গোল্ডিজির গল্প আপাতত স্থগিত রেখে আমার সঙ্গে গোল্ডিজির কীভাবে কখন আলাপ এবং বন্ধুত্ব হয়েছিল সেইটে বলে নেওয়া দরকার।এ জিনিস বলতে হলে আমার সুইটজারল্যান্ড যাত্রা কেমন করে হয়েছিল সেটা বলা জরুরি। সেই কাহিনি হয় একটু দীর্ঘ হতে পারে, তবে পটভূমিকাটা জানালে বুঝতে সুবিধে হবে।
সেল্ফ রেফারেন্সিং কে দেবার মত অবস্থানে থাকে, বা দেওয়া উচিত না অনুচিত, এসব ব্যাপারে আমার ফান্ডা কম। অতদূর লেখাপড়া আমি করি নি।
যাইহোক, ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত দেশ থেকে প্রথাগত শিক্ষার ইতি করে কোলকাতায় ফিরে বেশ কয়েকটা চাকরি করবার পরে আইটি নামক ইন্ডাস্ট্রিতে একটা নামকরা কোম্পানীতে ঢুকবার পরে ভেবেছিলাম পায়ের নীচে জমি পেয়েছি। বিদেশ ব্যাপারটা কেমন হয়, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব সম্পর্কে অল্প বিস্তর ধারণা ছাত্রাবস্থাতেই হয়ে গেছল। তাই বিদেশে গিয়ে সেটল করবার কোনও উচ্চাকাঙ্খা বা লোভ আমার ছিল না।
কিন্তু বিবিধ পরিস্থিতির প্রকোপে কোলকাতায় বাস করা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেছল। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে খুঁজতে দেখলাম চোখের সামনেই আইটির কর্মীরা হুটহাট বিদেশে যাচ্ছে প্রজেক্টের কাজ নিয়ে। নিশ্চয় এতে পয়সা বেশি পায়, কেউ ফিরে আসে, কেউ ফেরে না।
সদ্য অনেক ঝড় ঝাপটা কাটিয়ে মোটামুটি স্থিতিশীল যে জমিটাকে মনে করেছিলাম পায়ের নীচে রয়েছে, সেটাতেও মৃদু কম্পন কখনও কখনও অনুভব করেছি। টাকার লেভে নয়, জাস্ট প্রাণে বেঁচে থাকার ইচ্ছেয় চেষ্টা করছিলাম দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার, আর লড়াই করে করে প্রত্যেকটা দিন সারভাইভ করা যাচ্ছে না। মৃত্যুভয় জিনিসটা হয়ত একটা সময়ের পরে তেমন বেশি অ্যাড্রিনালিনের ক্ষরণ ঘটায় না, কিন্তু তিলে তিলে প্রতিক্ষণে অসম্মাণ এবং বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আদতে পাচ্ছি টা কী? ঐ পরিমানে শক্তিক্ষয় এবং মনের ওপরে যে চাপ পড়ছে, আমি কি সত্যিই তা ডিজার্ভ করি? খামোখা কোলকাতায় জীবনটা নষ্ট না করে একটা এমন পরিবেশে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতেই পারি যেখানে শান্তিতে শ্বাস নিতে পারব। মৃত্যুভয় তাড়া করবে না, বিদেশ তো অচেনা নয়, মোটামুটি চেনা, বাকি জীবনটুকু যদি অতি সাধারণ ভাবে শান্তিতে কাটানোর উপায় থাকে সেসবখানে, তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি কোথায়?
উঁহু, সুইটজারল্যাণ্ডের কথা আমি কস্মিনকালেও ভাবি নি।
তখন তো আইটিতে বিশাল ক্রেজ চলছে আমেরিকা যাবার। দলে দলে শত সেনা চলেছে আমেরিকা পানে।
আমেরিকার প্রজেক্টে কে কেমন করে ঢুকবে সেই নিয়ে বিশাল লবিবাজি চলছে কোম্পানীতে। তার একটু পরের ধাপে ইংলন্ড বা আয়ারল্যান্ড। কখনও সখনও জার্মানি। একেবারে কাছেপিঠের জন্য সিঙ্গাপুর সান্ত্বনা পুরস্কারের সামিল।
কোম্পানীতে আমার ব্যক্তিগত অতীত অচিরেই কেমন করে যেন শব্দের গতিবেগে প্রচারিত হয়ে গেল।
মেয়েটার একটা পাস্ট আছে। মেয়েটা অ্যাভেইলেবল। নানান জনে ইশারা ইঙ্গিত শুরু করেছিল। কেউ কেউ আমার বাড়িতেও আসতে চাইত। মনে করত, একবার বাড়ি আসতে পারলেই শুয়ে পড়তে আর কতক্ষণ। হ্যাঁ। ভারতবর্ষে কর্মক্ষেত্রে, কর্পোরেট অফিসে বাঙালি পুরুষ কোলিগরা, সিনিয়ররা এরকমই হয়।
আমাকে এরা বিদেশের প্রজেক্টে পাঠাবে না, চাপে রাখবে, দুর্ব্যবহার করবে, কতক্ষণে ভেঙে পড়ে আত্মসমর্পন করি সেই চেষ্টা চালাবে। মানুষ কেমন হতে পারে, তা জানার জন্য একেবারে ক্ষমতাহীন হওয়াটা বড্ড জরুরি।
আমি নিজে নিজেই ইন্টানেট ঘেঁটে আমেরিকার কোম্পানীগুলোতে জব অ্যাপ্লিকেশন করছিলাম। কিছু আবার এজেন্সীও ছিল।
হঠাৎ হঠাৎ ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ত। টেলিফোনে ইন্টারভিউ। গভীর রাতে সেসব কল আসত।
ইংরিজি সে সময়ে আমি খুবই কম জানতাম, উচ্চ মাধ্যমিকের সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজের পরে আর ইংরিজিতে কিছুই পড়ি নি। দীর্ঘকাল ইংরিজি শুনিও নি। অনেক শব্দ জানি না। আমেরিকান উচ্চারণ বুঝতেও সমস্যা হতো।
গোটা দুই তিন ইন্টারভিউ এর পরে পাসপোর্ট নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল, রিনিউ করা এবং আরও কিছু জটিলতা ছিল। সেই সময়ে পাসপোর্ট অফিসের অভিজ্ঞতা আমাকে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে বলল — ওরে, তুই পালা। এখানে জাস্ট মরে যাবি। শিগ্গিরি পালা।