হেনরি নামটাই যেন অন্য কিছু বোঝাতে চায় ---করতে চায়! এই যেমন জন হেনরি, কিংবা হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও! আরেক হেনরির সাথে চেনা করিয়ে দিয়েছিলো শুকতারা। বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদার পাশাপাশি অনুবাদ গল্পগুলি দিত অন্যরকম স্বাদ! আর তার সুতো ধরেই জেনেছিলাম ও হেনরি নামের একজন গল্প বলা লোকের কথা! 'শেষ পাতা ' গল্পটা পড়ে, মনে আছে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম।পরে জানলাম লোকটার আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার! বিচিত্র ও বহুমুখী উৎসাহের মধ্যে গপ্প লেখাটা সবার আগে এসে দাঁড়ালেও একটা সময়ে তার পরিচয় ---ব্যাঙ্কের কেরানি, তায় আবার তহবিল তছররুপের দায়ে গারদে! তখন গপ্পো লিখতে হচ্ছে মা হারা কন্যাটির খাবার জোটাতে! ছদ্মনাম ---হয়তোবা এই ভেবেই যে,আসল নামটা জেলের রেজিস্টারে কুখ্যাত হয়ে গেলো ---সেটা তো আর ব্যবহার করা যায়না এই নরম পবিত্র প্রয়োজনে! অথচ জেলও তাকে দিল অনেক কিছু ! মানুষ ---মানুষ --রং বেরঙ এর মানুষ! কোনো টাইপ, কোনো ধরাবাঁধা স্টিরিও টাইপে তাকে কি বাঁধা যায়? বাঁধতে গেলেনওনা তিনি! পরম যত্নে এঁকে চললেন মধ্যবিত্ত আর গরিব গুরবো মানুষগুলির কথা!হৃদকমলের নরম জায়গাটি থেকে আঁকলেন খেটে খাওয়া মেয়েদের কথা! সেই সদ্য তরুণীগুলির কথা, যারা পেটের দায়ে শহরে এসে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ---উৎকট পুঁজিবাদ, উৎকট পিতৃতন্ত্রের সাথে! না! হেনরি ঘোষিত ফেমিনিস্ট ছিলেননা। কিন্তু পরম মমতা আর তীক্ষ্ণ মানবিক অনুভূতি তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিলো খেটে খাওয়া মেয়েগুলির কষ্ট ও স্পিরিট কে! তিনি কুর্নিশ করেছেন সেই মেয়েলি জোট আর হাসিকে, যা নাকি স্বয়ং আদমেরও আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিতে পারে! তাঁর ভাষায় ইভ ও তার প্রথম কন্যাসন্তান যেন আদম কে বুঝিয়ে ছাড়ে তাদের 'মেয়েলি গেরস্থালী' তে সে নৈবিদ্যের কলা মাত্র! আসলে জোট বাঁধতেই হয়, চালাক চতুর হতেই হয় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে, আর এই সব মেয়েগুলি তাই দোকানের কাজ, ইস্ত্রির কাজ, সেলাই এর কাজ করতে করতেই মেপে নেয় সামনের পুরুষটির টাকা পয়সা আর মতলব দুটোর ই হালচাল! সেবা যারা কিনতে পারে তারা সেবা যে দিচ্ছে তাকে সেবাদাস হিসেবেই দেগে দেয়, বন্দি করে ফেলে কেবল সেই পরিচয়টিতেই। বনগাঁ লোকালে বাজার ফেরত বাড়ি ফেরা রুখু সুখু সবজিওয়ালি, টিপটপ পরিষ্কার--- সস্তা রং চটা শাড়ি ব্লাউজ, পোকায় খাওয়া শাঁখা পরা সেই সব 'আয়ারা ', রাজ্যের কাঠকুটো জুটিয়ে ট্রেনে ওঠা ক্যানিং এর 'মাসিরা ' কিংবা, নিউ ইয়র্ক এর 'দোকানি মেয়ে '---সবাই যেন কোননা কোনো 'টাইপ' হতে বাধ্য! না কি আমরাই তাদের বেরোতে দেইনা ওখান থেকে? হেনরি এই রাজনীতিটাকেই 'বিকৃত' বলে দেগে দিলেন! আসলে এটা নিজেই একটা টাইপ ---আল্হাদি অশিক্ষিত ক্ষমতার!তাই তাঁর গল্প সেই এক অন্যরকম বোঝাপড়ার ---সেই সংসারটার সাথে --যে সংসার ও সমাজ আমায় অসহায় করেছে, আমায় বুঝিয়ে ছেড়েছে যে যতই বাইরের সামাজিক উৎপাদনে তুমি থাকো, যতই তুমি নিজেকে যোগ্য প্রমান করো, তুমি আগেই হেরে আছো--- কারন তুমি মেয়ে --- আর, কারণ তুমি গরিব---!!অসহায়তার মধ্যে দিয়েই বাচ্চা মেয়েগুলি পৃথিবীর পাঠশালা থেকে শিখে যায় অনেক কঠিন সত্য! তারা উচ্চ শ্রেণীর আদব কায়দা রপ্ত করতে করতেই যেন বুঝে ফেলে তার শূন্যতাটুকুও। তারা লড়াই করে ভালোভাবে বাঁচতে!এরা নারীবাদের তাত্ত্বিক পাঠ নেয়নি, পুঁজিবাদ, সামন্ততন্ত্র বা সমাজতন্ত্র ---খায় না মাথায় দেয় জানেনা! কিন্তু পুরুষের রংশালায়, অর্থের অনর্থের সাথে লড়তে লড়তে কী ভাবে যেন অনায়াসে বেরিয়ে আসে চাপিয়ে দেওয়া ভাবনা ভীতি গুলো থেকে! তাই বারব্রত, রোজা আর রান্নাপুজো করতে করতেই সিসিফাসের মতো সংসারের মস্ত বড় পাথরটাকে কেবল ই ঠেলে গড়িয়ে উপরে তুলতে চায়! হেনরি যেন বার বার এসে দাঁড়ান চলন্ত লোকাল ট্রেনে, বাসে, স্টেশনে, বাজারে। দমদমের প্লাটফর্ম ধরে চলন্ত ট্রেনের পাশে ছুটতে ছুটতে মুড়ি আলুসেদ্ধর প্যাকেটগুলি লেডিসের জানলা গলিয়ে তুলে দেন মেয়েগুলির হাতে ---যারা রাত তিনটের ট্রেনে ধরে শহরে এসেছিলো, এখন ফিরে গিয়ে আবার রাঁধবে বাড়বে।কখনো বা রাজাবাজার বা মৌলালী র মোড়ে রিকশা থামিয়ে রাস্তার কলের জলে ভরা প্লাস্টিকের ভারী কলসিটা রোগা মেয়েটির মাথায় তুলে দিয়ে নির্বিকার গুন গুন করতে করতে চলে যান! তিনি কোনো আগুনখেকো বিপ্লবী ছিলেননা। 'social activist' ও না। মারা গিয়েছিলেন মাত্র আটচল্লিশে, দারিদ্রে আর সিরোসিস অফ লিভার রোগে। তবুও ----
সেবা দিলেও মেয়েরা যে আদতে কখনোই কারোর সেবাদাসী নয়--- সেকথা তাঁর মতো করে খুব কম লোকই বোঝাতে পেরেছে!
[হয়তো FB তে দিয়েছিলাম, দিলে কবে---মনে নাই। এখানে রইলো।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।