এক বন্ধুর কথা শুনে বহু দিন পরে এখানে এলাম। শুনতে পেলাম, ইমন ভাষা আমার ফেবুতে শেয়ার্ড হওয়া দুটো পোস্ট (একটি কালকেই লেখা, অন্যটি সামান্য আগের) এখানে সাঁটানোর পর থেকে ক্লোসেট চাড্ডিটি তার চিরাচরিত অসভ্যতা শুরু করেছে পুরোদমে।
এখন আমার প্রোপাগান্ডাটা ঠিক কী, সেটা আমি নিজেই জানি না! আমি যা যা এই পোস্টদুটোতে লিখেছি তার একটাও আমার আপন মনের মাধুরী মিশায়ে লেখা হয়েছে, এমন অভিযোগ আমার ঘোর শত্রুও করতে পারবে বলে মনে হয় না।
প্রথম পোস্টে লেখকের নাম লেখাই আছে, মানে ডি এল রায়ের বাবা কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়। বইয়ের নাম, পৃষ্ঠাসংখ্যারও উল্লেখ আছে। দ্বিতীয় পোস্টের যাবতীয় তথ্যের সূত্র মূলত তিনজন ইতিহাসবিদের গ্রন্থ - সিরাজুল ইসলাম-এর বাংলার ইতিহাস : ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বাঙ্গলার ইতিহাস অষ্টাদশ শতাব্দী এবং রমেশচন্দ্র দত্ত-এর The Economic History of India under Early British Rule। তো এগুলো যদি প্রামাণ্য গবেষণা গ্রন্থ না হয়, তাহলে সেই একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থপ্রণেতার নাম কি রমেশচন্দ্র মজুমদার? মানে কাল থেকে চাড্ডিরা যাঁর বইয়ের একটি পাতার নির্দিষ্ট অংশ হাইলাইট করে লাগাতার প্রচার করে চলেছে?
আগে রমেশ মজুমদারের এই বিষয়ক আলোচনার দুটো পাতার ছবি দিই বরং।
পৃষ্ঠা ১৭৪, মানে যে পাতার ছবিটা চাড্ডিরা দিচ্ছে না
পৃষ্ঠা ১৭৫, মানে যে পাতার অংশবিশেষ চাড্ডিরা হুলিয়ে শেয়ার করছে
তা রমেশবাবুর এই বিষয়ে মোদ্দা বক্তব্য কী? আহা, বড় সরল, বড় গোলগাল! তিনি লিখেছেন--- "তবে ষড়যন্ত্রকারীদের অধিকাংশ প্রধানত ব্যক্তিগত কারণেই সিরাজকে সিংহাসনচ্যূত করিবার ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন।" তো ক্লাইভ আর তার চ্যালাচামুণ্ডাদের সিরাজের বিরোধিতার করার মূল কারণ কী ছিল? ব্যক্তিগত? উঁহু, হিন্দু মহাসভার সদস্য নমস্য ইতিহাসবিদ সে ব্যাপারে রা কাড়েননি। কিন্তু আমরা তো আর রমেশ মজুমদারে আটকে নেই! গবেষণা যে তার পরে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তাই আমরা সুশীল চৌধুরী, রজতকান্ত রায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখদের একটু-আধটু পড়ার চেষ্টা করি।
এবং ওই চেষ্টার দৌলতে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসে। সুশীল চৌধুরী অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে জানান, "সিরাজউদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্ত দেড় কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।" মনে রাখবেন এই দেড় কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে কেবল এশীয় বণিকদের থেকে, ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় বণিকদের থেকে নয়। তার মানে মুল কারণটা সিরাজের 'চরিত্র' নয়, কারণটা নিখাদ আর্থিক।
আবার ধরুন এই প্রসঙ্গে সিরাজুলবাবু জানাচ্ছেন, "ইংরেজ বণিকদের এ দেশ থেকে তাড়াবার প্রথম কারণ, এরা দেশের প্রচলিত আইনকানুন অমান্য করে কলকাতায় দুর্ভেদ্য দুর্গ ও পরিখা স্থাপন করেছে। দ্বিতীয়ত, এরা বিশ্বাস ভঙ্গ করে দস্তকের অপব্যবহার করছে: বেআইনিভাবে কোম্পানির নামে প্রাইভেট ব্যক্তিদের মধ্যে দস্তক বিতরণ করে সরকারকে এর বৈধ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে; তৃতীয়ত, জমিদারি ইজারার নিয়ম ভঙ্গ করে ইংরেজরা এদের কলকাতা জমিদারিকে নিজেদের সার্বভৌম এলাকা হিসেবে গণ্য করছে এবং নবাবি আইন-আদালত থেকে পালিয়ে এসে অনেক অপরাধী কলকাতায় এসে আশ্রয় নিচ্ছে এবং কোম্পানি এসব অপরাধীদের স্বাগত জানাচ্ছে।" মানে এখানেও প্রধান কারণ দস্তকের অপব্যবহার অর্থাৎ যে বিষয়ে রমেশ মজুমদার হিরণ্ময় নীরবতা পালন করতে ভালোবাসেন!
আর এই যে নবাবি আইন-আদালত থেকে পালিয়ে আসা অপরাধীরা কলকাতায় কোম্পানির পদতলে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের অন্যতম হচ্ছেন রাজা রাজবল্লভের 'সুসন্তান' কৃষ্ণদাস যিনি কি না সেই আমলে নবাবের প্রাপ্য ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। মানে এ ব্যাপারে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও রাজা রাজবল্লভ গলায় গলায় বন্ধু। তারপর রাজবল্লভের বিধবা মেয়ের পুনর্বিবাহ দিতে গিয়ে কী হইল জানে শ্যামলাল!
ও, আরেকটা কথা। চাড্ডিরা বিদ্যাসাগরকেও ব্যবহার করছে দেদার। তাতে বাঙ্গালার ইতিহাস গ্রন্থ না হয়ে প্রবন্ধ হলেও আপত্তি নেই! এবং 'সম্মান' বানানটা চাড্ডিদের হাতে কেমন বিকৃত হয়েছে, সেটা দেখে নেবেন। কে না জানে, চাড্ডিদের বিদ্যাসাগর প্রেমও মারাত্মক! এই রইল সেই বহুব্যবহৃত ছবিটি। এবং কী আশ্চর্য, দুনিয়ার সমস্ত চাড্ডি এই ছবিটাই চিপকে চলেছে।
পরিশেষে একটা কথা। আমি এমনিতে কাউকে আগ বাড়িয়ে গালমন্দ করি না। তার মানে এই নয় যে আমি গালাগালি করতে পারি না। ধন্যবাদ