২৬, ২৭, ২৮, ৩১, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ বাদে ১ থেকে ৪০ এর বাকি সব কিস্তি রইল। না পাওয়া ৯টি কিস্তি পাওয়া গেলে, বন্ধুরা, পোস্টিয়ে দেবেন এখানেই। তালিকা ১, ২১ (May 18 2005)
বিনসর বিনসর
তিন বন্ধু- রঙ্গন, রঙ্গনা ও রঙ্গাই। তিনজনেই হোস্টেলবাসী। ফেব্রুয়ারির দিল্লি শহরে হালকা ঠান্ডা হাওয়া, ঝক্ঝকে নীল আকাশ আর রাস্তাঘাটে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে লাল গোলাপি ফুলের ঝাঁক। এই মরশুমে পায়ের তলায় প্রবল সর্ষে- হোস্টেলের পাতি বাওয়ালে সহে না, সহে না। স্যান্ডির নেতৃত্বে একদল ছেলে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য বিনসর। সেই সময় বিনসর অখ্যাত জায়গা, ক্লাব মাহিন্দ্রার বিলাসী রিসর্টের দৌলতে বা ভ্রমণ আর আউটলুক ট্র্যাভেলারের দাক্ষিণ্যে চেনাজানা ছুটি কাটানোর জায়গা হয়ে ওঠেনি। স্যান্ডি কোনোসূত্রে খোঁজখবর করে জেনেছে আলমোড়া থেকে কয়েক পা এগোলেই বিনসর- বাঁদুরেটুপিপরিহিত বাঙালী মেসো-মাসিদের ভিড়ভাট্টারহিত অতি মনোরম ভ্রমণস্থল। রঙ্গন "চলি গো চলি গো" করেও পা আর উঠাতে পারছে না। স্যান্ডিকে জিজ্ঞেস করায় জানা গেল বিনসরে নাকি মোটামুটি হোটেলটোটেল দোকানটোকান লোকটোক আছে। অভিজ্ঞ পাঠকপাঠিকামাত্রেই জানিবেন- "ট"কারান্ত শব্দপ্রয়োগের অর্থ বিষমমাত্রার কোনো ঘোর অনিশ্চিতি আপনার জন্য অপেক্ষমান। এই ঘটনার পাত্রপাত্রীগণ তখনও তদনুরূপ অভিজ্ঞতালাভ করেন নাই- অতএব। পরের দিন, বিভিন্ন দোটানা, টানাটানি এবং মাথাচালাচালির পর ঠিক করা গেল কুমায়ুনের দিকে বেরিয়ে পড়া যাক। হয় তো বিনসর, হয় তো বিনসর নয়। যার ট্যাঁকে যা ছিল তা নিয়ে এবং যার আলমারিতে যা ছিল তা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। কিন্তু বহুবিধ দোলাচলের পর বেরিয়ে পড়তে পড়তে প্রায় রাত নটা। দক্ষিণ দিল্লির থেকে উত্তর দিল্লির আন্ত:রাজ্য বাস টার্মিনাল ওরফে আই এস বি টি- অনেকটা পথ। মহানুভব অটোয়ালা এবং আই টি ও আর দরিয়াগঞ্জের জ্যামের জন্য সেই দূরত্বও দুর্বিষহ ঠেকে। কিন্তু তিন স্যাঙাৎ তখন বাহাদুর শাহ জাফর মার্গেও পাহাড় জঙ্গল দেখে ফেলছে। দিল্লির তোয়াক্কা কে করে? চলো আই এস বি টি।
উত্তর ভারতের ছোটোখাটো শহরের ধুলোমাখা, গ্যাঞ্জামে ঠাসা বাস ডিপোগুলোর এক বিশালবপু সংস্করণ হল এই আই এস বি টি। সরকার হল বাঙালির মাই বাপ। কিন্তু দিল্লি ও উত্তরপ্রদেশ- দুই সরকারি পরিবহণ সংস্থাই হতাশ করলেন। আলমোড়া এবং হলদোয়ানির বাস ছেড়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এক প্রায়ান্ধকার সিঁড়ির তলায় এক ক্ষুদ্রকায় মূর্তি "আলমোড়া হলদোয়ানি রুদ্দরপুর" বলে চিলচীৎকার করছিল। তিনমূর্তি তার থেকেই টিকিট কাটল। কিন্তু বাস কই? কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে পদব্রজে যাত্রা শুরু। এ গলি সে গলি ঘুরে গোটা চারেক তিনমাথা চৌমাথা টপকে যেখানে পৌঁছনো গেলো, সেখানে অন্ধকার গলিতে সারে সারে বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন ঝির্ঝিরে বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। বাসে উঠে দেখা গেল বাস বেশ ভরপুর। আস্তে আস্তে পুরো গপ্পো খোলসা হল। এই বাস হলদোয়ানি যাবে না রুদ্রপুর যাবে তা নির্ভর করছে কোথাকার কতজন যাত্রী টিকিট কেটেছে তার উপর। এবং যথারীতি আমাদের তিনমূর্তি
হলদোয়ানির একমাত্র যাত্রীদল। আরও সরেস ব্যাপার হল, প্রতি সিট ভর্তি না হলে বাস ছাড়বেও না। এক মুরুব্বির দেখা পাওয়া গেল যিনি সকাল দশটায় টিকিট কেটেছিলেন বেলা এগারোটায় বাস ছাড়বে বলে। তিনি এখনও কাশ্মীরি গেটের বাতাস খাচ্ছেন, মুখে চরম নির্বেদের হাসি।
এমন সময় ডেরাইভার এলেন- রাজকাহিনী থেকে জেরক্স জিনিস, টক্টকে রং, গালে ইয়াব্বড়ো গালপাট্টা, সাড়ে ছ ফুটিয়া বডি। রঙ্গাই তার ঠেঁট বিহারি হিন্দিতে পুছল বাস ঠিকঠাক চললে হলদোয়ানি পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে। গোঁফ চুমড়িয়ে উত্তর এল মেরেকেটে চার ঘন্টা। এতক্ষণে তিনমূর্তির ঘেঁটে যাওয়া সম্পূর্ণ। এর পর বাস এগারোটা নাগাদ যখন চলতে শুরু করল, ঘাঁটা পাবলিকের ফুত্তি দেখে কে! এপাশ ওপাশ ঘুরে দশ মিনিট বাদে বাস এসে দাঁড়াল বিরাট এক বিল্ডিং কম্পাউন্ডের সামনে- প্রচুর আলো, অনেক লোক, ব্যস্ত চলাচল। দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। অহো:! এ তো আই এস বি টি- চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবারে প্রশ্ন আরও মৌলিক স্তরে- বাস যাবে কি? একবার তিনজনের মনে হইল- আর গিয়া কাম নাই। কিন্তু জাড্য অতিক্রম অতীব কঠিন। অতএব বসে বসে দেখা গেল শতরকম জালজোচ্চুরির অন্য নাম আন্ত:রাজ্য বেসরকারী পরিবহণ। শেষে রাত একটা নাগাদ বাস ছাড়ল। ততক্ষণে রঙ্গনা বিদ্রোহী নারীমূর্তি, এই হেনস্থার কঠিন পিতিবাদ দরকার। ঠিক এই সময়ে একটি ছোট্টো ঘটনা- প্রচুর বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ওঠা দুই দেহাতী বুড়োকে ডেরাইভারের দুই কেঁদো স্যাঙাৎ ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নির্জন ন্যাশনাল হাইওয়েতে নামিয়ে দিলো। অপরাধ ভাড়া নিয়ে সামান্য বচসা। এর পর "আমার পিতিবাদের ভাষা" সটান পেটের মধ্যে। পাঠকপাঠিকা যদি বাসের এই গপ্পে ক্লান্তি বোধ করেন তাহলে বলে রাখি মালমশলা আরও ছিল- গাজিয়াবাদের অন্ধকার মাঠে জলবিয়োগরত মালিকের সঙ্গে টাকার লেনদেন, মাঝরাস্তায় পুলিশ কর্তৃক ডেরাইভার আটক কারণ কোনোরকম বৈধ কাগজপত্তর নেই। এইসব ক্যাঁচাল শেষ করে বাস যখন একটু জোরে দৌড়েছে, ভোরের নরম আলোতে চোখ বুঁজে এসেছে, এমন সময় বাস জগদ্দল নট নড়ন চড়ন। এবার বাসের সত্যি সত্যি গঙ্গাযাত্রা হয়েছে। কাজেই গাঁয়ের লোকাল বাসে চেপে প্রথমে কাশীপুর, সেখান থেকে আর এক লোকাল বাসে হলদোয়ানি।
হলদোয়ানি কুমায়ুন হিমালয়ে ঢোকার দরজা, সমতলের শেষ গঞ্জ শহর। কিন্তু আমাদের তিনমূর্তি বাসস্ট্যান্ডে প্রাত:কৃত্য সম্পন্ন করে হালকা দেহে ও হালকা মনেও ঠিক করতে পারেননি যে কোথায় যাবেন- বিনসর না কি নৈনিতাল, কৌশানি ইত্যাদি। বেলা বারোটা নাগাদ আলমোড়ার বাস এলে সেই বাসে ওঠাই স্থির হল কারণ আলমোড়া থেকে অন্যান্য জায়গার বাসের সংযোগ রয়েছে। এতো রকম খুচরো ঝামেলার হবার পর এই গপ্পের সব থেকে নিদারুণ সত্য আবিষ্কৃত হল- টাকাপয়সার অবস্থা বড়ই সঙ্গীন। তবে ততক্ষণে বাস গোঁ গোঁ করে চড়াইয়ে উঠতে শুরু করেছে, পাহাড়ি নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় মেজাজ তর্। কে আর টাকাপয়সার কথা ভাবে। তার উপর বিনসরে বসে রয়েছে স্যান্ডি আর তার দলবল। পাঠকপাঠিকা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, পুরো গপ্পের কোথাও একবারও খাওয়াদাওয়ার কোনো প্রসঙ্গই ওঠেনি। ওঠার কথাও নয়, কারণ বিকেলের পড়ন্ত আলোতে আলমোড়া পৌঁছনো পর্যন্ত পেটে পড়েছে গুটিকয়েক কমলালেবু আর এক প্যাকেট বিস্কিট। কাজেই! আলমোড়া থেকে বিনসর যেতে হয় জিপ ভাড়া করে। নইলে বাগেশ্বরের বাসে চেপে মাঝরাস্তায় নেমে আরও দশ এগারো কিলোমিটার হন্টন। পেটে দানাপানি না থাকলে কি আর এগারো নম্বর বাস স্টার্ট দেয়? অগত্যা একপিঠের জীপ ভাড়া করে চলো বিনসর।
কাপড়াখান পেরোতে না পেরোতেই রাস্তা হাঁই হাঁই করে সটান উপরে উঠতে শুরু করেছে। নিশ্চুপ সন্ধ্যায় শুধু অন্ধকার পাতা বওয়া পাইনের সারি। বিনসর অভয়ারণ্যের গেট পেরোতে জঙ্গল আরও ঘন, ঠান্ডা আরও বেশি। রাস্তার দুধারে গলে যেতে যেতেও থেকে যাওয়া সাদা বরফের চাঁই পড়ে আছে। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার আর টুকরো টুকরো বরফের মধ্যে ছোটো ছোটো বুনো লালফুলের গোছা আর নিবিড় পাইনের গন্ধ অদ্ভুতভাবে প্রাগৈতিহাসিক। গাঁ গাঁ করে উঠতে উঠতে জিপের ডেরাইভার জিগায়- থাকা হবে কোন ঠেঁয়ে? কুমায়ুন মন্ডল বিকাশ নিগম না কি বনবাংলো? তিনমূর্তি খুবই আশ্বস্ত রেলায়- অন্যান্য হোটেলটোটেলও দেখা যাবে। টোটেলও নাই, হোটেলও নাই। অভয়ারণ্যের শেষ চূড়োতে দুটি বাড়ি- একটি কে এম ভি এন, অন্যটি বনবাংলো। আর কিছু নেই- দোকানটোকান, ঘরটর, বাড়িটাড়ি- কিচ্ছু না। জিপ যখন বনবাংলোর সামনে থামলো আকাশ তখন ঘোর বেগুনি। বাংলোর সব দরজা বন্ধ। চৌকিদারের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। এই বাংলোর ভূতের গপ্পো আবার বেশ নামজাদা। কোথায় স্যান্ডি আর তার দলবল? এতক্ষণে মোটামুটি হিসেব করা গেছে- জিপের ভাড়া মিটিয়ে দেবার পর বাকি পয়সা দিয়ে দিল্লি ফেরা সম্ভব নয়। একটু পিছনে ফিরে এসে কে এম ভি এনের বাংলো। রঙ্গাই স্যান্ডিদের তালাশে গেলো। পাঁচ মিনিট বাদেই ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ফিরলেন ভগ্নদূত। একটি তথ্য ও একটি ভীষণ খারাপ খবর নিয়ে। তথ্য- স্যান্ডির দলবল এই বাংলোতেই ডেরা বেঁধেছিলো। ভীষণ খারাপ খবর- আজ দুপুরবেলা তেনারা চেক আউট করে চলে গেছেন। মনে রাখবেন, তখনও "তোমার দেখা নাই" বাজারে আসেনি। অত:পর মার্ক্স-মা কালী-রবি ঠাকুর সহায় বলে একরাতের জন্য বাংলো বুক করা হল। বুক করতে তো আর পয়সা লাগে না! বিনসরে তখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি। আধো আলো ঘরে কাঠের মেঝের পুরোনো গন্ধ আর মোমবাতির কাঁপা আলোতে তিনমূর্তি সময় এবং ভাগ্যের হাতে আপাতত: সঁপিল পরান। বাংলোর পিছনের খোলা জায়গায় গিয়ে দেখা হল উত্তর দিগন্তে ভার করে থাকা লাল আর বেগুনী মেঘের দল, তার উপরে অচল রাজপ্রাসাদের একটু চূড়া তখনও উঁকি মারছে- ত্রিশূল শীর্ষ।
এতক্ষণে হুঁশ ফিরেছে। ত্রিশূলের সেই আখাম্বা চেহারা দেখার পরে পেট ভয়ে গুড়গুড় করছে। জনপ্রাণী বলতে বাংলোর গোটা দুই তিন কর্মচারী। ঠিক এমন সময়ে লেংচে লেংচে রঙ্গাইয়ের প্রবেশ, দু গাল এঁটো করা হাসি আর থামছে না। পিছনের বাগানে এক ট্যুরিস্ট দম্পতি দেখা গেছে। কিমাশ্চর্যম, তারা বাঙালীও বটে! অন্ধকার সুড়ঙ্গের অন্যধারে কি কেউ হ্যারিকেনের পলতেতে দেশলাই ছোঁয়ালো? তিনমাথা এক করে ঠিক হল খাওয়ার আগে টুক করে গিয়ে দাদাবৌদিদের আমাদের বিপদের কথা খোলসা করে বলতে হবে। ভার পড়ল রঙ্গনের উপর। রাত আটটা নাগাদ দাবৌদির ঘরের দরজায় খুট্খুট্। মিনিট দশেক হেঁহেঁ হুঁহুঁ খেজুর ভূতের গপ্পো পাহাড়ের গপ্পো হওয়ার পর টেনশনে রঙ্গন দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর ছোট্টো সেই কামরায় হন্হনিয়ে পায়চারি। মুখের কাছে এসেও আর বেরোচ্ছে না। শেষে "বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা" ইস্টাইলে নিবেদিত হল তিন উজবুকের গপ্পো। দাদাও দুর্ভাবনায়- কারণ তিনমূর্তির ঠিক কত টাকা ধার চাই তার হিসেব এখনও মেলে নি। তারপর দু:স্থে দান করতে গিয়ে নিজের পকেটে না টান পড়ে! বাসভাড়ার পয়সা যোগাড় না হয় হল- কিন্তু তারপর বিনসর থেকে আলমোড়া যাওয়া কিভাবে? দাদাবৌদির জন্য কাল দুপুরে জীপ আসবে বটে, কিন্তু তারা কি বিনে পয়সার এই তিন উট্কো লোককে তুলতে রাজি হবে? এগারো নম্বর সিলেবাসের বাইরে। কিন্তু সামান্য ভরসা পেয়েই তিন হতভাগার দিলখুশ, এবং পেটে রাবণের চিতে। কিন্তু চিতে যতই জ্বলুক, পাটীগণিতের আঁক কষে কষে খাওয়া। একটি রুটি মানে পাঁচ টাকার নোট। ঠিক হল সকালের প্রাত:রাশ জলের আর চায়ের উপরেই সারা হবে। খাওয়ার পর রাত্রে বাইরে বেরোতেই কোটি কোটি তারার চাদর ঢেকে অন্ধকার পাহাড় শুয়ে আছে, উল্টোদিকের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ডাক।
পরের দিন ভোরে রক্তজমানো ঠান্ডা। কিন্তু চোখের সামনে? বান্দর্পুঞ্ছ থেকে নন্দাদেবী, ত্রিশূল হয়ে নীলকন্ঠ, কেদারনাথ পর্যন্ত সার বেঁধে একশ আশি ডিগ্রি জুড়ে এক অনৈসর্গিক থিয়েটার। খালিপেটে, টাকাপয়সা ছাড়া, ঘুমচোখে, রক্ত জমানো ঠান্ডায়, মাদক্হূন্য অবথায় এই ecstasy-তে পৌঁছনো হিমালয়েই সম্ভব। শুধু সাদা, শুধু বিশালতা, শুধু অনন্ত নৈ:শব্দ্য। এই বোবা করে দেওয়া বিরাটত্বের সামনে দাঁড়িয়েও দাদা কিঞ্চিৎ হাস্যরসের যোগান দিলেন বিনসর থেকে এভারেস্ট দেখিয়ে। সেদিন আকাশও "ও আকাশ, সোনা সোনা" টাইপের। হেঁটে হেঁটে জিরো পয়েন্টে গিয়ে একশ আশি ডিগ্রি প্যানোরমা আরও স্বচ্ছ, আরও মোহময়। বিনসরে দেখার বলতে এইটুকু এবং এইটুকুই যা জীবনভর দেখা যায়। কাজেই বিস্তৃত বর্ণনার পন্ডশ্রম বৃথা। এই হেসেওঠা সকালে দাদাবৌদির থেকে পয়সা নিয়ে তিনমূর্তি তাদের ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। দুপুরে আলমোড়ায় ফেরৎ যাবার জীপ এলে তিনজনের ঠাঁইও মিলল। আলমোড়ায় দাদাবৌদির বাস বেরিয়ে যেতেই প্রথম কাজ খ্যাঁটনের জোগাড়- তেরি মেরি বাঙালী, পেটপূজনের কাঙালী। আর দাদাবৌদিকে- ওগো পথের সাথী, নমি বারম্বার।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। দিল্লি ফেরৎ যাওয়ার বাসে মুখ অনবরত চলছে। হলদোয়ানিতে নেমে তার হৃদয়বিদারক সমাপ্তি। রঙ্গন ও রঙ্গাই ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে ঢুকেছিল এক ফলের রসের দোকানে। রঙ্গাই কাঁচুমাচু মুখে শস্তার গাজর বিটের রস অর্ডার দিতেই রঙ্গনের পেল্লাই ধমক- ও সব কি শাকপাতা খাবি র্যা? ভাইসাব, আনার কা রস পিলা দিজিয়ে। তারপর পয়সা দিতে গিয়ে সেই রসের দাম শুনে দুজনেই বুঝল আজ রঙ্গনার হাতে মার খেয়ে হাড্ডিও পিল্পিলিয়ে যাবে। সব পয়সা শেষ। আই এস বি টি পৌঁছে হোস্টেলে ফেরার অটোর পয়সা নেই। দিল্লি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত প্রায় আড়াইটা। ঠিক হল হোস্টেলের লোকজনকে জাগিয়ে দিয়ে পয়সা মিটিয়ে দেওয়া হবে। অটো যখন হোস্টেলের দরজায় রঙ্গনা প্রায় ম্যাজিকের মতো টাকার নোট বের করল ব্যাগ থেকে। দুই হাভাতের চোখের আড়ালে সে এই নোট বাঁচিয়ে রেখেছিল শেষ আশ্রয় হিসেবে। রঙ্গন আর রঙ্গাই রঙ্গনাকে কাঁধে চাপিয়ে পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে গাইতে গাইতে হোস্টেলে সেঁধুলো।
২ (Jun 2 2005)
অন্য হিমালয়
হিমালয় মোটের উপর দুই রকম। অন্তত: জনপ্রিয়তার নিরিখে। একধরনের হিমালয়ে নন্দাঘুন্টি-পাঞ্চৌলি-নীলকন্ঠের বেসক্যাম্পে, কুচো বরফ উড়ে আসা হিমেল হাওয়ায় উড়ে যেতে যেতে আটকে থাকা তাঁবুর সামনে কালো চশমাচোখে দামাল পর্বতারোহী, শেরপা ও কুলিদের দল। অন্য হিমালয়ে বাস ও ট্রেনের পেট উগ্রে বেরোনো, ভূঁড়িতে রংচঙে গোলাপ আঁকা সোয়েটার পরনে, গোলাপী-সবুজ বাঁদুরে টুপি মাথায়, ওয়াকম্যান কানে, মলের আইসক্রীম পার্লারে ভিড় করে, ঘোড়ার পিঠে চেপে ডিজিক্যামে ফোটোক তুলে ট্যুরিস্টের দল- সিমলা-কুলু-নৈনিতাল-মুসৌরীতে। এর সাথেই মিশে থাকে, সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক অন্য হিমালয়। সেখানেও ট্যুরিস্টের দল জোটে। সেখানেও কিছু উট্কো হোটেলের সাথে সাথে পর্যটন নিগমের ট্যুরিস্ট বাংলো গজিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই সব জায়গায় এখনও হয় তো ছোটোখাটো জীবন নিজেদের ছন্দে কেটে যায়। ট্যুরিস্টপ্রবাহের বিপুল তরঙ্গের দোলাচলের ঝাপটা লাগলেও দিনের শেষে কোনো ঘুমপাড়ানি হাওয়া নিজের লয়ে বয়। হরেককিসিমের বিকাশ যোজনার নৈর্ব্যক্তিক উন্নয়নের আড়ালে অবিচল থাকে লোকাচার-সংস্কার-আদিম প্রাণধর্ম নিয়ে গড়ে ওঠা হিমালয়ের ছোটো ছোটো অঞ্চল ও তার জনগোষ্ঠী। নৃতত্ত্ব-সমাজতত্ত্বের গূঢ় এষণা শিকেতে তুলে, শুধু অচেনা রং মাখার আনন্দেই কখনও কখনও দাঁড়িয়ে পড়তে পারেন এই রকম অন্য হিমালয়ে। সকালের সোনা আলোতে নির্জন পাহাড়ী হাইওয়ের ধারে কোনো গুলাব সিঙের পলিথিনে ঢাকা ছোট্টো দোকানে সেরে ফেলতে পারেন নাশতা। আপনার চারদিক ঘিরে দাঁড়ানো গাছগুলো, পিচের কালো রাস্তাটা, মিলিটারিতে কাজ করা গুলাব সিঙের বড়ো ছেলে, বহু নীচে পড়ে থাকা ছোট্টো গ্রামখানা, আপনি নিজে- মিশে যাবে একান্ত অগোচরে।
ধরুন না জৌনসর-ভাবর অঞ্চলের কথা। দেরাদুন থেকে যমুনা আর টনসের খাত ধরে যে রাস্তা হর কি দুনের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার মাঝামাঝি এই অঞ্চল। এ হল কৌরবদের দেশ, যেখানে পান্ডবশত্রুরা দেবতার আসন নিয়েছেন। এখানে একনও চালু আছে মেয়েদের বহুপতিগ্রহণপ্রথা, হয়তো বা দ্রৌপদীর পদাঙ্কে। রাস্তায় যেতে যেতে পড়বে লাখমন্ডল। প্রবাদ, এখানেই কৌরবেরা জতুগৃহ নির্মাণ করেন। পান্ডবকৌরবদের গপ্পোগাছায় ভরপুর এ অঞ্চলের পথঘাট। এমনকি, টনস নদীর উৎপত্তি যে স্বর্গারোহিণী পর্বতশৃঙ্গ থেকে, প্রবাদানুসারে পঞ্চপান্ডবের স্বর্গদ্বারে আরোহণ সেই শ্রেণী ধরেই। সেই পথের মাঝে পড়ে ছোট্টো জনপদ চক্রাতা। মিলিটারি অনুশাসনে রীতিমতো আঁটোসাঁটো প্রশাসন। শ্রীলঙ্কায় তামিল ইলমের জঙ্গীপনার সূচনাপর্বে পিরভাকরন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর থেকে এইখানেই তালিম পেয়েছিল। সব থেকে ভালো হবে যদি বনবাংলো পেয়ে যান। নতুবা গোটা দুয়েক হোটেল সম্বল। মল নেই।বাজার বলতে এক চিলতে রাস্তার দুই পাশ ধরে ছোটোখাটো দোকান। এখানে পাহাড় এখনও ঘোর সবুজ। পিচ বাঁধানো পাকদন্ডী ধরে অনবরত মিলিটারি ট্রাকের আনাগোনা। পাহাড়ের গা দিয়ে তর্তরিয়ে দু আড়াই কিলোমিটার নেমে পৌঁছে যান টাইগার ফল্সে। কোনো পাহাড়ী রাখালকে সাথে নিন গাইড হিসেবে। আপনার শৌখিন অ্যাডভেঞ্চারের শহুরে প্রকরণ ছুঁয়ে যাবে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা চাষীবাড়ির বালিকা-যুবতীদের অবাক তাকিয়ে থাকা চোখ। ঘোর গ্রীষ্মে, তুঙ্গ সীজনেও, টাইগার ফলসে দু এক দল ট্যুরিস্টের দেখা পাওয়া সৌভাগ্য। গভীর জঙ্গলের মাথা ফুঁড়ে নামা জলপ্রপাতের পায়ের তলায় ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি ওড়ে। দুপুরেও গভীর জলজ অন্ধকারে চামড়া কেমন শির্শিরিয়ে ওঠে। ফেরার সময় অন্য রাস্তা ধরুন না কেন। যে রাস্তা চক্রাতার পাকা রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। ঠিক যখন সন্ধে সন্ধে ভাব, পাকদন্ডী বেয়ে উঠতে শুরু করুন। লোকসঙ্গ দুর্লভ। হঠাৎ হারিয়ে যাবেন। চারদিকে দৈত্যপাহাড়দের অর্ধেক শরীর যখন অন্ধকার হয়ে এসেছে, দেখবেন আপনার অনেক নীচে জঙ্গল, আর উপরে পাশে চারদিকে অসংখ্য কালো সবুজ পাহাড়ের মাথা। এরপর পাকা রাস্তায় উঠে এলে একলা পিচঢালা রাস্তা- সারাদিনেরাতে বাস তো দূরের কথা, এমনি কোনো গাড়িরও দেখা পাওয়া যায় না। এখান থেকে চক্রাতা প্রায় দশ কিলোমিটার। পথের দুধারের জঙ্গলে হিমালয়ের ভালুকদের ঘনবসতি। হিমালয়ের উপর ভরসা রাখুন। কোনো এক তারাভরা রাতে নিজের আস্তানার কম্বলের ওমে ঠিক পৌঁছে যাবেন।
সিমলা তো হল বেশ কয়েকবার। কালকার থেকে কুঝিক্ঝিক্ খেলনাগাড়ি চেপে দুপাশের গাছপালার সাথে কথা বলতে বলতে। সেই রেলরাস্তার মাঝে সব থেকে লম্বা সুড়ঙ্গ যেই শেষ হয়, সেখানেই পুরানো ইংরিজি গল্পের মতো ছোট্টো ইস্টিশন বারোগ। স্থানীয় উচ্চারণে ব্রোগ। কেউ কি কার্টুনশিরোমণি নডিবাহাদুরের কীর্তিকলাপ দেখেন? নডির টয়ল্যান্ডের খেলনা ইস্টিশনের মতো এও এক খেলনা ইস্টিশন। সিমলায় যাওয়ার পথে নির্ঘাৎ এখানে ব্রেড পকোড়া কি আলুর চপ মেরেছেন। দিনে গোটা চারবার ট্রেন এলে উৎসুক ট্যুরিস্টমুখ, খাবার দোকানে হাঁকাহাঁকি, স্টেশন মাস্টার আর গার্ডের ব্যস্ততা। নইলে নি:ঝুম ইস্টিশনে ইংরেজ আমলের আলোকস্তম্ভ, খাস বিলেতে তৈরি জলের কল, লোহার বেঞ্চি, জাফরিকাটা কাঠের দেওয়ালে দুলতে থাকা বেগুনী অর্কিড চুপিচুপি যাত্রীদের জন্য প্রহর গোনে। দুখানা বেশ সাজানো গোছনো রিটায়ারিং রুমও আছে। কবি এবং পাগল ছাড়া এই ইস্টিশনে থাকতে আসবে না কেউ। তবে ব্রিটিশ সরকারের গোনাগুনতিতে কবি ও পাগলেরাও ছিল বোধ হয়। কোনো কারণ ছাড়া, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই রেললাইন ধরে হেঁটে আসুন। দুধারে সবুজ পাহাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। দুপুর কাটান সিমলাগামী ট্যুরিস্টদের পাঁচ মিনিটের দেখনদারি দেখে। নইলে পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলে কালকা-সিমলা বড়ো রাস্তা- ঘন ঘন বাস, লরি, গাড়িদের যাতায়াত। এখান থেকে নীচে বারোগ ইস্টিশনকে সত্যি সত্যি খেলনা ইস্টিশন মনে হবে। এই রাস্তার এক বাঁকে জড়ো হয়েছে ছোটো ছোটো খাবারের দোকান। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দোকানের বেঞ্চিতে বসে দিকদিগন্তে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়দের সুখদু:খরাগের পালা দেখুন। বরাৎ ভালো থাকলে উঁকি মারবে দু এক ফোঁটা রুপোলী ঝিকিমিকি। হঠাৎ পাহাড় ঢেকে কুয়াশা নামবে। পায়ের তলায় ঢেকে যাবে ধীর সাদা ধোঁয়াতে। কুয়াশার পেট ছিঁড়ে মাঝে মাঝেই প্রচন্ড শব্দে ধেয়ে যাবে প্রাগৈতিহাসিক আর্তনাদে বাসেদের দল। মাথাকান ভালো করে ঢেকে গরম চায়ের গেলাস হাতে জড়িয়ে বসুন। কুয়াশাঢাকা বেবাক শূন্যতার মাঝে আবার স্পষ্ট করে শুনতে পাবেন হৃদ্পিন্ডের একটানা ধক্ধক্ শব্দ।
কুয়াশা দেখতে পারেন কসৌলিতে। কালকার থেকে ধরমপুর হয়ে একটু পা বাড়ালেই কসৌলি। খুশবন্ত সিঙের বাংলোর মহিমায় বেশ একটু নামডাক হওয়া কসৌলি। কসৌলিতে মল আছে, ব্রিটিশ আমলের ফুট্ফুটে বাংলো আছে, মিলিটারি প্রতাপ আছে আর সেই প্রতাপের সুফলস্বরূপ নেই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বেজম্মা কংক্রীটের লেনদেন কারবার। আরও আছে আলুর পরোটা। কসৌলির অভিজাত এলাকা ছড়িয়ে যেখানে ঘিঞ্জি বাজার, সেই বাজারের কিছু চড়াই উৎরাই পেরোলে এক বুড়োদাদুর ছোট্টো একচিলতে দোকান, বুড়োবুড়ির বাসার লাগোয়া। কসৌলির পাহাড়জঙ্গল ঢেকে যখন ঝম্ঝম বৃষ্টি হবে, তখন সেই পাহাড়ী দাদুভাইয়ের দোকানে ঢুকে খাবেন আলুর পরোটা আর টক দই। দিল্লিতে তন্ন তন্ন করেও এই জিনিষ পাবেন না। আসার আগে বহু বছরের পুরোনো জরাজীর্ণ এক্সারসাইজ বুকে আপনার মন্তব্য লিখতে যেন ভুলবেন না। যাদের মনের খিদে আরও বেশি, তারা কসৌলির আপার মল ধরে চলে যান ভালোবাসা সরণিতে। এখানে ঝুপসি গাছের ছায়ায় আলো আঁধারির খেলা, ভিজে ভিজে হাওয়া, হঠাৎ জোনাকির মতো উঁকি মারে বুনো ফুলের উচ্ছসিত রং। অসমাপ্ত চিঠিখানা এখানেই লিখুন।
আড্ডা শেষ করি উত্তরাঞ্চল দিয়ে। গাড়োয়াল হিমালয়ের অনাদৃত গঞ্জ শহর পাউরি। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে লেপার্ড বেরিয়ে গৃহস্থের আঙিনায় ঢুকে পড়ে বলে কাগজে নাম বেরোয়। দিল্লির থেকে নাজিবাবাদ-কোটদ্বার হয়ে পাউরি গাড়োয়ালের কোলে চলে গেছে রাস্তা। পাউরির আধাশহুরে ভাব পছন্দ না হলে একটু দূরেই নিরবিচ্ছিন্ন নির্জন খিরসু, যদি না দুর্ভাগ্যক্রমে একশো ডেসিবেলে গানশোনা দিল্লিবাসী ট্যুরিস্টের খপ্পরে পড়েন। গ্রীষ্ম যখন তুঙ্গে, তখন তাপধুলোর অস্বচ্ছ পর্দায় ঢেকে থাকে বহুদূরের বরফের পাহাড়। তারপর একদিন পাহাড়ে বৃষ্টি নামে। বহুদিনের উপোসী পুরুষশরীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে থাকা ক্লান্ত পৃথিবীতে। জলের তোড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ভেসে যেতে থাকে গিরিখাত, নালা, গুহার ভিতর। বৃষ্টি একটু ধরে আসার পরে আপনি গাড়ি নিয়ে নেমে আসছেন সমতলে। কোটদ্বারের পরেই উত্তরপ্রদেশের গাঙ্গেয় সমতল। নাজিবাবাদ চিরাচরিত ম্লান ধুলিধূসরিত গঞ্জশহর, মুসলমান সংখ্যাধিক্য। নাজিবাবাদ পেরিয়ে বিজনোর- উত্তরপ্রদেশের ট্র্যাডিশনাল মহকুমা সদরের আর্কিটাইপ। কিন্তু বৃষ্টির পরে চারদিক ঠান্ডা, ধুলোবালি ধুয়ে মুছে গেছে। একবার পিছন ফিরে তাকাবেন। ততক্ষণে হয় তো আপনি পৌঁছে গেছেন বিজনোর আর মীরাট জেলার সীমানায়। এখানে বিস্তীর্ণ গঙ্গা তার দু বুক মেলে শুয়ে আছে। নদীর ওপারে বিকেলের ধানক্ষেতে নির্ভার সবুজ। হয় তো সেই অমোঘ মূহুর্তে দেখবেন ধানক্ষেতের শেষে দিগন্তে আগুন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারে সারে চৌখাম্বা কেদারনাথ নীলকন্ঠের দল। শেষ সূর্যের আগুনে নিশান উড়িয়ে সন্ধের আকাশকে কুর্নিশ জানাচ্ছে হিমালয়ের স্পর্ধিত পৌরুষ। আপনি সমতলের মানুষ- গঙ্গাতীরে, ভরন্ত ফসলের পাশে একবার নতজানু হোন। হয় তো এই মূহুর্তের জন্যই আমাদের ক্রমাগত জন্ম হতে থাকে।
৩ (Jun 16 2005)
ছেঁড়াখোঁড়া সংলাপ
"যাও বন্ধুগণ, মন্দার মালিকায় ভূষিত হয়ে স্বর্গের অক্ষয় অমরতা লাভ করো! আমরা রইলাম এই ভাঙাচোরা পৃথিবীতে....বলিষ্ঠ সমাজ....মানব সমাজ গড়তে....তোমাদের স্বপ্ন সার্থক করতে....যাও বন্ধুগণ...." - অশ্বত্থামা, মনোজ মিত্র
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের গোড়া অবধি একদল মানুষের বাচ্চা জন্মেছিল।
সেই সময়ে, একদিকে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ উদ্ধার হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের আঠেরো থেকে পয়ঁত্রিশের গুষ্টির তুষ্টি- কেউ মারে, কেউ মরে। দমাদ্দম লাশ পড়ছে। রাস্তায় বাজারে মোড়ে চৌমাথায় শকুনির ভিড়- পুলিশ, দালাল, খোচর, কিংবা নীরক্ত লুম্পেন। তখনও মধ্যবিত্ত বাবা মায়েদের বাচ্চারা আর জি করে, নীলরতনে, মেডিকেল কলেজে জন্ম নিত। জানলা ঢাকা কালো কাগজে। বাইরে চেনা জানা পেটোর উল্লাস। নি:শব্দ চাকুর ছোবোল। এই বাচ্চাদের জন্মানোর সময় শান্তিনগর বা পূর্বাচল নামের ছোটো ছোটো কলোনিতে মায়ের চোখের সামনে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া ছেলেকে কুচিয়ে কুচিয়ে কাটা হচ্ছিল। কিংবা কোনো নিরীহ কনস্টেবলের হাত থেকে বাচ্চার জন্য কেনা দুধের টিন গড়িয়ে গিয়েছিল পাশের খোলা হাইড্র্যান্টে।
"সে বড়ো সুখের সময় নয়".....
শত ঘোষের দলবল বরানগর-কাশীপুর সাফ করে ময়লা ফেলার গাড়িতে অবলা গঙ্গায় হাজার হাজার টাটকা লাশ ফেলে এসেছিল।
"সে বড়ো আনন্দের সময় নয়"....
মানুষের বাচ্চারা তখন ল্যাক্টোজেন খায়। অ্যা করার জন্য তখনও পাওয়া যায় "দৈনিক বসুমতী" কি "যুগান্তর"। কিন্তু আস্তে আস্তে সুতো গুটানোর পালাও আসে। যারা মরতে মরতে বেঁচেছেন, আপাতত শান্তিকল্যাণের খোয়াইশে মাঝবয়েসের সংস্কৃতিতে থিতু হলেন। সন্তানের মুখ ধরে যদি চুমো খাওয়া যায়! যারা বাঁচতে বাঁচতে মরেই থাকেন, তারা লক্ষতম হাঁপটি ছাড়লেন। শুধু ট্রেনগুলো আর সময়ে চলবে না বলে মনে কিঞ্চিৎ খেদ রয়ে গেল। যৌবনের নিদারুণ ব্রনোদম এবং অবশ্যম্ভাবী হস্তমৈথুনের শেষে বাপদাদাদের প্রজন্ম আবার তেলেজলেঅম্বলে বেশ মাখোমাখো বাবুটি হলেন। এশিয়ার মুক্তিসূজ্জ তখন প্রায় অস্ত যাবেন যাবেন। ভারতের ভাগ্যাকাশে উদিত হচ্ছেন শত শত নষ্টচন্দ্র। নতুন আসা কালার টি ভির মতই হাতে রংবেরঙের পতাকা।
কদ্দিন বেশ দেঁড়েমুষে চাড্ডি ভাত খাই নি মা, বেশ পাতলা মুসুর ডালে নেবু কচলে।
ভারতের ট্রেনের প্রবল হৈহল্লার মধ্যে এক কোণে ভালো করে শতরঞ্চি পেতে বাঙালী একটু ভাতঘুম দিল। জন্ম হল মধ্যবিত্ত ভন্ডামির খাপেখোপে মিলে যাওয়া নব্যবামপন্থা।
"Life is nothing more than the happiness that you get out of it"-Antigone, Jean Anouilh
নব্বই আসতে না আসতে সেই মানুষের বাচ্চারা বেশ লায়েক হয়েছে। হর্মোনের খেলা যখন বেশ তুঙ্গে, যখন "বিশ্ব উদ্ধার কল্লেই হল" ভাবটা গেঁড়ে বসার তাল করছে, তখন পৃথিবীর মাটিতে কি ভীষণ ঝড়! বামপন্থী রাজপ্রাসাদগুলো দুম্দাম্ ভাঙছে। পাড়ার রকে নতুন শব্দ শোনা যাচ্ছে- "গ্লাস্তনস্ত", "পেরেস্ত্রৈকা"। বানতলায় "হয়েই থাকে" গোছের দুর্ঘটনা। তিয়েনানমেন স্কোয়ারে কিছু একটা হচ্ছে এবং হচ্ছে না। জাত ধর্ম ব্যাপারগুলো বেশ মন দিয়ে আবার ভাবতে হচ্ছে। বেশ সাদা-কালো খেলা সমস্ত- মন্ডল কমিশন নাকি মন্ডল কমিশন নয়? রথযাত্রা নাকি রথযাত্রা নয়? ঠিক এই ধুলোর ঝড়ে চোখ ঢাকতে যাবার সময়ে গুটি গুটি পায়ে বাইরের বাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। হরমোননির্গত শক্তির অধিকাংশই খরচ হয়ে গেলো নিজেরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি সেটা বুঝতে। হাত-পা-চোখ-মুখ নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক করে রাখতে। সময় পালটাতে যাওয়ার আগে সময়ই বাচ্চাগুলোকে পালটে দিলো।
অতএব এখন বাবু-বিবি সক্কাল থেকে রাত অবধি আপিস এবং সংসারের উন্নতিসাধন করেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই চ্যারিটিতে পয়সা দেন- ট্যাক্সো বাঁচে। যতটা নির্বিঘ্নে শেষপর্যন্ত এই মলমূত্রমাংসসমেত দেহটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তারই ধান্দা চলছে অহোরাত্র।
দু হাজার পাঁচ।
তিরিশ পেরিয়ে কোমরের আশে পাশের ঘের বাড়ছে। মাইনে বাড়ছে, যদিও আরও বাড়লে আরও ভালো হত। দুশ্চিন্তায় থাকি- পরের দিনের সংসার এবং পরের দিনের আপিস। নিশ্চিন্ত আছি- মোটামুটি দূরদর্শী ফাইনান্শিয়াল প্ল্যানিং, ছেলেমেয়ের মোটামুটি ভালো ইশ্কুল, মোটামুটি ভালোভাবে থাকা। বড়োরা এই এক্স-বাচ্চাদের নাম দিয়েছেন- স্বার্থপর প্রজন্ম। না আছে প্যাশন, না আছে স্বপ্ন। পচনের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে এক অসীম উদাসিপন। ঘুষ দিতে হাত কাঁপে না, ন্যাংটো মেয়েমানুষের সিনেমা দেখতে চোখ কাঁপে না, খিস্তি করতে মুখ কাঁপে না। এ তুমি কোথায় লইয়া আইলা ঈশম?
কনে আর যাইবা কত্তা? যেখানে ছিলা সেইখানেই আইয়া পড়স।
পথটা ছিল বৃত্তাকার। ছুটতে ছুটতে খেয়াল হয়নি। ঘুরে ঘুরে ভাঙতে ভাঙতে দম ফুরোলেই আব্বুলিশ। তাই আমরা একটু থমকে দাঁড়াই। আজকাল থমকে দাঁড়ানোটাও মুশকিল। তাও একটু ঠাহর করি এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যে কোন ফাঁকে এক চিলতে আলো আসে। শেষ দৌড় দৌড়াবার আগে অনেকটা দম নিই।
শেষ দৌড় দৌড়ায় কারা? সেই পুরোনো আশি আর কুড়ির গপ্পো। আশি শতাংশ বনের মোষ তাড়িয়ে কুড়ির শতাংশের ঘরের বেড়ায় মাধবীলতা বেঁধে দেয়। তা সত্তরে যা, নব্বইতেও তাই। শুধু এই কুড়িজনের কোনো তাড়া নেই। বদল ব্যাপারটা তো বিষ্ঠাত্যাগ নয়, যে পেলেই ছুটতে হবে। নব্বই না করলে পরের নব্বই করবে। তারা প্রতীক্ষাতে প্রস্তুত। তার আগে ছোটো ছোটো চারাগাছ পুঁতে যেতে থাকে। শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে। রাশিয়া, চীন চেনার আগে প্রতিদিনের লড়াই চিনে নিতে থাকে। একটা টিউবওয়েলের জন্য লড়াই। একটা পাকা রাস্তার জন্য লড়াই। একটা ছাদ্হুদ্ধু ইশ্কুলবাড়ির জন্য লড়াই। লড়াই উঠে আসে আমাদেরই জমি থেকে, আমাদের জলহাওয়ায় বড়ো হতে থাকে। তথাকথিত দেশব্যাপী বড়ো কিছু একটার অভাবে আশি শতাংশকে দেখে এই এক্স-বাচ্চাদের নাম হয় "স্বার্থপর প্রজন্ম"। সঞ্জয় ঘোষদের তাতে কিছু এসে যায় না। এই আমাদের ইতিহাসের নতুন পাঠ।
প্রতিবাদের স্পেসের অনেকটা হাতবদল হয়। রাজনীতির প্রতিষ্ঠান ও দালালেরা কাঠি দেওয়ার মওকা খোঁজে। কিছু এসে যায় না।
"ভূত চলে যায় ভবিষ্যতে প্রেত চলে যায় ডিমে
ডিম ফেটে যেই বেরোই আমি, আগ লাগে পিদ্দিমে।"- ভুতুমভগবান, জয় গোস্বামী
আমরা স্বাধীনতা দেখি নি। আমরা পরাধ্হীনতা জানি না।
আমরা শূন্য সময়ে শূন্যের মোকাবিলা করি।
আমরা অসৎ সময়ের জাতক।
আমরা আগুনে না জ্বলে গভীর জলজ গুল্মে তা দিয়ে চলি।
আমরা বৈপরীত্যের সন্তান।
আমরা এক হাতে নীট রাম নিয়ে অন্য হাতে সন্তানের মুখে দুধ তুলে দিই।
আমারা অন্যের ঘর গড়ে নির্বিকার কৌতুকে নিজের ঘর ভাঙি।
আমাদের এক আঁখিতে তাম্বুলরাঙা বয়ানে মানদসুন্দরী, তো অন্য চোখে ছম্মকছল্লু বিপ্স।
আমারা বালিশের তলায় কথামৃত লুকিয়ে প্রকাশ্যে পর্নো পড়ি।
আমাদের হাতপায়ের শিকলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারে চূড়ান্ত রক্তকরবী।
আমরা অমাবস্যার হাত-পা-মুখ বেঁধে পূর্ণিমার চাঁদকে ধর্ষণ করি।
স্বপ্ন নয়, ভালোবাসা নয়, বোধও নয়, কি যে কাজ করে, মাথার ভিতরে!
চল্লিশ থেকে সত্তরের প্যাখনা তো অনেক হল। নব্বইয়ের ম্যানিফেস্টো কি কেউ লিখবেন? ভুলভুলাইয়াতে বুড়ো হতে থাকা স্বার্থপর প্রজন্মের ইশ্তেহার?
৪ (Jul 1 2005)
পুনশ্চ রক্তকরবী
"ফাগুলাল। আর, ঐ দেখো, ধুলায় লুটেছে তার রক্তকরবীর কঙ্কন। ডান হাত থেকে কখন খসে পড়েছে। তার হাতখানি আজ সে রিক্ত করে দিয়ে চলে গেল।
বিশু। তাকে বলেছিলুম, তার হাত থেকে কিছু নেব না। এই নিতে হল, তার শেষ দান।"
একটা স্পষ্ট আভাস ছিল- নন্দিনী "শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড" বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে শেষের দিকে, শেষ লড়াই লড়তে। অবশেষে ফাগুলাল আর তার দলবলের পূর্ণ এবং সক্রিয় সমর্থন নন্দিনীর পিছনে। বিশুর গলায় "তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি"। কিন্তু অবাক কান্ড ছিল এই যে রাজামশাইও কাছকোঁচা খুলে নিজের মূর্তি ভাঙার দড়িতে টান মারতে দৌড়োলেন। নন্দিনী কি অমোঘ মস্তিষ্কপ্রক্ষালন যন্ত্র! অন্যদিকে বিপক্ষনেতা সর্দারের বর্শার আগাতে ঝুলছে নন্দিনীরই দেওয়া সাদা কুন্দফুলের মালা। এই অদ্ভুত লড়াইটা কী রকম হয়েছিল?
***
নন্দিনীদের জিত ছিল স্বাভাবিক। একে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিকদের লোকবল। তার উপর রাজতন্ত্রের যে মোটিফ দেখিয়ে ভয় পাওয়ানো যেত, রাজা, তার জাল, তার রহস্য- সব আজ ভেঙে চুরমার, ফেটে ফর্দাফাঁই। শাসনের ভয় দেখানো অযৌক্তিক চিহ্নগুলো হঠে গেলে কি আর শাসন বেঁচে থাকে? কিন্তু ঐ কুন্দকুসুমমাল্য কি সম্ভাবনা বহন করেছিল? হয় তো সেই মালা ছিল সন্ধির শ্বেতপত্র। অর্থাৎ, আইস, আমরা রফায় বসি। মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার খাতিরে এইটুকু রফা না হয় করাই গেল। শেষাবধি সবই তো বৃহত্তর স্বার্থের জন্য বলিপ্রদত্ত। কাজেই শাসনক্ষমতা হস্তান্তরিত হল। মুক্তিসূর্যের মশাল হাতে এগিয়ে চলা নন্দিনীদেবী স্বাভাবিকভাবেই নব্য শাসনতন্ত্রের শীর্ষবিন্দুতে। তবে "উন্নততর যক্ষপুরী' নয়, পুরোনো ধাঁচার খোলনলচে পালটে জনগণের রাষ্ট্র, জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। শ্রমিকেরা নাম বদলে জনগণ হল। নন্দিনীর পরিচয় "মাটির কন্যা' হিসেবে। যক্ষপুরীর অন্ধকার মরচে ধরা সুড়ঙ্গের মাঝেও স্বপ্নকল্পনাতে শুনতে পেত "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে'। অতএব, কৃষকদের কৌমভিত্তিক সমর্থন আরও জোরদার করার তাগিদে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের স্লোগান বহাল হল। আরও ছিলেন অধ্যাপক, যিনি সময়ে অসময়ে দু:সময়ে নন্দিনীকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছেন, কোনও কাজের কাজ না করা সত্ত্বেও। এই বিবিধ শ্রেণীর সমর্থনে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রের সংবিধানে "জনগণ" নামে এক নতুন পাঁচমিশেলি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্তি ছিল অনিবার্য। প্রাক্তন রাজার জায়গা কোথায় হবে, এ নিয়ে নন্দিনীর সঙ্গে ফাগুলালের মনোমালিন্য হয়। ফাগুলালেরা চেয়েছিল রাজার বিচার হোক জনতার দরবারে। কিন্তু ফাগুলাল ভুলে গিয়েছিল যে নন্দিনী রাজার মধ্যে "ঝড়ের আগেকার মেঘ" দেখতে পেত। সেই মেঘ যখন জল ঝরিয়ে সাদা পেঁজা তুলো, তখন তাঁকে বরিষ্ঠ উপদেষ্টার পদে বসাতে অসুবিধা কোথায়? ফাগুলাল হোলটাইমার, অর্থাৎ জনগণের সেবায় দিনরাত, বিশেষ করে রাতে, নিয়োযিত। প্রথমদিকে সর্দারদের হতোদ্যম চেহারা ছিল। ওনাদের বন্দী করা হয়নি কারণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাকামী রাষ্ট্রে রাজনৈতিক বন্দীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অন্য কোন ফোঁপরদালালির অবকাশ না থাকায় সর্দারদের ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছিল। কিছুদিন যেতে না যেতে বোঝা গেল, জনগণের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কিঞ্চিৎ শৃঙ্খলাও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা থাকার সুবাদে সর্দারেরা পুনর্বহাল হলেন। তবে অবশ্য স্মর্তব্য, পুনর্বহালের আগে তাদের জনসংযোগের তালিম দেওয়া হয়েছিল, অর্থাৎ অবরে সবরে পাড়ার ফুটবল ম্যাচ, দুর্গাপুজো কালীপুজোয় জোগাড়যন্তর, মাঝে মাঝে গণবিবাহ, গণভাইফোঁটা, কাঙালিদের কম্বলদান ইত্যাদি ইত্যাদি। কিশোরকে নিশ্চয় মনে আছে। যে কিশোর প্রতিদিন নন্দিনীকে ফুল দিয়ে যেত। কিশোরদের ক্লোনিং করা হয়েছে। এখন পাড়ায় পাড়ায় কিশোরেরা নন্দিনীদের রক্তকরবী দিচ্ছে। নিতে না চাইলেও "পবিত্র প্রতীক, লিবি না মানে!' বলে জোর করে দিচ্ছে। এ ছাড়াও তাদের অনেক কাজ। মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অতিপুণ্যস্মৃতি জনগণের মনে চারিয়ে দেবার জন্য কিশোরবাহিনী ঘরে ঘরে ডেরা বেঁধেছে। আর রঞ্জন? যে রঞ্জনের জোর "শঙ্খিনীনদীর মতো", যে রঞ্জন "হাসতেও পারে', "ভাঙতেও পারে'? তারে কি ভুলিতে পারি? তার চিতাভস্মের সামনে দাঁড়িয়েই তো নতুন রাষ্ট্রগঠনের শপথগ্রহণ হল। পাড়ায় পাড়ায় তার জন্য শহীদবেদী, তার ছবি সরকারী ভবনের ঘরে ঘরে। এমন কি কারাগারও তারই নামে। নন্দিনী কেমন আছে জানা বেশ শক্ত। সমস্ত কাজ "এখনই' করতে করতে আজকাল আর নিজের সামনে বসার সময় হয়ে ওঠে না। তার উপর প্রায়শ: ফাগুলালের আর বরিষ্ঠ উপদেষ্টার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে হয়। সামান্য সমস্যা বিশু পাগল। এমনিতে লোকটা এখন চুপচাপ থাকে। শুধু কিশোর যখন বড়ো দাঁও মেরে চুল্লুর নেশায় বুঁদ হয়ে অঝোরে কাঁদে আর হাতের কব্জি ব্লেডের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে, তখন বিশু পাগল তাকে কি সব উৎকট গান শোনায়। গানগুলোর কথা সুর শুনলে মনে হয় কিছু পাগলা নেকড়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। ফাগুর বউ চন্দ্রা বিশুর দেখাশুনা না করলে পাগলার বেঁচে থাকাই মুশকিল হত। কিন্তু পুরোনো কমরেডকে ভুলে থাকা কি সম্ভব? সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশুকে খুব শীঘ্র কোনো আকাদেমির চেয়ারম্যান বানিয়ে দেওয়া হবে। মোটের উপর, স্বাভাবিক সব লোকজনেরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই ভালো আছেন।
অথবা,
লড়াইটা হয়েছিল। বেদম লড়াই। যদিও শেষে সর্দারেরাই জেতে, কিন্তু এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পাতি চাবুক আর শেকলের জোরে শাসনশৃঙ্খলার দিন শেষ। প্রথম মরেছিল গোকুল। বড়ো সর্দারকে দেখে "হালা ইবলিশের পো" বলে ছুটে যেতেই কুন্দফুল জড়ানো মালা বুড়ো গোকুলের দেহ এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দেয়। দু পক্ষেই মরেছিল বেশ কিছু। শেষে সর্দারেরা বাধ্য হয় শ্রমিককল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে। এখন অন্ধকার সুড়ঙ্গের জায়গায় ঝক্ঝকে রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে স্ট্রিটলাইট। খনিশ্রমিকদের জন্য জীবনবীমা প্রকল্প চালু হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। রাজা মূহূর্তের ভুলে বিপক্ষে যোগ দিলেও সিংহাসনে আবার পুন:প্রতিষ্ঠিত। রাজবংশের রক্ত বলে কথা! তবে রাজা এখন বৃদ্ধ, জরাগ্রস্ত। জানলার পিছনে রক্তকরবীর মালা গেঁথে গেঁথেই বেশির ভাগ সময় কাটে। ফাগুলালেরা ইউনিয়ন করার অধিকার পেয়েছে। তবে খনি বন্ধ হবে বলে গুজব হাওয়ায় ছড়াচ্ছে। ফাগুলালেরা শংকিত। আগেই আঁচ করে চন্দ্রা একটা বিউটি পার্লার খুলেছে। সেখানে সর্দারনীদের ভিড় লেগেই থাকে। কিশোর আগুনের আঁচ নিভতে না নিভতেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। যক্ষপুরীর মেধা তহবিল থেকে তাকে মোটা টাকার জলপানি পাঠানো হয়। যদিও তার বেশির ভাগটাই ফেরত আসে ফাগুলালদের শ্রমিক ত্রাণ তহবিলে। বিশুর এখন খুব বোলবোলাও। বছরের পর বছর তার গানের গোল্ডেন ডিস্ক বেরোচ্ছে। শুধু ফাংশনে গাইতে ওঠার আগে সেই পুরোনো পাগলের ধড়াচুড়ো পরে নেয়। আগে এই ধড়াচুড়োতে একটা সংখ্যা লাগানো থাকত। সর্দারদের আপত্তি থাকাতে সেই সংখ্যা খুলেই ধড়াচুড়ো পরতে হয়। অধ্যাপক বরাত পেয়েছেন "যক্ষপুরীর ইতিহাস" লেখার। মেজ সর্দারের সভাপতিত্বে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি বইটির নিরপেক্ষতা বিচার করবে। ফাগুলালদের প্রতিবাদের পর সেই কমিটিতে একজন শ্রমিক প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। মেটেবুরুজের এক এঁদো গলিতে এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের ইশ্কুল চালান। বেশ রোগা, মুখে মেচেতার দাগ, চুকের একপাশ সাদা হয়ে গেছে। সক্কলবেলা সেই ইশ্কুলের বারান্দাতে এক অকালবৃদ্ধ লোক বসে রোদ পোহায়। লোকটার পাগুলো অকেজো, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, চোখেও ভালো দেখে না বোধ হয়। রাতের মরা চাঁদ যখন মেটেবুরুজের ভাঙা বস্তির মাদুরে এসে বসে, তখন সেই প্রৌড়া মূক লোকটির মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়। রেশন কার্ডে এই দম্পতির নাম নন্দিনী-রঞ্জন। কখনও কখনও বিলি কাটতে কাটতে গান গাইতে থাকেন-
"আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন তাহার গেল খুলে,
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন্ অচেনার ধারে।"
***
আখ্যাননির্মাণ তো রাজা-মন্ত্রী-গজ-বোড়েদের পারমিউটেশন কম্বিনেশনের গাণিতিক রোজনামচা। শেষে জনগণ যাহা চায় তাহাই পড়িয়া থাকে।
৫ (Jul 18 2005)
গানের শরীর, শরীরের গান
স্টেজের উপর রাজার রাজা জিম মরিসন। ভূতগ্রস্তের মতো পাগলা নাচ নেচে চলেছেন। মাইক্রোফোন শরীরের সাথে মিশে কখনও তীব্র যৌনাঙ্গতুল্য, কখনও আদিম রাজার ক্ষিপ্ত তলোয়ার। ছিপছিপে বেতসশরীরের প্রতি কোষ থেকে হঠাৎ হঠাৎ জান্তব আর্তনাদ। মৃত্যু ও অচেতনার কোনো গূঢ়মন্ত্র শ্রোতা ও দর্শকশরীর চারিয়ে যায়। কোনো বোধ কাজ করে। প্রবৃত্তি মথিত হয়। ঘোর কালো আকাশের নীচে সহস্র শরীর কথা বলে- "Come'n baby, light my fire"। জিম মরিসন সেই শারীরিক সঙ্গীতযজ্ঞের মহাপুরোহিত- কবিতা আর সুরের ভারে আচ্ছন্ন দেহে। অথবা জ্যানিস জপলিনের চুলের কালো চিতায় জ্বলে ওঠা উদ্দাম ছবি। জিমি হেনড্রিক্স স্টেজের উপর গীটার ভাঙেন। গীটার জ্বলে, আগুন জ্বলে, সময় জ্বলে। শিরায় শিরায় উন্মাদ রক্ত বয়ে যাওয়া শরীরে গান তৈরী হয়। গানের শরীর তৈরী হয়।
"আমি সূর্যের আগুন খেয়ে ফেলেছি,
আমি চাঁদের অন্ধকার খেয়ে ফেলেছি,
আমি দুই বিশাল ব্যারেজ খেয়ে ফেলেছি
আমি দেড়শো কবিতা খেয়ে ফেলেছি আমি ধুলোর মধ্যে বসে আছি
আমি স্রোতের কাছে গিয়েছিলাম,
স্রোত আমাকে ম্ত্যুর কথা বলল
বৃক্ষ আমাকে মৃত্যুর কথা বলল
চাঁদ, মেঘের পাহাড়, নীলিমা এবং নদী, প্রজাপতি
আমাকে মৃত্যুর কথা বলল
আ:"
অথবা ধ্রুপদে কিবা লোকায়তে.......
গম্ভীর সিম্ফনি নিক্তিতে মাপা। ছকেফেলা ধ্রুপদী অনড়তা। সেই অনড়তার মধ্যেই একদল ব্যালেরিনা আঙুলের পিয়ানোতে চকিত নাচের পরেই সারি সারি বেহালার তারে একঝাঁক পাখি উড়ে গেল। পরবর্তী নৈ:শব্দ্যের ক্যানভাসে একাকী নীল নদের মতো বয়ে যায় গম্ভীর চেলোতে ধীর কোনো বাহু। নির্বাক শরীর নিশ্চুপ বিভঙ্গে আঁকা হয় শব্দের ছবি, গড়ে ওঠে শরীরের সমান্তরাল সিম্ফনি।
পিটার ব্রুক টস্কানিনির শেষ কনসার্ট শুনতে গেছেন। ভেবেছিলেন দেখবেন চূড়ান্ত নাটকীয় দৈহিক উচ্চারণ, দ্রুতলয় শারীরিক ব্যাকরণ। অথচ সেই শীর্ণ প্রাজ্ঞদেহ প্রায় চিরস্থির। হাতের প্রায় অধরা সামান্য নড়াচড়া। "And he listened. He listened through the whole of his vibrant stillness and drew from the instruments an incredibly detailed, completely transparent texture of sound in which each thread was clear and present, each player being transformed way beyond his best." পিটার ব্রুক বিস্ময়াভিভূত। সারা দেহ কিভাবে শোনে? নাটকে এই নিশ্চল শ্রবণের ধারাপ্রয়োগে ব্যর্থ হলেন। এই নিশ্চলতা দীর্ঘ জীবনের গতিজাড্য থেকে আহরিত একান্ত রসদ। "For a body to be able to listen motionless, it must first be developed is movement. It is no coincidence that conductors live so long, as they spend their life constantly exercising and bringing in harmony body, emotion and thought."
দিল্লিতে নেহরু পার্কে, মে মাসে। নগরপালিকার সৌজন্যে প্রতি রবিবারে প্রভাতী রাগের জলসা। খোলা পার্কে ঢাকা মঞ্চ। সামনে বিস্তীর্ণ সাদা গদিতে দর্শক ও শ্রোতা। অশক্ত শরীরে পুত্রের হাতে ভর দিয়ে কোনোক্রমে ভীমসেন যোশী মঞ্চে উঠলেন। ললিত দিয়ে আসরের শুরু। অবসন্ন শরীরের ছাপ পড়েছে দাপুটে কন্ঠে। বাবু হয়ে বসতে পারেন না। স্টেজের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে গাইতে হচ্ছে। মে মাসের ভোরে বেশ গুমোট গরম। ললিতের পর আশাবরী টোড়ি। আকাশের দূর কোণে এক চিলতে মেঘ জমেছে। দ্রুতের বন্দিশ "ম্যায় তো তুমারো দাস"। বৃদ্ধের আর্তি ফিরে ফিরে ভরে দিচ্ছে নেহরু পার্কের সবুজ কোণা। সুরের রঙ্গোলিতে আঁকা হচ্ছে আকুতিধ্বনি "ম্যায় তো তুমারো দাস"। বুড়ো শরীরটার কোষ্ঠেপ্রকোষ্ঠে জন্মাতে থাকা স্বরের বিদ্যুৎ সবার রোমকূপ স্পর্শ করছে। "ম্যায় তো তুমারো দাস"। একটা সপাট তানের পরেই চোখ বিস্ফারিত, মুখ বিকৃত, হাত আকাশের দিকে উড়ে গেছে বসেরা খোঁজা নির্জন কবুতর। আকাশ ঘোর কালো। "ম্যায় তো তুমারো দাস।" আমি তো তোমারি দাসানুদাস হে প্রভু। মরশুমের প্রথম বৃষ্টি নামল দুরন্ত নাবালকের মতো। শেষের পাতে যখন চিরাচরিত "যো ভজে হরি কো সদা" শুরু হচ্ছে, দর্শক তখন তুরীয়ানন্দে প্রায় নৃত্যাকুল। এইভাবেও ঈশ্বরের শরীর সৃষ্টি হয়।
নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সুফীগানের আসরেও এই চূড়ান্ত সময় উপস্থিত হয়, যখন দরবেশের শরীর সুরের উলট্পালট্ ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। বেপরোয়া শরীরভোলা শরীরের নাচে দরদালান, মিনারগম্বুজ মহাপ্রলয়ের স্রোতে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আবিদা পরভীন যখন প্রায় ঈশ্বরী, গলার সাথে সাথে সঙ্গত করে তার হাত, চোখ, ভুরুর ভঙ্গিমা। নিপাট শান্ত সবুজ ধানক্ষেতের আলে, খেজুরগাছের তলাতেও বাউলশরীর ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে গান গায়। পায়ের আলতো ঘুঙুরের তালে তালে আর্শিনগরের নক্শিকাঁথা বোনা হতে থাকে। অথবা যেদিন অবাধ কীর্তনে পাগলা নাচ নাচতেন মহাপ্রভু, স্বেদস্রোতে ভিজে যেত আপাদলিঙ্গপা। নবদ্বীপের রাস্তা একদল বেনিয়মী খ্যাপার পদভারে থরথর কাঁপত, অন্ত:পুরবাসিনীদের পা কেঁপে উঠত ধুলোমাটিমাখা কীর্তনিয়া সুরে। পাশাপাশি ভেঙে গেল স্থবির ব্রাহ্মণ্য সংস্কার এবং সুলতানী অপশাসনের দ্বৈত দরোজা। জিম মরিসন নিজের জন্য, শ্রীচৈতন্যদের জন্য বলেন-
"A hero is someone who rebels, or seems to rebel, against the facts of existence and seems to conquer them, but obviously that can work at moments. It can't be a lasting thing....but that's not arguing that paeople shouldn't keep trying to rebel against the facts of existence.....who knows, someday we might conquer death....and disease and war...."
এবং অন্দরমহলে
সুচিত্রা মিত্রের গান যতটা শোনার, ততটাই দেখার। ঘাড়ের দৃপ্ত ওঠানামা, হাতের বলিষ্ঠ চলনের মায়ায় সেই গান চোখ দিয়েও শুনতে হত। অথবা দূরদর্শনের পর্দায় বুড়ো জর্জ বিশ্বাস। বন্ধুবর পরীক্ষা করলেন। টি ভির শব্দ বন্ধ করে শুধু দেখে গানের সুর ছন্দ অনুভব করতে হবে। এবং অনুভূত হল। গানের ভাব ফুটে উঠেছিল বুড়ো মুখের ক্লান্ত পেশীগুলির প্রত্যেক কুঞ্চনে সংকোচনে। কিংবা একমাথা সাদা চুলে ছোট্টোখাট্টো প্রতুল মুখোপাধ্যায় যার পুরো শরীরটাই কখনও কখনও গান হয়ে ওঠে। কিংবা দু পা সোজা করে দাঁড়ানো ক্রুদ্ধ চোয়ালে কবীর সুমনের নসরীন জাহান বা গ্রাহাম স্টেইন্স। সুর ভাষা ছন্দের বাইরে গানের শারীরিকতায় শ্রোতা ও দর্শক আলোড়িত হন, গায়ক গায়িকার শরীরের ভাষাতেও আমরা উন্মোচিত হই। কখনও কি ইচ্ছে করে না "আঁধার রাতে একলা পাগল" গাইতে গাইতে দুমড়ে মুচড়ে নুয়ে পড়ি, ছোটোবেলায় হারানো বটবৃক্ষের জন্য গোঙাতে থাকি "বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে", চোখের অন্য পাতায় ভাসে বিহারের অনাম্নী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা একলা অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়!
অত:পর দুইশ চৌতিরিশে ঘেমো শরীরে শিয়ালদহ থেকে
বাঙালির বৃহত্তম কনসার্টে কাঠপুতুলের চাবিটেপা গান। মহাপঞ্চকদের কড়া নির্দেশ- "চলো নিয়মমতে"। অতএব "গোধুলিগগনে মেঘে" এবং "হারে রে রে"- উভয়ক্ষেত্রেই শরীর একই ব্যাকরণের ভাষায় কথা বলে, অন্তত: দর্শকচোখে। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মধ্যবিত্ত মহলে মন নামক একটি বায়বীয় পদার্থের একচেটিয়া রাজত্ব। পাঁচফোড়ন দেওয়া ভাত-ডাল-মাছের ঝোলের মতই আমাদের সুরবিহার অতীব ভদ্র এবং স্তিমিত সাবেকী গন্ডীর কঠোর বিন্যাসে। এই অভ্যস্ত ছকের থেকে বেরিয়ে দুনিয়ার সাথে তাল মিলাতে আমরা বানাই মিউজিক ভিডিও। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় আমাদের শরীরশূন্যতা কি অসহনীয় প্রবৃত্তিতে রূপান্তরিত। কাঠপুতুলদের আরও বেশি বেশি করে পুতুল সাজানোর নক্হা চলে সাজানো নলবনে। সঙ্গীত পরিবেশনের দৃশ্যময়তার প্রতি আমরা উদাসীন। তাই চিরাচরিত নীল বনাতের সামনে স্থির বসে বা দাঁড়িয়ে, এক টুকরো মালা আর দু টুকরো ধূপের সমাহারে আমরা গান গাইতে থাকি। মধ্যবিত্ত শ্রোতারাও এই শারীরিক নৈ:শব্দ্য আত্মস্থ করেছেন। বিশেষত: উচ্চবর্গের জলসা হলে তো কোনো কথাই নেই। চারিদিক নি:শব্দ, বেহালা কাঁদিয়া যায় পাতে। পন্ডিত রবিশঙ্কর কলকাতায় বাজানোর পর বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন- শ্রোতারা হাততালি না দিলে বুঝব কি করে ভালো লাগছে কি লাগছে না? তবে এই অকালেও সেই নীল বনাতের সামনে কোনো স্থির অনামা দেহ থেকে যখন হঠাৎ সিন্ধুবারোঁয়ায় লাগে তান, মুহুর্তে বেজে ওঠে অনাদিকালের বিরহবেদনা, প্রণত হই। প্রণত হই শিল্পীর সামনে, প্রণত হই সুরের সামনে। তবুও ভাবি, কুসুমের কি শরীরও নাই?
(লেখাটির পদ্যাংশ স্বর্গত ফাল্গুনী রায়ের লেখা, পিটার ব্রুকের উদ্ধৃতি তাঁর আত্মজীবনী "Threads of Time" থেকে।)
৬ (Aug 16 2005)
কাসারগোড-বেকাল-নীলেশ্বরম
দুর্গের কঠিন প্রাকারের চারধারে বৃষ্টিভেজা সবুজ। পিছনে আবছায়া সমুদ্রে নেমে আসছে মেঘবৃষ্টি। সেই ভিজে যাওয়া কালো দুর্গের মাথায় বসে একটি যুবক- "তেরে বিনা ম্যায় ক্যায়সে জিউঁ"। মনে পড়ে? মণিরত্নমের "বোম্বে" সিনেমার সেই জনপ্রিয় গান আর তার চিত্ররূপায়ণ? এই গানের শুটিং হয়েছিল বেকাল দুর্গে। আরব সাগরের থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তিনশ বছরের পুরোনো দুর্গ- বিজয়নগর রাজবংশ, তারপর টিপু সুলতান আর শেষে ইংরেজের হাত ঘুরে এবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে। অবস্থান কেরলের উত্তর সীমান্তে কাসারগোদ জেলায়। পর্যটনের মানচিত্রে কেরালা মানে আলেপ্পেই-কোচিন-কুমারকোম ছুঁয়ে আরও দক্ষিণে নারকেল গাছে ছাওয়া ব্যাকওয়াটার্সের শিরায় শিরায় অলস কেত্তুভাল্লাম। বিদেশী পর্যটকের হিসেবে সারা দেশে কেরল দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও উত্তরতম কেরল পর্যটকদাক্ষিণ্যের হিসেবে অকিঞ্চিৎ। কর্ণাটকের দডইণ-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে টুক্ করে নেমে পড়লেই কাসারগোড জেলার শুরু। সতেরো নম্বর জাতীয় সড়ক ম্যাঙ্গালোরে থেকে আরব সাগরের কোল ঘেঁষে ভারতের দক্ষিণতম বিন্দুর দিকে চলেছে। এই জাতীয় সড়কের উপরেই ছোটো সদর শহর কাসারগোড।
ব্যাঙ্গালোরে থেকে কর্ণাটক সরকারী পরিবহণের বাসে এক রাত্রির রাস্তা। দক্ষিণ-পশ্চিম বরাবর কুর্গ অঞ্চল ছুঁয়ে পৌঁছয় কাসারগোডে। একত্রিশে ডিসেম্বরের রাত্রি। ব্যাঙ্গালোরে ডিসেম্বরের রাত্রিও নাতিশীতোষ্ণ। পরিচ্ছন্ন আন্ত:রাজ্য বাস টার্মিনাস- উত্তর বা পূর্ব ভারতের অসহনীয় নৈরাজ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। বছরের শেষদিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা। শুধু রেস্টুরেন্ট, বার আর ধাবাগুলোতে অবিরত টুনিমালার দপ্দপানি। রাত বারোটার সময় পথের ধারের এক গ্রামের গির্জা হঠাৎ আতসবাজির রোশনাইতে জ্বল্জ্বল্ করে উঠল। কর্ণাটক পরিবহণের পক্ষ থেকে সবাইকে দেওয়া হল একটি গোলাপ। মহীশূরে স্বল্প যাত্রাবিরতির পরে বাস ধীরে ধীরে কুর্গের পথে। রাতের অন্ধকারে ঢাকা পড়ে আছে কুর্গের বুক চিরে বয়ে চলা কাবেরী, বিস্তৃত কফির বাগান, উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢাল। বাস যখন ভোররাতে কুর্গের সদর শহর মাদিকেরিতে পৌঁছেছে, তখন বাতাসে রীতিমতো হাড়কাঁপানো ঠান্ডার কামড়। সূর্য ওঠার পর পশ্চিমঘাটের উপর দিয়ে চলা লাল মাটির রাস্তা। অসংখ্য নারকেলগাছ। হাওয়ার শীত-শীত ভাব কমে গিয়ে সমুদ্রের নোনা গন্ধ ভেসে আসছে। যাত্রীরা টুক্টাক্ করে প্রায় সবাই নেমে পড়েছে। কাসারগোড বাস`আড্ডায় বাস যখন পৌঁছল তখন বাস প্রায় পুরো ফাঁকা।
ছোটো গঞ্জশহর কাসারগোড, কেরলীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘনবসতি। সড়কের দুধারের আলিশান ঘরবাড়িতে মধ্যপ্রাচ্যের পয়সার ছাপ স্পষ্ট। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে "দুবাই শপ" কি "শারজা স্টোর্স"। বাসঅড্ডায় বেশ কলকাতা-কলকাতা ভাব। দেওয়ালে দেওয়ালে সিটু, সি পি এম, আর এস পির রক্তিম বিজ্ঞাপন। কর্মচারীদের বেশ পোড়খাওয়া সরকারী সংগ্রামী চেহারা। এই ভোরে বাস`আড্ডায় কর্মচারীরা আর কিছু বেওয়ারিশ কুকুর। দোকানপাটের ঝাঁপ খুলতে বেশ দেরী আছে। থাকার জন্য যেতে হবে নীলেশ্বরম- কাসার্গোড থেকে আরও প্রায় এক ঘন্টার রাস্তা। ভাষার অসুবিধা বড়ৈ তীব্র। তবে আকারেইঙ্গিতে নীলেশ্বরম যাওয়ার অভিপ্রায় বোঝালে একটু আধটু হিন্দি ও ইংরিজিভাষে এক গাড়িচালকের খোঁজ মিলল। বেকাল দুর্গ কাসারগোড আর নীলেশ্বরমের মাঝামাঝি জায়গায়। নীলেশ্বরম একটি নদীর নামও বটে। সেই গাছে ছাওয়া নদীর কোল ঘেঁষে টালিতে ছাওয়া লাল পাথরের দেওয়ালে ঘেরা ছোটো ছোটো কটেজ- নালন্দা রিসর্ট। কেরলের রিসর্টকুলের ঊর্ধ্বগামী মূল্যতালিকার সর্বনিম্ন শ্রেণীতে, অথচ স্বাভাবিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কমতি নেই। রিসর্টের অন্যপাশে সতেরো নম্বর জাতীয় সড়কে দিনরাত গোঁগোঁ লরিবাস। তবে নিজের ছাউনিতে ঢুকে গেলে সেই সব শব্দ আর শোনা যায় না। খাওয়ার ব্যবস্থা নদীর ঠিক ধারেই লাল টালি ছাওয়া খোলামেলা এক বিশাল মন্ডপে। খাওয়াদাওয়ার মধ্যে সনাতনী কেরলীয় ভাব সুস্পষ্ট- গোল গোল সিদ্ধ চালের ভাত থেকে মশলাদার মীন মইলী পর্যন্ত। শুধু নারিকেল তৈলে ভাজা পমফ্রেট কেমন কেমন ঠেকে। শুধু মার্ক্সবাদ আর মাছবাতই নয়- সিদ্ধচালের ভাত খাওয়াতেও কেরল-বাংলা ভাই-ভাই। ভারতের বাকি অংশে আতপচালেরই বেশি চল। তবে সুধীজনে চাইলে অন্য ব্যবস্থাও মজুত।
দুপুর গড়াতে না গড়াতে যাত্রা বেকাল দুর্গের দিকে। সমুদ্রের থেকে থাকা এই দুর্গে শৌখীন স্থাপত্যের ঝিকিমিকি নেই। এক করুণ কাঠিন্যে ঢাকা কালো পাথরের বিরাট দেওয়ালগুলো নিষ্পলক সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি, রোদ দুর্গের গাঁঅথনিতে সহজে মিশে গিয়েছে। এখানেই বেশ কিছু ট্যুরিস্টের গতায়াত দেখা গেল। দুর্গের প্রাচীরে উঠে চোখ মেলতেই সামনে বিশাল আরব সাগর। নীচে একফালি চাঁদের মতো বেকাল সৈকত ছড়িয়ে রয়েছে। প্রাছের থেকে চোখ পড়ে সৈকতের অনতিদূরে ভাসতে ত্হাকা অসংখ্য ছোটো ছোটো জেলেনৌকায়। পাঁচিলের মধ্যে একফালি সুড়ঙ্গের মতো জায়গা। সেই সুড়ঙ্গ পেরিয়ে এবড়োখেবড়ো পাথর বেয়ে নীচে নামলেই সমুদ্রসৈকত। স্থানীয়ে কলেজের ছেলেরা সমুদ্রস্নানে মত্ত। সূর্যের ডোববার সময় হয়েছে। বহু রক্তের সাডঈ এই দুর্গের এক কোণায় ঝুঁকে পড়েছে এক বিশাল অশ্বথ্থগাছ। সেই গাছের এলোমেলো ডালপালার পিছনে গোধূলির সূর্য অস্ত গেল।
পরের দিনের গাড়িচালক কিছু বলবার আগেই নিয়ে হাজির এক নারকেলবাগানে।নারকেলবাগান থেকেই শুকনো মাছের তীব্র গন্ধ। ছোটো আর এক সমুদ্রসৈকত। নির্জন। সামনে অকূওল সমুদ্র। অন্যপাশে বিশাল খাঁড়ি। খাঁড়ির ওপারে ঘন সবুজের ভিড়। তিন্দিক ঘিরে আছে জল। মাঝে মাঝে মাছধরার ছোটোখাটো মোটোরবোট খাঁড়ির উজান বেয়ে চলেছে। নরম বালির উপর ভুর করে রাখা শুকনো মাছ আর জেলেদের জাল। পিছনের নারকেলবাগানে এক জেলেদম্পতি খোশমেজাজে বৈকালিক বিশ্রম্ভালাপরত। এ ছাড়া ত্রিসীমানায় লোকজন নেই। গাড়িতে বসার পর বোঝা গেল গাড়িচালক কিছু বলার আগেই কেন এখানে হুট করে নিয়ে এসেছিল। মালয়ালম ব্যতীত অন্য কোনো ভাষাবোধ শূন্য। কাজেই কোনোরকম কথাবার্তার ঝামেলাতেই যেতে চায় না। পরিকল্পনা ছিল হোসদুর্গ সৈকতে যাবার। এতদিন ধরে ডাম্ব শারাড খেলার সমস্ত কলাকৌশলও ব্যর্থ হল। নৃত্যমুদ্রা দিয়ে, ছবি এঁকে, চালক্ককে সমুদ্রসৈকত বুঝাতে ব্যর্থ। অতএব তিনি আমাদের নিয়ে ফেললেন হোসদুর্গে স্বামী নিত্যানন্দ প্রতিষ্ঠিত নিত্যানন্দাশ্রমে। এই আশ্রমে নাকি পঁয়তাল্লিশটা গুউহা আছে। খুঁজে পেতে কুড়িটার বেশি বেরোলো না। স্থাপত্যও বেশ কঠোর। মোটা মোটা দেওয়ালের রং কালো হয়ে এসেছে। দাঁড়িগোঁফওয়ালা এক বাবাজী আমাদের দেখেই এক লম্ফে টক্ করে এক গুহায় ঢুকে ধ্যান করতে লেগে গেলেন। আশ্রমের মূওল মন্দিরে তখন বেসুরো কীর্তনগান শুরু হয়েছে। পুনরায় চালককে আমাদের উদ্দেশ্য বোঝানোর পালা এবং ব্যর্থতা। অতএব হাল ছেড়ে দিয়ে চালকের হাতেই নিজেদের সমর্পণ করা গেল। তার ফলে তিনি আমাদের নিয়ে চললেন জাতীয় সড়কের যে দিকে সমুদ্র তার ঠিক উল্টো দিকে। পৌঁছে বুঝলাম চালক আমাদের বড়ৈ অধ্যাত্মভাবাপন্ন ঠাউরেছেন। এ আর এক অন্তুন আশ্রম- আনন্দ আশ্রম। বিশাল চত্বর ঢাকা গাছগাছালিতে। আশ্রমের আঙিনায় বাবাজীরা নেই। তার বদলে বহু অবস্থাপন্ন বৃধ্বৃদ্ধার ভিড়। এখানেও কীর্তনের আসর বসেছে। তবে কীর্তনের সুর অনেক পাকা, বনিয়াদ অনেক পোক্ত। অধার্মিক অধমও সুরেরে চলনের জোরে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। কাজেই থমকে দাঁড়ানো গেল। পাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল সন্ধ্যার হাস্নুহানার সুবাতাস। আশ্রমবিলাস সাঙ্গ হলে দুদিনের বাসায় ফেরার পালা।
মদ্যপ বলে কেরলীয়দের খ্যাতি আছে- লোকবিশেষে সু বা কু। এক কেরলীয় বন্ধুর মতে কেরলে যে কোনো আনন্দমূহুর্ত উদ্যাপনের ছূড়ান্ত উপায় অন্ধকার পানশালার আরও অন্ধকার কোণে বসে নিভৃত মদ্যপান। সামাজিক দু:খবিলাসের এই বর্ণন শুনে সদাভেজা বাঙালী মনে কেমন এক কমরেডীয় অনুভূতির উদ্রেক হয়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, কেরলে শিক্ষার হারও বেশি, আবার আত্মহত্যার হারও বেশি। কাঠখোটারা বলেন এ নাকি শিক্ষিত বেকারত্বের ফল। আমি বলি- শিক্ষার দরুণ অনুভূতির উচ্চমার্গে না পৌঁছাতে পারলে দু:খ, মৃত্যু জাতীয় বিষন্ন ব্যাপারের নাগালে এসে পৌঁছয় না। অতএব পানশালায়। সত্যিই অন্ধকার, সত্যিই কোণে কোণে একাকী আত্মাদের নিশ্চুপ অথচ মনোযোগী মদ্যপান। গোঁ গোঁ করে চলা এ সির দাপটে হু হু ঠান্ডা। ব্যাঙ্গালোরের আদেখলা শিশুদের উচ্চৈ:স্বরে তান্ডবনিনাদে মুখরিত পাবের তুলনায় এই পানশালা স্বর্গীয় এবং শস্তা। পানীয়ের অর্ডার দিতেই পানীয় এল, আর তার সাথে এল নেবুর আচার। নেবুর আচারের চাট দিয়ে মদ্পান ভারতের অন্যান্য অংশের লোকজনের কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হবে। আমার পাশে বসা এক মক্কেলকে দেখলাম। তর্জনী দিয়ে লেবুর আচার তুলে জিভে মাখিয়েই অন্য হাতের দুই আঙুল দিয়ে নাক চেপে সট্ করে এক গেলাস নামিয়ে দিলেন। তারপর পাঁচ মিনিট বিশ্রাম। অন্ধকারেও স্পষ্ট মুখে চেশায়ার বিল্লির হাসি দেখা গেল। এই নির্ঝঞ্ঝাট নেশার স্টাইল পরম শান্তিময়। অত:পর নীলেশ্বরম নদীর তীরে ঘাসের গালিচায় শুয়ে শুয়ে ভারতের দক্ষিণ আকাশের তারা গোনা।
ফেরার দিন চালক হিন্দিতে সুপটু। নিয়ে গেলেন কাপ্পিল সমুদ্রসৈকতে। বেকাল দুর্গ থেকে মিনিট দশেকের রাস্তা। সৈকতের অর্ধেক ছাপিয়ে গেছে তীব্র বেগুনী ফুলের গুল্মে। জল থৈ থৈ এক খাল প্রায় সমুদ্রকে ছুঁয়েছে। মধ্যে শুধু এক ছোটো বালির চড়া। দিগন্তবিস্তৃত বালির গালিচা। তার উপরে হুম্ড়ি খেয়ে পড়েছে বিশাল প্রাগৈতিহাসিক পাথরের দল। এখানে সমুদ্র আরও গম্ভীর, গর্জন আরও কান ঝালাপালা করা। বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সমুদ্র। অথচ পিছনে ফিরলেই খালের টল্টলে নীল জল বহু দূরে চলে গেছে। দুইপারে অতিঘন নারকেলের সবুজ বনে সামুদ্রিক হাওয়ার অহেতুক মাতলামি। এবং কোথাও কেউ নেই। নিরবিচ্ছিন্ন প্রকৃতির অক্লান্ত অস্তিত্ব। মানুষের উপস্থিতিতি নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। সমুদ্রের নোনা জল গায়ে মেখে এবার ফেরার পালা। আবার কাসারগোড বাস`আড্ডায়। কেরল পরিবহণের মুরুব্বিরা খুব করে বোঝালেন যে কর্ণাটক পরিবহণের বাসে আরাম বেশি হলেও কেরল পরিবহণের বাস আরও ভালো কারণ ইহা অতীব শস্তা। বাস যায়ও অন্য রাস্তা ধরে। উত্তরে ম্যাঙ্গালোর পৌঁছে আবার পূর্বদিকে ঘুরে ব্যাঙ্গালোরে। ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পরে ভিড়ে ঠাসা বাস চলার শুরু। তথ্যপ্রযুক্তির জঙ্গলের দিকে।
বিদায় কাসারগোড। আবার অন্য কোনোদিন এইখানেই।
৭ (Sep 1 2005)
দেসের কতা
আরেট্টা পোনেরোই অগাস্ট এসে পুঁই কোরে চোলে গ্যালো। বোঁচাবুঁচিরা "ধনোধান্যে পুস্পে ভরা' গেইয়ে গেইয়ে পোড়াচোকে আঁসু বৈয়ে দেলো। বাবুবিবিরা নাড্ডু আর বানরুটি বিলিয়ে দেসের জন্যো চিন্তা কোত্তে নেগে গেলেন। সে কত্তো চিন্তা! কেউ বলেন- ওরা তোমার জমিন লেবে, তোমরা ওদের অক্তো দেবে। কেউ বলেন- আমলাশোলে অক্ত নাই, আমরা কোতায় অক্ত পাই! আবার কেউ কেউ আরও কোটিন কোটিন ব্যাপার ভাবতে নেগেচেন। এই ধরেন- এক কেলাস থিকে বাংলা না পোল্লে কেন্দের রাজোস্সো ঘাটতির উপোর তার কি পভাব? কিম্বা ধরেন- হ্যারী পটার পোল্লে কি কেন্দো-রাজ্যো সম্পোক্কের উন্নোতি হবে? কে আবার সিদিন বোল্লো- জয়বাবু যোদি কোবিতা ছেড়ে পবন্ধ লেকেন, তাইলে ভারোত-বাংলাদেশ বডারে পবলেম সল্ভ হইয়ে যাবে। উ সব দেকেশুনে ভুতুমের মোনেও দেসোপ্পেমিক হবার শখ চাউড়ে চাউড়ে উটচে। ভুতুমের গুরুদেবও বোল্লেন- "বাবুবিবিরা দেসের কতা ভেবে ভেবে দু চোকের পাতা অ্যাক কোত্তে পাচ্চেন না, আর গুয়োর ব্যাটা ছাতিমগাছে চোড়ে ন্যাজ ঝোলাচ্চে! যা। গিয়া পাচ পয়েন লিকে আন- দেসের কি কোরে উন্নোতি হোতে পরে।' গুরুর আদেশ শুনে ভুতুম অনেক ভেবেচিন্তে পাচটা পয়েন লিকে আনলো।
এক লম্বর: সেজেগুজে বেরিয়েচো তো পাড়ার মোড়ে বঙ্কা দাঁইড়ে আচে। মুকখানা ছুঁচোর মতো গোল কোরে রেকেচে। ঠোঁটের ডগায় একদলা থুতু। ভাবতেচে সামনের পোশ্টারে পোসেনজিতের গলার লকেটে টিপ কোরবে নাকি রিতুপন্নার বেলাউজে টিপ কোরবে। তুমি আর এগুতে পারো না। যেই এগুতে গেলে, ওমনি থপাস। কিম্বা অটোর কিনারে একটেরে হোয়ে কোনো রকোমে পেছুন ঠেকিয়ে রেকেচো। সামনের বাসের জানলা দিয়ে পচাবাবু গোলা ছুঁড়লেন- থপাস। খানিকটে ছিটকে লাগলো তোমার জামার আস্তিনে। দেসের নোকেদের মুকে অ্যাতো অ্যাতো থুতু কোথ্থেকে আসে ভেবে ভেবে ভুতুম থ হইয়ে যায়। আপিসে আপিসে ঠাকুদ্দেবতার ছবি নাগিয়ে রেকেচে। আযা কোরিস, থুতু ফেলিস নে বাপু। কে কার কতা শোনে! দেসের বেওয়ারিশ রাস্তা ঘাট রোয়েচে কি কোত্তে! আপনা মাল রাস্তে মে ঢাল। পানু সোন্দেবেলার ফাংশানে ঞ্ছও আমার দেসের মাটি' গেইয়েই প্যাচাৎ কোরে মোক্ষম একদলা ফেললো দেসের মাটির বুকে। মুয়ে পান থাক কি না থাক, পাচ মিনিটে একবার থুতু না ফেললে নোকের শরীলে ক্যামোন আইঢাই কোত্তে থাকে। সায়েবরা ক্যানো আর এ দেসের নমে কুচ্ছো গাইবে নে, যকোন দেসের সবাই মিলে দিনরাত থু: থু: কোত্তে নেগেচে।
দু লম্বর: কারু বাড়ি সোন্দেব্যালা দজ্জা ঠক্ঠকিয়েচো তো আশি ডেসিবেলে- "ক্যা? কি চাই?' রোবীন্দ সদনে ক্যালান্তবাবু যেই গুচিয়ে গান ধোরেচেন ওমনি পেছুনে সোত্তোর ডেসিবেলে মোবলিতে "ধুম মচা লে'। সে আবার পোতি সেকেন্ডে পাচ ডেসিবেলে বাত্তে থাকে! তাপ্পর ফোন ধোরে আবার সোত্তোর ডেসিবেলে- "কি গো? তাই নাকি? আমি কদুপিসিকে আগেই বোলেছিনু তোমার ছোটোপিসির বড়ো খুত্তুতো ননদকে অতো পাত্তা দিও নি। কিন্তুক সদুপিসির সেজোমামার কতা শুনেচো তো...' হোয়ে গ্যালো! রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স মোবাইল:! রাত্তিরে ঘুমুতে যাবে তো তলার গ্যারেজে মিস্টার তলাপাত্তোরের গাড়ি পেছুনে "সারে জাঁহা সে আচ্ছা' বাজাতে বাজাতে ঢুকচে। যে কোনো ডেরাইভার সামনে হরন পেলেই মোনের সুকে টিপতে থাকবে। আর মিটিন মিচিলের কতা তো আর বোললেম নে। পাড়ার হারানদার গলা শুনলি মোনে হয় হাঁড়িচাচার গলায় টনসিল হোয়েচে। কিন্তুক ভোট এলে তাই নিয়েই মাইকে সি কি চিল্লানি! এর পরেও রোয়েচে শোনিপুজোতে "এ আমার গুরুদোক্খিনা', পাশের বাসার বৌদির রোজ সোন্দেব্যালা সন্ধ্যার মার সাথে ঝগড়া, রাত হোলেই বোস্বাবুদের ঘরে ক্যাঁ ক্যাঁ কোরে "কিউঁ কি...', "... একদিন পোতিদিন', পাসের হোরিসবার বাহাত্তোর ঘন্টা ননিস্টপ সংকেত্তন, ববির মারুতি গাড়িতে গাঁক গাঁক কোরে "মা-কা-রে-না'। ভুতুম যে এট্টু শান্তিতে দেসাত্তোবোধোক গান শুনবে, তার উপায় কি কেউ রেকেচে? অ্যাত্তো অ্যাত্তো শব্দো শুনে ভুতুমের কানে একন তাই কোনো কতাই ঢোকে না। আমাদের চুমু ও বাতকম্মো থেকে কান্না- সবই পয়ঁষট্টি ডেসিবেলের উপর। তাই ভুতুম ছাতিমগাচে ন্যাজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুকনো মুলো চিবোয়।
তিন লম্বর: ল্যাম্পোস্টেরও দরকার লাই। একখান খোলা জমি কি নদ্দমা পেলেই হোলো। ছ্যড়ছেড়িয়ে শব্দো, চারিদিক লি:শব্দো! বাইরের দেশ থেকি ঘুরে এসে যেই এয়ারপোট্টে পা রাখবে, ওম্নি একখান গন্দো নাকে এসে বদাম্ কোরে ঘুঁষি মারবে। চোতুদ্দিক আমরা ভিজিয়ে রেকেচি। এই ভিজিয়ে রাকেন যারা, তারা নিজেরাও কিন্তুক ভিজে বেড়াল। এরম অ্যাক ভিজে বিড়েলকে দেকেচিলুম আপিসের টাইমে শিয়ালদা ইস্টিশনের দু নম্বর পেলাটফর্মে দুই কামরার মাজে দাঁড়িয়ে ডিউটি দিচ্চেন। আর একজোনকে দেকেচিলুম যিনি এই কম্মে মহাপ্পোভু। হোরিদ্দারের গঙ্গাতেই এক্কেরে .. দোকানদারেরা ঘেঁটি ধোরে না নিয়ে গেলি কি যে হোতো! ভুতুমের গুরু বলেন- আমরা সব মাটির মানুষ। ভুতুম বলে- আমরা সব জলের মানুস। বিলেতে গিয়ে ওয়েলথ্যামস্টো ইস্টিশনের বাইরে বেরিয়ে ভুতুম দেখে এক স্যাঙাৎ বিলিতি ল্যাম্পোস্টের পাশে দাঁইড়ে আপিসের কোটপ্যান্ট পোরেই এক্কেরে ছ্যাড়্ছ্যাড়্। ভুতুম ভাবে এ লিচ্চয় আমার দেসের নোক গো! মুখ ফিরুতেই- আ মোলো যা! এ তো জ্যান্তো একখান লালমুখো সাহেব গো! সিদিনকে ভুতুমের মোনে যে কি আনোন্দোটাই না হোলো! গিয়াছে রাজ, দুক্হু নাই, আবার তোরা মানুষ হ।
চার লম্বর: আপিসে খেটেখুটে, বাড়িতে ভাজাভাজা হোয়ে দুখীবাবুর লরম শরীলে বড়ো বেদ্না। ডাগ্দার বোলেচে এক্সাসাইজ কোত্তে। তাই দুখীবাবু রাস্তাতেই যতোটা পারেন সেরে ন্যান। রাস্তা পেরুবার জন্য মাটির তলা দিয়ে একখান রাস্তা কোরে দেওয়া হোয়েছে। কিন্তুক দুখীবাবু ও সবে লাই। উনি দুইখান ট্যাস্কিকে ডজ কোরে, একখান মিনিবাসরে ছোট্টো ড্রিব্ল কোরে, দোতলা বাসের পেছুনে কান্নিক মেরে রাস্তা পেরুন। তাপ্পর কলিগের ছেলে বাসচাপা পোড়ে মোরে গেলে ক:পু:রে শুয়োরের বাচ্ছা বলে খিস্তি মারেন। সামন্তস্যারের এরম কোনো পবলেম নাই। ওনার নিজের গাড়ি আছে। বাড়িতে কম্পুটার আছে। তাতে সামন্তস্যারের পোঁয়াপাকা ছেলে দিনরাত বাঁই বাঁই কোরে গাড়ি চালায়। সামন্তস্যারকে ধোত্তেও দেয় নে। তাই সামন্তস্যার নিজের গাড়ি নিয়েই রাস্তায় খেলু খেলু করেন। লাল লাইট পেরিয়েও যোদি পুলুশ না ধরে তাইলে পাঁচ পয়েন। বাঁ দিকে দিয়ে টেরাককে ওভাট্টেক কোল্লেই দশ। গাড়ির লেনকে কলা দেকিয়ে যদি গলির মোড়ে জ্যামের কেচ্ছা বাঁদিয়ে দেওয়া যায়, তাইলে তো পোনেরো পয়েন বাঁধা। এ ছাড়া আরও খেলা আচে- ধোঁয়া ধোঁয়া খেলা, হরন হরন খেলা, খিস্তি খিস্তি খেলা। দশ্শোকের আবার খেলার মাঠে লামতে লাই। তাই ভুতুম ছাতিমগাচে বোসে দেখে আর সিটি মারে।
পাচ লম্বর: টেরেনের লাইনে দাঁড়িয়েচো- নম্বা লাইন। উশ্কোখুশ্কো কাকু সাম্নে ঘুর্ঘুর্ কোচ্চে। যেই মোনে হোলো কেউ দেকচে না, ওমনি পাত্লি গোলিতে সাইড মেরে- "দাদা, একটা শিমুরালি...'। কিম্বা মুদীর দোকানে ভিড়ের মোদ্যে দাঁড়িয়ে আচো। হটাৎ বিষ্টুদাদু পাজ্জনের পা মাড়িয়ে, কারুর বগলে খিমচি কেটে হাঁক পাড়বেন- "রামু, দুইখান লালসুতো দে তো দেখি।' তোমার মিন্মিনে গলা আর রামু ওবদি পৌঁছোয়ই না- "আমি, কিন্তু আগে, মানে, ...।' তবে এ নিয়ে ভুতুম বেসি কমপ্লেন করে না। জোর যার লাইন তার। চাগরি বাগরি, হাঁসপাতাল, ইশ্কুল কালেজ- সব জায়গাতেই ভুতুম এ দেকে আসচে- সালা আমার ভোগ্নীপোত এল সিতে আচে, সেই কানেক্সনে আমার হোয়ে গ্যাচে। বেসি পিতিবাদ দ্যাখাতে এলে হড়কে যাবে মামু! তাই টিরেনের লাইনে, কি দোকানের লাইনে, কি পাসপোটের লাইনে যখোন কেউ কনুই মেরে এগুয়ে যায়, ভুতুম রা কাড়ে না। ঠিকঠাক লইন মাত্তে না পাল্লে সুনাগোরিক হবি কি কোরে রে পাঁচু?
এ সব আলফাল লিকে ভুতুম যেই গুরুদেবের কাচে গ্যাচে, গুরুদেব তো খোচে দিদি- "শুয়ার, তোমারে কী লিখতে কইলাম আর কী লিখ্যা লইয়া আইলা? না আসে কুনো সাম্রাজ্যবাদী সক্রান্ত, না আসে বিরোধীদের উপর অইত্যাসার কি আইন-শিরিঙ্খলার অবোনতি, না আসে পাশ্চাইত্যের অন্ধো অনুকরোণের বিরুদ্ধে পতিবাদ। এমন কি ইলিশমাসের আমদানি লইয়াও কিসু কস নাই। যা হালায়, এই ল তর মুলো আর গামসা। সাতিমগাসে বইয়া সাবা আর পিড়িক পিড়িক কইর্যা সিটি মার। আর একবার দ্যাশের কথা কইসস নি কি তুমার একদিন কি আমার একদিন!'
৮ (Sep 19 2005)
স্বগত
কাঁদতেও ভয় হয় রে সোনা! আমরা সবাই পুরোপুরি সভ্য হয়েছি। লোকজনের সামনে পুরুষের চোখের জল সভ্য সমাজের প্রায় নিয়মভঙ্গের মতো। তাই রাত্রিবেলা শহরের হিজিবিজি আলো যখন আকাশকে দব্দবে লাল করে রাখে, বাবারা ঘাড় গুঁজে চোখের জল পকেটে করে গাড়ি চালিয়ে কি বাসে করে বাড়িতে ফেরে। অনেকের চোখের জল কবেই শুকিয়ে গেছে! সোমত্ত আপিসবাড়িগুলো ন্যাংটো কাঁচ-স্টিল-কংক্রিটের গতর দেখায়। ঘোর রাতের ফ্লাইওভারের উপর কদাকার কাকেরা জড়ো হয়ে শিয়ালের ডাক ডাকে। কাল দুপুরবেলা পরিত্যক্ত ফাঁকা রানওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটা বছর তিনেকের বাচ্চা "মা মা' বলে হাপুস কেঁদেই যাচ্ছিল। সুব্বু প্রোজেক্ট মিটিঙে বসে নিজের হাতের রেখা দেখতে থাকে- পয়ঁত্রিশে কালযোগ নাকি অবধারিত। অরভিন্দ ছ মাস হল ঘরছাড়া। কাজ শেষ হলে বিকেলে একা একা চিল্ড্রেন্স পার্কে গিয়ে সময় কাটায়। রাত্রে শুদ্ধবস্ত্রে পূজাশেষে আরও বিশুদ্ধ নীলছবি দেখে রাত কাটায়। সুতনুর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মহত্যার বীভৎস গল্প পড়া। এইভাবেই তোরা বড়ো হয়ে উঠিস আর তোদের বাবারা আরও বড়ো মানুষ, আরও কাজের মানুষ হয়ে ওঠে। শেষে মদনদার মতো কোনো কোনো বাবা মেলে আর ফোনে মেয়েদের উত্যক্ত করে আর তার ছোটো মেয়ে দুটোর সেরা ছাত্রী হিসেবে কাগজে নাম ওঠে। এই মহাজটেও এতো সমান্তরাল রেখা! কেউ কাউকে না ছুঁয়ে হেঁটে চলে যেতে থাকে। একে বুঝি হেঁটে যাওয়া বলে!
অথচ কথা ছিল সক্কাল সক্কাল তোকে নিয়ে কুয়াশা ঘেরা বড়ো রাস্তায় ভারত সুইট্সের কাঠের বেঞ্চিতে বসে বাসের নাম্বার দেখিয়ে সংখ্যা পরিচয় করাব। অথচ কথা ছিল তুই যাত্রা দেখতে যাওয়ার বায়না করলে "ঐ ভূত বাপ রে' লিখতে বলে নিজের পাশে বসিয়ে রাখব। অথচ কথা ছিল লোড্শেডিঙের রাতে তারা তারা আকাশের নীচে বসে তিনজনে গান গাইব। মায়ের গন্ধ নিয়ে যখন বড়ো হয়ে উঠলি, বাবাদের গায়ের সেই অদ্ভুত গন্ধই মিলিয়ে গেল। এ সি ঘর, মিটিং আর রিপোর্টের মধ্যে মাথা ঘষতে ঘষতে মাথা নিচু ঘোলা চোখ একদল মানুষ হয়ে গেল বাবা। তারা টাকা রোজগার করল, তোদের ইশ্কুলে পড়াল, দামী দামী খেলনা কিনে দিল, গাড়ি কিনল, বাড়ি কিনল, ধুমধাম করে বিয়ে দিল। কর্পোরেট কি সরকারি ছেনালির পয়সায় ঘরদোর উথলে উঠল। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক?
শুধু পারল না জোর গলায় শক্ত পায় নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছাতে চালাতে। যার গলায় নামত বর্ষার মেঘ, তার মগজে মগজে ঘোরে পলিসি সার্কুলার, ফাইল নাম্বার আর বড়ো আমলাদের তদ্বির। যে ছেলেটার হাতে ঝরত রঙের চোদ্দোপার্বণ, সে চাবির পর চাবি টিপে ঝক্ঝকে ভারত বানাচ্ছে। বিপ্লবী বাবাদের বিপ্লব ব্ল্যাকবোর্ডে আর পে কমিশনের রিপোর্টে। আর যে সমস্ত অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল? দস্তুরমতো হোমরা চোমরা সি ই ও। সফল বাবাগণ এইভাবেই শ্মশানের দিকে দৌড় মারছে অথবা বস হুড়কো দিলে বাথরুমে ঢুকে লুকিয়ে গালাগালি দিচ্ছে। প্রকাশ্যে খিস্তি মারলে জর্জ বুশ, ভারত সরকার, রাজনীতিবিদ বা রাহুল দ্রাভিড়। আর মাঝে মাঝে ছোবল মারে নিজের ঘরগেরস্থিতে বা সহকর্মীদের। নেটওয়ার্ক বজায় রাখা চাই, নিজের মার্কেটিং করা চাই- কম দায়িত্ব! আর এই সব না করলে বাবারা মূল দায়িত্ব পালন করেই বা কী করে- ইশ্কুল, খেলনা, টিউটর, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিয়ে, এবং অনন্ত ইলিউশন।
এইভাবেই সোনা, সরীসৃপ যুগ কেটে যাবে। কেই বা ধ্বংস হতে চায়? সরীসৃপ মাটির তলায় তলায় দুর্গ বানাতে থাকে। সেই দুর্গের কোটরে কোটরে সুতনু, সুব্বু, অরভিন্দ, মদনদা। ডিস্ফাংশনাল মগজে দু ছটাকের বেশি স্বপ্নও ঢুকতে চায় না। তার উপরে আবার প্রার্থনার নামে রোয়াব- আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক? এর পরেও তোরা কাঁদবি, বাবাদের ছবি টাঙিয়ে রাখবি আর সফল বাবাদের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হবি। মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা শীতল আত্মারা তখনও মুচকি হাসবেন, আর হিস্হিস্ করে জিভ বাড়াবেন পরের শিকারের দিকে। এই পাগল শিকারী দুনিয়ায় যদি পারি বর্ম দিয়ে যাব। তবে তারই পাশাপাশি শিকারও চলবে। লেবাননে, প্যালেস্টাইলে, শ্রী লঙ্কায় হাতে হাতে খেলনা তুলে দেব।
শুধু স্বাধীনতা শেখাতে পারব না।
অন্ধকার ঘর সোনার ঝলকে আলো করে দেবো। কিন্তু সূর্যসন্ধানে নিয়ে যেতে পারব না।
কে যেন কানের কাছে নব্বইয়ের ইশ্তেহারের কথা বলে? সন্তানের নরম গায়ের গন্ধের ভালোবাসা, প্লেন ল্যান্ডিং করার সময় গলায় দলা পাকানো যে সব ভালোবাসা এখনও উঁকি মেরে যায়, তাদের দেখা পেতেই এত সময় লাগে, তারপর নতুন ইশ্তেহারের সময় কোথায়?
"মানুষ অনেক অন্ধ, অনেকের অন্ধতা গিয়েছে।
বুঝেছি যাবার নয় আমার চোখের ভিক্ষা, চাপ...
যদি কৃপা করো, যাই, সন্তানের মুখ দেখে আসি।"
৯ (Nov 16 2005)
জেড্ডা: ইতস্তত বাক্যমালা
.
এই স্থানে সূর্য বড়ো প্রখর।
সূর্যমুখীর হতাশায় বিমর্ষ যৌবনের নখ আঁকড়ে ধরে স্টিয়ারিং।
স্থবির আবায়ার কালো পর্দা পেট্রোলের খ্যাপা হাওয়ায় দুলে ওঠে।
একশ কুড়িতে ছোটা কালো মোষ কেবল থামে শপিং মলের সামনে।
শপিং মলেও সূর্য বড়ো প্রখর।
সব কিছু চক্চক্ করে,
চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, পা ব্যথা করে, চোখে জং ধরে, গলা শুকিয়ে যায়।
শিশুরা ছাড়া চেঁচিয়ে ওঠা বারণ।
নি:শব্দ শপিং মলে পরিযায়ী পাখিদল রিয়াল গোনে।
মকবুলও রিয়াল গোনে ট্যাক্সিতে বসে।
নেত্রকোণায় পাঁচ বছর যাওয়া হয় নাই।
এখন শুধু আজিজিয়া থেকে শরাফিয়া থেকে আল-বালাদ।
দশ রিয়াল, পাঁচ রিয়াল, পনেরো...
মক্কা যেতে পারলে বড়ো দাঁও জোটে।
একশ কুড়িতে ছোটা মকবুল কি ভাবে আর থামে?
সন্ধের জুম্জুম বুফিয়াতে চায়ের গেলাস হাতে
নেত্রকোণা, বরিশাল, পেশাওয়ার, করাচি, কোচিন, হায়দ্রাবাদ....
একই হাতে আল-আমিনে রুটি আর হালিম
ঘরে ফিরে চার খাটিয়া একের উপর এক
চার ঘেমো পুরুষ দেহ
ফজরের নামাজের ডাকে পুন: জেগে ওঠে
প্রখর সূর্য পিঠে অবিশ্রাম ট্যাক্সি নিয়ে আমি
যে ট্যাক্সিওয়ালা
ট্যাক্সির খোঁজে চার মুখঢাকা আরব রমণী নিয়ে বিপুল বৃদ্ধ
লোহিত সমুদ্রের ধারে উটের মলগন্ধভরা কর্নিশে সান্ধ্যভ্রমণে
দুশো ফুট উঁচু ফোয়ারার ধারে চাঁদ লটকে থাকে
সন্ধ্যাবেলা
বিষন্ন সূর্যমুখী।
বিষন্ন সূর্যমুখী শুক্রবার দুপুরে শহরের মধ্যের চাতালে
যুবকেরা বধ হবে।
উপোসী দেহের স্রোত মিশেছিল মনিবগৃহিণীর আবায়ার নীচে
বধ হবে তপ্ত রক্তে, তপ্ত বালি, তপ্ত রাস্তা, তপ্ত বোমা
রাজা তরবারিহাতে সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে নাচেন টি ভির পর্দায়
ঐতিহ্য রক্ষা করা দায়।
দপ্দপ্ নিয়নের আলো ম্যাক, পিৎজা হাটের শিখরে
আফ্রিকার পকেটমার, ভিখারি ও পাগল
ঐতিহ্যের কোলে বসা নিশ্চিন্ত বালক
অযৌনতার নিশ্চিন্তি
অরাজনীতির নিশ্চিন্তি
অশরীরের নিশ্চিন্তি
শয়তানি গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
অষ্টমীর সন্ধ্যায় নুয়ে পড়া চাকর শরীর
নিশ্চিন্ত নিদ্রায় হাতের কব্জি কাটে
পাশে পড়ে থাকে প্রখর তৈলাক্ত শহর জেড্ডা
এ ছাড়াও থাকে হোটেলের দুশো সাত নম্বর ঘর।
১০ (Dec 16 2005)
তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে
.
"লুটা লুটা কিসনে উস্কো অ্যায়সে লুটা কে ফির উড় না পায়া"
বাঙালি জেগেচে। বোদ্দিতলার পাঁচু শেখ থেকে মেফেয়ার গাডেনের মিশ্টার ডাট পজ্জন্ত জেগেচে। এক্কেরে চেগিয়ে চেগিয়ে জেগেচে। লবোজাগোরোন শুরু হোলো বোলে- ডু ইট লাও। সবেধন লীলমণি একখান পিস বেরুয়েচিলো। তারেও সুমুন্দির পোরা চক্কান্তো কোরে গুপি কোরে দিলে গা! মুয়ে ঝ্যাঁটা মারি অলপ্পেয়েদের! বিদ্যেসাগর থেকে লিবারণ চক্কোত্তি- সব মোরে হেজে ভূত হোয়ে গ্যাছে। পোড়ে আচে শিবরাত্তিরের সোলতের পোদীপ খুঞ্চুমুনু পুঞ্চুমুনু মোদের গরোব, মোদের আসা। তাই নিয়ে ধ্যাষ্টামি! চল বে, দেকিয়ে দি পিতিবাদ কারে কয়।
আপিসে পানপরাগখেকো বস এভরিডে হুড়কো দিচ্চে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
বোনের হাজবেন্ডটার বহুত পয়সার রোয়াব হোয়েচে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
ছেলেটা ইশকুলে পানু নিয়ে গিয়েচিলো বোলে হেডমাস্টার ডেকে ধাতিয়েচে- পিতিবাদ পিতিবাদ!
ও পাসের বাড়িতে মিসেসের ময়লার জল পোড়েচিলো বোলে মিত্তিরবাবুর সাথে হাতাহাতি হোয়ে গ্যালো- পিতিবাদ পিতিবাদ!
সব লাঞ্ছোনা-গঞ্জোনা-বঞ্চোনা-অন্যায়-অবিচার-যাতোনা-বেদ্নার পিতিবাদ ইডেন গাডেনেই হবে। জাগো বাঙালি, কচুসাকের কাঙালী! বঙ্গোভঙ্গের সতোবস্সে দেখে লেবো বাঙালিকে কে রুখতে পারে। গিয়াছে জগু, দু:খু লাই, আবার তুই লায়ক হ। লিন্দুকেরা বোলচে যে মোদের বাংলাপেরেম সুদুই কিরিকেটের মাঠে। ইদিকে খাস কোলকেতায় বাঙালির বাস কোমতে কোমতে তলানিতে ঠেকেচে, বাংলা মিডিয়াম ইশকুল সব পগার পার- সিদিকে কোন হুঁশ লাই, খালি কিরিকেট আর কিরিকেট। কিন্তুক এনারা এটা বোঝছেন না যে এর মানে হল গিয়া আমারাও সেই ভারতীয়ই বটি। ভারতের দেসোপেরেমের জায়গা যেম্নি কিরিকেটের মাঠ, আমাদেরও বাংলাপেরেমের জায়গা সেই কিরিকেটের মাঠ। এ নিয়ে ছ্যা ছ্যা করার কি হোলো বাপু?
ভুতুমের এই ভাঙা গলার কাতরানি সুনে গুরুদেব বেম্মোতালুতে হাত রেকে কইলেন- ঞ্ছঅতো চিন্তে কোরিস ক্যানো রে খোকোন! কিরিকেট ছেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে দ্যাখ না পাগোল- বাঙালিতে বাঙালিতে এক্কেরে ছেয়ে ফেলেচি। এই তো সিদিন মুম্বাই থেকে ঘুরে এলুম। রাণীর কতা তো ছেড়েই দে, অবিষেক, রিতিক লোশন- সবই তো আমাদের ঘরের ছেলে রে! ঐদিকে মানিক রায়ের পরেও কতো রায় দিলুম বল দিকি- রিনা রয়, পোনয় রয়, অরুন-ধুতি রয়। কোনো কতা হবে নে! ঠিক তেম্নি বাবলু সেন আর রীণা সেনের পরেই ক্যামোন বের কল্লুম সুস্মিতা সেন। সিদিকটাও অ্যাকবার দ্যাখ! খালি গাঙ্গুলী নিয়ে ডাঙ্গুলী খেল্লে কি হব্যা?ঞ্জ
এই সুনে ভুতুমের পুরো পেত্যয় গ্যাচে যে লবোজাগোরোন দোরে এয়ে দেঁড়িয়েচে। জাস সিলি পয়েন্টে লোপ্পা এলেই খপাৎ।
"মিলাবে মানবজাত'
এর আগে য্যাকোন লবোজাগরণ এয়েচিলো ত্যাকোন ভুতুম খুব ছোটো- ভালো কোরে সব কতা মোনেও লাই। সেই উন্নিশে্শা সাত্তাত্তর সালে। য্যাকোন বাঙালি বেস রসেবশে পরিপুন্নু সাম্মোবাদী হোলো। তার আগে আগে কিরম অ্যাকটা আধাখ্যাঁচড়া ব্যাপার ছেলো। সাতাত্তরে বিরিগেডে মশাল জ্বালিয়ে বেশ লায়েকমাকা সাম্মোবাদী হোয়ে ওঠা গ্যালো। সেই তবেথ্থেকে অ্যাকোনো অব্দি সব্বাই সাম্মোবাদী- সি পি এম, কংগেস, তিনোমুল, বিজিপি- সব্বাই। কে আবার বোলেচে- আসোলে সব্বাই সি পি এম- সি পি এম, কংগেস, তিনোমুল, বি জি পি- সব্বাই। তবে বাঙালি যে হেব্বি সাম্মোবাদী এ নিয়ে জাস কোনো কতা হবে না। সাম্মোবাদী, অসাম্পোদায়িক, সামোস্কিতিক।
এই ধরো ভুতুমদের পাড়ার মোহিলা সমিতির খনা বৌদি- সা, অ, সা মনে সাম্মোবাদী, অসাম্পোদায়িক, সামোস্কিতিক। বর পাট্টির হোলটাইমার মনে সাম্মোবাদী তো বটেই। ছয় ডিসেম্বার খনা বৌদির মেয়ে টুম্পা মিচিলে বেলো টিপে গান গায়- ঞ্ছমাটি কতো মেহেরবান/ আনন্দে আজ গাইচি গান/ আমরা আচি পাসাপাসি হিন্দু মুসলমান।ঞ্জ অসাম্পোদায়িক বোলে অসাম্পোদায়িক! আর সামোস্কিতিক? সে তো লেগেই রোয়েচে। ওলাইচোন্ডী থেকে রোবিন্দোজয়েন্তী- গনোসমোস্কিতি নিয়ে কিতকিত খেলচে। তো সেই খনা বৌদির বাড়িতে কাজ করে সরোস্সোতি আর তার আট বছোরের মেয়ে পুন্নিমা। দুক্কুরবেলা নয় বছুরে টুম্পা বাড়ি ফিল্লে তারে চোকে চোকে রাখে আট বছরের পুন্নিমা। তবে খনা বৌদির বাড়ি ঝি-চাকরের খুব সন্মান। টুম্পা সরোস্সোতিকে ঝি বোলেচিলো বোলে খনা বৌদির কি ধমক রে বাওয়া- ক্যানো, কাজের লোক বোলতে পারো না? কিন্তু সাম্মোবাদের সাথে সাথে সাস্থোটাস্থোর ব্যাপারগুলো তো আচে। তাই খনা বৌদির দুটো বাত্তুনের কোনো বাত্তুনে সরোস্সোতি কি পুন্নিমার ঠাঁই লাই। যেদিন পুন্নিমা পোচোন্ডো পেট খারাপ নিয়েও টুম্পার দেখভাল কোত্তে এয়েছেলো, সেদিনও খনা বৌদির কড়া শাসোনে বড়ো হওয়া টুম্পা পুন্নিমাকে বাত্তুনে ঢুকতে দেয় নে। ছোটো মেয়েটা পেছুনের ন্যাড়া পার্কের ঝোপের আড়ালে বার বার দৌড়ে যাচ্চিলো। দিনের শেষে সরোস্সোতি য্যাকূন নিতে এলো, মেয়েটা নেতিয়ে পোড়েচে। এই দেকেই কিন্তু খনা বৌদি সাতে সাতে ওষুদের পয়সা বের কোরে দিয়েচিলো। সরোস্সোতির মাইনে বাড়াতেও খনা বৌদির খুব আপোত্তি। সরোস্সোতির বরটা মাল খেইয়ে পয়সা উড়িয়ে দেবে যে। তাই পাঁচ বচ্ছর হোয়ে গ্যালো সরোস্সোতি সেই একই মাইনা পায়। আর এ নিয়ে কতা কওয়ারই বা কি আচে- ঘরের নোক কি না! তবে খনা বৌদির বরের ইউনিয়ন যেদিন ধম্মোঘট শেষ কোরে দশ পার্সেন বোনাস বাড়িয়ে নিলো, সেদিন মোনের অনোন্দে খনা বৌদি সরোস্সোতিকে এক বাক্সো সন্দেশ কিনে দিয়েচিলো। ঘরের নোক বোলে কতা!
একন টুম্পা বড়ো হোয়েচে। মঝে পাড়ার বিহারী কেবলওয়ালা লবকাত্তিকের সাতে খুব লটরপটর শুরু কোরেচিলো। তাই শুনে তো খনা বৌদির মাতায় হাত। মা সন্তোষী মার উপোস রাকতে হোলো। মেয়ের ভোবিসৎ নিয়ে খ্যালা কোল্লে তো চোলবে নি! শেষে জোনাল কমিটির সিক্রেটারির ভাইপো- ফরিদপুরের পাক্কা বারেন্দ্র বাউন আই আই টি পাশ করা উইপ্রোতে চাগরি করা ছোকরার সাথে বিয়ে দিয়ে সান্তি! পুন্নিমারও বিয়ে হোয়েচে এক উড়ে জলের কলের মিস্তিরির সাতে। লোকটা ভালো, বালেশ্বরে একটা বৌ থাকলেও পুন্নিমের গায়ে হাতও তোলে না, লিসা-ভাংও করে না। পুন্নিমার বিয়েতে খনা বৌদি সুদু একছড়া হার দিয়েচিলো যে তাই লয়, তাসাথে টুম্পার বিয়েতে পাওয়া আসাপুন্না দেবীর পথম পোতিসুতি।
ভুতুমের নাক চোক এ সব দেকে ভোক্তিতে ভোরে আসে। অ্যামোন দেসটি কোতাও খুঁজে পাবে নে কো তুমি- য্যামোন সাম্মোবাদী, তেম্নি অসাম্পোদায়িক, তেম্নি সামোস্কিতিক। এই লবোজাগোরোন এলো বোলে।
জয়ম্মা বাঙালি, জয়ম্মা সাম্মোবাদী, জয়ম্মা লবোজাগোরোন!
১১ (Jan 3 2006)
জেড্ডা
শহরটার পশ্চিমে সমুদ্র। সমুদ্রের ধার দিয়ে কর্নিশ, এক লম্বা রাস্তা শহরটার একদিক ঘিরে রয়েছে। কর্নিশে সন্ধ্যাবেলা অজস্র ঢাউস গাড়ি, সৌদি পরিবার ও শিশুদের কলরব, উটের গুয়ের গন্ধ, বালির মধ্যে খেলনাগাড়ি চালায় সৌদি কিংবা ইয়েমেনি তরুণ। পুরোনো শহর, যেখানে সুড়ঙ্গমাফিক গলির মধ্যে আতর, খেজুর, মক্কার শস্তা ছবি আর চিন থেকে আমদানি খেলনার পসরা- নাম আল বালাদ। আল বালাদের এক প্রান্তে বন্দর। এইখানে সমুদ্র ধূসর, স্রোতহীন, কলকব্জা আর লোহার জাহাজেরা ভিড় করে একে অন্যের মুখে দেখে। দূরে দেখা যায় নীল সবুজ সমুদ্র, ধারে গাছপালা ঘেরা কোনো উদাস জমিন। অইখানে বিত্তবান যুবকযুবতীরা শরিয়তের বেড়া পেরিয়ে ঘেরাটোপের আড়ালে আমোদে মত্ত। আল বালাদের দোকানপাট, শপিং মল, রেস্তোরাঁ দুপুরে ঝাঁপ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছে। এই শহরের রাস্তায় কোনো কুকুরের দেখা নেই। শুধু রোগাভোগা এঁটো বিড়ালেরা চোখ সরু করে ঘুরে বেড়ায়। সমুদ্রের উড়ো হাওয়ায় শপিং মলের হা হা করা চত্বরে বেদুইন রোদ ওলট পালট খেতে থাকে। রাস্তার ধারের মালয়ালি কফির দোকান বা বুফিয়াতে কিছু খুচরো লোক তামিয়া, মানে লম্বা পাঁউরুটির মধ্যে পোরা মাংসভাজা দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারে। একটু দূরে ছোট মসজিদের সামনে পড়ে আছে একলা চত্বর। শুক্রবার এখানেই কারো শিরশ্ছেদ হবে।
বিদেশিরা এই চত্বরকে বলে চপ চপ স্কোয়ার। বিদেশি অর্থাৎ এক্সপ্যাট্রিয়েট বা এক্সপ্যাট। বহু সংখ্যায় শ্বেতবর্ণ, তারপরেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়রা। এই বিত্তবান পেশাদারদের জীবন কাটে শহরেরই দূর প্রান্তে মিলিটারি পাহারা দেওয়া কম্পাউন্ডে। গোটা পাঁচেক দুর্গদেওয়ালের সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে তবে ঢোকা যায় শহরের মধ্যে থাকা অন্য এক শহরে। কম্পাউন্ডের মধ্যে শরিয়তের ঢুকতে মানা। তাই পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনযাত্রায় অশরিয়তী হালচাল। বেশির ভাগ পরিবার পরিজন ছেড়ে দীর্ঘদিন বাদশা আবদুল্লার রাজ্যে। বিশাল বাড়ি, সুইমিং পুল, ক্লাব নিয়ে দিন কাটে, রাত কাটে। মদ্যপান নিষিদ্ধ। নৈতিক পুলিশের চোখ এড়িয়ে বাড়িতেই মদ বানানোর প্রচেষ্টা। বাড়ির কাজকর্ম করে দেয় ফিলিপিনো ঝি। দেহের তেষ্টা বেড়ে গেলে ফিলিপিনো মহিলার মধ্যস্থতায় দুই হাজার তিন হাজার রিয়ালে মহিলা দেহও জোটে। আরও গহীন ফুর্তি চাইলে বাহরাইন।
আরও একদল বিদেশি আছে যাদের এক্সপ্যাট বলা হয় না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইন্স, ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা শ্রমিক, নার্স, ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা। শহরের মধ্যে আল শরাফিয়া অঞ্চলে মালয়ালি প্রাধান্য, আল আজিজিয়ায় পাকিস্তানি। এদেরও মাসের পর মাস কাটে পরিবার পরিজন ছাড়া টাকা রোজগারের তাগিদে। কিন্তু না আছে কম্পাউন্ডের বিলাসব্যসন, না আছে নিয়মিত বাহরাইন দুবাই যাবার ট্যাঁকের রসদ। ধনী সৌদির বাড়িতে কাজ করতে করতে অনেক সময়ই কেউ কেউ কোনো এক গৃহিণীর শয্যাগত, এবং তারপর চপ চপ স্কোয়ার। বাজার চত্বরে কালোতে ঢাকা বাংলাদেশী রমণীদের টুকরো টুকরো সংলাপ ভেসে আসে- "কাল রাতে তোরে ডাকসিল? আমারে দুই রাতেই ডাকসে। দুই রাতই ঘুম হয় নাই।"
সর্বত্র সর্বাঙ্গ ঢাকা নারী। তা সত্ত্বেও কাগজে খবর বেরোয়- ইভটিজিং, যৌন হয়রানি থেকে ধর্ষণ। সমাজ যেখানেই যাক, প্রযুক্তি অতি তৎপর। অতএব পার্কে যুবকেরা মহিলাদের হয়রানি করে এবং মোবাইলে তার ছবিও তোলা হয়। সেই ছবি এস এম এসে ঘুরে বেড়ায় দেশের সর্বপ্রান্তে। কে যেন বলে নারীদের পোশাকই শুধু পুরুষকে ধর্ষণে প্রোভোকিত করে? তবে দিনকালের প্রকোপে মুখের পর্দা আস্তে আস্তে খুলছে। গত বছর থেকে মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশুনা অনুমোদিত হয়েছে। চাকুরিরতা মহিলা দেখাও খুব দুর্লভ নয়। জেড্ডা চেম্বার অফ কমার্সে প্রথমবার দুই মহিলা ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। কিন্তু রাস্তাঘাটে স্বামী কিংবা পিতা কিংবা ভ্রাতা ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সাথে চলাফেরা ভীষণ অপরাধ। আরও অপরাধ মেয়েদের গাড়ি চালানো। অভূতপূর্ব মিছিল বেরোয় গত বছর- মেয়েদের গাড়ি চালাতে দেওয়ার দাবিতে। বহুবিবাহের প্রচলন। শপিং মলে প্রৌঢ় শেখের পিছন পিছন হেঁটে চলে বিভিন্ন বয়সের গোটা চারেক পরী। তবে গোটা চারেক পরী ম্যানেজ করা কি মুখের কথা? কাগজে খবর বেরোয়- শপিং মলে দুই সতীনের উদ্দাম ঝগড়া এবং হাতাহাতি। কানে কানে কলমে জনৈক তিন চার পরীহুরি সামলানোর সুলভ উপায় জানতে চেয়ে চিঠি লেখেন। শহর চলে কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলায়। শৃঙ্খলা রক্ষা করেন মুতোয়ার দল- ধর্মীয় এবং নৈতিক পুলিশ।
অথচ এই রকম কথা ছিল না। জেড্ডা শব্দের অর্থ "ঠাকুমা"। প্রবাদ প্রথম মানবী ইভের মৃত্যু ও সমাধি এই শহরে। লোহিত সমুদ্রের ধারে গড়ে ওঠা বাণিজ্যবন্দর, অন্যদিকে মক্কায় যাবার প্রবেশদ্বার। পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে বণিক ও তীর্থযাত্রীর দল ভিড় করেছে শহরের ইতিহাস জুড়ে। ১৯২৫ সাল নাগাদ ওয়াহাবীরা সৌদ রাজবংশের নেতৃত্বে জেড্ডার দখল নিল। মোহম্মদ বিন অব্দ আল ওয়াহাবের নেতৃত্বে এই ওয়াহাবী ধর্মতের জন্ম। ওয়াহাবী ধর্মমত অনুযায়ী কোন সাধুসন্তের স্মৃতিসৌধ, মাজার ইত্যাদি অ-ইসলামীয়। তাই মক্কায় হজরত মহম্মদের স্মৃতিধন্য সমস্ত বাড়িঘর বুলডোজারের ধাক্কয় গুঁড়িয়ে যায়। তার জায়ায় তৈরী হয় অসংখ্য পাঁচতারা হোটেল মক্কার তীর্থযাত্রীদের জন্য। একইভাবে অন্যান্য শহরেও ইতিহাসের স্বাক্ষর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একমাত্র আল বালাদে বেঁচে থাকে গায়ে গায়ে ভিড় করা পুরোনো বাড়ি, বারান্দা আর জানলায় কাঠের জাফরি, ছোট ছোট সৌক বা বাজারে পুরোনো আতরের গন্ধ। সৌদ রাজবংশ এতদিন ওয়াহাবী ধর্মমতের একক ধারক ও বাহক ছিল। ইদানীং ওয়াহাবী উত্তরাধিকারের এক কঠিন প্রতিদ্বন্দীর জন্ম হয়েছে- আল কাইদা।
জেড্ডার অন্যতম সম্ভ্রান্ত পরিবার বিন লাদেন পরিবার। ২০০৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর জেড্ডার আমেরিকান দূতাবাসে আত্মঘাতী হামলায় পাঁচজন মারা যায়। বুশ সাহেবের প্রিয় রাজা রাজ্যশাসন করেন। ইরাকে গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ হয়। ইউ এস মেরিনেরা কম্পাউন্ডে কম্পাউন্ডে ঘাঁটি গেড়ে থাকে। মাঝে মাঝেই আল কাইদার সন্ত্রাসবাদীদের ধরপাকড় চলে। অস্থির যৌবনের একভাগ আমেরিকান ভোগের জন্য উৎসুক, আর এক ভাগ উলেমাদের সৌজন্যে জিহাদ লড়ার জন্য তৈরি হয়। জনৈক শিক্ষক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে স্কুলে পোস্টার লাগান। তার জন্য শিক্ষক ও ছাত্রদের এক অংশের কাছে তাকে একঘরে হতে হয়। একদল ছাত্র তার বিরুদ্ধে ইসলামের বিরোধিতার অভিযোগ আনে। শরিয়তী বিচারে শাস্তি হয় কারাদন্ড আর চাবুক। মানুষ কী ভাবে? প্রতিবাদ হয় কাগজে টি ভি তে। সম্প্রতি রাজার হস্তক্ষেপে শাস্তি মকুব হবার কথা। আরব দুনিয়ার সব থেকে বড় দেশ ঘিরে রয়েছে প্যালেস্টাইন, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, বাহরাইন, ওমান, কাতার। রক্তের অনেক রং, অনেক গন্ধ। আমরা একই তুলিতে সাদা কালোয় ছবি এঁকে যাই। কেউ কেউ ভাবি - "ওরা ওই রকম।' কেউ কেউ- "সবের গোড়া হতচ্ছাড়া আমেরিকা।' কিন্তু গল্পের ধরতাই পাই না। কাগজে জনৈক ধর্মপ্রাণ সৌদি চিঠি লেখেন- "পৃথিবী যেন মনে রাখে মুসলিমদের সবাই সন্ত্রাসবাদী নয়। ঠিক তারই সাথে সাথে আমাদেরও ভেবে দেখা দরকার দুর্ভাগ্যবশত আপাতত সন্ত্রাসবাদীদের অধিকাংশই মুসলিম'। মন্তব্য নিÖপ্রয়োজন।
১২ (Jan 17 2006)
এ রকম হয়েই থাকে
লোকটা বহুৎ ভয় খায়। পুরো শহরটাকেই কেমন বেজম্মা মনে হয়। গাঁয়ে সব কিছু কি সুন্দর সেট করা ছিল। সকালে মাঠে হাগতে যাওয়া থেকে রাতে মাল টানা পর্যন্ত। মুখিয়া আর পঞ্চায়েতের বুড়োরা জাত-জমি-মেয়েছেলের ছক ফিট করে রেখেছিল। দারোগারও ধক ছিল না যে সেই ছকের বাইরে যায়। যদিও লোকটা ছিল নীচুজাতের। যদিও লোকটাকে বহুৎ লাথিজুতো খেতে হত। কিন্তু কার সাথে পেয়ার মহব্বৎ হবে আর কোন গিদ্ধড় দেখলে ভাগাড় থেকে কাট মারতে হবে, সেই হিসেবটা ছিল পরিষ্কার। আর ছিল খাপরার চালাঘর, ঘরের পাশের শুকিয়ে যাওয়া তেঁতুলগাছ, বাপের হাতে ক্ষয়ে আসা কোদালের বাঁট, মুখিয়ার বাড়ির ক্ষেতে শ্যালোর ঘড়ঘড়ে শব্দ, সন্ধেবেলা এম্লেবাবুর ছেলের ভট্ভটি, কোথাও আখের রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, চার ব্যাটারীর জওয়ানী দীওয়ানী টর্চ। শুধু ছিল না পয়সা। ইজ্জৎও ছিল না। আনশান কিছু করলেই গান্ডুর বাচ্ছারা পিছনে কাঠি করত।
এই বেজম্মা শহরেও অনেকদিন হয়ে গেল। শহরের হালচাল অনেকদিন হল সমঝে নেওয়া গেছে। গলায় মাদুলি মোবাইল ফোন, টি ভির পর্দার মতো একটা জিনিষের পাশের গর্তে কার্ড ঢুকালে পয়সা বেরোয়, জুতোর মতো সান্ত্রো আর পোঁদমোটা সুইফ্ট্- সব চেনা হয়ে গেছে। ওয়াশিং মেশিন, কেব্ল্ টিভি, শপিং মল, ব্লাডার ভর্তি চন্মনে মাল, কুত্তার নাদি, ছুছুন্দর কে সর পে চামেলি কা তেল- সব কিছু।
তবু বহুৎ ভয় লাগে।
গিজ্গিজ্ করছে লোক। তাও শালা লোক দেখা যায় না। শুধু মনে হয় গোঁ গোঁ করে ধোঁয়াভর্তি বাস আর ট্রাক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কলের মিস্তিরির কাজ শেখার পর লোকটাকে কেউ আর চামার বলে না। কিন্তু কেউ তো কিছু বলেই না। এদিকে সারাদিন সবাই জোরে জোরে কথা বলছে। কাকে বলছে কেউ জানে না। কে শুনছে তাও কিন্তু কেউ জানে না। সকালে মোবাইল পায়খানায় হাগার জন্য মেয়েমরদে লড়ালড়ি। রাত্তিরে মেয়েমরদের গতরের জন্য চীৎকার, ছেঁড়াছেঁড়ি। পাশের কুঠুরির লোকটা তিনদিন মরে পড়েছিল। চোখগুলো পিঁপড়েতে খুবলে খেয়েছিল। রোজ সন্ধেবেলা লোকটা হনুমানচালিশা পড়ত। কে জানে গাঁয়ে কেউ খবর পেল কিনা।
লোকটার বহুৎ ভয় করে।
শালা বোঝাই যায় না আছি কি নেই। শুধু বই দেখতে গেলে আন্ধেরা হলের কিৎকিতে ভিড়ে, কাঠের সিটে, বিড়ির ধোঁয়ায় একটু "আছি আছি" মনে হয়। ঐখানেই যা একটু গান, যা একটু হাওয়া।
কাল রাতে লোকটা হাওয়া খেতে ঘোড়ায় চড়েছিল। এক তুড়িতে রাস্তাঘাট থেকে গাড়িঘোড়া সরিয়ে দিল। তারপর রেন্ডিখানার ফুলকির খোলা পিঠের মত কালো চক্চকে রাস্তা। চারদিকে রংমশালের মতো বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং জ্বলছে। একা একা রাস্তার সাদা ঘোড়ার পিঠে ঐ কি চামার? লোকজন পুরো হাওয়া। শুধু মোড়ে মোড়ে সাদা সাদা ল্যাম্পপোস্ট ঠক্ঠক করে পায়চারি করছে। এক একটা ট্র্যাফিক সিগনাল পেরোচ্ছে আর পুজোর ঢাক বেজে উঠছে। রাস্তাটা যেখানে কালো আকাশে মিশে গিয়েছে, তার উপরের আকাশে শুকতারার মতো দব্দব্ করছে লাল আলো। ঐ লাল আলোর পিছনে ভগবান লুকিয়ে লুকিয়ে চামারের ঘোড়সওয়ারী দেখছেন। চামারের ঘোড়ার দুই নাক দিয়ে বেরুচ্ছে লাল আগুনের হল্কা। বিজ্ঞাপনের প্রায় ন্যাংটো মানুষীরা পসরা ফেলে চামারকে দেখতে ঝুঁকে পড়েছে। রাস্তার শেষপ্রান্তে কিন্তু জেগে উঠছে এক নিকষ কালো দেওয়াল। চামার যতই এগোয়, দেওয়াল ততই বাড়ে। শেষে উপরে তাকিয়ে আর
ঠাহর হয় না দেওয়ালের শেষ কোথায়। সেই দেওয়ালের এক ছোট্টো ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক চিলতে আলো। চামারের সাদা ঘোড়া ছুটতে থাকে সেই আলোর চিলতের দিকে। কিন্তু পাঁচিলের ধারেকাছে পৌঁছোবার আগেই পাঁচিলের অন্ধকার এগিয়ে আসে চামার আর তার ঘোড়ার দিকে। তারপর সব অন্ধকার।
এরপর চামার, বা লোকটাকে দেখা যাবে শক্তি মহামন্ডলে। সে এখন শক্তি মহামন্ডলে বেশ মাতব্বর। মন্ডলের রাজ্জুভাইয়া মাঝে মাঝেই বস্তিতে আসত। নির্লোম মুখ, কপালে লাল তিলক, গেরুয়া পাঞ্জাবি, সারাক্ষণ হাতে নড়াচড়া করছে কালো মোবাইল। বস্তির লোকেদের অসুখেবিসুখে, শাদিতে তেওহারে সবসময় হাজির। একটা বাল বিদ্যাভবনও খোলা হয়েছে। সেইখানে প্রায়ই গুরুমহারাজ আসেন। মাঝে মাঝে অখন্ড মহাযজ্ঞে হালুয়া পুরী চড়ানো হয়। রাজ্জুভাইয়ার কথাবার্তায় লোকটা বুঝেছে ভয়টা ওর নাদান নয়। খতরনাক জানোয়ারেরা এখানে সেখানে ওঁত পেতে আঅছে। তাই ছায়ার মতো রাজ্জুভাইয়ার পিছনে ঘুরে বেড়ায়। শরীরটাও ভালো যায় না। প্রতি রাত্তিরে ঘুমের মধ্যেই হড়্হড় বমি। বিছানাচাদর, কাপড়চোপড় ভিজে যায়। বমির পর শরীরটা বেশ হালকা লাগে। এটাও নেশার মতো হয়ে যাচ্ছে। রাত্তিরবেলা এই গা মোচড়ানো পেট গুলিয়ে গলায় ঠেলা মারা ব্যাপরটা না হলে মনতা কেমন ছট্ফট্ করতে থাকে। লাল তিলক, রাজ্জুভাইয়া, বস্তির পিলেভরা ছেলেদের বালবিদ্যাভবন, রাত্তিরে বমি- এই সব নিয়ে লোকটার ভিতরে একটা আবছা ধরনের "আছি আছি" ভাব আসছে।
অত:পর যাহা হইয়াছিল তাহা অতীব সুষম এবং স্বাভাবিক। একটি কুখ্যাত রাজপথে ধর্মীয় শোভাযাত্রা এবং তজ্জনিত আইনী গোলযোগের দরুন দুইটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোরতর কোন্দল এবং প্রায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। মহাশক্তিশালী সর্বগুণসম্পন্ন পূর্বপুরুষাদিগণের উত্তরাধিকাররক্ষার নিমিত্ত দুই পক্ষের সেনাপতিগণ ভল্লতরবারিবন্দুকসহিত মহল্লার প্রতিকোণে আপনাপন সৈন্যদল লইয়া উপস্থিত হন। আমাদিগের আলোচ্য ব্যক্তি অর্থাৎ তিনিও একটি ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর নেতা নির্বাচিত হইয়াছেন। সেই করালবদনা রাত্রিতে অদূরস্থিত মহাহত্যার আশঙ্কায় চন্দ্রও নির্বাপিতপ্রায়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সুড়ঙ্গসদৃশ গলিপথে পথচারী সারমেয়ধ্বনিও সুদুর্লভ। অবোধ শিশুগণও আপনাপন শয্যাপরে শঙ্কিতচিত্তে অনিদ্র রাত্রি যাপন করিতেছে। হেনকালে সুড়ঙ্গের একপ্রান্তে একটি মনুষ্যমূর্তির কিঞ্চিৎ চলনের আভাস মিলিয়াছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই ছায়ামূর্তির পশ্চাদ্ধাবন করিলেন। ইহা ছিল তাঁহার অনুল্লেখ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মূহুর্তের সন্ধান। অতএব কোনো মনুষ্য বা মনুষ্যেতর জীবেরও উহাকে অতিক্রম করিবার সাধ্য ছিল না। বৃদ্ধা হইলে তো কথাই নাই। অতি সুনিপুণভাবে তিনি তাঁহার রামপুরিয়া মনুষ্যটির উদরে বিদ্ধ করিলেন। কাহারও উদর বিদ্ধ করিবার পর অস্ত্রের ফলাখানি ঘুরাইয়া দিতে হয়। তাহা হইলে উদরস্থ অন্ত্রাদিসমূহ পাক খাইয়া যায়। এতদ্বিধ কার্যাদি সম্পন্ন করিবার সময় তাঁহার মুখমন্ডলে অনেকখানি রক্ত ছিটকাইয়া আসিল। রক্তের উষ্ণ বনজ গন্ধে তাঁহার অস্তিত্ব পুনরায় সুসম্পূর্ণ অস্তিত্বরূপ ধারণ করিল। আশীর্ষ মূলাধারাবধি স্পন্দনের অবকাশে অবিরাম নি:সৃত প্রাণশক্তি অখন্ড সচ্চিদানন্দভাবে মিলিত হইল। মেঘাবৃত ঘোর রাত্রিতে দিকেদিগন্তরে মহাশক্তির আরধনায় ডমরুধ্বনি নিনাদিত হইল। শিবাগণের উল্লাসধ্বনিতে প্রকম্পিত মেদিনীতলে একটি তুচ্ছ বিধর্মী মনুষ্যদেহ পড়িয়া রহিল যাহাকে মনুষ্যাভিধানুসারে বৃদ্ধা বলা হইয়া থাকে। তিনি অতীব কোমল মাংসের নেশাতুর স্বাদ পাইয়া উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে ব্যস্ত হইলেন। এবং দীর্ঘ অবকাশের পর আপনার হৃৎকমলের দূরাগত ধ্বনি শুনিতে পাইলেন।
১৩ (Jan 31 2006)
মানে?
নান্দীমুখ
"মানে?' এই প্রশ্নটা আমাকে আপনাকে হরবখত শুনতে হয়। প্রশ্নটার নিজের "মানে'ও দুইরকম। এক, আপনি যা বলছেন তার বিবিধ ব্যাখ্যা সম্ভব। কাজেই আপনি যা বলছেন তার হুবহু ব্যাখ্যা কি? দুই, আপনি যা বলছেন তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। অতএব আপনার শব্দমালা নিরর্থক। কোনো প্রোজেক্ট মিটিঙে বা কোনো ক্লাস লেকচারে আপনাকে যদি কেউ এই প্রশ্ন করে তাহলে আপনি হয়তো খুশিই হবেন। কারণ আপনার এবং আপনার শ্রোতাদের মধ্যে ভাব ও তথ্য দেওয়া নেওয়ার একটা সাঁকো তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ শ্রোতারা আপনার বক্তব্য এবং তার অন্তর্নিহিত যুক্তির সম্পূর্ণ কাঠামো ঠিকঠাক বুঝে নিতে চাইছেন। প্রোজেক্ট মিটিং বা ক্লাস লেকচারে এই বোঝাপড়া, এই লেনদেনের সরাসরি ব্যাপারটা খুব জরুরি। ধোঁয়াশা বা হেঁয়ালি একেবারেই কাম্য নয়। কিন্তু এই "মানে'র জেরে যখন সাহিত্যকে জেরবার হতে হয়, যখন লেখকের পাঞ্জাবির খুঁট ধরে পাঠক অবোধ শিশুর মতো "মানে?' বলে ঝুলে পড়ে, তখন মনে হয় পাঠকের এইবার ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।
ভণিতা
অথচ "মানে?' অর্থাৎ অর্থ খুঁজে নেবার প্রয়াস বা জিজ্ঞাসার ইতিহাস প্রবলভাবে গৌরবান্বিত। মানুষের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র এবং ধর্ম জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তার কিয়দংশ সাধারণের নাগালে এলেও তার সত্যাসত্য যাচাইয়ের অধিকার ছিল না। কারণ রাজা এবং পুরোহিতই ছিলেন শেষ সত্য। এই কাঠামো ভেঙে পড়তে লাগল যখন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করতে শিখল, যখন মানুষ প্রতিটি উপপাদ্যের প্রমাণ দাবি করল, প্রত্যেক বাক্যের "মানে" জানতে চাইল। স্বত:সিদ্ধ বলে আর কিছুই রইল না। যুক্তি-তক্কো-গপ্পের একটা সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় "মানে' বুঝে নেওয়ার এই আন্দোলন ছিল নবজাগরিত ইউরোপীয় সভ্যতার শিরদাঁড়া।
এই শিরদাঁড়ার জোরেই ইংরেজদের শিক্ষার ভিত তৈরি হয়েছিল। যার উপযুক্ত পরিণতি ছিল শিল্পবিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লবের অনুবর্তী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাপট। তাঁরা নিজেদের গরজে আমাদেরও তার ছিঁটেফোঁটা দিয়েছিলেন, কিন্তু নিতান্ত চোলাই করা অবস্থায়। তারই মধ্যে কিছু ক্ষণজন্মা সেই চোলাইয়েরই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে মননের বনিয়াদ পাকা করলেন। কিন্তু গড়পড়তা মানুষের কাছে শিক্ষিত হবার মূল পাথেয় হয়ে উঠল মুখস্থবিদ্যা। শিক্ষার প্রসার হল, চাহিদা বাড়ল। কিন্তু গুণগত মানের কোনো আকাশপাতাল তফাত হল না। যদিও পরীক্ষা পাশের জন্য শুধু মুখস্থ নয়, "অর্থ বিশ্লেষণও' শিখতে হয়। তার জন্য তৈরি হল "মানে' শেখাবার পরিকাঠামো। অর্থাৎ "মানে' বুঝতে ভাবতে শেখার দরকার নেই। "মানে'ও মুখস্থ করিয়ে দেওয়া যায়। প্রাথমিক স্তর থেকে গবেষণা স্তর পর্যন্ত মানেবইয়ের রম্রম্ করে চলা কুটিরশিল্প। শ্রদ্ধেয় হীরেন মুখুজ্যে মশাইয়ের আত্মজীবনী "তরী থেকে তীরের' কথা মনে পড়ে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের কোনও একটি বিশেষ অধ্যায়ের উপর রচনা লিখে আনতে হবে। সম্পূর্ণ নিজের চিন্তাভাবনা যা`রা লিখলেন তাঁরা পেলেন সর্বোচ্চ নম্বর। যাঁদের লেখা অজস্র রেফারেন্স, অজস্র কোটেশনে কণ্টকিত, তারা পেলেন সব থেকে কম, লাইব্রেরিতে যতই মাথার ঘাম পায় ফেলুন না কেন! প্রতিপাদ্য হল, ভুল হোক বা ঠিক হোক, ভাবতে শেখা দরকার। আমাদের ব্যাপারস্যাপার একটু উলটোগোছের। সাধে কি সেই পরিচালকমশায় ভাবা প্র্যাকটিস করতে বলেন!
পাঠাগার
এতসব ধানাই পানাই করা হল কারণ, আমরা যখন সাহিত্যের পাঠক, আমাদের শিক্ষার ঐতিহ্য অনুসারে আমরা তখনও চিন্তায় অলস, আমাদের মস্তিষ্ক মেদবহুল ও স্থবির। আমাদের আশা, প্রত্যেক গল্প-কবিতা-উপন্যাসের একটি সুনির্দিষ্ট "মানে' থাকবে। সাহিত্যের ভাষা এতটাই সহজ হবে যে গড়গড় করে পড়ে গেলে একবারেই লেখার "মানে' বুঝে নেওয়া যাবে। লেখাপত্তর পড়ে রান্নাঘরের আলমারির তাকে আলাদা আলাদা প্লাস্টিকের কৌটোতে সাজিয়ে রাখা যাবে- এটা গল্প, এটা কবিতা, এটা উপন্যাস, এটা ইয়ে, এটা ইসে। আর যখনই বুঝতে পারব না "এটা কি' বা "এটা কেন', সঙ্গে সঙ্গে লেখকের পাঞ্জাবির খুঁট ধরে ঝুলে পড়ব- "মানে'টা কি দাদা?
যদিও প্রায় ক্লিশে, তবুও আবার বলি যে লেখা ছেপে যখন পাঠকের কাছে পৌঁছায়, তখন সেই লেখা পাঠকেরই সন্তান। কোনও লেখা বোঝা বা না বোঝা পাঠকেরই দায়িত্ব। কিংবা কোনও লেখার অর্থ নির্ণয়ের দায়ভারও পাঠকের। আপনি পাঠক হিসেবে কোনও লেখা বুঝলেন কি বুঝলেন না বা সেই লেখার কি পাঠোদ্ধার করলেন- তাতে যিনি লিখছেন তাঁর কিছু এসে যায় না। এসে গেলেও করার কিছু থাকে না। যদিও লেখা ছাপার পরে লেখক পুরস্কার পান, বক্তৃতা দেন, নিজের লেখার মানে নিয়ে মিডিয়াকে ইন্টারভিউ দেন বা প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু একক পাঠক হিসেবে আপনি লেখাটা যেভাবে বুঝেছেন সেটাই আপনার কাছে ঠিক। তা পরে লেখক যাই বলুন না কেন। কাজেই একক পাঠক হিসেবে আপনার দায়িত্বও অন্যরকম। যদি বুঝতেই না পারলেন, লেখকের দরবারে আর্জি না জানিয়ে নিজেই আর একটু আন্তরিক শ্রম ঢালুন না কেন। একটু ভাবুন। একটু দেখুন। একটু শিখুন। তার পরেও নাই বুঝতে পারেন। হয়তো অন্য কোনও অলীক সময়ে হঠাৎ করে কোনও একটা "মানে' আপনার সামনে দেখা দেবে। কিংবা এও হতে পারে যে লেখক আপনাকে পাঠক হিসেবেই চান না। আপনি লেখকের প্রার্থিত পাঠকশ্রেণীর মধ্যেই পড়েন না।
উম্বার্তো ইকো একজন ব্যাপক হারে না-বোঝা লেখক। না-বোঝা ভাষার বোঝার জন্য নয়। না-বোঝা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে উল্লম্ফনের জন্য। প্রতি উপন্যাসে অন্তত শ খানেক গুরুগম্ভীর বিষয়ের রেফারেন্স, যা অনেক ক্ষেত্রে আপাতভবে সম্পর্করহিত, পাঠককে হতচকিত করে। "ফুকোর পেন্ডুলাম" বইটিতে এই ভার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছেছে। কিন্তু আপনি যদি কষ্ট করে প্রথম বিশ পাতা পড়ে ফেলতে পারেন, তাহলে দেখবেন যে লেখক আস্তে আস্তে আপনার মাথার উপর থেকে ভার সরিয়ে নিচ্ছেন। ইকো সাক্ষাৎকারে বলছেন যে বইটির প্রারম্ভিক জটিলতা সুচিন্তিত এবং পরিকল্পিত। কারণ তিনি অলস পাঠক চান না। যে পাঠক সচেষ্ট হয়ে প্রথম পাঁচিলগুলো ডিঙোবে, তাকেই তিনি নিজের অন্দরমহলে বসতে দেবেন। কাজেই পাঠক হিসেবে আপনি যদি ভাবেন "মানে' শুদ্ধু সবকিছু ফ্রিতে পাওয়া যাবে, তাহলে ভুল করছেন।
আপনাকেও শিখতে হবে। "পড়তে' শিখতে হবে। ভাবা শিখতে হবে। শোনা শিখতে হবে। শিখতে হবে যে প্রতিটি শব্দ বহুমাত্রিক। প্রত্যেক শব্দ সাদামাটা অর্থ ছাড়াও পৃথক পৃথক ধ্বনি বহন করে। তাদের আলাদা আলাদা সামাজিক মাত্রা আছে। শিখতে হবে "ফুল' কখন "কুসুম' হয়ে ফোটে, কখন "ঘোড়া' "অশ্ব' হয়ে ওঠে। কেন সাধু থেকে চলিত থেকে রক-খিস্তি ঘুরে আবার সাধুতে ফিরতে হয়? রেফারেন্স যদি নাই বুঝতে পারেন, একটু গুগলি করুন না কেন? হাতের কাছেই তো রয়েছে! যাদি না শিখতে চান, তাহলে আপনি অন্তত সারা জীবন তিলমাত্র আক্ষেপ বহন করে বেড়াবেন যে কিছু কথা আপনার বোঝার গণ্ডির বাইরে থেকে গেল, কিছু কথা আপনাকে বাজাতে পারল না। তাতে যদিও দিনের শেষে আপনারও বয়ে গেল, আর লেখকেরও বয়েই গেল। লেখক আবার নিজের মতো করে লিখবেন। আর আপনিও পড়বেন আপনার মনের মতো মানেবদ্ধ ঘর ঘর কি কহানি।
শয়নকক্ষ
তাহলে কি লেখক স্বয়ম্ভূ ভোলেবাবা? যার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? মনে করিয়ে দিই, এখানে সামাজিক বা রাজনৈতিক দায়দায়িত্বের কথা বলছি না। বলছি লেখক এবং পাঠকের মধ্যের সংযোগের দায়দায়িত্বের কথা। এই ব্যাপারে একটা কথা খুব চালু আছে, লেখককে নিজের লেখার প্রতি সৎ থাকতে হবে। এই সততা-টততা খুব গালভরা শব্দ, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেকি বিশেষণ। কাজেই এই বুঝভুম্বুল শব্দ ছেড়ে সরলভাবে বলতে গেলে, লেখক শেষ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলতে চান। একটা সংযোগের সেতু বাঁধতে চান। অ্যাড এজেন্সির কপিরাইটার থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়ক- সবারই এই একই মাথাব্যথা। এই সেতুর কাজ শুরু করার আগে সবারই একটা টার্গেট অডিয়েন্স থাকে। লেখকেরও ঠিক সেইরকম একজন প্রার্থিত ভার্চুয়াল পাঠক থাকেন- সচেতনে বা অচেতনে। সেই পাঠক তিনি নিজেও হতে পারেন। বা সমমনস্ক পাঠকমণ্ডলীও হতে পারে। অথবা যাঁরা বাজারের ঘাঁতঘোঁত বুঝে ঝানু হয়ে গেছেন, তারা অনায়াসে একটা গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক বেছে নেনে। এবার তাদের কাছে পৌঁছোবার পালা। কিছু একটা বলবার পালা। লেখক যখন লিখছেন, তখন তিনি মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে সেই সেতু বাঁধবার কাজ করবেন। যদি সেইটুকু না করতে পারেন, যদি নিজের পুরোনো লেখাই বদলে বা না বদলে বারংবার চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে তিনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি চিন্তারহিতভাবে নিজের জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে থোড় বড়ি খারা চালিয়ে যান, তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীন। যদি নিজের গড়া আদল ভেঙেচুরে পাঠককে নতুন করে পাবেন বলে ক্ষণে ক্ষণে হারানোর স্পর্ধা না দেখান, তিনি মৃতপ্রায়। লেখা লেখকের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রক্রিয়া। কাজেই লেখকের দায়িত্ব এই প্রক্রিয়ার সশ্রম এবং সযত্ন নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু লেখা যেই ছেপে বেরোল, এবং পড়ার প্রক্রিয়া শুরু হল, তখন সেই প্রক্রিয়ার ভার পাঠকের এবং শুধুমাত্র পাঠকের। যদি লেখক আপনাকে "মানে' বলে দেন, তা আপনার উপরি পাওনা। কিন্তু লেখক বলছেন মানেই যে সেই "মানে'টাই একমাত্র সত্যি তা মোটেও নয়। আপনার যদি মনে হয় লেখক ফাঁকিবাজি করছেন, আপনাকে ধাপ্পা দিচ্ছেন, আপনার সঙ্গে তঞ্চকতা করছেন, জোরসে লাথি মারুন। লেখকের সঙ্গে কথা বলুন। সেতু বাঁধার চেষ্টা আপনিও শুরু করুন। কিন্তু আপনাকেও খাটতে হবে। বিনিপয়সায় দুপুরের ভোজ মেলে না।
উপসংহার
একটা সহজ কিছু লেখার চেষ্টা করা গেল, যদিও তা ক্লিশে। কিন্তু ছেপে বেরোবার পর আপনি "মানে' বুঝবেন কিনা, বা কি "মানে' করবেন, তা আপনিই জানেন। আপনার হল শুরু। আমার হল সারা।
পুনশ্চ
এই লেখায় লেখক অর্থে লেখক-লেখিকা, পাঠক অর্থে পাঠক-পাঠিকা, গায়ক অর্থে গায়ক-গায়িকা ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশির ভাগ সময়ে পোলিটিকাল কারেক্টনেসের উপরে কুঁড়েমিই জয়ী হয় কিনা!
১৪ (Mar 3 2006)
ইস্তানবুলের ডায়েরি - ১
হোটেলের পাশের উঁচু বাড়িটার ছাদে রাত হলেই শুরু হয় একঝাঁক শঙ্খচিলের চিৎকার। শঙ্খচিলেরা যে প্রায় হাঁসের মতো ক্যাঁ ক্যাঁ করে কেই বা জানত? হেমাঙ্গ বিশ্বাস জানতেন? পাশের ঘরে উঁচু আওয়াজে তুর্কিভাষার টি ভি চ্যানেল চলছে। ছাদের উপরের বারে দৈনন্দিন হৈহল্লা। তুর্কিদের জাতীয় পানীয় রাকে ("এ'-র উচ্চারণ অর্ধেক)। তীব্র মৌরিগন্ধী আরক। জলের মতো। তার মধ্যে জল ঢাললে ফেনিয়ে উঠে সব সাদা হয়ে যায়। মেটিন ওর্নেক বলেছে গালাটা ব্রিজের তলায় বসফরাসের ধারে বসে মাছের স্যান্ডুইচের সঙ্গে রাকে খেতে হয়।
মেটিন ওর্নেক। পুরো নাম হামিত মেটিন ওর্নেক। ছ ফুটিয়া ঢ্যাঙা তুর্কি যুবক। সফল পেশাদার। ধর্মে মুসলমান। কথা হচ্ছিল মহম্মদের ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে। মেটিনের মতে একটা ফালতু ছবি নিয়ে এত হইচই করার কোনও মানে হয় না। যার আঁকার কথা সে এঁকেছে। তুমি যদি দেখেই থাকো ভুলে যাও। মেটিনকে সৌদি আরবের গল্প শোনাই। মেটিন আঁতকে ওঠে। ওর প্রিয় শহর ফ্লোরেন্স আর প্যারিস। ওর একমাত্র আলোচ্য বিষয় বিভিন্ন দেশের নারী। ফ্রান্সের মেয়েরা নাকি আসলে "মা'। "নারী' দেখতে হলে যাও ইটালি। তুরস্কের মেয়েরা বিয়ের আগে "নারী' আর বিয়ের পরে "মা'। মেটিন প্রায় প্রতিজ্ঞা করে ফেলল যে কখনই সৌদি আরবে যাবে নয়।
মেটিন, কুর্দদের ব্যাপারটা কী? আমাদের "কাশ্মীর" ব্যাপারটার মতই মেটিনের কুর্দদের ব্যাপার। রাষ্ট্রের কাছে তো সবাই সমান। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ঐ ব্যাটারাই খালি আলাদা হওয়ার নাম করছে। এইসব নিয়ে চ্যাঁচামেচি করে বেশ নাম করেছেন ওরহান পামুক। শোনা যাচ্ছে তিনিই হবেন তুরস্কের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক। ইন্দ্রাণীর কথায় জানলাম সুনীলবাবুও দেশে ওরহান পামুক নিয়ে লেখালেখি করেছেন। পুরোনো বইয়ের বাজারে ওরহান পামুকের বিখ্যাত বই "কারা কিতাপের" ইংরিজি সংস্করণ পাওয়া গেল। দাম ইউরোতে, খুব চড়া। বাজারে দোকানে বই মানেই তুর্কি ভাষার বই। হোমার থেকে ব্রেখ্ট্- সবই তুর্কি। ইংরিজি বই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইংরিজিতে দীর্ঘ বাক্যালাপ করার লোক পাওয়াও কঠিন। তবে বসফরাস থাকতে আলাপের অভাব কীসের?
বসফরাসের তিন কূলে সন্ধে আসব আসব করছে। নদীটা তিনভাগে শহরটাকে ভাগ করেছে। একদিকে এশিয়ার ইস্তানবুল। অন্যদিকে ইউরোপের নতুন ইস্তানবুল। উলটোদিকে ইউরোপেরই পুরোনো ইস্তানবুল। বাইজেন্টিয়াম, পরে কনস্টান্টিনোপলের উৎপত্তি এইদিক থেকেই। তারও আগে গ্রিসের লোকজন এশিয়ার দিকে ঘর বেঁধেছিল। গালাটা ব্রিজের পাশে একের পর এক ব্যস্ত জেটি- উসুকুদার, কর্টিকয়, কাডিকয়- এই সব জায়গায় যাবে। ফেরির লঞ্চগুলো প্রায় জাহাজী আয়তনের। ঝাঁকে ঝাঁকে শঙ্খচিল দিনের শেষ উড়ান উড়ছে। নদীর ধারের ছোট ছোট দোকান। নদীর পাড়ে নৌকোর মধ্যেও একটা দোকান। বসফরাস থেকে মাছ তুলে ভাজা হচ্ছে। মাছভাজা, টোম্যাটো আর পিঁয়াজ রুটির মধ্যে পুরে। নদীর পাশের চত্বরে ছোট ছোট বসার টুল। সামনের ছোট টেবিলে লেবুর রসের শিশি আর নুনদানি। এই সন্ধেতে খদ্দের জমেছে ভালই। গালাটা ব্রিজের মুখেই ইয়েনি চামি। চামি মানে মসজিদ। ইয়েনি চামি মানে নতুন মসজিদ। নতুন মসজিদ তৈরি হয়েছিল যদিও ষোড়শ শতাব্দীতে। বাঁপাশে টোপকাপি প্রাসাদের আলো জ্বলে উঠছে। ডানপাশে উঁচু পাহাড়ের মাথায় সুলেমানিয়ে চামি। ইস্তানবুলের বৃহত্তম মসজিদ। উলটোদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গালাটা টাওয়ার। ইয়েনির চামির পিছনেই ইস্তানবুলের বিখ্যাত মশলার বাজার। রাখা আছে শতরকমের মশলা। একটারও নাম জানি না। একটা মশলাও চিনি না। আরও দেখছি পোষা জন্তুজানোয়ারের দোকানের ভিড়। দুটো ময়ূর খাঁচায় বন্দী। ইস্তানবুলের শিরশিরে ঠান্ডা বৃষ্টিতে পাখা মেলবে কী করে?
গালাটা ব্রিজের উপর দিয়ে ঢংঢঙিয়ে ট্রাম চলেছে। ট্রামের রাস্তার পাশে রেলওয়ে স্টেশন। এই স্টেশন থেকেই সেই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস ছাড়ত। এখনও কি ছাড়ে? মেটিনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। সাত পাহাড়ের শহর ইস্তানবুল। পাহাড়ের মাথায় মাথায় অটোমান আমলের চামি। সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হতে না হতেই পাহাড়ে পাহাড়ে আলো জ্বলে উঠেছে। অনেক দূরে হাজার আলো জ্বালানো একটা ক্রুইজার মর্মর সাগরের দিকে ভেসে চলছে। নদীর পাশের কাঁচা মাছের বাজারে হই হই, ট্যাক্সিওয়ালাদের ঠেক। উঁচু রাস্তা চলে গেছে গালাটা টাওয়ারের দিকে। ওই রাস্তার ডানকোণে ইস্তানবুলের সরকারি বেশ্যাখানা। তুরস্কে বেশ্যাবৃত্তি বৈধ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত পাবলিক সেক্টর। গলির মুখে পুলিশ পাহারাদার দাঁড়িয়ে থাকে। সেই গলিতে শিশু এবং নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সন্ধে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘোর ট্রাফিক জ্যাম। ইস্তানবুলের ট্র্যাফিক জ্যাম অতুলনীয়। যে কোনও পাঁচ মিনিটের রাস্তা পেরোতে আধ ঘন্টা লাগে। হোটেলে ফিরব।
ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজে থেকেই পৌঁছে দিতে চায়। অতি অমায়িক ড্রাইভার। ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বাক্যালাপের চেষ্টা করে। সিগারেট ধরায়। তুর্কিরা ঘোর ধূম্রপায়ী জাত। কোথাও তোমার ধূম্রপানের নেই মানা! সাধে কি এদের ই ইউতে নিতে চাইছে না। ট্যাক্সি চলে ঢিকির ঢিকির। পাশে বয় বসফরাস। মিমার সিনান বিশ্ববিদ্যালয়, নুসরাতিয়ে চামি, কেমাল পাশা চামি। হঠাৎ ঘোর ভাঙে ট্যাক্সিওয়ালার ডাকে। হোটেল থেকে বেশ একটু দূরে ট্যাক্সি থামিয়েছে। মিটারে দেখি স্বাভাবিকের ডবল ভাড়া। জিজ্ঞাসা করতেই ট্যাক্সিওয়ালার রুদ্ররূপ। কথা না বাড়িয়ে দুটো নোট দিই হাতে। নিমেষে একটা নোট ভোজবাজির মতো উবে যায়। মাথা চাপড়ে চাপড়ে এতক্ষণের বন্ধু বোঝায় আমি একটা নোট দিয়ে কম পয়সা দিয়ে ফাঁকি মারার চেষ্টা করছি। আরও কিছু টাকা গচ্চা যায়। গজ্গজ্ করতে করতে ট্যাক্সিওয়ালা চলে যায়। কিছুদূর গিয়ে নিশ্চয় হো হো করে হাসবে।
হাসুক গে। আমি ঘরে গিয়ে এখন এন রাজমের বেহালায় "ঠুমক চলত রামচন্দ্র" শুনব। ইস্তানবুলের সন্ধের ঠান্ডায় কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। হোটেলের ঘরের জানলা খুলে দিই। পাশের ছাদে আবার রাতের শঙ্খচিলগুলো এসে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তবে বেহালা বাজলেই কেন জানি উড়ে চলে যায়। ওরা হয় তো সুলতান ইব্রাহিমের পোষা। সুলতান ইব্রাহিম তোপকাপি প্রাসাদের খাঁচায় টানা চার বছর বন্ধ থেকে থেকে পাগল হয়ে গেছে। এবার এন রাজম চালিয়ে দিই।
১৫ (Mar 16 2006)
ইস্তানবুলের ডায়েরি- ২
টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। পনেরো তলার বন্ধ জানলায় সাঁই সাঁই হাওয়ার প্রবল ধাক্কা।
ইস্তানবুল এক বিশালতা। সচল বিশালতা। মুখের সামনে যেন কেউ এক তলা উঁচু কেক রেখে দিয়েছে। কেকের প্রতি অংশের স্বাদ-রং-গন্ধ-স্পর্শ আলাদা। তাও পালটাচ্ছে। ক্রমাগত। অথচ এক ঘন্টার মধ্যে খাওয়া শেষ করতে হবে। সম্ভব? কাজেই ইচ্ছের খোলা হাওয়ায় খাবলে খুবলে খাই। শুধু কেকের উপর লাল টুক্টুকে চেরিগুলোকে একটু সময় দিতেই হয়। এইরকমই এক অগ্রগণ্য চেরি আয়া সোফিয়া। ল্যাটিনে Sancta Sophia আর গ্রিকে Haghia Sofia ।
৩৬০ খ্রিস্টাব্দ। সম্রাট কনস্টান্টিনিয়াস এক কাঠের ব্যাসিলিকা তৈরি করলেন। রায়টের আগুনে ধ্বংস হল। আবার ৪১৫ খৃস্টাব্দে সম্রাট দ্বিতীয় থিয়োডোসিয়াস তৈরি করলেন। নিকা রায়টের সময় তাও পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখনকার কাঠামো তৈরি হল সম্রাট জাস্টিনিয়ানের হাতে। কনস্টাটিনোপলের পতনের আগে অবধি আয়া সোফিয়া ছিল খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যের মহত্তম সৌধ। ১৪৫৩ সালে সম্রাট মেহমেত দখল করলেন কনস্টান্টিনোপল। সঙ্গে সঙ্গে গির্জা হল মসজিদ। দুই ধর্মসম্প্রদায়ের কাছেই আয়া সোফিয়ার মাহাত্ম্য অসীম। ১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্কের আদেশে আয়া সোফিয়া রূপান্তরিত হল মিউজিয়ামে।
দেশের কথা কেন যে মনে পড়ে?
ইস্তানবুল সাত পাহাড়ের দেশ। পাহাড়ের মাথায় মাথায় অটোমান স্থাপত্যের মসজিদ। উপরের গম্বুজ নিখুঁত অর্ধগোলক। চারপাশ থেকে সরু পেনসিলের মতো খোঁচা খোঁচা মিনার আকাশের গায়ে লেপ্টে আছে। সেই তুলনায় আয়া সোফিয়ার বাইরের গড়ন একটু খাপছাড়া। বোঝা যায় হাতের পর হাত পড়েছে। ঠিক এর উল্টোদিকেই প্রকান্ড সুলতান আহমেত চামি বা নীল মসজিদ। অনেক সুঠাম। আয়া সোফিয়ার আসল খেল দরজা পেরোবার পর।
এখনও বৃষ্টি পড়ছে। টিকিট কাউন্টারের সামনে গাঁও থেকে আসা তুর্কিদের ভিড়। উঁচু গলার কথাবার্তা। দশ লিরার টিকিট।
আস্তে আস্তে এগোই। বিরাট অলিন্দের অন্ধকার মেঝেতে রঙিন কাচের জানলার ঝিলিমিলি। এর পরের বারান্দায় ঢুকতেই আস্তে আস্তে একের পর এক গম্বুজ খুলে যেতে থাকে। চোখের সামনে দূরে আবছায়া অনন্ত সেই মাতৃমূর্তি। মূল রাজকীয় দরজায় দাঁড়ালে বিশাল মূল গম্বুজ ছেয়ে ফেলে। নির্ভার বিশালতা। কোনো থাম ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। নি:শব্দ টুরিস্টদের ভিড়। একপাশে কান্নার স্তম্ভ। প্রবাদ স্তম্ভের গায়ের ফুটোতে আঙুল ঢুকিয়ে প্রার্থনা করলে ইচ্ছেপূরণ হয়। তার পাশে এক মানুষ সমান শ্বেতপাথরের জালা। সোজা এগিয়ে এলে পরবর্তী ইসলামীয় সংযোজন প্রার্থনার মিহরাব, আড়ালে ঢাকা রাজকীয় প্যাভিলিয়ন। উপর থেকে ঝুলে আছে গোলাকৃতি চামড়ায় আঁকা তুর্কি ক্যলিগ্রাফিতে আল্লা আর খলিফার নাম- মুস্তাফা ইজ্জেত এফেন্দির আঁকা। আলাদাভাবে অসাধারণ, কিন্তু আয়া সোফিয়ার অলৌকিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। সোনারঙের মোজেইকে করা ফ্রেস্কোতে একসময় আয়া সোফিয়ার দেওয়াল ভরা ছিল। এখন তার কিছু অবশিষ্ট। পাথুরে ঢালু রাস্তা বেয়ে উপরের গ্যালারিতে গেলে ছবিরা একদম চোখের সামনে। ক্লাস সেভেনের ইতিহাস বইয়ের পাতাগুলো মনে পড়ে? একসময় খ্রিস্টীয় জগতে প্রবল তর্কাতর্কি হয়। এইসব ছবি থাকা উচিত কি উচিত নয়। তার ফলে যে আভ্যন্তরীণ ধর্মযুদ্ধ তাতে বহু ফ্রেস্কো নষ্ট হয়। এর পরে ইসলাম আধিপত্য এলে আর এক প্রস্থ ধ্বংসের পালা। কিন্তু আমাদের তুমুল সৌভাগ্য যে অটোমান সম্রাটেরা ফ্রেস্কোগুলো খুঁচিয়ে নষ্ট না করে চুনামাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। ফ্ল্যাশের আলো ব্যবহার বারণ। তাও অত্যুৎসাহীরা। কেন যে করে? উত্তরপুরুষের জন্য কিছু থাকবে না। সেই ভাবনাচিন্তা নেই বোধ হয়। এই সুপ্রাচীন নৈ:শব্দ্যে নাস্তিকেরও ক্ষণস্থায়ী ঈশ্বরবোধ হয়। অথচ বেশির ভাগ মন্দিরে কেন যে?
আয়া সোফিয়া থেকে যখন বেরিয়ে আসি ইস্তানবুলের আকাশে রোদ ঝল্মল্ করছে। উল্টোদিকে ইস্তানবুলের বৃহত্তম মসজিদ- নীল মসজিদ। লন্ডনের যেমন রেনসাহেব ছিলেন স্থপতিদের রাজা, ইস্তানবুলের তেমনি মিমার সিনান। তো প্রথম থেকেই সিনানের চেষ্টা কী করে আয়া সোফিয়ার মতো থামহীন বিশাল গম্বুজ বানানো যায়। বহু মসজিদ বানানোর পরে অবশেষে সুলতানিয়ে চামিতে প্রথম সাফল্য। নীল মসজিদ বৃহত্তম হলেও এর বিরাট গম্বুজ চার থামের উপর দাঁড়িয়ে।
কত ইতিহাস! বাতাসে তুড়ি মারলে ঝরে পড়ে। আর সে ইতিহাসও ছোটখাটো কিছু নয়। মনেই ছিল না ক্রিমিয়ান যুদ্ধের সময় এই ইস্তানবুলেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গ্লের আত্মপ্রকাশ এবং মহত্তম সেবাকীর্তি।
যাচ্ছি গেব্জেতে। ইস্তানবুল থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে ইজ্মির প্রদেশে। খুবই ছোট জনপদ। মূল কেন্দ্র এক টেক্নোলজি পার্ক। তাকে ঘিরে মাইলখনেক জোড়া শহর। মর্মর সাগর এখানে স্থলভূমির মধ্যে গোঁৎ খেয়ে ঢুকে এসে এক উপসাগর তৈরি করেছে। উলটোদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ের তলায় বুর্সা- অটোমান সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী। আশি মাইল হাইওয়েতে। সেই এক যাত্রা। নিরুত্তাপ গতি। এটা এশিয়া। টেক্নোলজি পার্কে ঢোকার অনেক কড়াকড়ি। একের পর এক সিকিউরিটি চেক। গেট পেরোবার মুখে দিক্নির্দেশক বিভিন্ন সাইনবোর্ড। তার একটাতে লেখা হানিবলের কবর। কোনও ছোটখাটো পাহাড় হবে! মেটিনকে জিজ্ঞাসা করি। মেটিনের উত্তর- হানিবলের নাম শোনো নি/ অ্যান্টনি তো চেনো/ হানিবল সে অ্যান্টনিরই পূর্বপুরুষ জেনো। সেই হানিবল? সেই কার্থেজ, রোম, হাতির দল, আল্স অতিক্রম? এই অজ্ঞাতকুলশীল জনপদে শত শত প্রযুক্তিবিদের কান্ডকারখানার পাশে ভদ্রলোক শুয়ে আছেন? ঘুরে আসা যাক। পায়ে হাঁটা রাস্তা টিলার উপরে উঠে গেছে। টিলার উপরে উঠতেই আতাতুর্কের আদেশে তৈরি ছোট পার্কের মধ্যে হানিবলের সমাধি। আমাদের তুর্কি ড্রাইভারও বিস্ময়ে হতবাক। দূরে পাহাড়ের কোলে কুয়াশা ঢাকা মর্মর সাগর। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ এশিয়ান ভূখণ্ড। এইখানেই হানিবল আত্মহত্যা করেন। রোমান সাম্রাজ্যের প্রবলতম চ্যালেঞ্জারের উপযুক্ত সমাধিস্থলই বটে।
তুরস্কের আকাশে এখন অনেক রোদ। ঝাঁকে ঝাঁকে ছেলেমেয়ে গেব্জের জঙ্গুলে পাহাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।
১৬ (Mar 31 2006)
একটি দুর্বোধ্য ভোটনাট্য বা গিট্টু গিট্টিয়ে গিট্টালো
(তল্পিস্বীকার: শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
(স্টেজের উপর পেন্ডুমিতভাবে চার গিট্টু বসে আছে। প্রথমজন বয়োবৃদ্ধ। আদুল গা, পরনে টক্টকে লাল শায়া, মাথায় জরির টুপি, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, মুখে একটা হেলুভাসীন ভাব। নাম চক্রবৎ চক্রবর্ত্তী। বাকি তিনজনেরই মাথায় বেসবল ক্যাপ, পরনে সাদা ব্লাউজ আর কালো শর্টস। ক্যাপের রং থেকে বোঝা যায় কার গিট্টুমি কতটা ইরম্মিভ। নাম ইল্লিয়ার্কি পাল, ধর্মাধর্ম ধাড়া এবং জয়মাদয়া কর।)
চক্রবৎ।। ছ্যা ছ্যা ছ্যা! আবিত্ত বলে আর কিছুই রইল না। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে যত ফুসকিত বিরোধী ছ্যানাপোনা! এইটুকুও বোঝে না যে এই উদ্লাইয় রাজ্যে বামফ্রন্টের একমাত্র আলপত্য হল উন্নততর বামফ্রন্ট। (বাকিদের দিকে ফিরে) ও তোমরা যতই আবলুশ গাবলুশ কর, শেষে পাইবা একখান তেলুষ্টি রম্ভা।
ইল্লিয়ার্কি।। অলপ্পেয়ের কতা সোনো অ্যাকবার! তিরিস বচোর ধোরে লাইপেঁচুটি কোরেও মুগপোড়ার গ্যাঁড়ামি গ্যালো না। কয়েক বচোর ভোটে জিতেচে বোলে ছ্যাকারি কোরেই চোলেচে, কোরেই চোলেচে! সালা ময়ামিচিলের অ্যাকটা পেন্সিনেসন কত্ত, দেখতাম কে জেতে!
চক্রবৎ।। হায় রে কপাল! কাকে আর কী বলব? আমাদের কাছে শিখলি আর এখন আমাদেরই শেখাস! বাই দ্য ওয়ে, ওটা পেন্সিনেসন নয়, কম্পিটিশন। এই উদ্লায়িত রাজ্যের সর্বঘৃত স্বার্থে অন্তত ভাষাটা শুদ্ধ কর।
ইল্লিয়ার্কি।। য্যাতো বড়ো মু নয় ত্যাতো বড়ো কতা! জ্ঞান দিবি নে, জ্ঞান দিবি নে বোলচি। দুম্ করে ধম্মোঘট ডেকে দেবো। সেক্টর ফাইব ইলটুবিলটু হোয়ে যাবে। সিল্পোন্নয়নের গাড়ুয়া বাজিয়ে দেবো। সালা ওয়ান থেকে ইংলিস তুলে দিয়ে অ্যাকন আবার ধিনিচাঁদ ভাসা সেকাচ্চো!
চক্রবৎ।। (মুচকি হেসে) যার শেখার সে অমনি শেখে। তিরিশ বছরেও যখন কিছু শিখলি না, তখন ইংরিজিই বা কি, আর ধাঁইকিরিই বা কি! (হাই তুলে) জয় বাবা ধান্দানাথ, ভোট দে নয় বিরোধী দে।
ইল্লিয়ার্কি।। পেটোন্টিফিক রিগিং সেকাতে এসেচে! বলি হ্যাঁ গা, বয়েস তো কম হল নে। অ্যাকটা মেয়েমানসের সামনে এসব কইতে পোড়ামুয়ে অ্যাকবার বাঁদলো না?
চক্রবৎ।। নির্বোধের আবার ছেলেমানুষ মেয়েমানুষ! যাঁহা মুলো তাঁহাই বাতকর্ম।
ইল্লিয়ার্কি।। (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে) মাজার তলায় কাটি কল্লে সজ্জ কোরবো না বোলে দিলুম। তোমার সাদের বাগান ছালবাল কোরে দিয়ে যাবো। (দর্শকদের) এর পরেও আমার জোন্নো আপনাদের আদ ফোঁটা দুক্কু হয় নে কো! এ কোতায় আনিলে তুমি জগদীশ্বর সাজাহান? (জিভ কেটে) য্যা:, গুলিয়ে গ্যাচে। (চক্রবৎকে নীচু গলায়) অ্যাকটা সিগ্রেট ছাড়ো না জেঠু। চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে গলাটা ঢিম্মি হোয়ে গ্যাচে।
চক্রবৎ।। (কমল মিত্রের হাসি) হা: হা: হা: হা:। চিকলু এখন সিগ্রেটও খেতে চায়! হা: হা: হা: হা:। (হাসি থামিয়ে) এই নে তোর বরাদ্দ চুঁইবিড়ি।
ইল্লিয়ার্কি।। (বিড়ি ধরিয়ে) বিরোদীদের মুচে ফ্যালার চক্কান্তো মানচি না, মানবো না। মানচি না, মানবো না (ঘুরে ঘুরে)।
চক্রবৎ।। (দাপুটে গলায়) অ্যাই চোপ্। এনারা সব শুধু আমাদের খিল্লাখিল্লি দেখতে আসেন নি। প্রদ্যুম্ন আর অয়স্কান্তকেও কিছু বলতে দাও।
(ইল্লিয়ার্কি বসে পড়ে। ধর্মাধর্ম একটু তোতলা। তার উপর চারশো সাতচল্লিশ বছর আগে লুপ্ত হওয়া এক ভাষায় কথা বলেন। কাজেই কেউ বোঝেও না, শোনেও না।)
ধর্মাধর্ম।। মম পরিচিতি সম ক্ষম হে ক্ষম ধর্মাধর্ম।
ইল্লিয়ার্কি।। মানে ওঁয়ার নাম ধম্মাধম্ম। ওঁয়াকে পোঁদ্দুম্নো বলায় দুষ্ক পেয়েচেন।
ধর্মাধর্ম।। অপিনিহিতি অনুপ্রবেশ অপদ্রব্য আকুল আবেশ।
ইল্লিয়ার্কি।। সালার সরকার ওনুপ্পোবেস নিয়ে কিচ্চু কোরচে না।
ধর্মাধর্ম।। হিন্দুরাজ্য বহুব্রীহি সদয় তনয় সাগরদীঘি।
ইল্লিয়ার্কি।। অসাম্পোদায়িক হিন্দুরাজ্জো লা হোলে কিচ্চু হবে লা।
চক্রবৎ।। হ্যাঁ, আরও বল। ডট কম দমাদম, পা পিছলে আলুদ্দম।
ধর্মাধর্ম।। অন্ অন্ অন্ .....
ইল্লিয়ার্কি।। অন্যায়।
জয়মাদয়া।। হ: আমার নাম লইয়াও আফনে অন্যায় করসেন। জয়মাদয়ারে অয়স্কান্ত বানাইয়া দিলেন। কাল গান্দিমূর্তির কুলে বইয়া ইয়ে করতে অইব। মানে ইসে। আর আউট অফ টার্ন কতা কইতে কন ক্যান? কাল আফনের ইয়েতে গিয়া কইলাম না যখনতখন ইসে কত্তে কইবেন না। ম্যাডামের লগে দুইখান কতা কইয়া লই। তারপরে ইয়ে হইব খনে।
ইল্লিয়ার্কি।। তোর তরমুজটা ইয়ে না ইসে?
জয়মাদয়া।। অবজেকশন ইয়োর অনার। এইসব অসাংবিধানিক ইয়ে পাইন্য করুম না। অ্যাভোকাডো কইতে পার, ব্যাদনা কইতে পার, অ্যামন কি পেডন্ড কইতে পার। কিন্তু তাই বইল্যা ইসে? মহাজোট হয় নাই বইল্যা যা খুশি তাই কইবা?
ইল্লিয়ার্কি।। (হঠাৎ প্রচন্ড তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে শুরু করে) চুলকুচ্চে, চুলকুচ্চে। উরিব্বাপ, কি ভয়ানক চুলকুচ্চে। ওরে মারে, মোরে গেলুম রে।
জয়মাদয়া।। এই আর অ্যাক ঢং হইসে। মহাজোট শুনলেই খাউজাইতে লাগে। (সেলফোনে কিড়িং কিড়িং এবং জয়মাদয়ার তুমুল নৃত্য) ইয়ে আইসে, ইয়ে আইসে। (নাচতে নাচতে) কইব কতা আমার লগে, কইব কতা আমার লগে।
(এইসব চিল্লামিল্লির মাঝে ঢোকে তিনটি উলঙ্গ রোবট। এদের নাম ং, : এবং ঁ। কথা বলে চিংক্রিত সুরে।)
রোবটেরা।। আমাদের ছাড়া মিটিন হয় কেন? মিটিন হয় কেন? মিটিন হয় কেন?
চক্রবৎ।। এই সেরেছে। এরা আবার এখানে কেন? এদের তো তালা মেরে রেখে এসেছিলাম।
ইল্লিয়ার্কি।। আর কদ্দিন সবাইকে টেঁউটি করে রাখবি? বাংলার ভাগ্যাকাসে আজ য্যাকোন দুজ্জোগের ঘনঘটা (জিভ কেটে) আবার গুলিয়েচি।
রোবটেরা।। আমাদের বক্তব্য শোনা হোক। শোনা হোক। শোনা হোক।
চক্রবৎ।। (স্বগত) পাবে পাঁচটা সিট আবার বক্তব্য! (রোবটদে) তুনবো বাবু, তুনবো। বাইলে গিয়ে এত্তু বোচো। পেতকাতা ন্যাপিকাকু বোচে আচে। ও তোমাদের মিত্তি দেবে, খ্যান্না দেবে। বয়োদের কতার মাদে দুত্তুমি কয়ে না। দাও বাবু, মিত্তি খাও। আমি এক্হুনি তোলে আচবো।
রোবটেরা।। মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি। খাঁটি মিষ্টি।
(রোবটেরা বেরিয়ে যায়।)
ধর্মাধর্ম।। অনস্বীকার্য ব্রহ্মচর্য আলুলাইয় মূল্য ধার্য।
জয়মাদয়া।। এইডায় আবার কি কয়?
ইল্লিয়ার্কি।। উনিও মিস্টি খেতে চাইচেন।
চক্রবৎ।। উফ্! চার গন্ডা করে প্লট দিয়েছি, বাড়ি দিয়েছি, তাও তোদের পিঙ্কিবাজি আর থামল না। বসতে দিলে শুতে চায়, খেতে দিলে হাগতে চায়! মাথাটা কেমন বন্বন্ করে। আজ সভা ভংগ। পেটকাটা ন্যাপির সাথে দুটো কথা বলা দরকার। সভা ভংগ!
জয়মাদয়া।। সবা বঙ্গ করলে হইব? আমার তো ইসেখান কওয়াই হইল না। ফুনে ম্যাডামের লগে ইয়ে কইর্যা আইলাম। ম্যাডাম কইয়া দিলেন কি কইর্যা ইসে করতে হইব।
ইল্লিয়ার্কি।। আমাকে পেটোন্টিফিক রিগিং না সিকিয়ে কোতায় পালাবে চাঁদু? মাগনা মাগনা মিটিন হবে? খচ্চা নেই?
ধর্মাধর্ম।। অনস্বীকার্য ব্রহ্মচর্য আলুলাইয় মূল্য ধার্য।
(এমন সময় এক বালকের প্রবেশ। বেশভূষা শাহেনশা বইয়ের অমিতাব্বচ্চনের মতো। নাম ম্যাঁও।)
ম্যাঁও।। ঢিচকাও, ঢিচকাও। বুম বুম বুম।
জয়মাদয়া।। লাও। হইয়া গ্যালো গিয়া। অখন ম্যাও সামলাও।
চক্রবৎ।। আইস বৎস ম্যাও। ল্যাবেঞ্চুষ খাইবা?
ম্যাঁও।। ঢিচকাও ঢিচকাও।
ইল্লিয়ার্কি।। ল্যাবেঞ্চুস দ্যাকাচ্চো? বোলি বাজেতে পাস কোরিয়েচিলে?
ম্যাঁও।। বুম বুম বুম।
চক্রবৎ।। শোন রে হতচ্ছাড়া চিকলু। ম্যাঁও সামলাতে আমি কোথা থেকে কি পয়সা আনি তা নিয়ে তোদের কাছে কৈফিয়ৎ দেবো না। শালা ক্যাগের বাসায় বগের ডিম দেখাচ্ছে। (ম্যাঁওকে) আইস বৎস, ল্যাবেঞ্চুস লহ।
ম্যাঁও।। (লজেন্স নিয়ে) ঢিচকাও ঢিচকাও বুম বুম বুম। কপাৎ কপাৎ।
জয়মাদয়া।। রামদাও লইয়া আইসে।
(একটি সাধারণ মানুষ ঢোকে। হতচকিত এবং অম্প্রলিত।)
মানুষ।। (ইতস্তত: স্বরে) দাদা, রাইটার্স কোন দিকে একটু বলবেন?
(ভীতসন্ত্রস্ত সবাই তড়াক করে লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর।)
চক্রবৎ।। কমরেড, সাবধান। নির্বাচন কমিশন এসেছে।
ইল্লিয়ার্কি।। বিষ, বিষ। বাঁচাও, বাঁচাও।
জয়মাদয়া।। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। অ ম্যাডাম, আফনে কই গ্যালেন? ম্যাডাম, ম্যাডাম!
ধর্মাধর্ম।। (কেঁদে ফেলেছে) হায় আল্লা, হায় আল্লা!
ম্যাঁও।। পুলিশ পুলিশ! ঢিচকাও ঢিচকাও। পুলিশ পুলিশ!
মানুষ।। (সন্ত্রস্ত) ও দাদা, কী হল আপনাদের? প্লিজ বলুন না রাইটার্স কোন দিকে? কয়েকটা জরুরি কাজ ছিল।
(একটি প্রশ্ন এবং পাঁচ ভীত গিট্টুর চিল্লামিল্লির মধ্যে পর্দা পড়ে।)
১৭ (May 2 2006)
আস্তিকের ভোট
এখন পুরোনো সি পি এম মানে জ্যোতিবাবুর সি পি এম আর নতুন সি পি এম মানে বুদ্ধবাবুর সি পি এম। কিন্তু সাতাত্তরের আগেও সি পি এম ছিল। প্রমোদবাবুর সি পি এম ছিল, মুজফ্ফর আহমেদের সি পি এম ছিল, এমন কি এক সময় চারু মজুমদারের সি পি এমও ছিল। তবে আমাদের জন্ম সত্তরের শুরুতে। অর্থাৎ স্মৃতির খেয়া যখন ঘাটে এসে দাঁড়াল, তখন বামফ্রন্টের রাজ্যপাট শুরু হয়ে গিয়েছে। তার আগের সি পি এম গল্পকথার সি পি এম, বহুজনের স্মৃতির ভাষ্যে গড়ে ওঠা সি পি এম। আশি, এমন কি নব্বইয়ের দশকেও এই স্মৃতির ভাষ্য জীবন্ত ছিল। এখন আস্তে আস্তে জলছবির রং পালটেছে, ইতিহাসের কোণায় কোণায় মাকড়সার বাসা। এটাই স্বাভাবিক। স্মৃতিহীনতা যেমন অপক্ব সভ্যতার লক্ষণ, ঠিক সেই ভাবেই অবিরত স্মৃতিভার স্থবিরত্বের। দিন পালটায়, আমি পালটাই, তুমি পালটাও, স্মৃতিও উলটে পালটে যায়।
ছোটবেলায় ঘরের দেওয়ালে লেনিনের ছবি টাঙানো ছিল। লেনিন হিসেবে যতটা, তারও বেশি বাবাকে দেওয়া এক ছাত্রের উপহার হিসাবে। আশির দশকে বাবা যখন শিক্ষকতা ছেড়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছেন, এবং যখন হঠাৎ অসুখে প্রবল বিকারগ্রস্ত, লেনিনের ছবিটা নামিয়ে ফেলেছিলেন। তারপর আরও কিছু বাসাবদলের পরে নতুন সহস্রাব্দে ছবিটা উধাও। মামাবাড়িতে লেনিন-স্তালিন-মাও কেউ ছিলেন না। একটু সব্জেটে প্রিন্টে হাস্যমুখ মুজফ্ফর আহমেদ এবং ছোটখাটো হো চি মিন। এক সময়ে বামপন্থীরা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে যতই গাল পাড়ুন না কেন, গোঁড়া বামপন্থী পরিবারগুলোতে রবি ঠাকুরের মহিমা ছিল অবিসংবাদিত। ব্রাহ্ম এবং বামপন্থী রক্ষণশীলতার যৌথ প্রভাবে "মহাবিশ্বে মহাকাশে' থেকে "এসো মুক্ত করো'- এর মধ্যেই যাওয়া আসা ছিল। সিনেমার তুখোড় গান শুনতে আরও অনেকটা লায়েক হতে হবে। ঠাকুমার ঝুলির পাশে খাদ্য আন্দোলনের গল্প ছিল, মিতুল নামে পুতুলটির পাশে ছিল সত্তরের কলকাতার শহরতলির গল্প, ঠাকুরদা এবং ঠাকুমার ব্রিটিশ আমলের শ্রীহট্ট জেলের গল্পের পাশাপাশি ছোটমামার কবরখানায় লুকিয়ে থাকার গল্প। এই কবরখানায় লুকিয়ে থাকার সময়ই নাকি আমার জন্ম।
ছিল ভয়। চেনাজানা লোকেদের কাছে সত্তরের গল্প শুনতে শুনতে অনেক বড় না হওয়ার আগে ভাবতেই পারতাম না ভালো লোকেরা কংগ্রেসী হতে পারে। খালের একপাড়ে শান্তিনগর, আর এক পাড়ে পূর্বাচল। সেই পূর্বাচলের কলেজে পড়া ছেলে। পাড়ায় গোলমাল শুরু হতেই বাবা মা বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। পরে পাড়ার কংগ্রেসী ছেলেরাই বলল কোনও চিন্তা নেই, ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। কয়েকদিন বাদে সেই ছেলের লাশ খালে ভাসে। কিংবা কল্যাণনগরে তখন অবাধ দৌরাত্ম্য। কংগ্রেসের ছেলেরা রাতে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে উঠে মনের সুখে আড্ডা মারে এবং নিদ্রা যায়। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে চলে বিপুলভাবে ইলেকট্রিকের তারচুরি। একদিন পাড়ার লোক আর সহ্য না করতে পেরে বঁটি-খুন্তি হাতে বেরিয়ে এসেছিল। সেই অভাগাদের স্মরণে এক অনাদৃত স্মৃতিসৌধ কল্যাণনগর বটতলার মোড়ে পড়ে আছে। অথবা মামা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল বেলেঘাটার ছেলে রঞ্জিত। দিদার পাঁচ ছেলের সঙ্গে আরও একজন। খড়দহ স্টেশন থেকে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কুপিয়ে ফেলা হল। থিয়েটার ওয়ার্কশপের পুরোনো নাট্যকর্মী সত্যেন মিত্র। বাড়ি ফেরার পথে সিঁথির মোড়ে কংগ্রেসী গুন্ডারা মেরে ফেলেছিল। এখনও থিয়েটার ওয়ার্কশপ মনে হয় সত্যেন মিত্রের স্মরণে পুরস্কার দেয় বা নাট্যোৎসব করে। তো এইসব গল্প শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠার ফলে ভোটের সময় কংগ্রেসের কিছু নিরীহ ছেলে বাড়িতে ভোটার স্লিপ দিতে এলেও ভয়ে দম আটকে যেত।
এন বি এর বরুণকাকুর হাত দিয়ে পাওয়া প্রথম উপহার "ছোটদের কমিউনিস্ট ইশ্তেহার"। অন্তত এখন যা স্মৃতির পর্দায় ধরা পড়ে। প্রথম পাতায় ছিল সাদা কালো স্টেনসিলে আঁকা দুটো উত্তোলিত হাত, আর একটা মোটা গোছের ছেঁড়া শিকল। তলায় বড় বড় হরফে লেখা- সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই। তখন রাশিয়ান আর চিনে বইয়ের রম্রমা খুব। তারই মধ্যে একটা বই ছিল "সোসো'। রাশিয়ার একটি বাচ্চার ছেলেবেলার গল্প। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারবার পড়তাম। কমলা মলাটের উপর সেই কিশোরের ছবি। তার জনপ্রিয় নাম স্তালিন। কোনও এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে পেলাম মোটাগোঁফ মিলিটারি পোষাকে স্তালিনের পোস্টার। লেনিনের ছবির থেকেও তাড়াতাড়ি সেই পোস্টার হারিয়ে গিয়েছিল। তখন দেওয়ালে প্রায়ই গরু বলদের। আর এক হিংস্র ডাইনির হাত, বড় বড় নোখ, নোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। জেনে গিয়েছিলাম ওটা হল ইন্দিরা গান্ধির হাত। সেই সময় বি জে পি ছিল না। জনতা পার্টি হবে হবে করছে। লালকৃষ্ণ আদবানী, অটলবিহারী বাজপেয়ী- সবাই সেই জনতা পার্টির অংশ। ছোটদের সহজ সরল দুনিয়ায় একদিকে ভালো সি পি এম, আর একদিকে বাজে কংগ্রেস। বাকিরা অজানা।
দম্দমে তখন পার্টি আফিস একতলা, উপরে টিনের চাল। প্রতি সন্ধ্যাবেলা মায়ের হাত ধরে গুটি গুটি হাজির হতাম। সবাই আমাকে চিনত পার্টি অফিসে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হাজির হওয়া খুদে কমরেড হিসাবে। আমিও সবাইকে চিনছিলাম। নীরেন ঘোষ, শান্তি ঘটক বসে থাকতেন। নাগেরবাজার দিয়ে হেঁটে যেতে দেখতাম ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবিতে সুভাষ চক্রবর্তী। সেন্ট জেভিয়ার্সে পদার্থবিদ্যার মেধাবী ছাত্র পুকুলদা পড়াশুনো ছেড়ে সারাদিন রাজনীতি। আমার বাবা মা সারাক্ষণ পুকুলদাকে পড়াশুনা শেষ করার জন্য ব্রেন ওয়াশ করতেন। আর এক যাওয়ার জায়গা ছিল আর এন গুহ রোডের অতিবিস্তৃত বস্তি। মায়ের সঙ্গে মহিলা সমিতির মেম্বারশিপের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো। ছোট ছোট দরমার ঘরে বসে মহিলাদের সুখ দু:খের গল্প। কনফারেন্সগুলোতেও আমার ঠাঁই হত মহিলা সমিতির দেওয়া আলুর দম ঘুগনির স্টলে। কনফারেন্সের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেই আদি আই পি টি এ বা কলকাতা কয়ার। তখনও সারা টালিগঞ্জ-নন্দন-অ্যাকাডেমি আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান বলে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। তো এই অনুষ্ঠানে আমাদের কাছে হিট ছিল রানার আর জন হেনরি। রানারে এক জায়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৌড়ানো আর জন হেনরিতে সারা গায়ে কালিমাখা লোকটার গোল্লা গোল্লা মাংসপেশী কাঁপানো। দম্দমের বিপুল জনপ্রিয় এম এল এ ছিলেন তরুণ সেনগুপ্ত। দীর্ঘকায়, অতি সুরসিক মানুষ। যেদিন মারা গেলেন, সেদিন ভিড়ের ঠেলায় পার্টি অফিস অবধি পৌঁছনো দায় ছিল। দম্দম ছুটি ছিল। বাবা প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে পার্টির তাত্ত্বিক ক্লাস নিতেন। মিটিং-এর আগে বাড়ি বাড়ি ঘুরে হইহই ছেলেরা হাতে গড়া রুটি সংগ্রহ করে নিয়ে যেত। বাড়ির দুই তাক ভর্তি ছিল লেনিনের সম্পূর্ণ রচনাবলী, আর মার্ক্সের দুই খণ্ড গাবদা গোবদা দাস কাপিতাল। বইয়ের ওই তাকটা দেখতে বেশ সুন্দর লাগত। এক রং-এর মোটা মোটা বই সারি দিয়ে সাজানো। বেশ একটা গম্ভীর বই বই ভাব। কিন্তু এত সবের পরেও ছুটির দুপুরের নিয়মিত সঙ্গী বল্লালী বালাই আর অক্রুর সংবাদ। বছরের পর বছর।
তারপর আমারও বয়স বাড়ে, সি পি এমেরও। দুজনেই আরও হিসেবি, আরও বুঝদার হয়ে উঠি। আমি বড় হই, সি পি এমও বড় হয়। বড়ত্বের সুনিপুণ চালে ভবিষ্যৎ ইমারতের এক একটা ইঁট জড়ো হতে থাকে। সাদা-কালো মুছে গিয়ে আস্তে আস্তে ধূসরবর্ণের চশমা লাগে চোখে। খবরের কাগজ এবং টি ভির কিছু নৈর্ব্যক্তিক খোলসের খস্খসে ছোঁয়া লাগে বড় হয়ে ওঠার ব্যস্ত মুহূর্তে। কোনও খোলসে নীরক্ত হাত, কোনও খোলসে শুকতারার তলায় পড়ে থাকা ছোট ছোট খেলনা কাস্তে হাতুড়ি, কোনোটায় তীব্রগন্ধ পাঁকে পচতে থাকা পদ্মফুল। এর মধ্যেও নব্বইয়ের দশকের ছবিও আলগাভাবে গুছিয়ে তুলি। তিয়েনানমেন স্কোয়ার এবং বানতলা প্রায় পিঠোপিঠি আসে। মণ্ডল কমিশনের ঝড় কলকাতায় আছড়ে পড়লে কলেজে ক্লাস বয়কট হয়। আমি নির্বান্ধব গোঁয়ার ষাঁড় একা একা প্রতি ক্লাসে হাজিরা দিয়ে আসি। হাতে হাতে লোকদেখানো লি শাও কি, হ্যালডেন, গ্রামশি। আশ্রয় দেন স্বেচ্ছাচারী শক্তি চাটুজ্জে, নাইভ বিভূতিভূষণ, প্রতিক্রিয়াশীল সমরেশ বসু। আমরা আরও ছোট হতে হতে বড় হতে থাকি। অরুণ মিত্রের কবিতার লাইন লেখা পোস্টারে দেওয়াল ছাইতে থাকি, বিজয় গঁদের আঠা দিয়ে পোস্টার লাগানোয় বিশেষ পারদর্শী হয় ওঠায় নাম হয় গঁদার, সৌমেন কল্যাণী লোকালের ভিড়ে দাঁড়িয়ে গাঁজা টানে এবং ভোটে জিততে থাকে, কলেজের সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারা নিষিদ্ধ হয়।
এই হল যজমানিসূত্রে পাওয়া আমাদের বামপন্থা ওরফে সি পি এম ওরফে বামফ্রন্ট। আমি কেন করি? ছোট বেলায় বাবা মাকেও করতে দেখেছি। যতদিনে যুক্তি অভ্যাস করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, ততদিনে আমরা অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। তার আগে অবধি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে প্রাচীন যুথবদ্ধতার নস্টালজিয়া, মুছে যাওয়া দিনগুলির এক পরিবারতান্ত্রিক ইতিহাস, এক নিরালম্ব অথচ গূঢ়চারী প্রত্যয়। এখনও হয় তো অনেককেই করে। আর এটাই অনেকে বোঝেন না। আজ বহু প্রাক্তন সি পি এম সমর্থক রয়েছেন যারা চূড়ান্ত সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেন। ভাবেন একবার গদি থেকে হটলে বেনোজল বেরিয়ে যাবে। এরা সি পি এম বিরোধিতায় সাংবিধানিক বিরোধীদের থেকেও অনেক কঠোর, অনেক ক্ষুরধার। কিন্তু যখন ভোট আসে, যখন মনে হয় এবার হয় তো গণেশ উলটোলেও উলটোতে পারে, এরাই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে কয়েক সপ্তাহের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কমরেড। আসলে অনর্গল ধনতন্ত্রের পাশাপাশি আমাদের সত্তায় এখনও প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ, বংশপরিচয়ের গৌরব, মর্চে ধরা ইতিহাসের ঘ্রাণ। কাজেই সি পি এমেরও ভোট ঘোরা ফেরা করে একটি নির্দিষ্ট শতাংশে, বিরোধীদেরও তাই। যতই নাস্তিক্যে বিশ্বাস থাক, পৈতৃক ভিটের শালগ্রামশিলা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার ধক কজনেরই বা থাকে?
১৮ (Jun 1 2006)
একটি পারফোর্মেন্স টেক্সটের খসড়া
ইহা একটি প্রেক্ষাগৃহ। বাধ্যতামূলকভাবে যাহা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। এই স্থলে পাবলিক নাট্যক্রিয়া দেখিতে গাঁটের কড়ি খসাইয়া উপস্থিত হইয়া থাকেন ("গাঁটের কড়ি' আন্ডারলাইন করিয়া লওয়া যাউক)। আমাদিগের এই ক্রিয়া বা নাট্য, যাহাই হউক, তাহা শুরু হইবার প্রারম্ভে এইরূপ দর্শকগণ সাড়ম্বরে মধুমক্ষীগণের ন্যায় গুঞ্জনকরত: আপনাপন আসন পরিগ্রহণ করিবেন। তাঁহাদিগের জন্য চর্মবেষ্টিত আসন রহিয়াছে। তাঁহাদিগের জন্য দৃষ্টিসম্মুখে রহিয়াছে অন্ধকার একটি মঞ্চ। রহিয়াছে আশতাব্দী বঙ্গীয় নাট্যসংস্কৃতির সম্মিলিত জনস্মৃতি, জনপ্রবাদ এবং জন জানি জনার্দন তা রা রম পম রাম পম পম।
অথচ মঞ্চ এবং প্রথম দর্শকসারির মধ্যস্তিত স্থানে টেবিল পাতিয়া তিন সামরিক উর্দি পরা মুশকো জওয়ান বসিয়া রহিয়াছেন। তাহাদের টেবিলের উপরে কৃষ্ণকায় ওয়াকি টকি, স্লিক ল্যাপি এবং কতিপয় জাবদা খাতা। দর্শকগণের প্রবেশের মুহূর্ত হইতে তাহারা অতীব সতর্কতার সহিত জাবদা খাতা ও ল্যাপিতে দর্শক আগমন ও বহির্গমনের পাকা হিসাব রাখিতেছেন। মূহুর্মূহু গাম্বাট ওয়াকি টকি বাজিয়া উঠিতেছে। আমরা এই বাক্যালাপ লিপিবদ্ধ করিতেছি না কারণ ইহা হিন্দিভাষায় করা হইতে থাকে। দর্শকাসন যখন পরিপূর্ণপ্রায় (কোনো সুচতুর ঢপ ব্যতীত যাহার সম্ভাবনা প্রায় এক দশমিক চার সাত শতাংশ) তখন বেমক্কা ট্যাঁও ট্যাঁও শব্দে তৃতীয় ঘন্টি বাজিয়া উঠে। (প্রথম এবং দ্বিতীয় ব্যতীত তৃতীয় ঘন্টি কী রূপে বাজিতে পারে সেই বিষয়ে খসড়া নীরব অথবা ইহা একটি ইচ্ছাকৃত প্রমাদ)।
তৎক্ষণাৎ প্রেক্ষাগৃহের প্রতি দ্বারে সামরিক মদ্দাগণ পোজিশন লইয়া দাঁড়াইয়া পড়েন। সুধী দর্শকবৃন্দকে অধিক ত্যাঁদড়ামি না করিয়া আপনাপন আসনগ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করা হইয়া থাকে। ওয়াকি টকিতে কর্কশ বাক্যালাপ উচ্চগ্রামে উঠে। মাজায় সজ্জিত সামরিক অস্ত্রাদি আশংকিতভাবে খাড়া হইয়া উঠে। সামরিক পাহারাদারগণের মুখমণ্ডলে এক কঠোর উদ্বেগের ছায়া ঘনীভূত হইয়া উঠিতে থাকে। অন্ধকার মঞ্চের দিকে বোধ করি আমরা বিশেষ লক্ষপাত করি নাই। লক্ষপাত করিবার বিশেষ কারণও নাই কারণ উহা এখনও অন্ধকার। কেবল দর্শকগুঞ্জন অবিরাম হইলে একটি সুবৃহৎ ব্যানার মঞ্চ জুড়িয়া নামিয়া আসে যাহাতে "দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর'।
প্রেক্ষাগৃহের দ্বারগুলি, যাহাদের মস্তকে রক্তিম "এক্সিট' চিহ্ন ঝুলিয়া রহিয়াছে, সেইগুলি সম্পূর্ণরূপে সিল করিয়া দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহের বিভিন্ন কোণ জোরালো সার্চলাইটে আলোকিত করা হয়। কোনোরূপ মেটাফোরিকাল আন্দারলাইন না করিয়াই বলিতেছি, মঞ্চ এখনও অন্ধকার। সার্চলাইটের উদ্বিন্নযৌবনা আলোকে প্রেক্ষাগৃহের মগডাল হইতে দড়ি বাহিয়া নামিয়া আসেন একদল কৃষ্ণবেশী জওয়ান, যাহাদের ইদানীংকার ফেশনানুসারে কদাপি ফ্যাতাড়ু বলিয়া ভ্রম করিবেন না। ইহারা ভারতমাতার অতন্দ্র সেনানী অথবা কৃষ্ণকায় মার্জার। প্রতিটি দর্শকাসন শ্যেনদৃষ্টি দিয়া পরীক্ষা করা হইতে থাকে।
বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে এই সুবর্ণসন্ধ্যায় সত্য সত্যই একটি নাট্যক্রিয়ার উদ্যোগ করা হইয়াছিল। সেই নাট্যের কুশীলবগণ সমেক্আপ ও সসাজ মঞ্চপার্শ্বের সিঁড়ি দিয়া নামিয়া প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আসিয়া দাঁড়ান। তাঁহাদের মুখমণ্ডলেও সন্ত্রস্ত ভাব। কতিপয় কৃষ্ণ মার্জার তাঁহাদের বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। এবং দর্শকদের সহিত তাঁহাদেরও তল্লাশি লওয়া হইতে থাকে। এইরূপ তল্লাশিপূর্ণ সময়ে প্রথমবার মঞ্চের উপরে টিম্টিম্ করিয়া ষাট ওয়াটের একটি ডুম আলো জ্বলিয়া উঠে। মঞ্চের সম্মুখে পরিচালক মহাশয় আসিয়া দাঁড়ান এবং অতিক্ষীণ স্বরে তাঁহার বিনীত বক্তব্য পেশ করিয়া থাকেন।
বক্তব্যের সারমর্ম অতীব সরল। তাঁহারা নাটক অভিনয়ের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কতিপয় নাশকতাবাদীর উপস্থিতি সন্দেহ করিয়া এইরূপ ব্যবস্থা লইতে তাঁহারা বাধ্য হইয়াছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁহারা দর্শকগণের এই অপরিমেয় হয়রানির জন্য যৎপরোনাস্তি দু:খিত ইত্যাদি ইত্যাদি। তল্লাশিকার্য সমাধা হইলেই প্রেক্ষাগৃহের যাবতীয় দ্বার বন্ধ করিয়া অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এবং সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সহিত এই নাটকের অভিনয় সম্পন্ন হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যেহেতু আপাতত নাটক শুরু করা অসম্ভব এবং যেহেতু দর্শকগণ গাঁটের কড়ি খরচা করিয়াছেন, অতএব স্টপগ্যাপ রূপে মা-বোনেদের জন্য একটি ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করা হইবে যাহার নাম "রমাদির হেঁশেলে'।
মঞ্চ আলোয় আলোয় ভাসিয়া গেল। সেতারে সরোদে বেহাগে বাহারে এক অপূর্ব সুরলহরী ধ্বনিত হইতে লাগিল। মঞ্চে এক বিশালাকার ট্রলি লইয়া আসা হইল। এই ট্রলির উপরিভাগ হইতে ঝুলিয়া আছে সদ্যোজাত মানবশিশুর ন্যায় ছলছ্ড়ানো গোলাপীবর্ণের অজস্র "সম্পূর্ণাকার মুর্গী"। তলে সপ্তবর্ণে বিভূষিত শাকসব্জি এবং মশল্লাদের তুরীয় কার্নিভাল। তীব্র হরিৎ পালংশাকের সহিত রক্তিম বিলাইতি বেগুন, গৈরিক আধফালি কুমড়ার সহিত গাঢ় বার্তাকুবর্ণ, ধূসর আলুর সহিত অলাবুর ফিকা শ্যামলিমা, গোলাপী রাঙা আলুর বক্ষে কতিপয় ব্রহ্মচারী রসুনের শ্বেত আভা। দর্শকগণ, মনুষ্যনাট্যের অভাবে সত্যকারের ভূমিজ এই জীবনসমূহের রংতামাশা অবলোকনের জন্য প্রস্তুত হউন। অনুভব করুন করুণাময় জগদীশ্বরের মহান সুমতি এবং আমোদগেঁড়ে অ্যাটিট্যুড। এই সব্জিযাত্রায় আপনাদের সহিত থাকিবেন আমাদের পরমশ্রদ্ধেয়া রমাদি যাঁহার পরনে আফ্রিকার আদিম জনজাতির যোদ্ধৃবেশ, যাঁহার মুখমণ্ডল অদ্ভুত ও গভীর এক মুখোশে আবৃত।
তল্লাশি এবং রন্ধনশিক্ষা যখন পুরোদমে চলিতেছে, তখন দর্শকাসনের মধ্য হইতে একটি সুমধুর স্বর গান গাহিয়ী উঠিল "ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়"। সচকিত রক্ষীদল, নাট্যের খুশীলব এবং দর্শকবৃন্দ হতভম্ব। দর্শকের মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলেন একটি লোক, একটি অভিনতা, একটি জীবন বা একটি সাব-অল্টার্ন। (সজোরে হাসি)। লোকটি চেহারা বর্ণনা অনাবশ্যক কারণ তিনি তিনিও হইতে পারেন, অথবা আমি, বা আপনি, কিংবা বুদ্ধদেব ভটাচার্য্য, বাইচুং ভুটিয়া, আজিম প্রেমজি এমন কি বিরিঞ্চি দাসও হইতে পারেন। মল্লিকা শেরাওয়াত, মেধা পাটকার বা অঞ্জু ববি জর্জ হইলেও আশ্চর্যা হইব না। কিন্তু সেই লোকটির উদরের চতুর্পার্শ পোয়াতী নারীর ন্যায় ফুলিয়া আছে। অত্যধিক হর্মোনবাহী সৈনিকগণের পলক পড়িবার পূর্বেই সে এক দৌড়ে মঞ্চের উপর গিয়া উঠিল। তাহার এক হস্তে রিমোট ক®¾ট্রাল, এক হস্তে অত্যাধুনিক মোবাইল, আর যে হস্তগুলি পড়িয়া আছে তাহার একটিতে একবাক্স সন্দেশ এবং অপরটিতে এক হাঁড়ি রসগোল্লা।
বলিয়া দিবার বোধ হয় প্রয়োজন নাই যে ইনি একজন সক্ষাৎ আত্মঘাতী বোমারু ইয়ানে সুইসাইড বোম্বার। এতক্ষণে হুঁশ ফিরিয়া পাওয়া জওয়ানেরা এক পা আগাইতেই লোকটি কোলকুঁজো হইবার উপক্রম করে অর্থাৎ সাড়ে সর্বনাশ। জওয়ানেরা পিছাইয়া যায়। পুনারায় আগাইতেই পুনরায় কোলকুঁজো। এইরূপ টু স্টেপ্স ফরওয়ার্ড ওয়ান স্টেপ ব্যাকওয়ার্ড করিতে করিতে বুঝা যায় যে বোমারুকে সম্মুখযুদ্ধে বাগ মানানো প্রায় অসম্ভব। অতএব নবতর কম্ব্যাটপ্রণালী লইয়া ভাবনাচিন্তা করা হইতে থাকে। এতদ্বিধ ঘটনাসমূহ সংঘটিত হইবার কালেও রমাদি মুহূর্তের জন্য তাঁহার রন্ধনশিক্ষার ক্লাস বন্ধ করেন নাই। অতএব অপাতত উদ্বিগ্ন দর্শকগণ, হতভম্ব সৈনিকবাহিনী, যুগপৎ ভীত ও বিরক্ত অভিনেতৃগণ, হাস্যময়ী রমাদি এবং বিমুগ্ধ এক বোমারু।
কিন্তু জয় জওয়ানরে পরাস্ত করা বিষম কঠিন কার্য। মঞ্চের পিছনদিক দিয়া গুঁড়ি মারিয়া উঠিয়া আসে একদল অতিতৎপর কৃষ্ণমার্জার। প্রেক্ষাগৃহের দিকে মুখ করিয়া সটান গুলি মারে বোমারুর পিঠে। রক্ত ছলকিয়া সম্মুখসারির এলিট দর্শকের মুখ ভিজাইয়া দেয়। তাহার সহিত ছলকিয়া যায় ভগ্ন হাঁড়ির রসগোল্লার রস। বোমারুদেহ মঞ্চে পতনের পূর্বেই কৃষ্ণমার্জারগণ ক্ষিপ্রভাবে তাহার দেহ ধরিয়া ফেলে। মঞ্চের ভুবনভোলানো আলো নিভিয়া জ্বলিয়া উঠে ষাট ওয়াটের প্রায় নিভন্ত আলো। নিভন্ত আলোয় দোদুল্যমান গোলাপীবর্ণ ছালছাড়ানো "পূর্ণাঙ্গ মুর্গী"।
এইরূপ ক্লাইম্যাক্সের কালে সিলিত দরোজাগুলি হাট করিয়া খুলিয়া যায়। বিদেশী পোষাকে সজ্জিত তীক্ষ্মধী পুরুষের দল প্রেক্ষাগৃহে প্রবিষ্ট হন। "সোনার কেল্লা"র সে ক্ষুদ্র বালকের ন্যায় বলিতে থাকেন "মিশটেক মিশটেক"। তাহাদের মুখে খেদ এবং আশাভঙ্গের স্বাক্ষর অঙ্কিত। মঞ্চে উঠিয়া তাঁহারা বোমারুরু দেহটিকে শোয়াইয়া তাহার ঊ`র্ধাঙ্গের পোষাক অনাবৃত করেন। অনাবৃত উদরে মানিকচাঁড গুটকা, শ্রীনিকেতন, পাঞ্জাবী নিকেতন, স্বপন বাউলের মুখশুদ্ধি, বাপি চানাচুর ইত্যাদি ইত্যাদির অসংখ্য গিফ্ট ভাউচার বাঁধা রহিয়াছে। বিদেশী পোষাকপরিহিত অগ্রণী পুরুষ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এই নাটকের প্রতি দৃশ্যের পরে দর্শকগণের জন্য একটি চমকপ্রদ অন-হল প্রতিযোগিতা স্পনসর করা হইয়াছিল। ঘটনার বিরূপ গতিতে সেই উপহারবাহী জীবটিকে বোমারু বলিয়া ভুল করিয়া হত্যা করা হয়। প্রযোকক সংস্থা এবং স্পন্সর কোম্পানিগণ ক্রেতা বা দর্শকগণের এইরূপ হেনস্থার জন্য আন্তরিকভাবে দু:খিত। খেসারতস্বরূপ দর্শকগণের মধ্যে গুটকা, চানাচুর, শাড়ি, রুমাল ইত্যাদির প্যাকেট বিলি করা হইতে থাকে। জওয়ানদিগের অসমসাহসী ভূমিকার জন্য তাহাদিগকেও সন্দেশের বাক্সে পুরষ্কৃত করা হয়।
দর্শকগণ ধীরে ধীরে প্রেক্ষাগৃহ ছাড়িয়া যাইতে থাকেন। মঞ্চে পড়িয়া থাকে নিহত বোমারুর শব, মৃত মুর্গীর দল, সব্জির বর্ণালী এবং একটি ষাট ওয়াটের প্রায় নিভন্ত আলো। মঞ্চের সম্মুখে একটি বিশালাকার ব্যানার পুনরায় নামিয়া আসে- "সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারকে পুনর্নির্বাচন করার জন্য জনগণকে সংগ্রামী অভিনন্দন'।
১৯ (Jun 30 2006)
হেঁটে দেখতে শিখুন
"বারান্দায় রাতের শিশির টুপ্টুপ্। ছোট মোড়াটা ভেজাভেজা। কম্পিউটারের স্পিকারের গোঁ গোঁ শব্দ ভিতরের ঘরে। এয়ারপোর্টের টারম্যাকে এক একলা প্লেনের অবিরাম চক্কর। কম্পিউটারের নীল স্ক্রিন ড্যাবড্যাবে চোখ খুলে রাত জাগছে। ব্যাঙ্গালোর শহরে রাত দেড়টা। রাত দেড়টায় কত কি যে হয়! সম্মুগম মরে যাওয়া ছোট ছেলেটার সঙ্গে একলা একলা দাবা খেলে। অবিনাশ প্রোজেক্ট প্ল্যান বানাতে বানাতে একের পর এক পর্নোগ্রাফিক ছবি ডাউনলোড করে। সেন্থিল ব্রিগেড রোডের অটোওয়ালাদের সঙ্গে দরদস্তুর করে কোনো রাতপরীর ঠেকে ওঠার জন্য। সুরেশ অটোক্যাডে নতুন পিরামিডের নক্শা বানায়। ওরা কাজের মানুষ। দিনের অকাজের ঢিপির খোঁদল থেকে বেরিয়ে রাতে কাজে বসে। আবার কারো কাজও নেই, অকাজও নেই। চাকরিও নেই, নেশাও নেই।'
এইরকমভাবে একটা লেখা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্যাঙ্গালোর নিয়ে এর থেকে বেশি আর কিছু লেখার কথা ছিল না। লেখাটা স্বাভাবিকভাবেই এই এক প্যারার পরে থম্কে গিয়েছিল। শুধু বাঁচার জন্য থাকা চলছিল। এবং থাকার জন্য বাঁচা- তাও চলছিল জোরদমে। অনেকেরই হয় তো তাই। এর মধ্যেই বারো মাস মিহিন জলবায়ু, ইতস্তত আড্ডা এবং বাঙালি সংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা, মাল এবং মলময় জীবন- এই সবের ঘেরাটোপে বসে বেশ একটা "চলছে চলবে' ভাব। পর্দার উল্টোদিকে দ্বিমাত্রিক ছবির মতো দর্শিনীর কাগজে মোড়া শস্তা ইডলি, মুকাম্বিকা বারের কাউন্টারে গেলাস হাতে শূন্যদৃষ্টি মাতাল, মল্লিকা মালিগে মাথায় গুঁজে রুগ্না পরিচারিকাদের দঙ্গল, প্রায় সংকোচে পথ চলা ইংরিজি-না জানা নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারী, ক্রসিঙে ক্রসিঙে ভিখারি বালকবালিকা।
"ব্যাঙ্গালোরে এত ভিখারি?'
বহিরাগতদের এইরকম সবিস্ময় উচ্চারণের কথাও শুনেছি। যেন ব্যাঙ্গালোর একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রবিশেষ যার পথে পথে মাউস ছড়ানো, বিবর্ণ পলেস্তরা খসা বিল্ডিঙের জায়গায় গড়ে উঠেছে বৃহদাকার সি পি ইউরাশি; যেন এইস্থলে রাস্তায় পেচ্ছাপ নেই, দেওয়ালে পানের পিক নেই, ভিড় বাসে ঘাম শোঁকাশুঁকি নেই, যেন আছে শুধু নিয়নের সমান ভরের আলোয় ভরা কোটি কোটি কিউবিক্ল্; যেন বেশ্যা নেই, দালাল নেই, পকেটমার নেই, বেআইনী হকার নেই, ভিখিরি নেই, শুধু মোবাইল হাতে এবং ল্যাপটপ কাঁধে ইঞ্জিনিয়ারদের এক দানবীয় ম্যাট্রিক্স; যেন ব্যাঙ্গালোরের মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শুধু ঈষৎ বক্রচক্ষু নারায়ণমূর্তি, পক্বকেশ প্রেমজি সাহেব। যেন গিরিশ কারনাড, অনন্তমূর্তি, এম এস সথ্যু সবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক আইকন। যেন কন্নড় ভাষা সর্বাধিকবার জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেনি।
কিন্তু খোয়াব তৈরি হয় ভেঙে যাওয়ার জন্যই। যেদিন বিকেল চারটের সময় আপিসের কাজের মধ্যে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। যখন বাড়ি ফিরছি তখনও ব্যাঙ্গালোরের রাস্তাঘাট কর্মব্যস্ত, নিরাপদ। কোনোরকম গোলমালের বিন্দুমাত্র আঁচ নেই, এফ এমে প্রচারিত কিছু ছোটখাটো ঢিল ছোঁড়ার ঘটনা ছাড়া। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা খুব দ্রুত বদলায়। অলিতেগলিতে প্রতিটি দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ। এমনকি পুরোনো কাগজ জড়ো করে রাখার ছোট টিনের গুমটির দরজাতেও তালা। মোড়ে কাউন্টার পেতে বসে থাকা পান সিগারেটের দোকানিরা উধাও। শুধু মদের দোকানের সামনে ছায়ামূর্তিদের ইতস্তত জটলা। দ্বিগুণ দামে লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু বোতল বিকায়। কেব্ল টি ভিতে খবর আর কন্নড় ভাষার চ্যানেল ছাড়া সব বন্ধ। পরের দিন সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টি ভির পর্দায় এক জ্বলন্ত শহরের লম্বা গল্প। চলতে থাকে সারাদিন। অবিরাম বাস পোড়ে। রাজকুমারের ছবি না লাগালে সাধারণ গাড়িও অনেক সময় রেহাই পায় না। জ্বলতে থাকা বাসের মধ্যে থেকে সন্ত্রস্ত পুলিশ কনস্টেবলকে টেনে বার করে পিটিয়ে মারা হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ারগ্যাস ছোঁড় এবং অবশেষে বন্দুক চালায়। বাকি দেশ গা ঝাড়া দিয়ে সবিস্ময়ে লক্ষ করে হরেক ফুটানি এবং গলাবাজি সত্ত্বেও ব্যাঙ্গালোর একটি আদি, অকৃত্রিম ভারতীয় শহর যেখানে খেমটার উপর ঘোমটার মাপটা শুধু অপেক্ষাকৃত বড়। এবং আমাদের মহান ঐতিহ্য অনুসারে যার নিতম্বে কাপড় না থাকলেও মস্তকে জরির টুপি।
অনেকেই বেশ অবাক হয়েছিলেন। অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। ঠিক এইরকমটাই হওয়ার ছিল।
ব্যাঙ্গালোরে আমাদের জীবনে অনায়াস যাত্রা ভার্চুয়াল খোপের ভিতরে। যে সংখ্যাগরিষ্ঠ কন্নড়ভাষী অনুচ্চবিত্তদের নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের ইতিহাস, তারা আমাদের বেঁচে থাকার ফেরেব্বাজির মধ্যে কিছু ছায়ার বিন্দু। অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস, শপিং মল, পাব, রেস্টুরেন্ট এবং এয়ারপোর্ট- এই ছয়কোণা জীবন সাজাতে আমি এবং আমার মতো কিছু উদ্বৃত্তজীবী পরগাছাই যথেষ্ট। বাকিরা- মুকাম্বিকা বারের সেই মাতাল, বাড়িতে কাজ করতে আসা সেই দক্ষিণী মহিলা, অটোড্রাইভার, রঙের মিস্তিরি, ছোটখাটো দোকানদার, নিম্নপদস্থ সরকারি কর্মচারী- একই শহরে থাকে, কিন্তু ব্যাস, ঐটুকুই। আমাদের খোপগুলো শুধু আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকে। বাকিদের সঙ্গে ন্যুনতম আত্মিক লেনদেনের গরজও নেই। অথচ ব্যাঙ্গালোর আমাদের কথাই শোনে। কোথায় রাস্তা হবে, কোথায় শপিং মল, কোথায় এয়ারপোর্ট- সব আমাদের পছন্দ অনুসারে। আমাদের পছন্দের দৈত্য। সেই দৈত্যের হাতের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া ছিঁটেফোঁটা ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে বাকিদের দল। ভিক্ষান্ন ফুরিয়ে যায়, ক্রোধ জমতে থাকে। এক পাহাড় বিবমিষার চূড়োয় দাঁড়িয়ে আমরা আয়নায় নিজেদের দেখি আর হাততালি বাজাই। সাথসঙ্গত করে সগোত্র মিডিয়াবান্ধবেরা।
তাই আবারও হবে।
কোনও রাজনীতির কথা নয়। মানুষের কিছু মৌলিক প্রবৃত্তির কথা। ধরা যাক আমি বহু দশক ধরে পৈতৃক বাড়িতে বাস করছি। এখানেই আমার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। হঠাৎ আমার বাড়ির পাশে গজিয়ে উঠল বিশালবপু অট্টালিকার দল। নব্যধনীদের বাড়ির দ্যাখানেপনায় ঢাকা পড়ে গেল আমার বহুযুগের আস্তানা। এখন ঘরে রোদ ঢোকে না, বাতাস খেলে না। ওরা আমার এবং আমার আস্তানার অস্তিত্বকে গণ্যও করে না। আমার নিরুচ্চার অস্তিত্ব ওদের কাছে ঠিক যেন পাড়ার ল্যাম্পপোস্ট, পোস্ট আপিসের বাক্স বা এ টি এম কাউন্টার। কর্পোরেশনের চেনাজানা বাবুরা ওদের দরজায় দরজায় জিভ বের করে ঘুরে বেড়ায়। আমার আস্তানা ঢেকে যেতে থাকে। তখন কি আমার মনে হবে না শালাদের দরজায় এক বালতি গু ছুঁড়ে দিই, গাড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে হিসি করি ছ্যাড়ছেড়িয়ে? আর এক দুর্মর আশা পুষে রাখি, একসঙ্গে হলে সারা শহরের কাচ-কাঠ-ইঁট-লোহা ভেঙে চুরমার করব। প্রাথমিক টার্গেট পুলিশ এবং সরকার। তারপর?
এই অদ্ভুত দোতলা শহরের স্মৃতি নিয়ে কলকাতায় ফেরার পরই একটা খবর পড়লাম। একটি আবাসনের হাই ইনকাম অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা দাবি করেছেন যে তাদের বিল্ডিঙের সামনের গেট শুধু তাদেরই ব্যবহারের জন্য। অপেক্ষাকৃত নিম্নমূল্যের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এই গেট ব্যবহার করতে পারবেন না। যদিও নির্মাণকারী সংস্থা জানিয়েছেন যে চুক্তিতে এই রকম কোনো কথাই ছিল না। মামলা উচ্চ ন্যায়ালয় অবধি গড়িয়েছে। আদালত ১৪৪ ধারা জারি করেছে।
খোপ বাড়ছে। নিশ্চিন্ত থাকবেন না। এইবেলা গাড়ি বাড়ি টাকাপয়সা গয়নাগাঁটিগুলো একটু সামলে।
২০ (Jul 14 2006)
অপেক্ষা
সেই সময়ে মৃত্যু ছিল ভয়াবহ, শোক ছিল উৎসব।
অন্ধকার মধ্যরাতে বিডন স্ট্রিটের এঁদো গলি কাঁপিয়ে দিত নিমতলাগামী শবযাত্রীদের হরিধ্বনি। হৃদপিণ্ড কুঁকড়ে দম আটকে আসত। কানে দু আঙুল চেপেও জোর করে ঢুকে পড়ত বলহরি হরিবোলের উৎকট রেশ। রাস্তার মোড়ে খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে লাশের পর লাশ শ্মশানে যাচ্ছে। প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে চারপাশে গুঁজে রাখা পিল্পিলে রজনীগন্ধার রোগা ডাঁটিগুলো মুচড়ে যাচ্ছে। সাদা চাদর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা নারকেল দড়িতে যাতে ঝাঁকুনির চোটে লাশটা পিচরাস্তায় হুমড়ি খেয়ে না পড়ে। অসহ্য ধূপের ধোঁয়ায় অঝোরে ঝরে সাদা খই আর ধূসর খুচরো পয়সা।তখন লাশ মানে একটা লাশ। জীবন নামের আসল জিনিষটা হারিয়ে আমাদের মজার দুনিয়াটায় একটা বিচ্ছিরি বেঢপ ব্যপার। তাই বৃদ্ধ আত্মীয়রা মারা গেলে ভয় হয় শুধু। এই বুঝি আবার সেই শুয়ে থাকা লাশদর্শনে যেতে হয়। সেই মরা লাশের চারপাশে ফুল আর ধূপের গন্ধ যেন তাকে আরও বীভৎস করে তোলে। তখনও শোক অধরা, অছোঁয়া। তখনও মৃত্যু মানে আগুনে লাশ পুড়ে যাওয়া ধোঁয়া, আদিগঙ্গায় ছড়িয়ে থাকা পাঁকের মধ্যে ন্যাকড়া, শিশিবোতল, জবাফুল, ছেঁড়া রজনীগন্ধার মালা।
অথচ শ্রাদ্ধ মানেই তুমুল হৈহল্লা। কতদিন বাদে সব ভাইবোনেরা এক হওয়া। কত খেলা-গল্প-গান! বোম্বে-দিল্লি থেকে প্রবাসী আত্মীয়রা কলকাতায় ফেরেন। গন্ধওয়ালা ইরেজার, পুতুলের মধ্যে পেনসিল শার্পেনার, ছবির বই, কোকোকোলা খাওয়ার পয়সা! শ্রাদ্ধবাসরের দিকে পাও মাড়াই না। সেইখানে ছবির সামনে গম্ভীর মুখে বড়দের ভিড়। শামিয়ানার তলার টুকরো টুকরো সকালের রোদ্দুরে ভরা লুচি ভাজার গন্ধ। হঠাৎ কোনো বড়ো এসে আমাদের চেঁচামেচির জন্য ধমক লাগান। এক মিনিটের জন্য মনে হয় এটা ঠিক বিয়েবাড়ি নয়। কিন্তু তার পরে পরেই শুরু হয়ে যায় নতুন নতুন খেলার প্ল্যান। তবে শুধু ছোটোদের কথাই বা হবে কেন? সন্ধ্যাবেলা বড়োরা যথোচিত শুভ্রতা বজায় রেখে সাজুগুজু করে এসে গেটের সামনে আত্মীয়-বন্ধুদের আপ্যায়ন করেন। সদ্য কেনা পারফিউমের গন্ধ ভোজের মিশ্র গন্ধের সঙ্গে ছড়িয়ে যেতে থাকে। মগ্ন হই শোকের আনন্দপালনে।
আসলে তখন মনে হয়নি আমিও কোনও একদিন মারা যেতে পারি। অসুখ-বিসুখে খুব ব্যথা-বেদনা না থাকলে সে ছিল বড় আনন্দের সময়। স্কুলে যাওয়া নেই, দিনরাত বিছানায় বসে গল্পের বই পড়া। বাবা-মায়ের চিন্তিত মুখ, আত্মীয়-স্বজনের দেখতে আসা, ঠাকুমার সেই পুরোনোকালের নিপুণ সেবা। অসুখের মুখে গন্ধরাজ লেবু দিয়ে শিঙি-মাগুরের পাতলা ঝোলও খারাপ লাগত না। একবার বাবার খুব অসুখে আমাকে রেখে দেওয়া হল এক বন্ধুর বাড়ি যার বাবা খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। সে খুব গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করেছিল- তোর বাবার সঙ্গে তোর কখন শেষ কথা হয়েছে? আমার প্রায় সমবয়সি বন্ধুর গম্ভীর মুখ দেখে এবং ততোধিক গম্ভীর প্রশ্ন শুনে একপলকের জন্য হলেও একফোঁটা ভয় ছুঁয়ে গিয়েছিল বটে। কিন্তু তাই বলে আমি? এই তো আমার হাতের কাছে বাবা-মা-কাকু-জেঠু-মামা, এই তো আমার স্কুল, এই তো আমার পাড়ার মাঠ, ছাদে লুকোবার জায়গা, পুরোনো অমর চিত্রকথার ডাঁই, লুকিয়ে পড়া "দেশ' আর রবীনদার রিকশায় যশোর রোড ধরে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে জানলায় দাঁড়িয়ে গল্প, বান্ধবীর বড় হয়ে যাওয়ার বিস্ময়- এর মধ্যে মৃত্যু কোথায়? আমার পৃথিবীতে তো কোনও মৃত্যু নেই!
কিন্তু তাও কৈশোর হারাই। বাসাবদল হতে থাকে। শরীরেও অদ্ভুত বদল। নারীদেহ শরীর মাথা তোলপাড় করে। নিরালা দুপুরের হস্তমৈথুন, নিষিদ্ধ ম্যাগাজিন। বাংলা চটি বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেঁড়াখোঁড়া ডেবোনেয়ার আর ফ্যান্টাসি। তখনই হয়তো প্রথম দুনিয়া হারানোর স্বাদ জেগেছিল মনে। ছেলেবেলায় যা চাই তাই পাই বাবা মায়ের হাত ধরে। এখন চাওয়া পাওয়ার হিসেবের মধ্যে পয়সা-সংসার-রুটিরুজির আবছা আদল দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে অনেক কিছু আছে যা হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। বা ফিরে পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়। বুকের মধ্যে কী ভাবে কান্না চাপ বেঁধে ওঠে টের পাওয়া যায়। লুকিয়ে কাঁদার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়। যদিও হারানোর লিস্টিতে এখনও মানুষ যোগ হয়নি। শুধু আস্তে আস্তে গোলোকধাঁধায় ঢুকে পড়তে থাকি। আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাই। মাগো, বড় নষ্ট হয়ে যাই!
এখন অ্যাড্রিনালিনের উদগ্র রোয়াব স্তিমিত। ক্যাওড়াতলার মেঝেতে নিকটজন শুয়ে থাকেন। শুধু একটি স্বেতবস্ত্র শরীরে। কি শান্ত মুখচ্ছবি! কি নিষ্পাপ শ্মশানের এই মাটি! অথচ মৃত্যুর অনতিপূর্বে তারই মুখ দানবের মতো বিকৃত, বুকমুখ ঠেলে উঠে আসে শ্লেষ্মার পাহাড়। সেই মুখ আজ নিমগ্ন কোনও মায়ের গভীর গর্ভে। মাটি ঝরে গায়ে মুখে আগুনে ওঠার আগে। শুধু দুটি পা শেষ পর্যন্ত মাটির দিকে চেয়ে থাকে। কান্না চলে। ইতস্তত কথাবার্তা, সুখস্মৃতির গুঞ্জনের হাসি। মরে যাওয়ার পরেও অনেক কাজ থাকে। তলার স্যাঁৎসেঁতে বেসমেন্টে চুল্লীর নীচে জমা হয় কালো ছাই। কোনও এক বালক অগ্রবর্তী হয়ে নিয়ে যায় সেই গহ্বরের দিকে। হাত দিয়ে তুলে আনে নাভিমূল আর মাটি। শেষ হরিধ্বনিতে আদিগঙ্গায় বিকেল ভেঙে আসে। লাশেদের মুখ থেকে পর্দা সরে যায়।
হঠাৎ ব্যাঙ্গালোরের সন্ধ্যায় কর্মব্যস্ত সি এম এইচ রোডে আর্যসমাজের মন্দিরে ঢুকে পড়ি। কোনও অচেনা শ্রাদ্ধবাসর। অতিবিনম্রকণ্ঠে এক বালিকা গায় "প্রভু চাকর রাখো জী'। নৈ:শব্দ্যে ঘুরে বেড়ায় ধূপ আর রজনীগন্ধার অতৃপ্ত গন্ধ। কে মারা গেলেন তাঁর মুখচ্ছবি না দেখেই বেরিয়ে আসি। সন্ধ্যার সি এম এইচ রোড ভার হয়ে আসে। নিয়নের তীব্র আলোয় পূর্ণিমার চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। লাল লাল মেঘেরা আকাশ ছেয়ে। আমি বড়ো বড় হয়ে গেছি। মাথার উপরে ছাওয়া ডালপালাদের একে একে ঝরে পড়ার সময় এগিয়ে আসছে। টেলিফোন অপেক্ষায় আছে।
কত মানুষ মারা যাবে! কত মানুষ মারা গেল! বান্দ্রায়, জুহুতে, মাতুঙ্গা, ভিওয়ান্ডি, গুলমার্গ- ছেয়ে গেল মাটি আর আগুনের মুখ। মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু দাও; আমি মৃত্যু পেতে ভালোবাসি।
২১ (Aug 1 2006)
ইদানীং শোনা রবীন্দ্রনাথের গান
সুধীর চক্কোত্তি মশাই রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে একটি অসাধারণ বই লিখেছিলেন- নির্জন এককের গান। এখন আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ গান এককের গানই বটে। তব একটু অন্য অর্থে। এখনও কান আর মনে একচেটিয়া বনিয়াদ বানিয়ে রেখেছেন সেই প্রাচীন জ্যোতিষ্কমণ্ডলী। অথচ বছর পঁয়ত্রিশের বিবেচনা এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সায় দেয় না। বয়সধর্মের কারণে অবিশ্রান্তভাবে সেই নতুনকে খুঁজে ফিরি। কিন্তু এই কথা বলার স্পর্ধা রাখি না যে সাম্প্রতিক প্রজন্মের শিল্পীরা পুরোনোদের থেকে গুণমানে কোনও অংশে কম। নিশ্চয় তাঁরা অনলস চর্চায় চর্চিত এবং আন্তরিক বোধে এবং জ্ঞানে দীক্ষিত। কিন্তু আজন্ম রবীন্দ্রনাথের গান শুনে আসা কানে এখন আর কেউই এসে সেই বসত গড়েন না। সকালের বারান্দার চড়ুইপাখির মতো গানগুলো এসে এসে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। সারাদিনের ব্যস্ততার নির্জনে কেউ হঠাৎ করে বেজে ওঠেন না। অনেক পেয়েও না পাওয়ার যে শূন্যতা তাড়িয়ে বেড়ায়, তাকে ভরাট করার জন্য কেউ সেতু বাঁধেন না। কাজেই পড়ে থাকি আমি এবং আমার রবীন্দ্রনাথের গান। চ্যানেলে ক্যাসেটে সি ডিতে এমন কি ডি ভি ডিতেও এখন রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচুর ভাঁড়ার। তথাকথিত অন্য ধারার ফিল্মেও ন্যূনতম একটি রবীন্দ্রনাথের গান প্রায় ফর্মুলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ফর্মুলা ফর্মুলাই থেকে গেল, আমার মতো সামান্য এক শ্রোতার গান হয়ে উঠল না। হয় তো আমারই কানের দুর্বলতা।
তাই নতুনের খোঁজে পুরোনো গানের ধূসর কুলুঙ্গি হাতড়ে বেড়াই। খুঁজতে খুঁজতে পরশপাথর না পেলেও চকিৎ অভাবনীয়ের ক্কচিৎ কিরণ এসে পড়ে মাঝে সাঝে। এই সেদিনই হাতে পেলাম বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া একগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথের গান যাদের সবগুলিরই গায়নকাল চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দশকের মধ্যে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। যাঁদের গান খুঁজে পেলাম তাঁদের মধ্যে অনেকের নামই হয় তো রবীন্দ্রনাথের গানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনুরাগীরা শোনেননি - বীণা চৌধুরী, সুনীল রায়, তপতী দাম, সমর গুপ্ত, ইলা ঘোষ, সুধা মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী নাহা, সমরেশ রায়। আবার কিছু খুব চেনা গানও রয়েছে যথা রাজেশ্বরী দত্তের "বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের "হে ক্ষণিকের অতিথি' বা সুচিত্রা মিত্রের "সকল জনম ভরে' প্রভৃতি। এমন কিছু শিল্পীর গান রয়েছে যারা অন্যরকম গানের জন্যই বেশি প্রসিদ্ধ। বাংলা চলচ্চিত্রজগতের প্রখ্যাত অভিনেতা অসিতবরণের গাওয়া "আমরা দুজনা স্বর্গখেলনা'ও রয়েছে এই সংকলনে। সব গানেরই যে খুব উঁচু মান তা মোটেই নয়। শ্রীলা সেন "বিরহ মধুর হল' গানটিতে এতই বলিষ্ঠ, মনে হয়েছে গানটি বোধ হয় আরও একটু নম্রতা দাবি করে। জগন্ময় মিত্র মহাশয়ের "স্বপ্নে আমার মনে হল' ঠিক যেন "চিঠি" এবং "সাতটি বছর আগে"র একটি সিকোয়েল। ধীরেন বসুর "আজি যত তারা তব আকাশে' দেবব্রত বিশ্বাসের দুর্মর স্মৃতির কাছে দু:খজনকভাবে ম্লান।
কিন্তু গানগুলো শুনতে শুনতে একটা কথা মনে হচ্ছিল। দিলীপকুমার রায়কে তাঁর গানের সরলতা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলছিলেন-
"একজন রূপরসিকের কাছে গেছে এক সুন্দরী। তার পায়ে চিত্র-বিচিত্র করা একজোড়া রঙিন মোজা। রূপদক্ষকে পায়ের দিকে তাকাতে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করলে মোজার কোন অংশে তাঁর নজর পড়েছে। গুণী দেখিয়ে দিলেন মোজার যে অংশ ছেঁড়া। রূপসীর পা-দুটি ওই যে মোজার ফুলকাটা কারুকাজে তানের পর তান লাগিয়েছে নিশ্চয়ই আমাদের হিন্দুস্থানী মহারাজ তার প্রতি লক্ষ করেই বলতেন "বাহবা', বলতেন "সাবাস'। কিন্তু গুণী বলেন বিধাতার কিংবা মানুষের রসরচনায় বাণী যথেষ্টের চেয়ে একটুমাত্র বেশি হলেই তাকে মর্মে মারা হয়। সুন্দরীর পা-দুখানিই যথেষ্ট, যার দেখবার শক্তি আছে দেখে তার তৃপ্তির শেষ হয় না। যার দেখবার শক্তি অসাড়, ফুলকাটা মোজার প্রগল্ভতায় মুগ্ধ হয়ে সে বাড়ি ফিরে আসে।'
এই পুরোনো গানগুলিতে রবীন্দ্রনাথের গানের এই স্বত:স্ফূর্ত সারল্য আবার খুঁজে পেলাম। বিশেষ যন্ত্রায়োজন, অজস্র তানকর্তব, উচ্চারণের চেষ্টাকৃত নাটকীয়তা- কোনও কিছুতেই গানগুলো ভর করছে না। নিজের পায়ে যেন গানগুলো আবার দাঁড়িয়ে উঠল। কথা ও সুরের মিলেই তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারা রবীন্দ্রনাথেরই গান। যদিও এই সারল্যকে অতিসরল করে রবীন্দ্রনাথের গানকে ভুষিমালে পর্যবসিত করার উদাহরণেরও অভাব নেই। যার চলা ফিরতা উদাহরণ বাৎসরিক রবীন্দ্রজন্মোৎসব বা রবীন্দ্রনাথের বাৎসরিক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বহু রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষ রবীন্দ্রজন্মোৎসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে গুলিয়ে ফেলেন এবং পান থেকে চুন না খসলেও অযথাই কুপিত হয়ে ওঠেন। এই সঙ্গীতগুচ্ছের শুধু একটি গানের কথাই বিশেষভাবে উল্লেখ করব। নীলিমা গুপ্তের (ইনিই কি আমাদের চেনা নীলিমা সেন?) গাওয়া "শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে।' মুখড়ায় গানটি গাওয়া হয় "শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে/ না/ না/ নাই বা গেলে'। এই তিনটে নায়ের মধ্যে আর্তির যে প্রচ্ছন্ন স্বর তা তৈরি করতে গায়িকাকে একবিন্দু অতিরিক্ত নাটকের পর্দা টাঙাতে হয় না। স্বরলিপিবদ্ধ সুরের মধ্যেই কি অনায়াসে বর্ষাবিদায়ের চূড়ান্ততা ফুটে ওঠে। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের গানের জিৎ আর এই কথা ভুলতেই আমাদের বেশি সময় লাগে না।
কিন্তু এই মৃত মানুষদের গান তো আর সামনাসামনি শুনতে পাব না। কাজেই খ্যাপাকে পরশপাথর খুঁজে ফিরতেই হয়। এই রকম কোনও কেনার ঘোরে যা থাকে কপালে বলে কিনে ফেললাম বিক্রম সিং-এর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের ক্যাসেট। সত্যি কথা বলতে আগে বিক্রমের কোনও গানের কথাও শুনিনি বা পড়িনি। সাম্প্রতিক শিল্পীদের চেনা চক্রে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে নতুন নাম দেখেই এই ক্যাসেট কিনে ফেলা। কিনে ফেলার পর ক্যাসেট খুলে জানতে পারলাম বিক্রম রবীন্দ্রনাথের গানের জনপ্রিয় শিল্পী মোহন সিঙের পুত্র। মোহন সিং তাঁর গানে মুগ্ধ করেছিলেন। যদিও বলে রাখা ভাল তাঁর বাংলা উচ্চারণ কিছুটা হলেও আমার কানে লাগে। কিন্তু বিক্রম আমাকে আচ্ছন্ন করলেন। অন্তত এই একটি ক্যাসেটে সত্যি সত্যি আচ্ছন্ন করলেন।
বিক্রম সিং সম্পর্কে দু একটা কথা বলে রাখা ভালো। বিক্রম প্রথাবদ্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত শাস্ত্রীয়সঙ্গীতশিল্পী। বিক্রমের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি ক্যাসেট চোখেও পড়েছে এবং শুনেছি বিক্রম অধিকাংশ সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই গেয়ে থাকেন। বিক্রমের বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের দিক্পালদের নিকট সান্নিধ্যে। কণিকা বন্দোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, নীলিমা সেনেদের সান্নিধ্যের স্মৃতিতে উজ্জ্বল বিক্রমের শৈশব এবং কৈশোর। ক্যাসেটের কভার থেকে বিক্রমের আরও এক সৌভাগ্যসংবাদ পাই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনের শেষ বছরে যখন বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে বাংলা পড়াতে যান, বিক্রম ছিলেন তাঁর ছাত্র। শক্তি নাকি বিক্রমের গাওয়া গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। অর্থাৎ বোধ, সুর এবং ঘরানা- তিনের তালিমের কোনও অভাব নেই বিক্রমের গানের গঠনপর্বে। বিক্রম গান গানও গড়পড়তা শিল্পীদের থেকে অনেকটা উঁচু পর্দায়। শান্তিদেব ঘোষের পরে এবং দুই একটি গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া এত উঁচু পর্দায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে কাউকে শুনিনি। এই ক্যাসেটে গ্রথিত গানগুলির নির্বাচন থেকেই মেপে নেওয়া যায় শিল্পীর আত্মবিশ্বাসের মাত্রা- "আজ যেমন করে', "চোখের জলের লাগল জোয়ার', "আরো আঘাত সইবে আমার', "তবু মনে রেখো', "বিরহ মধুর হল আজি', "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই', "এরা পরকে আপন করে', "ও যে মানে না মানা', "আজ জ্যোৎস্নারাতে', "কিছুই তো হল না'। এর বেশির ভাগ গানই কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের গলায় সুপার ডুপার হিট। কিন্তু বলতে একবিন্দু দ্বিধা নেই, বিক্রম চেনার মাঝে অচেনার আনন্দের ভাগ দিয়েছেন। দেবব্রত-হেমন্তদের গান শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথের গানের শ্রোতারা ব্যারিটোন প্রত্যাশী হয়ে পড়েছেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত মশাই দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরকে মহাবলীপুরমের সমুদ্রধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেই তুলনায় বিক্রমের কণ্ঠ একটু অন্যরকম। মনে হয় যে হাওয়ায় দুপুরবেলা এক ঝাঁক শালপাতা মাঠের ওপারে উড়ে যায়, সেই হাওয়া রাতের কোপাইতে চাঁদের সঙ্গে খেলা করে।
দুটি গান একটু অপ্রচলিত সুর ও ছন্দে গাওয়া। "মাঝে মাঝে তব দেখা পাই" গানটির এই পাঠভেদ এবং সম্পূর্ণ কীর্তনাঙ্গ রূপ আগে কোথাও শুনিনি। চলতি গায়নের সঙ্গে এই সংস্করণটির একটু তুলনা করলে পার্থক্য পরিষ্কার হবে। সাধারণভাবে গানটির শেষ চরণটি গাওয়া হয়- "তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন'। বিক্রম গেয়েছেন- "তুমি যদি বল এখনি করিব বিষয়বাসনা বিসর্জন/দিব শ্রীচরণে বিষয়/দিব অকাতরে বিষয়/ দিব তোমার লাগি বিষয়বাসনা বিসর্জন'। সাধারণভাবে "ওরা পরকে আপন করে' গানটি ঢালা গান হিসেবে গাওয়া হয়। শ্রদ্ধেয় সুভাষ চৌধুরি মশাই এই ঢালা গান গাওয়ার প্রবণতার একটি অনভিপ্রেত দিক সম্পর্কে বলেছিলেন যখন অকারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রযুক্ত ছন্দ অস্বীকার করে গানগুলিকে ছন্দহীনভাবে গাওয়া হয়। সৌভাগ্যবশত বিক্রম এই গানটিকে ছন্দোবদ্ধ রূপে গেয়ে অন্যতর মাত্রা দিলেন। আরও দু একটি গানের কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। অনেক সময় "আজ জোৎস্নারাতে' গানটি এমন করে গাওয়া হয়ে থাকে, মনে হয় "ঠান্ডি হাওয়া ইয়ে চাঁদনি সুহানি।' অথচ গানটি রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত যন্ত্রণার গান যখন তিনি প্রিয় পুত্রের মৃত্যুর শোকে স্তব্ধ- "আমারে যে জাগতে হবে, কি জানি সে আসবে কবে/ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।' পিতার এই অপার্থিব সংলাপ গানের জগতে বিরল। বিক্রম চড়ায় প্রথম পর্দা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতার সাকিনে নাড়ীছেঁড়ার হাহাকার গুমরে ফেরে। আজকের দিনে এ এক দুর্লভ সৌভাগ্য। শুনেছি শক্তিরও বড় প্রিয় ছিল এই গানটি। বিক্রম চমকিত করেছেন "তবু মনে রেখো' গানটিতে। রবীন্দ্রনাথের নিজের গলায় ধরে রাখা গান যা পরে সুচিত্রা মিত্র গেয়েছেন। সুচিত্রা মিত্রের গলায় গানটি একটি লিজেন্ড। এই গানের নতুন অভিঘাত প্রায় স্বপ্নসম্ভব যা বিক্রমের গানে পেয়েছি। প্রসঙ্গত:, ক্যাসেটটির নামও "তবু মনে রেখো'। ন্যূনতম যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহার হয়েছে। ঢালা গানগুলিতে তানপুরার সঙ্গতই মুখ্য যন্ত্রশব্দ।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অনতিপূর্বে ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ বলছেন-
"আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে- তাদের মাটি করে দাও-না, আমার দু:খ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি- তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কি না বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।"
বিক্রমের গান শুনে আচ্ছন্ন হলাম এবং আশ্বস্ত হলাম। বৃদ্ধের কথা এখনও কেউ কেউ মনে রেখেছেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পটুতা সত্ত্বেও।
২২ (Aug 16 2006)
একটি বিদ্রোহের গল্প
এ এক পুরাতন কাহিনী বটে। জ্ঞানীজন এরে ইতিহাস কন। ধর্মের ইতিহাসও বটে। অধুনা কে বা শুনে ধর্মকথা, কে বা শুনে প্রাচীন কাহিনী? ইত্তিহাদের পথ জুড়ি বসে রয় অবিরত রক্তমাংসস্রোত। প্রতিযুগ জাহিলিয়াসম। কে বা ভ্রাতা, কে বা পিতা, কে বা আত্মপর, এ জগৎ মহাহত্যাশালা। ফজরের নামাজ শেষে মুণ্ড রাখি অব্বু ঘ্রাইব ক্রোড়ে। নিরীহের রক্তস্রোতে ক্ষনদষশহয়ভড়ঢ়ত-র তোড়জোড় শুরু। বিশ্বাস ওদের গণতন্ত্রে বা বিশ্বাস ওদের জিহাদে। বিশ্বাসে মিলায় প্রাণ গল্প বহুদূর। তাও গল্প গল্প হয় সময়ের ফেরে। শোনার জন্য গল্প শুনি, বলার জন্য গল্প বলি। নীতিকথা গুণীজন করহ সন্ধান। কথকের নীতিকথা নাই।
পারস্যদেশে সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়। পুবের দিকে ইংরাজ আর উত্তরশিয়রে রুশিগণ আছে ওঁত পেতে। তাঁরা রাজদণ্ড হাতে তোলে নাই। কেবল বণিকের মানদণ্ড কাজার রাজবংশের শাহদের রাজদণ্ডরে শিথিলতর করে। রাণীর মুকুটমণি ভারতবর্ষ যেনতেন প্রকারেণ রক্ষা করা চাই। তাই পারস্য সাগর জুড়ে ইংরাজ শ্যেনদৃষ্টি পাতে। উত্তরে রুশীদের রোয়াব। অক্ষম শাহেদের হাত থেকে সবই যায় বিদেশীদের অতল তহবিলে। অন্য দিকে ছকে পাতে ঘোর শক্তিশালী উলেমার দল। নজফ আর কারবালা জুড়ে তাঁহাদের বিপুল ওয়াকফ দৌলত। শিক্ষা, আইনব্যবস্থা চলে উলেমার অঙ্গুলিহেলনে। উলেমারাই বিদেশীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষের রসদ জোগান। তাই শ্রেষ্ঠীগণ তাঁদেরই পদানত। শ্বেতচর্মের বর্ধমান প্রভাবে শাহের উপর তারা ভরসা হারায়।
সাধারণ শিয়াগণ প্রচ্ছন্ন ইমামেরে খুঁজে ফিরে। যে ইমাম পয়গম্বরের স্নেহস্পর্শ বিতরণ করে, পৃথিবীরে শুদ্ধ ন্যায়ের আলোক দেখায়, সাম্যের ধ্বনিতে মন্দ্রিত করে ইসলাম হৃদয়। অথচ কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদের হাতে হুসেনের হত্যার পর থেকে ইসলামের খলিফারা শিয়াদের ইমামেরে সহিতে না পারে। একাদশ ইমাম হাসান আল আসকারিরে খলিফা গৃহবন্দী করে বিষপ্রয়োগে হত্যা করে। অত:পর শিয়াগণ প্রচ্ছন্ন ইমামেরে খুঁজিয়া বেড়ায়। সেই রক্তকান্নাস্বেদ প্রতি বৎসর মহরম পরবে মথিত করে পারস্যের ভূমি। নিরুপায় অদৃষ্টবাদী গণহৃদয় তাদের প্রচন্ড আকুতিরে উন্মোচিত করে এই পুণ্যদিনে। শাহের স্পনসরশিপে দু:খের পবিত্র উৎসব উৎসবযাপন। অথচ শূন্য শূন্যই থেকে যায়। বিগত এবং আগামীর খোয়াবে বিভোল পারসিক জনগণ। বর্তমান শুধু অন্যায়ের লীলাক্ষেত্র। কি ঘর বানাইলাম আমি শূন্যের মাঝার? এই গভীর আকুতি উলেমাদের না-পসন্দ। তাদের কেতাবে আছে ফিখ আর শরিয়ার কঠোর নিয়ম। শূন্য শুধু শূন্যে থেকে যায়।
সময়ের এইরূপ অবস্থা যখন, হেনকালে আইলেন সৈয়দ আলি মহম্মদ। ১৮৪৪ সালে জানালেন তিনিই স্বর্গের দ্বার, তিনিই প্রচ্ছন্ন ইমাম। সেই স্বর্গের দ্বার, আরবি ভাষায় যারে বাব কহা হয়। ইশফাহান, তেহরান, খুরাসান বাবের প্রবল আহ্বানে উদ্বেল হয়ে উঠে। উলেমা, শ্রেষ্ঠী এবং মান্যগণ্যদের খরস্রোত বয় এই নববাণীর উৎসপানে। আজানে ধনিত হয় বাবের পুণ্যনাম। নামাজিদের প্রার্থনার মুখ ফিরে শিরাজে বাবের জন্মভূমিদিকে। মক্কয় হজযাত্রায় গিয়ে পবিত্র কাবার পাশে দাঁড়িয়ে বাব সজোরে উচ্চারিলা তিনিই প্রচ্ছন্ন ইমাম। তাঁর শিষ্যশিষ্যাগণ- কুরাত আল আইন, মুল্লা সাদিক, মির্জা মহম্মদ আলি বরফুরুশি এক নবধর্মের কথা কহেন। বাব প্রকাশ করেন শিয়াদের এক নূতন ম্যানিফেস্টো- এক নূতন "বয়ান'। কী সেই নবধর্ম? কী বা সেই অদ্ভুত "বয়ান'?
পুরাতন ধর্মের কাল গিয়াছে। মানবজাতি এক নবযুগের সদরদরজায় দাঁড়িয়ে। অতএব পুরাতন ধর্মগ্রন্থসমূহ বাতিল হউক। কর্মযোগে ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াও। স্থাপন কর সামাজিক সাম্য। বাণিজ্য উন্মুক্ত হউক। সাধারণের উপর করভার লঘু করা হোক। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সুনিশ্চিত হউক। নারীগণ পূর্ণাঙ্গ মর্যাদায় উদ্বোধিত হন। এই এক মানবজীবন। বেহেশ্তের খোয়াব নাই, পরজন্ম নাই, আল্লার দরবারের শেষ বিচার নাই। যা হয় তা এইখানেই হয়, যা কর তা এই ক্ষণেই কর। এই পৃতিবীতে, এই একটি মাত্র জীবনে। এই পৃথিবীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতেই তোমাদের পুণ্য, এই পৃথিবীর সুস্থ সমাজই তোমাদের স্বর্গ।
নগরে নগরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। বাব যাথানিয়মে কারারুদ্ধ হলেন। এক কারাগৃহ থেকে অন্য কারাগৃহে স্থানান্তরের সময় মানুষের স্রোত উতরোল। কারাগৃহে অন্তরীণ বাব অত্যাচারী শাহকে তীব্র বিক্ষোভের চিঠি লেখেন। অনুগামীভিড়ে পরিপূর্ন কারা অভ্যন্তর। কারাগৃহ তীর্থস্থান হয়। বাব আরও দূরে নির্বাসিত হন। সুদূর চিহরিঘ দুর্গে বাব নির্বাসিত হলে তীর্থগামীদের ঠাঁই নাই কারাগৃহপ্রাচীরবেষ্টনে। ভিড় ছড়াইয়া পড়ে রাস্তায় রাস্তায়। ১৮৪৮ সালে তাব্রিজে বাবের চূড়ান্ত বিচার। অনুগামীগণ প্রত্যাশায় থরথর। ন্যায়, সাম্য, শান্তির নবযুগ আগত ঐ। তার পর? প্রমাণ করা হল বাব একটি নির্দন্ত ত্রাতা। প্রমাণিত হল বাবের আরবী ভাষাজ্ঞান সীমিত, ধর্ম ও দর্শনে তাঁর নৈপুণ্য সন্দেহজনক, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথে তাঁর কোনো চেনাজানা নাই। তিনি পুঅনরায় কারারুদ্ধ হলেন। কিন্তু ততদিনে বাব আর ব্যক্তি বাব নন, তিনি এক পুরাকালীন অর্কপ্রভ বিপ্লবসম্ভব। ততদিনে ধর্ম আর নীতির আঙন ছেড়ে বাবপন্থীরা আর্থ-সামাজিক ন্যায়ের খোলা রাস্তায় তুমুল বেগবান। সে আগুন ছড়িয়ে গেছে সব প্রাণে।
ধার্মিকেরা জড়ো হল নবধর্মের প্রাণোচ্ছাসে, ধর্ম-উদাসীরা জড়ো হন সামাজিক ন্যায়বিপ্লবের প্রবল উল্লাসে। ১৮৪৮ সালে খুরাসানের বুদাশ্ত শহরে বাবপন্থীদের বিশাল সভার আয়োজন। কী হয় সেই সভায়? প্রকাশ্যে কোরান বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। শরিয়তী আইন ইসলামের একমাত্র আইন- এইরূপ নিয়মাদি অমান্য করা হয়। বিশ্বাসীগণ আপনাপন বিবেকের স্বর মানিয়া চলুন। উলেমার কোনোরূপ সহায়তা বিনা ন্যায়বিচারের পথ খুঁজিয়া লউন। আপনাপন বিচারে শরিয়তী আইন মান্য হইলে মান্য, নতুবা নয়। অদ্য হইতে যাবতীয় "অপবিত্র' বস্তুসমূহ "পবিত্র' বলিয়া ঘোষিত। বাবের অগ্নিসমা শিষ্যা কারাত আল আইন প্রকাশ্য সভাস্থলে মুখের হিজাব ছিঁড়িয়া ফেলেন। বাবেদের কাছে নারীদমনের প্রতীক হিজাব ছিন্নভিন্ন, ভূলুন্ঠিত। সত্য এক নয়। সত্য অনির্বচনীয় নয়। কালক্রমে ধীরে ধীরে ঈশ্বরের নির্মোক উন্মোচিত হয়। এই সত্যবিচারের ভার মানুষের উপর।
বহু ভক্ত এই প্রবল আদেশে ভীত, পলায়নপর। বহু ভক্ত নেতাদের আক্রমণোদ্যত। সভাস্থলে বিশৃঙ্খলা, নবজন্মের যন্ত্রণায় বিপন্ন সময়। কিন্তু এইবার নেতারা অস্ত্র হাতে তুলে নেন। কৃষকেরা দলে দলে যোগ দেয় যুদ্ধে। সরকারী বাহিনীর সাথে ঘনঘোর সংঘর্ষ। লড়াই এবার মগজ ছেড়ে পেটের মধ্যে বেঁধে। নারীগণ পুরুষের সাজে যুদ্ধে নামেন। এইবারে অবস্থা সঙ্গীন। এই প্রথম দরিদ্র কৃষকেরা বোঝে তাঁরাও এই অসম যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সহযোদ্ধা। তাঁদের কন্ঠও শোনবার সময় এসেছে। ১৮৫০ সালেও ইয়াদ, নাইরিজ, তেহরান, জানজানে বিদ্রোহের ফুটন্ত কুসুম। এইবার দমনের সময় এসেছে। ১৮৫০ সালের ৯ই জুলাই বাবকে ফাঁসিতে চড়ানো হয়। অন্য সব নেতাদেরও হত্যা করা হয়। অনুগামীদের উপর নামে নৃশংস অত্যাচার। এক অংশ অটোমান ইরাকে পালান। ১৮৬৩ সাল নাগাদ আন্দোলন স্তিমিত, দ্বিধাবিভক্ত।
এই হল গল্প। ইহা ইসলামেরই গল্প বটে।
আমার কথাটি ফুরোলো।
নটে গাছটি মুড়োলো
কেন রে নটে মুড়োলি
কোন প্রাণটা জুড়োলি।
প্রাণের গল্পে ধৈর্য নাই
আইস এবার যুদ্ধে যাই।
২৩ (Sep 1 2006)
বুলাদির সঙ্গে কিছুক্ষণ
প্রবাস থেকে দীর্ঘকাল বাদে ফিরে দেখি বঙ্গভূমিতে বুলাদির জয়জয়কার। যেখানে তাকাই বুলাদি, যেদিকে শুনি বুলাদি। এমন কি শারদীয়া আনন্দমেলার বিজ্ঞাপনের পাতাতেও দেখি জ্বল্জ্বল্ করছেন মিচকে হাসি বুলাদি। আবার শুনতে পেলুম কলকাতার বড়ো বড়ো আটখানা পুজোর মণ্ডপের দোরে পেল্লায় পেল্লায় মিচকে হাসি বুলাদি দাঁড়িয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করবেন। অনেকেই নাকি বুলাদির এই এক্সপোনেনশিয়াল বাড়বাড়ন্তে বেজায় ক্ষুব্ধ। কিন্তু বুলাদিকে দেখলেই আমার বেজায় হাসি পায়। কুল্কুলিয়ে পেটের ভিতর থেকে হাসি বেরিয়ে আসে। বিশেষত যখন বেচারা লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুডো খেলার প্রস্তাব করে। ইদানীং আমাদের সমাজে কমেডি বলতে শুধু রাজনীতি আর খবরের কাগজ। সেই অবস্থায় বুলাদি খুব জরুরি সংযোজন। তবে পড়লুম যে বুলাদির বাড়বাড়ন্তে কিছু কিছু লাভও দেখা যাচ্ছে। যেমন সোনাগাছি এলাকায় এড্স্ সংক্রামিত যৌনকর্মীর সংখ্যা পাঁচ শতাংশে নেমে এসেছে। ভারতের অন্যান্য লালবাতি এলাকায় এই সংখ্যা নাকি তিরিশ শতাংশেরও বেশি। তবে বিভিন্ন এন জি ওর অক্লান্ত পরিশ্রমও নিশ্চয় এই কাজে সহায়তা করেছে। সব থেকে বড়ো কথা, বুলাদির কল্যাণে যদি আমাদের পরভিন, বৈশাখী, মসলিনা, তপনের পুজোর গল্প একটু কম পড়তে হয় তাতে ক্ষতি কি? যাক্ গে। কিবোর্ড চাপড়ে সমাজ পালটানোর বকওয়াসে কোনও বিশ্বাস নেই। কাজেই আমরা আমাদের গপ্পোগাছাই করি। আমাদের যৌনতার গপ্পোগাছা। আশা করি লেখার শিরোনাম পড়ে এর মধ্যে অনেকেই ঠিক করে ফেলেছেন যে এই লেখা না পড়াই ভাল।
ব্রাহ্মরা আসার আগে অবধি আমাদের বাঙালি সমাজে যৌনতা বেশ প্রবল আকারেই ছিল। সেই সময় কলকাতার বুকে লালবাতি এলাকার সংখ্যা দেখলে ব্যাপারটা বেশ ঠাহর হয়। তবে ব্রাহ্মরা আসার পরে এই যৌনতার ব্যাপারটা লুকিয়ে পড়ল। চলে গেল তা একেবারেই নয়। মজার ব্যাপার হল যে ব্রাহ্ম মনীষীদের মধ্যে অনেকেই নিজের জ্ঞাতি ভাই বা বোনেদের বিয়ে করেছিলেন। হুতোম প্যাঁচার কালে বাবু তার ইয়ারদোস্ত নিয়ে মাহেশে যাওয়ার সময় "মেয়েছেলে' না পেয়ে নিজের পিসিকে নিয়েই রঙ্গ করতে গেলেন। এই জাতীয় গপ্পো ব্রাহ্ম সংস্কৃতি কায়েম হবার পরে একটু থিতিয়ে এল, অন্তত প্রকাশ্যে। অন্যদিকে এই স্রোতকে আরও বলবতী করলেন মিশনারি হিন্দুরা। প্রথমে রামকৃষ্ণ, এবং পরে তাঁর পরে তাঁর শিষ্যরা। স্বামীজি নাকি ছোটোবেলাতেই রাধা-কৃষ্ণ পূজার বিরোধী ছিলেন। তাঁর উপাস্য ছিলেন শিব। তবে বৈদান্তিক সন্ন্যাসী চিরকাল সন্ন্যাসী মহাদেবকেই দেখে এলেন, দুর্গা আর চার কৃতী ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসারের কর্তা শিবঠাকুরকে তাঁর চোখে পড়ল না। এখন আবার শুনি যৌনতার ভরা কোটাল এসেছে। কেউ কেউ কপাল চাপড়াচ্ছেন, আবার কেউ কেউ "এ যৌবনজলতরঙ্গ রুধিবে কে' বলে মস্তি করতে বেরিয়ে পড়েছেন। যদিও আশেপাশের ছেলেমেয়েদের দেখে এখনও মনে হয়নি যে তারা ফাঁক পেলেই একে অন্যের সঙ্গে শুয়ে পড়ছে। শুধু টি ভি, খবরের কাগজ, সিনেমা দেখে দেখে মনে হয়েছে যৌনতা যত সুলভ হয়েছে, ততই স্ট্যান্ডার্ডাইজ্ড্ হয়ে পড়েছে। শপিং মলে সাজিয়ে রাখা ব্র্যান্ডেড মালের মতো। উপযোগিতা আছে, আনন্দ নেই। অবিরত সুখ আছে, আকস্মিক স্বর্গীয় বিস্ফোরণ নেই।
আমাদের ছোটোবেলার যৌনতা নিয়ে কেউ খুব একটা খোলসা করে কিছু লেখেন না। "মহাস্থবির জাতক' মনে হয় একমাত্র আত্মজৈবনিক বই, যাতে কৈশোরের যৌনতার উজ্জ্বল উল্লেখ পাওয়া যায়। তখনও কিন্তু ছেলেপুলেরা বেশ অল্প বয়সেই পাকত। অনেকেই ভুলে যান যে ইয়ং বেঙ্গলের বিদ্রোহীরা যখন মাল খেয়ে বাওয়াল শুরু করলেন, তখন তাঁরা চোদ্দো পনেরো বছর বয়সের কিশোর মাত্র। তবে আমাদের ছোটোবেলায় ঘরেদোরে সহাস্য বুলাদি ছিলেন না। ইমরান হাশমি, মল্লিকা শেরাওয়াত, শেফালী জরিওয়ালা, রাখি সাওয়ান্ত- কেউই ছিলেন না। আমাদের ভরসা বলতে রাজ কাপুর। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাড়িতে বাবা মায়ের কড়া শাসন। আনন্দমেলা-সন্দেশের বাইরে লক্ষ্মণরেখা। অন্যদিকে সিনেমা বলতে সবুজ দ্বীপের রাজা, হীরক রাজার দেশে। মানিকবাবু তো শিশুদের সিনেমায় প্রতিজ্ঞা করে কোনও নারী চরিত্র রাখলেনই না। তবে অরুণ-বরুণ-কিরণমালা দেখার সময় কিরণমালাকেই বেশি বেশি করে দেখতাম। আর ছিল আনন্দবাজারের দ্বিতীয় পাতায় বাঁদিকের নীচের কোণে অরণ্যদেব আর রিপ কার্বি। ক্লাস ফোর ফাইভে পড়ার সময় যৌন তীব্রতা নেই, কিন্তু অচেনার আনন্দ তো রয়েছে। অনেকে দেশে কাপড়ের বিজ্ঞাপন দেখে সেই অচেনার আনন্দের স্বাদ নিত। সব কিছুই যে বালকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি তা মোটেও নয়। সেই বয়সে আমার বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে একটা প্রিয় খেলা ছিল দেশে কোনও বিজ্ঞাপন দেখে সেই মডেলদের মতো পোজ করা। সেই পোজ যে সর্বদা ক্লাস ফোর ফাইভের বালক বালিকাদের পক্ষে নির্দোষ ছিল তাও নয়। বালক এবং বালিকা- উভয়েই অত্যুৎসাহে এই খেলা খেলত। তবে এই অচেনার আনন্দ অন্যরকম রোপ পেত ছেলেদের স্কুলে। একটু পেকে যাওয়া ছেলেরা ফরমান জারি করত যে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলাই বারণ। যার সঙ্গে ক্লাস থ্রি অবধি খেলে এসেছি, এখন রাস্তায় তাদের দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া। বাজারে যখন সবাই এই ফর্মান মেনে চলছে, তখন পলটু একদিন মাথাটা পিছনের বেঞ্চে হেলিয়ে দিয়ে বসেছিল। আর পিছনের বেঞ্চের বিলটু একটু মুখ ঝুঁকিয়ে পলটুর মুখের সামনে মুখ রেখে কথা বলছিল। ব্যাস! ক্লাসের মধ্যে উদ্দাম হুল্লোড়! শেষে এক দাড়িওয়ালা টিচার, যাঁকে দাদা বলে ডাকতুম, এসে শান্তি স্থাপন করলেন। শান্তি স্থাপনের প্রথম পর্বে উদ্দাম মার, দ্বিতীয় পর্বে গম্ভীর স্বরে জ্ঞানদান। শেষে দাদারও চোখ ছল্ছল্, আমাদেরও চোখ ছল্ছল্। এখনকার ছেলেপিলে হলে কেলাসেই নির্ঘাৎ ফ্যাঁচ্ফ্যাঁচ্ করে হেসে ফেলত। পরে যখন ঈশ্বরানুগামীদের ইস্কুলে গেলাম, সেইখানে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর ফ্রিকোয়েন্সি আরও বেশি। তার উপর পাশেই মেয়েদের ইস্কুল। কিন্তু মফ:স্বলের মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের সঙ্গে খোলামেলাভাবে মেশা তখনও ট্যাবু। কাজেই, যখন হর্মোন শিরায় শিরায় বন্যার মতো বইছে, তখন এই যৌনতার বহি:প্রকাশ হল একটু অদ্ভুতভাবে। ক্লাস এইটে পড়ার সময় ছেলেদের মধ্যে একটা খেলা হয়ে দাঁড়াল, কাউকে একটু অসাবধান পেলেই তার যৌনাঙ্গ টিপে দেওয়া। অথচ ক্লাস নাইন টেনে কোচিং-এ যাওয়ার সুবাদে যখন আবার ছেলেরা আর মেয়েরা কাছাকাছি, এই খেলাও আর রইল না। তখনও সমকামিতার সম্পূর্ণ অর্থ জানতাম না। যাঁরা এই খেলা খেলতেন তাঁদের কেউ সমকামীও নন, কারণ পরবর্তী জীবনে সবাই বিয়েথা করে সুখী সংসারী। তবে ঈশ্বরানুগামী ইস্কুলের ছাত্র হওয়ায় হোমোসেক্সুয়ালিটির গপ্পোগাছা আমাদের কানে যত সহজে পৌঁছাত, লেসবিয়ানিজ্ম্ সম্পর্কে ততটা ধারণা ছিল না। সমকামিত্বের রাজনীতি বুঝতে আরও অনেক বড় হতে হল।
নিউ ইয়র্কে ফিফ্থ এভিনিউতে সেইদিন উপচে পড়া ভিড়। দুইধারে মানুষের ঢল নেমেছে। মেট্রো স্টেশনে বহু মানুষের হাতে হালকা বেগুনি বেলুন, মাথায় রামধনু রং ফেট্টি। এক থেকে আশি বছর বয়সের লোকজন হুল্লোড় করতে করতে চলেছে। রাস্তার পাশে প্রেসবিটারিয়ান চার্চের যাজক যাজিকারা হাসিমুখে মানুষজনকে পানীয় জল সরবরাহ করছেন। আমি ম্যানহাটনের অনেকটা দক্ষিণ দিকে। তখনও প্যারেড এইদিকে এসে পৌঁছয়নি। সমকামী এবং বিকল্প যৌনতায় বিশ্বাসীদের বাৎসরিক প্যারেড যা গে প্রাইড বলে বিখ্যাত। আমি একলাফেকলা বাঙালি দর্শক, রাস্তার বেড়ার পাশে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে তাক করে দাঁড়িয়ে পড়লুম। প্রচন্ড ভিড় চারদিকে। হঠাৎ মেঘের গর্জনের গুরুগুরু রব আর জনতার তুমুল উচ্ছ্বাস। একঝাঁক তেজী আরবি ঘোড়ার মতো হার্লে ডেভিডসনের দল সামনে এসে দাঁড়াল। তাদের ইঞ্জিন চলছে, তাতে মাদলের দ্রিম দ্রিম ধ্বনি। এটাই প্যারেডের শুরু। এই বিশাল প্যারেডের বিশদ বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে যদি কেউ ভাবেন এ বোধ হয় কেবল যৌনতা এবং ছ্যাবলামির কার্নিভাল, তাহলে বোধ হয় ভুল ভাববেন। যদিও প্যারেডের সিংহভাগ অধিকার করে থাকেন বিচিত্র সাজপোষাকে বা প্রায় বিনা সাজপোষাকে সজ্জিত নরনারী। আপনার যদি কৌতুকবোধের ক্ষমতা বজায় থাকে, তাহলে মাঝে মাঝে পেট ফাটিয়ে হাসি পাবে। এখনও মনে পড়ে সেই বেঁটে মোটা লোকটিকে। ডেভিড বুনের মতো চেহারা, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মাথার চুলে পিছনের দিকে দুইটি লম্বা বিনুনি, আমার মা-মাসিরা ছোটবেলায় যেমন বাঁধতেন। পরনে সাদার উপর নীল ফুল ফুল আঁকা বাচ্চাদের ফ্রক। হাতে পুতুলের বাক্স, তার মধ্যে থেকে উঁকি মারছে ছোট্ট খুকি পুতুল। পায়ে বাচ্চাদের ইস্কুলে পরে যাওয়ার কালো জুতো।
কিন্তু, এই প্যারেড যতটা মজা ততটাই রাজনৈতিক। হেঁটে আসেন নিউ ইয়র্ক পুলিশ এবং দমকলবাহিনীর কর্মীরা, নিজেদের ইউনিফর্ম পরনে, সমকামীদের সমানাধিকারের দাবীতে কণ্ঠ মিলিয়ে। যোগ দেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ রাজনীতিকেরা। প্যারেডের এক বিশাল অংশ জুড়ে কেবল বুশ-বিরোধী পোস্টার। বহু যুদ্ধবিরোধী, বামপন্থী, সমাজতান্ত্রিক, নারীবাদী গ্রুপের সদস্যরা এই মহামিছিলে সামিল। বহু ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্য তাদের পতাকা হাতে যোগ দিয়েছেন। আশ্চর্য ব্যাপার হল, এদের মাঝে রিপাবলিকান একটি গ্রুপও আছে। তাঁদের পদক্ষেপ একটু সংকুচিত কারণ তাঁদের দেখতে পেলেই চতুর্দিকে যথেচ্ছ বিড়াল কুকুরের আওয়াজ। এই আন্দোলন বহুত্ববাদের আন্দোলন, মানুষর বৈচিত্র্য স্বীকার করে নেওয়ার আন্দোলন। রাষ্ট্র যেমন এক ভাষা, এক ধর্ম চাপিয়ে দিতে পারে না, ঠিক তেমনি এক যৌনতাও চাপিয়ে দিতে পারে না। স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যৌনতার নির্মাণ কৃত্রিম। যতক্ষণ দুটি মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে, রাষ্ট্র সেইখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এই প্যারেডে যাওয়ার আগে আমার নিজেরও সমকামিতার কথা শুনলে অস্বাভাবিক লাগত। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, ঠিক আমার পিছনেই দাঁড়িয়েছিল একদল ছেলে। তারা হাবেভাবে, পোষাকে পরিচ্ছদে একদম "আমাদেরই' মতো। কিছুক্ষণ বাদে আরও একদল ছেলে এল যারা এদের বন্ধু। দেখা হতেই প্রত্যেকে প্রত্যেকের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে চুমু খেল। সেই মুহূর্তে অস্বাভাবিক লেগেছিল। তবে এই জমায়েতে দুই তিন ঘন্টা কাটানোর পরে, সমকামী প্রেমের বহি:প্রকাশ নিয়ে সমস্ত জড়তা কেমন আপনা আপনি কেটে গেল। স্বাভাবিকতার বোধটাই অনেকটা পালটে গেল। বেশির ভাগ লোক যা করে সেইটাই স্বাভাবিক- এটা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নেওয়া এবং শিখিয়ে দেওয়া কথা। এইটাই জরুরি শিক্ষা ছিল।
যেদিন এই কার্নিভাল শেষ হয়, সেইদিন রাত্রে হাড্সনের রাতের আকাশে বাজির ফুলঝুরি। আমার নিউ জার্সির অ্যাপার্টমেন্টের জানলা দিয়ে নানা রঙের আলোর বন্যা দেখতে দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। কত রঙের আলোর ফুলকি নিজেদের ইচ্ছামতো আকাশে খেলা করছে! কেউ বলছেন না- তুই কেন লাল না? তুই কেন নীল? অন্ধকার হাডসন জুড়ে শুধু আনন্দের রঙিন বিস্ফোরণ। আয় রে রসের সুধায় হৃদয় ভর না।
২৪ (Sep 19 2006)
পুজোর ডায়েরি
ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসে শিউলি পড়ে থাকে না। নিউ টাউন থেকে গড়িয়ার সাদা বেঁটে বাসটা যখন অন্ধকার মাঠ চিরে ভূতগ্রস্তের মতো কালো পিচের রাস্তায় এসে দাঁড়ায় তখন কোনও দূরবর্তী ভেড়ির কালো জলের থেকে চাঁদ উঠেছে। বিধ্বস্ত শব আপিসফিরতি লোকজনের ঘামের মধ্যে মাঝে মাঝে মাথা তোলে রুগ্ন কন্ডাকটরের কণ্ঠস্বর বিহ্বল কুকুরের মতো। পার্ক সার্কাসের জ্যামে বাস যখন আটকে পড়ে হাই তোলে আর ঘাম মোছে, পাশে অন্ধকার ঘন জঙ্গলের ভিতরে কে জানে কোন কীট ক্ষুদ্র পশু রমনে আনন্দিত হয়! অথবা অন্য পাশে আই টি সি হোটেলের আলোকিত নীড়ে কার দেহে মোবাইল চুম্বন এঁকে দেন মডেলীয় বনলতা সেন। আহা এ কি আনন্দ! পুজো এসে গেল প্রায়।
শিউলি পড়ে থাকে হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখে গেটের পাশে। যেখানে কোনও বিহারী যুবা দিনরাত ইস্তিরি করে যায়, সিকিউরিটি গার্ড সন্ধে হলেই ঢুলে পড়ে আর গেটের গোল গোল আলোর উপরে অসংখ্য পোকারা আসর জমায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কারা যেন শঙ্খ বাজায়! প্রতিদিন সন্ধ্যায় কে বা জানি ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে একা একা ঘুমোতে যায়- রাতের দিকেই ওদের ফোন আসে। যদিও বেশির ভাগ ভীষণ জোরে টি ভি চালিয়ে "একদিন প্রতিদিন' দেখে। যেন এখনি ভীষণ আওয়াজের প্রয়োজন। এত শব্দের পরেও গড়ে ওঠা প্যান্ডেলের পাশে কুকুরটি শুঁকে যায় অশ্রান্ত মনোযোগে বিগতদিনের আয়োজন। কর্তা কাল মারা গেছেন। রাতের দিকে ফোন আসেনি। এবারে মানুষজনেরাই আসবে। মানুষজন, আপনজন। পুজো আসছে।
ওর ছেলেটার কাল থেকে খুব অসুখ। জ্বরে হাত পা পুড়ছে, ঠোঁট ফুলে লাল রক্ত পড়ে, চোখ লাল আগুনের মতো। ডাক্তার বলেছে এ এক বিরল অসুখ যা কেন হয় জানি না, কার হবে জানি না। হাসপাতালে ছোট হাতে ছুঁচ ঢোকে, স্যালাইন চলে। অন্য হাত ছুঁড়বে বলে তাও বেঁধে রাখা হয়। কত অসুখ হয়ে যাচ্ছে মানুষের। ঐতিহাসিক উপন্যাসে পড়া অসুখেও লোকে ভোগে আজকাল। অথবা একদম না- পড়া অসুখ যথা চিকুনগুনিয়া। ঠিক যেন ধলভূমের ছোট কোনও গ্রাম যাকে নিয়ে কলকাতার কোনও কবি ঠিক কবিতা লিখবেন। যেমন রিখিয়া। অসুখের নামও কেমন মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে! তাই বোধ হয় ওর ছেলেটা একদম ঠিক হয়ে যাবে বলে ডাক্তার বলেছেন। অসুখ চলে যাবে, আবার নতুন নতুন অসুখ আসবে। অসুখের মতো পুজোও এসে যায়।
কেউ কেউ আবার আসে না, শেষবারের মতো চুমু খেয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। এই ঘরে পড়ে থাকে সরল টিউবলাইটের সাদা আলো, গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা ফুলছাপ চাদর, জেলুসিলের ছেঁড়া পাতা, ড্রয়ারের উপরের তাকে প্রায় লুকিয়ে লোকনাথ বাবা, কাচের শোকেসে সাজানো খেলনা গাড়ি, শারদীয় নবকল্লোল, কভি আলবিদা না কহেনা। অন্যঘরে ল্যাম্পশেডের আড়ালে উদাসী হলুদ আলো, ফ্যাব ইন্ডিয়ার পর্দাগুলো জানলায়, ঢোকরার গণেশ খুব রোগা ও ঘুমন্ত, সোনি কোম্পানির সপ্রতিভ টি ভি ও হোম থিয়েটার, জমে ওঠা বার্বির সারি, টেডি বিয়ার এবং অরুন্ধতী রায়। তবে সব ঘরেই অন্তত একটা করে পুতুল থাকে। পুতুল পুতুল লক্ষ্মী পুতুল, বলো তুমি কার? মার না বাবার? এই পুতুলটা কথা বলা পুতুল না। কিছুই বলে না। বেশির ভাগ পুতুলই কিছু বলে না। শুধু দশ হাত নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। দশ হাত নিয়ে, তলায় সিংহ নিয়ে, সামনে ধাক্কাপাড়, বমকাই, টাঙাইল, চুড়িদার নিয়ে, সকালে ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা নিয়ে, দুপুরে ভোগের ব্যাচে হুড়োহুড়ি নিয়ে, বিকেলে পাড়ার জলসা নিয়ে, রাতে পুজো কমিটির সদস্যদের ছোট ছোট হুইস্কির গ্লাস নিয়ে, দুই মাস মোটা মোটা পুজোসংখ্যা নিয়ে।
গরুরা কাশফুল দেখে, নীল আকাশ দেখে বেশি বেশি দুধ দেয়। উৎসবে কলমসকল সাধ্যমত বীর্যবান ও ঋতুমতী হয়ে ওঠে। সাদা সাদা বাঁজা পাতা বিপুল উল্লাসে পোয়াতী হয়ে ওঠে। সবাই আমাদের নিয়ে গল্প লেখে যেন আমরাই জগতের প্রমাণিত কেন্দ্রে বাস করি। কবিতাগুলো কি আমাদের নিয়ে লেখা হয়? জীবজন্তু, গ্রহতারকা, বাসনৌকো, সর্ষে ইলিশ, বেলুড় হালেবিদ, রিনা ঢাকা, রাণী মুখার্জী এবং গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-অর্থতন্ত্র-উত্তরাধুনিকতন্ত্র নিয়ে শুধু রচনা লেখা হয়। তিরিশ থেকে পঁচাত্তরের মধ্যে সবকিছু পাওয়া যায়। তিরিশ হলে সবাই একটা দশ আর একটা কুড়ি টাকার নোট দেয়। পঁচাত্তর হলে দরাদরি করে। মায়ের বালিশের তলায় পড়ে থাকতে থাকতে মলাটগুলো খুলে আসে। মেয়েটাকে সেই মলাট দিয়ে নৌকো বানিয়ে দিতে হয়। নৌকোয় চড়ে পুজো আসে, নৌকোয় চড়ে পুজো যায়।
আর একটা বৈজয়ন্ত গড়িয়াহাটের দোকানে দোকানে আত্মীয়স্বজনের জন্য জামাকাপড় কেনে, বউয়ের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোল খায়, রোল খাওয়ার পর কোল্ড ড্রিঙ্ক্সের জীবাণু নিয়ে বউয়ের সঙ্গে তর্ক করে, বাসের ভিড় দেখে বিরক্ত হয়, ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করে, মন দিয়ে হলদিরাম থেকে মিষ্টি কিনে বাড়ি যায়। ওর কপালে পিঠে বুকে কত যুগের ঘাম জমে আছে! এখনও কি গ্রীষ্ম যায়নি? আর একটা বৈজয়ন্ত সাগ্রহে পুজোসংখ্যা পড়ে, স্নান করার পরে বগলে ডিও লাগায়, টি ভিতে রাতের সংবাদ শোনে, পাশের বাড়ির ঝগড়া কানে এলে জানলা বন্ধ করে দেয়, মেয়ে ঘুমোলে মাথায় হাত বুলায়। এইভাবে ক্রমে ক্রমে শিউলির রাত নেমে আসে। ক্ষয়াটে অন্ধকারে শিউলিরা বিপুলভাবে জন্মে যায়। জন্ম জন্ম জন্মে যায়।
সেই রাতে আমি যখন ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের এক নিরালা অংশে ঠিক রাস্তার মাঝখানে ছ্যাতলানো ঘিলু ও রক্ত মেখে পড়ে থাকি, সে আমার পাশে এসে বসে। আমি তার কপালের পিঠের বুকের ঘাম মুছিয়ে দিই। সে আমারে কোলে তুলে নিলে, শরতের চাঁদ ভেড়ির জলের পাশে বসে। সে আমাকে কোলে তুলে হেঁটে যেতে থাকে। চারদিকে কালো মাঠের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আলোর সারি আকাশে থেমেছে। আমরা সেই আলোর সারির মধ্যে দিয়ে আকাশের দিকে হেঁটে যাই। চাঁদ বসে দেখে। আমাকে আর বৈজয়ন্তকে।
২৫ (Oct 17 2006)
পঁচিশ নম্বর লেখা
ঠিক দুই বছর পরে আবার ভুতুমের সঙ্গে দেখা। সেই লন্ডন শহরে। একসময় যে শহরের নাম বড়দিনের রঙিন ঘন্টার মতো ডংডং করে বেজে উঠত। লন্ডন অনেকটা একই রকম আছে।
অক্টোবরের রাস্তায় ঝরে যাওয়া লাল পাতার গাদার উপরে ইস্পাত যে আকাশ ঝুঁকে থাকার কথা, তার বদলে প্রায়ই হলদে রোদ আর ফিকে নীল হাওয়া। তবুও টেম্সের পাশে "গহন কাফেতে দোঁহে যুবকযুবতী', "সাঁঝে ওড়ে বিষনীল অনন্ত বেলুন'। মাদাম ত্যুসোর সামনে, লন্ডন আইয়ের লাইনে, টাওয়ারব্রিজের উপরে আমুদে ট্যুরিস্টদের টুক্রো হল্লায় টেম্সের জলে বুজকুড়ি ওঠে। বইয়ের দোকানে দোকানে এখনও বেশ ভিড় হয়, এবং যথারীতি মদের দোকানে আরও বেশি। সোহোর বেশ্যারা ছোটো স্কার্টে, রক্তহীন মুখে, কালিমাখা চোখে, উঁচু উঁচু চামড়াজুতোয় খদ্দের ডেকেই চলেছে। টিউবস্টেশনের এস্ক্যালেটরের পাশে সাঁটা "মামা মিয়া', "লায়ন কিং', "এভিটা'র পোস্টার। এখনও "মাউজট্র্যাপ' অভিনীত হয়! এক থেকে চার নম্বর জোনের উইকলি টিকিট সাড়ে তিরিশ পাউন্ড। নর্দার্ন লাইনের ট্রেনে প্রায় প্রতিদিনই গন্ডগোল। সকালবেলার বিনেপয়সার কাগজে সোমত্ত যুবতীদের ছবি। ক্যনারি হোয়ার্ফের অভ্রংলিহ ইমারতের তলায় সারিবদ্ধ চিন্তিত চাকুরের মুখ হাত পা চোখ কোট। ব্রিক লেনে ইফ্তারের সময় দোকানের ঝাঁপ দশ মিনিটের জন্য বন্ধ। খুললে "বাইগন পসিন্দা কাবাব' আর "চিংড়ি বালতি ঝোলের' মতো উদ্ভটনামা খাবার পাওয়া যাবে। এখনও।
কিন্তু ভুতুম আর সে ভুতুমে নাই। পঁচিশ নম্বর লেখার কথা শুনে একপাক নেচে দিল বটে প্রথম প্রথম। কিন্তু যে ভুতুম ট্র্যাফালগার স্কোয়ারের শেষ বিকেলের আলোর মিছিলে লাল গামছা মাথায় একমুখ দাড়ি নিয়ে তুর্কী নাচন নেচেছিল, সেই ভুতুমের দেখা পেলাম না। এখন ভুতুমের দাড়ি রাখতে ভয় করে। এখন হুতুমের পরনে রংচটা জিন্স্, বেখাপ্পা টি শার্টের উপর জবুথুবু জ্যাকেট, সাফসুতরো মুখ। শুধু চোখের পিছনে রাত ঘনিয়ে এসেছে। এখন সন্ত্রস্ত হয়ে থাকার সময়। বাসে যেতে যেতে বাস ফেটে যেতে পারে। বা ট্রেনে উঠতে গিয়ে পুলিশ পিছন থেকে যদি গুলি করে! দাড়ি দেখে কেউ মুখখিস্তি দিল হয় তো বা! যে লোকগুলো বোম মারে বা মারার চক্রান্ত করে, তাদের সঙ্গে আমার মুখের মিল নেই তো? সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলেছে জোরকদমে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চলেছে জোরকদমে। তাই বড় সন্ত্রস্ত হয়ে আছি গো স্যাঙাৎ!
এই বিদেশে সবই মানায়-
রাতবিরেতের নিঝুম শান্তি,
তোমার আমার অমোঘ ভ্রান্তি,
সবই মানায়;
সবাই মানায়
গোপন সময়, অসুখবিসুখ,
এক ফোঁটা জল, চার ফোঁটা দুধ,
গড়িয়ে যাচ্ছে শেষ আলোতে
একলা আরাম, একলা শান্তি।
এই তো মিলিয়ে যাওয়ার সময়! এই তো মিশে যাওয়ার সময়! যাতে সবাইকে মোটামুটি একরকম দেখতে হয়। যাতে সবার কথাবার্তায় একটা একরকম ভাব থাকে। যাতে বেশভূষায় কেউ হঠাৎ দলছুট না হয়ে যায়! আইস, আমরা খামারে গিয়া মৌন বৃন্দগান অভ্যাস করি। আপাতত মাতৃগণ দুগ্ধপান করিয়া প্রমাণ করুন যে ইহা সন্তানের নিমিত্ত। আপাতত শিশুগণ মেটাল ডিটেক্টরের মধ্য দিয়া একাকী পদচারণা করিয়া প্রমাণ করুন যে তাহারা নিরাপদ বস্তুবটেক। আপাতত মনুষ্যকুল বাঁচিয়া থাকিয়া প্রমাণ করুন যে তাঁহারা বাঁচিয়া আছেন। আপাতত এ বড় বেঁচে থাকার সময়!
এইরকম প্রলাপকথনের মধ্যে দিয়েই ভুতুম আর আমার সময় কাটে। শেষে ভুতুমকে তার নিজের কথা বলতে বলি। ভুতুম সাদার্কের এক নিরালা গলিতে শস্তা বীয়ারের টিন হাতে উদাস হেলান দেয়।
"আজও বৃষ্টি পড়ে নি কোনো আকাশে। আমার চাতকের মতো তেষ্টা পায়। বীয়ারে আর মানায় না। অনেক জল। দেখো চেয়ে টেম্সের বুকে অনেক জল। অনেক জল বয় গঙ্গায় নীলনদে টাইগ্রিসে। ইরাকে নাকি সাড়ে ছয় লক্ষ লোক মারা গেছে। লন্ডনে সাড়ে ছয় লক্ষ পাউন্ডে মাথা গোঁজার জায়গা কিনতে পাওয়া যায়? ঘরদোরের দাম খুব বাড়ছে। তোমাদের সেইদিকে নাকি অনেক ঘরদোরে অনেক মানুষ থাকে? তবে শুনলাম যে মশার কামড়ে অনেক মানুষ মরে যাচ্ছে? আমাদের এখানে মশা নেই। শুধু লোকে খুব ছুরি চালায়। আমার চেনাজানা বাচ্চারাও। স্কুলের গেটে মেটাল ডিটেক্টর বসানো হচ্ছে যাতে বাচ্চারা ছুরি নিয়ে স্কুলে না ঢুকে পড়ে। যে ছেলেটা আমাকে বিনি পয়সায় বীয়ার খাওয়াত সেও নাকি মারবে শুনছি। বড়ো দাড়ি রেখেছে। পনেরো বছরের একটা ছেলে সেইদিন সারা জীবনের জন্য জেলে চলে গেল একটা এগারো বছরের মেয়েকে খুন করে। পনেরো তরিখ ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে দিওয়ালি ছিল। আমি যাই নি। রাতের বেলাতেও ভীষণ আলো । চোখে কি জানি একটা হয়েছে। আলোতে চোখে খুব ব্যথা হয়, জল পড়ে। যত আলো বাড়ে আমি আর কিছু দেখতে পাই না। প্রতিদিন বীয়ার খাওয়ার পরে গলা মুচড়ে পেটের থেকে গরম জল বেরিয়ে আসে। সবসময় খুব জলতেষ্টা পায়। আর ছয় বছর পরে এইখানে অলিম্পিক্স হবে। কত মানুষ আসবে বল দেখি! কত লোকে দৌড়াবে, লাফাবে, আনন্দ করবে! অনেকেই হেরে যাবে যদিও। খুব আলো হবে, রোশনাই হবে। আলোতে আমার চোখ ব্যথা করে। আমার জল তেষ্টা পায়।'
বুঝলাম এই অসংবদ্ধ প্রলাপের পরে আর বিশেষ এগোবার জায়গা নেই। ভুতুমের জন্য নিয়ে আসা গুটিকয়েক জিনিষ ওর হাতে তুলে দিলাম। ভীষণ হেলায় ভুতুম জিনিষগুলো পাশে সরিয়ে রাখে। টাওয়ারব্রিজের মাথায় জটিল কুয়াশা নেমে এসেছে। ক্যানারি হোয়ার্ফের বাড়িগুলো করুণ দৈত্যের মত আবছায়ায় ঢেকে যেতে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় বাতি জ্বলার সময় ঘনিয়ে এল। ভুতুম এইবার গর্তে ঢুকে যাবে। এইবার ভুতুমের হাতে হাত রাখি। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তার ধুমসো কোটের পরতে পরতে এক অপার শান্ত নরম কাঁথার গন্ধ। তার রাত্রিনামা চোখের কোণে আমার দুরন্ত সময় ভ্রূণ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
"ভুতুম ভুতুম করে মায়,
ভুতুম গেছে কাদের গাঁয়,
কোন কাকেতে দাঁড় বায়,
ভুতুম রে তুই ঘরে আয়।'
এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৬ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী নভেম্বর ১ ২০০৬
এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৭ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী নভেম্বর ১৭ ২০০৬
এটা সেটা এখানে সেখানে - ২৮ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী ডিসেম্বর ৪ ২০০৬
২৯ (Dec 18 2006)
প্রেসিডেন্সি-২
"In short, to remember is to reconstruct, in part on the basis of what we have learned or said since. That's normal, that's how we remember."- The Mysterious Flame of Queen Loana, Umberto Eco
দীপকবাবু সবসময় একটা কথা বলতেন- পড়ো, কিন্তু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবো। এই ভাবার প্র্যাকটিস আমাদের মগজের মধ্যে গেঁথে যাচ্ছিল। আর ভাবার একটা কাঠামো তৈরি হচ্ছিল মিহিরবাবুর ক্লাসে। খুব সম্ভবত ক্লাস হত পঞ্চাশ মিনিটের। সেই পঞ্চাশ মিনিট শুধু এক একটা ইঁট গেঁথে অর্থনৈতিক যুক্তির ইমারত তৈরি করে যাওয়া। সেই ক্লাসে একফোঁটা বাহুল্য নেই, এক মুহূর্ত বিষয়ান্তরে ভেসে চলা নেই, একটিও অদরকারি কথা নেই। যুক্তির ঘনত্বে ক্লাসের শেষে মাথা ভোঁ ভোঁ করত। তখন বুঝতাম না এই ক্রমাগত যুক্তির সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে কিভাবে ভাবতে শিখছিলাম। যে ভাবা শুধু পঠনপাঠন বা পেশাতেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রের পাথেয় হয়ে রইল। দীপকবাবুর ক্লাস ছিল অপেক্ষাকৃত খোলামেলা। একদিন বোর্ডে হঠাৎই বড় বড় অক্ষরে লিখলেন "RIMBOUD"। এখন আর মনে নেই কি প্রসঙ্গে। তবে ক্লাসের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল টিউটোরিয়াল। এক এক টিউটোরিয়াল গ্রুপে আট দশজন করে ছিলাম। এখন ভাবলে হাসি পেলেও মিহিরবাবুর টিউটোরিয়ালে কেউ প্রথম বেঞ্চে বসতে চাইত না। আট দশজন অত বড় ক্লাসে দুটি বেঞ্চ ভরাতে পারত। কিন্তু সেই দুটি বেঞ্চ সবসময় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বেঞ্চ, যাতে মিহিরবাবুর দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া যায়। অথচ মিহিরবাবু কোনোদিন উঁচুগলায় কাউকে কিছু বলেছেন শুনিনি। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কে ভয়-সমীহ-শ্রদ্ধার এই যে ধ্রুপদী সংমিশ্রণ, তার বিরুদ্ধযুক্তি আরও বড় হয়ে শুনলাম এবং কখনও কখনও মেনেও নিলাম। শুধু মিহিরবাবু-দীপকবাবুর মতো শিক্ষকদের নতজানু হয়ে প্রণাম করা এড়াতে পারলাম না। আজও। তাই আমাদের কলেজজীবনের শেষের দিকে যখন নবীন এবং প্রবীণ শিক্ষণপ্রতিভা একে একে কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, আমাদের দু:খ ছিল নিখাদ, যে রাজনৈতিক গ্রুপেই থাকি না কেন। প্রতিভার এই বিপুল অপচয় ছাত্রদেরও বিদ্ধ করেছিল। তখন নব্বই দশক মাঝপথে।
বরষা কখন ঘন মরীচিকা সাজে
তবে আগেও বলেছি, জীবনযাপনের একটা স্বাভাবিক কিন্তু ছোট অংশ ছিল পড়াশুনা। বাকিটার পুরোটাই অধিকার করে থাকত প্রেম-রাজনীতি-সংস্কৃতিচর্চার হুল্লোড় বা বেশির ভাগ সময় স্রেফ নিখাদ হুল্লোড়। যে কারণে কলেজে ঢোকার পরেই প্রথম গন্তব্য ছিল প্রমোদদার ক্যান্টিন। তখনও ক্যান্টিনে নরম পানীয়ের ভেন্ডিং মেশিন বসেনি। মলিন হলুদ দেওয়াল ছেয়ে থাকত পোস্টারের পর পোস্টার। এস এফ আইয়ের পোস্টারিং ছিল খাসা। সুভাষ মুখুজ্জে, অরুণ মিত্র থেকে শুরু করে শক্তি চাটুজ্জে- কেউই বাদ যেতেন না। কিন্তু যারা সেই পোস্টার লিখত এবং সাঁটত তাদের কলেজে দেখা যেত কম। কারণ তাদের বেশির ভাগেরই নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল প্রমোদদার দেওয়ালে লাগানো টেবিলে এবং বেঞ্চ। অন্যদিকে আই সির নেতৃবৃন্দের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। তাঁদেরই একজন এখনকার "ধুম'খ্যাত প্রীতম। এখনও মনে পড়ে ভোটের দিন সকালে কালীপুজোর টিপ লাগিয়ে প্রীতম সবাইকে পুজোর সন্দেশ বিলাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল সেই সন্দেশের ভাগ থেকে বিরোধীরাও বাদ যেত না। ফিক্স্ড্ পয়েন্টের অধিকাংশ আসত নকশাল শিবির থেকে। একবার এই রকমই একজন ক্যান্টিনে আমার কাছে সিগারেট জ্বালবার জন্য আগুন চাইলেন। আমার কাছে দেশলাই নেই আর সিগারেটের টুকরোটা সবে মাটিতে ফেলে দিয়েছি। তিনি সেই মাটিতে ফেলা সিগারেটের টুকরো তুলে নিয়ে সিগারেট জ্বালালেন এবং আমার দিকে খাঁটি উত্তমকুমার স্টাইলে ঘাড় ঘুরিয়ে কইলেন- আমরা এখনও নেভা আঁচ থেকে আগুন জ্বালাতে পারি। কিন্তু আগুন সত্যি সত্যি নিভে আসছিল। অরাজনৈতিকেরা ক্রমাগত রাজনৈতিক স্পেসের দখল নিচ্ছিল। গ্লাস্তনস্ত পেরেস্ত্রৈকা শুরু হয়ে গেছে। সাবেকি রাশিয়ান বামপন্থা টুকরো টুকরো হচ্ছে। চিনে তখন তিয়েনানমেন স্কোয়ার। আস্তে আস্তে পতনোন্মুখ বামপন্থী সাম্রাজ্যের সান্ধ্য ছায়া লম্বা হয়ে আসছে। সেই সময় বামপন্থী গ্রুপেরা দিশেহারা। রাজনৈতিক যুক্তি দিয়ে সমর্থন জোটানোর ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে। তার জায়গা নিচ্ছে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। এই দিশেহারা ভাব প্রখর হল মণ্ডল কমিশনের সময়।
কলেজ পোর্টিকোতে ভয়ানক উত্তেজনা। কলকাতাতে মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে বিশাল ছাত্র মিছিল বেরোচ্ছে। নকশালরা মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে না পক্ষে খুব একটা খোলসা নয়। এস এফ আইয়ের ঘোর বিপদ কারণ কেন্দ্রে তখন ভি পি সিং-এর বন্ধু সরকার। এমনকি ইন্ডিপেন্ডেন্টরাও ঘোর বিপদে কারণ ইউনিয়নের কোনও ডাক ছাড়াই ক্লাস বয়কট হতে যাচ্ছে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে। প্রেসিডেন্সির মতো এলিটিস্ট প্রতিষ্ঠানে মণ্ডল কমিশনের পক্ষে কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অরাজনৈতিকেরা রাজনৈতিক স্ট্যান্স খোলসা করে উঠতে পারেনি। আমি কোনও ছাত্র সংগঠনের নির্দেশ ছাড়াই ক্লাস বয়কটের বিপক্ষে ছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল আপাতত: রাজনৈতিক যুক্তিকে ছাপিয়ে উঠেছে এক সর্বগ্রাসী আবেগ। আমাদের ক্লাসের সমস্ত ছেলেমেয়ে ক্লাস বয়কট করল। আমি একা প্রতি ক্লাসের আগে প্রফেসরদের কাছে গিয়ে গিয়ে হাজিরা দিয়ে এলাম। এর পরে আরও দুই দিন যেতে না যেতেই রাজনৈতিক সমীকরণগুলো পরিষ্কার হয়ে এল। এস এফ আইকে মণ্ডল কমিশনের পক্ষে যেতেই হল কারণ গোপালন ভবন বন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে লেজুড়ের মতো জুড়ে দেওয়া হল অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার যুক্তি যে রেকর্ড এখনও বাজছে। কিন্তু বন্ধু সরকার ছাড়া হাতে আর কোনও জোরালো যুক্তি ছিল না। ইন্ডিপেন্ডেন্টস কনসোলিডেশন মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিল। নকশালদের স্ট্যান্ড বুঝে ওঠা সাধ্যাতীত ছিল। যখন মণ্ডল কমিশনের সম্পর্কে ফিজিক্স লেকচার হলে ছাত্র-শিক্ষক কনভেনশন আয়োজিত হল, তখন নকশাল ছাত্র সংগঠনের মুখপাত্রী বললেন- যারা মণ্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তারা স্রেফ তাদের শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থ করছে কিন্তু....কিন্তু মণ্ডল কমিশন অত্যাচারিতদের অধিকার অর্জনের কোনও পথ নয় কারণ এ হল ভিখিরির দিকে ভিক্ষে ছুঁড়ে দেওয়ার মতো অপমানজনক। ছাত্রছাত্রীদের সম্মিলিত বেপরোয়া মুডের সামনে অন্য কিছু বলা বোধ হয় সম্ভব ছিল না। কাজেই "কিন্তু"র উদ্ভব।
এই "কিন্তু" বানতলার ঘটনার পরে আর সম্ভব ছিল না। আমরা কেউ কেউ দাবি করলাম এস এফ আইকে বানতলার ঘটনার প্রতিবাদে পোস্টারিং করতে হবে। যা রাইটার্স বিল্ডিঙের তল্পিবাহক ছাত্র সংগঠনের পক্ষে অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ বলেই হয় তো সম্ভবপর হয়েছিল। কিছুদিন তীব্র বাক্বিতন্ডার পরে এস এফ আই সত্যি সত্যি বানতলার দুর্ঘটনা নিয়ে ক্যান্টিনের দেওয়ালে পোস্টার মারল। তবে এই ত্রিমুখী লড়ালড়ির চত্বরে একত্র কণ্ঠস্বরের জায়গাও ছিল। যখন রামমন্দির আন্দোলন এবং তজ্জনিত রায়টের পরে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের ব্যানারে বিশাল মিছিলে সে¾ট্রাল অ্যাভিনিউ মুখরিত হল। এই লিবারেল ধাঁচের কচি এবং হালকা বামপন্থা সেই সময়ের প্রেসিডেন্সি কলেজের রাজনৈতিক ইডিয়ম। বিরাট কোনো আদর্শগত ভেদাভেদ বা রাজনৈতিক যুক্তির লড়াই মুছে যাচ্ছিল। নব্বই একানব্বইতেই আজকের ভারতের ধারক বাহক অর্থনৈতিক নীতির পথ চলা শুরু যেখানে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনই শেষ কথা।
মঙ্গলগ্রহে বেড়াল থাকে না
এই অরাজনীতি প্রত্যাশিত ছিল। কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজে একদল ভালো ছাত্রছাত্রী পড়লেও পড়াশুনার বাইরে আঁতেলীয় বীক্ষণের যে বাজারচলতি গপ্পো চালু আছে তা অনেকাংশেই মিথ। কেউ কেউ অবশ্যই এক বগলে হকিং, আর এক বগলে গ্রামশি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তখনও দেরিদা-ফুকোরা আসি আসি করছেন। কলেজ স্ট্রিটের ক্ষুদ্র ভাবজগতে তাঁদের হেজিমনির ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। কাউকে কাউকে দেখতাম মুখে আধপোড়া চারমিনার নিয়ে গম্ভীরভাবে জ্যামিতিক কবিতার চর্চা করতেন। কলেজ ম্যাগাজিনে পেখম মেলে দেখনদারির স্বভাবজ প্রয়াস ছিল, বিশেষত ইংরাজি বিভাগে। কেউ কেউ অঙ্ক কষে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রমাণ করতেন, কেউ কেউ নতুন মার্ক্স এবং পুরোনো মার্ক্সের দ্বন্দ্ব নিয়ে বুলি কপচাতেন, কেউ কেউ ভূমিসংস্কারের অর্থনীতি নিয়ে গম্ভীর গম্ভীর কথা লিখতেন। বেশির ভাগই ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে দুষ্পাঠ্য। সত্যিকারের সৎ এবং ভালো লেখা দেখা যেত বাংলা বিভাগে। তবে এই বৌদ্ধিক দেখনদারি ছিল সীমাবদ্ধ। তার বাইরে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ছিল একদম আর পাঁচটা কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মতই।
কলেজের ফাংশনে সব থেকে জনপ্রিয় ছিল হিন্দি সিনেমার গান, কারণ তখনও সুমন পূর্ণ মহিমায় এসে পৌঁছাননি এবং বাংলা ব্যান্ড ভবিষ্যতের গর্ভে। নকশাল ছাত্র সংগঠনের অনুষ্ঠানে অন্যধরনের বাংলা গান শোনা গেলেও তার চলন ছিল এক সীমিত গোষ্ঠীর মধ্যে। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করা হত এবং হলের বেশির ভাগ অংশই ফাঁকা থাকত। সব থেকে বেশি হাততালি পাওয়া যেত হুল্লোড়ের গান গেয়ে। কোনও এক অনুষ্ঠানে এখনকার প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, তখন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র ছাত্রী রাজশ্রী ভট্টাচার্য্যের গানের সময় বীভৎস হুল্লোড়বাজি হয়। নকশাল ছাত্র সংগঠন তার প্রতিবাদে সাইক্লোস্টাইল করা এক প্রতিবাদপত্র প্রকাশ করেছিল কিন্তু ওই পর্যন্তই। ফেস্টের সময় সব থেকে ভিড় হত রকফেস্টের দিন, অন্যান্য যে কোনও কলেজের মতই। তবে একটু আলাদা হওয়ার বদভ্যাস মাঝে মাঝেই চিমটি কাটত। যে জন্য আমি সম্পূর্ণ বাবুবেশে ধুতি-পাঞ্জাবিপরিহিত হয়ে রকফেস্টে হাজির হয়েছিলাম। পরিপূর্ণ হুল্লোড়বাজির আগেই চলে আসতে হয়, কারণ ধুতি খুব একটা নির্ভরশীল পরিধেয় ছিল না। বেশ উঁচু মানের নাটক-বিতর্ক-আলোচনা হত। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ সাংস্কৃতিক জগতে অন্যান্য কলেজের থেকে আলাদা ছাপ মারা, এ কথা কখনও মনে হয়নি।
আবার বছর কুড়ি পরে
এর পরে জগৎ ও জীবনের নিয়মানুসারে আমরা প্রত্যেকেই নিজের ঘর-দুয়ার-সার্টিফিকেট গুছানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠলাম। সাম্রাজ্য ধুলিসাৎ, অশীতিপর উদাসীন মুখ্যমন্ত্রী নিয়মিত শ্রাগ করছেন, চারদিকে দেখছি গেরুয়া ফেট্টিমাথায় কপিবাহিনীরা উঠে আসছে, জাত এবং ধর্ম নিয়ে তীব্র প্রাণঘাতী লড়াই, আর অর্থনীতির বাঁধ খুলে গিয়ে আখের গুছিয়ে নেবার দিন আগত ওই। অতএব প্রত্যেকে নিজের ভেলায় নিজের স্রোতে উজান ডিঙিয়ে চলি। আমাদের আগের প্রজন্মও মনে হয় না এর থেকে খুব বেশি কিছু করেছিলেন। ঠিক সেই সময় বিভিন্ন বিভাগ থেকে নক্ষত্র শিক্ষকেরা অন্যকূলে পাড়ি দিচ্ছেন। এর পরে কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সম্মিলিত নস্টালজিয়া ভাগ করে নেওয়ার সূত্রে। শিক্ষণ ও পঠনপাঠনের মান নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের মান নিয়ে কোনোদিনই সন্দেহ রাখিনি। আমাদের মধ্যে পড়াশুনায় ভালো করা নিয়ে কোনও রেষারেষি ছিল না। কিন্তু এক আজব রসায়নের খাতিরে পরীক্ষায় ভালো করার তাগিদটা আপনা থেকেই চারিয়ে যেত। দেড় দশকে হয় তো ছবিটা পালটে গেছে। আমাদের স্বভাবজ প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মান রাখতে গিয়ে স্বাধীনতার পরে প্রতিষ্ঠান ভেঙেছি অনেক। গড়েছি অতীব সামান্য। আশা করি আর একটা প্রেসিডেন্সি কলেজ না গড়তে পারলেও, বাংলার সারস্বতসমাজ অন্তত একটা প্রেসিডেন্সি কলেজ টিঁকিয়ে রাখতে পারবেন।
৩০ (Jan 2 2007)
আসছে বছর আবার হবে
"Routine being the source of all happiness, its guarantee, and its death!"- Orhan Pamuk
২০০৬ বিগতপ্রায়। ২০০৬ সালের শেষের কয়দিন মানে ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। এবং পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, ২০০৭ সালে পুনরায় হবে।
যত দিন যাচ্ছে তত ধুলো বাড়ছে। আমাদের অফিসের চারদিকে ধুলোর মধ্যে লোকে খায়, মোতে এবং প্রোগ্রাম লেখে। ধুলোয় মোড়া পার্ক স্ট্রিটে ধুলো ধুলো মানুষের ভিড়ে রেস্তোরাঁ আর নাইটক্লাবগুলো খন্ডহর। ধুলোদের গায়ে গায়ে ধাক্কা, পায়ে পায়ে লেগে যাওয়া, হাতে হাতে মিঠে খুনসুটি। নিয়নের আলো থেকে ধুলো ঝরে পড়ছে। আমরা তাকে গোধূলি বলি।
এ এক মজার ভাগ হয়েছে। প্রতি তিনশ পয়ঁষট্টি দিনে এক এক বছর। একটা সোজা লাইন টেনে রাখো। তিনশ পয়ঁষট্টিটা ঢ্যাঁড়া কাটার পরেই নিশ্চিত জেনে রাখো যে নতুন বছর এসে গেল। অতএব ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। এবং পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, yyyy পুনরায় হবে।
একসময় যদিও সময়ের এইরকম চলন ছিল না। তখন সময় ছিল অখন্ড, চক্রবৎ। মানুষের জন্ম-শিক্ষা-বিবাহ-প্রজনন-মৃত্যুর চক্র ছিল এক জীবনকাল। এর মধ্যেই রাজ্যপাট, যুদ্ধবিগ্রহ, এক রাজা আসে, এক রাজা যায়, লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে। দিন বদলায় না। সময়ের বৃত্তাকার গতিতে দিনবদলের সম্ভাবনা কোথায়? বর্ষাকালে বীজবপন, হেমন্তে সুপক্ব ফসল, শীতের নবান্ন শেষে আবার বর্ষার প্রতীক্ষা। খেলা তখন ছিল তোমার সনে। আমাদের ঠাকুর্দা ঠাকুরমাদের জন্মদিনের খোঁজ কে রাখত? পশ্চিমী ধাঁচের পরিবারে হয় তো বা জন্মদিন। নইলে কোনো এক কাল্পনিক এবং সুবিধাজনক জন্মতারিখ নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হওয়া। জন্মেছি যে দেখাই যায়, জন্মের দিনে কিসের দায়?
অথচ কারখানা কি আর এই গোল গোল নিরুপদ্রবে চলে? কারখানার ভিত্তি হল একটি লাইন। অ্যাসেম্বলি লাইন। সময়ের একটা সাদাসিধে নাগাল পাওয়া দরকার। এই লাইনের পরে আমার কাজ শেষ, তোমার কাজ শুরু। সোজা সোজা বার গ্রাফ, ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮, ডট ডট ডট। জন্মেছি যখন তখন শূন্য। তারপর স্কুলে যাওয়ার মধ্যে একটা চার পাঁচ ইঞ্চির লাইন। তারপর স্কুল পাশ। সেই লাইনেরও একটা নিখুঁত দৈর্ঘ্য আছে। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি একটানা একটি লাইন। মাঝে মাঝে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর লাল লাল ঢ্যাঁড়া। সেই লাইনের কোনো অংশের নাম ২০০৫, কোনোটা ২০০৬, কোনোটা....। সবার দৈর্ঘ্য সমান। চলো নিয়মমতে।
কিন্তু দূরে তাকিয়ো নাকো বললেই কি না তাকিয়ে পারা যায়? বড়ো বড়ো কলকারখানা হবে, কোটি কোটি মানুষ কাজ করবে, বড়ো বড়ো রাস্তা, বাজারহাট দোকানপাট। কাজেই যদিও দৈর্ঘ্যে সমান, তাও ভেবে যাওয়া ২০০৭ হয় তো ২০০৬-এর থেকে একটু বেশি ভালো, ২০০৮ হয় তো আরো একটু। কলকারখানা বাড়ে, লোকের হাতে দুটো পয়সা আসে, বাজার বাড়ে, সেই বাজারের চাহিদা মেটাতে আরো কলকারখানা, আরো কাজ, আরো লোক, আরো চাহিদা। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এই বছরে নয় তো পরের বছরে।
তাহলে প্রতি বছরের শেষে কেন ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দারেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ? এবং কেন পার্ক স্ট্রিট জমকালো কাগজে হেডিং ডিং বেজে ওঠে ঘন্টার রবে, yyyy পুনরায় হবে?
সময় কুঁকড়ে যাচ্ছে। শ্রদ্ধেয় নীরেন চক্রবর্তী মহাশয়ের একটা কথা মনে ধরেছিল। কোনো এক বিরল দিনে যখন তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, উনি বলেছিলেন মানুষের জীবনযাত্রার প্রতি পরিবর্তনের মধ্যের সময়কাল ক্রমে ছোটো হয়ে আসছে। মানুষের আগুন জ্বালানো থেকে চাষবাষ শিখতে যা সময় লেগেছিল, তার তুলনায় চাঁদে যাওয়া আর ইন্টারনেটের মধ্যবর্তী সময়কাল প্রায় শূন্য। এটাই প্রগতি, এটাই সময়ের কুঁকড়ে যাওয়া। শেষে লাইনটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে একটা বিন্দু হয়ে যায়। আমরা এক একটা বিন্দুতে বেঁচে আছি।
এই বিন্দুকে আমরা বলি বর্তমান। ভগবানকে ভয় পেয়ে বা না পেয়ে, বর্তমানেই বেঁচে থাকি। যাঁরা নব্যধর্মপালন করেন, যাকে বইয়ের দোকানে নিউ এজ রিলিজিয়ন বলা হয়, তাঁরা হয় তো জানেন অত্যাধুনিক এই ধর্মমতে বলা হয় বর্তমানে বেঁচে থাকাটাই শ্রেয় কারণ ভবিষ্যতের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, আর অতীত তো যা গেছে তা যাক যাক। বৌদ্ধধর্মের আলগা ছোঁয়া এই ভাবধারা কর্পোরেট জগতেও অধুনা প্রবল জনপ্রিয়। কাজেও লাগে। কারণ কোটি কোটি কর্মী দরকার যারা বর্তমানে বাঁচে, এবং খাটে। ভবিষ্যতের দিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই, অতীতের দিকে তাকাবার প্রয়োজন নেই।
সবাই বর্তমানে বাঁচি। বুশ সাহেবও বাঁচেন। ভিয়েতনাম ভুলে যান, ২০০১ সালে দাঁড়িয়ে ২০০৬ দেখতে পান না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বর্তমানেই বাঁচেন এবং বেঁচে আছেন সে কথা বলা তো বাহুল্যমাত্র। আমার পাশের বাড়ির কল সেন্টারে কাজ করা ছেলেটা ১৯৫১ জানে না, ১৯৭১ জানে না, ১৯৯২ জানে না। আর ২০০৭? একেবারেই না। আমি? ২০০৬ বলতেই ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, বিলিতি খরিদ্দরেরা ছুটিতে, প্রবাসী বন্ধুরা কয়দিনের জন্য এসেছেন, চেনাজানাদের নিমন্ত্রণ, বাধ্যতামূলক উৎসবপালন, ডেডলাইন, ডেডলাইন, অসহ্য চাপ। স্রেফ ডিসেম্বরের শেষের কয়টা দিন। এই হল আপাতত: ২০০৬।
ছোটোবেলায় পড়া জ্যামিতি ভুলে গেছি। বিন্দুর কোনো দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, উচ্চতা নেই। স্রেফ একটা মাত্রাহীন ধারণা। যাদের মাত্রা নেই, তাদের কি করে আলাদা করি? অতএব যদিও বেশ বুঝতে পারছি মানুষজনের চোখ কাঁচের গুলি হয়ে যাচ্ছে, শব্দগুলো সংখ্যার মত হয়ে যাচ্ছে, গানগুলো সাইরেনের মত আর হৃদ্পিন্ড নোকিয়ার লেটেস্ট মডেলের মত, তাও ২০০৬ শেষ হচ্ছে ভাবলেই ইনভেস্টমেন্ট প্রুফ জমা দেবার তাড়া, .......।
২০০৭ আসুক। বেশির ভাগ লোকই আশা নিয়ে ঘর করেন এবং আশায় পকেট ভরেন। সেই নাছোড় আশাবাদীরা নিউ ইয়ার্স ইভের পরের দিন মাথায় ঘোরতর হ্যাং ওভার নিয়ে উজ্জ্বলতর ২০০৭-এর খোয়াইশ দেখুন। ২০০৬-এর এই শেষ কয়দিন আমার স্রেফ এইটুকু আশা যে ২০০৭ ঠিক যেন ২০০৭-ই হয়।
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩১ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী জানুয়ারি ১৬ ২০০৭
৩২ (Feb 1 2007)
সুন্দরবনের ডায়েরি
২৬শে জানুয়ারি ২০০৭ কাটল বালি দ্বীপের ৯নং ব্লকে। গ্রামের প্রান্তে গুমড়ি নদীর বিস্তার প্রায় আকাশ ছোঁয় ছোঁয়। প্রায় না দেখতে পাওয়া অন্যপারে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। আগে বাঘ নদী পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ত। এখন গ্রামের কাছাকাছি থাকা জঙ্গলের সীমানা বেড়ায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বাঘের আচম্বিতে হামলাও অনেক কমেছে। নদীর ধারে বাঁধের উপরের রাস্তা জেটি থেকে ট্যুরিস্ট ক্যাম্প পর্যন্ত সুঠাম, ইঁটে ছাওয়া। তারপরেই এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা। তার উপর দিয়েই সাইকেল চলেছে কিড়িং কিড়িং। প্রজাতন্ত্র দিবসের সকালে ছোট ছোট মেয়েরা কেউ কেউ রাস্তার পাশের জমে থাকা জলে ছোট জালে মাছ ধরছে, কেউ আবার নদীর কাদাপাড়ে জাল ফেলেছে। এক বাড়ির উঠোনে ঘড়ঘড়িয়ে ধান কোটার মেশিন চলছে। ঢেঁকি বলে কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গ্রামের অনেকটা ভিতরে মুদির দোকানের দাওয়ায় গুটিপাঁচেক কন্যাশিশু স্লেট হাতে দুলে দুলে "চারে শূন্য চল্লিশ, পাঁচে দুই বাহান্ন'। গুরুমশায় দাঁতন করতে করতে একবার মুদির দোকানে, আর একবার পাঠশালে। অতীতে এই গুরুমশাই ছিলেন চোরাশিকারী। বনের হরিণ শিকার করতেন। মিন্টুও চোরাশিকারী ছিল। ওর তিন বছরের ছেলে অন্য আর এক পাঠশালে যাওয়া শুরু করেছে। সেই পাঠশালের মাস্টারমশাই সকালে কচিকাঁচাদের নিয়ে আমাদের উঠোনে এসে হাজির। সকাল কাটে তিন-চার বছুরেদের "জয় হিন্দ', "বন্দে মাতরম' শুনে। তাদের এই ধ্বনি শেখালেন দুই নেপালি প্রৌঢ়া, যারা সুদূর দার্জিলিঙের গ্রাম থেকে সুন্দরবনের জলহাওয়া মাখতে এসেছেন। তাঁরাই বাচ্চাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা করে বিস্কিটের প্যাকেট। বাকি গ্রাম সাতসকালেই ভারী কর্মব্যস্ত। হই হই করে হাত পা চলছে। একটু বেলা হতেই জেটির পাশের খোলা জমিতে বাচ্চা ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নেমে পড়বে। কারুর হিরো শচীন, কারও সৌরভ। গ্রামের জোয়ানদের মধ্যেও শচীন-সৌরভ-রাহুল নিয়ে জোর আড্ডা শুনতে পাই। দু একটা বাড়ির খড়ের ছাউনির উপরে মাথা উঁচিয়ে আছে ডিশ টিভির অ্যান্টেনা। তবে যেহেতু বিদ্যুৎ মানে সৌরবিদ্যুৎ, আর সৌরবিদ্যুৎ রঙিন টি ভির খাঁই মেটাতে পারে না, আপাতত সাদা কালো টিভি ভরসা। বেশির ভাগ মানুষের আয় বাগদার মীনচাষে। মাটি বেজায় নোনা। আগে একফসলি ছিল। এখন কিছু মিষ্টি জলের পুকুর তৈরি হওয়াতে শীতে ধান উঠে যাওয়ার পরেও শাকসব্জি, ডালের চাষ হয়। খেঁসারির ডালের চাষ বেশি কারণ অল্প আয়াসে অধিক ফলন। পঞ্চায়েতে আগে সি পি এম ছিল, এখন আর এস পি। বাঁশের বেড়ার গায়ে ইতস্তত আর এস পির পোস্টার লটকানো।
এখানে বেড়াতে আসতেই পারেন। শহুরে চোখ-মন-কান শান্তি পাবে। মনে হবে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ইত্যাকার মধ্যবিত্ত ফ্যান্টাসির একটা বাস্তব আদল খুঁজে পেলেন বুঝি। সমস্যাগুলো খুব একটা ফ্যাশনেবল নয়। কাজেই শহুরে বাবুরা বিশেষ প্রতিবাদ বা বাওয়াল- কোনওটাই করেন না। সব থেকে কাছের হাইস্কুল হেঁটে যেতে এক ঘন্টা। তাও মাটি শুকনো থাকলে। হাসপাতাল রাঙাবেলিয়াতে। সেও প্রায় ঘন্টা খানেক মাটির রাস্তা ভেঙে যাওয়া। লঞ্চ চলে দিনে এক দুইবার। ক্যানিং-গোসাবা-বাসন্তী-সোনাখালির মত গঞ্জ শহরের দক্ষিণে আর কোনও কলেজ নেই। রাঙাবেলিয়াতেও নদীর পাড় ভাঙছে, জল ঢুকছে নিশ্চিত ভঙ্গীতে। এই সব দ্বীপে কৃষিজমি অধিগ্রহণ বা শিল্পায়ন নিয়ে শহরের বুদ্ধিজীবীদের ব্যস্ত মাথা ঘামাতে হবে না। বিদ্যুৎ বলতে টিম্টিম করে জ্বলা সৌরপ্রদীপ। মূল যোগাযোগ সমুদ্রপ্রমাণ নদীনালা পেরিয়ে। চাষের জমি নোনা। তার উপর নদীদের খামখেয়ালিপনায় আজকের চাষের জমি কালকের নদী, অথবা উলটোটাও। একসময় হরিণশিকার ছিল সব থেকে লাভজনক উপজীবিকা। গড়পড়তায় জনপ্রতি চার কেজি মাংস পাওয়া যেত একটা হরিণ মারতে পারলে। মানে চারশ টাকা। এই সব অঞ্চল থেকে নারী পাচার হয় খুব। অনেকে ওঠে বেশ্যাপাড়ার কোঠায়, আর অনেকে প্রবাসী উচ্চবিত্তের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে। কে বেশি ভালো থাকে বলা ভারী শক্ত। সোনাখালির দক্ষিণে মসজিদ নেই। গ্রামে গ্রামে বনবিবির থান। বনবিবির চেহারা লক্ষ্মী-সরস্বতী-জগদ্ধাত্রীর মতো। পাশেই বসেন বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গুলী। পায়ে গামবুট, মুখভর্তি গোঁফহীন চাপদাড়ি, মাথার পিছনে সবুজ পটে একটি তারা, এক ফালি চাঁদ। বনবিবির পালা শেষ হলে আল্লানাম নিতে হয়, হরিধ্বনিও দিতে হয়। কলকাতার পায়ের তলায় এ বড় আজব পড়শীনগর বটে।
এত সব আবোল তাবোল বকতে বকতে আসল ব্যাপারটাই বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সুন্দরবনে বাঘ থাকে। সেই বাঘ দেখতে ঝেঁটিয়ে মানুষ যান। সাধারণত তাঁরা লঞ্চের পিছনে ম্যারাপ বেঁধে প্রচুর রান্না করেন, ডেকের উপর বোতল খুলে বসে পড়েন, বাজনা চালিয়ে নাচেন, পাশের আর একটা ম্যারাপ বাঁধা লঞ্চ দেখলে সবাই মিলে হাত নাড়েন, সজনেখালি-সুধন্যখালির ওয়াচ টাওয়ারে উঠে প্রবল চেঁচামেচি ও ঠেলাঠেলি করেন, বাঁদর এবং হরিণ দেখে বেজায় এক্সাইটেড হন এবং শেষে "ধুর শালা, এর থেকে চিড়িয়াখানা ভালো' বলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান। এনাদের খিদমত খেটেও দু পয়সা ঘরে আসে। প্রাইভেট গাইডের কাজ করেন অনেকে। দিনের শেষে পকেটে আসে শ দেড়েক। আমাদের ম্যারাপ-না-বাঁধা লঞ্চে গাইড ছিলেন মন্ডলবাবু। লঞ্চ যাচ্ছিল কুমীরমারির পাশ দিয়ে। কুমীরমারি রাজনৈতিক খুনোখুনির জন্য কুখ্যাত। এই অঞ্চলে প্রধান দল মানে বামফ্রন্টের দুই শরিক সি পি এম এবং আর এস পি। তাদের মধ্যেই প্রবল ক্যালাকেলি। জেটির পাশে সাপ্তাহিক হাটের জমিতেই খুনোখুনি হয়। এখনও গ্রামে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। গ্রামের এক বাসিন্দা আড়ালে জানান ঘরে ঘরে বেআইনী দোনলা রয়েছে। মন্ডলবাবুই কুমীরমারি চেনালেন। ঠিক তার উল্টোদিকে আর এক জঙ্গুলে দ্বীপ সন্ধ্যানদীর ছায়ায় ভূতুড়ে হয়ে উঠছিল। মনে হয় না সেই দ্বীপে কোনও জনবসতি আছে। মন্ডলবাবু বলেন দ্বীপের নাম মরিচঝাঁপি। তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ির কুমীরছানা মাঝেই মাঝেই দেখানও হয়। এখন তো আরও বেশি বেশি করে। অথচ মরিচঝাঁপির কণ্ঠস্বর বাঙালি স্মৃতি থেকে বিলুপ্তপ্রায়। অমিতাভ ঘোষ মশাই তাঁর ইংরিজি উপন্যাসে মরিচঝাঁপির গল্প বলেছেন বটে। কানাইয়ের মেসোমশাই মরিচঝাঁপির ডায়েরি লিখে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত মরিচঝাঁপি মনে রাখেনি। সামাজিক স্মৃতির খেলা বড়ই আজব বটে! ভাবছি নিজের বেড়ানোর আগড়ম বাগড়ম না বকে মরিচঝাঁপির গল্পটা ছোট করে বলে নেওয়া যাক। অনেকের হয় তো মনে আছে। অনেকে জানেন, কিন্তু মনে নেই। আবার অনেকে হয় তো জানেনই না। এই গল্পটা লিখতে আমি প্রায় সব মালমশলা ধার করব Annu Jalais-এর লেখা "Dwelling on Marichjhanpi: When Tigers Became 'Citizens', Refugees 'Tiger-Food'" প্রবন্ধের, যা ইকোনমিক এন্ড পোলিটিকাল উইকলির এপ্রিল, ২০০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ষাট সত্তরের দশকে যখন বাংলাদেশ উত্তাল, নিম্নবর্ণের মানুষ রিফিউজি হয়ে সীমান্তের এইপারে চলে আসতে লাগলেন। দেশভাগের পরেও এই সব নিম্নবর্ণের মানুষেরা দেশের মাটি ছাড়েন নি। মিহির সেনগুপ্ত মশাইয়ের "বিষাদবৃক্ষে" তার বিবরণ পাবেন। বাবুদের শহরের নাজুক গায়ে যাতে এই হাড়হাভাতেদের আঁচড় না পড়ে, তাই তাদের পাঠানো হল মধ্যভারতের দণ্ডকারণ্যে। এই সব উদ্বাস্তুদের অধিকাংশ এসেছিলেন খুলনা থেকে। তাঁদের আগেই-চলে-আসা আত্মীয়স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন সুন্দরবনের দ্বীপে দ্বীপে। দণ্ডকারণ্যে যাবার কোনও ইচ্ছা ছিল না। তখন বামপন্থীরা বিরোধীপক্ষ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জ্যোতিবাবু বহুবার বিধানসভায় দণ্ডকারণ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশ্য জনসভায় জ্যোতিবাবু দাবী করেন দণ্ডকারণ্যে পাঠিয়ে দেওয়া উদ্বাস্তুদের সুন্দরবনে পুনর্বাসিত করতে হবে। ১৯৭৫ সালে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের এক বৃহদংশ সুন্দরবনের দিকে পাড়ি দিলেন। তখন থেকেই স্টেশন থেকে টেনে হিঁচড়ে তাদের দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠাবার পালা শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলেন। ততদিনে প্রায় দেড় লাখ উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্য থেকে এসে পৌঁছেছেন। তাঁরা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন এই নতুন সরকারের দিকে। আশায় বাঁচে চাষা। সরকার প্রমাদ গুনলেন। জোর করে ফেরত পাঠানো অব্যাহত। অনেকেই সেই বজ্র আঁটুনি পেরিয়ে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেন। মে মাসে প্রায় তিরিশ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির নেতা সতীশ মন্ডলের নেতৃত্বে মরিচঝাঁপিতে বসতি স্থাপন করলেন। ক্রমে ক্রমে টিউবোয়েল বসল, রাস্তা তৈরি হল, মাছের ব্যবসা, ডিস্পেন্সারি, ইস্কুল- সব। আশেপাশের সাতজেলিয়া, কুমীরমারি, ঝড়খালি ইত্যাদি গ্রামের বাসিন্দারদের কেউ কেউ এসে মরিচঝাঁপিতে থাকতে লাগলেন। গরীবগুর্বোদের নিজেদের হাতে গড়া এক নতুন উপনিবেশ। সরকার এই সব দেখে রেগে আগুন তেলে বেগুন। শহরের খোকাখুকুরা বাঘ দেখবে কি করে? তাই সরকার বাহাদুর লিখলেন- এই উদ্বাস্তুরা এসেছে with the intention of settling there permanently thereby disturbing the existing and potential forest wealth and also creating ecological imbalance". টেনে হিঁচড়েও দ্বীপ খালি করা গেল না। ১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি পুলিশ গুলি চালাল। ৩৬জন মারা গেলেন। পত্রপত্রিকা এবং বিরোধীরা চেঁচামেচি করায় জ্যোতিবাবু ঘোষণা করলেন মরিচঝাঁপিতে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। প্রজাতন্ত্র দিবস ১৯৭৯। অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষিত হল। তাতেও কাজ হয় না দেখে মে মাসে মরিচঝাঁপি ব্যারিকেডে ঘিরে দেওয়া হল যাতে সেখানকার লোকজনের কাছে জল এবং খাদ্য না পৌঁছায়। তিরিশটা পুলিশের লঞ্চ দাঁতালো কুমীরের মতো তখন দ্বীপটাকে ঘিরে আছে। বাড়িঘর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, কাঁদানে গ্যাস চলছে, নৌকাগুলো ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাকে গুলি করা হচ্ছে। জানা যায় না কত শত মানুশ মারা গিয়েছিলেন। জানাও যাবে না আর। স্রেফ অনেক মানুষ মরেছিল- এইটুকুই। কোনও দল তাদের নেতৃত্ব দেয়নি। তাহলে জানা যাবেই বা কি করে? কারা জানি বলেছিল "এ লড়াই বাঁচার লড়াই'? নদীর নোনা হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে সব, মিশে গেছে শব।
তবে আর কিছু হোক না হোক, পরিবেশ কিন্তু বাঁচল মশাই। এখন সুন্দরবনে প্রায় আড়াই শ বাঘ আছে। তাও তেনাদের দেখতে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। না দেখতে পেলেই বা হয়েছে কি, অনেক অনেক "প্রকৃতি', অনেক অনেক "পরিবেশ' রয়েছে। বেশ ভালো লাগবে। জল আর আকাশের প্রায় মিশে যাওয়া মোনোক্রোম ক্যানভাসে একটা দুটো গাঢ় সমান্তরালতা। সেই সব ভালো লাগা গল্পেই ফেরা যাক। এবার জাস্ট "দাও ফিরে সে অরণ্য, লও হে নগর'। প্রমিস।
(ক্রমশ)
৩৩ (Feb 16 2007)
সুন্দরবনের ডায়েরি
(গত সংখ্যার পর)
এই নিয়ে আট কি নয়বার সুন্দরবনে। কয়েকবার পশ্চিমের দিকে মানে নামখানা কাকদ্বীপ বকখালি সাগর। কয়েকবার পূর্বে বনবিবির দক্ষিণরায়ের রাজত্বে। এই দুইদিকের মাঝামাঝি মাতলার জল। মাতলার পশ্চিমে জলজঙ্গল কম, মূলত লোকালয়। এইদিকে বাঘের আনাগোনা নেই। তবে যার উপদ্রব আছে তিনি বাঘের থেকে কম কোনোমাত্রায় কম না। এইদিকে বনবিবি দক্ষিণরায় নেই, কিন্তু ঘরে ঘরে মনসার পূজা। পূর্বদিক মানেই জল, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল আর চারদিকে বাঁধ দেওয়া দ্বীপের মাঝে গ্রাম যেন কানাতোলা বাটির মধ্যে বসে। নব্বইয়ের দশকে সুন্দরবন ভ্রমণার্থীর আশাভরসা বলতে ছিল সরকারি পর্যটন কিংবা ক্যানিং থেকে প্রাইভেট লঞ্চ ভাড়া করে পিকনিক। সজনেখালি আর নেতিধোপানি ছাড়া ওয়াচটাওয়ার ছিল না। সুধন্যখালির ওয়াচ টাওয়ার একানব্বই বিরানব্বইতে ছিল কিনা মনে করতে পারছি না। এখন সুন্দরবনে পর্যটনের চেহারা অনেকটাই পালটেছে। দোবাঁকি, বুড়ির ডাবরির মতো নতুন নতুন সুপরিকল্পিত ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হয়েছে। বুড়ির ডাবরির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কারণ এটি মনে হয় একমাত্র ট্যুরিস্ট ওয়াচ টাওয়ার যা উত্তর চব্বিশ পরগণায় বসিরহাট ফরেস্ট রেঞ্জের ভিতরে। উত্তর চব্বিশ পরগণার মধ্যেও যে সুন্দরবনের একটা বিস্তৃত অংশ রয়েছে তা অনেকেই জানেন না। বুড়ির ডাবরির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল নদী রায়মঙ্গল। রায়মঙ্গলের অন্যপারে আবছা দেখা যায় খুলনা জেলার গাছপালামাটি। একবার রওনা হয়েছিলাম হাসনাবাদ থেকে। হাসনাবাদ থেকে শুরু করে সারা সুন্দরবন চষে যাত্রা শেষ হয়েছিল ক্যানিঙে। ক্যানিঙের আশেপাশে ট্যুরিস্ট লঞ্চের যত আনাগোনা, উত্তর চব্বিশ পরগণার দিকে তা অত দেখা যায় না। তার আরও একটা কারণ সুন্দরবনের সীমান্ত এলাকায় জলদস্যুর প্রকোপ। বিশেষত রায়মঙ্গল এবং আশপাশের নদীগুলো দস্যুবৃত্তির পক্ষে সহায়ক, কারণ জলের মধ্যে অদৃশ্য ভারত-বাংলাদেশের সীমানা। একসময় খবরের কাগজে জেলেদের অপহরণ এবং মুক্তিপণ দাবী নিয়মিত খবর ছিল। এখন শুনলাম এই উৎপাত আগের থেকে অনেকটাই কমেছে।
জলদস্যুর উৎপাত যেমন কমেছে, পাখিও অনেক কমে গেছে। নব্বইয়ের দশকে গাছে গাছে পাখির ঝাঁক দেখেছি। এখন পাখি দেখতে পাওয়া গেলেই লাফ দিয়ে উঠে চোখে দূরবীন লাগাতে হয়। কাদাখোঁচা, পানকৌড়ি, কোঁচবকই পাখিদের আসর সরগরম করে রাখে। জলে ডুবে থাকা ডালের উপর সাধারণ মাছরাঙাও খুব একটা দুর্লভ নয়। গ্রামের আশেপাশে ফিঙের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়। সুধন্যখালির উলটোদিকের জঙ্গলে দেখলাম প্রায় দুর্লভদর্শন কমলামাথা মাছরাঙা। ম্যানগ্রোভের ডালে ঠিক এক বড়োসড়ো কমলালেবুর মতো। আর হঠাৎ দুপুরে ঘন নীল আকাশ জুড়ে একঝাঁক হলুদপেট টিয়ার ঝাঁক উড়ে গিয়েছিল এ বন থেকে সে বনে। শুনলাম গত দশকের কয়েকটি বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের ফলে পাখিদের এই হাল। সেই তুলনায় কুমীরেরা মনে হল বহাল তবিয়তেই আছে। বিশেষত শীতের দুপুরে যখন ভাঁটা লাগে, নদীর জল কাদার চর থেকে নেমে আসে, তখন কাদার চরে নটনড়নচড়ন কুমীরমশায়দের ল্যাদ করতে দেখা খুব একটা দুর্লভ নয়। একদম মিনি থেকে দশাসই কুড়িফুটিয়া কুমীরও দেখা যায়। যথেষ্ট হরিণ চরে বেড়ায়। তবে ভারতের যে কোনো জঙ্গলেই বেশির ভাগ পর্যটককে যেহেতু শুধু হরিণ দেখে বাড়ি ফিরতে হয়, জঙ্গলভ্রমণের ব্র্যান্ড ইকুইটির দিক থেকে হরিণেরা নিতান্তই সাব-অল্টার্ন। হরেদরে সবাই হরিণ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ধুস্ বলে বাড়ি ফেরেন। তবে জরা হাটকে দেখলে বোঝা যাবে ম্যানগ্রোভের জটিল জালের আড়ালে লুকিয়ে সতেজ ত্বক, বিশাল শরীর আর বিস্তৃত শিং নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই সব হরিণের সঙ্গে ঘাসজমিতে চরতে আসা শকুন্তলার পোষ্য কাটিং মৃদু এবং খুদে হরিণের দলের একটু তফাত আছে। তবে বাঁদরের সংখ্যা বেড়েছে মনে হল। আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণায় ট্যুরিস্ট বাড়লেই বাঁদর বাড়ে। ব্যাখ্যা নিÖপ্রয়োজন।
এইবার বাঘ নিয়ে দুই এক কথা। সুন্দরবন চষে ফেলে কোনোদিন বাঘের লেজের ডগাও দেখতে পাইনি। প্রথমবার সুন্দরবন থেকে ফিরে ক্যানিং লোকালে বসে হতাশ ট্যুরিস্টদল যখন নিষ্ফলা ভ্রমণের আলোচনা করছিলাম তখন আমাদের পাশেই বসে থাকা এক ফলওয়ালা প্রায় তিরষ্কারই করেছিলেন। বলেছিলেন সুন্দরবনের বাঘ দেখা সুখকর অভিজ্ঞতা তো নয়ই, প্রাণঘাতীও হতে পারে। পৃথিবীর অন্যান্য বাঘের তুলনায় সুন্দরবনের বাঘ অনেকটাই আলাদা। এরা অনায়াসে দশ কুড়ি কিলোমিটার সাঁতরাতে পারে, নোনা জল খায় আর নিয়মিত খাদ্যের মধ্যে আছে মাছ আর কাঁকড়া। আরও বড়ো কথা প্রায় বিনা প্ররোচনায় মানুষকে আক্রমণ করে যা অন্যান্য কোনো অঞ্চলের বাঘ করে না। তবে বার বার গিয়ে বুঝেছি বাঘ দেখলেই জানের খতরা অনেকটা মিথই বটে। লঞ্চ থেকে পর্যটকেরা বাঘকে নদী এপার ওপার করতে দেখেছেন বা পঁচিশে ডিসেম্বর সুধন্যখালির ট্যুরিস্টমুখরিত ওয়াচ টাওয়ারের পাশে বাঘ এসেছে- এই রকম ঘটনা ঘটেই থাকে। একবার সুন্দরবনের গভীরে যেতে যেতে চামটা অবধি চলে গিয়েছিলাম। চামটার বাঘেরা আবার সুন্দরবনের বাঘের মধ্যে ইস্পেশাল ব্র্যান্ড। তাও তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই। ইচ্ছে ছিল আরও দক্ষিণে গিয়ে সুন্দরবনের প্রায় শেষ ঘাঁটি হলদিবাড়ি অবধি যাওয়ার, যা প্রায় মোহনার কাছাকাছি। কিন্তু সেইখানে তখন বাঘের থেকেও ডাকাতের ভয় আরও বেশি। কাজেই আর গিয়ে ওঠা হয়নি। এখন নেতিধোপানির দক্ষিণে সুন্দরবনের কোর এরিয়াতে ঢোকা নিষিদ্ধ। চামটা, হলদিবাড়ির জঙ্গল আওতার বাইরে। তবে স্থানীয় লোকেরা বলেন, কোথায় কখন বাঘ দেখা যাবে তা স্রেফ কপালের খেলা। কেউ সজনেখালির পর্যটকাক্রান্ত মহলেও বাঘ দেখতে পারেন, আবার কেউ চামটার বুক ধুক্পুক গভীর জঙ্গলে রাত কাটিয়েও শূন্যচোখে ফিরে আসতে পারেন। ঠাট্টা করে অনেকেই বলেন সুন্দরবনের বাঘ আসলে একটা ধারণামাত্র। সরকারি হিসেবে আড়াইশোর বেশি বাঘ রয়েছে। যদিও টাইগার সেন্সাসের এই পরিসংখ্যান নিয়ে অনেকের মধ্যেই তীব্র সন্দেহ রয়েছে। তো এই জীবন্ত মিথকে দেখতে পেলে কেমন আনন্দ হয় পরখ করিনি, তবে বসে আছি পথ চেয়ে-র আকুলতাও কম রোমাঞ্চের নয়। হেঁতালের পাতা নড়লেই যখন শরীর টানটান, সাজাগ হয়ে ওঠে কান। যদিও তারপরেই ধুস্। এবং একটা ভয় যেটা লঞ্চে দুপুরবেলা মাছভাত খেতে খেতে অনুভব করা অনেকসময় দু:সাধ্য। যে সব বাউলেরা মধু আর কাঠের খোঁজে জঙ্গলপাড়ি দেয়, ভয়ই তাদের বাঁচার রসদ। এ এক তীক্ষ্ম যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে ভয়ের জোরে মানুষ বাঘের সঙ্গে খালি হাতে লড়াই করে।
সেইবার নেতিধোপানির জঙ্গলে। একটু আগেই পিকনিক পার্টির অশ্লীল চেঁচামেচিতে জঙ্গলের পাখিরাও উড়ে চলে গেছে। আমরা অপেক্ষা করে আছি। নেতিধোপানিতে ওয়াচটাওয়ারের রাস্তার চারদিক জালে ঘেরা। ওয়াচটাওয়ারের সামনে মিষ্টি জলের ডোবা। ওয়াচটাওয়ার আর ডোবার মাঝেও স্টিলের তারের উঁচু বেড়া। সবাই ফিরে যেতেই দুপুরের জঙ্গল যখন নিঝুম, আমাদের দুজনের সেই বেড়ার গেট খুলে ডোবার পাশে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ডোবার পাশেই বাঘের তাজা পায়ের ছাপ। আমাদের সঙ্গে লাঠিধারী বনরক্ষী। হঠাৎ মনে হল, জালের এইপাশে এসে এখন আমরা দর্শক থেকে দ্রষ্টব্য। আমরা তাকে দেখছি না, কিন্তু সে হয় তো আমাদের দেখছে, চারদিকের ঘন জঙ্গলের কোনো দুর্গম আড়াল থেকে। ঘাড়ের রোয়াঁগুলো দুপুরবেলাতেও খাড়া হয়ে উঠল। এই সেই ভয়। আর একবার আমাদের লঞ্চ ঝড়খালির জেটিতে নোঙর ফেলেছে। যে সময়ের কথা বলছি তখন ঝড়খালিতে সরকারি ফিশারি রম্রমিয়ে চলছে। এখন সরকারি অবহেলায় সেই ফিশারি অবলুপ্ত। সন্ধেবেলা চাঁদের স্তিমিত আলোয় জলজঙ্গল গম্ভীর, থমকে রয়েছে। লঞ্চের ডেকে কালীপদ জমিয়ে গল্প ধরেছে। দু হপ্তা আগে নদীর উলটোপারে বাঘ ধরে নিয়ে গেছে গ্রামের এক মহিলাকে। কালীপদ প্রায় জি পি এস মনিটরের মতো নির্ভুলভাবে স্থানটি দেখায়। চার পাঁচদিন আগে ঝড়খালির কাঠের বাংলোর নীচে দুটি বাঘের ছানা খেলা করছিল। বাঘের গল্পে যখন সবাই মশগুল, তখন রাতের খাবারের ডাক পড়ে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে দেখা যায় ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো এ তরী। ঠিক হয় মহিলা এবং শিশুরা লঞ্চেই রাত্রিযাপন করবেন আর আমরা দুই জোয়ান ছেলে দ্বীপের মধ্যে পাকা বাংলোতে রাত কাটাব। পাকা বাংলো কাঠের বাংলো থেকেও আরও অনেকটা পথ গিয়ে। জেটি থেকে বাংলো অবধি উঁচু রাস্তা সটান চলে গিয়েছে। আমাদের গাইডের হাতে গদা সাইজের একখানা টর্চ। নিশ্চয় রাস্তার মধ্যে সাপখোপ থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা যে শুধু সাপখোপ নয় বুঝতে পারলাম যখন তিনি সেই টর্চটা খুব দ্রুতগতিতে প্রায় একশ আশি ডিগ্রি ঘোরাতে ঘোরাতে চললেন। আগেই বলেছি চাঁদ একেবারেই স্তিমিত। তখনও ঝড়খালিতে সৌরবিদ্যুৎ আসেনি। সেই তুমুল অন্ধকারের মধ্যে শুধু একফলা তীব্র আলোর দ্রুত থেকে দ্রুততর আন্দোলন। কোনো দূর থেকে আবছা হৈহল্লা ভেসে আসছে মনে হয়। কানের ভুল কিনা জানি না। রক্ত থমকে গেছে। এই সেই ভয় যা প্রাণের গভীর থেকে স্বতোৎসারিত, যার কোনো সমাজ-সংস্কৃতি-জাতিভেদ নেই। শুধু শরীরকে টান টান ছিলা করে তোলে। এই সেই ভয়।
(ক্রমশ)
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৪ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী মার্চ ১ ২০০৭
৩৫ (Mar 17 2007)
শেষ বসন্তের ডায়েরি
(যে লেখাটা জমা পড়ার কথা ছিল সেটা জমা পড়ল না। ২০০৭ সালের ১৫ই মার্চ মনে হয় একটু অন্যরকম দিন যেদিন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা শুধু একটা ব্যাপার নিয়েই ভাবতে পারেন, বলতে পারেন বা লিখতে পারেন। রাগে-বিক্ষোভে-ঘৃণায়-যন্ত্রণায় অনেকেই কাঁদছেন, বাজপড়া গাছের মতো শুকিয়ে যাওয়া চোখে। আবার "গুলি করেচে বেস করেচে' প্রতিক্রিয়াও দুর্লভ নয়। জানি না বাংলালাইভের বিদেশবাসী পাঠক-পাঠিকারা এই কান্নাঝরা অন্ধকার বসন্তের অভিজ্ঞান কীভাবে পাবেন, কিংবা আদৌ পাবেন কিনা। নিশ্চয়ই তর্কের ঝড় উঠবে নেটে নেটান্তরে, এবং তারপর "তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে', ঠিক আগের মতই। তবুও...., তবুও কেন জানি মনে হয় এই স্থবির হতবুদ্ধি সময়ে যেটুকু হৃদয়ের তাগিদ বেঁচে রয়েছে, তা দিয়ে এখনও আমারই স্বজন-সুজনের কান্নাকে ছুঁতে পারি। তাঁদের চোখের সেই পবিত্র জলকে সালাম জানিয়ে আমার শেষ বসন্তের ডায়েরি।)
"ওখানে রয়েছে শুয়ে গুলিবিদ্ধ একটা মানুষ
বুকে তার রক্তপদ্ম মুখে তার চৈত্রের পলাশ
অঙ্গ জুড়ে শান্ত নদী যন্ত্রণার গোলাপ বাগানে
তাকে ঘিরে গাছ পাখি বসন্তের প্রকৃতি আকাশ।" - রাম বসু
আজ থেকে একমাস আগে যখন ছোট করে মরিচঝাঁপির ইতিহাস লিখেছিলাম, তখন বুঝিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কতটা সম্ভব, কতটা অমোঘ। মরিচঝাঁপিতে সরকারি হিসাবে পুলিশের গুলিতে ৩৬জন মারা গিয়েছিলেন। প্রথমে ভাতে এবং শেষে হাতে তিলতিল করে যাদের মারা হয়েছিল তাদের সঠিক হিসেব আজ গভীর নদীগর্ভে। নন্দীগ্রামের হিসেবও উলটেপালটে যাবে। অথবা গেছে। জলমাটির দেশ রক্তকে খুব তাড়াতাড়ি মুছে ফেলে। শুধু দেখেছি গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া এক মহিলাকে আর এক মহিলা তুলে নিতে গেলে এক পুরুষ পুলিশ তাদের ক্রমাগত লাঠি মেরেই চলেছে। মেরেই চলেছে, মেরেই চলেছে যাতে মানুষ নামের শক্ত পাথরটাকে থেঁতলে গুঁড়িয়ে নরম তুলতুলে মাংসের বল বানিয়ে দেওয়া যায়। তারপর সেই নরম দলাটা দিয়ে ইচ্ছে হলে ভূমিসংস্কার কিংবা শিল্পায়ন। দেশের সংহতি কিংবা শান্তিশৃঙ্খলারক্ষাও হতে পারে। যখন যেটা দরকার আর কি! দেখেছি এক মহিলার মাথা ফুঁড়ে গুলি চলে গেছে, আর এক মহিলার পেট ফুঁড়ে। "সোনার বাংলায়' কি ঘরের, ক্ষেতের কাজ কম পড়িয়াছে যে গ্রামের মহিলারা সবাই দুম্দাম্ সমাজবিরোধী হয়ে যাচ্ছেন? নাকি সকালবেলায় ঘরের কাজ সেরে "বহিরাগত' তাঁরা অন্য গ্রামে পুলিশের বসন্ত উৎসব দেখতে গিয়েছিলেন?
সময়টাই বড় অদ্ভুত। এখন রাস্তা সারাতে গেলে পুলিশ দিয়ে মানুষকে খুন করতে হয়। এখন বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই লড়তে গেলে পুলিশ অফিসারদের সহায়তা লাগে। এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে বেয়াদপ গ্রামকে শিক্ষা দেওয়া প্রশাসনের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এখন দিল্লির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাজনৈতিক সংগ্রামের হালহকিকৎ বুঝে ফেলা যায়। এখন এমবেডেড সাংবাদিক না হলে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ নিষেধ। কিংবা সময়টা হয় তো আদৌ সে রকম অদ্ভুত নয়। পশ্চিমবঙ্গে ইতিহাসের চাকা শম্বুকগতিতে ঘোরে বলে হঠাৎ চোখের সামনে সূচীভেদ্য অন্ধকার আমার অদ্ভুত লেগেছে। হয় তো আলো কমেই আসছিল। অন্ধ আমি অন্তরে বাহিরে বুঝতেই পারি নি। ইতিহাস বুঝতে পারি নি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ভুলে গিয়েছিলাম।
২০০৭ সাল, ১৪ই মার্চ, সি পি এম পলিটব্যুরোর বিবৃতি:
"For two and a half months five gram panchayats in Block I of Nandigram have been out of bounds for the administration. Certain elements had resorted to violence and cut off roads and bridges in the area on the pretext of land acquisition.
CPI(M) members and supporters were driven out of the area. Two thousand and five hundred people were driven out of the area. More than a thousand people are sheltering in relief camps outside the area. Even after the government categorically declared that no land is being acquired in Nandigram, the Trinamul, naxalite and other elements refused to allow the administration or police into the area. Those who did not go along with their disruptive activities were targeted. Only a few days ago a woman, Sumita Mandal, was raped and killed. The repeated efforts to have meetings so that peace can be resorted were rebuffed with these parties and elements refusing to attend the meetings. Finally, after an all-Party meeting, which was boycotted by the Trinamul Congress, a decision was taken that the administration must reestablish its authority and peace be resorted in the area. The police entered Nandigram to see that the roads, culverts and bridges are repaired and the administration restored. They were attacked by brickbatting, bombs and use of pipe guns. It is regrettable that lives have been lost in police firing. But the organised elements who utilised bombs and pipe guns on the police have to take the blame. The Polit Bureau appeals to the people of West Bengal and in particular Nandigram and East Midnapur district to stand unitedly against such disruptive forces."
১৯৪৮ সালের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের সাতদিনের অধিবেশন শেষ হয় ৬ই মার্চ। তার ঠিক কুড়িদিন পরে পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৮ সাল, ৩০শে মার্চ, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরণশঙ্কর রায়ের বিবৃতি:
"....গত কয়েক মাসের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী এবং ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে সম্ভবত পরিষদের অনেক সদস্যই ওয়াকিবহাল নহেন।....সম্প্রতি খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়প্রার্থীর পুনর্বসতি, বেকারি ইত্যাদি আশু সমাধান সাপেক্ষ সমস্যাগুলির উপর গভর্নমেন্টের দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়া আছে। কম্যুনিস্ট পার্টি সরকারের এই তন্ময়তার সুযোগ গ্রহণ করিতে দ্বিধাবোধ করে নাই। তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল একটা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করা এবং শেষাশেষি ঐ সুযোগে হিংসাত্মক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। গ্রামাঞ্চলে ঐ পার্টি খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে কি রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করিতেছে গভর্নমেন্ট তাহার অসংখ্য সংবাদ পাইয়াছেন। এই পার্টি যে সব অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিয়াছে সেইসব অঞ্চলে তাহারা গ্রামবাসীদের আইন ও শৃঙ্খলা অমান্যের জন্য উস্কানি দিয়াছে। হুগলী জেলার কমলপুর গ্রামের সাম্প্রতিক ঘটনা পরিষদের স্মরণ থাকিতে পারে। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাবে গ্রামবাসীগণ বেশ কিছুকাল যাবৎ কর্তৃপক্ষ স্থানীয়দের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিয়া আসিয়াছে। একটি ক্ষেত্রে তাহারা এক পুলিশদলের উপর চড়াও হয়; ঐ পুলিশদল ফৌজদারি মামলা সম্পর্কে কয়েকজন পলাতককে গ্রেপ্তার করিতে গিয়াছিল। পরিশেষে পুলিশদল আত্মরক্ষার প্রয়োজনে গুলি চালাইতে বাধ্য হইয়াছিল।......গভর্নমেন্টের পক্ষ হইতে আমি জানাইতে চাই যে অত্যন্ত দু:খ ও অনিচ্ছার সঙ্গে আমরা এই ব্যবস্থা লইয়াছি। কোন জনপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক গভর্নমেন্টের পক্ষে এই সব অসাধারণ ক্ষমতার প্রয়োগ রীতিবিরুদ্ধ। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে একটা আসন্ন বিপদ নিবারণের জন্যই, এই বিপদ অত্যন্ত দ্রুত প্রসারলাভ করিয়া শান্তি ও শৃঙ্খলার বিঘ্নস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।...."
জানি না গুণীজনেরা একেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বলেন কিনা। জানি না বসন্তকাল হত্যার উপযুক্ত সময় কিনা। যে সময়ে কিরণশঙ্কর রায় এই বিবৃতি দিচ্ছেন, সেই সময়েরই এই গল্প:
২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮- বড়া কমলাপুরে পুলিশি সন্ত্রাস। ১৫০জন কৃষক গ্রেপ্তার। সান্ধ্য আইন জারি। পুলিশের গুলিতে গুইরাম মন্ডল ও কার্তিক ধাড়া নিহত ও ৪জন মহিলা আহত।
২৭শে ফেব্রুয়ারি,১৯৪৯- হাওড়ার মাসিলা গ্রামে কৃষকদের উপর গুলি। ৩জন কৃষক-বধূ নিহত।
৯ই মার্চ, ১৯৪৯- তমলুকের চকদুর্গাপুরে কৃষকদের উপর গুলি। নিহত ২জন।
২২শে মার্চ, ১৯৪৯- মালদহে খেতমজুর সম্মেলনের উপর গুলি।
২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০- মেদিনীপুরের কেয়াপাড়া গ্রামে কৃষকদের উপর গুলি। ১জন নিহত ও ১জন আহত।
এই ইতিহাসের প্রায় ষাট বছর পেরোবার সময় আমি জানি না আদৌ কাউকে ভরসা করা যায় কিনা। একদম ছোটবেলায় পুলিশের ভয় দেখিয়ে দুধ খাওয়াবার সময় থেকে পুলিশের উপর ভরসা হারিয়েছি। আমি ভরসা করি না একটিও রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে, ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাহীন, কারণ তাদের প্রত্যেকের হাত নিরীহ মানুষের রক্তে লাল। আমি ভরসা করি না সেই সব বুদ্ধিজীবীদের যাঁরা হাওয়ামোরগের মতো উলটেপালটে যান। আমার ভরসা থাকে না সেই সব নামী দামি গায়ক-শিল্পীদের উপর যাঁরা মানুষের রক্তে শৌখিন বিপ্লবের মধ্যবিত্ত আঁচ পোহান। আমি সেই বৈজয়ন্ত চক্রবর্তীকে একফোঁটা ভরসা করি না যে উদ্বৃত্তভোগী বাবুটি গোলমাল দেখলেই একদিকে তত্ত্ব এবং অন্যদিকে রক্তে থেকে যাওয়া ছিঁটেফোঁটা "আস্তিকতার' আড়ালে মুখ ঢাকার রাস্তা খোঁজেন। বন্ধের দিন একফোঁটা রোজগার না হওয়া আমার বাড়ির সামনের চাওয়ালাটি যখন ধরে আসা গলায় প্রশ্ন করেন "এই লোকগুলোর বাচ্চাদের কী হবে দাদা?' ভরসা রাখি তাঁর ওই প্রশ্নের উপর। ভরসা রাখি তাঁর মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, বৈশিষ্ট্যহীন, ভিড়ে মিশে যাওয়া লাখ লাখ মানুষের এইসব প্রশ্নের উপর। এই সব ভরসা নিয়েই আমরা সবাই বেঁচে থাকি। আর সেই ভরসা হারিয়ে গেলে তৈরি হয় একের পর এক নন্দীগ্রাম। জানি তাঁরা কেউ কোনোদিন আমার এই ডায়েরি পড়বেন না। আবার যাঁরা পড়বেন বিশ্বকাপের উত্তেজক মরশুমে অথবা বিদেশের ব্যস্ত জীবনের গতিতে এই অসহায় কণ্ঠস্বর ভুলে যেতে তাঁদের বেশিক্ষণ লাগবে না। তবুও সেই সব অপাঠক এবং অপাঠিকাদের জন্যই লিখলাম আমার শেষ বসন্তের ডায়েরি।
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৬ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী এপ্রিল ৩ ২০০৭
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৭ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী মে ৩ ২০০৭
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৮ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী মে ১৮ ২০০৭
এটা সেটা এখানে সেখানে - ৩৯ বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী জুন ১৮ ২০০৭
৪০ (Jul 6 2007)
শেষ কিস্তি
আবার এসেছে আষাঢ় বারোটা বাজিয়ে। শরীর আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে হাওয়ায় ঘামের টোকো গন্ধ। অল্প বৃষ্টিতে রাস্তার কাদাই সার, বেশি বৃষ্টিতে রাস্তায় গাছ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, রাস্তাঘাটে গাড়ি নেই, অফিসে আসা ধুন্ধুমার। যেদিন তিনি প্রথম আসেন, সেদিন নতুন ভেজা মাটির যোনিগন্ধে এক বিপুল উত্তেজনা মিশে থাকে। কলকাতার উথালপাথাল হয়ে যাওয়া রাস্তাঘাটে চুপচুপে ভিজতে ইচ্ছে করে। দিন যত এগোয় রিয়েল বা আনরিয়েল- কোনও এস্টেটই আর মেঘমল্লার শোনে না। শিউলি ঝরে পড়ার অপেক্ষায় শুধু হাপিত্যেশ বসে থাকা। তবে আমার পাশের গাছটায় দেখি সম্বৎসর শিউলি ফোটে। কে জানে আজকাল হয় তো ফুলও কার্বাইডে ফোটে! ইদানীং জাতে ওঠা পল্লীসমাজের এথনিক বর্ষাতেও বিশেষ সুখ মনে হয় না, যদি না উত্তরায়ণের বারান্দায় আরামকেদারা পেতে বসা যায়। সরকারি অযত্নের কাঁচা রাস্তা, পাড় ভাঙতে থাকা গঙ্গা এবং বন্যার উপদ্রবের মধ্যে স্বার্থপর প্রফেটটির একটি গানই সত্য- ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। ভেবে দেখলাম এই হিসেবী বয়সে বর্ষা উপভোগের ভ্যান্টেজ পয়েন্ট হল কোনও চোদ্দোতলা বাড়ির টঙে কাচঘেরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর। তার সাথে খেয়ালি বয়সের নস্টালজিক অনুপানরূপে এক বোতল রাম আর একথাল খিচুড়ি, বোসের মিউজিক সিস্টেমে নিখিলবাবুর মেঘ কিংবা মোহরদির নীলাঞ্জনছায়া। বাইরে বেরোলেই শহরে বৃষ্টি জলকাদামাখা নোংরা দেদার, বগলে বেঁটে ছাতা, চোখের চশমা ঝাপসা, অফিস থেকে বাড়ি ফেরা পুরো হাতা। ঝাপসা হয়ে আসে মগজও, এক অদ্ভুত স্যাঁৎসেঁতে ক্লান্তিতে।
বর্ষা প্রকৃত প্রস্তাবে যৌনতার সময়। রাজবংশীদের বৃষ্টির দেবতা হলেন হুদুমা। কোনও অমাবস্যার রাতে অনাবাদী জমিতে লাঙল আর বীজ নিয়ে রাজবংশী মেয়েরা এলোচুলে নগ্নদেহে নাচে আর গায়-
হিল হিলাসে কোমরটা মোর
শির শিরাসে মোর গাও
কোন্ঠে কেনা গেলে এলা
হুদুমা দেখা পাও?
পাটনিখানি পরেসে খসিয়া
আওলা হয়েছে খোঁপাটা মোর
হুদুম দেখা দাও গো আসিয়া
আইসেক রে হুদুমা দেওয়া
রসিয়া রসিয়া
তোর পদে মই আসে রে বসিয়া
দিংশালি দিংশালি কোমরটা
তাতেও নাই মোর ভাতারটা।
কারো কি মই কইবা কয়
কোন্ঠে গেলা দেখা হয়
দেখা হলে দেহটা জুড়ায়।
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে- "আমার কোমরটা দুলছে, শরীরটা কাঁপছে হুদুমার জন্য, কোথায় তাকে পাব? আমার কাপড়খানি খসে গেছে শরীর থেকে, চুল এলো হয়ে গেছে। হুদুমা, এবার দেখা দাও, আর এসে আমাকে তোমার রসে সিক্ত কর। আমার ভাতার এখানে নেই। কাকে বলব আমার কথা? কোথায় গেলে তোমার সঙ্গে দেখা হয়, ও দেখা হলে শরীরটা জুড়ায়?' প্রথম বৃষ্টির যৌনতার এই প্রবল আর্তি আমাদের রুটিনশরীরে সয় না। এই শরীরগুলোতে আপাতত কোনও আর্তি নেই, তাই কোনও প্রাপ্তি নেই। কোনও প্রাপ্তি নেই, তাই কোন বিস্ময়বোধ নেই। কোনও বিস্ময়বোধ নেই, তাই ক্লান্তিতে নুয়ে আসে বর্ষার ভিজেথাকা দিনরাতগুলো। স্থবিরের জন্য বর্ষা কিছু রেখে যায় না।
আকাশে ভর দিয়ে কোনওরকম দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর হাক্লান্ত মেঘ দেখে মনে পড়ে বর্ষা মৃত্যুরও সময়। শ্মশানে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল বুলেটের মতো। শ্মশানযাত্রীরা পড়িমড়ি দৌড়ে ঢুকে গেল অ্যাসবেস্টসের ছাউনির তলায়। পাগল হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে নিথর শুয়ে থাকা মানুষটির হাড়মাস অবিরত ভিজে যাচ্ছিল। পাশে বসে ঠায় ভিজছিল তাঁর নিথর সন্তান, শ্মশানের গাছদের মতো। প্রফেটের এই সৌভাগ্য হয়নি। বাইশে শ্রাবণ অসম্ভব ভিড় আর হুড়োহুড়ির মধ্যে শরীরটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিনও কলকাতার রাস্তা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজেছিল। কিন্তু সেই বৃষ্টির গল্প বিশেষ শুনিনি। বরং অনেক বেশি করে শুনেছি কাদাতে পিছল নিমতলার মাটির কথা। নিজের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের জন্য বেশ গুছিয়েগাছিয়ে শান্তিপারাবারের একটা ভাবগম্ভীর গান লিখে গিয়েছিলেন। অথচ বাইশে শ্রাবণ ভাবলেই মনে পড়ে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, অঝোর বৃষ্টির তলায় শুইয়ে রাখা একটি মৃতদেহ, পাশে বসে ভিজে যাওয়া একাকী সন্তান। সেই ছবিতে আমি মায়া দেখি। কি ঘোর মায়ায় সন্তানেরা পিতামাতাদের শরীরে হাত রেখে ভিজে যেতে থাকে। এই মায়া, এই বৃষ্টির জন্যই আমাদের চূড়ান্ত অপেক্ষা। ক্লান্তির জলে যদি বা ভাসে মায়ামাখা শবদেহগুলি!
মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব:।
মাধ্বী ন: সন্তু ওষধী:।।
মধু নক্তম্ উত ঊষস: মধুমৎ পার্থিবং রজ:।
মধু দ্যৌ: অস্তু: ন: পিতা।।
মধুমান্ ন: বনস্পতি: মধুমান অস্তু: সূর্য:।
মাধ্বী গাব: ভবন্তুন:।।
এতদিনের জমিয়ে তোলা অক্ষরগুলো পিঁপড়ের মতো গর্তে গিয়ে ঢুকেছে। নিজের লিখে যাওয়া অবিরল শব্দের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় এত কথা হয় তো আদৌ বলার ছিল না। নিজেকে ভয়ানক বাচাল মনে হয়। আপাতত ভীষণ ক্লান্ত লাগে। বাইপাসে আমাদের বলে যাওয়া লিখে যাওয়া শব্দের মতো গাড়িগুলো হুস্হাস্ বেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতেও তাদের হুঁশ নেই। এই অবিরাম চলনে খুব ক্লান্ত লাগে। আবার নিজের মধ্যে মায়ার রসদগুলো জড়ো করে তুলতে হবে। তার আগে থামতে হবে, নিজের সাথে কথা বলে যেতে হবে, নি:শব্দ হতে হবে। নৈ:শব্দ্যের অন্যপিঠে শব্দের নির্মাণ। লেখালেখিতেও কত মায়া! পাঠিকা পাঠকদের নিয়ে শব্দের মায়ার সংসার। এই মায়ার সংসার বারে বারে বহু যতন করে ধুয়েমুছে রেখে দিতে হয়। সেই পদ্মের জন্য সারারাত কোজাগর পূর্ণিমায় জেগে থাক বুড়োটে মগজ। নৈ:শব্দ্য প্র্যাকটিস করুক।
Hello darkness, my old friend,
I've come to talk with you again,
Because a vision softly creeping,
Left its seeds while I was sleeping,
And the vision that was planted in my brain
Still remains
Within the sound of silence.