এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব

  • সঞ্জীবনী

    Saswati Basu লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | ১০ আগস্ট ২০২১ | ১৬৬৫ বার পঠিত
  • - ও --লিও লিও-- লা
    - এলা লেগা ক্রেসেরা
    - এনো আত্রি লাভোরা তোরি
    - এনো আত্রিলা ভো ও ও রা তো ও ও রি

    সমবেত স্বরে গানের মুখরা নিনাদিত হচ্ছে – উঠছে উচ্চ থেকে উচ্চ গ্রামে – উত্তেজনায় গানের তাল দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্চে। সঙ্গে বাজছে তাম্বুরিন – যেটা বাঁধা মার্গারেটের গলায়।ফেডারেশন স্কয়ার। তার উন্মুক্ত মঞ্চে কয়েকটি তরুণী গান গেয়ে চলেছে। তার সঙ্গে সঙ্গত হচ্ছে শরীরী ভাষায় আর হাতের সমবেত তালিতে। তাদের প্রত্যেকের মাথায় স্কার্ফ বাঁধা। এ গানের আছে এক অদ্ভুত সন্মোহন আর মাদকতা। তারই টানে দর্শকের ভিড় জমছে মঞ্চের চারিদিকে – একজন দুজন করে। অনেকে শুধু দাঁড়িয়েই দেখছে না – গলাও মেলাচ্ছে মুখরাতে এসে – ও---লিও লিও --- লা, এলা লেগা – ----।

    আজ ৮ই মার্চ। বিশ্ব নারী মুক্তি দিবস। তারই উদযাপনে এই তরুণী দলের গান গাওয়া চলছে ফেডারেশন স্কয়ারের এই উন্মুক্ত মঞ্চে।

    রচনা আজ বাজার করতে বেরিয়েছিল। বাজার শুরু করার আগেই কানে এসেছিল এই উদ্দাম সঙ্গীত। সেই গানের টানে কখন যেন সেও এসে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। ওর চোখ টানছে তাম্বুরিন বাজানো মেয়েটি। গানের উত্তেজনায় টকটকে হয়ে রয়েছে তার মুখ ও কর্ণমূল। হয়তো বাজানোর পরিশ্রমও যোগ হয়েছে তাতে। চোখ দুটো টানা টানা স্বপ্নিল – কপালে কালো সাটিনের রিবন ঘুরিয়ে মাথার পেছনে টাইট করে বাঁধা – কানে ঝোলানো দুল ঝিকিয়ে উঠছে শরীরের বিভঙ্গে।

    - ও--- লিওলিও ----লা ---

    কখন যে রচনাও গান গাইতে শুরু করেছে এই সঙ্গীতময় ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে তা সে নিজেও খেয়াল করে নি। গান শেষ হয়ে যায় একসময়ে। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে সরে গেলেও রচনা কী এক দুর্বোধ্য আকর্ষণে দাঁড়িয়ে থাকে তখনো সেখানে। একটা ছোটখাটো জটলা এখনো সেই তরুনীদের ঘিরে।

    - ব্যান্ড এইড? ব্যান্ড এইড? কারো কাছে ব্যান্ড এইড পাওয়া যাবে? উচ্চকিত স্বর শোনা যায় সেই জটলার মধ্যে থেকে। রচনা দ্রুত পায়ে এগোয় সেই জটলা লক্ষ্য করে। ওর হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে একখানা ব্যান্ড এইড - তার ‘অল-ইন-ওয়ান’ হ্যান্ডব্যাগ এর ভেতর থেকে। রচনা ব্যান্ড এইডটা উঁচু করে তুলে ঢুকে যায় একদম জটলার মাঝখানটিতে। দেখে সেই তাম্বুরিন বাজানো মেয়েটির আঙ্গুল থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। একটা টিস্যু পেপার দিয়ে রক্ত পড়া আটকানো হচ্ছে। রচনাকে দেখা মাত্র একটি লম্বা মত মেয়ে হাত বাড়িয়ে দ্রুত ব্যান্ড এইডটি তুলে নেয় তার হাত থেকে।

    - থ্যাংক ইউ প্লিজ। আরও থাকলে একটু বের করে ফেল তাড়াতাড়ি।

    বলে অসম্ভব তৎপরতায় কিন্তু খুব সন্তর্পণে মেয়েটির আঙ্গুলে ব্যানডএইড টি জড়াতে থাকে সে। আঙ্গুলের অধিকারিণী তখন রচনার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে মৃদু হাসে। ব্যান্ড এইড এর ব্যবস্থা হয়ে যাবার পরেই চারিদিকের ভিড় পাতলা হতে শুরু করে। থেকে যায় শুধু রচনা আর গানের দলের তরুণীরা ।

    আলাপের সেই শুরু গানের দলের মেয়েদের সাথে রচনার। বিশেষ করে মার্গারেটের সঙ্গে। সেদিন তারা অনেকক্ষণ বসেছিল ফেডারেশন স্কয়ারের চত্বরে। রচনা শুনেছিল ওদের কাছ থেকে কিছুক্ষণ আগের ওই মঞ্চ মাতানো অশ্রুতপূর্ব ইতালীয় লোকগানটির ইতিহাস। সেই লম্বামত মেয়েটি – যার নাম জেনেছিল রেচেল – সেই এই গানটির ইতিহাস বলতে শুরু করে। রচনারই ঔৎসুক্যে। ততক্ষণে ব্যান্ড এইড এর খাতিরে রচনার সঙ্গ তরুণী দলের মধ্যে সাদরে গৃহীত হয়েছে। জানা যায় এই গানটি আজকাল মুক্তিকামী মানুষের বিদ্রোহের গান হিসেবেই ব্যবহার হয় ইতালিতে। গানটি লেখা হয়েছিল ঊনিশ শতকের কোন একটা সময়।

    - আর জানো গানটি লিখেছিলেন একটি মহিলা। রেচেলের গলার উত্তেজনা রচনার নজর এড়ায় না।
    - কিন্তু কেন এই গানটি লিখেছিলেন তিনি? কারণ কী?

    রচনা জিজ্ঞেস করে। কারণ গানটির ভাষা ইতালিয়ান বলে এর মাথামুণ্ড কিছুই বোধগম্য হয় নি তার।

    - ইতালির এক প্রত্যন্ত গ্রামে ধান উৎপাদক নারী শ্রমিকরা তাদের মালিকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল ঊনিশ শতকের শেষের দিকে। কারণ তাদের সাথে করা চুক্তির কোনো শর্তই মালিক মানত না। বঞ্চিত মেয়েরা এই গান গেয়ে আন্দোলন চালাত পথে পথে। এই গান তাদের বিদ্রোহের অন্যতম হাতিয়ার ছিল, ছিল বিদ্রোহের সিম্বল বা প্রতীক। তারা ইউনিয়ন গড়ে ছিল উনিশ শতকের সেই সময়ে যখন পৃথিবীর কোন জায়গাতেই খুব বেশী ইউনিয়ন সংস্কৃতি শুরু হয় নি। রেচেল বলে।

    রচনা গানটির অর্থ ও ইতিহাস শুনে খুবই উত্তেজিত বোধ করতে শুরু করেছিল। কারণ গানটির মোটামুটি মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, মেয়ে বলে আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না, ঠকিয়ে চলে যেতেও পারবে না, আমরা তোমাদের শাস্তি দেব, কারণ আমরা এখন সঙ্ঘবদ্ধ। ওর ততক্ষণে মনে পড়ে গিয়েছিল গণনাট্য সঙ্ঘের জন্য সলিল চৌধুরীর লেখা সেই বিখ্যাত গান –

    ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তে কাটাও শাণ হো,
    জান কবুল আর মান কবুল
    আর দেব না আর দেব না
    রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।

    কী আশ্চর্য! সলিল চৌধুরী কি কোনো জায়গায় ইতালির এই গানটির সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করেছিলেন! কে জানে? রচনার অন্তত সেটা জানা নেই। যদিও এটা ঠিক যে দুটো গানের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। তবে দুটো গানে একই ধরনের পটভূমি, একই ধরনের উন্মাদনা আছে। রচনা তখনকার মত এই সব তথ্য সরিয়ে রেখে মেয়েদের বলেছিল -

    - আরে জানো আমাদের দেশেও কৃষক বিদ্রোহের একটা গান আছে। সেটা আমাদের রাজ্যে কৃষকদের “তে ভাগা” বলে এক কৃষক আন্দোলনের সময় লেখা হয়েছিল। এটাও এই ইতালিয়ান গানটির মত মালিকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কৃষকদের বিদ্রোহের গান। তবে পার্থক্য হচ্ছে এই যে গানটি কোন বিদ্রোহী কৃষকের কলম থেকে বের হয় নি। লিখেছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির এক সদস্য।

    - ইস ইট? দেন ইউ স্যুদ তিচ আস দি সং। প্লিজ জয়েন আওয়ার গ্রুপ র‍্যাচানা। কাটা আঙ্গুল সামলে ফরাসিনি মার্গারেট বলে উঠেছিল সেদিন। রেচেলও সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। ওদের অনুরোধে সত্যিই পরে রচনা যোগ দিয়েছিল সেই গানের গ্রুপে। তারপরেই শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য এক অধ্যায় রচনার জীবনে।

    লোক্যাল গভর্নমেন্টের একটি সাংস্কৃতিক শাখায় রেচেলদের দলটি গান বাজনা করে। সেখানেই রচনা একদিন চলে গিয়েছিল। মনে আছে কোন এক শুক্রবারের সন্ধ্যায় রচনা এসে পৌঁছেছিল রেচেলদের জমায়েতে। ততক্ষণে অনেকেই এসে গেছে। দু একটি চেনা মুখ। ছোট খাটো হালকা ব্যায়াম চলছে। গান গাইবার আগের প্রস্তুতি। রচনা একপাশে দাঁড়ায় গিয়ে। রেচেল হাতের ইশারায় ঘরের কোনে স্তুপ করে রাখা চেয়ারগুলোর দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তার মানে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়। রচনা গিয়ে একটা চেয়ার টানতেই হুড়মুড় করে আরও চার পাঁচটা উল্টে পড়ে যায়। বাকিরা তখন দুড়দাড় করে এগিয়ে আসে। তারপরে হাতে হাতে দ্রুত গতিতে সব চেয়ার পাতা হয়ে যায় কার্পেট মোড়া মেঝেতে। এই চেয়ার পাততে পাততেই হাসি ঠাট্টায় রচনার সঙ্গে আরও অনেক অচেনাদের পরিচয় হয়ে যায়। রচনা বসেছে ততক্ষণে। তার চোখ তখন মার্গারেটকে খুঁজছে। মার্গারেট এলো অবশেষে। অনেক দেরী করে। তবে মুখে হাসি, কালো রিবন আর স্বপ্নিল চোখ নিয়ে সে যখন ঢুকল তখন মনে হল যেন দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠের একরাশ টাটকা হাওয়া নিয়ে এসে সে ঘরে ঢুকল। মার্গারেট সত্যিই সুন্দর।

    কেন সে এতো দেরীতে এলো – সবার এ প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল। নয় নয় করেও বেশ কয়েকশো ভেড়া আছে তাদের। তাদের অনেকেরই এখন সংসার বেড়েছে। সেই বৃহৎ সংসারের নতুন সদস্যদের দেখাশুনোর ভার মার্গারেটের ওপর। সেই সব করতে গিয়েই তার দেরি হয়ে গেছে। বোঝা গেল মার্গারেটের স্বামী সম্পন্ন কৃষক।

    - এই দেখো না হাত কী রকম লাল হয়ে গেছে! বলে সে তার করতল প্রসারিত করে হাসে। রচনার ভারী ভাল লাগে তার এই ছেলেমানুষি হাসিটি। রচনা এতক্ষণে আবিস্কার করে কেন মার্গারেটকে এতো আকর্ষণীয় মনে হয় তার। তার কারণ বোধ হয় মার্গারেটের এই খোলামেলা ও অকপট ব্যবহার ও নিষ্পাপ হাসি। কোন ভণিতা নেই তার ব্যবহারে। তাই মার্গারেটের উপস্থিতি এতো সজীব আর টাটকা। রচনা ততক্ষণে মার্গারেটকে তার পাশের চেয়ারটি এগিয়ে দিয়েছে।

    তারপরে জোর কদমে চলল রচনার গান শেখানোর পালা। ‘হেই সামালো’ সবাই উঠে পড়ে শিখতে লেগেছে। অডিও ক্যাসেটে সবাইকে গানটি দেওয়া, স্বরলিপি বানানো পাশ্চাত্য গায়িকাকে দিয়ে এবং কয়েক মাসের চেষ্টার শেষে একদিন হল ভর্তি দর্শকের সামনে সেই গান গাইল রচনা ও বিভিন্ন দেশের মেয়েরা। গান শেষ করে মঞ্চ থেকে দর্শক আসনের দিকে আসতেই এক বাঙালি ভদ্রলোক বললেন ‘কী করে এই অসাধ্য সাধন করলেন? গান শুনে মনেই হচ্ছিল না যে ইউরোপিয়ানরা গাইছে’। রচনা খুশী। ঘাড় ঘোরাতেই

    – এক্সকিউস মি! কুদ ইউ হাভ এ ফিউ মিনিতস? এক মাঝারি উচ্চতার ভারী চেহারার টাক মাথা মধ্য চল্লিশের পোলিশ ভদ্রলোকের সামনে পড়ে যায় রচনা।
    - হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই – রচনা তাড়াতাড়ি বলে।

    ভদ্রলোকের কথায় জানা গেল তিনি স্থানীয় ‘কমিউনিটি টিভি’ চ্যানেলের প্রতিনিধি। রচনাদের গান শুনে তার ভাল লেগেছে। তিনি তাদের এই মিউজিক্যাল গ্রুপের উপর একটি আধা ঘণ্টার প্রোগ্রাম করতে চান। অবশ্য রচনাদের আপত্তি না থাকলে ।

    তারপরের ইতিহাস খুবই সাবলীল গতিতে এগিয়েছে। প্রোগ্রামে কারো আপত্তি তো দূরের কথা, উৎসাহে টগবগ করেছিল সবাই। টিভিতে তাদের দেখা যাবে, সেতো দারুণ ব্যাপার।

    আজ কিছুক্ষণ আগে প্রোগ্রামের শুটিং হয়ে গেছে টিভি চ্যানেলের স্টুডিওতে। রেচেল রচনাদের সাক্ষাৎকার রেকর্ড করাও হয়ে গেছে। তিনটে গান ফাইনাল রেকর্ডিংও হয়ে গেছে এই মিনিট কয়েক আগে। সেই তিনটে গান রেচেলরা সবাই মিলে সিলেক্ট করেছিল। কিন্তু এই তিনটে গান থেকে একটা গান বেছে নেবে চ্যানেল কর্ত্রীপক্ষ। কোন গানটি টিভি চ্যানেল নিয়েছে সেটা জানার জন্য ওরা অপেক্ষা করছে এখন স্টুডিওতে। সবারই এক অদ্ভুত মনের অবস্থা। তিনটি গানের মধ্যে রেচেলের একটি পছন্দের গান ছিল। সেটার কম্পোজার আবার স্বয়ং মোজার্ট। দ্বিতীয়টি রচনার ‘হেই সামালো’ আর একটি মার্গারেটের ফ্রেঞ্চ গান। কোনটি? সবার সেই একই প্রশ্ন মনে মনে। অবশেষে সেই পোলিশ ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন ওদের সামনে ।

    – হাই র‍্যাচানা – কংগ্রাচুলেসন্স! চ্যানেল সিলেক্টস ইওর সং – দ্যাট বেঙ্গলি ওয়ান! খুব হাত তালির ঝড় বইল। তারপর থ্যাংক ইউ এর পর্ব শেষে রচনারা ফিরে এলো ওদের নিজেদের মিটিং রুমে ।

    এখন সবাই বসে আছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাতের খাবার অর্ডার করা হয়েছে। খেয়ে ফিরবে সবাই। কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। রেচেলের মুখ থম থমে। কারণ রেচেলের গানটি ল্যাটিন ভাষায় লেখা একটি ধর্ম সংক্রান্ত গান বা প্রার্থনা সঙ্গীত। বিশেষ করে ক্যাথলিক ও অন্যান্য কয়েকটি সম্প্রদায়ের চার্চের Mass এ এটি গাওয়া হয়। যেখানে ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা করা গানটির মূল বক্তব্য। তাই গানটি নির্বাচিত হয়নি বলে রেচেলের মনে হচ্ছে ঈশ্বরের করুণা থেকে যেন ওরা বঞ্চিত হয়েছে। রেচেল ভাবছে এটা হয়ত সবার জন্য একটা ব্যাড ‘ওমেন’ ও।

    - রাখো তো এসব মন খারাপের কথা। চল র‍্যাচানা আমরা সেই গানটা গাই যাতে সবার মন ভাল হয়ে যায়। মার্গারেট বলে ওঠে ।

    রচনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মার্গারেটের দিকে।

    - ওহ দ্যাত soothing one ………. তোমার pain killer তুমি আমায় বললে...। বললে তোমার কোনো কষ্ট হলে তুমি গানটা শোনো। তুমি যেটা আমায় শেখালে সেদিন আমাদের লাস্ট মিটিংএ। মনে নেই? অবশ্য আমি গানটির কী অর্থ কিচ্ছু জানি না.. তুমি প্রমিস করেছো আমায় বলবে পরে...।

    রচনা চুপ করে ছিল। সঙ্গীদের মনের অবস্থা দেখে ওর আনন্দ উবে গেছে। একটা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে আছে গলার কাছে। এলিজাবেথের কথায় ও ধীরে ধীরে বার করে ওর প্রিয় গানের বইটি... মূল গানটি আর তার ইংরেজি অনুবাদ যে পাতায় আছে সেখানে একটি মার্কার দেওয়া। সেই পাতাটি সে ধীরে ধীরে খোলে। চোখ যায় তার প্রিয়তম গানে। যে গানে সে প্রাণ ফিরে পায়। যে গান তার যে কোন কষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে এক লহমায়। যে গান.... রচনার চোখ ভিজে আসে।

    ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রিং ক্রিং ক্রিং দরজার ঘণ্টাটি জানিয়ে দেয় ওদের ঈপ্সিত বস্তুটির আগমন সংবাদ ।

    এরপর বহুদিন গড়িয়ে গেছে। জীবন তার নিজস্ব নিয়মে চলছে। শুধু মার্গারেটেরই দেখা নেই প্রায় বছর দেড়েক। মোবাইলে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে প্রায় মুছেই যাচ্ছে রচনাদের দৈনন্দিন যাপনের পাতা থেকে। একদিন রোজকার মত সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছে রচনা। কদিন একটানা বৃষ্টির পর আকাশ আজ মেঘহীন। হালকা টাটকা সতেজ হাওয়ায় রচনার মনে একটা প্রসন্নতার আমেজ। ঠিক সেই সময়টাতে হঠাৎই মার্গারেটের মুখোমুখি হয়ে গেল রচনা।

    - মা-র্গা-রে-ট তুমি-ই-ই ? ক—ত্ত ...দিন পরে? কী হয়েছিল কী তোমার? কেমন আছো? ততক্ষণে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরেছে। এই একরাশ প্রশ্নের উত্তরে মার্গারেট শুধু হাসে। মার্গারেটকে অনেক রোগা লাগছে। বয়স্কও। তবে তার প্রসন্ন হাসিটি ঠিক একই রকম আছে। অমলিন।

    - চল, আজ আমার বাড়িতে। বেশী দূর নয়। পনেরো মিনিট হাঁটা পথ। যেতে যেতে কথা হবে। বলে মার্গারেট।

    কথা হয়। দুজনের নয়, শুধু মার্গারেটই বলে যায়। তার বঞ্চনার কাহিনী। মার্গারেটের স্বামী মার্ক মারা যাবার পরে মার্কের আগের পক্ষের ছেলেরা মার্গারেটকে মার্কের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। উইল জাল করে। আরও মিথ্যে অপবাদ দেয় যে মার্গারেটের ছেলে ‘আরথার’ আসলে মার্ক এর ছেলেই নয়। এরপরে মার্গারেট আর ওই বাড়িতে থাকে নি। চলে আসে আরথারকে নিয়ে।

    - তুমি কোর্টে যাও নি? বিস্মিত রচনার স্বর ক্রুদ্ধ শোনায়।

    - না। তাতে আরথার এর মনের উপর এর ফল ভাল হত না। ও বড় হোক। তখন ও যদি কিছু করতে চায় -- তা ছাড়া যে অপবাদের সবটাই মিথ্যে তার প্রতিবাদ করলে বোধ হয় তাকে খানিকটা গুরুত্ব দেওয়াই হয়ে যায়। থাক - এই তো বেশ আছি। আমার গানের স্কুল নিয়ে, আরথার কে নিয়ে। এই তো এসে গেছি আমরা। এসো ।

    রচনার পা যেন চলছে না। এ কী শুনল সে? মানুষ কী এতদূর ...?

    অন্যমনস্ক হয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে একটা যেন চেনা চেনা সুর অস্পষ্ট ভাবে কানে আসে তার। রচনা মার্গারেটের দিকে তাকায় --

    - প্রার্থনা সঙ্গীত। স্কুলের ছেলেমেয়েরা এই সময়ে গায়। মার্গারেট বলে।

    ততক্ষনে প্রেক্ষাপটটি স্পষ্ট হয়ে যায় রচনার। ঘরের মধ্যে মার্গারেটের গানের স্কুলের ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে গাইছে ---

    “জীবন যখন শুকায়ে যায়
    করুণা ধারায় এসো
    সকল মাধুরী লুকায়ে যায়
    গীত সুধারসে এসো।

    কর্ম যখন প্রবল আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার ----
    হৃদয়-প্রান্তে হে নীরব নাথ শান্ত চরণে এসো।
    জীবন যখন শুকায়ে যায়
    করুণা ধারায় এসো ---------“

    মার্গারেট হাসে।

    - সেদিন তোমার গানের বইটি তুমি ফেলে গেছিলে। আমি তুলে নিয়েছিলাম। এই দেখো।

    মার্গারেটের হাতে জ্বলজ্বল করছে তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বইটি। গীতাঞ্জলি। পেজ মার্কার সহ।
    *********
    · পূর্বপ্রকাশিত ‘বাতায়ন’ রবীন্দ্রসংখ্যা ২০২০
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ধৃতি সেনগুপ্ত | 2a0b:f4c2:1::***:*** | ১০ আগস্ট ২০২১ ০০:৫১734830
  • খুব ভালো লাগলো 

  • Saswati Basu | ১১ আগস্ট ২০২১ ০৭:৫৪734858
  • অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন