বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দৌলতে চারদিকে এখন 'দিল দিল আফগানিস্তান'। দু বছর আগেই অবস্থাটা অন্য ছিল। তখন ছিল 'হায় হায় আফগানিস্তান'। দিল-দিল ছাড়ুন, তালিবান রাজত্বের আফগানিস্তান নিয়ে 'ততটা খারাপ অবস্থা নয়' বলার জন্যই এক কাবুল-ফেরতার কী হেনস্থা। আমিও লিখেছিলাম, যে, তালিবানকে মৌলবাদী হিসেবে দেখার সঙ্গে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকাটাও দেখা দরকার, তাতে লোকে প্রায় মারতে আসে আর কী। কারণ, টিভিতে জলজ্যান্ত দেখা যাচ্ছে, তালিবান দানবের ভয়ে লোকে ঝুলতে ঝুলতে প্লেনে যাচ্ছে, তারপর টপ করে পড়ে যাচ্ছে। মেয়েদের বোরখা পরা ছবি চতুর্দিকে। কিন্তু দুবছরেই পুরো খেলা ঘুরে গেছে। এখন স্রেফ 'দিল দিল'। যদিও এখনও ওখানে তালিবান রাজত্ব। এখনও মেয়েদের হাল একই। সেসব ছবি আর দেখা যায়না যদিও।
এই অবধি পড়েই কেউ কেউ বলবেন, আরে এ তো খেলা, রাজনীতি না। ঠিকই। খেলোয়াড়দের কি ঢিল মারা উচিত, না রাষ্ট্রীয় নীতির জন্য শূলে চড়ানো উচিত? কোনোটাই না। বরং বাহবা দেওয়া উচিত। কিন্তু সঙ্গে এটাও মনে করে দেখুন, গত বিশ্বকাপ ফুটবলের কথা। সেটাও ছিল খেলা। খেলছিল ইরান বলে একটা দেশ। নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সেখানেও ভুলুণ্ঠিত, তাই খেলার মধ্যেও সেটায় ফোকাস ছিল। কোন খেলোয়াড় বিড়বিড় করে কী বললেন, ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে কড়ি আঙুল তুলেও কিছু ভঙ্গী করে দেখালেন কিনা, এইসব। আফগানিস্তান নিয়ে এই বিশ্বকাপে সেই ফোকাসটাই দেখা যাচ্ছেনা।
তালিবানরা কি মৌলবাদ ত্যাগ করেছে? প্রচণ্ড গণতান্ত্রিক এবং সমানাধিকারপন্থী হয়ে গেছে? নাঃ, তেমন কিছু শোনা যায়নি। ওসব কিছু নয়ই, আসলে এই ফোকাসের অভাবের একটাই কারণ, টিভিতে ওসব দেখাচ্ছেনা। টিভিতে দেখাচ্ছেনা কেন? কারণ ভারতীয় টিভি পশ্চিমী খবরের টুকলি করে, পশ্চিমে এসব নিয়ে আর হইচই নেই। কেন নেই? সেটাও সোজা। আমেরিকার সঙ্গে তালিবানদের কোনো একটা পর্যায়ে বোঝাপড়া হয়ে গেছে। যেমন আছে কাতার বা সৌদি আরবের সঙ্গে। ফলে এসব আর খবরে আসেনা। ইরান আসে। ইউক্রেন তো আসেই। পুরোটাই পশ্চিমী স্বার্থে। ভারতীয় মিডিয়ারও গাঁটছড়া আছে পশ্চিমে, তার উপর, আগেই বললাম, তারা মূলত টুকলি করে। উপকরণই না থাকলে টুকবে কী? ফলে তারাও দেখাচ্ছেনা। আমাদের চিন্তাশীল জনগণও ফুটেজের অভাবে আফগানিস্তানে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আর বিশেষ চিন্তিত না। কারণ, অন্ধ হয়ে থাকলেই প্রলয় বন্ধ থাকে। এরপর যখন আবার কিছু একটা কভারেজ হবে পশ্চিমী মিডিয়ায়, সবাই আবার লাফ-ঝাঁপ মেরে লাফিয়ে উঠবে। ঠিক যেন পুতুলনাচের খেলা। দড়ির ওধারের খেলোয়াড় যেমন নাচাবেন, তেমন আমরা নাচব। ইতিহাস-ভূগোলচর্চা, এই অন্তহীন দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের বোমাবর্ষণে স্রেফ ধ্বংস হয়ে গেছে। হামাস হঠাৎ একদিন বোম মারেনি, তালিবানদের উত্থান এমনি এমনি একদিন সক্কালবেলা হয়নি, এ খুবই সহজবোধ্য কথা, কিন্তু এসব বললে লোকে বলবে, ধুর ওরকম হয় নাকি। হঠাৎ একদিন বোম্বের হিরো যেমন কোথা-হইতে-আসিয়া মারদাঙ্গা করে তিনঘন্টা পরে উবে যান, সবই তাই। পৃথিবীটাই ওরকম।
তা, এই যে কায়দা করে আমাদের কিছুর পক্ষে এবং কিছুর বিপক্ষে, বা ততটা-বিপক্ষে-নয় অবস্থানে নিয়ে চলে যাওয়া যাচ্ছে, আমরা পুতুল হয়ে নাচছি, এইটার নামই সম্মতি উৎপাদন। নোম চমস্কি সায়েব 'ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট'এ পুরোটাই বিশদে লিখে গেছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে স্মরণ করা দরকার, তাই লিখলাম।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।