বাইরের ঘরে পুরুতমশায় বিজয়বাবুর সঙ্গে বসে মৈত্রেয়ী ফর্দ বানাচ্ছে শ্রাদ্ধের, ঘাট কাজের। তেল, ঘি, প্যাকাটি, কুশ শব্দগুলো ধাক্কা মারছে শমীকের কানে। আজ তিন দিন হল অন্তরা চলে গেছে ঊর্ধ্বলোকে। অন্তরার ৮২ বছরের জন্মদিন হল গতমাসে। রাত্রে হঠাৎ হার্টঅ্যাটাক, সব শেষ ডাক্তার আসার আগেই। শমীকের চোখের সামনে ভাসছে সেই দিনটা। ঠাকুর পুজো করল সকালে অন্তরা, বারান্দার গাছে জল দিল, ওয়াশিং মেশিনে জামা কাপড় কাচল, দুপুরে দুজনে খেয়ে উঠল একসঙ্গে। তারপর অন্তরা তার অভ্যাসমত কিছু বই পড়তে বসল সারাদুপুর। বিকেলে দুজনে একসঙ্গে চা খেল বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে, সন্ধেয় দু’চার জনকে ফোন করল অন্তরা, তারপর রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে গেল ঘুমোতে। অন্তরা ঘুমিয়ে পড়েছিল সাড়ে দশটায়। শমীকের অভ্যাস কিছু পড়াশোনা করা রাতে খেয়ে উঠে। শমীক ওর ঘরে পড়ছিল। হঠাৎ অন্তরা রাত ১২টা নাগাদ চিৎকার করে ডাকল শমীককে ওর ঘরে।
-‘খুব ব্যথা করছে বুকে। একটা জেলুসিল দাও। মনে হচ্ছে অ্যাসিডিটি হয়েছে।‘
-‘দাঁড়াও, দিচ্ছি’।
আধঘণ্টা কাটল তারপর। তাও ব্যথা কমল না অন্তরার। শমীক ডাক্তারকে ফোন করল সঙ্গে সঙ্গে। ডাক্তার একটা ওষুধের নাম বললেন, এখনই দেওয়ার জন্য। কিন্তু ১৫ মিনিটের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। ম্যাসিভ হার্টঅ্যাটাক।
মেয়ে-জামাই খবর পেয়ে চলে এল পরদিন সকালেই দিল্লী থেকে। সন্ধ্যার মধ্যে নিমতলা শ্মশানে দাহ কাজ মিটে গেল। হঠাৎ সব ফাঁকা হয়ে গেল যেন। বাড়ি ফিরে শমীকের মাঝে মাঝেই ভুল হচ্ছে। থেকে থেকে অন্তরাকে ডেকে উঠছে। বলছে, -‘আমার চশমাটা কোথায় গেল, অন্তরা’। কিংবা, ‘অন্তরা, একবার চা দাও তো’। তারপর মনে পড়ছে যে ও আর নেই। বিকেলে বারান্দায় বসে এখন একাই চা খেতে হবে, ভাবে শমীক। এখন মেয়ে- জামাই, নাতি, নাতনি আছে বলে তাও বাড়িটা ভরে আছে। শমীক ভাবে, ওরা চলে যাবে আর কদিন পরে; তারপর দিন কাটবে কিভাবে কে জানে!
শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছে পুরোদমে। শমীক শ্রাদ্ধে বিশ্বাসী নন। কিন্তু অন্তরার খুব বিশ্বাস ছিল এতে। বলত, ‘শ্রাদ্ধ না হলে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকতে হবে আত্মাকে। আত্মা ঊর্ধ্বলোকে যেতে পারবে না’। তাই মায়ের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে মেয়ে মৈত্রেয়ী শ্রাদ্ধের আয়োজন করছে।
-‘শ্রাদ্ধটা কি বাড়িতেই করবি?’ শমীক বলে মৈত্রেয়ীকে।
-‘হ্যাঁ, বাবা। মা এতদিন এই বাড়িতে বাস করেছে, এখানেই হোক’।
-‘ঘাটের কাজ কোথায় করবি?’
-‘ভাবছি বাগবাজার ঘাটে গঙ্গায় যাব। ওটাই কাছে হবে।‘
-‘আমি কিন্তু ওসব কিছু করতে পারব না।‘
-‘না বাবা, তোমাকে কিছু করতে হবে না। জানি তুমি এসবে বিশ্বাস করো না।‘
- ‘শ্রাদ্ধের দিন কি বসে খাওয়ানো হবে নাকি প্যাকেট দিয়ে দিবি?‘
-‘বাবা, বসেই খাওয়ার ব্যবস্থা করব। মা তো ওসব প্যাকেট ফ্যাকেট পছন্দ করত না। বলত সবাই যেন তৃপ্তি করে খায় আমার শ্রাদ্ধে‘।
-‘লোকজন খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে যাবে আর আলোচনা করবে পাবদা মাছটা কি ভাল ছিল, ফিশফ্র্যইটা খুব সুন্দর – এগুলো বড় অশ্লীল লাগে আমার কাছে’।
-‘না বাবা, এগুলো না করলে মা’র আত্মা কষ্ট পাবে’।
-‘নিয়মভঙ্গে কতজন হবে?’
-‘তাও ধরো প্রায় ২০০ জন। আত্মীয় স্বজনের বাইরেও তো তোমাদের কত চেনাশোনা। সবাইকে বলতে হবে। মা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে সবাই দেখা করতে এসেছিল। না বললে খারাপ দেখায়।’
-‘ঠিক আছে। তুই যা ভাল বুঝিস কর’।
-‘মিঠি আর ছোটুকে দেখছি না কেন? ওরা কোথায়?’
-‘বাবা, ওরা টিভিতে কার্টুন দেখছে।’
-‘ওরা দিদাকে খুব ভালবাসত। ওরা কি বলছে এখন, দিদাকে না দেখতে পেয়ে?’
-‘মিঠি দেখলাম বলছে ছোটুকে, ‘দিদা আকাশের তারা হয়ে গেছে। প্রত্যেক দিন রাতে দিদা আকাশ থেকে আমাদের দেখবে’। ‘কোন তারাটা দিদা, বুঝব কেমন করে, দিদি?’ ’যে তারাটা সবচেয়ে জ্বলজ্বলে সেটাই আমাদের দিদা’।
শমীকের হঠাৎ মনে পড়ে বারান্দার গাছগুলো দু’দিন জল না পেয়ে শুকিয়ে উঠছে। অন্তরার সব প্রিয় গাছ – বেল, জুঁই, টগর, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, নীলমণি, রজনীগন্ধা। আর কত সব ফুল। শমীক জল দেয় গাছগুলোতে। ভাবে, ওরাও কি বুঝছে অন্তরার অভাবটা?
মৈত্রেয়ী দুপুরে ডাকে বাবাকে ভাত খেতে মাছের ঝোল দিয়ে। জানে বাবা মাছ খেতে ভালবাসে। আজ তিনদিন হল অন্তরা চলে গেছে। শমীকের মাছ খেতে ভাল লাগে না। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ে শমীক। মৈত্রেয়ী বোঝে বাবার মনের কথাটা। জোর করে না বাবাকে। খেয়ে উঠে মৈত্রেয়ী বসে বাবার পাশে।
‘এবার আমার সঙ্গে দিল্লী চলো বাবা। এখানে আর একা থাকার দরকার নেই তোমার। তোমার তো বয়েস এখন ৮৪। হঠাৎ শরীর খারাপ হলে কে দেখবে তোমায়?’
‘না রে। এখানেই থাকব আমি। সারাজীবন এই বাড়িতে থাকলাম। এখন শেষ বয়েসে অন্য কোথাও গিয়ে ভাল লাগবে না। কত স্মৃতি এই বাড়িতে।’
‘বাবা, মনে আছে আমার বিয়ের আগের দিন মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় টোকা। সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠে খুব ভয় পেয়ে গেল। তারপর তুমি সাহস করে দরজা খুললে। দেখা গেল পাড়ার কুকুর, ভুলু, দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। ওর বোধহয় ঠাণ্ডা লাগছিল বাইরে। তখন ডিসেম্বর মাস, ভরা শীত।’
‘আর তোর মনে পড়ে সেই ফাংসনের কথা আমাদের হাউসিংয়ে। তুই আর তোর আরও দুই বন্ধু মিলে নাচের জন্য রেডি হচ্ছিলি সাজগোজ করে। আর কাকলি আন্টি তোদের দেরি দেখে পরের অনুষ্ঠান শুরু করে দেয়। তোদের কি মনখারাপ! পরে অবশ্য তোদের অনুষ্ঠানটা হল। কত সব মজার ঘটনা’।
‘তারপর তোকে একবার স্কুল থেকে তুলতে ভুলে গেল স্কুলবাস। সবাই বাড়ি এল, তুই আর আসিস না। ক্লাস থ্রিতে পরিস তখন। আমাদের কী চিন্তা! তুই কিন্তু কাঁদিস নি একদম। স্কুলের সিস্টাররা তোকে গল্প বলে ভুলিয়ে রেখেছিল। আমরা গিয়ে তোকে নিয়ে এলাম বাড়ি সন্ধ্যাবেলায়’।
‘তারপর বাবা মনে আছে, সেই ছোটবেলায় মার সঙ্গে পার্কে গিয়ে কি হল! আমরা পার্কে খেলছিলাম। হঠাৎ একটা ষাঁড় কোথা থেকে পার্কে ঢুকে পড়ল। আর আমার গায়ে লাল রঙের সোয়েটার দেখে ষাঁড়টা তেড়ে এল। তখন তাড়াতাড়ি মা আমাকে নিয়ে স্লাইড-এর ওপর চড়ে পড়ল। ভাবো, মা স্লাইডের ওপর চড়েছে। ভাবলেই হাসি পায়! তারপর ষাঁড়টা চলে যেতে আমরা নামলাম নিচে’।
বাবা-মেয়েতে গল্প করে পুরনো দিনের কথা আর বারবার মনে হয় আজ আর ওদের মধ্যে অন্তরা নেই। একটা অভাব বোধ মনকে কুরে কুরে খায় দুজনেরই।
শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার ন’দিন পরে মৈত্রেয়ীরা ফিরে গেল দিল্লী। শমীক এখানে একা। মনে মনে গল্প করে অন্তরার সঙ্গে সারাদিন। সন্ধ্যায় পাশের ঘরে আলো জ্বেলে দেয় শমীক যেখানে ঠাকুর আছে, যেমন অন্তরা দিত।
‘ঠাকুরের ঘরে আলো জ্বালতে হয় সন্ধেবেলা’, অন্তরা বলত।
‘যত সব কুসংস্কার’,শমীক বলত।
এখন শমীক নিজেই এসব করছে।
-‘অন্তরা কি এখন স্বর্গে বসে তাকে দেখছে আর ভাবছে, কেমন মজা, এবার বোঝো একা থাকতে কেমন লাগে!’ শমীক ভাবে ।
শমীক সারাজীবন অফিসের কাজে ঘুরে বেড়াতো গোটা দেশ জুড়ে। অন্তরা বহুদিন একা থাকত। কখনো অভিযোগ করেনি অন্তরা এ নিয়ে। মাঝে মাঝে সে বড় নিঃসঙ্গ বোধ করত। শমীক বুঝত না সেটা।
আজ দুপুরে মৈত্রেয়ীরা চলে গেছে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে শমীক দেখতে যায় পাশের ঘরে অভ্যাসমতো। ভাবে অন্তরা ঘুমোচ্ছে ওখানে। একটু পরেই ভুল ভাঙ্গে। বিছানা ফাঁকা সেখানে। শমীক মনে মনে ভাবে, ‘অন্তরা, আমাকে তোমার কাছে এবার নিয়ে চলো। বড় একা লাগছে আমার। অন্তরা শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?’
হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগে শমীকের চোখে মুখে। অন্তরা বলে মৃদুস্বরে ‘পাশেই আছি। এই তো আমি’। শমীক ভাবে ভুল শুনলাম নাকি!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।