কাল কলকাতার প্রসঙ্গটা তুলে কেটে ওঠায় আন্তরিক দুঃখিত। ব্যাপারটা এমন না যে তাতে আমার খুব অসূয়া আছে। ব্যাপারটা এমনও না, কলকাতার বদলে আমার জন্মভূমির কথা লিখতে হবে। তাহলে কথাটা হঠাৎ বললাম কেন?
আমি বিষয়টাকে একটু অন্যভাবে দেখতে চাইছি। আচ্ছা আপনাদের মনে হয় না যে একটা রাজ্যের প্রায় সমস্ত অংশটা গ্রাম (ভদ্রতাবশত অনেকে মফস্সল বলেন বটে) হিসেবে চিহ্নিত করাটা কলকাতাবাসীদের চরম আত্মতুষ্টি এবং উৎকট উন্নাসিকতার লক্ষণ?
সেখানকার মানুষদের স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রায় বিসর্জনের বিনিময়ে সমস্ত রকমের সুযোগসুবিধা ভোগ করতে গিয়ে কোথাও আপনাদের বিবেক জাগ্রত হয়? আপনারা ফিল করেন উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের মানুষগুলো, জঙ্গলমহলের মানুষগুলো কিংবা সুন্দরবনের মানুষগুলো কতটা অসুবিধার সম্মুখীন হন তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনে? একটা ফ্লাইওভার, একটা ব্রিজ কিংবা ধরুন একটাও অ্যান্টি-ভেনাম ইঞ্জেকশন স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে না থাকায় তাঁদের কোনও সমস্যা হয় কি না?
একটা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি) পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কিংবা একটা ভালো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে তাঁদের কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়? আপনাদের একবারের জন্যও মনে হয় যে আপনারা স্বার্থপরের মতো অন্যকে বঞ্চিত করে অন্যায্য সুবিধে ভোগ করেন কেবলমাত্র কলকাতার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে?
আপনাদের কেমন মনে হয় যখন দেখেন এই খবরটা - এবারেও জেলাকে টেক্কা দিল কলকাতা? বা কবি সম্মেলনে যখন মফস্সলের কবিদের আলাদা পঙ্ক্তিভুক্ত করা হয়? নাকি নির্বিবাদে ভাবেন - সব আমাদের জন্য, সব আমাদের জন্য?
শান্তিনিকেতনের অধঃপতন অনেকদিন হয়েছে। প্রায় কুড়ি বছর আগে বিশ্বভারতী ফারস্ত প্যাসেঞ্জারে বোলপুর যাচ্ছি। এসি চেয়ার কারের যাত্রী। যাত্রী সংখ্যা হাতে গোনা। চেকার এসে চেক করে গেছে। হঠাৎ দেখি দরজার কাছে হই হই। বিশ্বভারতীর কিছু ছাত্র এসিতে যাবে। জায়গা খালি তাই তারা উঠবে। চেকার মৃদুভাবে নিষেধ করল । তাকেই পাত্তাই দেয়না। এবার কিছু হোমরা চোমড়া যাত্রী এগিয়ে গেল। বিপুল বাক বিতণ্ডা। তারপরেই শুরু হল ছেলে গুলোর গালি বর্ষণ। চেকার বলল এরা পরে স্টেশনে পরে আমায় একা পেয়ে ঝামেলা করবে। উঠতে দিন। যাত্রীগুলো বলল কয়েকজনকে দিতে পারি। না তা হবেনা। তাদের বিশাল দল। সবাইকে দিতে হবে। এবার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পালা। এবার একেবারে খিস্তি। দেখে নেব বলে তারা বিদেয় নিল।
২০১৫ য় শেষবার গেলাম শান্তিনিতেকন। পরেরদিন ভোরে কাঁচের মন্দিরে উপাসনায় গেছি। শুনলাম আগেরদিন মদ খেয়ে মোটরবাইক চালিয়ে সংগীত ভবনের দুজন কঙ্কালিতলায় গাছের সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করে স্পট ডেড। তাঁদের জন্যে হল স্পেশাল প্রার্থনা।
শুনলাম এরকম এরকম প্রায় হচ্ছে।
সুইটজারল্যান্ড দেশটা নিয়ে লেখালেখি প্রায় চোখেই পড়েনি। দেশটা বেশ অজানা।
অন্য আরেকটা জায়গায় থাকা মানেই সেখানকার সবকিছুতে পরিচিত ও অভ্যস্থ হওয়া। এটা একটা ইন্টারনল প্রসেস। সকলেই তার নিজের মত করে অভ্যাস গড়ে তোলে। কিন্তু মুশকিল হল সেই জায়গায় গিয়ে যদি দেখি আমার ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনধারণ কোনোটাই সব বদল করতে হচ্ছে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দায় পড়ে তখন সব করতে হচ্ছে, এবং আমার সব কিছুর জন্যে আমাকে কোথাও হ্যাঁটা হতে হচ্ছে তখন কনফ্লিক্ট শুরু হয়। তখনই অসম্ভব alienation তৈরি হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
কলকাতার কিছু ক্রাউড আছে যারা দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই কত খারাপ আবার অনেক প্রবাসীকে দেখেছি বসে বসে কলকাতা কত খারাপ এসব আলোচনা প্যাশনেটলি করতে। আমি দু জায়গাতেই এই সঙ্গগুলো আমি বিশবত ত্যাগ করি। এতাই হল কূপমণ্ডূকতা।
প্রত্যেকটা শহর, জায়গার আলাদা চরিত্র থাকে। আমি যেকটা জায়গায় থেকেছি সব জায়গার সঙ্গে আমার ভাললাগা, ভালবাসা জড়িয়ে আছে।