বিজ্ঞাপণ
হয়তো আর কয়েক দশক বাদে,
চারিদিক ছেয়ে যাবে বিজ্ঞাপনে,
এখনের থেকেও বেশি,অনেক অনেক বেশি,
প্রতিটা ঘরের দেওয়াল, রাস্তার পিচ,কংক্রিট বা মাটি কেউ বাদ যাবে না,
বইয়ের পাতায় ফাঁকা অংশ,
টাঁকলার টাঁক, লোমহীন বুক হাত পা,
জামার কাপড় বিজ্ঞাপনে ভর্তি হবে,
সাদা জামার দাম হবে বেশি,
আর বিক্রির জিনিস,সে তো ইজ্জত থেকে শুরু করে আলপিন-চিনির দানা,সওওব বিক্রি হবে,
মানুষের বিবেক,দয়া, মায়া এসবের দাম সবচেয়ে কম হবে,
মরার পরে লাশও বিক্রি করবে আত্মীয়,
দুটো টাকা বেশি পেলে,না কেনা গ্যাজেটটা কিনে নেবে হয়তো,
লাশ তো সেই পচেই যাবে!
বীর জাতির প্রতিনিধি
আমার মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হয়ে যাওয়ার পরেও,
যখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম প্রকাশ্য রাজপথে,
ওদের কয়েকজন আমায় চিনতে পেরেছিল,
কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেনি।
কি করে এমন দুর্বল জাতির এত বড়ো বুকের পাটা হতে পারে!
কিন্তু ওরা আমাদের ইতিহাস জানে না।
ওরা তো ক্লাস ফাঁকি দেয়।
আমরাই যে কত সাম্রাজ্যের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিলাম আগে,
আমরাই যে সারা পৃথিবী দখল করেছিলাম,
ওরা জানে না তাই।
আর সেজন্যই ওরা আমাদের ফেলনা ভেবেছিল।
আমি আবার ওদের চোখে আঙুল আর বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়ে দেখাতে চাই,
সেই বীরের রক্ত ঘুমিয়ে ছিল,
শুকিয়ে যায়নি।
আবার দখল নিতে পারি সব,
এতদিন নিইনি, বিশ্বাস ছিল তোমাদের প্রতি।
এবার আগুনের শিখা জ্বেলে সব শোধন করে নেব,
চিন্তা নেই।
ছোটলোকের অশ্লীল প্রশ্ন
আমি আগে কোনোদিন পাকা রাস্তা দেখিনি,
আজ যখন গ্রাম ছেড়ে এলাম,
বর্ষার কাদায় আমার পা দুখানা হাঁটু পর্যন্ত বুট দিয়ে ঢাকা,
রাস্তার ধারে লয়ানে পা ধুয়ে যখন রাস্তায় উঠলাম-
মনে যে কি বিশাল স্বস্তি পেলাম সে বলে বোঝানোর নয়।
আমি বুঝতে পারলাম আমি কত কষ্টে ছিলাম।
আমার গ্রামে ইস্কুল ছিল না,
প্রতিদিন চোদ্দ কিলোমিটার হেঁটে গেলে বন দিয়ে,
তবে ইস্কুল ছিল একটা,
তাও তাতে একটি মাত্র মাস্টার,
সে সর্বহাটের কাঁঠালি কলা,
জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব করে।
এখানে এসে দেখলাম ঘরের গাঙ দেয়ালে স্কুল,
সকাল বেলা গাড়ি যায় আনতে ছেলেদের,
আবার দিয়ে আসে পড়া হলে,
আমি বুঝতে পেরেছিলাম,
দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মানে কী।
এখানে ঘরের গায়ে ঘর,
সব পাকার।
কত কামরা,
লোকশূণ্য পড়ে আছে,
কেউ থাকে না।
ঘরের নীচে দোকান,তবু নাকি সব্জিও ঘরে দিয়ে যায়।
খাবার রাঁধতেও হয় না।
ঘরে কলের জল,
রান্না হয়,হাঁড়ি কালি হয় না।
এসব আমার কাছে স্বপ্ন।
আমি মাধ্যমিক দেওয়ার আগে বাস দেখিনি,
যখন দেখলাম পনের কিলোমিটার দশ মিনিটে যাওয়া যায়,
বুঝতে পারলাম আমি কত সময় নষ্ট করেছি।
বড় শহরের এসে দেখি,
এখানে মিনিটে মিনিটে বাস,
তবু লোকে ছটফট করে।
যখন গ্রামে ছিলাম,
বুঝতেও পারিনি কাকে সুবিধা বলে।
সবই স্বাভাবিক মনে হত।
ভোটের সময় বাবুরা এসে মদ মাংস দিয়ে বলে যেত,"ভোট আমাকেই দিবি কিন্তু!"
বিশ্বস্ত কুকুরের মতো লেজ নেড়ে হাসিমুখে বলতাম,"হ্যাঁ বাবু।"
তখন জানতাম না ভোটের বদলে-
ঘরের কাছে ইস্কুল,
চওড়া রাস্তা,
ইস্কুলে মাস্টার
সব পাওয়া যায়।
ভাবতাম,"ভোটের সময় যদি বন ভেঙে গাড়ি আমার ঘরের উঠোনে আসতে পারে,
তাহলে হাসপাতালে কেন বলে রাস্তা খারাপ তাই এম্বুলেন্স যাবে না?"
আমি সব স্বাভাবিক ভাবতাম।
ভাগ্যকে দোষ দিতাম রোজ,
ভগবানকে শাপ,শাপান্ত করত আমার ঠাকুমা,
আমার মা চুপচাপ গোরু-গাধার মতো খাটত।
আমি বুঝতে পারতাম না,
বাবুরা এসে বন সাফ করে দিলেও কেউ কিচ্ছু বলে না,
কিন্তু আমি সেবারে কাঠ কুড়াতে গেলে কেন পুলিশ নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে রেখেছিল,
পিটিয়ে আমার পা ভেঙে দিয়েছিল?
আমি এখনো ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারি না।
আমি ভেবেছি জিজ্ঞেস করব,
আমারই কি তাহলে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক?
সবার ভোটের যদি সমান মূল্য হয়,
তাহলে সবাই সমান সুবিধা পাবে না কেন?
কিন্তু বাবুরা ধমক দেয় যে!
ভয় লাগে।
নিষিদ্ধ
এই কদিন যখনই হাত চলে যায় পেছনদিকে,প্যান্টের ভেতর,
আমি পরিষ্কার একটা বাড়তি প্রবর্ধকের অস্তিত্ব বুঝতে পারি।
প্রথম যেদিন আবিষ্কার করি,বেশ চমকে উঠেছিলাম।
অনুভূতির যে ধারা বয়ে গিয়েছিল,তাতে ভয়ের অনুপাত ছিল সবচেয়ে বেশি।
তারপর থেকে ধীরে ধীরে মেনে নিতে আরম্ভ করি।
আয়নায় দেখার চেষ্টা করেছি কয়েকবার,
একবারও দেখতে পাইনি।
ভালোই হয়েছে।
নইলে লন মোয়ারদের পিয়ার প্রেসারে পড়ে হাস্যাম্পদ হতে হতো।
তবে আলোর অভাব হলে কিংবা পোষাকের আড়ালে-
ভালোই জানান দেয়,"আমি আছি।"
আমিও এখন উপভোগ করি লাঙ্গুলের সাথে আঙুলের ছোঁয়াছুঁয়ি,লুকোচুরি।
আমার বাঁদরামি বেড়ে গেছে;
বুঝতে পারছি আমি।
খুব যে খারাপ লাগছে তা নয়!
তবু ধরা পড়ে অপদস্থ হতে হয় পাছে,
তাই কাউকে জানাইনি।
আমি জানতাম কেও জানে না এসব!
সেদিন নারদ এসে বলল,"তোমার কী ব্যাপার বলতো!"
গৃহীসন্ন্যাসী
এভাবে বহুদূর চলে যাওয়া যায়,
সীমানাগুলো সব পেরিয়ে,দিগন্তের কাছাকাছি।
কেন যাব জানি না,
এতদূর যে এসেছি,এটাও তো হিসেব না করেই এসেছি,
ভালো লেগেছে বলে,
কিংবা আমার চারিদিক,
(যেটা আছে আর কি!)
ভালো লাগেনি বলে।
এক কথায় পালিয়ে এসেছি আমি।
তবে আমার খোঁজ পড়েনি এজন্য।
পড়ে না।
কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ওরা জানে,
আমি আবার ফিরে যাব।
যদি এখন উধাও হয়ে যাওয়া যায়!
খুব একটা খারাপ হবে না কিন্তু!
কিন্তু আমার কোমরে অদৃশ্য শিকলে বাঁধা আছে -
মায়া, মোহ, ভালোবাসা, দায়িত্ব, কর্তব্য.....
এসব লোহা।
চুম্বক আছে একখানা,
আমার গন্ডির মধ্যে,
বিভিন্ন জায়গায়,
প্রয়োজনমতো চালু করে,
তড়িৎচুম্বক তো!
আমি ফিরতি পথ ধরি,
কেউ সুইচ দিয়েছে চুম্বকে।
আদিমতম প্রবৃত্তি
সব যখন ছেড়ে গেল,
শুধু আমি বসে রইলুম,
আমার অবশিষ্ট শরীর আর মুক্তি উন্মুখ আত্মা নিয়ে,
যে কটা কাক বসে ছিল,
তারাও চলে গেল,
আবার কালকে আসবে বলে গেল -
যদি মরি!
কিন্তু আমি আর একটু বাঁচতে চেষ্টা করছি,
যদি আর একবার শ্বাস নেওয়া যায়,
এই শেষবার বলে কতবার বললাম!
আমি বড্ড আস্তিক হয়ে যাচ্ছি,
বড্ড হাহাকার প্রাণে।
মায়া পড়ে গেছে,
কিন্তু কার উপর,কাদের উপর?
সবাই তো গেছে ছেড়ে,
আমি এখন আমার নিজের মল মেখে পড়ে আছি,
বেশ আশ্চর্য লাগে,
এগুলো (পেচ্ছাব-পায়খানা) বন্ধ হয়নি কিন্তু!
আমি তবু বাঁচতে চাই,
কোনো কারণ ছাড়াই,
কারণ এটা আমার অধিকার,
এটাই একমাত্র প্রতিবর্ত,
যা সেই প্রথম কোয়াসারভেটেরও ছিল।
আমি তো তারই বংশধর।
নৈতিকতা
তোমার গরু-ছাগল মারলে খারাপ লাগে,
কিন্তু গাছ কাটলে কেন লাগে না?
মানুষের জন্য যদি হিউম্যান রাইটস থাকে,
তবে বাকি প্রাণীরা কী করল?
মানুষ আত্মহত্যা করলেও দোষী ঠাউরানো হয় কাউকে,
তবে পিঁপড়ে, মশা, আরশোলা খুন করার জন্য যে বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয়,
সেগুলোর কেউ প্রতিবাদ করে না কেন?
তামাকের, মদের বিজ্ঞাপণ যদি বন্ধ হয়,
তবে ইনসেক্টিসাইডের ব্যবহার কেন বন্ধ হয় না?
সবকিছু কি মানুষের উপকারের কথা বলে ন্যায়সঙ্গত করে ফেলা যায়?
পৃথিবীটা কী শুধু মানুষের তবে!
বাকিদের বাঁচার অধিকার কি তখনই থাকবে,
যখন তাদের বেঁচে থাকা মানুষের জন্য লাভজনক হবে?
যদি মানুষকে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য না করা যায়,
তবে কেন গরু, ছাগল, কুকুরদের যৌনমিলনে বাধ্য করা হবে!
শুধু একথা বলেই কি পার পাওয়া যায়,
"মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।সবকিছু মানুষের জন্যই।"
আজ যদি পৃথিবীতে হঠাৎ অন্য কোনো প্রজাতি সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে যায়,
তারাও কি আমাদের সাথে এভাবেই ব্যবহার করার অধিকার পাবে?
নাকি তখন আবার অন্য নিয়ম লাগু হবে;
যাতে মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে?
কালরাত্রি
কি জানি কেন,
আজকের রাতটা ঠিক স্বাভাবিক নয়!
পাখিদের ডাক চড়া,
আকাশে চাঁদ না থাকা সত্ত্বেও যেন ঠিক অন্ধকার নয়,
গাছগুলোও ঠিক করে উঠতে পারছে না,
হাওয়া বওয়ানো উচিত, নাকি ঘামিয়ে মারা?
ওরা সবাই অন্ধকারে প্রশ্নচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
দূরে পুকুর পেরিয়ে যে ঘরটা দেখা যায়,
সেটা আজকে আবছায়ায় আধো দৃশ্যমান,
কিন্তু চোখে খুব আপত্তিকর ঠেকছে না তো!
মনে হচ্ছে, আজ যেন কেউ পুরোপুরি শোয়নি,
শুধু ভান করছে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন,
আমি চারিদিকে দ্রুত কিন্তু সতর্ক হৃদস্পন্দন শুনতে পারছি,
ঘুমালে এমনটা হয়না।
এমনকি পাখিগুলো চঞ্চল,
ঘরের চারিদিকে নিশাচর প্রাণীদের যাওয়া আসা টের পাচ্ছি,
ক্লান্ত গোরু, ছাগল, মুরগি ওরাও ঘুমোতে পারছে না,
কিসের অপেক্ষা করছে ওরা জানি না,
আমিও ঘুমোতে পারছি না,
যদিও জানি না কেন!
ঈশ্বরের ব্যাপারে
হয়তো আমি এখনো ঈশ্বরের কাছে যেতে পারিনি,
চেষ্টাই করিনি তো!
প্রতিদিন ঈশ্বরের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আমি মোক্ষ নিইনি হাত পেতে,
ঈশ্বরের ইগো বড্ড বেশি,
তাই সে আমাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও মুক্তির অমৃত দেয়নি।
ভালোবাসে সে আমায় সন্দেহ নেই,
কিন্তু অধোশির চায় আমায়,
আমি জানিও না তার এই মনোকামনা,
তাই আমি মাথা ঝুঁকাইনি কোনোদিন।
মুখে বলেনি;কিন্তু কাগজে লিখে,অন্যের মুখ দিয়ে বলিয়েছে বারবার,
আমি আমল দিইনি,
কাগজে কিংবা লোকমুখে কি সেই আবেগ থাকে?
তাই আমি মুক্তি পাইনি।
সবাই আমাকে নাস্তিক বলে।
কিন্তু ওরা আমার মনোজগতে উঁকি মেরে দেখার শ্রমটুকু করে না।
আমিও তো বিশ্বাস করতে চাই,
পিচ্ছিল এই ধরায় আমিও খুঁটি চাই,
চাই এক টুকরো ঘাসে ঢাকা ডাঙ্গা।
কিন্তু চারিদিকে যদি ভাসমান দ্বীপ থাকে,
আমি আশ্রয় নিয়ে প্রতিবার,
যদি নিজেকে প্রতারিত অনুভব করি,
তবে কি করে আমি বিশ্বাস করব আবার?
ভিত বলে কিছু আছে তাই বা কি করে মানব,
যখন আমি দেখিইনি কখনো তা!
ঘর ও গন্ধ
যাদের ঘরের আঙিনা ছোট,
রোদ পড়ে না সেখানে,
ঘর স্যাঁতসেঁতে থাকে,
বাতাস খেলে না ঠিক,
যদি জানালা না খোলা থাকে।
আমার আঙিনাহীন দেহ,
আমি বহুতল ফ্ল্যাটের টবের চারা,
আমার বৃদ্ধি ওই ঘরের আলোর মতোই,
কৃত্রিম, ফ্যাকাশে, পুষ্টিহীন, চকচকে।
আমি মাটি কেমন দেখিনি,
আমার গায়ের চামড়া স্বাভাবিক নয়।
ডাক্তার বলে ভিটামিন ডি আর এ কম।
আমি জানি আমার দেহ আঙিনাহীন,
তাই হাওয়া-বাতাস খেলে না।
আমি কৃত্রিম।
ঘরের গন্ধ
প্রতিটা ঘরের একটা আলাদা গন্ধ আছে,
সেটা সেই ঘরের লোকে হয়তো বুঝতে পারে না,
কিন্তু আমি পারি,
আর পারে,যারা ওই ঘরের বাসিন্দা নয়।
এই গন্ধ ওই ঘরের লোক,
ঝরে পড়া পানির পরিমাণ,
আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কীট-পতঙ্গ,
এমনকি ঘরের আয়তন,
বাতাস সবাই মিলে নির্ধারণ করে।
প্রতিদিন পাল্টে যায় একটু,
কিন্তু তাতেও মিল থাকে আগের দিনের সাথে।
তখন মনে হয়,
ঘরটা মানুষের মতো।
ওরও নিজস্ব সত্ত্বা আছে,
ওরও প্রাণ আছে হয়তো,
আমরা জানতে পারিনি।
ও কী খায়?
মানুষের প্রাণ?
পুরোনো আর নতুন
এই পথে আমি শত-সহস্রবার গেছি আগে,
আমি এখানের প্রতিটি ইঁট, সিমেন্ট,
এমনকি বালির কণাকেও চিনি,
এই পথের পাশের গাছ আমাকে বেশি ছায়া দেয়,
পথের লোকেরা আমার আত্মীয়।
কখনো আত্মীয়তা দাবি করিনি,
ওটা স্বতঃস্ফূর্ত।
আমি নিশ্চিন্তে যেকোনো ঘরের দরজায় কড়া নাড়তে পারি,
আমার পরিচিত সবাই।
কিন্তু মাঝে এক দশক কেটে গেছে হয়তো,
আমি হিসেবে বড্ড কাঁচা কিনা?
তবে বেশ অনেকদিন, একথা বলতে পারি।
আজকে যখন হেঁটে এলাম,
অনেক নতুন মুখ যোগ হয়েছে রাস্তায়,দরজায়,জানালায়,
দোকানের কাউন্টারে।
ওদের সাথে পুরোনো মুখের আদল মেলে,
কিন্তু তাতে নতুন যুগের পালিশ।
ওদের মুখের অবাক অপরিচিত ভাব বলে দেয়,
আমি বাতিল হয়ে গেছি।
তাই আমি ফিরে যাই কবরস্থানের দিকে,
ওদিকে আমার পরিচিত বেশি।
নতুন যারা, তারাও পুরোনো, চেনা।
ওদের সাথে কথা বলা যাবে না, ঠিক।
কিন্তু ওদের উপস্থিতিও আন্তরিক।
আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতে পারি,
কোনো ক্লান্তি, দ্বিধা বা অপদস্থতা আসে না।
জানি এরা ক্ষমা করে দেবে সব।
এরা আমার নিজের।
প্রেমের মৃত্যুগাথা
যখন আমাদের দুজনের শরীরের প্রীতিটি ভাঁজ চেনা হয়ে যাবে,
যখন বারবার রিভাইজ করে মুখস্থ হয়ে যাব দুজনের কাছে,
তোমার স্তনের বা আমার অন্ডকোষের অসাম্যতা,
তখন আর অজানা থাকবে না,
কথা তখন বড্ড কেজো হয়ে যাবে,
হয়তো রাতের পর রাত আর ঘনিষ্ঠ হব না আমরা,
হাজার দায়িত্বের মাঝে প্রেম চাপা পড়ে যাবে মনের স্টোররুমে,
দরজা খুলতে চেয়েও খোলা হবে না কয়েক বছর,
যদি খুলেও ফেলি,
ময়লা মুছে আবার চর্চা করতে মন যাবে না,
কত কাজ বাকি!
আমরা তখন নিছকই বাবা-মা,কাকা-কাকী, মামা-মামী।
স্বামী-স্ত্রী যে ছিলাম তাও ভুলে যাব।
তারপর একদিন যখন সব দায়িত্ব সারা হবে,
সব ছেড়ে যাবে অখন্ড অবসর দিয়ে,
নিজেদের আবার নিভৃতে পাব আমরা,
কিন্তু তখন বুড়ো হাড়,গলে যাওয়া মাংসপেশী,
অকেজো অঙ্গ আর জাগবে না,
শুধু বেঁচে থাকা সবচেয়ে বড় কাজ হবে,
থিতিয়ে পড়ব আমরা সংসার পুকুরের নীচে,
পাঁক সরিয়ে আর কেউ দেখবে না,
ছেনে দিয়ে পায়ে চলে যাবে,
নতুন পাঁক এসে পড়বে,
আমরা প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাব।
মিষ্টিকথা
রেখে রেখে মিষ্টিখানি,
শেষপাতে খাব বলে,
শেষে আর খাওয়াই হলো না।
জুতোর কাদা পড়ে গেল এসে।
শুরু থেকেই কয়েকবার মনে হয়েছে,
একটা কামড় দিয়েই দিই,
কিন্তু শেষে পুরোটা তারিয়ে তারিয়ে খাব বলে,
রেখে দিয়েছিলাম নিজেকে বঞ্চিত করে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার,
এই পুরো সময়টা ওটা আমাতেই অর্পিত ছিল,
কিন্তু আমি তার যথার্থ ব্যবহার করিনি,
যখন কাদার ছিটে পড়ল,
তখন একটু বাঁকা হাসি কি দেখিনি,
কান্নাও ছিল জানি।
এখন আমি আফসোস করছি,
কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই,
ফেলে দেওয়া ছাড়া।
আত্মমুগ্ধ জাতির প্রতি
তুমি যে আমকে আম বলো,
সেটা কি সে জানে?
যদি তুমি তাকে আমড়া বলো,
তাতে কি ও রাগ করবে?
নিদেনপক্ষে যদি মিষ্টি না থাকে আর?
তুমি কী করে জানলে,
ওটাকেই কালো বলে?
কী করে বলা যায় আকাশটা নীল?
কেন কমলাটা স্কারলেট রেড নয়?
আমি কী করে বুঝব যেটাকে তুমি হলুদ বলো আমিও সেটাকে হলুদই বুঝি?
তুমি কী নিশ্চিত করে জানো,
আমাদের জানার বাইরে আর কোনো অনুভূতি নেই?
যদি অদৃশ্য অতিবেগুনী, অবলোহিত,
অশ্রাব্য শব্দেতর,শব্দত্তোর তরঙ্গ থাকে,
তবে কেন আর অনুভূতি থাকতে পারে না?
আমি আরো জানতে চাই,
আমার ক্ষুধা দিনদিন বাড়ছে।
যদি তোমাদের কথামতো স্রষ্টা থেকে থাকে,
তবে কিন্তু বেশ সুবিধা হয়।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করে নিতাম সব।
আমার পিপাসা নিবারণ হতো।
জিজ্ঞেস করতাম,
সে কী কী অনুভব করে।
তাহলে নিশ্চয় তার মতো হতে হবে।
তারপর যদি আমি আর তার রূপ না ছাড়ি,
কিংবা হারিয়ে দিই তাকেই?
এটাও তো জানার জিনিস?
আরো অনেক জানার থাকবে তখনও।
তখন কি তোমরা আমাকে স্রষ্টা বা ঈশ্বর মানবে?
যাকে তোমরা ঈশ্বর বলো
প্রতিবারে কেন ঈশ্বর জিতে যায়?
প্রিয়জনের প্রাণ কেড়ে নিলেও ভালো করে,
প্রাণ দিলেও ভালো।
কি করে হতে পারে?
দেশের পর দেশ উজাড় করেও কি করে ভালো হতে পারে?
কি করে গরিবকে দিনের পর দিন অভুক্ত রেখেও ভালো হতে পারে?
তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাকি পাতাও নড়তে পারে না,
তোমার সমস্ত পুণ্যের দায় তার,
কিন্তু যেই পাপ করলে,
তখন সে ঘাড় সরিয়ে নেবে সুড়ুৎ করে,
সেটা নাকি তোমার দোষ!
কেউ দেখেনি তাকে,
কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই,
তবু সবাই গভীর বিশ্বাস করে,
কেউ ভয়ে, কেউ লোভে, কেউ স্বার্থে।
তার জন্য খুন করতে পারে লোকে,
খুন হতে পারে।
এত ভুলে ভরা চরিত্র, এত চরিত্রহীন, দুশ্চরিত্র;
মানুষ হলে কয়েক লক্ষ বার ফাঁসি হত।
কিন্তু তার হয় না।
প্রচন্ড স্বেচছাচারী, আত্মমগ্ন, স্তুতিপ্রেমী,
কিন্তু তবু নাকি মহান!
সব ধর্মগ্রন্থ পড়ে একটিই নির্যাস পাওয়া যায়,
মানুষকে সে সৃষ্টি করেছে বন্দনার তরে।
কী আত্মপ্রেমী, কল্পনা করা যায়!
এমন জিনিস মহান হতে পারে না,
না হয় থাকতে পারে না।
দ্বিতীয়টাই সম্ভব।
মানুষ নিজের দরকারে বানিয়েছে তারে,
অমন কেউ না।
সভ্যতার আগে, মানুষের ভয়ের সময়ে,
অসহায় মানুষ বানিয়েছিল তাকে,
নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য,
তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে গেছে অহর্নিশ,
পুতুলখেলা করে গেছে,
নিজেদের বানানো নিয়ম অনুসারে।
অমরত্বের পরীক্ষা
আমি ভেবেছি একটা কফিন বানাব।
খুব যে সুদৃশ্য হতে হবে তা নয়,
কিন্তু খুব মজবুত হওয়া দরকার।
ঠিক প্রাণায়ামের মতো খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ে যেমন,
আমি তেমনই ধীরে ধীরে উপভোগ করব জীবনটা,
যেন কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা না আসে কোনোভাবে,
তীব্র দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রনা, সুখ, আনন্দ, প্রাপ্তি কিচ্ছু দরকার নেই।
তাতে জীবন দ্রুতলয়ে চলে,
কম সময়ে অনেকখানি আয়ু ক্ষয়ে যায়।
মনে হয় পাওয়া হয়ে গেল,
বাঁচার জন্য একটা কারণ কমে গেল।
আমি সব আশা-আকাঙ্খা জিইয়ে রাখতে চাই।
যাতে কখনো প্রাপ্তি না এসে বাঁচার ইচ্ছা নিভিয়ে দেয় এক ফুঁয়ে।
আমি এখন থেকেই প্রতিদিন মেপে খাই,
নিয়ম করে ব্যায়াম করি প্রতিদিন,
প্রতিদিন আটঘন্টা ঘুমাই,
একদিনও ভুল হয়নি।
হবেও না কোনদিন।
আমি যে ব্রহ্মার সাথে পাল্লা দিতে চাই।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।