জোয়ারে নাকি সব নতুন ঢেউরা আসে। প্রথমে আসে ‘মা’ ঢেউ। হটাত করে হুরমুর করে উপরে উঠে এসে পারের বালি ভিজিয়ে ফিরে চলে যায়। তারপর ছোট ছোট ঢেউগুলি আসে। একটা, দুটো, তিনটে আসতেই থাকে ওরা। অতটা উপরে উঠে আসতে পারে না। ফিরে যায়। মিলিয়ে যায়। আবার একটা বড় ঢেউ আসে।
সন্ধ্যা নামতে চলেছে। ঐ দিগন্তের জলের সীমানা ছুঁতে না ছুঁতেই সূর্যটা অদৃশ্য। তবে আকাশে এখনো অনেক আলো। আমাদের আরো কিছুক্ষণ নাকি অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটা আমাকে ঢেউগুলি নিয়ে আরো অনেক তত্ত্ব দিল। ভাঁটার সাথে সাথে নাকি পুরনো ঢেউ গুলো ফেরত চলে যায়।
কোথায় যায় ওরা?
কোথায় আবার। বাড়ি। ওরা সবাই নীচে নেমে যায় - ঐ আর একটু দূরে সমুদ্র যেখানে গভীর। ওরা ঘুমোতে যায়।
তাই?
তা নয় তো কি? ওদের তো আবার জোয়ারের ঢেউ হয়ে ফির আসতে হবে।
আর এরা?
এরা আবার ভাঁটা হয়ে ফিরে যাবে।
আরো একটা মা ঢেউ পারের অনেকটা অব্দি ছুটে এল। ও ফিরে যাবার পর ছোট ঢেউ আসে একটার পর একটা। মেয়েটি আমায় গুনে গুনে দেখিয়েছে – বারোটা, চোদ্দটা, আরো বেশি।
পারের সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছি আমরা। রঙ খেলছে জলে, পারের ভেজা বালিতে। লাল আর কিসের যেন কালো ছায়া সাথে সাথে। না দিন, না রাত। কি এক অদ্ভুত বিভ্রম।
মেয়েটির দৃষ্টি হটাত সতর্ক হয়ে উঠলো। কি দেখে সে? আমি ওর দৃষ্টি অনুসরন করি। মেয়েটি ফিস ফিস করে বলে, ঐ দেখো, মা ঢেউটার পেছন পেছন আসছে ও। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখি। আকাশের লাল আভা ঢেউগুলির মাথায়, ঢেউগুলির সাথে সাথে ভাঙ্গে, চমকায় ক্ষনিকের তরে। ব্যাস, আর তো কিছু দেখি না কিছু। জিজ্ঞেস করি, কোথায়?
মেয়েটি চাপা কণ্ঠে বলে, ও দেখছে আমাদের। একটা ছোট ঢেউয়ের পেছন পেছন আসছিল ও। আমাদের দেখে ডুব দিল। আবার আসবে সে। মেয়েটির স্বরে এক সতর্কতার সংকেত।
আকাশে এখনো আলো আছে। সন্ধ্যা তারা ফুটেছে। এদিকটার সমুদ্রে জেলেরা আসে না। মাছ নেই? নাকি পাথর চারপাশে তাই? জানিনা। তবে কেউ আসে না। আসা বারন। তবুও দুরন্ত ছেলের দল মাঝে মাঝে আসতো। বারন বলেই আসতো। গত বছর কোন এক বিকেলে জোয়ার লেগেছিল। ওরা খেলছিল বালির উপর। বল পরেছিল জলে। বল তুলতে গেছিল কেউ। কোন চিৎকার চ্যাঁচামেচি নয়, হাঁটুজলেই একটা ঢেউ ওকে নিয়ে হটাত অদৃশ্য। ঢেউয়ে বলটা নাচানাচি করছিল। গ্রামের লোকেরা এল। পুলিশ এল। একটা খাম্বা গেড়ে নোটিস লাগিয়ে দেওয়া হল, জলে নামা বারন।
বর্ষার জল ঝরে নোটিস বোর্ডটির এখন নাম নিশানা নেই। বর্ষা শেষ হওয়ার পর দুরন্ত ছেলের দল আবার আসতে আরম্ভ করল। কতবারই তো জলে পড়ে যায় ওদের বল, ঢেউ ফিরিয়ে দেয়। হাঁটুজলে বল ভাসে। টলমল টলমল করে। পারের দিকে আসে, আবার দুই পা পিছিয়ে যায়। এক সন্ধ্যায় গ্রামের আর একটি পরিবার তাদের ছেলে হারালো। তারপর থেকে আর কেউ আসে না। এলেও, হয়তো হতভাগ্য ছেলেটির প্রানের বন্ধুরা, দূরে কোন পাথরের উপর বসে বা কখনও এই আখরোট গাছটির নিচে ওরা সমুদ্রের দিকে চেয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে যায়।
তোমার ভয় করে না একা একা আসতে?
না তো। ও এতটা উপরে উঠে আসতে পারবেই না। ও পারে পারেই থাকে। কিন্তু সব দেখে ও। ও সন্ধ্যার একটু আগে আগেই আসে। সব দিন না, যখন জোয়ার লাগে সন্ধ্যায়। আমি তো জানি। ওরা খেলছিল ঐ বালিতে, সন্ধ্যার একটু আগে আগেই। সেদিন ছিল জোয়ার। বলটা তূলতে ভুমা নামলো জলে। ও তো অপেক্ষায় ছিল। ব্যাস, ওকে নিয়ে চলে গেল।
কেউ জানতে পারলো না?
কি করে জানবে? ও তো ......ঐ দেখো দেখো! ওই তো, ঢেউয়ের আড়ালে আড়ালে আসছে সে।
কোথায়?
শশশ.........। ভালো করে দেখো।
ঢেউএর পেছনে আর একটা ঢেউ। তার পেছন পেছন . .হটাত খেয়াল হল একটা কালো ঢেউ। না কালো তো নয়, স্লেটের রঙ; পেছন পেছন আসছে। পার অব্দি এল। তার সামনের ঢেউটির মত ভাঙ্গল না। ফেনা ঝরাল না। ফিরে যাচ্ছে এখন। যেতে যেতে একটা ডুব দিল। আর দেখা যাচ্ছে না।
দেখেছ? ফিসফিস করে বলে মেয়েটি।
আমি মাথা নাড়লাম।
ও কিন্তু দেখেছে আমায়।
তুমি ঠিক জানো ঐ কালো ঢেউ টাই..?
ঢেউ কেন হবে? ঢেউএর মত দেখতে এই যা।
ও ঢেউয়ের মত বাড়তে পারে, কমতে পারে। জেলিফিসগুলির মত ওর শরীর। শরীরটাকে যা ইচ্ছা করতে পারে।
তুমি কত কাছে গিয়ে দেখেছো?
নিরব মেয়েটি। কিছু বলে না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি ওকে কাছ থেকে দেখেছো?
হ্যাঁ। আমার সামনেই তো, আমার লায়লিকে নিয়ে চলে গেল।
ও দেখালো দূরে ডানদিকটায় পাহাড়ি জায়গাটা যেখানে বড় বড় গাছগুলিকে জংলী লতাপাতা গুলো ঢেকে ফেলেছে প্রায় ওখানে সে লায়লিকে নিয়ে যেত। লায়লির পছন্দের লতা পাতা ছিল যে জঙ্গলটাতে।
জিজ্ঞাসা করলাম সমুদ্র পারে নেমেছিল কেন ওরা?
এমনিই। জোয়ার লেগেছিল। কোন এক অজানা গাছের ডাল পড়েছিল চড়ায়। আগের জোয়ারেই বোধহয় সমুদ্র কোথাও থেকে নিয়ে এসে পারে ফেলে চলে গেছিল। হাঁটছিলাম আমরা – আমি আর লায়লা। ঢেউ উঠে এসে ডালটাকে ডুবিয়ে দিয়ে চলে যায়। লায়লা ওই ডালের পাতার গন্ধ শুঁকছিল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ওই খানটায় – ঐ বড় পাথরটার কাছে। হটাত দেখি একটা কালো ঢেউ উঠে আসছে। ফেরত ঢেউগুলির মাথার উপর দিয়ে কেমন বিনা বাধায় উঠে আসছে আমাদের দিকে। তখনই আমার মনে হল ও ঢেউ না। আমি অজান্তেই বেশ কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। লায়লা তখনও ডালটিকে নিয়ে রয়েছে। আর সে, অন্য ঢেউগুলির মত উঠে এসে লায়লার পাগুলিকে ডুবিয়ে, তারপর তার পুরো শরীরটাকে তালগোল পাকিয়ে জড়িয়ে ধরল। কি করে হটাত এতটা উপরে উঠে এল বুঝতে পারলাম না। ফিরে গেল। তারপরেই খেয়াল হল লায়লা নেই। একটা ছোট্ট ব্যা অব্দি করতে পারেনি সে। নিঃশব্দে ঘটে গেল পুরো ব্যাপারটা। আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। খুব। আমার গলা থেকে লায়লা ডাকটাও বেরোয়নি। ভয় পেয়ে দৌড়ে আমি উপরে উঠে এসেছিলাম – ঠিক এই জায়গাটায়।
আরো কিছুক্ষন বসে ছিলাম আমরা। ইতিমধ্যে সমুদ্র আরো উপরে উঠে এসেছে। অন্ধকার নেমে গেছে। পাথরগুলির গায়ে ঢেউগুলির আছড়ে পরার আওয়াজ কানে আসছিল।
টর্চের আলোয় পথ করে করে পাহাড়ি এলাকাটা ছেড়ে আমরা চলে এলাম। ঝুপসি কাঁঠাল গাছটির তলায় আমার জীপটি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে।
জানালার কাঁচটি নামিয়ে অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল মেয়েটি। ভাবছিলাম সেই বিকেলে বেরিয়েছি আমরা। ওর খিদে পেয়েছে নিশ্চয়। ওর বাড়ির দিকে ফেরার পথে মহালক্ষি মিঠায় থেকে আধ কেজির মত বরফি কিনে নিলাম।
ওর মা বারান্দায় বসে ছিল আমাদের অপেক্ষাতেই। মেয়েটি বরফির প্যাকেটটা নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। আমি বললাম মেয়েটির মাকে, ওকে একলা একলা সন্ধ্যায় বেরোতে দেন কেন উনি?
মা বললে, কথা শোনে না। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পরে।
“আমি একা মেয়ে মানুষ, কোনদিকে সামলাবো? আপনি বকে দিন স্যার।”
আচ্ছা, আমি একদিন এসে বোঝাবো ওকে।
কোয়াটারে ফিরবার আগে থানায় গেলাম। জ্যাকব চেয়ার থেকে উঠে সেলাম দিল। আমি আমার কেবিনের দিকে যেতে যেতে ওকে ডেকে নিলাম।
জ্যাকব, একটা রিপোর্ট লিখতে হবে।
----------
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।