এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মধুময় পালের 'লাশপূর্ণিমা' উপন্যাসের আলোচনা

    PURUSATTAM SINGHA লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৫৩ বার পঠিত
  • বাঙালি আর কত লাশ বইবে?
    পুরুষোত্তম সিংহ

    মধুময় পাল এই দগ্ধ বাংলার অমাবস্যার আলো। সুতীব্র সময়চেতনা, সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, সুমিষ্ট ভাষা দক্ষতা ও ব্যঙ্গ-শ্লেষের সুকঠোর আঘাতে তিনি যাপিত সময়কে ছিন্নভিন্ন করেন। এই সচেতন আখ্যান পরিক্রমা বিগত তিনদশক ধরে তিনি ধারাবাহিকভাবে করে আসছেন। সময়ের পোড়া চামড়ার যেন কিছুটা শুশ্রুষার মলম লাগাতে চান। আবার বাঙালির আদেখলেপনা, ন্যক্কারজনক রোমান্টিকতা, মেকি ভাবাবাদের ঘোমটা খুলে দেখিয়ে দেন এই তোমার অবস্থা। কোথাও মধুময় ক্রূর, বিধ্বংসী, ঘাতক সময়কে আক্রমণ করেন। হ্যাঁ মধুময় আক্রমণের ভাষা ও আক্রান্তের ভাষা দুইই আয়ত্ত করেছেন। কে আক্রমণ করে? রাষ্ট্র। কে আক্রান্ত হয়? বাঙালি। ভীতু বাঙালি পর্বে-পর্বান্তরে সব হারাচ্ছে। শুধু সংস্কৃতি নয় পরিবেশ, সভ্যতা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র সব। তার সংস্কৃতি নেই, তার পরিবেশ নেই, তার নদীনালা নেই, তার সুচিকিৎসা নেই, তার সুশিক্ষা নেই, তার আদবকায়দা, রীতিনীতি কিচ্ছু নেই। একেবারেই কি ছিল না? একদিন ছিল। সেই একদিন থেকে, সেই অতীত থেকে আজ পর্যন্ত যে অবস্থান্তর, নষ্টামি, ধান্দাবাজি, নীতিহীনতা প্রাধান্য পেলে মধুময় তাকেই আঘাত করতে চান। আঘাত করতে গিয়ে মধুময় নিজেই আহত হন বিবেকের কাছে। সেই আহত বিবেকই মধুময়কে দিয়ে এমন আখ্যান লেখাতে বাধ্য করে। বাঙালির বিনাশ বিসর্জনের ডমরু ধ্বনি কত ভয়ংকর, তার স্বর কত করুণ তা মধুময়ের আখ্যানভূমি স্পর্শ করলে বোঝা যায়।

    ‘লাশপূর্ণিমা’ একটি সময়ের দলিল। করোনাকে সামনে রেখে বাঙালিসহ গোটা ভারতের মানচিত্র, মনচিত্রের থইথই চিল চিৎকারের আর্তরব। যে অশনি সংকেতে আমি, আমার সময়, আমার রাষ্ট্র ভেসে গিয়েছিল যার পিছনে ক্ষমতাধারী পুঁজিবাদিদের বৃহত্তর ক্রোধ ছিল, ছিল মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে কিছুটা রোজগারের ইশারা তার ছালচামড়া খুলে দেখানো। মধুময় যেহেতু সর্বদাই বড় মাঠের শিল্পী, আখ্যানমাঠকে সর্বদাই বড় করে রাখেন সেহেতু পুকুর বোজা থেকে নার্সিংহোমের দুইনম্বরী, ডিজে আধিপত্য, জনপদের বদলে যাওয়া মানচিত্র, কলোনির অবস্থান্তর, জমি মাফিয়া, সিন্ডিকেটরাজ, ক্রাইম, ক্ষমতার পদধ্বনি, বাঙলির ইতিহাস, আধিপত্যবাদ, বেকারত্ব, ক্লাব কালচার, আমফন, শোষণের চূড়ান্ত ধষ্টামি সমস্তকেই নিপুণ প্রত্যক্ষে বিন্যাস্ত করে চলেন। চারুবেলা-প্রমথের জীবনের সংকটের মধ্য দিয়ে আখ্যানের যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানে লুকিয়ে আছে সময়ের হাজারো অমাবস্যার অন্ধকার। নবজাগরণে দীক্ষিত বাঙালি বদলে গেল কুঅভ্যাসে, মদ্যপানে, মিশ্র সংস্কৃতিতে। শুধু পরিবেশ ধ্বংস বা অর্থ রোজগার নয় বাঙালি নিজেই তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে উপড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে চাইল, দিচ্ছে। মধুময়ের বিদ্রোহ এখানেই। সেই বিদ্রোহই তার সমগ্র আখ্যানের সিংহদরজা।

    মধুময়ের আখ্যানে একটা দ্রুত গতি আছে। তার চলন ঠিক যেন এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো। ট্রেনের বিবিধ কোচে যেমন বিবিধ শ্রেণির মানুষ বিবিধ চিন্তাচেতনা নিয়ে উপস্থিত হয় ঠিক মধুময়ের আখ্যানও তেমনি। দেশভাগের পর্ব থেকে উদ্‌বাস্তু যন্ত্রণা বয়ে কলোনি পত্তন, কলোনির হেঁটে চলা এবং পরিবর্তনের সাঁচের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিনাশ যাত্রার সত্তর বছরকে স্পর্শ করার সোপান আছে। উদ্‌বাস্তু বাঙালি এপারে এসে কীভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেল, নিজের সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে আগ্রাসনের সংস্কৃতিতে মিশে গেল তার নানা ফরমান একাধিক বয়ানে তিনি দেখাতে চান। প্রত্যেকটি চরিত্রের পশ্চাত্যে স্থানীয় ইতিহাস আছে। আছে ধ্বংসযজ্ঞের বৃহত্তর পরিণাম। ধনঞ্জয়, হাতকাটা হিরুর পিছনে আছে রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর-ক্ষুদ্র ষড়যন্ত্র, শোষণ, চক্রান্ত। শিক্ষক ধনঞ্জয়ের দেশভাগে মোয়া বিক্রেতায় পরিণত হওয়া বা মদারু হিরুর পানের দোকানদারে পরিণতির পিছনে রয়েছে আধিপত্যবাদ, নেতাদের ষড়যন্ত্র। পুকুর ভরাট, বৃক্ষ নিধন, পুরাতন ঐতিহ্য ভাঙন, রাস্তাঘাট সংস্করণের নামে ছিনিয়ে নেওয়া, উন্নয়নের টেবলেট গেলানোর নামে যে শোষণ যা সমাজকে ক্রমেই দূষিত করছে তার সামগ্রিক নজরানা মধুময় দিনের আলোয় উড়িয়ে দেন।

    কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয়কে কেন্দ্র করে মধুময় আখ্যান রচনা করেন না। কেন্দ্রে কোনো একটি ঘটনা বা প্লট থাকে বটে কিন্তু তা বাঙালির সামগ্রিক অধঃপতনের বিসর্জন বাজনা শোনাতে চায়। আতশবাজি যেমন কেন্দ্র থেকে উড়ে অনেকটা এলাকায় ছড়িয়ে পরে আলো দান করে মধুময়ের আখ্যানও তেমন। সেখানে পার্টি, রাজনীতি, বুদ্ধিজীবী, ক্ষমতা, শোষণ, উন্নয়নের ধাপ্পাবাজি, ধ্বংস, খতম, বাঙালির অস্তিত্ব সংকট, জীবিকার সংকট, ভাষা বিচ্যুতি, নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব, বদলনামা, কলোনি থেকে ফ্ল্যাট, লেন, ফুর্তি, সংস্কৃতির অমাবস্যা সমস্ত মিলে এমন এক জারণক্রিয়া আবিষ্কার করেন যা সময়কেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক নাশকতাকেই মধুময় নায়কত্বের আসনে বসাতে চান। এই নাশকতা কখন, কীভাবে, কোন পথে বড় হল, দূষিত হল, সেই পথ পরিক্রমাই আখ্যানের দৌড়ভূমি। সেখানে নানাবিধ স্টপেজ আছে। মধুময় স্টপেজে স্টপেজে বাঙালির অন্ধকারের সারথি হয়ে যুদ্ধে নামেন। আঘাত করেন, বিদ্রোহের নিশান ওড়ান, ব্যঙ্গ করেন, গদ্যের চিত্রনাট্য শোনান। আছে কথকতার পাঠ। কিন্তু এই কথকঠাকুর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গল্প বলে না। ইচ্ছাকৃতই টানা গল্প ভেঙে দেন। গল্পের মধ্যে সময়ের অন্ধকার বুনে দিয়ে পাঠককে দেখান এই তোমার সময়, তার পার্শ্বনায়ক হে পাঠক আপনিও।

    করোনাকে কেন্দ্র করে যে ভয়ংকর বিপর্যয় নেমে এল নিম্নবিত্ত জীবনে তার বহুরৈখিক চালচিত্রের সংবাদ দিতে চেয়েছেন লেখক। কারখানা বন্ধ, শ্রমিক ছাটাই, করোনার পূর্ব থেকেই কারখানাকে কেন্দ্র করে মালিকপক্ষের বিবাদ, মাঝে করোনা আসতেই সব লন্ডভন্ড হয়ে গেল। জীবনের পথ ভুলে, রুজিরোজগারের দিশা হারিয়ে, ঘরে ফেরার যানবাহন থেকে চ্যুত হয়ে হাঁটা পথে গৃহ অভিযানের এক অমানবিক প্রতিচ্ছবির সাক্ষী থেকে গেল দেশ। রাষ্ট্র নেতাদের অপদার্থতা, রাষ্ট্রের উর্দিধারীদের সেয়ানাগিরি, পুঁজিবাদীদের অমানবিকতা সাধারণ-অতিসাধারণ মানুষের জীবনে মৃত্যুর বাজনা বাজিয়ে দিয়ে গেল। মানুষকে মানুষ মনে না করার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র বাবুরাম, রামশরণদের জীবনে মৃত্যু মিছিলের অন্ধকার ঘনিয়ে নিয়ে এল। বুদ্ধিজীবীদের আকাশ প্রমাণ নীরবতা, নাগরিক মানুষের জীর্ণতা প্রায় বুলডোজার চালিয়ে দিল প্রান্তিকের হৃদয়ে। বাবুরামরা ঘরে ফেরার সব পদ্ধতি হারিয়ে হাঁটা পথেই রওনা হল। কেউ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, প্রহরে উদ্যোত হল, কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। অর্ধহারে, অনাহারে মাইলের পর মাইল হেঁটে মানুষ ঘরে ফিরতে বাধ্য হল। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের উপর কোনো দায়িত্বই পালন করল না। এই

    মধুময়ের একটা নিজস্ব ভাষাদ্বীপ আছে। মিহি মৃদু মিষ্টি শব্দে তা যেমন তরঙ্গ তোলে তেমনি ব্যঙ্গ শ্লেষে একটা নিজস্ব আমেজে ভেসে যায়। জনপদের ভাষা, আঞ্চলিক সংলাপে তা যেমন জীবনের অন্তর্প্রদেশকে ধরে রাখে তেমনি মিশ্রভাষা সংস্কৃতির বহমান প্রক্রিয়ার ভয়াবহতাকে ব্যঙ্গ করে। মধুময়ের আখ্যান দ্রুত বয়ে যায় ভাষার সাবলীল প্রবাহের জন্যই। শব্দের মিষ্টতা, আঞ্চলিক শব্দ, ইংরেজি-হিন্দি শব্দের সচেতন প্রয়োগ এমন ভাষাপ্রবাহের জন্ম দেয় যা আখ্যানকে তরান্বিত করে। তেমনি ব্যঙ্গ, শ্লেষের সচেতন প্রয়োগ আখ্যানের অলংকার হয়ে ওঠে। একাধিক মেটাফোরকে সামনে রেখে সময়কে তিনি যেমন ময়দামাখা করেন তেমনি সময়ের মানুষ কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার গোপন রসদ স্পষ্ট করে দেন। আনকোরা শব্দ, আশ্চর্যরকম বয়ান দিয়ে আখ্যানে যেমন কাব্যত্ব বজায় রাখেন তেমনি কোথাও বিধ্বংসী বয়ানে মেকি মার্কা ভাববাদকে খণ্ডন করেন।

    ‘ঝড়ের মাঝে অভিসার’ পরিচ্ছেদে করোনার মধ্যবলয়ে যে আমফানে সমস্ত লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সেই রাতের পূর্বভাস এনেছেন। সেই কালরাতে পার্টির নেতা, ক্লাবের নেতা, প্রেসিডেন্ট, মেম্বার সবাই মিলে কীভাবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় তার মতলব এঁটেছেন। উন্নয়নের নামে মাল হাপিস করে দেওয়া, বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়ানোর নামে সব গুছিয়ে নেওয়ার যে ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতা চলে তার নথিনক্ষত্র টেনে বের করে দেন। ফুলনেতা থেকে হাফনেতা, ঘটনাকে সাজানো, পাবলিক-মিডিয়ার সামনে অভিনয় করা, নিজেকে সৎ সাজার চেষ্টা অথচ তল দিয়ে সব গুটিয়ে নেওয়ার কত যে কায়দা আছে মধুময় সব ব্যক্ত করে চলেন। নিবিড় ঢালি, গজেন গুহ, নিধিরাম সরকার কালরাতে ফন্দি এঁটে চলে কীভাবে সর্বনাশ যজ্ঞের বাজনা বাজানো হবে। মানুষকে আজ সর্বস্বান্ত করেছে রাজনীতির বিবিধ পর্যায়ের নেতারা। তোল্লাই দিয়েছে। জনসেবার নামে নিজেকে পেটমোটা গণেশ বানানোর যাবতীয় গুপ্ত পথকে লেখক টেনে হিঁচড়ে দেখান এই তোমার সময়। নিজেকে সংস্কৃতিবান, কর্তব্যপরায়ণ প্রমাণ করতে নীতিবাগিশের যে বাক্যজাল গড়ে ওঠে তার হরেকরকম সত্য কত বিরোধাভাসের জন্ম দেয় তার নথিনক্ষত্র এমন বিপদজনক বয়ানে চিহ্নিত হয়ে চলে যার নান্দনিক মূল্য বড় প্রখর। মানুষের বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নামে মানুষেরই পাঁজর ভাঙার যে ন্যক্কারজনক চিত্রনাট্য তার ভয়াবহতা কত তীব্র, কত বিপদজনক তার আগাপাশতলা কাছা খুলে দেন।

    আখ্যানের দুটি সরণি আছে। একদিকে বিত্তবাণ পুঁজিবাদি, মাফিয়া, নেতাদের সমস্ত গুছিয়ে নেবার বৃত্তান্ত, অন্যদিকে হাড়হাভাতে মানুষের চিলচিৎকার। আমফান, লকডাউনে নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের আর্তরব কত প্রখর, ভয়াবহ, পেটের জ্বালা কত যন্ত্রণাময় তার বেদনার্ত ভাষ্য বয়ে চলে। জীবন জীবিকার সংকটে ভুক্তভোগী মানুষ করোনায় সর্বস্ব হারিয়ে অভুক্ত কণ্ঠে জীবনের ঘোর অমাবস্যার যে যাপনচিত্র বুনে চলে তা সভ্য দেশের রাষ্ট্রকে যেন বড় জিজ্ঞাসার মুখে ঠেলে দেয়। সভ্যতার তলদেশ দিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষের গোপন ভাষ্যের মানবিক বয়ান এই আখ্যান। সভ্য মানুষ, পুঁজিবাদি বিত্তবাণ, রাষ্ট্রের উর্দিধারী পুলিশ, সভ্যরুচি এদের কেবল বাতিল করে দিতে চেয়েছে। নিজের সত্তাকে হারিয়ে কেবল পেটচিন্তায় মত্ত হয়েছে ভজা, গ্যানা, ভগবতরা। হতাশা আক্ষেপ ঝুলে থাকে গ্যানা, ভজার বয়ানে—
    “কী বললি! ঠিক কথাটা দুম করে বলে ফেললি মনে হয়। সেই ভাষাই সরিয়ে দিয়েছে আমাদের। বলেছে, এটা তোদের জন্য নয়। এই ভাষা ধরে রাখতে এমন কিছু লাগে, যা তোদের নেই। শুধু ভালোবাসা দিয়ে ধরে রাখা যায় না। একদিন গানকে নিজের জিনিস ভেবেছি। ট্রেনে গাইতে গাইতে বুঝে গেলাম, এটা আমার নয়। এটা গান নয়। খিস্তিখেউড়ের, ভাগাড়ের গানের পাশে আমার গান থাকতে পারে না। প্রেমটাও চলে গেল। শুধু ভালোবাসা দিয়ে প্রেম ধরে রাখা যায় না।”
    (লাশপূর্ণিমা, নয়া উদ্যোগ, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০২৪, পৃ. ৮৬)

    এই ভাষা বিচ্যুত মানুষ ক্রমাগত খিস্তি দেয়। খিস্তি দিয়ে মনের রাগ প্রকাশ করে। সর্বস্বহারা মানুষের আর তো হাতিয়ার নেই। সে সর্বত্র ব্যবহারের অংশ। নিচু তলার মানুষের তত্ত্বতালাশের মধ্য দিয়ে মধুময় সময়ের বিভীষিকাকে ব্যক্ত করেন—
    “পুরোনো চিটের মাল তো, কথার কায়দা আছে। ও একটা কথা বলেনি, দেশ চলে মদে আর খোঁচড়ে। মদ পয়সা দেয়, খোঁচড় খবর দেয়। বাকি সব ফালটুস। সাজানো বাগান। রঙের পাঁচালি। গ্যানা জোর চাপড় মারে নিজের পায়ে। নির্জনতা কেঁপে ওঠে। শালারা মশা মারতে পারে না, দেশ চালাবে! দিনভর খালি ঢপলা আর বাতেলা। তিনশো ইউনিভার্সিটি করেচি। পাঁচশো স্পেশাল হাসপাতাল করেচি। দশ লাখ চাকরি দিয়েচি। পঞ্চাশ লাখ বেকার বানিয়েচি। শালাদের মুখে কুষ্ঠ হয় না কেন যে!” (তদেব, পৃ. ৮৯)

    অনেকটা বৈঠকী ঢঙে, আলাপি চালে জনজীবনের নিম্নপ্রদেশ দিয়ে সময়ের অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে চলে। কেউ কেউ কথকঠাকুর হয়ে যায়। ‘জ্যোৎস্নার ডপলেট’ পরিচ্ছেদে ভজা-গ্যানা মদে মত্ত হয়ে করোনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি মনের কুসংস্কার, ভিত্তিহীন চাপানউতোরের জঘন্য ফাতরামি নিয়ে যেমন ব্যঙ্গ করে তেমনি অব্যর্থ বাণে কাষাঘাত করে। কাজ হারা, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা, মদের রমরমা ও মাতাল ভজা-গ্যানার নবজীবনের স্বপ্ন বোনার মধ্য দিয়ে লকডাউনের পুরো চিত্রটাই রিনিঝিনি ঝংকারে বাজতে দেখি। সময়ের বীভৎসতার মধ্যেও একটা রোমান্টিকতা আছে। আছে সৌন্দর্যবোধ। এটাই মধুময়ের ভাষাগত ও জীবনশৈলীর দক্ষতা। আখ্যান অন্ধকার প্রদেশে নামছে ঠিকই কিন্তু তার উপস্থাপন বড় রঙিন। মধুময়ের স্বচ্ছ ভাষা স্কেচ ও শব্দের মিছরি সেই স্বভাবজাত সৌন্দর্যকে ধরে রাখে। হ্যাঁ মধুময় সুন্দরেরই সাধক। তবে তা সময়কে খনন করে, সময়ের আন্ধকারকে স্পর্শ করে শব্দের শুদ্ধতম আরাধক। কৃত্রিম বা বানিয়ে তোলা নয়, জীবনকে নেড়েঘেঁটে, জীবনের সেতুবন্ধন করে তিনি জীবনেরই সৌন্দর্যসাধক হয়ে ওঠেন।

    করোনাকে কেন্দ্র করে অনলাইন শিক্ষা পরিসর, সেমিনার, যন্ত্র বিভ্রাট, মানুষের যান্ত্রিকতা ও সংকটকে অতিক্রম করার প্রবণতার মধ্য দিয়ে যাপিত সময়ের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি ধরে রাখতে চান। শিক্ষিত মানুষের এই সাংস্কৃতিক চর্চা, প্রান্তিক মানুষের নিষ্ঠুরভাবে বাঁচা, প্রতিবেশীর মৃত্যুতে নীরব উল্লাস, ভয়গ্রস্ততা, ভণ্ডামি সব মিলিয়ে সময়ের বুকে চাবুক হানেন। শুধু করোনা ভাইরাস নয় বাঙালি জীবনকে গ্রাস করেছে বহুবিধ ভাইরাস। দেশভাগ থেকে নকশাল দমন, কলকারখানার বারোটা বাজানো, শিক্ষা ব্যবস্থাকে লাটে তোলা, প্রতিবাদের কণ্ঠকে টিপে ধরা ও সংস্কৃতির দূষণ। মাফিয়ারা বাঙালিকে ধ্বংসস্তূপে ফেলে দিতে রবীন্দ্রনাথকে টার্গেট করেছে। যে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির বিবেক, বাঙালির মেরুদণ্ড সেই রবীন্দ্রনাথকে আজকের বাঙালি উৎসবের বিষয় করে তুলেছে। চর্চার অভাবে, রবীন্দ্রনাথের মননকে বোঝার অভাবে কেবল নাচ গানের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপনের হুজুগকে ব্যঙ্গ করেন। তবুও সংকটকালে মানুষ বাঁচতে রবীন্দ্রনাথকে একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছিল। এই সদার্থক প্রবণতাকে কেউ কেউ আবার ব্যঙ্গ করেন। বাঙালি মনের দূষিত বায়ুর ঝাঁজ কত তীব্র মধুময় তা দেখিয়ে চলেন।

    ‘টোটোযুবক ও বাঙালির ইতিহাস’ পরিচ্ছেদে এলিট বাঙালির কাছা খুলে দেন মধুময় পাল। সময়ের নোংরা রাজনীতির পঙ্ক কত ক্লেদময় তা অব্যর্থ ভাষ্যে উপস্থিত হয়ে চলে। বাঙালির জীবনচরিতে এত অন্ধকার, এত অধঃপতন, এত দৈন্যদশা, এত ধান্দাবাজি, মানুষ ঠকানো কারবার, সমস্ত ধ্বংসের উল্লাসময় আয়োজনের নিবিড় পাঠ এঁকে চলেন। টোটোচালক ও এলিট হরিদাসের বয়ানের মধ্য দিয়ে লকডাউনের সর্বনাশা চিত্রনাট্য, নিম্নবিত্তের সমস্ত হারানোর পদাবলি ও ‘কুঞ্জ লা রাধা’র বিবর্তন চিত্রিত হয়ে চলে। টোটো চালক ক্রমাগত খিস্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ, অভিমান, রাগ প্রকাশ করে চলেন। সামান্য তুলে ধরা যাক—
    “ট্রেন বন্ধ করে গাণ্ডুগুলো ঝাড় করে দিল। সকাল থেকে বসে। এক পিস প্যাসেঞ্জার নেই। তিনটে স্পেশাল ট্রেন গেল। একজনও এদিকের নামেনি। আর-একটা আসবে। তাতে যদি কিছু না হয়, এবেলা গাধার ভ্যাজাইনায়। এই লকডাউন গরিব মারা ছাড়া আর কোন বালটা ছেঁড়ে? চোদনাগুলো তো মজায় আছে। পার্লামেন্টে বিশ টাকায় বিরিয়ানি খায়। পঁচিশ পয়সায় পিয়োর দার্জিলিং টি। রাজার ব্যাটা, ভোদার ফ্যাতা। চামচাগুলো দিনরাত তোলা আর ছুকরি তোলে। ভোট চাইতে দরজায় আসে ভাঙা রাঁড়ের রাঙা হাসি নিয়ে। বোকোচ্চো…। টোটোচালক আপন মনে বলে যায়। আর, মাস্টাররা, শালারা সারাদিন মোতে, আর বাজার করে। মাস গেলে সরকারি টাকা নেচে নেচে অ্যাকাউন্টে ঢোকে।” (তদেব, পৃ. ১২৪)

    এই ভাষ্যই কি জীবনের প্রতিবাদ? না অক্ষম হতাশার দ্বিরালাপ। প্রান্তিক মানব তা বোঝে না। বুঝতেও চায় না। সে নিজের ট্র্যাজেডির কথা বলে। লকডাউন, কর্মহীনতা, স্ত্রীর চলে যাওয়া, এলাকার পাইকারি উন্নয়ন, অপর প্রান্তের অন্ধকার, মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট সব মিলিয়ে যেন চলমান সময়ই কথা বলে যায়। টোটোচালক ক্রমাগত খিস্তির মধ্য দিয়ে যেমন বহমান সময়কে অপ্রতিরোধ্য ব্যঙ্গে ব্যক্ত করে তেমনি বহমান সময়ের ধারাভাষ্যকার ধনা। ধনঞ্জয় পাল। বিফোর পার্টিশন শিক্ষক, আফটার পার্টিশন মোয়া বিক্রেতা (হে পাঠক ধনার জীবনচরিত সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনি ‘ধনপতির কথাপালা’ দেখে নেবেন)। সুতীব্র শ্লেষে লেখক বাঙালির ইতিহাসকে আক্রমণ করেন। শুধু তাই নয় সংস্কৃতির বহমান খাতে কত কাদা জমে দূষিত হচ্ছে তার অদ্ভুত চিত্রনাট্য বাঙালির পিঠে থাপ্পড় কষিয়ে যায়। ধনার বয়ানে পাই—
    “লোকটা বলে, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। আর করব না। একটা সাজেশন দিন। আমি মোয়া বেচি। আর বই লিখি। একজন বই লিখেছে ‘দুপুরে করতে নেই’। মারকাট বিক্রি। সেক্স আর বলদামির ঘাঁট। আমার বেশি বিক্রি চাই না। একা মানুষ। নাম দেব ‘নিজগুহ্যে নিজলিঙ্গ’। নামটা সংস্কৃতের সাইডে। বাংলা করলে হয় ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। অত কঠিন নাম দিলে বাঙালি বুঝব না, পড়ব তো না-ই। ‘নিজগুহ্যে নিজলিঙ্গ’টা সোজা, পরিষ্কার। বাঙালি এই কামটা খুব পারে। খুব করে। বইটা পইড়া অন্য জাতির লোক শিখতে পারে। আপনারা যদি একটু বইলা দেন, কোনো অ্যাকাডেমি অনুবাদ করতে পারে।” (তদেব, পৃ. ১৩৭)

    এ যেন ইতিহাসহীন বাঙালির নব্য ইতিহাস। হে বাঙালি তুমি যতই ইতিহাসকে বিকৃত করো, মুছে ফেলতে চাও পাছে কেউ তা লিপিবদ্ধ করে চলছেই। আসলে এই সমস্তই মধুময়ের সচেতন সময়চেতনার ফর্ম। বাঙালির বহমান সময়, নষ্টামি, ধান্দাবাজি, পতনের আর্তনাদ ও বদলে যাওয়া চরিত্রের সচেতন ন্যারেটিভ। যা বাংলা আখ্যানের জরুরি আয়োজন।

    মধুময়ের এই আখ্যানে একাধিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে। আসলে মধুময় কেন্দ্র বলে কিছু রাখতে চান না। লকডাউন, করোনা সংলগ্ন পরিস্থিতিতে বাঙালির অর্থনীতি-রাজনীতি-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধঃপতন, আধিপত্যবাদ সবটাই বাজাতে চান। লকডাউন মানুষকে যেহেতু ঘরবন্দি করেছিল তাই অনেকটা বৈঠকী ঢঙে বাঙালির শিক্ষা-সংস্কৃতি-বইপড়া-বই বাণিজ্য, লেখক প্রতিষ্ঠা, সংস্কৃতির বাংলা বাজার, বাংলা বাজারে প্রতিষ্ঠার গোপন পথের নোংরামির মুখোশ খুলে দেন। কবির বুনিয়াদি বিদ্যা, লেখার থেকে অন্য ক্ষমতার প্রয়োগ, লাইনবাজি, অধ্যাপকের সেক্সচিত্র, দুর্নীতি, নীতিহীনতা, ভীরু বাঙালির কলমের-মনের-সাহসের জোর যে দুর্বল তার একাধিক বয়ান এনে আখ্যান সময়ের ধ্বনি শুনিয়ে যায়। হিন্দির আগ্রাসন, বাঙালির ঐতিহ্য বিচ্যুতি, মুনাফার স্ফীতি ও সর্বত্র ধান্দাবাজির দাপট সমগ্র বাঙালি মানসকে কীভাবে কলুষিত করছে তার রক্তিম পাঠ মধুময় ব্যক্ত করে চলেন। মদ হয়ে ওঠে অর্থনীতির ভিত্তি। সেক্স হয়ে ওঠে চর্চার বিষয়। আমবাঙালির আগাপাশতলা চাষাবাদ করে মধুময় বাঙালির নিম্নপ্রদেশের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া প্রতিস্থাপন করে চলেন। মধুময় বাংলা সাহিত্যের সেই লেখক যিনি বিষয়কে আলগা সজ্জায় ধরতে চান না, সমস্যার গভীরে গিয়ে সমস্ত টেনে হিঁচড়ে বের করে দেন। মধুময়ের এইসব আখ্যান বহু বুদ্ধিজীবী বাঙালির গাত্রে ফোস্কা ফেলে দেবে, কৌশলে মধুময়কে পিছিয়ে ফেলার চক্রান্ত করা হবে, হচ্ছে এতকাল। এখন দেখা দরকার বাংলা বাজার কীভাবে তা গ্রহণ করে। হে সাহিত্যের বাংলা বাজার তোমার সুচিন্তিত মন আছে তো?

    সাংস্কৃতিক দূষণকেই মধুময় পাল সব আখ্যানে টার্গেট পার্ট করেন। ব্যতিক্রম নয় ‘লাশপূর্ণিমা’ আখ্যানও। বাঙালিকে ক্রমেই আজ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে বুদ্ধিজীবী তকমাধারী এলিট বাঙালি। বাঙালি লেখক আজ ধান্দাবাজের চূড়ান্ত সোপানে চলে গেছে। টিভিতে ঘণ্টা খানেক বক্তিমেতে শিল্পী-কবি-নাট্যকার-চিত্রকর বুদ্ধিজীবী কেবল নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। রসাতলে ভেসে যাচ্ছে আমার বাংলা। ক্রমাগত বিপক্ষকে ঘায়েল করা, অন্যের অতীতের গু টেনে বের করা ও অপরের দোষ ধরার মধ্য দিয়ে বাঙালির উন্নয়ন আজ শ্মশানযাত্রায়। সুগঠিত বক্তব্য, সামগ্রিক উন্নয়নের দিশা দেখানোর বদলে পক্ষ-বিপক্ষের কাজিয়া হয়ে ওঠে বিনোদনের সামগ্রী। বাঙালি লেখকের লাইনবাজি, বই বিক্রি, অন্যের দাস্যতা স্বীকার, থ্রিলার, ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে নিজের সময়কে ক্রমেই ভেন্টিলেশনে পাঠিয়ে দেবার বৃহত্তর চক্রান্তের মুখোশ খুলে দেন মধুময় পাল।

    বিভাবসু, মুকুলসুন্দর রায়, সন্দীপ মল্লিক, শুভব্রত সোম, হরিদাস প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীরা মদের সাগরে ভেসে যেতে যেতে বাংলা বাজারের সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। নিজেদের আধিপত্য, অস্তিত্ব সংকট, পাইয়ে দেওয়া আর লাইন করে টিকে থাকার মধ্য দিয়ে ঘণ্টা খানেক সঙ্গে সংবাদ বয়ান জীবনের রোজনামচা অব্যর্থ ভাষায় বুনে চলে। বাঙালির বাতেলাবাজি, তোল্লাইপনা, সামান্য তর্কেই আক্রমণ, তুই বড়-মুই বড় যুদ্ধে বাঙালির বানানো সত্তা যে কত ঠুনকো লেখক তাই চরিত্রের আত্মদর্পণে দেখাতে চান। বাঙালি ভাঙছে, বাঙালি ধান্দাপানি করছে, বাঙালি মেকি আদর্শ প্রচার করছে, এলিট বাঙালি আদর্শের তাবিজ ছড়িয়ে দিতে চাইছে অথচ প্রান্ত শোষিত হচ্ছে, নিম্নবিত্ত জীবন সংকটে ভুগছে। মূল জায়গায় প্রশ্নের বদলে আলাম ফালাম, লাফালাফি, দাপাদাপি করে ভণ্ড বাঙালির কালচারাল মুভমেন্টের জাঙিয়া খুলে মধুময় দেখান তোমার বীর্যলিঙ্গ ঘুণধরা। সেই মরচে ধরা ভাববাদের মস্তিষ্কে মধুময় একের পর এক ঢিল ছুঁড়ে যান।

    নেতাদের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী লাগে। বুদ্ধিজীবী কায়দা করে সরকার পক্ষ নিয়ে কথা বলে। বুদ্ধিজীবীর পোস্টখালি হলে নতুন বুদ্ধিজীবীর আমদানি করা হয়। নেতাদের শাগরেদরা বুদ্ধিজীবীদের সাপ্লাই দেয়। লাইন ধরে কথা বলতে হবে। সাহিত্য, মিউজিক, সম্পাদক, বক্তা ধরে নেতার পক্ষে সাওয়াল করার মধ্য দিয়ে সমস্তটা লোপাট হয়ে যায়। নিবিড় ঢালিদের এমন শাগরেদ বিভাবসু। মধুময় পাল মিঠেকড়া ভাষায় সময়কে ছিন্নভিন্ন করে চলেন। একপাল বুদ্ধিজীবী নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার ঠাণ্ডাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সময়ের কালবেলার প্রখরতা চিহ্নিত হয়ে চলে। নিজেদের সৎ-আদর্শবাদী প্রচারের আড়ালে সমস্তকে বিকৃত করে দেওয়ার বৃহৎ ষড়যন্ত্রকে মধুময় আক্রমণ করে চলেন পর্বে পর্বে। গণবুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির ফেস্টিভালে আজকের মানুষ কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছে সেই গোপন সূত্রমালাকে এঁকে দেন এই আখ্যানের পর্বে পর্বে।

    অবসাদ, বিপন্নতায় ডুবে গেছে আমার বাংলা। উন্নয়নের নামে লাশ মিছিলে ঢেকে গেছে চারিদিক। এই লাশ সরণি একদিনে নয় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ঘোর অমাবস্যার ফসল। হ্যাঁ পূর্ণিমাও আছে। তবে তা ক্ষীণ। অমাবস্যার অন্ধকারই যেন প্রগাঢ়। চাঁদের গা যেন পুড়ে যাচ্ছে। দহনবেলায় চাঁদ নিজেও যেন আলো দানে অস্থির হয়ে উঠেছে। আলো-অন্ধকারের যুদ্ধে অন্ধকারই যেন জিতে যাচ্ছে। লাশতন্ত্র, লাশ মিছিল, লাশ সরণিই যেন আজ বাঙালির ভবিতব্য। ঘাতক, নৈরাজ্যবাদ, দুর্নীতির ঢালাও বিস্ফোরণ, অপশাসনের বৃহৎ বাজার বাংলাকে আজ শ্মশানে পাঠিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে। সেই নৈরাজ্যবাদের সকালবেলা থেকে সন্ধ্যাবেলার পাঠ আবিষ্কারক মধুময় পাল।

    কে যেন বলেছিল আমাদের কিছু লাশ চাই। আর কে যেন লিখেছিল—ওরা কিছু লাশ পেয়ে গেল। হ্যাঁ সেই লাশ মিছিল চলছে বাংলার বুকে সময় থেকে সময়ান্তরে। নকশাল পর্বের লাশ ভাসিয়ে দেওয়া, লাশ গায়েব করা থেকে করোনায় লাশ ভেসে যাওয়া একই প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রনায়কদের এপিঠ-ওপিঠ। সেই দুই পিঠেই ছেঁকা দিতে চেয়েছেন মধুময় পাল। ফলস্বরূপ আখ্যান ঘাতকের ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দেবার পাঠ আবিষ্কার করে চলে। ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিবে যায় বারে বারে।’ হ্যাঁ অন্ধকারে ভেসে যায় দিন দুনিয়া। খতমের রাজনীতি এলোপাথাড়ি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে। পেটের দায়ে বোমা কারখানায় কাজে গিয়ে মৃত্যু ঘটে। ভোটে মৃত্যুর রাজনীতি কাজ করে। বন্ধ কারখানায় প্রতিবাদী শ্রমিককে হটিয়ে দেওয়া হয়। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সেই লাশতন্ত্র পূর্ণতা পেয়েছিল করোনার ছোঁয়াতে। করোনা, লকডাউন কেটে যাবে, কিন্তু সামগ্রিক অন্ধকারের অবসান ঘটবে কবে? আদৌও কি ঘটবে? বাঙালি আর কত লাশ বইবে? তবে কি অন্ধকারই শেষ কথা? কে জ্বালবে আলো? সর্বস্বহারা চারু, প্রমথ দিশাপ্রদীপ নিয়ে বসে আছে। চেতনার দীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছে। একদিন আলো জ্বালবে। সেই দিন কি আসন্ন? ‘সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ’।

    পুরুষোত্তম সিংহ। ঘোষপাড়া, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ। উত্তর দিনাজপুর। ৭৩৩১২৩। ৬২৯৭৪৫৮৫৯১।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কালনিমে | 103.244.***.*** | ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ২৩:৪৮540745
  • গুরুতে এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেখিনি আগে - যা হোক - এই মধুময় বাবুটি কে ? নাম তো শুনিনি কখনো 
  • PURUSATTAM SINGHA | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৮:৫৬540748
    • মধুময় পাল বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তিনটি উপন্যাস ছাড়াও দেড়শোর অধিক গল্প লিখেছেন। বাঙালি জাতিসত্তার ভাঙন, আধুনিকতা নিয়ে তিনি অক্ষরযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে । সম্পাদক, প্রাবন্ধিক হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচয়। 
  • | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৩৪540752
  • মধুময় পালের সম্পাদনায় মরিচঝাঁপির উপর বেশ ভাল বই আছে,  দেশভাগ বিনাশ ও বিনির্মাণ আরেকটা ভাল বই মধুময় পালের সম্পাদনায়। গাঙচিল থেকে বেরোন এই বইগুলো। কিছু ছোটগল্পও পড়েছি ওঁর লেখা। @কালনিমে
  • কালনিমে | 103.244.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫০540760
  • আচ্ছা- আমার জানা ছিল না - খুঁজে পড়বো তা হলে
  • কালনিমে | 103.244.***.*** | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫১540761
  • ** অনেক ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন