এলেবেলে, এই পাতায় রায়বাবু ও ঘটকবাবু নিয়ে দলাদলি বাদ দিন , অন্ততঃ আমার ক্ষেত্রে। আমি আমার পোস্টে স্পষ্ট করেছি যে আমি দুজনেরই ভক্ত, দুটো আলাদা ঘরাণা বলেই মনে করি, ব্যস্।
এবার শতরঞ্জ কী খিলাড়ি ।
কেন আপনার সংগে একেবারেই একমত হতে পারলাম না সেটা বলছি। কারণ আমি মূল গল্প ও সিনেমা দুটোই কয়েকবার (অন্ততঃ ন'বার) পড়েছি এবং দেখেছি।
আপনার যে বর্ণনা-- সারা দিন দাবা খেলা, অবৈধ প্রণয় , রাজনীতি বা দেশের অবস্থা নিয়ে বেখবর, লড়াই না করা --সবেতে রায় মশায় মুন্সী প্রেম চান্দের মূল কাহিনীর প্রতি বিশ্বস্ত। অ্যানাক্রনিজম? দেখা যাক।
ডালহৌসী আউধের সিঙ্ঘাসন কেড়ে নিলেন ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬। সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হল মে, ১৮৫৭। কাজেই আপনার বক্তব্যে অ্যানাক্রনিজমের অভিযোগ দাঁড়াচ্ছে না। মূল গল্পে দুই সামন্ত প্রতিভু অলস, এবং দাবাখেলায় মগ্ন। নিজের বেগম ইত্যাদি নিয়ে কোন খেয়াল নেই। সেই সময়ের লক্ষনোউ নিয়ে ভেড়ার লড়াই পতঙবাজি এবং বিলাসী কবি রাজকাজে অমনোযোগী বাদশাহের বর্ণনা প্রেমচন্দের মূল কাহিনীর গোড়াতেই আছে।
কিন্তু প্রেমচন্দের সামন্তপ্রভুর সম্মানবোধ টনটনে, একেবারে খপ পঞ্চায়েতের মত। তাই দাবার চালে চুরি্র অভিযোগ বা বেগমের চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ হতেই বেরিয়ে পরে তলোয়ার। দুই বন্ধু অস্ত্র ধরেন একে অপরের বিরুদ্ধে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে জমিতে পড়ে শেষ সময়ের অপেক্ষায়। এই জায়গায় লেখকের অমোঘ মন্তব্য -- এরা কাপুরুষ ছিলনা, বাহুতে শক্তি ছিল। কিন্তু নিজেদের দাবা খেলায় মগ্ন হয়ে ইংরেজের বড় দাবা খেলাটা দেখতে পেলনা, দেশের জন্য অস্ত্র ধরা হল না।
এই বার রায়মশায়ের দুই নায়ক। তারা বাইরে প্রেমচন্দের সামন্তপ্রভু, আসলে ইন্দিরার সময়ের বুদ্ধিজীবি (যেমন উনি নিজে)। ওরা দেশের ব্যবস্থা রাজনীতি সব জানে, কিন্তু স্থিতাবস্থার সুবিধেভোগী। ওরা পারিবারিক তলোয়ার খাপ থেকে বহুদিন বের করেনি। অপমানের প্রশ্নে পিস্তল থেকে গুলি চালায় কিন্তু এত অপদার্থ যে খুব কাছে থেকেও তাদের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তারা আত্মগ্লানিতে ভোগে। তাই জানে আজ বিনাযুদ্ধে লক্ষ্ণৌ দখল হচ্ছে (প্রেমচন্দ)। কিন্তু অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে আবার ঘরে ফিরে দাবা খেলার কথা ভাবে।
কিন্তু শেষটা? এইখানেই রায়মশায়ের ইতিহাসবোধ শিল্পসম্মত ভাবে প্রকাশ পায়।
ওনার বানানো ডায়লগ সঞ্জীব কুমারের মুখেঃ এবার দাবা খেলব তবে দেশি নয়, ইংরেজি পদ্ধতিতে। (উজিরের জায়গায় কুইন বসিয়ে এবং পেয়াদা প্রথমবার দু'ঘর একসঙ্গে)। ফল? স্পীড বাড়বে। "রেলগাড়ি জ্যায়সা তেজ রফতার। উজির সাহাব, আপ হট যাইয়ে। অব মালেকা ভিক্টোরিয়া তশরিফ লা রহী হ্যায়"।
সরে যান, মন্ত্রীমশায়। এবার মহারাণী ভিক্টোরিয়া আসন গ্রহণ করছেন।
আপনার মনে পড়বেই বৃটিশ রাজত্বে মার্ক্স কথিত রেলগাড়ির ভূমিকা এবং সিপাহীবিদ্রোহের পর কোম্পানির শাসনের অবসানে কুইনের রাজত্বের শুরু।
আর ইন্দিরার এমার্জেন্সিতে বুদ্ধিজীবিদের একটি বড় অংশের চুপচাপ বন্দনায় মেতে ওঠা।
প্রেমচান্দ ছিলেন ওই অঞ্চলের ( বেনারসের কাছে লমহী গ্রামে জন্ম, কার্যস্থল এলাহাবাদ ও লক্ষনৌ)। জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালে, ফলে আউধের ইতিহাস ও জন্মের ২৩ বছর আগের জীবনশৈলী ও সংস্কৃতি ভাল করেই জানতেন। সে ব্যাপারে রায়মশায় লেখকের প্রতি বিশ্বস্ত। ওঁর নিজস্ব মেটাফর ফিল্মের শেষভাগে।
, ,