@/\
কথাসরিৎসাগর একটা ছিলো বসুমতীর। মানে সেই দূর অতীতের বসুমতী খবরের কাগজ, ওদের। আপনি যার ছবি দিয়েছেন সেই এ্যাকাডেমিকের বইয়ে কি আলাদা করে এ্যানোটেশন বা ঐরকম কিছু আছে বলে জানেন ? ছবিতে দেখলাম বেশ মোটা এবং বড়োসড়ো আকারের। সেইজন্য প্রশ্নটা করলাম। এধরনের বইয়ে এ্যানোটেশন থাকলে আমার নিজের সুবিধা হয়, কারণ সংস্কৃত জানি না।
চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে ছবিও আছে, আকারবৃদ্ধির কারণ সেটাও হতে পারে। বসুমতী সংস্করণ সাদামাটা পেপারব্যাক। ছবিহীন।
সাধারণভাবে কথাসরিৎসাগরের গল্প আলাদা করে কিছু না। এর থেকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে কল্হনের রাজতরঙ্গিনী, যদিও কল্হনের বইটা অনেকটাই ইতিহাস জাতীয়, গল্প নয়। গুচ্ছের অতিরঞ্জন সত্ত্বেও। অন্তত লেখক ইতিহাস লিখতেই বসেছিলেন।
কথাসরিৎসাগর প্রসঙ্গে দেবদত্ত যা যা বলেছেন, ঐ বৃহৎকথা-পৈশাচী ভাষা-গুণাঢ্য, ঐ অংশটা আমার বরাবর বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। হয়তো গোয়েন্দাগিরি করার একটু সুযোগ আছে বলে। গুণাঢ্যর বইয়ের নাম ছিলো সম্ভবত বড্ডকথা, মানে বৃহৎকথা প্রাকৃতিফায়েড।
আর পাঁচটা প্রাচীন বইয়ের মতো কথাসরিতেও বেশিরভাগ অংশে রাজারাণীর গল্প, রাজারাণীর প্রেমের গল্প, যুদ্ধেরও। খুঁটিয়ে দেখলে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, রীতিনীতি এসব চোখে পড়বে। এর মধ্যে দুটো বিষয় আমার চোখ টেনেছিলো।
এক নম্বর, 'ক' রাজা এক গন্ডা বিয়ে করলেন। এ্যারেঞ্জড্ ম্যারেজ, লাভ ম্যারেজ, দুই-ই। পাঁচ নম্বর রাজকুমারীকে "দেখিবামাত্র কামশরে বিদ্ধ হইলেন।" দুজনের মধ্যে যোগাযোগ নেই বা যোগাযোগের উপায় নেই, অথচ মাত্র একবার দেখেই... ? এখানে মনে হয় প্রেমে হাবুডুবু বোঝাতে কামশরে বিদ্ধ হলেন বলা হচ্ছে। সেকালের ভাষার ব্যবহার এবং সামাজিক পর্যায়ে বিষয়গুলো কেমন চোখে দেখা হতো, এটাকে তার একটা নিদর্শন ধরা যেতে পারে।
দু' নম্বর : 'ক' রাজা যুদ্ধে 'খ' রাজাকে হারিয়ে দিলেন। তারপরে 'ক' রাজা 'খ'-এর "মহিষীকে লইয়া দর্পভরে রাজধানীতে প্রবেশ করিলেন।"
ঐ 'প্রবেশ করিলেন' পর্যন্তই আছে বসুমতী সংস্করণে। কিন্তু বাক্যটা যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। একমাত্র মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণকান্ড ছাড়া অন্যের মহিষীকে নিয়ে টানাটানির চেষ্টার উদাহরণ প্রাচীন সাহিত্যে তেমন নেই। সে যুগের সমাজের সামগ্রিক ভাবমূর্তিও বেশ স্যানিটাইজার মাখানো। একমাত্র ব্যতিক্রম দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাথে দাদার বৌ ধ্রুবাদেবীর প্রেম এবং পরে বিয়ের ঘটনা। চন্দ্র-ধ্রুবা কাহিনীর ঐতিহাসিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়, তবুও রেফারেন্স যখন আছে একটা, তখন ডাল মে সব কুছ দুগ্ধবরণ নেহিঁ হ্যায়। এমন হতে পারে যে সমাজে ট্যাবু হিসেবে দেখার ফলে এসব ঘটনা প্রাচীন ভারতে কম ঘটতো, কিন্তু ছিলো। থাকাটা তো আশ্চর্যের না, উল্লিখিত না হওয়া বা সমকালীন সাহিত্যে রেফারেন্স না থাকা আশ্চর্যের।
ইংরেজিতে bowdlerise একটা শব্দ আছে। পান্ডুলিপির কপি, তার কপি, কপির কপির কপি, এমন চলতে চলতে অন্যের মহিষীর দিকে দৃষ্টিদানের ঘটনাগুলোকে বাওডলারাইজ করা হয়েছে কিনা, সে সন্দেহ হয় আমার খুবই।
সরাসরি বর্তমান আলোচনার সাথে সম্পর্কিত না হলেও এখানে সেকালের রাজাদের বিষয়ে বাওডলারাইজ করার প্রসঙ্গে আরো একটা কথা মনে পড়ে গেলো।
সংস্কৃতে 'ঈতি' বলে একটা শব্দ আছে। ফসল চাষ করতে গিয়ে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলো বোঝাতে এই শব্দটা ব্যবহার হতো। শব্দটার অর্থে খানিকটা যেন বেশি ঝোঁক দেওয়া হতো পাকা ফসলের বিপদের ওপরে। ঈতি ছ'রকমের। খরা, বন্যা, পাখি, ইঁদুর, পঙ্গপাল এবং শত্রুরাজা। উত্তরের বিম্বিসার, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, কণিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধন, দক্ষিণের সাতকর্ণী বা রাজেন্দ্র চোলকে ঈতি বলে বর্ণনা করেছে এমন শিলালিপি-টিপি আছে বলে জানি না।
এমনকি ঘরের ছেলে শশাঙ্কের নামেও অন্যের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাবার দুর্নাম শুনিনি। তবে শব্দভান্ডারে আছে শব্দটা, অতএব বুঝ লোক যে জান সন্ধান।