কুমারপ্রসাদ ম্যহ্ফিল-এ লিখেছেন (৩২ পাতা), কমলকুমার মজুমদারের এই জাতীয় উক্তি 'পাড়াগাঁয়ে হিন্দু পরিবারে হেঁসেলের আঁশের কাপড়ে কেউ লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে হাত দেয়, না বিছানায় এসে বসে?' মানিকবাবুর ভাল লাগেনি। উনি বলেছিলেন কমলবাবুকে পল্লীগ্রামের ওপর ছবি করে আপনাকে খুশি করতে পারব না।
রাধাপ্রসাদ গুপ্তের জ্যাঠতুতো দাদা-- কমলাদা-- প্রথমবার সত্যজিত রায়ের সম্মুখীন হয়ে নেহাতই বিনম্রভাবে তার বক্তব্য পেশ করলেন
(১) গ্রামে শুধু কি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর কচি বাচ্চাদের এবং মধ্যবয়সী স্ত্রীলোকদের বাস? দেশে কি যুদ্ধ লেগেছে এবং জোয়ানরা সবাই যুদ্ধে চলে গেছে?
(২) একটাও পাখির ডাক শোনা গেল না গ্রামে দেড় ঘণ্টায়, কি আশ্চর্য!
(৩) রেলগাড়ি সিকোয়েন্সে অপু খাচ্ছিল শ্যামসায়রী আখ, দুগ্গার হাতে ছিল দিশি আখ, লক্ষ্য করেছিলেন কি? ইত্যাদি ইত্যাদি।
কুমারপ্রসাদও তাঁকে জানিয়েছিলেন --
মানিকবাবু, আপনার পথের পাঁচালিতে সবই সুন্দর, দারিদ্রও সুন্দর, শীতে গরম জামা নেই, বর্ষায় ভাঙা বাড়িতে থেকেও সবাই মনে হয় আনন্দে আছে, প্রথম বর্ষায় ভিজে দুগ্গার সান্নিপাতিক বিকার ও মৃত্যুর দৃশ্য এতই সংযত যে দারিদ্র্যজনিত দুঃখ স্পর্শ করবে না।” উনি শুনে গম্ভীরভাবে কুমারপ্রসাদকে বলেছিলেন “বিভূতিবাবুর বইটা পড়ে দেখবেন, ওই একই কথা মনে হবে।' বহু বছর পরে পার্থ বোসও আলোচনার মধ্যে এই কথাই বলেছিলেন, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালির দারিদ্র “অপরাজিত"য় অপুর কলেজ জীবনে স্ট্রাগল, বিয়ের পর জমিদারের মেয়ে অপর্ণাকে মনসাপোতায় খড়ের চালের ঘরে তোলা সব কিছুর মধ্যেই অসম্ভব রোম্যান্টিকতা আছে যা দুঃখকষ্ট ছাপিয়ে যায় পাঠকের মনে।
অশোক মিত্র তাঁর "তিন কুড়ি দশ" বইয়ের তৃতীয় খন্ডে জানিয়েছেন --
সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালি' প্রথম প্রকাশের অব্যবহিত পরে কমলবাবু একদিন এসে প্রায় দু'ঘণ্টা ধরে ছবিটির ধাপে ধাপে বাঙালী মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু সমাজের রীতিনীতি, স্ত্রীআচার, উৎসব, গৃহস্থালী-সংস্থানে কত অসঙ্গতি ও অজ্ঞানতা আছে একে একে বলে গেলেন, প্রায় সবগুলি মন্তব্যই অকাট্য মনে হল। সত্যজিৎ রায় যে সম্প্রদায়ে মানুষ হয়েছিলেন তাঁর এ-সব জানার কথা নয়। তবে, সবকিছুই নিখুঁতভাবে করা তো ছিল তাঁর পণ; না জানলেও শিখে নিতে পারতেন। কমলবাবুর মত নিশ্চিত জ্ঞান ও প্রতীতি আমি একমাত্র আশাপূর্ণা দেবীর 'প্রথম প্রতিশ্রুতি' বইতেই দেখেছি।
স্বপ্নকমল সরকার লিখেছিলেন "বালক অপুর তুলসীতলায় মুখ ধোয়ার দৃশ্যটি নাকি কমলবাবু একেবারেই মেনে নিতে পারেননি"। এখানেও ওই "নাকি" থাকায় একথা তিনি কোথা থেকে জেনেছেন জিজ্ঞাসা করার কোনো অর্থ ছিল না।
কমলবাবু বর্ণিত অসঙ্গতিগুলির তালিকা পাওয়ার আশায়, অরিনদা, আপনার বলা রাধাপ্রসাদের লেখাটার সন্ধান পাওয়া যাবে বলে যেটুকু দুরাশা ছিল "ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন" বললে তো সেটুকুও, হায়, জলাঞ্জলি যায়।