরভাবে আহত হবার ফলে গোরাঁ প্রায় এককভাবে  তাঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত এই কাজটি পরিচালনা করেছিলেন। Tout va bien-এর পরবর্তী পর্ব হিসাবে, তাঁরা দুজনে Letter to Jane নামে একটি পঞ্চাশ মিনিটের ফিল্ম তৈরি করেন যাতে  জেন ফন্ডার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ভিয়েত কং যোদ্ধাদের সাথে মেলামেশার স্হির ছবিগুলোকে সাজিয়ে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রটি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিনির্মাণ। এটাই ছিল গোদার আর গোরাঁর একসঙ্গে তৈরি শেষ চলচ্চিত্র।
    .
    গোদার  তাঁর "উগ্র রাজনৈতিক মতামত" এর জন্য পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে নিয়মিত রাজনৈতিক বিষয়বস্তু দেখাতেন। তাঁর প্রথম দিকের ফিল্মগুলোর মধ্যে একটি, দ্য লিটল সোলজার, যার বিষয়বস্তু ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ,  বিবাদটার জটিলতা উপস্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য উল্লেখ্য ।  আন্তর্জাতিক সমস্যার পাশাপাশি গোদার  ফ্রান্সের সামাজিক সমস্যা নিয়ে বিচলিত ছিলেন। এর প্রথম এবং সর্বোত্তম উদাহরণ হল Vivre sa vie-[বেঁচে থাকো]তে কারিনার  পতিতা চরিত্রে শক্তিশালী চিত্রায়ন। ষাটের দশকের প্যারিসে, রাজনৈতিক পরিবেশ কোনও একটা নির্দিষ্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েনি ; নানা ছোটোবড়ো আন্দোলন চলছিল ।  উত্তর আফ্রিকা আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপনিবেশগুলোর  আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে যুদ্ধ-পরবর্তী একটি স্বতন্ত্র আবহাওয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল ফরাসি সমাজে। La Chinoise এবং Weekend ফিল্মের পর গোদারের মার্কসবাদী মনোভাব স্পষ্ট হতে থাকে, আর তা ধরা পড়ে তাঁর  Pierrot [চড়ুই ] আর Une femme mariée [একজন বিবাহিতা মহিলা ] ফিল্মগুলোতে ।
    .
    জার্মান কবি ও নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের সাথে গোদারের সম্পর্ক ছিল মূলত ব্রেখটের এপিক থিয়েটারের তত্ত্বকে ফিল্মে প্রয়োগ ।  ব্রেখটের প্রভাব গোদারের বেশিরভাগ কাজে গভীরভাবে অনুভূত হয়, বিশেষ করে ১৯৮০ সালের আগে, যখন গোদার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সিনেমাটিক অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন। যেমন, ব্রেথলেস ফিল্মে  এলিপটিকাল সম্পাদনা, যা দর্শককে মূলধারার সিনেমার  সরল ন্যারেটিভ শৈলীকে বর্জন  করে দেখায়, দর্শকদের আরও সমালোচনামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য করে । গোদারের বেশিরভাগ রাজনৈতিক ফিল্মে , বিশেষ করে Weekend, Pierrot le fou এবং La Chinoise-তে  চরিত্রগুলো সরাসরি দর্শকদের চিন্তাভাবনা, অনুভূতিকে বার্তা পাঠায় ।
    .
    গোদারের প্রথম দিকের সব কয়টা ফিল্মে দেখা না গেলেও বেশিরভাগ ফিল্মের মার্কসবাদী পাঠ সম্ভব। মার্কসবাদের সাথে গোদারের সরাসরি মিথস্ক্রিয়া Weekend ফিল্মের আগে স্পষ্ট নয়, যে ফিল্মে কার্ল মার্কস নামটি যিশু খ্রিস্টের মতো অবতারের সঙ্গে একইসাথে উচ্চারিত। গোদারের সিনেমার পুরো কালখণ্ড জুড়ে একটা নিরবিচ্ছিন্ন অভিযোগ হল বুর্জোয়াদের ভোগবাদ, দৈনন্দিন জীবন ও কার্যকলাপের পণ্যীকরণ, এবং মানুষের এলিয়েনেশান—- মার্কসের পুঁজিবাদের সমালোচনার সমস্ত কেন্দ্রীয় বিতর্ক।
    .
    ১৯৬৮ সালে দুই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, জাঁ-লুক গোদার এবং জাঁ-পিয়ের গোরাঁ জিগা ভার্তোভ গ্রুপ নামে একটা গোষ্ঠী তৈরি করেন। জঁ অঁরি রোজে এবং আরমাঁ ম্যাকো ১৯৬৯ সালে এই গোষ্ঠীতে যোগদান করেন। তাদের চলচ্চিত্রগুলো প্রাথমিকভাবে ব্রেখটিয়ান আঙ্গিক, মার্কসবাদী মতাদর্শ এবং রচনা থেকে  লেখকর স্বামীত্ব বাদ দেবার প্রচেষ্টা দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়েছিল। ১৯২০-৩০ এর দশকের সোভিয়েত চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিজিগা ভার্তোভের নামে এই গ্রুপটা ১৯৭২ সালের Letter to Jane : An Investigation About a Still-এর  পরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
    .
    এটা ছিল প্যারিসের ষাটের দশকের ছাত্র-বিপ্লবের পৃষ্ঠপটে  রাজনৈতিকভাবে র‌্যাডিক্যাল ফিল্ম গোষ্ঠী । মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং মাওবাদী তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, যা প্যারিসের সেই সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আবহাওয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল আর ফিল্মনির্মাণকে বুর্জোয়া উদ্যোগের  মর্যাদায়  অসন্তুষ্ট হয়ে এই গোষ্ঠীটি কেবল রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণ নয়, ‘রাজনৈতিকভাবে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূত্রপাতের পর বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশেষ করে ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিদেশ নীতির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর জন্ম ঘটিয়েছিল, যারা চলচ্চিত্রকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা জাঁ লুক গোদার এবং জাঁ পিয়ের গোরাঁর নেতৃত্বে জিগা ভার্তোভ গ্রুপ ছিল সত্যিকার অর্থে  সম্ভাবনাপূর্ণ রাজনৈতিক সিনেমার ব্র্যান্ড গড়ে তোলার  এমনই একটি প্রচেষ্টা।
    .
    জিগা ভার্তোভ গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত সিনেমাটিক ব্যবস্হার প্রতিটি দিককে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিল এবং তার দরুন, নির্দিষ্ট কয়েকটি সহমর্মী সম্প্রদায়ের বাইরে খুব কম প্রচারিত হয়েছে ও দর্শক আকৃষ্ট করতে পেরেছে।  একটি বিপ্লবী সিনেমার উদ্দেশ্যে কাজ করার এবং প্রযোজনা, নির্দেশনা এবং প্রদর্শনীর জনপ্রিয় মডেলগুলিকে প্রত্যাখ্যান করার এই বিরোধিতামূলক অবস্থান গোষ্ঠীর পক্ষে এক ধরণের অচলাবস্থা তৈরি করে দিয়েছিল। যাইহোক, সত্যিকারের রাজনৈতিক আকাঙ্খা রয়েছে এমন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের আর সংশ্লিষ্ট লোকজনদের জন্য এই গোষ্ঠীর চলচ্চিত্রগুলি অপরিহার্য সমাবেশ-কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল ।
    .
    Letter to Jane  (১৯৭২ ) ছিল  একটি ফিচার-ফিল্ম দৈর্ঘ্যের প্রযোজনা যা   উত্তর ভিয়েতনামী প্রতিরোধ বাহিনীর মাঝে শুধুমাত্র জেন ফণ্ডার স্থির ছবি জুড়ে-জুড়ে  ঐতিহাসিক, নান্দনিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে   একক চিত্রকে কঠোরভাবে বিশ্লেষণ করেছে। অকল্পনীয়ভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নির্মমভাবে সমালোচনামূলক, ছবিটি ইমেজ তৈরির রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয় ফিল্ম। সম্ভবত অন্য যে-কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের চেয়ে বেশি, জিগা ভার্তোভ গ্রুপটি প্রচলিত সিনেমাটিক মডেলকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তার মানে কেবল জনপ্রিয় সিনেমা এবং আর্টহাউস প্রযোজনা উভয়েরই প্রত্যাখ্যান নয়, যাকে গ্রুপটা মনে  করেছিল যে ওগুলো শুধু প্রভাবশালী পুঁজিবাদী মতাদর্শকে সমর্থন করে আর  প্রযোজনা, বিতরণ এবং প্রদর্শনীর পুঁজিবাদী মডেলগুলোকে রক্ষা ধরে। প্রতিরূপের সমস্যাটি ছিল জিগা ভার্তোভ গ্রুপের অন্যতম দুশ্চিন্তা, যা চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয় ইমেজ তৈরির  রাজনৈতিক অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করতে চাইছিল। নন-ন্যারেটিভ এবং প্রাবন্ধিক বিন্যাস প্রয়োগ করে, গোষ্ঠীর ফিল্মগুলো শব্দ, ইমেজ এবং দর্শকদের একটি অসংলগ্ন কেরামতির মাধ্যমে ব্যবহার করতো যাতে মানে তৈরির প্রক্রিয়ায় তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য  প্ররোচিত হয়। এই চলচ্চিত্রগুলি  লেখকসত্বের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করতো, যা স্পষ্ট হয়ে উঠতো তাদের যৌথ স্বাক্ষর থেকে ।
    .
    গোদার তাঁর পরিচালিত ফিল্মের দুই নায়িকাকে বিয়ে করেছিলেন: আনা কারিনা (১৯৬১-১৯৬৫) এবং অ্যান উইজেমস্কি (১৯৬৭-১৯৬৯)। ১৯৭০ সালের শুরুতে, তিনি অ্যান-মারি মিভিলের সাথে ফিল্ম নির্মাণের সূত্রে পেশাগতভাবে এক সঙ্গে কাজ করা আরম্ভ  করেন। গোদার ১৯৭৮ সাল থেকে সুইজারল্যান্ডের রোলেতে মিভিলের সাথে বসবাস করতেন ।তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী করিনা গোদারকে "নির্জনবাসী" হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷ গোদারের একজন উপদেষ্টা প্যাট্রিক জেনারেটের মতে, ২০১০ সালে গোদার মিভিলকে বিয়ে করেন৷
    .
    কারিনার সাথে তাঁর সম্পর্কের সময়ে গোদার সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত কয়েকটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে সংবাদপত্র ও পত্রিকায় ব্যাপকভাবে খবর বেরোতো: দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট তাঁদের  দুজনকে “১৯৬০ এর দশকের সবচেয়ে বিখ্যাত জুটিগুলির মধ্যে একটি" হিসাবে বর্ণনা করেছিল৷ ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্কে লিখেছিল, "তর্কাতীতভাবে   সবচেয়ে প্রভাবশালী জুটি যাঁরা সিনেমার ইতিহাসে স্বাক্ষর রেখে গেছেন।" জীবনের শেষ দিকে,, করিনা বলেছিলেন যে তাঁরা আর একে অপরের সাথে কথাবার্তা বলেন না।
    .
     মিশেল অ্যাভেনিয়াশূ ২০১৭ সালে ওয়ান ইয়ার আফটার (ফরাসি: Un an après; ২০১৫) নামে ওয়াইজামস্কির লেখা  স্মৃতিকথার উপর ভিত্তি করে গোদার সম্পর্কে  Redoubtable ফিল্ম চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন। ফিল্মটা ষাটের দশকের শেষের দিকে তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে তৈরি, যখন গোদার আর ওয়াইজেমস্কি একসঙ্গে ফিল্ম  তৈরি করতেন। ফিল্মটা ২০১৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। গোদার বলেছিলেন যে ছবিটা তৈরি করার ধারণা একদম বোকা, বোকা ।
    .
    করিনার সাথে তার সহযোগিতায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ফিল্ম তৈরি হয়েছিল, যেমন Vivre sa vie ( ১৯৬২ ) Bande a part  [Keeping to Himself]( ১৯৬৪ ),  এবং Pierrot le Fou (১৯৬৫ ) যেগুলো সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল ফিল্মগুলো "তর্কাতীতভাবে সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী কাজ" । ফিল্মমেকার ম্যাগাজিন ২০০২  সালের একটি ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ জরিপে, জাঁ লুক গোদার সর্বকালের সেরা দশ জন পরিচালকের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ২০১০ সালে, গোদার একাডেমির অনারারি পুরস্কারে ভূষিত হন, কিন্তু তিনি পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাননি ।
    .
    গোদার Sauve qui peut ( la vie)[Save Who Can-Life] ( ১৯৮০) ফিল্মের সময় থেকে কিছুটা ঐতিহ্যগত কথাসাহিত্যে ফিরে যান, যেগুলোতে  আত্মজীবনীমূলক ঘটনার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় । তিনি মূলধারার চলচ্চিত্রগুলোর অনুসরণে একটি সিরিজের করেন: Passion, ( ১৯৮২ )Lettre to   à Freddy Buach [ফ্রেদি বুয়াচকে লেখা চিঠি ]( ১৯৮২ ) ,Prenom Carmen [Name Carmen] ( ১৯৮৩ ) এবং Grandeur et decadence d’un petit commerce de cinema [ একটি ছোট সিনেমা ব্যবসার উত্থান এবং পতন] ( ১৯৮৬ ) ।  Je vous salue, Marie [ আপনাকে সেলাম মারি] ( ১৯৮৫) ফিল্মটা নিয়ে আরেকটা বিতর্কের ঝড় উঠেছিল, যেটাকে রোমান ক্যাথলিক চার্চ  ধর্মদ্রোহিতার নামে  নিন্দা করেছিল আর এছাড়াও উইলিয়াম শেক্সপিয়রকে নিয়ে  প্রবন্ধমূলক চলচ্চিত্র King Lear ( ১৯৮৭ ) নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয় ।
    .
    তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলি অসাধারণ আনুষ্ঠানিক সৌন্দর্য এবং প্রায়শই শোকের অনুভূতিতে প্রচ্ছন্ন : Nouvelle Vague  (নিউ ওয়েভ, ১৯৯০), আত্মজীবনীমূলক JLG/JLG, autoportrait de decembre (JLG/JLG: সেলফ-পোর্ট্রেট ইন ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ), এবং For Ever Mozart (১৯৯৬)। Allemange annee 90 neuf zero (জার্মানি ইয়ার 90 নাইন জিরো, ১৯৯১ ) যা Alphaville ফিল্মের পরিশিষ্ট, তবে ফিল্মটিতে  সুমধুর এলেজিয়াক  সুরের মিশ্রণ ছিল এবং বয়সের অনিবার্য ক্ষয়কে প্রদর্শন করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে, গোদারকে ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ফিল্ম ক্রিটিকস-এর পক্ষ  থেকে একটি বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮-এর মাঝে, তিনি বহু-অংশযুক্ত Histoire( s ) du cinema সিরিজ  তৈরি করেছিলেন ; এটি একটি স্মারক প্রকল্প যা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সমস্যাগুলি নিয়ে তৈরি ।
    .
    ২০০১ সালে, Éloge de l'amour (In Praise of Love) মুক্তি পায়। সিনেমাটায় ফিল্ম আর ভিডিও দুটিরই ব্যবহার করেছিলেন গোদার  - প্রথমার্ধটি ৩৫ এমএম কালো এবং সাদাতে তোলা হয়েছে, পরবর্তী অর্ধেক ডিজিটাল ভিডিওতে রঙিন শট নেয়া হয়েছে - তারপর তাকে  সম্পাদনার জন্য চলচ্চিত্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ফিল্মটায় বার্ধক্য, প্রেম, বিচ্ছেদ আর ফিরে পাওয়াকে বিষয়বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে । ফিল্মটায়  এডগার নামের এক তরুণ শিল্পীর  প্রেমের চারটি পর্যায়কে পর্যালোচনা করা হয়েছে ।  Notre musique [ আমাদের সঙ্গীত] (২০০৪) ফিল্মে  গোদার আরেকবার যুদ্ধের দিকে দর্শকদের চোখ আর মনকে ফেরত নিয়ে আসেন, বিশেষ করে সারাজেভোর যুদ্ধ, এমনকি নানা যুদ্ধের ক্ষতিকর দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান, যেমন আমেরিকান গৃহযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে যুদ্ধ এবং ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত সহ সমস্ত যুদ্ধের দিকে ক্যামেরার চোখ ঘুরিয়ে ছিলেন গোদার। ফিল্মটি ডিভাইন কমেডির তিনটি দান্তীয় স্তরকে অবলম্বন করে তৈরি: নরক, প্রায়শ্চিত্তের এলাকা এবং স্বর্গ। কূটাভাসের প্রতি গোদারের আকর্ষণ এই ফিল্মের দেখতে পাওয়া যায় । ফিল্মটি যুদ্ধের ছবিগুলোর একটা দীর্ঘ, বিস্ময়কর মন্তাজ দিয়ে শুরু হয় যা মাঝে মাঝে হাস্যরসের উদ্রেক করে । দেখানো হয়েছে সমুদ্র সৈকতে  মার্কিন সৈন্যরা গাছগাছালিতে ভরা স্বর্গে অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে ।
    .
    গোদারের Film Socialisme [চলচ্চিত্র সমাজতন্ত্র] (২০১০)  কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে Un Certain Regard [ In Some Perspective] বিভাগে ২০১০ সালেই প্রিমিয়ার হয়েছিল। ফিল্মটা ২০১০  সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। ২০১৩ সালে, গোদার Les trois désastres (The Three Disasters) চলচ্চিত্র নির্মাতা পিটার গ্রিনওয়ে আর এডগার পেরার সাথে  3X3D এর অংশ হিসাবে তৈরি করেন। 3X3D ২০১৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিল। গোদারের ২০১৪  সালের চলচ্চিত্র Goodbye to Language, থ্রি ডাইমেনশনে তোলা, এমন এক দম্পতিকে ঘিরে যারা একে অপরের সাথে বার্তা বিনিময় করতে পারেন না আর তাই তাদের পোষা কুকুর তাদের জন্য দোভাষী হিসাবে কাজ করে । ফিল্মটিতে নিকোলাস ডি স্টায়েলের চিত্রকর্ম এবং উইলিয়াম ফকনারের লেখার  বিস্তৃত  উল্লেখ আছে, সেইসাথে গণিতবিদ লরেন্ট শোয়ার্টজের প্রসঙ্গে এবং নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের কথা —গোদারের ওপর যাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ফিল্মটা ২০১৪ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রধান প্রতিযোগিতা বিভাগে পালমে ডি'অরের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল আর  জুরির পুরস্কার পায় । চলচ্চিত্রটির জন্য ব্যবহৃত গোদারের হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট আর ছবির কোলাজকে শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল ।
    ..
    ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে, মিলানের ফন্ডাজিওন প্রাদা-তে গোদারের তৈরি একটি আর্ট ইনস্টলেশন দেখানো হয়। লে স্টুডিও ডি'অর্ফি শিরোনাম, ইনস্টলেশনটি গোদারের একটি পুনঃনির্মিত কর্মক্ষেত্র হিসেবে উপস্হাপিত হয়েছিল আর সেখানে সম্পাদনা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র এবং গোদারের পোস্ট-প্রোডাকশনে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণ রেখে প্রদর্শনী করা হয়েছিল ।
    .
    গোদার ২০২০ সালে Les Inrockuptibles পত্রিকাকে বলেছিলেন যে তাঁর নতুন ফিল্মটা একজন  “হলুদ ভেস্ট প্রতিবাদী” সম্পর্কে হবে এবং ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আর্কাইভাল ফুটেজের সাথে  শুটিংও হবে। আমি জানি না যে  অভিনেতাদের খুঁজে পাব কিনা... আমরা নিউজ চ্যানেলে যে লোকদের দেখি তাদের নিয়ে ফিল্ম করতে চাই আর তাদের এমন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই যেখানে তথ্যচিত্র এবং কথাসাহিত্য এক হয়ে যায়।" ২০১৮ সালের মে মাসে পোস্ট করা একটা অনলাইন পিটিশন প্রায় দশ লক্ষ লোক স্বাক্ষর  করার পরে, ফ্রান্সে ১৭ নভেম্বর গণবিক্ষোভ শুরু হয় যাতে সরকারি হলুদ ভেস্ট পরা প্রতিবাদীর সংখ্যা বেশি ছিল। আন্দোলনটি প্রাথমিকভাবে অপরিশোধিত তেল আর জ্বালানীর দাম বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে শুরু হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা যুক্তি দিয়েছিল যে ফ্রান্সে করের একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বোঝা শ্রমিক এবং মধ্যবিত্তদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ।
    .
    ২০২১ সালের মার্চ মাসে  কেরালার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি ভার্চুয়াল সাক্ষাৎকারের সময় গোদার বলেছিলেন যে তিনি দুটি নতুন ছবি নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। গোদার বলেছিলেন "আমি আমার চলচ্চিত্র জীবন শেষ করছি - হ্যাঁ, আমার চলচ্চিত্র নির্মাতা জীবন - দুটি স্ক্রিপ্টের ফিল্ম করে... তারপর, আমি বলব, 'বিদায়, সিনেমা'।
    .
    গোদার  বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম নেতা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৯ সালে, চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট সিনেমায় গোদারের গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছিলেন: “গোদার একেবারে প্রথম সারির একজন পরিচালক; ষাটের দশকে অন্য কোনো পরিচালক ফিচার-লেংথ ফিল্মের বিকাশে তাঁর চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেনি। কথাসাহিত্যে জয়েস বা থিয়েটারে বেকেটের মতো, তিনি একজন পথপ্রদর্শক যাঁর বর্তমান কাজ সাধারণ দর্শকদের কাছে ততো গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু অন্যান্য পরিচালকদের উপর তাঁর প্রভাব ধীরে ধীরে এমন একদল দর্শক তৈরি এবং শিক্ষিত করে তুলছে যা, সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলির দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য  হবে এবং দেখতে পাবে যে এখান থেকেই তাদের সিনেমা শুরু হয়েছিল। চলচ্চিত্র নির্মাতা কুয়েন্টিন ট্যারান্টিনো একটি প্রযোজনা সংস্থার নাম দেন ‘এ ব্যান্ড অ্যাপার্ট’, যা ছিল গোদারের ১৯৬৪ সালের এক চলচ্চিত্রের নাম। ইতালীয় পরিচালক বার্নার্ডো বার্তোলুচ্চি তাঁর চলচ্চিত্র দ্য ড্রিমার্স-এ গোদারের ‘ব্যান্ড অফ আউটসাইডার্স’ ফিল্মকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে ছিলেন।
    .
    গোদারের কাজ এবং উদ্ভাবনগুলো মাইকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি, সত্যজিৎ রায় এবং অরসন ওয়েলেসের মতো উল্লেখযোগ্য পরিচালকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে । পরিচালক হিসেবে গোদারের অসাধারণ ফিল্মনির্মাণের কারণে ফ্রিটজ ল্যাং গোদারের চলচ্চিত্র Le Mepris-এ অংশ নিতে রাজি হন। আকিরা কুরোসাওয়া 'ব্রেথলেস'কে তাঁর একশোটি প্রিয় চলচ্চিত্রের অন্যতম হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন৷ রাজনৈতিক কর্মী, সমালোচক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা তারিক আলী ২০১২  সালের সাইট অ্যান্ড সাউন্ড সমালোচকদের জরিপে গোডার্ডের চলচ্চিত্র Tout Va Bien-কে তাঁর সর্বকালের দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন৷ মার্কিন ফিল্ম সমালোচক আরমন্ড হোয়াইট একই জরিপে গোদারের ফিল্ম Nouvelle Vagueকে তাঁর সেরা দশটি প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছেন।
    .
    ভারতে, Adieu Godard ফিল্মের প্রযোজক স্বস্তিক চৌধুরী বলেছেন যে অনুরাগ কাশ্যপের ‘গুলাল’, ‘দেব.ডি’ এবং ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’-এর মতো চলচ্চিত্রগুলি গোদারের নিয়ম ভাঙা সিনেমার সাক্ষ্য দেয়। পরিচালক কমল স্বরূপের ‘ওম-দার-বি-দার’, ভারতের ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দ্বারা প্রযোজিত ১৯৮৮ সালের একটি পোস্টমডার্নিস্ট ফিল্ম, বলা হয় যে সেটি গোদার এবং তাঁর মুক্ত-প্রাণ, অস্থির এবং নাটকীয়ভাবে তীব্র গল্প দ্বারা প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত ।
    .
    ষাটের দশক থেকে, নব্বইয়ের দশক হয়ে, এবং সহস্রাব্দের মধ্যে, ভারতে গোদারের সমসাময়িক - মণি কৌল, কুমার শাহানি, সত্যজিৎ রায়, অদুর গোপালকৃষ্ণান, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটক - ফরাসি ফিল্মের নতুনত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন আর ভারতে নিজস্ব তরঙ্গের সূচনা করেছিলেন যাকে অনেকে বলেন কমার্শিয়াল সিনেমার বিপরীতে সমান্তরাল সিনেমা।
    .
    তাঁর মার্কসবাদী ঝোঁকের কারণে, গত কয়েক দশকের মালয়ালম এবং বাংলা সিনেমায় গোদারের প্রচুর শিষ্য গড়ে উঠেছে। ডন পালাথারা'র ‘এভরিথিং ইজ সিনেমা’ (২০২১) শুধু যে গোদারের জীবনী থেকে এর শিরোনাম নিয়েছে তাই নয়. এমনকি তাঁর জাম্প কাট, সাউন্ড ডিজাইনিং এবং দর্শকদের গল্প বলার অভিজ্ঞতার সাথে নিমগ্ন ও বাধা দেওয়ার উপায়গুলিও নিয়েছে। কেরালায় গল্পের দিক থেকে গোদারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ২০১৭ সালের চলচ্চিত্র, ‘মায়ানাধি’, আশিক আবু দ্বারা পরিচালিত এবং সহ-প্রযোজিত। গোদার যে সামাজিক-রাষ্ট্রিক আধিপত্য এবং ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং  প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি মুখ হয়ে উঠেছেন তা কেরালার সিনেমায় স্পষ্ট নজরে পড়ে। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি সাজানো-গোছানো নয়, তাঁর নান্দনিকতা জৈব, স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাঁর শৈলীতে একটি অতি সত্যতা এবং স্পষ্টতার অনুভূতি রয়েছে। তাঁর পরে প্রতিটি সিনেমাই তাঁর কাছ থেকে নিয়েছে। গোদারের আগে এবং পরবর্তী সিনেমাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে  ফর্ম, ভাষা এবং শৈলীতে বিশাল পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
     
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৩738593
  • ‘গোদার সিনেমাকে তছনছ করে দিয়েছিলেন’ : কয়েকজন প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতার মতামত
    ( ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখের দি গার্জিয়ান পত্রিকা থেকে মলয় রায়চৌধুরী দ্বারা অনুদিত )
    মাইক লে : 'একটি চ্যালেঞ্জের উৎসব যা ছিল খাঁটি নৈরাজ্যিক আনন্দ'
    জাঁ লুক গোদারের প্রয়াণ আমাকে গভীর নস্টালজিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত করেছে, তাঁর সম্পর্কে আমার খুঁতখুঁতুনি সত্ত্বেও - যে মতামত অনেকেরই–  পরিচালকের পরবর্তী উদ্ভটতা সম্পর্কে। সেটা ছিল ১৯৬০ আর ‘ব্রেথলেস’ ফেটে পড়েছে স্ক্রিনে । ঠিক সেই সময়ে আমি ছিলাম লন্ডনে পৌঁছেছিলাম, সালফোর্ডের সতেরো বছর বয়সী একজন চলচ্চিত্র-প্রেমিক, যে জীবনে কখনও এরকম একটি সিনেমা দেখেনি যা কিনা  ইংরেজিতে নয় , আমার তখন পর্যন্ত খোরাক ছিল ব্রিটিশ আর হলিউডের ফিল্ম । গোদারের প্রথম মাস্টারপিস সত্যিই একজনকে ( ব্রেথলেস ) শ্বাসরুদ্ধ করে তোলার জন্য যথেষ্ট । মুক্ত-অনুপ্রাণিত লোকেশনে ছবি তলা, স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়, এদিক-সেদিক চলে-যাওয়া সংযোগহীন অদ্ভুত মুহূর্তগুলো … সেটা  সিনেমা সম্পর্কে একজনের ধারণাকে   চ্যালেঞ্জের একটি উৎসব ছিল: বিশুদ্ধ নৈরাজ্যিক আনন্দ!
    অবশ্য, একাধিক বিশ্ব সিনেমা আবিষ্কার হয়েছে, ত্রুফো তো বটেই - আমি সম্ভবত গোদারের অন্য ফিল্মের চেয়ে ‘দি ৪০০ ব্লোজ’ এবং ‘জুলে এ জিম’-এর কাছাকাছি নিজেকে অনুভব করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গোদারই  ছিলেন সেই দশকের ধারাবাহিক চলচ্চিত্রের আখ্যানে আধিপত্য বিস্তারকারী।  তিনি প্রতি বছর একটি নতুন টুকরো তৈরি করতেন, এবং আমি আর আমার সিনেমাভক্ত বন্ধুরা সেগুলোকে হাঘরের মতন জড়িয়ে ধরেছিলাম, প্রতিটি নতুন কাজ সম্পর্কে আমরা গভীর রাত পর্যন্ত তর্ক করেছি। আমার প্রিয় ফিল্মগুলো হলো : Vivre Sa Vie, Les Carabiniers, Bande à Part এবং 2 or 3 Things I know about Her এবং পরে, Weekend-her জন্য একটি কৌতূহলী আকর্ষণ।
    মার্টিন স্করসেসে : 'তার সিনেমাগুলি আগের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় এবং জীবন্ত মনে হয়'
    ‘ব্রেথলেস’ থেকে আরম্ভ করে,  একটি চলচ্চিত্র কী এবং তা  কোথায় যেতে পারে তার ধারণাকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করেছিলেন গোদার। গোদারের মতো সাহসী আর কেউ ছিল না। আপনি Vivre Sa Vie বা Contempt কিংবা Made in USA দেখবেন এবং আপনার ধারণা হবে  যে উনি আসলে নিজেরই ফিল্মটাকে ছিঁড়ে ফেলে আলাদা করছেন আর আপনার চোখের সামনে তা পুনর্নির্মাণ করছেন। আপনি কখনই জানতে পারতেন  না যে মুহূর্ত থেকে মুহুর্তে কী আশা করা যেতে পারে, এমনকি ফ্রেম থেকে ফ্রেমে - সিনেমার সাথে তাঁর সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তা জানা যায়।
    উনি কখনই এমন একটি ছবি তৈরি করেননি যা কোনও একটি ছন্দ বা মেজাজ বা দৃষ্টিকোণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে  এবং তাঁর চলচ্চিত্রগুলি আপনাকে কখনও স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যায় না। তারা আপনাকে খুঁচিয়ে জাগায় । তারা এখনও সেই কাজই করে - এবং তারা চিরকাল তা করবে। এটা ভাবা কঠিন যে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু যদি বলা যায় যে কোনো শিল্পী তাঁর শিল্পে তার নিজস্ব উপস্থিতির চিহ্ন রেখে গেছেন, তা হলে তিনি হলেন গোদার। আর আমাকে এখনই বলতে হবে, যখন অনেক লোক নিজেদের প্যাসিভ ভোক্তা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তখন তাঁর চলচ্চিত্রগুলি আগের চেয়ে আরও প্রয়োজনীয় এবং জীবন্ত বোধ করি ।
    ক্লেয়ার ডেনিস : 'তার উপস্থিতি আমাকে সাহসী করে তুলেছিল'
     আমি বন্ধুদের বলেছি যে আমি এমন একটি বিশ্ব কল্পনা করতে পারিনি যেখানে আমি বেঁচে আছি কিন্তু জাঁ লুক গোদার চলে গেছেন। তাঁর উপস্থিতি আমাকে সাহসী করে তুলেছিল। তাঁর চলচ্চিত্রগুলি কেবল  সিনেমাকে বিশ্বাসের কথা বলেনি - কেননা আমি আগে থেকে একজন বিশ্বাসী ছিলাম - এমনকি আমার অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রতিভা সত্বেও  কীভাবে আমাকে আমার নিজের পথ খুঁজে পেতে হয়েছিল ।  তিনি উদ্ধৃত করেছেন – চুরিও, এমনকি – সারা বিশ্বের চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, সঙ্গীত এবং সাহিত্য থেকে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাঁর আত্মা বসবাস করতো ইউরোপের মাঝখানে, এমন এক মহাদেশ যা ইতিহাসে ভরপুর । Le Petit Soldat ফিল্মে গোদার আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময়  ফ্রান্সের একটি  দিককে তুলে ধরে ছিলেন। আজ আবার ইউরোপে যুদ্ধ চলছে, তাই আসুন আমরা আরেকবার দেখি Je Vous Salue, Sarajevo.
    পল শ্রাদের : 'সিনেমা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত রুবিক কিউব'
    সিনেমায় দুই যুগ আছে, গোদারের আগে আর গোদারের পরে ।  পনেরো বছর ধরে তিনি সিনেমাকে ভাঙাভাঙি করেছেন, আবার তাকে জুড়েছেন , ফের ছেঁড়াছিঁড়ি  করেছেন যতক্ষণ না সেটা তাঁর ব্যক্তিগত রুবিক কিউব হয়ে ওঠে। গোদার এবং ডিলান তাদের প্রজন্মের জিজ্ঞাসু সংকেতমানুষ। গোদার ছিলেন উদ্ধৃতির জাদুকর, তাই তিনি Touch of Evil-এ তানিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা মারলিন ডিয়েট্রিচের মুখ দিয়ে হ্যাঙ্ক কুইনলান সম্পর্কে  তার প্রশংসা করবেন: “উনি একধরনের মানুষ ছিলেন। আপনি মানুষের সম্পর্কে কী বলেন তাতে কিই বা আসে যায়?"
    ক্যারল মোরলে : 'একটি সসেজ কারখানায় ধর্মঘট নিয়ে তাঁর চলচ্চিত্র আমার মনকে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল’
     প্রথমবার আমি গোদারের  ফিল্ম দেখেছিলাম একদিন সন্ধ্যায় এ-লেভেল ফিল্ম স্টাডি ক্লাসের সময়। আমার বয়স তখন তেইশ আর সিনেমার তেমন জ্ঞান ছিল না । আমাদের শিক্ষক বেভ জালকক Tout Va Bien দেখিয়েছিলেন যেটা একটা সসেজ কারখানায় ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে তৈরি, যা দেখে আমার মন বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক কী ছিল এই ফিল্ম ? এটার অস্তিত্ব কেমন করেই বা সম্ভব ?  যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে এটি আমাদের দেখা অন্যান্য ফিল্মগুলির থেকে কীভাবে আলাদা, তখন মুখে শব্দ যোগানো  কঠিন ছিল – আমরা সবাই ফিল্মটির দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম যা আমরা  স্পষ্টভাবে বলতে পারিনি - যদিও আমার  একজন ছাত্রীর স্পষ্ট স্মৃতি রয়েছে আমার যে বলেছিল একটা বড়  পার্থক্য হল তার দেখা অন্যান্য বিদেশী চলচ্চিত্রের তুলনায় পর্দায় সাবটাইটেলগুলি বড়ো  বেশি ওপরের দিকে ছিল।
    কিন্তু বেভ আলোচনাটি পরিচালনা করার সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে গোদার, জাঁ-পিয়ের গোরিনের সাথে সহযোগিতায়, প্রতিটি ফ্রেমে দর্শকদের চ্যালেঞ্জ করছেন: এটি ছিল রাজনৈতিক, র‌্যাডিক্যাল, বিপ্লবী সিনেমা। ফিল্মটা ছিল জেন ফন্ডা অভিনীত - এমন একজন যাঁর সম্পর্কে আমরা আগে  সবাই শুনেছিলাম ! পরে, যখন আমি একজন ফিল্ম-নির্মাতা হলাম , আমি আই এম নট হেয়ার নামে একটি ছোটো ফিল্ম তৈরি করি, যেখানে Tout Va Bien দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি সিকোয়েন্স রয়েছে: একটি সুপারমার্কেটের দীর্ঘ এবং বারবার ট্র্যাকিং শট।
     গোদারের মৃত্যুর খবর পেয়ে, আমি আমার শেলফ থেকে ‘গোদার অন গোদার’ বইটা খুঁজলুম ।বইটা আমি কয়েক বছর আগে পড়েছিলাম আর তাতে লেখা: “আমি কেবল শুটিংয়ের সময়ই নয়, আমি স্বপ্নের মতো, খাই, পড়ি , তোমার সাথে কথা হবে।" উনি আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছিলেন যে চলচ্চিত্র তৈরি করা আমার জীবনের প্রতিটি শ্বাস দখল করবে, এবং গোদার আমাকে শিখিয়েছিলেন যে সিনেমার তথাকথিত নিয়মগুলি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং সর্বদা খেলা এবং উদ্ভাবন করা এবং শেখা কখনই  বন্ধ করা উচিত নয় । কথাগুলো মনে রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
    লুকা গুয়াদাগনিনো : 'জনতা উত্তেজিত এবং চিৎকার করছিল'
    জাঁ লুক গোদাএর নামের মহৎ শক্তি, বা আমার চিরকালের কিংবদন্তি সংক্ষিপ্ত  JLG বলা উচিত, আমার চেতনায় এসেছিল যখন  আমার বয়স চোদ্দো। সেটা ছিল ১৯৮৫ সাল এবং আমার কৈশোরের অন্ধকার এবং নিপীড়িত পালেরমো শহরে আমি একদল লোকের একটা সিনেমা হলের সামনে উন্মাদ চিৎকারের মুখোমুখি হয়েছিলাম । সেখানে হেইল মেরি চলছিল । আমার অবাক লাগল যে কেমন করে  একটা ফিল্ম এই ধরনের বুনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে? তারপরে আমি ফিল্মটা দেখলাম আর  এর উজ্জ্বল সৌন্দর্যের মাধ্যমে আমি চিন্তাভাবনা করার শক্তি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হলাম । গডার্ড ছিলেন এক উজ্জ্বল আলো যিনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন, সিনেমার পর সিনেমায়, ধারণার পর ধারণায়, ফিল্মের ভাষায়। আমরা আজ আরও নিঃসঙ্গ আর তবু ওনার বিস্ময়কর সিনেমা চিরকাল আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
    মার্ক কাজিনস : ‘খারাপ-লাগার  কার্ডিনাল যিনি কাচের উপর হাতুড়ির ঘা মেরে আত্মতুষ্টিকে ভেঙে দিয়েছেন'
    .
    উনি ছিলেন খারাপ-লাগার কার্ডিনাল । আগুন এবং গন্ধকের প্রচারক । আমি প্রথম দেখেছিলাম Weekend, আর দেখে লাঞ্ছিত, উচ্ছ্বসিত অনুভব করেছি। উনি  আমাদের নৈতিক উঁচু পাটাতনে চড়তে বাধ্য করেছিলেন । বিনোদন এবং গীতিকাব্যিকতাকে অবজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু তারপরে যখন আমি Vivre Sa Vie দেখি, যা ছিল অনুভূতি প্লাবিত তারপর  দেখেছিলাম Two or Three Things I Know About Her.  নারীকে কেন্দ্র করে তৈরি ওনার চলচ্চিত্রগুলো ভালো হয়েছিল, আমার জন্য  ক্ষমাশীল । Hail Mary ফিল্মের কামোত্তেজনা মনে হয়েছিল বিরোধাভাসমূলক । ওনার কাছে সিনেমা কখনোই আনন্দের বিষয় ছিল না।.
    .
     ভয়েসওভার, টেক্সট এবং দৃশ্যমান মন্তাজের যে পরত তৈরি করতেন তা প্রায়ই আমার মগজে ঢোকার  জন্য বড্ডো  বেশি মনে হতো । উনি এবং অ্যান-মারি মিভিল অন্যান্য চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পেছনে ফেলে দিয়েছিলেন। তারা সিনেমার দৌড়ে ওনাদের পেছনে পেছনে গেছেন । ওনার উত্তরাধিকার? কাচের ওপর হাতুড়ি মারার মতো উনি আত্মতুষ্টির সিনেমাকে ঘা মেরে চুরমার করে দিয়েছেন। আমি সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের রোলে গিয়েছিলাম, আশায় ছিলাম যদি হঠাৎ ওনার মুখোমুখি হই এই ভেবে কিংবা দেখি ওনার কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন। আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কেমন করেই বা তার ছবি তোলা যেতো ?
    .
    কেলি রেইখহার্ট : 'আমাদের জন্য একটা গভীর কুয়ো রয়েছে যা থেকে সব সময় জল খাওয়া যায়'
    .
     আমি বুঝতে পারি ডেভ হিকি যখন বলেন  অ্যান্ডি ওয়ারহোলের আগে বিশ্ব কেমন দেখতে ছিল আর তারপর কেমন দেখতে হয়েছে । এটা কি গোদারের ক্ষেত্রেও খাটে না ?  ওনার আগে চলচ্চিত্রগুলি এক রকমভাবে  দেখাতো আর ওনার পরে আরেকরকমভাবে। উনি বেশ প্রফুল্ল ছিলেন আর দীর্ঘ জীবনযাপন করেছেন। আমাদের সকলের জন্য একটা গভীর কুয়ো রয়েছে যা থেকে সব সময় জল খাওয়া যায় ।
    .
    কেভিন ম্যাকডোনাল্ড : তিনি ট্যারান্টিনো এবং সোডারবার্গের জন্ম দিয়েছেন - কিন্তু তার পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলি একটি কাজ'
    .
     গোদার সিনেমাকে বদলে দিলেন। তিনি একে আত্ম-সচেতন করে তুলেছিলেন যেমনটা আগে কেউ করেনি - আপনি সর্বদা জানতেন যখন  আপনি তাঁর চলচ্চিত্রগুলি দেখছেন তখন কার সিনেমা দেখছেন, ঠিক  যেমন  ব্রেখট দেখা।দেখার সময় আপনি সর্বদা তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর প্রক্রিয়া এবং ভিত্তি সম্পর্কে সচেতন থাকেন - এবং তাদের প্রভাব (সাধারণত প্রথম দিকের আমেরিকান গ্যাংস্টার চলচ্চিত্রগুলি ; ভার্তোভ এবং পরে রাশিয়ান গঠনবাদীরা)। Breathless, Bande à Part, Une Femme Est Une Femme: সবগুলোই অসাধারণ, শান্ত, আইকনোক্লাস্টিক ফিল্ম যা সত্যিই ছিল সিনেমা তৈরির বিষয়ে । উনি গল্প, বা জনগণ সম্পর্কে ততো আগ্রহী নন। উনি ছিলেন প্রভাব এবং ধারণাগুলিতে আগ্রহী। উনি একজন সমালোচক হিসাবে শুরু করেছিলেন এবং সারাজীবন সমালোচক থেকেছেন।
    .
     তবে এটা বলা বড়ো কথা  নয় যে গোদার পয়দা করেছেন রিচার্ড লেস্টার, ট্যারান্টিনো, সোডারবার্গ, সেলিন স্কামা প্রমুখদের - অন্য কথায় প্রায় সমস্ত আধুনিক সিনেমার জন্ম দিয়েছেন। সেই প্রথম দিকের ফিল্মগুলির এখনও এমন তীব্রতা আছে যা আমাকে  শ্বাসরুদ্ধ করে । কিন্তু পরবর্তী ফিল্মগুলো আমি দেখেছি বেশিরভাগই উদ্দেশ্যমূলক: অত্যন্ত রাজনৈতিক, অত্যন্ত দ্বন্দ্বমূলক -  কখনও কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভাবনী হলেও। উনি “বুর্জোয়াদের প্রভাবিত করুন” ধারণাটা পছন্দ করতেন। তার মানে  আমার বুর্জোয়া হওয়া দরকার, কারণ সেই ছবিগুলো আমাকে সত্যিই “প্রভাবিত” করেছিল। কিন্তু ওনার রোলিং স্টোনস ডকুমেন্টারি One Plus One আমার ভালো লেগেছিল, যাতে  রাস্তার রাজনীতির দৃশ্যের বিরুদ্ধে ব্যান্ডের মহড়ার অমনোযোগকে তুলে ধরে। এটা রক মিউজিক আর সমাজে তার ভূমিকা সম্পর্কে সেই যুগের অন্য যেকোন চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশি ইশারা মেলে ধরে – সম্ভবত Gimme Shelter বাদে।
    .
    আমি একবার ক্যারোলিন চ্যাম্পেটারের সাথে কাজ করেছিলাম,  যিনি ফটোগ্রাফির একজন পরিচালক ছিলেন আশি আর নব্বই  দশকে গোদারের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেছেন। আমি "পথনির্দেশক" সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারি এমন প্রতিটি শব্দ শুনতাম । মস্কোর ভেঙে পড়া সোভিয়েত-পরবর্তী রেলওয়ে স্টেশনগুলিতে শুট করা আনা কারেনিনার ধারণাগত সংস্করণে রাশিয়ায় চিত্রগ্রহণের বিষয়ে তাঁর গল্পগুলি শুনতে শুনতে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম । ব্যাপারটা হল, গোদার নিজে তার সাথে যায়নি। তিনি প্যারিস থেকে ফোনে নির্দেশ দিতেন। ঘটনাটা থেকে আমি তাঁর সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিলাম । একজন মানুষ যিনি আক্রোশজনকভাবে সাহসী, খুব শান্ত – কিন্তু সম্ভবত মানব-ছোঁয়ার অভাব রয়েছে।
    .
    অ্যাবেল ফেরারা : 'আমি পরিচালকদের চেটেপুটে খেয়েছি কিন্তু আমি কখনই তাঁর কাছ থেকে সরে আসিনি'
    .
     আমি একটা ট্যাক্সিতে  বসেছিলাম আর  রেডিওতে  বাজছিল রোলিং স্টোনসের স্যাটিসফ্যাকশন আর তখনই মহিলা ঘোষক বললেন: "Soixante-cinque, 1965" গোদার তখন সত্যিই রোল করছিলেন। আমি ১৯৬৭ সালে ষোলো বছর বয়সে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি আর শীঘ্রই আবিষ্কার করলাম যে  হলিউডের বাইরেও চলচ্চিত্র তৈরি হয়। আমি একবারে এক-একজন বড়ো পরিচালককে চেটেপুটে খেতাম,  তাঁর সবকিছু দেখতাম তারপর এগিয়ে যেতাম, কিন্তু আমি কখনই গোদারের কাছ থেকে এগিয়ে যাইনি। পাসোলিনির মতো, লেখার ব্যাপারটা চলচ্চিত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর সেগুলোকে ভিন্ন আলোয় দেখার জন্য আমাদের আবার ফিরিয়ে এনেছিল ।  কেনেডিস, মার্টিন লুথার কিং এবং ম্যালকম এক্স-এর মৃত্যুর পর আমি ভেবেছিলাম নতুন একটা প্রজন্ম শীঘ্রই আসবে কিন্তু তারা কখনোই এলো না। কেউ আর গোদারকে  অনুসরণ করেনি। পিয়ার পাওলো পাসোলিনি ছাড়া কেউ ওনার কাছাকাছি আসেনি। আমি একজন বালক চলচ্চিত্র নির্মাতার মতন বসে থাকতাম এমনকি শিরোনামের কাব্যিকতা  আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করে দিতো: My Life to Live, One Plus One, A Woman Is a Woman, Alphaville   আমার প্রিয়, All The Boys Are Called Patrick৷ একটি দুঃখের দিন।
    .
    টেরেন্স ডেভিস : 'তাঁর প্রচণ্ড আবেগ  আমাদের ছাপিয়ে যায়’
    উপন্যাসের বেলায় যেমন প্রুস্ত আর জয়েস যেমন উপন্যাসে, তেমনি  সিনেমায় গোদার । তাঁরা সবাই এখনও নতুন লেখক এবং পরিচালকদের ওপর তাঁদের ক্ষমতা বিস্তার করেন । গোদারের প্রভাব এবং তাঁর প্রচণ্ড আবেগের মিনার আমাদের ছাপিয়ে ওপরে উঠে যায় , আর আমরা যারা পেছনে থেকে গেছি তারা কেবল তাঁদের প্রতিফলিত গৌরবে আলোকিত হতে পারি এবং তাঁদের স্মরণ করে  আনন্দ নিতে পারি।  বিদায় বলা অত্যন্ত কঠিন যখন সেই সময়ে আবার দেখা হবে বলাটা  আরামদায়ক ।  তাঁর চলে যাওয়ায় আমরা  নিঃস্ব। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না তবে তিনি আমাকে একবার  প্রশংসা করেছিলেন যা আমি  মূল্যবান হিসাবে সঞ্চয় করে রেখেছি । সুতরাং, ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ, টুপি খুলে সেলাম জানাই  এবং সবাউ উঠে দাঁড়াই একজন প্রতিভাধরের বিদায় বেলায় ।
    .
    পিটার ওয়েবার : 'আমি প্রথমবারের মতো জেনেছিলাম যে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক বলতে ঠিক কি বোঝায়'
    .
     আমি সত্তর দশকের শেষের দিকে লন্ডনের পোর্টোবেলো রোডে থাকতাম - একজন কিশোর যে Daddy Kool-এ কয়েকটা রেগে রেকর্ড কিনতে গিয়েছিল, কিন্তু দেখলো দোকানটা বন্ধ ।  বৃষ্টি পড়ছিল আর আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না । আমি ভাবলাম যাই গিয়ে দেখি  ইলেকট্রিক সিনেমায় কী চলছে, তখনকার দিনে ওটা ভাঙাচোরা সিনেমা হল ছিল । Pierrot Le Fou  সবেমাত্র শুরু হতে যাচ্ছিল আর আমি ফিল্মটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যা দেখলাম তা আমাকে বিদ্যুৎ তাড়িত করে দিলো । সেটা দৃশ্যত ছিল থ্রিলার  কিন্তু আমার দেখা অন্য কোনও চলচ্চিত্রের মতো নয় । অভিনেতারা ঘুরে ফিরে সরাসরি ক্যামেরার সাথে কথা বলছিলেন ।  সঙ্গীত এমনভাবে শুরু হচ্ছিল আর বন্ধ হচ্ছিল যা আপনাকে লক্ষ্য করতে বাধ্য করবে যে কীভাবে সাউন্ডট্র্যাক আপনার অনুভূতিকে নিয়ে খেলছে । চরিত্রগুলো এলোমেলোভাবে গানে বা কমেডি টুকরোয়  ছড়িয়ে পড়ছিল, এক মুহূর্তের নোটিশে জনার সরে যাচ্ছিল আর বদলে যাচ্ছিল । ফিল্মটা ছিল একই সাথে আবেগময় আর রোমান্টিক, নিষ্ঠুর, ধূর্ত এবং হৃদয়গ্রাহী । আমি গোদারের প্রেমের দেবী   অ্যানা করিনার প্রেমে পড়ে  গেলাম, যিনি ছিলেন অভিনেত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্বল । ফিল্মটা  শেষ হওয়ার পর, আমি প্রথমবারের মতো টের পেলাম একজন ফিল্ম পরিচালক আসলে কে, আর  কীভাবে বেশিরভাগ সিনেমার নিয়মকে এই ফিল্মটা দুর্দান্ত প্রভাবে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।  আমি সিনেমা হলের বাইরে  বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে নিজের মনে বিড়বিড় করছিলাম: "আমি এই জিনিসই করতে চাই। আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই।” সেটা তখন এক অসম্ভব স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল কিন্তু  স্বপ্নটা সত্যি হয়েছিল - আর তার সমস্ত দোষ গোদারের । কয়েক দশক পরে, আমি ইলেকট্রিক  হলে  ফিরে যাই, ততোদিনে পয়সাঅলা সদস্যদের ক্লাব, সিনেমার জন্য আমার প্রথম ছবির চরিত্র খুঁজছি : Girl With A Pearl Earring. মনে হয়েছিল, বৃত্তটা সম্পূর্ণ হলো ।
    .
    জন বুরম্যান : 'ফিল্ম বানানোর চেয়ে ফিল্মের কথা বলার সময়ই তিনি সেরা ছিলেন'
    .
     ওনার প্রথম দিকের চলচ্চিত্রগুলো ছিল প্রাণবন্ত এবং রোমান্টিক, যা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। পরে, তাঁর চলচ্চিত্রগুলো বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। কানে যখন ওনার কোনও চলচ্চিত্র আসতো তখন ওনার প্রেস কনফারেন্সগুলো সব সময় একটি দুর্দান্ত ঘটনা হয়ে উঠতো আর একেবারে ঠাসাঠাসি । চলচ্চিত্র নির্মাণের তুলনায় কথা বলায় উনি ছিলেন সেরা কিন্তু মানতে হবে যে  উনি একজন দুর্দান্ত উদ্ভাবক ছিলেন আর চলচ্চিত্র-শিল্পকে তার সীমা অতিক্রম করিয়ে  তার বাইরেও প্রসারিত করেছিলেন।
     
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৭:৫৫738594
  • Daniela Cappelo : Strategies for Translating Obscenity: Medical Language and Sanitization in Malay Rāychoudhury’s Poetry
    Obscenity and Taboo Language
    Cultures vary widely in the treatment and reception of speech related to sex and bodily
    activities; while some cultures may perceive language related to sex as dirty and offensive, other social and cultural contexts may in fact not regard the same as a taboo (Allen and Burridge 2006). Working on modern Bengali poetry and specifically dealing with ‘poetics of obscenity’ has forced me to question my position as a translator with regard to the cultural, social and ethical limits – as well as freedoms – that I, consciously or unconsciously, avail myself of in my research. In particular, I was faced with the challenge of finding ways to negotiate between the multiple meanings of the text and my personal experience and understanding of those. For instance, how does a foreign translator of a South Asian language respond to ‘obscene’ phrases which are not a taboo in her own culture? Or else, how do I, an Italian scholar translating into English for a German academic audience, distinguish between different layers and understandings of a translated ‘obscene’ word, and reproduce its ambivalences and problematics? To show how possible an ‘impossible translation’ can be, I will here address some of the problematics that I face in translating ‘obscene’ words and phrases in the poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ (1964) and its English translation (‘Stark Electric Jesus’, 1967) by the Hungryalist poet and writer Malay Rāychaudhurī. 
    In particular, the verses that will be examined relate to the description of a woman’s sexual organs, rape, masturbation, and bodily ‘effluvia’,1 such as sperm and menstrual blood. In my attempt at re-translation, I have first identified the ambivalent purpose behind the texts: the poet’s ironical use of a Bengali ‘medical’ lexicon achieves a ‘sanitized’ description of the sexual organs and sexual activity while aiming at provoking the ‘bourgeois’ readership and subverting normalized views on sexuality. Yet the scientific high-status language of both the Bengali poem and its English translation, pregnant with terms of Latin derivation, betrays the poet’s attempt at ‘cleaning’ the translation of its most controversial aspects in order to avert the risks
    of obscenity charges. The dualities and ambivalences of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and its English counterpart make the process of re-translation all the more significant to the translator who wants to unravel the multiple stages, layers, and meanings of a literary text. My concern here is to engage with the ‘possibilities’ of negotiation between the textual strategies (irony, sanitization, subversion, and self-censorship) and the material and economic reasons behind the production of such texts. Before addressing the problems of translation, the main methodological question that I am constantly faced with is: what do we mean by ‘obscenity’? Which textual strategies and interpretative practices operate within an ‘obscene’ poem? The boundaries between the concepts of erotic, bawdy, obscene and pornographic have always been fuzzy and mobile, moving back and forth according to gender, class, taste and times.2 Any attempt to define this category has inevitably ended up in essentialistic views of obscenity and resulted in determining ‘obscene’ an intrinsic quality of a speech, a writing, a performance. However, there has been wide research from different disciplines, from legal, cultural and literary studies, that has wanted to re-examine the concept of obscenity as it was
    formulated in a specific historical situation by a particular social group in power. These reexaminations have contributed to releasing the concept of obscenity from moral, legal and ethical essentialisms, acknowledging the multiplicity of its meanings and applications in different social and cultural locations.3 The concept of the obscene (aślīl) in nineteenth century Bengal, for instance, was informed by the differentiation that was being shaped between elite and popular culture, high and low registers, where the latter was obscured and suppressed from the life of the bhadralok, the Bengali gentry (Banerjee 1197). Obscene acts or materials generally denote something that is offensive to common morality and to the public sense of decency, predominantly referring to the domain of sexuality (‘Obscenity’, Encyclopaedia Britannica). Breaking down the concept of obscenity into smaller units can help in identifying the main characteristics that define a behaviour, a speech, or a text, as obscene. Taboo, for instance, is a key concept to the understanding of the ‘obscene’: it originally denoted a ‘prohibition’, more likely a food, an object, or a behaviour that was perceived as ‘polluting’, harmful and offensive, to a certain community. Taboo and taboo language has been the subject of much scholarship from anthropology and social linguistics which has found the main interpretation of taboo as ‘the matter out of place’, that is contaminating and therefore dangerous for the social order of the community (Douglas 1966). Yet taboo language, in its most contemporary and colloquial acceptation, is more than ritual prohibition and avoidance: it is “a breach of etiquette” consisting of ‘dirty words’ that a speaker normally avoids in a standard public context. These words
    “have the power to titillate” and along with taboo language are “the most emotionally evocative of all language expression” (Allan and Burridge 42). The process of translating Bengali aślīl poetry into English has shown resistance to traditional practices of translation formulated in the field of Translation Studies, such as fluency, accuracy, and Lawrence Venuti’s much debated ‘foreignization’ of a text and ‘visibility’ of the translator (Venuti 2008). To cope with these problematic aspects of the translation process, I have taken free inspiration from Anjali Nerlekar’s study on the poet Arun Kolatkar (2016), the bilingual poet in the Marathi and English languages, where she observes that the concept of translation needs to be questioned because of the “slippery nature of the translational practices”, especially when these take place in multilingual contexts. Practices of self-translation and transcreation have in fact contributed to interrogating the authority and authenticity of original texts (Nerlekar 208). In the same way as Kolatkar’s translation of his own poetry collection Jejuri resists simplified readings – which identify one version as the original and the other as a derivative version – the ‘mobile’ nature of the two translations of the Hungryalist poem is established by reason of its multiple editings and re-translations.
    The Poet and the Poems: 
    ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and ‘Stark Electric Jesus’ Malay Rāychaudhurī is today acknowledged as one of the early creators of the Hungry Generation movement in 1961, along with his brother Samir, Shakti Chattopadhyay and Debi Roy.4 Inspired by the American beatniks and affiliated to the global neo-avant-gardes, the anti-establishment group of wild guys published manifestos and little magazines, experimented with language, brought their subjectivity and sexuality into poetry and challenged the cultural and political establishment of Calcutta with irony and provocation. Born in Patna in 1939, Malay lived his childhood and late adolescence in a poor suburb of the city known as Imlitalā. In his childhood memoirs, Malay gives great importance to the years spent in this neighbourhood surrounded by Shia Muslims, Dalits and low-caste Hindus. He turns to the memories and stories of these subaltern people in Patna to retrace the cultural and social hunger for a ‘realer’ literature, as promoted in a late manifesto, which has later become a mark of Hungryalist writing (Rāychoudhurī n.d.).
    Both the English and Bengali versions of the poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and ‘Stark Electric Jesus’ have become icons of Hungryalist writings, especially after Malay’s infamous sentence for obscenity. The poem originally appeared in Bengali in 1964 as part of the Hungry bulletin that was seized by the police and used as the main object for the obscenity accusations against the Hungry writers. After the poem was banned as obscene, Malay and his fellows, Debi Roy, Subimal Basak, Saileswar Ghosh and Pradip Chaudhuri started an intense correspondence with American editors and poets, such as Howard McCord, Karl Weissner, Lawrence Ferlinghetti and Allen Ginsberg, in order to ask for financial support for the trial. In response to that, the international avant-garde community started a circle of literary exchange with the Hungryalists, collected and edited a selection of their writings and compendia of contemporary Indian poetry that were eventually published in special issues of American journals and little magazines such as Salted Feathers, Intrepid and City Lights.
    From the mid-sixties, Malay and his ‘Stark Electric Jesus’ had become well-known names associated with the Indian avant-garde movement and with issues related to obscenity and freedom of speech. The English version of the poem was originally published by Tribal Press and edited by Howard McCord, professor of English literature at Bowling Green State University and avant-garde writer himself, in three editions in 1965 and 1966 with an afterword by the editor. City Lights Journal #3 also published the poem with a longer version of the afterword under the title “Note on the Hungry Generation” (Ferlinghetti 159-60). ‘Stark Electric Jesus’, self-translated by Malay for the first Tribal Press edition, appears again in a 1967 issue of the American journal Salted Feathers edited by DickBakken. In this issue, fully dedicated to poetry, essays and letters from Hungryalist writers, it is mentioned that Dick Bakken wrote to poets and scholars of Bengali in the United States, at that time Edward C. Dimock and Jyotirmoy Datta, to assist him in the translation project (Bakken n.p.). The politics of translation endorsed by the editor of Salted Feathers aimed at keeping the original translations of the Bengali authors, unless otherwise noted, and changing some spelling, diction and syntax to make them ‘less awkward’ (Bakken n.p). Malay offered to translate his poetry as well as some of his friends’, who were “not well to do with English”, and leaves the work of re-editing to Dick Bakken.5 The English version of the poem is then edited at least twice by McCord and Bakken to produce a text that appeals to a different audience - readers of avant-garde literature in Europe and the United States. The distribution of Malay’s English poem to these American journals of avantgarde poetry finds the main reason in the search for financial support during the obscenity trial. The ‘material’ reason of financial necessity behind the translation of the Bengali poem locates this text at the juncture of commercial publishing and experimental writing. Prompted by the need for a critical re-interpretation of the poem, I will here lay out some methodological principles that have guided my new English translation of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ (from now on PBC), informed by a consciousness of the economic reasons and ethical choices that stood behind Malay’s ‘Stark Electric Jesus’ (from now on SEJ). In the extracts from the English poem that will follow in this paper, I suggest a slightly different rendering of the verses here discussed, especially those concerning the representation of the female body and male masturbation.
    Translating Shubha’s Sexual Body
    Issues surrounding the poet’s unfulfilled sexual desires, his inability to love, scenes of rape and masturbation have made this poem a divisive icon of the unabashed and grotesque, yet ultimately misogynist and irreducibly bourgeois, ‘hunger’ of these poets. Through the hallucinatory monologue of Malay to his imaginary muse Shubha, an allegoric representation of woman, the poem describes the oedipal and sexual frustrations of the poet. The documents of the Hungryalists’ trial show that the charges for obscenity were corroborated by Section 292 of the Indian Penal Code, which stated that “the accused was found to be in possession of the impugned publication. So one of the ingredients of Sec 292 IPC namely, of circulation, distribution, making and possessing [of obscene material] are present.” Although the Magistrate acknowledges that the IPC does not define the word ‘obscene’, and that a piece of art or literature may not be judged only on the basis of vulgarity, he finally decides to sentence Malay’s poem because it deals with sex and nudity in a way that “transgresses public decency and morality.”6 Interestingly, the Magistrate then delves into a detailed description of the ‘moral transgressions’ of the poem: 
    In bizarre style it starts with restless impatience of sensuous man for a
    woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed
    by a description of the vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts
    of the female body and organ, boasting of the man’s innate impulse and
    conscious skill as to how to enjoy a woman, blaspheming God and
    profaning parents accusing them of homosexuality and masturbation,
    debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship.
    (Decision by Presidency Magistrate, 1965)
    According to the Magistrate’s interpretation, the offensive passages of the poem were the ones describing female pleasure and uncontainable sexual desire, parental homosexuality and masturbation.The controversial content of the poem was identified in the idea of a woman’s sexual ‘urge’ and in sexual activity as non-procreative or as performed for the sake of pure pleasure. Malay’s banned poem is still the object of critique from Bengali literary critics, academics and an ordinary readership who have especially criticized the lack of substantial literary quality in his poetry. Apart from that, there exists also a feminist critique of Hungryalism as a male-centered poetics where “female sexual agency is vilified” and where women are described only as ‘sexual bodies’ (Dhar).7 The ambivalent status of Hungryalism in Bengali literary history seems to mirror the ambiguous role that the representation of sexuality and the related terminology plays in Malay’s poetry. In the controversial passages of the Bengali poem, for instance, transliterated English words are juxtaposed to a scientific Bengali terminology to describe Shubha’s sexual and reproductive organs and other bodily activities such as male ejaculation and urination. Kumar Bishnu De, in his research on Malay’s poetry, admits that the meaning of the words ‘clitoris’  and ‘labia majora’  became clear only after he read the sequence of Bengali words that visually depicted a vagina (De 210).8 The incorporation of these English words into the Bengali text helps mitigate the scandalous content and attenuate the visual power that the ‘obscene’ words depicting the female sex organs may have on the Reader. 
    The following verses show how the juxtaposition between the English-Latin words (i.e. uterus, clitoris, labia majora) and the Sanskritized Bengali words (i.e. garbha (womb), ṛtusrāb (seasonal bloodstream), śukra (sperm) and satīcchad (hymen)) operates in the poem as ‘sanitizer’ of the ‘sexual body’, ultimately deprived of its sensual component and transformed into a biological body, where sexual intercourse and masturbation occur exclusively as mechanical activities:
    Shubha, let me sleep for a few moments in your violent silvery uterus
    Give me peace, Shubha, let me have peace
    Let my sin-driven skeleton be washed anew in your seasonal bloodstream [ṛtusrāb]
    Let me create myself in your womb with my own sperm [śukra]
    […]
    Let me see the earth through your cellophane hymen [sāticchad]
    […]
    I remember the letter of that final decision in 1956
    The surroundings of your clitoris were being embellished with coon9 at that time
    […]
    Let me enter in the immemorial incontinence of your labia majora
    Into the absurdity of woeless effort
    In the golden chlorophyll of the drunken heart (Bakken 1967)10
    Both the Bengali words (ṛtusrāb; ātmamaithuna; śleṣmā) and their English translation (i.e. seasonal bloodstream; self-coition; ovum-flux) show a conscious selection by the author of a scientific vocabulary of the Bengali language and a correspondent English translation of the medical terminology related to the sexual body. In some of the passages illustrated above, Malay directly uses the transliterated English word to denote the female sexual organs (i.e. labia majora; uterus; clitoris) for lack of a Bengali equivalent, or so the poet himself explained during an interview I carried out at his home in Mumbai (personal interview, November 26, 2017). Yet the proliferation of a Bengali ‘sexual’ terminology, already established from the late nineteenth century through an expanding market of medical publications (Mukharji 86), shows that Malay’s use of the English words was actually prompted by the need for a certain degree of secrecy with regard to the more contentious aspects of the poem. It is in fact quite common in ordinary Bengali language, and especially in the technical and more problematic context of sexual activity, to use English words as substitutes for a Bengali that would more easily ‘offend’ middle-class morality. If the poet was at that point already aware of the risk of a trial and sentence for obscenity, he knew how provocative and transgressive his writings could become in media and popular perception. The use of the English equivalents in the Bengali poem then shows the poet’s attempts at suppressing the straightforwardly outrageous quality of the Bengali by replacing it with a more ‘delicate’ English word to attenuate the scandalous content.
    Medical Language and Sanitization
    The second half of the nineteenth century saw the explosion of medical publishing in vernacular languages, including Bengali medical dictionaries, books on sexology and encyclopedias of sexual knowledge, which acted as sites of ‘vernacularization’ that provided vernacular alternatives to English technical terms (Mukharji 86-7). These publications illustrate the creation of a vocabulary of anatomic and physiological terms of the Bengali language, shaped from an already established English medical lexicon, encouraged by the international reception of modern ‘western’ books on the study of sexuality. For instance, the description of the male and female reproductive organs (strī-jananendriya) already had a quite well-established Bengali vocabulary by the late 1930s, when Hasanat’s Yauna Bigyān and Basu’s Yauna-Biśbakoṣ were published (Hasanat 1936; Basu 1938-1946). In the latter, ‘clitoris’ is in fact translated into bhogāṅkur and ‘labia majora’ into bhogādhar guru (lit. bhog = vagina; adhar = lip) (Basu 187).
    Malay plays with the Bengali medical lexicon related to sexual organs and activities (i.e.
    yonivartma (urethra); ātmamaithuna (self-coition); rajah/ṛtusrāb (menstruation); śleṣmā (mucus, phlegm)) to convey a biological description of the body.11 The effects generated by such scientific treatment of the language are ones of ironic ‘inversion’ of the obscene images related to sex: on the one hand, non-procreative sex acquires dignity of literary treatment, while on the other, the high status of the constructed, artificial scientific vocabulary is ironically downplayed through the sexual context.
    Abul Hasanat’s Sacitra Youna Bigyān (Illustrated Book of Sexual Science) presents a good example of a modern book of sexology dealing with multiple aspects of sexuality, including illustrated descriptions of conception, the formation of the embryo, and birth, as well as a detailed analysis of younabodh, the sexual perception. 12 In the first volume, Hasanat describes the anatomy and physiology of sex (youna-indriyasamuha) with illustrations of the male and female sex organs (Hasanat 93-99) and the process of menstruation (ṛtusrāb), a word “originated from the latin ‘mensis’ meaning ‘monthly.’ Since it takes place every month, it is called monthly (māsik) in different languages” (Hasanat 102). Abul Hasanat wrote books on this subject until the 1950s and his works remained highly popular through the sixties. The occurrence of words for the organs, such as linga, yoni, jorāyu, garbha, śukra, aṇḍakoṣ, mūtrāśay, yonipath, satīcchad, and their functions, such as prasrāb (urination) and ṛtusrāb (menstruation), provide evidence for the selection of medical words in the Bengali poem.
    In my own translation, I substitute seasonal bloodstream and ovum-flux with menstruation, self-coition with masturbation and phlegm with mucus, as it appears from the following verses:
    Why wasn’t I lost in my mother’s urethra?
    Why wasn’t I shaken away in my father’s urine after he masturbates?
    Why wasn’t I mixed with mucus in the menstruation?13
    As compared to Malay’s English translation:
    Why wasn’t I lost in my mother’s urethra?
    Why wasn’t I driven away in my father’s urine after his self-coition?
    Why wasn’t I mixed in the ovum-flux or in the phlegm?
    My choice of replacing the more sterile, scientific terms that describe masturbation and menstruation was informed by the need for greater readability and a more direct reception of the ‘defiling’ activities on behalf of the readers, while still retaining the scientific touch of the Latin etymology. If Malay’s self-coition, phlegm, and seasonal bloodstream aim at reproducing masturbation, menstruation and reproduction purely as mechanical processes of the biological body in the ‘anatomic’ lexicon, they also lay out different possibilities of interpreting the reasons behind their use. The semantic potential of the English self-coition and seasonal bloodstream, for example, and the possibilities of playing with the construction and meaning of these words, allow the retention of the ‘clinical’ structure of the poem and a mechanical description of the body. At the same time, the choice of ‘high’ words here serves two functions: on the one hand, they elevate to a lyrical subject what the middle-class readership interprets as low, repulsive and scandalous; on the other, they ironically ‘minimize’ the technical scientific language by applying it to the low semantic sphere of sex and other bodily activities. By replacing self-coition with the verb masturbate, I have tried to make the reading more fluent and the ‘obscene’ content more easily graspable, as well as to reproduce the ironical touch that was inevitably lost in the ‘surgical’ English translation. Yet Malay’s ‘sanitization’ of the original poem is only one among other valuable hypotheses that explain the textual tactics and language strategies behind this text. The representation of Shubha’s body and of the male semen through a subversive use of Bengali medical terminology is not only a mark of purification of the text already banned for obscenity. The hyper-pedantic constructions of the English translation (i.e. self-coition; ovum-flux; seasonal bloodstream), as well as the juxtaposition with the higher status of the Latin derived  English words, appear as anti-hegemonic practices of translation and language construction  that give the dignity of literary matter to the bawdy topic of sexuality. One more practice of subverting the rules of accuracy and faithfulness in translation appears in another instance of the poem, where Malay translates the Bengali dharṣaṇ into the English ‘copulation’, as in the following verses:
    I’d have gone two billion light years and kissed God’s ass
    But nothing pleases me nothing sounds well
    I feel nauseated with more than a single kiss
    I've forgotten women during copulation and returned to Muse
    Into the sun-colored bladder
    I do not know what these happenings are but they are occuring within me
    […]
    My power of recollection is withering away
    Let me ascend alone toward death
    I haven’t had to learn copulation and dying (Bakken 1967)14
    If we look into the Sanskrit etymology of the word dharṣaṇ, we encounter no explicit ‘sexual’ connotation, but the nouns ‘assault, outrage, offence, violation, seduction’, ‘overpowering’ and ‘copulation’ (Monier Williams 513). For a modern definition of the word, the Samsad Bengali-English Dictionary (2000 edition) translates dharṣaṇ also as ‘rape’ (537). On the other hand, according to the Samsad Bāṁlā Abhidhān (1964 edition), the monolingual dictionary of the Bengali language, the noun lacks the connotation of sexual abuse, signifying more generally an act of  oppression or submission (416). However, among the multiple entries under dharṣaṇ (i.e. pīṛhan, atyācār, balātkār, daman, parājit-karaṇ), the synonym balātkār in particular involves the idea of oppression, control and submission “especially against women” (biśeṣatah nārīr prati) (Biswas 416). I could not come across any critical engagement with the alleged ‘dishonest’ translation until I came across Nandini Dhar’s ‘feminist critique’ of Hungryalist poetry, where she acknowledges the Hungryalist movement as a “profound failure of the Bengali radical imagination” (Dhar n.p.). Here she proposes a gender-based critique by pointing out to the fundamental ‘vilification’ of the female sexual agency in Malay’s poetry, turned into a site of male sexual violation. In a new critical reading, Dhar remarks how Malay has mistranslated the passages of the poem that centered on Shubha’s body. In Dhar’s view, the alleged mistranslations of dharṣaṇ as ‘copulation’, and of uṭhiye neowā as ‘elevate’ (whereas she claims the real meaning to be ‘abduction’) legitimize rape and sexual violence.
    My suspicions regarding Malay’s translation grew during a reading session with Bengali-speaking colleagues and students at the Südasien-Institut in Heidelberg, as they remained quite perplexed at the ‘unfair’ translator. My puzzlement at the ‘mysterious’ translation initially led me to argue that if Malay had replaced ‘copulation’ with another English equivalent involving a violent act of oppression and submission he could have found a way to escape the mistranslation. Since SEJ was edited and corrected by the American editors, native speakers of English who were most likely not aware of the original Bengali version, we could assume that Malay was fully conscious of the ‘corrupt’ translation he was proposing to avant-garde readers in the United States. Yet in order to clarify Malay’s choice of translation, I turned to him in a private communication where he claimed that “the word ‘rape’ has been in use now only. When I wrote, people talked either of intercourse or of copulation. For me at that time ‘dharshan’ was same as intercourse or copulation. I did not mean rape while using the word ‘dharshan’”.15 How do I engage with the changing semantics of one specific word in translation? Was the poet enacting a strategy of self-censorship, purging the text of its most objectionable contents to make it less problematic to the American readership (where Shubha would not be the object of violent sexual abuse, but the consenting partner in intercourse)? Or is the ‘misunderstanding’ by Nandini Dhar caused by the enhanced sexual and violent connotation that has been assigned to the word in more recent times? Dharṣaṇ today has become a highly controversial term in the social and political landscapes of South Asia, especially after the Delhi Gang Rape in 2012 has projected the discourse on rape and violence against women to the foreground of national interest. Taking the word out of the original poetic context here helps retracing the semantic history and evolution of the word and establishing a trajectory of social, cultural and literal meaning that could not be transmitted to the reader through the mere act of translating. The recasting of dharṣaṇ and its history into the subversive semiotics of the poem, which aims at representing the act of sexual intercourse as a possibility of emancipation from middle-class oppressive morality, also on behalf of the ‘sexual body’ of the Muse Shubha, contributes to returning meaning and dignity to what Dhar has criticized as a ‘mysterious’ translation that ‘legitimizes rape and sexual violence through repetitive articulations of male pain and alienation’ (Dhar n.p.). The rough, unabashed ‘bodily’ language of Malay, a mark of the Hungryalist aesthetics signalling the disintegration of a masculinity that oscillates between the traditional models of the Indian patriarchate and the ‘Western’-oriented revolution of love and sexual relationships, is often embodied in Malay’s highly conservative and misogynist aesthetics. Yet in the internal logic of the poem, where dharṣaṇ is viewed as an imaginary act of social subversion, it can be argued that the word had a more nuanced connotation that did not necessarily entail sexual aggression or abuse in the years when Malay was writing and translating his poem.
    What, in this case, shall a more ethically and politically correct translation in the first place account for? The task of the translator in this case lies in the sensibility and ability to ensure the same thoroughness and contextualization for both options of translation (i.e. copulation, rape). Although my translation here ‘betrays’ the intentions of the author, who had personally dissociated the word dharṣaṇ from a context of sexual violation, it performs a conscious transgression of traditional norms and practices of translation such as accuracy and faithfulness. My personal approach was here to exploit the potential of the original word, with all the multiple shades of meaning implied in the Sanskrit and Bengali etymology, by suggesting in my own re-translation the more contemporary political signification of dharṣaṇ in PBC, in order to ‘dislocate’ the poem and operate a semantic transfer to a modern readership’s perception.
    Then I would kiss the ass of God for billions of light years
    But nothing pleases me, nothing pleases me
    If I gave more than one kiss my body would be nauseated
    How many times have I forgot women after rape and came back to Art
    In the solar bladder of poetry
    What’s going on I don’t know, yet it happens inside me
    […]
    My power of recollection is fading away
    Let me walk alone towards death
    I didn’t have to learn about rape and death
    Translating Masturbation
    The abundance of descriptions of male masturbation in Hungry poetry has turned it into a true literary topos of Hungryalism. The grotesque and pictorial character of masturbation, a leitmotif of avantgarde arts, performances and literature across the world, plays a relevant role also in Hungryalist poetry: the non-reproductive nature of ‘solitary’ and pleasurable sex becomes one way to express the social and psychological conflicts of the young Bengali male with the dominant bourgeois morality and middle-class social regulations of post-independence Bengal. Masturbation and ejaculation were signs of pathological abnormality in colonial Bengal that affected Bengali middle-class narratives of the body and sexuality. The ‘weakness of the semen’ (dhātu dourbālya), associated with impotency and involuntary discharges, substantiated the anxieties of Bengali effeminacy and racial inferiority (Mukharji 247). Following Foucault’s engagement with the repression of ‘peripheric’ sexualities and the obsession with their classification in the Victorian period (Foucault 1990), scholarship on the cultural significations of masturbation in colonial India has showed that loss of semen was mainly associated with sickness, sexual perversion and anxieties of masculinity (cf. Pande 2010; Alter 2011;  Mukharji 2011). In the late nineteenth century, Bengali men, burdened with the stereotypes of degeneration and perversion, developed a paranoia over squandered sperm resulting in an ambivalence towards women that verged on misogyny (Pande 172). Bengali periodicals on public health treated the subject of masturbation, especially when this activity takes place during puberty and adolescence, as a serious health issue since it makes the boy’s “semen watery and weak” (śukradhātu taral o nisteja) (Basu 228). In accordance with the state of brahmacharya, male Hindu celibacy, masturbation was interpreted in terms of physical strength more than a moral vice: the preservation of semen represented in fact an act of self-control and self-development while waste of semen signified a loss of virility (Alter 287). According to Hindu physiology at large and to Indian traditional medicines, ejaculation was therefore equated to a loss of masculine strength and waste of essential energy. However, Srivastava has remarked how the notion of ‘semen anxiety’, combined with a general ethic of self-control, had come to take on the appearance of an irrevocable truth of Indian masculinity(Srivastava 3).16
    In Hungryalist poetry, non-reproductive sexual activity is ambivalently represented as a
    liberating act that denounces and subverts the regulation of social bonds and relationships, as well as a state of frustrated uneasiness with one’s own unconventional position towards matters of sexuality and sociality. As powerfully illustrated by Falguni Roy, a cult figure of the Hungry Generation, in his poem ‘Byāktigata Bichāna’ (A Private Bed), the act of masturbating becomes part of normal daily life when it concerns the ideal ‘family man’:
    Not only Radha – even the prostitute menstruates
    The father of three children – the ideal man of family planning
    Masturbates from childhood – doesn’t he? 17 (my translation)
    The acts of masturbating and ejaculating, as suggested in this passage, do not only relate to colonial discourses and to traditional medicine that pathologized sex and semen loss. Through masturbation, here the Hungry poet wants to subvert the post-colonial predicament of the Indian father, ‘ideal man of family planning’, with all the creepy associations with vasectomy and mass sterilization programs carried on under Indira Gandhi’s rule, and express the wish for liberation from imposed disciplined regulations of the body. At the same time, these poets’ relationship with the body remains ambiguous and unavoidably torn between society and personal experience, between the ongoing sexual revolution of the West and the ostensible cultural immobility of Bengali middle-class society. In Malay and other Hungryalist poets like Falguni Roy, preoccupations with masculinity and virility take  shape through the description of male semen during sexual intercourse, masturbation and fetus production (Miśra 2015). The obscene character of these representations, however, is not determined by the ‘fear’ of prudish descriptions of sexual intercourse or discourses on sexuality at large; rather, they are informed by the insecure and precarious conditions of modern masculinity. The act of masturbation thus reproduces the conflicts, ambivalences and anxieties of a changing concept of the modern male middle-class Bengali individual.
    We have already encountered the word ātmamaithuna in PBC, which is transcreated in SEJ as self-coition, a neologism crafted by the poet to reproduce ironically and scientifically a ‘copulation  with oneself.’ Although ātmamaithun seems to be the most common word in Bengali language that refers to ‘masturbation’, along with hastamaithun, there are other equivalents to define both male and female masturbation, such as svamehan, svakām, hastamaithun and svayaṁrati, as appears from a fully detailed Wikipedia page in Bengali dedicated to this subject.18 The medical periodical Chikitsā Sammilanī, a magazine of health and medical science instructing families on modern concerns surrounding sexuality and sexual relations in late colonial Bengal, also uses the word hastamaithun for the ‘evil’ practice of masturbation among male children and adolescents (Basu 227). Abul Hasanat’s Sacitra Youna Bigyān dedicates a section to ‘auto-eroticism’ (svayaṁmaithuna) and ‘masturbation’ (hastamaithuna), and includes these phenomena in the section ‘The Multiple Manifestations of the Sexual Perception’ (younabodher bibhinnamukhī prakāś) (Hasanat 200-1). Although the word ‘masturbation’ linguistically speaking is an ‘orthophemism’ that does not constitute an offense,19 the trespassing from the medical space into the public domain of literature and poetry makes its interpretation more problematic, to the point that it becomes one of the triggers of the obscenity charges, as it is pointed out by the Magistrate of the obscenity trial (Decision by Presidency Magistrate, 1965). In the following verses of SEJ, the contentious topic of masturbation and the  cultural significations of male semen are addressed with the Bengali words śukra and bīrya:
    Let me create myself in your womb with my own sperm [śukra]
    Would I have been like this if I had different parents?
    Was Malay alias me possible from an absolutely different sperm? [śukra]
    Would I have been Malay in the womb of other women of my father?20
    […]
    I will die
    Oh what are these happenings within me
    I am failing to fetch out my hand and my palm
    From the dried sperms [bīrya] on trousers spreading wings
    3000000 children gliding towards the district of Shubha’s bosom
    Millions of needles are now running from my blood into Poetry
    Now the smuggling of my obstinate leg is trying to plunge
    Into the death-killer sex-wig entangled in the hypnotic kingdom of words
    (Bakken 1967)21
    The English ‘sperm/s’ for both words in SEJ does not distinguish between the meanings of the two Bengali words śukra and bīrya, two equivalents of the English ‘sperm’, ‘semen.’ The Samsad Bāṁlā Abhidhān considers both terms, śukra and bīrya, as synonyms, although there is a qualitative difference between the two that classifies śukra as noun only, and bīrya also as attribute (i.e. as in the adjectival construction bīryavān or bīryaśālī, ‘endowed with vigour’). The Sanskrit definition of vīrya associates it with ‘manliness, valour, strength, power, energy’, and only in the third entry with ‘manly vigour, virility, semen virile’ (Monier-Williams 1006); the modern Bengali usage assigns to bīrya the characteristics of valour, courage and heroism, which are by definition qualities that pertain to a male hero, a bīr (Biswas 756). As also Kakar observes, vīrya is “a word that stands for both sexual energy and semen. Virya, in fact, is identical with the essence of maleness: it can either move downward in sexual intercourse, where it is emitted in its gross physical form as semen, or it can move upward through the spinal chord and into the brain, in its subtle form known as ojas” (Kakar 118-9).Hasanat’s sexology book, in the section describing the male sex organs, abounds with compounds having śukra- as first noun for organs related to the production of semen (i.e. śukrakoś; śukravahī nala) (93). ‘Spermatozoa’ here translate as śukrakīṭ and are described as follows: “The man’s spermatozoa give life to the woman’s eggs. The spermatozoa are immerged in the liquid part of theman’s semen (puruśer śukrer aṁgśe bhāsiyā beṛhāy)” (86). The recurrence of śukra in such texts, as compared to the absent bīrya, suggests the scientific connotation of the former.
    In Malay’s poem, bīrya stands as the concrete physical appearance of the spermatic liquid, while śukra represents the neutral, scientific term that refers to the smaller units of the latter, the spermatozoa, as shown above in Habunat’s sexology book. Drawing a distinction between the two words becomes a significant operation in the translation of Malay’s medical language: if śukra is an orthophemism, a neutral term with neither positive nor negative connotation, bīrya has attributive quality and is intentionally juxtaposed to the latter to suggest a metaphorical reference to the poet’s troubled masculinity, expressed through the culminating gesture of the poet who compares the activity of masturbation to poetry-making. Also the recurrence of the words bīrya and bīj rather than śukra in Falguni Roy’s poetry is used in a significantly different context where the ‘liquid flow of sperms’ is the material substance through which heredity traits are transmitted: “In the liquid flow of sperms inside autoeroticism there is a skeleton of 206 bones and fleshy nerves sticking to the skeleton in the liquid semen the semen of memories of thought-carrying sound” (Miśra 29). The abstract matter denoted by the word śukra is substantiated in bīrya, significantly originating from the same root of bīj, the seed, through the bodily materialization of the spermatozoa during ejaculation. Hence in my retranslation I suggest preserving the ‘material’ differentiation denoted by the Bengali words by translating śukra as the English ‘semen’ and bīrya as ‘sperm’, following the Oxford Learner’s Dictionaries of the English Language that define ‘semen’ as “the whitish liquid containing sperm” (‘Semen’, Oxford Learners Dictionary). Exploiting the Latin etymology of semen, I aimed at highlighting the medical representation of male semen.
    Give me birth again from your womb with my own semen
    Would I have been like this even if I had different parents?
    Would I have become Malay alias me from a completely different semen?
    Would there be Malay if my father had impregnated another woman?
    The orthophemistic or neutral connotation of the words ātmamaithuna, śukra and bīrya, shows that Malay pursued an ambivalent strategy of sanitization of the text through the medical lexicon that resulted in an ironical ‘inversion’ where the ‘dirty’ sexual matter is elevated to lyrical subject of poetry, while the high status of the scientific language is minimized through the transgressive descriptions of masturbation and bodily fluids. Masturbation is not only painted as a mechanical act, but it stands also as the ultimate condition of the alienated male poet, the ultimately bourgeois man of modernity, inexorably caged in a modernity that mechanizes sexuality and disintegrates relationships between the sexes.
    Concluding Remarks
    In this paper, I have tried to clarify the linguistic terminology related to the description of sexual organs and masturbation, and to identify the textual strategies for sanitizing the ‘sexual body’ in selected passages of Malay Rāychoudhurī’s banned poem ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ and his English self-translation ‘Stark Electric Jesus’. First, the use of a medical terminology for describing the ‘sexual body’ in Bengali (i.e. yoni, jorāyu, mūtrāśay, śukra, yonivartma, satīcchad, ātmamaithun, rajahsrāb, śleṣmā) and in the English translation (i.e. uterus, bladder, semen, urethra, hymen, selfcoition, seasonal bloodstream, ovum-flux, phlegm) functions as a strategy of ‘sanitization’ of the language related to the contentious topic of the text. The incorporation of transliterated English words into the Bengali poem (i.e. lābiyā myājorā, yuṭerās, kliṭoris) allows the poet to attenuate the ‘bawdy’ and ‘obscene’ perception of what the Bengali middle-class interprets as indecent and offensive. The hyper-literal, artificial constructions of the English translation (i.e. self-coition, seasonal bloodstream) aim at representing the body as a machine, in its purely biological functions. Secondly, as illustrated by the discussion surrounding the translation of the word dharṣaṇ, the hyper-technical lexicon of medical sciences could be seen as a moderate practice of self-censorship that ‘obscures’ the most controversial aspects treated in the poem as a tactic to defend himself against further institutional censorship. Yet the poet’s subversive use of the medical lexicon allows for a double effect of subversion of the textual components: on the one hand, the high status of the scientific language is brought down to earth by applying it to the semantic sphere of sex, a subject considered unsuitable for
    the ‘respectable’ sphere of poetry. On the other, the socially reproachable topics of masturbation and un-reproductive sexual activity gain dignity of literary and lyrical subject by being dealt with a scientific terminology that dislocates the repulsive sexual matter to the ‘extra-ordinary’ discourse of poetry-making.
    In the duality of Malay’s poem, located between irony, sanitization, literary subversion, and self-censorship, dwells the ‘radical’ operations of the translator and the problematic process of retranslation. The pragmatic choices of my re-translation and re-reading of ‘Pracaṇḍa Baidyutik Chutār’ reflect the need to propose a new text that identifies and reproduces the strategies already foregrounded in the source-texts. The multiple textual strategies already identified in the ‘original’ poem shall not be neglected by the translator who wants to produce an ethically and politically correct translation. The conclusions that I want to share in this paper are based on my experience of translating so-called ‘obscene’ modern poetry in Bengali; they show that translation remains a ‘tentative process’, neither impossible nor fully possible, that can change according to the tasks and intentions of the translator, who becomes a ‘visible’ agency, to follow Venuti’s main argument, of a newly produced independent text. As translators, especially of writings of living authors, we have to engage with the ‘life’ and mobility of that text, confront the textual strategies and the material and economic conditions behind the production of the piece of writing. Finally, what I draw from the ‘tentative process’ of translation of Hungryalist poetry is: that one way to process a ‘radical translation’ is to elaborate a personal and contextual practice of the latter by going to the ‘roots’, that is, to the textual, economical and material reasons of semantically problematic texts such as ‘obscene’ poetry.
    Notes
    1 I am borrowing this evocative phrase from Allen and Burridge, which offers a perspective on ‘the human psyche’ in its relation with ‘tabooed language’ (2), who associate “bodily effluvia like ear-wax, menstrual blood, piss, semen, shit, snot, spit, sweat and vomit” with “dirt, rotting organic material” (41).
    2 See, for example, Gladfelder’s overview of the debates on the cultural significance of erotic, obscene, and pornographic writing from the eighteenth century (Gladfelder 2013). Here he lists the criteria that scholars have used to distinguish among the concepts of ‘pornographic, obscene, erotic, bawdy, lewd, and indecent’, such as authorial intention, content, tone, mode of representation, reader and political or censorial response. For instance, an ‘obscene’writing is defined as ‘a description whose effect is shocking or disgusting [reader response]’,while ‘bawdy’ denotes ‘the humorous treatment of sex [content and tone]’ (Gladfelder 5).
    3 For works that focus on India, see for example Deana Heath’s exploration of the British biopolitical project of regulation of the obscene in Britain and its relocalization in the colonies (Heath 2010); Anindita Ghosh’s analysis of the popular prints of Baṭtalā market in colonial Bengal (Ghosh 2006), and Charu Gupta’s study on the emergence of discourses on gender and sexuality in colonial Hindi pamphlets (Gupta 2001).
    4 There has been a long controversy on the issue of the ‘founder’ (sraṣṭābitarka) in Bengali criticism on the Hungry Generation (Sen 13-6). Meetings and interviews with some old Hungryalists and other contemporary poets have proved the existence of multiple narratives on the history of the movement. I have noticed a clear negative stance against Malay Rāychoudhurī on behalf of some Bengali academics and critics, as well as of some poets and translators who associated with the movement in the past. On the other hand, Malay has been the gigantic omnipresence of Hungryalism compared to others participants of the rebellious group, who celebrated himself as a ‘great poet’ (mahākabi) and as the only founder of the movement (Sen 13). The eminent Bengali critic Jyotirmoy Datta, for instance, claims that
    Malay has been “quite as generous to himself and his brother as he is niggardly to others”, alleging Bengali criticism and writing to be “dead, mummified, goofy, but when he comes to himself his language rises to lyric heights” (Bakken 1967).
    5 “I’ll have to translate all the matters. Because my friends are not well to do with English. I, myself, can somehow cook in English, as you find in this letter. So you’d have to edit the matter properly. You give all sorts of matter in it. You can include my poem” (Letter from Malay Raychoudhuri to Dick Bakken, 18.4.66).
    6 Decision by Presidency Magistrate, Bankshal Court, Calcutta, concerning Malay
    Roychoudhuri’s Poem “Prachanda Baidyutik Chutar”, Case No. Cr/579 of 1965 (Courtesy of Stanford University Libraries, Dept. of Special Collections, Ginsberg Papers).
    7 The phrase ‘sexual body’ is used in Nandini Dhar’s article to criticize the misogynist stance of much Hungryalist poetry, where women are represented as “nothing but bodies on which desire is projected” (Dhar).
    8 “Barāṅga, bīrya, mūtrāśay, satīcchad, yuterās, ṛtusrāb, yonivartma, śukra, yonikeśar, poṁd, prasrāb, ityādi”. He later on explains his embarrassment in reading out the poem or reciting it in public because at a first reading those words had sounded ‘obscene’ (aślīl) to him (De 211).
    9 According to the digital Oxford Living Dictionaries of English, the word has two definitions: the first one is a shortened version of ‘raccoon’ (the North American Procyon), while the second is an offensive way to address a black person. Considering that the original Bengali poem has bhālluker chāl (lit. bear fur), I assume that the English translation ‘coon’ must be a metonymic use of the word that, by extension, must here signify the pubic hair. Yet one fundamental question remains unanswered: why did the Bengali poet and the American editor use such a problematic word, at least for a virtual American readership of the Sixties, such as the slang ‘coon’? In the limited space of this paper it suffices to take this example as a further evidence of the multiple –and unexpected!– manners of subverting the original meaning of a
    given text.
    10 Unless stated otherwise, all quotations of the English poem ‘Stark Electric Jesus’ in this paper are taken from the issue of the journal Salted Feathers dedicated to Hungryalism and Indian experimental writings (Bakken 1967).
    11 In a private conversation, Malay confirmed his selective choice of the words that illustrate the sexual body from a Bengali medical handbook until then unknown to him (Private Facebook conversation with Malay Rāychoudhurī, April 17, 2018).
    12 I am deeply grateful to Projit Bihari Mukharji who has shared with me his findings and considerations on Abul Hasanat’s Sacitra Yauna Bigyān. In a private conversation via email, Projit Bihari Mukharji kindly informed me that Abul Hasanat was a police officer who turned to sexology partly under the influence of Girindrasekhar Bose (who corresponded with Freud and presided over one of the most popular literary addas in the 1920s/30s). Hasanat began writing on sexology in the late 1930s, and wrote several books on the subject until the early 1950s, which remained highly popular through the 60s. One of Hasanat's stated missions was to create a scientific vocabulary for speaking of sex in his mothertongue, viz. Bengali. Hasanat's mentor, Girin Bose, was the elder brother of Rajsekhar Bose (aka Parasuram, the litterateur) who purportedly presided over a Calcutta University committee to create a scientific vocabulary in Bengali (private mail conversation, April 17, 2018).
    13 The italicized words are my own rephrasing of Malay’s English translation.
    14 “tāhole āmi dukoṭi ālokbarṣa iśbarer poṁde cumu khetum/ kintu kichui bhālo lāge nā āmār kichui bhālo lāgche nā/ ekādhik cumo khele āmār gā guloy/ dharṣaṇkāle nārīke bhule giye śilpe phire esechi katadin/ kabitār ādityabarṇā mūtrāśaye/ esab kī hocche jāni nā tabu buker madhye ghoṭe jāchhe aharaha […]/ āmār smṛtiśakti naṣṭa hoye jācche/ āmāke mṛtyur dike jete dāo ekā/ āmāke dharṣaṇ o more jāowā śikhe nite hoyeni” (Rāychoudhurī 187).
    15 Private Facebook conversation, April 17, 2018.
    16 He further argues that the obsession of India-related scholarship for semen anxiety has overshadowed the multiple, little ‘social topographies’ that could constitute a fuller picture of Indian sexualities, a word that the sociologist declines in plural (Srivastava 4).
    17 “śudhui rādhikā noy - gāṇikāo ṛtumatī hoy/ tin santāner pitā – paribār parikalpanār
    ādarśapuruṣ/ kaiśore kare thāke ātmamaithun – kare nā ki” (Mishra 19).
    18 “Svamehan” (n.d.). In Wikipedia. Retrieved January 23, 2018, from
    https://bn.wikipedia.org/wiki/স্বমেহন
    19 As pointed out by Allen and Burridge (29), masturbation is an orthophemism, a neutral term with neither positive nor derogatory connotations.
    20 “āmāke tomār garbhe āmāri śukra theke janma nite dāo/ āmār bābā-mā anya holeo ki erakam hotum?/ sampūrna bhinna ek śukra theke malay orphe āmi hote pārtum?
    (Rāychoudhurī 188)
    21 “oh e samasta kī ghaṭche āmār madhye/ āmi āmār hāt hāter ceṭo khuṁje pācchi nā/
    pāyjāmār śukiye jāoyā bīrya theke ḍānā melche/ 300000 śiśu uṛhe jācche śubhār
    stanamaṇḍalīr dike/ jhāṁke jhāṁke chuṁc chuṭe jācche rakta theke kabitāy/ ekhan āmār jedi ṭhāṅger corācālān seṁdote cāiche/ hipnoṭik śabdarājya theke phāṁsāno mṛtyubhedī jounaparculāy” (Rāychoudhurī 189).
  • Malay Roychoudhury | ১২ অক্টোবর ২০২২ ১৮:০০738595
  • Malay Roychoudhury in Conversation with Daniela Cappello 
    Introducing the Poet
    Malay Roychoudhury (1939) was born in Patna, Bihar, in a family of Bengali Brahmins, claiming to descend from the clan of Sabarna Roychoudhury, the  zamindar family who handed over rental rights of Dihi Kalikata, Gobindapur and Sutanuti  to the British in what is today’s  Kolkata. Malay’s grandfather was a mobile photographer and on his sudden death at Patna his seven sons and a daughter became penniless. While Malay’s eldest uncle Pramod got a job of dusting statues at Patna Museum, Malay’s father started a photography shop. His mother was a housewife. His childhood was spent in Patna’s  Imlitala slum area inhabited by low-caste ( at that time called ‘untouchables’) Hindus and poor Shia Muslim communities . His maternal grandfather was laboratory assistant to Sir Ronald Ross and the maternal uncles, who were comparatively richer and educated, stayed in Panihati, north Kolkata, the place where Samir stayed during his education at City College, Kolkata. Malay used to visit Panihati during summers to keep in touch with sophisticated Bengali language and culture. His elder brother Samir studied in Kolkata, where he befriended a group of young poets (Shakti, Sunil, Ananda, Dipak and others) with whom he shared his passion for poetry and literature. Malay joined his brother Samir in Kolkata only later. In 1961, he and other fellow poets published the Manifesto on Hungryalist Poetry from Patna, which announced the foundation of the avant-garde and anti-establishment movement the Hungry Generation. In 1961 he along with his brother Samir, Shakti and Haradhon Dhara started the movement Hungry Generation (from Patna), a group of wild and rebellious poets who were tired by the lyricism of most Bengali poetry as well as with the literary establishment that, according to their view, was bourgeois and exclusive in taste and values. The movement and its poets were arrested on charges of obscenity ( Section 292 Penal Code ) and conspiracy against the State ( Section 120B Penal Code ) in 1964. Though the rest of the writers were released, and after a trial by lower court, Malay was sentenced to either serve jail for one month or pay a fine. He lost his job. Copies of Hungryalist writings were seized by the police. He was sentenced for his poem “Stark Electric Jesus' ' which was judged obscene by the lower court magistrate. Some poets were defence witnesses at his trial, like Sunil Gangopadhyay, Jyotirmoy Datta and Tarun Sanyal. However some of his friends testified against him, like Shakti Chattopadhyay, Sandipan Chattopadhyay, Saileswar Ghose, Utpalkumar Basu and Subhas Ghose. There was national and international pressure, especially from Hindi, Gujarati and Marathi writers and the American avant garde writers and from the Beat poet Allen Ginsberg. The sentence was overturned by Kolkata High Court  in 1966. 
    Malay has continued to write and publish collections of poems, novels, short stories and translation of poems. Since the 1990s, with his brother Samir, who edited the avant garde magazine Haowa49, he contributed to discussions on postmodernism and magical realism in Bengali. He is a prolific writer who has written about 80 books since he launched the Hungry movement. Worthy of mention are his poetry collections Shaitaner Mukh (1963),  the long poem Jakham (1965 ), Medhar Batanukul Ghungur ( 1987 ) and Kounaper Luchimangsho ( 2003 ). His prose writings are mostly from the 1990s, such as the five-part postcolonial novels Dubjaley Jetuku Prashwas (1994); Jalanjali (1996); Naamgandho (1999), Ouras ( 2020 ) and Prakar Parikha ( 2021 ) reminiscent of the format and textual design of the Mahabharata, which have been defined as “the novels of rebellious counter discourse” and “a real time post-Independence socio-political nightmare”.  Nakhadanta (2002), a narrative segmented into seven-day stories (drawn from Ramayana) related to the decline of the jute industry around Kolkata in particular and political violence that took place around that time. In Chhotoloker Chhotobela ( 2004 ) he has written his memoir of Imlitala days. This book has been revised to include his entire life and published as Chhotoloker Jibon in 2022. In 2003, he was awarded the prestigious Sahitya Akademi prize for his Bengali translation of Dharamvir Bharati’s Suraj ka satvan ghora but he refused it. He has translated into Bengali works by William Blake, Baudelaire, Arthur Rimbaud, Tristan Tzara, Andrè Breton, Jean Cocteau, Blaise Cendrars, Jean Genet and Allen Ginsberg as well as Arab, Uighur and Pakistani poets.. Malay’s translation of Illuminations by the French poet Rimbaud and Paris Spleen by Baudelaire have come out in early 2020. 
    Geographies of Youth
    Question 1. Malay, you belong to a Bengali family from Patna. Your family claims to descend from Sabarna Roychoudhury family but by the time your great grandfather was born, your family had lost the lands and privileges of the title ‘roychoudhury’ – which was traditionally assigned by the Nabobs  under Mughal rule – and what remained was only the name and the social history behind that title. I think that already this contradiction in narrating about yourself sums up your style and your work. How do you think Patna, Imlitala and the history of your family was significant to you and to your literary persona?
    Answer 1: Though we lived in Imlitala slum, our house was full of Sabarna Roychoudhury items brought by boat from the ancestral zamindari villa at Uttarpara which has since been dismantled and a housing colony constructed in its place. Myself and Samir have sold off our share to the builder. Items brought were Iranian perfumes, very big golden frame mirrors, a mantle piece, gramophone records, silver tobacco stand, big utensils, mounted heads of tiger, deer, wolf etc and musical instruments such as organ, sitar, tabla, clarionet, harmonium etc. which reminded us of our past ancestry. My cousins, uncle Promod’s daughters, Sabu and Dhabu, used to play them before their marriage. Problem was that  my father was the main earning person  running the extended family of twenty members. Ancestry remained only as a miasma. What mattered was the real world of Imlitala. Uncle Pramod did not have a son ; so he purchased a baby boy from a prostitute, obviously of lower caste. Though Brahmin, our family did not prohibit us from mixing with our low caste neighbours, who were mostly petty criminals, and poor Shia Muslims, who had fled from Lucknow when the city was attacked by the British.  We had no restriction on entering their houses. We brothers ate roasted bandicoots, pork meat and drank palm toddy and rice liquor, smoked cannabis at those neighbours’ festivities right from childhood.  My eclectic persona and urge to rebel against restrictions was a gift from these people. Our parents did not stop us from entering Muslim houses from whom we purchased duck eggs. We also entered the local mosque to hide behind namaz mats while playing hide-and-seek. They also gave us goat legs during the celebration of Bakrid. Since uncle Pramod worked at Patna Museum, I sat behind his bicycle and visited the Museum on holidays. It was a wonderful experience for me. You just cross a door and  step into prehistoric life, Mohenjodaro, Egypt or Shivaji’s Fort. I came across the dead as living beings. These were the main influences. There was no burden from my ancestry. Though a Hindu-Muslim mixed locality, there were no riots at Imlitala before, during or after partition of India. I used to roam the lanes with a cross made of two wooden planks from my Dad’s parcels and shout ‘Hip Hip Hurray’ with Imlitala urchins, like Samir’s football team, not knowing much about Christ at that time. Imlitala being an ignominious locality, Bengalis of Patna avoided visiting our house ; to them we were “Cultural Outsiders.” Bihari friends of uncles and aunts visited our house without qualms. In fact my mother and aunts did not know that the ‘Imlitala Hindi’ they were speaking was not sophisticated and some expressions were indecent. The Imlitala tap was just in front of our house ; ladies who had babies with them handed infants over to an old man who rested on the outside platform of our house, where our windows opened. This old man used to teach abuse to the infants and the infants often asked, “Grandpa, shall I tell him/her this abuse?”
    Question 2. You grew up in the Patna slum of Imlitala, inhabited by Shia Muslims and Dalit Hindus alike. Your maternal uncles stayed in Panihati, north of Calcutta, and they were comparatively richer and educated, and this is where Samir was sent for study after High School and you were sent during summers to keep in touch with Bengal.  What about Kolkata? What did it mean for you and your peers to move (back) to West Bengal? Do you remember having any particular “imagination” or expectation about the city of Kolkata before you reached it?
    Answer 2. Firstly, nobody from our family thought of moving back to West Bengal. Samir did, when he was in his sixties,  to launch his magazine ‘Haowa49’, and prove that he was not a “Cultural Outsider”. Haowa49, according to Rigveda,  means Unopanshash Vayu representing fortynine storms of madness. Except for Utpalkumar Basu, all of his Krittibas friends avoided writing in Haowa49. I lived in Kolkata from time to time but not permanently. In fact I have not lived permanently in any city. Uttarpara, where we had our ancestral villa and Panihati, were pristine villages during my childhood. Compared to Imlitala, those were completely different. My maternal uncles had a huge garden with various fruit trees and two ponds full of fishes. Samir learned swimming and I learned angling as well as climbing trees. They had a library with photographs of famous Bengalis hanging on the wall. We used to visit Ahiritola, at the centre of Kolkata, from our childhood, where Aunt Kamala ( Dad’s sister) lived with her husband, six sons and two daughters. During Durga puja we visited the main Sabarna Roychoudhury house at Barisha but had a dislike for the slaughters of goats and buffaloes and their blood offered to the deity in earthen pots.. It seemed strange because at Imlitala the pigs were also slaughtered before roasting. The partition refugees did not come to Kolkata till then, when I first visited the city. No new imagination grew as I had the experience of the city whenever I went to Aunt Kamala’s house. In the late 1950s, Samir and I got disturbed when we saw hundreds of destitute refugees living at Sealdah station, through which we had to go to Kolkata city from Panihati. It created a scar in our conscience and worked as the fuse of the Hungryalist bomb against the Establishment.  But I experienced real hardships of life at Kolkata during the thirty five months’ trial when I had no place to stay at night, no certainty of lunch and dinner. I had to wear the same shirt-pant for months without a bath. I used the toilets of long distance trains waiting on the Sealdah platform. The hearing at the court used to be only for ten fifteen minutes initially where I had to wait for my turn to come. I was friendless at that time and roamed the streets. I had seen the nightlife of Kolkata during that period. Aunt Kamala’s eldest son Sentu used to advice me to sleep on footpath with cheap prostitutes, in their mosquito nets. Kolkata told me in clear terms that “Malay Roychoudhury is a cultural outsider”.
    Question 3. How was your relationship with your mum and dad? Do you remember it as a conflictual opposition or did you get along well? What did they do for a living, and in what way have they influenced your career as a poet, if so? What did they have to say about your poetry and your Hungryalist movement?
    Answer 3. Dad being the main source of income, had no time and my mother was in charge of the family. Both of them had never gone to school. Dad was self-taught. I was much closer to my mother. She would shout from the kitchen, “read loudly so that I may hear”. She had only one anxiety that I should not become like Arun, our brother who was purchased by uncle Pramod as Arun had become a ruffian, stole items from home, fled away many times after breaking uncle Pramod’s cash-box, and secretly brought women at night when everybody slept. Arun died young and that solved everybody’s problem. Samir was sent to Panihati so that he was not influenced by Imlitala. When I was in High School Dad purchased a house at Dariapur to avoid Imlitala influence. I lived alone in that house with uncle Biswanath’s brother in law who had come to learn photography.  Mother was not religious minded. Except for uncle Promod’s wife Aunt Nandarani, none of the aunts and uncles were religious minded. None of them visited temples or went on pilgrimage. I do not know why. Maybe because we could not afford it. Uncle Promod was the guardian and children were punished by him ; main punishment being a few sticks on the palm or cleaning his bicycle. After we shifted to Dariapur, Dad appreciated that I had started writing and gave me a beautiful diary ; he also told me to identify books at a local shop to deliver at home and collect payment. I had purchased a lot of English books to start my own library. Prof. Haoward McCord and Lawrence Ferlinghetti had also sent a lot of books. Since Hungryalist movement initially attracted publicity, both of them were happy that we brothers were becoming famous. When the police came to arrest me both of them were angry with them as they broke open Dad’s glass-showcase and mother’s wedding trunk, handcuffed and tied a rope around my waist while arresting me.  Dad and other uncles had come to Kolkata to select a lawyer for me and Samir.  Aunt Kamala’s husband used to visit the lower court to keep Dad informed. Dad had said that there was nothing to worry as I may fall back on the photography business if anything untowards happened. Dad had met the Kolkata Police Commissioner and complained about the vandalism by the policemen. The Police Commissioner had told him that they were not aware that ours was a serious literary activity. Mr. A.B.Shah, Executive Secretary of Indian Committee for Cultural Freedom had written to me on 27 January 1965, “I met the Deputy Commissioner of Police the day after we met at the office of the Radical Humanist in Calcutta. I was told that they would not have liked to bother themselves with the ‘Hungry Generation’ but for the fact that a number of citizens to whom the writings of your Group were made available, insisted on some action being taken.”
    Question 4. You went to a Catholic school and then to the Ram Mohan Roy Seminary in Patna , an institution run by the Brahmo Samaj, the monotheistic religion that aimed at reforming Hinduism in colonial Bengal. We could say that even your poem “Stark Electric Jesus”, or at least its title, carries the traces of that period. Your father was an orthodox Brahmin, and you too were invested with the sacred thread ceremony. Do you think that having been brought up in religious institutions made you more rebellious or transgressive? What was your relationship with Brahmanism – in the sense of practising the rules of purity and caste hierarchy – and with the daily rituals and practises of Hindu religion?
    Answer 4. The poem has several strains. The complexities of my life are included in it. My teenage and only love dominates. It took more than a month to write it. You are the first person asking this question. Nobody so far has asked what signified ‘Chhutar’ in the original poem and why it had been translated as Jesus. Yes, Samir and I had a sacred thread ceremony but we discarded the thread in a few months and did not observe the rules of Brahminism attached to it. If Brahminism had been observed by our family uncle Promod would not have purchased a baby boy from a low caste prostitute. Both the schools influenced my thinking and writing.  I got admission at Catholic school because of Father Hillman, an ameteur photographer who saw me playing at Dad’s shop and got me admitted for free. At the Catholic school I had to attend Bible classes every Thursday and came to know about the story of Jesus, and that carpentry was his profession. I also came to know about Moses, Joseph, Mary Magdalene and that Jesus’s mother remained virgin.  The wish to see the earth through cellophane hymen is possible only if your lover Mary is a virgin and you are in her womb. She was of snow white marble at the church which is Shubha in Bengali. Brahminisim was wiped off from  life during my days at Imlitala. Kulsum Apa’s house, a Muslim girl of very dark complexion, probably having African slave blood,  had intiated me into urdu poetry at Imlitala. Namita Chakraborty, the lady librarian, had introduced me to Brahmo Bengali poets and writers including Ram Mohan Roy, Shivnath Shastri, Rabindra Nath Tagore,  Jibanananda Das and others.  None of the schools in which I studied allowed Hindu functions. When I was urinating at the bank of the Ganges river, Allen Ginsberg shouted at me, “Hey, what are you doing ? It is a holy river !”
    Question 5. You and other Hungryalists wrote a manifesto on Religion, which started with “God is Shit”. Why is that? Which God were you thinking about? How important was religion for you and for your writing?
    Answer 5. Since no God existed for us, we had to attack the press whose owners had their God. I have pilloried orthodox religious views of others in my novels and stories. During my tours in villages throughout India I have seen people consider anything to be God, even a brick or piece of wood. My daughter presented to me three wooden gods of an African tribe. Kulsum Apa’s family had a flying horse made of tin which they revered. My erotic novel ‘Aroop Tomar Ento Kanta’ is based in Benaras and it deals with the city’s religious shenanigans ; even foretells the arrival of a conservative Hindu Political Party. Another novel ‘Naamgandho’ deals with a kidnapped Muslim baby girl during partition of Bengal by a refugee Communist-turned-landlord Hindu who becomes village chief. The baby girl grows up in a Hindu household and observes Hindu rituals as she is unaware of her antecedents. Her childhood lover of refugee colony days,, a Bengali Christian, who wanted to rescue her, is murdered. She never knows about her origin. 
    Question 6. Let us now move to sex, sexual education, porn and sexuality back in the 60s for Bengali Hindus. What kind of stuff did you have access to? Any female or male sex icon you remember from cinema? Why sex was so central in the Hungryalist early writings? Would you say it was also a metaphor for something else? 
    Answer 6. There was no sexual education. As a child when I visited the Museum I had seen men touching the vagina and breast of  Apsaras whereas ladies touching the penis of Alexander. Continuous touches made those portions polished. When asked, uncle Promod had said, “grow up, you would know.” At Catholic school during piano class I had to stand between the legs of the piano Madam and my head touched her breasts and Do Re Mi Fa So La Ti Do resonates at the back of my head even now.  At Ram Mohan Roy Seminary ( it was a coeducation school ) a friend had a small triangular mirror to look at the breasts of girls which did not excite me. Large prints of naked Apsaras used to be processed by Dad but I had become accustomed to their open breasts and vaginal slits. I first read a porn in Hindi in which the penis was the hero and recorded its adventure. The second was ‘Fanny Hill’, which I do not consider as porn. There were no porn films at that time. My ejaculations had started before I came to know of masturbation from my class fellow Subarna. He had advised that the penis should be kept clean through masturbation otherwise lints would gather as we Hindus are not circumscribed like to Jews and Muslims. My first encounter with a female body was when Kulsum Apa stood naked in their dark dirty damp room full of ducks, hens, goats and sheeps. After embracing me and finishing what she wanted to do, she declared that “you are no more a kafir.”  These lines in SEJ are from the  encounter with Kulsum Apa : “The surroundings of your clitoris were being embellished with coon at that time. Fine rib-smashing roots were descending into your bosom.” Then again in the poem a reference to her : “Though I wanted the healthy spirit of Aleya's fresh China-rose matrix/Yet I submitted to the refuge of my brain's cataclysm”. Aleya, as you know, means ‘jack-o-lantern’. Before I talk about my female icons, let me tell you that uncle Sushil and his Hindu priest friend Satish Ghoshal used to watch Hindi films on Tuesdays on which Dad’s shop remained closed. Dad remained busy in photographic dark room but these two persons discussed about sex of Madhubala, Nargis, Suraiya, Rehana and others. Just imagine the atmosphere of our family. Four school friends Tarun, Barin, Subarna and myself would watch English films on Sunday mornings funded by Tarun who was from a rich family. Barin had a bicycle and visited the halls to have a look at the posters and decide which film was to be watched. I was fascinated by sexual appeal of Rita Hayworth, Elizabeth Taylor, Gina Lollobrigida, Sofia Loren, Brigitte Bardot, Audrey Hepburn. Among Bengali actresses I liked Suchitra Sen and Madhabi Mukhopadhyay. Among Hindi actresses I liked Madhubala and Nargis. All older than me and dead by now. Sex for me was a challenge that posed questions around self-awareness, right from my experience with Kulsum Apa telling me “you are no more a kafir”. But she really taught me to be an infidel. It was beyond my conscious fantasies, maybe even unconscious fantasies, though sexual desire were vital components of what it meant to be adult. During my undergraduation, at Patna, prostitutes, even housewives to make quick money, used to come from other side of Ganges, around student hostels, from evening onwards ; granite slabs of a discarded graveyard were used as beds for quick sex. Biharis are more open about sex than Bengalis. Imlitala had converted me to be a Bihari. Biharis are more beatnik than American Beat writers. Even now explicit songs are sung in village weddings in Bihar, with which I have been acquainted since childhood. Each year at Imlitala, during the festival of Holi, the ladies and gents both sang explicit songs and the people became so intoxicated with palm-toddy, rice liquor and cannabis that Samir, Arun and I were warned not to venture out. But we did go out in torn clothes to enjoy the merriment. Since you know Hindi, here is an example of a song: “Daye Or Baye Ke Hile Ta Lage Better/Hai Tor Duno Indicator/Daye Or Baye Ke Hile Ta Lage Better/Hai Tor Duno Indicator/Joban Hoi Fuse Je Karbe Tu Use/Hai Chadhal Tor Jawani Chhodata Kahe Pani/Ae Rani/Hai Chadhal Tor Jawani/ Chhodata Kahe Pani.” Thus, sex was not a taboo for the Imlitala boy.
    Question 7. Did age have anything to do with that (young boys in their 20s)? Or would you say that this hype about sexuality (in aesthetics and as a taboo in real life) was something rather social and historical that was rooting all over the world in those days?
    Answer 7. I had only a faint knowledge of what was happening all over the world. There was no Television and Internet in those days. The newspapers were more interested in Indian news than international. Whatever I could gather was from the magazines at the British Library and USIS Library and those libraries avoided such news to be presented to Indians. Confessional poetry underlining sex had not been written till then in Bengali and to a young man from Imlitala nothing was obscene or taboo. I enraged the Cultural Guardians of Kolkata who had no idea of the lingo of even lower caste/strata of Bengalis. Their aesthetic reality was upper caste/class and different from ours. I was from Imlitala, Debi Roy from Howrah slum, Saileswar, Subhas, Pradip, Abani, Subo were from refugee families, Subimal Basak was from a family of weavers. If you go through poetry magazines of that time, you would not find low caste names therein. You might have known that the present generation of Bengali female poets write in explicit language.
    Question 8. What did your wife Shalila and the other poets’ wives think about what you were writing back then? What was their role and place vis-à-vis the Hungryalist poets?
    Answer 8. Shalila did not have interest in literature. She can read Bengali but can not write. When I was introduced to her by a lady named Sulochana Naidu, it was she who showed Shalila my literary activities and photographs published in Hindi magazines. She was a field hockey player when I married her. My children and even grandchildren are proud of me. Initially my blogs were started by my son. But Shalila wonders why mostly two of my poems have been recited on youtube by more than fifteen vocal artists, one is SEJ and the other one being ‘Matha Ketey Pathachhi Jotno Kore Rekho’, which translates as ‘Sending my cut-off head, please keep it safe’. Other Hungryalist writers and poets got full support from their wife. Saileswar’s wife was a poet herself. Subhas Ghose’s wife was his financial backbone. Tridib’s wife Alo was a poet and financially supported him. In fact, Tridib’s wife arranged poetry readings at various places, and edited the English magazine ‘The Wastepaper’. Pradip Choudhuri, Subo Acharya, Abani Dhar, Basudeb Dasgupta and Subimal Basak’s wife did not have any interest in literature. Arunesh Ghose’s wife knew about his activities as he was living near a brothel during his formative days. Falguni Ray did not marry. Falguni was from a zamindar family which became so poor that the members started uprooting floor and wall marble plates and sold them.
    Question 9. We know that only one female poet participated in your movement – Alo Mitra, wife of Tridib Mitra. What was her role in the movement? Were there other female participants of which we don’t know about?
    Answer 9. When male poets were hesitant in joining us, how can you expect female poets would join ? Saileswar’s wife Sunita had joined but that was after my trial. Female poets of my generation even now are shy of writing sex oriented poems though such poems are being written these days by young female poets. I would like to say that they are more bold than we were during our movement. About Alo Mitra’s role I have already talked about. She also edited a collection of letters written to me.
    Question 10. Does it bother you when people, readers and even scholars to some extent remind you of the obscene & wild writer of Stark Electric Jesus? What is your current relationship with that poem?
    Answer 10. Yes, it does. Many readers, mostly from Bangladesh, are stuck at SEJ. When they interview me or write about me they focus mainly on this poem though I have written hundreds of poems and written several novels and plays. Even young ladies are mesmerised with SEJ. I want to tell readers, please look beyond SEJ to my other works, especially essay collections on the socio-political condition of India in general and West Bengal in particular. Recently, Pooja Gupta, a painter, arranged installation of Hundred Prosecuted Poets in various cities of the world in which SEJ was included. The installation shows pierced poems on sharp rods in a dimly lit hall and voices reciting the poems one after another. SEJ to me is a double edged weapon.
    Question 11. In your confessional poetry, as well as in other Hungryalist poets from the 1960s, the “male gaze” is easily recognizable. And in fact, about the Hungry Generation poetry, someone once stated that “all Hungries must prove that they are Alpha males” (who was it?). One can say confessional poetry written by male writers, as if there was a clear intention of representing the 'personal’ as a masculine “I”. Would you agree with that? 
    Answer 11. Yes, I agree. Miss Sreemanti Sengupta of ‘The Odd Magazine’ talked about Hungryalists trying to prove they are Alpha males.  I have written poems titled ‘Alpha Female Bidalini’ and ‘Alpha Purusher Kobita’, Saileswar Ghose and Arunesh Ghose’s poems have strong ‘male gaze’ and the masculine “I”. There is nothing unethical about the “male gaze”. Greek, Roman and Hindu epics are all stories of Alpha males. In the animal world the male elephant and tiger is able to pick up the fragrance of a female in heat from ten kilometres away. Human  beings have lost that power.
    Question.12. Why do you think you and other Hungryalist poets were accused of “misogyny”? Do you consider yourself one?
    Answer. 12 . No, I do not consider myself a misogynist. None of the Hungryalist poets were misogynist. These imputations were made by middle class Bengali academicians and not by academicians of other Indian languages in which our poems were translated. Famous Hindi writers like Phanishwar Nath Renu, Kamaleshwar, S.H.Vatsyayan Ajneya, Dharmavir Bharati wrote about us and published translated works in Hindi periodicals. Poet Nagarjun arranged to get Jakham translated and published in Hindi. Gujarati writer Umashankar Joshi wrote about us. Marathi poets Arun Kolatkar and Dilip Chitre wrote about us. Misogyny  is hatred or contempt for women. It is a form of sexism used to keep women at a lower social status than men, thus maintaining the societal roles of patriarchy. People who have read my novels would not say that I am a ‘misogynist’. Even in poetry I have offered my severed head to my beloved. Several of my poems talk about the fingers or feet or eye movement of my beloved.
    Question.13. How has your perception on sex and love changed in your works – from Stark Electric Jesus to later poems ?
    Answer. 13. You can not stick to the same type of poetry throughout your life. It changes with reading world poetry as well as  experience. Otherwise there is no use of publishing poetry collections after the first one. Love is a maddening experience. Moreover the idea sex changes with age. I had published a book titled ‘অ’, the first vowel in Bengali, in 1998, and in that book I have dissected twenty three poems of mine including the vocal speed factor in SEJ. Love is maddening, fascinating, intoxicating and sometimes disastrous. My cousin sister Meenakshi wanted to marry a Bihari non-Brahmin boy; no one in our family was agreeable - I completed the solemnization wearing a pink dhoti, yellow cotton shawl and cohl in my eyes according to their custom, at a mas marriage in a temple in Khusrupur, Bihar. My sister in law Ramola wanted to marry a non Brahmin boy for which none in Nagpur was agreeable ; I had to bring the couple to Patna and solemnise their marriage at Arya Samaj. Aunt Omiya, wife of uncle Anil was in love with a person who did not marry, went to live at Aurobindo Ashram, Pondicherry. Aunt Omiya maintained relations with him and often visited Pondicherry, an affair which imbalanced uncle Anil who became a recluse, washed his own clothes, gave up wearing shoes, ate only once a day and stopped talking to everyone except Dad. He died alone at Uttarpara weeping for aunt Omiya, who had died of breast cancer. Uncle Sunil’s daughter Puti fell in love with a boy working as a bearer at her father's catering job ; since nobody agreed, she died by hanging herself. Puti’s brother Khoka knew that his father would not agree and therefore eloped with the lower caste girl he loved and went to live at Hyderabad. The girl was brilliant in mathematics and became a famous convent teacher at Thane, near Mumbai.  Samir was in love with a married lady named Gouri to whom he dedicated his first collection of poems ; in order to maintain relations with her family he married her younger sister Bela. A junior lady officer at Lucknow was in love with me and caught hold of my hand at a bus station when I was going on tour and said, “let us elope. I have told your wife that I love you.” I was stunned and convinced her that we may think over the issue calmly afterwards. She committed suicide after her marriage. Another junior lady officer at Mumbai, came to me one day and introduced herself by declaring, “you know, I do not have a uterus.” I had to avoid talking to her thenceforth. Youngest uncle Biswanath married a tenant’s daughter Kuchi at Uttarpara though granny did not approve of it, since the girl belonged to same gotra. Because of Biswanath’s threats, granny had to agree. The couple used to sleep in Dad’s studio at Dariapur ; when they left Patna and went to live at Kotrong, a hut with land,  purchased by Dad, after about five years, Sentu and myself found in the trunk left by them several photographs of naked aunt Kuchi in various poses copying western artists. They were childless. Aunt Kamala’s daughter Geeta eloped with her husband’s nephew, an incident which had to be approved in a family meeting in which I was present. They did not marry, just lived-in together. Aunt Kamala’s husband committed suicide. Love has such strange getaways.
    Question.14. Politics seems to be more relevant to your novels than to your poetry. We have seen your narrative shifting to economic disorder, terrorism, political scam, government corruption etc. Would you say that your poetry (or that poetry in general) is political? And if yes, how?
    Answer.14. Why ? The long poem Jakham and the short poem Kamor I wrote during the Hungryalist movement were political. Jakham has been reprinted five times. Some poems in Medhar Batanukul Ghungoor, Ja Lagbey Bolben and Kounoper Luchimangsho are political. If you listen to Indian urdu poets you would know how poetry is being used as a political tool. Indian lady poet Iqrar Khalji writes and recites poems against religious restrictions. Literature in general has always been utilised to speak on important issues in a way that articulates an author’s feelings of injustice. Hungryalist movement itself was a result of Samir and my feelings about refugees on Kolkata’s Sealdah station platforms. Politics has become more relevant because of experience gathered by me during my tours in Indian villages. I have dealt with exploitation of tribals in my novels Ouras and Nongraporir Konkal Premik ; the second one is a detective love story.
    Malay Roychaudhury On Writing
    Question.15. You are both a poet and a prose writer, perhaps more of a poet in your youth and a prose writer in your adulthood. Would you say this is a historical shift? Do you still write poems?
    Answer. 15. Yes, I still write poems. I have published a total of thirteen collections in India ( the last one titled ‘Domni’ in 2020, love poems of a poet as a Baul ) and one in Bangladesh in 2019 which contains about hundred poems from various periods. A collection which includes novella, poetry, short story, translated poems, interview and analysis of my works was published in 2019. I have also written four poetic dramas. I am in search of a publisher who will publish all my poems and poetic dramas in one volume. I write prose to unburden myself of the nightmares seen by me during my tours. I have included real life incidents in some of my novels. In essays I try to present the human condition seen by me throughout India. During some of my tours in West Bengal I used to take Shalila with me so that she could enter the houses and find out the real state of the families.
    Question.16. How different is it to write a piece of prose and a poem? How different is the Malay-poet from the Malay-prose writer? 
    Answer.16. They are very different. Poems require a flash in the form of an image or line or idea or even a word ; one has to work on its diction, rhythm, images and choice of words. Earlier, when my fingers were not struck by arthritis, I used to keep a paper when I went out of home and note the ‘flash’ for using it later.  For writing novels I generally think of the entire story for days together and start writing ; I keep on working on the language and structure so that I do not repeat the same. It takes several months. For essays I start writing and keep on reading on the subject. 
    Question.17. What kind of things do you write or like writing today?
    Answer.17. I am thinking of writing a novel on the Marichjhapi massacre as a magical realist novel. Marichjhapi massacre refers to the forcible eviction of thousands of Bengali Hindu Dalit  refugees who settled on  forest land in Marichjhapi island in the Sundarbans, West Bengal, in 1979, and the subsequent death of hundreds refugees due to gunfire by police, rape, party atrocities,  hutments set on fire, blockades and resultant starvation, and disease. Several tigers became man eaters after eating floating corpses. I shall be using real life characters and that is the reason for resorting to magic realism. Otherwise I contribute to little magazines at the request of their editor.
    Question.18. Which writers/books/genres do you like reading today?
    Answer.18. To be frank, I do not get time to read others. I go through the little magazines sent to me and read a piece or two. We have become old and I help Shalila in cutting vegetables and cooking, loading washing machine, drying clothes etc. 
    Question.19. Tell us a bit about the writing process, if there is one. How do you come up with the right idea at the basis of a novel, and how do you feel it is right? How was it for you in the past? What is it that inspires you and pushes you to write?
    Answer.19. I have become addicted to writing. Writing has become some sort of drug. I do not drink or smoke anymore. These days I write several  novels and essays in draft form at the same time. I am a loner and I write every day. My tours throughout India have enriched my stock of experience in such a way that I use  incidents in my novels and essays. If a poem crops up I make a draft thereof as well , and after finishing it send it to any little magazine editor when requested.
    Question.20. In the last decade, young people in India and elsewhere in South Asia have been protesting for various reasons, and especially against the conservative measures taken by the BJP government. Freedom of speech and censorship have come back to the centre of political discussion, and university campuses have been one of the main battlefields. What is your take on that, having been a censored and banned poet in the past? Is there any continuity you see in India’s censoring policy since then?
    Answer.20. The censoring policy and process now has become more draconian. During Left rule in West Bengal, several plays were barred from being enacted, even famous writers like Nabarun Bhattacharya were denied permission.. Ananda Margies were burnt alive in Kolkata ; massacres took place in Nanoor, and Nandigram. I have used Rabindra Nath Tagore’s story ‘Kshudhita Pashan’ to impose on it the Sainbari killings in which the mother was fed  rice soaked in her sons’ blood. The leftist strategy of territorial control, called ‘elaka dokhol’ in Bangla, by slaughtering opponents, was one of the Left’s most potent political weapons. The new menace is fascist BJP. The Bharatiya Janata Party is a steam roller party, far more dangerous,  levelling all citizens into an idea of vague Hindu Nationalist ‘Indian Culture’ conceived by them. During my tour I had visited Ayodhya and what they called Ram Janmabhoomi ; I found that except for a sleeping constable on a charpoy the premises were completely empty. Now a huge temple is coming up in its place. I think because of poet Tulasidas’s Ramcharitmanas, Ram acquires an important place in the Hindi speaking population. These days reporters are murdered and cases do not reach the courts. BJP is funded by crony capitalists and most of the print and electronic media are controlled by them. Problem with fascism is that only few at the top decide and millions follow them.
    Question.21. Do you think that poetry can be a means to protest?
    Answer.21. Yes, it certainly can and is being used as a means of protest in various languages in India. The relationship between protest and poetry is not new in India and it goes back to before partition. This relationship can be traced back to the formation of the Progressive Writers Association in the 1930s. Hindi and Urdu language writer Premchand was made the president. Writers, poets, play writers joined the association in great numbers. Some of them included Faiz Ahmed Faiz, Saadat Hasan Manto, Ismat Chugtai, Mulk Raj Anand, Maulana Hasrat Mohani, Sahir Ludhayanvi, Kaifi Azmi, and others. Recently, Nabina Das has edited an anthology of protest poems in English titled ‘Witness - The Red River Book of Poetry of Dissent (2021)’.Telugu poet Varvara Rao, presently on bail,  was in jail for a long time. In 2021 I published an anthology of poems translated by me titled ‘Anti Establishment Foreign Poets’ which includes poems of Afghan, Ugandan, Israeli, Iranian, Cuban, Uighur, Chilean, Tibbettan, Nigerian, Pakistani, French, Indian and Russian poets.
    Question.22. If you could meet the young Malay in the early 60s, what would be your suggestion to him? Would you do anything differently, would you change anything?
    Answer.22. Recently I saw an Anti-Establishment little magazine editor in North Bengal  hired a vehicle with a loudspeaker and read out the poems and essays while moving throughout the town. He was obviously called by Police. I liked the idea and would have used the method to spread our presence throughout Kolkata and other West Bengali cities. In the 1960s our reach was limited to editors and academicians. I would have contacted young writers at district level and invited them to join. We remained Kolkata-centric and did not spread. 
    Question.23. In what way, with which feelings, do you look back at the Hungry Generation and at that period? Do you have any regrets?
    Answer.23. My regret is that I could not prevent the insult of my parents by the Kolkata Police.  Afterwards when my Dad died I could not be present ; I was on tour in Orissa at that time.
     

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন