মানসাই
প্রতিভা সরকার
কারুবাসা প্রকাশনী
মূল্য তিনশো টাকা
এই লেখা কোনো রিভিউ নয়। ঠিক এক সপ্তাহ আগে পড়া বইটির পাঠপ্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে; চেষ্টা করছি , এই উপন্যাসের যে বৈশিষ্ট্যগুলি আমার কাছে ধরা দিয়েছে, তা লিখে রাখার।
"সময় -ধারাকে খুব স্পষ্ট ধরবার মতো কোনো যন্ত্র থাকলে তা থেকে যে ছবি বেরোত তার চেহারা অনেকটা ইকোকার্ডিওগ্রাম রিপোর্টের মতো হত বোধহয়। ঢেউয়ের মতো কোথাও উঠছে, একেবারে উত্তল, তো পর মুহূর্তেই অবতল। আবার ছোট ছোট ঢেউয়ের খাঁজখোঁজগুলো ও বেশ স্পষ্ট"- মানসাই, পৃষ্ঠা ৭৬। শ্রীমতী প্রতিভা সরকারের "মানসাই" উপন্যাসপাঠ শেষে উপরের লাইনগুলি ফিরে পড়লাম যেন আমাকে এই উপন্যাসটিকে থীম ধরে ছবি আঁকতে বলা হয়েছে, যেন আমার সামনে শূন্য ক্যানভাস- রেখা ফুটে ওঠার অপেক্ষায়।
আমরা জানি, মানসাই একটি নদী- উত্তরবঙ্গে জলঢাকা আর মুজনাই নদীর মিলিত প্রবাহ। এই নামেই রাজবংশী ভাষায় একটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে - এও জেনেছি। এ নদীর চির সজীবতা ও জলজ প্রাণগুলির অভিনবত্ব বাঙালীর লেখাপত্রে কতটুকু ধরা আছে, গবেষক তা বলবেন। ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিভার দুটি ছোটোগল্পে এ নদীর উল্লেখ পেয়েছিলাম- 'দাঙ্গা পরবর্তী ' ও 'সহোদরা' য়। মানসাই যেন শুধুই ব্যাকড্রপ ছিল গল্পদুটির, কিন্তু এই উপন্যাসে এই নদী , এই জনপদ তার ভাষা, তার সংস্কৃতি এবং ঐ কালখণ্ডের যতেক অস্থিরতা ধারণ করে নিজেই মুখ্য চরিত্র; এই মহান বহমানতার অংশ মনুষ্য চরিত্রগুলি, তাদের জন্ম মৃত্যু, ভালোবাসা, রাজনৈতিক বিশ্বাস।
গত শতকের ছয়ের ও সাতের দশকে বাংলার রাজনৈতিক অস্থিরতা সর্বজনবিদিত। স্বাভাবিকভাবেই, এই পটভূমিকায় বহু গল্প উপন্যাস রয়েছে- নামোল্লেখ বাতুলতা এক্ষেত্রে। অথচ 'মানসাই'কে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না পাঠকের। প্রতিভার আখ্যানের স্বাতন্ত্র্য, আমার মতে, লেখার চলনে, পটভূমিতে, ভাষায় এবং সেই অর্থে নায়ক নায়িকার অনুপস্থিতিতে।
একটি ভয়াবহ গুপ্তহত্যায় যে কাহিনী শুরু হচ্ছে, 'জনপ্রিয়' আখ্যানের ধারা অনুযায়ী তার চলন হতেই পারত রুদ্ধশ্বাস , থ্রিলারধর্মী। লেখক অতীব দক্ষতায় চলনটি ইকোকার্ডিওগ্রামের রিপোর্টের আদলে রেখেছেন- উত্তল, অবতল, আবার শান্ত- জীবন যে রকম। অস্থির সময়ের উত্তেজনা তিনি অসীম নৈপুণ্যে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এই আখ্যানে অথচ অভিঘাত তীক্ষ্ণতা হারায় না বিন্দুমাত্র। রাজনৈতিক গুপ্তহত্যাটির অবশ্যম্ভাবিতায় তিনি পাঠককে অভ্যস্ত করান উপন্যাসের শুরু থেকেই, ফলত পাঠক অংশ হয়ে যান প্রীতির উদ্বেগের, দুশ্চিন্তার। বস্তুত পাঠক এইখানেই উপন্যাসটির জীবনলগ্নতাকে চিনে নেন। ঘটনাপ্রবাহ কালানুক্রমিক- নদীর স্রোতের মতৈ- একমুখী, অবশ্যম্ভাবিতার দিকে ধেয়ে চলে।
আখ্যান এই ক্ষুদ্র জনপদটির ভৌগোলিক গণ্ডী ছাড়ায় নি, অথচ বহির্বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ লেখকের ধারাভাষ্যে আগাগোড়া ধরা থাকে- ডকুফিকশনের জনরা উঁকি দিয়ে যায় রচনায়।
উপন্যাসের ভাষা স্বতন্ত্র উল্লেখ দাবি করে । প্রমিত , কথ্য , আঞ্চলিক ভাষার অনবদ্য নকশা এই উপন্যাস জুড়ে। যেমন ধরুন, 'আজকে এই বিসর্জনের ভিড়ে, বহু লোকের আনন্দ কোলাহলে সেদিন মঞ্চের ওপর অভিনীত নৃত্যনাট্যের শেষ দৃশ্যের গভীর ব্যঞ্জনা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আকাশ বাতাস পূর্ণ করে সেই বীণা ঝংকারের মতো কণ্ঠ অনুরণিত হচ্ছে না'র মতো প্যারাগ্রাফটির পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষা 'দশমী আউজগা? হায় ভগবান, অন্ধের কিবা দিন, কিবা রাত্র! বাইচা আছি ক্যান কেডা জানে!', বা আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথন 'মোর বাপৈটা ফিরি আসিল। এতদিন কুন্ঠে ছিলু রে বাপৈ' - অক্লেশে লিখে গেছেন প্রতিভা এই আখ্যান জুড়ে।
আশ্চর্য কিছু উপমা মনে থেকে যায়- যা কখনও কাব্যিক কখনও এমন জ্যান্ত যেন হাতে নিলে খলবল করে উঠবে সে সব শব্দ। যেমনঃ ' সদ্য ধরা জ্যান্ত মাছের মতো উলসে উলসে উঠছিল হামিদুল'- এইখানে উলসে শব্দের ব্যবহার এমনই সুপ্রযুক্ত যেন ছাপা অক্ষরগুলি হামিদুলকেই সশরীর নির্মাণ করে ফেলে চোখের সামনে। বা , 'পুরোনো কিছু সম্পর্ক জিগা গাছের আঠার মতই লেপ্টে রয়েছে তার সঙ্গে' র মতো লাইন। আবার এই লাইনগুলির কাব্যময়তা পাঠকমনকে ছেয়ে ফেলে কেমন দেখুনঃ 'উৎসব মিটে গেলেও সর্বত্র তার একটা রেশ থেকে যাউয়। এযেন হঠাৎ কেউ কাঁচি দিয়ে নিপুণ কেটে দিয়েছে ফিতে, কিম্বা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেছে মাঝের বিরাট দরজা, কিছুক্ষণ আগের আলো ঝলমলে মুখরিত নদীপার আর এই অন্ধকারে ডুবে থাকা জল ও বালুচরকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না।'
ডিটেইলিংয়ের অসাধারণ সব কাজ রয়েছে আখ্যানেঃ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া মৃতদেহর মশারির চালে রোদ আড়াল করা চার ভাঁজ নকশি কাঁথাটি, রাসমেলার মাঠের বিবরণ....
উপন্যাসের কাহিনী যে পরিবারটিকে ঘিরে আবর্তিত, তার কেন্দ্রে প্রীতিলতা - যতেক শোক ও বিপর্যয়ের মধ্যেও যিনি নবীনকে দুই হাত বাড়িয়ে বরণ করে নিচ্ছেন; প্রীতিকে পাঠক দুঃখবেদনা জর্জরিত দেশের প্রতীক হিসেবেও দেখতে পারেন।
অন্যান্য যে চরিত্রগুলি এই আখ্যানে উপস্থিত- প্রতিভা কখনও তাঁদের হাইলাইট করেছেন, কখনও আউট অফ ফোকাসে রেখেছেন- ফলত একটি অনন্য বুনন তৈরি হয়েছে, যেখনে প্রতিটি সুতোর গুছি কখনও সামনে আসে , নকশার প্রয়োজনে পিছনে চলে যায় আবার।
আমার সামনের ক্যানভাসে এবারে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে ছবি। একটি কালচে লাইন যেন ফুটে উঠছে, সরলরেখা নয়, কোথাও উত্তল, কোথাও অবতল; একটি রেখার পাশে আরো রেখা ফুটলো ক্যানভাসে, কালো রেখা বদলে গেল নীলে, দুপাশে সবুজের পোঁচ পড়ল তারপর- সেই সব সবুজ রঙে ঘর বাড়ি মানুষজনের আদল স্পষ্ট হচ্ছিল; স্থির ক্যানভাস তারপর বদলে গেল চলচ্ছবিতে- লং শটে বহমান মানসাই নদী, দুপাশে জনপদ। ক্যামেরা প্যান করল মসৃণ- দুপাশে জনপদ, প্রবাহমানতার থেকে কেটে নেওয়া সময়ের খণ্ড- গত শতকের ছয়ের দশক শেষ হচ্ছে, সাতের দশক শুরু হল। ক্লোজ আপে মানসাই- বয়ে চলেছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।