পর্ব ১
— শোনো, আমরা যেদিন সন্ধেয় এই শহরে ফের ফিরে আসব, আমাদের ট্রেন কিন্তু একবার বদলাতে হবে উত্তরের স্টেশনে।
— আমি তো টিকিট দেখে কিচ্ছু পড়তে পারি না। তা সেই উত্তরের স্টেশনটা কতদূর মেইনস্টেশন থেকে?
— খুব বেশি দূরে নয়, একটা স্টপ ট্রেনে, টিকিটে লিখছে ছমিনিটি।
— আর ট্রেন বদলানোর জন্য কত সময় পাবো?
— দুমিনিট।
— দুমিনিট মাত্র? মালপত্র নিয়ে প্ল্যাটফর্ম বদলাতে হবে না? পেরে উঠবো?
— তাহলো চলো, বাসে করে যাই ঐ উত্তরের রেলস্টেশনটা একবার দেখেই আসি।
— তাই চলো।
এই ওপরের কথোপকথনটা বাবুর সঙ্গে আমার।
বাবু টিকিট দেখে কিছু পড়তে পারে না, তার মানে এই নয় যে তার চোখ গেছে। তার কারণ ভাষাটা সে জানে না, আমিও সেই ভাষা জানি না, তবে অক্ষরগুলো পড়তে পারি, এই ই যা তফাৎ।
তো সেই উত্তরের স্টেশনে গিয়ে যা দেখলাম, সে এক অভিজ্ঞতা বটে। সেসব পরে আসবে। এটা আসলে একটু টীজার দিলাম আর কি!
হ্যাঁ। জুরিখ থেকে বের হবার আগে কী কী করলাম সেটা আগে বলে নিই।
প্রথমেই গন্তব্য ঠিক করা একটা কাজ। অতএব ম্যাপ খুলে দেখে নেওয়া শুরু হলো কোথায় যাওয়া যায়। রোমানিয়া থেকে কৃষ্ণসাগরে দিব্যি যাওয়া যেত, গরমের কারণে কিছুই করা হলো না। তা সেপ্টেম্বরের শেষের দিক যেহেতু, গরমের আঁচ একটু পড়ে এসেছে, কৃষ্ণসাগরের দিকেই যাওয়া যাক তবে। তুর্কিয়, রোমানিয়া, ইউক্রেন, রাশিয়া, মলদোভা, বলগারিয়া, গ্রুজিয়া, এইসব দেশ ঘিরে রেখেছে কৃষ্ণসাগরকে।
তুর্কিয় আগে ভালো করে ঘুরেছি ইস্তাম্বুল এশিয়া ও ইউরোপের দিকটা, সঙ্গে মার্মারে সমুদ্র এবং বসফোরাস প্রণালী যা জুড়েছে মার্মারে সমুদ্রকে কৃষ্ণসাগরের সঙ্গে। রাশিয়ার জন্য অন্য প্ল্যান করব পরে, বড়ো করে। ইউক্রেনে যুদ্ধ চলছে, রোমানিয়া সবে ঘুরে এলাম, বাকি রইল গ্রুজিয়া, মলদোভা এবং বলগারিয়া। প্রথমটায় গেলে, পরে কাস্পিয়ান সাগরের দিকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাধা সৃষ্টি হতে পারে। আজারবাইজানের ভিসা দেবার সময় দেখে নেয়, ওদের শত্রু দেশ গ্রুজিয়ায় গিয়েছি কি না। গ্রুজিয়া আপাতত বাদ থাকুক, বাকু বেড়িয়ে এসে তারপরে যাওয়া যাবেখন। মলদোভা যাওয়া যেতেই পারে, তবে সঙ্গে করে পাসপোর্ট নিতে হবে। বলগারিয়া সবে শেংগেনে ঢুকেছে রোমানিয়ার সঙ্গে, পাসপোর্ট লাগবে না, ডোমস্টিক ফ্লাইট। বেশ, তাহলে ঐ কথাই রইল — বলগারিয়া।
ভাষা একটা সমস্যা হতে পারে। তবে আমরা দুজন মিলে মঙ্গোলিয়া এফোড় ওফোঁড় করে এসেছি বছর ঘোরে নি বলতে গেলে, বলগারিয়ান ভাষাকে ভয় পাবো? রোমানিয়াতেও দিব্যি চালিয়ে নিয়েছি। অতএব সোফিয়ার রাউন্ড ট্রিপের ফ্লাইট টিকিট কেটে ফেললাম।
এবার হচ্ছে থাকব কোথায়? হোটেল হোক কি এয়ারবিএনবি, কতদিন কোন শহরে থাকব সেটা না জেনে বুক করা যাচ্ছে না। সোফিয়াতে সমুদ্র নাই। সমূদ্র ঐ দেশের পূর্বদিকে। পূবদিকে ম্যাপটা একটু জুম করা যাক। ঐ তো একটা শহর ভালোভাবে ফুটে উঠলো, লম্বা বীচ আছে। নাম ভার্না। তাহলে সোফিয়া থেকে আমরা যাব ভার্না। কীভাবে যাবো? বাস, ট্রেন, ফ্লাইট, তিনটে অপশনের মধ্যে ট্রেন হচ্ছে একদম বেস্ট। হাঁটাচলার সমস্যা নেই। মোটামুটি বলছে সাড়ে আট নঘন্টার মতো লাগবে। বাসে একটু কম সময় লাগবে, বাসের ভাড়া কমও হবে, কিন্তু সীটে বসে বসে শরীরের ওপর বড্ড চাপ পড়বে। তাহলে ট্রেনই হোক। রাতের ট্রেনে ফার্স ক্লাস কুপে স্লীপার পছন্দ হলো আমাদের। অনলাইনে বুকিং, দুটো ভাষার অপশন, ইংরিজি এবং বলগারিয়ান। যতবার ইংরিজি করে দিই, একটু পরেই বলগারিয়ান হয়ে যায়। টিকিটের জন্য পেমেন্ট করবার পরে স্ক্রীনটা হাওয়া হয়ে গেল। ল্লেহ! টিকিট কই?
চাপ নিতে নেই, কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখা যাচ্ছে না।
আইডিয়া!
ইমেইল খুলতেই দেখা গেল জাংক ফোল্ডারে দুটি সিরিলিক অ্যালফাবেটে লেখা ইমেইল। ও দুটোই আমাদের ভার্না যাবার টিকিট, দুজনের নাম ছাড়া পুরো টিকিট বলগারিয়ান ভাষার সিরিলিক হরফে।
এখন বোঝা গেল, কেন বাবু টিকিট পড়তে পারে নি?
ঐ একই পদ্ধতি মেনে ভার্না থেকে সোফিয়া ফেরার টিকিট প্রায় কিনেই ফেলছিলাম। ভাগ্যিস কিনিনি!
ভার্নায় এবং সোফিয়ায় কদিন করে থাকবো সেসব ঠিক করা হলো। আগে থাকার ব্যবস্থা হোক, তারপর টিকিট।
আমরা দিন দুয়েকের বেশি থাকলে হোটেলে উঠতে চাই না। তিনবেলা করে বাইরের খাবার খেলে শরীর খারাপ হতে পারে। এয়ার বিএনবি বুক করা হয়ে গেল, তিনদিন সোফিয়া, চারদিন ভার্না, ফের তিন দিন সোফিয়া।
এরপরে আমরা ডিনার করতে গেলাম। দুজনেরই খিদে পেয়েছিল। ভাবলাম খাবার পরে এসে ভার্না টু সোফিয়ার ট্রেনের টিকিটটা কেটে ফেলব। ট্রেনের টিকিট কাটা এত ঝামেলার যে, ... ওদিকে বাবু খাবার বেড়ে দিয়েছে।
টিভি চালিয়ে খাচ্ছি, গমগম করে সিএনএন চ্যানেল চলছে। উরিত্তারা কী সমাপতন! বুলগেরিয়া (ইংরিজিতে ওরকমই ভুল উচ্চারণ, কী আর করা যাবে) দেখাচ্ছে।
আরিব্বাস! কী একটা গুহায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওদের প্রতিনিধি দল। বলছে ওখানে গুহামানবেরা ছবি এঁকেছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে। সেসব ছবিও দেখালো।
বাবু ঝপ করে জায়গাটার নাম টুকে রাখল। থুড়ি জায়গা নয়, গুহার নাম। মাগুরা। মাগুরা কেভ। বলছে এটা প্রাচীনতম কেভ যেটাই গুহামানবেরা নানানরকমের স্কেচ করে গেছে।
কিন্তু জায়গাটা কোনখানে সেসব বলে না।
বাবু তখনই ঠিক করে ফেলেছে মাগুরা গুহায় সে যাবে। তাহলে কি আমরা ভার্না থেকে সোফিয়েতে ফিরব না? কিন্তু এয়ারবিএনবিতো সবকটা পেমেন্ট হয়ে গেল। ঐ দ্যাখো টিংটিং করে মেসেজ ঢুকছে ফোনে, কনফার্মড। সবকটা কনফার্মড। এগুলো এখন ক্যানসেল করে দেবো? একটাতে আবার তিনদিনের কম হলে বুকিং নেয় না।
কিন্তু মাগুরা জায়গাটা কতদূর?
খেয়েদেয়ে আঁচিয়ে ফের মানচিত্রই সম্বল। ওরেবাবা! এ তো দেশের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে, সার্বিয়ার বর্ডারে প্রায়!
সেখানে নিকটবর্তী শহর কোনটা?
ভার্না থেকে ট্রেন যাবে সেদিকে?
কতঘন্টা লাগবে যেতে? রাতের ট্রেন যদি না থাকে তবে পৌঁছব কখন?
গুহায় কেমন করে যেতে হয় রেলস্টেশন থেকে?
ওখানে হোটেল বুক করতে হবে। গুহায় কটা থেকে কটা ঢুকতে দেয় টুরিস্টদের?
সব ছক মিলিয়ে তারপরে তো ট্রেনের টিকিট কাটবো।
আমি একটা কাগজ নিয়ে লিখতে বসি, স্টেপ বাই স্টেপ। পাশে বাবু বসে সব ভেরিফাই করে নিচ্ছে, একে বলে ফোর আই প্রিন্সিপল।