কদিন আগে শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন খাওয়া নিয়ে ভাট হচ্ছিল। সেই উপলক্ষে নেটে ঘুরে বেড়ানো এই লেখাটা শেয়ার করলাম।
“কেন আমি শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে যাইনা”
ঐন্দ্রিল ভৌমিক
যারা সিরায়াস এবং তাত্ত্বিক আলোচনা ভেবে পড়তে শুরু করেছেন, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তত্ত্ব কথা লেখার ক্ষমতা আমার নেই। সকাল থেকে রাত অব্দি পেশেণ্ট দেখতে দেখতেই কেটে যায়। শাস্ত্র টাস্ত্র ঘেঁটে দু একটা গুরু গম্ভীর কথা যে আপনাদের শোনাব, তা আমার সাধ্যের বাইরে।
শ্রাদ্ধ বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাইনা আমি অনেক দুঃখে। সেই দুঃখের গল্পই আপনাদের শোনাব।
এমনিতে আমি নেমতন্ন খেতে বেশ ভালইবাসি। সে বিয়ে, অন্নপ্রাশন, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকি যাই হোক। এমনকি লক্ষ্মী পুজো, কালী পুজো এসবের নেমন্তন্নও আমি পারতপক্ষে ছাড়িনা।
তবে আমার প্রিয় ছিল শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন। তার প্রধান কারন মাংসের চাইতে মাছের প্রতি আমার লোভ বেশী। আর শ্রাদ্ধ বাড়ি মানেই অবধারিত ভাবে দু তিন রকমের মাছ হবেই।
অনেক সমাজ সচেতন ব্যক্তি আমাকে অনেকবার বলেছেন, শ্রাদ্ধ হোল শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান, দুঃখের অনুষ্ঠান। সেখানে এমন এলাহি খাবার দাবারের বন্দোবস্ত, ইলিশ টা একবার ঘুরিয়ে দাও, পাবদাটা বেড়ে হয়েছে, এত হাহা হিহি খুবই অশ্লীল।
আমি তাদের কথায় ঘাড় নাড়িয়েছি। তর্ক ছাড়াই তাদের কথার সাথে একশ শতাংশ সহমত জানিয়েছি। কিন্তু যেই কোনো শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন পেয়েছি, গুটি গুটি পায়ে হাজির হয়েছি।
তবে আজকাল আমি আর শ্রাদ্ধ বাড়িতে যাই না। সমস্যার সুত্রপাত মেডিসিনে এম ডি করে স্থানীয় জায়গায় প্রাকটিস শুরুর পর থেকে।
আমি প্রাকটিস করি নিজের বাড়িতেই। ধারণা ছিল প্রাকটিসে বসলেই পেশেন্টের ঢল নেমে যাবে। নাওয়া খাওয়ার সময় পাব না।
কিন্তু বাস্তব অতটা সহজ নয়। প্রথম দিকে একেবারেই যে পেশেন্ট হচ্ছিল না, তা নয়। কিন্তু সে সব পেশেন্ট অত্যন্ত জটিল।
চারবার মাথায় স্ট্রোক হয়েছে। তিনবার ভেলোর ঘুরে এসেছে। উন্নতি বিশেষ কিছু হয়নি। কথা বন্ধ, বিছানায় শুয়ে শুয়েই পেচ্ছাপ পায়খানা চলছে। কোমরের দুপাশে দুটো বড় বড় বেড সোর হয়েছে। ঝিনুক দিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে।
তাঁর ছেলে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। “ডাক্তার বাবু, অনেক বড় বড় জায়গায় দেখিয়েছি। সবাই জবাব দিয়েছেন। দেখুন আপনি যদি কিছু করতে পারেন।”
আমার তখন গরম রক্ত। মাথার মধ্যে টগ বগ করে ফুটছে থিয়োরিটিক্যাল নলেজ। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, পুটামেন, সিঙ্গুলেট জাইরাস, সিয়াদ (এসআইএডিএইচ) ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবলাম এই তো সূবর্ণ সুযোগ। এই পেশেন্ট যদি সুস্থ করতে পারি তাহলে আমার সুখ্যাতি দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পরবে।
কিন্তু বাস্তব বড় কঠোর। কয়েকদিনের মধ্যে একটা ডেথ সার্টিফিকেট লেখা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারলাম না।
সেই মৃত রোগীর পুত্র বাড়িতে এলেন। হাতে গঙ্গা লেখা কার্ড। ভদ্রলোক বললেন, “ডাক্তারবাবু, বাবার শেষ সময়ে আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন। বাবার শ্রাদ্ধে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে।”
হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে যথা সময়ে শ্রাদ্ধ বাড়িতে গেলাম। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। “আসুন আসুন ডাক্তারবাবু।”
তারপর পাশের লোকটিকে বললেন, “ এই যে, বাবার শেষ ডাক্তারবাবু। এনার হাতেই বাবা মারা গেছেন।”
কথাটায় আমার বুকের মধ্যে একটু ধাক্কা লাগল। এর পর যতজনের সাথে উনি কথা বলেছেন একই ভাবে আমার পরিচয় দিলেন। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাবলাম, তাড়াতাড়ি খেয়ে পালাতে হবে।
কিন্তু খেতে বসেও বিপদ। মৃত রোগীর ছোটো ছেলে হাজির। আমার পাশে যে ভদ্রলোক খেতে বসেছেন, তাকে তিনি উপযাজক হয়ে জানিয়ে গেলেন আমি ডাক্তার এবং ওনার বাবা আমার হাতেই পঞ্চপ্ত প্রাপ্তি হয়েছেন।
ব্যাস, ভদ্রলোকের প্রশ্নের ঠেলায় আমার নেমতন্ন খাওয়া মাথায় উঠল। উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “সেরিব্রাল না হার্ট এট্যাক?”
আমি তখন এক মনে ভাবছিলাম, পমফ্রেট না পাবদা, এরপর কোনটা আসবে? ভদ্রলোকের প্রশ্নে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। বললাম, “মানে?”
“বলছি যে নিত্যানন্দবাবু সেরিব্রাল না হার্ট এট্যাক কোনটায় মারা গেলেন?”
আমার মুখে প্রায় চলে এসেছিল, সেটা জেনে আপনার কি দরকার? কোনোরকমে চেপে গেলাম। গম্ভীর মুখে বললাম, “বলা মুশকিল। আসলে বাড়িতে মারা গেছেনতো। কোনো রকম ইনভেস্টিগেশন হয়নি।”
ভদ্রলোক একটু বাঁকা হাসলেন। তারপর বললেন, “আজকালতো ইনভেস্টিগেশন ছাড়া ডাক্তারবাবুরা কোনো রোগই ডায়াগনসিস করতে পারেন না। ডাঃ রায় কাশির শব্দ শুনেই বলে দিতে পারতেন রোগীর টি বি হয়েছে নাকি হুপিং কাশি। কোনো ইনভেস্টিগেশন লাগত না।”
“কোন ডাক্তার রায়?”
“সে কি, একজন ডাক্তার হয়ে আপনি ডক্তার রায়ের নাম শোনেননি। ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়।”
আমি বুঝতে পারলাম আমার নেমন্তন্ন খাওয়ার বারোটা বেজে গেছে। ইলিশ, চিংড়ির বদলে ডাক্তারবাবুদের সমন্ধে সমালোচনা গিলতে হবে।
সবে পাতে ইলিশ পরেছে এমন সময় ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা ডাক্তারবাবু পায়খানা যদি কাদা কাদা হয়, তাহলে কি মেট্রোজিল খাওয়া যায়?”
“শুধু শুধু মেট্রোজিল খাবেন কেন। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বলে একটা অসুখ...”
“মেট্রোজিল খেলে আবার কষে যাবে নাতো?”
......
“আর কফ কফ পায়খানা হলে কি খাব?”
......
“এমন একটা ওষুধের নাম বলুননা খেলেই সকালে কোষ্ঠ একেবারে সাফ হয়ে যাবে। রোজ যদি কোষ্ঠ সাফ হয়ে যায় তাহলে সুগার, প্রেশার এসমস্ত রোগ ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। কি বলেন?”
কি আর বলব। আধপেটা খেয়েই উঠে পড়লাম। ততোক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়েছি পেটুকের মত শ্রাদ্ধ বাড়িতে আর খেতে যাব না।
যার বাবার শ্রাদ্ধ তাকে বলে আসতে গেলাম এবং আবার ভুল করলাম। এক পাশে কাঙালি ভোজন চলছে। উনি তখন ওখানে তদারকিতে ব্যস্ত।
আমি যেতেই উনি সকলের সামনে আমার গণ পরিচয় করে দিলেন, “ইনিই বাবার ডাক্তারবাবু। এনার হাতেই বাবা মারা গেছেন।”
সামনে একটি দুঃস্থ মহিলা আর তার ছেলে খাচ্ছিলেন। মহিলাটি তার ছেলেকে বললেন, “শিগগিরি ডাক্তারবাবুকে পেণ্ণাম কর। ওনার জন্যই আজ আমাদের পেট ভরে খাবার জুটছে।”
এখন রোজই প্রায় দু একটা করে শ্রাদ্ধের নেমতন্ন পাই। টেবিলের ড্রয়ার নেমন্তন্নের চিঠিতে প্রায় ভরে উঠেছে। এনারা এক কালে আমারই পেশেন্ট ছিলেন। চিঠি গুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে নেড়ে চেড়ে দেখি। নিজের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হই।
কিন্তু নেমন্তন্ন বাড়ি মুখো আর হইনা।