এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমাদের উত্তর ভারত দর্শন ২০২৪ - সন্তোষ কুমার পাল ২৭/০২/২৪

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৭২২ বার পঠিত
  • | |
    দ্বিতীয় পর্ব

    মোহালি থেকে অমৃতসর

    পরের দিন ১৪ই ফেব্রুয়ারি সকালে হোটেল থেকে অটোতে ক‍্যান্টনমেন্ট স্টেশনে। সাতটায় ট্রেন। ছেলের বর্তমান ঠিকানা মোহালির  IISER-এ আমাদের অন্তবর্তীকালীন বিশ্রামস্থল। সরস্বতী পূজার দিন সন্ধ্যায় ঢুকে পরের দিন শক্তি সঞ্চয় করে ১৬ তারিখে বেরিয়ে পড়লাম অমৃতসরের উদ্দেশে, চণ্ডিগড়-অমৃতসর ইন্টারসিটি ধরে। সাড়ে এগারোটায় অমৃতসরের গোল্ডেন অ্যাভিনিউ-এর একটি হোটেলে উঠি। বেশ ঠাণ্ডা, তাই ওখানে কাক-চান সেরেই বেড়িয়ে পড়লাম।

    জালিয়ানওয়ালাবাগের ক্ষত

    জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই দানবিক ইতিহাসকে রি-এক্সপ্রিয়েন্স করতে আমার এখানে আসা। আমরা রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড ত‍্যাগ করার কথা পড়েছি, পড়েছি কুখ্যাত জেনারেল ডায়ায়ের সেই গুলি চালানোর নির্মম নির্দেশের কথা। কিন্তু জানতাম না ব্রিটিশ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং, যিনি আবার সেই বিখ্যাত "হোয়াইট ম‍্যানস বার্ডেন"-এর তত্ত্বের প্রবক্তা, এই জঘন্য কাজকে সমর্থন করেছিলেন। তৎকালীন আরো কিছু বুদ্ধিজীবীও এর সমর্থনে ছিলেন, ঠিক যেমন আজকের দিনে নারীর সভ্রম নিয়ে টানাটানির সময়  তার বিরোধিতা না করে অতীতচারিতার ভিডিও আপলোড করে চলেছেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর কেউ কেউ। এই স্মারক-স্থলের দেওয়ালগুলির দগদগে ক্ষত এখনো সংরক্ষিত আছে। একটি প্রবেশ-মুখ ছাড়া চারদিকে ঘেরা মাঠে বিক্ষোভ দেখানো জনতার উপর নির্মম গুলি চালোনো হয়েছিল সেদিন! এখনো দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা গুলির ক্ষত চিহ্নের কাছে দাঁড়িয়ে কেমন এক বিপন্ন মানবতার অনুভূতি হয়! ভাষায় তা বোঝাতে পারবো না। পাশেই সেই কূপটি সংরক্ষণ করা হয়েছে, যে গভীর গর্তে গুলির হাত থেকে বাঁচতে জনতার অনেকেই ঝাঁপ দিয়েছিল। পরে ওই কূপ থেকে শতশত মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। বিচারালয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে ডায়ারের সেই চূড়ান্ত অসংবেদনশীল বক্তব্যকে কৃত্রিমভাবে ফুটিয়ে তুলে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে, যা শুনলে আপনার রক্ত মাথায় উঠবে।  অনেক ধরনের স্মারক রয়েছে, শ্বেত পাথরের একটি বিরাট স্মারকে শতাধিক শহীদের মুখমণ্ডল ও নাম অতি যত্নে খোদিত রয়েছে। এভাবে সেকালের ইতিহাসকে প্রাণবন্ত করে রাখার চেষ্টা হয়েছে আমাদের মতো দুর্বল স্মৃতির মানুষজনের জন্য। তবে (জেনারেল ডায়ায়ের মতো না হলেও) অসংবেদনশীল বেশ কিছু পর্যটককে দেখলাম ঐসব স্থানে এমন সব পোজে ছবি তুলতে, যা তাজ-চত্বরে মানালেও এখানে মানায় না!চারদিকে এতো জাতীয়তাবাদী ভক্তিরসও তাদের চেতনাকে এতটুকু শ্রদ্ধালু করে তুলতে পারে নি। 

    দেশভাগের সংগ্রহশালা

    একটু দূরেই একেবারে অনন্য একটি স্মারক- কক্ষ:  'পার্টিশন মিউজিয়াম' (নামান্তরে 'পিপলস মিউজিয়াম')। সময়ের হিসেবে দেরি হয়ে যাওয়ায় ভিতরে বেশি ক্ষণ থাকা হয়ে ওঠে নি আমাদের, তথাপি যেটুকু দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা দেশভাগের  ট্রাজেডিকে আমাদের চেতনায় জাগরূক করে তুলতে যথেষ্ট। আমাদের এদিকে বাংলাভাগের তেমন কোন সংগ্রহশালা দেখিনি। এখানকার একটি বিষয় আমার বাঙালি-সত্তাকে আবেগ-তাড়িত করে: ঐ মিউজিয়ামের সূচনা-পোস্টে অন‍্যান‍্য তিন/চারটি ভাষার মধ্যে আমার মাতৃভাষা স্থান করে নিয়েছে।  এ কি "What Bengal thinks today..."-এর স্বীকৃতি!

    সাদাত হাসান মান্টোদের জীবন-কাহিনি সিনেমায় দেখেছি। আর এই মিউজিয়ামে ফেলে-যাওয়া স্মৃতি-ভারাক্রান্ত চিহ্নগুলিকে দিয়ে সেসবকিছুকে মূর্ততা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। হঠাৎ-করে-লাগা দাঙ্গায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জিনিসপত্র ফেলে প্রাণ বাঁচাতে পালাতে হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। পিতলের বাসনপত্র, ট্রাঙ্ক, কৃষি-উপকরণ, এমনকি সোনার জুয়েলরি--আরো কত কি যে ফেলে ছুটতে হয়েছে প্রাণটুকু শুধু বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে তার হিসাব নেই। পরবর্তী কালে এসবের কিছু কিছু সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে এটা মনে করিয়ে দিতে যে এরকম ঘটনা ঘটানোর আগে আমরা যেন দ্বিতীয়বার ভাবি! হঠাৎ করে দেশভাগে এ দিকে কমবেশি ২ কোটি মানুষকে ছিন্নমূল করেছে, অথবা অন্য কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এত বড় মাইগ্রেশনের কোনো তুলনা নেই। এখানে কয়েকজন বেঁচে-ফেরা মানুষজনের অভিজ্ঞতাও অডিওতে ধরে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন রকমের তথ্য, স্মৃতিকথা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ এখনও চলছে এই মিউজিয়ামে। গবেষকদের সাহায্য  করার জন্যও এই মিউজিয়াম আরো তথ্যবহুল ও কার্যক‍রী হয়ে উঠতে চায়।

    ভারত-পাক সীমান্তে

    এবার আসি আমাদের পাকিস্তান-সীমান্ত দর্শনের কথায়। বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত আমি দু'তিন জায়গায় প্রত‍্যক্ষ করেছি। এই কিছুদিন আগেই গৌড়ের বর্তমান শেষ সীমার অপরপ্রান্তে সোনা মসজিদ হয়ে রাজশাহী গেলাম, এলাম। ২০১৮-য় গেছি গেদে-দর্শনা সীমান্ত দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত এই প্রথম দেখলাম ওয়াঘায়। এও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রথমেইপ্রথমেই বলে রাখা ভালো, ভারতের দিকের সীমান্ত পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার আত্তারি গ্রাম-মৌজার শেষ বিন্দু, আর পাকিস্তানের দিকে সীমান্ত হল ওয়াঘা। এটি পাকিস্তানের লাহোর সিটি জেলার ওয়াঘা জোন তথা ইউনিয়ন কাউন্সিলের শেষ গ্রাম।

    শের শাহের জি টি রোড 

    আর একটি বিষয়, আমরা জানি শের শাহের গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড (সংক্ষেপে, জি টি রোড) এখানেই পাকিস্তানের ঢুকছে, গেছে রাওয়ালপিণ্ডি পর্যন্ত। এই জি টি রোড কোথায় শেষ হয়েছে জানেন? বাংলাদেশ-মায়ানমার বর্ডার টেকনাফ-এ। আর জানেন নিশ্চয়, আফগানিস্তানও বহু দিন ভারতের অংশ ছিল। বোঝা যাচ্ছে তাহলে, ভারতীয় উপমহাদেশ কারে কয়?

    র‍্যাডক্লিফ লাইন ও পাঞ্জাবের বিপন্নতা

    ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসি- ডেন্সিকে ভাগ করে ভারত-পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের মূল প্রস্তাবটি করেন স‍্যার শেরিল র‍্যাডক্লিফ। তাই এই ভেদরেখার এরকম নাম। এই দুই প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত করতে গিয়েই যত বিপত্তি। দেশত্যাগ, ডাইরেক্ট অ্যাকশনের জোর জুলুম, গণহত্যা, আরো কত কী! পাঞ্জাবের এদিকে কত প্রাণহানি ঘটেছে, কতজন কতরকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সঠিক তথ‍্য পাওয়া সম্ভব নয়। তবুও শুধু প্রাণহানির সংখ্যাটাই এদিকে দুই থেকে আড়াই লক্ষ (হিন্দু, শিখ ও মুসলিম সব সম্পদায়ের মানুষজনকে ধরে)! পার্টিশন প্রদর্শন-শালার মতো আরো  অনেক স্মারকে এই ট্রাজেডির মর্মবেদনা ধরে রাখা হয়েছে। অমৃতসর-ওয়াঘা সীমান্তে না এলে তা অনুভব করতে পারতাম না। 

    সীমান্তের জাতীয়তাবাদ

    তবে অন্য যে কারণে পর্যটকরা এখানে আসে তা'হল দুই দেশের সিকিউরিটি ফোর্সের দৈনিক রিট্রিট অনুষ্ঠান প্রত‍্যক্ষ করা। স্বর্ণমন্দির তল্লাট থেকেই অটো, ক‍্যাব আমাদের পিছনে লেগেছে। কতক্ষণ আর অ-মাতৃভাষায় বার্গেনিং করা যায়! তিনজনের ছয়শো টাকা, আনা-যানা। অটো ভর্তি হতে আধ ঘণ্টা সময় নিল। তার পর তিনটে পনের নাগাদ চলতে শুরু করল। রাস্তা বেশ ভালো, জি টি রোড। এদিকটায় অনেকখানি এক্সপ্রেসওয়ের মতো। একবারে ৩৬ মিনিটে ছত্রিশ কিলোমিটার পৌঁছে দিল। রাস্তার দুপাশে বিস্তৃত ক্ষেত, বাগিচা, গম-ভুট্টার সবুজের চাদর। ওয়েদার মনোরমই ছিল বলা যায়। রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ল সেই বিখ্যাত খালসা কলেজ, অমৃতসরের একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত, বিস্তৃত ৩০০ একরের এই ক্যাম্পাসটি এই অমৃতসর-লাহোর জিটি রোডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

    আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত এলাকার এক কিলোমিটার আগেই আমাদের নামিয়ে দিল অটোর ড্রাইভার। এবার হাঁটা। সিকিউরিটি চেকিং শেষ করে যখন মূল স্টডিয়ামে পৌঁছলাম তখন সোয়া চারটে। আপনারা জানেন, সামরিক রীতি অনুসারে প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুই দেশের পতাকা নামিয়ে নেওয়া হয়। আর এর সূত্র ধরেই সিকিউরিটি ফোর্সের পারস্পরিক শক্তি প্রদর্শন ও জাতীয়তাবোধাত্মক সংগীত পরিবেশন, যা কালক্রমে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। দুই দেশের কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। ব‍্যথা-বেদনা-ক্ষমতাপ্রদর্শন-কূটনীতি-- সবকিছু মিলে মিশে একাকার এই সান্ধ্য অনুষ্ঠানে। তবে এখনকার প্রদর্শন আমার কিছুটা বিসদৃশ ঠেকেছে। যে অঙ্গভঙ্গি ও অস্বাভাবিক ভ‍্যলুমে ডিজে বাজিয়ে দেশাত্মবোধক সংগীতের তালে তালে যে উদ্দাম নৃত্য দেখলাম তা কূটনীতিক শালীনতার মাত্রাকে কোথাও যেন অতিক্রম করে যায় বলে আমার মনে হয়েছে। পাকিস্তানের দিকের সেদিনের প্রদর্শন আমাদের এ দিককার তুলনায় আমার কাছে ম্রিয়মাণ মনে হয়েছে।

     যাই হোক, একটি বিষয় আমাকে খুবই ভাবায়: এই দেশ-ভাগের জন্যে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষী স‍্যাবস্ত করে, এর 'প্রতিশোধ' নিতে চায়। এখনকার মুসলমানদের সবক শেখাতে চায়। কিন্তু এর জন্য বর্তমানের মানুষ কী করতে পারে? আসলে ভুলটা হয়েছে দ্বি-জাতি তত্ত্বে, রাজনৈতিক মতাদর্শে। জিন্নাহ ও তার দলবল‍ এবং অন‍্যান‍্য কিছু রাজনৈতিক নেতা এটাকে কাযর্করী করতে গিয়ে অন‍্যায় অবিচার ভয়-সন্ত্রাস হত্যার সাহায্য নিয়েছে। এতদিন পরে কীভাবে তার শোধবোধ সম্ভব? মূল কথা এটাই যে ধর্মের ভিত্তিতে দেশের ভাগ-বাঁটোয়ারা কখনও সুস্থিতি এনে দিতে পারে না! জমানো ক্ষোভ থেকে ওদের "মাথা চাই" বলা বা একটি নির্দিষ্ট ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ চরিত্র পাল্টানোর পক্ষে গলা ফাটানো সামনের দিকে যাওয়ার কোনো সিঁড়ি নয়! পশ্চাপসারণের এই যাত্রায় কয়েকজন ধান্ধাবাজ শিল্পপতি দেশের তথা জনগণের  যাবতীয় সম্পদ নিজেদের অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে নেয় ছলে-বলে-কৌশলে, যা আজ জলের মতো পরিষ্কার।

    সর্বধর্মসমন্বয়ের স্বর্ণমন্দির

    স্বর্ণমন্দির ছিল অমৃতসর দর্শনের আর এক গন্তব্য। এদিকে এসে এই মহান শিল্প-কাঠামো তথা শিখসম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থক্ষেত্র না দেখে ফেরার কথা ভাবাই যায়না। আমরা সকাল পৌনে এগারোটা থেকে বিকেল তিনটে পর্যন্ত, এবং সন্ধ্যায় সাড়ে ছয়টা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত--এই দুই পর্যায়ে মন্দির দর্শন করেছি। দিনের বেলায় এই সৌধের এক রূপ, রাতের বেলায় আর এক।  মন্দির ক্ষেত্রের খোলামেলা পরিবেশ, সকলেকেই স্বাগত জানাতে দিবারাত্র প্রস্তুত। আর এর লঙ্গরখানার ধর্ম-দর্শন আমাকে মুগ্ধ করেছে। মানবসেবাই যে ঈশ্বরসেবা তা এখানকার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতিফলিত। সরকারী বা ক‍র্পোরেটের সাহায্য ছাড়াই সাধারণ শিখ জনসাধারণ কী ভক্তিভরে কাজ করে চলেছেন শুধু পর্যটক ও তীর্থযাত্রীদের সেবা করার জন্য! মূল মন্দিরে ঢোকার আগে পাদুকাজোড়া সুশৃঙ্খলভাবে গুছিয়ে রাখা, যে আগ্রহভরে আমাদের তিন জোড়া জুতা হাতে ধরলেন এক মধ্য বয়স্ক মহিলা, যেন মনে হল তিনি যেন ঈশ্বরের পদযুগল হস্তে ধারণ করছেন! আমার অন্তর সত্তা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়েছিল ঐ মহিলার আচরণে। একেই বলে যথার্থ করসেবা। (আমরা অবশ্য কয়েক দশক আগে উত্তর প্রদেশে সম্পূর্ণ বিপরীত আর এক ধরনের 'করসেবা'-র নমুনা দেখেছি!) তবে কোন কিছুর প্রত‍্যাশা না করে স্বেচ্ছায়  মানবসেবার পরাকাষ্ঠা ও পবিত্রতার পরিবেশ আমি খুব কম মন্দিরে পেয়েছি।  তবে শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় খালিপায়ে মার্বেল-মণ্ডিত মন্দির-প্রাঙ্গণ প্রদক্ষিণ করা বেশ কষ্টকর, যদিও অনেক স্থানে হালকা কার্পেট পাতা রয়েছে। আসলে আবশ‍্যিকভাবে পদযুগল ধৌত করেই তো মন্দির-প্রাঙ্গণে ঢুকতে হয়। সকলেরই পা ভিজে থাকে, যা ঐ কার্পেটকেও ভিজিয়ে দেয়! 

    চব্বিশ ঘন্টা চালু এই লঙ্গরখানায় আপনি বসলেই প্রসাদরূপী আহার্য পাবেন। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ- খৃস্টান নেই, ছোট-বড় নেই, নারী-পুরুষ নেই, আম আদমি-খাস আদমি নেই-- সবাই আগে থেকে পেতে-রাখা চটে এক পংক্তিতে বসে পেটপুরে খেতে পারেন। কেউ জিজ্ঞেসও করবে না আপনি ব্রাহ্মণ, না শূদ্র? মাংস-বিক্রেতা, না জে এন ইউ-র অধ্যাপক? সব মানুষের প্রতি, সব ধর্মের প্রতি সদয় মনোযোগ শিখ ধর্মকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।  

    বিশ্বভারতীতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের কিছু কনফিডেন্সিয়াল কাজ করতে গিয়ে সহকর্মী অধ্যাপকদের কাছে জানতে পারি, শিখ ধর্মগ্রন্থ 'গ্রন্থসাহিব'-এর মূলমন্ত্রের অনেক কিছু হিন্দু, ইসলাম ও ভক্তিবাদের কথা আছে নাম-গানে ব‍্যবহার করে। শিখরা অন‍্যান‍্য বিভিন্ন ধর্ম, ধর্মগুরু, সুফি-সন্তদের  ভাবনা ও বাণী তাদের ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছে, অবশ‍্য তাদের পৃথক পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখেই। অখণ্ড নাম-গান মন্দির-চত্বরকে এক স্বর্গীয় আবহ দান করেছে। এখানে একটা কথা বলে রাখতে ইচ্ছে করছে, আমরা যারা ধর্মান্ধতা ও অমানবিক রীতি-নীতি তথা জাতপাতের সমালোচনা করি তাদেরও ধর্মের এই সদর্থক দিকটির কথা মনে রাখা বাঞ্ছনীয়।

    (চলবে...)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Arindam Basu | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৫৮528907
  • এই লেখাটায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এসেছে, লেখাটিকে সমৃদ্ধ করেছে, যেমন এইটা,
     
    "তবে (জেনারেল ডায়ায়ের মতো না হলেও) অসংবেদনশীল বেশ কিছু পর্যটককে দেখলাম ঐসব স্থানে এমন সব পোজে ছবি তুলতে, যা তাজ-চত্বরে মানালেও এখানে মানায় না!"
     
    জালিয়ান ওয়ালা বাগে মনে হয় সেল ফোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে, সবাইকে নীরব থাকার নিয়ম করে দিলে এই ধরণের যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। কুশিক্ষার বহিপ্রকাশ!
     
    "তবে এখনকার প্রদর্শন আমার কিছুটা বিসদৃশ ঠেকেছে। যে অঙ্গভঙ্গি ও অস্বাভাবিক ভ‍্যলুমে ডিজে বাজিয়ে দেশাত্মবোধক সংগীতের তালে তালে যে উদ্দাম নৃত্য দেখলাম তা কূটনীতিক শালীনতার মাত্রাকে কোথাও যেন অতিক্রম করে যায় বলে আমার মনে হয়েছে"
     
    এও আরেকরকম বিচিত্র অভব্যতার বহিঃপ্রকাশ। এই ধরণের শো এর সত্যি কি প্রয়োজন? কিন্তু যত মানুষ, যত সংবেদনশীলই হোন না কেন, যাবেন, নেহাৎ দেখতেও, ততই এদের রমরমা। এরা একরকম অসুস্থ exhibitionism, এই জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করাই শ্রেয় মনে হয়। 
     
  • Santosh Kumar Pal | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:২৮528911
  • আপনার সঙ্গে একমত!!
  • r2h | 165.***.*** | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৬:১৬528922
  • সত্যি, কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এই লেখায়, যেগুলি নিয়ে ভাবা উচিত।

    "এর সূত্র ধরেই সিকিউরিটি ফোর্সের পারস্পরিক শক্তি প্রদর্শন ও জাতীয়তাবোধাত্মক সংগীত পরিবেশন, যা কালক্রমে একটি বিশেষ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। দুই দেশের কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। ব‍্যথা-বেদনা-ক্ষমতাপ্রদর্শন-কূটনীতি-- সবকিছু মিলে মিশে একাকার এই সান্ধ্য অনুষ্ঠানে। তবে এখনকার প্রদর্শন আমার কিছুটা বিসদৃশ ঠেকেছে। যে অঙ্গভঙ্গি ও অস্বাভাবিক ভ‍্যলুমে ডিজে বাজিয়ে দেশাত্মবোধক সংগীতের তালে তালে যে উদ্দাম নৃত্য দেখলাম তা কূটনীতিক শালীনতার মাত্রাকে কোথাও যেন অতিক্রম করে যায় বলে আমার মনে হয়েছে। "

    ওয়াঘা সীমান্তের ভিডিও ইত্যাদি দেখেছি - সীমা সুরক্ষা দলের হাত পা ছুঁড়ে অঙ্গভঙ্গি একাধারে একটি নৃশংস ও করুণ ভাঁড়ামি বলে মনে হয়েছে - দেশভাগের মত এমন একটি ভয়ানক রক্তক্ষয়ী ঘটনার এমন উদযাপনের যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা সভ্যতা বা মানবিকতার পরিসরে বের করা কঠিন মনে হয়।
  • Santosh Kumar Pal | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:১৫528927
  • এক দম ঠিক বলেছেন!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন