এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিস্মৃত নটসম্রাট শান্তিগোপাল (১ম পর্ব)

    রজত দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ নভেম্বর ২০২২ | ৮৯৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • গত শতকের সাতের দশকের শুরুর বছরগুলি। গ্রাম বাংলা দাপিয়ে হইহই করে চলেছে যাত্রা সম্রাট শান্তিগোপালের কালজয়ী পালা 'লেনিন'। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীতের পাশাপাশি এই যাত্রায় ছিল আরও ১০ টি গান। গ্রামীণ বাংলার আমজনতার মুখে মুখে ঘুরছে এই গানগুলি। স্বচ্ছল গৃহস্থ কিনে নিয়ে যাচ্ছে এলপি রেকর্ড। 'লেনিনের' এই তুমুল জনপ্রিয়তার খবর পৌঁছে গেল মস্কোতে।
     
    'লেনিনে'র গান ছড়িয়ে পড়ল খোদ 'লেনিনে'র দেশে 
     
    সোভিয়েত প্রশাসন 'লেনিনে'র হাজার হাজার এলপি রেকর্ড ভারত থেকে রাশিয়া নিয়ে গেল। শান্তিগোপালের লেনিনে'র গান ছড়িয়ে পড়ল খোদ 'লেনিনে'র দেশে। একই সঙ্গে উত্তর কলকাতার প্রশান্ত ভট্টাচার্যের সুর বাংলার সীমা ছাড়িয়ে পড়ল রুশ দেশের কমিউনে। সত্তরের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে তরুণ প্রশান্তই শান্তিগোপালের 'লেনিনে'র তুমুল জনপ্রিয় গানগুলির সুরকার ছিলেন। শুধু 'লেনিন' নয়, তিনি দুশোর বেশি যাত্রায় সুর দিয়ে ছিলেন। গানও গেয়েছেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে সংগীতের পাঠ নেওয়া প্রশান্ত ভট্টাচার্য।
     
    বছরের পর বছর বাংলার যাত্রা রসিক জনতার মুখে মুখে ফিরেছেন শান্তিগোপালের বিখ্যাত বহু যাত্রার গান। যে গানগুলির অধিকাংশের সুর দিয়ে ছিলেন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। এই নেটফ্লিকস, অ্যামাজন প্রাইমের জমানায় যাত্রা এখন অস্তিত্ব রক্ষার শেষ লড়াই লড়ছে। 'লেনিন', 'হিটলার', 'আমি সুভাষ বলছি' মঞ্চ কাঁপানো এইরকম যাত্রার নাম আর শোনা যায় না। যাত্রাপালার ভয়ঙ্কর এই দুর্দিনে শান্তিগোপাল অভিনীত সেইসব বহু বিখ্যাত যাত্রার গান যদি একবার শোনার সুযোগ হত শহরের নাগরিকদের। পরখ করে দেখা যেত মানুষের রুচিবোধের। শিল্প পিপাসার।

    বেশ কিছু বছর আগে আইসিসির একটি অনুষ্ঠানে ষাট সত্তর দশকের বিখ্যাত বহু যাত্রার স্মৃতিমেদুর গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন সে দিনের টগবগে তরুন, তখন বয়সের ভারে নুব্জ খোদ প্রশান্ত ভট্টাচার্য। গানের পাশাপাশি শুনিয়ে ছিলেন টুকরো টুকরো অনেক গল্প। যাত্রার পাশাপাশি দীর্ঘদিন পেশাদার থিয়েটারেও সুর সংযোজন করে ছিলেন তিনি। সেই পেশাদার মঞ্চের আলো নিভে গেছে অনেক বছর আগেই। শেষ সুর দিয়েছিলেন ন'য়ের দশকের শুরুতে মিস শেফালি অভিনীত একটি থিয়েটারে।
     
    শান্তিগোপাল, যিনি ইতিহাসের পাতা থেকে জীবন্ত ব্যক্তিত্ব নিয়ে এসে ছিলেন। তিনি জোরের সাথে বলতেন যে, "আমি যে কোনো ভূমিকায় অভিনয় করার সময় 'আমদানি করা মুখোশ বা বিশেষ প্রসাধন সামগ্রী' ব্যবহার করিনি। আমি সবসময় সহজলভ্য মেক-আপ কিট ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমি খুব যত্ন নিয়ে মুখাবয়বের লাইনগুলি আঁকতে যা আসলের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করে। বা মুখের বলিরেখা, ভ্রুর তির্যক, ঠোঁটের কার্ভ... যা ধীরে ধীরে চরিত্রটিকে গড়ে তুলতে সাহায্য করত। এতো গেল মেকআপের বিষয়। সবচেয়ে জোর দিতাম, মূল ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দেহের ভাষাগুলো অভিনয়ের দ্বারা ফুটিয়ে তুলতে।”
     
    শান্তিগোপাল ১৯৫৮ সালে একটি অপেশাদার থিয়েটার গ্রুপ থেকে যাত্রা মঞ্চে এসেছিলেন জীবিকা উপার্জনের জন্য। সেই সময়ে উনি রয়্যাল বিনাপানি অপেরায় যোগ দেন। যেখানে বড় ফনি এবং পাঁচু সেনের মতো যাত্রা কিংবদন্তিরা রাজত্ব করতেন। দশ বছর পর, তিনি নিজের দল অর্থাৎ "তরুণ অপেরা" গঠন করেন। এবং শম্ভু বাগের লেখা "হিটলার" মঞ্চস্থ করেন।

    ১৯৮৪ সালে শিব ভট্টাচার্য মারা যাওয়ার পর তরুণ অপেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শান্তিগোপাল বাবুর কথায়, “তিনি আমার বাবার মতো ছিলেন। শিবুবাবুই আমার দল পরিচালনা করেছিলেন। তাঁকে ছাড়া, আমি দল চালিয়ে যেতে পারতাম না… এখন, আমার বন্ধুরা এবং পাড়ার ছেলেরা আমাকে মঞ্চে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চায়।” কথাগুলো বলে ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী শান্তিগোপাল। হিটলারের মতো মেকআপে নিজের একটি ছবির দিকে তাকিয়ে।
     
    সেই সময়টিতে আবার হিটলার হওয়ার জন্য শান্তিগোপাল, ফুয়েরারের আত্মজীবনী, মেইন ক্যাম্প এবং বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বই, উইলিয়াম শিরার্স এর লেখা রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য থার্ড রাইখ-এর মতো বইগুলোর সৌজন্যে স্বৈরশাসকের মানসিকতার মধ্যে তলিয়ে যেতেন।

    গত শতকের সাতের দশকের শুরুর বছরগুলি। গ্রাম বাংলা দাপিয়ে হইহই করে চলেছে যাত্রা সম্রাট শান্তিগোপালের কালজয়ী পালা 'লেনিন'। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীতের পাশাপাশি এই যাত্রায় ছিল আরও ১০ টি গান। গ্রামীণ বাংলার আমজনতার মুখে মুখে ঘুরছে এই গানগুলি। স্বচ্ছল গৃহস্থ কিনে নিয়ে যাচ্ছে এলপি রেকর্ড। 'লেনিনের' এই তুমুল জনপ্রিয়তার খবর পৌঁছে গেল মস্কোতে।

    _____________(ক্রমশ)
    © রজত দাস

    ________

    ঋণ স্বীকার:- টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান, যুগান্তর, বর্তমান, প্রতিদিন ও আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাচীন সংখ্যা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sas | 84.106.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২২ ১৮:২৫513636
  • ভালো লেখা 
    শান্তি গোপাল এর কোনো যাত্রাপালার বা কোনো অভিনয়ের রেকর্ডিং কি যাচ্ছে 
  • Sas | 84.106.***.*** | ০৯ নভেম্বর ২০২২ ১৮:২৫513637
  • ভালো লেখা 
    শান্তি গোপাল এর কোনো যাত্রাপালার বা কোনো অভিনয়ের রেকর্ডিং কি  আছে ?
  • রজত দাস | ০৯ নভেম্বর ২০২২ ১৯:০৮513640
  • Sas@ অনেক চেষ্টা করেও ওঁর অভিনয়ের কোনো ভিডিও জোগাড় করতে পারিনি। কারোর কাছে থাকলে আমায় অবশ্যই জানাবেন। অগ্রিম ধন্যবাদ।
  • Sara Man | ১০ নভেম্বর ২০২২ ০৯:৫৫513666
  • শান্তিগোপালের চেঙ্গিস খান যাত্রা পালায় - ইঁ-ইঁ-ইঁ-হা হা হা - হাসি আজও আমার কানে বাজে। 
  • Sobuj Chatterjee | ১০ নভেম্বর ২০২২ ২০:২৪513685
  • যাত্রাপালায় অনন্য এক মাত্রা আনয়ন করেছিলেন! ! এমন এক অভুতপূর্ব বৈশিষ্ট্যের চেহারা নাট্য জগতে বিরল!। মে চরিত্র ই হোক না, ফুল ফোটাতেন। ওনার বেশীর ভাগ পালা দেখেছি!। আমার কাছে অবিস্মরণীয় লেগেছে 'কার্ল মার্কস'!  পালাকার সম্ভবত অমর ঘোষ মহাশয়। আমি ভুল হতে পারি। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের সোনালী দিন সব! এই লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন