এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • লাল পাহাড়ির দেশের এক আশ্চর্য মানুষ 

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ৬৯ বার পঠিত
  • লাল পাহাড়ির দেশের এক আশ্চর্য মানুষ 
     
    সেটা ১৯৮৭ সাল, আমার শিক্ষকতা জীবনের একেবারে গোড়ার দিক। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পাট চুকতেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জনা দশেক ছাত্র আর আমরা দুজন মাস্টারমশাই মিলে। হেডমাস্টার মশাইও যাবেন। গন্তব্য লালপাহাড়ের দেশ পুরুলিয়া। ওখানেই তখন স্কুল অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের উদ্যোগে এবং সংস্থার মুখ্য কর্ণধার তথা পরিবেশবিদ্ বিপ্লব ভূষণ বসুর নেতৃত্বে অযোধ্যা পরিক্রমার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে পরিবেশ রক্ষার ভাবনাকে পৌঁছে দেওয়া। এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন পরিবেশকর্মী সহ কলকাতার বেশ কিছু সমভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠানকে। আমরা ডাক পেয়েছিলাম আমাদের হেডমাস্টার মশাই প্রয়াত শ্রী মিহির সেনগুপ্ত মশাইয়ের পরিবেশ কেন্দ্রিক কর্মভাবনার কল্যাণে। তিনি ছিলেন এই কর্মসূচির অন্যতম রূপকার।
     
    বাঘমুণ্ডি থেকে শুরু হবে নির্ধারিত পদযাত্রা। দুপুরের মধ্যেই বহু মানুষের ভিড়ে বাঘমুণ্ডির শিবির জমজমাট। সব নামীদামী কৃতী মানুষের আগমন। এঁদের মধ্যে বেঁটে খাটো বলিষ্ঠ চেহারার, মাথায় রঙিন স্কার্ফ বাঁধা এক আশ্চর্য প্রাণোচ্ছ্বল মানুষকে আলাদা করে চিনে নিতে কারোরই ঘাম ঝরাতে হয়নি। নিজের চেনা বৃত্তকে বারংবার ভেঙে চুরে পরিচিতির পরিধিকে বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন অনায়াসে। একসময় আমরাও সেই বৃত্তে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দলের ছাত্ররা তো এঘর ওঘর ঘুরঘুর করে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে শিবিরের সবার সঙ্গে। লম্বা দাড়ি, মাথায় রঙিন স্কার্ফ বাঁধা কাকুর কথায় তো উদ্বেলিত পঞ্চমুখ তারা সবাই। সন্ধের মুখে আলাপ হলো ছেলেদের কাকুর সঙ্গে। নিজেই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন মুখজোড়া সাদাকালো দাঁড়ির জঙ্গল ঠেলে একমুখ হাসি নিয়ে।

    – আমি অরুণ, আপনাদের ছাত্রদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এবার মাস্টারমশাইদের সঙ্গে পরিচয় করতে এলুম। ভারি ভালো আপনাদের ছেলেরা। আফটার অল মিহির দার ছাত্র তো ! খারাপ হবার সুযোগ‌ই নেই। ভালো থাকবেন। আবার কথা হবে। 

    আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চললেন আরও কিছু মানুষের খোঁজখবর নিতে। রাত খাবারের আগে পরিচিতির আসরে আরও একবার দেখা হলো অরুণ দার সঙ্গে। শিবিরে হাজির সকলেই নিজের নিজের ব্যক্তিগত পরিচয় দাখিল করছে। অরুণদার পালা আসতেই বিপ্লব দা উঠে এসে অরুণদাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে – ইনি লালপাহাড়ির কবি অরুণ চক্রবর্তী। তুমুল হাততালি দর্শকদের পক্ষ থেকে। 

    অরুণদা আত্মপক্ষ সমর্থনে বললেন , “বিপ্লব দা নিয়ম ভঙ্গ করেছেন আগ বাড়িয়ে আমার সম্পর্কে বদনাম রটিয়ে।” একথা শুনে আবারও হাততালির ঢল নামলো। বুঝলাম নিজের আলাদা খাতির তাঁর বিলকুল না পছন্দের। মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষেরা এমন ধারায় যে মোটেই অভ্যস্ত নন। ভারি পুরুষালি গলায় কথা ফুটিয়ে বললেন - “আমি অরুণ, অরুণ চক্রবর্তী। খাতা কলম নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই । মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে ভালোবাসি, আর তাই সময়ে অসময়ে এসে হাজির হ‌ই এই রাঙা মাটির দেশে।”
    রাঙামাটি কথাটা কানে যেতেই সমবেত সুধীজনদের তরফে দাবি উঠলো গান গাইবার জন্য। খানিকটা গলা খাকারি দিয়ে শুরু করলেন গান।
     
           তু হিথাক কেনে …….. ইক্কেবারে মানাইছেনা গো।
     
    গানের মাঝে মাঝেই চলে গান রচনার প্রেক্ষাপটের বর্ণনা যা আজ ইতিহাস হয়ে ফিরছে মানুষের মুখে মুখে। গান গাইতে গাইতেই পুরুলিয়ার প্রচল বাচনভঙ্গির কথকতায় আসরে রসের ধারা ব‌ইয়ে দিতে থাকেন অবিশ্রান্ত ধারায়। আবৃত্তি করেন আরও কিছু আশ্চর্য কবিতা। আমাদের ছেলেরা তো পারলে তাদের কাকুকে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করে আর কি! নিজের ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর মনখোলা মেজাজ নিয়ে আর কাউকে এভাবে মানুষের হৃদদুয়ারের সিঁধ কাটতে দেখিনি। ছেলেদের সেসব কাণ্ড দেখে মনে মনে একটু অভিমান জাগছিল বটে, কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম যে এমন ব্যক্তির নিবিড় সান্নিধ্য ওদের ভাবী জীবনের নির্মিতিতে বড়ো ভূমিকা নেবে, তখন সবকিছু ভুলে আমরাও ওদের মতো অরুণ দার চেলা বনে যাই। লাল পাহাড়ি গানের সুর আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে যে সুর আর কথার বুননে অরুণ দা সেদিন লাল পাহাড়ের গান শুনিয়েছিলেন সেই সুরের হয়তো অনেক অনেক পরিবর্তন পরিমার্জন ঘটেছে পরবর্তীতে। গায়ক বা গায়িকার বদল ঘটেছে বারংবার, তবে সেদিন বাঘমুণ্ডির পেট্রো ম্যাক্স জ্বালা রাত আসরে,রাত পিদিম জ্বেলে সামিয়ানা খাটানো রাত আকাশের নিচে যে গান সেদিন শুনেছিলাম অরুণ দার কন্ঠে, সেই গান এতো কাল কান আর মন জুড়ে ছিল, আছে, থাকবে আরো বহু দিন। খালি ওই ছোটখাটো রসিক মানুষটি সহসা স্টেজ থেকে একরকম চুপিসারে বিদায় নিলেন। আজ লাল পাহাড়ের দেশের মহুল,পলাশ, কুসুম, নিম, কেন্দ, শালেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হয়তো বলছে –

         হেই গো বাবু, তু কুথাকে লুকাইন গেলি বটে
          তুয়ার লাগি মুদের মনটো আনচান করে।
          কাছে আইসে মুদের দুখের কথা, সুখের কথা 
           ভালোবেইসে শুধাইবে কুন জনা ?
          তু কুথাকে লুকাইন গেলি বটে বাবুটো?
     
    কমল চক্রবর্তীর মৃত্যু নেই, অরুণ চক্রবর্তীর মৃত্যু নেই। এঁদের সান্নিধ্যের অমলিন স্মৃতিকে আগলে রাখতে হয় নিজের গভীর গোপন অনুভবে। তাই রাখছি অরুণ দা, ভালো থাকবেন।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২১:২০539620
  • আপ্লুত।
    যতদূর মনে পড়ছে ভারত প্রুডেনশিয়াল কাপ জেতার পর উন্মাদনার রেশ কাটার আগেই ছত্রিশগড়ে বসে দেশ পত্রিকায় একটা কবিতা পড়লাম জনৈক অরুণ চক্রবর্তীর লেখা। কবিতাটির নাম 'প্রুডেনশিয়াল কাপের গল্প'।
    পড়ে চমকে গেলাম, এ তো দেশ পত্রিকার গতানুগতিক কবিতা নয়।
    আমার যে ক'টা লাইন মনে আছে ঃ
    "বাজি ফুটল ইধার উধার মেঘে মেঘে বাইজলঅ কাঁড়া,
    রাত বারোটার কঠিন আধার চাঁদ কইরলেক ডিংলা ফাড়া।
    ই বলছে জিতে ইলাম, উ বলছে জিতে লিলাম,
    রাত বারোটার রাজা এখন দেশের বেবাক ছেইলাগুলান।
    --------
    -------
    তবে আমরা কেনে চোদুর পারা 
    গাল পাড়ছি খালভরা
    ই উয়াকে?
    রাত বারোটার বাজি ফুটা 
    লাগছে বলে দিনমানে সবই ঝুটা।।
     
    চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত, ভুল থাকতে পারে। কেউ যদি আপাতসরলা কাঠামোর এই অসাধারণ কবিতাটি তুলে দিতে পারেন তবে ভাল হয়। 
  • Somnath mukhopadhyay | ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:৪৭539623
  • রঞ্জনদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অরুণদাকে যে একবার দেখেছে তার পক্ষে মানুষটিকে ভুলে যাওয়া এককথায় অসম্ভব। একদম খোলা মনের মানুষ ছিলেন। ঐ একটি জনপ্রিয় গানের জন্য নয় একজন সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে তাঁকে মনে রাখবো।
    বাজি ফুটলো আমার পড়া নয়। কোনো গুরুভাই নিশ্চয়ই আপনার আবেদনে সাড়া দেবেন।
    ভালো থাকবেন।
  • সৌমেন রায় | 2409:40e1:10f5:c4fb:8000::***:*** | ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৩১539626
  • অসামান্য মানুষ! প্রণাম।
    হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন