এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • জেলের গরাদ, গাছের পাতা ইত্যাদি

    সৈকত
    বইপত্তর | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ৮৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সৈকত | ***:*** | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২৩:৫২377501
  • গত পঁয়্তাল্লিশ বছরে প্রায় গোটা পঁচিশ মামলা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পুলিশ হত্যার প্ররোচনা, অস্ত্র সরবরাহ, কোন মামলাতেই শাস্তি দিতে পারেনি প্রশাসন, হয় মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে, নয় মামলা দাঁড়ায়নি। এবার পুলিশ একটু বেশীই উদার, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথাও যোগ করা হয়েছে, কারণ তারা সব জানে।
  • সৈকত | ***:*** | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:১১377509
  • তো, বলছি ভারভারা রাওয়ের কথা। কবি ও বিপ্লবী। সত্তর দশকের সময়ে থেকে জীবনের অনেকটা সময়ই কেটেছে জেলখানায়। এবারেও হয়ত তাই হবে, বাড়ী থেকে জেলখানা হয়ে আবার বাড়ীতেই ফিরে আসবেন।

    অবশ্য পুরো ঠিক লিখিনি, ভারভারা রাওয়ের জীবনের কথা লিখছি না। লিখছি, ওনার লেখা একটা বই নিয়ে। বইটার নাম -বন্দী কল্পনা, ইংরেজীতে ক্যাপ্টিভ ইম্যাজিনেশন। ১৯৮৮ সালে, ভারভারা রাও যখন জেলে, ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের তৎকালীন সম্পাদক, অরুণ শৌরী, ভারভারা রাওকে, ঐ কাগজের জন্য একটি কলাম লিখতে বলেন, জেলখানার দিন ও রাত নিয়ে। জেল থেকে লেখা চিঠিই বলা যায়, ঐ লেখাগুলিকে। বইটা ঐ লেখাগুলোর সংকলন, ১৯৮৯ সালে তেলুগুতে প্রকাশ হয়, ২০০৮ সালে হিন্দী অনুবাদ, ২০১০-এ ইংরেজীতে। আমি বইটার কথা পড়ি ২০১১ নাগাদ, রবিশংকর বলের এক লেখায়, এবং তার পরে পরেই, ঐ বছরেই, বেরিয়ে ফেরার সময়ে দিল্লী এয়ারপোটে বইটি কিনি। বিশেষ আর কোথাও পরে চোখে পড়েনি। শুধু বন্দী কল্পনাই নয়, বন্দীর কল্পনাও বলা যায়, অবশ্যই।

    কিন্তু ব্যাপার হল, বইটা এই এতদিন বাদে পড়তে শুরু করলাম। আগে হয়ত উল্টেপাল্টে দেখেছি কয়েক পাতা; সময় এমনই এক পদার্থ, কোন কারণে কী বই কখন হাতে উঠে আসে !!
  • সিকি | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২০:১২377510
  • পড়ছি। লেখো।
  • সৈকত | ***:*** | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ২৩:৪৭377511
  • অপেক্ষা কোরো আমার জন্য, আমি ফিরে আসব,
    অপেক্ষা কোরো, আমি আসব।
    অপেক্ষা কোরো শরতের হলুদ বৃষ্টির মধ্যে
    একঘেয়ে যা
    মনকে শক্ত রেখো আর দুঃখ কোরো না,
    অপেক্ষা কোরো শীতের ধোঁয়াশার মধ্যে,
    অপেক্ষা কোরো হাওয়া আর তুমুল ঝড়ের মধ্যে ,
    অপেক্ষা কোরো গরমের হল্কার মধ্যে।
    অপেক্ষা কোরো, যখন অন্যরা আর অপেক্ষা করে না,
    যখন আমার চিঠিগুলো থেমে যাবে,
    অপেক্ষা কোর সেইরকম আশা নিয়ে যা কখন স্তিমিত হয়্না,
    অপেক্ষা কোরো আর হাল ছেড়ে দিয়ো না।

    অপেক্ষা কোরো আমার জন্য, আমি ফিরে আসব,
    ধৈর্য্য ধর, প্রিয় আমার, শেখো।
    তাদের পাত্তা দিও না যারা বলে
    যে আমি আর ফিরবো না।
    আমার ছেলে আর মা দুঃখের কান্না কাঁদুক,
    বন্ধুরা বলেই যাক যে সময় হয়েছে
    যে তুমি সব ভুলে যাও।
    তাদের কথা শুনোনা
    সমবেদনার কথাগুলো,
    তাদের সাথে যোগ দিও না যদি তারা আমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে পান করে।
    অপেক্ষা কোরো আমার জন্য ! যারা করেনা তাদের ছেড়ে দাও -
    যখন আমি তোমার কাছে ফিরে আসব-
    তাদের বলতে দিও যে এটা নিতান্তই সৌভাগ্য
    যে আমরা দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি।
    তুমি আর আমিই শুধু জানব
    যে আমি নিরাপদেই এসেছি
    যাবতীয় মৃত্যুকে উপেক্ষা করে,
    সেই হন্তারক শিখার মধ্যে দিয়ে,
    শুধু এই জন্যই যে তুমি শিখেছিলে অপেক্ষা করতে
    জেদী আর গোঁয়ার ভাবে।
    এবং পৃথিবীর আর কারোর মতই না,
    অপেক্ষায় ছিলে, প্রিয়, আমার জন্য।
  • সৈকত | ***:*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২৯377512
  • ওপরের কবিতাটা, রাশিয়ার এক কবি কনস্ট্যান্টিন সিমোনভ-এর, ১৯৬৫ তে ভারভারা রাও তেলুগুতে অনুবাদ করেন, এই বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদটি শেশ হয়েছে এই কবিতাটি দিয়ে। মূলতঃ তেরটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই বইয়ের, প্রতিটি পরিচ্ছেদই কবিতা আর গদ্যের মিশ্রণ। কখনও নিজের কবিতা ব্যবহার করেছেন , কখনও বা অন্যের। যেমন, প্রথম পরিচ্ছেদটি, যার শিরোনাম 'সেই অন্তহীন অপেক্ষা', শুরু হচ্ছে, এই তিনটি বাক্য দিয়ে

    শ্রমহীন এক দিন
    ভালবাসাহীন এক রাত
    ইতিহাসের পাড়ে অপেক্ষা করা ...

    তার পর বাহাদুর শাহ জাফর যেমন বলেছিলেন - চার দিনের এই ভিক্ষা পাওয়া জীবন, দুদিন নষ্ট হয় আশা করে, বাকি দিনগুলো যায় অপেক্ষা করে। জেলজীবন এই অপেক্ষা করে যাওয়া, কারণ তুমি সমাজ জীবনের আর অংশ নও, ইতিহাসেরও নও। তুমি একজন দর্শক মাত্র, বর্তমানের এক সাক্ষী শুধু, সময় ক্রমাগত সেটা তোমাকে মনে করিয়ে দেয়। ১৯৮৮ সালের সেই দিনগুলিতে, অন্যদিনের থেকে ভোরবেলা আগে উঠে, টিভির সামনে সিওল অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুস্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে (টিভির সাথে লেখকের পরিচয় সেই জেলেই), টিভির স্ক্রীনে ভেসে ওঠা সেকেন্ডের সংখ্যাগুলো দেখতে দেখতে যার পরে শুরু হবে অনুস্ঠান, লেখকের মনে হয়, বাইরের জীবনে কেউই, কখনই এইভাবে সময়ের হিসেব রাখে না, পাঁচ মিনিটেরও না। অথচ জেলের মধ্যে এটাই অভ্যেস, সব সময়েই অপেক্ষা করা, হয়ত খুব তুচ্ছ কিছুর জন্য। আর রাতগুলো কেটে যায় ভালবাসাহীন, নিকষ অন্ধকারের মধ্যে, যতই কেননা সহানুভূতি থাকুক বা দুঃখ আর আনন্দ ভাগ করে নেওয়া হোক।
  • সৈকত | ***:*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:২৪377513
  • জেলের ঐ দিনগুলিতে, ভারভারা রাও সাধারণ ভাবে নির্জন একাকী কারাবাসের মধ্যেই থাকতেন, যদিও, নিজেই বলেছেন শারীরিক ভাবে কোনোরকম অসুবিধে তাঁর ছিল না। লেখালেখির জন্য টেবিল-চেয়ারও পেয়েছিলেন, বিশেষ বন্দীর সুবিধাজাত যা। অন্য বন্দীদের সাথে মেলামেশাও কিছু ছিল, অলিম্পিকের অনুষ্ঠানের ভোরে, টিভি দেখার জন্যই অন্য দুই কমরেডের সাথে একই সেলে রখা হয়েছিল। কিন্তু কিছু সুবিধে পেলেও, মানসিক, সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক্ভাবে সবকিছু থেকে বিযুক্তিই ছিল তাঁর প্রধান সমস্যা; ফলতঃ দিন কেটে যেত চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, পাখী, গাছ, লতাপাতা আর আকাশ এই ছিল সঙ্গী। বইপত্র পেতেন, বিকেলের দিকে খবরের কাগজ, দুপুরের দিকে বিবিধ ভারতীতে মহম্মদ রফির গলায় গুরু দত্তের সিনেমার গানও ভেসে আসত, আর রাতে দূর আকাশ থেকে কি যেন এক নামের তারা যেন তাকে লক্ষ্য করত, নির্জন সেলে একাকী হেঁটে বেড়ানো। ভিজিটিং আওয়ারে যে আসত, তার সাথে গোলোকধাঁধাপ্রতিম এক সময় কাটাতেন, খেয়ালও থাকত না কখন সময় শেষ হয়ে গেছে, হঠাৎ এক গন্ধে তাদের ঘোর কাটত। আর মনে পড়ত, একই ভাবে কাটানো কত না বন্দীর কথা। নগুগি ভন থিওঙ্গোর 'জেলখানার ডায়েরীর' কথা, নেলসন ম্যাণ্ডেলা কিভাবে ছাব্বিশ বছর মুক্তির আশায় অপেক্ষা করতেন, স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের পর ধৃত শিখদের কথা যারা যোধ্পুর জেলে বন্দী, দূর বাংলায় বন্দী আজিজুলের কথা। অথবা ১৯৭৪ সালে দেখা হওয়া ভুমাইয়া আর কিষ্টা গৌড়ের কথা, কৃষক আন্দোলনের কর্মী যারা, ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত। শেষ দুবছর ধরে তারা অপেক্ষা করছিল কিসের জন্য, মৃত্যুর ? যা ঘটবে ১৯৭৫ এর ১লা ডিসেম্বর, ফাঁসিতে।

    কিন্তু কল্পনাশক্তিময় এক রাজনৈতিক বন্দী, তার কাছে এই অপেক্ষা করাটাই বিশেষ কিছু, যেন চিরকাল জ্বলে থাকা এক শিখার মত, কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে হাওয়াতে, কিন্তু সেটা দূর থেকে ভেসে আসা মুক্তির বাতাসই, অপেক্ষাকাতর দিনগুলিতে এইরম ভাবনার মধ্যেই এক বন্ধু ভারভারা রাওকে তাঁরই করা সিমোনোভের কবিতাটি পাঠায়।

    এক ঝটকায় প্রথম পরিচ্ছেদটি শেষ হয় সুবাতাস দিয়ে।
  • | ***:*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:২৭377514
  • পড়ছি
  • সৈকত | ***:*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:০১377515
  • নিরক্ষর এক বন্দীর কথা লিখেছিলেন ভারভারা রাও। লোকটি, তার পাশে রাখা এক গাদা খবরের কাগজ থেকে একটি একটি করে তুলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। প্রশ্ন করলে বলত, সে এমনিই ছবিগুলো দেখছে। লেখকের মনে হত, লোকটি নিশ্চয় কাগজগুলোকে ছুঁয়ে, ছবি দেখে, কাগজের পুরুত্ব বুঝে, কালির গন্ধ পেয়ে, কিছু না কিছু খবর সংগ্রহ করছে। হয়ত কল্পনার মাধ্যমে সে কিছু খবর বের করে নিতে পারছে যা কাগজগুলোতে নেই, কিন্তু আসলে সত্যি এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়েই আছে। কল্পনার এই ব্যবহার যেন লোকটিকে মুক্তি দিচ্ছে তার বন্দীত্ব থেকে, অক্ষরগুলোই ঢেকে দিচ্ছে পৃথিবীটাকে।

    বাইরের পৃথিবী থেকে বিযুক্ত হয়ে লেখকও অনবরত চেষ্টা করতেন সেখানে কী ঘটছে সেগুলো বুঝে নেওয়ার। সকালে কাগজ পড়ার অভ্যাস থেকে চ্যুত হয়ে, সারাদিন ধরে অপেক্ষা কখন আর সকলের হাত ঘুরে খবরের কাগজ এসে পৌছবে। কিন্তু পড়ার পর বুঝতেন, যে খবর তিনি জানতে চান, আদিবাসীদের কথা, মেয়েদের কথা, পরিবেশ আন্দোলনের কথা, অধিকার বুঝে নেওয়ার আন্দোলনের কথা, সেসব কিছুই কাগজে নেই। ফলে, একটা নয়, অনেকগুলো কাগজই পড়তে হত, সবই যা পাওয়া যেত জেলখানায়। বিশেষ করে স্থানীয় কাগজগুলো। বিজয়ওয়াড়া, তিরুপতি, হায়্দ্রাবাদ অথবা রাজ্যের অন্য জায়গা থেকে যেসব বন্দীরা কোর্টে আসত, তারাও ক্রমাগত আলোচনা করত ঐসব জায়্গার বিভিন্ন কাগজে কী খবর প্রকাশ হয়েছে সেই নিয়ে। যেন অজানা, অচেনা স্থান থেকে পিঁপড়ের খাদ্য সংগ্রহের মত, সবকিছু জড়ো করে, যতখানি পারা যায় ধারণাগুলো স্থির রাখার জন্য। ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কাগজ আর রেডিওর বুলেটিন, বাদ দেওয়া , বদলে দেওয়া,ঘটনার আংশিক প্রকাশ, এসব কিছুই আসলে এক ভাওলেন্স বলে মনে হত ! খবরের কাগজ যদিও বা পাওয়া যেত, সেসবই বাইরের জগতের দিকে খোলা এক জানলা কিন্তু যা একমাত্রিক।

    ফলতঃ বইয়ের দিকে যেতে হত। বর্তমান নিয়ে নিজের মতামত অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে না পারা, যে বর্তমান ক্রমাগত তাঁকে রাগিয়ে তুলছে, বর্তমানের ঘটনায় নিজে অংশ নিতে না পারা অথবা বাইরের পৃথিবীতে সেইসব নিয়ে তার মন্তব্য ও অভিজ্ঞ্তা পৌছে দিতে না পেরে, অশ্রুবিন্দুগুলোকে সরিয়ে রেখে, নীরবে বইয়ের পৃথিবীতে আশ্রয় নিতেন।
  • | ***:*** | ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ১১:২৪377516
  • কি গো ল‍্যাখো।
  • সৈকত | ***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৫৭377502
  • প্রাসঙ্গিক বলে নগুগি ওঅ থিওঙ্গোর কথা লিখি। কেনিয়ার এই লেখকের কথা, ভারভারা রাওয়ের লেখাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকবার এসেছে এবং বইটার সাড়ে তিন পাতার ভূমিকাও ওয় থিওঙ্গোরই লেখা। যোগাযোগটা, এই দুই লেখকের মধ্যে, মূলতঃ দুজনেরই প্রতিবাদী চরিত্র এবং ফলতঃ দুজনেরই জেলযাপনের জন্যই হয়ত। চিনুয়া আচিবির প্রায় সমসাময়িক নগুগি এবং এই দুজনেই হয়ত বা গত পঞ্চাশ বছরে আফ্রিকার প্রধাণ দুই লেখক, পোস্টকোলোনিয়াল সাহিত্যের দুই ঋত্বিক। উচ্চশিক্ষা বিলেতে, প্রথম দিকের লেখালেখি ইংরজীতেই, ষাটের দশকে ফ্যাননপন্থী মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠা। উপনিবেশবাদের প্রখর সমালোচক, অতএব জন্মদত্ত নাম জেমস নগুগি ত্যাগ করে, নগুগি ওয় থিওঙ্গো নাম নেওয়া এবং উপন্যাস ও নাটকের ভাষাতেও ইংরেজী থেকে সরে এসে গিকুয়ু ও সোয়াহিলিতে লেখালেখি শুরু করা। একই সাথে স্বাধীনতা পরবর্তী কেনিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজের ক্রিটিক এবং এসব মিলিয়ে যারপরনাই ভাবে সরকার বিরোধী। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক মত সমন্বিত একটি নাট্ক লেখার পরে ('আমার যখন ইচ্ছে হবে তখ্ন আমি বিয়ে করব'), গিকুয়ু ভাষাতেই, গ্রেপ্তার হন এবং জেলে যেতে হয়। রাত জেগে লেখালেখি চালিয়ে যান, বিখ্যাত উপন্যাস, ডেভিল অন দ্য ক্রস, জেলে থাকাকালীনই লেখা, আর কিছু না পেয়ে টয়লেট পেপারেই ! যথারীতি জেল কর্তৃপক্ষ সেই লেখা হস্তগত করেন, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছু দিন বাদে লেখাগুলো আবার ফিরিয়েও দেওয়া হয়, এমার্জেন্সী তুলে নেওয়ার পরে জেল কর্তৃপক্ষ বদল হওয়ার কারণেই হয়ত। ১৯৭৮ এ জেল থেকে বেরোনোর পরে, আবার সরকার বিরোধী লেখালেখি এবং সেই বার দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া। আশির দশকের মাঝামাঝি পোস্টকলোনিয়াল চিন্তাভাবনার প্রায় আকরগ্রন্থ, তত্ত্ব এবং প্র্যাক্সিসের দিক থেকেও, ডিকোলোনাইজিং দ্য মাইন্ডের প্রকাশ। প্রায় বছর কুড়ি বাদে, ডিক্টেটরশিপ উঠে যাওয়ার পরে দেশে ফেরা, ২০০৪ -এ বাড়ীতে চুরির ঘটনা, প্রবল মারধোর করা হয় লেখককে, সিগারেট দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পাশের ঘরে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করা হয় ! সত্যি চুরিরই ঘটনা, নাকি ঐ আক্রমণও রাজনৈতিক, তার মীমাংসা এখনও হয়েছে কিনা আমি জানিনা, শুধু মনে হয়, সমসময়ের ক্ষত, দেশের বিবাদ ও দ্বন্দ, একটা গোটা মহাদেশেরও, এভাবে একজন লেখকের জীবনে ক্রমাগত ফুটে ওঠা, ক্রমাগতই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো, ক্ষতজীবন যেন, এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।
  • সৈকত | ***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪০377503
  • তো ভারভারা রাও যখন এই লেখাগুলো লিখছেন, আশির দশকের শেষের দিকে, আমার ধারণা, নগুগি থিওঙ্গোর অন্তত চারটে বইয়ের খবর এদেশে চলে এসেছে। ডেভিল অন দ্য ক্রস, পেটালস অফ ব্লাড, জেলবাসের দিনগুলো নিয়ে প্রিজন ডায়েরীজ, হয়ত বা , ডিকোলোনাইজিং দ্য মাইণ্ডের কথাও। এবং অতি অবশ্যই নগুগির জীবনের কথাও। ভারভারা রাও জেলে থাকাকালীনই প্রিজন ডায়েরিজের অনুবাদ করছিলেন, আর যেসব বইয়ের প্রসঙ্গ এনেছিলেন, বাইরের পৃথিবী থেকে দূরে থেকে যেসব বইয়ের মধ্যে আশ্রয় নিতেন (অন্য রাজনৈতিক বন্দীরা যখন রাজনীতি, সমাজতত্ব বা ইতিহাসের বইই বেশী পড়তেন, তখন ভারভারা রাওয়ের পছন্দ ছিল উপন্যাস অর সিনেমা সংক্রান্ত বই), যেসব বইয়ের চরিত্রগুলো, তাদের জীবনের ঘট্না , তাদের চিন্তাভাবনা আর অনুভূতি, যা লেখককে ঘিরে থাকত, মুক্তিও দিত, সাহচর্যও, সেগুলোর মধ্যে ডেভিল অন দ্য ক্রস একটা। এই উপন্যাসটা মুলতঃ ওয়ারিঙ্গা নামে একটি মেয়েকে নিয়ে, এবং আরও তিন চরিত্রকে নিয়ে, যারা চার জনেই ইলমোরোগ নামে এক শহর থেকে (ম্যাপে যার অস্তিত্ব নেই) যাচ্ছে নাইরোবি, এবং যাওয়ার পথে তাদের জীবনের গল্প বলচে নিজেদের মধ্যে। সেই বলা কথাগুলোর মধ্যে কেনিয়ার সমাজ, রাজনীতি, শিল্প আর সবকিছুই উঠে আসছে, আর শেষ পর্যন্ত ওয়ারিংগা বুঝতে পারছে তার জীবনটা, যা প্রায় ভেঙে পড়া ও ধ্বস্ত, তার কারন নিছকই ব্যক্তিগত নয়। সেসবই যুক্ত হয়ে আছে রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথেই।

    একটা খুব আর্জেন্সী আ্ছে বইটার মধ্যে, যেন লেখকের হাতে বেশী সময় নেই, বলে জাওয়ার আছে অনেক কিছুই, অভিযুক্ত করার আছে অনেককে, উপায় খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছে আছে খুব বেশী পরিমাণে। নাটকীয়্তা আছে বইটাতে, বক্তব্যই যেন প্রধাণ, সাজানো গোছানো সাহিত্যের ধারা থেকে পুরোপুরি বিচ্যুতি এক, সাহিত্যের রসও ক্ষতিগ্রস্ত যেন। আদ্যন্ত রাজনৈতিক এবং সরাসরি যা। তো ভারভারা রাও যখন সেলের মধ্যে ক্রমাগত হাঁটেন, ওয়ারিঙ্গা যেন তাঁকে সঙ্গ দেয়, জানলা দিয়ে উধাও হয়ে গিয়ে, আকাশের একটা তার হয়ে । আফ্রিকার একটি মেয়েই নয় শুধু, চিত্তপ্রসাদের ছবিতে আঁকা বস্তার অরণ্যের একটি মেয়ে যেন। অথবা ওন্ড জুবতীর উজ্বাল মুখের মুখশ্রীই যেন বা। আদিলাবাদ জেলায় ১৯৮১ সালে পুলিশের গুলি চালানোতে গোণ্ড আদিবাসীদের মৃত্যুতে নির্মিত শহীদ বেদীর উন্মোচনের সময়ে সারা দিন রাত ধরে যারা নেচেছিল, আনন্দে আর উত্তেজনায়, সেই মেয়েগুলোর মতই যেন। সাম্রাজ্যবাদ আর পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়া ওয়ারিঙ্গাই যেন শিখিয়েছিল লেখককে।
  • সৈকত | ***:*** | ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৭377504
  • * বলে যাওয়ার আছে
    * গোণ্ড যুবতীর উজ্জ্বল মুখের
  • সৈকত | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৪৯377505
  • বই থেকে,
    আমার চোখের সামনে দিয়ে অবিশ্রান্তভাবে চলে যেতে থাকে
    মানুষের কর্ষণ করা অর্থগুলো
    আর অক্ষরের সুচারু খাত ।
    বইতে-
    সম্প্রসারণ, শ্বাসাঘাত,
    উপর্যুপরি ধ্বনিপ্রাধাণ্য।
    মিশ্রিত শব্দের মত
    অবিরামভাবে ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠতে থাকে মানুষের
    ছাপ ফেলে আমার হৃদয়ে।
    অতীতের কাজ আর
    পুনর্জন্ম অদৃশ্য হয়ে যায়
    যখন কপালটা মোছার সময়ে
    আমি রক্ত মাখিয়ে ফেলি
    রিক্ত আর ঘর্মাক্ত অস্তিত্বের ওপর।
    শূন্যস্থানে সূর্যালোকের মত
    যা মুছে ফেলা যায় না,
    বিবর্ণ না হয়ে যাওয়া, অবোধ্য...
    আমার হাতে ধরে থাকা বই থেকে
    মানুষ আমাকে আঁকড়ে ধরে।
    নিজেকে ভুলে
    বুকের ওপরে ছড়িয়ে থাকা বইয়ের জগতে আমি প্রবেশ করি।
    বাস্তবিক, আমি অনুভব করি তাদের স্পর্শ
    নীরবে পড়ার সময়ে আমি বুঝি
    চোখের পাতা না ফেলে একদৃষ্টিতে তাদের তাকিয়ে থাকা।
    যখন আমার ঠোঁটদুটো নড়ে আর জিভটা জড়িয়ে যায়
    সৃষ্টির গূঢ় রহস্য স্রোতের মত ঢুকে পড়ে আমার মুখের মধ্যে
    তরঙ্গায়িত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে
    আমার নাভির দিকে।
    তবুও আমি জানি
    যে এই অভিজ্ঞতা নিজের নয়।
    আমার অস্থি থেকে
    সংগঠিত করি মানুষকে
    তবুও
    পাভলভের কুকুরের মত
    নিজের অস্তিত্বের গভীরে থাকা ফল্গুধারা
    আর অগ্নি উদ্গিরণকারী আগ্নেয়গিরি
    দুইয়ের দ্বারাই আমি নিয়ন্ত্রিত।
    তবুও,
    যে আমি মানুষকে বইয়ের মত পড়তে অভ্যস্ত
    কখনই কী খুঁজে পাব বইতে মানুষের বিকল্প ?

    বই পড়া নিয়ে ভারভারা রাওয়ের কবিতা; আমর অক্ষম অনুবাদ। বই পড়ার সময়ে তাঁর হুঁশ থাকত না, ল্চেনা ওকজন কাছাকাছি থাকলেও বইতেই ডুবে থাকতেন। এক বন্ধু বলেওছিল, নগুগির প্রতি ভালবাসার জন্য একদিন অন্য সবাইকে ভুলে যাবে সে, যারা তাকে ভালবাসে। আর এক বন্ধু চিঠিতে লিখেছিল, বই জীবনের এক রক্তহীন বিকল্প, চিঠি যেমন প্রেমের এক নীর্জীব বিকল্প। সন্দেহ নেই, রুঢ় সত্য এই কথাটা, মনে হয়েছিল তখন। কিন্তু বইয়ের চরিত্রগুলো কাছাকাছি না থাকলে নিজের সম্পূর্ন অস্তিত্বটাই কারাবাসের একাকীত্ব আর নীরবতায় ডুবে যেত,, এরকমও ভেবেছিলেন। গ্রন্থপাঠ তাই হয়ে দাঁড়ায় এক স্বার্থপর কাজ। এই কবিতাটা এই সব কিছু নিয়েই।
  • সৈকত | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫৭377506
  • * চেনাজানা লোকজন কাছকাছি থাকলেও
  • aranya | ***:*** | ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০২:০০377507
  • দারুণ
  • | ***:*** | ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:৩৮377508
  • পড়ছি এবং অপেক্ষা ও করছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন