বাসব রায় লিখলেন,
কল্লোল দাশগুপ্ত অতি সহজেই ফেসবুকে লভ্য। কয়েকটা পোস্ট পড়লেই বোঝা যায় তিনি আপাদমস্তক বামপন্থী। সম্প্রতি তাঁর দুটি বই পড়লাম, একটা বড় নাম – কারাগার বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা এবং আরেকটি হল তক্কোগুলি, চরিতাবলী ও আখ্যানসমূহ। প্রকাশক গুরুচণ্ডা৯।
লেখক ১৫ বছর বয়সে প্রথম জেলে যান। হ্যাঁ, তাঁকে তখনই নকশাল সন্দেহে ধরা হয়েছিল। কিছুদিন জেলে থাকার পর তিন বছর কলকাতায় থাকতে পারবে না এই শর্তে ছাড়া পান। দুটি বই প্রকৃতপক্ষে সিকোয়েল। প্রেক্ষাপট পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতা। আর সময়কাল ১৯৭৪-১৯৮৬। দুটো বই টানা পড়লে মনে হবে একটিই গ্রন্থ পড়ছি।
বছর দশেক আগে শিলঙের হিরণ্ময় রায়ের একটি বই পড়েছিলাম, পুরনো শিলঙের সংস্কৃতি ও খেলাধুলো। সেখানে হিরণ্ময় অসাধারণ নির্লিপ্তিতে লিখেছেন ভীমসেন যোশি, অমিতাভ বচ্চন, রেখা, কেন ব্যারিংটন, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পিকে-চুনী-বলরামের কথা। একটা উদাহরণ দিই, ‘ভীমসেন আমাদের বাড়িতে থাকাকালীন খুব ভোরে উঠে রেওয়াজ করতেন। একদিন মাকে বললেন আপনি খুব চমৎকার লুচি বানান, এরকম জীবনে খাইনি।’ ব্যস ভীমসেন সম্পর্কে এটুকুই। আবার অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে তাঁর ওয়ান লাইনার, ‘খুব লম্বা। আমাদের দরজা দিয়ে ঢোকার সময় মাথা হেলিয়ে দিয়েছিল।’
কয়েক মাস আগে মারা গেছেন গুয়াহাটির নারায়ণচন্দ্র সরকার। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ, গান্ধীজি এবং শেখ মুজিবর রহমানের। নাহ্ এনিয়ে তিনি কখনোই উচ্চবাচ্য করতেন না।
কল্লোলের দুটি বইয়ে এরকম উদাহরণ যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, শিবু সোরেন, অশোক মিত্র, ক্ষিতি গোস্বামী, যতীন চক্রবর্তীকে মিট করেছেন, কিন্তু কোনো অতিশয়োক্তি নেই। লেখকদের মধ্যে জ্যোতির্ময় দত্ত, শম্ভু রক্ষিত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর রায়, সংস্কৃতি জগতের হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মৃণাল সেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বাদল সরকার, প্রতুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু এঁরা নিছ্কই একেকটি চরিত্র, তেমন প্রশংসাও নেই, নিন্দাও নেই।
সত্তর দশক নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশক। কল্লোলের এই দুটি বইকে ওই দশকের বাস্তব দলিল বললে একেবারেই ভুল বলা হবে না। প্রায় পঞ্চাশটা লিটল ম্যাগাজিন যেমন স্বদেশ, প্রস্তুতিপর্ব, অনুষ্টুপ, পদধ্বনি, পূর্বতরঙ্গ.. এগুলোর গুরুত্ব উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। পাশাপাশি রয়েছে অনেক গণসংগীতের দলের কথা। যেমন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাস সিংগার্স, উত্তরপাড়ার অরণি, এখানে গান গাইতেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
দুটি বইয়ের আখ্যানের অনেকটা জুড়ে রয়েছে জেলখানা পর্ব। প্রেসিডেন্সি জেলে রাজনৈতিক বন্দিরা জরুরি অবস্থার সময়ে কেমনভাবে থাকতেন, আদ্যোপান্ত লেখা রয়েছে। নকশালরা কেন ব্যর্থ হল, চারু মজুমদার কেন ধরা পড়লেন, বামফ্রন্ট সরকার গড়ার পর নকশালরা কেন ধীরে ধীরে মুছে গেল... লেখক নিজের মতো ব্যাখ্যা করেছেন।
যাঁরা সত্তর দশকের কলকাতা দেখেননি, এই বই দুটো ভ্রমণ করুন, দর্শন হয়ে যাবে। আড্ডা, আড্ডা এবং আড্ডা। কেওড়াতলা, কালীঘাট, রাসবিহারী, টালিগঞ্জ, ময়দান, ব্রিগেড, কলেজ স্ট্রিট, রাজাবাজার, লালবাজার, বেহালার রাস্তাঘাট মায় দোকানও উঠে এসেছে বইতে।
আজ মে দিবসের অনুষ্ঠান তো কাল ফ্যাসিবাদ বিরোধী কনভেনশন, পরশু গণসংগীতের অনুষ্ঠান.. হয়েই চলেছে। বৈকালিক আড্ডা শুরু হয়েছে কেওড়াতলার মোড়ে, সন্ধ্যায় ভবানীপুর আর রাসবিহারী মোড়ের শেষ যে চায়ের দোকান বন্ধ হয় সেখানে থেমেছে, তখন রাত্রি বারোটা।
নকশাল আন্দোলন, পুলিশি নির্যাতন, বামপন্থার আগুন, সংঘবোধ, লেখক-শিল্পীদের সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ছবির মতো উঠে এসেছে বইদুটিতে। ওহ্ একটুকরো ফুটবলের গল্পও আছে।