এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মঞ্জিস রায় | ***:*** | ১২ নভেম্বর ২০১৯ ১১:৫৪387938
  • হেমন্তের সন্ধ্যায় রঙ্গীতের ধারে
    মঞ্জিস রায়

    এখানে এখন সন্ধে নেমে আসে নিঃশব্দে l রোদ ডুবে যায় রঙ্গীতের ঢেউয়ে l একা বসে থাকি রিসর্টের বাইরে l দূর থেকে টিমটিম করে পাহাড়ি আলো l কখনো কুয়াশা এসে আচ্ছন্ন করে তোলে l গাছেরা এখনই ঘুমিয়ে পড়েছে l রঙ্গীতের গানের সুরে চারদিকটা যেন মেতে উঠেছে lও পাশের জঙ্গলের ভেতরে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠেছে l ওখানে কি আছে কে জানে !

    এমন নির্জন সন্ধ্যায় মনে পড়ে যায় অনেক পুরোনো কথা l হেমন্তকাল এলেই আমার এই বদভ্যাস যেন আরও জাঁকিয়ে বসে l মনে পড়ে ছোটবেলার সন্ধ্যাগুলোতে মায়ের কাছে The little Mermaid , Alice in Wonderland , শিশু ভোলানাথ, টুনটুনির বই, হ য ব র ল, আবোল তাবোল কিংবা কাগ নয় পড়া l সে ছিল এক অনামা হ্যামলেট l সেখানেও সন্ধে হলে চারদিক নির্জন হয়ে যেত l সেখানে অবশ্য কোনও নদী ছিল না l রুখা, শুখা সে এক দেশ l
    রিসর্টের ঘরে ফিরে এসে হাত পা ছড়িয়ে বসতে না বসতেই ওখানের কর্মচারী করণ চা নিয়ে এল l ছেলেটিকে আমার বেশ লাগছে l 19- 20 বয়স হবে l রোগা, ছোটোখাটো করণের সবসময় মুখে একগাল হাসি l রঙ্গীত নদীর মতই ঝরঝরে ছেলেটি l আজ পূর্ণিমা l নিখুঁত চাঁদ উঠেছে আকাশে l চারদিকের এই আলো আঁধারির রোমাঞ্চ উপভোগ করার জন্য আবার বাইরে এলাম l ঝিঁঝির ডাক, রঙ্গীতের কলতানের মধ্যেও আমার কানে এল দূর থেকে ভেসে আসা এক হালকা অস্পষ্ট সুর l কখনো একটু স্পষ্ট হয় কখনও আবার মিলিয়ে যায় l এই লুকোচুরির মধ্যেই প্রায় হিংস্র ভাবে ধেয়ে আসে একটা তাগড়া চেহারার কুকুর l আমি ছুটে পালাতে যাব এমন সময় করণ ছুটে এসে ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে চেন দিয়ে বেঁধে রাখল l বলল ভয় পাবেন না দাদা, ও এখানকার পোষা l আসলে আপনাকে নতুন দেখছে তো l বললাম , ও কিচ্ছু নয় l আসলে হঠাৎ চলে এসেছে তাই l

    আমার পাশের ঘরে আজকে কয়েকজন এসেছে কিন্ত তারা নিজেদের উপস্থিতি খুব একটা জানান দিচ্ছে না l লাঞ্চ করার সময় কমন স্পেসেও দেখেছি তারা কথা বলছে চাপা গলায় l আমিও আর যেচে আলাপ জমাতে গেলাম না l তবুও ওরা বারবার আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে l
    এরপর আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়লাম l ঠান্ডা তেমন নেই ঠিকই তবে বাইরে কিছুটা হলেও হেমন্তের হিমেল হাওয়া দিচ্ছে l ঘরে এসে আলোটা বন্ধ করে ইউটিউবে আমার অনেক অবেলার বন্ধু বিক্রম সিং এর গানে ডুব দিলাম l চোখ বুজে শুয়ে রইলাম l বিজনবাড়ির কাছাকাছি রঙ্গীতঘেরা এই সবুজ গ্রামটার কথা আমি আগে একজনের কাছে শুনেছিলাম l তাইতো এখানে তিনদিনের জন্য আসা l আসলে ছবি তোলা আর লেখালিখি হল আমার শখ l চাকরি একটা আছে বটে তবে সে তো শুধু পেট চালানোর তাগিদে l আর আমার আর একটা শখ বলা নেই কওয়া নেই, তল্পি-তল্পা গুটিয়ে হুটহাট বেরিয়ে পড়া l শান্তিনিকেতনের লালমাটির রাস্তা আর আদিবাসী গ্রাম যে আমার কত বিষাদময় ভালোলাগার সঙ্গী, তা আমিই জানি l বিক্রম সিং আমাকে সবসময়েই কোথাও একটা নিয়ে যান l মনে হয় এই সময় অনন্তকাল ধরে বয়ে চলেছে l মনে হচ্ছে হয়ত এখানেই সে আছে, রঙ্গীতের কাছে l নিজের সমস্ত বিষাদ ভাগ করে নিচ্ছে নদীর সাথে " আরও আঘাত সইবে আমার ..." l রাত অনেক হল l একটু পরেই হয়ত রাতের খাবার খেতে যেতে হবে l করণকে অনেকক্ষণ দেখিনি l এখানকার আরেক কর্মচারী পাশের ঘরের বাসিন্দাদের একজনকে সঙ্গে নিয়ে রিসর্টের পেছনের রাস্তা দিয়ে বারবার আসছে- যাচ্ছে l আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না l করণ ছাড়া কোনও কর্মচারীর সাথেই আমার হ্যাঁ হুম বাদে আর কোনও কথাই হয়নি l তাদের এই অস্বাভাবিক নির্লিপ্ততা দেখে আমার মনে খটকা লাগছে l এখানে দুটো খরগোশ একটা ঘেরা জায়গায় রয়েছে l শুয়ে শুয়ে ওই ছানাদুটোর কথা খুব মনে পড়ছে l করণ এসে বলল- খাবার তৈরী আছে, খেয়ে নিন l নদীর শব্দ, দুরে কোথাও কোনও কুকুরের কান্না, সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম সংকেত l
    ডাইনিং স্পেসে আমিই একা খেলাম l পাশের ঘরের লোকজন কি শুয়ে পড়েছে? জানিনা l রিসর্টে এই দুটো ঘর বাদেও অনেক ঘর আছে l কিন্তু কেউ নেই l কি অদ্ভূত, না? অথচ কত সুন্দর এই জায়গা l রাতে ঘুম হল না l একটা বন্য প্রাণীর ঝটপটানি শুনতে পেলাম l কিন্তু বাইরে বেরোনোর সাহস হয়ে উঠল না l
    ভোরে উঠে পড়লাম l বাইরে হাঁটছিলাম l করণকে দেখলাম চায়ের বন্দোবস্ত করছে l রিসর্ট থেকে বাইরে রঙ্গীতের ধারে যেতে গিয়ে দেখলাম খাঁচা দুটো শূন্য, এখানে ওখানে রক্ত, পালক পড়ে রয়েছে l আমার ওই ছোট্ট আদুরে খরগোশ দুটোর কথা ভেবে অসুস্থ লাগছিল l রঙ্গীতের পারে একটা বোল্ডারের ওপর বসে জিরোলাম l কিছুক্ষন পরে করণ চুপি চুপি এখানে এসে দাঁড়ালো l আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল দাদা, এরা সুবিধের লোক নয় l এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়া ভালো l বললাম, কেন গো ? ও বলল, এখন এখানে বলা যাবে না l ওরা নজর রাখে l
    আমি চা জলখাবার খেতে যাবার সময় একজন যুবক কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এলেন l ওরা একটা টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল l করণ খাবার নিয়ে এসে চুপিচুপি বলল- উনিই এখানকার মালিক l
    লোকটা আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে l ওর গায়ে টি শার্ট, হাতে দামি ঘড়ি, গলায় চেন l ওরা টেবিল থেকে উঠে চারদিক দেখতে দেখতে যখন ওপাশের কোনও একটা ফাঁকা ঘরে ঢুকে পড়ল, তখন করণ আমাকে ওর মালিকের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলল l এই রিসর্ট চালু হয়েছে মাত্র বছর দুয়েক l মালিকের বাবা বিজনবাড়ি এলাকার বড় নেতা l এদের অনেক কীর্তি কাহিনী আছে l এমন কি খুনখারাপির মামলাও এদের নামে আছে l আমি অবাক হলাম l মালিকের বয়স বড়োজোর ছাব্বিশ - সাতাশ হবে l এখনই এই বিপুল সম্পত্তির মালিক ! করণকে বললামও সে কথা l করণ বলল- সৎপথে থেকে কি আর এসব হয় দাদা ?

    এমন সময় ওরা আবার বেরিয়ে এল l করণ মুখে আঙুল দিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দিল l ওরা করণ কে ডাকল l মনে হল ওরা হয়ত ওকে সন্দেহের বশে কিছু জিজ্ঞেস করছে l
    আমি বসে রইলাম l মনে হল- এ কোথায় এলাম ? কাদের পাল্লায় পড়লাম l ওরা কিচেনের দিকে চলে গেল l কিচেনের পেছনের ঘর থেকে একজন বয়স্কা মহিলার কাশির শব্দ শুনলাম l তারপর শুনলাম চেঁচামেচি l একটি বাচ্চা মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছে l আর তাকে অশ্লীল গালাগালি দিয়ে থামানো হচ্ছে l একটু পরে কানে এল মারধর আর কান্নার শব্দ lআমার গলা দিয়ে খাবার আর নামতে চাইছে না l
    বেশ কিছুক্ষণ পর করণ এসে উদ্বিগ্ন মুখে বলল - আপনি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ুন l এখন ওরা ওই দিকে গেছে l যে কোনও সময় আবার আসতে পারে l বললাম- কিন্তু তোমার? তোমার কি হবে? ও বলল- আমার কি দাদা? এরা আমার পেটের ভাত যোগায় l আমি থাকতে বাধ্য l আমার মুখ চেয়ে আমার মা আর ছোট্ট বোন বাড়িতে আছে l কে আর কাজ দেবে আমাদের? প্রাণের মায়া ভুলে যেতে হয় দাদা l

    অনেক জায়গাতেই এরকম ছেলেদের দেখা পেয়েছি l হায় আমার দেশ ! আমি কোনোমতে খাবার শেষ করে উঠে পড়লাম l ঘরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম l করণ আমাকে পেছনের দিকের গেট দিয়ে বের করে দিল l পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে করণ l আমি হতবাক l এখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনই বা কিভাবে পৌছাবো l হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছু দুর যাবার পরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম l এগিয়ে দেখি একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী গাড়িতে বসে আছেন l ড্রাইভার কোনও কারণে বাইরে গেছে l জানি এখনকার দিনে অচেনা লোককে কেউ গাড়িতে নেবে না l ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করে জানলাম ওনারা এখন দার্জিলিং যাচ্ছেন l আমি খুব বিনয় করে একটা লিফ্ট চাইলাম l জানিনা কেন ওনারা রাজি হলেন l দার্জিলিংয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কেন করণের মুখ আমাকে বারবার ভাবাচ্ছে l নিজেকে জিজ্ঞেস করছি, আমি কি পালিয়ে এলাম ?
    যেতে যেতে বহুদিন আগে পড়া T S Eliot এর Murder in the Cathedral এর একটা লাইন মাথায় ঘুরছিল -
    " However certain our expectations
    The moment foreseen may be unexpected
    When it arrives."
    সত্যিই যেমন আশা করা হয়, ঠিক তেমনটা হয়ে ওঠে না l
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন