এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • ফুকো, ফেমিনিজম ইত্যাদি

    Ishan
    অন্যান্য | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ | ১৩২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ishan | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:৫২382577
  • এটা ফেমিনিজমের ইতিহাস নয়। তাহলে কী? না, 'ইজম' বা 'বাদ' নামক বস্তুটা যে নড়তে নড়তে বিগত কয়েক দশকে সম্পূর্ণ অন্য একটা রূপ পরিগ্রহ করেছে, এটা সম্পর্কে অনেকেই, এমনকি 'অমুক বাদ'এর সমর্থকরাও সম্যক ওয়াকিবহাল নন। অথচ ব্যাপারটা বোঝা জরুরি। তাঁদের জন্যই টেকনিকালিটি বাদ দিয়ে একটু সহজ করে এই লেখা। এতে এই লক্ষ্যেই অল্প কিছু বিষয় ছুঁয়ে যাওয়া হবে। অনেকটাই না ধরা থাকবে। ফলে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পড়তে হলে একদম এই লেখা পড়বেননা।

    প্রাককথন
    --------------
    দেড়শো দুশো বছর আগে তো বটেই, এমনকি বিংশ শতকের প্রথমার্ধ্বেও 'বাদ' বা 'ইজম' বলতে একটা মনোলিথিক ব্যাপার বোঝা হত। যেমন মার্কসবাদ। ডারউইনবাদ। ইত্যাদি প্রভৃতি। সে যুগে এদেরকে যেভাবে বোঝা হত, তা হল, 'বাদ' ব্যাপারটার একটা উৎস বা কেন্দ্র আছে, যেমন মার্কসের বইগুলি মার্কসবাদের উৎস। সেখানে মোটামুটি ব্যাপারটা বলে দেওয়া আছে। এরপর বোঝাবুঝিতে মতপার্থক্য ঘটতে পারে, কিন্তু তিন রকম ব্যাখ্যা থাকলে একটা "মার্কসবাদ সম্মত"। বাকিগুলি ভুলভাল। সংশোধনবাদী বা অন্য কিছু।

    মোটামুটি ষাটের দশক থেকে(বা তার একটু আগে) এই চিন্তার ঘরানাটা বদলাতে শুরু করল। পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম দিয়ে ব্যাপারটা শুরু। পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম, দেখুন, নামের শেষেই "ইজম" আছে, কিন্তু সেটা কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্বকে বোঝায়না। এরপর আরও নানা চিন্তন আসতে লাগল। পোকো-পোমো তো সবাই জানেন, অর্থাৎ কিনা পোস্ট কলোনিয়ালিজম, পোস্ট মডার্নিজম। সেসব কী বস্তু, এখানে লেখার কোনো মানে নেই, এখানে কথা হচ্ছে "ইজম" নিয়ে। এই সকল "ইজম"ই নামে ইজম হলেও তাৎপর্যগতভাবে আগের পর্যায়ের ইজম থেকে আলাদা। এসবের নির্দিষ্ট কোনো উৎস বা কেন্দ্র নেই, বা নির্দিষ্ট কোনো তাত্ত্বিক কাঠামোও নেই। শুধু কিছু নির্দিষ্ট চিহ্ন দিয়ে লেখা বা চিন্তার ধরণটা বোঝা যায়। যেমন ধরুন, খুব সোজা ভাষায় বললে, "বৃটিশ আর নেই, কলোনি কিন্তু আছে" এই মর্মে আপনি কিছু বললে সেটা পোকো হেডলাইনের নিচে আসবে। কলোনি কীভাবে আছে, সে আপনি যা খুশি বলুন। এমনকি শেষে প্রমাণও করতে পারেন, কলোনি এখন বিশ্বময়, অর্থাৎ কলোনি আর নেই।

    অর্থাৎ ইজম ব্যাপারটা, নাম অপরিবর্তিত রেখেও ভিতরে ভিতরে বদলে গেল। কী হল? না, একটা বিষয়ের উপর একটাই ইন্টারপ্রিটেশন "সঠিক" বাকিগুলো "ভুল" এই ধারণাটা গোল্লায় গেল। বরং বহুস্বর, বা অনেক ইন্টারপ্রিটেশনের সম বা কাছাকাছি মর্যাদার জায়গা তৈরি হল। তারা পরস্পরবিরোধীও হতেই পারে। এবং এদের একটা লুজ সেটকে একটা "ইজম" এর খোপে ফেলা হল। একটা এবার এই চিন্তনের যে ঢেউ, সেটা পুরোনো "বাদ" এবং নতুন "বাদ" গুলোতেও লাগল। পুরোনো গুলোতে নানা চিন্তায় চুলোচুলি আগেই ছিল। যেমন ধরুন মার্কসবাদীরা সবাই সবাইকে সংশোধনবাদী বলত। এখন পোস্ট মার্কসিজম বলে একটা প্র‌্যাকটিস চালু হল, সেখানে নানা পরস্পরবিরোধী চিন্তাকে আশ্রয় দেওয়া হল। তারা চুলোচুলি এখনও করবে, কিন্তু তাতেও সব্বাই মার্কসিস্ট। একই সঙ্গে আরও কিছু অ্যাকটিভিজমের উত্থান বা পুনরুত্থান ঘটল, যাদের সে অর্থে কোনো কেন্দ্র বা উৎস ছিলনা। সমকামিতার আন্দোলন তাদের মধ্যে একটা। এর নামের শেষে কোনো ইজম জুড়ে "জেন্ডারিজম" করা হয়নি। পরিবেশ এবং নারী, এরা হল আরও দুটি। এরা দুটিই পুরোনো। এবং এদের নানা ঘরানার মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ-পরস্পরবিরোধিতা আগেও ছিল। কিন্তু মূলত ষাট ও সত্তরের দশকে "মানবীবিদ্যা" এবং 'পরিবেশবিদ্যা' নামক একটি ছাতা ফর্মালি তৈরি হল, যার ভিতরে নানা নারীবাদী এবং পরিবেশবাদী চিন্তাভাবনার জায়গা হল। অর্থাৎ, আগেই যেটা বলেছি, বহুস্বরের জায়গা হল, অনেক পরস্পরবিরোধী মতামতের সম বা কাছাকাছি মর্যাদার জায়গা তৈরি হল। অনেক অনেক কিছু বলছেন পরিবেশ নিয়ে, সবাই পরিবেশবাদী, কেউ আর "আসল" পরিবেশবাদী নন। একই ভাবে অনেকে অনেকরকম ভাবে নারীবাদের কথা বলছেন, কেউ আর "আসল" নারীবাদী নন, সবাই নারীবাদী। সোজা ভাষায় বলতে গেলে চিন্তাভাবনার আর কোনো হোলসেলার থাকলনা, ফর্মালি।

    এবার, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, যাকে বলে ক্যাকোফনি তৈরি হল। বহুস্বর বলতে যা বোঝায়। সমকামিতা, পরিবেশ, নারী, সর্বত্রই। পরিবেশচিন্তার নানা ঘরানা নিয়ে আমাদের বন্ধু পার্থ একটি ভারি চমৎকার বই লিখেছে, পড়ে দেখতে পারেন। পরিবেশের চেয়েও বেশি ক্যাকোফনি তৈরি হল নারীবাদে। নানা ঘরানা নানা মতবাদ। সেগুলোতে আমরা পরে ঢুকব। আপাতত মুখবন্ধে পয়েন্টটা হল, এই ২০১৭ সালে নারীবাদ, পরিবেশবাদ, বা অন্য যে কোনো "বাদ", নামের শেষে যতই "বাদ" লাগাকনা কেন, মূলত সেগুলি নানা পরস্পরবিরোধী মতবাদের সমষ্টিমাত্র। "একটি মতবাদের একটিই দোকান" কনসেপ্টটি এখন আর নেই। এর সুবিধে ও অসুবিধে দুইই আছে। সুবিধে হল, যদি অবশ্য এটাকে সুবিধে ভাবা যায়, "আমি নারীবাদী" বা "আমি পরিবেশবাদী" বলতে গেলে এখন আর কোনো বড়দা বা বড়দির পারমিশন নেবার প্রয়োজন পড়েনা। এখন সবাই স্বঘোষিত। আর অসুবিধে হল, "নারীবাদ বা পরিবেশবাদের বিরুদ্ধে বলতে এলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব" এই জাতীয় স্ট্যান্ড আর নেওয়া যাবেনা। কারণ এরা এত পরস্পরবিরোধী মতামতের সমাহার, যে, যে কোনো ইস্যুতে কোনো স্ট্যান্ড নিলে কোনো না কোনো ঘরানার "বাদ"এর বিরুদ্ধতা করতেই হবে।
  • Ishan | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১০:০৫382583
  • দ্বিতীয় তরঙ্গ
    ----------------
    এই ক্যাকোফনি বা বহুস্বর নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় দ্বিতীয় তরঙ্গে। মোটামুটি ষাটের দশকে দ্বিতীয় তরঙ্গ শুরু হয়েছে বলা হয়। এও বলা হয় তরঙ্গের ধারণাটা সবকিছু ব্যাখ্যা করেনা, কিন্তু আপাতত আমরা তরঙ্গ বলে কিছু ছিল ধরে নিয়েই এগোব এবং ধরে নেব, ওটা ষাটের দশকেই শুরু। কিন্তু শুরু থেকেই তীব্র কোনো বিতর্ক ছিল এমন নয়। দ্বিতীয় তরঙ্গ মোটের উপর সুস্পষ্ট লিঙ্গবৈষম্যকে উদ্দেশ্য করেই এগিয়েছিল। প্রকট লিঙ্গবৈষম্যই ছিল কেন্দ্রীয় বস্তু। এবং এ সংক্রান্ত লেখালিখি একটি অন্যটিকে সমর্থন করছিল বলেই মনে হয়। সিমোন দা বেভোয়ার যখন সেকেন্ড সেক্স লেখেন, যদিও সেটা সময়কালে খানিকটা পিছিয়ে, তখন সুস্পষ্টভাবেই তিনি লিঙ্গবৈষম্যের একটি ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা নেন। কীভাবে একটি লিংগ দ্বিতীয় লিঙ্গ বা অপর লিঙ্গ হয়ে উঠল এ মূলত তারই খতিয়ান। তিনি জোর দিয়েই বলেন, এর কারণ জৈবিক একেবারেই নয়। সম্পূর্ণ সামাজিক। মূলত সন্তান উৎপাদন এবং প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতাই এর কারণ। সোজা ভাষায় অনুবাদ করলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ায়, যে কেবল বাচ্চা বিইয়ে চলতে হলে এবং পালন করে চলতে হলে অন্য লিঙ্গ মেয়েদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবেই।

    প্রসঙ্গত, ফ্রিডরিক এঙ্গেলসও এর বহুদিন আগে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের সঙ্গে জুড়ে "নারীজাতির সার্বিক পরাজয়" এর একটি তত্ত্ব নির্মান করেন। কিন্তু সেখানে সন্তান উৎপাদন মূল কারণ ছিলনা। মূল কারণটি ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্ন। নারীজাতির পরাজয়ের ব্যাপারে সিমোন সম্ভবত একমতই ছিলেন, কিন্তু মূল কারণটিতে একেবারেই না।

    এর পরে ফেমিনিন মিস্টিক যখন লেখা হয়, যা দ্বিতীয় তরঙ্গের বাইবেল, তখন সেটা অনেকটাই সেকেন্ড সেক্সের সঙ্গে একই সুতোয় বাঁধা। ফেমিনিন মিস্টিক ব্যাপারটা কী? না, স্বামীসঙ্গ এবং সন্তান প্রতিপালনই মেয়েদের জীবনের সার্থকতা -- এইটা প্রোজেক্ট করা। যদিও, এগুলি মেয়েদের সুখ্ দিচ্ছেনা। এর কারণ, জৈবিকভাবে মেয়েরা ওইটুকুতে সুখী হয়না, ওটা সামাজিকভাবে নির্মিত ভূমিকামাত্র। এর কিছু পরে আসে "পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল" স্লোগান। সেটাও মোটামুটি একই দিকে ধাবিত। প্রতিটাই একে অপরের পরিপূরক। আরও পরে সত্তরের দশকে আসে সুসান ব্রাউনমিলারের ধর্ষণ সংক্রান্ত বই, এগেনস্ট আওয়ার উইল। সেখানে তিনি বস্তুত বেভোয়ারের তত্ত্বে ধর্ষণকে যোগ করেন। একদিকে ধর্ষণকে সভ্যতার গোড়া থেকে একটি রাজনৈতিক টুল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তিনি দেখান, নৈতিকতা সেই ভাবেই নির্মিত, এবং একই সঙ্গে সেটি মেয়েদের সন্ত্রস্ত করে রাখার যন্ত্রও। বলাবাহুল্য এঙ্গেলসের তত্ত্বে ধর্ষণ বস্তুটিও ছিলনা।

    এই তত্ত্বগুলির মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। ১। এরা সবাই বৈষম্যের জন্য সামাজিক কারণকে দায়ী করেছিল। বায়োলজিকে নয়। ২। এরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছিল। পরস্পরবিরোধী হিসেবে নয়। ৩। এদের প্রত্যেকটি থেকেই নির্দিষ্ট কিছু আন্দোলনের লক্ষ্য বার করা সম্ভব। যেমন,
    ১। জন্মনিয়্ন্ত্রণের অধিকার। মাতৃত্বই যদি দাসত্বের কারণ হয়, তো জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নারীর থাকা উচিত। ঘটনাচক্রে ষাটের দশকেই কার্যকরী গর্ভনিরোধক প্রথম চালু হচ্ছিল। প্রচুর বাধা, বিধি নিষেধ ছিল। আন্দোলন ছিল জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে।
    ২। স্রেফ সুখী গৃহকোণ আলো করে বসে থাকাই যদি নারীর জীবনের লক্ষ্য না হয়, তবে তার শিক্ষা এবং কাজের সমানাধিকার দরকার। আইনত বহু জায়গাতেই সেরকম ছিলনা। ফলে সেগুলো আদায়ের দাবীতে আন্দোলন হয়।

    এগুলো সবই মোটামুটি সত্তরের দশকের মধ্যে আদায় হয়ে যায়। যদিও এই ঘরানাটা অনেকের কাছেই এলিটিস্ট ঘরানা ছিল, কারণ ফেমিনিন মিস্টিক মূলত তাদের সমস্যার কথা বলছিল, যাদের বাকি সব কিছু মিটে গেছে, কিন্তু তবুও তারা অসুখী। অনেক মহিলাই মনে করেন, কাজ করা ব্যাপারটা অমন শৌখিন মজদুরি নয়, সে নিয়ে কিছু বিভাজনও তৈরি হয়। কিন্তু সে কোনো তীব্র মতাদর্শগত ফারাক নয়।
  • Ishan | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৩৩382584
  • দ্বিতীয় তরঙ্গ ও ক্যাকোফনি
    ---------------------------

    চোখে দেখা যায় এরকম দাবীগুলি মেটার পর, ফেমিনিজমের নানা ঘরানা অন্যান্য বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। এবং, মোটামুটিভাবে ৮০র দশক থেকে তীব্র মতবিরোধ শুরু হয়। এর শুরু অবশ্য অনেক আগেই। ষাটের দশকের শেষ দিকে, তখনও জন্মনিয়ন্ত্রণের উপর মেয়েদের সার্বিক অধিকার কায়েম হয়নি, একদল ফেমিনিস্ট আমেরিকান সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের বক্তব্য ছিল সুন্দরী প্রতিযোগিতা বা এই সৌন্দর্যের ধারণাটিই একটি শোষণের কল। এই ফেমিনিস্টদের র‌্যাডিকাল ফেমিনিস্ট বলা হত।

    এই ঘরানা থেকেই মতবিরোধের শুরু হয়। সেই সময় হয়নি, কিন্তু মতবিরোধটি বড় আকার নেয় আশির দশকে। আরও একটা বিষয় নিয়েও নানা মতপার্থক্য বাড়ে, সেটি আগেই বলা হয়েছে। ফেমিনিন মিস্টিক একটি এলিটিস্ট ঘরানার থিয়োরাইজেশন। শ্রমজীবি মহিলাদের সমস্যাকে তা একেবারেই অ্যাড্রেস করেনা। ফলে মতবিরোধ দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। যতদিন হাতে সুস্পষ্ট কিছু ইস্যু ছিল, ততদিন এরা সামনে আসেনি। কারণ কর্মক্ষেত্রে, জন্মনিয়ন্ত্রণে, শিক্ষায় বৈষম্য থাকলে তা চোখে দেখা যায়। সেসব নিয়ে ঐকমত্য না থাকারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেগুলো মোটের উপর মিটে গেলে, সূক্ষ্মতর বিষয় এবং প্রায়োরিটির প্রশ্নে নানা মত আসতে বাধ্য এবং তারা স্রেফ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকবে এমন না।

    তা, এরকম সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী মতামত আসতে শুরু করে ৮০র দশক থেকেই। মোটামুটি তখন থেকেই নারীবাদ এর "বাদ" টি একটি বৃহৎ ছাতায় পরিণত হয়। এবং এরকম বিতর্কের সংখ্যা একটি মাত্র নয়। যদিও আমরা একটির উপরেই ফোকাস করব্, কারণ সব লেখা সম্ভবও নয়, সব আমি জানিও না। কিন্তু সেই বিতর্কটিই যথেষ্ট বড়। সেখানে কাল ঢোকা যাবে। আজ না।
  • S | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৩৮382585
  • প্রথম লেখার শেষ দিকে যেদুটো সুবিধে এবং অসুবিধের কথা লিখেছেন, সেগুলো পড়ে মনে হচ্ছে আপনি পিওরিস্ট। আজকের দিনে, যেখানে শিক্ষা ও চিন্তাভাবনার এরকম জগত জোড়া প্রসার ঘটে চলেছে, সেখানে একজন বা কয়েকজন কোনো বিশেষ মতবাদকে কুক্ষিগত করে রাখবে, আর বাকিদের বলবে তোমরা বাদ - সেটা কখনো হতেই পারেনা। ওসব প্রি-সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার কনসেপ্ট। দুজন লোক চারটে বই পড়ে লড়াই করতো, বাকিরা মুগ্ধ হয়ে শুনতো আর বাহ বাহ করতো। সেসব দিন গেছে, ভালো হয়েছে। আইডিওলজিরও ডেমোক্র্যাটাইজেশন ঘটেছে। আপনি সেটাকে যতই ক্যাকোফনি বলে গাল দিন, সেভাবেই ডিসকোর্স চলছে, চলবে।

    এর কারণ হলোঃ লোকে দেখে নিয়েছে যে কোনো একটা বিশেষ আইডিওলজি দিয়ে কাজ চলেনা। সব কটা ফেইল করেছে, করছে, করবে। সব আইডিওলজিতে প্রচুর গ্যাপস থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব আইডিওলজিরই পরিবর্তন দরকার।

    আরেকটা সমস্যাঃ এটা বোধয় শব্দ গুলো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে আপনার। যেমন "পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম" এর শেষ ইজমটা স্ট্রাক্চারালিজমের ইজম, পুরো ফ্রেজটার নয়। পোস্ট-সামথিঙ্গ।
  • Ishan | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৫১382586
  • হায় ভগবান। আমায় বলে পিওরিস্ট। পোস্টমডার্ন থেকে পিওরিস্ট? আমার এ কী ডিমোশন হল?
    ক্যাকোফনি গাল কেন হবে। পৃথিবীর কী কোনো সংকট হয়েছে, নাকি জগৎটা আচমকা বদলে গেছে? বহুস্বর, ক্যাকোফনি এসব আমার কাছে কোনো গাল নয় তো। :-(
  • Ishan | ***:*** | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১০:৫৪382587
  • এছাড়াও শব্দ বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। এগুলো আমি, না হলেও কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে বলে বুঝে আসছি। বাদ ব্যাপারটাই বদলেছে। স্ট্রাকচারালিজমও এখন একই ভাবে ব্যবহার করা হয়। পোস্ট ছাড়াও। পরিবেশবাদ ও তাই। তাতেও কোনো পোস্ট নেই।
  • Ishan | ***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৪৮382588
  • ক্যাকোফনি(২)
    ----------------
    আমরা এবার বিতর্কের এলাকায় ঢুকে পড়েছি, যেটা এখানে কিঞ্চিৎ বড় করে বলা হবে। মূল যে বিতর্কটিতে ফোকাস করা হচ্ছে, সেটায় ঢোকার আগে জিনিসটা একটু সোজা ভাষায় বুঝে নেওয়া যাক। ধরা যাক, সুন্দরী প্রতিযোগিতার এক প্রতিযোগিনী আর তার কোনো বান্ধবীর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে। দুজনেই নারীবাদে উদ্বুদ্ধ কিন্তু প্রতিযোগিনী প্রতিযোগিতার পক্ষে আর বান্ধবী বিপক্ষে, হয়তো র‌্যাডিকাল। বলাবাহুল্য, কথোপকথনটি পুরো কাল্পনিক, এবং ২০১৯ এর ভাষায় বলা হচ্ছে।

    বান্ধবীঃ তোকে কিন্তু ওরা পণ্য বানাচ্ছে।
    প্রতিযোগিনীঃ কে পণ্য নয়?
    বান্ধবীঃ কিন্তু তোর যৌনতাকে পণ্য বানানো হচ্ছে।
    প্রতিযোগিনীঃ বুদ্ধিকে পণ্য বানানো গেলে যৌনতাকে কেন নয়?
    বান্ধবীঃ কারণ এটায় বাধ্য করা হচ্ছে মেয়েদের শরীরকে, বিভঙ্গকে, যৌনতাকে মেল গেজ অনুযায়ী শেপ করতে।
    প্রতিযোগিনীঃ কে বাধ্য করল? আমি তো নিজের ইচ্ছেয় করছি। তাছাড়া মেল গেজ হলেই বা কী, পুরুষরাই তো পায়ে এসে পড়ছে। এটাই তো লিবারেশন।
    বান্ধবীঃ ওটাই দাসত্ব। লিবারেশন নয়।
    প্রতিযোগিনীঃ কেন?
    বান্ধবীঃ কারণ তোকে সেক্সুয়াল অবজেক্টে পরিণত করা হচ্ছে। অবজেক্টিফিকেশন।
    প্রতিযোগিনীঃ তা, শরীর দেখালে সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনই তো হবে। কবিতা লিখলে হবেনা। আমি স্বইচ্ছায় আমার সেক্সুয়ালিটি দিয়ে অন্যকে এন্টারটেন করছি। আমি যে পারছি, এটাই আমার ক্ষমতা।
    বান্ধবীঃ কিন্তু এটা তো তুই নিজে করছিসনা। তোকে এইভাবে কন্ডিশন করা হয়েছে। তুই আসলে নিজে নিজের কথা বলছিসনা। পিতৃতন্ত্র তোর মুখ দিয়ে তার কথা বলাচ্ছে। তুই পিতৃতন্ত্রের এজেন্ট।
    প্রতিযোগিনীঃ আমার কথা আমি বলছিনা, পিতৃতন্ত্র বলাচ্ছে, তুই জানলি কীকরে? একজন মেয়ের তার শরীরের উপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে। সেটায় তুই বাধা দিচ্ছিস। তুই পিতৃতান্ত্রিক।

    এই কথোপকথনটি পুরোই কাল্পনিক। এরকম কিছু ষাটের দশকে হয়নি। বিতর্কটা হয়েছিল আশিতে। সেও এই ফর্মে নয়। কিন্তু বস্তুত এর চেয়ে অনেক বড়ো আকারে এবং আরও অনেক সংবেদনশীল ব্যাপার নিয়ে। আশির দশক শুরু হবার আগেই একদল র‌্যাডিকাল ফেমিনিস্ট পর্নোগ্রাফি বিরোধী একটি আন্দোলন শুরু করেন। সেটা গতি পায় আশিতে। যদিও পর্নোতে মেয়েদের উপস্থাপনা নিয়েই বিষয়টা শুরু হয়, কিন্তু আজকের ভাষায় বললে বিষয়টা সমাজে এবং মিডিয়ায় মেয়েদের সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন সংক্রান্তই ছিল। সোজা ভাষায় বললে, পর্নোগ্রাফি, বিডিএসএম, যৌনগন্ধী বিজ্ঞাপন, এগুলোতে মেয়েদের যৌন পণ্য করে তোলা হয়। করা হয় সমাজের মেল গেজ অনুযায়ী। সেটা দাসত্ব। মেয়েদেরও এইভাবেই নিজেকে ভাবতে কন্ডিশন করে ফেলা হয়। ফলে এগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা প্রয়োজন।

    এঁদেরকে সোজা ভাষায় বলা হত অ্যান্টি পর্নোগ্রাফি ফেমিনিস্ট। এঁদের বক্তব্য জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উল্টোদিকে আরেকটি ফেমিনিস্ট ঘরানা উঠে আসে মূলত লিবারাল ফেমিনিস্টদের মধ্যে থেকে, যাঁদের বলা হত সেক্স-পজিটিভ ফেমিনিস্ট। তাঁদের কথাবার্তা উপরের কাল্পনিক কথোপথনে প্রতিযোগিনীর মতো। মোদ্দা বিষয়টা একই, যদিও অনেক বেশি রাজনৈতিক। অ্যান্টি-পর্ন ফেমিনিস্টদের তাঁরা দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলদের মুক্তযৌনতা এবং পর্নো বিরোধী অবস্থানের সঙ্গে এক গোত্রে ফেলেন। তাঁরা সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার উপর জোর দেন। মেয়েদের যৌন ইনহিবিশনের শৃঙ্খল ভাঙার কথা বলেন। ফলত যৌনতা, পর্নোগ্রাফি, পুরো বস্তুটাকেই এঁরা লিবারেশনের সঙ্গে যোগ করেন। সোজা ভাষায় বললে নারীর যৌনতা বা যৌন আনন্দ কুন্ঠিত হবার মতো কোনো বিষয় নয়, তা দেখানো, বিক্রি করা, অর্থাৎ এক কথায় যাকে অবজেক্টিফিকেশন বলা হয়, সবই মুক্তির দিশা দেখায়। সিনেমা বা বিজ্ঞাপনে মেয়েরা শোষিত হচ্ছে না (অর্থনৈতিক শোষণ হচ্ছেনা বা ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে না ধরে নিলে ), শোষণ নয়, ওটাই স্বাধীনতা।

    সম্পূর্ণ প্রাথমিক একটি বিষয় নিয়ে এই বিতর্কটি এত তীব্র আকার ধারণ করে, যে, একে ফেমিনিস্ট সেক্স ওয়ার বলা হয়। এখানে কেবল মোটা দাগে জিনিসটা বলা হল। এর অনেক কৌতুহলোদ্দীপক দিক আছে, সেসবে আর যাওয়া হবেনা, যে কেউ নেট টেট ঘেঁটে দেখে নিতে পারেন। এখানে মোদ্দা দুটো জিনিস বলার।

    ১। খুব স্পষ্ট যে বৈষম্য, যেমন চাকরির, জন্মনিয়ন্ত্রণের, বা শিক্ষার ক্ষেত্রে আইনী বৈষম্য, যৌনহিংসা, এসব নিয়ে নারীবাদীদের মধ্যে বিশেষ মতবিরোধ ছিলনা। শুধু নারীবাদী নয়, বাম ঘরানার চিন্তাবিদদের মধ্যেও এই দাবীগুলি নিয়ে তেমন কোনো দ্বিমত ছিলনা।

    ২। ঠিক উল্টো হল সূক্ষ্মতর যে বিষয়গুলি নিয়ে। আজকের দিনেও যে বস্তুগুলি আলোচনায়, যেমন অবজেক্টিফিকেশন, এ গুলি নিয়ে ন্যূততম মতৈক্যের কোনো জায়গাও কখনও তৈরি হয়নি। অবজেক্টিফিকেশন সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য এবং অবজেক্টিফিকেশনই মুক্তির পথ, এই দুটিই দুই ঘরানার নারীবাদীদের বক্তব্য। অবশ্যই এর মাঝামাঝি নানা অবস্থানও আছে। একই মতানৈক্য অপ্রেশনের প্রসঙ্গেও (সূক্ষ্মতর বিষয়গুলিতে। সৌদি আরবে মেয়েদের অপ্রেশন নিয়ে কেউই দ্বিমত হতেন বলে মনে হয়না)। একদলের কাছে যা অপ্রেশন বা দমন-পীড়ন (যেমন পর্নো বা বিজ্ঞাপন বা বিডিএসএম), অন্য আরেকদলের কাছে তাইই লিবারেশন বা মুক্তি। অপ্রেসর বা পীড়ক কে, আদৌ আছে কিনা, এই নিয়েও অজস্র মতামত। বেভোয়ার তাঁর ক্লাসিক বইয়ে পুরুষ ও নারীর 'ব্রাদারহুড'এর ডাক দেন। ফেমিনিস্ট মিস্টিকে একটা নামহীন ঘটনাকে অপ্রেশন বলা হয়েছে, কোনো পীড়ক শ্রেণী নির্ধারণ করা হয়নি। খুব ছোটোখাটো কিছু চরমপন্থী ঘরানায় পুরুষই শত্রুশ্রেণী এরকম কিছু ফর্মেশন করা হয়, কেউ কেউ পুংহীন নারীসমাজের ডাক দেন (লেসবিয়ানিজম কেও কী আশ্চর্য একটি মুভমেন্ট হিসেবে ভাবা হয়েছিল), কেউ ক্যাস্ট্রেশনেরও ডাক দেন, কিন্তু এগুলি কখনই বড় কোনো স্কুল ছিলনা। এই তরগের পরিচিত এবং নামকরা ফেমিনিস্ট যাঁরা তাঁরা সকলেই মোটামুটি ওই র‌্যাডিকাল এবং লিবারাল স্কুলের সীমানায় এঁটে যান। এবং তাঁদের, এই সমস্ত ব্যাপারগুলিতে মতৈক্য ছিলনা।

    কাজেই এই ২০১৯ সালে "ফেমিনিজম বলিয়াছে" বলে কিছু হয়না। "সমান মজুরির দাবী"কে কেউ "ফেমিনিজম বলিয়াছে" বললে মেনে নিতে পারেন অবশ্যই, টেকনিকালি ব্যাপারটা ঠিক না হলেও, কার্যক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবার সম্ভাবনা কম। কিন্তু ফেমিনিজম বলিয়াছে অবজেক্টিফিকেশন বদ, ফেমিনিজম বলিয়াছে নারী মাত্রেই অপ্রেসড এবং অপ্রেসর ক্লাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে হবে, ফেমিনিজম বলিয়াছে সেনসেশনালইজেশন দরকার, ফেমিনিজম বলিয়াছে ইয়েস মিনস ইয়েস, এই জাতীয় দাবী কেউ যদি করেন, তা একেবারেই ঠিক নয়। এর প্রতিটি ব্স্তু নিয়েই তীব্র বিতর্ক আছে। এর প্রতিটি অবস্থানেরই পাল্টা ফেমিনিস্ট অবস্থান আছে। থাকাই স্বাভাবিক। সেটা স্বাস্থ্যকরও। যাঁরা এই স্বাস্থ্যকর বিতর্কগুলিকে বন্ধ করতে চান, তাঁরা আর যাইহোক ফেমিনিজম ব্যাপারটার কিছুই বোঝেননা, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
  • Ishan | ***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২৫382589
  • ফুকো
    ---------
    নারীবাদের ভিতরের এই টানাপোড়েন অভূতপূর্ব কিছু নয়। এটা বস্তুত পুরোনো ঘরানার মনোলিথিক 'বাদ' এর ধারণা থেকে বহুস্বরীয় 'বাদ' এ পরিবর্তনের সূচকও। একই জিনিস হয়েছিল, চিরপুরাতন মার্কসবাদের ক্ষেত্রেও, যেটাকে এক কথায় আমরা বলতে পারি 'ফলস কনসাসনেস' এর সমস্যা। সেটা কী রকম? না, মার্কসবাদীরা তো দেশে-দেশে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি বানিয়ে ফেললেন, ধরুন বিংশ শতকের গোড়ায়। কিন্তু তার পরেও দেখা গেল শ্রমিকরা শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিকে সমর্থন না করে বুর্জোয়াদের সমর্থন করছে। এ কেন? শ্রমিকরা কি গাম্বাট, নিজের স্বার্থ বোঝেনা?

    এর একটা উত্তর হল 'না বোঝেনা'। তারা গাম্বাট নয়, কিন্তু বুর্জোয়া মতাদর্শে তাদের মগজ ধোলাই হয়ে গেছে। অনেক পরে গ্রামশি প্রক্রিয়াটার একটা পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ করলেন, মতাদর্শগত আধিপত্য বা হেজিমনির ধারণা নিয়ে এলেন। সহজ করে বললে, হেজিমনি হল মগজ-ধোলাই যন্ত্র, ধোলাই হয়ে যাবার পর লোকে সে যা নয় তাই হয়ে যায়, অর্থাৎ ফলস কনসাসনেসে আক্রান্ত হয়। এগুলো বলাবাহুল্য গ্রামশির উদ্ধৃতি নয়, কিন্তু মূল গল্পটা এরকমই।

    র‌্যাডিকাল ফেমিনিস্টদেরও মূল সমস্যাটা একই। তাঁরা নারীবাদীদের সংগঠন বানিয়েছেন। কিন্তু মেয়েরা তার পরেও শরীর দেখাতে চায়, 'অবজেক্টিফায়েড' হতে চায়। কেন? না নিশ্চয়ই সেটা পিতৃতান্ত্রিক মগজ ধোলাই বা সেলফ কনসাসনেস। কোনো নির্দিষ্ট ফেমিনিস্টকে কোট করছিনা, কিন্তু মূল গল্পটা এরকমই।

    তা, এই সমস্যাটা থিয়োরি অফ পাওয়ারের পুরোনো সমস্যা। সেখানে ষাটের দশক এবং তৎপরবর্তী সময় একটি র‌্যাডিকাল আইডিয়া নিয়ে হাজির হলেন মিশেল ফুকো। তিনি কস্মিনকালেও মার্কসবাদ বা নারীবাদ বিষয়ের লেখক নন, কিন্তু দুটিতেই তাঁর চিন্তার প্রভাব বেশি মাত্রায় প্ড়েছে, সমালোচনার দিক থেকে হলেও।

    তা, ফুকো কী বললেন? সংক্ষেপে বললে এইরকম, যে, অন্তত বিংশ শতকে, ক্ষমতা শোষণ করে টিকে নেই, টিকে আছে এম্পাওয়ার করে। ক্ষমতা নিশ্চয়ই ডিসিপ্লিন করে, কিন্তু সেটা ফলস কনসাসনেস তৈরি করে নয়, বলা যায় কনসাসনেস তৈরি করে। ডিসিপ্লিন আর ঠেঙিয়ে হয়না, হয় স্টিমুলেট করে। যৌনতার ক্ষেত্রে খুব নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায়, ক্ষমতা যৌনতার ক্ষেত্রে আর নিষেধাজ্ঞার বিধি তৈরি করেনা, স্টিমুলেট করে কাজ করিয়ে নেয়। যেমন, পুরুষকে ক্ষমতা বলে মাসল বানাও, তাহলেই মেয়েরা তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। এটা শুধুই স্টিমুলেশন, বেত উঁচিয়ে বাধ্য করা নয়। কিন্তু এর ফল অনেক বেশি এফেক্টিভ। ছেলেরা দলে-দলে জিমে দৌড়য়। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে। ডিসিপ্লিনড হয়। এবং ডিসিপ্লিনড হয়েই তারা সেক্সুয়াল পাওয়ার অনুভব করে। এইভাবেই তৈরি হয় তাদের ক্ষমতাসীন আইডেন্টিটি, যে ক্ষমতা অলীক কিছু নয়।

    মেয়েদের ক্ষেত্রে এই একই ডিসকোর্সকে নিয়ে এলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই, যে, মেয়েদের সেক্সুয়ালিটিকে প্রকট করে তোলা হয়, সেনসুয়াল করে তোলা হয়, স্টিমুলেট করে। তাতে মেয়েটি স্টিমুলেটেড হয়, কারণ সে ক্ষমতার বোধ পায়। তার শরীর এবং সেক্সুয়ালিটি তাকে ক্ষমতার বোধ দেয়, যে ক্ষমতা অলীক কিছু নয়।

    লক্ষ্য করে দেখবেন এটা সেক্স পজিটিভ ফেমিনিস্টদের বক্তব্যের সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায়। যৌনতা তাঁদের ক্ষমতা দেয়, অপ্রেশন নয়।

    ফুকো স্পষ্ট করে নারীবাদ নিয়ে লেখেননি। পুরুষদের নিয়ে যেটা লিখলাম, সেটা বলেছ্ন। কিন্তু জিনিসটা এক্সট্রাপোলেট করলে এরকমই দাঁড়ায়। ফলত বিভিন্ন ঘরানার নারীবাদী আলোচনায় ফুকো আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছেন। সমালোচনার একটি ভিত্তি যথার্থই মনে হয়, যে, সরাসরি দমনকে ফুকো তাঁর হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার তন্তুর সূক্ষ্মতর বিচারে ফুকোর পর্যবেক্ষণ, সাধারণভাবে গুরুত্বপূর্ণই মনে করা হয়।
  • Ishan | ***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৩৪382590
  • তৃতীয় তরঙ্গ
    ---------------

    যদি তরঙ্গের সীমারেখাগুলি মেনেই নিই, তাহলে এই বিতর্ক অমীমাংসিত রেখেই দ্বিতীয় তরঙ্গ শেষ হয়ে যায়। সর্বজনস্বীকৃত মীমাংসা কেউ আশা করেছিলেন এমনও না। তৃতীয় তরঙ্গ শুরু হয় সমস্যাটিকে এড়িয়ে বা অতিক্রম করেই। দ্বিতীয় তরঙ্গে একটি আঁটোসাটো তাত্ত্বিক কাঠামোর সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছিল, পরিবর্তে এসে গিয়েছিল নানা পরস্পরবিরোধী মতামতের একটি ছাতা। তাই তৃতীয় তরঙ্গ প্রথম থেকেই একটি বিকেন্দ্রিত ঘরানা। "ফেমিনিজম অনুযায়ী এইটি ঠিক, বা ওইটিই মুক্তির দিশা" এই জাতীয় প্রকল্প তৃতীয় তরঙ্গে থাকা অসম্ভব।

    ফলত এই বিতর্ককে অতিকম করে বা এড়িয়েই তৃতীয় তরঙ্গ শুরু হতে পারত। এবং ঐতিহাসিকভাবে তৃতীয় তরঙ্গ শুরুও হয় যৌন হিংসার বিরুদ্ধে, যার সঙ্গে আগের তীব্র বিতর্কের কোনো সম্পর্ক নেই। যৌন হিংসার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় কোনো পক্ষেরই কোনো মতানৈক্য নেই। দ্বিতীয় তরঙ্গের মতো এটিও প্রাথমিক ভাবে আমেরিকান ঘটনা, যার শুরুর দিকের ল্যান্ডমার্ক হল অনিতা হিল কেস। তার ডিটেলে যাবার দরকার নেই, এটি ছিল নব্বইয়ের আলোড়ন তোলা এক যৌন হেনস্থার ঘটনা।

    তত্ত্বের ক্ষেত্রেও বিতর্ককে এড়িয়ে নানা ভাবে বিষয়গুলি দেখা শুরু হয়। যেমন, জুডিথ বাটলার, এই সময়ের একজন বড় তাত্ত্বিক, তিনি, যতদূর সম্ভব প্রথম, জেন্ডার এবং সেক্সকে আলাদা করেন (তিনিই প্রথম কিনা আমি ১০০% নিশ্চিত নই)। এটি খুবই মূল্যবান ইনসাইট, কিন্তু লক্ষ্যণীয়, যে আগের তরঙ্গের বিতর্ক সম্পর্কে আলাদা কোনো আলোকপাত করেনা।

    এই দুটোই দুটো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ। দেওয়া হল দুটো জিনিস বোঝানোর জন্য।
    ১। তৃতীয় তরঙ্গ দ্বিতীয় তরঙ্গের বিতর্কগুলির মীমাংসা করেনা। এড়িয়ে যায় বা অন্য অঞ্চলে চলে যায়।
    ২। তৃতীয় তরঙ্গ একটি সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রিত ব্যাপার। এর আর কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিলনা বা থাকা সম্ভব ছিলনা। নির্দিষ্ট কোনো তাত্ত্বিক কাঠামোও নেই, বলাবাহুল্য।

    এই বিকেন্দ্রিত ঘরানার চিন্তা বা আন্দোলনের সুবিধে বা সুবিধে দুইই আছে, যেমন অন্যান্য নেতৃত্ব ও আইডিওলজিহীন যেকোনো আন্দোলনে দেখা যায়। সুবিধেটা এই, যে, অন্য কোনো চিন্তাকে ডিফেন্ড করার অসুবিধে নিতে হয়না। "আপনি যে বলছেন হোর্ডিং এ অমুকের ছবি দেখানো অবজেক্টিফিকেশন, কিন্তু নারীবাদীরাই বলেছেন ওটাই লিবারেশন?" এই রকম কোনো প্রশ্ন এলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, "ওটা উনি বলেছেন, এটা আমি বলছি। আমি কি ওঁর শিষ্য নাকি?" এটা অমীমাংসিত সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার অতিক্রম করে যাবার একটা পদ্ধতি। কোনো মতাদর্শগত পিতা-মাতা কে স্বীকার না করে এগোনো।

    এর অসুবিধেও ওই একই। আপনি যখন দেখছেন সম্পূর্ণ আরবিট কিছু কথা অন্য কেউ বলে তাকে "নারীবাদ" লেবেল দিচ্ছে, সেও সেটাকে "আমার ব্র‌্যান্ডের নারীবাদ" বলে প্রোমোট করতেই পারে। সেটা ভুলও না, সমস্যারও কিছু নেই। কিন্তু এর পরের ফেজেই দেখা যেতে পারে যেকোনো একটা চিন্তাকে "এটাই নারীবাদ" বলার প্রবণতা। এবং যেকোনো সময় বহুমাত্রিকতা গোল্লায় গিয়ে মবই ঠিক করে দিতে পারে কোনটা "নারীবাদ"। এবং সেটা বহুক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনের পক্ষে যাওয়াও সম্ভব।

    এই সুবিধে এবং অসুবিধে সহ, নব্বই দশক থেকে এখন পর্যন্ত আমরা এই ধারার মধ্যেই বসবাস করছি। ব্যাপারটা এতই বিকেন্দ্রিত , যে, এর মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো ঘরানা খুঁজে বার করাই অসম্ভব। বর্ণনা করতে গেলেও তা হবে অসম্পূর্ণ, টুকরো-টাকরা। এর মধ্যে সম্পূর্ণতা খুঁজে বার করা সম্ভব নয়। আমি চেষ্টাও করবনা। "ইহাই নারীবাদ" যে একটি অসম্ভব প্রকল্প সেটুকু দেখানোর জন্য এই টুকু লেখা। সেটা শেষই হয়ে গেছে।

    পুঃ আরেকটি টুকরো লিখতেও পারি। বিকেন্দ্রিত কয়েকটি টুকরো দিয়ে। সঙ্গে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, যে, এটা তৃতীয় তরঙ্গের সম্পূর্ণ বিবরণ একেবারেই নয়। কিন্তু আপাতত আজকের মতো এই।
  • dd | ***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:৫০382578
  • বেশ বেশ। আলোকিতো হলেম।
  • সুকি | ***:*** | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ১২:২৯382579
  • পড়ছি - কিন্তু এই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আগে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে আর ভয়ে আলোচনাতেই ঢুকি না! খুবই জটিল এবং গোলমেলে বিষয় আমার কাছে।
  • Ishan | ***:*** | ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২৮382580
  • ভয়ের আবার কী হল?
  • | ***:*** | ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৭:১১382581
  • ভয় এর প্রশ্ন নেই , যা খুশি ল‍্যখো।
  • সুকি | ***:*** | ০১ মে ২০১৯ ১২:১০382582
  • অতো সিরিয়াস ভেবে ভয়ের কথা বলি নি :) আসলে আমার নিজের এই নিয়ে তেমন সিষ্টেমেটিক পড়াশুনা নেই, ওই খাপছাড়া ভাবে যেমন পড়া হয়, সেই থেকে একটা নিজের মত ধরণা গড়ে তোলা আর কি। তো হয় কি সেই নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে গেলে বেশ ফ্লেক্সিবিলিটি রাখতে হয়, অপরের কাছ থেকে শেখার আছে এই ভেবে। কিন্তু অনেক পাবলিক নিজেদের মতামতে এত গোঁড়া থেকে যান যে সেই নিয়েই বাওয়াল - ব্যাপারটা অনেক সময় 'মাই ওয়ে ওর হাইওয়ে' টাইপের হয়ে যায়!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন