দিল্লি এবং লাগোয়া অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন তুঙ্গে। হরিয়ানার সমস্ত খাপ পঞ্চায়েতগুলি দিল্লির কৃষক বিক্ষোভকে সমর্থন করার কথা ঘোষণা করেছে। অনেকগুলি খাপ পঞ্চায়েত সরাসরি বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করারও ডাক দিয়েছে। এর মধ্যে পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনে খালিস্তানি স্লোগান দেবার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগটি খুব সম্ভবত বিজেপির আইটিসেলের প্রচার। কারণ যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল, বা বলা ভাল ভাইরাল করা হয়েছিল, সেটি অন্তত বছরখানেক আগের ব্রিটেনের ভিডিও। আইটি সেলের কারবার নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই, কিন্তু এর মধ্যে পাঞ্জাবি অভিনেতা দীপ সিধু, যিনি আন্দোলনের মুখও বটে, একটি বিস্ফোরক কান্ড ঘটিয়েছেন। আন্দোলনে খালিস্তান যোগ থাকার অভিযোগ ওঠায় বরখা দত্ত, যিনি কারগিলের পর থেকেই প্রচন্ড 'জাতিয়তাবাদী' হয়ে উঠেছেন, দীপের একটি সাক্ষাৎকার নেন। ক্যামেরার সামনে দীপ পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, যে, ভিন্দ্রানওয়ালে আসলে শক্তপোক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য লড়াই করছিলেন।
এগুলি একটিও নতুন কথা নয়, টিভি বা ইন্টারনেটে সকলেই দেখে ফেলেছেন। খবর দেবার জন্য এই লেখা নয়। যেটা কৌতুহলোদ্দীপক, যেজন্য এই লেখা ফাঁদা হচ্ছে, সেটা হল আন্দোলনের পক্ষের এবং বিপক্ষের ন্যারেটিভ। বিপক্ষের ন্যারেটিভে নতুন কিছু নেই। যেকোনো আন্দোলনের বিরোধিতায়ই বিজেপির মূল ন্যারেটিভ হল, তারা ঐক্যবদ্ধ শক্তপোক্ত ভারত বানাচ্ছে। এবং পাকিস্তানকে পিটিয়ে ছাতু করে দেবে। এবার কৃষক আন্দোলন হোক, বা এন-আর-সি-বিরোধী আন্দোলন, তা তো আর পাকিস্তানে হচ্ছেনা, কাজেই বিজেপির একমাত্র কাজ হল দেশের মধ্যে সব আন্দোলনেই এক টুকরো পাকিস্তান খুঁজে বার করা। যারা বিজেপি-বিরোধী তারা 'আর্বান নকশাল', 'টুকরে টুকরে গ্যাং', ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্তানের শত্রু। কাজেই এদেরও পিটিয়ে মারতে হবে। এই হল মূল গল্প। সেই গল্প এই আন্দোলনবিরোধিতাতেও আছে। যে কারণে কবেকার কোনো খালিস্তানি সমর্থনের ভিডিওকে ভাসিয়ে তোলা হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে এই আন্দোলনের বহুদূরেও কোনো যোগাযোগ থাকা সম্ভব নয়, এই আন্দোলনেও পাকিস্তান টেনে আনা হচ্ছে।
উল্টোদিকে 'প্রগতিশীল' ন্যারেটিভও খুব সহজ। ভারতীয় কৃষকরা কৃষিবিলের কারণে ক্ষুব্ধ। অশান্ত। সমস্ত স্তরের কৃষকদের বল হচ্ছে অন্নদাতা। অন্নদাতারা শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত। তারা প্রধানমন্ত্রীর দরজায় কড়া নাড়ছে, আর প্রধানমন্ত্রী কথা না শুনে তাদের উপর বলপ্রয়োগ করছেন।
বিজেপির ন্যারেটিভ চিরাচরিত গরু রচনা, যদিও এই লেখা লিখেই এতদিন ধরে পরীক্ষায় পাশ করে চলেছে বিজেপি। উল্টোদিকে দেশের একাংশের কৃষকদের ক্ষোভ, তার বহিঃপ্রকাশ এবং প্রধানমন্ত্রীর বলপ্রয়োগ সংক্রান্ত বাম-লিবারাল ন্যারেটিভে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হল এক জায়গাতেই, যে, এই আন্দোলনের উপর একটি সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত চাপানো হচ্ছে। কৃষি বিল একটি সর্বভারতীয় ব্যাপার, তার প্রভাব গোটা দেশেই পড়বে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যেটা দেখা যাচ্ছে, যে, এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ন্যারেটিভ একেবারেই সর্বভারতীয় নয়, এমনকি লিবারালও না। খাপ পঞ্চায়েতগুলির সামগ্রিক মতাদর্শের সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত লিবারাল মতাদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং লাঠালাঠি আছে। এবং খাপ পঞ্চায়েত কোনো ভাবেই দরিদ্র, ভূমিহীন এবং নিচু জাতের মানুষের প্রতিনিধি নয়। হিন্দি বলয়ের জটিল সমাজ এবং জাতপাতের কারবারে সবচেয়ে অ-লিবারাল অংশের প্রতিনিধিত্ব করে এই খাপ পঞ্চায়েত। তারা যখন এই আন্দোলনে আসছে, তারা নিজেদের সমাজ, শ্রেণী এবং জাতপাতের প্রতিনিধিত্ব করেই আসছে। এলে কোনো সমস্যা তো নেইই, খুবই আনন্দের কথা, কিন্তু তাদের আসার প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা। বস্তুত আমাদের অনধিগম্য।
একই কথা পাঞ্জাবের ক্ষেত্রেও। পাঞ্জাবের একজন মুখ যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কথা বারবার বলছেন, শক্তপোক্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর কথা বলছেন, তখন পরিষ্কার বোঝা যায়, এই পুঞ্জিভূত ক্ষোভ শুধু কৃষিবিলের কারণে নয়। পিছনে আরও কিছু আছে। পাঞ্জাবের গণস্মৃতি থেকে খালিস্তান আন্দোলন, দমন-পীড়ন, সর্বভারতীয় শিখ-নিধন কিছুই মুছে যায়নি। সবই রয়ে গেছে। এবং এই গোটা প্রেক্ষিতটি সর্বভারতীয় দৃষ্টি থেকে অনধিগম্য।
বাংলার বাম-লিবারালদের অনেককে আক্ষেপ করতে শোনা যাচ্ছে, যে, পাঞ্জাবে বা হরিয়ানায় এত বড় আন্দোলন, বঙ্গের কৃষকদের কেন হেলদোল নেই। এই অভিযোগও বস্তুত সর্বভারতীয় চশমা দিয়ে দেখার ফল এবং সে কারণেই পরিস্থিতির ভিন্নতা অনধিগম্য মনে হচ্ছে। চশমাটি খুললেই দেখা যাবে, হরিয়ানা এবং এবং পাঞ্জাব বস্তুত আলাদা আলাদা ন্যারেটিভ উপস্থাপন করছে আন্দোলনের পক্ষে। পাঞ্জাবি ন্যারেটিভে তো পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং পাঞ্জাবিদের নিজেদের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবী আছে। হরিয়ানায় ভূমি সংস্কারের ভ ও হয়নি, সেখানে খাপ পঞ্চায়েত এবং বড় কৃষক, জোতদার-জমিদারদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান আছে। এর কোনোটিই সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে ধরা যায়না।
ভারতবর্ষ বস্তুত একটি সমতলভূমি নয়। বস্তুত উপ নয়, একটি মহাদেশই। তার নানা অংশের মানুষের বিপুল বৈচিত্র্য আছে। বিজেপির ন্যারেটিভে এই বৈচিত্র্যকে সুস্পষ্টভাবেই মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর উল্টোদিকে যাঁরা আছেন, তাঁরাও ওই ঐক্যের ন্যারেটিভে ঢুকে পড়লে লাভের লাভ কিছু হবেনা। বস্তুত বিরোধিতাটি একটি কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, এই ধারণাটিরই উল্টোদিকে যাওয়া উচিত। হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের ন্যারেটিভ সেরকমই দেখাচ্ছে। খাপ পঞ্চায়েত হরিয়ানার ব্যাপার, কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধিতায় তাদের সঙ্গে ব্যাপকতম যুক্তফ্রন্ট গড়া যেতেই পারে, কিন্তু সেটি স্রেফ কেন্দ্র নামক চাপিয়ে দেওয়া ধারণাটির বিরুদ্ধেই। তার বেশি না। একই ভাবে, পাঞ্জাব যদি অধিকতর ক্ষমতা চায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুনর্বিন্যাস চায়, তার সঙ্গে অবশ্যই হাত মেলানো যেতে পারে। একটি বিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, কেন্দ্রীয় কৃষি বিল, কেন্দ্রীয় শ্রম বিল, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতির প্রচার, এইটির উল্টোদিকে যাওয়া উচিত। পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাত মারাঠা, এই ভিন্নতাই হল ভারতবর্ষ। এবং কেন্দ্র তার ভাগ্যবিধাতা নয়।
অনেকটাই সহমত।
এই লেখাটা খুবই ভালো লাগলো। এই আন্দোলনকে এখনো পর্যন্ত বিপর্যস্ত হতে হয়নি, গত ক'বছরের ভারতবর্ষে এটা একটা আশাপ্রদ ব্যাপার। আবার বাংলায় চাষীভাই বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গে এঁদের তফাত বা যোগদানকারী খাপগুলির কথা, আন্দোলনকে সমর্থন করেও, মনে রাখা ভালো।
ইনফ্যাক্ট দীপ সিধুকে গাল দেওয়া বা বিজেপি প্ল্যান্টেড রোগ বা বিশ্বাসঘাতক বলা নিয়ে অস্বস্তি হচ্ছে। দু'মাস আগে বিজেপি সমর্থক ছিল এখন আন্দোলনকারী, সেটা হাইলি হতেই পারে, যোগদানকারী অনেকেই নিশ্চিতভাবে তাই, হরিয়ানার খাপ ইত্যাদি মনে রেখে সেটা ধরা যায়। কিন্তু এই দোষারোপ ইত্যাদি কালসর্প, সরকার এতদিন আন্দোলন, মনোবল, ঐক্য ভাঙতে পারেনি, এই ধরনের ফাটলের অনেক ঝুঁকি।
আবার দীপ সিধুর পরিচয় জানার আগে পর্যন্ত লালকেল্লায় নিশান সাহিব ওড়ানোর বিপুল সমর্থন দেখতে পাচ্ছিলাম সোশাল মিডিয়ায় বাম সমর্থক বন্ধুদের মধ্যে। আজ দীপ সিধুর পরিচয় জানার পরেও, কাল সেটা ভালো থাকলে আজও ভালোই থাকার কথা। হরিয়ানার খাপসমূহকে এই আন্দোলনে অ্যাকোমোডেট করতে পারলে বিজেপি নেতার ছায়াসঙ্গীকেও অ্যাকোমোডেট করতে খুব অসুবিধে হওয়া তো উচিত না।
ধর্মীয় পতাকা নিয়ে অস্বস্তি আছে, কিন্তু মোটের ওপর এই পতাকা তোলাকেও এক ধরনের জয় হিসেবেই দেখতে চাই। এ নিয়ে অ্যাপোলোজেটিক হওয়া বা এতে আন্দোলনের খুব ক্ষতি হলো এমন মনে করার কারন, কী জানি, খুব আছে তো মনে হয় না।
অনেকের কাছেই বিজেপি বিরোধিতার বড় কারন বিজেপির বৈচিত্রবিদ্বেষ, হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তান তো তাই, সবাইকে এক রকম হতে হবে, সবাইকে দুরমুশ করে এক করে দিতে চাওয়া।
তো, ঐ, সবার একই লক্ষ্য, দুনিয়ার কৃষক শ্রমিকের স্বার্থ, অন্তত বর্তমান দুনিয়াদারিতে যে এক নয়, তা তো আমরা জেনেই গেছি। নানান রকম লোক থাকবেন এই আন্দোলনে, অনেকের অনেক রকম ব্যাকগ্রাউন্ড। সে তো হবেই।