আজকের দিনে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বার্তা পৌঁছে যায় অতি সহজেই। অতি উন্নত প্রেরণ ব্যবস্থার কারণে কোনো খবর থেকে যে কোনো ছবি বা ডকুমেন্ট যাইহোক না কেনো মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো দূরত্বে পাঠানো আজ আমাদের কাছে শুধুমাত্র একটা ক্লিক বা মোবাইল ফোনে একটা আলতো টোকা। এখন আমরা বার্তা বলতে অনেককিছু বুঝলেও শুরুর সময়ে বার্তা বলতে চিঠি বা খবর বোঝাত। কিন্তু এই বিবর্তন তো একদিনে আসেনি। আমাদের মাথায় বার্তা প্রেরণের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথম আসে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে, ৩২১ থেকে ২৯৭ খ্রীষ্ট পূর্ব্বাদে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর বিরাট সাম্রাজ্যকে শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। তিনিই প্রথম প্রাদেশিক রাজধানীর সাথে সাম্রাজ্যের মূল রাজধানীর বার্তা বিনিময়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনিই প্রথম শুরু করেন পায়রা মারফত বার্তা আদান প্রদানের ব্যবস্থা। শুরু হয় মানুষ ছাড়া কোনো মাধ্যমের দ্বারা এক জায়গা থেকে দূরবর্তী কোনো জায়গায় বার্তা প্রেরণ। এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত থাকে, এমনকি মৌর্য শাসনকালের পরেও। পায়রা ছাড়াও ঈগল বা অন্যান্য অনেক ধরনের পাখির ব্যবহার দেখা যায় ইতিহাসে, যাদের দিয়ে বার্তা পাঠানো হতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এই পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরণ মূলতঃ যুদ্ধক্ষেত্রের বা অন্য কোনো গোপন খবর পাঠানোর জন্য কাজে লাগানো হতো। সাধারণ মানুষের কোনো খবর পাঠানোর ব্যবস্থা তখন ছিলনা। মানব সভ্যতা যত এগোতে থাকে এবং মানুষ যত উন্নত হতে থাকে, আমাদের নিজস্ব বার্তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠানো ততই প্রয়োজনীয় হতে থাকে। পাশাপাশি আমরা বুঝতে পারি যে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিরও উন্নতি দরকার। কারণ পায়রা বা ঈগলকে মাধ্যম করে খুব বেশী বার্তা পাঠানো সম্ভব হয়না। সুতরাং মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় বার্তা পাঠাতে গেলে পদ্ধতির উন্নতির দরকার। এই চিন্তাভাবনা থেকেই ১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খিলজী প্রথম ঘোড়ায় এবং পায়ে হেঁটে ডাক পরিবহন চালু করেছিলেন। এরপরে মোঘল আমলে বাবর আগ্রা থেকে কাবুল পর্যন্ত ডাক পরিবহন চালু করেন। এতদূর রাস্তায় ডাক পরিবহনের জন্য প্রতি ৩৬ মাইল অন্তর ছয়টি করে ঘোড়া থাকতো। অর্থাৎ, সেই প্রথম ৭২৮ মাইল বা ১১৭১ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে ডাক পরিবহন শুরু হয়। পরবর্তীতে শেরশাহ সুরি এই ব্যবস্থাকে আরও উন্নত এবং দীর্ঘ করেন। কাবুল থেকে কলকাতা পর্যন্ত গ্রান্ট ট্রাংক রোড নির্মাণ করেন এবং রাস্তার ধারে কিছুদূর অন্তর অন্তর বিশ্রামের জন্য সরাইখানা নির্মাণ করেন। কাবুল থেকে কলকাতা অব্দি গ্রান্ট ট্রাংক রোডের দৈর্ঘ্য ছিল ২৫০০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পথ ধরে ডাক পরিবহনের সুবিধার জন্য মোট ৩৪০০ ঘোড়া কাজে লাগানো হতো। অর্থাৎ ডাক ব্যবস্থা এবং ডাক পরিবহন ভারতবর্ষে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বিদ্যমান ছিল। কোনো নির্দিষ্ট সন, তারিখ বলা সম্ভব নয়, যখন থেকে এদেশে ডাক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। কিন্তু সেই ডাক ব্যবস্থা একেবারেই অসংঘঠিত চেহারায় বিদ্যমান ছিল। রাজা, মহারাজা বা সম্রাটদের আমলের ডাক ব্যবস্থা বলতে গেলে তাদের নিজস্ব রাজত্বের মধ্যে আপন আপন পদ্ধতিতে চলতো। মূল বিষয়টা একই বলে সেইসব পদ্ধতিতে মিল যেমন ছিল তেমনি অমিলও নিশ্চয়ই ছিল। মোঘল রাজত্ব শুরু হওয়ার পরে অমিলের পরিমাণ নিশ্চয়ই কমে ছিল কারণ একই সম্রাটের অধীনে একাধিক রাজা বা মহারাজার রাজত্ব চলতো, ফলে অমিলগুলো কমে যাওয়ার সম্ভাবনাই যে যথেষ্ট ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৭৬৬ সালে রবার্ট ক্লাইভ প্রথম সংঘঠিত করেন এইদেশের ডাক ব্যবস্থা। ইংল্যান্ডের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যোগাযোগের জন্য সেই ডাক পরিষেবা কাজ করতো। ১৭৭৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম সংঘঠিত চেহারার ডাকঘর চালু করেন দেশে সাধারণ মানুষের জন্য। ৩১ শে মার্চ, ১৭৭৪ সালে প্রথম কলকাতা জি, পি, ও কাজ করা শুরু করে। এরপরে ধীরে ধীরে আজকের ডাকঘরের যে চেহারা আমরা এখন দেখতে পাই সেই চেহারা আসে। অর্থাৎ হেড পোস্ট অফিস, সাব পোস্ট অফিস, ব্র্যাঞ্চ পোস্ট অফিস ইত্যাদি স্থাপিত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। যদিও তখন প্রশাসনিক অফিসের আলাদা অস্তিত্ব ছিলনা। হেড পোস্ট অফিসের যিনি পোস্টমাস্টার হতেন তিনিই সেই জেলার বা সেই ডাক মণ্ডলের বিভাগীয় প্রধান হতেন। সেই কারণে বর্তমানে যেমন পোস্টমাস্টার বা হেড পোস্টমাস্টার বলা হয় হেড পোস্ট অফিসের প্রধানকে, সেই আমলে বলা হতো ইন্সপেকটিং পোস্টমাস্টার। অনেকপরে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে প্রশাসনিক অফিস তৈরী হয়েছিল। ডাকঘরের সংঘঠিত চেহারা তৈরী হওয়ার পরে প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক হেড পোস্ট অফিস নির্দিষ্ট হয়। সেই হেড পোস্ট অফিসের অধীনে সারা জেলা জুড়ে বিভিন্ন মানের বা মাপের সাব পোস্ট অফিসকে রাখা হয় যারা তাদের নিত্যদিনের কাজের হিসেব অর্থাৎ একাউন্ট হেড পোস্ট অফিসে পাঠায়। আবার প্রতিটি সাব পোস্ট অফিস যেখান থেকে ডাক বিলি হয়, তাদের অধীনে বিভিন্ন মানের বা মাপের ব্র্যাঞ্চ পোস্ট অফিস রাখা হয় যারা তাদের নিত্যদিনের কাজের হিসেব অর্থাৎ একাউন্ট সাব পোস্ট অফিসে পাঠায়। অর্থাৎ প্রতিদিনের একাউন্ট যেমন হেড পোস্ট অফিসে এসে একত্রীকরণ হয়ে যায় তেমনি প্রতিটি ডাকঘরের মধ্যে তার ব্র্যাঞ্চ অফিস বা হেড অফিসের সাথে সংযুক্তি ঘটে। এই একাউন্ট সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়েই এক পোস্ট অফিসের সাথে অন্য পোস্ট অফিসের ডাক বিনিময় চালু হয়ে যায়। অর্থাৎ ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ডাক পরিবহনের আওতায় চলে আসে। আগে যেমন ডাক পরিবহনের ক্ষেত্রে রানার বা বাহকদের কাজে লাগানো হতো কিন্তু দূরত্বের হিসেব করা হতো না। ফলে বহু বহুদূর অব্দি একজন রানারকে ডাক পরিবহন করতে বাধ্য হতে হত। সারাদিন, সারারাত ধরে সেই রানার বা বাহকেরা ডাক বয়ে নিয়ে চলতো। দূরত্ব বেশী হলে রিলে প্রথায় রানারদের কাজে লাগানো হতো। এতে সেই রানার যেমন নিষ্পেষিত হতো, বঞ্চিত হতো তেমনি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ডাক পরিবহন করতে অত্যধিক সময় লেগে যেত। পরবর্তীতে রানারদের দিয়ে ডাক পরিবহনের ক্ষেত্রে সময়সীমা বা দূরত্বসীমা বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে তাদের বঞ্চনা যেমন কমে তেমনি ডাক চলাচলে দ্রুততা আসে। বেশীদুর হলে সেক্ষেত্রে সাইকেলের ব্যবস্থা চালু হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়মবিধি (টেন্ডার প্রভৃতি) মেনে ডাক পরিবহনকে যান্ত্রিক করা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়না। নিয়মবিধির অসুবিধা এবং আর্থিক গ্রহণযোগ্যতা না থাকার কারণে গ্রামেগঞ্জে এখনও রানার মারফত ডাক পরিবহন ব্যবস্থা চালু আছে। শহরাঞ্চল এবং মফস্বল শহরে ডাক পরিবহন ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হতে পেরেছে। এই যান্ত্রিকতার উদ্দ্যেশ্যেই ১৮৭৯ - ১৮৮০ সালে প্রথম চালু হয় রেলওয়ে মেল সার্ভিস। দেশের একস্থান থেকে অন্যস্থানে অনেকবেশী পরিমাণে ডাক পরিবহনের জন্য এবং অনেক কম সময়ে পরিবহনের সুবিধার জন্য ট্রেনের মধ্যে একটি বগিতে চালু হয় রেলওয়ে মেল সার্ভিস। ডাক বিভাগের লোকেরা সেই বগিতে বিভিন্ন রকমের ডাক অর্থাৎ চিঠিপত্র নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাড়ি দিত। সেই বগির মধ্যেই চিঠিপত্র শর্ট করা হত, বিভিন্ন পোস্ট অফিসের জন্য মেল ব্যাগ বাঁধা হত, ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ডাক পরিবহনে সুবিধা হত। সেই ট্রেনগুলোকে মেল ট্রেন হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, যেমন বম্বে মেল, মাদ্রাজ মেল, কালকা মেল, দার্জিলিং মেল ইত্যাদি। মাদ্রাজ মেল ট্রেনের নাম দেখলে যেমন বোঝা যায় যে ট্রেনটি মাদ্রাজ যাবে তেমনি বোঝা যায় যে ট্রেনটি ডাক পরিবহন করে। ট্রেনের বগিতে চিঠিপত্র শর্ট করা হত বলে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে এক পোস্ট অফিস থেকে অন্য পোস্ট অফিসে চিঠিপত্র পৌঁছে যেত। ধীরে ধীরে সারা দেশে সংঘঠিত ডাক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরে মূলতঃ যে যে ভাবে ডাক পরিবহন করা হতো সেইগুলো হলো:
১. রেলওয়ে মেল সার্ভিসের মাধ্যমে
২. স্থানীয় বিভিন্নরকম পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে
৩. ঘোড়ার মাধ্যমে এবং ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে
৪. পায়ে হেঁটে ডাক রানারের মাধ্যমে
৫. সাইকেলে ডাক রানারের মাধ্যমে
৬. নৌকার মাধ্যমে
অনেক পরে ডাক বিভাগের নিজস্ব গাড়ী বা মেল মোটর সার্ভিস এবং দেশে ও বিদেশে চালু বিভিন্ন বিমান পরিষেবার মাধ্যমে ডাক পরিবহন চালু হয়। পরবর্তীতে ডাক বিভাগ নিজের বিমান ব্যবস্থাও চালু করে ডাক পরিবহনের জন্য। পায়রা বা ঈগল জাতীয় পাখির মাধ্যমে বার্তা পরিবহন শুরু হলেও প্রয়োজনীয়তার কারণেই ধীরে ধীরে ঘোড়া বা পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে ডাক পরিবহন চালু হয়। রানার প্রথা চালু হয়, যদিও তখনও সংঘঠিতভাবে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়নি। দিন নেই, রাত্রি নেই রানারদেরকে কাঁধে বার্তার বোঝা নিয়ে এক জায়গা থেকে দূরবর্তী জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসতে হতো। সংঘঠিত ভাবে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হওয়ার পরে সেই রানারদের হাতে আত্মরক্ষার জন্য একটি বল্লম জাতীয় অস্ত্র, লোককে জানানো ও ছোট কীট পতঙ্গের হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি ঘন্টি এবং রাত্রিবেলায় চলাচলের সুবিধার জন্য একটি লন্ঠন দেওয়া হতো। কিন্তু তার আগের পর্যায়ে এক একজন রানারকে বহুদূর অব্দি ভ্রমণ করতে হতো পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে। এমনকি সংঘঠিত হওয়ার পরেও সারারাত ধরে রানারের হেঁটে চলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই কারণেই পরবর্তীতে রানারকে বঞ্চিত এবং নিষ্পেষিত সমাজের প্রতিভূ ধরা হয়। গরীব এবং পিছিয়ে পড়া সমাজের সেই বঞ্চনা এবং নিষ্পেষণকেই বর্ণনা করেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রানারকে প্রতিভূ করে। ডাক ব্যবস্থা যত সংঘঠিত হতে থাকে এবং বিস্তারলাভ করতে থাকে ততই ডাক পরিবহনের উন্নতি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঘোড়ায় করে বা রানারের ঘাড়ে চেপে খুব বেশী পরিমাণে ডাক বহুদূর অব্দি নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সমগ্র ভারতবর্ষে সংঘঠিতভাবে ডাক ব্যবস্থার বিস্তার করতে গিয়ে কর্তা ব্যক্তিদের অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য হতে হয়। এরপরে দূরবর্তী জায়গায় ডাক পরিবহনের জন্য রেলকে মাধ্যম করা হয়। শুরু হয় রেলওয়ে মেল সার্ভিস। মনে করা যাক কোনো বার্তা বা চিঠি দার্জিলিং থেকে বারুইপুর পাঠাতে হবে, তাহলে প্রথমে সেটা দার্জিলিং থেকে সড়কপথে শিলিগুড়ি অব্দি নিয়ে আসা হবে, তারপরে রেলওয়ে মেল সার্ভিসের মাধ্যমে শিয়ালদহ হয়ে বারুইপুর অব্দি যাবে এবং শেষ ধাপে বারুইপুর ডাকঘর থেকে প্রাপকের কাছে বিলি করা হবে। পূর্বের অবস্থায় দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি অব্দি এক বা একাধিক রানার ডাক পরিবহনের কাজ করতো, আবার বারুইপুর রেল স্টেশন থেকে বারুইপুর ডাকঘর অব্দি কোনো রানার ডাক পরিবহনের কাজ করতো। পরবর্তীতে চিঠির পরিমাণ বেশী হওয়ার কারণে রানারের পক্ষে সেই পরিমাণ ডাক বহন করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে এবং দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি স্থানীয় বিভিন্নরকমের পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্য নেওয়া হয়। আবার সেই একই কারণে বারুইপুর রেল স্টেশন থেকে বারুইপুর ডাকঘর অব্দি স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্য নেওয়া হয়। আরও পরে দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি অব্দি ডাক পরিবহনের জন্য ডাক বিভাগের নিজস্ব গাড়ীকে কাজে লাগানো হয়, যাকে আমরা ডাক বিভাগের মেল মোটর সার্ভিস নামে চিনি। কিন্তু বারুইপুর রেল স্টেশন থেকে বারুইপুর ডাকঘর অব্দি দূরত্ব খুব কম হওয়ার কারণে স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্যে কোনো একজন রানার আজও ডাক পরিবহন করে চলেছে। আরও পরে ডাক পরিবহনের সুবিধার জন্য এবং আরও দ্রুত পরিবহনের জন্য বার্তার বা চিঠির শ্রেণীবিভাগ করা হয়। পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার, খাম ইত্যাদিকে প্রথম শ্রেণীর ডাক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। রেজিস্ট্রি বা পার্সেলকে দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রথম শ্রেণীর ডাককে দ্রুততার সাথে দূরবর্তী জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিমানের সাহায্য নেওয়া হয়। বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের মধ্যে ভারতবর্ষেই প্রথম এই পরিষেবা চালু হয়েছিলো। ১৯১১ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ থেকে নাইনি অব্দি ১১ মাইল বা ১৮ কিলোমিটার রাস্তায় সর্বপ্রথম এয়ারমেল বিমান চলাচল করেছিল, সময় লেগেছিল ২৭ মিনিট। প্রায় ১৫ কিলোগ্রাম মেল পরিবহন করা হয়েছিল। আগের উদাহরণের জের টেনে বলা যায় শিলিগুড়ি থেকে বারুইপুর শিয়ালদহ হয়ে রেলওয়ে মেল সার্ভিসের মাধ্যমে না গিয়ে বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে কলকাতা বিমানবন্দর অব্দি বিমানে আসবে চিঠিটি, যদি সেটা প্রথম শ্রেণীর ডাক হয়। নতুবা যেমন আগের ক্ষেত্রে ট্রেনে এসেছিল তেমনিই আসবে। অর্থাৎ চিঠিটি ডাকঘরে আসার জায়গা থেকে বিলির জায়গার মাঝে যদি গোটা রাস্তা বা মাঝের কিছু রাস্তাতেও বিমান পরিষেবা চালু থাকে তাহলে প্রথম শ্রেণীর ডাকের ক্ষেত্রে বিমান পরিষেবা দেওয়া হবে। ফলে চিঠিটি গন্তব্যে পৌঁছতে অনেক কম সময় নেবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাকের ক্ষেত্রে কিন্তু রেলওয়ে মেল সার্ভিসের সাহায্য নেওয়া বহাল থাকে। আসল কারণ চিঠির ওজন, বিমান পরিষেবার ক্ষেত্রে যেমন ডাক বিভাগের অনেক বেশী মাশুল দিতে হয় তেমনি ওজন কম থাকার কারণে অনেক বেশী সংখ্যক চিঠি পরিবহন করে নিতে পারে ডাক বিভাগ। এইভাবে চলেছে দীর্ঘকাল। ডাক ব্যবস্থার সংঘঠিত চেহারার সময়কালে এবং সময়ের সাথে সাথে এই সংঘঠিত চেহারার রূপও পরিবর্তিত হয়েছে। মাঝে দেশ স্বাধীন হয়েছে, ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্থান এবং পূর্ব পাকিস্থান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) নামের আলাদা রাষ্ট্র তৈরী হয়েছে। ফলে ডাক ব্যবস্থার আওতা থেকে অনেক অংশটাই বেড়িয়ে গেছে, সেই রাষ্ট্রের নিজস্ব ডাক ব্যবস্থা তৈরী হয়েছে। কলকাতা থেকে কাবুল অব্দি ডাক চলাচলের চিন্তা আর ভারতীয় ডাক বিভাগকে করতে হয়না, কারণ সেটা এখন আন্তর্জাতিক ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেই ব্যবস্থার যতটুকু ভারতীয় ডাক বিভাগের করার কথা সেইটুকু করলেই হয়। তেমনি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতীয় ডাক বিভাগকে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তর অব্দি পৌঁছতে হয়েছে ধীরে ধীরে। দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় ডাক পরিষেবা চালু করতে হয়েছে, কারণ ক্রমবর্ধমান জনবসতি এবং জনবিস্ফোরণ। ডাক পরিবহনের নতুন নতুন যাত্রাপথ তৈরী করতে হয়েছে। পাশাপাশি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এবং জনসাধারণের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নিত্যনতুন পরিষেবার আমদানি করতে হয়েছে ডাক বিভাগকে।
মানুষের প্রয়োজনের কারণে যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক ডাক সংঘের (Universal Postal Union) চাহিদামতো পরবর্তীতে স্পিড পোস্ট সার্ভিস, এক্সপ্রেস কার্গো সার্ভিস ইত্যাদির প্রচলন করেছে ডাক বিভাগ। স্পিড পোস্ট পরিষেবা চালু করার পরে ডাক পরিবহনের বিপুল পরিবর্তন আনতে হয়েছে কারণ ডাক বিভাগকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিঠি বিলির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হয়েছে। আবার নাগরিক সনদ (citizen charter) অনুযায়ীও ডাক বিভাগ বিভিন্ন পরিষেবা বিভিন্ন রকমের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রদান করতে বাধ্য। মাঝের অনেকটা সময়ে ডাক পরিবহন গতানুগতিক হয়ে পড়লেও স্পিড পোস্ট সার্ভিস চালু হওয়ার পরে ডাক পরিবহনের যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। অতি দ্রুততার সাথে বুকিং অফিস থেকে ডেলিভারী অফিস অব্দি কোনো চিঠির যাত্রা নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন রকমের অত্যাধুনিক কারিগরী ব্যবস্থারও সাহায্য নেওয়া হয় চিঠির তাৎক্ষণিক অবস্থান জানার জন্য। ডাক পরিবহনে গতি এলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণীর ডাকের মধ্যে। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির কারণে প্রথম শ্রেণীর ডাক দিনে দিনে কমে আসছিল, শুধুমাত্র স্পিড পোস্ট পরিষেবার আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি হচ্ছিল। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাককে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিলো। আবার গোটা দুনিয়ায় কার্গো পরিষেবা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে শুধুমাত্র কার্গো পরিবহনের জন্য বিমান পরিষেবা চালু হয়ে গিয়েছিল। ডাক বিভাগ এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শুরু করে পার্সেল পরিষেবা। পার্সেলের দ্রুত পরিবহনের জন্য যেমন একদিকে বিমান পরিষেবার সাহায্য নেওয়া হয় তেমনি ডাক বিভাগ চালু করে রোড ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক সার্ভিস। এই সার্ভিসে এক রাজ্যের রাজধানী থেকে অন্য রাজ্যের রাজধানী পর্যন্ত গাড়ীতে করে ডাক পরিবহন করা হয়, সেখানে প্রথম শ্রেণীর চিঠি যেমন থাকে তেমনি দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাকও থাকে। আবার প্রয়োজন পড়লে অতিরিক্ত গাড়ীর ব্যবস্থাও করা হয়। কোভিডের সময় থেকে ডাক বিভাগ শুরু করেছে ওষুধ থেকে বিভিন্ন রকমের চিকিৎসার সংরঞ্জাম এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ, তা সে পি,পি,ই কিট হোক বা ভেন্টিলেশন মেশিন যাই হোক না কেনো। ফলে দ্রুততার সাথে দ্বিতীয় শ্রেণীর ডাক পরিবহন শুরু হয়। পাশাপাশি অতি সম্প্রতি রেলের সাথে যৌথভাবে চালু হয়েছে এক্সপ্রেস কার্গো সার্ভিস। যেখানে শুধুমাত্র পার্সেল পরিবহন করা হয় এক জায়গা থেকে দূরবর্তী কোনো জায়গায়। বর্তমান সময়ে পার্সেলের আধিক্যের কারণে কার্গো বিমানের মতো রেলও চালু করেছে কার্গো ট্রেন। চূড়ান্তমাত্রার সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় জি,পি,এস এবং ও,টি,পি নির্ভর তালা। যে তালা নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় খোলা যায়না আবার যিনি সেই তালা খোলার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই লোকের মোবাইলে ও,টি,পি যায় এবং সেই ও,টি,পি ছাড়া সেই তালা খোলা যায়না। অর্থাৎ দ্রুত ডাক পরিবহনের জন্য বর্তমানে বিমান, রেল এবং রোড ট্রান্সপোর্ট তিনটি মাধ্যমেরই সাহায্য নিচ্ছে ডাক বিভাগ।
পাশাপাশি কিন্তু সেই রানার ব্যবস্থাও চালু আছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় প্রচুর নদীর কারণে নৌকাতে ডাক পরিবহন হয় এখনও। ভারতবর্ষের অনেক জায়গাতেই এখনও নৌকা চালু আছে ডাক পরিবহনের জন্য। ধরা যাক কলকাতা জি,পি,ও থেকে একটি চিঠি পোস্ট হয়েছে যার গন্তব্যস্থল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ছোট মোল্লাখালি। চিঠিটি বিকেলবেলায় কলকাতা জি,পি,ও থেকে প্রথমে আসবে কলকাতা আর,এম,এস - এ, সেখান থেকে সন্ধ্যে বা রাত্রের মধ্যে যাবে শিয়ালদহ আর,এম,এস - এ। পরেরদিন ভোরবেলায় শিয়ালদহ আর, এম, এস থেকে লোকাল ট্রেনে সকাল আটটা, সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছবে ক্যানিং স্টেশন। সেখান থেকে স্থানীয় ডাক রানার নিয়ে যাবে ক্যানিং পোস্ট অফিসে। সেখান থেকে আবার ডাক রানার নিয়ে যাবে নৌকাযোগে ডুগডুগী বাজার অব্দি। সেখান থেকে সড়কপথে যাবে বড় মোল্লাখালি ফেরিঘাট অব্দি। বড় মোল্লাখালি ফেরিঘাট থেকে আবার নৌকাযোগে প্রায় ১২ কিলোমিটার জলপথ পেড়িয়ে চিঠিটি পৌঁছবে ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিসে। তখন বিদ্যাধরী নদীর পশ্চিমে সূর্য প্রায় অস্তাচলে। পরেরদিন প্রাপকের হাতে পৌঁছে যাবে চিঠিটি, অর্থাৎ জি,পি,ও - তে চিঠিটি পোস্ট হওয়ার দুদিনের মধ্যে প্রাপকের হাতে পৌঁছবে। দূরত্ব খুব বিশেষ নয়, কিন্তু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এবং নদীপথের জোয়ার, ভাটার কারণে ক্যানিং থেকে ছোট মোল্লাখালি পৌঁছনো ডাক বিভাগের কাছে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা। আগে ক্যানিং থেকে একজন রানার বিদ্যাধরী নদী বরাবর নৌকাযোগে প্রায় সাত আট ঘণ্টা যাওয়ার পরে সেই ডাক ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিসে পৌঁছত। আবার ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিস থেকে আর একজন রানার ওই একই নদীপথে ক্যানিংয়ে পৌঁছত। কারণ একজনের পক্ষে গিয়ে একদিনে ফিরে আসা সম্ভব নয় কিছুতেই। ফলে যে চিঠি ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিসে পোস্ট হচ্ছে, সেই চিঠি যেমন শিয়ালদহ আর,এম,এসে পৌঁছতে তিনদিন লাগতো তেমনি যেসব চিঠি ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিস থেকে বিলি করতে হবে সেইসব চিঠিও ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিসে তিনদিনের আগে পৌঁছত না। পরবর্তীতে দুইজন রানার দুইদিক থেকে যাত্রা শুরু করে মধ্যবর্তী রাস্তায় ডাক আদানপ্রদান করে, ফলে ডাক পরিবহনে একদিন কম সময় লাগে। এতে ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিসে পোস্ট হওয়া চিঠি যেমন, তেমনি ছোট মোল্লাখালি পোস্ট অফিস থেকে যে চিঠি বিলি হবে সেগুলোও, সবক্ষেত্রেই একদিনের লাভ হয় প্রেরক এবং প্রাপকের। আবার ধরা যাক কোনো চিঠি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর পোস্ট অফিসে পোস্ট করা হয়েছে যার গন্তব্যস্থল কপিলমুনির আশ্রম। তাহলে চিঠিটি সন্ধ্যার মধ্যে বহরমপুর পোস্ট অফিস থেকে বহরমপুর আর,এম,এসে পৌঁছে যাবে, রাত্রের ট্রেনের মাধ্যমে ভোরবেলায় শিয়ালদহ আর,এম,এসে পৌঁছে যাবে। যেহেতু ভোরবেলাতেই শিয়ালদহ থেকে নামখানা যাওয়ার ট্রেনে আর,এম,এস চলে তাই সেইদিন চিঠিটি গন্তব্যের দিকে আর এগোতে পারবে না। পরেরদিন সেই চিঠিটি শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ পৌঁছে যাবে আর,এম,এসের মাধ্যমে। কাকদ্বীপ পোস্ট অফিস থেকে ইঞ্জিন ভ্যানে চেপে পৌঁছে যাবে হুগলি নদীর লট - ৮ ঘাটে। সেই ঘাটে ভেসেলে করে প্রায় একঘন্টায় হুগলি নদী পেরিয়ে ওপারে সাগরদ্বীপে পৌঁছবে। সেখান থেকে আবার ইঞ্জিন ভ্যান করে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সেই চিঠি পৌঁছবে রুদ্রনগর পোস্ট অফিসে। এরপরে রুদ্রনগর পোস্ট অফিস থেকে রানার সাইকেলে করে নিয়ে যাবে সাগর ব্র্যাঞ্চ পোস্ট অফিসে। তারপরে বিলি হবে কপিলমুনির আশ্রমে। তখন বঙ্গোপসাগরের কোলে সূর্যের লালাভ রূপে চতুর্দিক রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে। আবার ধরা যাক কলকাতা জি,পি,ওতে কোনো চিঠি পোস্ট হয়েছে যার গন্তব্যস্থল দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবন। তাহলে চিঠিটি বিকেলবেলায় কলকাতা জি,পি,ও থেকে মেল মোটর সার্ভিসের গাড়ী করে সরাসরি কলকাতা বিমান বন্দরের কাছে অবস্থিত কলকাতা এয়ারপোর্ট সর্টিং অফিসে যাবে। সেখান থেকে রাত্রিবেলার বিমানে চেপে সোজা দিল্লী বিমান বন্দরে পৌঁছবে। সেখান থেকে ভোরবেলায় আবার মেল মোটর সার্ভিসের গাড়ী করে সোজা রাষ্ট্রপতি ভবন পোস্ট অফিস এবং সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে বিলি হবে চিঠিটি। অর্থাৎ, গ্রাহকের সুবিধার জন্য যেখানে যেভাবে দ্রুততার সাথে পৌঁছানো সম্ভব সেইভাবেই গড়ে উঠেছে ডাক পরিবহন ব্যবস্থা। ভৌগলিক প্রতিবন্ধকতা আছে অনেক জায়গাতেই, আবার ডাক পরিবহন ব্যবস্থাকে অনেকটাই রেল এবং বিমানের ওপর ভরসা করতে হয় বলে তাদের সময়সূচী অনুযায়ী চলতে হয় ডাক বিভাগকে। ফলে কিছুটা দেরী মেনে নিতে হয়। যেমন বহরমপুর থেকে চিঠিটা যখন শিয়ালদহতে পৌঁছয় তার কিছুটা পরেই শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং বা কাকদ্বীপের ট্রেন থাকার কারণে চিঠিটি গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে অনাবশ্যক একদিন দেরী হয়ে যায়। হিঙ্গলগঞ্জ, হাটগাছা, সন্দেশখালি, যোগেশগঞ্জ, পাথরপ্রতিমা, পাঠানখালি, ছোট মোল্লাখালি, গোসাবা, রুদ্রনগর, নামখানা, কাকদ্বীপ, মথুরাপুর ইত্যাদি এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নদীর আধিক্যের কারণে খুবই অনুন্নত। ফলে এইসমস্ত পোস্ট অফিসগুলো (কাকদ্বীপ, নামখানা, মথুরাপুরে রেল পরিষেবা আছে বলে শুধুমাত্র এইসব গ্রাম বা আধা শহরগুলোতে খুব একটা অসুবিধা হয় না) এবং এদের অধীনে থাকা ব্র্যাঞ্চ পোস্ট অফিসগুলোতে ডাক পরিবহন করা এবং যথা সময়ে ডাক বিলি করা ডাক বিভাগের কাছে নিত্যদিনের অসহায়তা।
রানারের হাতে বর্ষা বা বল্লম এখন আর দেখা যায়না, রাতের অন্ধকারে ঝুম - ঝুম ঘন্টার আওয়াজও আর পাওয়া যায়না, তবু রানার আজও আছে দেশের সর্বত্র। বেশীরভাগ রানার এখন সাইকেলে চেপে যাতায়াত করে, দিনের বেলায় এবং খুব একটা বেশীদুর যেতে হয়না তাদের। পাশাপাশি নদীবহুল এলাকায় রানারের যাত্রাপথে নদী থাকলে তাকে নৌকায় নদী পেরোতে হয়। কোথাও আবার ঘন্টার পর ঘন্টা নৌকায় চেপে নদীপথে পাড়ি জমাতে হয়। খুব একটা চোখে না পড়লেও রানাররা কোথাও কোথাও এখনও পায়ে হেঁটে ডাক পরিবহন করে। তেমনি পাহাড়ি এলাকা বা মরুভূমি এলাকায় বা কোনো দুর্গম এলাকায় রানারকে ঘোড়া বা ঘোড়ার গাড়ী বা উটের পিঠেও চাপতে হয় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ডাক পৌঁছে দিতে। সবুজ, হলুদে ভরা পাহাড়ের দেশে বা নদীতে ঘেরা পলাশের আগুনে রাঙানো সবুজ গ্রামগুলোতে যেন সবকিছুই প্রাকৃতিক, যান্ত্রিকতার স্থান নেই সেখানে। প্রকৃতিকে বশ মানিয়ে সেই জায়গাগুলোয় আমরা এখনও কেউই যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগাতে পারিনি। যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে এখনও সেই মানুষগুলো মুক্ত। শান্তির নীড়, ছায়া সুনিবিড় সেই প্রান্তরগুলো ভরা থাক রাতের সুমিষ্ট জোছনায়, ভোরের লাল আবিরে আর দিনের রৌদ্রছায়ায়। কাঁধে চিঠির ভারে ন্যুব্জ রানার গুটি গুটি পায়ে ছুটে চলুক নতুন কোনো বসন্তের খবর নিয়ে। আমাদের জন্য বিমান, রেলগাড়ী ছুটে চলুক জীবনদায়ী ওষুধ কিংবা ভেন্টিলেশনের কোনো যন্ত্রপাতি নিয়ে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।