এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নারী এবং সম্প্রদায় 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ এপ্রিল ২০২৫ | ৬৮ বার পঠিত
  • বাংলার অর্ধেক বিষয়ই নারী এবং সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত হয়। সন্দেশখালি দেখুন, স্রেফ গুন্ডামি বা জমিদখল নয়, একটা রগরগে যৌনদাসীর ফ্যান্টাসিতে পৌঁছল, যে যৌনদাসী পুষত এক বিশেষ সম্প্রদায়। ঠিক যেন আরব্য রজনী। আরজিকরে দেখুন, একটা সরকারি হাসপাতালে  খুন, ধর্ষণ, অধ্যক্ষের প্রাইজ-পোস্টিং, এইসব না, জিনিসটা পৌঁছল কুৎসিততম একটা পর্নোগ্রাফিতে। এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ছেলেদের দ্বারা গণধর্ষণ, একটা মেয়ের অবধি হাত চেপে ধরে রাখা, এইসব মিলিয়ে আমি-সোমা-বলছি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, তাকে টপকানো সম্ভব বলে মনে হচ্ছিলনা। কিন্তু তাকেও টপকে এল লাশের সঙ্গে সঙ্গমের গল্প। দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। বিকৃতির এই মাপ আগে কখনও দেখা গেছে বলে মনে হয়না। এবারও এই মুর্শিদাবাদ নিয়ে দেখুন, সংখ্যালঘু তো ছিলই, এখন মহিলা কমিশন এসে গেছে। একটু ফাঁক পেলেই নারী ইস্যু ঢুকে পড়বে। 

    এইটা হচ্ছে কেন? সংখ্যালঘুটা মোটের উপর আমরা জানি। তারা সবাই যে ধোওয়া তুলসিপাতা, তা একেবারেই না, কিন্তু ইস্যুটা দরকার রাজনৈতিক কারণে। মুর্শিদাবাদে কিছু ধর্মীয় উত্তেজনা জড়িয়ে ছিল, কিন্তু যেখানে ছিলনা সেখানেও খুঁজে বার করা হয়। নারী ইস্যুটাও রাজনৈতিক। কিন্তু এতটা সরল না। নারীর উপর যৌনলাঞ্ছনা নিয়ে সমাজের একটা মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গী আছে। লাঞ্ছনা কেন হয়? মূলত নারীর উপর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য (পুরুষের ক্ষেত্রেও হয়, সেটা এখানে বিষয় নয়)। নির্ভয়া বা তিলোত্তমা যাই হোক, জিনিসটা স্রেফ ক্ষমতার  আস্ফালনের মাধ্যম। সাধারণভাবে এর পর আসে নিন্দে, মেয়েটিই দায়ী, তারপর আসে রসালো বর্ণনা, অনেকেই তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে, এবং মেয়েটির জন্য আসে লোকলজ্জা।

    ঠিক এর উল্টোদিকে আরেকটা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে, সেখানে ধর্ষণ একটা ঘৃণ্য অপরাধ। জেলে অবধি অন্য আসামীরা এই আসামীদের নিচু চোখে দেখে। এই একটা কালো দাগ পড়লে সামাজিক অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যায়, মুখ দেখানোর জায়গা থাকেনা। তপন সিংহের আতঙ্ক মনে করুন। একজন প্রতিবাদীকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, স্রেফ লাঞ্ছনার অভিযোগে।

    এই দুটো দিকই একটা ব্যবস্থায় একসঙ্গে থাকলে যা হয়, তা হল, একদিকে ঘৃণ্য অপরাধ বলে নারী ইস্যুতে গর্জে ওঠা। অন্যদিকে ফ্যান্টাসি তৈরি হয়ে চলা। যত বেশি ফ্যান্টাসি তত বেশি ভাইরাল এবং তত বেশি গর্জন। যাঁরা গুজবগুলো ছড়ান, তাঁরা এই চক্রটা বিলক্ষণ জানেন বলেই, রাজনৈতিক কারণে এগুলোকে ব্যবহার করেন, ছড়ান, ছড়াতে দেন। এখন "ভাইরাল" বলে একটা বস্তু হওয়ায় ব্যাপারটায় সুবিধেও হয়।

    এবার কথা হল, এই দুটো দৃষ্টিভঙ্গী একসঙ্গে থাকে কীকরে। দুটো তো পুরো উল্টো। ঠিকই, কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার একদম গোড়া থেকেই এই দুটো ব্যাপারকেই ধারণ করার ব্যবস্থা ছিল। আদিম জনগোষ্ঠীর মোটামুটি একটা সাধারণ ছক ছিল, পরাজিত গোষ্ঠীর পুরুষদের খুন, আরে মেয়েদের  ধর্ষণ এবং দাসী বানানো। নিজের গোষ্ঠীর জন্য সম্পূর্ণ আলাদা প্রেসক্রিপশন। সেখানে মেয়েদের সম্মান এবং নিরাপত্তার জন্য পুংদের জানকবুল, আর অপরাধীদের লিঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড, এইসব। এর নান ভ্যারিয়েশন ছিল, যেমন জাতিচ্যুত কুলটা নিচুজাত এদের জন্য এক বিধান, আবার নিজের গোষ্ঠীর জন্য আলাদা। এ জিনিস নানা আকারে এখনও টিকে আছে। অর্থাৎ বৈপরীত্যটা আমরা ধারণ করেই রেখেছি। নারী ইস্যু নিয়ে হট্টগোল শুধু নারীর অধিকারের জন্য হয়না, নিজের গোষ্ঠীর নারীকে রক্ষা করা, ফ্যান্টাসি, সবকটাই মিশে থাকে।

    এ খুব হাতিঘোড়া ব্যাপার না। কিন্তু এই পুরোটা নিয়ে কোনো আলোচনা দেখবেন না কোথাও। অ্যাকাডেমিশিয়া থেকে শুরু করে চিন্তাবিদ পর্যন্ত সবাই স্রেফ 'রেপ কালচার' নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু পিতৃতন্ত্র এরকম কোনো সংস্কৃতির ধারক বা বা বাহক নয়। নিরাপত্তা এবং লাঞ্ছনা এরকম দুটো বিপরীতমুখী ধারণা নিয়ে তৈরি হয় একটা সংস্কৃতি। নিরাপত্তা বিষয়টা চালু আলোচনা থেকে একদম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিসকোর্সটাই এমন তৈরি করা হয়েছে, যে, এটা যেন মূলধারার আলোচনায় না আসতে পারে। সেইজন্যই আলোচনা দেখতে পাবেন না। 

    এর কারণটা কী, নিশ্চিত করে বলা শক্ত। অনেকরকম ভাবে বলা হয়। মতাদর্শগত আধিপত্যকে আমরা বলি হেজিমনি। তার কোনো কর্তা থাক বা না থাক, ব্যবস্থার প্রতি একটা আনুগত্য থাকে। সেটা নানা ভাবে নির্মিত হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যবস্থাটা মোটের উপর যুদ্ধক্ষেত্র। ফলত চিন্তার ক্ষেত্রে একটা নিয়ন্ত্রক সুইচ থাকার দরকার থাকে। দেখবেন, সুইচ-অন সুইচ-অফের মতো আফগানিস্তানের নারীরা কখনও অত্যাচারিত হয়ে যায়, কখনও ইরানের নারীরা। তৈরি হয় বিশ্বব্যাপী জনমত। তারপর হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তো, চালু বিশ্বব্যবস্থার একটা অংশের অন্তত এরকম উদ্দীপনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের একটা ক্ষেত্র বা বিষয় দরকার। নারী মোটামুটি সারা পৃথিবীতেই চলে। ফলে ওখানে শুধুই 'রেপ কালচার' বলা হয়, মিশ্র-টিশ্র সংস্কৃতি বললে আপনি চিন্তক জগতে একঘরে হয়ে যাবেন। বেশিরভাগ তথাকথিত চিন্তকই অবশ্য চিন্তা করতে ভালোবাসেন না, পেপার-টেপারও বেশিরভাগই আবর্জনা বা টুকে লেখা হয়, ফলত বেশিরভাগই এই হেজিমনিটা টের পান না, শুধু উদ্দীপনা টা টের পান। সেটাই উদ্দেশ্য। 

    এই উদ্দীপনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ একটা খুব কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার। কথাটা প্রথম চালু করেছিলেন ফুকো। উপনিবেশের পরিসরে, নারীর পরিসরে এসে তাঁর আখ্যান অনেক সময়ই ভেঙে পড়ে। ফলে একটা নতুন তত্ত্বের দরকার। কিন্তু সেটা লেখা যাবেনা। কারণ লিখলেই সেটা আর পড়া হবেনা। এই নিয়েই একটা তত্ত্বায়ন হয়, কিন্তু আমার আজকের টাইপ করার সময় শেষ। তাছাড়া সোশাল মিডিয়ায় এইসব মুক্তো ছড়িয়ে লাভ কী। সেখানেও তো কেউ পড়বেনা। ফলে ফার্মার শেষ থিয়োরেমের মতো দাঁড়াল। আমার খাতার মার্জিনে লেখা আছে চমৎকার তত্ত্বটা, যেটা আপনারা কক্ষনো খুঁজে পাবেন না। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • s | 2a03:e600:100::***:*** | ২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৪৬542467
  • হেজিমনি পাছে ইসলামোফোবিক দেগে দেয়, তাই কতজনের ভাষণে কন্ডোম পরানো থাকে!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন