এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অর্জুন অভিষেক | ***:*** | ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:৩৬380814
  • গত বছর লিখেছিলাম লেখাটি ফেসবুকে। লেখাটি সম্পাদনা না করে আজ আবার শেয়ার করলাম।

    দেশের সামাজিক অবস্থা যখন তমসাচ্ছন্ন, সেই সময় এক দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত নারী, নারী শিক্ষা, শিশু শিক্ষা ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে একটি জোড়াল প্রদীপ হাতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁর নাম সাবিত্রীবাঈ ফুলে। আজ তাঁর ১৮৮ তম জন্মবার্ষিকী ।

    কাল (৩রা জানুয়ারী ২০১৮) মহারাষ্ট্রে দলিত সম্প্রদায়রা হরতাল ডেকেছে, দুদিন আগেই তাদের একটি পদযাত্রার ওপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। তাতে একজন মারা গেছে ও অনেকে আক্রান্ত। পদযাত্রাটিও ছিল ১৮১৮ পেশয়া বালাজী বাজী রাওর বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র বিজয় উৎসবের দুশো বছরের উদযাপন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওই সেনা দলে অধিকাংশই ছিল দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। দেশীয় শ্রেণী শত্রুদের ঔপনিবেশিক শাসককুলের সাহায্যে পরাজিত করতে পারা উৎসব ছিল কি এটা ? ঘটনাটা খুব সহজ নয়। এই ঘটনায় মনে করিয়ে দেয়, আমাদের দেশে দলিত সম্প্রদায় ও শাসক দলের চিরাচরিত সমস্যাটা কত জলন্ত। আমার লেখাটা এই সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। বরং অনেকটা পিছনে ফিরে ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে একটু ফিরে দেখা। ঘটনাচক্রে ৩রা জানুয়ারী ছিল এমন এক মানুষের জন্মবার্ষিকী, যার জীবন দলিত সংগ্রামের সূচনাটা দেখতে সাহায্য করে।

    তিনি হলেন সাবিত্রীবাঈ ফুলে (৩রা জানুয়ারী ১৮৩১- ১০ মার্চ ১৮৯৭) দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত এক অসামান্যা নারী। জন্মেছিলেন মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার নওগাঁও এ। দেশের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা। সাবিত্রীবাঈ যে সময়ে সমাজসেবার কাজে শুরু করেন অর্থাৎ ১৮৪০ এর শেষ ও ’৫০ এর শুরুতে, ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহেরও পূর্বে, সেই সময়ে স্ত্রী শিক্ষা ও স্ত্রী স্বাধীনতায় যারা অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন তারা সকলেই ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত শহরাঞ্চলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্গীয় পুরুষ। সাবিত্রী বাঈয়ের মত একদম নিম্নবর্গীয় সমাজের, যে সমাজে পুরুষরাই শিক্ষা পাননা, সেই শ্রেনী থেকে এক নারীর সমাজকল্যাণের কাজে এগিয়ে আসাটা একটি অভাবনীয় ঘটনা ছাড়া আর কি বলা যায়! এইরকম উদাহরণ আর আছে বলে আমার জানা নেই! অথচ তিনি ইতিহাস ও জনস্মৃতি থেকে কি ব্রাত্য।

    তাঁর সময়ের পরে দেশের অন্যান্য যে মহিলারা পাদপ্রদীপের আলোকে এসেছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন উচ্চবর্গীয় সমাজভুক্ত, কমবেশী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই হয়ত ইতিহাসও সাবিত্রীবাঈকে মনে রাখেনি। আমাদের দেশ কোনোদিনও মনে রাখেনা দলিতদের। তিনি তাই হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের পাদপ্রদীপের তলায়।

    মহারাষ্ট্রে জ্যোতিরাও ফুলে আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে জাতিবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, ধর্মীয় অনুশাসন, লিঙ্গ ভিত্তিক অসাম্য, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর সংগ্রাম ও সংস্কার যজ্ঞ শুরু করেন। পরবর্তীকালে বি। আর। আম্বেদকার যে জাতীয় দলিত আন্দোলন শুরু করেছিলেন, জ্যোতিরাও ফুলে তার প্রায় ৭৫ বছর আগেই তার সূচনা করেন। জাতিতে মালি জ্যোতিরাও ফুলে ছিলেন আম্বেদকারের আদর্শ স্বরুপ। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে দেশবাসী ‘মহাত্মা’ আখ্যা দেবার আগেই জ্যোতিরাও কে ‘মহাত্মা’ বলে সম্বোধন করেছিল । এই ব্যাপক সমাজ সংস্কার কর্মযজ্ঞে তিনি পাশে পেয়েছিলেন সহধর্মিণী সাবিত্রীবাঈকে। জ্যোতিরাও যে সময়ে সমাজ সংস্কারের কাজ শুরু করলেন, সেই সময়ে বাংলায় বিদ্যাসাগর কাজ করছেন, রামমোহন রায় তার কিছু বছর আগেই অনেক কাজের সূচনা করেছেন। এর আগে পরে পশ্চিম ভারতে মহারাণা গোবিন্দ রানাডে, আত্মারাম পাণ্ডুরাম বা দণ্ড কেশব কার্ভেও যে ব্যাপক সংস্কার কর্ম শুরু করেন তারা প্রায় সকলেই ছিলেন জাতিতে উচ্চবর্গীয়, শহরাঞ্চলের এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। সঙ্গে পেয়েছিলেন দেশীয় ও ঔপনিবেশিক শাসক সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট কৃতি ব্যক্তিদের।

    জ্যতিরাও ও সাবিত্রীবাঈ ফুলের সংগ্রাম ছিল একক ও স্বাতন্ত্র্য।

    ১৮৪৮ এ ফুলে দম্পতি পুনায় একটি বালিকা বিদ্যালয় খোলেন। ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়, যে বড় শহরে সেই যুগে মেয়েরা ছিলেন অসূর্যস্পর্শা, ১৭ বছরের সাবিত্রীবাঈ পড়াশোনা শিখে আহমেদনগরের একটি মিশনারি সেন্টারে টিচার্স ট্রেনিং নিয়ে নিজেকে তৈরি করে পুনার মত একটি ব্রাহ্মণ অধ্যুষিত ছোট শহরে মেয়েদের শিক্ষা দেবার ব্রত শুরু করেন । কি ভাবে জোগাড় করেছিলেন ছাত্রীদের? কতগুলো দরজা তার মুখের সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মাথায় পরেছিল পাথর !! পুনায় থাকতে শুনেছি সমাজ এতই রুষ্ট ছিল এই কাজে যে তাদের বাড়ির সামনে সব নোংরা ও মলমূত্র ত্যাগ করে যেত। ছাত্রী জোগাড় করতে বেরোবার সময় তার ব্যাগে একটি বাড়তি শাড়ি নিতে হত, কারণ গ্রামের পথে যেতে তার গায়ে পড়ত গোবর ও নোংরা। পরে নিরাপত্তার জন্যে একটি সেপাই রাখতেন।

    ভাবতে বেশ শিহরণ লাগে যে এক দলিত দম্পতির প্রতিষ্ঠিত এই অভিনব অনামা বালিকা বিদ্যালয়টি দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। কলকাতায় বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা পায় তার পরের বছর ১৮৪৯ এ। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ও বেথুন প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিলেন দেশী, বিদেশী সব বিখ্যাত শিক্ষাবিদেরা।

    শুধু স্ত্রী শিক্ষাই নয়, তার সময়ের থেকে বহু যোজন এগিয়ে যাওয়া সাবিত্রীবাঈ আরও অনেক সমাজ সংস্কার মূলক কাজকর্মের সূচনা করেন। ধর্ষিতা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েরা যারা সমাজে জন্তুজানোয়ারের চেয়েও অচ্ছুৎ তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। ভাবা যায়? তাঁর সমাজ সংস্কারের মধ্যে ছিল অসবর্ণ বিবাহ প্রচলন, ব্রাহ্মণ পুরোহিতহীন ও কোনোরকম পণহীন বিবাহ প্রথা। আজকের দিনের হিসেবেও বেশ চমকে দেবার মত, না? ২০১৭ তেও নিজের ধর্ম ও জাতের বাইরে বিবাহ করলে বাবা-মা সন্তানদের সগর্বে হত্যা করে। তার ওপর ‘লভ জেহাদ’ তো এখন হট টপিক। নিজেদের সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন ফুলে দম্পতি? সমাজের তর্জনী উপেক্ষা করে স্বামী জ্যোতিরাও এর মৃত্যুর পরে তাঁর মুখাগ্নি করেছিলেন সাবিত্রীবাঈ।

    ঘটনাগুলো শুনতে যত রোমাঞ্চ লাগে আমাদের, আসলে তাদের সময়ে কাজটা ছিল সীমাহীন কষ্টের। একটা একটা করে পথের কাঁটা তুলে এগোতে হয়েছিল তাঁদের । মিলেছিল শুধু ধিক্কার আর নানারকম নিপীড়ন।

    এই কর্মময়ীর জীবনদীপও নিভেছিল পরের সেবা করতে করতেই। ১৮৯৭ এ পুনায় প্লেগ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে। সাবিত্রীবাঈয়ের পালিত পুত্র প্লেগ রুগিদের সেবায় একটি হাসপাতাল খোলেন, সাবিত্রীবাঈ এগিয়ে আসেন সেবার কাজ করতে এবং এই সেবার কাজে করতে করতেই প্লেগ রোগই তাঁর মহান জীবন ছিনিয়ে নেয়।

    আজ ও যখন আমরা বিভিন্ন সংখ্যালগু নিপীড়ন ও অসাম্য লড়াইয়ে সামিল হই তখন আমাদের মনে রাখা উচিত সাবিত্রীবাঈ ফুলে, জ্যোতিরাও ফুলের মত ব্যক্তিত্বরা ছিলেন এই সব সংগ্রামের পথ প্রদর্শক।

    তাঁরা আমাদের দিয়ে গেছেন তাঁদের সব, পরিবর্তে আমরা তাঁদের শুধু দিতে পারি কুর্নিশ আর তাঁদের স্মরণ ।

    তিনি আজও খুব প্রাসঙ্গিক।
  • | ***:*** | ০৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৩380815
  • সবসময় প্রাসঙ্গিক, প্রাতস্মরণীয় ব‍্যক্তিত্ত্ব।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন