এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মোঘল সালতানাতের ইতিহাসে সব চেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ (গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে) ১৬৩০-৩২

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ জুন ২০২৩ | ৬০৭ বার পঠিত
  • এই দুর্ভিক্ষের দুটো লিখিত বয়ান পাওয়া যাচ্ছে। 

    ১) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনীকার পিটার মুনডির বয়ান
     
    গুজরাট দুর্ভিক্ষ ষোলোশো তিরিশের খরার বছরে আরম্ভ হল। পরের বছরও ফসলে ইঁদুরের আক্রমণ আর পঙ্গপালের উৎপাতের সঙ্গে বন্যাও হয়। দুর্ভিক্ষ আর জলবাহিত রোগের মহামারীতে তিরিশ লক্ষ লোক মারা যায়। কম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় পালাতে গিয়ে অনেকে রাস্তাতেই মরে পড়ে রইল আর মৃতদেহের পাহাড় রাস্তা আটকে দিল। ফার্সি আর ইংরিজিতে এই দুর্ভিক্ষের কথা লেখা আছে। সেখানে দুর্ভিক্ষের সময় লোকের যা পাচ্ছে খাওয়ার বীভৎস বর্ণনা আছে- পশুর চামড়া খাচ্ছে ,গুঁড়ো করা মরা মানুষের হাড় ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে খাচ্ছে, এন্তার মানুষের মাংস খাওয়া চলছে, মড়াও বাদ যাচ্ছে না। কম ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা, ফসল উপচানো এলাকা মালওয়া থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে আসা ভ্রাম্যমান বাহক বানজারাদের বলদ গাড়ি দাক্ষিণাত্যে লড়াইরত ফৌজের চাহিদা মেটাতে শাহী ঘাঁটি বুরহানপুরে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দুর্ভিক্ষের আগে গমের দাম ছিল মন প্রতি এক মাহমুদি (মাহমুদি হল মোঘল পূর্ব গুজরাট সুলতানশাহীর সময়কার মুদ্রা। এটা সপ্তদশ শতকে মোঘল আমলেও চলত। এক মাহমুদি সমান ২/৫ থেকে ৪/৯ টাকা Agrarian System of Mughal India – Prof Irfan Habib, page 384), ষোলোশো একত্রিশে দুর্ভিক্ষের চরমে তা বেড়ে হচ্ছে ষোলো। শাহী লঙ্গর বা খাজনা মকুবের দাক্ষিণ্য দুর্ভিক্ষ কমাতে নেহাতই অপ্রতুল। ক্যালিকো কাপড় তৈরি আর ব্যবসার ঘাঁটি গুজরাট, তাঁতিদের মৃত্যু আর অন্য জায়গায় পালানোর ফলে চরম ক্ষতিগ্রস্থ। 

    ২) শাজাহানের শাহী তারিখ পাদশানামার রচয়িতা আব্দুল হামিদ লাহোরির বয়ান। 
     
    গত বছর বালাঘাট অঞ্চলে বৃষ্টি হয়ই নি আর দৌলতাবাদ খরায় জ্বলেছে। এ বছরও সীমান্তবর্তী দেশে ফসলাভাব, দখিন ও গুজরাট ধুঁকছে। ঐ দুই দেশের লোক চরম দুর্দশায় পড়েছে। রুটির জন্য লোকে নিজেকে বেচতে চায়, কেনার লোক পায় না, পিঠের জন্য খেতাব বেচতে আসে কেউ ফিরেও তাকায় না। যে হাত ঐশ্বর্যে উপচে পড়ত তা ভিক্ষে করছে, যে পা আমোদের ঘরে বাড়ানো ছিল তা দিন গুজরানে ক্লান্ত। অনেক দিন ধরে কুকুরের মাংস বিক্রি হচ্ছে খাসির বদলে আর ময়দার মরা মানুষের হাড় মেশানো হচ্ছে আকছার। অভাবের আর খিদের তাড়নায় লোকে আদরের ছেলেকে খাচ্ছে। মড়ার পাহাড়ে রাস্তা চলা দায়, যারা মরে বাঁচল না, যাদের হাঁটার ক্ষমতা আছে তারা শহরে, গ্রামে বা অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছে। যে দেশে ফসল উপচে পড়তো সেখানে উর্বরতার চিহ্ন নেই।  

    মহানুভব শাহেনশাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন বুরহানপুর, আহমেদাবাদ আর সুরাট সুবায় গরিব দুস্থদের খাবার বিলোনোর জায়গা - হিন্দুস্থানের ভাষায় যাকে লঙ্গর বলে, খুলতে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত সুরুয়া আর রুটি বিলোন হয়েছিল। আরো ফরমান জারি হল যতদিন বাদশাহ বুরহানপুরে থাকবেন প্রতি সোমবার পাঁচ হাজার টাকা করে প্রকৃত গরিবদের দেওয়া হবে। কারণ সোমবার হল অন্য দিনের থেকে আলাদা, বাদশাহের তখতে বাসার বিশেষ দিন। সেই মতো কুড়িটা সোমবারে এক লাখ টাকা দান ধ্যান করা হল।
     
    মুনডি আর জন ইয়ার্ড দুই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী ব্যবসায়িক সফরে গুজরাটের সুরাট থেকে আগ্রায় গিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষের সময়। মুনডির লেখার বৈশিষ্ট্য হল ডাচ ম্যাপের ব্যবহার আর নানান হাতে আঁকা স্কেচের খেয়ালি ব্যবহার যেটা পাদশানামায় থাকা সম্ভব নয় কারণ সেটা শাহী প্রকল্প তাছাড়া মোঘলরা কার্টোগ্রাফিক ম্যাপের ব্যবহার করেনি। 
    ওই ম্যাপটা আর সম্ভবত ভ্রমণ বেত্তান্তটাও কোম্পানির কাছে অফিসিয়ালি পেশ করা হচ্ছে। বিদেশ বিভুঁয়ে এলে স্থান আর ভ্রমণের বোধও বদলায়। যেতে যেতে দুর্ভিক্ষের অসহনীয় বাস্তবতার সঙ্গে অনবরত আবেগগত বিনিময় হয়েছিল মুনডি সাহেবের। যেটা পাদশা নামার বিবরণী থেকে তার লেখাকে আলাদা করেছে। লাহোরির বর্ণনায় সুবা ভিত্তিক উল্লেখ আছে বা সালতানাতের বাইরের আশপাশের রাজ্যের উল্লেখ আছে  কিন্তু ম্যাপ ধরে ধরে নির্ধারিত সীমান্ত নেই। একটা ধীরে সুস্থে বসে গুছিয়ে লেখা - হয়তো বা দরবারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে, কোন ক্রস চেক না করেই। 

    মুনডির লেখা অনেক বেশি সময়ের প্রতিফলন। অন্যটার উদ্দেশ্য শাহী ইনসাফের গুণ কেত্তন।

    মুনডির লেখাতে কোথায় অভাব আর কোথায় প্রাচুর্য তারও আলাদা উল্লেখ আছে যেটা কোম্পানির ব্যবসায়িক তথ্য হলেও এর মধ্যে দিয়ে দুর্ভিক্ষের সময় অর্থনৈতিক কার্যকলাপে দিয়ে প্রকোপ কমানোর আভাস আছে। আছে মোঘল ফৌজের বৈষম্যমূলক হস্তক্ষেপের প্রমাণ যা লাহোরির পক্ষে পাদশানামায় লেখা সম্ভব ছিল না।
     
    তবে বেশ কিছু মিলের দিক আছে দুটো লেখায়। এখনকার হিসেবে অনুযায়ী গুজরাট আর গোটা দাক্ষিণাত্য মিলিয়ে দুর্ভিক্ষের সময় স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা চুয়াত্তর লাখ যেটাকে দুর্ভিক্ষের ক্ষতি বলা যেতে পারে। মোঘল আমলের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prativa Sarker | ২৯ জুন ২০২৩ ১৪:০৪520811
  • ভয়ংকর ! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন