এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোনো এক গাঁয়ের কথা

    shrabani
    অন্যান্য | ২২ এপ্রিল ২০১০ | ১৮০৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sarbani | ***:*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:০০449767
  • (৪)
    সনাতন ওঝার কাজকম্মের আজকাল বড়ই মন্দা চলছে। সে গাঁয়ের তিন পুরুষের সাপের ওঝা, মা মনসার দয়ায় আজ এত বছর ধরে দিব্যি কাটছিল, কিন্তু ইদানীং হাওয়া উল্টো বইতে শুরু করেছে। গাবপুরে সরকারী হাসপাতাল নতুন করে তৈরি হয়েছে, সেখানে সাপের বিষের নিদান ইঞ্জেকশন পাওয়া যায়, সূচ ফুটলে নাকি সাপেকাটা মড়াও জ্যান্ত হয়ে ওঠে।
    সরকারী ডাক্তারবাবু ও তার দলবল পাঁচগাঁয়ে ঘুরে ঘুরে লোককে শেখায়, সাপে কাটলে প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে করতে হবে। রেডিওতে অনুষ্ঠান শুনছে লোকে তাতেও নাকি এসব কথা থাকে। এছাড়া এও কানাঘুষো শোনা যায় যে দু পাতা পড়ালেখা করে উঠতি ছেলে ছোকরার দল রটিয়ে বেড়াচ্ছে, ওঝা গুণিন সব মিথ্যে, ভেকধারী।ভদ্রলোকেরা তো যেমন তেমন চাষাভুষোর দলও সব আজকাল সব কিছুতে হাসপাতালে ছোটে।

    মধু গুণিন ছিল গাঁয়ে, জিনিষপত্র এটা ওটা হারালে লোকে আগে তার কাছে যেত। মেঝেতে খড়ি দিয়ে আঁক কেটে, কখনো বা জলদর্পণ করে হালহদিশ বলে দিত। ছিঁচকে ও ঘাগু দুই ধরণের চোরেদের সাথেই বন্দোবস্ত ছিল, কিছু কিছু মিলে যেত, তাতেই মোটামুটি নামযশ হয়ে করে খেত। ইদানীং তারও ব্যবসা তেমন চলেনা, ওই একই রোগে।
    কিছু হারালে লোকে থানায় যায়, নিজেরা গোয়েন্দাগিরি করে, নাহলে নিধিরামের কাছে যায়।গুণিনের সব নাকি বুজরুকি। যেসব চোরেদের সাথে বোঝাপড়ায় ব্যবসা চলছিল, তারাই সব ফাঁস করে দিয়েছে। শেষমেশ মধু এখন গুণিনগিরি ছেড়ে এখান থেকে দূরে নামালের গাঁয়ে গিয়ে কবরেজের সাগরেদ হয়েছে।

    সনাতনের কপালটা তেমন ভালো নয়। বউটাকে গেল বছর সাপে কামড়ালে, ছেলে মাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে চাইল। সে যেতে দেয়নি, ওঝা নিজের বউকে ডাক্তারের কাছে পাঠালে লোকে আর কোনোদিন তাকে ডাকবে!মোক্ষম কেটেছিল, মনে হয় শঙ্খচূড়, তার জড়িবুটি কাজেই এলনা। ছেলে মায়ের কাজ করে ঘর ছাড়ল, এখন মামাবাড়িতে থাকে, বাপের মুখ আর দেখবেনা বলেছে।সেই থেকে সনাতন একা। তার আবার ভুতের ভয় বেজায়, ঘরটা একটেরে মাঠের ধারে, মাইতিপাড়ার শেষে, আশেপাশে লোকজন বা বাড়িঘর তেমন নেই।

    তবু সনাতন মধুর মত গাঁ ছাড়বার কথা বা পেশা বদল করার কথা ভাবেনি।বরং ছেলেছোকরাদের হুজুগকে পালটা জবাব দেওয়ার জন্য গাঁয়ের পাকা মাথাদের শরণাপন্ন হয়েছিল। সনাতনের মা রায়েদের বাড়ি ধানসেদ্দ চালমুড়ি খই ভাজত, সেই সুবাদে ছোট থেকেই তার ওবাড়ি যাতায়াত।সে তাই গেল বড়রায়ের কাছে এক বিকেলে দরবার করতে। রায়কত্তা তখন দিবানিদ্রা সেরে সদরে এসে বসেছে, সামনের দীঘির হাওয়ায় চারিদিক বেশ ঠান্ডা মনোরম, হাল্কা বাতাস বইছে।
    বড় রায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সনাতনের বক্তব্য শুনল। তার মুখের ভাব দেখে সনাতনের মনে আশা জাগে, বনেদীয়ানার রকমই আলাদা, একী আর দুপাতা পড়ে নব্য দিগগজের দল!
    -“পড়ালেখা ভদ্রলোক গেলে তাও মানা যায়, শেষকালে নামোর দলও সব হাসপাতাল যাচ্ছে, তায় আবার সাপে কাটায়। আপনাদের সনাতন তো শুধু গুণিন নয়, তিনপুরুষের মা মনসার পূজারীও হই বটে। কথায় বলে বাঘের দেখা আর সাপের লেখা। সাপের কাটা মাথায় লেখা থাকে, এককথায় মায়ের ইচ্ছে। সে ইচ্ছের ওপর খোদকারী করলে মা কুপিত হবেননি? তার চেলা চামুন্ডাতে গাঁ ভরে যাবে যখন, কটাকে বাঁচাবে ডাক্তার? আপনেরা কত্তারা না ব্যবস্থা নিলে সব্বনাশ হতে আর কদিন!”
    বড়কত্তা অল্প কথার মানুষ, কিন্ত যা বলে সাফ কথা বলে। সব শুনেটুনে দুকথায় পরিস্কার বুঝিয়ে দেয় যে যুগ এখন বদলে গেছে। চিকিৎসা শাস্ত্রের অনেক উন্নতি হয়েছে এবং সে সব সুযোগ সুবিধে এ গাঁয়ে আসছে এ খুবই ভালো কথা। ওসব টোটকা জলপড়া ওঝাদের দিন যে যাচ্ছে, এতে সকলেরই মঙ্গল। সনাতনও ওসব ভেকবাজি ছেড়ে এখন অন্য পেশা দেখুক।
    কত্তার মন ভালো, সাধ্যমত গাঁয়ের সবার জন্য করে। সনাতনকে বলে রায়েদের জমি কিছু নিয়ে চাষ করতে, ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে, বাপবেটা মিলে খেটে ফসল ফলাক, সংসার দিব্যি চলে যাবে, বুজরুকি ধান্দা আর করতে হবেনা।
    সনাতন একথা শুনে মনে মনে শিউরে উঠে সেখান থেকে সেই যে চলে এল, আর রায়েদের বাড়ির দিকে পা মাড়ায়নি। ওঝাগিরি তার বাপ ঠাকুরদার পেশা। এ বিদ্যে, কত কষ্ট করে আয়ত্ত করেছে সে, সব ছেড়ে এই বয়সে মাঠে মুখ্যু চাষাদের মত খাটবে বলে! বয়স হয়ে আর টাকার গুমোরে কত্তার মাথাখানা গেছে।

    এরপরে আরো দু চারজনের কাছে দরবার করেছে, কিন্ত সবার সেই এক কথা, গাঁয়ের লোক সাপে কাটলে আর কেউ ওঝার কাছে যাবেনা, ডাক্তারের কাছে যাবে।
    সনাতন সেই থেকে মহা চটে আছে গোটা গাঁয়ের ওপর। দিনকয়েক হল আবার শুনছে তার ছেলেও দলে মিশে লোকের বাড়ি গিয়ে গিয়ে সাপে কাটলে কী করতে হবে সেই সব শেখায়। তার মা সাপের কামড়ে মারা গেছে বলে সে নাকি আর কাউকে সাপে কাটায় মরতে দেবেনা!

    সন্ধ্যের মুখে ঘরের সামনের দুয়ারে বসে এসব কথাই ভাবছিল। শীত গিয়ে দুপুরে আজকাল হাওয়াটা হাল্কা গরম বয়, ঘরের ভেতরে চাপা লাগে। ঘরের উঠোনে মা মনসার থান, মনসা গাছের তলায় সিঁদুর মাখানো পাথরের দেবী, তার বাবার আমলের, মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে একটু ধুনো দিয়েছে। ওঝার রোজগার গিয়ে এখন এই দেবীর কল্যাণেই দুটি খাওয়া জুটছে তার। মাইতিপাড়ার বউ ঝিরা মনসা পুজো এখানেই দিয়ে যায়, কালীতলা দূর পড়ে বলে।এছাড়া বয়স্কারা এখনো কচি ছেলেপিলেদের জন্য তার কাছে সর্পহরা মাদুলী করিয়ে নিয়ে যায়, জড়িবুটি নেয়।এসব করে যা রোজগার হয় তাতে তার একটা পেট চলে যায়।

    অন্ধকার হয় হয় করছে, সনাতন আধখাওয়া বিড়িটা ধরায়, শেষ হলে ঘরে ঢুকে দোর দেবে, রাতে সে সচরাচর বাইরে থাকেনা।এমনেতে এই সময়টা তার দুয়ারে বসে গাঁয়ের লোকেদের শাপশাপান্ত করার সময়, তাতে বেশ শান্তি হয়, হলে তারপর ঘর ঢুকে যায়, একা অন্ধকারে বাইরে বসতে ভয় করে।
    কিন্তু আজ তার মনমেজাজ ফুরফুরে, আর কদিন পরেই গাজন।চড়কের কাঠ তোলা হয়ে যাবে দু একদিনে। তার সাথে ভক্তদের ঘর ঘর দেউল নিয়ে ঘোরা শুরু হয়েছে, কদিন এখন সরগরম থাকবে চারধার।
    পঞ্চানন্দের চড়কের মেলায় দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসে, সেও তার জড়িবুটি মাদুলী নিয়ে মেলায় বসে, এবং ভালো বিক্রিবাটা হয় প্রতিবারে।

    “এবারেও এর অন্যথা হবেনা আশাকরি, সব গ্রাম একসাথে নিশ্চয়ই এগাঁয়ের মত শহুরে হাওয়া ঢুকে উচ্ছন্নে যায়নি।“
    আসন্ন মেলার কথা ভেবে মন এত উৎফুল্ল তার, যে আজ রাতে সে আলু পোড়া লঙ্কাভাজা দিয়ে মেখে সকালের পান্তা খাবে, সকালের কাঠের উনুনের মরা আঁচে চারটে আলু ফেলে রেখেছে।

    উঠতে যাবে, কে যেন পিছন থেকে ডেকে ওঠে,
    “ও দাদা, সনাতন দাদা, একটু শুনতে হবে যে দাদা।“

    চমকে উঠে সনাতন পেছন ঘুরে আধ অন্ধকারে আবছামত একটা চেহারা দেখে “ভু ভু” করে উঠে পিছু হঠতে গেলে, চেহারাটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে,

    “না না দাদা, আমি ভুত নই, মানুষ।এই যে দেখুন, এই চিমটি কাটলাম।“ বলে সনাতনের ঘাড়ের কাছে একটি রাম চিমটি এমন কাটে যে জ্বালায় লোকে ভুতের ভয় ভুলে যাবে।

    জায়গাটা হাত দিয়ে ডলতে ডলতে সনাতন প্রদীপের মিটমিটে আলোর আভাসে ঠাহর করার চেষ্টা করে লোকটাকে।চোখে আজকাল ভালো তেমন দেখে না, তবু আদল দেখে বাউরিদের ছিদাম মনে হয়।
    “কে বলত। ছিদে নাকি? তা এই সাঁঝের বেলায় ঘর না যেয়ে এদিকপানে কেন? আর অমন করে ভুতের মত পিছন থিকে এসে আচমকা ডাকিস কেন।“

    লোকটা বিনয়ে মাথাটা প্রায় নুইয়ে ফেলে,
    “আমি দাদা এগাঁয়ের লোকই নই। পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম, এই আঁধার হয়ে এল দেখে ভাবছি আজকে এখানেই রয়ে যাই, রাতবিরেতে তেনাদের দৌরাত্ম্য খুব পথেঘাটে। আমার আবার দাদা ভুতপ্রেতে বড় ভয়।বলতে গেলে ভুতের জন্যে গাঁ ছাড়তে হয়েছে আমাকে। তা আজ রাতে যদি দাদা আপনার এখেনে থাকতে দেন।“

    ভুতপ্রেতে ভয় শুনে সনাতনের লোকটিকে বেশ আপনার মনে হয়। থাকতে দিতে আর কী অসুবিধে, বরং একজন থাকলে রাতে আজ ঘুমটা ভালো হবে। ফি রাতে ভয়ে সে বিশেষ ঘুমোতে পারেনা, রাতভর জেগে থেকে ভোর হলে তবে ঘুমোয়।
    সমস্যা হবে খাওয়া নিয়ে, সে বড় একটা রাঁধেবাড়ে না, সকাল সন্ধ্যে পান্তা খায়, বাকি মুড়ি ফলার।
    লোকটা দুয়ারে খুঁটির ধারে বসেছে। সনাতন লন্ঠন জ্বালাতে যাচ্ছিল, লোকটা তা দেখে বলে,
    “দাদা আবার আমার মত সামান্যি লোকের জন্যে তেল পোড়াবে কেনে।এই তো প্রদীপের আলোতে বেশ চারধার দিনের মত পরিস্কার দেখাচ্ছে।“

    একথাও সনাতনের খুব পছন্দ হল। গাঁয়ে বিদ্যুতের আলো এসে গেছে অনেকদিন হল, কিন্তু টাকা জমা দিতে হয় কনেকশানের জন্যে। বেঁচে থাকতে বউ আর ছেলে মিলে খুব জোরাজুরি লাগিয়েছিল, সনাতনই হচ্ছে হবে করে আটকেছিল, এমনে দেখে দিনরাত কারেন্ট থাকেনা, অতগুলো কাঁচা টাকা গচ্চা দিয়ে লাভ!
    এখন মাঝেসাঝে মনে হয়, তখন আলো নিয়ে নিলেই হত, ভুতের ভয়ে সারারাত লন্ঠন জ্বালিয়ে শোয়, তেলের খরচ একটা বড় খরচ তার, পয়সা দিয়ে কিনতে হয়।তখন ঘর জমজমাট ছিল, ভয় পেতনা, তাই আলোর প্রয়োজন মনে হয়নি, আর এখন রোজগার কমে গিয়ে, পয়সা নেই হাতে।
    আজ রাতে এই লোক আছে, সারারাত আলো জ্বালাতে হবেনা, খাওয়াদাওয়ার সময় আলো হলেই হবে।

    লঙ্কামাখা আলুপোড়া আর পেঁয়াজ কামড়ে মুড়ি মেশানো পান্তাভাত দুজনে খেয়ে উঠল বড় তৃপ্তি করে। খাওয়ার পরে দুয়ারে বসেছে, সঙ্গী আছে তাই আজ সাহসী সনাতন, কে আর শখ করে চাপা ঘরের মধ্যে শুতে যায়। লোকটি কাপড়ের খুঁট থেকে বিড়ি বার করে নিজে দেশলাই ধরিয়ে নিয়ে সনাতনকে দেয়। এরকম আস্ত বিড়ি অনেকদিন টানেনি সে, বেশ মৌতাত হয়ে, মাথাটা ভারী হাল্কা লাগে।
    “তা হ্যাঁ হে তোমার নামটি কী বললেনি তো? নিবাসই বা কোথায়?”
    “নামের কথাটি বলনি দাদা। কতজন যে কত নামে ডাকে, নিজেই ভুলে যাই আসল নাম কী!আর আসছি তো মেলা দূর থিকে। এ গাঁয়ের কত নাম ডাক, বড় বড় নামী লোকেদের বাস। ওসব দূর থেকে শুনতেই ভালো, এসে যা দেখলুম, ছ্যা ছ্যা ঘেন্না ধরি গেল গো।পয়সা থাকলেই কী আর বড় মানুষ হয় গো। মন থাকতি হয়। এই গাঁয়ে একটাই বড় মানুষ, সে হল তুমি দাদা।“

    সনাতন খুব খুশী হল, একেবারে তার মনের কথা। গাঁয়ের লোক বিশেষ করে বড় লোক সব মহা পাজি সেকী আর জানা নেই তার। লোকটি বুদ্ধিমান বটে, একদিনেই সত্যিটা টের পেয়ে গেল অথচ সে এতকাল গাঁয়ে বাস করেও এখানকার বাসিন্দাদের স্বরূপ আগে বোঝেনি!
    অনেকদিন পরে আজ দোসর পেয়ে সনাতনের মনের আগল খুলে গেল, নিজের হেনস্থার কথা, ব্যবসায় মন্দা পড়ার কথা, বলতে বলতে বাইর দুয়ারেই ঘুমে ঢলে পড়ে।

    সকালে ঘুম ভাঙল যখন তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে, পূবদিকে মাঠের ধারের খেজুরবনের ফাঁক দিয়ে সুজ্জি দেখা যাচ্ছে। উঠে প্রথমে একটু বেভুম্বুল লাগে, মাথাটা ভার ভার।এমনটা আগে কখনো হয় নি, রোগ ব্যামোর বালাই তার তেমন নেই। একদিকে রাখা মাটির গামলার জল মুখে চোখে ভালো করে দিতে কিছুটা পরিস্কার হয় মাথা, মনে পড়ে যায় রাতের লোকটার কথা।
    গেল কোথায় সে, মাঠের দিকে গেছে, নাকি চলে গেল, না বলে?

    বাইরে খুঁজে দেখবে বলে উঠোন পেরোতে গিয়ে সনাতন দাঁড়িয়ে গেল। গাছের তলায় মা মনসা নেই, আগের দিন সকালেও যে পাথরে হরি মাইতির বউ ভক্তিভরে সিঁদুর লেপে, লাল কাপড়ের টুকরো চাপিয়ে গেছে, গাছতলায় সেই জায়গাটা খাঁ খাঁ করছে যে শুধু নয়, মাটিতে গর্তমত হয়ে গেছে, কেউ যেন শাবলজাতীয় কিছু দিয়ে চাড় দিয়ে মা মনসা বলে পুজো হওয়া ছবি আঁকা পাথরের টালিকে তুলে নিয়ে গেছে!!

    সনাতন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনা, ধাক্কাটা সামলে নিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে দেখে, পুকুরধারে, রাস্তায়।তার পাথরের দেবীকে নিয়ে গিয়ে কার কী লাভ হবে বুঝে উঠতে পারেনা, কিন্তু নিজের ক্ষতি মেলা, মনসা পুজোর আমদানীতে তার সংসার চলে। এখনি কিছু ব্যবস্থা না করতে পারলে, লোক জানাজানি হয়ে গেলে, কেউ আর তার ঘরে পুজো দিতে আসবেনা!

    ওঝা মানুষ, বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। ভাবনা চিন্তা করতে করতে সকালের কাজ সারে, দু গাল মুড়ি জল খেয়ে মাথায় গামছা দিয়ে ধর্মতলার দিকে হাঁটা দেয়। ধর্মতলায় অনেক পোড়া মাটির টালি পড়ে থাকে, একটা নিয়ে এসে সিঁদুর টিদুর লেপে খালি জায়গাটায় স্থাপন করে দিলেই হবে। তারপরে একটু পরামর্শ করতে হবে।অন্যসময় হলে বড়রায়ের কাছে যেত কিন্তু ইদানীং সে রায়কত্তার ওপর অসন্তুষ্ট।
    টালি নিয়ে এসে স্থাপন করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। তার বাড়িটা একটেরে তাই রক্ষা, লোকজনের চলাচল তেমন নেই, লোকচক্ষুর আড়ালেই কাজ মিটে গেল। এমনি দেখলে কেউ অত বুঝতে পারবে না যে ঠাকুর পালটে গেছে। ভাগ্যিস সেরকম মূর্তি নয়, টালির গায়ে খোদাই, তাও সিঁদুর আর তেল লেপে লেপে, ভালো বোঝাও যায়না কিসের আদল। তবে এই মনসার প্রতিষ্ঠা করেছিল সনাতনের বাবা, তাকে কে যেন দিয়েছিল, মায়ের কাছে এমনটাই শুনেছে।তার আগে ঠাকুরদার আমলে শুধু মনসা গাছ ছিল, উঠোনে, তারই পুজো হত।

    ভাতে ভাত রেঁধে, খেয়েদেয়ে একটু গড়িয়ে নিয়ে সনাতন বেরিয়ে পড়ল। কথাটা সে পাঁচকান করতে পারেনা, একেই ওঝাকে কেউ ডাকেনা আবার যদি লোকে জানতে পারে মনসার থানের মা মনসাও ভুয়ো, তাহলে এগাঁয়ের বাস তুলতে হয়।

    ভেবে চিন্তে সনাতন ছোটপুকুর পেরিয়ে পালপাড়ার রাস্তা ধরে। যদিও মহেন পালের মত মান্যিগন্যি প্রবীন লোকের বাড়ির রাস্তা সে পারতপক্ষে মাড়ায় না, তবু আজ কেমন মনে হচ্ছে রহস্যটা গভীর এবং সত্যিকারের পাকামাথার দরকার এ জট ছাড়াতে।

    কাল রাতে লোকটার মুখটাও ঠিক করে দেখা হয়নি অন্ধকারে। লোকটি গোলমেলে এটা মেনে নিলেও, গাঁয়ে এত কিছু চুরি করার মত থাকতে, ছল করে তার উঠোনের পাথর কেন তুলে নিয়ে যাবে, এটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না!

    (৫)
    থানার নতুন দারোগা ছন্দময় আজকালকার ছোকরা, শহরের ছেলে। তবে কমবয়স হলেও এলেমদার আর তাই তাকে থানার দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে, আগের দারোগা ঘণ্টাকর্ণের জায়গায়। ঘণ্টাকর্ণ প্রোমোশন নিয়ে এখন সদরে বড় থানায় রয়েছে। ছন্দময়ের সব ভালো, শুধু গ্রামের লোকেদের সে বড় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, করুণার চক্ষে দেখে থাকে। কেউ কোন পরামর্শ ইত্যাদি দিতে এলে সে প্রায় শোনেই না।তবে সেজন্যে যদি কেউ মনে করে দারোগার ভয়ে এলাকায় চুরি ডাকাতি সব বন্ধ হয়ে গেছে, তা ভুল।চোর চুরি করবেনা এরকম অলুক্ষুনে কথা শুনলে এলাকার লোকে কানে হাত দেবে।গেরস্ত সজাগ থাকবে আর চোর ফাঁক পেলে চুরি করবে, এই তো দুনিয়ার নিয়ম। শুধু কোনোদিকে বাড়াবাড়ি হলে তখন থানা পুলিশের খোঁজ পড়বে। ছন্দময়কে প্রথম কিছুদিন দেখার পরে এদিককার লোকজনের তেমন পছন্দ হয়নি, তা তারা কানাঘুষোয় আলোচনা করছে পথেঘাটে হাটেবাজারে। অবিশ্যি ছন্দময়ের কানে এখনো সেকথা এসে পৌঁছয়নি। তা তাকে আর বলতে যাবে কে সাহস করে!

    সে এসে থেকেই এমন নিয়মকানুন চালু করেছে থানার লোকেদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে।শুধু কনস্টেবলদের নয়, জমাদার পিওন এমনকি থানার ঝাড়ুদার লাটুকেও রোজ সকাল বিকেল পঞ্চাশটা ডনবৈঠক দিয়ে থানার মাঠে চারপাক দৌড়োতে হয়। মানিকের বয়স কম, সে তাই এই ব্যবস্থায় খুব একটা খারাপ কিছু দেখেনা। বরং ঘন্টা দারোগার আমলে পুলিশকে লোকে আমল দিতনা, এখন এসব দেখে যদি লোকে সমীহ করে তো মন্দ কী!

    সে কথা সে সিনিয়র কনস্টেবল রামভজনকে বলতে গিয়ে অবশ্য মুখঝামটা খেল।

    রামের মেজাজ এই নতুন দারোগা আসা থেকে ভালো নেই। আগে সকাল হলেই রামভজন থানার সামনে বাঁধানো চাতালে বসে খৈনি ডলতে ডলতে আসন্তি জাওন্তি লোকজনের সঙ্গে মুলুকের গল্পগাল করত আর মাঝে মাঝে মানিককে নানা পরামর্শ দিত, এছাড়া দিনে বিশেষ কাজকম্ম তার থাকত না। দুপুরে ঘুম, সন্ধ্যেয় বাজারের দোকানের জিলিপি দানাদার, খাওয়াদাওয়ার সুখ ছিল খুব। কখনো সখনো দারোগার সাথে একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসা, ব্যস, কাজ বলতে ঐটুকু। এই করে করে এতদিনে বেশ একটি নধর ভুঁড়ি বাগিয়েছিল। এই কদিন সকাল বিকেল দৌড়ে কোমর ঢিলে হয়ে গেছে, গা গতরে ব্যথা।লাটু ঝাড়ুদার কাজ খুঁজছে, রামভজনও ভাবছে মুলুকেই চলে যাবে, দু চারটে গাই ভঁইস আছে, জমিজমা যা আছে তাতে বাকী জীবন চলে যাবে।মানিকের উৎসাহ তার তাই একেবারে নাপসন্দ, বরং লাটু তার সমব্যথী, আজকাল লাটুর সাথেই তার দোস্তি বেশী!

    দারোগার নিজেরও যে এই নতুন থানায় দিন খুব সুখে কাটছে তা নয়। মাসখানেকের ওপর হয়ে গেল কোন কেস আসেনা, চোর ডাকাত সব ব্যবসা ছেড়ে কোথায় উধাও হল কে জানে। প্রথম হপ্তায় দুচারদিন থানায় নানা লোক আসছিল, বেশ কিছু চুরির কেসও এল।সে মহা উৎসাহে ঘোরাঘুরি করে কয়েকটা চোরও ধরে ফেলল।তারপরেই সমস্যা শুরু হল। এদিক ওদিক থেকে নানা পাড়ার মাতব্বর গোছের লোকেরা এসে তাকে এদিকে কিভাবে চুরি হয়, কোন চোরকে ধরতে হয়, কাকে ধরতে নেই, কাকে ধরে বকাবকি করে ছেড়ে দিতে হয়, এসব নানান জ্ঞান দিতে থাকে। তিতিবিরক্ত হয়ে সে কারুর কথা না শুনে দুজনকে সদরে চালান করে দিতেই দেখা গেল, লোকে বাকী কেস তুলে নিচ্ছে। ওই দুজনও কোর্টে সাক্ষী অভাবে বেমালুম ছাড়া পেয়ে গেল। এরপর কেউ আর থানায় তেমন আসছে না, এলেও খাতায় নালিশ মোটেই লেখাচ্ছে না, তার সাথে পারতপক্ষে কেউ কথা বলেনা, মানিক বা রামকে বলেই চলে যায়। এ সপ্তাহে এখনো পর্যন্ত একটা মুরগি চুরির কেস এসেছে।

    মনে মনে দমে গেলেও ওপরে নতুন দারোগার কাজে কোন গাফিলতি কেউ পাবেনা, এদেরকে সে দেখিয়ে দেবে তার এলেম। লিখিত নালিশ ছাড়াই টানা দুদিন এ গলি ও গলি, মাঠ খামার ঘুরে ঘুরে ছেঁড়া পালকের সূত্র ধরে শেষকালে পুকুরপাড়ের ছাইগাদায় সে মুরগির পালক চামড়া দেহাবশেষ উদ্ধার হয়েছে, ক্লাবের ছেলেরা স্বীকারও করেছে যে বাগেদের মুর্গি চুরি করে তারাই ফিস্টি করেছে।কিন্তু এত করেও কাউকে ধরে গারদে পুরতে পারেনি। পাড়ায় সালিশি বসে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সব নিজেরা মিটমাট করে নিল।

    আজ সকালে নিজের চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দাঁত কিড়মিড় করছিল দারোগা।আজব জায়গা, চুরি ডাকাতি যাই হোক, মীমাংসা নিজেরাই করে নিতে চায়, এমন ভাব করে যেন থানা বারোয়ারী বৈঠকখানা, দারোগা পুলিশ সব বসে আছে এখানে এমনি এমনি, গল্পগুজব আড্ডা দিতে।
    ঠিক করেছে এবার থেকে খুব কড়া হতে হবে, যারা সালিশি মীমাংসা করবে তাদেরই ধরে গরাদে পুরে দেবে, সে যত বড় মাতব্বর, গ্রামের মাথাই হোক না কেন সব! ভাবতে ভাবতে ছন্দময় যেন নিজের ছন্দ ফিরে পেয়েছে এমনি উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে চোখ মুখ তার। চোরকে এরা একরকম বলতে গেলে সাহায্য করছে তো, আইনের চোখে এরাও অপরাধী কম নয়, অ্যাঁ!

    এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ছন্দময় খেয়াল করে না কখন খোলা দরজা দিয়ে তারক বোস, রায়েদের মেজকত্তা এবং আরো দু চার জন মাতব্বর দলবল নিয়ে ঢুকে বলার অপেক্ষা না রেখেই দারোগার সামনের বেঞ্চি চেয়ার দখল করে বসে পড়েছে।

    খেয়াল হল যখন দেখল মানিক ও রাম এসে আগতদের স্যালুট মেরে টেবিলের দুদিকে টানটান দাঁড়িয়ে তাকেও ইশারা করতে থাকে বাবুদের অভ্যর্থনা করার জন্যে।

    এদিকে দারোগাকে হাসি হাসি মুখ দেখে বাবুদের মনে যারপরনাই আহ্লাদ জাগে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ছোকরা নতুন দারোগা যে বদমেজাজী এ নেহাতই দুষ্টু লোকের রটনা। এই তো দিব্যি হাসিখুশী চেহারা। শহরের ছেলে পাড়াগাঁয়ের ধরনধারণ রপ্ত হতে হয়ত সময় লাগছে, সে সবাই একটু কাছে টেনে আপন করে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।যেন পাশের বাড়ির ছেলেটির সাথে কথা কইছে, এমন গলায় তারক বলে,

    “তা বাবা ছন্দময়, বেশ নামটি কিন্তু বলুন রায়দাদা, ডাকলে মনে হয় যেন গান গাইছি। বাবা, আর কদিন পরেই পঞ্চানন্দের গাজন, সে ব্যাপারে একটু আলাপ আলোচনা ছিল তোমার সঙ্গে, তাই আমরা সবাই এলাম আজ।এছাড়া তুমি গাঁয়ের দারোগা, তোমাকে নেমন্তন্ও করতে এসেছি, সবাইকে নিয়ে যেতে হবে কিন্তু।“

    ছন্দময় বাক্যরহিত। নিজের নামের ওপর এত রাগ জন্ম ইস্তক আগে কখনো হয়নি। এরা মানুষ না রামছাগল, নিজেদের কী মনে করে? থানার দারোগাকে সম্বোধন করছে বাবা ছন্দময়? এরকম শুনলে চোর ডাকাত তাকে আর ভয় পাবে? আবার বলে নাম শুনলে গান মনে পড়ে! মনে পড়াচ্ছি গান, স্টেনগান মাথায় যখন ধরব তখন বাবাবাছা করার মজা টের পাবে! সবকটাকে গারদে পুরব,সাথে এই কনস্টেবল দুটোকেও, দারোগাকে কোনোদিন এত ভক্তিভরে স্যালুট ঠুকতে দেখিনা.........

    মনে মনে আওড়ায়, এসব কথা তো আর মুখে বলা যায়না, প্রতিপত্তি আছে লোকগুলোর যাই হোক, ওপরমহলের সাথে দহরম থাকাও বিচিত্র নয়। এর আগের দারোগা শুনেছে বহুবছর এখানে বসেছিল, প্রোমোশন হত না, এই কারণেই হবে। এদেরকে বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। তবু মুখটাকে যত সম্ভব গম্ভীর করে বলে,

    “কী ব্যাপারে আলোচনা? গাজনের মেলার জন্যে থানার অনুমতি চাই? ঠিক আছে একটা লিখিত দরখাস্ত দিয়ে যান, পঞ্চানন্দের সেবাইতের বকলমে, আমি সদরে কথা বলে রাখব।“

    বাবুরা একটু নড়েচড়ে বসল। এ দারোগা বলে কী, চড়কের মেলার অনুমতি! এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দারোগা তো বাবা পঞ্চানন্দ নিজে, তার কাজে অনুমতি দেবে দুদিনের এই ছোকরা!

    তারক এবার গম্ভীর হয়ে ওঠে,
    “সে নাহয় আমি কাল পরশু দরখাস্ত পাঠিয়ে দেব ছেলেদের হাতে। নাহয় যদি বল তো যেদিন সদরে বড়কর্তাকে নেমন্তন্ন করতে যাব সেদিন সোজা ওনার হাতেই দিয়ে দেব, তোমার এখানে এত কাজ, লোকবলও তেমন নেই, শুধু শুধু আবার গাজনের মেলার কথা বলতে এতটা পথ যাবে।“
    ছন্দময় ইঙ্গিতটা বুঝল। যা ধরেছে ঠিক, এদের ওপরমহলে খাতির আছে, সে ঘাঁটাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবু এখন এদের সামনে মচকালে তার নিজের সম্মান রাখা মুশকিল হয়ে যাবে, থানার কর্মচারীরা কান খাড়া করে সব শুনছে, চাউর হতে দেরী হবেনা।

    “সে দেখুন আপনি, যা ভালো মনে করেন। বড়কর্তা যদি অনুমতি দেন, আমি তো চুনোপুঁটি। তেনার সঙ্গেই আলোচনাও করে নিতে পারেন তাহলে। আমার ওপর কর্তার যেমন আদেশ হবে তেমন পালন করব। আজ আপনারা আসতে পারেন, এখন আমি একটু বেরবো।কিছুদিন ধরেই গাবপুরের হাটে পকেটমারের উপদ্রব খুব বেড়েছে, তাই একবার দেখে আসব।“

    পুরো গুল, সেটা রামের মত মোটামাথাও বুঝতে পারে। গাবপুরের হাটে চিরকালই পকেটমারি হয়, তবে সে যদি কোন বোকা বা নতুন খদ্দের নিজের পকেট সামলাতে না পারে তবেই। রোজের হাট হল উঠতি চোর গাঁটকাটাদের শিক্ষানবিশি করার জায়গা।তার জন্যে কোন দারোগা ছেড়ে কনস্টেবলও কোনোদিন তদন্ত করতে গেছে, এমনটা আজ পর্যন্ত হয়নি। আজ ছন্দময়েরও যাওয়ার কথা নয়, তবু সামনের দিকে তাকিয়ে রাস্তায় হাটুরেদের যেতে দেখে তার তাড়াতাড়িতে এটাই মনে এল।

    কত্তারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করে নিল, ভাবটা এরকম, নাঃ, দারোগাটার ডাঁট আছে বটে, কাজের কাজী কতটা সে অবশ্য বোঝা যাবেনা এখন, তবু দারোগা পুলিশের তেজ থাকা ভালো বই মন্দ নয়।

    “সে তো বটেই, কাজের মানুষের সকালে বসে থাকলে কী আর চলে। তবে বাবা আমরা বলতে এসেছিলুম যে গাজনের সময় চোর ছ্যাঁচোরের উপদ্রব একটু বেড়ে যায়। প্রতিবারেই তাই মেলার দিনে পুলিশ মোতায়েন করা হয় নজরদারীর জন্যে। তুমি এ থানায় নতুন তাই জানিয়ে গেলুম যাতে সময় করে আগে থাকতে সব ব্যবস্থা নিতে পারো।বড়কর্তাকেও জানাবো, তোমাকেও জানিয়ে গেলাম। পঞ্চানন্দের গাজনে দশগাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ে, এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় পরব, আমরা সেবাইতরা চেষ্টা করি তার ব্যবস্থাদিতে কোন ত্রুটি না রাখতে। সে জন্যে তোমাদের সবারই সাহায্য চাই।“
    মেজরায়কত্তা ব্যবসাদার মানুষ, অনেক লোক দেখে, দারোগার মেজাজ বুঝে একটু মধু ঢেলে ইনিয়ে বিনিয়ে কথা কয়ে আবহাওয়াটি নরম করে, দলবল নিয়ে বিদায় নিলে।

    থানা আবার শান্ত হয়ে যে যার জায়গায় ফিরে গেল।তবে ছন্দ দারোগা তো আর কামচোর নয় অথবা বুদ্ধুরামও নয় রাম কনস্টেবলের মতন। সে কিছুক্ষন বসে বসে অনেক চিন্তাভাবনা করে কনস্টেবল দুজনকে আদেশ দিল পুরনো খাতাপত্তর বার করতে, গাজন সম্বন্ধে কিছু রিপোর্ট আছে কিনা একবার দেখতে হবে, তার মন বলছে এমনি এমনি শুধু নিয়মরক্ষে এরা দারোগার কাছে নিরাপত্তার জন্যে আসেনি, গাজনের অপরাধবলী এদের হাতের ও এক্তিয়ারের বাইরে বলেই এত কায়দা করে জানাতে এসেছে!

    দুপুরের দিবানিদ্রার পর থানায় ফিরে দেখে রাম আর মানিক মিলে পুরনো খাতাপত্তর বার করে তার মধ্যে আবার চৈত্রগাজন সংক্রান্ত কাগজ সব আলাদা করে ফেলেছে, প্রধানত মানিকের উৎসাহে। দুপুর শেষ হয়ে প্রায় বিকেল হয় হয়, সেইসব খাতা মন দিয়ে পড়ছে ছন্দময়, এমন সময় টেবিলের ওপর একটা ছায়া পড়ল, মুখ তুলে দেখে লম্বা কালোপানা একটা লোক, কপালে সিঁদুরের ছোপ, গলায় কাঠির মালা, পরনে ধুতি আর ময়লা ফতুয়ার ওপরে পাট করে রাখা লাল জ্যালজেলে গামছা।

    “দারোগাবাবু, আজ্ঞে আমি সনাতন, পালকত্তা পাঠালেন, একটা চুরির নালিশ করতে এলাম।“

    ****************************
  • Sarbani | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:৩৬449768
  • (৬)

    চৈত্রের শেষ, বৈশাখ যে দরজায় কড়া নাড়ছে সে আর কিছু নাহোক, দুপুরের রোদ আর গরম টের পাইয়ে দিচ্ছে। চাদ্দিকে এত গাছপালা, দক্ষিণখোলা বারান্দা, তবু বসে থাকলে একটু একটু ঘাম হচ্ছে, হাওয়ায় তেমন শীতলভাব নেই যেন। আরামকেদারায় চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে রোদ পড়ার অপেক্ষা করতে থাকে মহেন পাল, মাঝে মাঝে পাশে মোড়ায় রাখা হাতপাখাটা টেনে নেয়। গরমে দিবানিদ্রাটা তেমন জুতের হলনা। কাল থেকে ঘুমটা ঘরে পাখার নীচেই সারতে হবে।
    মাথার মধ্যে নানা চিন্তা খেলে যায়, সেদিনের পরে সেই উটকো লোকটাকে আর গাঁয়ে দেখা যায়নি। নিধিরামের চেলাচামুন্ডারা নজর রাখছে কিন্তু লোকটা যেন সেদিনের পর থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। গিন্নি সব শুনে বলে নির্ঘাত ওটা ভুত ছিল। মহেনের অবশ্য ভুতটুতে তেমন বিশ্বাস নেই, তা বললে বাড়ির মেয়েরা ছাড়বে কেন, সর্ষেপড়া নিয়ে এসে চতুর্দিকে দেওয়া হয়েছে, কালী ও পঞ্চানন্দের প্রসাদী ফুল সবসময় জামার পকেটে রাখছে।প্রসাদী ফুলের মাহাত্ম্যেই হোক বা সর্ষেপড়ার ভয়ে, সে লোক আর মহেনের ধারেকাছে আসছে না।

    এদিকে গাজন শুরু হয়ে গেছে, আর দিনকয়েক পরেই চড়কের মেলা।নিধিরাম কথা দিয়েছে যে সে তার লোক রাখবে মেলায় বাইরের লোকের ওপর নজরদারীর জন্যে, বোসেরা থানায়ও যাবে, তবু মহেনের কেমন যেন আনচান লাগছে, কিছু একটা ঠিক নয়, কোথাও একটা গণ্ডগোল কিন্তু কোথায় সে বুঝতে পারছে না। নিধেকে কাল বলেছে বলাহাটিতে লোক পাঠাতে, ভোলাঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে ওই উটকো লোকটার কথা যাচাই করে আসবে।আজ খবর নিতে হবে বলাহাটিতে কী জানা গেল।
    কথাটা মনে পড়তে একটু চাঙ্গা হয়, চোখ খুলে পাশে রাখা গেলাস তুলে দু ঘোঁট জল খেয়ে আরামকেদারায় আবার গা এলাতে যাবে, দরজায় পালগিন্নি এসে দাঁড়ালো, পেছনে আধোঅন্ধকারে ঘরের মধ্যে কে একজন।

    -“সনাতন এসেছে দেখা করতে কী যেন বলার আছে, এখন কথা বলবে না পরে আসতে বলব?”

    -“সনাতন, কে সনাতন?”

    -“বলি ঘুম কি এখনো কাটেনি? গাঁয়ে আবার কটা সনাতন! ওই মা মনসার সেবক গো, ওই সেই খুড়ঠাকুরের নামে যে ওঝা ছিল তার ছেলে। বাছা তুমি বরং এখন একটু বারদুয়ারে বস, কত্তা মুখেচোখে জল দিক, চা হলে চা খেয়ে একটু ধাতস্থ হোক তখন পরামশ্যি যা করার করবেখন”।

    গিন্নির কথার মাঝেই মহেন হাত নেড়ে সনাতন ওঝাকে ডাকে,

    -“ও লখীনদার ছেলে সনাতন, আয়, তোর আবার কী হল? আমি জেগে আছি। তুমি বরং নাতবউকে চা বসাতে বল, সনাতনকেও দিক।“

    গিন্নি গজগজ করতে করতে চলে গেল, সনাতন ওঝা সামনে এসে গড় হয়ে মাটিতে উবু হয়ে বসল। গাঁয়ের পুরনো লোকেরা তাকে ওঝা মানেনা, তাদের কাছে ওঝা ছিল তার বাপ লখীন্দর। অন্য সময় হলে এ নিয়ে তার মুখভার হত কিন্তু আজ আর সেদিকে খেয়াল করার কথা মনে হলনা।

    -“খুড়ো, সব্বনাশ হয়ে গেছে।“

    মহেন একটু অবাক, সনাতনের বউয়ের মৃত্যু, ছেলের ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া এসবই সবাই জানে, পুরনো অঘটন। এখন আবার নতুন করে কী ঘটল, গুরুতর কিছু না হলে তো সনাতনের মত লোক চট করে তার কাছে আসবে না।

    -“সেকীরে, তোর আবার কী সব্বনাশ হল?”

    -“মনসাতলা থেকে বাবার পিতিশঠে করা দেবীর মূর্তি চুরি হয়ে গেছে কাল রাতে। একটা লোক এসে কাল রাতে আমায় এমন বিড়ি খাওয়ালে যে সারারাত মরার মত ঘুমোলুম, কখন যে উঠোনের মনসাতলা থেকে শাবল চাড়িয়ে পাথর তুলে নিয়ে গেছে, বুঝতেও পারিনি।“

    এবার মহেনের হতভম্ব হওয়ার পালা। সনাতনদের বাড়ি সে শেষ কবে গেছে মনেও পড়েনা।এক আধবার ওর বাবা বেঁচে থাকতে গিয়ে থাকবে। মনসাতলা বা দেবী মূর্তি কেমন সে মনেই করতে পারেনা। এমনিতে এদের সাথে সামাজিক লৌকিকতার চল নেই, ওই বউ মেয়েরা মনসাপুজো দিতে যায় হয়ত পালাপাব্বণে।অন্য সময় হলে এই চুরিকে সে অত গুরুত্ব দিতনা, কিন্তু সময়টা গোলমেলে।

    মহেন এক এক করে পুরো কাহিনীটা জেনে নেয় সনাতনের কাছ থেকে। সনাতন এসেছিল দ্বিধা নিয়েই, রায়কত্তার সঙ্গে খটাখটি হয়েছে বলেই সেখানে যায়নি। ভেবেছিল পালকত্তাও সব শুনে তাকে খেদিয়েই দেবে, তবু বুদ্ধিমান কাউকে বলা রইল, এইটুকু সান্ত্বনা থাকবে। মহেন পাল এত উত্তেজিত হয়ে পড়বে সব শুনে, এ তার আশার অতীত। পালকত্তা অনেক প্রশ্ন করল ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে। কিসের তৈরি মূর্তি, দামী ধাতু বা পিতল কাঁসার কিনা!সে চেষ্টা করল মনে করে করে যেটুকু জানে ঠিকঠাক উত্তর দেওয়ার।

    কথাবার্তার মাঝে চা আর কুচো নিমকি এল।সনাতন অনেককাল এমন চা আর ঘিয়ে ভাজা নিমকি খায়নি। আয়েশ করে খেতে খেতে তার চোখ বুজে এল, নাঃ এ গাঁয়ে এখনো ভালো লোকজন আছে বলেই মনে হচ্ছে, পালকত্তা সত্যিকারের মহৎ লোক, নাইলে আর তার এত সম্মান দশ গাঁয়ে, সনাতনের মত গরীবকেও কত খাতির করছে।
    মহেন সব শুনে বেশ ধন্দে পড়ল। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা সেই বলাহাটির ভোলাঠাকুরের উটকো লোক হলেও হতে পারে।ধড়িবাজ লোক, বিড়ির মশলাতে কিছু জড়িবুটি মিশিয়ে খাইয়েছে। কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে এত লোক থাকতে সনাতনকে কেন, গরীব মানুষ, দু বেলা খাওয়া জোটে যার কোনরকমে? তারপরে লোকটা এই কদিন গাঁয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, অথচ নিধিরামের চেলাদের চোখে পড়ল না!
    এ নিয়ে অবশ্য মহেনের একটু সন্দেহ আছে, সেই দিনও নিধিরামের দুজ্জধন লোকটাকে খুঁজে পায়নি, অথচ নিধিরামের কথা অনুযায়ী দুজ্জধনের অসীম ক্ষমতা, ছ কোশ দূরে মানুষ থাকলেও সে টের পেয়ে যায়।
    তা সে নাহয় কোনোপ্রকারে নিধিরামের লোকদের ফাঁকি দিয়ে গ্রামে ঢুকেছে লোকটা,কিন্তু এই মনসার পাথরের মূর্তিখানা এত ঝুঁকি নিয়ে তুলে নিয়ে গেল কেন?

    কথাবার্তা ও ভাবনাচিন্তার মাঝেই মহেন পাল বৈকালিক ভ্রমণের জন্যে তৈরি হল। সনাতন সব কথা পালকত্তাকে বলে বেশ হাল্কা মেজাজে একটি একটি করে নিমকি প্রায় চুষে চুষে খাচ্ছে। দেখে একটু মায়া হল মহেনের, একা থাকে, বড়রায় বলছিল, সাপের ওঝাগিরি নাকি আজকাল আর চলেনা, রোজগার পাতি তেমন নেই, ছেলেটাও ছেড়ে গেছে, খাওয়াদাওয়া হয় না হয়ত ঠিকমত। তৈরি হয়ে বেরোতে গিয়ে নাতিকে ডেকে বলল, সনাতনের রাতে খাওয়ার কথা ঠাকুমাকে বলতে। সনাতন সেকথা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়,
    -“খুড়ো, তাহলে আমি কী করব এখন?আগের মত মনসাগাছেরই পুজো হবে না পোড়ামাটির টালির?”

    সদরের দিকে যেতে যেতে মহেন কী ভেবে বলে,
    -“সে ঠিক আছে, ঠাকুর সর্বত্র থাকে, পোড়ামাটি হোক বা পাথর, ভক্তিভরে পুজো করা নিয়ে কথা। যা হয়েছে যতক্ষণ না এর একটা কিনারা হচ্ছে ততক্ষণ কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। শুধু তুই একবার থানায় চলে যা, গিয়ে দারোগাকে আমার নাম করে পুরো ঘটনাটা বল। এও বলিস যখন তদন্ত করবে তখন আমার সঙ্গে একবার কথা বলে নেয় যেন আর তদন্ত একটু চুপিসারে করতে, ঘন্টাদারোগার মত ঢাক ঢোল বেশী না পেটাতে। আর রাতে এখানে এসে খুড়িমার কাছে খেয়ে যাস, এ কদিন নাহয় এখানেই খেয়ে নিস দুবেলা।“

    সনাতন এমনিতে থানা পুলিশ বারোয়ারী এসবের থেকে দূরে থাকে কিন্তু আজকের ব্যাপার ভিন্ন। এই প্রথম তার নিজের বাড়িতে চুরি হয়েছে। যদিও তার এখন মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা বুঝতে ভুল হয়েছে চোরের। হয়ত তাকে এ গাঁয়ে কেউ পাঠিয়েছে অন্য কিছু চুরি করতে, লোকটা ভুল করে সনাতনের মনসা ঠাকুরকে তুলে নিয়ে গেছে।মহেন পালের রকমসকম দেখে তার ধারণাটা আরো পাকা হচ্ছে, পালখুড়ো জানে কী চুরি করতে এসেছিল চোর, পুলিশে খবর হয়ত সেইজন্যেই দিতে বলছে। তাকে বলবেনা আসল কথাটা, দারোগাকে বলবে।
    সনাতনকে থানার দিকে রওনা করিয়ে মহেন পাল চলল নিধিরামের বাড়ির দিকে। যদিও এত হাঁটাহাঁটি আজকাল আর ভালো লাগেনা কিন্তু নিধিরামের সঙ্গে কথা বলা জরুরী, আর সে তো বাতে কাবু, তাকে ডেকে পাঠানোও যায়না।

    পঞ্চানন্দের মন্দিরের ওদিক থেকে গাজনের ঢাকের শব্দ আসছে, ভক্ত সন্ন্যাসীরা মাঠে চড়কের মহড়া দিচ্ছে বোধহয়।পঞ্চানন্দের গাজনের ভক্ত হয় অনেক, লোকে রীতিমত সুপারিশ করে সন্ন্যাস নেয়, অনেকের মানত থাকে।ফি বছর তার কাছেও দু চারজন আসে ভক্ত হবার সুপারিশ নিয়ে। বোসেরা এব্যাপারে বড় কড়া, জাগ্রত দেবতা, পঞ্চানন্দের সন্ন্যাসীদের এতটুকু ভুলচুক হলে বাবার কোপে পড়বে সবাই, তাই ভালো করে দেখেশুনে তবেই তারা ভক্ত হতে দেয়।
    এখন রোজ বিকেলেই একবার মন্দিরের দিকে যায় মহেন, অন্যরাও আসে, সব ব্যবস্থাদি একবার দেখেশুনে নিতে এক হয় পাকামাথারা। কাল চড়ককাঠ তোলা হবে, আজ পান সুপারি দিয়ে চড়ককাঠকে আহ্বান করে আসার কথা।আজ মন্দিরে গেলে আটকে যাবে তাই সে আগে নিধিরামের কাছে চলল, বলাহাটির খবর জানা জরুরী।

    কিছুটা গিয়ে দেখল নিধিরামের নাতি তপাই আসছে, পঞ্চানন্দের সন্ন্যাসী ভক্তদের জন্যে ফলমিষ্টি পাঠিয়েছে তার মা। মহেনকে দেখে বলল,

    -“যাও, দাদু তোমার জন্যে বসে আছে। আমাকে বলছিল তোমার ওখেনে নিয়ে যেতে, মা মানা করল। ব্যথা বাড়লে চড়কের সময় ঠাকুর দর্শন করতে পারবেনা, তাই এখন একটু সামলে রাখতে হবে।“

    মহেন কিছু বলে না। নিধিরামের বাড়ি পৌঁছতে নিধিরাম তাড়াতাড়ি দুয়ার থেকে নেমে আসে। গলা খাদে নামিয়ে বলে,

    -“দাদা, তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। গোবিন্দ দুপুরে ফিরেছে বলাহাটি থেকে।“

    এতটা হেঁটে এসে আর উত্তেজনায় মহেন দুয়ারে মাটিতেই বসে পড়ে, নিধিরামেরও খেয়াল হয় না কাউকে ডেকে আসন দিতে বলতে, সেও মহেনের পাশে বসে পড়ে।

    “বলাহাটিতে কেউ ভোলাঠাকুর নেই। কালীতলার পুরুতের নাম অন্য। সেও ওই তোমার উটকো লোকটার ভুতের গল্পের বিন্দুবিসর্গ জানেনা। আমাদের এ গাঁয়ের নাম শুনেছে তবে তোমাকে চেনে টেনে না।“

    মহেন খুব বেশী অবাক হয়না। সেও এরকম কিছু একটাই আশা করছিল, দুয়ে দুয়ে চার যে হবেনা ব্যাপারটা সে তো বোঝাই যাচ্ছে।

    নিজের কথা বলার আগে সে বলাহাটির গল্পটা পুরো জানতে চায়।

    -“নবীন মুহুরীর পরিবারের খোঁজ করেছিল গোবিন্দ? এ গাঁয়ের সঙ্গে বলাহাটির যোগসূত্র কিন্তু ওই নবীন মুহুরী।“
    -“হ্যাঁ, নবীন জ্যাঠার খোঁজ নিয়েছিল। তার পরিবারের কেউ ওখানে থাকেনা। ছেলে নাতিপুতি অনেককাল কলকাতা না দুর্গাপুর কোথায় চলে গেছে, জমিজমা সব বেচে দিয়ে। শুধু বসতবাড়িটা আছে, আদ্ধেক ভেঙে পড়েছে, গোবিন্দ যেমন বলল। বাকী অদ্ধেক নিয়ে ওদের রাখালের পরিবার থাকে। বাড়ির সাথে বাগান পুকুর আছে, কে এক ভাগ্নে না ভাগ্নের ছেলে আছে জ্যাঠার, তাদের ভাগে পড়েছে, তারা মাঝে সাঝে এসে যা আয় হয় নিয়ে যায়। গোবিন্দ ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসেছে দাদা, নবীন জ্যাঠার পরিবারে ভোলা বলে কেউ নেই।“

    মহেন নিধিরামকে সনাতনের ঠাকুর চুরির ঘটনাটা বলল। নিধিরাম বেশ লজ্জা পেল, তার শাগরেদরা সারা গাঁয়ে নজর রেখেছে, আসা যাওয়ার রাস্তায়, রাতবিরেতে বাইরে থেকে অজানা সন্দেহজনক কেউ এলে তাদের চোখে পড়ার কথা। লোকটা এত ধুরন্ধর হবে সে ভাবতেও পারছে না। গোবিন্দদের মত বাঘা চোরেদের নজর এড়িয়ে চুরি করে ফেলল, তারা টেরও পেলনা!

    -“সমস্যা হচ্ছে, কাল চড়ককাঠ উঠবে, এরপরে বানের জলের মত বাইরের লোক ঢুকবে, তখন আর কিছু করার থাকবেনা। কিন্তু সনাতনের মনসা চুরি করল কেন? তবে কি ভুল করে?”

    নিধিরামের কাছেও এর জবাব নেই। আজ আর দুজনের গল্পগাল হলনা। দুজনেই অন্যমনস্ক, একজন বাড়ির ভেতরে ঢুকল, অন্যজন মন্দিরের পথ ধরল।
    মহেন মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছেছে, ধুনোসেবা আরম্ভ হয়েছে, আটচালার সামনেটায় ভিড়,

    “পঞ্চানন্দের চরণের সেবা, সেবা করিলে সেবা,

    তোমার ভক্ত তোমায় ডাকে.........মহাদেব”

    আটচালার আলোর জন্যে তেঁতুলতলার এদিকটা অন্ধকার, মহেন অন্ধকারটা পেরচ্ছে, এমন সময় পাশ থেকে একজন বলে উঠল,

    -“কত্তামশায়, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল যে”।

    ********************************
  • Sarbani | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:৪৭449769
  • (৭)

    ছন্দময় দারোগার দোষ যাই থাকুক, সে ঘন্টা দারোগার মত অবুদ্ধির নয়। সনাতনের কাছে সব শুনে সে বুঝতে পারল ব্যাপারটার কিছু একটা গুরুত্ব আছে নাহলে মহেন পাল সনাতনকে তার কাছে পাঠায় না।এ থানায় এসে সে কানাঘুষোয় শুনেছিল কীভাবে মহেন পালের বুদ্ধির জোরেই মূলত তার পূর্বসূরি ঘন্টা দারোগা একটা বড় কেসের সমাধান করে প্রোমোশন পেয়েছে।
    তাই সনাতন চলে যাবার পর সে আর দেরী না করে রামকে থানায় রেখে শুধু মানিককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে গাঁয়ের উদ্দেশ্যে।

    মেলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে, দুটো পুকুরের পাড় আর স্কুলের মাঠ জুড়ে মেলা চত্বর, বাঁশ বাঁধা চলছে, দু একজন তার মাঝে খাবার দাবার আর টুকটাক জিনিস নিয়ে বসেছে।মেলা সম্বন্ধে যা পড়েছে তাতে উল্লেখ আছে যে এই মেলায় গাছের আর বীজের বিশাল বিক্রি হয়, এছাড়া মাছ ধরার সরঞ্জাম ও লোহার জিনিসের। সারা বছরের বাণিজ্য হয় এসব দরকারী জিনিসের, চাষির লাঙলের ফাল থেকে কোদাল শাবল, মাছের জাল, ছিপ কাঁটা ঘুনসি ইত্যাদির এত বড় মেলা আর এদিকের দশ গাঁয়ে হয় না।
    বাবা পঞ্চানন্দের দূর দূর অবধি নাম, ভক্তের ভিড় হয় মেলা, প্রচুর মানত ইত্যাদিতে আয় হয় বিস্তর।সেরকম বড় চুরি না হলেও, ছুটছাট চুরি পকেটমারি হয়ে থাকে, কখনো বেশী, কখনো কম, তবে সেইসঙ্গে সদর থেকে ভালো সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েনের ব্যবস্থা করা হয়, দমকলের গাড়িও থাকে।বছর দুয়েক আগে কিছু বড় দোকানে লাগাতার দু রাত চুরি হয়ে একটু হইহই হয়েছিল, সম্ভবত এলাকার বাইরের চোরের কীর্তি।

    সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে, দারোগা পুরো জায়গাটা এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চক্কর কাটল সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্যে। সব দেখেশুনে তেমন কিছু মনে হলনা, তবু মানিককে সজাগ থেকে টহল জারী রাখতে বলে মন্দিরের আটচালার দিকে যেতে গিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ লাঠিহাতে পুকুরের ওদিকটা থেকে আসছে। মহেন পালকে এর আগে সে একবারই দেখেছে দূর থেকে, তবু দারোগার চোখে চিনতে ভুল হলনা নিঃশব্দে অথচ দ্রুত পায়ে পাশে গিয়ে ডেকে উঠল।

    মন্দিরের দিকে ভিড় জমেছে, কর্তারা সব পাশের চালাঘরে বসে গজল্লা করছে। হাঁকডাক হচ্ছে আর তার সাথে কাজের লোকেদের ধমকাধমকি চলছে, অবশ্য কাজ যা যেমনভাবে হওয়ার তেমনভাবেই হচ্ছে, তবু কত্তাদের হাঁকডাকে সারা চত্বর একেবারে সরগরম হয়ে আছে। মহেন পাল দারোগাকে নিয়ে মন্দিরের ওখানে না গিয়ে নিমাই সাঁতের দোকানের পিছন দিকটায় বাঁশের বেঞ্চি আছে সেখানে গিয়ে বসল। সেখান থেকে বোসপুকুর দেখা যায়।পুকুরের ঘাট থেকে জলের ভেতর কিছুটা গিয়ে ছোট একটা ঘর, সেখানে চাতালে প্রদীপ রাখা। ওখানে আজ চড়ক কাঠকে আহ্বান করে পান সুপুরি দেওয়া হয়েছে, তাই প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ।
    অনেক আগে ওই ঘরে পঞ্চানন্দের বাসনকোসনের সিন্দুক ও অন্যান্য সামগ্রী রাখা থাকত।মন্দিরের ঘাট লাগোয়া পুকুরপাড়ে ছিল ঘরখানা।সাতাত্তরের বন্যার পরে সেই ঘাট ভেঙে গিয়ে পুকুরের সীমানাও বদলে যাওয়ার পরে ঘরটা এখন অর্ধেক জলের তলায়।পুরনো মন্দিরেরও পরে অনেক অদলবদল হয়ে গেছে। ও ঘরের জিনিসপত্র সব সরিয়ে নিয়ে এসে এখন নতুন মন্দিরের লাগোয়া ভাঁড়ার ঘরে রাখা আছে।তবে অনেক আগে যখন পঞ্চানন্দের ভার বোসেদের ওপর আসেনি, তখন নাকি ওই ঘরে ওদের গোবিন্দ থাকত।গোবিন্দর সে আসন আছে একপাশে তাই এখনো কীসব তিথিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে আসা হয়। ওখানে যাওয়ার জন্যে ঘাটের একপাশে চালার ওপরে ছোট একটা কাঠের ভেলাও তুলে রাখা আছে।

    দারোগার ডাকে পালকত্তা পুকুর থেকে চোখ সরিয়ে দারোগা ছন্দময়কে উটকো লোকের বৃত্তান্ত সব জানিয়ে বলে,
    -“আমার ধারণা লোকটা কোনো একটা মতলবে বিশেষ করে এই গাজনের সময় এ গাঁয়ে এসে ঘোরাঘুরি করছে। আর এক দুদিনে এই মেলা এমন আকার নেবে যে এরকম কোনো লোককে ভিড়ের মাঝে খুঁজে বার করা সে ধানের গাদায় ছুঁচ খুঁজে বেড়ানোর সামিল হবে।“
    ছন্দময় বয়সে নবীন হলেও অবস্থার গভীরতা সম্যক উপলব্ধি করার মত বুদ্ধি তার আছে।সে মহেন পালের কথায় ঘাড় নেড়ে বলে,
    -“ঠিক কথা। তবে রহস্যটা যা বলছেন তার অনেকটাই এখনো অজানা।ধরুন এমন হল যে ওই উটকো লোকটার সঙ্গে মনসা চুরির কোনো সম্পর্কই নেই।সনাতনের গল্প সত্যি হলেও নেই। লোকটা আপনার কাছে কেন এসেছিল সেটাও ধরা যাচ্ছে না।
    গাজনের মেলায় চুরি করতে এসে আপনার সঙ্গে কী দরকার! আমরা এই ভিড়ে লোকটাকে খুঁজে বার করলেও তার অপরাধ কী, কিভাবে জানা যাবে? যতক্ষণ না অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে ততক্ষণ আমরা কিছুই করতে পারব না।“

    মহেন পাল বিচক্ষণ মানুষ, দারোগার সমস্যাটা বুঝতে পারে।দারোগাকে নজর রাখতে বলতে গিয়েও যুতসই কারণ খুঁজে পায়না অথবা কোথায়ই বা নজর রাখতে বলবে।হাতে সময় বেশী নেই। এমনও হতেই পারে তার আশংকা পুরোপুরি অমূলক, যদিও সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে গণ্ডগোল কিছু আছে।
    একটাই ভরসা যে নিধিরাম আরো লোক লাগাবে বলেছে চাদ্দিকে নজর রাখতে। যদিও ছন্দময় দারোগাকে দেখে কথা বলে বেশ বুদ্ধিমান মনে হয় তবু ওই কটা তালপাতার সেপাই নিয়ে এত বড় মেলায় অপরাধী ধরা অসম্ভব, এবং সবচেয়ে বড় কথা হল আসল অপরাধ যে কী হতে পারে সেটা জানা নেই, শুধু অপরাধী কে তাই অনুমান করা হচ্ছে!
    -বাপু, তুমি নাহয় এখন মনসা পাথর চুরিরই তদন্ত কর, ওই কেঁচো খুঁড়লেই আসল সাপ বেরোবে বলে আমার বিশ্বাস।“

    ছন্দময় আপত্তি করে না, এমনিতে তার হাতে কাজ কিছু নেই, মেলার জন্যে সদর থেকেও কাল লোক আসবে, ফোনে বড়কত্তার সাথে কথা হয়েছে। তাদের তদারকির মাঝে মাঝে সে এই উদ্ভট চুরির কেসটাও নাহয় দেখে নেবে।

    ছন্দময়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মন্দিরের দিকে আর না গিয়ে পালকত্তা বাড়ির পথে পা বাড়ালো।সন্ধ্যে পার করে ঘরে ঢোকার জন্যে গিন্নির বিস্তর মুখঝামটা খেতে খেতে অন্যমনস্কে হাত পা ধুয়ে সন্ধ্যে আহ্নিক সেরে ঘরে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিল।

    গিন্নি চায়ের সঙ্গে একটা প্লেটে কিছু ফল বাতাসা নিয়ে এসেছে। মহেন পাল খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সংযমী, সন্ধ্যেয় চা ছাড়া কিছু খায়না, রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে। একটু বিরক্তি দেখিয়ে “কিছু খাইনা এখন, জাননা” বলাতে গিন্নি আহা আহা করতে করতে মাথায় প্লেটটা ঠেকিয়ে বলল,
    -“এরকম বলতে আছে, ঠাকুরের প্রসাদ। দেখেশুনে কথা বলবে তো। অন্তত একটা বাতাসা, আর এক টুকরো ফল ছোঁয়াও মুখে, প্রসাদে কিছু হয়না। তাও তো সিন্নি দিই নি।“
    মহেন একটু অবাক হল। তার বাড়িতে সিন্নি পুজো হল, সে জানেনা।
    -নারায়ণ পুজো আবার করলে কখন? বাড়িতে কোন আয়োজন চোখে পড়েনি তো।
    -আঃ মোলো যা, তোমার দেখছি বুদ্ধিসুদ্ধি সত্যিই লোপ পেয়েছে। বয়স হলে কি সব যায়?
    মহেন পালের বুদ্ধির ওপর চার গাঁয়ের লোকের ভরসা চিরকাল অটুট থাকলেও, গিন্নির ওতে কোনকালেই তেমন আস্থা নেই।
    মহেন অবশ্য ব্যাপারটা ধরে ফেলে নিজেকে শুধরে নিল সঙ্গে সঙ্গে। আসলে সত্যিই সব মিলিয়ে মাথায় এমন জট পাকিয়ে আছে যে ছোটখাটো ব্যাপারে আর মাথা খেলছেনা।
    -কার বাড়ি থেকে দিয়ে গেল প্রসাদ? এসময় আবার সিন্নি হয় কী করে, পুন্নিমে তো নয়?
    গিন্নির মুখে হাসি ফুটল, নাঃ কত্তার জ্ঞান এখনো টনটনেই আছে, শুধু একটু ধাক্কা দিতে হয় মাঝে মাঝে।
    -আরে, মান্নাদের ছোট ছেলে দোকান খুলল গাবপুরে, তার পুজোতেই সিন্নি হয়েছে। মান্না গিন্নি নিজে এসে প্রসাদ দিয়ে গেল।

    মহেন আর বাক্যব্যয় না করে প্রসাদের ফল চিবিয়ে বাতাসা জল খেয়ে চায়ের কাপ নিল হাতে।কী যেন একটা মনে পড়ছে অথচ ঠিক পরিস্কার নয়, কিছু একটা গিন্নির কথা শুনে মনে এল আবার মিলিয়ে গেল ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে এল, চটকা ভাঙল কার একটা ডাকে,
    “ও দাদা, গায়ে চাদর দাওনি, হাওয়াটা ভালো নয়, হিম লেগে যাবে।“
    এতো ধীরেন মান্নার গলা। তাই তো, জানালা দিয়ে হাওয়া এসে একটু শীত শীত করছে। কিন্তু ধীরেন কোত্থেকে এল, এই রাতবিরেতে বেরোবার মানুষ তো সে নয়।
    ভালো করে হুঁশ আসার আগে কিছুক্ষণ বোঝভুম্বুল হয়ে বসে রইল। মাথাটা একটু একটু করে পরিস্কার হয়ে এল, ওঃ স্বপ্ন দেখেছে। ধীরেন মান্নার বাড়ির সিন্নির আলোচনা, তাই। ভাবতে ভাবতে বিদ্যুতের মত মনে পড়ে গেল, আরে ধীরেন বলেছিল না, ভোলা ঠাকুরের লোক তাই অমন ধারা। বলাহাটিতে কোন ভোলা ঠাকুর নেই, সে বা নিধে কোনো ভোলা ঠাকুরকে চেনেনা, তবে ধীরেন কোন ভোলাঠাকুর নামটা শুনে অবাক হওয়ার পরিবর্তে এমন মন্তব্য করল!

    মহেনের আর তর সইছিল না, মনে হল তখনই মান্না বাড়ি গিয়ে ধীরু মান্নাকে জিগ্যেস করে ভোলাঠাকুরের ব্যাপারটা পরিস্কার করে নেয়।হাতে সময় নেই, তার মন বলছে গাজনে কিছু একটা হবে।
    কিন্তু রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে, ধীরেন মান্না সন্ধ্যের মুখেই খাওয়াদাওয়া মিটিয়ে শুয়ে পড়ে, শত ডাকলেও সে এখন উঠবেনা। অনেক ভেবেচিন্তে মহেন ঠিক করল ভোর অবধি অপেক্ষা করে মান্না বাড়ির দিকে যাবে, তার বাড়ি থেকে বেশী দূর নয়, খামারের ভেতর দিয়ে গেলে প্রায় পাশের বাড়িই বলা যায়।

    **********************

    (৮)

    ধীরেন মান্না খুব ভোর ভোর ওঠে, ভোরে ওঠা শরীরের পক্ষে ভালো। প্রতিদিনই সে চেষ্টা করে যাতে তার বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও তার সাথে উঠে পড়ে। কিন্তু কেউই এ নিয়ম মানে না, পাশে শোয়া গিন্নি পর্যন্ত ডাকতে গেলে হয় মুখ ঝামটা দেয় নয় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে।
    ধীরেনের ভোর মানে অবশ্য প্রায় রাত থাকে, মোরগ ডাকারও আগে। আবছা অন্ধকারে উঠে সে টুপি মাফলার সোয়েটার ইত্যাদি ভালো করে জড়িয়ে বাগানে পায়চারি করে, মর্নিং ওয়াক।এইসময় কেউ কোথাও থাকেনা, শীতের সময় খেজুর রস পাড়তে যায় যারা তারা আর অবশ্য রাতের অতিথিরাও ডিউটি সেরে এসময় ফেরে এবং জানে বলে মান্না বাড়ির দিকটায় কেউ ঘেঁসেনা।

    আজ সবে দুই পাক ঘুরেছে, ওদিকের খামার পার করে ডোবার পাশ দিয়ে টুকটুক করে মহেন পাল হাজির লাঠি হাতে। মান্না কত্তা একটু অবাক হল, আলো ফুটে চিনতে পেরেছে তাই নাহলে চোর ভেবে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত।
    -একী দাদা, তুমি এই ভোরে, কী হয়েছে?
    -কিছু হয়নি রে, বয়স হয়ে মাঝে মাঝে ঘুম হয়না ঠিকমত, তাই সক্কালে বেরিয়ে পড়েছি। খামারের দিকটা আসিনি অনেকদিন, সব তো ছেলেরাই দেখে আজকাল, তাই এদিকে এসে চোখে পড়ল তুই পায়চারি করছিস।তোর এই স্বভাবটা কিন্তু ভারী ভালো, শীত গ্রীষ্ম এই সক্কাল সক্কাল উঠে পড়ার অভ্যেস, নীলু ডাক্তার বলে সকালে উঠলে শরীর খুব জুতের থাকে, হজম ঘুম সব ভালো হয়। কিন্তু কটা লোকে পারে বল, তুই পেরেছিস। “
    ধীরেন মান্নার শুনে ভারি আরাম হল, তার শরীর নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতার কারণে ঘরে বাইরে সবাই তাকে বায়ুগ্রস্ত বলে সে জানে। আজ পালকত্তার মত বিজ্ঞজনের প্রশংসা শুনে বেশ একটা প্রশান্তির ভাব এল।
    -“চল দাদা ঘরে, সকালের চা খেয়ে যাবে, আমি নিজে বানাই, তুলসীপাতা আর মধু দিয়ে।“
    -সে নাহয় যাব, কিন্তু তার আগে একটা কথা বল দিকি। সেদিন তোর সাথে বারোয়ারীতলার কাছে দেখা হতে আমি যখন বললাম আমার সাথের লোকটা ভোলা ঠাকুরের লোক, তখন তুই বলেছিলি, ভোলাঠাকুরের লোক তাই অমনধারা। মনে পড়ছে?
    ধীরেন মান্না একটু ভাবল,
    -ঠিক মনে পড়ছেনা। তবে তুমি যখন বলছ তখন হবে।
    -আরে সেই আমার সঙ্গের লোকটা, তোর প্রথমে দূর থেকে মনে হয়েছিল ছিদের মত দেখতে।

    ধীরেন মান্নার এবারে মনে পড়ল কিছুটা।
    -আরে তাই তো। সেদিন বাড়ি এসে শুনি খোকা ছিদেকে কাঠের ঘরের চালে নতুন খড় দিতে বলেছিল, তা ছিদে না দিয়েই ভক্ত হয়ে গেল, তাই নিয়ে খোকা রাগ করছিল। এখন কতদিন আর কাজ পাওয়া যাবেনা। ঘরে হাওয়া ঢুকে আগুনের জ্বাল দিতে মেয়েদের অসুবিধে হয়।তাতেই আমি খোকাকে বললাম ছিদের মত একটা লোককে দেখলাম, তবে পালদাদা বলল ও ছিদে না, ভোলাঠাকুরের লোক। পরে ভেবে একটু অবাক লাগল, এতকাল ভোলাঠাকুর বেঁচে আছে কেমন করে!আমার তখন কত আর বয়েস, তখনই সে তিরিশের কোঠায়। এখন তো তার একশর ওপরে বয়স হওয়ার কথা।

    মহেন পাল একটু অধৈর্য হয়ে বলে,
    -ভোলাঠাকুর কে? তুই তাকে কিভাবে চিনতিস।
    -“আরে তোমার বোধহয় মনে নেই, তুমি তো আবার সেসময় মামাবাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে। আমি তখন সেকেন্ডারী ইস্কুলে পড়ি। ভোলাঠাকুরকে নিয়ে এসেছিল বোসেরা।তাকে সবাই ঠাকুর বলে ডাকত কারণ সে একটু সন্নেসী ধরণের ছিল, বিয়ে থা সংসার করেনি। বোসেদের এক মুহুরী ছিল তার কীরকম আত্মীয় বা পরিচিত ছিল।
    তার হাতের কাজ ছিল খুব ভালো, পাথর মাটি এইসবের কাজ জানত। আগে নাকি কোন জমিদারের বাড়ি থাকত, একটু পাগলাটে ছিল।সে আমাদের স্বজাতি ছিল বলে ব্যবস্থা হয় আমাদের বাড়ি থাকার। তখন তো মাটির বাড়ি, বারদুয়ারে একটা ঘর ছিল মনে আছে তোমার, যেখানে আমাদের মাস্টার পড়াত, সেই ঘরে সে থাকত।
    আমি তার কাছে খোদাইয়ের কাজ শিখব বলে প্রথমটা খুব সঙ্গে ঘুরতাম, কিন্তু তার তেমন সময় হতনা। বোসেদের মন্দিরের কিছু কাজ নিয়ে এসেছিল, সেখানেই দিনরাত পড়ে থাকত। তবে তার কাছে খুব অদ্ভুত লোকেরা আসত, বাবাদের আলোচনায় শুনেছিলাম সে নাকি নানারকমের সিন্দুক ও গোপন কুঠরি তৈরি করতে পারত, অনেক রাজারাজরাদের ধনসম্পত্তির সুলুকসন্ধান তার জানা ছিল তাই নানা ধরণের লোকেরা তার কাছে আসত। কেউ কেউ চোরডাকাত, কেউ আবার পাগল ধরণের, ভোলাকে সন্নেসী ঠাউরে গুরুবিদ্যে ওষুধ মাদুলী চাইত, কেউ কেউ নাড়া বাঁধতেও আসত। তবে সে এমনিতে মানুষ বোধহয় খারাপ ছিলনা, খারাপ কিছু শুনিনি, বরং গুণী ছিল বলেই বলত লোকে, একটু আলাদা খামখেয়ালে প্রকৃতির।
    বোসেদের কাজ শেষ হতেই সে চলে যায়।বাবা বেঁচে থাকতে মাঝেসাঝে এসেছে দেখা করতে, আমার মাকে মা বলে ডেকেছিল, পরে আর যোগাযোগ ছিলনা।"

    মহেন পাল এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল। বোসেদের সঙ্গে বা পঞ্চাননের মন্দিরের সঙ্গে ভোলাঠাকুরের একটা সম্পর্ক তাহলে পাওয়া গেছে।তবে শুনে মনে হচ্ছে ভোলাঠাকুর সম্ভবত বেঁচে নেই। ধীরেন যেরকম বলছে তাতে হিসেবটা তাই দাঁড়াচ্ছে। উটকো লোকটা ভোলাঠাকুরের নাম নিল কেন? বলাহাটির সাথেও একটা যোগ পাওয়া গেল, যা মনে হচ্ছে নবীন মুহুরীই ভোলা ঠাকুরকে নিয়ে এসেছিল।
    এতসব কথার পরেও ধীরেন মান্নার মনে অবশ্য কোনো প্রশ্ন জাগল না। সে বেশীরভাগই নিজেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, অন্য কোনো কিছুতে মাথা ঘামায় না। তবে চেষ্টা করেও মহেন চা খাওয়া এড়াতে পারলনা। অবশ্য শেষমেশ তাকে মান্না কত্তার হাতের বিস্বাদ চা খেতে হলনা, উৎসব পাব্বণের বাজারে গিন্নি ও বউ মেয়েরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে, মান্না গিন্নি নিজে হাতে চা বানিয়ে গাঁ সুবাদের ভাসুর ঠাকুরকে খাওয়ালো।

    বাড়ি ফিরে মহেন পাল চান পুজো, সকালের জলখাবার শেষে পঞ্চানন্দ মন্দিরের দিকে চলল। বোসেদের মধ্যে তারক এখন সর্বজ্যেষ্ঠ, তার সাথে কথা বলা জরুরী হয়ে যাচ্ছে। এখন তাকে মন্দিরেই পাওয়া যাবে। তারকের সাথে কথা বলে নিধিরামের কাছে যাবে। এ বয়সে এত হাঁটাহাঁটি করলে গিন্নি ও ছেলে নাতিরা রাগ করে। এমনেতে তার অসুবিধে হয় না, বয়সকালে কোশ কোশ হেঁটে মেরে দিত, সাইকেল টাইকেল চড়েনি কোন কালে। আজকের ছেলেপুলেরা দু পা যেতেই সব সাইকেল বার করে, মাইলটাক হাঁটতেই জিভ বেরিয়ে যায়।

    তারক বোস মন্দিরের লাগোয়া ঘরে বসে ফর্দপত্রতে চোখ বোলাচ্ছিল, মন্দিরের সাথে সাথে তার ঘরেও রাজার যজ্ঞি, আত্মীয়কুটুমে ঘর ভরে যায় এই কটা দিন।ভক্তের দল দেউল নিয়ে বেরিয়ে গেছে, মন্দির চত্বর একটু ফাঁকা, পুরোহিতরা চুপচাপ নিত্য পুজোর আয়োজন করছে। কাঠের চালাতে কাঠ কেটে ডাঁই করা আছে। পাশের ফাঁকা মাঠে কিছু লোকে আজ শেষবারের মত ঘাস উপড়চ্ছে, ওখানেই সন্ধ্যেরাতে রাখা হবে চড়ককাঠ।
    এত সকালে মহেন পালকে দেখে অবাক হলেও তারক বোস মুখে কিছু বলেনা। সাধারণত মহেন পাল সকালে বাড়ি থেকে বেরোয় না, পুজো টুজো ছাড়া।

    মহেন আয়োজন নিয়ে একথা ওকথা কইতে কইতে প্রথমে নবীন মুহুরী ও পরে ভোলা ঠাকুরের প্রসঙ্গ তুলল, এমনভাবে যাতে তারকের খুব একটা সন্দেহ না হয়। খামকা ওদের এইসব কাজের মাঝে ভয় পাইয়ে দিতে চায়না সে।
    খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল একটি লোক কিছুদিন আগে তার সাথে দেখা করতে এসেছিল বলাহাটি থেকে কাজের খোঁজে, ভোলাঠাকুর পাঠিয়েছে বলে।সে তাকে ভাগিয়ে দিয়েছে ভোলাঠাকুর বলে কাউকে চেনেনা তাই, তাছাড়া উটকো লোক। কিন্তু পরে মনে হয়েছে বলাহাটির লোক বোসেদের মুহুরী ছিল, তাই আজ খেয়াল হয়েছে তারককে জিগ্যেস করে জানবে ভোলাঠাকুর কে!

    তারক বোস প্রথমটায় খুব অবাক হল, বর্তমানের এত ভাবনা তার মাথায় যে চট করে অতীতের কথা মনে করতে পারেনা।
    ইতিমধ্যে একজন এসে চা দিয়ে গেছে দুই কত্তাকে। মহেন না করেনা, চা খেতে খেতে মেজাজ আসবে তারকের, গল্পের মৌতাতে অনেক কিছু জানা যেতে পারে।

    এমনিতে এ গাঁয়ের সবার ধারণা অতীত বর্তমান সবাইকার হাঁড়ির খবর বা এগাঁয়ের সব ইতিহাস মহেন পাল যেমনটি জানে তেমনটি আর কারুর জানা নেই।
    তারক বোসের বিস্মিত হবার কারণটাও সেটাই। কোনোকিছু মহেনের মনে নেই, তার কাছে জানতে এসেছে, এ এক নতুন জিনিস বটে!চা খেতে খেতে মনে করে সে বৃত্তান্ত শোনায়।
    -“আরে সে তো অনেককাল আগের কথা। আমি তখন বোধহয় ইস্কুলে পড়ি।তখন সবে বছর কয়েক হয়েছিল পঞ্চানন্দের ভার আমাদের ওপর এসেছে। গোবিন্দর মন্দির ওই যেটা এখন অর্ধেক জলের তলায় তখন ওটা বেশ নতুন ছিল, যদিও খুব ছোট বলে পঞ্চানন্দের মন্দির পাশে নতুন করে তৈরি হয়।
    তা ওই মন্দিরে ঠাকুরের সব জিনিস পত্র রাখা থাকত।ভোলাঠাকুরের পাথরের কাজের হাত ছিল খুব ভালো। নবীন জ্যাঠা তো আমাদের অনেককালের লোক, পঞ্চানন্দ আসার আগে থেকেই জমিজমা দেখত, দাদুর আর বাবার খুব বিশ্বাসী ছিল। নবীন জ্যাঠাই ভোলাঠাকুরকে নিয়ে এসেছিল একটা পাথরের সিন্দুক বানাতে।দেওয়ালে কিছু পাথরের কাজও করেছিল, পঞ্চানন্দের মন্দিরে এবং ওই গোবিন্দ মন্দিরেও।
    তা সেই পুরনো পঞ্চানন্দের মন্দির তো এখন নেই, তবে পাথরের সিন্দুকটা বাড়িতে আছে, খুব ভারী, ঠাকুরের বাসন আর কিছু গয়নাগাঁটি নিত্য ব্যবহারের, রূপোর ত্রিশুল টিশুল সব রাখা থাকে। বাকী দামী জিনিসপত্রতো আজকাল ব্যাঙ্কের লকারে রাখা থাকে। আগে অবশ্য বাবার আমলে টাকাপয়সা যা আয় হত সব ওতেই থাকত।
    গোবিন্দ মন্দিরের ওপরে ভেসে থাকা চাতালের নীচে জলে যে ঘর সেখানে দেওয়ালে এখনো ভোলাঠাকুরের করা কিছু কারুকার্য আছে।ওর টালির বিশেষত্ব হল যে গাঁথতে হয়না, খাঁজে বসিয়ে দিলে দিব্যি বসে থাকে এমন মাপজোক।
    কিন্তু এতকাল পরে ভোলাঠাকুরের নাম করে লোক এসেছে, কেমন যেন ঠেকছে। তোমার কাছেই বা কেন? ভোলাঠাকুর এ গাঁয়ে চিনত এক আমাদের বাড়ি আর নয়ত মান্নাবাড়ি। ওদের স্বজাতি, ওদের বাড়িতেই থাকত কিনা।“

    ধীরেন মান্নার মনে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন না জাগলেও, তারক বোস ঝানু ব্যবসায়ী লোক, তার মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগল।
    মহেন পাল একটু দোনোমোনো করে শেষে বলেই ফেলল মনসা চুরির কথাটা। শুনে তারক কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবতে থাকে।কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। মহেন তাকে ভাবতে দিয়ে নিজে চুপ করে থাকে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে ধাঁধার জটগুলো এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, সব দেখা গেলে অঙ্কটা মেলাতে আর দেরী হবেনা।

    ওদিকে তারক কী সব ভেবেচিন্তে বলে ওঠে,
    -“দাদা, একটা কথা মনে হচ্ছে, অবশ্য তার সাথে এই চুরির কোন সম্পর্ক নেই। তুমি তো ভাবছ ওই লোকটাই মনসা চুরি করেছে। কিন্তু সনাতনের মনসা তো খোলা উঠোনে অরক্ষিত রাখা থাকে, সেটা চুরি করতে তো কোন ছল চাতুরী বা প্যাঁচপয়জারের দরকার হওয়ার কথা নয়। তবে ভোলাঠাকুরের কথা উঠল তাই মনে হল, ওই মনসার যে মূর্তি তা আসলে একটি খোদাই পাথরের টালি যা আমাদের গোবিন্দর মন্দিরের দেওয়ালে ছিল, ভোলাঠাকুরের হাতের কাজ। সেইসময় ওটি দেখে আমার ঠাকুমা খুব আপত্তি জানায়, মা মনসাকে নাকি এমনি করে পুজো না করে রাখতে নেই, আবার মন্দিরে মনসা পুজো করতে নেই। অন্তত বাবা আমাকে এমনটাই বলেছিল।
    লখীন্দর কাকা ভোলাঠাকুরের সাহায্যকারী ছিল, ওঝা হলেও কাকার এসব হাতের কাজে খুব উৎসাহ ছিল বলে বাবার কথায় ভোলাঠাকুর কাকাকে শাগরেদ করে নেয়।লখীনকাকার উৎসাহেই নাকি ভোলাঠাকুর মনসা খোদাই করে। তাই বাবা ওই পাথর লখীন্দরকাকাকে দিয়ে দেয় পুজো করতে।
    তবে মারা যাবার আগে বাবা আমাকে বলেছিল বটে ওই টালি ফিরিয়ে এনে মন্দিরের দেওয়ালে টালির জায়গায় বসিয়ে দিতে এবং তার বদলে লখীন্দর কাকাকে পাথরের মূর্তি গড়িয়ে দিতে, তাতে নাকি আমাদের ভালো হবে।
    এমনকি একটা কাগজে লেখাও আছে কিভাবে কী করতে হবে। কাকা বেঁচে থাকতে আমাকে অনেকবার বলেছে, আমারই আর গড়িমসি করে করা হয়নি।আমার মাও বলত বাবার আদেশ। তারপর বন্যার পরে গোবিন্দর মন্দির মাঝপুকুরে চলে যাওয়ায় ও মন্দিরে আর কিছুই নেই, কেউ কালেভদ্রে যায়, দেওয়ালে টালি নেই চোখেও পড়েনা, মন থেকে ব্যাপারটা চলে গেছে।
    আসলে পঞ্চানন্দের সেবা করে আমাদের আর কোনোদিকে খেয়াল থাকেনা, তার ওপর জমিজমা ব্যবসাপাতি, কার আর ফুরসত আছে বল।“

    হ্যাঁ, তায় যখন পঞ্চানন্দের নামে রোজগারপত্র এত ভালো হয়, তার দয়ায় এত রমরমা, অন্য দেবী দেবতা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়!,
    মহেন সব শুনে মনে মনে ভাবে।মুখে শুধু বলে,
    -“গোবিন্দর মন্দিরে একবার যাওয়া যায়?”
    -“তা যাবেনা কেন তবে তুমি ওই ভেলায় যেতে পারবে, পড়েটরে গেলে?পুরুতমশাই তো যায় ওতে, তার বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে, ছেলে ছোকরারা সাঁতার কেটে যেতে পারে।“

    মহেন অনেককাল সাঁতার কাটেনি, এই বয়সে জলে পড়ে গেলে সত্যি একটা কেলেংকারী। তাছাড়া চাদ্দিকে এখন লোক ভর্তি, সকলের নজর এড়িয়ে কিছু করা যাবেনা। গিয়ে অবিশ্যি খালি দেওয়াল বা ভোলাঠাকুরের শিল্পকর্ম দেখে কী হবে তাও বুঝতে পারছেনা। এত বছর বাদে ভোলাঠাকুরের নাম নিয়ে কেউ এল কেন কে জানে!
    -“তারক, যে কাগজে লেখা আছে মনসার পাথর নিয়ে কী করতে হবে সেটা একটু আমাকে দেখাতে পারবে?”
    তারক বোস এককথায় রাজী।
    -আরে ও কাগজের লেখা দু তিনটে কপি করে আমাদের সব ভাইয়েদের নামে আছে, আমারটা গিন্নির কাছে তার পুজোর ঘরের বাক্সতেই আছে। আমি ঘরে যাব যখন বার করে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব।“
    বেলা হয়ে লোকজনের ভিড় বাড়ছে, চড়ককাঠ তুলতে লোক লাগে, ভক্তরা ছাড়াও। মেলার দোকানদাররা বোসকর্তার সঙ্গে বিষয়কর্ম নিয়ে কথা বলতে আসছে। কর্তা ব্যক্তিরাও এক এক করে ঢুকছে দেখে মহেন চুপচাপ বেরিয়ে নিধিরামের বাড়ির দিকে পা চালালো, তবে আনমনে নয়। চারিদিকে ভালো করে নজর রেখে হাঁটছিল যদি সেদিনের সেই লোকটা চোখে পড়ে।
    *************************
  • Sarbani | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:৫২449770
  • (৯)

    নিধিরামকে সকালে ধীরেন মান্না ও পরে তারক বোসের কাছে যা শুনেছে সেসব বিশদে বলল। বয়স হয়ে শরীরে কাবু হলে কী হয়, নিধিরামের ব্যবসার মাথা এখনো পরিস্কার।
    -“দাদা, কী মনে হয়, ওই পাথরের কোন রহস্য আছে? পাথর যদি তেমন দামী হয় তাহলে এতদিন এমন করে সনাতনের উঠোনে তাকে ফেলে রেখেছে বোসেরা?”
    মহেন ঘাড় নাড়ে,
    -“হ্যাঁ আমারও সেখানেই খটকা। তবে তারক তো সত্যি কথা বলল বলেই মনে হল, লুকিয়ে রাখল কিছু বলে বোধ হলনা।“
    -“ভোলাঠাকুর যদি মারাও গিয়ে থাকে তবু তার খোঁজখবর পেলে ভালো হত,এই উটকো লোকটার মনে হয় কোনোভাবে ভোলাঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল এবং সেখান থেকেই কিছু গোপন তথ্য জেনেছে।কিন্তু এতকাল পরে কেন, আগে আসেনি কেন?“
    -“খোঁজ করার অত সময় নেই বুঝলি। তবে একটা জিনিস এখন পরিস্কার যে রহস্য যা আছে তা পঞ্চানন্দ মন্দির, পুকুর ও গোবিন্দর মন্দিরকে ঘিরে। তাই যে কাজটা করা দরকার তা হল এই জায়গাগুলোর ওপর নজর রাখা।তুই তোর চেলাদের বলে দে, আমি থানায় দারোগাকে খবর পাঠাচ্ছি। এমনভাবে নজর রাখতে হবে সে লোক যেন সন্দেহ না করে।“

    নিধিরামের নাতি তপাই বেরিয়ে এল। মহেনকে বলল,
    -“দাদু, মা বলল বেলা হয়েছে, এখানেই নাওয়া খাওয়া সেরে নাও, আমি তোমার বাড়িতে ঠাকমাকে খবর দিয়ে দেব, ওদিকেই যাচ্ছি কিনা।“
    মহেন উঠে পড়ল, নাওয়া খাওয়ার সময় প্রায় পার হতে চলল, গিন্নি হয়ত ইতিমধ্যে তার পেয়াদাদের পাঠিয়ে দিয়েছে রাস্তায়।
    নিধিরাম তাই দেখে বলল,
    -হ্যাঁ, দাদা, তাই নাহয় কর। বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে একেবারে মন্দির হয়ে বাড়ি যেও।“
    -“না রে গিন্নি খুব রেগে যাবে, বলে আসিনি, সবাই হয়ত আমার জন্যে না খেয়ে বসে আছে। তাছাড়া তারক ওই কাগজ পাঠাবে, দারোগাকে খবর দিতে হবে, এসব আমি বাড়িতে না বসলে হবেনি।“
    নিধিরাম আর জোর করল না, পাল গিন্নিকে সে ভালো চেনে। শুধু তপাইকে ইশারা করল মহেনের সঙ্গে যেতে।
    তপাই মহেনের লাঠিটা এগিয়ে দিয়ে সঙ্গে চলল। তাই দেখে মহেন পাল বলে,
    -“তুই এই বেলায় কোথায় বেরচ্ছিস? আমার সঙ্গে যেতে হবেনি, আমি একাই চলে যাব, কতটুকু আর পথ!”
    -“না গো দাদু, আমি তো অমনিতেই মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলুম। আমাদের ক্লাবের কয়েকজনকে চড়ক কাঠ তোলার সময় থাকতে হবে। ভক্তরা সব উপোষ টুপোষ করে নেতিয়ে থাকে, জলে কিছু যদি হয়, প্রত্যেক বছরেই তাই আমরা থাকি তো। কতগুলো আলোর ব্যবস্থা করতে হবে, বোসেদের কানু আর আমিই তো সব করি।“
    কানু, তারক বোসের নাতি, মহেনের নাতি ধীরুও সব এদেরই বন্ধু।

    খিদে পেয়েছে, নিধিরামের ওখানে মিষ্টি জল দিয়েছিল কিন্তু সে খায়নি, অসময়ে আজকাল খায় না। মাথাটা তাই একটু ভার লাগছে, তপাইয়ের কথায় কী যেন একটা মনে এসে আবার মিলিয়ে গেল।
    মন্দিরের কাছে এসে সে তপাইকে নিজের কাজে যেতে বলল, বাড়ি অবধি সঙ্গে নিলনা। তপাই একটু গাঁইগুঁই করল “দাদু বকবে, পাল ঠাকমা কী বলবে” ইত্যাদি।
    বাড়ি এসে দেখল সনাতন বসে আছে। গিন্নি আজ কীসব উপোষতিরেসে ব্যস্ত, তাছাড়া জানে গাজনের সময়, তাই দেরী করে বাড়ি ফেরার জন্যে তেমন চেঁচামেচি করল না।
    চানটান করে মহেন খেতে বসল যখন তখন ছেলেদের সঙ্গে সনাতন খাচ্ছে। মহেনের মনে পড়ল সেইই বাড়িতে বলেছিল এ কদিন সনাতনকে দুবেলা খাওয়াতে।

    খেয়ে মৌরী মুখে দিয়ে বারান্দার আরামকেদারায় বসেছে, সনাতন এসে দাঁড়ালো।
    -“খুড়ো, খুড়িমা বড় যত্ন করে খাওয়াচ্ছে কদিন। এ গাঁয়ে আপনাদের মত মানুষ হয় না।“
    মহেনের তারকের কথাটা মনে পড়ে। সনাতনকে তার বাপ এ নিয়ে কিছু বলে যায়নি এটা একটু অদ্ভুত লাগে তার।
    -“হ্যাঁরে সনাতন মনসার মূর্তি খোদাই করা ওই পাথর যে তোর বাপ বোসবাড়ি থেকে এনেছিল তা তুই জানতিস না?”
    সনাতন মাটিতে বসেছে একপাশে।
    -“বোসবাড়ি থেকে এনছিল? কী জানি, বাবা তো কিছু বলেনি। তবে বাবা ওখানে তো প্রায়ই যেত, বুড়োকত্তা বেঁচে থাকতে, কাজকম্মও করে দিত অনেক। আমাকে তো বাবা কিছুই বলতনি, রাগ ছিল খুব, লেখাপড়া শিখিনি বলে। আমাকে তো ওঝাবিদ্যেও শেখালো নি, শেষে আমি কেষ্টপুরের কালীওঝার শিষ্য হলাম বলে আমার মুখ দেখতে চাইতনি। বরং খোকার মায়ের সঙ্গে শেষ দিকে কথা কইত, তাকেই যা বলার বলত।“
    মহেন আর কথা বাড়ালো না, হতে পারে লখীন্দর ছেলের সাথে মন কষাকষি হয়ে কথাটা বলেনি, এছাড়া হয়ত যখন দেখেছে বোসেদের কারুর পাথরের টালি মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার কোনো গা নেই তখন সেও ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি।
    সনাতনকে বলল থানার দারোগাকে একটু খবর দিয়ে দেয় বিকেলের মধ্যে যেন এসে দেখা করে, জরুরী কথা আছে।
    সনাতন রাজী হয়ে যায়, যদিও আজ থেকে সে তার জিনিসপত্র নিয় মেলায় বসবে ঠিক করেছে তবু পালবাড়িতে এত যত্নআত্তি পাচ্ছে, বিনিময়ে এটুকু কাজ কিছুই নয়।

    দুপুরে একটু তন্দ্রামত সবে এসেছে, নাতি ধীরু এল, মন্দিরের ওখানে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছিল, তারক বোস দেখতে পেয়ে ওর হাতে কাগজ একটা দিয়েছে, দাদুকে দেওয়ার জন্যে।
    ধীরুকে চশমাটা আনতে বলতে সে চশমা এনে দিয়ে চলে গেল, উৎসবের দিনে বাড়ি বসে থাকতে সে রাজী নয়।
    কাগজেটা হলদে হয়ে এসেছে, কালি আবছা তবু পড়া গেল দিব্যি। মহেন কাগজ পড়ে একটু চিন্তা করে। যা মনে হচ্ছে তা যদি হয় তাহলে বোসেদের এই ছেলেগুলোকে তো মহা অপোগণ্ড বলতে হবে। বাপ এমন করে লিখে গেছে তা বোধহয় ছেলেগুলো কখনো পড়েও দেখেনি ভালো করে। আসলে তেমন কিছু মেহনত না করেই পঞ্চানন্দের দয়ায় এত কিছু পেয়ে গেছে যে মাথা খরচ করার এদের আর দরকারই হয়না।

    চড়ককাঠ তুলতে নামা হয় একটু রাতের দিকে। চিরকাল পঞ্চানন্দের এই নিয়ম। যাতে প্রচুর লোকজন বিশেষ করে উৎসাহী কিশোর ও বাচ্চারা পুকুরপাড়ে এসে গোল না করে তাই এই ব্যবস্থা, কেউ জলে নেমে পড়লে বা কিছু একটা বিপত্তি হলে তার জেরে এতবড় আয়োজন না পণ্ড হয়ে যায়।
    ভক্তরা সব জলে নেমেছে। সারা দুপুর তারা বিশ্রাম করে, সন্ধ্যেবেলায় ধুনোসেবার পর অল্প ফলমূল আর বাবার প্রসাদ খেয়ে নিয়েছে। আজ তারক বোস আর ভীম বোস দুজনে নিজেরা তদারকি করেছে সব ব্যবস্থার। সারাদিন উপোষ করে আর দেউল নিয়ে ঘোরাঘুরির পর এদের আর তেমন শক্তি থাকেনা। অথচ নিয়ম হল চড়ক কাঠ তুলবে ভক্তরা, নাহলে কাঠ ভাসবেই না।
    রাতের অন্ধকার, পুকুরধারে আলো নেই তাই পাড়ের দু দিকে দুটো হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। একদিকে জেলেদের একটা ডিঙ্গি রাখা আছে। ভক্তরা সব এসে একে একে ঘাটে নামল, “পঞ্চানন্দের চরণে সেবা, জয় মহাদেব” ধ্বনি দিতে দিতে। কয়েকজন ছেলের দল ঘাটে রইল এছাড়া বোসেদের দুটো মুনিষ, তারাই দরকারে ডিঙ্গি ভাসাবে।
    তারক বোস আজ আছে সাথে মহেন পাল। তারই নির্দেশে আজ লোক অনেক কম রাখা হয়েছে, পুরোহিত একজন, দুই ঢাকী।
    এমনিতে পঞ্চানন্দের কিছু ভক্ত আছে যারা প্রত্যেক বছর ভক্ত হয়, তাদের নির্দেশেই মূলত কাঠ তোলা পর্ব সারা হয়, অন্যেরা সঙ্গে থেকে তাদের কথামত কাজ করে।
    বলা হয় যে চড়ক কাঠ সহজে ধরা দেয়না। একবার ভেসে ওঠে, সাঁতরে সেদিকে যেতে যেতে কাঠ ততখনে অন্যদিকে ভেসে গেছে, এভাবে বেশ খানিক লুকোচুরি খেলার পরই কাঠকে ধরা যায়। এর মধ্যে কোন ভক্ত কাহিল হয়ে পড়লে বা কিছু হলে তাই ছেলেরা টর্চ আর লাইট মেরে মেরে নজর রাখে, ভক্তদের সবাইকে বলা আছে এরকম মনে হলে হাত তুলে দেয় যেন, ডিঙ্গি নিয়ে গিয়ে তাকে তুলে নেওয়া হবে।

    মহেন পাল ঘাটের ধারে চালায় বসে, দৃষ্টি তার গোবিন্দর মন্দিরের দিকে, সেখানে লুকিয়ে আছে ছন্দময় ও মাণিক।
    বেশ কিছুক্ষণ কাঠ তোলা চলছে, যারা আছে আশেপাশে সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, “ওই ওই কাঠ”, ওখানে দেখা গেল। নিন্দুকেরা যদিও বলে যে কাঠ ভেসে বেড়ায় না ও পাকা ভক্তদের একজন থাকে যে কাঠকে এদিক ওদিক নিয়ে বেড়ায়, ঠাকুরের লীলা প্রমাণ করার জন্যে।
    প্রায় আধঘন্টা হয়ে গেল, চড়ক কাঠ ধরি ধরি করে ধরেই ফেলেছে ভক্তের দল, ওদিকে গোবিন্দর মন্দিরের দিক থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। মহেন একটু হতাশ, তাহলে কী তার সব যোগবিয়োগ ভুল!

    শেষমেশ কাঠ উঠল পশ্চিমপাড়ে, সবাই আনন্দে উত্তাল, ঢাক এতক্ষণ বাজানো হয়নি, নিষেধ ছিল, এবারে ঢাকী দুজন উদ্দাম বাজাতে শুরু করেছে, পুরোহিত শাঁখ আর ঘন্টা বাজাচ্ছে। মহেন পালও গোবিন্দের মন্দিরের কথা ভুলে সবার সঙ্গে পাড়ের দিকে এগিয়ে গেল, ছেলেবয়সের চড়ক কাঠ তোলার উত্তেজনা যেন ফিরে এসেছে।
    কাঠ তোলা হয়েছে, পুরোহিত সিঁদুর বেলপাতা দিয়ে বরণ করছে এমন সময় দেখা গেল কে যেন একটা বড় টর্চ লাইটের আলো চারিদিকে ঘোরাচ্ছে, আলো পড়ছে ভিজে টইটুম্বুর ভক্তদের মুখে, পুকুর পাড়ের গাছ এমনকি চড়ক কাঠের ওপরেও। সবাই আলো কোথা থেকে আসছে দেখতে গিয়ে দেখে গোবিন্দর মন্দিরের ভাসা চাতালে দাঁড়িয়ে একজন প্রাণপণে টর্চ ঘোরাচ্ছে আর কী যেন বলছে।
    মহেন এক ঝলক দেখেই অনুমান করল এ নির্ঘাত মাণিক কনস্টেবল। সে সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের ডিঙ্গি ও ভেলা দুটো নিয়ে ওদিকে যেতে বলল।জলের দু তিনজন ততক্ষনে কিছু বিপদ হয়েছে ভেবে গোবিন্দর মন্দিরের দিকে সাঁতার দিতে শুরু করেছে।

    খানিক পরে উত্তেজনা থিতিয়ে আসলে মহেন, তারক ও আরো দু একজন এসে মন্দিরের চাতালে বসেছে।
    বোসেদের মুনিষ দুজন লোকটাকে ধরে নিয়ে এল। তার আগে ছন্দময়ের নির্দেশে তারা গরুবাঁধা দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধেছে লোকটার হাত।
    সিড়িঙ্গেপানা কালো লোকটা, চুল দাড়ি ভরা মুখ, পরনে ভিজে গেরুয়া ধুতির ওপর গামছা বাঁধা, খালি গা।

    তারক বোস একটু উসখুস করে উঠল,
    -ও দাদা, ভুল হচ্ছেনি তো, এতো দেখে বাবার সন্নেসী মনে হচ্ছে। সনাতনের মনসা এই চুরি করেছে কী করে বুঝলে?”
    ছন্দময় দারোগা রাগ রাগ মুখ করে বাঁ হাত চেপে ধরে দাঁড়িয়ে বেশ রাগে গর গর করছে।লোকটা মহা ত্যাঁদড়, ধরতে গেলে বার বার পিছলে যাচ্ছিল, ভিজে গা বলে, আর একটু হলে জলে ঝাঁপ দিয়ে দিত। শেষমেশ জাপটি মেরে মাটিতে ফেলতে গিয়ে, তার বাঁ হাতে জব্বর মোচড় লেগেছে।
    -“না, তারক, ভুল হয়নি। ওকে বামালসমেত ধরেছে দারোগা।
    তারক বোস একটু এগিয়ে এসে ভালো করে দেখে বলে,
    -“এ ছিদে না? বাউরিদের ছিদাম বলেই তো মনে হচ্ছে।“

    -‘হ্যাঁ, ছিদে বলে মনে হয় তবে ও ছিদে নয়। ও হল বলাহাটির উটকো লোক। বাবা ছন্দময়, তুমি ওকে থানায় নিয়ে গিয়ে দাওয়াই দিয়ে দ্যাখো সব কথা বার করতে পারো কিনা। এতদিন আগেকার গুহ্য কথা সব জেনে চুরি করার পরিকল্পনা ওর মাথায় এল কিভাবে সেটা নাহলে জানা যাবেনা। ততক্ষণে আমরা গিয়ে গোবিন্দর মন্দিরে দেখি দেওয়ালের গোপন সিন্দুকে কী আছে, কী চুরি করতে এসেছে ও।“

    **********************************
  • Sarbani | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:০০449771
  • (১০)

    আবার সেই ডিঙ্গি নিয়ে চলল মহেন পাল, সঙ্গে বোসকর্তা ও ওদের বাড়িরই দু চারজন ছেলে। এছাড়া মনসা পাথর হাতে মাণিক। মাণিককে ছন্দময় রেখে গেছে মহেনের কথায়, পুরো ব্যাপারটায় সরকার তরফের একজন সাক্ষ্য থাকা ভালো।

    বেশী কষ্ট করতে হলনা, ছন্দময় দারোগার দাওয়াই খেয়ে থানাতে লোকটা তার কাহিনী সব গড়গড়িয়ে বলে দেয়। উটকো লোকের আসল নাম বলাই দাস। বাড়ি বলাহাটির পাশের গাঁ কামারহাটি, যেখানে ভোলাঠাকুরের আদি বাড়ি।
    ওর বাপ ভোলাঠাকুরের কাছে আসা যাওয়া করত বিদ্যে শিখতে, ছোটখাটো চুরি চামারি করত। ভোলা ঠাকুরের খুব ন্যাওটা হয়ে ওঠে, সেই সুবাদেই এগাঁয়েও এসেছে এককালে। শেষজীবনে ভোলাঠাকুর ঘুরেফিরে কামারহাটিতে নিজের ভিটেয় বাস করতে আসে।
    তখন বলাই দাসের বাবা রাখাল দাস ছেলে বউ নিয়ে পাকাপাকিভাবে ভোলাঠাকুরের কাছে উঠে আসে, তার জমি জমা বাড়ি দেখাশোনা করতে। ভোলাঠাকুর দেওয়াল সিন্দুকের কথা রাখালকে বলেছিল। এরকম সিন্দুক সে জীবনে একটাই তৈরি করেছে তাই বুড়ো বয়সে এ নিয়ে গল্প করতে ভালোবাসত।সিন্দুক খোলার নিয়মও সেই বলেছিল রাখাল দাসকে।
    ঠাকুরের অনেকদিন মান্না বাড়িতে যাতায়াত ছিল, তখনই সম্ভবত সে পুরনো চ্যালা লখীন্দরের কাছে শুনেছে যে মনসার পাথর লখীন্দরের কাছেই আসে, বোসেরা নিয়ে যায়নি, এবং অনুমান করেছে সিন্দুকের নিয়ে এত গোপনতা যখন তখন বোসকত্তা নিশ্চয় কোনো অমূল্য সম্পদ সেখানে রেখেছে! এই অনুমানের কথাও হয়ত সে রাখালকে গল্পছলে বলেছে।

    রাখাল এমনিতে খুব বেশী লোভী ছিলনা, ভোলাঠাকুরের জমিজমা সেই পেয়েছিল, এবং তাতেই তার দিন কেটে যাচ্ছিল। ছেলে বলাই একটু লায়েক হওয়া থেকেই বদসঙ্গে পড়েছিল।
    চুরিডাকাতি লোক ঠকানো সবেতেই তার রুচি, তবে হাতের কাজ শেখার বা নিয়ম মানার ধৈর্য ছিলনা।এককালে সে নিধিরামের কাছে নাড়া বাঁধতেও এসেছিল, কিন্তু তার রকম দেখে নিধিরাম তাকে নেয় নি। তাই নিধিরাম তাকে চিনে ফেলবে এই ভয়ে সেদিন মহেন কত্তাকে নিধিরামের বাড়ি যেতে দেখে পালায়।

    তারক বোসের বাবা তার অন্য শরীকদের ফাঁকি দিতে পঞ্চানন্দের সোনাদানার অংশ সরিয়ে ওই দেওয়াল সিন্দুকে রেখে দিত। লখীন্দর ওঝা যখন দরকার হত মনসা পাথর নিয়ে আসত যা আসলে দেওয়াল সিন্দুকের চাবি ছিল।তারপর দুজনে মিলে সিন্দুক খুলে জিনিসপত্র রেখে দিয়ে আবার মনসা পাথর নিয়ে চলে যেত। এর ফলে শরীকদের যা হিসেব দেখানো হত তাতে ঠাকুরের তেমন আয় মনে হতনা। এক সময় এই কারণে অন্য শরীক তারক বোসের কাকারা পঞ্চানন্দের ভাগ সব এদের লিখে দেয়, আয় তেমন নয় অথচ দায়িত্ব বিস্তর ভেবে।

    বুড়ো বোসকত্তা তার পরেও দেওয়াল সিন্দুকে রাখা সোনাদানার কথা কাউকে বলেনি, পাছে শরীকরা সবাই ভাগ চাইতে আসে। ছেলেদেরও সংকেতে লিখে রেখে জানিয়ে যায়, সংকেতে পরিস্কার নির্দেশ ছিল।
    মারা যাবার পরে তার ছেলেরা সেভাবে সংকেত বুঝতে পারেনি অথবা ভালো করে দেখেইনি। মনসা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারটাতেই তাদের উৎসাহ ছিলনা, পঞ্চানন্দের কৃপায় তাদের সব ভালো চলছে, মনসাকে ওঝাবাড়ি থেকে নিয়ে এসে আবার আর একটা পুজার দায়িত্ব নেওয়ার কী দরকার!

    কাগজে যে ভাবে দেওয়ালে পাথরের টালি বসাবার কথা বলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করার এমন নিয়ম হতে পারেনা। “ডানে দুই আঙ্গুল, ঘুরিয়ে চার কড়া,
    মা মনসা বসলে ঠিক, ভরবে সৌভাগ্যের ঘড়া”।
    তারপরে হাবিজাবি পুজোর কথা,
    “পাঁচ কড়ি পাঁচ শস্য পাঁচ ফল দিয়ে, মা মনসা পুজ তুমি দুধ বাতাসা ঘিয়ে।“
    দুই আঙ্গুল চার কড়া ঘুরিয়ে বসলে চাবি তালায় ঢুকে সিন্দুকের ডালা খুলবে।

    বলাই দাসের বুদ্ধি কম ছিলনা। রাখাল দাস মারা যাবার আগে যেমন ভোলাঠাকুরের দেওয়াল সিন্দুকের রহস্যের কথা ছেলেকে বলে। বলাই দাস সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর শুরু করে এবং এলাকার চোরেদের সাথে কথা বলে বুঝে যায় যে গোবিন্দর মন্দিরে এরকম সিন্দুক আছে এটা কারোর জানা নেই। তখন সে ধারণা করে যে সম্ভবত কোনো কারণে সিন্দুক পরে আর খোলা হয়নি, নাহলে এরকম একটা জিনিস, লোকে এ সম্বন্ধে কথা বলত।
    হয়ত সিন্দুকের জিনিসও এখনো যথাস্থানেই রয়েছে, এবং সবচেয়ে বড় কথা কারুর ওদিকে তেমন নজর নেই। তাই কৌশলে চুরি করলে সেভাবে কেউ ধরতেও আসবেনা।

    সে ভেবেচিন্তে দেখল এমনিতে মন্দিরের লাগোয়াই পুকুর, সেখানে সাঁতার কেটে যাক বা ভেলায় চড়ে যদি যায়, ভিনদেশী , নজর এড়াতে পারবেনা। জিনিসপত্র পেলে সেসব নিয়ে আসা, পাথর নিয়ে যাওয়া এসব করাও মুশকিল। শেষে তাই সে পঞ্চানন্দের গাজনের সময় বেছে নেয়।
    খোঁজখবর নিয়ে সে মহেনের কাছে যায় এইজন্যে যে পাল বাড়িতে কিছু একটা বলে ঢুকবে পরে মহেনকে বলে ভক্ত হবে।
    এমনিতে সে শুনেছিল পালবাড়িতে সবার অবারিত দ্বার, কাজকম্ম জুটে যায়, ওখানে সবসময় কাজের লোকের দরকার হয়। নাহলে অচেনা অন্য গাঁয়ের লোককে ভক্ত করতে বোসেরা রাজী হবেনা।পরিচয়ের জন্যে জোরাজোরি করতে সে তাড়াহুড়োতে গল্প বানাতে গিয়ে ভোলাঠাকুরের নাম করে আর কামারহাটি বলবে না বলে পাশের গাঁ বলাহাটির নাম করে ফেলে।সে ভেবেছিল মহেন বুড়ো হয়েছে, একটু খাতির করে কথা বললেই তাকে বশ করে ফেলবে, কিন্তু কার্যত ফল হল উল্টো।

    মহেনের ওখানে সুবিধে হয়না কিন্তু ইতিমধ্যে সবাই তাকে ছিদে বারুই বলে ভুল করছে দেখে তার মাথায় আর একটা বুদ্ধি খেলে যায়।
    খোঁজ নিয়ে ছিদের সঙ্গে দেখা করে তাকে বুঝিয়ে ভক্ত হতে বলে, মানতের কথা বলে। ছিদেকে যখন পঞ্চানন্দের ভক্ত করে নিতে রাজী হয়ে যায় মন্দিরে তখন ছিদের জায়গায় বলাই দাস ভক্ত সেজে যায়, এবং যা ভেবেছিল এত ভক্তের ভিড়ে লোকে খেয়াল করেনা। একবার ভক্ত হয়ে ঢুকে গেলে কেউ আর তারা আসলে কে তা খুঁটিয়ে দেখে না।
    ছিদে এদিকে এর পরামর্শে ও টাকা কিছু পেয়ে কদিন গিয়ে শ্বশুরবারি বসে থাকে। মহেনেরর কথামত তাকে লোক গিয়ে নিয়ে আসতে, সে স্বীকার করেছে যে বলাই দাস তাকে ছেলের অসুখের মানতের কথা বলে রাজী করিয়েছে। যদি কেউ ছিদেকে দেখে ফেলে আসল কথা ফাঁস হয়ে গিয়ে বলাইকে বার করে দেয়, তাই ছিদেকে এ কদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলেছিল, ছিদেও সেরকমটাই করে।

    তারপর দেউল নিয়ে এবাড়ি ও বাড়ি ঘোরার সময় সনাতনের বাড়ি ঘর মনসার পাথর দেখে এসে সেটা চুরি করার ফন্দি বার করে। রাতের দিকে মন্দির চত্বর থেকে বেরনো সহজ, সবাই ক্লান্তিতে আর অন্য কারুর দিকে দেখেনা, কে কোথায় গেল!
    মাঝে একসময় সাঁতরে গিয়ে পাথরটার গোবিন্দর মন্দিরে লুকিয়ে রাখাও কঠিন হয়নি। ভক্তরা পুকুরে চান করছে, সাঁতার দিচ্ছে কী করছে কেউ খেয়াল করবেনা, করেওনি।

    চড়ক কাঠ তোলার দিনই সে চুরির জন্যে বেছে নেয় কারণ এই দিন অনেকক্ষণ জলে ওই এলাকায় ঘোরাফেরা করা যায়, সময় অনেকটা পাওয়া যাবে। প্রচুর লোক থাকে, তার মাঝে একজন ভক্ত জলে কাঠ না খুঁজে গোবিন্দর মন্দিরে চুরি করছে কী করছে কেউ দেখবে না। গোবিন্দর মন্দিরে যে কিছু আছে সেটাই তো কারুর মাথায় নেই।
    এছাড়া পরের দিন থেকে ভক্তদের হাজিরা চড়কের মাঠে বা মন্দিরে সর্বদা, তার অন্যথা হলে ডাকাডাকি খোঁজাখুঁজি হবে, বা খেয়াল করবে লোকে, ভিড়ও বেড়ে যাবে।
    মন্দির পুকুরের মাঝে না হলে এত কান্ড করতে হতনা বা এই সময়টা বাছতে হতনা।

    সিন্দুক খুলে যা পাওয়া গেল তা প্রচুর না হলেও অনেকই। বোসেদের এমনিতে অভাব কিছু নেই, তাছাড়া তাদের বাবা যে অন্যায় ভাবে এই সম্পদ রেখেছিল এটা জানাজানি হয়ে যেতে বিশেষ করে চাদ্দিকে যখন এত লোক কুটুম তার মাঝে, তারা বেশ অস্বস্তিতেই পড়ল। শরীকদের কেউ বেঁচে নেই নাহলে তারা এককথায় সব ভাগ করতে রাজী।

    মহেন ও অন্যান্য মাথারা ব্যাপারটা বুঝে সবকিছু গোপন রেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসল, বোস কত্তাদের নিয়ে।

    -“তা বাপু তারক এতো তোমার একার হক্কের ধন নয়, শরীকদেরও ভাগ ছিল, পঞ্চাননের কৃপায় তোমাদের অভাব তো কিছু নেই, যে অবস্থায় তোমার বাবা একাজ করেছিল সে অবস্থাও তোমাদের আর নেই।ভালো কাজে ব্যয় করলেই ভালো হবে, তবে তোমরা দরকার মত ন্যায্য কিছু রাখবে তো বটেই।

    আর আমার মনে হয় লখীনকাকার বংশধরদেরও কিছু পাওনা আছে। চাবিকাঠি এতকাল তারা রেখেছে। কাকার মনে পাপ থাকলে ছেলেকে সব বলে নিজেরাই নিয়ে নিতে পারত, অথবা চাবি নিতে এলে বখরা চাইতে পারত। সেসব কিছুই সে করেনি, তাই সনাতনকেও কিছু দিও। অবস্থা ভালো নয়, ব্যবসা মন্দা।“
    -“খুড়ো, আমরা ঠিক করেছি, সনাতনের ওখানে একটা মন্দির বানিয়ে দেব। এছাড়া টাকা তো পঞ্চানন্দের, মেলা চত্বর পাকা করতে ও মানুষের সুযোগসুবিধের জন্য কিছু লাগাবো, আর গ্রামের জন্যেও কিছু টাকা দেব।এছাড়া বাকীটা হাসপাতালে দান করব।“
    খুবই ভালো প্রস্তাব, সবার পছন্দ হল এবং বেশ একটা খুশীর আবহ তৈরি হয়ে চড়কের মেলার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

    মেলা বেশ ভালো ভাবেই কাটল, তেমন কোনো ঘটনা ছাড়াই। ছন্দময় তার দলবল নিয়ে সজাগ ছিল, রাত্রিদিন সে নিজে হাজিরা দিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে সব দেখভাল করল।
    শেষ দিনে বোসেরা সারা গ্রামকে ভোজ খাওয়ালো। শোনা যায় একটু রাতের দিকে নিধিরামের যত চেলা আছে সবাই খেয়ে গেছিল, তারক নিজে দাঁড়িয়ে তাদের আপ্যায়ন করেছিল, তবে সে শোনা কথা!

    গাঁয়ের মাথারা দাঁড়িয়ে থেকে সনাতনের ছেলের সঙ্গে মিটমাট করিয়ে তাকে ফেরত নিয়ে এল। ছেলে এখন সদরে কম্পাউন্ডারি পড়তে যায়। সনাতন নিজেকে আর ওঝা বলে না, সে এখন শুধুই মা মনসার পূজারী, মাদুলি তাবিজ দিতেও সে আজকাল রাজী হয়না।
    তবে পাথরের টালিটি তাকে বোসেরা আর ফেরত দেয়নি, নতুন মূর্তির অর্ডার দিয়েছে নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠার জন্যে।

    গোবিন্দর মন্দিরে আবার গোবিন্দকে রাখার কথা হচ্ছে, তার জন্যে কলকাতা থেকে নাকি ইঞ্জিনিয়র আসছে পঞ্চানন্দের মন্দির থেকে পুকুরের মাঝ বরাবর সাঁকো তৈরি করতে, তবে এসবও ওই গাঁ ঘরের গিন্নিদের দুপুরের আসড় বা ছেলে ছোকরাদের আড্ডাতেই আলোচনা চলে, মহেন পালকে দু একজন জিজ্ঞেস করেও সত্যি মিথ্যে কেউ জানতে পারা যাচ্ছেনা, তবে এ রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলেই শোনা যয়।

    (শেষ)
  • Ela | ***:*** | ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২৩:০৫449772
  • ব্যাপক!
  • Ruchira | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১৪449773
  • সব কাজ ফেলে শ্রাবণী/সর্বাণীর লেখা পড়তে বসে যাই। মাঝে অনেকদিন লেখা পাইনি - আপনি আরো লিখুন। আপনার লেখায় পুরনো শরদিন্দু শীর্ষেন্দুর আমেজ পাই, আর আগাথা ক্রিস্টি তো বটেই।

    দোলের মিষ্টি প্রেমের গল্প-ও খুব সুন্দর ছিল - ঐ seriesটা বাড়ানো যায় কি? পড়ে মনে হয় অতি অল্প হইল
  • Ruchira | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:২৬449774
  • রাইকেও আবার দেখতে চাই - খুব ভালো লাগে আপনার লেখা
  • Sarbani | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৭:৫২449775
  • ধন্যবাদ।

    Ela, Ruchira।
    টইয়ের পুরনো লেখায় ডেট স্ট্যাম্প দেখে খেয়াল হল যে দীর্ঘ সাত বছর পরে লিখছি। এই লেখাটা অন্য টুকরো টাকরায় শুরু হয়ে এখানে শেষ করতে পারলাম, আমার পুরনো টইয়ে, বলে ভালো লাগছে, আরো ভালো লাগছে যে এখানে কিছু লোক এখনো আমার লেখার কথা, আমার সৃষ্ট চরিত্রদের মনে রেখেছে।
    Santanu এই লেখাকে পুজো উপহার বলেছে, রুচিরা বা অন্য কজন যারা পড়লে তাদের মন্তব্যগুলো আসলে আমার এবারের পুজো উপহার হয়ে রইল।

    রুচিরা, "বুরা না মানো" টই যদি খুঁজে পাও, তাহলে দেখবে, মিষ্টি দোলের গল্প কিছুটা এগিয়েছে, ঝিমলি এগারো বারো ক্লাসে, বর্ষা ও পুজোর গল্পে। আমি এখানেও খুব অবাক হলাম যে ঝিমলির গল্প যেভাবে আমি বলতে চাই, ছোট ছোট সিরিজে, সেই ভাবনাটা মিলে গেল তোমার সঙ্গে এবং আবারও চমকালাম এতকাল আগের দোলে লেখা ঝিমলির কথা তোমার মনে আছে দেখে ।

    রাই ফিরবে কিনা জানিনা......... আসলে আমি ফিরতে পারছি কিনা তাই জানিনা, মানে লেখায় আর কী! :)
    অনেক ধন্যবাদ, লিখে তো ভালো লাগেই, তোমরা কজন পড়লে দেখে দিব্য লাগছে!
  • Ela | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৩৭449777
  • শ্রাবণী, আপনাকে সত্যিই খুব মিস করতাম আর রাইকেও। দেখুন না এখনও পুরোন নামেই ডাকছি আপনাকে। আরও অনেক অনেক লিখুন, আমরা অনেকেই পড়ব বলে বসে আছি। আমার কেমন মনে হচ্ছে রাইয়ের একটা গল্প বোধহয় শেষ হয়নি, সেটা কি শেষ করার অনুরোধ জানাতে পারি? যদি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে আর সেজন্য ভুল বলে থাকি, ক্ষমা করবেন।

    আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
  • Sarbani | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:৫৭449778
  • Ela,
    শ্রাবণী চলবে। আর একজন সর্বানি ছিল বলে তখন আড্ডায় নামটা একটু অদল বদল হয়েছিল, দরকার ফুরনোর পরেও বদল করা হয়নি আর কী!
    রাই সম্ভবত কখনো অসমাপ্ত রাখিনি, টই ডুবে টুবে গিয়ে হয়ত টের পাওনি। কিছু একটা অল্প শুরু করে আর লিখিনি, তবে সে রাই নয়।

    ধন্যবাদ, পুজো খুব ভালো কটুক।
  • Ela | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৯:০৩449779
  • তাহলে আমি এক্ষুনি অনুসন্ধান-এ ক্লিক করছি ঃ)

    আপনাকেও পুজোর আর এই নতুন শরতের দিনের অনেক শুভেচ্ছা।
  • :-@ | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:৫৮449780
  • “ধানের গাদায় ছুঁচ খুঁজে বেড়ানোর” না খড়ের গাদা।
    উপোস, উপবাস থেকে, তাই ষ না।
    শরিক, ঈ না
    আর পঞ্চানন্দ মাঝে মাঝে পঞ্চানন হয়ে গেছে।
    বই হিসেবে ছাপাবার সময় ঠিক করে নিতে পারেন।
    ভালো লেখা।
  • Ela | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২০:০৬449781
  • শ্রাবণী, ‘দৃশ্যাদৃশ্য’-এর শেষটা আমি মিস করে গিয়েছিলাম। সেই সময় বেশ কিছু দিন আসা হয়নি। আপনি একেবারে ঠিক ধরেছেন, এই না হলে গোয়েন্দাগল্পের লেখিকা ঃ)
  • $ | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২০:৩৭449782
  • আরেকটা, হয় মালসমেত নয় বমাল। বামাল বলে কিছু হয় না। আশা করি কিছু মনে করছেন না। সুন্দর লেখাটাকে যতটা নিখুঁত করা যায় সেজন্য চেষ্টা করছি। ভুল ধরার উদ্দেশ্য না।
  • Sarbani | ***:*** | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ২২:১৯449783
  • @$, না না কিছু মনে করছি না। আগের ভুলগুলো একেবারেই বাংলা সফ্টওয়ারে যে অপশন আসে বা পিক করে নেয় তাড়াতাড়িতে সেটা হয়ে টাইপো। খড়ের বদলে ধানের গাদাও না জানার দোষ নয়, তাই আর উত্তরে কিছু লিখিনি। তবে বাংলাতে আমি বেশ কাঁচা, শিখতে ভালোই লাগে।
    এত মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার জন্যে এবং ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
  • $ | ***:*** | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:১৭449784
  • ধন্যবাদ, শর্বাণী।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন