বাংলাদেশ ও চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে নিয়ে কলম ধরলেন ইমতিয়াজ মাহমুদ। আশা করি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ লেখকের সঙ্গে একমত হবেন।
------------------------------------------------
(১) আমার খুব লজ্জা লাগছে। বিষণ্ণ এবং ক্রুদ্ধও খানিকটা। আমার প্রিয় মাতৃভূমিতে কেবল ধর্মবিশ্বাসের কারণে মানুষের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। মানুষকে প্রহার করা হচ্ছে রাস্তাঘাটে। এরকম গ্লানি আমার এর আগে যখন বিরানব্বই সনে বা দুই হাজার এক সনে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হামলা এসব হচ্ছিল তখনো হয়নি। কেননা সেইসময় একদল লোক হিন্দুদের উপর হামলা করছিল বটে, কিন্তু সেই সাথে আবার একতা বৃহৎ অংশের মানুষ প্রতিবাদও করেছে। আপনারা জানেন যে সেসময় তসলিমা নাসরিন 'লজ্জা' লিখেছেন। সাপ্তাহিক একতা এবং আরও কিছু কাগজ বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবাদ করেছে অনেকে, লিখেছে, মিছিল করেছে।
আমার মনে আছে আমার বন্ধু একরাম ভাই অনেক কষ্ট করে দেশে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে হিন্দুদের উপর সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। একরাম ভাইয়ের সংগৃহীত সেইসব তথ্যের ভিত্তিতে এখনো গেলনা আঁধার নামে একটা প্রকাশনাও হয়েছিল। দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করেছিল, সিপিবি বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। আরও অনেক ব্যক্তি দল ও সংস্থা যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেছে। বিরানব্বই আর দুই হাজার এক সনে মনে একতা সান্ত্বনা ছিল যে, না, কতিপয় তস্কর সন্ত্রাস করছে কিন্তু সন্ত্রাসীদের চেয়ে এবং সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের চেয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যারা করেছে ওদের সংখ্যা বেশী ছিল।
এইবার তো আমি হিন্দুদের বিরুদ্ধে এইরকম সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কাউকে দেখছি না। আওয়ামী লীগ তো নেইই, সিপিবি নিশ্চয়ই এখনো প্রতিবাদ করছে কোন না কোনভাবে, কিন্তু ওদের কণ্ঠও যেন খানিকটা মৃয়মান। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেসব ভালো মানুষেরা টুকটাক প্রতিবাদ করছেন, ওদের কথাও একটু কেমন যেন। 'বৈচিত্র্যের ঐক্য' নামে একটা অনুষ্ঠান করেছেন একদল ভালো মানুষ, চমৎকার ধারণা, চমৎকার অনুষ্ঠান, খুবই সুন্দর জমায়েতও হয়েছে। যেসকল ভালমানুষেরা সেই অনুষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ওরা তো সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করা কথা। ওদের হাবভাব দেখলে মনে হচ্ছে যেন সেটা একটু অধিক প্রত্যাশা হয়ে যাচ্ছে।
(২)
দৈনিক পত্রিকাগুলি নানা খবরের লাইভ ভিডিও দেখায় অনলাইনে। সেরকম একটা লাইভ স্ট্রিমিং দেখলাম খুলনা শহরের। কিছু লোক নিজেদেরকে ছাত্র জনতা নাম দিয়ে ইস্কন নিষিদ্ধের দাবী জানাচ্ছেন। সেটা ওরা জানতেই পারেন, ওদের ইচ্ছা। কিন্তু ওদের পাশ দিয়ে কয়েকজন যাচ্ছিলেন চিন্ময় ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবীতে মিছিলে যোগ দিতে। ওদেরকে ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে আর 'দিল্লী না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা' শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের একটা আদালতে চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে হাজির করা হয়েছিল, তাঁর পক্ষে জামিন চাওয়া হয়েছে, জামিন হবে কিনা জানিনা। চট্টগ্রামের একটা সমাবেশে পতাকা উঁচু নিচু হয়েছে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছে বিএনপির একজন- সেই মামলাটায় তিনি আটক। দেখেন, চিন্ময় ব্রহ্মচারী জেলে আছে নাকি বাইরে আছে সেটা নিয়ে আমার অধিক দুশ্চিন্তা নাই। তিনি ব্রহ্মচারী মানুষ, তাঁর জন্যে জেল কি আর সংসারই বা কি! দুশ্চিন্তার বিষয় যেটা, সেটা হচ্ছে যে এই লোকটাকে হয়রানী করা হচ্ছে শুদ্ধ সাম্প্রদায়িক কারণে। হিন্দুদের উপর অত্যাচার হচ্ছে বলে তিনি সেটার প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, কথা বলেছেন। শুধু এই কারণেই তাকে এই হয়রানী করা হচ্ছে। আমাদের এখন যে সরকার আছে সেই সরকারে একাধিক উকিল আছেন, একজন আইনের অধ্যাপক আছেন। অনুমান করি এরা ঠিকই জানেন যে পতাকা উঁচু হলো নাকি নিচু হলো সেটার জন্যে আর যাইই হোক রাষ্ট্রদ্রোহিতা হয় না।
ব্রহ্মচারীর গ্রেফতারের খবরে গতকাল রাতে অনেকেই শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন প্রতিবাদ করবেন বলে। এটা তো একটা খুবই স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি। সেখানে জড়ো হওয়া সনাতনী বিক্ষভকারীদের বেধড়ক পেটানো হয়েছে। পুলিশ পিটিয়েছে, তার চেয়ে নাকি বেশী পিটিয়েছে উপস্থিত হিন্দুবিদ্বেষী সরকার সমর্থকরা। দেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও এইরকম খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে কাউকে কিছু বলতে শুনছি না। চট্টগ্রামের আদালত পাড়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছে চিন্ময় ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবীতে। খবর পেলাম যে সকাল বেলা একজন ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিতে অস্বীকার করেছেন। কোর্ট প্রাঙ্গণে অসংখ্য মানুষ জড়ো হয়েছে, পুলিশ মিলিটারিও আছে।
(৩)
এই দেশ আমার দেশ, আমার পিতা-পিতামহের দেশ। একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের অংশ হতে চাইনি বলে আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি, আমার পূর্বসূরিরা যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। এই রাষ্ট্রটি আমার রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রকে একদল লোক উচ্ছন্নে নিয়ে যেতে চাইবে আর আমি বসে বসে দেখব! না। এই দেশে যদি মন্দ কিছু হয় সেই গ্লানি আমারও গ্লানি। আমি যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই না করি তাইলে তো আমি আমার শিরায় প্রবাহিত শোণিতের সাথে বেইমানি করলাম। আমি লড়বো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আমি লিখতে পারি, আমার কিবোর্ড আমার তলোয়ার আমার বন্দুক- সেই নিয়েই আমি লড়বো।
আর যদি লড়াই অন্য কোন আকারে হয়, সেইভাবেই লড়বো। আমার দেশ আমার জননী, এই দেশ চিন্ময় ব্রহ্মচারীরও দেশ- এই মাতি চিন্ময়েরও জননী। চিন্ময় আমার ভাই। এই দেশে চিন্ময় একটা প্রতিবাদ সংগঠিত করতে পারবে না সেটা তো হবে না। আমরা লড়বো। এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের আদালত পাড়ায় বীর চট্টলার সংগ্রামী জনতা জড়ো হয়েছে। ওরা সূর্যসেনের উত্তরাধিকারী, প্রীতিলতার বংশধর। ওদের সাথে আমি আছি। লড়াই আমরা ছাড়বো না। চিন্ময়ের বিশ্বাসের সাথে আমি একমত নাও হতে পারি- কিন্তু চিন্ময় তাঁর নিজের কথাটা বলতে পারবে না সেটা তো হয় না। আমি আমার নিজের স্বার্থেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়বো।
আপনি সিদ্ধান্ত নেন, আপনি কোন পক্ষে থাকবেন- লিবার্টির পক্ষে? নাকি সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। কেবল এই কথাটা মনে রাখবেন স্বাধীনতার প্রশ্নে আপনি নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না।